অপবাদ পর্ব-৭
অপবাদ(৭)
“আমি জানি না! আমি আমার মক্কেলের হয়ে লড়বো! আমার মক্কেলকেও বাঁচাবো! আমাকে ক্ষমা করবেন!” বিকেলে মিনহাজ আর রাইসাকে কথাটা বলে জিতু বেড়িয়ে যাবার পরই রুমে এসেছিলো জদু । রুমে ঢুকে বলেছিল, “ও, ভেতরে ভেতরে এই চলে!”
মিনহাজঃ জদু! আমি কিন্তু তোমার বড়!
জদুঃ বয়সে, ক্ষমতায় না ।
রাইসাঃ আমি কিন্ত উলটো পথে হাটবো জদু! তোমাদের কিন্তু আর আমি সাপোর্ট করবো না!
জদুঃ বুড়ির মায়া গেছে গা না? দাঁড়াও, তোমরা এহন আর কোন কাজের না । তোমাদের এখন আটকায় রাখার সময় । তারপর দুজন মাস্তান ভেতরে এসে রাইসা আর মিনহাজের হাত পা মুখ বেধে ফেলে । একটু পর হাত পা মুখ বাধা অবস্থায় ভেতরে আনা হয় মধুবালাকে । জদু বলে, “কি ভাবসো তোমরা, আমি কিচ্ছু জানি না? আরে ওই বৃদ্ধাশ্রমের দারোয়ানরে বলা আছে, জিতু কখনও সেইখানে গেলে জানাইতে । এখন, প্রমাণ লাগবো আমার । মাত্রই তো গেলোগা, এখন ডাকলে সন্দেহ করবেনে । তার চেয়ে একটু সময় যাক, তারপর ডাকমুনে । তোমাদেরই দিয়া কল দিয়া ডাকমুনে । ততোক্ষণে একটু মাল খাইয়া আসি ।” বলে রুম থেকে বেড়িয়ে যায় জদু ।
(ইন্ট্রো)
১৭ জুলাই ২০২০, শুক্রবার ।
সকালের কথা । রুমন কত করে ট্রাই করলো অথচ জিতু ভাই কিছুতেই কল ধরল না । কিছুক্ষণ পর কলই আর ঢুকল না । মনে মনে রুমন বলল, “আজব! ভাই তো এমন কখনও করে না!”
এদিকে জিতুর মোবাইল তখন ছিল জদুর হাতে ।
জদুঃ আহারে, বেচারা বার বার কল করতে ছিলো, কিন্তু আমি মোবাইলটা এয়ারপ্লেন মোডে দিয়া দিলাম । শান্তি মতো প্রমাণটাও দেখতে দেয় না পোলাডা!
সবার মুখ বাধা থাকায় সবাই চুপচাপ ।
জদুঃ তোমাদের আমি মারবো না । আগে ইশাদের শাস্তি হোক, আমার বাপ বড় বড় লোকের লগে যোগাযোগ কইরা এমন ব্যাবস্থা করতেছে, যেন জজ ইশাদের শাস্তি দেন মৃত্যুদণ্ড! জজ তো আবার ভালো, তাই আমরাই একটু মিথ্যার আশ্রয় নিতে, আমাদের কথা বিশ্বাস না করলেও বড় বড় লোকেদের কথা তো অন্তত বিশ্বাস করবে জজ, কিছু কিছু বড় বড় লোকেরা তো আছে আমাদের মতো, না?
জিতুর চেহারায় প্রচণ্ড রাগ দেখা দিলো । তা দেখে জদু বলল, “আহারে, শেষ রক্ষা হল না । বেচারা! তোর মক্কেলের দিন শেষ! ওর ফাসিটা হইয়া নিক, তারপর তোদের ছাইরা দিমু । তখন পারলে ইশাদরে বাচাইস! কবর থেইকা! হাহাহাহা!
বলে হেসে উঠলো জদু ।
জেলে বাম পাশের সবাইকে আপন করে নিয়েছে বিল্লাল আর লিমন । সবার সাথে নানা কথা বার্তা শেষ করে খাওয়া দাওয়া করতে গেলো ওরা ।
দুপুরের দিকের কথা । জুম্মার নামাজ শেষে সবাই মসজিদের পাশে রুমন সবার সাথে কথা বলবে বলে দাঁড়িয়ে ছিল । ইমন আর মাহিন এলেও পলাশ এখনও আসে নি । ইমন বলল, “পলাশের পেছনে আরেকজন নামাজ পড়তেছিল দেখে বসে আছে ।” একটু পর পলাশও এলো । জিজ্ঞেস করলো, “হ্যাঁ বল! ডেকেছিস কেন?”
রুমনঃ হ্যাঁ শোন এবার । জিতু ভাইকে কলে পাচ্ছিনা আমি ।
মাহিনঃ তো? হইতেই পারে ভাই ব্যাস্ত, বা মোবাইলে চার্জ নাই ।
রুমনঃ আরে না! ভাই প্রতিদিনই দুই তিনবার কল দেয় আমাকে, কিন্তু গতকালও দেয় নাই, আজকেও দেয় নাই ।
পলাশঃ শেষ সেই যে তোরে বলছিলো আসবে না, তারপর আর দেয় নাই কল?
