অপবাদ পর্ব-২
অপবাদ(২)
কারাগারে ঢোকার সমস্ত নিয়ম কানুন মেনে ভেতরে ঢুকল ইশাদ আরও কিছু আসামীর সাথে । যাদের সাথে এসে তারা সবাই সাধারণ পোশাক পরিহিত । জেলের ভেতরে ইশাদ দু ধরণের আসামী দেখতে পেল । কেউ জেলখানার সাদা কালো পোশাক, আর কেউ সাধারণ পোশাক । জেলখানার সাদাকালো পোশাক যারা পড়ে আছে, তারা আসামী বলে আদালতে প্রমাণিত হয়ে গেছে । তারা কয়েদি । আর সাধারণ পোশাক পরিহিতরা এখনও নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে আদালতে লড়ছে ইশাদের মতো । তারা হাজতি । যদিও তারা সবাই যে দোষী না তা বলা মুশকিল । একটা ছাদ বিহীন একটা রাস্তার দুধারে লোহার দরজার ভেতর বন্দি লোকজন । একটা দুটো দরজা না । শেষ মাথা পর্যন্ত দু ধার মিলিয়ে দশ মতো হবে । একেকটা লোহার দরজা একেকটা রুমের । অর্থাৎ সব মিলিয়ে এখানে দশটা কক্ষে আসামিরা বন্দি । এরই কোনটায় রাখা হবে ইশাদকে, ভাবতেই খারাপ লাগছে ইশাদের । একটু পর ও যে সারি ধরে আসছিলো, সেই সারি ঢুকে গেলো ডানপাশের রুমগুলির একটা রুমের ভেতর । সেখানে সবাই নানা কুকথা বলে বলে এদের স্বাগতম জানাচ্ছে । ইশাদকে দেখতেই তারা ইশাদের ব্যাগ কেড়ে নিলো । তারপর সবাই ইশাদের সব কেড়ে নিতে নিতে বলতে লাগলো “টুথপেস্ট আমার!” “আরিব্বাস! এই ব্রাশ আমার!” “আরে! জোস প্যান্ট তো!” “ওই জাইঙ্গা নাই!” আরও কত কিছু । ইশাদ ইতস্তত বোধ করছিলো । না করতে মন চাইছে, কিন্তু কীভাবে করবে তা বুঝতে পারছিলো না । এমন সময় সাদাকালো পোশাক পরিহিত এক লোক এসে বলল, “আরে ভাই, কান্দোস ক্যান? আগে কখনও জেইলে আহোস নাই?” ইশাদ ডানে বামে মাথা নাড়লো । লোকটা বলল, “ও । হুন, এইহানে সবারে দিয়া থাকতে হয় । আরে তোর যা তাও আমার আমার যা তাও আমার । বুঝছোস!” ইশাদ কিছু বলল না । লোকটা আবার বলল, “হুন, জেইলের এই অংশের সর্দার আমি । তাই আমার কথা মাইন্না চলবি! নাইলে কইলাম তরে আমি………!” লোকটা থেমে গেলো । ইশাদ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো, “না…না হলে কি?” লোকটা একটু হেসে বলল, “এক পরিবারের ১০ জনরে মাইরা জেলে আইছি । আর কিছু কইবি?” ইশাদ ডানে বামে মাথা নাড়লো । রুমগুলোয় জানালা আছে । সেদিক দিয়ে ওপাশের জেলের দিকে তাকিয়ে ইশাদ দেখল, এক বয়স্ক হাজতি ইশাদের দিকে তাকিয়ে আছে ।
(ইন্ট্রো)
“আচ্ছা, এই জদু ছেলেটা বলল আর ও হুট করে চলে গেলো, এটা কোন কথা?” পলাশ, ইমন, রুমন আর মাহিনকে বলছিল জিতু । ওরা সবাই ইশাদদের বাসায় বসে কীভাবে কি করা যায় তা ডিসকাস করছে । রুমন বলল, “ভাই, তুমি আর যাই বলো, ইশাদ কিন্তু এটা করতে পারে না ।”
জিতুঃ আমি বলছি না ও কাজটা করেছে । আমি শুধু বলছি ওর ভেতরে যাওয়াটা উচিত হয় নি ।
ইমনঃ কিন্তু স্যার এভিডেন্স কীভাবে কালেক্ট করবো এখন আমরা?
জিতুঃ আদালতে স্যার বলো আলাদা কথা, এখানে ভাই ডেকো তোমরা আমাকে ।
পলাশঃ ভাই, আমি বলিকি, ওই ছেলেটাকে আদালতে হাজির করে আনি?
মাহিনঃ কীভাবে আনবি তুই, তুই বললেই কি ও চলে আসবে?
