লাভ ডট কম
লাভ ডট কম
১
“বিশাল এই মহাবিশ্ব । এ যে কতো বড় তার কোন ধারণা
নেই কারো । এরই মাঝে ছোট একটা গ্যালাক্সি, নাম যার মিল্কিওয়ে । এই গ্যালাক্সিরই মাঝে
একটা ছোট কক্ষপথ, নাম যার সৌরজগৎ । সেই সুবিশাল সৌরজগৎ-এরই মাঝে ছোট একটি গ্রহ, নাম
পৃথিবী । মহাবিশ্বের সাথে তুলনা করলে কতো ছোট, তাইনা! আরও ছোট হই । এরই মাঝে একটা ছোট
দেশ, বাংলাদেশ । ম্যাপে তো দেখাই যায় না । কিন্তু তবুও, এদেশের একজন নাগরিক হয়ে আমি
গর্বিত । এই বাংলাদেশেরই একটা জেলা, নাম ঢাকা । জনবহুল একটা জেলা । সেই জেলারই ছোট
একটা ক্যাম্পাস, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস । সেই ক্যাম্পাসের ছোট একটা হলের কোন
একটা রুমে বসে লিখছি আমি সোহান । তাহলে কতোটা ছোট আমি এই মহাবিশ্বের তুলনায়? শুধু আমি
কেন, আমি আপনি সবাই । এতোটা ছোট হবার পরেও আমরা কিসের এতো বড়াই করি! আমরা কেন এতো মারামারা
কাটাকাটি করি!” থেমে গেলো সোহানের কলম । না, কালি শেষ হয় নি, শেষ হয়েছে ওর কাহিনী ।
ঠিক শেষ হয় নি তা না, এরপর কি লিখবে, তাই নিয়ে ভাবছে সোহান । আর কি লিখবে? কি শুরু
করছিলো? লেখার বিষয়টা কি হবে? লেখার নাম কি হবে? লেখাটা কি মানুষের মন কাড়বে? জানা
নেই সোহানের । খাতা থেকে পেইজটা ছিঁড়ে ময়লার ঝুড়িতে রেখে টেবিল ল্যাম্পটা অফ করে শুয়ে
পড়লো । ওর রুমমেট ইকবাল আর সাকিব ঘুমিয়ে পড়েছে । সোহানই জেগে ছিল ।
সোহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র
। নিজের বাড়ি বগুড়া । এখানে বিশ্ববিদ্যালয়
হলে থাকে । লেখালেখির প্রতি বেশ ঝোঁক সোহানের । ছোটবেলা থেকে যা পারতো, লিখে যেতো সোহান
। অথচ কি লিখছে, কেউ পড়তো না । একদিন নিজের লেখা নিজেই পড়ে কিছুই বুঝতে পারলো না ঠিক কি লিখেছে । তখন থেকেই লেখার প্রতি
ওর ঝোঁকটা উঠে যায় । এই ঘটনাটা ঘটেছিল যখন ও ক্লাস সেভেনে পড়ে । সোহান তখন ভেবেছিলো,
এবার ও বাংলা নিয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে এবং আরও অনেক কিছু জেনে তারপর আবার লেখালেখি
শুরু করবে । ক্লাসের বাংলা সাবজেক্টে ও যে খারাপ লিখত তা কিন্তু না, সবটা ছিল মুখস্ত
বিদ্যার বহিঃপ্রকাশ । সেটাই তো ছেলেমেয়েদের সৃজনশীলতাকে খেয়ে ফেলল । যাই হোক, অনেক
চড়াই উতরাই পেড়িয়ে সোহান অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ নিয়ে ভর্তি হতে পারলো
। সোহানের বাবা মা-র যদিও আপত্তি ছিল । এখনকার যুগে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের দাম বেশি,
তার ওপর সোহানের মা চায় সোহান ডাক্তার হবে, বাবা চায় ইঞ্জিনিয়ার হবে । কিন্তু সোহান
বাংলা নিয়ে পড়বে, এটাই শুধু জানে । কি হবে তা জানে না । লেখক? হবে হয়তো । টিচার? খারাপ
না । মুভির স্ক্রিপ্ট রাইটার? এটার ভালোই কদর পাবে হয়তো । গত এক সপ্তাহ ধরে সোহান প্রায়
অনেকগুলো মুভি দেখেছে আর কিছু লিখতে চেষ্টা করেছে যা যেন একটা মুভির মতোই কাহিনী হয়
। কিন্তু এত বছর পর লেখা শুরু করায় কেমন যেন লেখার প্রতি আগ্রহটা কমে গেছে । নিজের
একটা লেখাও পছন্দ হয় না । এক সপ্তাহ হল লেখা শুরু হয়েছে, আর আজ খাতার সাত নাম্বার পাতাটাও
ছেঁড়া হল ।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখল ইকবাল নিজের গার্ল ফ্রেন্ড
রাইসার কথা বলছে । “হ্যাঁ বাবু……, খেয়েছো! না সোনা,……হ্যাঁ ময়না, এখনই হলে যাবো ।”
ইকবালও বাংলা বিভাগের ছাত্র । তবে এখানে এসে সাবজেক্টটা যেন ওর প্রেম হয়ে গেছে । সারাটাদিন
গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলে । এ পর্যন্ত সোনা, ময়না, বাবু, বেবি, জান, পাখি, লায়লি,
সিমরান, নাতাশা, বিপাশা কতো নামে ডেকেছে তার হিসেব নেই । কথায় কথায় একেক নামে ডাকে
গার্ল ফ্রেন্ডকে । আর এতোটা প্রেম, মানে বলার মতো না । লোকে যেটাকে বলে আলগা পিরিত
। চোখটা সরিয়ে সোহান সাকিবের দিকে তাকাল । খুব সম্ভবত ইতিহাসের বই পড়ছে । সাকিব কিন্তু
বেশ ব্রিলিয়ান্ট । ওর যদিও ইঞ্জিনিয়ার হবার শখ ছিল, কিন্তু কি একটা কারণে ও বাংলা সাহিত্য
বিভাগে চলে আসে । এতে কিন্তু ওর মাঝে মোটেও আক্ষেপ নেই । কিন্তু ওর মেধা দেখলে লোকজন
অবাক হয়ে যায় । বাংলা ইতিহাসের হয়তো এমন কোন বিষয় নেই, যা ওর অজানা হবে । টিচাররাও
পর্যন্ত ওকে দেখে অবাক । যদিও এর মাঝেও সাকিবের প্রেম করা থেমে নেই । সাকিবেরও একটা
গার্ল ফ্রেন্ড জুটেছে । নাম সুমি । সাকিবের প্রেমটাও বলতে গেলে ইকবালের মতোই আলগা পিরিত
। যদিও সবার সামনে ইকবালের মতো লজ্জাহীনভাবে সাকিব প্রেম করে না । ফোন এলে সাকিব একটু
আড়ালে যেয়েই কথা বলে । সাকিব বই পড়তে পড়তেই সোহানকে বলল, “গুড মর্নিং ।” সোহান চোখ
রগড়ে উঠে বসে ঘুম ঘুম কণ্ঠেই বলল, “গুড মর্নিং ।” দুহাত টান টান করে শরীরের আরমোড়া
ভেঙ্গে উঠে বসলো সোহান । সাকিব আর কিছুই বলল না । নিজের ইতিহাসের বই পড়ায় মনোনিবেশ
করলো । সোহান ওয়াশরুমের দিকে গেলো ।
ওরা তিনজনই প্রথম বর্ষের ছাত্র আজ ওদের সেকেন্ড
সেমিস্টারের দ্বিতীয় ক্লাস । প্রথম সেমিস্টারে সোহান, সাকিব আর ইকবাল একই সেকশনে ছিল,
দ্বিতীয় সেমিস্টারে সোহান আলাদা সেকশনে চলে যায় । সাকিব আর ইকবালের ১২টায় ক্লাস, আর
সোহানের ১০টায় । তাই সাকিব আর ইকবালের চেয়ে সোহানের তাড়া এখন বেশি । বাজে সকাল ৯টা
।
২
সাড়ে ৯টা বাজতেই সোহান বেড়িয়ে যায় । তারপর ক্যাফেটেরিয়াতে
এসে দুটো পরোটা কিনে খায় । খাওয়া শেষে ক্লাসরুমের
দিকে যাচ্ছিলো, নজরে পড়লো খানিকটা দূরে দুটো ছেলে খালি গায়ে হাফ প্যান্ট পড়ে কান ধরে
উঠবস করছে । ওই দুজনের সামনে দাড়িয়ে মজা দেখছে আরও তিনজন ছেলে । নিশ্চয় এরা সিনিয়র,
জুনিয়রদের ওপর র্যাগিং করছে । সোহান আরেকটু সামনে যেয়ে ডানে মোড় নিয়ে ক্লাসরুম ভবনের
দিকে গেলো । ক্লাসরুম দোতলায় । বারান্দা দিয়ে ক্লাসরুমের দিকে যাচ্ছিলো, এমন সময় একটা
মেয়ে এসে সোহানকে বলল, “ও হাই! কেমন আছো!” সোহান চিনলো মেয়েটাকে । নাম জেসি । গত সেমিস্টারে
বেশ জালিয়েছে । মেয়েটা নাকি সোহানকে পছন্দ করে । কিন্তু সোহানের তো এসব প্রেমে জড়াবার
ইচ্ছেই নেই । যদিও মেয়েটা নিজে থেকে কোনদিন বলে নি, ইকবাল একবার এসে বলেছিল । এই মেয়ে
নাকি সোহানের জন্য ইকবালের গার্লফ্রেন্ড রাইসার সাথে ভাব জমিয়েছে । শুধু তাই নয়, আজকাল
নাকি সাকিবের গার্লফ্রেন্ড সুমির সাথেও ঘুর ঘুর করে । সোহান জবাব দিলো, “হ্যাঁ ভালো । তুমি কেমন আছো?” সোহানের পাল্টা প্রশ্নে মেয়েটা
যেন বেশ খুশি হয়ে উঠলো । বলল, “হ্যাঁ! অনেক ভালো! মানে তোমাকে কি করে বোঝাই, যতোটা
ভালো থাকা যায় যেন তার চেয়েও ভালো!” সোহান কিছু বলল না, তবু খারাপ ভাবতে পারে ভেবে
হালকা হাসল । ইচ্ছে করে খারাপ হতে, যেন মেয়েটা ওর কাছে না ঘেঁষে সেরকম কিছু করতে, কিন্তু
ছেলের সাহিত্যিক মন তা করতে দেয় না । যতোই হোক, এভাবে একটা নির্দোষ রমণীকে তো কষ্ট
দেয়া যায় না । মেয়েটা প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা তোমার গার্লফ্রেন্ড নেই?” সোহান কিন্তু এই
প্রশ্নের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল । এ পর্যন্ত
মেয়েটার সাথে যতবার দেখা হয়েছে, ততবারই মেয়েটা এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছেই । ততোবারই
সোহান একই জবাব দিয়েছে । আজও ব্যাতিক্রম না । সোহান জবাব দিলো,
“আমার এসব প্রেমের প্রতি আগ্রহ নেই ।” মেয়েটা
বলল, “ধুরু! তুমি শুধু একই জবাব দাও ।” সোহানের ইচ্ছে করলো বলতে তুমি শুধু একই প্রশ্ন
করো, কিন্তু করলো না । ওই যে, শুধু শুধু নির্দোষ রমণীকে কষ্ট দেয়া ঠিক হবে না । আচ্ছা,
আসলেই কি মেয়েটা নির্দোষ? নাকি? বাহ! এ নিয়ে কিছু একটা লেখা যেতে পারে! সোহান চেহারায়
একটা আনন্দের ভাব ফুটে উঠলো । এমন সময় মেয়েটা জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, তোমার কি মেয়েদের
দেখে অন্যরকম ফিল হয় না! মানে শরীরে একটা আলাদা আলাদা ভাব আসে না!” সোহান হালকা বিরক্তির
সাথেই বলল, “না ।” প্রায় ক্লাসরুমের সামনে এসে পড়েছে, এমন সময় মেয়েটা সোহানকে বলল,
“আমার দিকে একটু তাকাও!” সোহান মেয়েটার দিকে তাকালো । মেয়েটা নিজের চুলে হাত দিয়ে ঠোঁট
দুটো চুমু খাওয়ার মতো করে ধীর গতিতে চোখের পাপড়ি খুলে আর বন্ধ করে সোহানকে দেখালো ।
এবার সোহানের বিরক্ত লাগতে শুরু করলো । এ কাজ মেয়েটা আজই প্রথম করছে । মেয়েটা তখন বলল,
“এবার বলো, আমায় দেখে কি ফিল হল!” সোহান হাসিমুখে জবাব দিলো, “বমি পাচ্ছে!” বলেই সোহান
ভেতরে চলে গেলো । মেয়েটা সোহানের পিছু পিছু ক্লাসরুমে ঢুকতে ঢুকতে যা তা বলতে লাগলো
। সোহান যেয়ে নিজের সিটে বসলো । মেয়েটা এখন কিছুটা থেমেছে । সোহানের পাশেই ছিল হিমেল
নামে ওর একটা বন্ধু । সোহানকে বলল, “কিরে? ওর সাথে আবার কি হল?” সোহান শুধু বলল, বুঝিস
না! মেয়েদের যা আকাম করার তাই ।” হিমেল বলল, “কি ছ্যাকা দিছে না দিছিস?” সোহান ভ্রু
কুঁচকে হিমেলের দিকে তাকাল । হিমেলের পেছনেই বলে নিলয় । নিলয় হাসতে হাসতে বলল, “আরে,
সোহান তো প্রেমেই পড়বে না, তাহলে ও ছ্যাকা খাবে ক্যামনে?” বলেই হিমেল আর নিলয় হেসে
উঠলো । সোহান চোখ ফিরিয়ে সামনের দিকে তাকাল । হিমেল সোহানকে শুনিয়ে নিলয়কে বলল, “আরে
আর বলিস না, সিঙ্গেল তো, কষ্ট পাবে বেচারা ।” সোহান ওদের কথায় আর কান দিলো না ।
কিছুক্ষণ পরেই ক্লাস শুরু হল । প্রথম ক্লাস আলিয়া
ম্যাডামের । ক্লাসে এসে ম্যাম নাম ডাকছিলেন । “রাফি” আওয়াজ এলো, “ইয়েস ম্যাম ।” “মাইশা”
আওয়াজ এলো “ইয়েস ম্যাম ।” “সোহান” সোহান বলল, “প্রেজেন্ট ম্যাম ।” “ঊর্মি” কোন আওয়াজ
এলো না । সিরিয়াল অনুযায়ী মেয়েটা সোহানের পেছনেই হবার কথা । সোহান পেছনে তাকিয়ে দেখল,
পেছনের সিটটা ফাঁকা । ম্যাম আবারো নামটা ডাকল, “ঊর্মি কি আছে?” ম্যাম সোহানের পেছনের
সিটটার দিকে তাকাল । তারপর বলল, “এই ঊর্মি মেয়েটা গতদিনও আসে নি । কে এ?” এমন সময় ক্লাস
রুমের দরজা থেকে আওয়াজ এলো, “প্রেজেন্ট ম্যাম!” ক্লাসের অনেকেই দরজার দিকে তাকাল ।
সোহানও তাকাল । সাদা সালোয়ার কামিজ আর ওড়না মাথায় ব্যাগ নিয়ে দাড়িয়ে একটা মেয়ে । চেহারা
ফর্সা, সোহানের চেয়ে খানিকটা ছোট হবে চুলগুলো কোমর পর্যন্ত নেমে গেছে । অপরূপ একটা
চাহনি । এতোটা দুর থেকেও যেন সোহান টের পাচ্ছে । কি সুন্দর ঘ্রাণ মেয়েটার মাঝে! আচ্ছা
এটাও কি সোহান এতদুর থেকে টের পাচ্ছে! নাকি মেয়েটাকে দেখে জেসির কথার মতো সোহানের মাঝে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে সোহানের যার
দরুন এসব কল্পনা করছে সোহান! তবে কি সোহান মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেলো?
৩
সোহান কিন্তু মেয়েটার দিকে দৃষ্টিই সরাতে পারছে না । আজ কি হল সোহানের?
সোহানের অন্যমনস্কতা কেটে গেলো আলিয়া ম্যামের
ব্যাঙের মতো খ্যার খ্যারে গলাটা শুনে । হালকা ধমকের ম্যাম ঊর্মিকে বলল, “কোথায় ছিলে তুমি! প্রথম
দিনই লেট করেছো?” সোহানের হালকা বিরক্ত লাগলো । ইস! কি সুন্দর মেয়েটাকে দেখছিল, মাঝখান দিয়ে ম্যামের এই
ব্যাঙের মতো গলাটা ডিস্টার্ব করলো । এরপর আবার সোহান মেয়েটার দিকে মনোনিবেশ করলো মেয়েটার
কথা শুনে । বলল, “সরি ম্যাম, আসলে আগের দিন হলে জায়গা পাইনি, মামার বাসায় ছিলাম, ওখান
থেকে আসতে পারিনি । গতকাল লেট করে এসেছিলাম, আর ভার্সিটি তাই না এসে হলের ব্যাপারটা
ক্লিয়ার করে এলাম ।” আহা! কি মিষ্টি গলা! কোকিলের মুখে কেউ যদি মধু দিয়ে কথা বলতে বলে, তবে যেরকম গলা হবে,
যেন সেরকম মিষ্টি গলা । সোহান একটু অবাক হল । আরে! মেয়েটাকে দেখে ওর যে শুধু ভালো লাগছে
তাই-ই না, লেখালেখির জন্য দারুন দারুন সব ভাষা খুঁজে পাচ্ছে! না, আজই তাহলে নতুন একটা
গল্প লেখা শুরু করতে হবে । ম্যাম ঊর্মিকে ভেতরে আসার পারমিশন দিলো । মেয়েটা ভেতরে এলো
। হাঁটতে হাঁটতে সোহানের কাছাকাছি আসতেই অল্প কিছুক্ষনের জন্য সোহানের দিকে তাকাল ।
সোহান কিন্তু সেই ওর ভেতরে ঢোকা থেকেই ওর দিকে তাকিয়ে । তারপর সোহান মেয়েটার বসা পর্যন্ত
মেয়েটার দিকে তাকিয়েই রইল । মেয়েটা বসতেই হাত
বাড়িয়ে দিয়ে সোহানকে বলল, “হাই! আমি ঊর্মি!” গলাটা যেন এখন আরও সুন্দর লাগছে!