রুমনঃ না রে ।
ইমনঃ আচ্ছা, প্যারা নিস না ।
পলাশঃ ভাই প্যারা তো ভাইরে নিয়া না, প্যারা জদুরে নিয়া । গতকাল রুমনরে হুমকি দিয়া গেছে না?
মাহিনঃ আরে ভাই, চিল । জদু এইটুক পিচ্চি, আর জিতু ভাই, কত বড় মানুষ ।
পলাশঃ জদুর কাছে পিস্তল আছে, আর ভাই নিরস্ত্র ।
ইমনঃ হুম, তা-ও একটা কথা । কিন্তু তাও, আজকে রাত পর্যন্ত দ্যাখ, খোঁজ না পাওয়া গেলে কাল সকালে ইনস্পেক্টর দেলোয়ারের কাছে যাওয়া যাবে না হয় ।
মাহিনঃ হ্যাঁ । চল বাসায় চল ।
ওরা বাসায় চলে গেলো । সেদিন রাতেও জিতু ভাইয়ের আসার জন্য অপেক্ষা করলো ইশাদ, কিন্তু জিতু আজও এলো না ।
১৮ জুলাই ২০২০, শনিবার । সকাল হতেই রুমন, ইমন আর মাহিন চলে গেলো ইনস্পেক্টর দেলোয়ারের কাছে । পলাশ একটু হসপিটালে গেছে ইশাদের মা ডেকেছে সে কারণে । ইনস্পেক্টর দেলোয়ারের চেম্বারের সামনে এসে ওরা তিনজন এসে দাঁড়ালে রুমন বলল, “স্যার, আসবো?”
দেলোয়ারঃ ও তোমরা! হ্যাঁ এসো এসো ।
ওরা ভেতরে ঢুকল ।
দেলোয়ারঃ বোসো বোসো ।
সামনে থাকা তিনটে চেয়ারে বসলো ওরা ।
দেলোয়ারঃ সব কিছু ঠিক আছে তো? তোমাদের চেহারা দেখে ঠিক মনে হচ্ছে না কিন্তু!
রুমনঃ স্যার, জিতু ভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না!
দেলোয়ারঃ হোয়াট! কোথায় গেছে?
ইমনঃ সেটাও জানি না স্যার! গতকাল শেষ উনি রুমনকে ফোন করে বলেছিল মুজাদপুর যাচ্ছে । তারপর আর কোন খোঁজ নাই ।
দেলোয়ারঃ মুজাদপুর! কিন্তু সেখানে কেন?
মাহিনঃ তাও আমাদের বলেন নাই ।
দেলোয়ার কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল । তারপর বলল, “আজব ব্যাপার তো! একটা মানুষ তাই বলে এভাবে হুট করে উধাও!”
রুমনঃ স্যার আরেকটা কথা! দুদিন আগে ওই জদু নামে যে ছেলেটা, ও আমাকে লিফটে হুমকি দিয়েছিলো, জিতু ভাই যেন আর কিছু প্রমাণ জোগাড়ের চেষ্টা না করে ।
মাহিনঃ স্যার আমার মনে হয় কি, ভাই মনে হয় মুজাদপুরে কোন প্রমাণ জোগাড় করতেই গেছিলো, সেখানেই ওই জদু আর খগেন সেন কিছু করছে ।
দেলোয়ারঃ অস্বাভাবিক না । আমি জিতুর কাছ থেকে এই কেসের ব্যাপারে জানার পর খোঁজ খবর নিয়েছি । যা বুঝেছি, চোখের সামনে কিছু মানুষ এক আর আড়ালে আরেক এরকমই একজন এই খগেন সেন । তার সাহায্য এমন যে তাতে মানুষের কোন উপকারই হয় না । একটা উপমা দিতে গেলে ব্যাপারটা এমন যে, তিনি অন্ধ মানুষকে নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রিপশন দান করেন । মাঝখান দিয়ে উনি কাউন্সিলর পদে টিকে থাকার প্রসংসাটুকু পেয়ে যান ।
মাহিনঃ স্যার, উনাকে দিয়ে আমাদের কাজ নেই! আমাদের ইশাদকে যে করেই হোক জেল থেকে বের করতে হবে, আর তার জন্য আমাদের জিতু ভাইকে দরকার!
দেলোয়ারঃ ঠিক আছে, আমাকে জানিয়েছো আমি এখনই খুজে দেখছি ।
ইমনঃ যদি কালকের মধ্যে খুজে না পান?
দেলোয়ারঃ তাহলে সে মুহূর্তে লয়ার পাওয়া হয়তো কষ্টকর হবে, তাই আমি-ই যদি কিছু পারি মাননীয় জজকে জানাবো ।
বিকেল পেরিয়ে রাত হয়ে গেলো সেদিন, কিন্তু জিতুর কোন খোঁজ ইনস্পেক্টর দেলোয়ার করতে পারলো না ।
রাতের বেলা বাগানে বসে ইশাদ, বিল্লাল, লিমন আর বজলু বসে গল্প করছিলো । কাল ইশাদের রায় বেরোবে । তারপর ছেলেটাকে খুব মিস করবে বাকিরা । তাই আজ ওদের একটু গল্প করার ইচ্ছে হল । রাতে সাধারন এদিকে কেউ আসে না, তাই আশেপাশে লোকজন তেমন নেই । ক্ষীয়মাণ অর্ধচন্দ্রের রাত আজ । আকাশে তাঁরার মেলা । মৃদু বাতাস বইছে । এতো সুন্দর একটা আবহাওয়া দেখে লিমন বলে উঠলো, “কি সুন্দর ওয়েদার । মনে কাল তো নিশ্চিত ভালো কিছু হবেই ইশাদের সাথে!”
