0 %

Thanks a lot for being with us!
We are re-constructing our website!
Sorry for this temporary inconvenience
We are coming to you with a fresh look and design from 1 January 2022!
Till then! Stay connected!

Porichoy Season 1

Porichoy Season 1
×
পরিচয়(১)(সিজন-১)

রাত ১২টা ৩০মিনিট ৷ ঢাকার ধানমন্ডির নিউক্লিয়াস হাসপাতাল ৷ সেই হাসপাতালে বড় মেয়ের পাশে অপারেশন থিয়েটারের সামনে অপেক্ষাগারে বসে আছে মি. সোহেল ৷ তার স্ত্রী মিসেস শায়লা প্রসব বেদনায় ছটফট করায় হাসপাতালে আনা হয়েছে ৷ মেয়ের নাম জেরিন ৷ জেরিনের আবার ক্যান্সার ৷ ডাক্তার বলেছে, মেয়ে আর বেশিদিন বাচবে না ৷ এজন্য পরিবারে আরও বেশি দুঃখ ৷ খানিক বাদে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেড়িয়ে এলো ডাক্তার ৷ মুখ থেকে মাস্কটা নামিয়ে সোহেলের পাশ দিয়ে হেটে যেতেই সোহেল ডাক্তারের পথ আটকে দাঁড়ালো ৷ তারপর কান্নার স্বরে বলল, "ডাক্তার, আমার স্ত্রী কেমন আছে? আমার বাচ্চা?" ডাক্তার সোহেলের কথার কোনো জবাব না দিয়ে পাশ কেটে চলে গেলো ৷ জেরিন বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, "টেনশন কোরো না আব্বু ৷ সব ঠিক হয়ে যাবে ৷" এদিকে ডাক্তার গেছে হাসপাতালের মালিকের কাছে ৷ হাসপাতালের মালিক তখন একটা ইজি চেয়ারে বসে সিগারেট খাচ্ছিলো ৷ ডাক্তার এসেই মালিকের কাঁধে হাত রেখে বললো, "কি হে? আরেকটা মরেছে ৷" হাসপাতালের মালিক মুখ থেকে সিগারেটটা নামিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, "কি করবে, সব তো জানাই আছে ৷" ডাক্তার বলে উঠলো, "কিন্তু বাচ্চাটা?" মালিক একটু হেসে বলল, "মনে হয় কিছুই জানো না? আরে আয়াকে দিয়ে বাচ্চাটাকে খুন করে রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে আয় ৷ আর সোহেলরে বল যে মা ও বাচ্চা দুইটাই অসুস্থ, আরও টাকা জমা করতে হবে ৷" ডাক্তার আবার জিজ্ঞেস করলো, "পরে বাচ্চা চাইলে কি করবো?" হাসপাতালের মালিক আবার একটু ধোয়া উড়িয়ে বললো, "আপাতত বল মা ও বাচ্চা কারও সাথেই দেখা করানো যাবে না ৷ পরে যখন মা মরেছে বলবি, তখন মর্গ থেকে কোনো লাশ সংগ্রহ করা যাবে ৷ আর হ্যাঁ, আয়াকে বলিস, অন্য কোনো হাসপাতালের সামনে বাচ্চার লাশটা ফেলতে ৷ যেন আমাদের সন্দেহ না করে ৷"
কথাটি শেষ হতেই ডাক্তার দরজার কাছে যেয়ে দরজার দিকে হাত বাড়ালো । দরজা না খুলেই পেছন ফিরে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল, "কাল আবার খবর আসতে চলেছে, রাস্তার পাশে নবজাতকের লাশ উদ্ধার ৷" হাসপাতালের মালিক মুখে সিগারেট নিয়ে আবার ধোয়া উড়িয়ে হালকা হাসলো ৷ ডাক্তার দরজা খুলে বেরোতেই চমকে গেলো ৷ কারণ তার সামনে চোখে জল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সোহেল ৷ হাতে মোবাইলটা নিয়ে পাশেই থাকা জেরিনের হাতে দিয়ে বলল, "যা বলেছিলাম সেটা করো ৷" জেরিন মোবাইলটা হাতে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের দিকে দৌড় দিলো ৷ ডাক্তারের বুঝতে বাকি রইলো না কি হয়েছে ৷ ভেতরে থাকা হাসপাতালের মালিকও সব বুঝে সিগারেটটা অ্যাশ ট্রে তে রেখে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো ৷ ডাক্তার জেরিনের হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নেয়ার জন্য দৌড় দিতে গেলে পথ আটকে দাঁড়ায় সোহেল ৷ ভেতরে হাসপাতালের মালিক তখন টেবিলের ওপর থাকা একটা কেচি নিয়ে বাইরে এসে প্রথমে ঢুকিয়ে দেয় সোহেলের পেটে ৷ সোহেলের পেট দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে কিন্তু তবুও থামে না ৷ এরপর সেই হাসপাতালের মালিক কেচিটা ঢুকিয়ে দেয় সোহেলের বুকে ৷ সোহেল তবুও থামে না ৷ হাসপাতালের মালিক তখন খুব রেগে বলল, "এই ডাক্তার! তুমি যাও, এর মেয়ের কাছ থেকে মোবাইলটা কেড়ে আনো ৷ আমি একে দেখছি ৷" ডাক্তার তখন "আচ্ছা ৷" বলেই চলে গেল সোহেলের মেয়েকে ধরতে ৷ সোহেল তখন ডাক্তারকে আটকানোর জন্য দৌড় দিলে হাসপাতালের মালিক সোহেলের ঘাড়ের রগ কেচি দিয়ে কেটে দেয় ৷ সোহেল আর দৌড়াতে পারে না ৷ মাটির ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে যায় ৷ ঘাড় দিয়ে প্রচুর রক্ত ঝরছে ৷ হাসপাতালের মালিক সেখান থেকে দৌড় দিয়ে চলে এলো ৷ আর সোহেল মেঝের ওপর ছটফট করতে করতে মারা গেলো ৷
এদিকে জেরিন অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার সময় দেখলো, হাসপাতালের নার্স বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৷ জেরিন নার্সের কাছে আসতেই নার্স জেরিনের হাতে বাচ্চাটা দিয়ে বলল, "এই নাও, তোমার ভাইকে নাও ৷ তাড়াতাড়ি পালাও ৷ আমি সব জানি ৷" জেরিন বাচ্চাটাকে হাতে নিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, "আমাকে আম্মুকে একটু দেখবো ৷" নার্স খুব তাড়াহুরা করে বললো, "তুমি প্লিজ পালাও ৷ নয়তো তুমিও বাঁচবে না, তোমার ভাইও বাঁচবে না ৷" জেরিন আর কিছু না বলে ভাইকে নিয়ে পালিয়ে গেলো ৷

আগামী পর্বে:
দারোয়ান বললো, "হাসপাতালের গেইটে একটা মেয়ে কোলে একটা বাচ্চা নিয়ে যাবার সময় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেছে ৷" নার্স অবাক হয়ে বলল, "কী!" দারোয়ান বলল, "মনে হয় মারা গেছে ৷ নাক দিয়ে তো শ্বাস বেরোতে দেখলাম না ৷"
×
পরিচয়(২)(সিজন-১)

জেরিন আর কিছু না বলে ভাইকে নিয়ে পালিয়ে গেলো ৷ একটু পর ডাক্তার অপারেশন থিয়েটারের কাছেই এলো ৷ ডাক্তারকে দেখেই নার্স অভিনয় শুরু করলো ৷ নার্স মাথায় হাত রেখে হাঁফিয়ে যাবার অভিনয় করে বলতে লাগল, "ডাক্তার! সোহেল স্যারের বড় মেয়ে সোহেল স্যারের বাচ্চারে নিয়া পালাইসে ৷" ডাক্তার জিজ্ঞেস করল, "কোনদিকে গেছে?" নার্স, জেরিন যেদিকে গেছে, তার বিপরীত দিকে ইশারা করে দেখিয়ে দিলো ডাক্তারকে ৷ ডাক্তারও সেদিকেই গেলো ৷ একটু পর হাসপাতালের মালিক আসলে তাকেও একই কথা বলে জেরিন যেদিকে গেছে তার বিপরীত দিকে পাঠিয়ে দেয় নার্স ৷ খানিক বাদে নার্সের কাছে হাসপাতালের দারোয়ান আসে, এসে বলে, "ডাক্তার কই?" নার্স ঘর্মাক্ত মুখটা মুছে বলল, "বাইরে, কিন্তু কেন?" দারোয়ান বললো, "হাসপাতালের গেইটে একটা মেয়ে কোলে একটা বাচ্চা নিয়ে যাবার সময় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেছে ৷" নার্স অবাক হয়ে বললেন, "কী!" দারোয়ান বলল, "মনে হয় মারা গেছে ৷ নাক দিয়ে তো শ্বাস বেরোতে দেখলাম না ৷" নার্স ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, "বাচ্চাটা কই?" দারোয়ান বলল, "বাচ্চাটারে আমার বসার চেয়ারের ওপর রেখে এসছি ৷" নার্স কিছু না বলে দৌড় দিলো হাসপাতালের গেইটের দিকে ৷ সাথে সেই দারোয়ানও গেল ৷ নার্স এসে দেখলো সত্যিই গেইটের সামনে পরে আছে জেরিন ৷ কাছে যেয়ে হাতের পার্লস রেট চেক করে দেখলো, জেরিন আর নেই ৷ নার্স কিছুতেই কিছু বুঝতে পারলো না ৷ কারণ সে জানতো না, জেরিনের ক্যান্সার ছিলো এবং খুব শীঘ্রই মারা যাবার সম্ভাবনা ছিলো ৷ ওদিকে নার্স খেয়াল করলো, ডাক্তার আর হাসপাতালের মালিক সারা হাসপাতাল খোঁজাখুজি করার পর এদিকেই আসছে ৷ তারা এখনও গেইটের সামনে জেরিনকে পরে থাকতে টের পায় নি ৷ "শুনুন, এই মেয়েটার লাশ এখন তাড়াতাড়ি লুকান ৷ উনাদের কিছুই জানাবেন না ৷ আমার কথাও কিছুই বলবেন না ৷"- দারোয়ানকে কথাটি বলেই বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে গেলো নার্স ৷ সাথে ওই মোবাইলটাও নিলো ৷ দারোয়ান তাড়াতাড়ি লাশটাকে দারোয়ানের রুমে লুকিয়ে রাখলো ৷ একটু পর সেই হাসপাতালের মালিক আর ডাক্তার এদিকেই আসলো ৷ উচ্চপদস্থ লোকদের দেখলেই দারোয়ানদের কাজ দাড়িয়ে স্যালুট করা ৷ দারোয়ান তাই করলো ৷ ডাক্তার তখন আশেপাশে তাকাতে তাকাতে বললো, "কেউ কি কোনো বাচ্চাকে নিয়ে বেরিয়েছে?" দারোয়ান হালকা ঘাবড়ে গেলো ৷ তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, "কই স্যার? না তো ৷" হা়সপাতালের মালিক দারোয়ানের কথা শেষ হতে না হতেই বলে উঠলো, "দুর থেকে খেয়াল করলাম কার সাথে যেন কথা বলছিলে?" দারোয়ান তখন বুদ্ধি করে বললো, "ও, উনি তো নার্স ৷ এইযে আপনি যে কথা বললেন, উনিও সেই কথা বলে খুঁজতে গেলেন ওই মেয়ে আর বাচ্চাটারে খোঁজার জন্য ৷" ডাক্তার আর হাসপাতালের মালিক আর কিছু না বলে চলে এলো ৷ একটু দুরে যেতেই ডাক্তার বলল, "নার্সটা কাজের আছে ৷ এখন শুধু মোবাইলটা পেলেই হয় ৷" এদিকে নার্স বাচ্চাটাকে নিয়ে হাটতে লাগলো মেইন রোডের একপাশ দিয়ে ৷ রাস্তা তখন খুব নির্জন ৷ একটা মানুষও নেই ৷ নার্স একটু বাচ্চাটার দিকে তাকালো ৷ কি সুন্দর আর নিষ্পাপ চেহারা ৷ কিন্তু সে যে বাচ্চাটাকে তার বাসায় নিয়ে যাবে তারও উপায় নেই ৷ কারণ তার স্বামী সন্দেহ করতে পারে ৷ নার্সটির আসল নাম হোসনে আরা ৷ বিয়ে করেছে মাত্র একমাস ৷ কিন্তু তার স্বামী তাকে অল্পতেই সন্দেহ করে ৷ যেমন তরকারিতে নুন কম হয়েছে, তো ওর স্বামী রেগে যেয়ে বলবে, রান্নার সময় অন্য কোনো ছেলের কথা ভাবছিলো, তাই এমন হয়েছে ৷ এখন বাচ্চাটাকে নিয়ে গেলে বাড়িতে একটা তুলকালাম কান্ড ঘটে যাবে ৷ হাটতে হাটতে খেয়াল করলো, রাস্তার পাশে কিছু গুন্ডা মতো লোক বসে বসে নেশা করছে ৷ নার্স ভয় পেতে লাগলো ৷ কিন্তু যেখানেই বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয় ৷ লোকগুলো নার্সকে নানা বাজে কথা বলতে বলতে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো ৷ নার্স ভয়ে দৌড় দিলো ৷ হাতে বাচ্চাটা থাকায় ঠিকমতো দৌড়াতে পারছে না ৷ মাস্তানগুলোও তার পিছে দৌড়াতে লাগলো ৷ ওরাও নেশা করায় ঠিকমতো দৌড়াতে পারছে না ৷ নার্স একটু দুরে রাস্তার ডানে যেতেই একটা ট্রাক দেখতে পেল ৷ ট্রাকটা তখন থেমে ছিলো ইঞ্জিন চালানো অবস্থায় ৷ নার্স ঐ ট্রাকের জানালার কাছে যেয়ে ড্রাইভারকে বললো, "ভাই, আমাকে একটু সাহায্য করুন না! আমাকে কিছু মাস্তান তাড়া করেছে ৷"

আগামী পর্বে:
নার্স কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলে উঠলো, "কি চান আপনারা? আমি আপনাদের কি ক্ষতি করেছি?" ড্রাইভারের সাথে যে লোকটা ছিলো, সেই লোকটা বলল, "ওই মাস্তানগুলা আপনের লগে যা কইরবার চাইসিলো, অহন আমরা আপনার লগে তাই করুম ৷"
_____________________________
"হায় আল্লাহ! বাচ্চা কানতেসে কনে? এই রাস্তা দিয়া এতো দিন ধইরা আসি, কোনোদিনও তো এইহানে কোনো বাড়িঘর দেহি নাই যে কান্নার আওয়াজ আইবো? জিন টিন না তো আবার? নাকি আবার কেউ বিপদে পরছে? যাই ৷ আল্লাহর নাম কইরা একটু আগাইয়া যাইয়া দেহি ৷"
×
পরিচয়(৩)(সিজন-১)

নার্স ঐ ট্রাকের জানালার কাছে যেয়ে ড্রাইভারকে বললো, "ভাই, আমাকে একটু সাহায্য করুন না! আমাকে কিছু মাস্তান তাড়া করেছে ৷" ট্রাক ড্রাইভারের সাথে আরেকজন লোকও ছিল ৷ ট্রাক থেকে ড্রাইভার একটা লাঠি নিয়ে নামল ৷ তারপর লাঠি দিয়ে মাস্তানগুলোকে প্রচুর মারতে লাগলো ৷ তারপর মাস্তানগুলো দৌড় দিয়ে চলে গেলো ৷ ড্রাইভার ডান হাত দিয়ে বাম কাঁধের ধুলো ঝারতে ঝারতে বললো, "আপনে ঠিক আছেন?" নার্স বললো, "জ্বী ঠিক আছি ৷" ট্রাক ড্রাইভার তখন বলল, "আপনে চাইলে আপনারে কোথাও পৌছাইয়া দিতে পারি?" নার্স কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো ৷ ট্রাকের পেছনের পাল্লা খুলে দিলে ট্রাকের ওপর উঠলো নার্স ৷ তারপর ট্রাক চলতে শুরু করলো ৷ ওর এক বন্ধ্যা বান্ধবী আছে যে ছেলে মেয়ে নিতে খুব আগ্রহী ৷ তাই নার্স ভাবলো, ওর ওই বান্ধবীর কাছে বাচ্চাটাকে দেবে ৷ বাচ্চাটাকে একপাশে রেখে নিজের মোবাইলের মেমোরি কার্ড খুলে জেরিনের হাতে যে মোবাইল ছিলো, সেটায় লাগালো ৷ আর সেই মোবাইলে যে মেমোরি কার্ড ছিলো, সেটা নিজের গলার লকেটের ভেতর রেখে বাচ্চাটার গলায় পড়িয়ে দিলো ৷ সাধারণত লকেটের ভেতর নিজের এবং আপন মানুষের ছবি থাকে ৷ কিন্তু এই লকেটে কোনো ছবিই ছিলো না ৷ হঠাৎ নার্স খেয়াল করলো, ট্রাক ড্রাইভারদের নার্স যে পথে যেতে বলেছিলো, সে পথে না যেয়ে অন্য পথে যাচ্ছে ৷ নার্স বার বার তাদের ট্রাক থামাতে বললেও তারা ট্রাক থামালো না ৷ শুধু মুখে অশালীন হাসি হেসে উঠলো ৷ নার্স বুঝতে পারলো, এও তাদের মতো আরেক গুন্ডা ৷ নার্স পরে গেলো বিপদে ৷ কি করবে বুঝতে পারলো না ৷ কাউকে যে কল করবে, তারও উপায় নেই ৷ না নিজের মোবাইলে ব্যালান্স আছে, না জেরিনের কাছ থেকে পাওয়া মোবাইলটায় টাকা আছে ৷ ট্রাক চলতে চলতে ঢাকার বাইরে টাঙ্গাইলের একটা গ্রামের ভেতর থামলো ৷ রাত তখন ৩টা ৩০এর মতো বাজে ৷ তাই গ্রামও সে সময় নির্জন ৷ আশেপাশে কোনো বাড়ি ঘরও নজরে পড়ছে না নার্সের ৷ ট্রাক থেকে সেই ড্রাইভার আর ড্রাইভারের সাথে থাকা লোকটা নেমে এলো ৷ তারপর ট্রাকের পেছনের পাল্লা খুলতে লাগলো ৷ নার্স কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলে উঠলো, "কি চান আপনারা? আমি আপনাদের কি ক্ষতি করেছি?" ড্রাইভারের সাথে যে লোকটা ছিলো, সেই লোকটা বলল, "ওই মাস্তানগুলা আপনের লগে যা কইরবার চাইসিলো, অহন আমরা আপনার লগে তাই করুম ৷" নার্স বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, "আমি তোকে এই ট্রাকে আল্লাহর ভরসায় রেখে গেলাম ৷ আমি আর কিছুই করতে পারছি না এই মুহুর্তে ৷" ট্রাক ড্রাইভার আর তার সাথে থাকা লোকটা যখনই ট্রাকে উঠলো, সেই সময় নার্স ট্রাকের পাশ দিয়ে চাকার ওপর পা দিয়ে নেমে রাস্তার পাশে থাকা ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে দৌড় দিলো ৷ বাচ্চাটা তখনও কাঁদছে ৷ ট্রাক ড্রাইভার আর তার সাথে থাকা লোকটা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েই রইলো ৷ কিছু করতে পারলো না ৷ ট্রাক ড্রাইভারের সাথে থাকা লোকটা বলল, "যা! চইলা গেল?" ট্রাক ড্রাইভার তখন বাচ্চার দিকে তাকিয়ে বললো, "এই বাচ্চাটার কি করবি?" ট্রাক ড্রাইভারের সাথে থাকা লোকটা বললো, "চল, খুন কইরা ফেলি ৷" ট্রাক ড্রাইভার তাতে অসম্মতি জানিয়ে বলল, "না ৷ পাপ হবেনে ৷ এ করা যাবে না ৷" "একটু আগে নার্সের লগে যা কইরবার চাইলি সেইডা বুঝি পাপ আছিলো না?" ট্রাক ড্রাইভার লোকটার গালে একটা চড় মেরে বলল, "সে তো বড় মানুষ ছিল ৷ এইসব পুচ্চিগুলা নিষ্পাপ হয় জানোস না? এদের মারলে যদি বেশি পাপ হয় ৷" অন্য লোকটা গালে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, "পাপ তো পাপই ৷ এর আবার কম বেশি কি?" ড্রাইভার এবার খুব বিরক্ত হয়ে বলল, "তুই বেশি কথা কস৷"
এরপর কেউ আর কেনো কথা বললো না ৷ ট্রাক ড্রাইভার বাচ্চাটাকে রাস্তার পাশেই একটা পেয়ারা গাছের গোড়ায় রেখে ট্রাক নিয়ে চলে এলো ৷ বাচ্চাটা তখনও কাঁদছে ৷
একটু দুরেই একটি লোক হাতে টাকা গুনতে গুনতে এ পথেই আসছিলো ৷ লোকটা মোটামুটি লম্বা ৷ মাথায় চুল ভরা ৷ গায়ে একটা ময়লা সাদা গেঞ্জি, আর লুঙ্গি ৷ কোমরে গামছা বাঁধা ৷ হাঁটতে হাঁটতে নিজেই নিজেকে বলছিলো, "যাইক ৷ সকল ধারগুলা জোগাড় কইরা ফেলসি ৷ আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া ৷ আল্লাহ বাঁচায় রাখলে পরশুই গেরামে ফিরা যামু ৷ হঠাৎ বাচ্চাটার কান্নার আওয়াজ লোকটার কানে এসে পৌছায় ৷
"হায় আল্লাহ! বাচ্চা কানতেসে কনে? এই রাস্তা দিয়া এতো দিন ধইরা আসি, কোনোদিনও তো এইহানে কোনো বাড়িঘর দেহি নাই যে কান্নার আওয়াজ আইবো? জিন টিন না তো আবার? নাকি আবার কেউ বিপদে পরছে? যাই ৷ আল্লাহর নাম কইরা একটু আগাইয়া যাইয়া দেহি ৷"

