0 %

Thanks a lot for being with us!
We are re-constructing our website!
Sorry for this temporary inconvenience
We are coming to you with a fresh look and design from 1 January 2022!
Till then! Stay connected!

একাত্তরের গফুর

একাত্তরের গফুর
সেদিন রাত ২টা বাজে। সিলেটের চা বাগানের রাস্তা দিয়ে অফিস শেষে বাড়ি ফিরছিলেন জনাব আশিক। চারপাশে অন্ধকার । শুধু ছিল অর্ধ চন্দ্রের আলো । তার হাতে ছিল ফোন যার ফ্ল্যাশ লাইট অন করা ছিল । কিন্তু চার্জ আছে মাত্র ২% । অন্যান্য দিন তাড়াতাড়িই ফিরতেন । কিন্তু আজ রাস্তায় জ্যাম একটু বেশিই ছিল ।
আশিক : যাক বাবা। শেষ পর্যন্ত গাড়ি থেকে নেমেছি। পথ যেনো শেষই হতে চায় না। কিন্তু ফোনের চার্জ চলে গেলে বাড়ি পৌঁছব কী করে?
বলতে না বলতেই চার্জ চলে গেলো। অর্ধচন্দ্রের আলোয় পথ চলতে লাগলেন তিনি । হঠাৎ এক রিকশাওয়ালা কে দেখতে পেলো রিকশা নিয়ে দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় ।
আশিক : ও ভাই, একটু আমায় পৌঁছে দেবেন? ২ কি.মি. সামনেই আমার বাড়ি ।
গফুর(রিকশাওয়ালা): উঠে পড়ুন।
আশিক রিকশায় উঠে পড়ল রিকশায় । হঠাৎ রিকশাওয়ালা সোজা না যেয়ে বামের রাস্তায় ঢুকে পড়লো।
আশিক: একি, আপনি এদিকে যাচ্ছেন কেনো? আমার বাড়ি তো সামনে।
গফুর: আজ্ঞে বাবু জানেন না, রাইতের বেলা এই রাস্তায় রিকশা চালানো নিষেধ?
আশিক: হ্যাঁ তা তো জানিই কিন্তু এই রাস্তা দিয়ে গেলে তো এক ঘন্টা লাগবে। আমি বরং হেঁটেই যাই।
কথাটা বলে যেই রিকশা থেকে আশিক নামতে যাবে, অমনি রিকশাওয়ালা ওর হাত ধরলো। অর্ধচন্দ্রের আলোয় দেখতে পেলো, লোকটার এক চোখ নেই। যদিও এটা দেখে আশিক একটু ঘাবড়ে গেলো, তবুও বললো," আচ্ছা আপনার মতলবটা কী?"
গফুর: মোর কোনো মতলব নাই বাবু। মু একজন অন্ধ রিকশাচালক, বাবু। কানা বইলা রাইতের বেলা কেউই মোর রিকশায় ভয় পাইয়া উঠতে চায় না। আইজকা সারাদিন একটা টাকাও পাই নাই । আপনে গেলে যা পামু তাই দিয়াই চালাইতে হইবো। অহন আপনে না কইয়েন না।
আশিক: ঠিক আছে, আমি তোমাকে ১০০০ টাকা দিচ্ছি, তোমার কাছে রাখো।
গফুর: বাবু, মুই গরীব হইতে পারি । তাই বইলা কারও কাছ থেইকা এইভাবে টাকা লইতে পারি না।
আশিক: বাহ, আপনি তো খুব ভালো মানুষ! ঠিক আছে, চলুন।
আশিক রিকশায় উঠলো । সারা রাস্তা চুপচাপ ই ছিলো দুজনে । প্রায় 1 ঘন্টা পর বাড়ি পৌছলো আশিক । আশিক তাকে ১০০০ টাকা দিলো।
গফুর : না বাবু। মোর কাছে ভাংতি নাই।
আশিক:এটা আপনাকে এমনিই দিলাম । রাখুন আপনার কাছে ।
গফুর : না বাবু, আপনে খালি ১৫০ টাকা দেন।
আশিক: ইশ্! আপনার মতো যদি সবাই হতো।[ ১৫০ টাকা বের করে ] নিন।
বাড়ির সামনের ৫০ ওয়াটের বাল্বের আলোতে আশিক দেখতে পেলো, গফুরের চোখে জল। টাকাটা গফুর নিলো।
আশিক: আপনি কাঁদছেন কেন?
গফুর: আইজকা কয় তারিখ?
আশিক: ১৬ ডিসেম্বর ।
গফুর:আপনার আনন্দ হচ্ছে না?
আশিক: কেনো?
গফুর: আইজকা থেইকা ৪৯ বছর আগে আমাগো দেশ স্বাধীন হইছিল ।
আশিক একটু লজ্জা পেলো। কারণ ও ভুলেই গিয়েছিল আজ বিজয় দিবস । অথচ এই অশিক্ষিত গরীব লোকটার মনে আছে। তাই কথা এড়িয়ে গেলো সে।
আশিক: আপনার একচোখ কী করে নষ্ট হলো?