বিল্লালঃ হ, তাই যেন হয় । পোলাডা ভালো মতো এই খারাপ জায়গা থেইকা চইলা যাক ।
ইশাদঃ আচ্ছা, এসব বাদ । অন্য কথা বলি আমরা ।
বিল্লালঃ কি আর কমু, যা কওয়ার সব তো এতদিন ধইরা কইছিই ।
লিমনঃ এই হইলো কষ্ট । যখন কেউ থাকে না সব আজাইরা কথা মাথায় আসে, আর আড্ডায় বসলে কিচ্ছু মাথায় আসে না ।
বজলুঃ আমি একটা ঘটনা বলবো?
ইশাদঃ অবশ্যই আঙ্কেল! বলেন!
বজলুঃ ঘটনা বলতে এইটা সত্য ঘটনা । ইতিহাসে আছে, কিন্তু এই ইতিহাস কেউ জানে না । আর সেই ইতিহাসের কারণেই আমি জেল থেকে বাহির হতে পারি ।
বিল্লালঃ কিয়ের ইতিহাস?
বজলুঃ আজ আশেপাশে কেউ নেই, এটাই বলার মোক্ষম সুযোগ । শোনো তবে ।
“আজ থেকে ২০০ বছর আগের কথা । এই এলাকায় তখন এক জমিদারের বসবাস ছিল । ইংরেজদের তাণ্ডব চলছিলো তখন এই বাংলা জুড়ে । তারই বানানো এই জেল । কিন্তু তিনি একটু বুদ্ধি খাটিয়েছিলেন । এই জেলের প্রত্যেকটা কক্ষের টয়লেটের কমডের নিচে সুড়ঙ্গের ব্যাবস্থা করেছিলেন তিনি । যদি কোন ইংরেজ তাকে বন্দি করে রাখে, তাহলে যেন তিনি পালাতে পারেন । তবে এই ব্যাবস্থা তিনি এমনভাবে করেন, যে টয়লেট থেকে কেউ বেরোতে পারবে না, আগে সুড়ঙ্গের অন্য পথ দিয়ে ঢুকে কমোডের নিচে আস্তে হবে । কমডের নিচে দুপাশে দুটো ইউ শেপের হুকের মতো আছে, আবার যে মেঝের ওপর কমড রাখা, তার সাথেও ইউ শেপের হুকের মতো আছে । এই হুকের মধ্যে রড দেয়া থাকে । যা খুললে কমোড ওপরে তুলে সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে বের হওয়া যায় । সেই জমিদার তো ঢুকলে একা বেরোনো সম্ভব ছিল না, তাই তিনি তার এক বিশ্বস্ত বন্ধুকে সব বলেছিলেন । যেন কোনদিন তিনি জেলে বন্দি হলে তার বন্ধু তাকে বের করতে আসে । কিন্তু আফসোস, বেচারা ইংরেজ মুখোমুখি যেদিন হয়, ইংরেজরা তাকে কারাগারেই বন্দি করে না, মেরেই ফেলে । কিন্তু সেই সুড়ঙ্গের খবর তো রয়ে যায় তার বন্ধুর কাছে । তার বন্ধুর বংশধর আমার সহযোগী, কাশেম, যে আমাকে কম্পিউটারের দোকানে সাহায্য করত । আমি জেলে আসার পর আমাকে দেখতে আসার সময় সে একদিন হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করে, কমডের পা রাখার স্থানে কিসের ডিজাইন গোলাকার, বৃত্তাকার, বর্গাকার, মাছ, ফুল, পাখি ইত্যাদি । আমি দেখলাম, আমার এই জেলে মাছের খোদাই করে আকা ।”
এ সময় হঠাৎ ইশাদ বলে উঠলো, “হ্যাঁ! আমি ডানপাশের জেলে যখন ছিলাম, তখন প্রজাপতির ডিজাইন দেখেছিলাম ।”
বজলু বলল, “হ্যাঁ । এগুলো ডিজাইন করা ছিল কারণ মাটির নিচে সব জেলের কমোডের নিচের সুড়ঙ্গ একসাথে মিলিত হয়ে তারপর এক রাস্তা দিয়ে সুড়ঙ্গের মুখের কাছে গেছে । এই সুড়ঙ্গের মুখও ছিল এই জেল থেকে প্রায় ৫ কিলমিটার দুরে একটা কবরস্থানের কোনায় ইট দিয়ে ঘেরাও দেয়া একটা মিথ্যে কবরের নিচে । কোন জেলের কোন রাস্তা তা বোঝার জন্য এই বৃত্তাকার, বর্গাকার, ফুল এসব ব্যাবহার করে হয়েছিলো । যাই হোক, ওকে যেদিন জানালাম, ও আমাকে বলল, আজ রাত ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত জেলের টয়েলেটে বসে থাকতে, আর কমোড যদি উঠে আসতে চায়, তবে একটু টেনে তুলতে । আমি রইলাম, এবং ও উঠে আসলো । নিচে বেজায় দুর্গন্ধ । তবু ও আমার জন্য এসেছে দেখে খুশি হলাম । শুনলাম আমার দোকান উঠে যাবার পর ও পিজ্জা ডেলিভারির কাজ নিয়েছে । সেই থেকে প্রায়ই ও আসে । আমাকে বাইরে নিয়ে যায় । আমি ঘুরে আসি । মাঝে মাঝে আমার জন্য পিজ্জা নিয়ে আসে ।”
বিল্লালঃ সেইদিন রাইতে ও জেলের ভেতর আইছিলো ক্যান?
