লাভ ডট কম (পর্ব-১৪)

লাভ ডট কম (পর্ব-১৪)
কিছুক্ষণ দাড়িয়ে নিজের হলে চলে গেলো ।
পরদিন ভার্সিটিতে এক উৎসব মুখর পরিবেশ । সবাই চলে যাওয়ার আগে নিজেদের মাঝে শেষ বারের মতো আনন্দ করে নিচ্ছে । রেজাল্ট দিয়ে দিলেও স্টুডেন্ট অফ দ্যা ইয়ার কে হয়েছে তা এখনও জানানো হয় নি । হিসেবে যদিও সাকিবই হওয়ার কথা, কারণ সাকিবের রেজাল্ট সবার চেয়ে ভালো । সবাই বাইরে বেশ মজা করছে, আর সোহান নিজের রুমে বসে গান শুনছে । ইচ্ছে করেই । বাইরে গেলে সবাই আবার রাগ করতে পারে ।
১২টার দিকে মুল অনুষ্ঠান শুরু হবে জানান হয়েছিলো । ভার্সিটি প্রাঙ্গনে ছোট একটা স্টেজ করা হয়েছে । সবাই ভার্সিটির লোগো লাগানো টি-শার্ট গায়ে দিয়ে এসেছে । সোহানও ব্যাতিক্রম নয় । শুধু সবার মজা করার মতো বন্ধু বান্ধব আছে, সোহানের নেই । সোহান অনুষ্ঠানেও হয়তো আসতো না । ইচ্ছে ছিল অনুষ্ঠান শেষ হলে হল থেকে বেড়িয়ে চলে যাবে, কিন্তু আগের দিন হিমেল বলেছে দেখে সোহান এলো অনুষ্ঠানে সবার থেকে খানিকটা দূরে থাকা সত্ত্বেও কিছু ছেলেমেয়ে যারা সোহানের কাছাকাছি ছিল, সোহানকে দেখে সরে গেলো । ওরা সোহানকে দেখে এমন্ন করছে, যেন কোন টোকাই নোংরা হয়ে ওদের কাছে খাবার চাইতে এসেছে । সোহান্ন তবুও সহ্য করতে লাগলো । অনেকের অনেক কথাই সোহানের কানে এলো । কিছু জুনিয়র-ও ছিল । সোহানের ব্যাচের ছেলেমেয়েদের অনেকে জুনিয়রদের সোহানের দিকে ঈশারা করে দেখিয়ে বলছে, “দ্যাখ, দ্যাখ, ওই সেই গে ছেলেটা ।” সোহানের বিরক্ত লাগছিল, কিন্তু তবুও অপেক্ষা করলো হিমেলের । আসেপাশে হিমেলকে খুজল, কিন্তু পেলো না । একটু পর অনুষ্ঠান শুরু হল । নাচ গান আরও কতো কিছু । হিমেলের সাথে দেখা হল না সোহানের । এখন ছাত্রছাত্রীদের ভীরের ভেতরেও তো যেতে পারবে না । সবাই কু-নজর দেবে । অবশেষে অনুষ্ঠানের শেষ হল, এবার ঘোষণা করার পালা স্টুডেন্ট অফ দা ইয়ার কে হয়েছে । আলিয়া ম্যাম স্টেজে উঠলেন, কিছু বক্তব্য রাখলেন, এবং তারপর ঘোষণা করলেন “স্টুডেন্ট অফ দা ইয়ার হয়েছে, সাকিব!” সবাই সাকিবকে উৎসাহ দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো । সাকিব দৌড়ে স্টেজে উঠলো । সার্টিফিকেট আর মাথায় স্কয়ার অ্যাকাডেমিক ক্যাপ পড়ে সুমির দিকে তাকাল । সোহানও হালকা হাসিমুখে উৎসাহ জানালো, কিন্তু মুখে চেঁচিয়ে কিছু বলল না । এরপর একে একে ছাত্রছাত্রীদের এই ভার্সিটিতে পড়ে নিজেদের অনুভুতির কথা প্রকাশের জন্য স্টেজে ডাকা হল । সবাই এলো একে একে । নিলয়, ইকবাল, জেসি, রাইসা, আরও অনেকে । শেষে বাকি শুধু হিমেল, আর সোহান । হিমেল আগে উঠলো । মাউথপিসটা হাতে নিয়ে বলল, “আমি ইচ্ছে করেই আলিয়া ম্যামকে বলেছি আমাকে যেন লাস্টের আগে আর সোহানকে সবার লাস্টে কথা বলার সুযোগ দেয়া হয় যাতে করে আমি আমার একটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ কথা বেশি সময় নিয়ে বলতে পারি ।” সোহান হিমেলের দিকে তাকাল । হিমেল বলতে লাগলো, “আমি এই ভার্সিটিতে সেই শুরু থেকেই একটা মেয়েকে পছন্দ করতাম । সে হল জেসি । অনুষ্ঠানের সবাই জেসির দিকে তাকাল । হিমেল বলল, “কিন্তু একটাই সমস্যা ছিল, জেসি পছন্দ করতো সোহানকে ।” সামনে দাড়িয়ে থাকা সবাই বিরক্ত হয়ে গেলো সোহানের নাম শুনেই । রাইসা ইকবালকে বলল, “এই নামটা শুনলেই আমার গা জ্বলে ।” সোহানও টের পেলো ভীরের মধ্য থেকে কে যেন বলল, “এই ছেলেটাকে শুরুতেই ভার্সিটি থেকে টিসি দিয়ে দিলেই হতো ।” টিসির কথা উঠেছিলো সোহানের, তবে ভার্সিটি দুটো শর্ত দিয়েছিল । তা হল, সোহান যদি ভার্সিটিতে স্বাভাবিক থাকতে পারে, তবেই সোহান এই ভার্সিটিতে থাকতে পারবে । পরবর্তীতে সোহানকে যদি আবার একই কুকর্ম করতে দেখা যায়, তবে টিসির সাথে জরিমানাও হবে । সোহান সেই শর্তে রাজি হয়েছিলো । কিন্তু এখন হিমেল কি বলবে? সোহান একটু ভাবলো, গতকালও তো সোহান হিমেলকে পানি থেকে তোলার পর মুখে মুখ লাগিয়েছিল শ্বাস প্রশ্বাস চালু করবার জন্য, তবে কি এখন! সোহান বেশ বুঝতে পারছে আগের বারের মতো এবারেও ওকে ফাসানো হচ্ছে । হিমেল এরকম গাদ্দারি করলো! এভাবে আসতে বলে অপমান করলো! সোহান সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে সেখান থেকে হলের দিকে ফিরতে লাগলো । হিমেল যখন দেখল সোহান্ন চলে যাচ্ছে, তখন তাড়াতাড়ি কথা বলতে লাগলো হিমেল । সামনে সবাই হিমেলকে বলতে লাগলো “এসব জানোয়ারদের কথা বাদ দে” “গে ও ভাই!” “ভাই ও