কাছ থেকে শুনছে তো । সোহান খেয়াল করলো মেয়েটা
হাত বাড়িয়ে বসে আছে । কি করবে এখন সোহান! এ পর্যন্ত কোন অচেনা মেয়েকে
স্পর্শ করে নি সোহান । কিন্তু সোহানের হাত
কেমন যেন মেয়েটার হাত ধরতে চাচ্ছে । সোহান মেয়েটার সাথে হ্যান্ডশেক করলো । কি
সুন্দর একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে সোহানের । সত্যি অন্যরকম । পুরো শরীরটা কেমন যেন
মেয়েটার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে । হঠাৎ সোহান চমকে পেছন ফিরে তাকাল ম্যামের ডাকে । এর
আগে দুবার ডেকেছে সোহান টের পায় নি । শেষটায় ম্যাম ধমকের স্বরে ডাকায় সোহান পেছন ফিরে তাকাল । ম্যাম বলল, “সমস্যা
কি তোমার? পেছনে কথা বলছো কেন?” সোহান দাড়িয়ে বলল, “সরি ম্যাম ।” ম্যাম সোহানকে বলল,
“বসো ।” বসলো সোহান । ক্লাস শুরু হল, অথচ সোহান যেন ক্লাসে মনই দিতে পারছে না । বার
বার ইচ্ছে করছে পেছন ফিরে তাকাতে, ইচ্ছে করছে দেখতে মেয়েটাও
কি সোহানের প্রতি দুর্বল? মেয়েটাও কি বার বার
সোহানকে দেখতে চাইছে? মেয়েটাও কি সোহানকে দেখে দুর্বল হয়ে পড়েছে? নাকি মেয়েটা অন্য কারো
প্রতি দুর্বল? মেয়েতার দিকে কি অন্য কেউ বার বার তাকাচ্ছে? আচ্ছা আজ সোহানের
এমন হচ্ছে কেন? সোহান একটু নড়েচড়ে বসলো
। তবে কি এটাকেই বলে ক্রাশ খাওয়া? কই কতো মেয়েকেই তো সোহান দেখেছে । এই প্রথম এই মেয়েটাকেই দেখে সোহান ক্রাশ খেলো কেন?
ইকবাল আর সাকিব তো সারাদিন কতো মেয়েদের দেখে বলে “দোস্ত ক্রাশ খাইলাম!” তবে কি ওটা
নিছক ওদের ইয়ার্কি? তাই হবে । “সোহান!” আবারো ম্যামের ডাকে দাড়িয়ে গেলো সোহান । এবারেও
তৃতীয়বার সোহান শুনতে পেলো । ম্যাম বলল, “কি ব্যাপার? এতো অন্যমনস্ক কেন তুমি?” সোহান
আবার মাথা নিচু করে বলল, “সরি ম্যাম ।” ম্যাম ধমকের সাথে বলল, “হ্যাঁ তো, তোমাদের এই
সরি বলা আর প্রেম ছাড়া কিছুই নেই । যেন প্রেমের ওয়েবসাইট খুলে বসেছে ।” সোহান এতক্ষণ
লজ্জিত ছিল অন্যমনস্ক থাকার জন্য, কিন্তু হঠাৎ ম্যামের কথা শুনে সোহান মুখ থেকে লজ্জাটা
চলে গেলো । ফুটে উঠলো আশার আলো । প্রেমের ওয়েবসাইট না! একটা গল্প লেখা যাবে এটা নিয়ে
। কি নাম দেবে? ভালোবাসা ডট কম! না, এই নামে কি একটা সিরিয়াল হতো স্টার জলসায় । প্রেম
ডট কম? না, এটা তো মিরচি রেডিওতে প্রতি শুক্রবার হয় । হ্যাঁ, গল্পের নাম তবে
দেয়া যায় লাভ ডট কম । এই নামে কিছু হলেও জানা নেই সোহানের ।
কয়েক ক্লাস
পর ব্রেক টাইমে সোহান নিলয় আর হিমেলের সাথে ক্যাফেটেরিয়াতে বসে খাচ্ছিল আর খেতে খেতে কথা
বলছিল । এমন সময় হিমেল জিজ্ঞেস করলো, “কিরে সোহান, তোর গল্প লেখা কদ্দুর?” সোহান বলল, “গতকাল একটা শুরু করেছিলাম, আবার ছিঁড়ে
ফেলে দিয়েছি ।” নিলয় ইয়ার্কির সাথে বলে উঠলো, “তোর কাজই তো ওই, শুধু ছেঁড়া । খাতার পেইজ, চুল, মোচ, দাড়ি………থাক
আর নিচে না নামি ।” বলেই হেসে দিলো নিলয় আর
হিমেল । সোহানও বন্ধুদের ইয়ার্কির সাথে তাল মিলিয়ে হালকা হাসল । তারপর বলল, “আজ একটা
লিখবো ভাবছি । নাম, লাভ ডট কম ।” সাথে সাথে হো হো করে হেসে উঠলো । সোহান বলল, “কিরে!
তোরা হাসছিস কেন?” নিলয় বলল, “তোর এই লাভ ডট কম ওয়েবসাইটে যেসব ওয়েবপেইজ থাকবে সেগুলো
হল মা, বাবা, ভাইয়া, আপু, শিক্ষক, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, তুই নিজে ।
কোনদিন ওই গার্লফ্রেন্ড বিষয়টা এর মধ্যে ঢুকবে
না ।” সোহান ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বিরক্তির সাথে বলল, “উফ! তোরাও না!” বলেই উঠে যাচ্ছিলো সোহান
বিল দিতে । বিল দিয়ে আসছিলো, এমন সময় চোখে
পড়লো একটা টেবিলে একটা মেয়ে একা বসে আছে । পেছন থেকে তো মনে হচ্ছে ঊর্মি, হ্যাঁ তো,
জামাটাও তো একই, সাদা সালোয়ার কামিজ ওড়না । সোহান আরেকটু ভালো করে দেখার জন্য কৌশলে
টেবিলটার ওপাশ দিয়ে হেঁটে আসতে গেলো, মেয়েটা দেখে ফেলল সোহানকে । ডেকে বলল, “ও হ্যালো!”
সোহান দাড়িয়ে গেলো ।
৪
তারপর মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, “হাই! আমি……।”
নামটা বলতে গিয়ে থেমে গেলো সোহান । দেখল, হিমেল আর নিলয় অবাক দৃষ্টিতে সোহানের দিকে
তাকিয়ে আছে । মেয়েটাই সোহানকে বলল, “তোমার নাম সোহান, আমি জানি ।” সোহান নিলয় আর হিমেলের
থেকে চোখ সরিয়ে চোখটা ঊর্মির দিকে নিলো । ঊর্মি বলল, “বসো ।” সোহান বসলো । মেয়েটা বলল,
“কোথায় থাকো?” সোহান মেয়েটার সামনে কেমন হালকা ভয় ভয় পাচ্ছিলো । কি বলতে কি বলবে, মেয়েটা
রাগ না করে বসে । বলল, “ইয়ে, মানে, হলে থাকে ।” মেয়েটা খিল খিল করে হেসে উঠলো । সোহান
ওর হাসির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল । কি অপরূপ লাগে মেয়েটা হাসলে! মেয়েটা তারপর
বলল, “হলে থাকো সে তো বুঝলাম, আমি জিজ্ঞেস করেছি তোমার বাসা কোথায়?’ সোহান বলল, “হ্যাঁ!
হ্যাঁ……আমি বাসায় থাকি ।” মেয়েটা আবার হেসে উঠলো । এবার সোহানের একটু লজ্জা লাগছে ।
মেয়েটা কি ভাবছে! হয়তো ভাবছে ছেলেটা বেকুব । কিন্তু মেয়েটা সোহান অবাক করে দিয়ে হাসি
থামিয়ে বলল, “তুমি তো বেশ মজার মানুষ! ছোট বেলা থেকে এরকম মানুষই জানো আমার খুব পছন্দ
।” এবার সোহানের ভেতর থেকে ভয় ভয় ভাবটা কেটে গেলো । চেয়ারটা আরেকটু টেনে বসে বলল,
“ও আচ্ছা, আমি থাকি বগুড়া । তুমি?” মেয়েটা জবাব দিলো, “সিরাজগঞ্জ । পাশাপাশি থাকি তাহলে?”
সোহান বলল, “হ্যাঁ, জেলা তো পাশাপাশিই, চাইলে এখানেও পাশাপাশি থাকতে পারো । মেয়েটা
আবার হেসে উঠলো । ওরা দুজন সেখানে বসে অনেক কথা বলল ।
রাতে সোহান ইকবাল আর সাকিব রুমেই ছিল । সোহান কেবলই
নিজের গল্প লেখার খাতাটা বের করেছে । সাকিব পড়ছে, আর ইকবাল রাইসার সাথে বসে চ্যাটিং
করছে । পড়ার ফাঁকে সাকিব সোহানকে বলল, “কিরে,
তুই শুনলাম আজ নাকি মেয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলেছিস?” সোহান বলল, “ক…কই না তো?” সাকিব
বইতে একটা ভাজ দিয়ে বইটা বন্ধ করে বলল, “মিথ্যে বলিস না চাঁদ! সকালেই দেখলাম ।” সোহান
বলল, “তুই ছিলি তখন! তোদের না ক্লাস চলছিলো?” ইকবাল চ্যাট করার মাঝে বলে উঠলো, “আরে,
সাকিবের সুমি ডাকলে সাকিবের আর কিছু লাগে নাকি!” সাকিব ইয়ার্কি করে পাশে থাকা গোল করে
মুচড়ে রাখা রাখা কাগজ ছুঁড়ে মারল ইকবালের দিকে । সোহান লিখতে লিখতে বলল, “ও তাই বল
। তোদের তো পুরো দুনিয়া ওই গার্লফ্রেন্ডই ।” সাকিব বলে উঠলো, “কেনো তোর কি জ্বলে?”
সোহান বলল, “কেনো জ্বলবে কেন?” সাকিব ইয়ার্কির সাথে বলল, “না, তুই সিঙ্গেল কি না!”
সোহান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় ইকবাল কি যেন জোরে জোরে পড়া শুরু করলো, “কাক
। অবলা এই প্রাণীটাকে কেউ পছন্দ করে না । না এর রূপ সুন্দর, না এর ডাক । আচ্ছা যদি
এমন হতো, কাকের মাঝে কোকিল কণ্ঠ ঢুকিয়ে দেয়া যেতো, তবে কেমন হতো?” সোহান জিজ্ঞেস করলো,
“এটা পেলি কই?” ইকবাল বলল, “এইতো একটু আগেই সাকিব আমার দিকে ঢিল মারল ।” সোহান হালকা
রাগের দৃষ্টিতে সাকিবের দিকে তাকাতেই সাকিব বলল, “ইয়ে……দোস্ত, শোন, আসলে ওই কাগজ তুই
ওই ডাস্টবিনে ঢিল মারতে গিয়া বাইরে ফালায় দিছিলি । আমি রাইখা দিছিলাম ।” সোহান সাকিবকে
কিছু না বলে চেয়ার থেকে উঠে ইকবালের কাছে গেলো কাগজ ফেরত নিতে । ইকবালের সাথে জোরাজুরি
করে বলল, “হারামজাদা! কাগজটা দে ।” কিন্তু ইকবাল নাছোড়বান্দা । কাগজ সে সোহানকে দেবে
না । কিন্তু সোহান নিয়েই ছাড়বে, দুজনে যখন মারামারিতে ব্যাস্ত, তখন সাকিব এই ফাঁকে,
সাকিব উঠে সোহান এখন যে খাতায় লিখছিল, সেই খাতাটা নিলো । তারপর পড়া শুরু করলো, “লাভ
ডট কম । ঊর্মি । মানে ঢেউ । আমরা সবাই ঊর্মিমালা দেখে খুব আনন্দিত হই । যেন মনে হয়
মনের ভেতর দিয়েই ঊর্মিমালা ভেসে যায় । কিন্তু সে যদি মানুষ ঊর্মি হয় আর তাকে থেকে মনের
মাঝে ঊর্মিমালা ভেসে যায়, তখন তাকে কি বলা যায়? প্রেম? না ভালোবাসা?.........।” সোহান
প্রথমে টের পায়নি । যখন টের পেলো, ইকবালকে ছেড়ে সাকিবের সাথে এবার খাতা নেয়ায় জোরাজুরি
শুরু । ইকবাল বলল, “দিবি না দোস্ত! ছেলে আজকে আসল পুরুষ হয়েছে!” এমন সময় সাকিবের মোবাইলে
একটা কল এলো । সাকিব হয়তো তবুও থামতো না, কিন্তু কলটা করেছে সুমি তাই থামতে হল । খাতাটা
সোহানের হাতে দিয়ে বলল, “দোস্ত, আমি একটু আসি, বাইরে থেকে ঘুরে আসি ।” বলে সাকিব বাইরে
চলে গেলো । সোহান খাতাটা নিয়ে টেবিলের ড্রয়ারে রেখে তালা আটকে দিলো । ইকবাল সাকিবের
ওপর হালকা রাগ করলো । কিন্তু এমন সময় ইকবালের মোবাইলে এলো রাইসার কল । ফোন ধরেই বলল,
“হ্যালো কাক……সরি……কোকিল!”
পরদিন সকালের কথা । “হ্যাঁ বাবা, আচ্ছা, আমি বিকেলের
দিকে মোটরসাইকেলটা ওখান থেকে নিয়ে আসবো, আচ্ছা রাখি তাহলে ।” ফোনটা রেখে বিছানা থেকে
উঠলো সোহান । ওর মোটরসাইকেলটা বাবাকে পাঠিয়ে দিতে বলেছিল, আজ সেটা আসছে । মোটর সাইকেল
থাকলে একটু ঢাকায় ঘুরে ঘুরে দেখতে পারবে । আজকে সোহানের ক্লাস ছিল না । সাকিব আর ইকবালের
ছিল । তাই রুমের ভেতর একা একা বসে বেশ একঘেয়ে
অনুভব করছিলো সোহান । গতকালকে গল্পটাও অনেকদুর লিখেছে । এবারের গল্পটা সোহানের মন মতো
হয়েছে । ছিঁড়তে হয় নি আর । কিন্তু তাই বলে
কতক্ষণই বা গল্প লেখা যায়? হলরুম থেকে বেড়িয়ে সোহান বারান্দায় এলো । এমন সময় খেয়াল
করলো, ভার্সিটির পুকুর পাড়ে দাড়িয়ে একটা মেয়ে । দুর থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ঊর্মি
। একা একা হাঁটছে । যাবে? না, একটু যাওয়াই যায় । তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে একটা প্যান্ট পড়ে গায়ে ভালো একটা টি-শার্ট
পড়ে নেমে গেলো মেয়েটার কাছে । মেয়েটা সোহানকে দেখেই বলল, “হাই! কেমন আছো?” সোহান বলল,
“হ্যাঁ ভালো । তুমি?” মেয়েটা বলল, “এইতো, আলহামদুলিল্লাহ ভালো ।” সোহান জিজ্ঞেস করলো,
“একা একা হাঁটছ যে?” মেয়েটা বলল, “আসলে তেমন কারো সাথে এখনও সেভাবে পরিচয় হয় নি তো,
তাই?” “ আমার সাথে তো হয়েছে ।” মেয়েটা হেসে বলল, “হ্যাঁ তা হয়েছে, কিন্তু, আপনার অসুবিধে
নেই তো?” সোহান বলল, “যাব তাক হে যান, কোন অসুবিধা নেই ।” মেয়েটা আবার খিল খিল করে
সেই মিষ্টি হাসিটা হেসে উঠলো । তারপর বলল, “চলো যাই ।” দুজনে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করতে
লাগলো ।
৫
এদেরকে একটু একা ছেড়ে দেই, দেখে আসি সাকিব আর ইকবালকে
। সাকিব ক্লাস শেষ হবার পরও বেড়িয়ে এলো ইকবালের সাথে । তখনই দেখল সুমি দরজার সামনে
দাড়িয়ে । সাকিব বলল, “দোস্ত, তুই যা তাইলে ।” ইকবাল কিন্তু গেলো না । সাকিব চলে গেলে
অপেক্ষা করলো অপেক্ষা করলো রাইসার । রাইসা ওদেরই
সেকশনে ।
“তারপর বলো , এই পরের সেমিস্টারেও এক সেকশনে আমাকে না পেলে কি হবে?”-
সুমির প্রশ্নের জবাবে সাকিব বলল, “উম, ভেবে দেখা যাবে তখন ।” সুমি আর সাকিব পুকুর পাড়ে
একটা বটতলার চারপাশে ঘেরাও দেয়া ইটের ওপর বসে । এই যায়গাটা বটতলার চেয়ে প্রেমতলা নামেই
বেশি পরিচিত । কারণ সব কাপলরা এই বটতলাতেই বেশিরভাগ সময় কাটায় । একেকজনের একেক ধরণ
। কেউ কাঁধে মাথা রেখে প্রেম করে, কাউ হাতে হাত ধরে । কেউ আবার কথার মাঝে মারামারিও
করে, জানা নেই বিয়ের পর এদের হাল কি হবে । সাকিব আর সুমির প্রেমটা আবার অন্যরকম । বেশিরভাগ
দিনই ও সুমির সাথে এখানে পড়াশুনো করে । তবে আজ সেই বেশিরভাগ দিনের একটি নয় । আজ ওদের
অনলি রোমান্স করার দিন । সুমি বলল, “আচ্ছা তুমি কি জেসিকে দেখেছো?” সাকিব জিজ্ঞেস করলো,
“কোন জেসি? সোহানকে পছন্দ করে যে মেয়েটা?”