ইমনঃ কিন্তু কি করলে আসবে তাইলে?
জিতুঃ আচ্ছা ওর কথা পড়ে, আগে বলো সেদিন ইশাদের সাথে শেষ কার দেখা হইছিলো?
রুমনঃ আমার । ও আঙ্কেলের ওষুধ আনতে গেছিল ।
জিতুঃ ওষুধ! কোন দোকানে?
রুমনঃ রেজা ফার্মেসী ।
মাহিনঃ স্যার!............মানে ভাই, আমি ওইদিন ওর সাথে কথা বলছিলাম!
জিতুঃ কখন?
মাহিনঃ জানি না, তবে সেই সময় ওই জদু ওকে ডেকে নিয়ে যায়, আমি স্পষ্ট জদুর গলা শুনতে পাইছি ফোনে ।
ইমনঃ তোর না ফোনে কল রেকর্ড হইয়া থাকে! শুনা তাইলে!
মাহিনঃ হায়রে আল্লাহ! আমার যদি একটুও খেয়াল থাকে!
বলে মাহিন পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সবাইকে শোনালো রেকর্ডটা ।
রুমন বলল, “তুই তখন কল কাটছিলি ক্যান?”
মাহিনঃ কাটি নাই, টাকা ছিল না ।
পলাশঃ তোর মোবাইলে কোনদিন টাকা থাকে?
ইমনঃ ভাই, ইশাদ আমাকে বলছে ও যখন ওই দোকানের সামনে ছিল তখন ওকে ওই জদু ডেকে নিয়ে গেছে । তার মানে ওই রেজা আঙ্কেল স্বচক্ষে জদুকে ইশাদের কাছে অনুরোধ করতে দেখেছে ।
জিতুঃ হুমম । একটা সাক্ষী পাওয়া গেলো তাহলে ।
পলাশঃ ভাই, একটা কথা বলবো?
জিতুঃ বলে দিবা । জিজ্ঞেস করার কিছু নাই ।
পলাশঃ ভাই, আমরা তো শুধু ইশাদকে নিয়েই কথা বলতেছি । ওই মেয়েটার সাথে যা হইছে তাও কিন্তু খারাপ হইছে । কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, মেয়েটার হয় লড়তেছে শুধু ইন্সপেক্টর মিনহাজ । মেয়েটা কি তবে পরিচয়হীন?
রুমনঃ এই হ্যাঁ! আমিও তাই ভাবতেছিলাম । মেয়েটার বাপ মা কাউরেই তো দেখলাম না ।
জিতু জবাব দিলো না । কিছুক্ষণ পরিবেশ চুপচাপ । একটু পর ঘড়িতে জিতু দেখল, দুপুর ২টা বাজে । তারপর জিতু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আচ্ছা, তোমরা যাও, লাঞ্চ করে এসো । বিকেলে আবার দেখা হবে । আমি ।”
রুমনঃ বিকেলে ইশাদকে দেখতে যাবা না?
জিতুঃ না । রাতে যাবো ।
রুমনঃ কিন্তু ভিজিটিং টাইম তো বিকাল ৩টা থেইকা সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত!
জিতুঃ তোরা আজকে যাইস, তারপর বুঝতে পারবি, কেন আমি বিকেলে যাবো না ।
বলে জিতু চলে গেলো ।
এদিকে খাবার সময় হয়ে গেছে । জেলখানার সবাই খাবার খেতে যাবে । প্লেট নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলো ইশাদ । খিদে পেয়েছে বেশ । সকালে খাওয়া হয় নি । লম্বা একটা লাইন শেষে ইশাদের পালা এলো । মোটা চালের ভাত, আর পানির মতো ডাল । সাথে মাছ । তাও খেতে কেমন আল্লাহই জানেন । যাক, কপালে খাবার তো জুটছে । কিন্তু এতক্ষণ কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নেওয়ার পর কোত্থেকে সেই লোকটা এলো যে ডানপাশের জেলের সর্দার । সে এসে বলল, “হুন, তোরে এইডা আমারে দে ।” বলে ইশাদের হাত থেকে খাবার নিয়ে নিলো লোকটা । তারপর তার হাতের খালি প্লেট দিয়ে বলল, “তুই আবার লাইনে দাড়া যা!” ইশাদ কিছু বলল না । লাইনে দাঁড়িয়ে গেলো । আবারও ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে খাবার