সিঙ্গেল” “ভাই ভালো মুহূর্তে মুডটা নষ্ট করিস না” । হিমেল কিন্তু ওদের কথা শুনলো না আদৌ । হিমেল সোহান প্রায় জায়গাটা থেকে অনেক দুর চলে এসেছে । হিমেল বলতে যতো দ্রুত সম্ভব বলতে লাগলো, “আমরা সবাই জানি এই সোহানের কিছু ছবি কেউ একজন ফেসবুকে আমাদের ভার্সিটির গ্রুপে ছড়িয়ে দিয়েছে, আমাদের ভার্সিটিতে ওকে নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, আর আজকে আমি আপনাদের সব সত্যি কথা বলবো, আসল কথা হচ্ছে ওই ছবিগুলো আমিই ছড়িয়েছিলাম ।” সোহান সামনে পা রাখতে গিয়ে দাড়িয়ে গেলো । সামনে থাকা ছাত্রছাত্রীদের কোলাহলও থেমে গেলো । পুরো পরিবেশ যেন নিমিষেই নিস্থব্ধ হয়ে গেলো । সোহান সানগ্লাস খুলে পেছন ফিরে তাকাল । আলিয়া ম্যাম উঠে দাড়িয়ে বলল, “এসব কি বলছ হিমেল!” হিমেল বলল, “জি ম্যাম । আসল ঘটনা হল আমি জেসিকে পছন্দ করতাম । কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জেসি সোহানকে পছন্দ করতো । তাই আমি সবসময় সোহানকে জেসির সামনে এমনভাবে হাজির করতে চাইতাম, যেন জেসি সোহানকে পছন্দ না করে । একদিন সোহানদের হলের সামনে দিয়ে আসবার সময় দেখলাম মেঝেতে ইকবালের দুপাশে হাঁটু গেড়ে বসে ইকবালের সাথে মারামারি করছে সোহান, তখনই আমার মাথায় আসে সোহানকে গে বানানো প্ল্যান ।” সামনে দাড়িয়ে সাকিবের তখন সেদিনের কথা মনে পড়ে গেলো । সেইদিন সুমির সাথে কথা বলার সময় ও হিমেলকে দেখেছিলো । হিমেল বলতে লাগলো, “এরপর আমি সোহানকে ফলো করা শুরু করি, যদি এরকম আরও কোন মুহূর্ত পাই । ফের আমি ওর ওকে ইকবালের সাথে দেখি । পুকুর পাড়ে । একে সোহান সবাইকে বলতো ও সিঙ্গেল, তার ওপর ও সবাইকে বলতো মেয়েদের প্রতি ওর ইন্টারেস্ট নেই, তার ওপর ও ইকবালকে যেখানে পুকুর থেকে তুলে রেখেছিল, সেখানে বসে ছেলেমেয়েরা প্রেম করে । তাই সবটা মানুষকে বিশ্বাস করানো আমার জন্য ব্যাপারই ছিল না । আমি শুরু থেকে ভার্সিটির ছাত্র পরিচয়ে একটা ফেইক আইডি চালাতাম, সেখানে আলিয়া ম্যামও আমার ফ্রেন্ড । তখন আমি-ই আলিয়া ম্যামকে ছবিগুলো পাঠাই । তাহলে সবাই বুঝুন, ম্যাম যদি সবটা সবাইকে বলে, তবে কে বিশ্বাস করবে না?” এর মধ্যে সোহান ধীরে ধীরে হিমেলের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্টেজের কাছাকাছি চলে এসেছে । হিমেল একবার সোহানের দিকে তাকাল । তারপর বলল, “গতকাল এই ছেলেটা আমাকে বাঁচিয়েছিল । এমনিতেও এই কাজ করার পর আমার অনেক গিল্ট ফিল হতো । গতকাল সেই সীমা যেন ছাড়িয়ে গিয়েছিলো । তাই আমি সবার সামনে সোহানের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য এখানে সোহানকে ডেকেছি । না হলে হয়তো ও আসতো না । সব ছাত্রছাত্রী সোহানের দিকে তাকাল । ভীরের মধ্য থেকে ঊর্মিও । ওর নতুন বয়ফ্রেন্ড হিমু বলল, “ঊর্মি! তুমি কি এখন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?” ঊর্মি কোন জবাব দিলো না । ও সোহানের দিকেই তাকিয়ে । হিমেল সোহানকে বলল, “দোস্ত, একটু স্টেজে আসবি?” সোহান কিছু বলল না । আলিয়া ম্যাম তখন স্টেজ থেকে নেমে সোহানের হাত ধরে বলল, “তুমি আমার ছেলের মতো, এই এতগুলো বছর একটা মিথ্যে অপরাধে তুমি অনেক কষ্ট সহ্য করেছো । আমি এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী, আমাকে ক্ষমা করে দাও!”
- “না ম্যাম! এসব কি বলছেন, আপনি তো আর ইচ্ছে করে এসব করেন নি ।” জবাব দিলো সোহান । কিন্তু এখনও ওর চেহারা থেকে অবাক দৃষ্টি সরে নি । আলিয়া ম্যাম জোর করে সোহানকে স্টেজে নিয়ে গেলেন । সোহান হিমেলের কাছে আসতেই হিমেল সোহানের হাতে মাউথপিসটা দিয়ে বলল, “সবার উদ্দেশ্যে কিছু বল ।” সোহান যেই না মাউথপিসটা হাতে নিলো, অমনি হিমেল বসে সোহানের পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দে দোস্ত! আমাকে ক্ষমা করে দে!” সোহান অনেক কষ্টে হিমেলকে দাঁড় করাল । তারপর হিমেলকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এভাবে বলিস না । ভুল সবারই হয় । শান্ত হ ।” কিছুক্ষনের মধ্যে হিমেল শান্ত হয়ে দাঁড়ালো । সোহান মাউথপিস নিয়ে সামনে তাকাল । এতো বছর পর সোহান সবার সামনে দাঁড়ালো । একবার সবার দিকে চোখ বোলাল । সাকিব, ইকবাল, সুমি, রাইসা, ঊর্মি, হিমু, নিলয়, জেসি অন্যান্য সবার দিকে । সবাই সোহানের দিকে তাকিয়ে । তারপর ঠোঁটের কোণে একটা হাসি আনবার চেষ্টা করে বলল, “প্রতিটা মানুষের জীবনে কিছু স্পেশাল মুহূর্ত