গফুরের মুখে এবার হাসি দেখলো আশিক।
গফুর: আপনার আগে কেউ আমারে জিজ্ঞাসা করে নাই এই কথা। মু আপনারে কইতাসি
গফুর তার গল্প শুরু করলো।

সেই ১৯৭১ সালের ১৯ জুলাই এর কথা। গফুর তখন ৫ বছরের ছেলে । আশেপাশে প্রচুর ঝামেলা চলছিল তখন । যুদ্ধ হচ্ছে । বাড়িঘর পুড়ে যাচ্ছে । গফুরের বাবা-মাও পুড়ে মারা গেছে । কিন্তু গফুর ও তার ৮ বছর বয়সী ভাই, জলিল বেঁচে যায়। চাচীর কাছে থাকে সে ও তার ভাই জলিল । চাচা চাচী রাজাকার । ছোট ছিল তো, তাই রাজাকারদের কাজটা কি তা বুঝতো না। সারাদিন বাড়িতে কি সব সৈন্যরা আসতো। নাস্তা করতো। যে ভাষায় কথা বলতো, তাও সে বুঝতো না। একদিন তার বাসায় দুজন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আসে । একজন জুলাত, আরেকজন কামা। গফুর খুব অসুস্থ ছিল সেদিন । অথচ তার চাচা চাচী জুলাত আর কামাকে নিয়ে ব্যাস্ত। গফুরের পাশে বসে ছিল জলিল ।
গফুর: ভাইয়া, মা বাপ তো সেই কবে তারাদের দেশে গেছে । আমি যে অসুস্থ খবর পাঠাইছো? আইবো না আমারে দেখতে?
জলিল: ওরে ভাই আমার, যে তারাদের দেশে চইলা যায়, সে তো আর ফিরা আসে না ।
গফুর: তাইলে আমি যাই? কেমনে যাইতে হয়?
জলিল: চুপ, এইরকম কথা ভাববি না কখনও। তুই থাক, আমি চাচার কাছ থেইকা টাকা নিয়া আসি। তারপর ডাক্তারের কাছে যাই।
জলিল চাচার কাছে এলো।
কামা: হা হা। বাত তো সেহি হে.......আরে, ইয়ে বাচ্চে কন হে?
কদু (গফুরের চাচা) : ইয়ে মেরা ভাই কা বেটা হে । কী রে, কি করিস?
জলিল: কিছু টাকা দেবেন চাচা, গফুরের খুব অসুখ করছে । ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
কদু: যা যা। নাই টাকা। দুই তিনটা চড় মার, দেখবি অসুখ উধাও হয়ে গেছে।
জলিল: এইসব কী কথা কইতেসেন?
জুলাত: এ বাচ্চে, ইধার আ।
জলিল: চাচা, উনি কি কয়?
কামা: আরে, ইয়ে বাচ্চে উর্দু নেহি সামাঝতে। এ বাচ্চা, এখানে আও ।
জলিল উনার কাছে গেলো ।
জুলাত: তুমকা নাম কি আছে?
জলিল:মোর নাম জলিল । তয় আপনাগো আমি চিনি।
জুলাত: উয়াহ ভাই, দেখ, হাম কিতনা ফেমাস হে। ঠিক হে, তাহলে বল, আমরা কে আছি?
জলিল: আপনারা জানোয়ার ।
কামা: এ, মুখ সামলে কথা বলবি।
জলিল: যা কইসি, ঠিকই কইসি । আপনাগো জন্যই আমার বাপ মা মইরা গেছে।
কামা : তুমহারে ইতনি হিম্মাত!!!
কথাটি বলেই জলিল কে মেঝের উপর ফেলে দিলো কামা। তারপর প্যান্টের বেল্ট খুলে প্রচুর জোরে মারতে লাগলো জলিল কে। জলিলও আর্তনাদ করতে লাগলো ।
জলিল: ও মাগো, ও আল্লাহ, আল্লাহ আপনাগো গজব দিবো। দেইখেন । একদিন দেশ স্বাধীন হইবই। তহন আমি ,চাচা, চাচি গফুর আপনাগো আজাব পাইতে দেখমু।
জুলাত: এ কামা, রুক। [জলিল কে মেঝে থেকে তুললো।] তু জানিস, তোর চাচা একজন রাজাকার আছে?
জলিল: তাতে কি হলো?
জুলাত: রাজাকাররা কেয়া করে জানিস?