নিয়ে যখনই সে খাবার খেতে যাবে, তখন আবার ডানপাশের জেলের সর্দার এসে ইশাদের হাতের খাবার নিয়ে বলল, “তোরে কইসি না, যা তোর তা আমার, আর যা আমার তা আমারই!” ইশাদের রাগ উঠলো প্রচুর, কিন্তু কিছু করতে পারল না । মনে পড়লো লোকটার কথাটা, “এক পরিবারের ১০ জনরে মাইরা জেলে আইছি ।” ইশাদ নিজের জেলে চলে গেলো । ভেতরে ঢুকে জানালা দিয়ে তাকাতেই আবার সেই বয়স্ক লোকটাকে দেখতে পেলো । এখানে আসার পর যাকে দেখেছিল ।
বিকেলে রুমন, পলাশ, ইমন আর মাহিন দেখতে এলো ইশাদকে । একটা খাচা । তার এপাশে ভিজিটরস, ওপাশে কয়েদি আর হাজতি । এতো ভিড় যে ভিড় থেলে ওরা ইশাদের দেখা প্রায় পায় নি বললেই চলে । ওরা ৩টা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত সেখানে ছিল । অথচ তবু দেখা পায় নি । একজন পুলিশের কাছে ওরা জানতে চাইলেন কখন এইরকম ভিড় কমে আসে, পুলিশ জানালেন এই ভিড় খুব ভালো ভাগ্য থাকলে সাড়ে ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে কোন কোনদিন ফাকা পেলেও পাওয়া যায় তবু এটা একটা রেয়ার ঘটনা । মাহিন বলল, “এজন্যই জিতু ভাই এ সময় আসতে চান নি ।”
মাগরিবের পর যখন সন্ধ্যার আলো প্রায় নিভু নিভু, তখন ইশাদ বা পাশের জেলখানার দিকে সেই বয়স্ক লোকটাকে ভালো করে দেখার জন্য সাহস করে এগিয়ে গেলো । যদিও বয়স্ক লোকটা তখন জানালার সামনে ছিল না । এমন সময় ইশাদ দেখল, একটা ছেলে মাটিতে বসে কি সব করছে । ইশাদ ভালো করে দেখল, সে হাতের লেখা প্র্যাক্টিস করছে । ছেলেটা ইশাদকে দেখে বলল, “হাই! আমি লিমন!” ইশাদ দেখল, ছেলেটা ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে । ইশাদ হাতে হাত মিলিয়ে বলল, “আমি ইশাদ ।” লিমন বলল, “হাতের লেখা প্র্যাক্টিস করতেছি । খারাপ হাতের লেখার জন্য ফেল করছিলাম বইলা রাগের মাথার স্যারের দিকে ডাস্টার ছুঁইরা মারছিলাম । কে জানতো, সেই আঘাত স্যার এর বিচিতে লাইগা স্যার মইরাই যাইবো?” ইশাদ হাসবে না কাদবে, বুঝতে পারল না, শুধু জিজ্ঞেস করলো, “তারপর?”
লিমনঃ তারপর আর কি, আমি আসলাম জেলে, স্যার গেলোগা কবরে । আমি সিদ্ধান্ত নিলাম জেইল থেইকা বাইর হওয়ার আগে হাতের লেখা ভালো কইরাই ছারমু ।” ইশাদ কিছু বলল না । লিমন বলল, “তয় চিন্তা কইর না । আমি মানুষ খুব ভালো । মাঝে মাঝে রাগ কন্ট্রোল করতে পারি না ।” ইশাদ বলল, “তোমাকে দেখে তো মনে হয় না তুমি এতো রাগি ।” লিমন বলল, “ওইতো, ওইরকমই । তয় আমার রাগ বিল্লাল ভাইয়ের মতো না ।” ইশাদ জিজ্ঞেস করলো, “বিল্লাল ভাই কে?” লিমন কিছু বলার আগের হঠাৎ একটা চিতকারে কথোপকথন থেমে গেলো ইশাদ আর লিমনের । ডানপাশের জেল গুলোর শেষ রুমটা থেকে আওয়াজটা এসেছে । ভয়ঙ্কর এই আওয়াজ শুনে সবাই সেদিকে ছুটে যাচ্ছে । লিমন বলল, “ওই, বিল্লাল ভাইয়ের কাম ।” ইশাদ উঠে আর সব লোকের মতো ছুটে গেলো সেখানে যেখান থেকে আওয়াজটা এসেছে । ইশাদ ভীরের মধ্যে কিছু দেখতে পারছিলো না । একজনকে জিজ্ঞেস করলো, “ভাই কি হয়েছে?”