থাকে । আমার জন্য আজ হয়তো সেই স্পেশাল মুহূর্ত । আমি হিমেলকে থ্যাংকস জানাবো । ও এসব না করলে আমি আসলে ভালোবাসার আসল মানেটা বুঝতেই পারতাম না । বিশ্বাস জিনিসটা যে কতো সেনসিটিভ, তা আমি আজ বুঝলাম । ছোটবেলা থেকেই আমি গল্প লিখতে পছন্দ করতাম, কিন্তু আমার একটা গল্পও গল্প হতো না । আজ আমার জীবনটাই যেন একটা গল্প হয়ে গেলো ।” বলতে বলতে সোহান থেমে গেলো । তারপর সোহান বলল, “আমি জানি, সবাই ইচ্ছে করে কিছু করে নি, তাই আমি আজও সবাইকে অনেক ভালোবাসি । কিন্তু আমি নতুন করে কিছু শুরু করতে রাজি নই । কেউ একজন আমাকে বলেছিল, মানুষের মধ্যে এখন বিশ্বাস কেমন জানি । হাজারটা মানুষ যদি বলে সূর্য পশ্চিমে ওঠে, তাহলেও মানুষ বলে সেটাই সঠিক । একজন যতোই সত্য কথা বলুক, কেউ বিশ্বাস করে না । আর তাদের মধ্যে যদি সবচেয়ে কাছের মানুষও থাকে, তাহলে বলা যায় ওই আপন মানুষের ভালবাসায় কমতি ছিল ।” শেষ কথাটা বলার সময় সোহান ঊর্মির দিকে তাকাল । তারপর স্টেজ থেকে সোহান নিজের হলে চলে আসে । ঊর্মি, সাকিব আর ইকবাল বোধ হয় আসতে চেয়েছিল, কিন্তু ভীরের মধ্য থেকে বের হয়ে আসা সে সময় অসম্ভবই বটে ।
১টার দিকে লাঞ্চ ব্রেকে ভীর ছড়িয়ে পড়লে সাকিব আর সুমি, ইকবাল আর রাইসা, ঊর্মি আর হিমু এবং নিলয় আসে সোহানের হলে । ছেলেদের হলে মেয়েদের আসা নিষেধ থাকলেও আজ শেষ দিন সে নিষেধ অমান্য করলে তেমন কিছুই হবে না । সাকিব হলের দরজা খুলে দেখল, ভেতরে সোহান নেই । সোহানের জিনিসপত্রও নেই । পাশ দিয়েই তখন হলের কেয়ারটেকার যাচ্ছিলেন, ইকবাল জিজ্ঞেস করলো, “মামা, সোহান কথায়?” কেয়ারটেকার আঙ্কেল বলল, “ও তো মিনিট পনেরো আগে চইলা গেলো, কইলো ১টায় ট্রেন ।” সাকিব মাথায় হাত দিয়ে “শিট!” বলে উঠলো । ঊর্মি প্রায় কেঁদেই ফেলল । কেয়ারটেকার আঙ্কেল বলল, “তোমরা কি ওর কাছে মাফ চাইতে আইছো?” ইকবাল লজ্জার সাথে বলল, “জি । ওকে আমরা সেদিনের পর ব্লক করে রেখেছিলাম । এখন দেখি ও নিজেও আমাদের ব্লক করে রেখেছে ।”
- “একটা কাম করতে পারো ।” কেয়ারটেকার আঙ্কেল কথা শুনে সবাই কেয়ারটেকার আঙ্কেলের দিকে তাকাল ।
ইকবাল জিজ্ঞেস করলো, “কি?”
- “বাংলাদেশের ট্রেনতো কখনোই টাইম মতো থামে না, এইখান থেইকা স্টেশন যাইতে ৫-১০ মিনিট লাগবো, তোমরা যাইয়া খোঁজ করতে পারো ।” বলল কেয়ারটেকার আঙ্কেল । রাইসা ইকবালকে বলল, “বাবু, বাদ দাও, যা হওয়ার হয়েছে ।” সুমি সাকিবকে বলল, “হ্যাঁ জান, ও তো বলেছেই, ও তোমাদের ভালোবাসে এখনও, তাহলে নিশ্চয় তোমাদের ক্ষমাও করে দিয়েছে ।” হিমু ঊর্মিকে বলল, “কাম ওন বেবি, ওদিকে সবাই মজা করছে, চলো যাই ।” নিলয় নিজে ভাবছে । কি করবে? এমন সময় ঘটলো এক ঘটনা । সাকিব হঠাৎ সুমিকে একটা চড় মেরে “হেইট ইউ!” বলে চলে গেলো । এটা দেখে রাইসা ইকবালকে বলল, “বাবু দেখছো! তোমার বন্ধু কি খা……” কথা শেষ করার আগেই ইকবাল রাইসাকে চড় মেরে বলল, “আই অলসো হেইট ইউ ।” বলে ইকবালও বেড়িয়ে গেলো । হিমু কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই ঊর্মি হিমুর গালে একটা চড় মেরে বলল, “নেভার থট দ্যাট আই এম ইওর গার্লফ্রেন্ড । হেইট ইউ আ লট!” বলে ঊর্মিও চলে গেলো সেখান থেকে । নিলয়ের সাথেতো আর কেউ নাই, নিজেই নিজের গালে চড় মেরে বলল, “আমারও যাওয়া উচিৎ!” এরপর সেও সেখান থেকে চলে এলো । বেচারা সুমি, রাইসা আর হিমু হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইল ।
স্টেশনে ওরা পৌঁছতেই দেখল, ট্রেন দাড়িয়ে । নিলয় কাউকে জিজ্ঞেস করলো, “ভাই এটা কয়টার ট্রেন?” লোকটা জবাব দিলো, “একটার ট্রেন ভাই, ছাড়তে দেরী হইছে । এরপর সবাই বাইরে থেকে ট্রেনের শেষ মাথা থেকে শুরু করলো জানালার বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে সোহানকে খোঁজা । শেষ বগিতে নেই, তার আগের বগিতেও নেই । যতো দ্রুত সম্ভব ওরা খোঁজা শুরু করলো । কারণ এপাশ শেষ হলে ওপাশের জানালাতেও খুঁজতে হবে । কিন্তু প্রায় মাঝামাঝি বগিগুলোর কাছাকাছি আসতেই ট্রেন ছাড়া শুরু করলো । ইকবাল সাকিবকে বলল, “ভাই তুই সামনে থেকে দ্যাখ!” এমন সময় ঊর্মির চোখে পড়ল বস্তির কয়েকটা লোক কাকে যেন জানালা দিয়ে বিদায় জানাচ্ছে । সোহান যে কিছু বস্তির বাচ্চাকে এতদিন পড়িয়েছে, সেটা জানে ঊর্মি । প্রায় চতুর্থ বগির সামনে ছেলেগুলো দাঁড়ানো । তবে এগুলোই সেই বস্তির ছেলে কি না তা জানা নেই ঊর্মির । এমন সময় জানালা দিয়ে কেউ হাত বের করে বস্তির ছেলেমেয়েগুলোকে টাটা জানালো । হাতের ঘড়িটা দেখল ঊর্মি, হ্যাঁ, এটাই তো সকালে সোহান পড়ে এসেছিলো স্টেজে । ঊর্মি বলে উঠলো, “ওইতো সোহান!” ব্বলে ঊর্মি দিলো এক দৌড় । সাথে সাকিব ইকবাল আর নিলয়ও । এক দৌড়ে ওরা জানালার কাছাকাছি চলে এলো । ঊর্মি জানালায় হাত রেখে বলল, “সোহান! সরি সোহান! আই লাভ ইউ সোহান!” সোহান চমকে জানালার দিয়ে বাইরে তাকাল । দেখল, সাকিব, ইকবাল আর নিলয়ও আছে ।