বজলুঃ ওর খুব দেখতে ইচ্ছা হচ্ছিলো, আমি কেমন পরিবেশে কাদের সাথে থাকি সেটা ।
ইশাদঃ বাহ! কিন্তু এই জেলের কেউ কোনদিন খেয়াল করে নি এই ব্যাপার?
বজলুঃ না । জেলের কয়দিরা থাকবে, তাদের জন্য ওপর থেকে হালকা পাতলা ঘষা-মাজা ছাড়া তেমন কিছুই করা হয় নি ।
বিল্লালঃ হেহ! পালানোর রাস্তায় সব হাইগা মুইতা আসে, কিন্তু পালাইতে পারে না ।
বজলুঃ হ্যাঁ, অনেক কথাই বললাম আর কি বলবো ।
ইশাদঃ আমার একটা বন্ধু আছে জানেন, নম্বরিটেকে ৭৫ এর সাত তলার ডি নম্বর বাসায় থাকে, মাহিন নাম ওর । ও প্রতিদিন কল করে তারপর খেলতে আসে ।
লিমনঃ তো?
ইশাদঃ তো কিছু না, হাসি পাচ্ছে না?
লিমন হেসে উঠলো । তারপর বলল, “কথা শুনে হাসি পাচ্ছে না, হাসি পাচ্ছে এই শুনে তোমার কোথায় হাসিরই কিছু নাই ।”
এমন সময় এক পুলিশ এসে বলল, “এই! যাও রুমে যাও! রাইত হইছে অনেক!”
সবাই রুমে চলে গেলো ।
পরদিনের কথা । ১৯ জুলাই ২০২০ । আজই সেই মোক্ষম দিন, যেদিন রায় বেরোবে । আজ আরেকটা জিনিসও আছে । ওদের এইচ এস সি পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে । ১২টায় রেজাল্ট প্রকাশ পাবে । ১০টা থেকে আদালতের কাজ শুরু হবে ।
জেল থেকে বেরনোর আগে বিল্লাল, বজলু আর লিমনের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে বেরোল ইশাদ । সাথে এ কথাও বলল, “যদি ২টার মধ্যে ফিরে আসি, ভাববেন এই জেলই আমার পরবর্তী কয়েক বছরের বাসস্থান ।”
লিমনঃ আর যদি না আসো?
ইশাদঃ তাহলে হয় আমি ছাড়া পেয়েছি, নয়তো…………।
বিল্লালঃ নাইলে? নাইলে কি?
ইশাদঃ নয়তো আমার ফাসি হয়েছে ।
আদালতের কার্যক্রম শুরু হতে আর মাত্র ১ মিনিট বাকি আছে । পলাশ, রুমন, মাহিন ইমন ওরাও এসেছে ।
ইমনঃ কিরে? ইনস্পেক্টর মিনহাজ আর লয়ার রাইসাকে দেখছি না যে?
জদুও মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল ।
রুমনঃ ওই দ্যাখ, জদুও টেনশনে আছে ।
পলাশঃ সত্যিই টেনশনে আছে তো? নাকি এটাও ওর প্ল্যানের অংশ?
ইমনঃ হইতে পারে, ও হয়তো ইশাদকে আরও ভালোভাবে ফাসাইতে চাচ্ছে, তাই হয়তো ও এমন প্ল্যান করছে, যে সবাই ভাববে রাইসা ম্যাম আর মিনহাজ স্যারকে আমরাই গুম করে দিয়েছি ।
মাহিনঃ আচ্ছা থাম এখন, জজ এসে পড়ছে ।
জজ আসতেই সবাই সম্মান জানালো জজকে । তারপর শুরু হল বিচার কার্যক্রম ।
জজঃ একি! দুই পক্ষেরই কোন লয়ার নেই? আপনাদের লয়ার কোথায়?
দেলোয়ার কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু এমন সময় জদু দাঁড়িয়ে যেয়ে বলল, “আমিও তো তাই ভাবতেছি ইয়োর অনার! আমার লয়াররে খুইজে পাইতেছি না! একজন ইনস্পেক্টর আমারে সঙ্গ দিতেন, তারেও পাইতেছি না! আমার মনে হয় কি ইয়োর অনার, এই ইশাদই ওর বন্ধুদের দিয়া কিছু করাইছে!”