জবাবে সে বলল, বিল্লাল ভাই নাকি কোন লোকের হাত শরীর থেকে আলাদা করে দিয়েছে । ইশাদের দেখতে ইচ্ছা করছিলো এই বিল্লাল ভাইটা কে । কিন্তু ভীরের ভেতর কিছুই দেখতে পেল না সে । একটু পর পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করলো । ইশাদ নিজের রুমে চলে এলো ততক্ষণে । খানিক পর ওর রুমের আরও অন্যান্য কয়েদি এবং হাজতিরাও ঢুকল । ইশাদ তখন এক লোককে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা ভাই, এই বিল্লাল ভাই কে?” লোকটা তখন দরজার দিকে আঙ্গুল তুলে ইশারা করলো । ইশাদ দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল, এ এই ডান পাশের সর্দার! যে সকালে ইশাদের খাবার কেড়ে নিয়েছে । যে ১০ খুনের দ্বায়ে জেলখানায় এসেছে ।
“ভাই, একটা টুথব্রাশ ব্রাশ দেন তো ।” দোকানে এসে বলল রুমন । তারপর ব্রাশ নিয়ে টাকা দিয়ে বাসার পথে ফিরছিলো । সে সময় রুমন দেখতে পেল জদু হেটে এদিকেই আসছে । রুমন জদুর সামনে যেয়ে বলল, “তুই কি করেছিস! সত্যি করে বল!” জদু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “বিশ্বাস করেন রুমন ভাই! ক্যামনে কি যে হইলো! ছিহ! আমাগো ইশাদ ভাই শেষ মেশ! হায় আল্লাহ! ভাবতেও অবাক লাগে রে ভাই ।”
রুমনঃ নাটক করিস না! আমরা তো শিওর এই খুন তুই করেছিস । খুব শীঘ্রই আদালতের কাঠগড়ায় এবং তারপর জেলখানায় তোর সাথে দেখা হবে ।
জদুঃ জেলখানায় কি না তা বলতে পারবো না, তবে কাল আদালতে নিশ্চয় দেখা হবে ভাই!
রুমন অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “মানে?”
জদুঃ এমা সে কি, জানেন না? আরে আমিই যে সে রুমে লাশটা প্রথম দেখেছি ।
রুমনঃ হোয়াট!
জদুঃ হ্যাঁ, তবে ভাববেন না আমিই করেছি এটা । আমার সাথে ওয়েটারও ছিল ।
রুমনঃ তোকে তো ছাড়বো না, আমার বন্ধুকে ফাঁসানোর জন্য তো মোটেই না! আরও ই বেচারি মেয়েটাকে মারার জন্যও না ।
জদু হালকা হেসে জবাব দিলো, “ছাড়া তো পড়ের কথা ধরুন তো আগে!” রুমন কিছু বলতে পারল না ।
রাত ৯টার দিকের কথা । লয়ার জিতু এসেছে জেলখানায় ইশাদের সাথে কথা বলতে । একজন কনস্টেবল তার পথ আটকে বলল, “দাড়ান! কোথায় যাচ্ছেন!”
জিতুঃ ভেতরে আমার এক মক্কেল আছেন তার সাথে দেখে করতে ।
কনস্টেবলঃ এখন কি আপনার ভিজিটিং আওয়ার? আপনি জানেন না দুপুর তিনটা থেকে ৬টা পর্যন্তই দেখা করা যায়?
জিতুঃ আপনার এখানে দায়িত্বে থাকা ইন্সপেক্টর দেলোয়ার আছেন না?
কনস্টেবলঃ ও স্যার! হ্যাঁ আছেন তো!
জিতুঃ উনি আমার বন্ধু । আমাকে বলেছিল যখন খুশি আসতে । কেউ পথ আটকালে উনাকে জানাতে ।
কনস্টেবলঃ আরে স্যার! কি যে বলেন! আসুন না ভেতরে! ছি ছি কত বড়ো ভুলটা করলাম আপনার পথটা আটকে ।
জিতুঃ এই আপনি দায়িত্বে নিয়োজিত, কেবল এ কথা বলতেই আপনি বিশ্বাস করে নিলেন, আমার জায়গায় যদি কোন প্রতারক থাকতো, আপনি কি তাকেও এভাবে বিশ্বাস করতেন?
কনস্টেবল মাথা নিচু করলো । তারপর আবার জিজ্ঞেস করলো, “তাহলে কি করবো স্যার?”
জিতু হালকা বিরক্ত হয়ে বলল, “কি করবে মানে? আপনার তো ইন্সপেক্টর দেলোয়ারকে ডেকে ভেরিফাই করা উচিত তিনি আসলেই আমাকে চেনেন কি না । তাই নয় কি?” জিতু কথা শুনে দেলোয়ার ভেতরে চলে গেলো । একটু পর ইন্সপেক্টর দেলোয়ার এসে হাজির হল । দূর থেকেই জিতুকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে বলল, “আরে বন্ধু! কি খবর তোর?”