- “দোস্ত! মাফ কইরা দিস!” বলল নিলয় ।
- “ভাই! তোর যা হইছে আমার জন্য, আমাকে মাফ কইরা দিস ভাই! প্লিজ! ভুল বুঝিস না!” বলল ইকবাল ।
- “ভাই! আমারেও মাফ কইরা দিস! তুই যদি ট্রেনে না থাকতি! আমি সত্যি তোর পা ধইরা মাফ চাইতাম!” ধীরে ধীরে ট্রেনের গতি অনেক বেড়ে গেছে । ঊর্মি হঠাৎ করে পা মচকে পড়ে গেলো । যেহেতু ঊর্মিই সবার সামনে ছিল, তাই ঊর্মিকে টপকে আর দৌড়োতে পারলো না । ট্রেন চলতে লাগলো । সবাই সামনের দিকে তাকাল । সোহান জানালা থেকে মাথা বের করে সবার দিকে একটা ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিয়ে হাত লাভ আকৃতির করে দেখাল । সবাই খুব খুশি হল । তবে সোহান কিন্তু সবার সাথে নতুন করে আর বন্ধুত্ব করলো না । সেই যে ব্লক করে রেখেছিল, সেই ব্লক করেই রেখে দিলো ।
১ বছর পরের কথা । শীতের ছুটিতে বাড়ি এসেছে সোহান । আপাতত বেকার জীবন পার করছে, চাকরীর সন্ধানে আছে । বাড়ি থেকে বেরিয়েছে মোটরসাইকেলটা একটু মেরামত করার জন্য । গ্যারেজে মোটরসাইকেলটা রেখে দোকানদারের সাথে গল্প করছিলো ।
- “কিরে! হল তোর?”
- “মামা, ৩ মিনিট খারান!” বলল দোকানদার এমন সময় মেয়ে কণ্ঠে কেউ সোহানের পেছনে দাড়িয়ে বলল, “ভাই এখানে সোহান নামে একটা ছেলে কোথায় থাকে বলতে পারেন?” সোহান পেছন ফিরে তাকাল । ঊর্মি না!” এই ১ বছরে বেশ শুকিয়ে গেছে । ঊর্মি সোহানকে দেখেই চিনতে পেরে সোহানকে জড়িয়ে ধরল । তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল, “গত ১টা বছর ভার্সিটির রেজিস্টার খাতা থেকে তোমার ঠিকানা অনেক কষ্টে জোগাড় করে এসেছি । তুমি কেন এখনও আমাকে আন ব্লক করনি?”সোহান দোকানদারের দিকে তাকাল । সে চোখ ঢেকে বলল, “মামা আমি কিছু দেখি নাই ।”
দোকানের সামনের একটা খোলা মাঠ । মাঠে পাশেই পুকুর । সেই পুকুর পাড়ে দুজনে বসে পড়ল ।
- “সাকিব আর ইকবালের কি অবস্থা?” জিজ্ঞেস করলো সোহান ।
- “হ্যাঁ ভালো । ওরা রাইসা আর সুমিকে ছ্যাকা দিয়েছে, এখন সাকিব কানাডায় গেছে আরও পড়াশুনা করার জন্য । আর ইকবাল ভার্সিটিতেই প্রফেসর হিসেবে জয়েন করেছে ।” বলল ঊর্মি ।
- “ও । আর তোমার হিমু?”
- “ওর কথা ভাবি না আর । ও একটা বেয়াদব । এখন আরেকজনকে ধরেছে । শুনেছি এর আগে আরও অনেকের সাথেও ছিল ।”
- “ও । হিমেল আর নিলয়?” জিজ্ঞেস করলো সোহান ।
- “হিমেলের সাথে যোগাযোগ হয় না, নিলয়ও কানাডা গিয়েছে ।” সোহান একটু নড়েচড়ে বসলো । তারপর বলল, “তুমি ?”
- “কিছুই না । এখন তোমার মতোই বেকার বসে আছি । বাবা বিয়ের কথা তুলেছিলেন, কিন্তু আমি রাজি হই নি ।”
সোহান কিছু বলল না । ঊর্মি বলল, “তুমি কাউকে আনব্লক করোনি কেন? সবাই তোমার কথা কতো ভাবে জানো?” সোহান ঊর্মির দিকে তাকাল । এমন সময় পেছন থেকে ড্রাইভার ডেকে উঠলো, “সোহান ভাই! হইয়া গেছে!” সোহান বলল, “আসছি!” তারপর ঊর্মির দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো যাই?”
- “কোথায় যাবো?” প্রশ্ন করলো ঊর্মি ।
- “আমার বাড়িতে আজ বিয়ের অনুষ্ঠান । দাওয়াত খেয়ে যাও ।”
ঊর্মি হেসে বলল, “নিশ্চয় তোমার না, তোমার বড় ভাই বা বোনের………” থেমে যেয়ে ঊর্মি মুখ গোমড়া করে বলল, “তুমি তো বলেছিলে তোমার শুধু একটা ছোট ভাই আছে!” সোহান তখন হেসে দিলো । বলল, “আমার কাজিনের বিয়ে । আমরা জয়েন ফ্যামিলি ।” ঊর্মি একটা শ্বাস ফেলে বলল, “উফ! কি যে ভয় পেয়েছিলাম!” সোহান বলল, “কিন্তু আমি যে বেকার! তোমার বাবা মেনে নেবেন?” ঊর্মি বলল, “তা কেন, আমি বসে থাকবো, তুমি চাকরি পাবে, আর আমাকে বলবে, চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি ঊর্মি শুনছো, এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না!” বলেই দুজনেই খিল খিল করে হেসে উঠলো । সোহান মোটর সাইকেলে উঠলো, ঊর্মি সোহানের পিছে । আয়নায় সোহান ঊর্মিকে দেখল একটিবার । তারপর আসতে লাগলো বাসার পথে । ঊর্মি তখন বলল, “তুমি তো জবাব দিলে না, কেন সবাইকে আনব্লক করো নি?”