- “হ্যাঁ ” বলল সুমি ।
- “আমি ওকে দেখে কি করবো? আমি তো শুধু তোমাকে দেখি
।”
হেসে উঠলো সুমি । তারপর বলল, “ঢং, ক্লাসে কতো মেয়েকেই
তো দ্যাখো ।” বলেই সুমি সাকিবের কাঁধে মাথা রাখল ।
- “তা হঠাৎ সুমির প্রসঙ্গ এলো কেন?”
- “আরে, ও তো প্রায়ই আমাদের সাথে কথা বলতো সোহানের
ব্যাপারে জানতে চাইতো, কাল থেকে কেন যেন আর আসে না ।” বলল সুমি
- “ও, হয়তো সোহানকে ছেড়ে অন্য কাউকে ধরেছে ।”
- “আরে না, তা কেন হবে । ও তো সোহানের জন্য পাগল
ছিল ।”
- “কি জানি, মেয়েদের কথাবার্তার তো কোন ঠিক
ঠিকানা নেই ।” ইয়ার্কি করে বলল সাকিব
।
সুমি সাকিবের কাঁধ থেকে মাথা সরিয়ে রাগি দৃষ্টিতে
সাকিবের দিকে তাকিয়ে মেজাজি গলায় বলল, “কি বললা তুমি!”
সাকিব হেসে বলল, “আরে, তোমাকে বলি নি । আমার বেবিটাতো
সবার থেকে ডিফারেন্ট ।” সুমি খুশিতে গদ গদ
হয়ে উঠলো । তারপর সাকিবের হাত ধরে সাকিবের কাঁধে মাথা রাখল । বলল, “আচ্ছা তোমার
এই সোহান বন্ধুটা এমন কেন?”
“এমন কেন তা আমি কি করে বলবো?” বলে উঠলো ইকবাল
। ওরা গিয়েছে রমনা পার্কে । বিস্ববিদ্যালয় থেকে খুব বেশি দূরে না । ওদেরও একই টপিক,
জেসি আসছে না, তবে কি জেসি সোহানকে ছেড়ে দিলো নাকি । রাইসা আবার প্রশ্ন করলো, “তোমার
এই ফ্রেন্ডটার মধ্যে কোন রস কস নাই ।”
- “কে বলছে? আমাদের সাথে তো ভালোভাবেই মেশে ।”
রাইসা বলল, “আচ্ছা, ছেলেটার কোন সমস্যা নাই তো?”
- “সমস্যা মানে?” প্রশ্ন করলো ইকবাল ।
- “মানে ও আবার গে না তো?”-প্রশ্ন করলো রাইসা ।
ওদিকে সুমিরও একই প্রশ্নে অট্টহাসি হেসে উঠলো সাকিব
। তারপর বলল, “আরে না, কি সব যে বলো না । না ও ওরকম না মোটেও ।”
- “তারপরও সাবধানে থেকো । এ যুগে কতো অদ্ভুত জিনিস
দেখি বাবা!”-একপ্রকার সোহানের প্রতি বিরক্ত প্রকাশ করেই কথাটা বলল সুমি ।
- “আচ্ছা বাদ দাও তো এসব উল্টো পাল্টা কথা । রোমান্সের
কথায় আসো ।”
ইকবালের একই কথায় ইকবালের কাঁধে মাথা রাখল রাইসা
। বলল, “আচ্ছা যাও বাদ দিলাম । আচ্ছা তুমি আমাকে বিয়ে কবে করবে?”
এবার আসি সোহানের কাছে । ওদের মধ্যে এখনও সম্পর্কটা
সেরকম গভীরে যায়নি । দুজনে একটা মাটিতে চিত
হয়ে পড়ে থাকা নারকেল গাছের ডালের ওপর বসলো । দুজনের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ১ হাত । ঊর্মি
সোহানকে বলল, “আচ্ছা, এই নারকেল গাছটার কি হয়েছিলো? আগের সেমিস্টারেও তো দেখেছিলাম
।”
- “ঝড়ে পড়ে গেছে সপ্তাহ দুয়েক আগে ।”- জবাব দিলো সোহান
- “ও । আচ্ছা ।”
- “একটা প্রশ্ন করবো?”
- “হ্যাঁ অবশ্যই বলো ।”
- “গতকাল তুমি বললে হল পাওনি দেখে কোন আত্মীয়ের
বাসা থেকে আসতে তোমার দেরি হয়ে গিয়েছিলো । তাহলে ১ম সেমিস্টার কোথায় ছিলে?”
ঊর্মি হালকা হেসে বলল, “ও, এই কথা । ১ম সেমিস্টারে
আমি এখানে একটা বাসায় ভাড়া ছিলাম । কিন্তু একটু বেশিই ভাড়া ছিল, তার ওপর ছিলো বুয়ার
ঝামেলাও । এজন্য এই সেমিস্টারে হলের জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলাম ।”
সোহান আর কিছু বলল না । ঊর্মি তখন উঠে দাড়িয়ে বলল,
“আচ্ছা, আমি তাহলে যাই? অনেকক্ষণ গল্প করলাম ।” সোহানও উঠে দাঁড়ালো হাসিমুখে জবাব দিলো,
“ঠিক আছে ।” যাবার আগে মেয়েটা বলল, “তোমার আমার পরিচয়ের শুরুটা কতো অদ্ভুত, তাই না?”
- “কেন?”-প্রশ্ন করলো সোহান ।
- “এইযে, সবার পরিচয়ের শুরু হয় আপনি দিয়ে, আর আমাদের তুমি দিয়ে ।”- কথাটি বলেই মেয়েটা ওখান থেকে
চলে গেলো । সোহান মেয়েটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে আবার তাকিয়ে রইল । শেষ কথাটা বলার সময়
মেয়েটা কেমন লজ্জা পেলো না? তবে কি মেয়েটাও সোহানক……… । ধুর! কি সব ভাবছে । সবই কেবল
নিজের সাহিত্যিক মনের কল্পনা ভেবে সেখান থেকে হোস্টেলের দিকে ফিরতে লাগলো সোহান ।
৬
কিছুদুর
হাঁটতে হাঁটতে এসেই দেখা নিলয়ের সাথে নিলয় খুব সম্ভবত মাত্র ঘুম থেকে উঠে ক্যাফে
থেকে ব্রেকফাস্টটা করে এলো । সোহান নিলয়কে দেখে নিলয়ের কাছে গেলো, নিলয়ও সোহানকে দেখে
দাঁড়ালো সোহানের জন্য । কাছে যেতেই নিলয় জিজ্ঞেস করলো, “কিরে? অবশেষে গার্লফ্রেন্ড
পাইলি নাকি?”
- “মানে?” প্রশ্ন করলো সোহান ।
- “দুদিনের মধ্যেই দেখি নতুন মেয়ের সাথে ভালোই
ওঠা বসা চলছে!” ইয়ার্কি করে বলল নিলয় ।
সোহান হেসে বলল, “আরে ধুর, কিছুই না। জাস্ট ফ্রেন্ড
।”
- “জাস্ট ফ্রেন্ড থেকে বেষ্ট ফ্রেন্ড পড়ে গার্ল
ফ্রেন্ড পড়ে বউ, এই তো নিয়ম নাকি?”
কথাটা শুনে সোহানের ভালো লাগলো বটে, কিন্তু বিরক্ত
হয়েছে এরকম একটা ভাব ধরে হাসিমুখে বলল, “ধুর, কি সব যে বলিস না । আমার দ্বারা এসব প্রেম
সম্ভব না ।”
- “কেন? কোন গোপন রোগ নাকি গে?” বলেই হেসে দিলো
নিলয় । সোহান ইয়ার্কির ছলে নিলয়কে একটা হালকা করে ঘুষি মেরে বলল, “মাইর খা তুই । শালা!
তোর দোস্তো হিমেলেরও তো গার্ল ফ্রেন্ড নাই । ও কি গে হয়ে গেলো নাকি তাইলে? নাকি রোগী
হয়ে গেলো?” নিলয় ভ্রু কুঁচকে বলল, “কে বলেছে তোকে? হিমেলের গার্ল ফ্রেন্ড আছে তো ।
যদিও এখনও ওয়ান সাইড লাভ, প্রোপোজটাই করতে পারে নাই ।”
- “তাই নাকি? কই আমাকে তো বলে নাই? নাম কি?”- জিজ্ঞেস
করলো সোহান ।
- “তুই ভালো করে চিনিস । রোজ সকালে ক্লাসে আসবার
সময় যে তোর সাথে কথা বলার জন্য এগিয়ে আসে ।” হালকা হেসে বলল নিলয় ।
- “কে জেসি!” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো সোহান ।
- “হ্যাঁ ।”
- “ভাই! হিমেলের লাইফ শেষ । এমন মেয়েকে কি করে
পছন্দ করে ও?”
- “কি জানি । ওর মন চেয়েছে । যাক গা, ওর তো তাও
ক্রাশ আছে, তোর তো তাও নাই, তার ওপর তুই বলিস তোর নাকি প্রেম করার ইচ্ছা জাগে না
। ক্লাসের বেশিরভাগ ছেলে মেয়ে ইয়ার্কি করে তুই গে কি না ।” বলেই হেসে উঠলো নিলয়
।
সোহান কষ্ট পেলো । সিঙ্গেল হওয়া কি অপরাধ? মানুষ
এমন কেন? সিঙ্গেল আর প্রেম করার ইচ্ছে নেই
বলে এরকম উল্টাপাল্টা কথা বলবে? মুখটা এক মুহূর্তে গোমড়া হয়ে গেলো সোহানের । নিলয় সোহানের
দিকে তাকিয়ে বলল, “দোস্ত, তোকে আমিই শুধু, বললাম, তুই আবার কাউকে বলিস না । পড়ে ওরা
আমার ওপর রাগ করবে ।” সোহান কষ্টটা আটকে রেখে হালকা হাসিমুখে বলল, “আরে, বলার কি আছে
এসব ।”
রাতের কথা । খুব সম্ভবত ১০টার দিকের হবে । সোহান
সকালে নিলয়ের বলা কথাটা প্রায় ভুলে গেছে বললেই চলে । বসে বসে লিখছিল নিজের লেখা গল্প,
লাভ ডট কম । সাকিব একটু বাইরে গেছে । ওর তো বাইরে যাওয়ার কারণ একটাই, সুমির ফোন । ইকবাল
রুমে বসেই কথা বলছে ।
- “হ্যাঁ বাবু, তুই খাইছো?.....................না
শাহজাদী, একটু পরেই যাবো…………আচ্ছা রানী, আমাদের বিয়ের পর কয়টা বাবু হবে………তোমার মতোই
কিউট হবে তাই না…………ধুর! আমি কি কিউট নাকি……।”
এমনিতেও অন্যান্য দিন ইকবালের নানাম অসহ্যকর কথাবার্তা
সহ্য করতে হয়, তার ওপর আজ শুরু করেছে বাড়তি ন্যাকামো । সোহান বিরক্ত হয়ে হালকা মেজাজ
দেখিয়ে বলল, “ওই, যা, তো তুই, বাইরে যেয়ে কথা বল ।” ইকবাল সোহানের দিকে ফিরে তাকাতে
যাচ্ছিলো, এমন সময় রাইসা বলল, “এই, কে কথা বলল, সিঙ্গেল সোহান না?” ফোনটা লাউড স্পিকারে
না থাকলেও কথা কিছুটা শোনা যায় । সোহান সেটা শুনতে পেরে পেছন ফিরে তাকাল । ইকবাল কিছু
বুঝে ওঠার আগেই সোহান ইকবালের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে কানে নিয়ে রাগ দেখিয়ে এক দমে
বলল, “হ্যাঁ আমি সিঙ্গেল সমস্যা তোমার? ফাজিল মেয়ে কোথাকার, ভদ্রতা সভ্যতা কিচ্ছু নাই?
লজ্জা শরম কিচ্ছু নাই? বাসায় কি কিছু শেখায় নাই? আমি তোমার কোন বাড়া ভাতে ছাই দিছি
যে তুমি আমাকে নিয়ে এমন বলো! সাহস পাও কি করে!
সাহস থাকে তো একদিন সামনে এসো, থাপ্পড় দিয়ে বোঝায় দেবো সিঙ্গেল থাকা কি আর রিলেশনশিপে
থাকা কি! কি ভেবেছো ইকবালের গার্ল ফ্রেন্ড বলে কিছু বলবো না? ওই কথা ভেবো না । নেক্সট
টাইম যদি আর এসব কথা শুনেছি, তাহলে তোমার এই ভার্সিটিতে পড়াই আমি বন্ধ করে দেবো ।”
বলেই সোহান ইকবালের বিছানার ওপর ফোনটা ছুঁড়ে টেবিলে এসে ধপ করে বসে পড়লো । ইকবাল একদম
মাথায় হাত দিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিল । সোহানকে যে আটকাবে, সে সুযোগটাও পায় নি
। তার ওপর যা যা বলে ফেলেছে, এরপর আটকালেও রাইসাকে কি বলবে তা ভেবে আর আটকানোই হয় নি
সোহানকে । সোহান ফোন ঢিল দিয়ে ছুঁড়ে মারতেই ইকবাল কিছুক্ষণ সোহানের দিকে তাকিয়ে ফোন
হাতে নিলো । তারপর ফোন কানে নিতেই দেখলো, রাইসা কাঁদছে । ইকবাল কম্পিত কণ্ঠে যেই বলতে
যাবে, “হ্যালো!” বলতে না বলতেই চেঁচিয়ে রাইসা বলল, “তোমার সাথে ব্রেকআপ! আর কথা বলবা
না!” ইকবাল ফোনটা রেখে সোহানের দিকে তাকাল । তারপর রেগে গিয়ে বলল, “তুই কি করলি এটা
সোহান!” সোহানও পাল্টা রাগ দেখিয়ে বলল, “ঠিক করেছি । মানুষের পার্সোনাল ব্যাপার নিয়ে
কথা বলতে যাবে কেন?” ইকবাল বিছানা থেকে নেমে দাড়িয়ে সোহানে দিকে এগিয়ে এসে বলল, “নিজে
সিঙ্গেল বলে খুব হিংসা হয়!” সোহানও উঠে দাড়িয়ে কষ্ট নিয়ে বলল, “ইকবাল! তুইও!” ইকবাল
কিছু না বলে সোহানকে একটা চড় মেরে বসলো । সোহানও পাল্টা ইকবালকে একটা ঘুষি মারল । এরপর
ইকবাল শুরু করলো । শুরু হয়ে গেলো দুজনের মধ্যে
মারামারি ।
৭
“আচ্ছা রাখি
তাহলে জান! লাভ ইউ! উমাহ!” বলে ফোনে আওয়াজ করে একটা চুমু খেয়ে ফোনটা কাটল সাকিব
। রুমে দিকে আসতে আসতে দেখা হিমেলের সাথে । সাকিব জিজ্ঞেস করলো, “কিরে! তুই এখানে?”
- “এইতো দোস্ত, কাজ ছিল একটু । আর তুই এখানে কি
করছিস!”
