0 %

Thanks a lot for being with us!
We are re-constructing our website!
Sorry for this temporary inconvenience
We are coming to you with a fresh look and design from 1 January 2022!
Till then! Stay connected!

অপবাদ পর্ব-৩

 অপবাদ (৩)

 

৮ জুলাই ২০২০ ।

জদুঃ চাচা!

রেজা শুনতে পেল না ।

জদুঃ ও চাচা!

রেজাঃ হ্যাঁ! কি হয়েছে, ওষুধ লাগবে?

জদুঃ হ চাচা, ওষুধ লাগবে ।

রেজাঃ কিসের ওষুধ বলো!

জদুঃ চাচা, আপনাকে অভিনয় করতে হবে ।

রেজাঃ কিসের অভিনয়?

জদুঃ আমি যা কমু, আপনেরে সেইডা কইতে হবে আর রেকর্ড করতে হবে মোবাইলে । আর জবাব দিবেন আমি য্যামনে শিখামু, ত্যামনে ।

রেজাঃ ক্যান? কইরা আমার লাভ?

জদুঃ কইরা লাভ হইবো না, তয় না করলে…………বুঝতেই পারতেছেন, আমি কাউন্সিলরের পোলা ।

রেজাঃ আচ্ছা, বলো, কি করতে হবে ।

জদু রেজাকে কিছু শেখালো । তারপর জদুকে বলল, “আপনার মোবাইলডা দেন ।” নিয়ে রেকর্ডার ওপেন করলো । তারপর, “শুরু করা যাক! ৩…২…১…” বলেই রেকর্ডিং স্টার্ট করলো । আর শুরু হল অভিনয় ।

জদুঃ চাচা, ইশাদ ভাই কেমন জানি ভয়ে ভয়ে আছে না?

রেজাঃ হ্যাঁ । কি হইছে?

জদুঃ কি জানি । উনি তো নম্বরিটেক হোটেলে রুম নিছে শুনছিলাম ।

রেজাঃ ও । এইখানে বাসা থাকতে হোটেলে রুম নিয়া করবে কি?

(ইন্ট্রো)

৯ জুলাই ২০২০

জিতুঃ আপনি মিথ্যে কথা বলছেন! আপনি তখন এক কথা বললেন আর এখন এক কথা কেন বলছেন?

রাইসা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “অব্জেকশন ইওর অনার! উনি জোড় করে সাক্ষ্য গ্রহণের চেষ্টা করছেন!”

জিতুঃ ইয়োর অনার এই লোকটা সেদিন এক কথা বলে আজ আরেক কথা বলছেন । আমি নিশ্চিত, এখন যা উনি বলবেন তার পক্ষে উনি কোন প্রমাণ দেখাতে পারবেন না ।

জজঃ আপনি যা বলছেন, তার পক্ষে কি আপনি কোন প্রমাণ দেখাতে পারবেন?

রেজাঃ পারবো ইয়োর অনার!

জিতু আরও অবাক হয়ে গেলো ।

রেজাঃ সেইদিন আমি নিজে গান রেকর্ড করতেছিলাম । তখন এই জদু আসছিলো । তখন ওর কথা আমার মোবাইলে রেকর্ড হইছিল । রেজা নিজের মোবাইলের রেকর্ডিং অন করে বিচারকের কাছে পেশ করলো । বিচারক রেকর্ডটি শুনলেন ।

জদুঃ চাচা, ইশাদ ভাই কেমন জানি ভয়ে ভয়ে আছে না?

রেজাঃ হ্যাঁ । কি হইছে?

জদুঃ কি জানি । উনি তো নম্বরিটেক হোটেলে রুম নিছে শুনছিলাম ।

রেজাঃ ও । এইখানে বাসা থাকতে হোটেলে রুম নিয়া করবে কি?

জদুঃ আল্লাহই জানেন । দেখি, আমিও ওইদিকেই যামু । জিজ্ঞেস করমুনে উনারে ।

রেজাঃ তুমি কি করতে যাইবা?

জদুঃ ওই, কিছু লোক আসবে, তাই ওদের থাকার জন্য ।

রেজাঃ ও আইচ্ছা ।

এরপর রেকর্ডটা থেমে গেলো । বিচারক মোবাইলটা রেজার হাতে দিয়ে জিতুকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি কিছু বলবেন আর?”

জিতুঃ অবশ্যই ইয়োর অনার কারণ আমি এই মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম কারণ আমি আগেই জানি এই ঘটনা ঘটেছে । আই মিন, সাজানো হয়েছে ।

তারপর জিতু রেজার দিকে ঘুরে বলল, “আপনি তো বলছিলেন মোবাইলে গান রেকর্ড করেন । তা শুনি একটু কি কি গান আছে আপনার মোবাইলে?”

রাইসাঃ অব্জেকশন ইওর অনার, আমরা এখানে গান শুনতে আসি নি ।

জিতুঃ কিন্তু ইয়োর অনার, উনি আদৌ গান রেকর্ড করেন নাকি করেন না সেটাও তো জানা দরকার, তাই না?

জজঃ অব্জেকশন ওভাররুলড ।

জিতুঃ থাঙ্ক ইউ ইয়োর অনার ।

রাইসা বসে পড়লো । জিতু রেজার সামনে গিয়ে বলল, “আপনি আপনার রেকর্ডারটা অন করুন তো ।”

রেজাঃ হ্যাঁ! কিসের রেকর্ডার! কীভাবে ওপেন করে?

জিতুঃ তাহলে আপনি রেকর্ড করলেন কি করে?

রেজাঃ কি জানি, ভুলে মনে হয় ।

জিতুঃ কিন্তু একটু আগে আপনি বলছিলেন আপনি গান রেকর্ড করছিলেন!