- “এমনি ।” জবাব দিলো সোহান ।
- “তা বললে হয়? সবাই তোমার কথা কতো ভাবে তুমি জানো?” বলল ঊর্মি ।
- “মনে হয় আমি ভাবি না? তোমাদের কথা মনে রাখতে আমি একটা উপন্যাসও লিখেছি । সামনের বই মেলায় ভাবছি ছাপাবো ।” বলল সোহান ।
- “ওমা তাই! কি উপন্যাস?” খুশি মনে প্রশ্ন করলো ঊর্মি ।
সোহান জবাব দিলো, “লাভ ডট কম ।”
(সমাপ্ত)
পরদিন ভার্সিটিতে এক উৎসব মুখর পরিবেশ । সবাই চলে যাওয়ার আগে নিজেদের মাঝে শেষ বারের মতো আনন্দ করে নিচ্ছে । রেজাল্ট দিয়ে দিলেও স্টুডেন্ট অফ দ্যা ইয়ার কে হয়েছে তা এখনও জানানো হয় নি । হিসেবে যদিও সাকিবই হওয়ার কথা, কারণ সাকিবের রেজাল্ট সবার চেয়ে ভালো । সবাই বাইরে বেশ মজা করছে, আর সোহান নিজের রুমে বসে গান শুনছে । ইচ্ছে করেই । বাইরে গেলে সবাই আবার রাগ করতে পারে ।
১২টার দিকে মুল অনুষ্ঠান শুরু হবে জানান হয়েছিলো । ভার্সিটি প্রাঙ্গনে ছোট একটা স্টেজ করা হয়েছে । সবাই ভার্সিটির লোগো লাগানো টি-শার্ট গায়ে দিয়ে এসেছে । সোহানও ব্যাতিক্রম নয় । শুধু সবার মজা করার মতো বন্ধু বান্ধব আছে, সোহানের নেই । সোহান অনুষ্ঠানেও হয়তো আসতো না । ইচ্ছে ছিল অনুষ্ঠান শেষ হলে হল থেকে বেড়িয়ে চলে যাবে, কিন্তু আগের দিন হিমেল বলেছে দেখে সোহান এলো অনুষ্ঠানে সবার থেকে খানিকটা দূরে থাকা সত্ত্বেও কিছু ছেলেমেয়ে যারা সোহানের কাছাকাছি ছিল, সোহানকে দেখে সরে গেলো । ওরা সোহানকে দেখে এমন্ন করছে, যেন কোন টোকাই নোংরা হয়ে ওদের কাছে খাবার চাইতে এসেছে । সোহান্ন তবুও সহ্য করতে লাগলো । অনেকের অনেক কথাই সোহানের কানে এলো । কিছু জুনিয়র-ও ছিল । সোহানের ব্যাচের ছেলেমেয়েদের অনেকে জুনিয়রদের সোহানের দিকে ঈশারা করে দেখিয়ে বলছে, “দ্যাখ, দ্যাখ, ওই সেই গে ছেলেটা ।” সোহানের বিরক্ত লাগছিল, কিন্তু তবুও অপেক্ষা করলো হিমেলের । আসেপাশে হিমেলকে খুজল, কিন্তু পেলো না । একটু পর অনুষ্ঠান শুরু হল । নাচ গান আরও কতো কিছু । হিমেলের সাথে দেখা হল না সোহানের । এখন ছাত্রছাত্রীদের ভীরের ভেতরেও তো যেতে পারবে না । সবাই কু-নজর দেবে । অবশেষে অনুষ্ঠানের শেষ হল, এবার ঘোষণা করার পালা স্টুডেন্ট অফ দা ইয়ার কে হয়েছে । আলিয়া ম্যাম স্টেজে উঠলেন, কিছু বক্তব্য রাখলেন, এবং তারপর ঘোষণা করলেন “স্টুডেন্ট অফ দা ইয়ার হয়েছে, সাকিব!” সবাই সাকিবকে উৎসাহ দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো । সাকিব দৌড়ে স্টেজে উঠলো । সার্টিফিকেট আর মাথায় স্কয়ার অ্যাকাডেমিক ক্যাপ পড়ে সুমির দিকে তাকাল । সোহানও হালকা হাসিমুখে উৎসাহ জানালো, কিন্তু মুখে চেঁচিয়ে কিছু বলল না । এরপর একে একে ছাত্রছাত্রীদের এই ভার্সিটিতে পড়ে নিজেদের অনুভুতির কথা প্রকাশের জন্য স্টেজে ডাকা হল । সবাই এলো একে একে । নিলয়, ইকবাল, জেসি, রাইসা, আরও অনেকে । শেষে বাকি শুধু হিমেল, আর সোহান । হিমেল আগে উঠলো । মাউথপিসটা হাতে নিয়ে বলল, “আমি ইচ্ছে করেই আলিয়া ম্যামকে বলেছি আমাকে যেন লাস্টের আগে আর সোহানকে সবার লাস্টে কথা বলার সুযোগ দেয়া হয় যাতে করে আমি আমার একটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ কথা বেশি সময় নিয়ে বলতে পারি ।” সোহান হিমেলের দিকে তাকাল । হিমেল বলতে লাগলো, “আমি এই ভার্সিটিতে সেই শুরু থেকেই একটা মেয়েকে পছন্দ করতাম । সে হল জেসি । অনুষ্ঠানের সবাই জেসির দিকে তাকাল । হিমেল বলল, “কিন্তু একটাই সমস্যা ছিল, জেসি পছন্দ করতো সোহানকে ।” সামনে দাড়িয়ে থাকা সবাই বিরক্ত হয়ে গেলো সোহানের নাম শুনেই । রাইসা ইকবালকে বলল, “এই নামটা শুনলেই আমার গা জ্বলে ।” সোহানও টের পেলো ভীরের মধ্য থেকে কে যেন বলল, “এই ছেলেটাকে শুরুতেই ভার্সিটি থেকে টিসি দিয়ে দিলেই হতো ।” টিসির কথা উঠেছিলো সোহানের, তবে ভার্সিটি দুটো শর্ত দিয়েছিল । তা হল, সোহান যদি ভার্সিটিতে স্বাভাবিক থাকতে পারে, তবেই সোহান এই ভার্সিটিতে থাকতে পারবে । পরবর্তীতে সোহানকে যদি আবার একই কুকর্ম করতে দেখা যায়, তবে টিসির সাথে জরিমানাও হবে । সোহান সেই শর্তে রাজি হয়েছিলো । কিন্তু এখন হিমেল কি বলবে? সোহান একটু ভাবলো, গতকালও তো সোহান হিমেলকে পানি থেকে তোলার পর মুখে মুখ লাগিয়েছিল শ্বাস প্রশ্বাস চালু করবার জন্য, তবে কি এখন! সোহান বেশ বুঝতে পারছে আগের বারের মতো এবারেও ওকে ফাসানো হচ্ছে । হিমেল এরকম গাদ্দারি করলো! এভাবে আসতে বলে অপমান করলো! সোহান সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে সেখান থেকে হলের দিকে ফিরতে লাগলো । হিমেল যখন দেখল সোহান্ন চলে যাচ্ছে, তখন তাড়াতাড়ি কথা বলতে লাগলো হিমেল । সামনে সবাই হিমেলকে বলতে লাগলো “এসব জানোয়ারদের কথা বাদ দে” “গে ও ভাই!” “ভাই ও সিঙ্গেল” “ভাই ভালো মুহূর্তে মুডটা নষ্ট করিস না” । হিমেল কিন্তু ওদের কথা শুনলো না আদৌ । হিমেল সোহান প্রায় জায়গাটা থেকে অনেক দুর চলে এসেছে । হিমেল বলতে যতো দ্রুত সম্ভব বলতে লাগলো, “আমরা সবাই জানি এই সোহানের কিছু ছবি কেউ একজন ফেসবুকে আমাদের ভার্সিটির গ্রুপে ছড়িয়ে দিয়েছে, আমাদের