- “আরে, তেমন কিছুই না । ওই এমনি আরকি ।”
- “কেন ভায়া! গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে কি চলছে?”-
ইয়ার্কি করে বলল হিমেল । সাকিবও মুচকি হেসে উঠলো । বলল, “যাহ শালা! কি সব যে কস না
। যা তাহলে ।”
হিমেল চলে গেলো । সাকিব রুমে এসে দেখল, মেঝে শুয়ে
ইকবাল, আর ইকবালের দু পাশে পা ছড়িয়ে বসে ইকবালকে
মারছে সোহান । ইকবাল নিজেকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে । সাকিব যেয়ে আটকাল দুজনকে
অনেক কষ্টে থামাল । এরপর সাকিব মেজাজ দেখিয়ে দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কি শুরু করলি
তোরা! আজব!” ইকবাল প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “ও রাইসাকে উলটা পাল্টা কথা বলছে । এখন আমি রাইসারে কি বলবো তুই-ই বল! ব্রেকআপ হইয়া গেলো
আমার!” সাকিব সোহানের দিকে তাকিয়ে বলল, “সোহান! ঠিক করলি না কিন্তু এইসব! কেনো করলি
তুই!” সোহান বলল, “ওর গার্ল ফ্রেন্ড ভালো কথা, আমি সিঙ্গেল বলে খোটা দেবে কেন! সিঙ্গেল
বলে কি আমি মানুষ না!” ইকবালের কোথায় সোহানের বিরুদ্ধে সাকিব যেভাবে কথা শোনালো, সোহানের
কথায় কিন্তু সাকিব তেমন কিছু বলল না । সোহান অবাক হয়ে বলল, “কিরে! তুই এবার কিছু বলবি
না ইকবালকে!” সাকিব মাথা নিচু করলো । সোহান বলল, “ও, তারমানে তোর গার্ল ফ্রেন্ডও আমাকে
সিঙ্গেল বলে খোটা দেয়, তাই না!” সাকিব মাথা উচু করে বলল, “শুধু তাই না, ও তোরে গে-ও
বলে ।” সোহান ধপ করে বসে পড়লো চেয়ারে । ইকবাল বলে উঠলো, “আমার গার্লফ্রেন্ডও বলে ।”
সোহান কিছু বলতে পারলো না । সাকিব একটু পর বলল, “দ্যাখ সোহান, আমার মনে হয় কি, তুই
একটা রিলেশনশিপ কইরা ফেল । না পারোস তো অন্তত একটা মিথ্যা অভিনয় কর তুই রিলেশনে আছোস
। আর নাইলে…………।” থেমে গেলো সাকিব । সোহান মেজাজি গলায় বলল, “নাইলে কি! বল! নাইলে কি!
চুপ করলি কেন! না বল! তোদের তো গার্লফ্রেন্ড যা বলল তাই ঠিক । গার্লফ্রেন্ড যদি বলে
সূর্য আজকে উত্তরে উঠেছে তোরা বলবি তাও ঠিক । এখন চুপ করলি কেন! বল নাইলে কি!” ইকবাল
জবাব দিলো, “নাইলে আমরা রুম চেঞ্জ করবো ।” সাকিবও ওপর নিচ মাথা নাড়ল । সোহান কিছু বলল
না । চুপ্ করে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল ।
সকালে ঘুম থেকে উঠে সাকিব দেখল সোহান রুমে নেই
। না রুম চেঞ্জ করে নি, জিনিসপত্র সবই আছে, শুধু সোহানই নেই । এমনকি মোবাইলটাও ফেলে রেখে গেছে । সোহান বেড়িয়েছে
মোটর সাইকেল নিয়ে । হাতিরঝিল ব্রিজের ওপর দাড়িয়ে রইল মোটরসাইকেলটা রেখে । আজকে ক্লাস
আছে, কিন্তু ক্লাসে যাওয়ার মুডটা নেই ওর । এমন সময় একটা মেয়ে সোহানকে ডেকে উঠলো, “আরে
সোহান ।” সোহান দেখল , ঊর্মি দাড়িয়ে ।” অবাক হয়ে বলল, “একি ঊর্মি, তুমি এখানে! ক্লাসে
যাও নি!”
- “যেতে ইচ্ছে করলো না আজ ।”- বলল ঊর্মি ।
- “ও আচ্ছা । কিন্তু তোমার তো মিস হবে অনেক ক্লাস,
এমনিতেও প্রথম দিন আসো নি, আজ আবার ।”
- “ব্যাপার না । ম্যানেজ করে নেবো । তুমি কি করছো
ক্লাস বাদ দিয়ে?”
সোহান সত্যটা তো আর বলতে পারবে না, তাই সত্য কথা
গোপন করেই বলল, “তেমন কিছু না । গতকাল বিকেলে মোটরসাইকেলটা আনলাম তো, দেখছিলাম, কেমন
চলে । সাথে তেলটাও দিলাম আর কি ।” ঊর্মি একবার সোহানের মোটরসাইকেলের দিকে তাকাল । তারপর
বলল, “চালাতে পারো?” সোহান অট্টহাসি হেসে উঠলো
। ঊর্মি জিজ্ঞেস করলো, “একি, হাসছো কেন?”
- “মোটর
সাইকেল না চালাতে পারলে এখানে এলাম কি করে?”-
বলল সোহান । সোহানের কথা শুনে নিজের প্রতি লজ্জা পেয়ে মৃদু হেসে ঊর্মি বলল, “ও।” সোহান ঊর্মির দিকে
তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “যাবে নাকি আমার সাথে?”
ঊর্মি হেসে বলল, “আরে না না, আমার মোটরসাইকেলে
উঠতে ভারি ভয় লাগে ।” সোহান বলল, “আমার সাথে চলো, দেখবে, ভালো লাগবে ।” ঊর্মি নেগেটিভ
কিছু বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় সোহান বলল, “ভরসা
করতে পারো আমাকে ।” ঊর্মি সোহানের চোখে চোখ রাখল । তারপর রাজি হল । সোহান মোটরসাইকেলে
উঠে বলল, “আমার কাঁধে হাত রেখো, নয়তো পড়ে যাবে কিন্তু । বেশি ভয় লাগলে জাপটে ধরো ।”
ঊর্মি হেলমেট পড়ে সোহানের কাঁধে হাত রেখে মোটরসাইকেলে বসলো । এরপর সোহান মাথায় হেলমেটটা
পড়ে মোটর সাইকেল স্টার্ট করলো । এরপর দুজন ঘুরে বেড়াল ঢাকা ইউনিভার্সিটির আশপাশের এলাকা
। হাতিরঝিল থেকে পরিবাগ, শাহাবাগ, রমনা পার্ক,
বেইলি রোড, পুরনো পল্টন, বায়তুল মোকারম মসজিদ,
পড়ে আব্দুল গনী রোড দিয়ে দুপুরের দিকে ফিরে এলো ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে । মাঝে মাঝে সোহান ইচ্ছে
করে এমনভাবে মোটরসাইকেল চালিয়েছে, যে
ভয়ে ঊর্মি সোহানকে সত্যিই জাপটে ধরেছে । ভার্সিটির
প্রবেশ পথের সামনে ঊর্মিকে নামিয়ে দিলো সোহান । ঊর্মি হেলমেট খুলে সোহানের মোটরসাইকেলে লাগিয়ে রাখল । সোহান হেলমেট খুলে
জিজ্ঞেস করলো, “কেমন লাগলো?” ঊর্মি
বলল, “খুব ভালো ।”
- “ঠিক
আছে, যাও তাহলে, আমি মোটরসাইকেলটা গ্যারেজে
রেখে আসি ।”
- “তোমাকে একটা কথা বলবো ।”-হঠাৎ বলল ঊর্মি ।
- “হুম কি বলবে, বলো!”- জিজ্ঞেস করলো সোহান ।
- “আজ না, কাল ক্লাসে বলবো । ক্লাসে একটু তাড়াতাড়ি
এসো কাল ।” বলেই চলে গেলো ঊর্মি । সোহান কিছুক্ষণ দাড়িয়ে ভাবল, কাল কি এমন আছে যে কালই বলবে? এমন সময় মনে পড়লো কাল তো ১০মে, সোহানের জন্মদিন
। তার মানে কি বলতে পারে তা-ও সোহান কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো । লজ্জায় হেসে উঠলো সোহান
। তারপর আবার নিজেকে বোঝাল, শুধু শুধু এসব ভেবে লাভ নাই । যদি না বলে, তখন্ন আবার কষ্টের
সীমা থাকবে না । সোহান হেলমেট পড়ে গ্যারেজের
দিকে এলো ।
৮
হোস্টেলে আসতেই ইকবাল আর সাকিব দুজনেই সোহানকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইলো আগের দিনের কাজের জন্য ।
ইকবাল বলল, “সরি ভাই! কিছু মনে করিস না! ভুল
হইয়া গেছে ।” সাকিবও বলল, “সরি রে, মাইন্ড করিস না ।” সোহান বলল, “আরে ব্যাপার না,
বন্ধুত্বের মাঝে এরকম একটু আধটু ঘটেই ।” তারপর সোহান টেবিলে যেয়ে বসতেই দেখল, ওর লাভ
ডট কম গল্পের খাতাটা টেবিলে পড়ে আছে । সোহান সাকিব আর ইকবালের দিকে
ঘুরে তাকাল । সোহান কেন তাকিয়েছে, তা
বুঝতে পেরে সাকিব বলল, “সরি ফর দ্যাট টু, আসলে
আমি আর ইকবাল একটু দেখছিলাম । ভালোই লিখেছিস,
নতুন একটা ওয়েবসাইডও অ্যাড করেছিস দেখছি গল্পে, যা তোর জীবনে নেই । প্রেম ।” সোহান
একটু হেসে বলল, “হুম । কেন, বাহুবালির ডিরেক্টর তো আর বাহুবালি ছিলেন না, তেমনি আমার
জীবনেও তো প্রেম নেই । তাই বলে বানাতে বা লিখতে
তো অসুবিধা নেই ।” ইকবাল তখন বলল, “কিন্তু প্রেমটা গড়তে কিন্তু খুব কষ্ট হয় ।” সোহান
একটা হতাশার দম ফেলল ।
বিকেলের দিকে সোহান ঊর্মির সাহায্যে রাইসাকে ক্যাফেতে
আনলো সোহান । তারপর ঊর্মি কিছুক্ষণ রাইসার
সাথে কথা বলল । রাইসা জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি আমাকে এখানে আনলে কেন? কি বলার ছিল বলো, আমার তাড়া আছে ।” ঊর্মি একটু হেসে বলল,
“হ্যাঁ বলবো । তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো ।” রাইসা হালকা বিরক্তের সাথেই বলল,
“কি জিজ্ঞেস করবে করো ।”
- “তোমার রাগ হলে কি করো?” জিজ্ঞেস করলো ঊর্মি
।
- “এ আবার কেমন প্রশ্ন!” ভ্রু কুঁচকে ঊর্মির দিকে
তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো রাইসা ।
- “আহ! যা বলছি, তাই জবাব দাও না!”
- “কিছুই না, জিনিস ভাংচুর করি ।” আবারো বিরক্তের
সাথে জবাব দিলো রাইসা ।
- “তারপর, ধরো আমি তোমার বোন, অনেক বড় একটা ভুল
করে ফেললাম আমি, তুমি কি করবে?”
রাইসা বিরক্ত হয়ে মোবাইলে টাইমটা চেক করলো । তারপর
জবাব দিলো, “কিছুই না, কিছুদিন রাগ করে থাকবো, পড়ে ঠিক হয়ে যাবে ।”
- “হুম, গুড । এবার বলো, আমি যদি তোমার বয়ফ্রেন্ডের
মোবাইল দিয়ে তোমাকে গালিগালাজ করি, তোমার কেমন লাগবে?” প্রশ্ন করলো ঊর্মি । রাইসা ঊর্মির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই তুমি কে বলতো! কখন থেকে এসব উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে যাচ্ছো! মতলব কি তোমার?”
- “আর একটু ওয়েট করো, সবটা জানতে পারবে । এবার
জবাবটা দাও ।”
- “কিছুই না, শুধু তোমার সাথে আমি মিশবো না!” জবাব
দিলো রাইসা ।
- “তোমার বয়ফ্রেন্ডকে কিছু বলবে না?” জিজ্ঞেস করলো
ঊর্মি । রাইসা বিরক্ত হয়ে জবাব দিলো, “করেছো তো তুমি! তাহলে বয়ফ্রেন্ডকে কেন কিছু বলবো?
এমন সময় ইকবাল আর সোহান এলো রাইসার সামনে । সোহান
এসেই বলল, “তাহলে কেন ওর সাথে কথা বলছো না!” রাইসা উঠে দাঁড়ালো । ঊর্মি উঠে রাইসার
পাশে যেয়ে বলল, “আর রাগ কোরো না । তুমি জানো, ও আজকে ফাসি দিতে যাচ্ছিলো তোমার জন্য!”
রাইসা কাঁদো কাঁদো হয়ে ইকবালের কাছে যেয়ে বলল, “হায় আল্লাহ! কি ইকবাল! কি এসব!” ইকবাল
মাথা নিচু করে বলল, “তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থেকে কি লাভ ।” ইকবাল আর রাইসা যখন কথা
বলায় ব্যাস্ত, তখন সোহান গেলো ঊর্মির কাছে । ফিসফিস করে ঊর্মিকে বলল, “ও আবার কখন ফাসি
দিলো!” ঊর্মি বলল, “আরে, এসব ব্রেকআপ রোগ সারানোর ওষুধ!” সোহান বলল, “ও আচ্ছা । আমার
মনে হয় কি, এদের একটু একা ছাড়া উচিৎ । কি বলো?”
- “আমাদেরও একটু এখন একা হয়ে যাওয়া উচিৎ, কি বলো?” সোহানের দিকে তাকিয়ে বলল ঊর্মি
। সোহান ঊর্মির কথা শুনে ঘাবড়ে গেলো । মেয়েটা
এতো রোমান্টিক কথা বলে না,
যে সোহান নিজেই কনফিউসড, মেয়েটা সোহানের প্রেমে
পড়েছে নাকি পড়ে নি । ঊর্মি রাইসাকে বলল, “আচ্ছা,
তোমরা কথা বলো তাহলে, আমরা যাই!” রাইসা
ডানে মাথা কাত করলো । যাবার সময় সোহান ইকবালকে
চিমটি কেটে ফিসফিসিয়ে বলল, “চালিয়ে যা মামা!” সোহান আর ঊর্মি চলে গেলে ইকবাল আর রাইসা টেবিলে বসে পড়লো । ইকবাল বলল, “সরি!”
রাইসা বলল, “সরি তুমি বলবে কেন? যার বলার কথা সেই তো বলল না! কি বদমাইশ!” ইকবাল একটু দম ফেলে বলল, “আচ্ছা, বাদ দাও । তারপর বলো,
তোমার কি খবর মহীয়সী!”
- “তোমাকে অনেক মিস করছিলাম ।” বলল রাইসা ।
- “আমিও । তোমার গলার আওয়াজ না শুনতে পেয়ে প্রায়
অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম ।” বলল ইকবাল ।
- “ঠিক আছে, আজ আমরা তাহলে সারারাত একসাথে কাটাবো
। রাত ১২টা-১টা পর্যন্ত ।
এদিকে ঊর্মির একই প্রশ্নের জবাবে অবাক হয়ে সোহান
বলল, “রাত ১২টা! আর ইউ ক্রেইজি! কাল ক্লাস আছে! তারপর এতো দেরি করে বাইরে আমাদের দেখলে
পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে ।” দুজনে বসে রমনা পার্কে কথা বলছিল । ঊর্মি বলল, “আচ্ছা, একসাথে
আজ অনেকটা রাত কাটাই?”
- “ঠিক আছে ।” জবাব দিলো সোহান ।
৯
- “আচ্ছা, তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?” জিজ্ঞেস করলো
ঊর্মি ।
- “আমার মা, বাবা, আর ছোট ভাই ।” জবাব দিলো সোহান
।
- “ওয়াও, তোমার ভাই কেমন?”
- “কেমন বলতে?
- “মানে দুষ্টুমি করে, নাকি শান্ত থাকে?”
- “করে দুষ্টুমি, তবে কখনো লিমিট ক্রস করে না ।
সময়সাপেক্ষ বুঝে দুষ্টুমি করে ।” হালকা হেসে জবাব
দিলো সোহান ।
- “ওয়াও, তোমার ভাই তো দেখি তোমার চেয়েও স্মার্ট
।” বলল ঊর্মি ।
সোহান হেসে
একটু নড়ে বসে বেঞ্চের ওপর হাত রাখতেই হাত পড়লো ঊর্মির হাতের
ওপর । ঠিক তখন দুজনে হাতের দিকে তাকাল । তারপর দুজন দুজনের দিকে । দুজনের চোখে একে অপরের প্রতিচ্ছবি
দেখতে পাচ্ছে । সেই সময় বাতাস বইতে শুরু করলো । সন্ধ্যা নামার ঠিক আগ মুহূর্তে শুধু
দুজনে বসে দুজনের দিকে তাকিয়ে । ধীরে ধীরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো । বেঞ্চের ওপর একটা
ছাতার মতো কিছু থাকার দুজনে ভিজল না, তবে আশেপাশে লোকজন দৌড়ে যার যার মতো চলে গেলো
। পার্কে শুধু সোহান আর ঊর্মি । ধীরে ধীরে ঊর্মি সোহানের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো । সোহানও
ধীরে ধীরে ঊর্মির দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো দুজনে প্রায় যখন কাছাকাছি, ঠিক তখন সোহান অন্য
দিকে তাকিয়ে বলল, “অ্যাসাইনমেন্ট করেছো?” ঊর্মিও অন্যদিকে তাকিয়ে দূরে সরে গেলো । বলল,
“ইয়ে মানে, না । তুমি?” সোহান জবাব দিলো,
“না ।” দুজনে কিছুক্ষণ চুপ । তারপর সোহান জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা ঊর্মি, তোমার কি আমার
প্রতি কোন দুর্বলতা কাজ করে?’ হঠাৎ সোহানের এমন প্রশ্নে ঊর্মি সোহানের দিকে তাকাল ।
ঊর্মি ভয় পায় নি! কিন্ত চেহারাটা দেখে মনে হচ্ছিলো ঊর্মি হয়তো নেগেটিভ কিছু বলবে ।
আর যাই হোক, সোহানের অন্তত অমনটা মনে হচ্ছিলো । ফ্রেন্ডশিপটা নষ্ট হয়ে যাবে এই ভেবে
সোহান হেসে উঠে বলল, “আরে, মজা করলাম । আমার তো মেয়েদের প্রতি কোন দুর্বলতাই কাজ করে
না ।” ঊর্মি হেসে উঠলো । একটু পর বৃষ্টি থেমে গেলো । ঊর্মি উঠে দাড়িয়ে
তখন বলল, “আমার যাওয়া লাগবে , চলো যাই?”