জজঃ আপনি বসুন । আপনার কথা আমি বুঝেছি, কিন্তু প্রমাণ ছাড়া একথা আপনি বলতে পারেন না ।
দেলোয়ার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার, আমি একটু কথা বলতে চাই ।”
জজঃ জি বলুন ।
দেলোয়ারঃ স্যার, দেখুন আপাতত আমার কাছে কোন প্রমাণ নেই, কিন্তু আমি এটুকু নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, এই ছেলেটা কিচ্ছু করে নি । জিতু যা প্রমাণ করেছে, তা হয়তো ও যে খুনি নয় তা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়, কিন্তু অপরপক্ষের রাইসা যা প্রমাণ করেছেন, তাও কিন্তু ও যে খুনি তা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয় । এই ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখবেন ইয়োর অনার ।
জজঃ ঠিক আছে আপনি বসুন ।
দেলোয়ার বসলো । তারপর জজ বলা শুরু করলেন, “গত ১৫ জুলাই এর পর থেকে গতকাল পর্যন্ত আমি জিতু আর রাইসা এই দুজনকে প্রমাণ দিয়েছিলাম । আজ কেন তাঁরা আসেন নি আমি জানি না, তবে একসাথে দুজনেই সাথে ইনস্পেক্টর মিনহাজও আসেন নি, ব্যাপারটা একটু বেশি অদ্ভুত । আমি পুলিশকে বলবো ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে । তবে রায় আমি এখনই ঘোষণা করবো । কারণ এ কদিনে আমি অনেকের সাথে কথা বলেছি ।”
এদিকে জেলে বাগানে বসে চিন্তা করছে বিল্লাল, লিমন আর বজলু ।
বিল্লালঃ আরে টেনশনের কি আছে? ছাড়া পাইয়াই যাইবো ইশাদ ।
লিমনঃ আমার টেনশন ওইখানে না । জদুর বাপের সাথে অনেক পাওয়ারওয়ালা লোকের খাতির আছে! যদি তাদের ধইরা অন্য কিছু করে?
বজলুঃ বড় বড় লোক মানে? কাদের সাথে?
লিমনঃ যেমন রাহিগঞ্জের কাউন্সিলর জিয়া সাদ্দাম ।
(আদালতে)
জজঃ রাহিগঞ্জের কাউন্সিলর জিয়া সাদ্দাম আমাকে বলেছে, খগেন সেন অনেক ভালো মনের মানুষ । তার ছেলেও মাটির মতো পবিত্র । উল্টে এই ইশাদই নাকি তার নাম ডোবানোর অনেক চেষ্টা করেছে ।
(জেলে)
লিমনঃ কিংবা আমাদের স্কুলের প্রিন্সিপাল, আব্বাস শেখ ।
(আদালতে)
জজঃ আমি জদু সেনের প্রিন্সিপাল আব্বাস শেখের সাথেও কথা বলেছি । তিনিও জানালেন, জদু খুব ভালো মানুষ । অথচ ইশাদ যখন ওই স্কুলে পড়তো, তখন ইশাদ ওই স্কুলের মেয়েদের টিজ করে বেড়াতো ।
সামনে বসে থাকা পলাশ মনের অজান্তে বলে উঠলো, “মিথ্যা! সব মিথ্যা!”
(জেলে)
লিমনঃ আর ইশাদ যে কলেজে এখন আছে, সেই কলেজের নামকরা প্রফেসর, অতুল চটকদার!
(আদালতে)
জজঃ আর ইশাদের কলেজের প্রফেসরের কাছ থেকে এও জেনেছি, ইশাদ ছেলেটা মোটেও সুবিধার না!
(জেলে)
লিমনঃ এই স্যার আগে আমাদের স্কুলে ছিল, আমারে ভয় পাইতো । আমার স্যাররে মারার কাহিনী উনি জানে ।
(আদালতে)
জজঃ অতুল চটকদার এও জানিয়েছেন, আগের স্কুলে ইশাদের প্রেরণায় এক ছাত্র তার স্যারকে অণ্ডকোষে আঘাত করে খুন করেছে!
সামনে বসে থাকা ইমন বলল, “ভাই! জজের মাথা ঠিক আছে!”
রুমনঃ জজ যাদের কাছ থেকে শুনছেন তাদের হয়তো জজ ভালো জানেন, কিন্তু আড়ালে তাঁরা হয়তো খগেন সেনের মতোই চতুর ।
(জেলে)
বজলুঃ আল্লাহই জানেন রায় কি হয়!
(আদালতে) তাই আমি সব দিক বিবেচনায় এটাই রায় দেবো যে, আসামী ইশাদকে মৃত্যুদন্ডের সাজা দেয়া হল ।
আদালত খানিকক্ষণ নিশ্চুপ । সবাই যেন হারিয়ে গেছে । ফাসি দেয়া হবে ইশাদের!
এদিকে জেলে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে লিমন দেখল, আকাশে মেঘ জমেছে । দূরে কোথা থেকে যেন মেঘ ডাকার আওয়াজ আসছে ।
“এবং এরই সাথে এই কেসের পরিসমাপ্তি হচ্ছে ।” বলে আদালত থেকে প্রস্থান করলেন জজ ।
ইশাদ আজ খুব ভেঙ্গে পড়েছে । তাই তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে গেলো আদালত থেকে । ইমন, মাহিন, রুমন, পলাশ ইনস্পেক্টর দেলোয়ারকে রিকুয়েস্ট করলো কিছু একটা করতে, কিন্তু ইনস্পেক্টর দেলোয়ার ওদের হতাশ করে বলল, “আমাকে ক্ষমা কোরো, প্রমাণ ছাড়া আমি কিছু করতে পারবো না ।”
দুপুর ১২টা । সব বন্ধুরা নিজেদের রেজাল্টের কথা ভুলেই গেছে । মাহিন একটু শক্ত ছিল । ওই সবার রেজাল্ট দেখছিল । সবারটা দেখা শেষে ইশাদের রেজাল্ট দেখে বলল, “ইশাদ গোল্ডের এ প্লাস পাইছে ।”
দুপুর ২টা যখন বাজে, তখন জেলে বিল্লাল বলল, “তাইলে কি ইশাদ জিতা গেছে?”