রেজা আর কিছু বলতে পারল না । জিতু বিচারকের কাছে এসে বলল, “ইয়োর অনার, যে লোক রেকর্ডার অন করতে পারে না সে নাকি গান রেকর্ড করছিলো । আর সেদিন যা ঘটেছিলো তার আসল রেকর্ড আমার কাছে আছে ইয়োর অনার ।” জিতু একটা পেনড্রাইভ বিচারকের কাছে পেশ করলো । বিচারক সেটা ল্যাপটপে লাগিয়ে শুনলেন ।

জদুঃ ভাই! ভাই! ম্যালা বড় ঝামেলায় পড়ছি ভাই! আমারে বাচান ভাই!

ইশাদঃ বিপদে পড়ে হঠাৎ আমার কথা মনে পড়লো না?

জদুঃ ভাই সরি! আমারে মাফ কইরা দেন ভাই! আমারে মাফ করেন, আর জীবনেও করমু না! আমারে খালি বাচান!

ইশাদঃ বল কি হয়েছে?

তারপর রেকর্ডটা শেষ হয়ে গেলো ।

জিতুঃ ইয়োর অনার এখান থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় সেদিন জদু ইশাদকে নিয়ে গিয়েছিলো ।

রাইসাঃ না ইয়োর অনার! উনি এভাবে বলতে পারেন না! আমার মক্কেল প্রাঙ্ক করছিলেন ইশাদের সাথে, কারণ দেখুন পুরো রেকর্ড কিন্তু নেই! ওরা এডিট করে কাট করেছে!

জিতুঃ ইয়োর অনার, আমি এটা বুঝতে পারছি না আমার বিপক্ষের বন্ধু কি লাশের জন্য ব্যাথিত ইন্সপেক্টর মিনহাজের লয়ার, নাকি জদুর লয়ার ।

রাইসাঃ না, আমার কাজ ইশাদ যে খুনি তা প্রমাণিত করা! এর মধ্যে জদু ছেলেটা কীভাবে আসে!

জিতুঃ আসে ইয়োর অনার । কারণ খুন তো কেউ না কেউ তো করেছে । হয়তো এই জদু ছেলেটাই । আর এই রেকর্ডটা মিথ্যে মনে হলেই আপনার কাছে পেনড্রাইভে থাকা ভিডিওটা মিথ্যে নয় ইয়োর অনার ।

বিচারক পেনড্রাইভের ভিডিওটি দেখলেন । সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, জদু আর রেজার কথোপকথন ।

জদুঃ চাচা!

জদুঃ ও চাচা!

রেজাঃ হ্যাঁ! কি হয়েছে, ওষুধ লাগবে?

জদুঃ হ চাচা, ওষুধ লাগবে ।

রেজাঃ কিসের ওষুধ বলো!

জদুঃ চাচা, আপনাকে অভিনয় করতে হবে ।

রেজাঃ কিসের…………………………।

ভিডিও শেষ হলে জিতু বলল, “ইয়োর অনার, জদু এমন কিছু একটা করতে পারে আন্দাজ করেই আমি আমার মক্কেলের বন্ধু মাহিনকে বলেছিলাম জদুর ওপর নজর রাখতে । এবং ও নজর রেখেছে সেই সাথে ভিডিও-ও করেছে । আশা করি আমার বিপক্ষের বন্ধুর কিছু বলার নেই ।”

জজঃ আপনি কি কিছু বলবেন?

রাইসাঃ নো ইয়োর অনার, আমার আর কিছু বলার নেই ।

জিতু রেজাকে বলল, “আপনি আসতে পারেন ।”

রেজার নিজের জায়গায় চলে গেলো । জিতুও বসে পড়লো নিজের জায়গায় ।

জজঃ আমি এই কেসের এই পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে খুনটা হয় ইশাদ, নয়তো জদু সেন খুনটা করেছে । কিন্তু জদু যে খুন করেছে সে ব্যাপারে খুব একটা সুস্পষ্ট প্রমাণ এখনও পাওয়া যায় নি বিধায় জদুকে বাসায় থাকারই অনুমতি দেয়া হল । তবে এই কেসের রায় ঘোষণা পর্যন্ত জদু যেন এই এলাকার বাইরে না যায় তার দায়িত্ব আমি ইন্সপেক্টর মিনহাজকে দিচ্ছি । কেসের ধর্ষণের ব্যাপারে এবং বাকি কার্যক্রম আগামী ১২ জানুয়ারি করা হবে । আপনারা এর মধ্যে আরও যা প্রমাণ জোগাড় সম্ভব হয় সেসব করুন । আজকের মতো কোর্ট এখানেই মুলতবী ।

সবাই কোর্ট থেকে বেড়িয়ে পড়লো । ইশাদকে নিয়ে যাওয়ার সময় ওর বন্ধুরা এসে ডাকলো ওকে, কিন্তু ইশাদ শুনল না । কাউকে পাত্তা না দিয়ে চলে গেলো । জিতু এলে পলাশ জিজ্ঞেস করলো, “ভাই, কি হয়েছে ওর, কথা বলছে না কেন?”

জিতুঃ রাগ করেছে, তোমরা দেখা করতে যাও নি, তাই । তবে চিন্তা কোরো না । আমি ওর সাথে তোমাদের দেখা করার ব্যাবস্থা করবো ।

জেলখানায় এসে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিলো ইশাদ । সে সময় লিমনের সাথে দেখা । লিমন বসে বসে হাতের লেখা প্র্যাকটিস করছে । ইশাদকে দেখে উঠে দাঁড়ালো । জিজ্ঞেস করলো, “আরে আরে! ইশাদ ভাই! কি অবস্থা, আজকে কি হল কোর্টে?”