- “এখনই?” জিজ্ঞেস করলো সোহান ।
- “আচ্ছা, তুমি যাও তাহলে, আমি পড়ে যাবো ।” বলল
সোহান ।
- “আচ্ছা ঠিক আছে ।” ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে কথাটা
বলল ঊর্মি । তারপর যেতে গিয়েও হঠাৎ থেমে বলল, “কাল ক্লাসে তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু!” সোহান
ঊর্মির দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে!” ঊর্মি চলে গেলো । সোহান বেঞ্চের পাশেই একটা গাছের
সাথে মাথা ঠেকিয়ে সামনের দিকে তাকাল । সূর্য ডুবে গেছে । আকাশে লাল বর্ণের দাগগুলো
এখান থেকে দারুন দেখা যাচ্ছে ।
রাত প্রায় ১২টার দিকের কথা । রুমে সুমির সাথে কথা
বলছিল সাকিব । “আচ্ছা জানু, না ওরা এখনও আসে নি । হুম আমি রুমে একা । ঠিক আছে, থাকো তাহলে, ওকে, লাভ ইউ, উমাহ ।” বলে ফোনটা রাখল । তারপর
উঠে এসে একবার বারান্দা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল । নিজেই নিজেক বলল, “কি ব্যাপার! সোহান
আর ইকবাল এতো রাত পর্যন্ত কি করে?” তারপর কিছুক্ষণ আশপাশে চোখ বুলিয়ে রুমে ঢুকে একটা
বই বের করে পড়তে লাগলো সাকিব ।
“কি মামা! যাইবেন না! রাইত হইয়া গেছে তো! ১২টা
বাজে! মামা কি নেশা করছেন নাকি!” চোখ খুলে সোহান দেখলো বছর ১২এর একটা ছেলে ডাকছে সোহানকে
। সোহান উঠে বসলো । জিজ্ঞেস করলো, “কয়টা বাজে?” ছেলেটা বলল, “১২ টার বেশি বাজে মামা
।” সোহান একটা হাই তুলে জিজ্ঞেস করলো, “তুই কে?”
- “টোকাই মামা, দিনের বেলায় লোকজন যা ফালায় থুইয়া
যায়, রাইতে সেইগুলা কুড়াইয়া নিয়া যাই । আপ্নেরে দেখলাম শুইয়া আছেন তাই ডাকলাম ।” জবাব
দিলো ছেলেটা । সোহান কিছু বলল না । ছেলেটা তখন জিজ্ঞেস করলো, “মামার কি শত্রু আছে?”
সোহান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “কেন?” ছেলেটা বলল, “জানি না, তয় খেয়াল করতেছিলাম, কেডায়
জানি আপনেরে আড়াল থেইকা দেখতেছিল ।” সোহান আশপাশে তাকাল । কাউকে না দেখে ছেলেটা ভুল
দেখেছে ভাবল । তারপর ছেলেটাকে সোহান জিজ্ঞেস
করলো, “খাওয়া দাওয়া করেছিস?”
- “না মামা, এই যা কুড়াইয়া পামু তা বেইচা যা টাকা
পামু তাই দিয়া সকালে খামু ।” জবাব দিলো ছেলেটা । সোহান ছেলেটার দিকে একবার তাকাল ।
তারপর পকেট থেকে ১০০টা বের করে ছেলেটার হাতে দিয়ে বলল, “নে কিছু কিনে খাস ।” ছেলেটা
টাকা পেয়ে খুব খুশি । সোহানকে ধন্যবাদ দিয়ে ভরিয়ে দিয়ে বলল, “যাই মামা, ভালো থাইকেন
।” সোহান ছেলেটার মাথায় হাত রেখে আদর করে দিয়ে বলল, “আচ্ছা যা ।” ছেলেটা চলে গেলো ।
সোহান উঠে দাঁড়ালো । ভার্সিটির গেইট দিয়ে ঢোকার সময় দারোয়ান জিজ্ঞেস করলো, “কি মামা,
বাইরে কি চলে?” সোহান মধ্যমা আঙুল দেখিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো । এতো রাতে বাইরে কেউ থাকে
না । এমনকি গেইটের দারোয়ান ছাড়া বাকি দারোয়ানরাও রেস্ট নেয় । কিছু ছেলেপেলে থাকে, র্যাগ
ট্যাগ করে । সোহান রুমের দিকে যাচ্ছিলো । শটকাটে যাওয়ার জন্য মাঠের মাঝখান দিয়ে যেতে
হবে ওকে আর মাঠের মাঝখানে আছে সেই পুকুর যার পাড়ে বসে সোহান আর ঊর্মি কথা বলেছিল যেতে
যেতে সোহানের মনে হল পুকুর থেকে কেউ চেচাচ্ছে “হেল্প! হেল্প!” পানি প্রায় ডুবতে ডুবতে
কথাগুলো বলছিল, তাই বেশি দুর অবধি কথা কারো কানে পৌঁছায় নি । সোহান পুকুরের কাছে গেলো
। বৃষ্টিতে পুকুরের গভীরতা অনেক বেড়েছে । সোহান দেখল, সত্যি কেউ বিপদে পড়েছে । হাত
দিয়ে কোনোরকমে ভেসে আছে । সোহান সাতার জানতো, কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাড়াতাড়ি পানিতে
নেমে গেলো । সাতার কেটে লোকটা কাছে যেতেই লোকটা জ্ঞান হারাল । তারপর অনেক কষ্টে পাশেই
ভেসে থাকা একটা ডালের ওপর লোকটাকে ধরল সোহান । ভালো করে খেয়াল করে দেখল, এটা ইকবাল
। সোহান ইকবালকে ডালের সাহায্যে ধরে ইকবালকে পাড়ে নিয়ে এলো । সোহান ইকবালকে বটতলার
নিচে এসে ইটের ওপর উপুড় করে শোয়াল । তারপর ইকবালের পিঠে চাপ দিতে লাগলো । ইকবালের মুখ
দিয়ে বেশ খানিকটা পানি বের হল । তারপর সোহান ইকবালকে সোজা করে শোয়াল । ইকবালের গালে
হাত দিয়ে কয়েকবার ডাকল, সাড়া পেলো না । সোহান ইকবালের বুকে চাপ দিয়ে কয়েকবার চেষ্টা
করলো, কিন্তু তাতেও কিছু হল না । এখন আর একটাই উপায় আছে । মুখে মুখ লাগিয়ে ইকবালের
শ্বাস প্রশ্বাস চালু করা ।
১০
সোহান সেটাই করলো । খানিক পর ইকবালের জ্ঞান ফিরল
। সোহান বলল, “ইকবাল, ঠিক আছিস?” ইকবাল কাশতে কাশতে উঠে বসলো । তারপর বলল, “আ, আমি পড়ে
গিয়েছিলাম না পুকুরে?”
- “হ রে ভাই । কি হইছিল?” জিজ্ঞেস করলো সোহান ।
- “আরে, বৃষ্টিতে পুকুরপাড় কাদায় ভরে ছিল, সেজন্য,
পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম ।” জবাব দিলো ইকবাল ।
- “চল রুমে যাই ।” সোহান ইকবালকে ধরে রুমে নিয়ে
গেলো । সাকিব দুজনকে ভেজা দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে? কি হয়েছে?”
সোহান জবাব দিলো, “ইকবাল পা পিছলে পুকুরে পড়ে গিয়েছিলো
।”
- “ও । তা একটু প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে পুকুরে হাবুডুবু
খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিলো হয়তো ।” ইকবাল ভেজা শরীর
নিয়েই মারতে চলে গেলো সাকিবকে । সোহান টাওয়েলটা হাতে নিয়ে বলল, “তোরা ঝগড়াঝাঁটি করতে
থাক, আমি ড্রেসটা চেঞ্জ করে আসি ।” বলেই সোহান ওয়াশরুমে গেলো ।
পরদিন সকালের কথা । সোহানের ক্লাস সাড়ে ৯টায় ।
সাকিব আর ইকবালের আজ ক্লাস নেই । সোহান ঘুম থেকে উঠে রওনা হল ক্লাসের উদ্দেশ্যে ৯টার
দিকে । অন্যান্য দিন মিনিট দশেক আগে রওনা হতো কিন্তু আজ এতো তাড়াতাড়ি যাওয়ার কারন ঊর্মি
যেতে বলেছে তাই । তার ওপর আজকে সোহানের বার্থডে । ভেবেছিলো ইকবাল আর সাকিব উইশ করবে,
কিন্তু ওরা তো সারারাত গভীর ঘুমে মগ্ন ছিল । এতো তাড়াতাড়ি নিজের সেকশনের সাথে দেখা
না হলেও আসবার সময় অন্যান্য সেকশনের ৩-৪জন পরিচিত আর বেশ অনেকজন অপরিচিত লোকেদের সাথে
দেখা । সবাই সোহানের কীভাবে যেন তাকিয়ে আছে । রাস্তা দিয়ে হঠাৎ একটা অপরিচিত প্রাণী
হেঁটে গেলে মানুষ যেভাবে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু প্রাণীটা আঘাত করতে পারে বলে কাছে যায়
না, এরকম করে তাকিয়ে আছে সবাই সোহানের দিকে । পরিচিত যারা ছিল, তাদের সাথেও দেখা হল,
সোহান তাদের “হাই! কি অবস্থা!” বলল, কিন্তু ওরা জবাব দিলো এমনভাবে যেন ওরা সোহানকে
দেখানোর জন্য কথা বলছে, কিন্তু বলতে ইচ্ছে করছে না ওদের । ওরাও বাকিদের মতো সোহানের
দিকে তাকিয়ে ছিল । সোহান ক্লাসে চলে এলো । ক্লাসে সোহানের সামনের মেয়েটা, মাইশা, সোহানকে
দেখে বেঞ্চ থেকে উঠে বাইরে চলে গেলো । কেন গেলো, বুঝল না সোহান । ক্লাসে আর কেউ আসে
নি এই মাইশা ছাড়া । সোহান অপেক্ষায় রইল ঊর্মির, কিন্তু ঊর্মির দেখা নেই । তাড়াতাড়ি
আসতে বলে নিজে এতো দেরি করছে কেন? সোহান উঠে বারান্দার দিকে গেলো । বারান্দায়ও যারা
ক্লাসের দিকে যাচ্ছে, তারাও সোহানের দিকে তাকিয়ে । কারো কারো ফিস ফিস করে বলা কথাও
শুনল সোহান । কেউ কেউ বলছে, “বাপরে! আমি তো বাপের জন্মেও জীবনেও শুনি নি!” কেউ কেউ
আবার বলছে, “ভাই আমি তো সোশ্যাল ডিসটেন্স মেইনটেইন করছি এর থেকে ।” কিছু বখাটে আবার
সরাসরি সোহানকে শুনিয়েই বলছিল, “আরে সিঙ্গেল! আমরা তো আগে থেকেই জানতাম তুই এমন ।”
কেমন! সোহানের মনে প্রশ্ন জাগলো । হয়েছে কি আসলে? সবাই সোহানকে দেখে এমন করছে কেন?”
একটু পর সোহান জেসিকে দেখল । জেসি সোহানের থেকে কয়েকহাত দুরেই ছিল । আজ জেসি সোহানের
দিকে তো এলোই না, উল্টো সোহানের দিকে ঘৃণার ভঙ্গিতে তাকিয়ে ক্লাসে ঢুকে গেলো । সোহানও
ক্লাসে ঢুকল, এবং ঢুকেই যা দেখল, তা দেখে ও অবাক । সোহানের সিট যেখানে, তার পেছনের
সিটটা আরও পেছনে সরানো হয়েছে, আর তার সামনে সিটটা আরও সামনে এগোনো হয়েছে । সোহানকে
দেখে পুরো ক্লাস থেমে সোহানের দিকে তাকিয়ে রইল । সোহান নিলয়কে দেখে নিলয়ের দিকে এগিয়ে
যাচ্ছিলো, নিলয় সোহানকে কাছে আসতে দেখে ভয়ে বলল, “ভাই, ক্কাছে আসিস না! প্লিজ! ভয় লাগে
তোরে দেখলে!” সোহান দূরে দাড়িয়ে রইল । একবার চারপাশে তাকিয়ে সবাইকে দেখল, সবাই সোহানের
দিকে তাকিয়ে । হয়েছে কি আজ? সোহান নিলয়কে জিজ্ঞেস করলো, “দোস্ত, বলনা কি হয়েছে?”
- “ভাই শোন, আজ থেকে তুই আমার সাথে কথা বলিস না
।” জবাব দিলো নিলয় ।
- আমি তোকে কি প্রশ্ন করছি আর তুই কি জবাব দিচ্ছিস?”
বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো সোহান ।
নিলয় আর কিছু বলল না । সোহান সে সময় খেয়াল করলো,
ক্লাসরুমে ঢুকেছে আলিয়া ম্যাম । সোহান নিজের সিটে গেলো । পাশে তাকিয়ে পেছনে তাকিয়ে
দেখল, ঊর্মির সিট এখনও ফাঁকা । এখনও ঊর্মি আসে নি । সোহান এও খেয়াল করলো, আলিয়া ম্যামও
সবার মতো সোহানের দিকে তাকিয়ে আছে । আলিয়া ম্যাম অন্যান্য দিনের মতো যথারীতি রোল কল
করলেন । সোহান বার বার পেছনের দিকে উরমিত সিটের দিকে কেন যেন তাকাচ্ছিল । নাম ডাকা
শেষে আলিয়া ম্যাম ডাকলো সোহানকে । এবারেও তৃতীয়বার সোহানের কানে কথা গেছে । আগের দুবার
সোহান পেছনের দিকে ঊর্মির সিটের দিকে তাকিয়ে ছিল বলে ম্যামের ডাক শুনতে পায় নি । ম্যাম
তখন সোহানকে বলল, “ও আর আসবে না । আমি ওকে বারণ করেছি । ও অন্য সেকশনে যাবার জন্য অ্যাপ্লিকেশন করতে গেছে ।” সোহান ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো, “কেন ম্যাম?” আলিয়া ম্যাম সোহানের
প্রশ্নের জবাব দিলেন না । কিছুক্ষণ থেমে বললেন,
“দ্যাখো সোহান, তুমি যদি নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারো, তাহলে এই ভার্সিটিতে থেকো, অন্যথায়
আমরা টিসি দিতে বাধ্য হবো । স্বাভাবিক? সোহান কি অস্বাভাবিক কাজ করলো?
১১
সোহান ম্যামকে জিজ্ঞেস করলো, “ম্যাম, হয়েছে কি
আসলে?” ম্যাম বিরক্ত হয়ে বলল, “ঢং কোরো না সোহান!” সোহান আর কিছু বলল না । ম্যাম সোহানকে
বসতে বলল । যাই হোক, ম্যামের মুখের ওপর তো আর কথা বলা যায় না । সোহান ভাবতে লাগলো,
এক রাতে হঠাৎ এমন কি হয়ে গেলো?
ক্লাস শেষে সোহান সবাইকে কতো করে জিজ্ঞেস করলো
কি হয়েছে, কেউই সোহানের সাথে কথা বলল না । যেখানে গ্রুপ ধরে সোহান আড্ডা দেয়, সোহান
যখনই ওদের কাছে যায়, ওরা তখনই এক সাথে উঠে অন্য দিকে হাঁটা শুরু করে । সোহান কিছুতেই
বুঝতে পারছে না হয়েছে কি । সোহান ঊর্মিকেও খুজল অনেক, কিন্তু পেলো না । অবশেষে হতাশার
সাথে নিজের রুমে এলো । রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে সোহান অবাক । ছিটকিনি দেয়া কেন? সাকিব
আর ইকবাল কোথায়? সোহান ভাবল হয় ক্যাফেটেরিয়াতে গেছে, আর না হয় নিজেদের গার্লফ্রেন্ডের
সাথে দেখা করতে গেছে । সোহান ভেতরে ঢুকল । এবার আরও অবাক সোহান । ভেতরে নেই ইকবাল আর
সাকিবের কোন জিনিস । একটু পর এই হলের কেয়ারটেকারের সাথে দেখা সোহানের । রুমের সামনে
বারান্দা দিয়েই যাচ্ছিলো । সোহান লোকটাকে আটকে বলল, “মামা, এই রুমে দুটো ছেলে ছিল ইকবাল আর সাকিব নামে, দেখছেন ওদের?” কেয়ারটেকার
লোকটাও সোহানের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আপনে যা কইরলেন, হেইয়া দেইখা আমি
তো অবাক! সাকিব আর ইকবাল তো হের লাইগাই চইলা গেছে ।” সোহান ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত হয়ে বলল, “আমি কি করেছিটা কি আসলে! সবার
হয়েছে কি! আমাকে দেখে কেন সবাই এমন করছে?”