জিতুঃ এইতো স্যার, আপনি তো ব্যাস্ত মানুষ খোঁজই পাওয়া যায় না ।
দেলোয়ারঃ আহ কি যে বলিস না । অন ডিউটি আছি তো, তাই এই আপনি ডাকাটা সহ্য করে নিলাম । হ্যাঁ বল কি করতে এসেছিস?
জিতুঃ আমার এক মক্কেল ভেতরে আছে । ভিজিটিং আওয়ারে কি ভিড় হয় তা তো জানিসই । তাই ভাবলাম এ সময় এসে তোকে বলে যদি ওর সাথে দেখা করা যায় ।
দেলোয়ারঃ আরে বন্ধু অবশ্যই পারবি । তবে আগে বল, কার কেস লড়ছিস?
জিতুঃ এইযে, নম্বরিটেক হোটেলে একটা মেয়ের খুনের মামলায় ইশাদ নামের যে ছেলেটা এসেছে ।
জিতুর কথা শুনে দেলোয়ার খানিকটা অবাক হল বলে মনে হল । বলল, “একি, তুই এই কেস লড়ছিস! আমি অবাক হচ্ছি, এই কেসে ছেলেটা দায়ী তা তো প্রায় প্রমাণিত । তুই একটা আসামীর পক্ষ নিচ্ছিস?”
জিতুঃ না রে, ওর বন্ধু আমার কাজিন হয় । রুমন । রুমন যেভাবে বলল, আমার মনে হয় না এই ছেলে কিছু করেছে ।
দেলোয়ারঃ ও আচ্ছা। যা তাহলে ভেতরে । আর তুই যেহেতু কেসটা হাতে নিয়েছিস, ইনশাআল্লাহ তুই পারবি প্রমাণ করতে ।
জিতুঃ দোয়া করিস বন্ধু ।
দেলোয়ার হেসে দিলো, “যাক, আপনি থেকে তুই হয়েই গেলো তাহলে!”
রুমের পেছনে টয়লেট । তার অবস্থা পাবলিক টয়লেটের চেয়েও খারাপ অবস্থা । ভেতরে মল পড়ে আছে, বিশ্রী দুর্গন্ধ । কমোডেই মল ত্যাগ করে নাকি কমোডের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মল ত্যাগ করে বোঝা যায় না । ইশাদ কোনোরকমে নাক বন্ধ করে টয়লেট সেড়ে বেড়িয়ে আসতেই সেই কনস্টেবল এলো ওর কাছে । সে ইশাদকে বলল, “তোমাকে একজন দেখতে এসেছে ।” ইশাদ গেলো কনস্টেবলের সাথে । সেই খাচা । এপাশে ইশাদ, ওপাশে জিতু ।
জিতুঃ কেমন আছো তুমি?
ইশাদঃ আমার ভালো খারাপ আমি নিজেও বুঝতে পারি না এখন ।
জিতুঃ হুম । তোমার বন্ধুদের কাছে সবটা শুনেছি । তবুও তোমার মুখ থেকে সবটা আমি শুনতে চাই ।
ইশাদ সবটা খুলে বলল । জিতু বলল, “ভয় লাগছে?”
ইশাদঃ ভয়, কিসের? অপবাদে মৃত্যুর?
জিতুঃ না, যদি বের হতে না পারো সেটার । এর জন্য মৃত্যু হবে কি না জানি না ।
ইশাদঃ আচ্ছা, আমাকে কি আপনি বের করতে পারবেন এখান থেকে?
জিতুঃ জানি না । হয়তো পারবো ।
ইশাদঃ পারবেন না ।
জিতুঃ কি করে বলছো?
ইশাদঃ আমার ওই ঘটনার সময় কি আপনি ছিলেন? নাকি আপনি আমাকে আগে থেকে চেনেন যে প্রমাণ সংগ্রহ সহজেই করতে পারবেন?
জিতুঃ ইশাদ, তুমিও কিন্তু ভুলে যাচ্ছো, সে সময় তুমি একা ছিলে, সেন্সলেস, এবং জদু তোমার মুখে স্প্রে করার পর কি হয়েছে তার কিছুও তুমি জানো না ।
ইশাদ কিছু বলল না ।
পরদিন সকালের কথা । ৬ জুলাই ২০২০ । হাসপাতাল থেকে ফিরছিল পলাশ আর ইমন ।
ইমনঃ আচ্ছা দোস্ত, আমরা কি পারবো ইশাদকে নির্দোষ প্রমাণিত করতে ।
পলাশঃ কে আপন কে পরের জবাকে নিয়ে আয় । ও ঠিকই পারবে ।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ ।
ইমনঃ এক সময় এগুলো জোকস ছিল, আর এখন হাসিও পাচ্ছে না ।
পলাশঃ ভাই, কিছু একটা করতে হবে যেন ওই ছেলেটা মানে জদুকে দোষী প্রমাণিত করা যায় ।
ইমনঃ কি ভাবে করবি ।
পলাশঃ এমন যদি হতো, কোনোভাবে যদি ওই জদুর সব কথা জানতে পারতাম!