জলিল: তা জাইনা আমি কি করমু।
কামা: তুমকো চাচা চাচী যে আমাদের পার্টনার । নিজের দেশের ক্ষতি নিজেরাই কার রাহে হে।
জলিল ওর চাচার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো।
জলিল: আইজকা সব প্রশ্নের উত্তর পাইলাম। বুঝলাম, কেন তুমি আমার বাবা মার মৃত্যুর সময় লাশ নিয়ে যাও নি যেখানে সমস্ত গ্রামবাসী সাথে গেছিল যুদ্ধের মধ্যেও, কেন তোমার বাড়ি আগুন লাগে না যেখানে গ্রামের মানুষ আগুনে পুইড়া মরতেছে, আর কেনো এই জানোয়ার গুলো তোমার বাড়ি আসে।
হঠাৎ গুলির করলো কামা। গুলিটা ওর হৃদপিণ্ড দিয়ে গেলো। মাটির উপর লুটিয়ে পড়ল নিথর দেহ । রক্ত রঞ্জিত হয়ে গেলো মেঝে। এবার চোখটা বন্ধ চিরনিদ্রায় শায়িত হবার পালা । কিন্তু চোখ চলে গেলো সেই রুমের দরজার দিকে, যে রুমে ছিল ওর অসুস্থ ভাই, গফুর। এতক্ষণ দরজার সামনে দাড়িয়ে সব দেখেছে সে ।
জলিল যত জোরে সম্ভব, চিৎকার করে ভাইকে বললো, "ভালো থাকিস, গফুর" । তারপর মুখ দিয়ে বের হলো, "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (স.)" ধ্বনি ।
জুই(জলিলের চাচী): এই কদু, এইবার এই গফুররে ধরো ।
কদু যেয়ে গফুরকে ধরলো। গফুর ঠাস করে কদুর গালে একটা চড় লাগালো ।
কদু: ওই কুত্তা, তর এত্তো বুকের পাটা । যে চাচারে চড় মারস!!!
গফুর: তুমি চাচা হবার অযোগ্য । আমার ভাইকে তোমার চামচাগুলা মেরেছে । আমি সব দেখেছি।
জুই:[একটা কাটা চামচ এনে ] যেই চোখ দিয়া তুই সব দেখছস, সেই চোখ এহন উপড়াইয়া দিমু।
কথাটি বলেই গফুরের এক চোখ উপড়ে ফেললো জুই। পাশে দাড়িয়ে হাসতে থাকলো জুলাত আর কামা । গফুর তখন চাচার হাতে কামড় দিয়ে টেবিলের উপর রাখা রিভলবারটা নিলো।
জুলাত : এ বাচ্চে, ওটা কোনো খিলোনা নেহি আছে, মেরে কাছে দে দাও।
কামা : [ফিসফিসিয়ে] এ জুলাত, ইসমে আভিভি ৩০ গলিয়া হ্যা।
সাথে সাথে গুলি চালালো গফুর । ছোট বেলায় কত গুলি নিয়ে খেলেছে ও । কিন্তু এবার খেলার জন্য নয়, বাস্তবেই গুলি চালালো । ১,২,৩..............৩০। গুলি শেষ । ৭ টা লাগলো চাচার গায়ে, ৫ টা লাগলো চাচির গায়ে। ৩ টা লাগলো জুলাতের গায়ে, আর ২ টা লাগলো কামার গায়ে। সব শেষ। গুলির আওয়াজ শুনে ছুটে এলো আশপাশের মুক্তিযোদ্ধারা। ওরা সব ঘটনা শুনলো গফুরের কাছ থেকে । জুলাত আর কামা কে মেরে ফেলাতে আর সব পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের ঐ গ্রামছাড়া করা সহজ হয়ে যায় । ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে গফুর এক অজানা আনন্দে মেতে ওঠে, পুরোনো সব দুঃখ ভুলে । সেদিন সে আব্দুল চাচার বাড়িতে গান শুনেছিল, "এক সাগর রক্তের বিনিময়ে .................।"
একি, গানটা যেন সত্যি বাজছে । কল্পনা ভেঙে গেল আশিকের । সকাল হয়ে গেছে এতক্ষণ গফুর যা বলেছিল, সব যেনো তার চোখের সামনে কেবলই ঘটলো। চোখ দিয়ে জল ঝরছে তার।
গফুর: সেইদিনের সেই গফুর রে অহন কেউই দাম দেয় না। সম্মান করে না।[হাত দিয়ে দু চোখ মোছে গফুর ।] আমি আসি বাবু। কে জানে, কবে আমারেও আমার বাপ, মা, ভাইয়ের কাছে ওই তারাদের দেশে চইলা যাইতে হয়।
কথাটি বলেই উল্টো দিকে রিকশা ঘুরিয়ে চলে যেতে থাকে। আশিক কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে। শুধু গফুরের চলে যাওয়া দেখছে। হঠাৎ একটা চা পাতাবাহী ট্রাক এসে ধাক্কা দেয় গফুরের রিকশায়, গফুর ছিটকে যায় ও তার মাথা প্রচন্ড বেগে ধাক্কা খায় গাছের সাথে । লোকজন এসে জড়ো হলো । কিন্তু আশিক যেন হাঁটার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে । শুধু দূর থেকে দেখে যাচ্ছে । বুঝলো, সেই ৭১ এর গফুর এখন আর নেই । চলে গেলো তার মা, বাবা, ভাইয়ের কাছে, ঐ তারাদের দেশে।