কেয়ারটেকার লোকটা বলল, “আমি তো ফেসবুক চালাই না, তয় আমারে অন্য একখান পোলা দেখাইল ।
নাউযুবিল্লাহ, ওইসব দেখাও পাপ ।” বলেই কেয়ারটেকার লোকটা চলে গেলো । সোহান লোকটাকে কিছু
বলতে চাইলো, এমন সময় লোকটার একটা কথা সোহানকে আশার আলো দেখায় । ফেসবুক । সকাল থেকে
সোহান ফেসবুকে বসে নি । সোহান রুমে যেয়ে মোবাইলটা নিয়ে ডাটা অন করলো । সাথে সাথে মেসেজ
আর ফেসবুকের নোটিফিকেশন এসে ভরে গেলো । সোহান শুরুতে মেসেঞ্জারেই ঢুকল । শুরুতে সাকিবের
মেসেজ । সোহান ওপেন করলো । সাকিব লিখেছে, “তোরে আমার দোস্ত বলতেও কেমন জানি লাগতেছে
। ভালো থাকিস, কিন্তু প্লিজ, আমাদের লগে আর থাকিস না । তোর জন্য সুমি আমারে খারাপ ভাববে,
তাই আমি অন্য আসলাম, নিজে পারলে একটা ডাক্তার দেখা ।” এরপর ইউ ক্যান্ট রিপ্লাই টু দিস
কনভারসেশন । সোহান ব্যাকে যেয়ে দেখল, এরপর ইকবালের মেসেজ । লিখেছে, “মারামারি করা ব্যাপারটা
কিছু বললাম না তোরে, কারণ ওই সময় আমার সেন্স ছিল । কিন্তু গতকাল তুই এটা কি করলি! লজ্জা
করে না তোর! সেন্সলেস ছিলাম বলে তুই আমার সাথে এই করলি! রাইসা কতো রাগ করছে জানোস?
ভাই আমার পক্ষে সম্ভব না তোর সাথে থাকা, তুই ভাই ডাক্তার দেখা ।” এরপরই ইউ ক্যান্ট রিপ্লাই টু দিস কনভারসেশন । সোহান
দেখল, ভার্সিটির পরিচিত আরও অনেকে মেসেজ দিয়ে সোহানকে ব্লক করে দিয়ছে । কেউ লিখেছে,
“ছি ভাই! তোর কাছে এটা এক্সপেক্ট করি নাই ।” কেউ লিখেছে, “ভাই তুই মরার পর বুঝবি কি
হয়!” কেউ লিখেছে, “তোর লগে আর কথা নাই ।” আরও অনেকে অনেক কিছু লিখেছে আর তার নিচে ইউ
ক্যান্ট রিপ্লাই টু দিস কনভারসেশন । সোহান কপালে হাত দিলো । মানে কি এসবের? সোহান এবার ফেসবুকে ঢুকল । আলিয়া ম্যাম একটা পোস্ট আপলোড করেছে । সোহান ঢুকল সে পোস্টে
। দুটো ছবি । একটা সোহান ইকবালের সাথে সেদিন
মেঝেতে ইকবালের দুপাশে পা দিয়ে হাঁটু গেড়ে
বসে ইকবালকে মারছিল, সেদিনকার । কিন্তু ছবিটা এমনভাবে তোলা হয়েছে, দেখে মনে হয় দুজনে
রোমান্স করছে । পাশের ছবিটা আরও ভয়ানক । পুকুরপাড়ে সোহান ইকবালের মুখে মুখ লাগিয়ে যে
শ্বাস দেয়ার চেষ্টা করছিলো সেটা । এমন ভাবে তোলা, মনে হচ্ছে সোহান ইকবালকে কিস করছে
। সোহান ক্যাপশন পড়লো । আলিয়া ম্যাম লিখেছে, “আমার বলার ভাষা নেই । ছবিগুলো ভার্সিটির
এর সিনিয়র স্টুডেন্টের কাছে আমি পেয়েছি । আমার মতে এসব ছেলেদের
ভার্সিটি থেকে বের করে দেয়া উচিৎ, তা না হলে এদের জন্য ভার্সিটির মান সম্মান
সব নষ্ট হয়ে যাবে । সবার জানার জন্য বলি, ইকবালের কিন্তু কোন দোষ নেই । প্রথম ছবিটায়
ইকবাল বুঝতে পারে নি সোহান ওর সাথে রোমান্স করার চেষ্টা করছিলো । ও ভেবেছিলো সোহান্নন হয়তো শুধুই মারামারি করছে । দ্বিতীয় ছবিটা দেখলেই বোঝা যায় সোহানের আসল রূপটা । ইকবাল
সেন্সলেস ছিল, সেই সুযোগে সোহান ওর সাথে যা করলো, আর নাই বা বললাম
। এসব বলাও পাপ । আমি সবাইকে সাবধান করে দিচ্ছি আর ভার্সিটির অন্যান্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি । এই ছেলের টিসি চাই!” সোহানের পুরো শরীর কাঁপতে লাগলো । কে করলো এটা! না জেনে
না বুঝে এরকম বিরাট একটা বাজে মিথ্যে কে ছড়ালো!” সোহান কমেন্ট বক্সে গেলো । সবাই সোহানকে
উল্টোপাল্টা কথা বলেছে । বেশিরভাগই বলছে, “আমরা তো আগে থেকেই জানতাম । তা না হলে এতদিন
কেউ সিঙ্গেল থাকে?” আরেকটা কমেন্টও সোহানের নজর কাড়ল । ভার্সিটির গেইটের দারোয়ানের
। সে লিখেছে, “গতকাল এই ছেলে আমাকেও বাজে অঙ্গভঙ্গি ঈশারা করেছে । তখন বুঝিনি, এখন
বুঝলাম, ছেলেটার সমস্যা আছে !” সোহান মোবাইলের নেট অফ করে সামনের দিকে তাকাল । চেহারায়
ওর শঙ্কার ছাপ । মিথ্যে অপবাদের শঙ্কা ।
১২
সোহান জানে ওর কোন দোষ নেই, তবুও নিজের নিজের চুল
টানতে লাগলো মনের দুঃখে । এখন সবাইকে বললেও কেউ
বিশ্বাস করবে না । তবু, ইকবাল আর সাকিবকে একবার বলা যেতে পারে, কিন্তু সারাদিন
অনেক চেষ্টা করেও সোহান কিছুতেই সাকিব আর ইকবালের খোঁজ পেলো না । রাইসাকে দেখেছিলো
ভার্সিটির গেইটের ওখানে, কিন্তু রাইসা সোহানকে পাত্তা না দিয়ে চলে গেলো । বিকেলের দিকে
সোহান সাকিব আর সুমিকে ক্যাফেতে একসাথে দেখল, সোহান কাছে এগিয়ে যেতেই সুমি সাকিবকে
নিয়ে চলে গেলো । কিছু বলতে পর্যন্ত দিলো না । নিলয় আর হিমেলও পাত্তা দিচ্ছে না । ক্লাসের
অন্যান্য টিচাররাও পাত্তা দিচ্ছে না । হলের কেয়ারটেকার, দারোয়ান, ক্যাফেটেরিয়ার দোকানদার
কেউ না । শুধু বেচাকেনার খাতিরে সোহানের কাছে জিনিস বিক্রি করছে এই পর্যন্তই । এই প্রথম
এরকম একটা বাজে জন্মদিন পার করলো সোহান ।
মাগরিবের সময় সোহান রমনা পার্কের দিকে যাবে ভাবছিল,
সে সময় হলের সোহান ভার্সিটির সামনের পুকুরপাড়ের ওই পড়ে থাকা নারিকেল গাছের ডালের ওপর
ঊর্মিকে দেখল সোহান । সোহান ধীরে ধীরে ঊর্মির কাছে গেলো । প্রায় কাছাকাছি এসে সোহান
ডাকল, “ঊর্মি!” ঊর্মি মাথা ওঠাল । পেছন ফিরে যে-ই না দেখল সোহান দাড়িয়ে, সে-ই ও চলে
যাবার জন্য পা বাড়াল । সোহান ঊর্মির হাত টেনে ধরল । ঊর্মি হাতে টান অনুভব করতেই সোহানের
দিকে তাকিয়ে অন্য হাত দিয়ে সোহানকে চড় মারল । সোহান গালে হাত দিলো আর ঊর্মির হাত ছেড়ে
দিলো । ঊর্মি আবার চলে যেতে লাগলো, সোহান বলল,
“ঊর্মি, আমার কথা তো শোনো!” ঊর্মি আবার সোহানের দিকে ঘুরে দাড়িয়ে বলল, “কি শুনবো আমি!
কি শুনবোটা কি! নিজেকে কি ভাবো তুমি! আমার এতো বড় ক্ষতি তুমি কীভাবে করলে?” সোহান জিজ্ঞেস
করলো, “তোমার আমি কি ক্ষতি করলাম!”
- “ও! ভালো সাজা হচ্ছে না! নিজে যখন এরকম অ্যাবনর্মাল,
তখন কেন আমাকে ভালবেসেছ তুমি?” রেগে গিয়ে বলল ঊর্মি ।
- “দ্যাখো ঊর্মি, আমি কিন্তু একবারও তোমাকে বলিনি
আমি তোমাকে ভালোবাসি ।” বলল সোহান ।
- “আমার জীবনে এলে কেন? কিছু বোঝো না! কখন ভালোবাসা
হয়! তুমি কি এটা বোঝো নি আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি!”
সোহান কিছু বলল না ।
ঊর্মি কিছুটা রাগ দমন করে বলল, “অবশ্য আমি কাকে
কি বলছি! তোমার তো এসব বোঝার কথাও না । তুমি তো গে! সিঙ্গেল! রাবিশ! বুলশিট! জানোয়ারের
বাচ্চা!”
- “ঊর্মি!” বলে চেঁচিয়ে ঊর্মির গালে এবার চড় বসাল
সোহান । ঊর্মি গালে হাত রেখে কিছুক্ষণ সোহানের দিকে তাকিয়ে রইল । তারপর রেগে সোহানকে
আরও কয়েকটা মেরে চেঁচিয়ে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “আই হেইট ইউ সোহান! আই হেইট ইউ!”
বলে চলে গেলো । সোহান ঊর্মির দিকে ততোক্ষণ তাকিয়ে রইল, যতক্ষণ ঊর্মিকে দেখা যায় । ঊর্মিকে
আর পিছু ডাকার সাহস পেলো না সোহান । ঊর্মি দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে সোহান এক দৌড় দিয়ে
রুমে চলে আসে । তারপর ওর গল্প লেখার খাতা থেকে লাভ ডট কম গল্পটা যতোটুকু লিখেছিল, ততগুলো
পেইজ ছিঁড়ে টয়লেটে ফ্ল্যাস করে দিলো
। তারপর কমোডের ঢাকনাটা লাগিয়ে দিয়ে
ওখানে বসেই কাঁদতে লাগলো ।
- “এ মামা! মামা!” সোহান চোখ খুলল । ঝাপসা দৃষ্টিতেই
খেয়াল করলো, এ গতদিনের সেই ছেলেটা । টোকাই । সোহান উঠে বসলো । রাতে রমনা পার্কে এসে একাই বসেছিল সোহান । আজও কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টের
পায় নি । সোহান টোকাইটাকে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে? কেমন আছিস?”
- “হ মামা,
ভালো । আপনে কেমন আছেন?”
- “হুম, বেঁচে আছি, এই আলহামদুলিল্লাহ ।”
- “মামা কি নেশা টেশা করেন নাকি?” হালকা হেসে বলল
টোকাই ছেলেটা । সোহান ছেলেটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো । ছেলেটাকে
যতোটা ভদ্র ভেবেছিলো, ততোটাও ভদ্র না । অবশ্য এ যুগে বস্তির টোকাই ভদ্র হবে এটা ভাবাই
যায় না । সোহান ছেলেটাকে পাশে বসতে বলল । ছেলেটা সোহানের পাশে বসতেই সোহান প্রশ্ন
করলো, “নাম কি?”
- “বুলু ।”
- “গ্রাম থেকে এসছিস?” প্রশ্ন করলো সোহান ।
- “হ মামা । কামের লাইগা আইছিলাম মায়ের লগে ।”
- “ও । কোন ক্লাসে পড়িস?” জিজ্ঞেস করলো সোহান ।
- “ক্লাস সেভেনে পড়ার কথা, তয় বাদ দিয়া দিছি পড়াশুনা ।”
- “কেন?” বুলুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো সোহান ।
- “খরচ মেলা মামা ।” জবাব দিলো বুলু ।
- “কেন? সরকারী স্কুল আছে তো অনেক, সেখানেও তো
পড়তে পারিস অল্প খরচে ।”
- “তাই-ই ছিলাম মামা, কিন্তু ক্লাসের পড়া দিয়া
আর কতোই হয়, সব বাসার আলাদা টিচার রাখছে, আমার তো আর সেই পয়সা নাই মামা ।” বলল বুলু
।
সোহান আর কোন জবাব দিলো না । বুলু হঠাৎ সোহানকে প্রশ্ন করলো, “মামার কি মন খারাপ?” সোহান
কিছুক্ষণ কোন জবাব দিলো না । ভাবল, এরকম সময় কারো সাথে যখন সোহান কিছু শেয়ার করতে পারছে
না, তখন বুলুকে না হয় সবটা শেয়ার করা যায় । সবটা বলা শেষে সোহান বলল, “এই হল কাহিনী
। এখন কেউ আমার কথাই শুনছে না । বিশ্বাস তো দুরের কথা ।”
- “আমি আপনেরে বিশ্বাস করি মামা । এই পার্কে কতো
ভার্সিটির কতো পোলাপাইন আইছে, সব গার্ল ফ্রেন্ড নিয়া খালি ইটিস পিটিস করে । আমাগো
দিকে তাকায়ও না । আর আপনে আমারে খাওয়ার লাইগা
টাকা দিলেন । অন্তত আমি আপনারে বিশ্বাস করি ।”
সোহান কিছু বলল না । ছেলেটা আবার বলল, “আমার মায়ে
একখান কথা কইতো । মানুষের মধ্যে এহন বিশ্বাস কেমন জানি । হাজারটা মানুষ যদি কয় সূর্য
পশ্চিমে ওঠে, তাইলেও মানুষ কয় হেইডাই সঠিক । একজন যতোই সত্য কথা কউক, কেউ বিশ্বাস করে
না । আর তাদের মধ্যে যদি সবচেয়ে কাছের মানুষও
থাকে, তাইলে বলা যায় ওই আপন মানুষের ভালবাসায় কমতি ছিল ।”
সোহান আরেকবার ছেলেটার দিকে তাকাল । ভালো একটা কথা বলেছে । ছেলেটার মেধা আছে ভালো । সোহান বলল,
“আমি যদি তোর প্রাইভেট টিউটর হই, তবে তুই আবার স্কুলে যাবি?” বুলু সোহানের দিকে তাকাল
। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না ও রাজি নয় ।
১৩
পরদিন বিকেলের দিকে সোহান গেলো বুলুর বস্তিতে । সোহানের হল থেকে বেশি দূরে নয়, মোটর সাইকেল নিয়ে
গেলে ৫ মিনিট মতো লাগে । বস্তিটা আর সব বস্তির
মতোই, নোংরা, ঘরবাড়ি কোনোরকমে বানানো, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে,
কেউ সাইকেলের টায়ার নিয়ে লাঠি দিয়ে সেই টায়ার চালিয়ে খেলছে । সোহান বস্তিতে ঢুকেছে
দেখে সবাই সোহানের দিকেই তাকিয়ে । বুলুকে জিজ্ঞেস করলে জানালো এ বস্তিতে সচরাচর বড়
বাড়ির লোকেরা আসে না । কেউ এলে সোহানের মতোই এভাবে দ্যাখে । বস্তির এক কোণে বুলুর বাড়ি
। টিনের । মোটর সাইকেল বুলুদের ঘরের ঠিক সামনেই রাখল বুলুর কোথায় । চুরি হবার ভয় আছে
তো । ভেতরে ঢুকতেই বুলু বলল, “আম্মা, ভাইয়া আইছে । সোহানও ভেতরে ঢুকল । এক মহিলা মেঝেতে
বসে কিছু করছিলো, খুব সম্ভবত কোন মশলা বাটছিল । সোহানকে ঢুকতে দেখেই মহিলা মাথায় ওড়না
দিয়ে উঠে দাঁড়ালো । সোহান বলল, “আসসালামু আলাইকুম আনটি । কেমন আছেন?” বুলুর মা বেশ
লজ্জার সাথে জবাব দিলো, “ভালো বাবা, তুমি ভালা আছো?”
- “জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি ।” বলল সোহান ।
- “তুমি ওরে কইছো পড়াইবা, তাই আমি আইজকা সকালে
ওর স্কুলের গেছিলাম । ওর প্রিন্সিপ্যাল স্যার
কইছে ওরে এহন কলেজে নেয়া যাইবো ।” বলল বুলুর মা ।
- “ও, তাহলে তো ভালোই হল ।” খুশি মনে জবাব দিলো সোহান ।
- “তুমি তাইলে ওরে পড়াও, আমি বাইরে যাই ।” বলেই
বুলুর মা বাইরে চলে গেলো । সোহান চারপাশটা তাকিয়ে
দেখল । এই ঘরেরই এক পাশে মাটির চুলা
। একে তো ভেন্টিলেশন সিস্টেম ভালো না, তার
ওপর ঘরের ভেতরেই রান্না । চুলোর পাশে পাটায়
কিছু বেটে রাখা । দুর থেকে ঠিক দেখতে পারছিল না সোহান । টিনের দেয়াল ঘেঁষেই
দড়ি টানিয়ে কাপড় ঝোলানো । একপাশে কোনোরকমে ২ জন শুতে পারবে এরকম সাইজের একটা চারপায়া
। তার নিজের বইখাতা রাখা । রুমে আর কিছুই নেই, তবু মনে হচ্ছে যেন কতো কিছু দিয়ে রুমটা
ভরা । রুমের সাইজের সাথে তুলনা করলে এমনটাই
মনে হয় । বুলু সোহানকে বিছানায় বসাল । সোহান জিজ্ঞেস করলো, “আজ কি দিয়ে শুরু করবো?”