ইমনঃ কীভাবে করবি?
পলাশঃ জানি না । কিন্তু খুব ইচ্ছে করছে কিছু একটা করতে!
সকালের খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ইশাদ । জুটবে রুটি গুড় । রাতের খাবারটা ওই বিল্লাল আর কেড়ে নিতে পারে নি । ফলে খিদে যে তেমন আছে তাও নয় । রুটি গুড় খেয়ে ইশাদ বাইরে এলো । গতকালকের লিমনের সাথে দেখা । এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “হাই, কেমন আছো?” লিমন গতদিনের মতই হাতের লেখা প্র্যাকটিস করছিলো ।
লিমনঃ এইতো, ভালোই । তোমার কি খবর?
ইশাদঃ ভালো । হাতের লেখার কি অবস্থা?
লিমনঃ আরে বইলো না ভাই । আমার এক বন্ধু ছিলো । খুব ভালো হাতের লেখা । ছেলের ওপর মাইয়ারা ক্রাশ খায় হাতের লেখা দেইখাই । ওরই হাতের লেখা প্র্যাকটিস করতেছিলাম । তা সকালে উইঠা দেখি কোন হারামজাদা টয়লেটে টিস্যু না পাইয়া ওই কাগজ দিয়ে হাগছে, কেমনডা লাগে!
ইশাদ হেসে উঠলো ।
লিমনঃ এহন কেমনডা লাগে কও তো!
ইশাদঃ আচ্ছা, এতদিন প্র্যাকটিস করেছো না, সেগুলো দেখে লেখো, তাহলেই তো হয় ।
লিমনঃ ধুরু! মাথায় সেই আকারে রাগ । কিন্তু রাগ প্রকাশের মানুষ পাইতাছি না ।
ইশাদঃ ওয়াও । আমার ওপর রাগ ঝাড়ার ইচ্ছে হচ্ছে নাকি?
লিমনঃ আরে না! তুমি খুব ভালো মানুষ । আইসা থেকে দেখতেছি । ওইযে, হারামজাদা বিল্লালডা তোমার খাওয়া কাইড়া নিলো তুমি কিছু কইলা না, ওই দেইখাই বুঝসি, তোমার ধৈর্য আসে বহুত ।
ইশাদ নিশ্চুপ ।
লিমনঃ আচ্ছা, তুমি সত্যি ওই মাইয়ারে মারছো?
ইশাদঃ না ।
লিমনঃ তাইলে কি হইছিলো?
ইশাদ সবটা খুলে বলল লিমনকে ।
লিমনঃ ও! জদু! আরে ওরে তো আমি চিনি । ক্লাসের মধ্যে বিড়ি খাইতো, আর টিচার বিড়ির গন্ধ পাইয়া সন্দেহ করলে অন্য পোলাপাইনের ব্যাগে প্যাকেট ঢুকাইয়া দিত । কিন্তু পোলাপাইন কিছুই করতে পারতো না । কারণ ওরা জানে এর বাপ কাউন্সিলর ।
ইশাদঃ তোমার কি মনে হয়, জদু আমাকে ফাঁসিয়েছে?
লিমনঃ সেইডা আমি এক্কেরে শিওর । তয়…………।
হঠাৎ থেমে গেলো লিমন ।
ইশাদঃ তবে? তবে কি?
লিমনঃ তুমি ছাড়া পাবা কি না, জানি না ।
ইশাদের বুকটা আবারও ছ্যাঁত করে উঠলো ।
দুপুরের কথা । পলাশ নিজের রুমে টেবিল গোছাচ্ছিলো । এমন সময় ওর মা এসে বলল, “দেখসিস! বুয়া আজকেও আসে নাই! নাহ! এরে আর কামে রাখমু না ।”
পলাশঃ মা! আমাকে কেন তুমি বুয়ার কথা বলো বলতো!
মাঃ তোর বাপ গেছে বিদেশ, তো তোর সাথে কথা শেয়ার করবো না তো কি ওই সামনের দোকানদারের সাথে শেয়ার করবো?
পলাশঃ কিছু বলার নাই! আব্বুকে কল করে বলোগা যাও ।
মাঃ হায়রে! বিয়ার আগেই এইসব বলতেছোস, বিয়ার পর যে কি হবে, আল্লাহই জানেন!