লিমনঃ যাক ভালোই হইছে । চলে গেছে । বেচারা এখনে বেশ কষ্টে ছিল ।
বিল্লালঃ কিন্তু এখনও তো জানি না কি হইছে!
বজলুঃ শান্ত হও । আর আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করো ।
আধ ঘণ্টা পরের কথা । টয়লেটে আটকে দাঁড়িয়ে ছিল বজলু । এমন সময় কমোডের নিচ থেকে হাত তালির আওয়াজ আসতেই বজলু কান পেতে দিলো কমডের ছিদ্রের কাছে । তারপর কেউ ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো, “ফাসি!”
রাত ১০টা । মাহিন ইমন পলাশ রুমন বসে আছে ইশাদদের বাসায় । ভালো লাগছে না । বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে । সাথে মেঘের গর্জন ।
ইমনঃ আমার এখনও এটা হচ্ছে!
পলাশঃ ভাই! আমারও খারাপ লাগতেছে!
রুমনঃ খারাপ সবারই লাগতেছে । ভাবতে পারিস, যাকে আমরা এতদিন ধরে দেখেছি, ছুয়েছি, কথা বলেছি, সে আর এই আমাদের মাঝে থাকবে না! চিরতরে চলে যাবে!
মাহিনঃ আমার বেশি কষ্ট লাগতেছে এটা ভেবে, ছেলেটা কিছু না করেও শাস্তি পাচ্ছে ।
ইমনঃ জিতু ভাই কোথায় গেল! ইনস্পেক্টর দেলোয়ারও এখনও কোন খোঁজ দিলেন না!
এমন সময় ইনস্পেক্টর দেলোয়ারের কল এলো ।
পলাশঃ ইমন! কলটা ধর! মনে হয় জিতু ভাইয়ের খোঁজ পাইছে!
ইমন কল ধরেই বলে উঠলো, “হ্যালো! স্যার! খোঁজ পাইছেন! জিতু ভাইয়ের?”
ফোনের ওপাশ থেকে ইনস্পেক্টর দেলোয়ার বলল, “না, খোঁজ পাইনি, কিন্তু একটা খারাপ খবর আছে ।”
ইমনঃ খারাপ খবর! কি খারাপ খবর!
দেলোয়ারঃ আজ রাত ১২টা থেকে আগামীকাল ভোরের মধ্যেই ইশাদের ফাসি কার্যকর করা হবে ।
একটু থামল ইনস্পেক্টর দেলোয়ার । তারপর বলল, “তোমরা চাইলে এখনই চলে এসো শেষ দেখা করতে । আর, ইশাদের মা-কে পারলে নিয়ে এসো ।”
রাত সাড়ে ১১টা । এবার আর মাঝে খাচা নেই । একটা রুমেই ওদের দেখা হল ইশাদের ।
ইশাদঃ ভাই, তোরা পারলে আমাদের ভুল মাফ করে দিস ।
পলাশঃ ভাই! আমরা বিশ্বাস করতে পারতেছি না!
ইমনঃ তুই-ও পারলে আমাদের ক্ষমা করে দিস দোস্ত!
ইশাদঃ আমার আম্মু আসলো না?
রুমনঃ আন্টি আসলো না । বলল, আন্টি তোকে দেখতে পারবেন না ।
মাহিনঃ মা কি কখনও ছেলে মারা যাবে এটা ভাবতে পারে?
ইশাদঃ ও আচ্ছা । সমস্যা নেই । আমার আব্বু আম্মুর খেয়াল রাখিস ।
দেলোয়ারঃ শোনো ইশাদ, তুমি একটা কাজ কোরো, ক্ষমা চাইতে বললে ক্ষমাটা চেয়ে নিয়ো ।
ইশাদঃ না আঙ্কেল, সরি । আমি এটা করতে পারবো না । যে দোষটা আমি করিই নি, তার জন্য কেন আমি ক্ষমা চাইবো? সারাজীবনে যতো ভুল আমি করেছি তার জন্য আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবো । আর আমি এটাও বিশ্বাস করি, হায়াত না থাকলে আমার সাজা মৃত্যুদণ্ড না হলেও যে কোন সময়েই মরে যেতে পারতাম । আর হায়াত থাকলেও দেখবেন, আজও আমি মরবো না । বাইরে তখন একটা বড় সড় বাজ পড়ার আওয়াজ হলো ।
রাত প্রায় ১২টা । নিজের রুমে একটা শুয়ে ছিল জদু । মোবাইল চালাচ্ছিল । এমন সময় দরজায় কলিংবেলের আওয়াজ । বাবা খগেন সেন এসেছে ভেবে দরজা খুললেও, দেখলো এক লোক । চিনতে ভুল হল না, সেদিনের সেই সাংবাদিক, যে ইমনকে অপমান করতে যেয়ে নিজেই অপমানিত হয়েছিলো, যে বিল্লালের ছোট ভাই, খলিল ।
জদুঃ একি! আপনি?