ইশাদঃ হয়েছে, আসল যে অপরাধী তার খোলস কিছুটা উন্মোচন করা গেছে । কিন্তু আমার ওপর থেকে দোষ খুব একটা সরে নি ।

লিমনঃ চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে । আমরা অপরাধ করেছি । শাস্তি পাচ্ছি । কিন্তু তুমি তো অপরাধ করো নি । যতই মানুষ যা-ই বলুক, আল্লাহই তোমাকে বাচাবে ।

ইশাদঃ ইনশাআল্লাহ!

বলে ইশাদ নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিলো, সে সময় ঘেঁষা গলায় কেউ ডেকে উঠলো, “এই ছেলে!” ইশাদ দাঁড়িয়ে গেলো । তারপর পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, সেই বয়স্ক হাজতি, যিনি জানালার ধারে বসে ইশাদের দিকে তাকিয়ে থাকতো । লোকটাকে দেখে লিমন, “আরে ওস্তাদ! আসসালামু আলাইকুম!” লোকটা সালামের জবাব দিয়ে বলল, “যা তো, ভেতরে । আমি একটু ওর সাথে কথা বলতে চাই ।” লিমন ভেতরে গেলো । ইশাদের বুঝতে বাকি রইলো, ইনি এই জেলের বাম অংশের লিডার । এর কথাই বাকি সব কয়েদি আর হাজতিরা শোনে । লোকটা বলল, “আমি খন্দকার বজলু ।”

ইশাদঃ আমি ইশাদ ।

বজলুঃ জানি । আমি সেই শুরু থেকে তোমাকে দেখছি ।

ইশাদঃ জানি । কারণটা জানতে পারলে খুশি হবো ।

বজলুঃ তোমার মতো একটা ভালো ছেলে বিল্লালের আন্ডারে থাকবে, ব্যাপারটা ভালো লাগে নি ।

ইশাদঃ আপনি খুব ভালো?

বজলুঃ কয়েদি আর হাজতির পার্থক্য নিশ্চয় জানো?

ইশাদঃ হাজতি হয়েও আপনি লিডার হলেন কি করে? কয়েদিরা লিডার হয় না?

বজলুঃ গত ৪মাস ধরে নিজেকে নির্দোষ প্রমানের জন্য আদালতে লড়ছি । এরই মধ্যে মানুষ আমার আচরণে ভালোবেসে আমাকে নিজেদের লিডার বানিয়েছে ।

ইশাদঃ ও । ভালো তো । তা আমাকে কি বলবেন?

বজলুঃ তোমার মতো ছেলেদের ওপাশে মানায় না । তুমি এপাশে চলে এসো । তবে ভেবো না আমি জোড় করছি । আমি জাস্ট সাজেস্ট করছি ।

ইশাদঃ আপনাকে দেখে একজন ভদ্রলোক মনে হচ্ছে? তবে জেলে কেন আপনি?

বজলুঃ তোমাকে দেখেও একজন ভদ্রলোক মনে হচ্ছে, তবে জেলে কেন তুমি?

ইশাদ কিছু বলল না । “আমি গেলাম ।” বলে নিজের রুমে চলে গেলো । জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, লোকটা এখনও দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ।

বিকেলের দিকের কথা । মাহিন তখন নিজের রুমে ছিল । এমন সময় বাইরের দরজায় নক করবার আওয়াজ এলো । মাহিন উঠে যেয়ে দরজা খুলতেই দেখল একজন পুলিশ । তার হাতে একটা শপিং ব্যাগ । পুলিশ বলল, “এই লও, তোমার বুট!” তারপর মাহিনের হাতে শপিং ব্যাগটা দিয়ে চলে গেলো । মাহিন দরজা আটকে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো । শপিং ব্যাগ থেকে বুট জোড়া বের করে দেখলো, রক্ত জমে প্রচুর বাজে গন্ধ । নিজেই নিজেকে বলে উঠলো, “হায়রে! কি গন্ধ! ধুইতে হবে এটা ।” তারপর বুটজোড়া নিয়ে বাথরুমে গেলো । পানি দিয়ে ধোয়ার জন্য যে-ই না পানি ছেড়ে ট্যাপের নিচে দিতে যাবে, এমন সময় চোখে পড়লো একটা চুল । পুলিশ বোধহয় বুটজোড়া সেভাবে খেয়ালই করে নি, তা না হলে তো এই চুলটা পাওয়ার কথা । ইশাদ চুলটা টান দিতেই চুলটা ইশাদের হাতে এলো । বুটের ভেতর যতোটা ছোট দেখাচ্ছিলো, আসলে কিন্তু চুল সে পরিমাণেও ছোট নয় । বেশ বড় । মাহিন নিজেই নিজেকে বলল, “এতো বড় চুল তো ইশাদের নেই, যাকে খুন করা হয়েছে সে-ও তো মেয়ে, তার চুল আরও বড় হতে পারতো, যদিও এরকম চুল থাকাটাও অস্বাভাবিক না, তবে তার চেয়ে বেশি স্বাভাবিক হবে যদি এটা…………।” থেমে গেলো মাহিন । তারপর বলল, “তবে কি এটা জদুর চুল?” মাহিন তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো । কল করলো জিতুকে । বলল, “ভাই, বিকেলের দিকে একটু আমার সাথে দেখা করতে পারবেন ইশাদদের বাসায়?”

জিতুঃ তুমি বলছো তুমি এটা বুটের ভেতর পেয়েছো?

মাহিনঃ হ্যাঁ ভাই! আমি সত্যি…………।

জিতুঃ প্রমাণ?

মাহিনঃ ভাই আমার কথা বিশ্বাস করছেন না?