পলাশ আর কিছু বলতে পারল না । এমন সময় ওর কাছে রুমনের কল এলো । কল ধরতেই রুমন বলল, “দোস্ত! তাড়াতাড়ি টিভিটা একটু খোল!” পলাশ টিভির রুমে যেয়ে টিভি ওপেন করলো । একজন সাংবাদিক খবর পড়ছে, “সারাদেশে অজ্ঞাত নারীকে ধর্ষণের পর খুনের ঘটনায় আসামী ইশাদের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে জনগন ।” পলাশ অবাক হয়ে গেলো । নিজের অজান্তেই বলে উঠলো, “ধর্ষণ কোত্থেকে এলো!” আন্দোলনে নামা জনগণের এক ছাত্র প্রতিবাদের স্মরে সাংবাদিককে বলছিল, “আমরা এই ধর্ষকের ফাসি চাই! ফাসি চাই! কোনরকম ছাড় দেয়া হবে না! যতক্ষণ না ফাঁসির রায় বেরোবে! আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো!”
পলাশ হতবাক হয়ে গেলো ।
সকাল থেকেই জেলখানার কয়েদিরা কাজ করছে । কেউ ঝাড়ু দিচ্ছে, কেউ বাগানে কাজ করছে । সশ্রম কারাদণ্ড । ইশাদ দেখল, বিল্লাল বাগানে কাজ করছে । জেলখানাটা এইটুকুই ভেবেছিল ইশাদ কিন্তু এর আরও বিস্তৃত সীমানা রয়েছে । শেষ মাথায় একটা ছোট দরজা আছে । সেই দরজা দিয়ে একটা মাঠের মতো জায়গায় যাওয়া যায় । সেখানে কেউ খেলছে, কেউ কাজ করছে । বাগানটার দিকে গেলো ইশাদ । টমেটোর গাছই বেশি দেখা যাচ্ছে । কিছু বেগুন আর ঢেঁড়সের গাছও আছে যদিও । ক্ষেতের ভেতরে বসে কে যেন পরিচর্যা করছে ক্ষেতের । কাছে যেয়ে ইশাদ দেখল, বিল্লাল । কাছে আর গেলো না ।
বিকেলের দিকে আবারও ইশাদদের বাসায় সবাই একসাথে জড়ো হয়েছে । লয়ার জিতুও এসেছে । সে আজ খুব রেগে আছে । বলল, “আমি বুঝতে পারছি না! ডাক্তার বলছেন, পোস্ট মরটেম করে নাকি দেখা গেছে মেয়েটাকে ধর্ষণ করা হয়েছে! আর সেটা নাকি ইশাদ করেছে ডিএনএ টেস্ট করে প্রমাণিত হয়েছে ।”
মাহিনঃ কি! এটা কীভাবে সম্ভব! ইশাদের ডিএনএ কীভাবে পাবে ওরা?
জিতুঃ আমি বিশ্বাস করি এটা পুরো মিথ্যে । কিন্তু ওরা বলবে ইশাদের জামাকাপড় থেকে ডিএনএ নিয়েছে ওরা ।
রুমনঃ ইশাদের জামাকাপড় পাবে কোত্থেকে?
ইমনঃ গতকাল পুলিশ বাসায় এসেছিলো ওদের ।
রুমনঃ কখন?
ইমনঃ আমরা যে ইশাদকে দেখতে গিয়েছিলাম, এসে দেখি ঘরে সব এলোমেলো, তালা ভেঙ্গে পুলিশ ভেতরে ঢুকেছে তল্লাশি করতে । তখন কিছু জিনিস উনারা নিয়ে গেছেন ।
জিতুঃ আদৌ পুলিশ ছিল তো? নাকি ওই খগেনের কেনা পুলিশ নামক কিছু লোক ছিল?
ইমনঃ জানি না । হতে পারে ।
মাহিনঃ আমার বুটটাও আর পাইলাম না ।
রুমনঃ বাহ! আমরা আছি ইশাদের চিন্তায় আর তুই বুটের চিন্তা করতেছিস!
জিতুঃ পলাশ, তুমি আজ চুপচাপ?
পলাশঃ জানি না । খারাপ খারাপ চিন্তা মাথায় আসছে । ইচ্ছা করছে ওই খগেনের পুরো পরিবারটাকেই ধংস করে দিতে । এতো খারাপ হয় মানুষ!
রুমনঃ ভাই, গতকাল জদুর সাথে আমার দেখা হয়েছিলো । ও নাকি ৭ তারিখ আদালতে আসবে ।
জিতুঃ ভালো তো । বাঘ নিজেই খাচায় বন্দি হবে । তা কি করতে আসবে শুনি?