ভার্সিটিতে ওকে নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, আর আজকে আমি আপনাদের সব সত্যি কথা বলবো, আসল কথা হচ্ছে ওই ছবিগুলো আমিই ছড়িয়েছিলাম ।” সোহান সামনে পা রাখতে গিয়ে দাড়িয়ে গেলো । সামনে থাকা ছাত্রছাত্রীদের কোলাহলও থেমে গেলো । পুরো পরিবেশ যেন নিমিষেই নিস্থব্ধ হয়ে গেলো । সোহান সানগ্লাস খুলে পেছন ফিরে তাকাল । আলিয়া ম্যাম উঠে দাড়িয়ে বলল, “এসব কি বলছ হিমেল!” হিমেল বলল, “জি ম্যাম । আসল ঘটনা হল আমি জেসিকে পছন্দ করতাম । কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জেসি সোহানকে পছন্দ করতো । তাই আমি সবসময় সোহানকে জেসির সামনে এমনভাবে হাজির করতে চাইতাম, যেন জেসি সোহানকে পছন্দ না করে । একদিন সোহানদের হলের সামনে দিয়ে আসবার সময় দেখলাম মেঝেতে ইকবালের দুপাশে হাঁটু গেড়ে বসে ইকবালের সাথে মারামারি করছে সোহান, তখনই আমার মাথায় আসে সোহানকে গে বানানো প্ল্যান ।” সামনে দাড়িয়ে সাকিবের তখন সেদিনের কথা মনে পড়ে গেলো । সেইদিন সুমির সাথে কথা বলার সময় ও হিমেলকে দেখেছিলো । হিমেল বলতে লাগলো, “এরপর আমি সোহানকে ফলো করা শুরু করি, যদি এরকম আরও কোন মুহূর্ত পাই । ফের আমি ওর ওকে ইকবালের সাথে দেখি । পুকুর পাড়ে । একে সোহান সবাইকে বলতো ও সিঙ্গেল, তার ওপর ও সবাইকে বলতো মেয়েদের প্রতি ওর ইন্টারেস্ট নেই, তার ওপর ও ইকবালকে যেখানে পুকুর থেকে তুলে রেখেছিল, সেখানে বসে ছেলেমেয়েরা প্রেম করে । তাই সবটা মানুষকে বিশ্বাস করানো আমার জন্য ব্যাপারই ছিল না । আমি শুরু থেকে ভার্সিটির ছাত্র পরিচয়ে একটা ফেইক আইডি চালাতাম, সেখানে আলিয়া ম্যামও আমার ফ্রেন্ড । তখন আমি-ই আলিয়া ম্যামকে ছবিগুলো পাঠাই । তাহলে সবাই বুঝুন, ম্যাম যদি সবটা সবাইকে বলে, তবে কে বিশ্বাস করবে না?” এর মধ্যে সোহান ধীরে ধীরে হিমেলের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্টেজের কাছাকাছি চলে এসেছে । হিমেল একবার সোহানের দিকে তাকাল । তারপর বলল, “গতকাল এই ছেলেটা আমাকে বাঁচিয়েছিল । এমনিতেও এই কাজ করার পর আমার অনেক গিল্ট ফিল হতো । গতকাল সেই সীমা যেন ছাড়িয়ে গিয়েছিলো । তাই আমি সবার সামনে সোহানের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য এখানে সোহানকে ডেকেছি । না হলে হয়তো ও আসতো না । সব ছাত্রছাত্রী সোহানের দিকে তাকাল । ভীরের মধ্য থেকে ঊর্মিও । ওর নতুন বয়ফ্রেন্ড হিমু বলল, “ঊর্মি! তুমি কি এখন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?” ঊর্মি কোন জবাব দিলো না । ও সোহানের দিকেই তাকিয়ে । হিমেল সোহানকে বলল, “দোস্ত, একটু স্টেজে আসবি?” সোহান কিছু বলল না । আলিয়া ম্যাম তখন স্টেজ থেকে নেমে সোহানের হাত ধরে বলল, “তুমি আমার ছেলের মতো, এই এতগুলো বছর একটা মিথ্যে অপরাধে তুমি অনেক কষ্ট সহ্য করেছো । আমি এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী, আমাকে ক্ষমা করে দাও!”
- “না ম্যাম! এসব কি বলছেন, আপনি তো আর ইচ্ছে করে এসব করেন নি ।” জবাব দিলো সোহান । কিন্তু এখনও ওর চেহারা থেকে অবাক দৃষ্টি সরে নি । আলিয়া ম্যাম জোর করে সোহানকে স্টেজে নিয়ে গেলেন । সোহান হিমেলের কাছে আসতেই হিমেল সোহানের হাতে মাউথপিসটা দিয়ে বলল, “সবার উদ্দেশ্যে কিছু বল ।” সোহান যেই না মাউথপিসটা হাতে নিলো, অমনি হিমেল বসে সোহানের পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দে দোস্ত! আমাকে ক্ষমা করে দে!” সোহান অনেক কষ্টে হিমেলকে দাঁড় করাল । তারপর হিমেলকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এভাবে বলিস না । ভুল সবারই হয় । শান্ত হ ।” কিছুক্ষনের মধ্যে হিমেল শান্ত হয়ে দাঁড়ালো । সোহান মাউথপিস নিয়ে সামনে তাকাল । এতো বছর পর সোহান সবার সামনে দাঁড়ালো । একবার সবার দিকে চোখ বোলাল । সাকিব, ইকবাল, সুমি, রাইসা, ঊর্মি, হিমু, নিলয়, জেসি অন্যান্য সবার দিকে । সবাই সোহানের দিকে তাকিয়ে । তারপর ঠোঁটের কোণে একটা হাসি আনবার চেষ্টা করে বলল, “প্রতিটা মানুষের জীবনে কিছু স্পেশাল মুহূর্ত থাকে । আমার জন্য আজ হয়তো সেই স্পেশাল মুহূর্ত । আমি হিমেলকে থ্যাংকস জানাবো । ও এসব না করলে আমি আসলে ভালোবাসার আসল মানেটা বুঝতেই পারতাম না । বিশ্বাস জিনিসটা যে কতো সেনসিটিভ, তা আমি আজ বুঝলাম । ছোটবেলা থেকেই আমি গল্প লিখতে পছন্দ করতাম, কিন্তু আমার একটা গল্পও গল্প হতো না । আজ আমার জীবনটাই যেন একটা গল্প হয়ে গেলো ।” বলতে বলতে সোহান থেমে গেলো । তারপর সোহান বলল, “আমি জানি, সবাই ইচ্ছে করে কিছু করে নি, তাই আমি আজও সবাইকে অনেক ভালোবাসি । কিন্তু আমি নতুন করে কিছু শুরু করতে রাজি নই । কেউ একজন আমাকে বলেছিল, মানুষের মধ্যে এখন বিশ্বাস কেমন জানি । হাজারটা মানুষ যদি বলে সূর্য পশ্চিমে ওঠে, তাহলেও মানুষ বলে সেটাই সঠিক । একজন যতোই সত্য কথা বলুক, কেউ বিশ্বাস করে না । আর তাদের মধ্যে যদি সবচেয়ে কাছের মানুষও থাকে, তাহলে বলা যায় ওই আপন মানুষের ভালবাসায় কমতি ছিল ।” শেষ কথাটা বলার সময় সোহান ঊর্মির দিকে তাকাল । তারপর স্টেজ থেকে সোহান নিজের হলে চলে আসে । ঊর্মি, সাকিব আর ইকবাল বোধ হয় আসতে চেয়েছিল, কিন্তু ভীরের মধ্য থেকে বের হয়ে আসা সে সময় অসম্ভবই বটে ।