আগামী পর্বে:
দরজা খোলার পর বাচ্চাটাকে দেখেই ঘুম জড়ানো চোখদুটো বিষ্ময়ে বড় বড় হয়ে গেলো ৷ বলে উঠলো, "ওমা! এই বাচ্চা কেডা?" জয়নাল মুখে আঙুল দিয়ে বলল, "আস্তে কথা কও ৷ ভেতরে চলো, কইতাসি ৷"
×
পরিচয়(৪)(সিজন-১)

"হায় আল্লাহ! বাচ্চা কানতেসে কনে? এই রাস্তা দিয়া এতো দিন ধইরা আসি, কোনোদিনও তো এইহানে কোনো বাড়িঘর দেহি নাই যে কান্নার আওয়াজ আইবো? জিন টিন না তো আবার? নাকি আবার কেউ বিপদে পরছে? যাই ৷ আল্লাহর নাম কইরা একটু আগাইয়া যাইয়া দেহি ৷" কথাটি বলেই কালেমা পড়তে পড়তে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলেন লোকটা ৷ একটু দুর হাঁটতেই পেয়ারা গাছের গোঁড়ায় বাচ্চাটাকে দেখতে পেলেন লোকটা ৷ ছোটবেলায় বাচ্চারা দেখতে অনেক সুন্দর হয় ৷ বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বলল, "আহারে! কি সুন্দর একখান বাচ্চা ৷ কেডায় যে এইভাবে বাচ্চা পোলাপাইনগোরে এমনে ফালাইয়া দেয়, আল্লাহই জানেন ৷" লোকটার কোলে ওঠার কিছুক্ষণ পর বাচ্চাটা কান্না থামালো ৷ তারপর ফ্যাল ফ্যাল করে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো ৷ চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে লোকটা বললো, "কাউরেই তো দেখতাসি না যে বাচ্চাডারে এইহানে রাইখা গেছে এইরকম ৷ আমার বউডার বাচ্চা কাচ্চা হইবো না শুইনা কি কষ্টে আছে, আর এই বাচ্চার মাও ক্যামনে যে ওরে এইহানে ফালাইয়া রাইখা গেছে, আল্লাহই জানেন ৷ কি আর করার, যাই দেহি ৷ বাসায়ই লইয়া যাই ৷ একটু পরে আবার ফজরের আজান দেবে ৷ নামাজ পড়তে হইবো ৷" বলেই বাচ্চাটাকে নিয়েই নিজের বাসার দিকে রওনা হলো লোকটা ৷ বাচ্চাটা লোকটার কোলেই ঘুমিয়ে পড়লো ৷ বাসায় যেতে খুব একটা দেরি হয়না ৷ তার ঘরটা একটা ফাঁকা মাঠের কোণায় কোনোরকমে কাঠ খড় দিয়ে বানানো ৷ সামনের দিকে ফাঁকা, আর পেছনের দিকে দুটো টিনের বাড়ি ৷ ঘরের সামনে এসে দরজায় নক করতে করতে বলতে লাগলো, "ও জামেনা, জামেনা! দরজা খোলো ৷ ও জামেনা ৷" লোকটার স্ত্রীর নাম জামেনা বেগম ৷ আর লোকটার নাম জয়নাল তালুকদার ৷ কিছুক্ষণ পর ঘুম জড়ানো চোখ নিয়ে দরজা খুললো জামেনা ৷ জামেনা জয়নালের চেয়ে খাটো ৷ চেহারাটা মোটামুটি ফর্সা ৷ চুলগুলো কোকড়ানো ৷ দরজা খোলার পর বাচ্চাটাকে দেখেই ঘুম জড়ানো চোখদুটো বিষ্ময়ে বড় বড় হয়ে গেলো ৷ বলে উঠলো, "ওমা! এই বাচ্চা কেডা?" জয়নাল মুখে আঙুল দিয়ে বলল, "আস্তে কথা কও ৷ ভেতরে চলো, কইতাসি ৷"
জয়নাল ভেতরে ঢুকে বাচ্চাটাকে কাঠ খড়ের তৈরি বিছানার ওপর রাখলো ৷ তারপর তারপাশে বসে বোতল থেকে স্টিলের গ্লাসে পানি ঢেলে খেলো ৷ ঘরটা খুবই ছোট ৷ ওই কাঠখড়ের বিছানা আর একটা ছোট টেবিল ছাড়া কিছুই ছিলো না ৷ ঘরে বিদ্যুতের ব্যাবস্থা ছিলো না ৷ টেবিলের ওপর একটা হারিকেন জ্বলছে ৷ জামেনা আগ্রহের সহিত জয়নালের পাশে বসে বলল, "হ্যাগো? বাচ্চাটা কার? তুমি আবার অন্য কাউরে বিয়া করো নাই তো?" জয়নাল জয়নাল হালকা বিরক্ত হয়ে বলল, "আরে ধুর ৷ কি সব যে উল্টা পাল্টা কথা যে কও না ৷" জামেনা বলল, "তাইলে কোত্থেইকা আনসো এই বাচ্চারে?" জয়নাল সব কথা খুলে বলল জামেনাকে ৷ জামেনা বলল, "ও ৷ আচ্ছা, এই বাচ্চারে আমরা রাইখা দেই?" জয়নাল আবার বিরক্ত হয়ে বলল, "পাগল হইসো? কার না কার বাচ্চা ৷" জামেনা তখন বলল, "আইচ্ছা, যদি কোনোদিন কেউ এই বাচ্চার খোঁজ করতে আসে, তাইলে দিয়া দিমুনে ৷ ততদিন আমার কাছে থাক?" জয়নাল একটু ভেবে তারপর বলল, "ঠিক আছে রাখ ৷ ভালো কথা ৷ কাইলকাই কিন্তু আমরা গেরামে ফিরা যাইতাসি ৷ জামেনা খুশির সাথে বলল, "সত্যি কইতাসো! ধারের ট্যাকা সব জোগাড় করা শেষ?" জয়নাল একটু কেশে বললো, "হ ৷" আইচ্ছা, তাইলে গেরামে যাইয়া সবাইরে কমু, এইডা আমাগো বাচ্চা ৷" জয়নাল একটু নড়েচড়ে বসে বলল, "তা কইও ৷ তয় আসল বাপ মা ফিরা আইলে ফেরত দেওয়া লাগবো কিন্তু ৷" জামেনা মুখে কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো ৷ খানিক বাদে ফজরের আজান দিলে নামাজ পড়তে মসজিদে চলে যায় জয়নাল ৷
এদিকে ফজর আজানের একটু পর হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারের সামনে যেতেই সেই নার্স দেখতে পেলো, ডাক্তার আর হাসপাতালের মালিক মুখোমুখি বসে আছে আর কি সব শলা পরামর্শ করছিলো ৷ নার্সকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে নার্সের কাছে এলো দুজনেই ৷ ডাক্তার হাসিমুখে বলল, "পেয়েছো ওদের?" কিছুক্ষণ চুপ করে নার্স বলল, "না৷" হাসপাতালের মালিক আর ডাক্তার দুজনেই বিরক্ত হয়ে গেলো ৷ হাসপাতালের মালিক বললো, "তাহলে কি করেছো সারাটা রাত? সারাটা রাত আমরা টেনশনে ঘুমাইনি ৷" নার্স বলল, "সারারাত আমি প্রমান ওদের খুঁজে বেরিয়েছি ৷" ডাক্তার তখন বলল, "পারসো? খুজতে পারসো কিছু?" নার্স তখন বিদঘুটে একটা হাসি হেসে বলল, "হ্যা, পেরেছি ৷" ডাক্তার আগ্রহের সাথে বলল, "কি পেয়েছো?" নার্স তখন "এই মোবাইলটা ৷" বলেই মোবাইলটা দেখালো ডাক্তার আর হাসপাতালের মালিককে ৷ দুজনের মুখেই একটা ভিন্নরকম হাসি ফুটে উঠলো ৷ চোর ধরা পড়তে গিয়েও ধরা না পড়লে যেরকম হাসিমুখ দেখা যায়, ঠিক সেরকম ৷

আগামী পর্বে:
এক আছাড়ে জাশির ভেঙে ফেলল মোবাইলটা । জাশির তখন বিদঘুটে হেসে বলল, “শেষ । না থাকল প্রমান না থাকল ভয় ।” সাখুরা তখন বলল, “আরে গাধা, প্রমান কি মোবাইলে থাকে? প্রমান থাকে মেমোরি কার্ডে । এর মেমোরি কার্ড বাইর কইরা ভাঙো । তাইলেই শান্তি ।” জাশির তখন মেমোরি কার্ডটাও ভেঙে ফেলল । আর দুজনে মিলে হাসাহাসি শুরু করে দিলো ।
×
পরিচয়(৫)সিজন-১

চোর ধরা পড়তে গিয়েও ধরা না পড়লে যেরকম হাসিমুখ দেখা যায়, ঠিক সেরকম ৷ নার্স নিশ্চিন্তে ডাক্তারের হাতে দিলো মোবাইলটা । বাইরে আসা রোদের আলোয় ডাক্তার আর হাসপাতালের মালিকের নেমপ্লেট চক চক করছে । এই হাসপাতালের মালিকের নাম সাখুরা শেখ আর ডাক্তারের নাম জাশির খান । এক আছাড়ে জাশির ভেঙে ফেলল মোবাইলটা । জাশির তখন বিদঘুটে হেসে বলল, “শেষ । না থাকল প্রমান না থাকল ভয় ।” সাখুরা তখন বলল, “আরে গাধা, প্রমান কি মোবাইলে থাকে? প্রমান থাকে মেমোরি কার্ডে । এর মেমোরি কার্ড বাইর কইরা ভাঙো । তাইলেই শান্তি ।” জাশির তখন মেমোরি কার্ডটাও ভেঙে ফেলল । আর দুজনে মিলে হাসাহাসি শুরু করে দিলো । নার্সও হাসিতে যুক্ত হল কিন্তু তার হাসিতে একটু তফাৎ লক্ষণীয় ।
এদিকে ভোরের আলো স্পষ্ট হবার আগেই তল্পিতল্পা গোছানো শেষ জয়নাল আর জামেনার । বেরোনোর আগে আশে পাশে পরিচিতজনদের সাথে দেখা করে এলো জামেনা । এরপর ভোরের আলো স্পষ্ট হতেই বেড়িয়ে পড়লো নিজেদের গন্তব্যে । দুধারে কাশবনে ঘেরা রাস্তার পাশে বাসের জন্য ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জয়নাল, জামেনা । জামেনার কোলে বাচ্চাটা ঘুমিয়ে গেছে । খানিক বাদেই এলো একটি বাস । তেমন ভিড় নেই বাসে । শেষের দিকে দুটো সিটে বসলো ওরা । বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে জামেনা ভাবতে লাগলো পুরনো দিনের কথা ।
জামেনা আর জয়নাল বিয়ে করেছে ১৬ বছর হবে । ওরা থাকতো ফকিরাপুল গ্রামে । জামেনা এতিম একটা মেয়ে । ছোটবেলা থেকে দোকানে কাজ করে বড় হয়েছে । জয়নাল ট্রাকে জিনিসপত্র এ জেলা থেকে ও জেলা আনা নেয়া করে যদিও ট্রাকটা জয়নালের ছিল না । জামেনার একটা শারীরিক সমস্যা থাকায় ওর কোন সন্তান হয় নি । তারপরেও তাদের সংসারে শান্তির কোন কমতি ছিল না । কিন্তু একদিন ঘটে যায় এক বিরাট ঘটনা । ফকিরাপুল গ্রামের চেয়ারম্যান ফয়সাল শেখের ছিল অনেক বিঘা ধানের ক্ষেত । সেই ক্ষেতে যে ধান উৎপন্ন হয়, সেই ধান বিভিন্ন জেলায় জেলায় পাঠিয়ে টাকা আয় করে । বিভিন্ন জেলায় সাধারণত এই জয়নালের ট্রাকেই পাঠাতো । একদিন এরকম ধান নিয়ে যাবার সময় হঠাৎ গাড়ির চাকা রাস্তার পাশে পামচার হয়ে যায় । জয়নাল ট্রাক থেকে নেমে চাকা ঠিক করার আগে রাস্তার ওপাশে যেয়ে একটু মুত্রত্যাগ করে আশে । কিন্তু এসে যা দেখল, তা দেখার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না । ট্রাক রাস্তার যে পাশে ছিল, তার পাশেই ছিল একটা বিরাট খাল । রাস্তা ভেঙে ট্রাক পড়ে গেছে ঐ খালের ভেতর । জয়নাল নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না । খুব দ্রুত সেখানে একটা ভিড় জমে যায় । জয়নাল নিজের কপাল চাপড়াতে থাকে । ট্রাকে প্রায় ১০হাজার টাকার ধান ছিল । আর ট্রাকটার দাম ছিল ২লাখ ৩০হাজার টাকা । গ্রামের চেয়ারম্যান ধানের দাম মাফ করে দিলেও ট্রাকের মালিক ট্রাকের দামের জন্য উঠেপড়ে লাগে । তখন জয়নাল প্রতিজ্ঞা করে, সে গ্রাম থেকে চলে যাবে এবং এই মোট ২লাখ ৪০হাজার টাকা জোগাড় করে তবেই আবার গ্রামে ফিরবে । অবশেষে ৫ বছরের চেষ্টায় সে মোট ২ লাখ ৭৫হাজার টাকা জোগাড় করেছে । এই টাকা জোগাড়ের জন্য ওরা কতই না কষ্ট করেছে । দিনে বিভিন্ন কন্সট্রাকশনে কাজ করে, সন্ধায় বিভিন্ন জিনিস ফেরি করে এবং রাতে নাইট গার্ডের কাজ করে কিছু টাকা জমিয়েছে । আর বাকিটা জামেনা মানুষের বাসায় কাজ করে, কাপড় সেলাইয়ের কাজ করে এবং বিভিন্ন ছোটখাট হোটেলে খাবার বানিয়ে এ টাকা জমিয়েছে । তাদের এতদিনের পথচলা মোটেও সহজ ছিল না । আজ তাদের সুখের দিন এসেছে । আজ ওরা বাড়ি ফিরছে । কতদিন যে নিজের গ্রামের মানুষগুলোকে, নিজের বাসাটাকে দ্যাখে না! আর সাথে ওদের একটা বাচ্চা । ওদের কাছে এটা আল্লাহর রহমত । ২লাখ ৪০হাজার টাকা শোধ করার পর বাকি ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে নিজেদের বাসায় একটা দোকান দিয়ে ব্যাবসা করে ওদের বাকি জীবন চলে যাবে । ওদের এই ছেলে একদিন বড় হবে, লেখাপড়া করবে অনেক বড় মানুষ হবে আরও কত কি! একটু পড়ে গাড়ি এসে গেলো ফকিরাপুল গ্রামে । পোড়ামাটির ফলকের মতো দেয়ালে কে যে কবে গ্রামের নামটা সীমানার শুরুতে লিখেছিল তার কোন হদিস নেই । জানালা দিয়ে মাথা বের করে মনের আনন্দে নিজের গ্রাম দেখতে লাগলো জামেনা ।

আগামী পর্বেঃ
জামেনা জয়নালের বুকে মাথা রেখে বলল, “আইচ্ছা, এই পোলার নাম কি দিবা?” জয়নাল বলল, “তুমি দেও । তোমার যা ইচ্ছা হয় ।” জামেনা ভ্রু কুঁচকে বলল, “না । তুমি বিয়ার আগে আমারে কইসিলা পোলার নাম তুমিই দিবা । তহন তো আর জানতাম না, আমার কোন পোলা মাইয়া হইব না । এহন তুমিই নাম দেও । তয় রহিম, করিম, নেলে, বুলু এইসব নাম দিলে কিন্তু চলবো না , আমার পোলারে শহরের পোলাগোরে মতো নাম দেও ।” জয়নাল বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বলল, “শহরের পোলাগোরে নাম যে কেমন, তা তো আর জানি না, তয় একবার একখান সিনেমা দেখসিলাম । ঐ সিনেমায় যে নায়কের নাম ছিল আবির । তাই আমিও আমার পোলার নাম দিলাম আবির ।”
×
পরিচয়(৬)(সিজন-১)

জানালা দিয়ে মাথা বের করে মনের আনন্দে নিজের গ্রাম দেখতে লাগলো জামেনা । রাস্তার দু পাশ ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেছে । সেখানে সব মানুষের বাসা আর কত সবুজ গাছপালা । একটু পড়েই গাড়ি থেকে নেমে গেলো ওরা । বাকি রাস্তা বাসে যাওয়া যায় না । গাড়ি থেকে নামতেই দেখা জামেনার বাসার পাশের বাসার ছোট ছেলে রফিকের সাথে । কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সাইকেলে করে কোথাও যাচ্ছিলো । ৫ বছরের ব্যাবধানে অনেক বড় হয়ে গেছে । জামেনা ওকে চিনতেই পারে নি । রফিকই ডাকল জামেনাকে, “আরে, জামেনা বু, কেমন আছো?” জামেনা ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আছি রে, আল্লাহ ভালোই রাখসে । তুই কেমন আছিস?” রফিক বলল, “এইতো আসি । আমার মাও তো সারাদিন তোমার কথা কয় । তুমি কবে আইবা, তুমি কবে আইবা ।” রফিক যখন ক্লাস টু তে, তখন জামেনারা গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলো । আর আজ সে ক্লাস সেভেন এ পড়ে । জামেনার কোলে বাচ্চাটাকে দেখে রফিক বলল, “অমা! এইডা কি তোমার পোলা?” জামেনা বলল, “না……মানে, হ ।” রফিক একগাল হেসে বলল, “না মানে কি? মিষ্টি কিন্তু খাওয়াইতে হইব । বাড়িত যাও তাইলে । আমি কোচিং কইরা আসি ।” বলেই সাইকেল নিয়ে চলে গেলো রফিক । জামেনা আর জয়নাল রিকশা নিলো । জামেনার কোলে থাকা বাচ্চাটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখতে লাগলো চারপাশ । পথে চেনা অচেনা কত মুখের সাথে দেখা । জামেনা জয়নালের বুকে মাথা রেখে বলল, “আইচ্ছা, এই পোলার নাম কি দিবা?” জয়নাল বলল, “তুমি দেও । তোমার যা ইচ্ছা হয় ।” জামেনা ভ্রু কুঁচকে বলল, “না । তুমি বিয়ার আগে আমারে কইসিলা পোলার নাম তুমিই দিবা । তহন তো আর জানতাম না, আমার কোন পোলা মাইয়া হইব না । এহন তুমিই নাম দেও । তয় রহিম, করিম, নেলে, বুলু এইসব নাম দিলে কিন্তু চলবো না , আমার পোলারে শহরের পোলাগোরে মতো নাম দেও ।” জয়নাল বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বলল, “শহরের পোলাগোরে নাম যে কেমন, তা তো আর জানি না, তয় একবার একখান সিনেমা দেখসিলাম । ঐ সিনেমায় যে নায়কের নাম ছিল আবির । তাই আমিও আমার পোলার নাম দিলাম আবির ।” জামেনা বলল, “মেলা সুন্দর নাম তো? আইচ্ছা, এইডা হইব ওর ডাক নাম । আমি তাইলে ভালো নাম দেই । ওর নাম আমি দিলাম সালমান খান আবির ।” জয়নাল হালকা হেসে বলল, “বাহ, তুমিও দেহি নায়কের নামই দিলা ।” জামেনা শুধু হাসলো । কিছু বলল না ।
এদিকে নার্স হোসনে আরা সকালে হাসপাতালে কাজ শেষে বাসায় ফেরার জন্য রওনা হলেন । গেইটের কাছে দারোয়ানকে ডাকলেন । বলল, “মেয়েটার লাশটা কি করেছেন?” দারোয়ান বলল, “আমার একখান পরিচিত ভ্যানওয়ালা দিয়া মাইয়াডারে কবর দিয়াইসি । নার্স কেবল ধন্যবাদ জানিয়ে কিছু টাকা দারোয়ানের হাতে দিয়ে চলে এলো । বাসায় যেয়ে স্বামীকে কি বলবে তা সে জানেনা । তার চেয়ে চিন্তা হচ্ছে, বাচ্চাটা কেমন আছে এটা ভেবে । ঐ ট্রাকওয়ালারা কি বাচ্চাটাকে মেরে ফেলল, নাকি অন্য কারো আশ্রয় গ্রহণ করলো এসব চিন্তা ভাবনা করতে করতে বাসার পথে যেতে লাগলো নার্স । একটা রিকশায় করে বাসায় এলো সে । এসে দেখল, দরজা খোলা । ভেতরে ঢুকে স্বামীর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল প্রচুর রেগে ঘরের এ কোণ থেকে ও কোণ দ্রুত বেগে হাঁটছে । বিড়বিড় করে বলছে, “আসুক আজ বাড়িতে । ওর আজকে খবর আছে । সারারাত কি করে ও? আজ ওর অন্য কে আছে, খুজে বের করবোই ।” নার্স নিজের উপস্থিতি বোঝানোর জন্য হালকা কেশে উঠলো । খুব ভয় লাগছে তার । কাশির আওয়াজ শুনে দাঁড়িয়ে গেলো ওর স্বামী, সামির । পেছন ফিরে তাকিয়ে যেই দেখল মাথা নিচু করে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে হোসনে আরা, অমনি এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে দরজা খুলে গলা চেপে ধরে হোসনে আরার পিঠ দেয়ালের সাথে লাগালো ।
এদিকে জামেনা নিজের বাসার কাছে পৌঁছে গেলো । বাকি রাস্তা রিকশা নিয়ে যাওয়া যাবে না । রিকশা ভাড়া দিয়ে ধীরে ধীরে ঢালু পথে নেমে গেলো ওরা । এলাকায় নতুন অনেকেই এসেছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে । নিচে নামতেই দু পাশে দুটো বাড়ি । বা পাশের বাড়িটায় থাকতো কলিমারা । বোধ হয় এই পাঁচ বছরের মধ্যে অন্য কোথাও চলে গেছে । জানালার ধারে বসে থাকা এর অচেনা পুরুষকে দেখে বুঝল জামেনা । ডা পাশের বাড়িটায় জামিলারা থাকে । জামিলার বয়স বর্তমানে ১৭ । জামেনা যেয়েই জামিলাকে জানালা দিয়ে ডাকলো । জামিলা জামেনা দেখেই উৎফুল্লের সাথে বলল, “ও মা! জামেনা আপা! কেমন আছো গো তুমি?” জামেনা জামিলার গাল ছুঁয়ে বলল, “এই তো সোনা, ভালোই আছি রে । তুই কেমন আছিস?” জামিলা বলল, “এই তো, আছি ভালোই । জয়নাল ভাই কই?” “ঐ ব্যাগ ট্যাগ নিয়া মনে হয় আমার আগেই চইলা গেছে । তোর কাকি আর ভাইয়ের কি খবর?” জামিলার সাথে এখানে ওর মা আর ভাই থাকতো । জামিলার বাবা মারা গেছে জামিলা ছোট থাকতেই । জামিলা বলল, “ভাইয়া তো পড়াশুনার জন্য ঢাকায় গেছে ।” জামেনার কোলে বাচ্চাটা দেখে জামিলা বলল, “ও মা! এইডা তোমার বাচ্চা নাকি?” “হ রে ।” “কি সুন্দর দেইখতে । নাম কি দিসো?” জামেনা হেসে হেসে বলল, “সালমান খান আবির ।” জামিলার মা জামেনাকে মোটেও পছন্দ করে না । আড়াল থেকে কথা শুনে বলল, “সে কি! তোর না শুনছিলাম বাচ্চা হইবো না? এহন ক্যামনে হইলো? অন্যখানে যাইয়া আবার চরিত্র নষ্ট হইয়া যায় নাই তো?” জামেনা কিছু বলল না ।

