মা কোথায়?
মা কোথায়?
জ্যোৎস্না রাতের চাঁদের
আলোতে নাবিলের দেহের একাংশ আলোকিত, অপর অংশ অন্ধকারে আবৃত হয়ে আছে । বিদ্যুৎ চলে গেছে
আধ ঘণ্টা আগে । এখনও আসে নি । রুমের চার্জার লাইটের ব্যাটারি শেষ, মোমের শেষ অংশটুকু
চলছে । বাবা অফিস থেকে এখনও ফেরেনি । এই এলাকাটা গ্রামের মতো, অবশ্য গ্রাম বললে একটু
ভুল হবে । চারপাশে বড় বড় গাছে ঘেরা, বসতি থেকে এই বাড়িটা বেশ দূরে । বারান্দায় দাড়ালে
আশে পাশে কোন ঘরবাড়ি দেখা যায় না । তাই অন্ধকারে ১০ বছর বয়সী এই নাবিলের একা একা ভয়
লাগাটাই স্বাভাবিক । রুমের ভেতর একটা অতিরিক্ত
নির্জন পরিবেশ । তাই তো বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে । এখানে দাঁড়ালে ঝিঁঝিঁ
পোকার আওয়াজে তাও খানিকটা ভালো লাগে । থেকে থেকে মৃদু বাতাস । নাবিল বার বার নিচের
দিকে তাকাচ্ছে আর দেখছে, মা এলো কি না । এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল নাবিল । পা-টা একটু লেগে
আসায় বসলো চেয়ারে । মায়ের কথা মনে পড়ছে ওর । ওর যখন ৭ বছর বয়স ছিল, তখন ওর মা ওকে এভাবে
বারান্দায় এনে কোলে নিয়ে বসে থাকতো । মা ওকে প্রশ্ন করত, “চাঁদটা খুব সুন্দর তাই না?”
নাবিল জবাব দিতো, “হ্যাঁ মা, অনেক সুন্দর । জানো মা, আমি বড় হয়ে রকেট চালাবো, তারপর
তোমাকে নিয়ে চাঁদে যাবো ।” মা প্রশ্ন করতো, “আগে পরীক্ষা ভালো করে দে, তারপর তারপর
অনেক বড় হ, নিশ্চয়ই তুই পারবি একদিন চাঁদে যেতে ।”
Writer
এমন সময় হাটার আওয়াজ শুনে চেয়ার
থেকে উঠে বারান্দা দিয়ে মুখ বাড়াল নাবিল । আনন্দের সাথে একবার বলে উঠলো “মা এসেছে!”
কিন্তু নাবিলের আশা ভঙ্গ হল । একটা শেয়াল পড়ে থাকা শুকনো পাতাগুলোর ওপর হাঁটছিল, সেটা
শুনেই মনে হচ্ছিলো কেউ হয়তো এসেছে । নাবিল আবার বসে পড়লো । শেয়াল দেখতেই মনে পড়লো,
গতবছর ও মায়ের সাথে চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলো । মায়ের হাত ধরে চিড়িয়াখানার একটা জন্তু দেখিয়ে
মা-কে বলেছিল, “মা দ্যাখো! কুকুর!” মা বেশ অনেক্ষন হেসে জবাব দিয়েছিলো, “ওটা কুকুর
না বাবা, ওটা শেয়াল ।” নাবিল তখন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিলো, “তাই! কিন্তু অনেকটা
কুকুরের মতোই তো দেখতে ।” মা তখন বলেছিলো,
“তুই আরেকটু বড় হ, তখন তুই কুকুর আর শেয়ালের মাঝে পার্থক্য আরও ভালো করে খুজে পাবি
।” নাবিল আবার উঠে বারান্দা দিয়ে মুখ বাড়ালো । আসলেই কুকুর ছিল তো, নাকি শেয়াল? কিন্তু
সেখানে আর কিছুই খুজে পেলো না নাবিল ।
বারান্দায় বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না নাবিলের । ঘরে ঢুকল । মোমবাতিটা নিভু নিভু প্রায় । ঘরের ভেতর মশাও রয়েছে অনেক । টেবিল থেকে একটা কয়েল নিয়ে মোমবাতির আগুনের সাহায্যে জ্বালিয়ে নিলো নাবিল । কয়েলের কথা মনে হতেই মনে পড়লো, ও একবার মা-কে জিজ্ঞেস করেছিলো, “আচ্ছা মা, কয়েলের ধোঁয়াতে মশারা চলে যায় কেন?” মা তখন বলেছিল, “কয়েলের ধোঁয়াতে অনেক সৈনিক থাকে । ওরা মশার সাথে যুদ্ধ করে মশাকে তাড়িয়ে দেয় ।” নাবিল জিজ্ঞেস করেছিলো, “কোথায় মা, আমি তো ধোঁয়ার মাঝে কোন সৈনিক দেখতে পারছি না?” ওর মা তখন হেসে বলেছিল, “বড় হ, দেখতে পারবি ।” আজ নাবিল বড় হয়েছে । কয়েলের ধোঁয়ায় মশা মরে যাবার আসল কারণটা না জানা থাকলেও এটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছে, কয়েলের ধোঁয়ায় কোন সৈনিক-ই নেই ।