১টার দিকে লাঞ্চ ব্রেকে ভীর ছড়িয়ে পড়লে সাকিব আর সুমি, ইকবাল আর রাইসা, ঊর্মি আর হিমু এবং নিলয় আসে সোহানের হলে । ছেলেদের হলে মেয়েদের আসা নিষেধ থাকলেও আজ শেষ দিন সে নিষেধ অমান্য করলে তেমন কিছুই হবে না । সাকিব হলের দরজা খুলে দেখল, ভেতরে সোহান নেই । সোহানের জিনিসপত্রও নেই । পাশ দিয়েই তখন হলের কেয়ারটেকার যাচ্ছিলেন, ইকবাল জিজ্ঞেস করলো, “মামা, সোহান কথায়?” কেয়ারটেকার আঙ্কেল বলল, “ও তো মিনিট পনেরো আগে চইলা গেলো, কইলো ১টায় ট্রেন ।” সাকিব মাথায় হাত দিয়ে “শিট!” বলে উঠলো । ঊর্মি প্রায় কেঁদেই ফেলল । কেয়ারটেকার আঙ্কেল বলল, “তোমরা কি ওর কাছে মাফ চাইতে আইছো?” ইকবাল লজ্জার সাথে বলল, “জি । ওকে আমরা সেদিনের পর ব্লক করে রেখেছিলাম । এখন দেখি ও নিজেও আমাদের ব্লক করে রেখেছে ।”
- “একটা কাম করতে পারো ।” কেয়ারটেকার আঙ্কেল কথা শুনে সবাই কেয়ারটেকার আঙ্কেলের দিকে তাকাল ।
ইকবাল জিজ্ঞেস করলো, “কি?”
- “বাংলাদেশের ট্রেনতো কখনোই টাইম মতো থামে না, এইখান থেইকা স্টেশন যাইতে ৫-১০ মিনিট লাগবো, তোমরা যাইয়া খোঁজ করতে পারো ।” বলল কেয়ারটেকার আঙ্কেল । রাইসা ইকবালকে বলল, “বাবু, বাদ দাও, যা হওয়ার হয়েছে ।” সুমি সাকিবকে বলল, “হ্যাঁ জান, ও তো বলেছেই, ও তোমাদের ভালোবাসে এখনও, তাহলে নিশ্চয় তোমাদের ক্ষমাও করে দিয়েছে ।” হিমু ঊর্মিকে বলল, “কাম ওন বেবি, ওদিকে সবাই মজা করছে, চলো যাই ।” নিলয় নিজে ভাবছে । কি করবে? এমন সময় ঘটলো এক ঘটনা । সাকিব হঠাৎ সুমিকে একটা চড় মেরে “হেইট ইউ!” বলে চলে গেলো । এটা দেখে রাইসা ইকবালকে বলল, “বাবু দেখছো! তোমার বন্ধু কি খা……” কথা শেষ করার আগেই ইকবাল রাইসাকে চড় মেরে বলল, “আই অলসো হেইট ইউ ।” বলে ইকবালও বেড়িয়ে গেলো । হিমু কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই ঊর্মি হিমুর গালে একটা চড় মেরে বলল, “নেভার থট দ্যাট আই এম ইওর গার্লফ্রেন্ড । হেইট ইউ আ লট!” বলে ঊর্মিও চলে গেলো সেখান থেকে । নিলয়ের সাথেতো আর কেউ নাই, নিজেই নিজের গালে চড় মেরে বলল, “আমারও যাওয়া উচিৎ!” এরপর সেও সেখান থেকে চলে এলো । বেচারা সুমি, রাইসা আর হিমু হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইল ।
স্টেশনে ওরা পৌঁছতেই দেখল, ট্রেন দাড়িয়ে । নিলয় কাউকে জিজ্ঞেস করলো, “ভাই এটা কয়টার ট্রেন?” লোকটা জবাব দিলো, “একটার ট্রেন ভাই, ছাড়তে দেরী হইছে । এরপর সবাই বাইরে থেকে ট্রেনের শেষ মাথা থেকে শুরু করলো জানালার বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে সোহানকে খোঁজা । শেষ বগিতে নেই, তার আগের বগিতেও নেই । যতো দ্রুত সম্ভব ওরা খোঁজা শুরু করলো । কারণ এপাশ শেষ হলে ওপাশের জানালাতেও খুঁজতে হবে । কিন্তু প্রায় মাঝামাঝি বগিগুলোর কাছাকাছি আসতেই ট্রেন ছাড়া শুরু করলো । ইকবাল সাকিবকে বলল, “ভাই তুই সামনে থেকে দ্যাখ!” এমন সময় ঊর্মির চোখে পড়ল বস্তির কয়েকটা লোক কাকে যেন জানালা দিয়ে বিদায় জানাচ্ছে । সোহান যে কিছু বস্তির বাচ্চাকে এতদিন পড়িয়েছে, সেটা জানে ঊর্মি । প্রায় চতুর্থ বগির সামনে ছেলেগুলো দাঁড়ানো । তবে এগুলোই সেই বস্তির ছেলে কি না তা জানা নেই ঊর্মির । এমন সময় জানালা দিয়ে কেউ হাত বের করে বস্তির ছেলেমেয়েগুলোকে টাটা জানালো । হাতের ঘড়িটা দেখল ঊর্মি, হ্যাঁ, এটাই তো সকালে সোহান পড়ে এসেছিলো স্টেজে । ঊর্মি বলে উঠলো, “ওইতো সোহান!” ব্বলে ঊর্মি দিলো এক দৌড় । সাথে সাকিব ইকবাল আর নিলয়ও । এক দৌড়ে ওরা জানালার কাছাকাছি চলে এলো । ঊর্মি জানালায় হাত রেখে বলল, “সোহান! সরি সোহান! আই লাভ ইউ সোহান!” সোহান চমকে জানালার দিয়ে বাইরে তাকাল । দেখল, সাকিব, ইকবাল আর নিলয়ও আছে ।
- “দোস্ত! মাফ কইরা দিস!” বলল নিলয় ।
- “ভাই! তোর যা হইছে আমার জন্য, আমাকে মাফ কইরা দিস ভাই! প্লিজ! ভুল বুঝিস না!” বলল ইকবাল ।
- “ভাই! আমারেও মাফ কইরা দিস! তুই যদি ট্রেনে না থাকতি! আমি সত্যি তোর পা ধইরা মাফ চাইতাম!” ধীরে ধীরে ট্রেনের গতি অনেক বেড়ে গেছে । ঊর্মি হঠাৎ করে পা মচকে পড়ে গেলো । যেহেতু ঊর্মিই সবার সামনে ছিল, তাই ঊর্মিকে টপকে আর দৌড়োতে পারলো না । ট্রেন চলতে লাগলো । সবাই সামনের দিকে তাকাল । সোহান জানালা থেকে মাথা বের করে সবার দিকে একটা ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিয়ে হাত লাভ আকৃতির করে দেখাল । সবাই খুব খুশি হল । তবে সোহান কিন্তু সবার সাথে নতুন করে আর বন্ধুত্ব করলো না । সেই যে ব্লক করে রেখেছিল, সেই ব্লক করেই রেখে দিলো ।
১ বছর পরের কথা । শীতের ছুটিতে বাড়ি এসেছে সোহান । আপাতত বেকার জীবন পার করছে, চাকরীর সন্ধানে আছে । বাড়ি থেকে বেরিয়েছে মোটরসাইকেলটা একটু মেরামত করার জন্য । গ্যারেজে মোটরসাইকেলটা রেখে দোকানদারের সাথে গল্প করছিলো ।
- “কিরে! হল তোর?”