আগামী পর্বেঃ
হোসনে আরা মাটির ওপর পড়ে গেলো । সামির তখন হোসনের চুল ধরে টান দিতেই খেয়াল করলো হোসনের গলার লকেটটা নেই । রেগে যেয়ে বলল, “কিরে! তোর গলার লকেট কই?” হোসনে এবার পড়ে গেলো আরও বড় বিপদে । লকেটটা ওর স্বামী বিয়ের আগের রাতে দিয়েছিলো । সামির তখন হাতে ঝাড়ু নিয়ে বলল, “কারে লকেট দিসোস বল, নাইলে আইজকা তোরে মাইরাই ফেলমু!”
×
পরিচয়(৭)(সিজন-১)

জামেনা কিছু বলল না । জামিলা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আহ, আম্মা, আপনে যান তো । এইসব কি ধরনের কথা কন আপনে? আপনের মুখে কি………” জামেনা জামিলাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “থাক, বাদ দে তুই । ভুল তো কিছুই বলে নি, কিন্তু ভুল ভেবেছে অনেক কিছু । আমি সেখানে ডাক্তার দেখিয়ে নিজেকে সুস্থ করে তারপর এই বাচ্চার মা হয়েছি ।” জামিলার মা ঠোঁট বাকিয়ে ভেংচি কেটে চলে গেলো । জামেনা আর কিছু বলল না । জামেনা বলল, “ও জামেনা আপা, গোসল করতে যাইবা না?” জামেনা বলল, “হ, যামু তো, কইলখাটা ঘাট এহনো আছে? জামিলা বলল, “হ, আছে তো, তুমি যাও, আমি আইতাসি ।” বলেই জামিলা চলে গেলো । জামেনা বাচ্চাকে নিয়ে এগোতে লাগলো । সামনে সরু একটা খাল । খালের ওপর একটা ছোট সাঁকো । এই সাঁকো আর খাল আগে ছিল না । হয়তো কেউ কোন কারণে কেটেছে । খাল পেরিয়ে ওপাশে পাশাপাশি দুটো বাড়ি । ডান পাশে আগে বাড়িটা ছিল না । ফাঁকা ছিল । আর ডান পাশের বাড়িটায় থাকে রফিকরা । রফিকের সাথে ওর মা, বাবা আর ওর ১ ভাই, ৩ বোন থাকে । ভাইয়ের নাম রকিব । দুই বোনের নাম আলিয়া আর মালিহা । ওরা যখন চলে যাবে, মালিহার তখন ২ বছর বয়স । এখন সাত বছর হয়েছে । দরজার সামনে পুতুল হাতে বসে থাকা মেয়েটাকে দেখে চিনে ফেলল জামেনা । যদিও সে জামেনাকে চেনে না । আলিয়া এখন হয়তো কলেজে পড়ে । আর রকিব ৭ বছর আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলো । এখন হয়ে সেখান থেকে পাশ করে চাকরি বাকরি করছে । যা হোক, বাড়ির ভেতর আর না যেয়ে সামনের বাড়িটায় গেলো আর সেটাই ওর বাসা । ভেতরে ঢুকতেই একটা ছোট উঠান । উঠোনে থাকা আম গাছটা অনেক বড় হয়ে গেছে । উঠোনের বাম পাশে রান্নাঘরের এক পাশের চাল কোন ঝড়ে বা অন্য কোন কারণে হয়তো ভেঙে গেছে । তার পাশেই টয়লেট অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে । রুমে ঢুকতেই একটা ঘর । ঘরটা কইলখাটা ঘাট ঘেষে অবস্থিত । জানালা দিয়ে তাকালেই ঘাটটা নজরে পড়ে । জানালা ঘেঁষে একটা বিছানা । বিছানায় আবিরকে শুইয়ে দিলো জামেনা । ঘরে আরও রয়েছে একটা থালাবাসন রাখার র‍্যাক, একটি জামাকাপড় রাখার মরিচা ধরা আলমারি, আর একটা ছোট ফুলের টব । সবকিছুতেই ময়লা পড়েছে । টিনের চালের ফুটো দিয়ে সূর্যের আলো ভেতরে আসছে । আবির ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে চারপাশ দেখছে । জামেনা পাশের ঘরে গেলো । যেয়ে দেখল, জয়নাল ব্যাগ থেকে জামাকাপড়গুলো বের করছে । এই ঘরে একটা চারপায়া, ৩-৪টা চেয়ার ছাড়া আর কিছুই ছিল না । দেয়ালে কিছু পুরনো ক্যালেন্ডার আর পুরনো প্লাস্টিকের ফুল । জামেনা ব্যাগ থেকে জামাকাপড় নিয়ে চলে গেলো গোসল করতে ।
এদিকে সামির হোসনে আরার গলা ধরার কিছুক্ষণ পর কোনোরকমে সামিরের হাত সরিয়ে পাশে সরে আসতে গিয়ে হোসনে আরা মাটির ওপর পড়ে গেলো । সামির তখন হোসনের চুল ধরে টান দিতেই খেয়াল করলো হোসনের গলার লকেটটা নেই । রেগে যেয়ে বলল, “কিরে! তোর গলার লকেট কই?” হোসনে এবার পড়ে গেলো আরও বড় বিপদে । লকেটটা ওর স্বামী বিয়ের আগের রাতে দিয়েছিলো । সামির তখন হাতে ঝাড়ু নিয়ে বলল, “কারে লকেট দিসোস বল, নাইলে আইজকা তোরে মাইরাই ফেলমু!” হোসনে আরা কান্নাকাটি করতে লাগলো । সামির “বল কইতাসি, বল……।” বলতে বলে চড় মারতে লাগলো হোসনে আরাকে । শেষ মেষ আর সহ্য করতে না পেরে হোসনে আরা পুরো ঘটনাটা বলে দিলো সামিরকে । সামির পুরো ঘটনা শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো । তারপর বলল, “হায় হায়! তুই করছিস এইগুলা? সাহস তো কম না? তুই হইতেছিস নার্স, এতো পণ্ডিতি করতে বলসে কে? আমি এখনই যাব । সব কথা সাখুরা আর ডাক্তার জাশিররে বইলা দেব । বলেই দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেলো সামির । যাবার সময় দরজাটা আটকে দিয়ে গেলো । নার্স সামির আটকাতে গিয়েও পারলো না । দরজায় জোরে জোরে আওয়াজ করতে করতে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, “বোলো ওদের, তোমার পা ধরি, ওদের কিছু বোলো না । প্লিজ । দরজা খোলো । ওদের কিছু বোলো না………।” কিন্তু সামির ততক্ষনে অনেক দূর চলে গেছে । বাইরেও তেমন কেউ ছিল না যে হোসনে আরার দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ শুনে দরজাটা খুলে দেবে ।
এদিকে ব্যাগ থেকে জামাকাপড়গুলো বের করা শেষে আবিরের কাছে এসে ফ্যান দিয়ে শুয়ে পড়লো জয়নাল । তখনই ওর চোখ গেলো আবিরের গলায় থাকা লকেটটার দিকে । সেটা ধরে নিজেই নিজেকে বলল, “এই লকেটের মধ্যে কি আছে? একবার তো দেইখছিলাম এর মধ্যে মাইষের ছবি-টবি থাকে । ওর বাপমায়ের ছবি-টবি যদি পাই, তাইলে তো ভালোই হয় । আহারে, বাপ মাই ওরে ফালাইয়া গেছে কিনা, তাও তো জানি না । আইচ্ছা, আগে খুইলা দেহি ।” বলেই আবিরের গলা থেকে চেইনটা খুলে নিলো জয়নাল ।

আগামী পর্বেঃ
“সাখুরা সাহেব, অনেক বড় একটা খবর আছে আপনার জন্য ।” সাখুরা তখন জাশিরের কানে কানে বলল, “এইটা হোসনে আরার ঐ বেআক্কেল স্বামীটা না?” জাশির মাথা নাড়ল । সাখুরা তখন বলল, “কি রে? তোরে না বলসি আমারে বস ডাকবি?” সামির তখন অট্টহাসি হেসে উঠে বলল, “আরে রাখেন বস । যা শোনাবো, তা শুনে আপনার খাবার হজম হয় কিনা তা-ই আগে দেখেন ।” জাশির বলল, “আচ্ছা, তুই বল কি হইসে । সামির বলল, “শর্ত আছে একটা ।” জাশির বিরক্ত হয়ে বলল, “আবার শর্ত কিসের?” জবাবে সামির বলল, “আমারে ২০ হাজার টাকা দিতে হবে ।” জাশির বিরক্ত হয়ে বলল, “আচ্ছা যা, আগে কাহিনী বল কি হইসে, তারপর ভেবে দেখবো ।” সামির তখন সব ঘটনা খুলে বলল জাশির আর সাখুরাকে । পুরো কাহিনী শুনে ভয়ে কাঁপতে লাগলো সাখুরা আর জাশির ।
×
পরিচয়(৮)(সিজন-১)
বলেই আবিরের গলা থেকে চেইনটা খুলে নিলো জয়নাল । জয়নাল যাই লকেটটা খুলতে যাবে, অমনি পেছন থেকে গোসল করে আসা জামেনা জয়নালের হাত থেকে চেইনটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো । তারপর অভিমানের স্বরে বলল, “তোমারে কইসি না, এমন কিছু করবা না, যাতে আমরা ওর মা বাপের খোঁজ না পাই ।” জয়নাল তখন বলল, “আরে, তাই বইলা ওরে কি ফেরত দেয়া লাগবো না? তুমি তো মাই হইতে পারো নাই । তাই বুইঝা দ্যাখো, এই বাচ্চাডার মায়ের মনের কি অবস্থা ।” “তা ঠিক । কিন্তু সত্যি যদি এর মা এরে ভালোবাসতো, তাইলে এমনে রাস্তার ওপর ফালায় রাইখা যাইতে পারতো?” জয়নালের ভ্রু কিঞ্চিত কুচিত হল । থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে ভাবতে লাগলো । জামেনা তখন বলল, “আর তারপরেও, আমি তো কইসিই, ওর বাপ মা যদি খোঁজ করতে করতে ওরে পাইয়া যায়, আমি ওরে দিয়া দিমু ।” জয়নাল মাথা উপর নিচ নেড়ে বলল, “ঠিক আছে । তোমার কথাই রাখলাম । কিন্তু এইটুকু আমি কইতে পারি, এর বাপ মা তোমার কাছে আইসা বাচ্চা চাইলেও তুমি এতো সহজে দিবা না । ততদিনে তোমার অনেক মায়া জন্মাবে । আর মায়া জিনিসডা ভালো না ।” জামেনা জয়নালের কথা শুনতে শুনতে চেইনটা তুলছিল । তখন দেখল, নিচে পড়ে লকেটটা খুলে গেছে । ভেতরে কোন ছবি নেই, একটা মেমোরি কার্ড । জামেনা সেটা দেখে চিনতে পারলো না । জয়নালের হাতে দিয়ে বলল, “এর মধ্যে তো কোন ছবিই নাই । শুধু এইডা আছে । কিন্তু এইডা কি জিনিস?”
এদিকে সামির হাসপাতালে এসেই গেইটের সামনে হাসপাতালের মালিকের সাথে দেখা । হাসপাতালের মালিক সাখুরা ডাক্তার জাশিরের সাথে তখন রোগীদের সাথে ভাব বিনিময় করছিলেন । এটা কেবল তার বাহিরে দেখানো মিথ্যে ভালোবাসা । কিন্তু ভেতরের খারাপ মনোভাবটা সবার অজানা । হোসনের স্বামি বিয়ের পরের দিনই এই হাসপাতালে ঘুরতে আসে । সেখান থেকেই সামিরকে চেনে এই সাখুরা আর জাশির । সামিরকে সাখুরা তেমন একটা পছন্দ করে না । কারণ সামির মুখে যা আসে তাই বলে দেয় । এখানেও কিছু উল্টাপাল্টা বলতে পারে ভেবে সামিরকে দেখেই ওর কাছে এলো সাখুরা আর জাশির । সাখুরা এখনো যদিও ভালোভাবে চিনতে পারে নি সামিরকে । সামির হাসিমুখে দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল, “সাখুরা সাহেব, অনেক বড় একটা খবর আছে আপনার জন্য ।” সাখুরা তখন জাশিরের কানে কানে বলল, “এইটা হোসনে আরার ঐ বেআক্কেল স্বামীটা না?” জাশির মাথা নাড়ল । সাখুরা তখন বলল, “কি রে? তোরে না বলসি আমারে বস ডাকবি?” সামির তখন অট্টহাসি হেসে উঠে বলল, “আরে রাখেন বস । যা শোনাবো, তা শুনে আপনার খাবার হজম হয় কিনা তা-ই আগে দেখেন ।” জাশির বলল, “আচ্ছা, তুই বল কি হইসে । সামির বলল, “শর্ত আছে একটা ।” জাশির বিরক্ত হয়ে বলল, “আবার শর্ত কিসের?” জবাবে সামির বলল, “আমারে ২০ হাজার টাকা দিতে হবে ।” জাশির বিরক্ত হয়ে বলল, “আচ্ছা যা, আগে কাহিনী বল কি হইসে, তারপর ভেবে দেখবো ।” সামির তখন সব ঘটনা খুলে বলল জাশির আর সাখুরাকে । পুরো কাহিনী শুনে ভয়ে কাঁপতে লাগলো সাখুরা আর জাশির । পাশে থাকা রোগীরা কিছুই শোনে নি । সাখুরা তখন জাশিরকে বলল, “জাশির, এবার কি হবে?” সামির মুচকি হেসে বলল, “এইযে সাখুরা সাহেব, পালালে চলবে না । আমারে আগে কিছু মালকড়ি তো দিয়ে যান ।” সাখুরা জাশিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “জাশির, একে এর পুরস্কারটা দিয়ে গ্যারেজের সামনে এসো । আমি গাড়ি বের করছি ।”জাশির কেবল হ্যাঁ বলে সম্মতি জানালো । সাখুরা গেলো গাড়ি বের করতে আর জাশির সামিরকে নিয়ে হাসপাতালের ভেতর ঢুকলো । সামির তখন জাশিরকে ইয়ার্কির সাথে জিজ্ঞেস করলো, “এইযে ডাক্তার, মাল চেয়েছি মাল । পকেট থেকে ঝেড়ে দিলেই তো হয় । তুমি কি আমার ফ্রি চিকিৎসা করে পুরস্কৃত করতে চাইছ নাকি?” জাশির তখন বলল, “আগে চল তো । এমন মাল দেব, খাওয়া দাওয়ার জন্য আর কোনদিন চাকরি বাকরি করা লাগবে না ।” একটু পর ডানে ঘুরতেই হাস্পাতালের মর্গ । উপরে লেখা থাকলেও সেটা নজরে পড়লো না সামিরের । বোকার মতো জাশিরের আগেই মর্গে ঢুকে পড়লো সামির । চারপাশে বেডে শোয়ানো অনেক লাশ । বা পাশেই ড্রয়ার । লাশগুলো থেকে একটা বিদঘুটে গন্ধ আসছে । সামির যখনই জিজ্ঞেস করতে যাবে তাকে এখানে আনা হল কেন, জাশির তখনই দরজাটা আটকে দিলো । সামির তখন পেছন ফিরে তাকিয়ে জাশিরকে বলল, “এ ডাক্তার? দরজা আটকালে কেন?” জাশির কিছুই বলল না । লাশ রাখার একটা ড্রয়ারের ভেতর ছিল ডাক্তারই সরঞ্জাম । সেখান থেকে একটা ধারালো কেচি আর একটা Chloroform এর স্প্রে নিলো জাশির । তারপর মুখে মাস্ক পড়ে সামিরের দিকে এগোতে লাগলো । সামিরও হালকা ভয় পেয়ে পেছাতে লাগলো । সামির বলতে লাগলো, “ভালো হচ্ছে না কিন্তু ডাক্তার? ডাক্তার? ঠিক হচ্ছে না কিন্তু………ভালো হচ্ছে না কিন্তু!”