এমন সময় রুমটা ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে যেতে লাগলো । নাবিল তাকিয়ে দেখল মোমবাতির আলোটা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে । নাবিল শেষ হতে থাকা মোমবাতির শিখার দিকে তাকিয়েই রইল, ধীরে ধীরে সেটা নিভে গেলো । এরপরই নাবিলের বুকের ভেতরটা ধুক ধুক আওয়াজ করতে লাগলো । কেন যেন মনে হচ্ছে আশেপাশে অনেকেই দাঁড়িয়ে । যেন ওকে সবাই খেতে আসছে । জানে এটা ওর কল্পনা। কিন্তু তবুও, ভয় হচ্ছে । নাবিল এক পা দু পা করে অন্ধকারের মাঝে হাটার চেষ্টা করলো । বারান্দার দরজাটা বাতাসে লেগে গেছে, যার জন্য বাইরের চাঁদের আলোটাও ঘরে আসতে পারছে না । এমন সময় বিদ্যুৎ চলে এলো, হঠাৎ লাইটের আলোতে নাবিলের চোখ ধাধিয়ে উঠলো, সেই অবস্থায় নাবিল দেখল সামনে সাদা রঙের কি একটা! নাবিলের বুকটা ধরাস করে উঠলো! নাবিল “মা!” বলে একটা চিৎকার করে উঠলো । রুম থেকে বেরনোর জন্য হাতের কয়েলটা ফেলে দরজার দিকে অগ্রসর হতে লাগলো । সেই সময় দরজা খুলে ঘরে ঢোকে নাবিলের বাবা । নাবিল বাবাকে দেখে একটু স্বস্তি পায়, বাবার কাছে যেয়েই বাবাকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে । নাবিলের বাবা হাটু গেড়ে বসে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কিছুক্ষণ শান্তনা দিলেন । ছেলের কান্না একটু থামলে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে?” “বাবা! ভুত এ………” পেছন ফিরে বাবাকে জিনিসটা আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখাতে গিয়ে থেমে গেলো নাবিল । সেখানে দেয়ালে হ্যাঙ্গারে ঝুলছিল একটা সাদা পাঞ্জাবী । সেটা আচমকা দেখেই ভয় পেয়েছিলো নাবিল ।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় ভুত?” নাবিল কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলো, “মা কোথায় বাবা? তুমি প্রতিদিন অফিসে যাও, আমার একা খুব ভয় করে । আজ তো বিদ্যুৎ-ও ছিলো না । মা কবে আসবে?” বাবা একটু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, “আসবে, তোর মা আসবে ।” নাবিল জিজ্ঞেস করলো, “এই এক কথা তুমি আমাকে গত একমাস ধরে বলছ । সেই যে মা হসপিটালে গেলো, আর এলো না । কবে আসবে মা? মা কি এখনও হসপিটালেই? আমাকে নিয়ে যাও না কেন?” নাবিলের বাবা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললন, “গত একমাস ধরে তোকেও আমি একটা কথাই বলছি, তোর মা আর নেই, আর এখন তোর মা যেখানে আছে, সেখানে তোকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় । তুই তো বিশ্বাস-ই করিস না ।” নাবিল জিজ্ঞেস করলো, “কি ভাবছো বাবা?” নাবিলের বাবা বললেন, “বড় হ, বুঝতে পারবি ।”
নাবিল বলল, “চাঁদে যেতে বড় হতে হয়, কুকুর আর শেয়ালের পার্থক্য করতে বড় হতে হয়, মশার কয়েলের ধোঁয়ায় সৈনিক দেখতে বড় হতে হয়, যে মা আমাকে এসব শিখিয়েছে, সেই মাকে দেখতেই এখন আমার বড় হতে হবে?” নাবিলের বাবা বললেন, “রুমে যা । আমি খাবার নিয়ে আসছি ।” তারপর এক প্রকার জোড় করেই সেখান থেকে রান্নাঘরের দিকে গেলেন নাবিলের বাবা ।
নাবিলও আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না । নাবিলের বাবাও ছেলে আজ আর মৃত্যুর কথাটা বললেন না । বলে কি লাভ? ছেলে বিশ্বাস করবে না সে কথা । পরদিন আবার জিজ্ঞেস করবে, “মা কোথায়?”