- “মামা, ৩ মিনিট খারান!” বলল দোকানদার এমন সময় মেয়ে কণ্ঠে কেউ সোহানের পেছনে দাড়িয়ে বলল, “ভাই এখানে সোহান নামে একটা ছেলে কোথায় থাকে বলতে পারেন?” সোহান পেছন ফিরে তাকাল । ঊর্মি না!” এই ১ বছরে বেশ শুকিয়ে গেছে । ঊর্মি সোহানকে দেখেই চিনতে পেরে সোহানকে জড়িয়ে ধরল । তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল, “গত ১টা বছর ভার্সিটির রেজিস্টার খাতা থেকে তোমার ঠিকানা অনেক কষ্টে জোগাড় করে এসেছি । তুমি কেন এখনও আমাকে আন ব্লক করনি?”সোহান দোকানদারের দিকে তাকাল । সে চোখ ঢেকে বলল, “মামা আমি কিছু দেখি নাই ।”
দোকানের সামনের একটা খোলা মাঠ । মাঠে পাশেই পুকুর । সেই পুকুর পাড়ে দুজনে বসে পড়ল ।
- “সাকিব আর ইকবালের কি অবস্থা?” জিজ্ঞেস করলো সোহান ।
- “হ্যাঁ ভালো । ওরা রাইসা আর সুমিকে ছ্যাকা দিয়েছে, এখন সাকিব কানাডায় গেছে আরও পড়াশুনা করার জন্য । আর ইকবাল ভার্সিটিতেই প্রফেসর হিসেবে জয়েন করেছে ।” বলল ঊর্মি ।
- “ও । আর তোমার হিমু?”
- “ওর কথা ভাবি না আর । ও একটা বেয়াদব । এখন আরেকজনকে ধরেছে । শুনেছি এর আগে আরও অনেকের সাথেও ছিল ।”
- “ও । হিমেল আর নিলয়?” জিজ্ঞেস করলো সোহান ।
- “হিমেলের সাথে যোগাযোগ হয় না, নিলয়ও কানাডা গিয়েছে ।” সোহান একটু নড়েচড়ে বসলো । তারপর বলল, “তুমি ?”
- “কিছুই না । এখন তোমার মতোই বেকার বসে আছি । বাবা বিয়ের কথা তুলেছিলেন, কিন্তু আমি রাজি হই নি ।”
সোহান কিছু বলল না । ঊর্মি বলল, “তুমি কাউকে আনব্লক করোনি কেন? সবাই তোমার কথা কতো ভাবে জানো?” সোহান ঊর্মির দিকে তাকাল । এমন সময় পেছন থেকে ড্রাইভার ডেকে উঠলো, “সোহান ভাই! হইয়া গেছে!” সোহান বলল, “আসছি!” তারপর ঊর্মির দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো যাই?”
- “কোথায় যাবো?” প্রশ্ন করলো ঊর্মি ।
- “আমার বাড়িতে আজ বিয়ের অনুষ্ঠান । দাওয়াত খেয়ে যাও ।”
ঊর্মি হেসে বলল, “নিশ্চয় তোমার না, তোমার বড় ভাই বা বোনের………” থেমে যেয়ে ঊর্মি মুখ গোমড়া করে বলল, “তুমি তো বলেছিলে তোমার শুধু একটা ছোট ভাই আছে!” সোহান তখন হেসে দিলো । বলল, “আমার কাজিনের বিয়ে । আমরা জয়েন ফ্যামিলি ।” ঊর্মি একটা শ্বাস ফেলে বলল, “উফ! কি যে ভয় পেয়েছিলাম!” সোহান বলল, “কিন্তু আমি যে বেকার! তোমার বাবা মেনে নেবেন?” ঊর্মি বলল, “তা কেন, আমি বসে থাকবো, তুমি চাকরি পাবে, আর আমাকে বলবে, চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি ঊর্মি শুনছো, এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না!” বলেই দুজনেই খিল খিল করে হেসে উঠলো । সোহান মোটর সাইকেলে উঠলো, ঊর্মি সোহানের পিছে । আয়নায় সোহান ঊর্মিকে দেখল একটিবার । তারপর আসতে লাগলো বাসার পথে । ঊর্মি তখন বলল, “তুমি তো জবাব দিলে না, কেন সবাইকে আনব্লক করো নি?”
- “এমনি ।” জবাব দিলো সোহান ।
- “তা বললে হয়? সবাই তোমার কথা কতো ভাবে তুমি জানো?” বলল ঊর্মি ।
- “মনে হয় আমি ভাবি না? তোমাদের কথা মনে রাখতে আমি একটা উপন্যাসও লিখেছি । সামনের বই মেলায় ভাবছি ছাপাবো ।” বলল সোহান ।
- “ওমা তাই! কি উপন্যাস?” খুশি মনে প্রশ্ন করলো ঊর্মি ।
সোহান জবাব দিলো, “লাভ ডট কম ।”
(সমাপ্ত)