আগামী পর্বেঃ
“আমি আপনারে কতবার কইসি, একখান স্মার্টফোন কিনা লন ।” বলেই মেমোরি কার্ডটা হাতে নিলো রাদিব । তারপর সেটা কম্পিউটারে ঢোকাল রাদিব । ভেতরে শুধুমাত্র একটা রেকর্ড করা অডিও । আবিরের বাবা সোহেল সেদিন মেমোরি কার্ড ফরম্যাট করে রেকর্ডটা করেছিলো যেন সহজে অন্য কেউ সেটা খুজে পায় । রেকর্ডটা অন করে শুনতে লাগলো ওরা । সাখুরা আর জাশিরের সেদিনকার কথোপকথন শুনে বেশ অবাক হল দুজনেই ।
×
পরিচয়(৯)

সামির বলতে লাগলো, “ভালো হচ্ছে না কিন্তু ডাক্তার? ডাক্তার? ঠিক হচ্ছে না কিন্তু………ভালো হচ্ছে না কিন্তু!” কিন্তু ডাক্তার কোন কথাই কানে নিলো না । ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো । একটু দূর যেতেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলো সামিরের । ডাক্তার তখন হাতে থাকা Chloroform-টা স্প্রে করলো সামিরের মুখের ওপর । তার পরপরই অজ্ঞান হয়ে পড়ে সামির । ডাক্তার জাশির তখন সামিরের বডিটা নিয়ে একটা ফাঁকা বেডে শোয়ালো । তারপর ডাক্তার ধীরে ধীরে ওর ঘাড়ের ও হাতের রগ কেটে দিলো । কিছুক্ষণ পরই ওর হৃদস্পন্দন থেমে গেলো । জাশির তখন সামিরের বডিটা সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে রক্ত মুছে নিজের চেম্বারে যেয়ে পোশাক চেঞ্জ করে বেড়িয়ে গেলো হাসপাতাল থেকে । গ্যারেজের সামনেই গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল হাসপাতালের মালিক সাখুরা । জাশির গাড়িতে উঠে বসলো । সাখুরা জিজ্ঞেস করলো, “কাজ হয়েছে?” জাশির বলল, “হ্যাঁ হয়েছে । এখন আমরা যাব কোথায়?” সাখুরা বলল, “হোসনে আরার বাড়ি ।” বলেই গাড়ি চালু করে রওনা হল হোসনে আরার বাড়ি ।
এদিকে জয়নাল মেঝে থেকে মেমোরি কার্ডটা তুলে নিলো । তারপর নিজের স্ত্রীকে দেখালো । ওর স্ত্রী জামেনা মেমোরি কার্ডটা দেখে বলল, “এইডা তো ম্যামোরি কার্ড । ঐ যে, কম্পুটারের দোকানদার আছে না, রাদিব, ওর দোকানে দেখসিলাম ।” জয়নাল বলল, “হ তাই তো দেখতেসি । আইচ্ছা, তুমি একটি থাকো, আমি একটু এইডা ওরে দেখাইয়া আসি ।” বলেই জয়নাল বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো । জামেনা ওকে থামাতে গিয়েও থামালো না । চোখ আটকে গেলো অন্য একটা দৃশ্যে । বিছানায় শুয়ে ঘুমন্ত আবিরের সুন্দর হাসিমুখ মন কেড়ে নেবে যে কারোরই । জামেনাও হাসিমুখে আবিরের পাশে শুয়ে পড়লো ।
বাজারেই একটা কম্পিউটারের দোকান চালায় রাদিব নামের একটা ছেলে । শেষ ওকে যখন দেখেছিল তখন ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী । দোকানে ঢুকতেই রাদিব জয়নালকে দেখে অবাক । কম্পিউটারে কি কাজ করছিলো । সে কাজ রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আসসামু আলাইকুম জয়নাল চাচা কেমন আছেন?” জয়নাল তখন বলল, “এইতো বাবা, তোমারে তো চিনাই যাইতেসে না । কত পাল্টায় গেছো ।” রাদিব বলল, “আরে, পালটাবো না তো আর কি । বিয়াসাধি কইরা ফালাইসি ।” জয়নাল অবাক হয়ে বলল, “বাপরে! তোমারে সেই পিচ্চি থেইকা দেখতাম, আর এহন তুমি বিয়া কইরাও ফালাইসো ।” তারপর একটা শ্বাস ফেলে বলল, “সময়গুলা কত তাড়াতাড়ি কাইটা যায় ।” রাদিব জিজ্ঞেস করলো, “তা আপনেরা কবে আইলেন?” “আইজকাই আইসি । তোমার বাড়ির সব ভালো আছে তো?” রাদিব বলল, “জী আলহামদুলিল্লাহ ।” জয়নাল তখন মেমোরি কার্ডটা রাদিবের হাতে দিয়ে বলল, “একটু আমারে সাহায্য করো । এই মেমোরি কার্ডে দ্যাখো না কি আছে ।” “আমি আপনারে কতবার কইসি, একখান স্মার্টফোন কিনা লন ।” বলেই মেমোরি কার্ডটা হাতে নিলো রাদিব । তারপর সেটা কম্পিউটারে ঢোকাল রাদিব । ভেতরে শুধুমাত্র একটা রেকর্ড করা অডিও । আবিরের বাবা সোহেল সেদিন মেমোরি কার্ড ফরম্যাট করে রেকর্ডটা করেছিলো যেন সহজে অন্য কেউ সেটা খুজে পায় । রেকর্ডটা অন করে শুনতে লাগলো ওরা । সাখুরা আর জাশিরের সেদিনকার কথোপকথন শুনে বেশ অবাক হল দুজনেই ।
জয়নাল তখন বলল, “কি কয় ওরা? কে মরসে? কোন বাচ্চার কথা কয়?” রাদিব তখন বলল, “এইডা তো আমিও বুঝতেসি না । তয়, হইতে পারে কোন নাটক ফাটকের রেকর্ড । আপনে এই মেমোরি কার্ড পাইসেন কই?” জয়নাল কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “ঐযে, আমি যেইহানে গেছিলাম, সেইখানে ।” তারপর রাদিবের মন ঘোরানোর জন্য বলল, “তা বাবা, তুমি এহন কই পড়াশুনা করতেস?” রাদিবের মনটা তখন খারাপ হয়ে গেলো । বলল, “দুঃখের কথা কি আর কমু চাচা । এইচএসসি পরীক্ষায় আমি পাশ করতে পাড়ি নাই । মায়ে তখন রাগ কইরা আমারে কইল আমারে দিয়া আর পড়াশুনা করাইবো না । তাই এহন এই দোকানডাই আমার সম্বল । জয়নাল আর কিছু বলল না । মনে মনে ভেবে রাখল, মেমোরি কার্ডটা আবিরের লকেটেই থাক । ও যখন বড় হবে, তখন ও নিজেই খুজে বের করবে কি এই অডিও । হতে পারে এটার সাথে ওর পরিবারের কোন দুঃখজনক কাহিনী জড়িয়ে আছে ।
এদিকে সাখুরা আর জাশির হোসনে আরার বাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল । ঘরটা এলোমেলো হয়ে আছে । জাশির আর সাখুরা তন্ন তন্ন করে পুরো বাড়ি খুজে কোথাও খুজে পেলো না হোসনে আরাকে । জাশির তখন সাখুরার কাছে এসে বলল, “পেলাম না তো কোথাও ।” সাখুরা বলল, “হুম । গেলো কোথায় । দরজাও তো লাগানো ছিল । জাশিরের তখন নজর গেলো টয়লেটের দিকে । দরজাটা খোলা । জাশির হেসে হেসে বলল, “বারে বারে হোসনে তুমি খেয়ে যাও ধান, এবারে হোসনে তোমার বধিবো পরান ।” জাশিরের দৃষ্টি দেখে সাখুরা বুঝলো, জাশির ভাবছে হোসনে আরা টয়লেটে লুকিয়ে আছে । দুজনেই এগোতে লাগলো দরজার কাছে ।

আগামী পর্বেঃ
“সত্যি ড্যামেজ মেমোরি কার্ড ঠিক করা যায় না?” রাদিব অবাক হয়ে বলল, “এক কথা কয়বার বলব আপনাকে । মেমোরি কার্ড অনেক বছর পর কিংবা কোন কারণে ড্যামেজ হয়ে যায় এটাই স্বাভাবিক । এখন আপনার নতুন মেমোরি কার্ড কেনা ছাড়া উপায় নেই ।” জয়নাল রাদিবকে জিজ্ঞেস করলো, “আইচ্ছা রাদিব, ড্যামেজ কি জিনিস?” রাদিব বলল, “একটা সময় পর মেমোরি কার্ড আর কাজ করে না । ওইটারেই ড্যামেজ কয় ।” জয়নাল তখন মনে মনে বলল, “হায় হায়! তাইলে আবির বড় হইয়া যাওয়ার পর আই ম্যামরি কার্ডও যদি কাজ না করে?”
×
পরিচয়(পর্ব-১০)(সিজন-১)

দুজনেই এগোতে লাগলো দরজার কাছে । জাশির দরজার কাছে যেয়ে দরজা খুলল । দরজার মরিচা ধরা কলকব্জা আওয়াজ করে দরজাটা খুলে গেলেও ভেতরে নেই হোসনে আরা । সাখুরা তাকিয়ে দেখল, টয়লেটের ভেন্টিলেটর ভাঙ্গা । মানে, এখান দিয়েই বাইরে পালিয়েছে হোসনে আরা । এদিকে হোসনে আরা এতক্ষণে হাসপাতালে যেয়ে পৌঁছেছে । হাসপাতালের যিনি রিসিপশনিস্ট, তার কাছে গেলো সে । এই রিসিপশনিস্ট ওর পরিচিত । নাম, ফাতেমা । জামাকাপড়ে ময়লাসহ হন্তদন্ত হোসনে আরাকে দেখে ফাতেমা বলল, “কি হয়েছে হোসনে আপা? আপনার এই অবস্থা কেন?” হোসনে আরা বলল, “সময় নেই ফাতেমা আপা । আপনি আমার একটা সাহায্য করতে পারবেন?” ফাতেমা তখন বলল, “হ্যাঁ অবশ্যই । বলুন, কিভাবে সাহায্য করতে পারি ।” হোসনে আরা তখন বলল, “গতকাল সোহেল নামের একজন এসেছিলেন না উনার স্ত্রীকে নিয়ে?” ফাতেমা একটু ভেবে বলল, “ও হ্যাঁ । মনে পড়েছে । কেন কি হয়েছে?’ হোসনে আরা তখন বলল, “উনার যেই ফর্মটা দিয়েছেন, সেটা একটু দাও ।” ফাতেমা “একটু অপেক্ষা করুন ।” বলে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা বই বের করে তার ভেতর থেকে বের করলো একটা ফর্ম যেটা স্ত্রীর অপারেশনের আগে পূরণ করেছিলো সোহেল । হোসনে আরা সেটা হাতে নিয়ে বলল, “আমি এটা নিয়ে যাচ্ছি । কেউ আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবেন না যে আমি এসেছিলাম । অনেক ধন্যবাদ ।” ফাতেমা বোধ হয় “কেন জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলো, কিন্তু থেমে গেলো । সামনে থাকা রোগী আর অন্যান্য লোকজনের ভীরের মাঝে কোথায় চলে গেলো হোসনে আরা, তার কোন কিনারা করতে পারলো না ফাতেমা । ঠিক আধ ঘণ্টা পরেই এসে হাজির সাখুরা আর জাশির । এসেই ফাতেমাকে বলল, “হোসনে আরাকে দেখেছেন?” ফাতেমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “হ…হোস...হোসনে আরা? কই না তো । সকাল থেকেই তো উনাকে দেখি নি ।” সাখুরা আর কিছু বলল না । প্রচুর রাগ দেখালো । জাশির কেবল চোখ দুটোই লাল করে তাকিয়ে রইল ।
এদিকে জয়নাল যখন রাদিবের দোকান থেকে চলে আসতে নেবে, এমন সময় একজন বেশ স্বাস্থ্যবান কাস্টমার এলো তার দোকানে । এসে বলল, “এই রাদিব ভাই, দেখেন না, মেমোরি কার্ডটা কাজ করতেসে না ।” রাদিব লোকটার হাত থেকে মেমোরি কার্ডটা নিয়ে বলল, “দাঁড়ান দেখতেসি ।” জয়নাল দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো । রাদিব মেমোরি কার্ডটা নিজের মোবাইলে ঢুকিয়ে বলল, “মেমোরি কার্ড ড্যামেজ হইয়া গেছে । ঠিক করা যাইব না ।” লোকটা তখন বলল, “কি কন? আমার কত জরুরী ফাইল টাইল আছিলো, বুঝতেসেন আপনি?” রাদিব মেমোরি কার্ড লোকটার হাতে দিয়ে বলল, “লাভ নাই । নতুন মেমোরি কার্ড কিনা নতুন কইরা ভরা লাগবো ।” লোকটা কিছুক্ষণ মেমোরি কার্ডটা নেড়েচেড়ে বলল, “সত্যি ড্যামেজ মেমোরি কার্ড ঠিক করা যায় না?” রাদিব অবাক হয়ে বলল, “এক কথা কয়বার বলব আপনাকে । মেমোরি কার্ড অনেক বছর পর কিংবা কোন কারণে ড্যামেজ হয়ে যায় এটাই স্বাভাবিক । এখন আপনার নতুন মেমোরি কার্ড কেনা ছাড়া উপায় নেই ।” জয়নাল রাদিবকে জিজ্ঞেস করলো, “আইচ্ছা রাদিব, ড্যামেজ কি জিনিস?” রাদিব বলল, “একটা সময় পর মেমোরি কার্ড আর কাজ করে না । ওইটারেই ড্যামেজ কয় ।” জয়নাল তখন মনে মনে বলল, “হায় হায়! তাইলে আবির বড় হইয়া যাওয়ার পর আই ম্যামরি কার্ডও যদি কাজ না করে?” জয়নাল তখন রাদিবকে বলল, “আইচ্ছা বাবা, আমার এই মেমোরি কার্ডও যদি নষ্ট হইয়া যায়?” রাদিব তখন বলল, “হইলে হইসে, ওর মধ্যে তো আপনার তেমন কোন দরকারি কিছুই নাই । আর আপনের তো স্মার্টফোন-ই নাই । জয়নাল অনেকক্ষণ ভাবলো । ওর মনের মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন বাসা বুনছে । কি করবে এখন সে? যদি মেমোরি কার্ডটা নষ্ট হয়ে যায়? যদি এই রেকর্ডটা এমন কিছু হয় যা ঐ নিষ্পাপ শিশুটার আজকের এই অবস্থার জন্য দ্বায়ী? সব প্রশ্নের সমাধান ওর কাছে নেই । ও শুধু জানে যে করেই হোক, মেমোরি কার্ডের এই অডিও বার্তাটা আবিরের কাছে পৌঁছতেই হবে । স্বাস্থ্যবান ভদ্রলোক চলে যাবার পরপরই জয়নাল রাদিবের হাত ধরে বলল, “বাবা, আমি তোমার কাছে একখান অনুরোধ করমু । রাখবা?” রাদিব তখন বলল, “সি!সি! এইভাবে বলতাসেন কেন? আমি তো আপনার পোলার মতোন । কন কি করতে হইবো ।” জয়নাল তখন বলল, “এই ম্যামরি কার্ডে যেই অডিও রেকর্ডটা আছে, ঐডা যেন অনেক অনেক বছর আমার কাছে থাকতে মানে, মানে অনেক বছন পরও এই ম্যামরি কার্ড ঐ ড্যামিজ না কি কইলা, ঐডা হইলে এই রেকর্ড আমি পামু এমন কিছু করা যাইব না?” রাদিব তখন জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু আপনি করবেনটা কি এইডা দিয়া?” জয়নাল কিছুই বলে না । ছলছল চোখে রাদিবের দিকে নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে । জয়নালের এই দৃষ্টি রাদিবের মনে লাগে খুব । বুঝতে পারে কিছু হয়তো আছে, যা হয়তো এই অসহায় লোকটার জন্য কোন কারণে বলা সম্ভব না ।

আগামী পর্বেঃ
মনে মনে ভাবলো, “কি এমন হইতে পারে এইডার মধ্যে যে জয়নাল চাচা আমারে কিছু কইলো না? এক কাম করি । ফেসবুকে ছাইড়া দেই । যদি ভাইরাল হয়, আমি তো ফেমাস হইয়া যামু ।” এরপর সেটা সে ফেসবুকে আপলোড করে দিলো ।
………………………………………………………………
দরজা খুলতেই সীমা দেখলো, হোসনে আরা দাঁড়িয়ে । চেহারার করুন অবস্থা দেখে সীমা বলল, “কিরে তুই? আয় ভেতরে আয় ।” হোসনে আরা ভেতরে ঢুকল ।
×
পরিচয়(পর্বঃ১১)(সিজন-১)

এই অসহায় লোকটার জন্য কোন কারণে বলা সম্ভব না । রাদিব তাই আর প্রশ্ন না করে বলল, “একটা উপায় আছে ।” জয়নাল তখন বলল, “কি উপায় বাবা?” রাদিব বলল মেমোরি কার্ডটা আমারে দ্যান ।” রাদিবকে মেমোরি কার্ডটা দিলো জয়নাল । রাদিব এরপর সেটা কম্পিউটারে কপি করলো । জয়নাল কেবল দেখতে লাগলো । কিছু জিজ্ঞেস করলো না । রাদিব তখন সেটা গুগল ড্রাইভে আপলোড করলো । এরপর সেটার যে লিঙ্ক, সেটা কপি করে প্রিন্ট করলো । জয়নালের হাতে লিঙ্কটা দিয়ে বলল, “এইডা ন্যান । এই মেমোরি কার্ড যদি কখনো ড্যামেজ হইয়া যায়, তাইলে আমার কাছে আইসেন । আর আমি যদি তখন নাও থাকি, তাইলে এই যে লেখাগুলা দেখতেসেন, এইগুলা ইন্টারনেটে সার্চ করলেই পাইয়া যাইবেন । জয়নাল কাগজটা নিয়ে মুচকি হাসল । টেনশনটা তো অন্তত দূর করতে পারলো এতেই সে খুশি । শার্টের পকেট থেকে ১০০টাকা বের করে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও বাবা, এইডা রাখ । তোমারে তো কখনো কিছু দিতে পারি নাই, তাই এইডা নিলে আমি খুব খুশি হমু ।” রাদিব তখন বলল, “আরে চাচা, টাকার দরকার নাই । আপনে যে আমারে ভালবাসেন, এইডাই তো অনেক । টাকা লাগবো না ।” জয়নাল তখন বলল, “তুমি আমারে চাচা ডাকো, তাইলে তুমি হও আমার ভাতিজা । কিন্তু তাও আমি তোমারে আমার পোলার মতো বাপ বইলা আদর করি ।” তুমি আমার এই অনুরোধ টা রাখ ।” রাদিব আর কিছু বলতে পারলো না । টাকাটা নিলো । জয়নাল জিজ্ঞেস করলো, “আইচ্ছা, তোমার লগে না এই দোকানে রহিম নামের একখান পোলা কাম করতো? অয় কই?” “অয় তো ঢাকার ধানমণ্ডির নিউক্লিয়াস হাসপাতালে কাম পাইসে । অইখানকার কোন এর ডাক্তারের পিএ ।” জয়নাল বলল, “ও আইচ্ছা। থাকো তাইলে বাবা, আমি যাই এখন । বাসায় আইসো ।” রাদিব বলল, “আইচ্ছা চাচা, আপনিও আইসেন ।” জয়নাল এরপর চলে গেলো । রাদিব কি যেন ভাবতে ভাবতে রেকর্ডটা আবার ওপেন করলো । মনোযোগ দিয়ে রেকর্ডটা শুনলো । মনে মনে ভাবলো, “কি এমন হইতে পারে এইডার মধ্যে যে জয়নাল চাচা আমারে কিছু কইলো না? এক কাম করি । ফেসবুকে ছাইড়া দেই । যদি ভাইরাল হয়, আমি তো ফেমাস হইয়া যামু ।” এরপর সেটা সে ফেসবুকে আপলোড করে দিলো ।”
এদিকে হোসনে আরা চলে গেলো ওর বান্ধবীর কাছে যে বান্ধবীকে ওই বাচ্চাটাকে দিতে চেয়েছিল । নাম তার সীমা । সীমার বাড়ি হোসনে আরার বাড়ি থেকে ২ ঘণ্টার পথ । ঢাকার বাইরে । সেই ছোটবেলা থেকেই সীমা আর হোসনে আরা অনেক ভালো বান্ধবী ছিল । দুজনেই বিয়ের পর স্বামীর জন্য আলাদা হয়ে যায় কিন্তু শেষে দুজনেই স্বামী নিয়ে সুখি হতে পারে নি । হোসনে আরার স্বামী তো ওর ওপর সন্দেহ করতো । কিন্তু সীমার স্বামী ওর ওপর সন্দেহ ছাড়াই মারধর করতো । অথচ দুজনেই কিন্তু ওদের স্বামীকে প্রেম করে বিয়ে করেছিলো । কি জানি, আমাদের দেশের কিছু মানুষ বিয়ের আগে প্রেম প্রেম খেলায় মেতে বিয়ের পর অস্বাভাবিক আচরণ করে নিজের দেশ, ধর্ম, জাতি, বংশ ইত্যাদির ভাবমূর্তি নষ্ট করে কি মজা পায়। অনেক কষ্টে স্বামীর স্বামীর কাছ থেকে লুকানো কিছু টাকা দিয়ে অনেক কষ্টে পৌঁছে গেলো ওর বান্ধবী সীমার বাড়ি । একতালা পাকা বাড়ি, তার সামনে সামান্য প্রশস্থ উঠান যার বেশিরভাগটাই দখল করেছে বিরাট জাম গাছ । হোসনে আরা দরজায় নক করলো । দরজা খুলতেই সীমা দেখলো, হোসনে আরা দাঁড়িয়ে । চেহারার করুন অবস্থা দেখে সীমা বলল, “কিরে তুই? আয় ভেতরে আয় ।” হোসনে আরা ভেতরে ঢুকল । সীমাকে হোসনে আরাকে বাইরের ঘরে সোফার ওপর বসিয়ে রেখে একগ্লাস পানি এনে ওর কাছে দিলো । হোসনে আরা পুরো পানি এর চুমুকেই শেষ করে হাতের উলটো পাশ দিয়ে মুখ মুছল । এরপর সীমা ওর পাশে বসে বলল, “কিরে? কি হয়েছে?” হোসনে আরা কিছু না বলে কান্না শুরু করে দিয়ে সীমার বুকের ওপর মাথা রাখলো । সীমা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “আচ্ছা, কাদিস না । তুই এক কাজ কর, গোসল করে নে, আমি আমার একটা সালোয়ার-কামিজ দিচ্ছি তোকে । পড়ে সব কথা শোনা যাবে ।” হোসনে আরা গোসলে ঢুকল । সীমার গায়ের রঙ ফর্সা । মুখটা গোলগাল । তার ওপর গোল ফ্রেমের চশমাতে ওকে দেখতে দারুন লাগে বলে সবসময় চশমা পড়েই থাকে চোখ ভালো থাকা সত্ত্বেও । লোকজন মন্তব্য করে, এমন সুন্দর মেয়ের সাথে কেন যে অমন একটা ছেলের বিয়ে হল । কিন্তু ওর কিছু করার নেই । কারণ কথায় আছে, কপালের লিখন, না যায় খণ্ডন ।