- “ম্যাথ করান ।” জবাব দিয়ে চারপায়ার নিচ থেকে একটা ম্যাথ খাতা আর বই বের করলো বুলু ।
সোহান বলল, “তাহলে শুরু করা যাক?”
শুরু হল সোহানের টিউশনি লাইফ । প্রতিদিন বিকেলে একটা সময় করে বস্তিতে যেয়ে বুলুকে পড়াত সোহান । শুধু
বুলুই নয়, বুলুর সাথে সাথে আরও কয়েকজন বস্তির ছেলেমেয়েও বুলুর সাথে পড়া শুরু করলো ।
সোহানও সবার সাথে বস্তিতে বেশ মজা করতো । কোন কোন দিন না পড়িয়ে পুরো বস্তি ঘুরে বেড়াতো,
ক্রিকেট খেলত । এদিকে ভার্সিটিতে তার ক্লাসে যাওয়া আর ক্যাফেটেরিয়াতে খাওয়া ছাড়া আর
কোন কাজ ছিল না সোহানের । কিছুদিন পর অবশ্য
ক্যাফেটেরিয়াতেও যাওয়া বাদ দিয়ে দেয়, ওখানে ছেলেমেয়ে সোহানের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসতো, সাথে ক্যাফেটেরিয়ার
দোকানদাররাও সোহানকে পাত্তা দিত না । তাই সোহান বাইরের রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়া
সেরে নিতো । ভার্সিটির কেউই আর সোহানের সাথে মিশতো না । পরবর্তীতে যারা-ই সোহানের
হলে এসেছে, তারা-ই পরবর্তীতে অন্যান্যদের মুখে শুনেছে সোহানের কথা, তখনই হল ছেড়ে চলে
গিয়েছে । এভাবে কষ্টের মাঝেই ভার্সিটিতে সময় কাটালেও সব কষ্ট আবার দুর হয়ে যেতো বস্তিতে
সবার সাথে সময় কাটিয়ে । দুর থেকে সোহান ইকবালকে দেখতো, সাকিবকে দেখত, ওরা নিজেদের গার্লফ্রেন্ড
নিয়ে বেশ আছে । বেশিরভাগ সময় সোহান দেখতো ঊর্মিকে । নতুন কাউকে পেয়েছে হয়তো । নতুন
কারো সাথে বেশ আছে । সোহান কারো কাছে যেতে চাইলে সে চলে যেতো বা পাত্তা দিত না । তাই
সোহানও কারো কাছে যাওয়া বন্ধ করে দেয় ।
কেটে যায় প্রায় সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময়ের কথা
। ভার্সিটিতে সোহানের পড়াশুনা শেষ । ভালো একটা রেজাল্ট করেছে পরদিন সবার বিদায় । সোহানের
প্ল্যান বিদায় অনুষ্ঠান শেষেই জিনিসপত্র নিয়ে বগুড়া গ্রামের
বাড়ি চলে যাবে । অনুষ্ঠানের আগের দিন সকালেই মোটর সাইকেল আর ভারি কিছু জিনিস পত্র বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে সোহান । বিকেল
থেকে রাত বস্তিতে সবার সাথেই থেকেছে । শেষ বারের মতো সবার সাথে দেখা করার জন্য । বুলু ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়েছে, এবছর
এসএসসিতেও গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে । অন্যান্য
ছেলেমেয়েরাও অনেক ভালো রেজাল্ট করেছে । আসবার সময় বুলু সোহানকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাদল ।
অন্যান্যরাও সোহানের জন্য অনেক কাদলো সবাই মিলে টাকা জমিয়ে সোহানকে বেশ দামি একটা ঘড়িও
গিফট করেছে ।
বস্তিতে ইমোশোনাল মুহূর্ত শেষে ভার্সিটির পথে রওনা
হল সোহান । আজ তো সাথে মোটর সাইকেল নেই, তাই বাসেই গিয়েছিলো, বাসেই ফিরছে । ভার্সিটির
গেইটের কাছে দারোয়ান সোহানের দিকে তাকাল । লোকটা সোহানের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাল । গত কয়েক
বছর প্রতিদিন এই গেইটের কাছে সোহান এই লোকটার এই দৃষ্টির স্বিকার হয়েছে । কিছু
না বলে ভেতরে ঢুকল সোহান । হলের দিকে যাচ্ছিলো,
পুকুর পাড়ের পাশ দিয়ে । এমন সময় সোহান কার
যেন আওয়াজ শুনতে পেলো । পুকুরটা থেকেই আসছে । কে যেন “হেল্প! হেল্প! করে সাহায্য চাইছে
। আশেপাশে কেউ নেই বলে কেউ সাড়া দিচ্ছে না, তার ওপর প্রায় পানিতে ডুবে ডুবে চেচাচ্ছে
বলে বেশি জোরে চেঁচাতেও পারছে না । সোহান্ন এগিয়ে গেলো পুকুর পাড়ের দিকে । হালকা আলোয়
যা মনে হল, হিমেল । সোহান পানিতে ঝাঁপ দিলো । তুলে এনে বটগাছের নিচে রাখল । জ্ঞান হারিয়েছে । সোহান হিমেলকেও ইকবালের মতো উপুড়
করে শুইয়ে মুখে কাঠি দিয়ে হ্যাঁ করিয়ে পথে চাপ দিয়ে পানি বের
করলো । তারপর বুকে চাপ দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস
চালু করার চেষ্টা করলো । এরপরও যখন শ্বাস এলো না, সোহান হিমেলের মুখে মুখ লাগিয়ে ফু দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস চালু করার চেষ্টা করলো । একটু পর হিমেল উঠে বসলো
। সোহান জিজ্ঞেস করলো, “কিরে? ঠিক আছিস?” হিমেল
বার কয়েক কেশে সোহানের দিকে তাকাল । সোহান জিজ্ঞেস করলো, “পুকুরে পড়েছিস কি করে? হিমেল
সোহানের দিকেই তাকিয়ে । সোহান মাথা নিচু করে হতাশার দম ফেলে বলল, “বুঝেছি, আমি তুলেছি
তো, তাই অনেক উল্টোপাল্টা কথা ভাবছিস হয়তো । ঠিক আছে, আমি যাই ।” বলেই সোহান্নন উঠে
আসতে লাগলো কিছুদুর আসতেই হিমেল সোহানকে বলল,
“কাল বিদায় না?” সোহান শুধু পেছন ফিরে তাকাল । হিমেল বলল, “সেখানে থাকিস, কথা আছে ।” সোহান আর
কিছু বলল না । কিছুক্ষণ দাড়িয়ে নিজের হলে চলে গেলো ।
১৪
পরদিন ভার্সিটিতে এক উৎসব মুখর পরিবেশ । সবাই চলে
যাওয়ার আগে নিজেদের মাঝে শেষ বারের মতো আনন্দ করে নিচ্ছে । রেজাল্ট দিয়ে দিলেও
স্টুডেন্ট অফ দ্যা ইয়ার কে হয়েছে তা এখনও জানানো
হয় নি । হিসেবে যদিও সাকিবই হওয়ার কথা, কারণ
সাকিবের রেজাল্ট সবার চেয়ে ভালো । সবাই বাইরে বেশ মজা করছে, আর সোহান নিজের রুমে বসে গান শুনছে । ইচ্ছে করেই । বাইরে গেলে সবাই আবার রাগ করতে পারে ।
১২টার দিকে মুল অনুষ্ঠান শুরু হবে জানান হয়েছিলো
। ভার্সিটি প্রাঙ্গনে ছোট একটা স্টেজ করা হয়েছে । সবাই ভার্সিটির লোগো লাগানো টি-শার্ট
গায়ে দিয়ে এসেছে । সোহানও ব্যাতিক্রম নয় । শুধু সবার মজা করার মতো বন্ধু বান্ধব আছে,
সোহানের নেই । সোহান অনুষ্ঠানেও হয়তো আসতো না । ইচ্ছে ছিল অনুষ্ঠান শেষ হলে হল থেকে
বেড়িয়ে চলে যাবে, কিন্তু আগের দিন হিমেল বলেছে দেখে সোহান এলো অনুষ্ঠানে সবার থেকে খানিকটা দূরে থাকা সত্ত্বেও কিছু ছেলেমেয়ে যারা সোহানের
কাছাকাছি ছিল, সোহানকে দেখে সরে গেলো । ওরা সোহানকে দেখে এমন্ন করছে, যেন কোন
টোকাই নোংরা হয়ে ওদের কাছে খাবার চাইতে এসেছে । সোহান্ন তবুও সহ্য করতে লাগলো । অনেকের অনেক কথাই
সোহানের কানে এলো । কিছু জুনিয়র-ও ছিল । সোহানের ব্যাচের ছেলেমেয়েদের অনেকে জুনিয়রদের
সোহানের দিকে ঈশারা করে দেখিয়ে বলছে, “দ্যাখ,
দ্যাখ, ওই সেই গে ছেলেটা ।” সোহানের বিরক্ত লাগছিল, কিন্তু তবুও অপেক্ষা করলো হিমেলের
। আসেপাশে হিমেলকে খুজল, কিন্তু পেলো না । একটু পর অনুষ্ঠান শুরু হল । নাচ গান আরও কতো কিছু । হিমেলের
সাথে দেখা হল না সোহানের । এখন ছাত্রছাত্রীদের
ভীরের ভেতরেও তো যেতে পারবে না । সবাই
কু-নজর দেবে । অবশেষে অনুষ্ঠানের শেষ হল,
এবার ঘোষণা করার পালা স্টুডেন্ট অফ দা ইয়ার কে হয়েছে । আলিয়া ম্যাম স্টেজে উঠলেন, কিছু বক্তব্য রাখলেন, এবং তারপর ঘোষণা করলেন “স্টুডেন্ট অফ দা ইয়ার হয়েছে, সাকিব!”
সবাই সাকিবকে উৎসাহ দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো । সাকিব দৌড়ে স্টেজে উঠলো । সার্টিফিকেট আর মাথায়
স্কয়ার অ্যাকাডেমিক ক্যাপ পড়ে সুমির দিকে তাকাল । সোহানও হালকা হাসিমুখে উৎসাহ জানালো,
কিন্তু মুখে চেঁচিয়ে কিছু বলল না । এরপর একে একে ছাত্রছাত্রীদের এই ভার্সিটিতে পড়ে নিজেদের অনুভুতির কথা প্রকাশের জন্য স্টেজে ডাকা হল । সবাই এলো একে
একে । নিলয়, ইকবাল, জেসি, রাইসা, আরও অনেকে
। শেষে বাকি শুধু হিমেল, আর সোহান । হিমেল আগে উঠলো । মাউথপিসটা হাতে নিয়ে বলল, “আমি
ইচ্ছে করেই আলিয়া ম্যামকে বলেছি আমাকে যেন লাস্টের আগে আর সোহানকে সবার লাস্টে কথা
বলার সুযোগ দেয়া হয় যাতে করে আমি আমার একটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ কথা বেশি সময় নিয়ে
বলতে পারি ।” সোহান হিমেলের দিকে তাকাল । হিমেল
বলতে লাগলো, “আমি এই ভার্সিটিতে সেই শুরু থেকেই
একটা মেয়েকে পছন্দ করতাম । সে হল জেসি । অনুষ্ঠানের সবাই জেসির দিকে তাকাল । হিমেল
বলল, “কিন্তু একটাই সমস্যা ছিল, জেসি পছন্দ করতো সোহানকে ।” সামনে দাড়িয়ে থাকা সবাই বিরক্ত
হয়ে গেলো সোহানের নাম শুনেই । রাইসা
ইকবালকে বলল, “এই নামটা শুনলেই আমার গা জ্বলে
।” সোহানও টের পেলো ভীরের মধ্য থেকে কে যেন বলল, “এই
ছেলেটাকে শুরুতেই ভার্সিটি থেকে টিসি দিয়ে
দিলেই হতো ।” টিসির কথা উঠেছিলো সোহানের, তবে ভার্সিটি দুটো শর্ত
দিয়েছিল । তা হল, সোহান যদি ভার্সিটিতে স্বাভাবিক থাকতে পারে, তবেই সোহান এই ভার্সিটিতে
থাকতে পারবে । পরবর্তীতে সোহানকে যদি আবার একই কুকর্ম করতে দেখা যায়, তবে টিসির সাথে
জরিমানাও হবে । সোহান সেই শর্তে রাজি হয়েছিলো
। কিন্তু এখন হিমেল কি বলবে? সোহান একটু ভাবলো, গতকালও তো সোহান হিমেলকে পানি থেকে
তোলার পর মুখে মুখ লাগিয়েছিল শ্বাস প্রশ্বাস চালু করবার জন্য, তবে কি এখন! সোহান বেশ
বুঝতে পারছে আগের বারের মতো এবারেও ওকে ফাসানো হচ্ছে । হিমেল এরকম গাদ্দারি করলো! এভাবে
আসতে বলে অপমান করলো! সোহান সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে সেখান থেকে হলের দিকে ফিরতে লাগলো
। হিমেল যখন দেখল সোহান্ন চলে যাচ্ছে, তখন
তাড়াতাড়ি কথা বলতে লাগলো হিমেল । সামনে সবাই হিমেলকে বলতে লাগলো “এসব জানোয়ারদের কথা
বাদ দে” “গে ও ভাই!” “ভাই ও সিঙ্গেল” “ভাই ভালো মুহূর্তে মুডটা নষ্ট করিস না” । হিমেল কিন্তু ওদের কথা শুনলো
না আদৌ । হিমেল সোহান প্রায় জায়গাটা থেকে অনেক দুর চলে এসেছে । হিমেল বলতে যতো দ্রুত
সম্ভব বলতে লাগলো, “আমরা সবাই জানি এই সোহানের কিছু ছবি কেউ একজন ফেসবুকে আমাদের ভার্সিটির
গ্রুপে ছড়িয়ে দিয়েছে, আমাদের ভার্সিটিতে ওকে নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, আর আজকে আমি আপনাদের সব সত্যি কথা বলবো,
আসল কথা হচ্ছে ওই ছবিগুলো আমিই ছড়িয়েছিলাম ।” সোহান সামনে পা রাখতে গিয়ে দাড়িয়ে গেলো
। সামনে থাকা ছাত্রছাত্রীদের কোলাহলও থেমে গেলো । পুরো পরিবেশ যেন নিমিষেই নিস্থব্ধ
হয়ে গেলো । সোহান সানগ্লাস খুলে পেছন ফিরে তাকাল । আলিয়া ম্যাম উঠে দাড়িয়ে বলল, “এসব
কি বলছ হিমেল!” হিমেল বলল, “জি ম্যাম । আসল ঘটনা হল আমি জেসিকে পছন্দ করতাম । কিন্তু
দুর্ভাগ্যবশত জেসি সোহানকে পছন্দ করতো । তাই আমি সবসময় সোহানকে জেসির সামনে এমনভাবে
হাজির করতে চাইতাম, যেন জেসি সোহানকে পছন্দ না করে । একদিন সোহানদের হলের সামনে দিয়ে
আসবার সময় দেখলাম মেঝেতে ইকবালের দুপাশে হাঁটু গেড়ে বসে ইকবালের সাথে মারামারি করছে
সোহান, তখনই আমার মাথায় আসে সোহানকে গে বানানো প্ল্যান ।” সামনে দাড়িয়ে সাকিবের তখন
সেদিনের কথা মনে পড়ে গেলো । সেইদিন সুমির সাথে কথা বলার সময় ও হিমেলকে দেখেছিলো । হিমেল
বলতে লাগলো, “এরপর আমি সোহানকে ফলো করা শুরু করি, যদি এরকম আরও কোন মুহূর্ত পাই । ফের
আমি ওর ওকে ইকবালের সাথে দেখি । পুকুর পাড়ে । একে সোহান সবাইকে বলতো ও সিঙ্গেল, তার
ওপর ও সবাইকে বলতো মেয়েদের প্রতি ওর ইন্টারেস্ট নেই, তার ওপর ও ইকবালকে যেখানে পুকুর
থেকে তুলে রেখেছিল, সেখানে বসে ছেলেমেয়েরা প্রেম করে । তাই সবটা মানুষকে বিশ্বাস করানো
আমার জন্য ব্যাপারই ছিল না । আমি শুরু থেকে ভার্সিটির ছাত্র পরিচয়ে একটা ফেইক আইডি
চালাতাম, সেখানে আলিয়া ম্যামও আমার ফ্রেন্ড । তখন আমি-ই আলিয়া ম্যামকে ছবিগুলো পাঠাই । তাহলে সবাই বুঝুন, ম্যাম
যদি সবটা সবাইকে বলে, তবে কে বিশ্বাস করবে
না?” এর মধ্যে সোহান ধীরে ধীরে হিমেলের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্টেজের কাছাকাছি
চলে এসেছে । হিমেল একবার সোহানের দিকে তাকাল । তারপর বলল, “গতকাল এই ছেলেটা আমাকে বাঁচিয়েছিল
। এমনিতেও এই কাজ করার পর আমার অনেক গিল্ট ফিল হতো । গতকাল সেই সীমা যেন ছাড়িয়ে গিয়েছিলো
। তাই আমি সবার সামনে সোহানের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য এখানে সোহানকে ডেকেছি । না হলে
হয়তো ও আসতো না । সব ছাত্রছাত্রী সোহানের দিকে তাকাল । ভীরের মধ্য থেকে ঊর্মিও । ওর
নতুন বয়ফ্রেন্ড হিমু বলল, “ঊর্মি! তুমি কি এখন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?” ঊর্মি কোন জবাব
দিলো না । ও সোহানের দিকেই তাকিয়ে । হিমেল
সোহানকে বলল, “দোস্ত, একটু স্টেজে আসবি?” সোহান কিছু বলল না ।
১৫
আলিয়া ম্যাম তখন স্টেজ থেকে নেমে সোহানের হাত ধরে
বলল, “তুমি আমার ছেলের মতো, এই এতগুলো বছর একটা মিথ্যে অপরাধে তুমি অনেক কষ্ট সহ্য
করেছো । আমি এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী, আমাকে ক্ষমা করে দাও!”