খলিলঃ আরে! চিনেছো দেখছি! আমি, সংবাদপাঠক খলিল ।
জদুঃ আপনার কি কাম?
খলিলঃ এই দ্যাখো! ভেতরে না ঢুকতে বলেই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু!
জদুঃ আরে! মানে কি?
খলিলঃ আচ্ছা, কারণ বলে ঢুকতে হবে? শোনো তাহলে, এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, বৃষ্টিতে আটকা পড়ে গেলাম । তাই ভাবলাম একটু এসে আপনার কথা রেকর্ড করি ।
জদুঃ কিসের জন্য?
খলিলঃ একটা ডকুমেন্টারি বানাবো, আপনাকে যে অপবাদ দিলো না, ওই ইশাদ না কি? এই পুরা বিষয় নিয়া । আইডিয়া কেমন ভালো না?
কিছুক্ষণ ভেবে জদু বলল, “আসুন ভেতরে ।” খলিল ভেতরে গেলো । ভেতরে ঢুকে বিছানায় বসতে বসতে বলল, “আসলে কি জানো তো? তোমার বাবা, মানে খগেন স্যার, অনেক ভালো মানুষ । মিডিয়ায় উনার কথা প্রচার করলে পুরা দেশে সুনাম হয়ে যাবে!”
জদুঃ আইচ্ছা, আমি রাজি ।
খলিলঃ আচ্ছা, এক মিনিট ।
বলে খলিল ফোনে কি যেন করে তারপর জদুকে বলল, “এই, পিজ্জা অর্ডার করে দিলাম দুটো ।”
জদুঃ সেকি, আমার বাসায় এসে আপনি আমাকেই পিজ্জা খাওয়াবেন?
খলিলঃ আরে প্যারা নাই, চিল । হ্যাঁ, এবার একটু পুরো ঘটনাটা আমাকে বলো ।
এদিকে ইশাদকে গোসল করানো হল । গায়ে পড়ানো হল আসামীর পোশাক । সাদা কালো পোশাক । ইশাদ একটু নামাজ পড়ে নিলো । নফল নামাজ । তারপর ওকে রেডি থাকতে বলা হল । কারণ যেকোনো সময় ওকে নিয়ে যাওয়া হবে ফাঁসির কক্ষে ।
এদিকে নিজের রুমের বাসান্দায় বসে ছিল পলাশ । ভালো লাগছে না ওর । অবশ্য হাটতে চলতে হাসতে কাদতে দেখা একজন মানুষ একটু পর লাশ হয় যাবে, এটা ভাবলে যে কারোরই খারাপ লাগবে । এমন সময় পলাশের মোবাইলে একটা কল এলো । ইমনের কল । ধরতেই ইমন বলল, “ভাই! যতো তাড়াতাড়ি পারিস রুমন আর মাহিনরে নিয়া হসপিটালে আয়! আঙ্কেলের অবস্থা বেশ খারাপ!” পলাশ চলে গেলো রুম থেকে ।
এদিকে প্রায় ১ঘণ্টা থাকার পর খলিলের কাছে একটা কল এলো । কল ধরে খলিল কথা বলল, “হ্যালো! হ্যাঁ!.........কি!.........আচ্ছা আমি আসতেছি!”
জদুঃ কি হইছে?
খলিলঃ আরে, নায়িকা ববিতার বাসায় বিড়াল ঢুকেছে তাই ববিতা ম্যাম চমকে উঠেছেন । এটা নিয়ে একটা খবর বানাতে হবে! আমি আসি । বলে চলে গেলো খলিল । আবার দরজ খুলে বলল, “ও হ্যাঁ! পিজ্জার বিলটা দিয়ে দিয়েছি অনলাইনেই । তুমিই দুইটা খেয়ে ফেলো ।” বলে তারপর খলিল বিদেয় হল । ঘড়িতে তাকিয়ে জদু দেখল, রাত ১টা ১৫ বাজে । ঘুমিয়ে পড়া উচিৎ । ভেবে যে-ই না লাইট অফ করলো, এমন সময় আবার কলিংবেলের আওয়াজ । দরজা খুলে জদু দেখল, পিজ্জা নিয়ে ডেলিভারি ম্যান দাঁড়িয়ে ।
হাসপাতালে পৌঁছে গেলো পলাশ, রুমন আর মাহিন । ইশাদের বাবা আইসিইউতে আছেন । বাইরে একটা কাচ থেকে কেবল দেখা যাচ্ছে তাকে ।
পলাশঃ কিরে কি হয়েছে?
ইমনঃ খুব খারাপ ।
রুমনঃ ডাক্তার কি বলেছেন?
ইমনঃ ডাক্তার বলেছেন আঙ্কেল এখন জিবনের শেষ কয়েকটা মুহূর্ত পার করছেন হয়তো ।
মাহিনঃ আল্লাহ! আজকের দিনটা এতো খারাপ কেন!
রুমনঃ আন্টি কোথায়?