আগামী পর্বেঃ
“যাক, আল্লাহর রহমতে আপনি তাহলে এই টাকা জোগাড় করতে পেরেছেন । কিন্তু আমার এটার দরকার নেই ।” জয়নাল চেয়ারম্যানের দুহাত ধরে বলল, “আপনে ম্যালা ভালো মানুষ । জানি, এই ট্যাকা না নিলেও আপনার চলবো । কিন্তু আমি যে শান্তি পামু না, তাই আপনি দয়া কইরা না কইরেন না হুজুর ।”
………………………………………………………………
ফাইলটা বের করতে গিয়ে হঠাৎ জাশিরের মনোযোগ চলে গেলো একটা চেনা আওয়াজের কাছে । সেদিন সোহেলের রেকর্ড করা সেই রেকর্ডিং টা কোত্থা থেকে যেন বাজছে । জাশির আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখল, শব্দটা আসছে দরজার বাইরে থেকে । দরজা খুলে বাইরে এসে দেখল, ওর পিএ রহিম ফেসবুকে রেকর্ডিংটা শুনছে । রহিম জাশিরকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো । জাশির কোনোরকমে নিজের রাগ গোপন করে বলল, “কি শুনছেন আপনি?”
×
পরিচয়(পর্বঃ১২)(সিজন-১)

কারণ কথায় আছে, কপালের লিখন, না যায় খণ্ডন । গোসল করে এসে হোসনে আরা একটু স্বস্তি পেলো । কথা বলার মতো আর শক্তি পেলো না । খুব ঘুম পাচ্ছিলো । সীমাও আর জোড় জবরদস্তি করলো না । হালকা ভাত খেয়ে সীমার বিছানাতে ঘুমিয়ে পড়লো হোসনে আরা ।
বিকেলে জয়নাল গেলো চেয়ারম্যান ফয়সালের কাছে তার ১০হাজার টাকা ফেরত দিতে । চেয়ারম্যান তখন তার বাড়ির সামনে পুকুরের পাশে চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিল । লোকটার বয়স ৬০ মতো হবে । চেহারায় বয়সের ছাপ সেভাবেও পড়ে নি । মাথার চুলগুলো এখনো সুন্দর করে আঁচড়ে রাখে । শরীরের গড়নে লোকটার বয়সের ছাপ না এলেও পোশাক-আশাকে মনে হচ্ছে কত যে বয়স । পড়নে সে ফতুয়া পড়তে পছন্দ করে । আর সাথে সাদা পাজামা । জয়নালকে দেখে সে খুশি হয়ে বলল, “আরে! জয়নাল? কেমন আছো?” জয়নাল সালাম দিয়ে বলল, “জী হুজুর, আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো আছি । চেয়ারম্যান ফয়সাল সালামের জবাব দিয়ে তার সাথে সাথে থাকার লোক আব্বাসকে ডাকল । আব্বাসকে দেখতে একটু অদুত । চেহারা শ্যামলা, মাথার মাঝখানে হালকা চুল, চারপাশ ফাঁকা । মুখের দাড়ি গুলো কোঁকড়ানো । মোচগুলো দেখে মনে হয়, টেনে ছিঁড়ে ফেলি । চেয়ারম্যানের সামনে এসে দাড়িয়ে বলল, “উনার জন্য একটা চেয়ার নিয়ে আয় ।” আব্বার মাথা ডান দিকে কাত করে চলে গেলো । জয়নালকে চেয়ারম্যান বলল, “তা বলুন, বাসার সবাই কেমন আছেন?” “এইতো, হুজুর, ভালো আছে ।” চেয়ারম্যান বলল, “কতদিন পর আপনার সাথে দেখা । ভালো লাগছে অনেক ।” কথার মাঝে আব্বার এসে চেয়ার দিয়ে গেলো । জয়নাল আর চেয়ারম্যান বসে বসে কথা বলতে লাগলো । জয়নালের কাছে শুনতে লাগলো তার টাকা জোগাড়ের গল্প ।
এদিকে সন্ধায় সীমা বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল । হোসনে আরা ঘুম থেকে উঠে এসে সীমার পাশে আরেকটা চেয়ারে বসলো । সীমা বলল, “ঘুম ভেঙেছে?” হোসনে আরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “না ভাংলে এলাম কি করে ।” সীমা ইয়ার্কি করে বলল, “আমার তো মনে হচ্ছে আরও ১কেজি ঘুম বাকি আছে ।” হোসনে আরা একগাল হেসে দিলো । হাসতে হাসতে হঠাৎ কি চিন্তা মাথায় আসতেই হাসিটা থেমে গেলো । সীমা তখন ওর নীরবতা দেখে জিজ্ঞেস করলো, “এবার কি শুনতে পারি, হয়েছে কি?” হোসনে আরা বলল, “বলছি । তার আগে এটা বলে রাখি, আমি এবার তোর বাসা থেকে আর যাব না ।” সীমা চায়ে একটু চুমুক দিতে নিচ্ছিল, হোসনে আরার কথা শুনে কাশি উঠে কাপ থেকে একটু চা পড়ে গেলো । হোসনে আরা বলল, “না, কোন সমস্যা থাকলে আমি চলে যাব । ভয় পাশ না । তবে ঢাকায় মনে হয় এ জন্মে আমার আর যাওয়া হবে না ।” বাবার রেখে যাওয়া ৩রুম ১ডাইনিং ১ড্রইং রুমের বাসায় একা একাই থাকে সীমা । একটা স্কুলের শিক্ষিকা । স্কুলের বেতন দিয়ে বেশ ভালো করে কেটে যায় ওর দিন । তাই হোসনে আরা এলে ওর বিন্দুমাত্রও সমস্যা হবে । তার ওপর সে ওর ছোটবেলার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী । হোসনে আরাকে বলল, “না সমস্যা নেই । হয়েছেটাকি তা তো বল ।” হোসনে আরা পুরো ঘটনা বলতে শুরু করলো ।
এদিকে জয়নালের মুখে সব কথা শুনে চেয়ারম্যান বলল, “যাক, আল্লাহর রহমতে আপনি তাহলে এই টাকা জোগাড় করতে পেরেছেন । কিন্তু আমার এটার দরকার নেই ।” জয়নাল চেয়ারম্যানের দুহাত ধরে বলল, “আপনে ম্যালা ভালো মানুষ । জানি, এই ট্যাকা না নিলেও আপনার চলবো । কিন্তু আমি যে শান্তি পামু না, তাই আপনি দয়া কইরা না কইরেন না হুজুর ।” চেয়ারম্যান আর না করতে পারলেন না । মসজিদ থেকে সে সময় আজানের শব্দ ভেসে এলো । মাগরিবের আজান দিচ্ছে । চেয়ারম্যান ৫ওয়াক্ত নামাযি মানুষ । চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আচ্ছা, যাই এখন নামাযে । পড়ে আবার কথা হবে । আর কোন সমস্যা হলে আমার বলতে দ্বিধা বোধ করবেন না কিন্তু ।” বলেই চেয়ারম্যান চলে গেল নামাজ পড়তে । জয়নালও নিজের বাসার কাছে এক মসজিদে নামায পড়বে বলে রওনা হল ।
হাসপাতালে জাশির আর সাখুরা কোনরকমে রাগ কমিয়ে নিজেদের কাজে মগ্ন । সাখুরা তখন বাসায় গেছে একটু বিশ্রাম নিতে । জাশির রোগী দেখে নিজের টেবিলে বসে ভাবছিল । এমন সময় কোন এক রোগীর ফোন এলো জাশিরের কাছে । ফোন দিয়ে কি একটা ফাইল দেখতে বলল । উঠে দাঁড়িয়ে পাশে থাকা বুকশেলফে খুজে বের করলো ফাইলটা । ফাইলটা বের করতে গিয়ে হঠাৎ জাশিরের মনোযোগ চলে গেলো একটা চেনা আওয়াজের কাছে । সেদিন সোহেলের রেকর্ড করা সেই রেকর্ডিং টা কোত্থা থেকে যেন বাজছে । জাশির আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখল, শব্দটা আসছে দরজার বাইরে থেকে । দরজা খুলে বাইরে এসে দেখল, ওর পিএ রহিম ফেসবুকে রেকর্ডিংটা শুনছে । রহিম জাশিরকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো । জাশির কোনোরকমে নিজের রাগ গোপন করে বলল, “কি শুনছেন আপনি?”

আগামী পর্বেঃ
“আমি গাড়ি নিয়ে হাসপাতালের সামনে আসছি, ফোন দিলে চলে এসো ।” জাশির জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাবেন?” সাখুরা বলল, “ফকিরাপুল গ্রামে ।”
……………………………………………………………
“আমি জানি না আমার স্বামী এখন কোথায় । কিন্তু ডাক্তারের স্বভাব যদ্দুর জানি, আমার স্বামীকে বাচিয়ে রাখবে না। আমাকেও রাখত না যদি না আমি ওইদিন সাহায্য করেছি বলে অভিনয় করতাম ।” সীমা তখন বলল, “আচ্ছা, এই ডাক্তার আর হাসপাতালের মালিকের সমস্যা কি?”
×
পরিচয়(পর্বঃ১৩)(সিজন-১)

জাশির কোনোরকমে নিজের রাগ গোপন করে বলল, “কি শুনছেন আপনি?” রহিম উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, “ইয়ে স্যার, ঐ আমার একখান বন্ধু ফেসবুকে কি জানি ছারসে, সেইডা দ্যাখতেসিলাম ।” জাশির বলল, “কে সেই বন্ধু?” রহিম বলল, “আমাগো ফকিরাপুল গেরামে থাকে । কম্পিউটারের দোকানে কাম করে । নাম রাদিব ।” “ও । তা কাজ বাদ দিয়ে এসব আলতু ফালতু কি শুনছেন । কাজে মন দিন ।” লোকটা মোবাইল বন্ধ করে পকেটে ঢোকাল । জাশির চলে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে যেয়ে বলল, “একটা কাজ করুন, আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে আসুন ।” রহিম জী বলে চা আনতে চলে গেলো । জাশির আসলে চা খাওয়ার জন্য রহিমকে পাঠায়নি । পাঠিয়েছে কথা যেন না শুনতে পারে, সে জন্য । জাশির তখন ফোন দিলো সাখুরাকে । ফোনের ওপাশ থেকে সাখুরা ঘুম ঘুম গলায় বিরক্তের সাথে বলল, “কে বলছেন?” জাশির ফোনটা অন্য কানে নিয়ে বলল, “আমি আমি । জাশির ।” “তোমাকে বলেছিলাম না, আজকে অন্তত ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব না করতে ।” “যে একটা খবর দেবো, সেটা শুনলে আপনার নিজের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যাবে ।” সাখুরা বিছানা থেকে উঠে বসলো । পাশে থাকা টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে পানি খেয়ে বলল, “হ্যাঁ বলো কি বলবে ।” “আমি একটা ফাইল খুজছিলাম । তখন………।” সব ঘটনা জাশির খুলে বলল সাখুরাকে । সাখুরা সব কথা শুনে সত্যি থমকে গেলো । তাড়াতাড়ি করে একটা শার্ট গায়ে দিতে দিতে বলল, “আমি গাড়ি নিয়ে হাসপাতালের সামনে আসছি, ফোন দিলে চলে এসো ।” জাশির জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাবেন?” সাখুরা বলল, “ফকিরাপুল গ্রামে ।” এদিকে সীমাকে সব ঘটনা খুলে বলা শেষে হোসনে আরা বলল, “আমি জানি না আমার স্বামী এখন কোথায় । কিন্তু ডাক্তারের স্বভাব যদ্দুর জানি, আমার স্বামীকে বাচিয়ে রাখবে না। আমাকেও রাখত না যদি না আমি ওইদিন সাহায্য করেছি বলে অভিনয় করতাম ।” সীমা তখন বলল, “আচ্ছা, এই ডাক্তার আর হাসপাতালের মালিকের সমস্যা কি?” হোসনে আরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুরো কাহিনী বলা শুরু করলো ।
হোসনে আরার বাবা মায়ের শখ ছিল মেয়ে লেখাপড়ায় ভালো রেজাল্ট করে অনেক ভালো একটা চাকরি করবে । কিন্তু কলেজে ওঠার পর সামিরের সাথে প্রেম শুরু করায় ওর এইচএসসি এর রেজাল্ট অনেক খারাপ হয় । সেদিনই ওর বাবা মা রাগ করে ওর সাথে অন্য একটা ছেলের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় । আর ওর বাবা মায়ের পরামর্শে সীমার বাবা মাও একই সিদ্ধান্ত নেয় কারণ তখন সীমারও অবস্থা ছিল একই । সীমা ভালোবাসতো জয় নামের একটা ছেলেকে । বিয়ের আগের রাতে সীমা আর হোসনে আরা জয় আর সামিরকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে চলে আসে এই ঢাকা শহরে । প্রথম প্রথম ওরা একসাথে থাকলেও পরে জয় আর সামিরের কি একটা কারণে ঝগড়া লাগার কারণে ওরা আলাদা হয়ে যায় । হোসনে আরা চলে যায় অন্য এক যায়গায় । হোসনে আরা তখন ঐ নিউক্লিয়াস হাসপাতালে নার্সের চাকরি নেয় । এরপর থেকে ওর স্বামী ওর সাথে অদ্ভুত আচরণ শুরু করে । এমনকি ওকে মাও হতে দেয় নি ঐ সামির । প্রথম যেদিন সামিরকে নিয়ে হাসপাতালে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে যায়, ঐদিন এক বৃদ্ধ আগন্তুক হোসনে আরা আর সামিরের পথ আটকে দাঁড়ায় । সেই আগন্তুক হোসনে আরাকে জানায়, এই জাশিরের দাদার দাদারা ছিলেন ডোম । ওরা মানুষ কাটতে কাটতে এমন এক অবস্থা হয়েছিলো যে, লাশ কাটা ছাড়া ওরা আর কিছুই বুঝত না । শোনা গেছে, শেষ বয়সে নাকি উনি কাটার জন্য লাশ না পেলে মানুষ মেরে লাশ কাটতো । তাদেরই বৈশিষ্ট্য প্রকট হয়েছে জাশিরের মাঝে । সাখুরা জাশিরের ছোটবেলার বন্ধু । ছোটবেলা থেকেই জাশিরের মনমানসিকতা ছিল অদ্ভুত । ওর বাসায় গেলে ছোটবড় সব ধরনের পতঙ্গ এখানে ওখানে কাটা অবস্থায় পাওয়া যেত । একসময় ওর ঘরের আশে পাশে কুকুর, বিড়ালের লাশও পাওয়া যায় । মাঝে মাঝে এ কাজের জন্য জাশির সাখুরাকেও সঙ্গে রাখত । সাখুরাও খুব মজা পেত । এভাবে ওরা বড় হতে থাকে । একদিন জাশিরের বাবা মাকে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায় । ধারনা করা হয়, জাশিরই হয়তো ওর বাবামাকে খুন করেছে । জাশিরের কারণে প্রভাবিত হয় সাখুরাও । জাশির খুবই গরিব একটা ছেলে । বাবা অনেক কষ্ট করে কোনরকমে ওকে বড় একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলো । কিন্তু সাখুরা অনেক বড়লোকের ছেলে । ওর বাবা ছিল এই নিউক্লিয়াস হাসপাতালের প্রাক্তন মালিক । উনি মারা যাবার পর একমাত্র ছেলে সাখুরা হয় এ হাসপাতালের মালিক । সাখুরার মাথায়ও তখন ভুত চাপে লাশ কাটাকাটি করার । কিন্তু একা একা ও এ কাজ করতে হালকা ভয় পেত । তাই ভুয়া সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে জাশিরকে বানাল এই হাসপাতালের মালিক । আরও অনেক ভালো ভালো ডাক্তার আগে থেকেই এই হাসপাতালে ছিলেন । এরপর একদিন ঘটে যায় এক ঘটনা ।

আগামী পর্বেঃ
সীমার ভাই অফিস থেকে তখনই ঘরে ফেরায় খুন করার দৃশ্য ওর চোখে পড়ে যায় । মহিলার মাথায় তখন খুন চেপে যায় । শেষে নিজের স্বামীকেও মেরে ফেলে । ঘরের মধ্যে তিনটে লাশ যা নিজের হাতে খুন করা, দেখে হুশ ফেরে সীমার ভাইয়ের স্ত্রীর । খুব আফসোস করে । পড়ে নিজেও খুন করে ফেলে নিজেকে । ঘরের মধ্যে থাকা সিসি ক্যামেরা থেকে সবটা স্পষ্ট হয়ে যায় । তারপর থেকে সীমা এই দুনিয়ায় একা হয়ে যায় । হোসনে আরা ছাড়া ওর আর কেউ নেই । এদিকে হোসনে আরার একদিন দায়িত্ব পড়ে সোহেলের স্ত্রী শায়লার ওপর । সোহেলের স্ত্রী ছিলেন খুব ধার্মিক আর ভালো একজন মহিলা । হোসনে আরার সাথে নিজের বোনের মতো কথা বলতো ।
×
পরিচয়(পর্বঃ১৪)(সিজন-১)

এরপর একদিন ঘটে যায় এক ঘটনা । এই জাশির আর সাখুরা চিন্তা করে, লাশ দিয়ে টাকা আয় করলে কেমন হয়? সেই উদ্দেশ্যে ওরা মৃত লাশও জীবিত বলে ভর্তি রেখে বেশি টাকা আদায় করতো । অনেক দিন পর সেই লাশকে মৃত ঘোষণা করে লাশ দিয়ে দিত । এভাবে ওরা অনেক মানুষের ক্ষতি করতে লাগলো । আবার মাঝে মাঝে সুযোগ পেলেই এসব লাশ কাটাকাটি করে মজা নিত । শুধু তাই নয়, মাঝে মাঝে নবজাতকের লাশ অন্যান্য হাসপাতালের পাশে কোন ময়লার স্তুপে ফেলে আসতো । যেন সেসব হাসপাতালের দুর্নাম হয় আর লোকজন বাচ্চাকে নিয়ে এই হাস্পাতালেই আসে । লোকটা এটুকু বলেই থেমে যায় । হোসনে আরা তখন উনার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে উনি বলেন, উনি নিউক্লিয়াস হাসপাতালের অনেক পুরনো একজন ডাক্তার । উনি সব কোন না কোন ভাবে জানতে পেরেছিলেন । কিন্তু কিছু করতে পারতেন না । আজ উনি এই হাসপাতাল থেকে রিটায়ার করলেন । যাবার আগে কাউকে যে বলবেন সে সাহসও পাচ্ছিলেন না । কিন্তু এই হোসনে আরার স্বভাব আর কর্তব্যপরায়নতা উনার ভালো লাগায় উনি এই হোসনে আরাকে সবটা জানালেন । বলেই ঐ লোকটা কোথায় চলে গেলেন । হোসনে আরা খুব ভয় পায় । কিন্তু কিছু করতে পারে না । এদিকে খবর পায় সীমার স্বামী ওকে ছেড়ে অন্য একজনকে বিয়ে করে চলে গেছে । সীমা তখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে । চলে যায় ঢাকা ছেড়ে ওর বাবা মার কাছে । বাবা মা তখন ওকে আবার আপন করে নেয় এবং সব জমিজমা, বাড়ি গাড়ি সীমার নামে করে দেয় । কিন্তু এতে খুব ক্ষেপে যায় সীমার ভাইয়ের স্ত্রী । রাগের রাগের বশে খুন করে ফেলে সীমার বাবা মাকে । সীমা তখন বাসায় ছিল না । সীমার ভাই অফিস থেকে তখনই ঘরে ফেরায় খুন করার দৃশ্য ওর চোখে পড়ে যায় । মহিলার মাথায় তখন খুন চেপে যায় । শেষে নিজের স্বামীকেও মেরে ফেলে । ঘরের মধ্যে তিনটে লাশ যা নিজের হাতে খুন করা, দেখে হুশ ফেরে সীমার ভাইয়ের স্ত্রীর । খুব আফসোস করে । পড়ে নিজেও খুন করে ফেলে নিজেকে । ঘরের মধ্যে থাকা সিসি ক্যামেরা থেকে সবটা স্পষ্ট হয়ে যায় । তারপর থেকে সীমা এই দুনিয়ায় একা হয়ে যায় । হোসনে আরা ছাড়া ওর আর কেউ নেই । এদিকে হোসনে আরার একদিন দায়িত্ব পড়ে সোহেলের স্ত্রী শায়লার ওপর । সোহেলের স্ত্রী ছিলেন খুব ধার্মিক আর ভালো একজন মহিলা । হোসনে আরার সাথে নিজের বোনের মতো কথা বলতো । মাঝে মাঝে বাসা থেকে সোহেলের মেয়ে জেরিন বাসা থেকে মায়ের জন্য খাবার আনতো, তখন শায়লাও ওকে খেতে দিত । এরপর শায়লা ফিরে যায় বাসায় । যাবার আগে হোসনে আরাকে জোড় করে ৫০০টাকা দিয়ে গিয়েছিলো । এরপর আবার ১০মাস ১০দিন পর প্রসব বেদনায় ছটফট করতে করতে শায়লাকে আবার আনা হয় হাসপাতালে । কিন্তু কোন একটা সমস্যার কারণে শায়লা মারা যান, শুধু বেচে থাকে ওর বাচ্চাটা । কিন্তু হোসনে আরা তখন বুঝে যায় ডাক্তাররা এই ভদ্রমহিলা আর নিষ্পাপ শিশুটার সাথে কিছু করবে, তখনই ও সিদ্ধান্ত নেয় এখনই সেই সময় কাউকে অন্তত এই ডাক্তার আর মালিকের হাত থেকে বাঁচানোর । সোহেল সেদিন রাতে যখন জাশিরের সাথে কথা বলার জন্য এগিয়ে আসে এবং জাশির কোন জবাব না দিয়ে চলে যায় সাখুরার কাছে, সেদিন হোসনে আরার পরামর্শেই সোহেল যেয়ে সব কথা জানতে পারে ও রেকর্ড করে । তারপর থেকে এ পর্যন্ত সব ঘটনা খুলে বলল সীমাকে । সীমাও সব কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে গেলো । একটু পর বলল, “একটা সত্য কথা কি জানিস, বাংলাদেশে উনাদের মতো আরও কত লোভী, হিংস্র আর বিবেকহীন মানুষদের জন্য কত মানুষের যে ক্ষতি হচ্ছে, তার কোন হিসেব নেই । তোর আর ঐ রিটায়ার করা ডাক্তারের মতো ভালো মানুষরা আজ আছে বলে এরা পার পাবে না কখনো ।” হোসনে আরা চোখের জল মুছে বলল, “আমি ওদের আটকাতে পারলাম না । ওরা তো এখনো ঐ নির্মম কাজ চালিয়ে যাবে । আমি তো থামাতে পারলাম না ।” সীমা তখন বলল, “কিন্তু তুই একটা ভুল করেছিস । ঐ মেমোরিকার্ডটা ঐ ছোট শিশুটার গলায় না ঝুলিয়ে দিয়ে তুই যদি নিয়ে আসতি, তাহলে তুইই কিন্তু ওদের শাস্তি দেয়ার একটা প্রমান পেয়ে যেতি ।” হোসনে আরা কিছু বলতে পারলো না । কারণ এটা আসলেই ওর একটা খুব বড় বোকামি হয়ে গেছে ।