- “না ম্যাম! এসব কি বলছেন, আপনি তো আর ইচ্ছে করে
এসব করেন নি ।” জবাব দিলো সোহান । কিন্তু এখনও
ওর চেহারা থেকে অবাক দৃষ্টি সরে নি । আলিয়া ম্যাম জোর করে সোহানকে স্টেজে নিয়ে
গেলেন । সোহান হিমেলের কাছে আসতেই হিমেল সোহানের হাতে মাউথপিসটা দিয়ে বলল, “সবার উদ্দেশ্যে কিছু বল ।”
সোহান যেই না মাউথপিসটা হাতে নিলো, অমনি হিমেল বসে সোহানের পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দে দোস্ত! আমাকে ক্ষমা করে দে!” সোহান অনেক কষ্টে হিমেলকে দাঁড় করাল
। তারপর হিমেলকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এভাবে বলিস না । ভুল সবারই হয় । শান্ত হ ।” কিছুক্ষনের
মধ্যে হিমেল শান্ত হয়ে দাঁড়ালো । সোহান মাউথপিস নিয়ে সামনে তাকাল ।
এতো বছর পর সোহান সবার সামনে দাঁড়ালো । একবার
সবার দিকে চোখ বোলাল । সাকিব, ইকবাল, সুমি, রাইসা, ঊর্মি, হিমু, নিলয়, জেসি অন্যান্য
সবার দিকে । সবাই সোহানের দিকে তাকিয়ে । তারপর ঠোঁটের কোণে একটা হাসি আনবার চেষ্টা
করে বলল, “প্রতিটা মানুষের জীবনে কিছু স্পেশাল মুহূর্ত থাকে । আমার জন্য আজ হয়তো সেই স্পেশাল
মুহূর্ত । আমি হিমেলকে থ্যাংকস জানাবো । ও এসব না করলে আমি আসলে ভালোবাসার আসল মানেটা
বুঝতেই পারতাম না । বিশ্বাস জিনিসটা যে কতো সেনসিটিভ, তা আমি আজ বুঝলাম । ছোটবেলা থেকেই
আমি গল্প লিখতে পছন্দ করতাম, কিন্তু আমার একটা গল্পও গল্প হতো না । আজ আমার জীবনটাই
যেন একটা গল্প হয়ে গেলো ।” বলতে বলতে সোহান থেমে গেলো । তারপর সোহান বলল, “আমি জানি,
সবাই ইচ্ছে করে কিছু করে নি, তাই আমি আজও সবাইকে অনেক ভালোবাসি । কিন্তু আমি নতুন করে
কিছু শুরু করতে রাজি নই । কেউ একজন আমাকে বলেছিল, মানুষের মধ্যে এখন বিশ্বাস কেমন জানি
। হাজারটা মানুষ যদি বলে সূর্য পশ্চিমে ওঠে, তাহলেও মানুষ বলে সেটাই সঠিক । একজন যতোই
সত্য কথা বলুক, কেউ বিশ্বাস করে না । আর তাদের মধ্যে যদি সবচেয়ে কাছের মানুষও থাকে,
তাহলে বলা যায় ওই আপন মানুষের ভালবাসায় কমতি
ছিল ।” শেষ কথাটা বলার সময় সোহান ঊর্মির দিকে তাকাল । তারপর স্টেজ থেকে সোহান
নিজের হলে চলে আসে । ঊর্মি, সাকিব আর ইকবাল বোধ হয় আসতে চেয়েছিল, কিন্তু ভীরের মধ্য
থেকে বের হয়ে আসা সে সময় অসম্ভবই বটে ।
১টার দিকে লাঞ্চ ব্রেকে ভীর ছড়িয়ে পড়লে সাকিব আর
সুমি, ইকবাল আর রাইসা, ঊর্মি আর হিমু এবং নিলয় আসে সোহানের হলে । ছেলেদের হলে মেয়েদের
আসা নিষেধ থাকলেও আজ শেষ দিন সে নিষেধ অমান্য করলে তেমন কিছুই হবে না । সাকিব হলের
দরজা খুলে দেখল, ভেতরে সোহান নেই । সোহানের জিনিসপত্রও নেই । পাশ দিয়েই তখন হলের কেয়ারটেকার
যাচ্ছিলেন, ইকবাল জিজ্ঞেস করলো, “মামা, সোহান কথায়?” কেয়ারটেকার আঙ্কেল বলল, “ও তো
মিনিট পনেরো আগে চইলা গেলো, কইলো ১টায় ট্রেন ।” সাকিব মাথায় হাত দিয়ে “শিট!” বলে উঠলো
। ঊর্মি প্রায় কেঁদেই ফেলল । কেয়ারটেকার আঙ্কেল বলল, “তোমরা কি ওর কাছে মাফ চাইতে আইছো?”
ইকবাল লজ্জার সাথে বলল, “জি । ওকে আমরা সেদিনের পর ব্লক করে রেখেছিলাম । এখন দেখি ও
নিজেও আমাদের ব্লক করে রেখেছে ।”
- “একটা কাম করতে পারো ।” কেয়ারটেকার আঙ্কেল কথা
শুনে সবাই কেয়ারটেকার আঙ্কেলের দিকে তাকাল ।
ইকবাল জিজ্ঞেস করলো, “কি?”
- “বাংলাদেশের ট্রেনতো কখনোই টাইম মতো থামে না,
এইখান থেইকা স্টেশন যাইতে ৫-১০ মিনিট লাগবো, তোমরা যাইয়া খোঁজ করতে পারো ।” বলল কেয়ারটেকার
আঙ্কেল । রাইসা ইকবালকে বলল, “বাবু, বাদ দাও, যা হওয়ার হয়েছে ।” সুমি সাকিবকে বলল,
“হ্যাঁ জান, ও তো বলেছেই, ও তোমাদের ভালোবাসে এখনও, তাহলে নিশ্চয় তোমাদের ক্ষমাও করে
দিয়েছে ।” হিমু ঊর্মিকে বলল, “কাম ওন বেবি, ওদিকে সবাই মজা করছে, চলো যাই ।” নিলয় নিজে
ভাবছে । কি করবে? এমন সময় ঘটলো এক ঘটনা । সাকিব
হঠাৎ সুমিকে একটা চড় মেরে “হেইট ইউ!” বলে চলে গেলো । এটা দেখে রাইসা ইকবালকে বলল,
“বাবু দেখছো! তোমার বন্ধু কি খা……” কথা শেষ করার আগেই ইকবাল রাইসাকে চড় মেরে বলল,
“আই অলসো হেইট ইউ ।” বলে ইকবালও বেড়িয়ে গেলো । হিমু কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই
ঊর্মি হিমুর গালে একটা চড় মেরে বলল, “নেভার থট দ্যাট আই এম ইওর গার্লফ্রেন্ড । হেইট
ইউ আ লট!” বলে ঊর্মিও চলে গেলো সেখান থেকে । নিলয়ের সাথেতো আর কেউ নাই, নিজেই নিজের
গালে চড় মেরে বলল, “আমারও যাওয়া উচিৎ!” এরপর সেও সেখান থেকে চলে এলো । বেচারা সুমি,
রাইসা আর হিমু হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইল ।
স্টেশনে ওরা পৌঁছতেই দেখল, ট্রেন দাড়িয়ে । নিলয়
কাউকে জিজ্ঞেস করলো, “ভাই এটা কয়টার ট্রেন?” লোকটা জবাব দিলো, “একটার ট্রেন ভাই, ছাড়তে
দেরী হইছে । এরপর সবাই বাইরে থেকে ট্রেনের শেষ মাথা থেকে শুরু করলো জানালার বাইরে থেকে
উঁকি দিয়ে সোহানকে খোঁজা । শেষ বগিতে নেই, তার
আগের বগিতেও নেই । যতো দ্রুত সম্ভব ওরা খোঁজা শুরু করলো । কারণ এপাশ শেষ হলে
ওপাশের জানালাতেও খুঁজতে হবে । কিন্তু প্রায় মাঝামাঝি বগিগুলোর কাছাকাছি আসতেই ট্রেন
ছাড়া শুরু করলো । ইকবাল সাকিবকে বলল, “ভাই তুই সামনে থেকে দ্যাখ!” এমন সময় ঊর্মির চোখে
পড়ল বস্তির কয়েকটা লোক কাকে যেন জানালা দিয়ে বিদায় জানাচ্ছে । সোহান যে কিছু বস্তির বাচ্চাকে এতদিন পড়িয়েছে, সেটা জানে ঊর্মি । প্রায় চতুর্থ বগির সামনে ছেলেগুলো দাঁড়ানো । তবে এগুলোই
সেই বস্তির ছেলে কি না তা জানা নেই
ঊর্মির । এমন সময় জানালা দিয়ে কেউ হাত বের করে বস্তির ছেলেমেয়েগুলোকে টাটা
জানালো । হাতের ঘড়িটা দেখল ঊর্মি, হ্যাঁ, এটাই তো সকালে সোহান পড়ে এসেছিলো স্টেজে ।
ঊর্মি বলে উঠলো, “ওইতো সোহান!” ব্বলে ঊর্মি দিলো এক দৌড় । সাথে সাকিব ইকবাল আর নিলয়ও
। এক দৌড়ে ওরা জানালার কাছাকাছি চলে এলো । ঊর্মি জানালায় হাত রেখে বলল, “সোহান! সরি
সোহান! আই লাভ ইউ সোহান!” সোহান চমকে জানালার দিয়ে বাইরে তাকাল । দেখল, সাকিব, ইকবাল
আর নিলয়ও আছে ।
১৬
- “দোস্ত! মাফ কইরা দিস!” বলল নিলয় ।
- “ভাই! তোর যা হইছে আমার জন্য, আমাকে মাফ কইরা
দিস ভাই! প্লিজ! ভুল বুঝিস না!” বলল ইকবাল ।
- “ভাই! আমারেও মাফ কইরা দিস! তুই যদি ট্রেনে না
থাকতি! আমি সত্যি তোর পা ধইরা মাফ চাইতাম!”
ধীরে ধীরে ট্রেনের গতি অনেক বেড়ে গেছে । ঊর্মি হঠাৎ করে পা মচকে পড়ে গেলো ।
যেহেতু ঊর্মিই সবার সামনে ছিল, তাই ঊর্মিকে টপকে আর দৌড়োতে পারলো না । ট্রেন চলতে লাগলো
। সবাই সামনের দিকে তাকাল । সোহান জানালা থেকে মাথা বের করে সবার দিকে একটা ফ্লাইং
কিস ছুঁড়ে দিয়ে হাত লাভ আকৃতির করে দেখাল । সবাই খুব খুশি হল । তবে সোহান কিন্তু সবার
সাথে নতুন করে আর বন্ধুত্ব করলো না । সেই যে ব্লক করে রেখেছিল, সেই ব্লক করেই রেখে
দিলো ।
১ বছর পরের কথা । শীতের ছুটিতে বাড়ি এসেছে সোহান
। আপাতত বেকার জীবন পার করছে, চাকরীর সন্ধানে আছে । বাড়ি থেকে বেরিয়েছে মোটরসাইকেলটা
একটু মেরামত করার জন্য । গ্যারেজে মোটরসাইকেলটা রেখে দোকানদারের সাথে গল্প করছিলো ।
- “কিরে! হল তোর?”
- “মামা, ৩ মিনিট খারান!” বলল দোকানদার এমন সময়
মেয়ে কণ্ঠে কেউ সোহানের পেছনে দাড়িয়ে বলল, “ভাই এখানে সোহান নামে একটা ছেলে কোথায় থাকে
বলতে পারেন?” সোহান পেছন ফিরে তাকাল । ঊর্মি না!” এই ১ বছরে বেশ শুকিয়ে গেছে । ঊর্মি
সোহানকে দেখেই চিনতে পেরে সোহানকে জড়িয়ে ধরল । তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল, “গত ১টা বছর
ভার্সিটির রেজিস্টার খাতা থেকে তোমার ঠিকানা অনেক কষ্টে জোগাড় করে এসেছি । তুমি কেন
এখনও আমাকে আন ব্লক করনি?”সোহান দোকানদারের দিকে তাকাল । সে চোখ ঢেকে বলল, “মামা আমি
কিছু দেখি নাই ।”
দোকানের সামনের একটা খোলা মাঠ । মাঠে পাশেই পুকুর । সেই পুকুর পাড়ে দুজনে বসে পড়ল ।
- “সাকিব আর ইকবালের কি অবস্থা?” জিজ্ঞেস করলো
সোহান ।
- “হ্যাঁ ভালো । ওরা রাইসা আর সুমিকে ছ্যাকা দিয়েছে,
এখন সাকিব কানাডায় গেছে আরও পড়াশুনা করার জন্য । আর ইকবাল ভার্সিটিতেই প্রফেসর হিসেবে
জয়েন করেছে ।” বলল ঊর্মি ।
- “ও । আর তোমার হিমু?”
- “ওর কথা ভাবি না আর । ও একটা বেয়াদব । এখন আরেকজনকে
ধরেছে । শুনেছি এর আগে আরও অনেকের সাথেও ছিল ।”
- “ও । হিমেল আর নিলয়?” জিজ্ঞেস করলো সোহান ।
- “হিমেলের সাথে যোগাযোগ হয় না, নিলয়ও কানাডা গিয়েছে
।” সোহান একটু নড়েচড়ে বসলো । তারপর বলল, “তুমি ?”
- “কিছুই না । এখন তোমার মতোই বেকার বসে আছি ।
বাবা বিয়ের কথা তুলেছিলেন, কিন্তু আমি রাজি হই নি ।”
সোহান কিছু বলল না । ঊর্মি বলল, “তুমি কাউকে আনব্লক
করোনি কেন? সবাই তোমার কথা কতো ভাবে জানো?”
সোহান ঊর্মির দিকে তাকাল । এমন সময় পেছন থেকে ড্রাইভার ডেকে উঠলো, “সোহান ভাই!
হইয়া গেছে!” সোহান বলল, “আসছি!” তারপর ঊর্মির দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো যাই?”
- “কোথায় যাবো?” প্রশ্ন করলো ঊর্মি ।
- “আমার বাড়িতে আজ বিয়ের অনুষ্ঠান । দাওয়াত খেয়ে
যাও ।”
ঊর্মি হেসে বলল, “নিশ্চয় তোমার না, তোমার বড় ভাই
বা বোনের………” থেমে যেয়ে ঊর্মি মুখ গোমড়া করে বলল, “তুমি তো বলেছিলে তোমার শুধু একটা
ছোট ভাই আছে!” সোহান তখন হেসে দিলো । বলল, “আমার কাজিনের বিয়ে । আমরা জয়েন ফ্যামিলি
।” ঊর্মি একটা শ্বাস ফেলে বলল, “উফ! কি যে ভয় পেয়েছিলাম!” সোহান বলল, “কিন্তু আমি যে
বেকার! তোমার বাবা মেনে নেবেন?” ঊর্মি বলল, “তা কেন, আমি বসে থাকবো, তুমি চাকরি পাবে,
আর আমাকে বলবে, চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি ঊর্মি শুনছো, এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না!” বলেই
দুজনেই খিল খিল করে হেসে উঠলো । সোহান মোটর সাইকেলে উঠলো, ঊর্মি সোহানের পিছে । আয়নায়
সোহান ঊর্মিকে দেখল একটিবার । তারপর আসতে লাগলো বাসার পথে । ঊর্মি তখন বলল, “তুমি তো
জবাব দিলে না, কেন সবাইকে আনব্লক করো নি?”
- “এমনি ।” জবাব দিলো সোহান ।
- “তা বললে হয়? সবাই তোমার কথা কতো ভাবে তুমি জানো?”
বলল ঊর্মি ।
- “মনে হয় আমি ভাবি না? তোমাদের কথা মনে রাখতে
আমি একটা উপন্যাসও লিখেছি । সামনের বই মেলায় ভাবছি ছাপাবো ।” বলল সোহান ।
- “ওমা তাই! কি উপন্যাস?” খুশি মনে প্রশ্ন করলো
ঊর্মি ।
সোহান জবাব দিলো, “লাভ ডট কম ।”
(সমাপ্ত)