জিতুঃ আমি বিশ্বাস করে কি লাভ? প্রমাণ তো করাতে হবে আদালতের বিচারকের কাছে ।

মাহিন কিছু বলল না ।

জিতুঃ প্রথমত, এটা আদৌ কার চুল সেটাই শিওর না, তার ওপর এই চুলটা যে তুমি কোন এক ফাকে জদুর চুল থেকে ছিঁড়ে নাও নি তারই প্রমাণ কি? এক কথায় এই চুলটা আমাদের কিছুই করতে পারবে না ।

মাহিনঃ আচ্ছা ভাই, এমন কিছু কি নাই? যা আমাদের সাহায্য করবে?

জিতুঃ সেটাই তো আমরা খুজে চলেছি ।

মাহিনঃ আল্লাহই জানেন! এই বাজে দিনগুলোর শেষ কবে হবে!

জিতুঃ আচ্ছা, পরদিন তো ইশাদ যে ধর্ষণ করে নি, সেটার প্রমাণ করতে হবে ।

মাহিনঃ জি ভাই! আমি পাক্কা শিওর হইয়া বলতে পারি, জদু এখানেও কোন চক্রান্ত করতেছে!

জিতুঃ স্বাভাবিক । না হলে ইশাদকে ভালো করে ফাসাবে পারবে না যে । খুনে সাথে ধর্ষণের অপবাদ প্রায় জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালার মতো ।

মাহিনঃ জি ভাই । দেশে তো আন্দোলন চলতেছে । গতকাল বাসায় মিডিয়ার লোকজন আসছিলো । আমি দরজা খুলি নাই ।

জিতুঃ ভালো করেছো ।

রাতের দিকের কথা । প্রায় ৩টা বাজে তখন । ইশাদ ঘুমিয়ে পড়েছে প্রায় । এমন সময় হুট করে কে জানি ওর মুখ চেপে ধরল । ইশাদ চিৎকার করলো, কিন্তু লোকটা শশশ… ধরণের আওয়াজ করে ইশাদকে থামতে বলল । তারপর ইশাদকে নিয়ে টয়লেটের দিকে গেলো । ইশাদ দেখল, এটা বিল্লাল । বিরক্ত হয়ে ইশাদ বলল, “কি সমস্যা আপনার! আমাকে কেন বিরক্ত করছেন!”

বিল্লালঃ শশশ……! আস্তে কথা ক! তোর লগে কথা আছে ।

ইশাদঃ কথা! এতো রাতে কিসের কথা! আগের বলা যায় নি?

বিল্লালঃ আরে **! আমি পারি নাই বইলা তো এখন ডাকছি নাকি?

ইশাদঃ কি বলেন ।

বিল্লালঃ হুন, জানালা দিয়া সামনের দিকে তাকাবি । সাবধানে! কেউ জানি টের না পায়!

তারপর টয়লেট থেকে বের হয়ে ইশাদ আর বিল্লাল জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল । সামনের রুমটায় কে যেন পায়চারী করছে না? হ্যাঁ, তাই তো! না, এতো রাতে জেগে থাকাটা অস্বাভাবিক না । একটু পর লোকটা সামনের টয়েলেটে ঢুকে গেলো । কিন্তু আর বেরোল না । অনেকক্ষণ কেটে গেলো, তবু এলো না । ইশাদ ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি আমাকে কি দেখাচ্ছেন বলুন তো?”

বিল্লালঃ চুপ কইরা দেখতে থাক! পড়ে কইতাছি!” ইশাদ অপেক্ষা করতে লাগলো । অন্ধকারে চেহারা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না । বেশ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে লাগলো ওরা । ইশাদের চোখে তন্দ্রা চলে এসেছিলো প্রায় । এমন সময় ঘটলো অদ্ভুত এক ঘটনা । ২ জন লোক বের হল টয়লেট থেকে । ইশাদ তো অবাক! কি ব্যাপার! ২ জন লোক এলো কি করে! গিয়েছিলোই তো একজন! নতুন যে এসেছে সে একটু চিকন । তাই দুজনের মধ্যে পার্থক্য করা যাচ্ছে । একটু পর যে চিকন অর্থাৎ যে পড়ে এসেছে সে চলে গেলো । হাতে কিছু একটা নিয়ে । বেশ ভারি সে জিনিস । তারপর আবার অনেকক্ষণ টয়লেটের দরজা বন্ধ । তারপর যে লোকটা একটু আগে পায়চারী করছিলো, সে শুয়ে পড়লো ঘুমানোর উদ্দেশ্যে । ইশাদকে নিয়ে বিল্লাল ঘরের এক কোনায় গেলো ।

ইশাদঃ কি হল ওই রুমে!

বিল্লালঃ আমিও বুঝলাম না । তাই তো তোরে কইলাম । আমি এইরকম আগেও দেখছি! কিন্তু কি হয় আসলে আমি নিজেও বুঝি না!

ইশাদঃ তো এটা আগে জানিয়ে রাখলেই হতো! আমি জেগে থাকতাম ।

বিল্লালঃ আরে! পুলিশ এই গলি পায়চারী কইরা আড়াইটার দিকে চইলা যায়গা । দেইখা যায় সবাই ঘুমাইছে কি না । তাই আমি দেরি কইরা আসলাম তোর কাছে । আর দেখলিই তো, ওরাও এই সময় কামডা সারে ।

ইশাদঃ তো এই ব্যাপারে আমি কি সাহায্য করতে পারি?

বিল্লালঃ সকালে তোরে দেখলাম ওই পাশের সর্দার তোরে ওই পাশে যাইতে কইছিলো । তুই যা! যাইয়া এই রহস্য বাইর কর!

ইশাদঃ যাবো না!