আগামী পর্বেঃ
রাদিব যেই দোকানের শাটারটা বন্ধ করতে যাবে, অমনি পেছন থেকে জাশির আর সাখুরা ভেতরে ঢুকে ভেতর থেকে শাটারটা বন্ধ করে দিলো । রাদিব চিৎকার করে বলল, “কে আপনারা? কি চান?” জাশির তখন ওর গলা ধরে ছিল সাখুরা বলল, “তুই ফেসবুকে আজকে একটা অডিও রেকর্ড ছেরেছিস । বল, কোথায় পেয়েছিস সেই অডিও?” রাদিব ভয়ে ভয়ে বলল, “একখান মেমোরি কার্ডে । আর ঐ মেমোরি কার্ডও আমার না ।” সাখুরা তখন ওর মোবাইল কেড়ে নিয়ে ওর ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে ফেসবুক থেকে সেই অডিওটা ডিলিট করে দিলো ।”
×
পরিচয়(পর্ব-১৫)(সিজন-১)

কারণ এটা আসলেই ওর একটা খুব বড় বোকামি হয়ে গেছে । ওরা আর কোন কথা বলল না ।
এদিকে মাগরিবের নামায পড়ে জয়নাল আবার রওনা হল ট্রাকের মালিক ট্রাকের গ্যারেজের উদ্যেশ্যে । গ্যারেজের সামনে মাত্রই একটা ট্রাক ঢুকে গেলো । পাশেই চেয়ারে বসে বসে গুনগুন করে গান গাচ্ছেন ট্রাকের মালিক, জব্বার । বয়স ৫০ কি ৫৫ । মাথা ভরা চুল । গায়ের রঙ কালো । শরীরের গড়ন তেমন মোটাও নয়, তেমন চিকনও নয় । জয়নালকে দেখেই সে তেড়ে আসে জয়নালের দিকে । জয়নালের গেঞ্জি টেনে ধরে বলে, “কিরে? আমার ট্রাকের ট্যাকা না দিয়া পালাইসিলি ক্যান?” জয়নাল জবাবে বলল, “আমি ট্যাকা জোগাড়ের জন্যই গেসিলাম স্যার ।” জয়নালের কথা শুনে জব্বার কিছুক্ষণ জয়নালের দিকে মূর্তির মতো তাকিয়ে রইল । তারপর একগাল হেসে বলল, “তাই নাকি? তা পেয়েছিস টাকা উপার্জন করতে?” জয়নাল আর কোন কথা না বলে পকেট থেকে মোটা কাগজে মোড়ানো জমানো ২লাখ ৩০হাজার টাকা জব্বারের হাতে দিলো । জব্বার কাগজ খুলে দেখল, অনেকগুলো খুচরা টাকা । জয়নালের সামনে দাঁড়িয়েই পুরো টাকা গুনে নিলো । তারপর মুচকি হেসে বলল, “বাহ! তুই জীবনে অনেক উন্নতি করতি পারবি । তা বাড়ির সবাই ভালো আছে নাকি?” “হ, আল্লাহর রহমতে ভালোই আছে । আপনের বাড়ির সবাই কেমন আছে?” “হ, ভালোই । তয় তোরে ছাড়া কেমন যেন একা একা লাগত । তুই ছাড়া কথা বলার তেমন কোন সঙ্গি ছিল না তো । তা বল দেহি । ক্যামনে এই ট্যাকা কামাই করলি ।” অগত্যা আবার পুরো ঘটনা শোনাতে শুরু করলো জয়নাল । সব শোনা শেষে জব্বার বলল, “বাহ! আমি তো জীবনেও পারতাম না । ম্যালা গল্প হইলো, ভেতরে এহন অনেক কাম । তুই কি আর এইহানে কাম করবি না?” জয়নাল তখন বলল, “না স্যার, ভাবসি, বাসায় বইসা দোকান চালামু ।” “আইচ্ছা, তোর যা ভালো মনে হয় কর । আমি যাই তাইলে । মাঝে মাঝে আসিস কিন্তু ।” জব্বার ঢুকে গেলো গ্যারেজে, আর জয়নাল ফিরতে লাগলো বাড়ির পথে । বাসায় এসে জয়নাল দুপুরে রাদিবের দেয়া কাগজের যে অংশে লেখাটা ছিল, সেই অংশটুকু কেটে মেমোরি কার্ডসহ ঝুলিয়ে দিলো আবিরের লকেটে । একটু বাদেই এশার আজানের শব্দ শুনতে পেলো । নামায পড়ে ফেরার পথে হঠাৎ দেখা ছোটবেলার বন্ধু হারুন, রাশেদ, লতিফ আর কাশেমের সাথে । ছোটবেলা থেকেই ওরা এই গ্রামেই থাকে । অনেকদিন পর ওরা একসাথে আড্ডায় মেতে উঠলো ।
এদিকে ডাক্তার জাশির আর সাখুরা শেখ তখন প্রবেশ করলো ফকিরাপুল গ্রামে । গ্রামটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় অবস্থিত । গ্রামে ঢুকতেই সেই পোড়ামাটির ফলকে লেখা নাম । একটু দুরেই বসে গল্প করছিলো জয়নাল আর ওর বন্ধুরা । সাখুরা গাড়ি ওদের সামনে দাড় করিয়ে জানালার কাচ খুলে বাইরে মাথা বের করে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা, আপনাদের এখানে রাদিবের দোকান কোনটা বলতে পারেন?” জয়নাল বলল, “হ্যাঁ, ঐ বাজারের দিকে যান, ওইহানে একখানই কম্পুটারের দোকান আছে । ওইডাই রাদিবের দোকান ।” সাখুরা বেশ মিষ্টি করে একটা থ্যাংকস জানিয়ে চলে গেলো ।” জয়নাল ওর বন্ধুদের তখন বলল, “দ্যাখ, কি ভালো মানুষ । আমারে থ্যাংকস জানাইলো আইজকাইলকার লোকজন একখান থ্যাংকস দেয়ারও প্রয়োজনবোধ করে না ।” জয়নাল কথাটা বলল ঠিকই, কিন্তু সে নিজেও জানেনা, সে শেয়ালের কাছে মুরগীর বাসার সন্ধান দিয়েছে । বাজার তখন পুরো ফাঁকা । গ্রামের এলাকায় এরকমটাই স্বাভাবিক । দুটো দোকান খোলা আছে ঐ মুহূর্তে । একটা কাপড়ের দোকান, অন্যটা কম্পিউটারের দোকান । রাস্তা পুরো ফাঁকা । সাখুরা আর জাশির রাস্তার একপাশে গাড়িটা রেখে গাড়ি থেকে নেমে দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো । রাদিবও তখন বেরলো দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে । রাদিব যেই দোকানের শাটারটা বন্ধ করতে যাবে, অমনি পেছন থেকে জাশির আর সাখুরা ভেতরে ঢুকে ভেতর থেকে শাটারটা বন্ধ করে দিলো । রাদিব চিৎকার করে বলল, “কে আপনারা? কি চান?” জাশির তখন ওর গলা ধরে ছিল সাখুরা বলল, “তুই ফেসবুকে আজকে একটা অডিও রেকর্ড ছেরেছিস । বল, কোথায় পেয়েছিস সেই অডিও?” রাদিব ভয়ে ভয়ে বলল, “একখান মেমোরি কার্ডে । আর ঐ মেমোরি কার্ডও আমার না ।” সাখুরা তখন ওর মোবাইল কেড়ে নিয়ে ওর ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে ফেসবুক থেকে সেই অডিওটা ডিলিট করে দিলো ।” তারপর রাদিবের শার্ট ধরে জাশির বলল, “বল কই আছে সেই মেমোরি কার্ড?” রাদিব বলল, “জয়নাল চাচার কাছে । জাশির বলল, “চুপচাপ আমাদের সাথে ঐ জয়নালের বাড়ি চল । পালানোর চেষ্টা করলে বা চালাকি করার চেষ্টা করলে জীবন শেষ তোর । আমি কিন্তু ডাক্তার । আমার বংশধর কিন্তু ডোম । লাশ কাটতে আমার হাত একফোঁটাও কাপবে না কিন্তু ।” বাধ্য হয়ে রাদিব রাজি হল জয়নালের বাসায় যেতে ।

আগামী পর্বেঃ
জামেনার কাঁপছে । দরজার বাইরে থেকে জাশির আর সাখুরা জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে । জামেনা মোবাইল নিয়ে ফোন করলো জয়নাল কে । এপাশে ট্রাকের মালিক জব্বার তখন কাজ করে গ্যারেজ লাগিয়ে বাসার পথে ফিরছিলেন । হঠাৎ খেয়াল করলেন, চেয়ারের ওপর পড়ে আছে জয়নালের ফোন আর ফোনটা বাজছে । ফোনটা ধরতেই অপাশ থেকে কাঁদো কাঁদো গলায় চিৎকার করে জামেনা বলল, “জয়নাল, তাড়াতাড়ি বাসায় আসো! কয়েকজন লোক আবিররে নিয়া যাইতে চাইতাসে । জয়নাল! তাড়াতাড়ি আসো । আমার ভয় করতাসে!” এমন সময় দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকার শব্দ । জামেনার হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে ভেঙে গেলো । আর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো । জব্বার তাড়াতাড়ি দৌড় দিলো জয়নালের বাসার দিকে ।
×
পরিচয়(পর্ব-১৬)(সিজন-১)

বাধ্য হয়ে রাদিব রাজি হল জয়নালের বাসায় যেতে । রাতের আধারে নির্জন রাস্তা দিয়ে ওরা পথ চলতে লাগলো । রাস্তায় মাঝে মাঝে ২-১জন হেঁটে গেলেও বুঝবার উপায় নেই এরা কেন যাচ্ছে ।
বাসায় তখন ছেলের পাশে শুয়ে বা হাতের কনুইয়ের ওপর ভর করে তালুর ওপর মাথা রেখে ডান হাত দিয়ে ছেলেকে আদর করতে করতে জামেনা বলছিল, “আইচ্ছা আবির, তর তো আকিকা দেয়া লাগবো, তাইনা? আইচ্ছা, তুই বড় হইয়া কি হবি বলতো? আমি চাই তুই অনেক বড় একখান নায়ক হ । তরে আমি বাংলা সিনেমার নায়ক বানামু । তুই সিনেমা বানাবি, আর আমি সিনেমা হলে বইসা বইসা তোর সিনেমা দেখমু । চারপাশে লোকজন আমারে দেখবো । কইবো, ঐ দ্যাখ, নায়ক আবিরের মা বইসা আছে । আমার যে তহন কি খুশি লাগবো।” ছোট আবির তখন কিছুই বুঝতে পারছে না । চকচকে চোখ দুটো বড় বড় করে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে । একবার জামেনার দিকে তাকায়, একবার ঘরের ছাদের দিকে তাকায় আর হালকা করে হাসতে চেষ্টা করে । জামেনা আবারও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় দরজায় জোরে ধাক্কানোর শব্দ । বাহির থেকে গলা এলো রাদিবের । বলতে লাগলো, “জামেনা আপা, ও জামেনা আপা, দরজা খোলো আপা………ও জামেনা আপা……জামেনা আপা………দরজা খোলো ।” জামেনা উঠে দরজার কাছে গেলো । দরজা খুলতেই সাখুরা আর জাশির রাদিবকে মেঝেতে ধাক্কা মেরে ঘরের ভেতর ফেলে দিলো । তারপর ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো । জামেনা অবাক হয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, “আপনারা কেডা? কি করতাসেন?” কিন্তু জাশির আর সাখুরা কোন জবাব দিলো না । ওদের চোখ চলে গেলো আবিরের দিকে । সাখুরা তখন জাশিরকে বলল, “ঐযে ঐ পোলা । ওরে মাইরা গলার লকেট খুইলা নে ।” জাশির পাশেই একটা টেবিলে রাখা ছুরি নিয়ে যেই এগিয়ে যেতে নেবে, অমনি জামেনা একটা বাশ নিয়ে জাশিরের মাথায় মারল । তারপর সাখুরার মাথায়ও মেরে আবিরকে কোলে নিলো । কিন্তু ভয়ের কারণে দরজা তাড়াহুড়া করতে গিয়ে দরজা খুলতে খুলতে পারলো না খুলতে । জাশির ততক্ষনে উঠে দাঁড়িয়েছে । জামেনা আর কোন উপায় না পেয়ে পাশে রুমে যেয়ে দরজা আটকে দিলো । সেই সুযোগে রাদিব পালাতে গেলে জাশির এসে ওর ঘাড়ে ছুরির কোপ বসিয়ে দিলো । রাদিবের ঘাড় দিয়ে গড়গড় করে রক্ত পড়তে লাগলো । সাথে সাথে মাটির ওপর লুটিয়ে পড়লো রাদিবের দেহ । জাশির প্রচুর রেগে আছে । নতুন করে আবার ওর মাথায় খুন চেপেছে । সাখুরাও তখন উঠে দাঁড়ালো । তারপর দুজনে মিলে দরজা ধাক্কাতে লাগলো । অন্য রুমে ছিল জামেনার মোবাইল । জামেনার কাঁপছে । দরজার বাইরে থেকে জাশির আর সাখুরা জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে । জামেনা মোবাইল নিয়ে ফোন করলো জয়নাল কে । এপাশে ট্রাকের মালিক জব্বার তখন কাজ করে গ্যারেজ লাগিয়ে বাসার পথে ফিরছিলেন । হঠাৎ খেয়াল করলেন, চেয়ারের ওপর পড়ে আছে জয়নালের ফোন আর ফোনটা বাজছে । ফোনটা ধরতেই অপাশ থেকে কাঁদো কাঁদো গলায় চিৎকার করে জামেনা বলল, “জয়নাল, তাড়াতাড়ি বাসায় আসো! কয়েকজন লোক আবিররে নিয়া যাইতে চাইতাসে । জয়নাল! তাড়াতাড়ি আসো । আমার ভয় করতাসে!” এমন সময় দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকার শব্দ । জামেনার হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে ভেঙে গেলো । আর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো । জব্বার তাড়াতাড়ি দৌড় দিলো জয়নালের বাসার দিকে । জব্বারের গ্যারেজ থেকে জয়নালের বাসা ২মিনিটের রাস্তা । দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছে সাখুরা আর জাশির । জামেনা খুব ভয় পাচ্ছে । জামেনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “কি চান আপনারা? আমার পোলার লগে এমন করতসেন ক্যান?” সাখুরা তখন বলল, “ওটা তোমার বাচ্চা নয় । ওটা আরেকজনের বাচ্চা । যার জন্য আমরা আজ বিপদে । আমরা ওকে মারতে চাই, আর ও তোর কাছে থাকার কারণে তুইও মরবি ।” সাখুরার কথা শেষ হতে না হতেই জাশির কোত্থেকে এসে জাশিরের মাথায় আবার বাশদিয়ে জোরে আঘাত করলো । জাশির আবার মাটিতে শুয়ে পড়লো । জাশির তাকিয়ে দেখল, সাখুরাকেও মেরেছে একটা লোক । লোকটা আর কেউ নয়, জব্বার । জব্বার তখন জামেনাকে বলল, “পালাও জামেনা, পালাও ।” জামেনা তখন বাহিরে চলে এলো । জব্বার যখনই বেরোতে যাবে, অমনি ওর পা টেনে ধরলো জাশির । জামেনা বাইরে এসে আশেপাশের সবাইকে জড় করার জন্য চিৎকার করে বলল,“ডাকাত এসছে, বাচাও, ডাকাত এসছে ।” সবাই লাঠি, ঝাড়ু, যে যা পারে, তাই নিয়ে বেড়িয়ে এলো । এরপর ঘরে ঢুকে দেখল, অন্য একটাপাশের টিন ভাঙ্গা । এক রুমের মেঝেতে পড়ে আছে রাদিবের লাশ, অন্য রুমের মেঝেতে পড়ে আছে জব্বারের লাশ । দুজনেরই ঘাড়ে ছুরি দিয়ে কোপ দেয়া হয়েছে ।

আগামী পর্বেঃ
এদিকে ঢালু পথ দিয়ে নামতে নামতে জয়নাল অনেক লোকের ভিড়, আলো আর কোলাহলের আওয়াজ শুনে অবাক হল । ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে গেলো । ভীরের মধ্যে কেউ একজন চিৎকার করে বলে উঠলো, “ওই যে, জয়নাল ভাই আইসে । সবাই তখন জয়নালের দিকে তাকালো । মাটিতে পড়ে আছে দুটো ডেড বডি । চাদরের দেহ ঢাকা । তিন দিক ঘিরে দাঁড়িয়ে পুরো গ্রাম । ওদেরই মাঝে চেয়ারে আবিরকে নিয়ে মুখ গোমড়া করে বসে ছিল জামেনা । জয়নালকে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছে । অন্য পাশে বসে জমিদার ফয়সাল ।
×
পরিচয়(১৭)