সমাপ্ত
বারান্দায় বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না নাবিলের । ঘরে ঢুকল । মোমবাতিটা নিভু নিভু প্রায় । ঘরের ভেতর মশাও রয়েছে অনেক । টেবিল থেকে একটা কয়েল নিয়ে মোমবাতির আগুনের সাহায্যে জ্বালিয়ে নিলো নাবিল । কয়েলের কথা মনে হতেই মনে পড়লো, ও একবার মা-কে জিজ্ঞেস করেছিলো, “আচ্ছা মা, কয়েলের ধোঁয়াতে মশারা চলে যায় কেন?” মা তখন বলেছিল, “কয়েলের ধোঁয়াতে অনেক সৈনিক থাকে । ওরা মশার সাথে যুদ্ধ করে মশাকে তাড়িয়ে দেয় ।” নাবিল জিজ্ঞেস করেছিলো, “কোথায় মা, আমি তো ধোঁয়ার মাঝে কোন সৈনিক দেখতে পারছি না?” ওর মা তখন হেসে বলেছিল, “বড় হ, দেখতে পারবি ।” আজ নাবিল বড় হয়েছে । কয়েলের ধোঁয়ায় মশা মরে যাবার আসল কারণটা না জানা থাকলেও এটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছে, কয়েলের ধোঁয়ায় কোন সৈনিক-ই নেই ।
এমন সময় রুমটা ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে যেতে লাগলো । নাবিল তাকিয়ে দেখল মোমবাতির আলোটা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে । নাবিল শেষ হতে থাকা মোমবাতির শিখার দিকে তাকিয়েই রইল, ধীরে ধীরে সেটা নিভে গেলো । এরপরই নাবিলের বুকের ভেতরটা ধুক ধুক আওয়াজ করতে লাগলো । কেন যেন মনে হচ্ছে আশেপাশে অনেকেই দাঁড়িয়ে । যেন ওকে সবাই খেতে আসছে । জানে এটা ওর কল্পনা। কিন্তু তবুও, ভয় হচ্ছে । নাবিল এক পা দু পা করে অন্ধকারের মাঝে হাটার চেষ্টা করলো । বারান্দার দরজাটা বাতাসে লেগে গেছে, যার জন্য বাইরের চাঁদের আলোটাও ঘরে আসতে পারছে না । এমন সময় বিদ্যুৎ চলে এলো, হঠাৎ লাইটের আলোতে নাবিলের চোখ ধাধিয়ে উঠলো, সেই অবস্থায় নাবিল দেখল সামনে সাদা রঙের কি একটা! নাবিলের বুকটা ধরাস করে উঠলো! নাবিল “মা!” বলে একটা চিৎকার করে উঠলো । রুম থেকে বেরনোর জন্য হাতের কয়েলটা ফেলে দরজার দিকে অগ্রসর হতে লাগলো । সেই সময় দরজা খুলে ঘরে ঢোকে নাবিলের বাবা । নাবিল বাবাকে দেখে একটু স্বস্তি পায়, বাবার কাছে যেয়েই বাবাকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে । নাবিলের বাবা হাটু গেড়ে বসে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কিছুক্ষণ শান্তনা দিলেন । ছেলের কান্না একটু থামলে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে?” “বাবা! ভুত এ………” পেছন ফিরে বাবাকে জিনিসটা আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখাতে গিয়ে থেমে গেলো নাবিল । সেখানে দেয়ালে হ্যাঙ্গারে ঝুলছিল একটা সাদা পাঞ্জাবী । সেটা আচমকা দেখেই ভয় পেয়েছিলো নাবিল ।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় ভুত?” নাবিল কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলো, “মা কোথায় বাবা? তুমি প্রতিদিন অফিসে যাও, আমার একা খুব ভয় করে । আজ তো বিদ্যুৎ-ও ছিলো না । মা কবে আসবে?” বাবা একটু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, “আসবে, তোর মা আসবে ।” নাবিল জিজ্ঞেস করলো, “এই এক কথা তুমি আমাকে গত একমাস ধরে বলছ । সেই যে মা হসপিটালে গেলো, আর এলো না । কবে আসবে মা? মা কি এখনও হসপিটালেই? আমাকে নিয়ে যাও না কেন?” নাবিলের বাবা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললন, “গত একমাস ধরে তোকেও আমি একটা কথাই বলছি, তোর মা আর নেই, আর এখন তোর মা যেখানে আছে, সেখানে তোকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় । তুই তো বিশ্বাস-ই করিস না ।” নাবিল জিজ্ঞেস করলো, “কি ভাবছো বাবা?” নাবিলের বাবা বললেন, “বড় হ, বুঝতে পারবি ।”
নাবিল বলল, “চাঁদে যেতে বড় হতে হয়, কুকুর আর শেয়ালের পার্থক্য করতে বড় হতে হয়, মশার কয়েলের ধোঁয়ায় সৈনিক দেখতে বড় হতে হয়, যে মা আমাকে এসব শিখিয়েছে, সেই মাকে দেখতেই এখন আমার বড় হতে হবে?” নাবিলের বাবা বললেন, “রুমে যা । আমি খাবার নিয়ে আসছি ।” তারপর এক প্রকার জোড় করেই সেখান থেকে রান্নাঘরের দিকে গেলেন নাবিলের বাবা ।
নাবিলও আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না । নাবিলের বাবাও ছেলে আজ আর মৃত্যুর কথাটা বললেন না । বলে কি লাভ? ছেলে বিশ্বাস করবে না সে কথা । পরদিন আবার জিজ্ঞেস করবে, “মা কোথায়?”
সমাপ্ত