বিল্লাল ছুরি হাতে নিয়ে ইশাদের দিকে ধরে বলল, “দশ খুন করছি কিন্তু! তোরে *** খুন করমু! রাগাইস না আমারে **!” ইশাদ হেসে বলল, “তাই নাকি? মারুন! তারপর দেখি কে কাজ করে দেয় আপনার?” বিল্লাল সুর পাল্টে অনুরোধের সাথে বলল, “এ, ভাই! পিলিজ! একটু যাইয়া দ্যাখ না! তোর দুইডা পায়ে পড়ি!”

ইশাদঃ তাতে আপনার লাভ?

বিল্লালঃ বহুত লাভ হইতে পারে!

ইশাদঃ যেমন?

বিল্লালঃ হইতে পারে ওইডা জেল থেইকা পলানোর রাস্তা!

১০ জুলাই ২০২০, শুক্রবার

সকালে ঘুম থেকে উঠে খাবার আনতে যাচ্ছিলো ইশাদ । ঘুম একটু দেরিতেই ভেঙ্গেছে আজ গতকাল রাতে বিল্লালের কারণে । প্রতিদিনের মতো লিমনের সাথে দেখা । হঠাৎ খেয়াল হল, লিমন তো এই রুমেই থাকে । লিমনকে জিজ্ঞেস করলে কি বলবে? “আরে ইশাদ! কেমন আছো!” বলে উঠলো লিমন ।

ইশাদঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো । তুমি?

লিমনঃ আছি, খারাপ ক্যামনে থাকি ।

ইশাদঃ ও । আচ্ছা একটা কথা বলবো?

লিমনঃ বলো, শুনি ।

ইশাদঃ গতকাল রাতে………।

বলতে গিয়ে হঠাৎ ইশাদের নজর চলে গেলো জেলের দরজার দিকে দিকে । দাঁড়িয়ে আছে বজলু । লোকটার চেহারা দেখে ভালো লাগলো না ইশাদের । কথাটা না বাড়িয়ে চলে গেলো খাবার নিতে । লিমন নিজেই নিজেকে বলে উঠলো, “আজিব! কি বলতে গিয়া থাইমা গেলো?”

জেলখানায় দায়িত্বরত ইনস্পেক্টর দেলোয়ারের কাছে এলো জিতু । দেলোয়ার বলল, “আরে বন্ধু, কি খবর? কেমন আছিস?”

জিতুঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তুই কেমন আছিস?

দেলোয়ারঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো । যা দেখা করতে যা!

জিতুঃ না, আজ ওর সাথে না, তোর সাথে একটু কথা বলতে এসেছি ।

দেলোয়ারঃ আমার সাথে?

দুজনের টেবিলের দুপাশে মুখোমুখি বসলো । জিতুর প্রশ্নটা ছিলো ইনস্পেক্টর মিনহাজ কেমন মানুষ ।

দেলোয়ারঃ উনার সাথে আমি তো সেভাবে কাজ করিই নি । তাই সেভাবে বলতে পারবো না । তবে ভালো মানুষই শুনেছি ।

জিতুঃ উনার কোন ভালো কাজ দেখেছিস?

দেলোয়ারঃ না, তবে রাগ করিস না, এই কেসে মেয়েটার হয়ে উনি যেভাবে লড়ছেন, তোর চেয়ে আমি উনাকে বেশি সাপোর্ট করবো । কারণ প্রমাণ থাকার পরও তুই হুদাই লড়ে যাচ্ছিস ।

জিতুঃ ভাই, তুই জানিস আমি এতো সহজে কেস নেই না ।

দেলোয়ারঃ হ্যাঁ, সেজন্যই তো আমি তোকে কিছু বলছি না । আমি আগেই বুঝেছি, তুই যখন কেসটা হাতে নিয়েছিস, তখন কোন কারণেই নিয়েছিস ।

জিতুঃ আচ্ছা, পোস্টমর্টেম এর ব্যাপারে তো কিছু জানিস?

দেলোয়ারঃ না । তবে………

জিতুঃ তবে কি?

দেলোয়ারঃ কোথায় পোস্টমর্টেম হয়েছে সেটা আমি বলতে পারি । লাশটা হয়তো ওখানেই আছে ।

জিতুঃ কোথায়?

দেলোয়ারঃ এখান থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে, রাহিগঞ্জ থানার একটা বস্তির পাশে পুরনো মর্গে পোস্টমর্টেম করা হয়েছে ।

জিতুঃ রাহিগঞ্জ! সেতো বহুত দূর! এতো দূরে কেন নিয়ে যাওয়া হয়েছে?