দুজনেরই ঘাড়ে ছুরি দিয়ে কোপ দেয়া হয়েছে ।
এদিকে জয়নাল আড্ডা শেষে বাসার পথে আসতে লাগলো লতিফের সাথে । লতিফের বাসা রাদিবের দোকানের পেছনেই । রাদিবের দোকানের সামনে এসে দেখল, দোকান খোলা, কিন্তু রাদিব নেই । লতিফ ইয়ার্কি করে বলল, “ঐ বড়লোক মানুষগুলা মনে হয় ওর পরিচিত কেউ, আইসে, তাই খুশিতে হয়তো খুইলা রাইখাই বাড়িত গেছে গা ।” জয়নাল একটু হেসে বলল, “ভালো কইসোস । আইচ্ছা, কাইল দেখা হইবো ।” লতিফ্ও বলল, “হ, ম্যালাদিন পর তর লগে দেখা হইয়া ভালোই লাগলো । যা তাইলে । ভাবিরে আমার সালাম দিস ।” জয়নাল আইচ্ছা বলে বাড়ির পথে পা বাড়ালো । এমন সময় পাশ থেকে কিসের আলো ওর চোখে পড়লো । তাকিয়ে দেখল, সেই গাড়িটা । এতক্ষন রাদিবের দরজার সামনেই ছিল । গাড়ির ভেতর বসে জাশির আর সাখুরা । যদিও জয়নাল ওদের দেখতে পেলো না আলোর তীব্রতার কারণে । সাখুরা অনেকক্ষণ জয়নালের দিকে তাকিয়ে রইল । যদিও তেমন কিছু বলল না । গাড়িটা যেদিক থেকে এসেছিলো, সেদিকেই ফিরে যাচ্ছে । জয়নাল কিছুক্ষণ তাকিয়ে পা বাড়াল বাসার পথে । সাখুরা আর জাশির কিন্তু জেলা ছেড়ে পালালো না । ফকিরাপুল গ্রামের পাশেই একটা এলাকা নাম সোনারামপুর । সেই এলাকার একটা হোটেলে রুম বুক করলো । শিকারকে হাতের কাছে পেয়ে ওরা এতো সহজে চায় না । তবের ওদের চিন্তা একটাই, ওরা আবার চলে না যায় । তবে গেলে তো আর এখনই যাবেনা, পরদিন সকাল ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই । তাই ওরা প্ল্যান করলো, ফজরের আজানের আগে ওরা ওদের কাজ সেরে তারপর ঢাকায় ফিরে আসবে ।
এদিকে ঢালু পথ দিয়ে নামতে নামতে জয়নাল অনেক লোকের ভিড়, আলো আর কোলাহলের আওয়াজ শুনে অবাক হল । ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে গেলো । ভীরের মধ্যে কেউ একজন চিৎকার করে বলে উঠলো, “ওই যে, জয়নাল ভাই আইসে । সবাই তখন জয়নালের দিকে তাকালো । মাটিতে পড়ে আছে দুটো ডেড বডি । চাদরের দেহ ঢাকা । তিন দিক ঘিরে দাঁড়িয়ে পুরো গ্রাম । ওদেরই মাঝে চেয়ারে আবিরকে নিয়ে মুখ গোমড়া করে বসে ছিল জামেনা । জয়নালকে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছে । অন্য পাশে বসে চেয়ারম্যান ফয়সাল । জয়নাল ভীরের কাছাকাছি আসতেই জামেনা ওর কাছে এগিয়ে এলো । সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে । কেউ কোনো কথা বলছে না । জয়নাল ভ্রু কুঁচকে জামেনার দিকে তাকিয়ে বলল, “জা…জামেনা, কি হয়েছে?” জামেনা তোতলাতে তোতলাতে বলল, “বা…বা…।” কথা শুরু করতে না করতেই জব্বার ও রাদিবের পরিবারের লোকজন এসে হাজির । কাঁদতে কাঁদতে ওরা লাশের পাশে বসে পড়লো । এক লোক ওদের মুখের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে দিলো যেন ওদের পরিবারের লোকজন ওদের দেখে চিনতে পারে । জয়নাল জব্বার আর রাদিবের লাশ দেখে জয়নাল কাঁপতে কাঁপতে লাগলো । কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, “কি হইসে জামেনা? উনাদের এই অবস্থা ক্যান?” জামেনা জয়নালকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলল । লোকজন যখন মেঝেতে লাশ পড়ে থাকতে দেখেছিল, তখনই একটা হুলস্থূল কাণ্ড বেধে যায় । গ্রামের সব লোকজন জড় হয়, সবাই পেছনের ভাঙ্গা টিন দেখে বুঝতে পারে, ডাকাত পালিয়েছে । তখনই ওরা আরও লোক জড়ো করে আর সাথে চেয়ারম্যান ফয়সালকেও ডেকে আনে । চেয়ারম্যান ফয়সাল তখন সব জিজ্ঞেস করলে সব খুলে বলে জামেনা । কিন্তু যখনই চেয়ারম্যান ফয়সালের মনে একটা প্রশ্ন দানা বাধতে শুরু করে, এই বাচ্চার সাথে ওদের কি সম্পর্ক, তখনই চুপ হয়ে যায় জামেনা । আসল কথা তো আর সবাইকে ও বলতে পারবে না । তাহলে তো সবাই তখন ওদেরই দোষারোপ করবে কেন ওরা বাচ্চাটাকে ওদের বাবা মা-র কাছে ফেরত না দিয়ে কেন ওরা ওদের কাছে রাখলো । জয়নালের চোখে পানি ছল ছল করছে । বার বার রাদিব আর জব্বারের চেহারাটা চোখের সামনে ভাসছে । কানে বাজছে রাদিবের চাচা বলে ডাকার শব্দটা, জব্বার বলেছিল মাঝে মাঝে আসত, সেই কথাটা । হঠাৎ একটা বিভোরের মধ্যে চলে যায় জয়নাল চেয়ারম্যান তখন জয়নালের কাছে এগিয়ে এসে বলল, “দ্যাখো জয়নাল, আমি জানি, তুমি বা তোমার বউ এইরকম কিছু করতেই পারে না । কিন্তু পুলিশ কেইস হইলে তোমারে যে জবানবন্দি দিতে হইবো, এইডাও সত্য । এহন আমাদের তো এই ছাড়া কিছু করার নাই । ভীরের মধ্যে থেকে এক বয়স্ক বৃদ্ধা বলে উঠলো, “আহারে, পুলিশরে কইলেই তো হ্যারা লাশ কাইটা-কুইটা একখান ভয়ঙ্কর চেহারা পাঠায় দিবো । আল্লাহ, তুমি আমাগোর গেরামের কাউরে এমন মৃত্যু দিও না, যেন লাশ কাইটাকুইটা চেহারাটা নষ্ট কইরা দেয় । কথাটা শুনে রাদিবের মায়ের বুকটা ছ্যাত করে উঠলো । সে চেয়ারম্যানের কাছে এসে বলল, “চেয়ারম্যান সাহেব, আমি চাইনা পুলিশের কাছে আমার পোলার নাম কইয়া দ্যান । আমি আমার পোলার অমন চেহারা দ্যাখতে পারমু না ।” চেয়ারম্যান ফয়সাল কিছু বললেন না । দুঃখিনী মায়ের এমন আর্তনাদ শুনে তার মনটাও কেমন করলো । একই আবদার জব্ববার মায়েরও । জব্বারের স্ত্রী যদিও আপত্তি করলো, কিন্তু অন্যান্য সকলের জোরজবরদস্তির জন্য মেনে নিলো সেও । অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হল, পুলিশকে কিছু জানানো হবে না ।

আগামী পর্বেঃ
এতো বছর পর গ্রামে আসতে না আসতেই আবার গ্রামটা ছেড়ে আবার কোন এক অজানার উদ্দেশ্যে রওনা হতে হচ্ছে ওদের । একটা দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে । জামেনা মনে হচ্ছে, হাওাটা ওদের গ্রামের দিকে ডাকছে । আবার মনে হচ্ছে, গ্রামের অন্ধকার ওদের চলে যেতে বলছে । কেন বলছে? জানে না জামেনা । উত্তর নেই কোন । জয়নাল আপন মনে বইঠা বাইতে লাগলেও ওরও যে কষ্ট হচ্ছে না, তা কিন্তু নয় । কিন্তু ওই যে, পুরুষ মানুষ যে জন্ম থেকেই কষ্টকে আপন করে নিতে শিখেছে, সেটাকে লুকিয়ে বাস্তবতাকে মেনে নিতে শিখেছে, সেটার প্রতিফলনই ওর মধ্যে দেখা যাচ্ছে । কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? আগের বার যাওয়ার সময় তো এমনটা হয় নি । তবে কি এটাই গ্রামের সাথে ওদের শেষ দেখা?
×
পরিচয়(১৮)(সিজন-১)

অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হল, পুলিশকে কিছু জানানো হবে না । কিছুক্ষনের মধ্যেই ভিড় জমে থাকা যায়গাটা শান্ত হয়ে যায় । সবাই যে যার বাসায় চলে যায় । শুধু থেকে যায় জামেনা আর জয়নাল । জামিলা যদিও বলেছিল আজ রাতটা ওদের বাসায় থাকতে, কিন্তু জয়নাল রাজি হয় নি । কথাটা হঠাৎ মাথায় আসতেই জামেনা জয়নালকে বলল, “আইচ্ছা, জামিলা তো কইসিলো ওদের বাসায় আইজকা থাকতে । তুমি থাকলা না ক্যান?” জয়নাল কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, “দেখো জামেনা, জব্বার ভাই আর রাদিব দুজনাই আমার খুব পছন্দের মানুষ আছিলেন । আমাদেরই একখান ভুলের জন্য বেচারারা এইভাবে মারা গেলো । এহন যদি জামিলাগো বাড়ি যাই, পড়ে যদি ওরা বিপদে পড়ে?” জামেনা আর কিছু বলল না । জয়নাল ভুল কিছুই বলে নি । কিন্তু তাদের নিজেদেরও তো জীবনের একটা মায়া আছে । আর তাছাড়া বাচ্চাটার কি হবে? জামেনা যেই-ই কথাটা জয়নালকে বলতে যাবে, তখনই জয়নাল যেন ওর চোখ মুখ দেখে সব বুঝতে পেরে বলল, “হুম । আমি জানি । তুমি ভাবতেসো আমরা এখন কই যামু । আমার ভাবা আছে । আইচ্ছা, আমাগো বাড়ির পিছে একখান নৌকা আছে না?” জামেনা বলল, “হ তো । কার নৌকা তা তো কইতে পারি না ।” জয়নাল কিছুক্ষণ কি যেন ভেবে তারপর বলল “তুমি তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতর থেইকা প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়া আসো, টাকা পয়সা, জামা কাপড় । আমি নৌকা তৈরি করতাসি । জামেনা বুঝল, জয়নাল নৌকায় করে দূরে কোথাও যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে । জামেনা একটুও বিলম্ব না করে চলে গেলো সব গোছাতে । জীবনের এই মুহূর্তটা ওদের জন্য আনন্দের নাকি ভয়ের, তা ওরা নিজেরাই বুঝতে পারছে না । আগেরবার যখন ওরা গিয়েছিলো, তখন ওরা জানত, একদিন ওরা ফিরে আসবেই । কিন্তু এবার কি ওরা আর ফিরে আসবে? তার কোন নিশ্চয়তা নেই । জামেনা সব গোছাতে লাগলো । ছোট আবির তখন বিছানায় শুয়ে গলার লকেটটা নাড়াচাড়া করছে । এদিকে জয়নাল নৌকা ঠিক করছে । দেখে মনে হয় না তেমন পুরনো নৌকো । জয়নাল সেটা পানিতে নামিয়ে আপাতত দড়ি দিয়ে পুকুর পাড়ে বেধে রাখলো । এরপর পাশেই পড়ে থাকা একটা ডাব গাছের ডাল থেকে পাতা ছাড়িয়ে তৈরি করলো বইঠা । সব কাজ করতে করতে বেজে গেলো প্রায় রাত ২টা । আকাশে হালকা চাদের আলো ছাড়া আশেপাশে কোনো আলোই নেই । খানিক বাদে জামেনা চলে এলো পুকুর পাড়ে । জয়নাল জামেনাকে দেখে বলল, “সব নিয়া আসছ?” জামেনা কেবল উপর নিচ মাথা নাড়াল । মুখে কিছু বলল না । হাতে ওর একটা পুটলি । এর মধ্যে সব জামাকাপড় আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এনেছে । অন্য হাতে আবির তখনও সেই লকেটটা হাতে নিয়ে জামেনার কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছে । জয়নাল নৌকার একপাশে উঠে বসলো । আগে থেকেই জয়নাল একটা হারিকেন এনেছিল । সেটা হালকা করে জালিয়ে দিলো । তারপর জামেনাকেও উঠে আসতে বলল । অন্যপাশে জামেনা বসে পড়লো । পুটলিটা এক পাশে রেখে দিলো । জয়নাল পাড় থেকে দড়িটা খুলে দিলো । তারপর বইঠা দিয়ে নৌকা চালাতে লাগলো । ধীরে ধীরে গ্রাম থেকে ওদের দুরত্ব বারতে লাগলো । জামেনা এক দৃষ্টিতে চিরচেনা গ্রামটার দিকে তাকিয়ে রইল । আগেরবার যখন এসেছিলো তখনও বোধ হয় এতোটা কষ্ট পায়নি জামেনা । এতো বছর পর গ্রামে আসতে না আসতেই আবার গ্রামটা ছেড়ে আবার কোন এক অজানার উদ্দেশ্যে রওনা হতে হচ্ছে ওদের । একটা দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে । জামেনা মনে হচ্ছে, হাওাটা ওদের গ্রামের দিকে ডাকছে । আবার মনে হচ্ছে, গ্রামের অন্ধকার ওদের চলে যেতে বলছে । কেন বলছে? জানে না জামেনা । উত্তর নেই কোন । জয়নাল আপন মনে বইঠা বাইতে লাগলেও ওরও যে কষ্ট হচ্ছে না, তা কিন্তু নয় । কিন্তু ওই যে, পুরুষ মানুষ যে জন্ম থেকেই কষ্টকে আপন করে নিতে শিখেছে, সেটাকে লুকিয়ে বাস্তবতাকে মেনে নিতে শিখেছে, সেটার প্রতিফলনই ওর মধ্যে দেখা যাচ্ছে । কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? আগের বার যাওয়ার সময় তো এমনটা হয় নি । তবে কি এটাই গ্রামের সাথে ওদের শেষ দেখা?
ওদিকে ডাক্তার জাশির আর সাখুরা হোটেল থেকে নেমে গাড়িতে উঠলো । জাশির গাড়ি চালাতে লাগলো । সাখুরাকে বলল, “কি হে, কি মনে হয়? এই রক্তারক্তির পড়ও ওদের মারতে পারবে?” সাখুরা বলল, “কি বোঝাতে চাচ্ছো?” জাশির বলল, “না, আপনিই বলুন । দুটো খুনের পরও কি গ্রামের মানুষ এখন এতোটা চুপচাপ থাকবে? যদি ওরা নিরাপত্তা বাড়ায়? কিংবা সারারাত না ঘুমায়?” সাখুরা কোন জবাব দিলো না ।

আগামী পর্বেঃ
সাখুরা তখন জাশিরকে বলল, “কি ব্যাপার? এরা গেলো কোথায়?” জাশির কিছু বলল না ।” সাখুরা কিছুক্ষণ কি ভেবে বলল, “আমার মনে হয়, আশেপাশে কারো বাসায় যেয়ে ঘুমিয়েছে ।” জাশির তখন বলল, “হুম । আমারও তাই মনে হয় । কিন্তু এখন তাহলে কি করবেন?” সাখুরা কিছুক্ষণ ভাবলো । হঠাৎ ওর চোখ আটকে গেলো ঘরের একপাশে থাকা কিছু কেরোসিনের ডিব্বার দিকে । সাখুরা সেগুলো হাতে নিয়ে বলল, “আমি বুঝতে পেরেছি, আমার এখন কি করতে হবে ।” জাশির তখনও বুঝতে পারছিলো না, সাখুরা কি করতে চলেছে ।
×
পরিচয়(১৯)(সিজন-১)

সাখুরা কোন জবাব দিলো না । জাশির আবার জিজ্ঞেস করলো, “জবাব নেই না? পাপ কিন্তু বাপকেও ছাড়ে না ।” সাখুরা এবার একটু বিরক্ত হল । যে লোকের লাশকাটার কাহিনী দেখে নিজেও লাশকাটার নেশায় মাঝে মাঝে মেতে ওঠে, সেই লোকটার মুখে এখন এ কি কথা শুনছে?” জাশির বলল, “লাশ কাটতে আমারও ভালো লাগে । কিন্তু তাই বলে এই না, যে আমারও মায়া নেই । আপনার মনে আছে, আমি যখন লাশকাটার নেশায় আমার বাবা মাকে খুন করেছিলাম, সেটা কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর দিন ছিল । কিন্তু আমি আগে বুঝতে পারিনি । আজ কেন যেন মনে হচ্ছে । কত বড় ভুল করেছি আমি । কিন্তু মেরেছি নেশার জন্য । লাশকাটার নেশা ।” সাখুরা এবার সত্যিই অবাক হচ্ছে , এ কোন জাশিরকে দেখছে ও? ও কি পাল্টে গেলো এক রাতেই? নাকি ওর ওপর ভালো জীন ভর করেছে? সাখুরা আবার ভয়ও পাচ্ছে । ওকে আবার খুন না করে ফেলে । জাশির একটু থেমে আবার বলল, “নেশা জিনিসটা খুব খারাপ জিনিস । হোক তা মাদকের নেশা, হোক তা লাশকাটার নেশা, হোক তা অন্যকিছুর নেশা । সেই নেশাটাই একজন মানুষকে তার মাধমেই আপন মানুষহারা করে দেয় এবং সে বুঝতেও পারে না । একটা সময় যখন বুঝতে পারে, তখন……………।” থেমে যায় জাশির । ওর চোখ দিয়ে অশ্রুধারা এই আধারেও স্পষ্ট বুঝতে পারছে সাখুরা । না, কি হচ্ছেটা কি? স্বপ্ন দেখছে না তো? নিজের অজান্তেই নিজেকে চিমটি কেটে সাখুরা দেখলো, না । এটা কোন স্বপ্ন নয় ।” জাশির আর কিছু বলল না । গাড়ি চালাতে লাগলো ।
এদিকে জামেনা আর জয়নাল পুকুর পার করে নদীতে এসেছে । তিতাস নদী । নদীর পাড়েই রয়েছে একটা ঘাট । ঘাট থেকে একটা লঞ্চ যাবে ঢাকায় । জামেনা আর জয়নাল সেখানে গেলো । অন্ধকারে ঘাট পারে নেমে এলো ওরা । জয়নাল নৌকাটা ভাসিয়ে দিলো জলের বুকে । নদীর স্রোতে খুব দ্রুতই সেটা ভাসতে ভাসতে চলে গেলো অনেক দূর । জয়নাল আর জামেনা লঞ্চে উঠলো । নৌকায় তেমন যাত্রী না থাকলেও ভেতরে কোথাও যাওয়ার মতো অর্থ ওরা খরচ করতে চায় না । তাই কম টাকায় ডেকেতেই নিজেদের জায়গা করে নিলো । এক পাশে পুটলি রেখে তার ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লো জয়নাল । আর জামেনা একটা দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে কোলে বাচ্চাটাকে নিয়ে বসে রইল । ৩:৩০ বাজতেই লঞ্চ ছেড়ে দিলো ।
একই সময়ে গ্রামে এসে প্রবেশ করলো জাশির আর সাখুরা । না । জাশির যেমন ভেবেছিলো, তেমন কিছুই না । এলাকায় নিস্তব্ধতা বিরাজমান । আশেপাশে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না । জাশির আর সাখুরা ছুরিটা পকেটে নিয়ে এগিয়ে গেলো জামেনার বাসার দিকে । ধির পায়ে ওরা যেতে লাগলো যেন কেউ টের না পায় । কিন্তু বাসার কাছাকাছি এসে দরজা খোলা দেখেই সাখুরা বুঝতে পারলো, ওরা বাসায় নেই । তবুও ভেতরে যেয়ে দেখে নিশ্চিত হয়ে নিলো । সাখুরা তখন জাশিরকে বলল, “কি ব্যাপার? এরা গেলো কোথায়?” জাশির কিছু বলল না ।” সাখুরা কিছুক্ষণ কি ভেবে বলল, “আমার মনে হয়, আশেপাশে কারো বাসায় যেয়ে ঘুমিয়েছে ।” জাশির তখন বলল, “হুম । আমারও তাই মনে হয় । কিন্তু এখন তাহলে কি করবেন?” সাখুরা কিছুক্ষণ ভাবলো । হঠাৎ ওর চোখ আটকে গেলো ঘরের একপাশে থাকা কিছু কেরোসিনের ডিব্বার দিকে । সাখুরা সেগুলো হাতে নিয়ে বলল, “আমি বুঝতে পেরেছি, আমার এখন কি করতে হবে ।” জাশির তখনও বুঝতে পারছিলো না, সাখুরা কি করতে চলেছে । সাখুরা বাইরে এসে সব বাসার ছাদে কেরোসিন ঢেলে দিলো । সাঁকো পার হয়ে ওপাশে যেয়েও সেই বাড়িগুলোতেও কেরোসিন ছিটিয়ে দিলো । কেরোসিন দেয়া শেষে ডিব্বাগুলো খালপাড়ে ফেলে দিলো । জাশির তখন সাখুরার কাছে এসে বলল, “এটা ঠিক হচ্ছে না । শুধু শুধু এসব মানুষকে কষ্ট দেয়া ঠিক হচ্ছে না । আমাদের যাকে মারা লাগবে, তাকে খোঁজা দরকার ।” সাখুরা বিরক্ত হয়ে বলল, “মাথা-টাথা ঠিক আছে? আরে তুমিই আমাকে শিখিয়েছ মানুষ মারতে, এখন সেই দোষ ঢাকতে আমাকে বারণ করছো?” জাশির তখন সাখুরাকে ধাক্কা দিয়ে বলে, “আপনি এরকম করলে আমি কিন্তু আপনাকে লাশ বানাবো ।” সাখুরা আর সহ্য করতে পারলো না । এক ধাক্কা মেরে জাশিরকে ফেলে দিলো খালের মধ্যে । আর এই ফাঁকে ম্যাচের কাঠি দিয়ে নিজের কাজ হাসিল করলো । একবার খালের এপাশে, একবার ওপাশে । খুব একটা বেশি কেরোসিন না দিতে পারায় আগুন ছড়াতে একটু দেরিই হল । তবে এতে সাখুরার সুবিধাই হল । ঘুমন্ত মানুষ হঠাৎ কিছু টেরও পেলো না । অনেক কষ্টে কোনোরকমে খাল থেকে উঠে এলো জাশির । তারপর সাখুরার কাছে এসে ওর শার্টের কলার টেনে ধরে বলল, “কেন এমন করলেন আপনি?” সাখুরা সাতপাঁচ না ভেবে জাশিরকে এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো আগুন ছড়ানো একটা বাড়ির ভেতর । ইতোমধ্যে ঘুমন্ত মানুষের চিৎকারের আওয়াজও শুরু হয়ে গেছে । সাখুরা আর দেরি না করে সেখান থেকে পালিয়ে এলো ।