ইমনঃ আন্টির প্রেশার হাই হয়েছিলো, তাই আন্টিকে এখনই কিছু বলিনি । আন্টিকে অন্য একটা ওয়েটিং রুমে রেখে এসেছি ।
ভেতরে ইশাদের বাবার শরীরের সাথে লাগাল মনিটরটি দেখা যাচ্ছে, যেখা সুক্ষ একটা “বিপ” ধরণের আওয়াজ থেমে থেমে হচ্ছে, আর আকা বাকা রেখা চলছে । ওরা এই মনিটর আগেও দেখেছে । রেখাগুলো সমান হয়ে গেলে রোগী মারা যায় ।
রাত ১টা ৫০ মিনিট । দরজায় হঠাৎ নক করবার আওয়াজ শুনে এগিয়ে উঠে এলো খগেন সেন । খালি গায়ে ভুড়িওয়ালা লুঙ্গি পড়া । ঘুমচ্ছিলো । দরজা খুলেই দেখল, এক পিজ্জা ডেলিভারি ম্যান । তারপর রাগ দেখিয়ে বলল, “কি ব্যাপার? রাইতের বেলায় তোমার মনে হয় আমগো পিজ্জা খাওয়ার শখ জাগছে?” পিজ্জা ডেলিভারি ম্যান বলল, “স্যার, আমরা কি এমনি এমনি আসি? জদু সেন নামে একজন অর্ডার দিয়েছেন মনে হয় ।”
খগেনঃ জদু! সে তো ওপরের তলায় থাকে! তুমি এইহানে কি করো মিয়া?
ডেলিভারি ম্যানঃ ও স্যার সরি । আমি যাচ্ছি ।
খগেনঃ না খাড়াও । আমিও যামু । গেঞ্জি লইয়া আসি । দেহি, এতো রাইতে ক্যান ওর পিজ্জা খাওয়ার শখ জাগলো!
রাত ১টা ৫৭ । ইনস্পেক্টর দেলোয়ার জেলেই আছেন । উনার জেলে না, কেন্দ্রীয় জেলে । যেখানে ফাঁসি দেয়া হয় । তবে উনি জানেন না, কোথায় ফাঁসি দেয়া হচ্ছে । এমন সময় উনার কাছে একটা কল এলো । কল ধরতেই কলের ওপাশ থেকে একজন বলল, “স্যার! জদু সেন সুইসাইড করেছে! আর সুইসাইড নোটে নম্বরিটেক হোটেলের মেয়েক ও খুন করেছে তা স্বীকার করেছে স্যার! আপনি তাড়াতাড়ি পারলে আসুন!” তারপর শেষটায় লোকটা ফিসফিসিয়ে বলল, “আর পারলে ইশাদের ফাঁসি ঠেকান” দেলোয়ারের হাত থেকে ফোন পড়ে গেলো । একজনকে জিজ্ঞেস করলো, “ফাঁসির রুম কোথায়!”
রাত ১টা ৫৯ মিনিট । ফাঁসির রুমে ইশাদকে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করিয়ে হাত বেধে মাথায় কালো কাপড় পড়িয়ে দেয়া হল । তারপর গলায় পড়িয়ে দেয়া হল দড়ি । ১টা ৫৯ মিনিট ৩০সেকেন্ড হতেই ম্যাজিস্ট্রেট এক হাতে রুমাল আর অন্য হাতে ঘড়ি দেখতে শুরু করলেন । আর জল্লাদ লিভারের হাতলের সামনে দাঁড়ালেন । ঠিক ২টায় ম্যাজিস্ট্রেট হাতের রুমাল ফেলে দিলে জল্লাদ লিভার ধরে টান দেবেন আর তারপর ফাঁসিতে ঝুলবে ইশাদ ।
এদিকে হঠাৎ একটা জোড়ে শাস নেবার আওয়াজ শুনে কাচের সামনে এসে দাড়াল মাহিন, ইমন, রুমন পলাশ! রেখাগুলো সমান হবার চেষ্টা করছে! আজ আওয়াজটাও ধীরে ধীরে দ্রুত থেমে থেমে বাজা শুরু করেছে । আর ইশাদের বাবা জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছেন ।
এদিকে ইনস্পেক্টর দেলোয়ার এক লোককে জিজ্ঞেস করলো, “আসামী ইশাদের ফাঁসি কোথায় হচ্ছে?” লোকটা বলল, “আপনি ভুল পথে এসেছেন স্যার! ওর ফাঁসি তো উলটো দিকে হচ্ছে! ঠিক ২টায়-ই নাকি হবে ফাঁসি ।” দেলোয়ার দৌড়োতে দৌড়তে ঘড়িতে দেখল, আর মাত্র ১০ সেকেন্ড ! দেলোয়ার প্রাণপণে দৌড়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে লাগলেন ।
৯……৮……৭……৬……৫……৪……৩……২……১……০
আঁকাবাঁকা রেখাগুলো সমান হয়ে গেলো, বিপ আওয়াজটাও না থেমে একনাগাড়ে বাজতে লাগলো । ইশাদের বাবার শেষ নিঃশ্বাসের আওয়াজটাও বাইরে থেকে শুনতে পেল মাহিন ইমন রুমন পলাশ ।
আর এদিকে ম্যাজিস্ট্রেটের হাত থেকে রুমাল ফেলে দিলেন, জল্লাদ লিভার ধরে টান দিলেন, ইশাদের পায়ের নিজের তক্তা সরে গেলো । দড়ির টান পড়লো ইশাদের গলায়! অথচ ইনস্পেক্টর মিনহাজ এখনও পৌঁছতে পারেন নি ইশাদের ফাঁসির কক্ষে!