দেলোয়ারঃ সে তো ইনস্পেক্টর মিনহাজ-এ বলতে পারেন ।

দুপুরের দিকের কথা । জুম্মার দিন সেদিন । অন্যান্য এলাকার মতো নম্বরিটেক এলাকায়ও যে আন্দোলন হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । এর ইন্ধনটাও জুগিয়েছে খগেন সেন । জুম্মার দিন সেদিন । নামাজের দিকে যাচ্ছিলো, আন্দোলনের ভিডিও কভার করে মসজিদের দিকে আসছিলো এক সাংবাদিক । একই সময় মসজিদে ঢুকছিলো ইমন । ঠিক যখন মসজিদে ঢুকতে যাবে, এমন সময় সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পাগড়ী পরিহিত এক লোক এসে রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো, “এই শয়তান! তুই মসজিদে ঢুকবি না!” ইমন অবাক হয়ে গেলো । জানতে চাইলো, “বেয়াদবি মাফ করবেন, কিন্তু আপনি বলার কে আমি মসজিদে ঢুকবো না?”এই ঘটনা দেখেই সাংবাদিক ক্যামেরা বের করে ভিডিও করা শুরু করলো । লোকটা বলল, “তোর মতো বদমাইশের সাথে নামাজ পড়লে আমাদের নামাজ কবুল হবে না ।” ইমন ভ্রু কুঁচকে বলল, “আঙ্কেল, আল্লাহ তা’আলাই ভালো জানেন কার নামাজ কবুল হবে কার নামাজ কবুল হবে না, এটা আপনি বলার কেউ নন!” লোকটা আরও ভাব দেখিয়ে বলে উঠলো, “অবশ্যই বলতে পাবি! তুই ধর্ষকের বন্ধু! তোরও নিশ্চয় চরিত্র খারাপ! তোর মসজিদে ঢোকা উচিত না!” ইমন বলল, “আঙ্কেল, নামাজতো বোধ হয় পাচ ওয়াক্তই পড়েন, পারলে একটু হাদিসও পড়বেন, কাজে দেবে ।” লোকটা ক্ষেপে গিয়ে বলল, “আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস! তোর এতো বড় সাহস!” ইমন বলল, “জ্ঞান না আঙ্কেল, ভদ্রভাবে শুদ্ধ ইসলাম জানতে বলছি ।” এরই মধ্যে সেখানে একটা ছোটোখাটো ভিড় জমে গেলো । এদিকে বেচারা সাংবাদিকের ব্যাটারি গেলো শেষ হয়ে আর সেই মুহূর্তেই মসজিদের একজন হুজুর এলেন । তিনি এসে বললেন, “কি হয়েছে?” লোকটা বলল, “দেখেন না হুজুর! এই ছেলেটার বন্ধু একজন ধর্ষক! এ নামাজ পড়লে আমাদের নামাজ কি কবুল হবে!” হুজুর জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কোন হাদিসে এরকম কিছু শুনেছেন একটু বলবেন?” লোকটা বলল, “আরে! এতে হাদিস জানার কি আছে! এগুলো তো লোকমুখেই প্রচলিত ।” হুজুর বললেন, “লোকমুখে প্রচলিত সব কথা সত্য নয় । সত্য একমাত্র কুরআন ও হাদিস । তাই কিছু বলার আগে ভেবে বলবেন । আর ওর বন্ধু ইশাদকে আমরা সবাই চিনি । ভালো একটা ছেলে । তবুও যদি ধরি ও এমন কোন পাপ করেছে, তা কিন্তু এখনও প্রমাণিত হয় নি । আর তবুও যদি ধরি এটা প্রমাণ হয়ে গেছে, তাতে ওর বন্ধু কেন দ্বায়ি হতে যাবে? আর ইমন যদি পাপীও হয়, ওর পাপ ওর পাল্লায়, সেটা আপনার পাল্লায় কেন আসতে যাবে?” লোকটা চুপ হয়ে গেলো । হুজুর আরও কিছুক্ষণ লোকটাকে বোঝালেন । লোকটা বুঝল কি বুঝল না আল্লাহই ভালো জানেন । যাই হোক, ইশাদ নামাজে গেলো ।

বিকেলের দিকে ইশাদ একা একা বসে ছিল দরজার পাশে । এমন সময় লিমন এসে পাশে বসলো ।

লিমনঃ কি খবর? কেমন আছো?

ইশাদঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো । তুমি?

লিমনঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো । মন খারাপ নাকি?

ইশাদঃ যদি বলি হ্যাঁ?

লিমনঃ তাইলে আমি ভালো কইরা দিতে পারবো 

ইশাদঃ কীভাবে?

লিমনঃ দরজার কাছের যাইয়া দরজার চিপায় হাত রাইখা ধাম কইরা দরজা আটকায় দিবা, যে ব্যাথা লাগবে, তা মন খারাপকে প্রশমিত কইরা মন ভালো কইরা দেবে ।

ইশাদ হেসে উঠলো । বলল, “তোমার কথা শুনেই তো মন ভালো হয়ে গেলো, হাতে আর ব্যাথা দেবো কি ।”

লিমনঃ যাক তাও ভালো । হুদাই কইলাম, ট্রাই কইরো না আবার ।

ইশাদঃ সেটা আমিও বুঝেছি ।

লিমনঃ সকালে কি যেন বলতে চাচ্ছিলে?

ইশাদ চুপ হয়ে গেলো । লিমন জিজ্ঞেস করলো, “কি হইলো?”

ইশাদ লিমনের কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার এই রুমটায় গতকাল রাতে জানালা দিয়ে আমি দেখেছি একজন লোক টয়লেটে গেলো, দুইজন নিয়ে বেড়িয়ে এলো, পড়ে আবার দুইজনে টয়লেটে গিয়ে একজন ফিরে এলো । এর রহস্য কি?” ইশাদের কথা শুনে লিমন চুপ হয়ে গেলো । ইশাদ জানতে চাইলো, “কি হয়েছে?” লিমন শুধু একটা কথাই বলল, “সাবধান, এই কথা কেউ যেন না জানে! তোমারও জানার দরকার নাই! চুপ থাকাটাই বেশিদিন বাঁচার পক্ষে ভালো হবে ।” বলে লিমন চলে গেলো । ইশাদ ঠিক বুঝতে পারল না কেন লিমন এমনটা করলো ।

সন্ধ্যার আগ দিয়ে মোবাইল চালাচ্ছিল ইমন । এমন সময় ফেসবুকের একটা পোষ্টে চোখ আটকে গেলো ওর । ছবিতে ইমন আর সকালের সেই লোকটা । সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার, সাংবাদিক হেডলাইন লিখেছে, “বন্ধু ধর্ষক বলে মসজিদে ঢুকতে দিলো না হুজুর ।” লাইক কমেন্ট আর শেয়ারের সংখ্যা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, পোস্টটা ভাইরাল ।

পরদিন সকালের কথা । ১১ জুলাই ২০২০, শনিবার । হাসপাতালে ইশাদের বাবাকে দেখে ফিরছিলো মাহিন আর রুমন ।

মাহিনঃ ভাই সিরিয়াসলি! আমি বুঝি না! সাংবাদিকরা এক ঘটনা অন্যরকম ভাবে কেন ঘুরায় প্যাঁচায় লেখে!