আগামী পর্বেঃ
জয়নালের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে লঞ্চের ধারে রেলিঙের কাছে গেলো জামেনা । ওরা একটা নদীর মাঝখানে । দুপাশে অনেক দূরত্ব বজায় রেখে লোকজনের বসতি । সামনে এই দু ধারের বসতি একসাথে মিলেছে বলে মনে হচ্ছে, সেখানে অর্ধেক সূর্য কেবল উঁকি দিয়েছে । নদীর পানিতে তার প্রতিফলন আরও সুন্দর রুপের সৃষ্টি করেছে । দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে । অজান্তেই জামেনার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো । এ যেন ভালো কিছুর পূর্বাভাস ।
……………………………………………………………………………….
নদীর ওপাশে একটা গ্রাম । ওপাশে সূর্য প্রায় উঠে গেছে এমন পর্যায়ে আছে । সাখুরা সেদিকে তাকিয়ে রইল । খারাপ বলে তার মাঝে সৌন্দর্য দেখার যে কোন ইচ্ছা হয় না, তেমনটা নয় । তারও মনে হচ্ছে, এ যেন এক নতুন জীবনে পা রাখার পূর্বাভাস ।
×
পরিচয়(২০)(সিজন-১)

সাখুরা আর দেরি না করে সেখান থেকে পালিয়ে এলো । আগুনে পোড়া বাড়িগুলোর ভেতর থেকে যে যার যার জীবন বাচিয়ে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করছিলো। যারা বেড়িয়ে এসেছে, তারা যে যার সাধ্যমতো পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে । জাশির সাখুরার ধাক্কায় জমিলাদের বাড়ির ভেতর পড়ে আগুনের তাপে অজ্ঞান হয়ে ছিল । জামিলা তাই সাতপাঁচ না ভেবে জাশিরের দেহটা কোনরকমে বাইরে নিয়ে এলো । তারপর এক পাশে যেখানে আগুন লাগেনি সেখানে একটা খুটির সাথে জাশিরের দেহটা হেলান দিয়ে রেখে এলো । লোকজন আগুন নেভাতে ব্যাস্ত থাকার কারণে জাশিরকে কেউই খেয়াল করে নি । জামিলাও আগুন নেভানোয় ব্যাস্ত হয়ে পড়লো । তার মা আগেই বের হয়েছে । চেয়ারম্যানের কাছে খবর পৌঁছতেই তিনি তাড়াতাড়ি করে চলে এলেন এখানে । তিনি নিজেও পানি দিয়ে আগুন নেভানোর কাজে লেগে গেলেন ।
এদিকে অনেক ক্লান্ত হওয়ায় অনেকক্ষণ ধরে লঞ্চে ঘুমিয়ে ছিলো জামেনা আর জয়নাল । সকালের সূর্যের আলো চোখের ওপর পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় জামেনার । কোলে আবির নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে । যেন ওর জীবনে কত আনন্দ । পুটলির ওপর হালকা গর্ত করে তার ওপর আবিরকে শুইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো জামেনা । সামনে জয়নালও ঘুমিয়ে আছে । জয়নালের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে লঞ্চের ধারে রেলিঙের কাছে গেলো জামেনা । ওরা একটা নদীর মাঝখানে । দুপাশে অনেক দূরত্ব বজায় রেখে লোকজনের বসতি । সামনে এই দু ধারের বসতি একসাথে মিলেছে বলে মনে হচ্ছে, সেখানে অর্ধেক সূর্য কেবল উঁকি দিয়েছে । নদীর পানিতে তার প্রতিফলন আরও সুন্দর রুপের সৃষ্টি করেছে । দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে । অজান্তেই জামেনার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো । এ যেন ভালো কিছুর পূর্বাভাস ।
এদিকে সাখুরা আগুন লাগিয়ে আর হোস্টেলের দিকে যায় নি । সরাসরি ঢাকার পথে রওনা হয়েছে । আজ ওর মনে অনেক শান্তি । আজ যেন ঠিক মতো ওর রাতে ঘুম হবে । মনের সুখে গাড়ি চালাচ্ছে । হঠাৎ কি মনে করে গাড়িটা থামিয়ে বাইরে এলো । রাস্তার পাশে একটা বিরাট নদী । নদীর ওপাশে একটা গ্রাম । ওপাশে সূর্য প্রায় উঠে গেছে এমন পর্যায়ে আছে । সাখুরা সেদিকে তাকিয়ে রইল । খারাপ বলে তার মাঝে সৌন্দর্য দেখার যে কোন ইচ্ছা হয় না, তেমনটা নয় । তারও মনে হচ্ছে, এ যেন এক নতুন জীবনে পা রাখার পূর্বাভাস । আনন্দের দিন আসছে ওর জন্য । শুধু একটাই চিন্তা, জাশির যদি কোনোরকমে বেচে ফেরে, তাহলে? আচ্ছা, বেচে ফিরলেও ও যদি সাখুরার নামে কিছু বলে, তাহলে সাখুরাও থেমে থাকবে না । সব বলে দেবে কৌশলে নিজের দোষটা আড়াল করে । কিন্তু যদি জয়নাল আর জামেনা তার সাথে সোহেলের ছেলেটাও বেচে যায়? যদি মেমোরি কার্ডটা নষ্ট না হয়? তখন কি হবে? যদি ঐ বাড়িগুলোর ভেতর ওরা না-ই থাকে, তাহলে কি হবে? কথাগুলো মাথায় আসতেই হঠাৎ ওর একটু আগেকার আনন্দ বিদায় নিলো । এখন সূর্যটা দেখে মনে হচ্ছে, ওর জীবনের খারাপ সময় অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো এগিয়ে আসছে । এখন গ্রামে যাওয়াটাও সুবিধার না । সাখুরার নিজের প্রতি খুব রাগ হতে লাগলো । রেগে গাড়ির মাথায় একটা থাবা মারল । কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে গাড়িতে উঠে আবার ঢাকার দিকে রওনা হল ।
ফজরের নামায শেষে সবাইকে নিয়ে আবারও একটা মিটিং-এর আয়োজন করলেন চেয়ারম্যান ফয়সাল । রাতের একটা বিপদের রেশ কাটতে না কাটতেই মাঝরাতে আরেকটা বিপদ । জাশিরকে হাসপাতালে নিয়ে পাঠানো হয়েছে । ওর মুখটা সামান্য পুড়ে গেছে তবে না এমনভাবেও পোড়ে নি যে প্লাস্টিক সার্জারি করতে হবে । তবে আগের চেহারার থেকে পার্থক্য অনেক হয়েছে । মিনিং-এ গ্রামের সব লোক জন যখন আলোচনা করছিলো, হঠাৎ তার মাঝে চেয়ারম্যান ফয়সাল বলে উঠলেন, “আচ্ছা, জয়নাল আর জামেনা কোথায়?” লোকজন তখন আশেপাশে তাকিয়ে খেয়াল করে সত্যিই অবাক হয়ে গেলো । আসলেই তো? জয়নাল আর জামেনা কোথায়? আরও একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখল , ওদের বাসায় আগুন লাগে না । যেমন ছিল, তেমন অক্ষত । দুজন লোক ওদের বাসা থেকে দেখে এসে বলল, “চেয়ার ম্যান সাহেব, ভেতরে তো কাউরেই দেখলাম না । তাইলে ওরা কই গেলো?” চেয়ারম্যান কিছু বলতে যাবেন এমন সময় জামিলার মা বলে উঠলো, “আমার তো মনে হয় ওরাই আগুন লাগাইসে ।” এমনিতে জামিলার মা জামেনা কে সহ্য করতে পারেন না, তার ওপর তার স্বভাব মানুষের নামে বদনাম ছড়ানো । এখানে এই সুযোগ তো আরও হাতছাড়া করা যাবে না । কিন্তু চেয়ারম্যান ব্যাপারটা গায়ে মাখল না আদৌ । বলল, “ধুর, কি যে বলছেন । জয়নাল এসব কেন করতে যাবে । না না, ও এইরকম মানুষ না ।” জামিলার মা আবার বলল, “না গো জমিদার সাহেব, বলা যায় না । কত বছর পর এসেছে । কোত্থেকে টাকা জোগাড় করেছে কে জানে । খুন খারাপি করলেও করতে পারে । আর তাছাড়া ওরা কিছু যদি না-ই করে? তাহলে যাবে কেন বলেন তো?” এবারে গ্রামের সব লোকজন হইচই শুরু করে দিলো । সবাই এবার জয়নাল আর জামেনার ওপর সন্দেহ করতে লাগলো ।

আগামী পর্বেঃ
ফয়সাল তখন বললেন, “আজ থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম, গ্রামে নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হবে ।” এবার যেন নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললেন, “আর জয়নাল, জামেনা আর তার বাচ্চা এই গ্রামে কখনই আসতে পারবে না । আসলেও তাদের বের করে দেয়া হবে ।” সবাই খুব খুশি । সবাই আবার সেই সূর্যটার দিকে তাকালো । এ যেন তাদের জন্য এক নতুন দিনের বার্তা ।
………………………………………
ওরা বাসে উঠলো । বাসে আরও কিছু লোকজন ছিল । ১২টা বাজার পরপরই বাস ছেড়ে গেলো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে । এক নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে ওরা ।
………………………………………….
তবে আজকে ওর ছেলে আর স্ত্রীর এই ভালোবাসা দেখে ওর মনে প্রশ্ন জাগছে । মানুষ খারাপ কেন হয়? সে খারাপ কেন হয়েছিল? ভালো হওয়াটাই তো খারাপ থাকার চেয়ে আনন্দের । সাখুরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো, নতুন একটা জীবন শুরুর এটাই সময় ।
×
পরিচয়(২১)(সিজন-১ এর শেষ পর্ব)

সবাই এবার জয়নাল আর জামেনার ওপর সন্দেহ করতে লাগলো । জামিলা বার বার ওর মাকে কথা বলতে ইশারায় মানা করলেও সে কথা বলেই যাচ্ছে । এক মহিলা তখন বলে উঠলো, “আইচ্ছা, ধইরা নিলাম, জয়নাল আর জামেনা আমাগো বাড়িত আগুন ধরাইয়া দিসে । কিন্তু এইডা কইরা অগো কি লাভ হইব? ওরা আগুন ক্যান ধরাইবো অকারণে?” জামিলার মা-ও কথাটা বলার জন্যই অপেক্ষা করছিলো এমন একটা ভাব করে বলল, “আরে বুঝেন না? এই যে আগেরবার ওরা গেরাম ছাইড়া গেছিলোগা, সেই জন্যই । আর আমার মনে হয় কি, কাইল রাইতে যেই গুন্ডাগুলা আইসিলো, অইগুলা অগোরে চেনা । নিজেদের দোষ ঢাইকবার জন্য এই কাম করসে । কারণ অগোরে আমরা ছাড়া আর কেউ তো ভালো কইরা চেনে না ।” ব্যাস, শুরু হয়ে গেলো আরও সমালোচনা । জয়নাল আর জামেনাই এই কাজ করেছে, ওরা এবার পুরোপুরি নিশ্চিত । সবাই তো জামিলার মায়ের প্রশংসা করতে লাগলো । যদিও চেয়ারম্যান ফয়সাল এখনো ব্যাপারটাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না । কিন্তু জয়নাল আর জামেনার এরকম হঠাৎ করে চলে যাওয়াটাকেও তো অবিস্বাস করা যাচ্ছে না । আকাশের সূর্যটা পুরোপুরি উঠে গেছে । গাছের পাতার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে । চেয়ারম্যান ফয়সাল এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছেন । গ্রামের অন্যান্য লোকজন তার এই দৃষ্টি দেখে তারাও সেদিকে তাকাল । সবাই চুপচাপ । দৃশ্যটা দেখতে দারুন লাগছে । ফয়সাল তখন বললেন, “আজ থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম, গ্রামে নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হবে ।” এবার যেন নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললেন, “আর জয়নাল, জামেনা আর তার বাচ্চা এই গ্রামে কখনই আসতে পারবে না । আসলেও তাদের বের করে দেয়া হবে ।” সবাই খুব খুশি । সবাই আবার সেই সূর্যটার দিকে তাকালো । এ যেন তাদের জন্য এক নতুন দিনের বার্তা ।
দুপুর ১২টা বাজতে না বাজতেই জামেনা আর জয়নাল ঢাকা সদরঘাটে এসে পৌঁছল । লঞ্চ থেকে নামছে অনেক মানুষ । আবার ঘাট পারেও দাড়িয়ে অনেক মানুষ । মানুষের এত ভিড় ওরা এর আগে কখনোই দেখেনি । গ্রামে নির্বাচনের প্রচারণার মিছিলে যে পরিমান মানুষ হয়, এখানে যেন তার থেকেও বেশি মানুষ । মানুষের ভীরে ঠিক মতো হাঁটাও যাচ্ছে না । একটু দূরে চার লেনের বিরাট রাস্তা । বড় বড় গাড়ি চলছে । ওরা এর আগে কখনো এতো গাড়িও একসাথে দেখেনি । রাস্তার ওপারে বিরাট বিরাট ১০তলা, ১৫তলা বাড়ি । এগুলোও ওরা এর আগে কখনোই দেখে নি । এক কথায় এই শহরের প্রতিটা পদক্ষেপ ওদেরকে আশ্চর্য করে দিচ্ছে । এখানে ওখানে ঝালমুড়িওয়ালা, আইসক্রিমওয়ালা, আরও কত ফেরিওয়ালা হাঁক দিচ্ছে । রাস্তার ধারে কিছু লোকজন বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে । জামেনার কোলে শুয়ে ছোট আবিরও ছোট চোখদুটো দিয়ে সবটা দেখছে । ওর কাছেও যেন সবটা নতুন মনে হচ্ছে । এমন সময় বাসের একজন হেল্পার ওদের সামনে এলো । এসে বলল, “ভাই কই যাইবেন?” জয়নাল বলল, “যামু না ভাই, আইসি ।” হেল্পার জয়নাল কথা শুনে হেসে বলল, “নতুন আইসেন নাকি?” জয়নাল বলল, “হ ভাই । কিন্তু আপনে ক্যামনে বুঝলেন?” বাসের হেল্পার একটু থেমে বলল, “এই শহরে কিছুদিন থাকেন, আপনেও বুঝবেন ।” জয়নাল তখন বলল, “ভাই, আমরা খুব বিপদে । আমরা গেরাম ছাইড়া আইসি । কিন্তু এইহানে আমাগো থাকার যায়গা নাই । আমাগো থাকার কোন যায়গা কইরা দিবেন?” হেল্পার আরও হেসে উঠলো । বলল, “ভাই, কারে যে কি কন । তয় যারে তারে কইয়েন না । এই শহরে ভালো কারো দেখাই আপনি পাইবেন না । খারাপ মানুষের দেখাই বেশি পাইবেন ।” জয়নাল বলল, “আপনে তো ভালো মানুষ । আপনে তো সাহায্যটা করেন ।” লোকটা একটু ভেবে বলল, “একখান কাম করা যায় । কমলাপুর ইষ্টিশন আছে একখান । অইডার পাশেই একখান বস্তি আছে । সেইহানে আপনাগো মতো অনেক মানুষ আছে, যারা গেরাম ছাইড়া বস্তি বানাইয়া বাস করে । সেইহানে থাইকতে পারেন ।” জয়নাল তখন বলল, “যামু ক্যামনে সেইহানে?” লোকটা তখন বলল, “আমাগো বাস একটু পরেই ছাড়বো । সেইহানে নিয়া যামুনে । যাইবেন?” জয়নাল কি যেন ভাবল । জামেনা তখন বলল, “ভাই, ভাড়া কত নিবেন?” হেল্পার বলল, “ভাড়া নিয়া টেনশন কইরেন না । আমি আপনাগো কাছ থেইকা কম নিমুনে । আসেন । বাসে উইঠা পড়েন ।” ওরা বাসে উঠলো । বাসে আরও কিছু লোকজন ছিল । ১২টা বাজার পরপরই বাস ছেড়ে গেলো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে । এক নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে ওরা ।
এদিকে সাখুরা নিজের বাসায় পৌঁছে গাড়িটা গ্যারেজে রেখে বের হতেই ওর ৪ বছর বয়সী ছেলে লাবিব এসে হাজির । “বাবা” বলে জড়িয়ে ধরল বাবাকে । সাখুরা মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কি খবর আব্বু, কেমন আছো?” লাবিব বলল, “হ্যাঁ বাবা, ভালো । তুমি সারারাত কোথায় ছিলে?” সাখুরা আর কোন জবাব দিলো না । লাবিব আবার বলল, “আচ্ছা বাবা, জাশির আঙ্কেল আসে নি আজকে?” মাঝে মাঝেই জাশির সাখুরার সাথে সাখুরার বাসায় আসতো বেড়াতে । তাই প্রশ্নটা করলো লাবিব । সাখুরা উপরনিচ মাথা নাড়ানো ছাড়া আর কিছুই বলল না ।” লাবিব তখন বাবার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “এসো বাবা, তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো ।” সাখুরা বার বার প্রশ্ন করতে লাগলো কি দেখাবে, কিন্তু ছেলের একটাই কথা এসো আগে । সাখুরা দরজার কাছে নিজের ঘরের সামনেই আসতেই লাবিব দাঁড়িয়ে গেলো । দরজাটা বন্ধ করা । সাখুরার স্ত্রী চলে এলো সেখানে । নাম তার সেলিনা । বেশ সুন্দরী । চেহারা ফর্সা, চুলগুলো কোমর পর্যন্ত লম্বা । সে আসতেই সাখুরা বলল, “কি ব্যাপার, তোমরা মা ছেলে মিলে কি করছ?” সেলিনা হেসে হেসে বলল, কিছু না । আগে চোখটা বন্ধ করো । সাখুরা কি যেন বলতে যাচ্ছিলো, বলতে না দিয়ে সেলিনা বলল, “কোন কথা না । চোখ বন্ধ ।” বাধ্য হয়ে সাখুরা চোখটা বন্ধ করলো । তারপর সেলিনা দরজাটা খুলে দিয়ে সাখুরাকে ভেতরে নিয়ে গেলো । এবার সেলিনা চোখ খুলতে বলল । চোখ খুলতেই দুজনে চিৎকার করে “Happy Birthday” গানটা গেয়ে উঠলো । সাখুরা তাকিয়ে দেখল, সামনে কেক রাখা । আর পুরো রুমটা অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে । জীবনের এ এক অন্য রকম মজা উপভোগ করলো সাখুরা । ভেতরে যতই খারাপ হোক, অন্তত পরিবারের লোকের সাথে তো ও অনেক ভালো । তবে আজকে ওর ছেলে আর স্ত্রীর এই ভালোবাসা দেখে ওর মনে প্রশ্ন জাগছে । মানুষ খারাপ কেন হয়? সে খারাপ কেন হয়েছিল? ভালো হওয়াটাই তো খারাপ থাকার চেয়ে আনন্দের । সাখুরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো, নতুন একটা জীবন শুরুর এটাই সময় । সব ভুলে যেয়ে আজ থেকে শুধু বাইরেই না, ভেতরেও ভালো হতে হবে ওকে । এরপর কেক কেটে সে যেমন নিজের জন্মদিন পেলন করলো, তেমনি একটা নতুন জীবন শুরু করার আনন্দও উপভোগ করলো সে । ভালোবাসা সব পারে আজ তা আবার প্রমানিত হয়ে গেলো ।

আগামী পর্বেঃ
মর্গের লাশগুলোও এখানে ওখানে পড়ে আছে । এক মধ্যে একটা লাশ চিনতে অসুবিধা হল না সাখুরার । ওটা জাশিরের লাশ । সাখুরা ধীরে ধীরে সেই লাশটার দিকে এগিয়ে গেলো । কেমন যেন একটা পচা দুর্গন্ধ আসছে লাশগুলো থেকে । সাখুরা জাশিরের লাশটার কাছে আসতেই জাশির চোখ খুলে তাকালো ।