রুমনঃ আরে! ওইটা হুজুরই ছিল না! ওইটা একটা সাধারণ লোক ছিল । পায়জামা পাঞ্জাবি পাগড়ী পড়লেই তো আর কেউ হুজুর হয়ে যায় না!

মাহিনঃ জানি রে ভাই, আমি গতকাল ইমনরে ফোন দিছিলাম । ও আমারে বলল, এই ঘটনা পুরা মিথ্যা । পড়ে ওই লোকটারে হুজুরই বুঝাইয়া বলছে, সেইটা আর সাংবাদিক লেখে নাই ।

সে সময়ের পলাশের কল এলো মাহিনের কাছে । কল ধরতেই পলাশ বলল, “কিরে কোথায় তোরা?”

মাহিনঃ এইতো, ইশাদের আব্বুরে দেখতে গেছিলাম । কিছু হইছে?

পলাশঃ না তেমন কিছু না । আগে বল আঙ্কেল কেমন আছে?

মাহিনঃ ভালো না রে ডাক্তার বলছে শরীরের অবনতিই হইতেছে ।

পলাশঃ আল্লাহ! কি একটা অবস্থা! আর এইদিকে কি হইছে শোন । ইমনের কাছে ওই যে চ্যানেলে ওর খবরটা প্রচার করেছে সেখান থেকে কল করছে, খবরের মাঝে আমাদের সাক্ষাৎকার নেবে । সেখানে আমাদের সবাইকে থাকতে বলছে, আর সাথে গতকালকের লোকটাকেও ।

মাহিনঃ বাহ! আসুক একবার সাংবাদিক! দেখায় দিমু সংবাদ ক্যামনে করতে হয়!

পলাশঃ আচ্ছা, বিকার ৪টায় রেডি থাকিস । ইশাদদের বাসায় ।

সকালের নাস্তা সেরে নিজের রুমে দিকে যাচ্ছিলো ইশাদ । এমন সময় বাম পাশের লিডার হাজতি বজলু ইশাদকে ডাকলো । ইশাদ কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিছু বলবেন?”

বজলুঃ কথা বলতাম একটু । সময় হবে?

ইশাদঃ জেলে সময় অভাব আর কোথায় । বলেন ।

বজলুঃ আচ্ছা তুমি জেলে কেন এসেছো?

ইশাদঃ আপনি কি এটা জানার জন্যই ডেকেছেন?

বজলুঃ না, তবে আমাদের দুজনেরই তো মিথ্যা মার্ডারের অপবাদে এখানে আসতে হয়েছে তো, তাই ভাবলাম, দুজন দুজনের গল্প শুনে দেখি, মিলে যায় যদি ।

ইশাদ কিছুক্ষণ চুপ করে লোকটার দিকে চেয়ে রইলো । বোঝা বড় কষ্টকর, লোকটা কি আসলেই ভালো, না খারাপ । ইশাদ সমস্তটা খুলে বলল লোকটাকে । লোকটা সব শুনে বলল, “না । তাহলে তোমার সাথে আমার মিল নেই ।”

ইশাদঃ কেন? মিথ্যে অপবাদের তো মিল আছে?

লোকটা একটু হেসে বলল, “সত্যি কথা বলতে কি, তাও নেই ।”

ইশাদঃ কেন?

লোকটা আশেপাশে একটু তাকিয়ে ইশাদের কাছে একটু এগিয়ে এসে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, “আমি আসলেই খুনটা করেছি! কিন্তু আমি এখন নিজের দোষ ঢাকায় ব্যাস্ত!” ইশাদের পুরো শরীরে একটা ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে গেলো । লোকটা তারপর বলল, “তবে তুমি হয়তো আমার ঘটনা শুরু থেকে শুনলে আমার খুন করাটা মাফ না করলেও কিছুটা হলেও তোমার আমার প্রতি মায়া হবে ।” ইশাদ জিজ্ঞেস করলো, “কি ঘটনা?” বজলু বলতে লাগলো ।

“আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগের ঘটনা । বুয়েটে দশম স্থান অধিকার করে পড়ার সুযোগ পাওয়া ছাত্র ছিলাম আমি । আমার বাবা ছিলেন বিরাট ব্যাবসায়ী । কোটি টাকার মালিক ছিলেন তিনি । আম আর আমার এক ছোট ভাই তার সন্তান ছিলাম । আমাদের মা মারা গেছে আরও বহু আগে । বাবার কাছেই মানুষ হওয়া আমাদের । কিন্তু একদিন বাবার ব্যাবসায় লাভের জন্য বাবার শত্রু হয়ে যায় অন্য এক ব্যাবসায়ি তুফান খন্দকার । তুফান লোকটা ভয়ঙ্কর চালাক ছিলেন । তিনি আমাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে এমনভাবে, লোকে ধরে নিয়েছে শর্টসার্কিটের জন্য আগুন লেগেছে । যাই হোক, সেই আগুনে আমাদের ব্যাপক ক্ষতি হয় । বাস্তুহারা হতে হয় আমাকে আর আমার ছোট ভাই ফজলুকে । আমার বাবা কিন্তু আগুনে পুরে মারা গিয়েছিলেন । টাকার রোজগারের জন্য ব্যাবসার হাল ধরার চেষ্টা করি, কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র দাড়া কি আর ব্যাবসা সম্ভব? ব্যাপক লস হল, সাথে পড়াশুনাও আর এগোলো না । কিন্তু এদিকে আমার ছোট ভাইটা পড়াশুনা করবে কীভাবে? তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, নিজের কথা না ভেবে ছোট ভাইয়ের কথা ভাববো । ট্রাকে মাল তুলে, অন্যের গাড়ি পরিষ্কার করে, মাঝে মাঝে চিঠিও বিলি করেছি । আরও কত কিছু যে করে টাকা আয় করেছি, তার হিসেব নেই । ভাইকে মানুষ করতে হবে । শেষে ভাইটাকে মানুষ করতে পারলাম । সে ইকোনমিক্স এর ওপর পড়াশুনা করে বাবার ব্যাবসা আবার চালু করলো । আমার বিয়ে সাধি তো করা হল না, ভাইটার বিয়ে হল । তবে কি জানো তো, ভাইটা এখন এতোই বড়লোক হয়েছে যে, আমাকে ভাই বলে পরিচয় দিতে তার বেশ লজ্জা লাগে । ওর বিয়েতেও পর্যন্ত গিয়েছিলাম ঝাড়ুদার সেজে, গোপনে । তবে আমার ভাই আমাকে যে কিছু দেয় নি, তাও না । আমাকে একটা কম্পিউটারের দোকান খুলে দিয়েছিলো । সেখানে প্রিন্ট করা, টাইপ করা, ইত্যাদি কাজ করে টাকা আয়ের জন্য । একদিন আমার কাছে এক লোক আসে তার মেইল আইডি থেকে কি একটা প্রিন্ট করাবে বলে । আমি তাকে বলেছিলাম আমার মেইলে পাঠাতে, কিন্তু সে বলেছিল গোপন মেইল, তাই দেয়া যাবে না । সে ভেতরে ঢুকে তার জিমেইলে লগইন করে প্রিন্ট করলো ঠিকই, কিন্তু যতক্ষণে সে কাজ করলো, ততোক্ষণে আমার নজর তার আরেকটা মেইলে চলে গেলো । সেখান দুটো নাম নজরে এলো আমার । মেইল অ্যাড্রেসে তুফান শব্দটা রয়েছে, আর সাবজেক্ট ফিল্ডে লেখা কিল ফজলু এজ সুন এজ পসিবল! আমি অবাক হয়ে গেলাম । বলে রাখি, আমি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার । ছোটবেলা থেকে শখের বসে হ্যাকিং এর কাজ শিখেছি আমি । তাই লোকটা চলে যাওয়া পর লগ আউট করলেও আমি হ্যাক করে ঢুকে দেখি, তুফান লোকটা আমার ভাই ফজলুকে খুন করতে এই লোকটাকে মেইল করেছে । কারণটা এক, মানুষ ভিন্ন । আমার ভাইয়ের জন্য তার ছেলের ব্যাবসায় লস হচ্ছে । তখন আমার রাগ উঠলো । দেখার ইচ্ছে হল লোকটা কি প্রিন্ট করতে এসেছিলো । দেখি, সেখানে আমার ভাইয়ের ব্যাবসার সমস্ত গোপন ইনফরমেশন! আমি সিদ্ধান্ত নেই, এই তুফান লোকটাকেই শেষ করতে হবে । মনে মনে খুশি হই এই ভেবে, ভাগ্যিস ফজলু আমাকে নিজের ভাই বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পেত, তা না হলে সবাই জানলে এ লোক আমার দোকানে আসতোও না, প্রিন্ট করার সময় আমার চোখে এসব পড়তও না । আমি সেদিনই প্ল্যান করে তুফান লোকটাকে ঠিক সেভাবেই মারি, যেভাবে আমার বাবাকে সে মেরেছিল । বাড়িতে আগুন লাগিয়ে । এতে তুফান লোকটা মরলেও তার ছেলে আর বউ মরে নি । দুর্ভাগ্যবশত তার স্ত্রী আমাকে দেখে ফেলে । তাই আমাকে আদালতে হাজির করে । এইতো, ৪-৫ মাস আগেকারই ঘটনা এটা । আমি জানি আমি ঠিক করিনি । তবু আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা চালাচ্ছি । গোপনে আমার ভাই-ই লয়ার জোগাড় করে দিয়েছে আমার ।” এতো কথা বলার পর লোকটা একটু থামল । ইশাদ সত্যি দোটানায় পড়ে গেলো । লোকটা কি আসলেই দোষী? নাকি দোষী না? নাকি দুটোই? এমন কি আদৌ হতে পারে? ভাবনার মাঝেই হঠাৎ বজলু বলে উঠলো, “সকালে নাকি লিমনকে কি জিজ্ঞেস করেছো?” ইশাদ আবার চমকে উঠলো । মনে মনে বলে উঠলো, “উনি জানল কি করে?” লোকটা ইশাদের মনের কথা আন্দাজ করেই বলল, “লিমনই আমাকে বলেছে । এই রুমে অনেক গোপন কিছু আছে, যা কেবল এই রুমের লোকেরাই জানে । তোমায় আমার বিশ্বস্ত মনে হয়, তাই তোমায় বলছি, আশা করি আমার বিশ্বাসের মান রাখবে ।” ইশাদ জিজ্ঞেস করলো, “কি বলবেন আপনি?” লোকটা ইশাদের দিকে আবার এগিয়ে এসে বলল, “যেটুকু বলছি, সেটুকু শুনে রাখো, এক বেশি শুনতে চেয়ো না । সময়মতো তুমি জানার যোগ্য হলে আমি বলবো । এই রুমে একটা গোপন জায়গা আছে, যেটার রাস্তা কেবল আমি জানি । এখান দিয়ে জেলের বাইরে যাওয়া যায়!”