রুমনঃ ও নাকি প্রথম ওই রুমে দেখেছে লাশটা!
জিতুঃ এবার তো আরও পরিষ্কার হওয়া গেলো জদুই আসলে কিছু করেছে!
রাতের কথা । ইশাদের সাথে দেখা করতে এসেছে জিতু ।
জিতুঃ ইশাদ, শুনেছো কি হয়েছে?
ইশাদঃ আজকাল ডান কান দিয়ে কথা ঢুকে কেন যেন বাম কান দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে বুঝলেন ।
জিতুঃ ইশাদ, কি হয়েছে, তুমি কেন এতোটা ভেঙ্গে পরছো!
ইশাদঃ আমি কি কাচ যে ভাংবো?
জিতুঃ মানুষ কাচের হয় না । ভেতরের মনটা একটা অদ্ভুত পদার্থ জানোতো, কখনও কাচের মতো ভেঙ্গে যায়, কখনও পানির মতো গলে যায়, কখনও বরফের মতো শক্ত থাকতে হয় ।
ইশাদ নিশ্চুপ । বোধ হয় কথাগুলো একটু ভাবল ।
জিতুঃ এখন তোমার মনটা শক্ত করতে হবে ।
ইশাদঃ আপনি আর কিছু বলবেন?
জিতুঃ তোমার কিছু বলার আছে?
ইশাদঃ আমার মা বাবা কেমন আছেন?
জিতুঃ তোমার বাবার শরীরের কোন উন্নতি হচ্ছে না । আর তোমার মা তো বেজায় ভেঙ্গে পড়েছে জানোই ।
ইশাদঃ আর আমার বন্ধুরা?
জিতুঃ তোমাকে ছাড়া ওদের মন একটু বিষণ্ণ আছে । তাছাড়া শরীর ভালো আছে সবার ।
ইশাদঃ একজনও যে দেখতে আসে না আমাকে?
জিতুঃ ওই যে, ভীরের জন্য । আজও এসেছিলো । আসো নি দেখতে?
ইশাদ ডানে বামে মাথা নাড়ল ।
জিতুঃ আচ্ছা, আমি একদিন আমার সাথে ওদের আনার চেষ্টা করবো ।
৭ জুলাই ২০২০
সকালে জিতু গেলো রেজা ফার্মেসীতে । বয়স্ক লোকটা দোকানে বসে আছে ।
জিতুঃ আপনার নাম কি রেজা?
রেজা লোকটা একটু চমকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ! কিছু বললেন?”
জিতুঃ আপনার নাম কি রেজা!
রেজাঃ হ্যাঁ কেন?
জিতুঃ আপনি কি সেদিন দোকানে ছিলেন যেদিন ইশাদ এই দোকানে ওর বাবার ওষুধ আনতে এসেছিলো?
রেজাঃ কে ইশাদ? কে কার বাবার ওষুধ?
ইমনঃ আরে আজব! আপনি এমন করছেন কেন! আপনি তো ছিলেন সেদিন! ইশাদ নিজে বলেছে!
জিতুঃ ইমন, শান্ত হও । উনি বোধহয় সহজে সব মনে রাখতে পারেন না । আর ইশাদের নামই উনি জানবেন কি করে ।
ইমন রেজাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আচ্ছা, আপনি খগেন সেনকে তো চেনেন? এলাকার কাউন্সিলর?”
রেজাঃ হ্যাঁ, চিনবো না কেন?
ইমনঃ তার ছেলে জদু সেনকে চেনেন?
রেজাঃ হ্যাঁ চিনি তো, এই তো গত পরশু না কবে জানি একটা ছেলেকে নিয়ে গেলো ।
ইমন আর জিতু কিছুক্ষণ লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর,
জিতুঃ সেদিনের কথাই জিজ্ঞেস করছি আপনাকে! কি হয়েছিলো সেদিন?
রেজাঃ সেদিন একটা ছেলে ওষুধ নিতে এসেছিলো ।
জিতুঃ তারপর?
রেজাঃ তারপর ওই জদু এলো, হঠাৎ কি জানি বলা শুরু করলো ।
ইমনঃ জদু কি কিছু অনুরোধ করছিলো?
রেজাঃ হতে পারে, আমি খেয়াল করিনি ।
জিতুঃ আচ্ছা, এটুকু কথাই কি আপনি আদালতে যেয়ে বলতে পারবেন?
রেজাঃ কেন? এতে কি হবে?
জিতুঃ এতে একটা নিষ্পাপ ছেলে অপবাদ এবং জেল থেকে মুক্তি পাবে ।
রেজাঃ ও, আচ্ছা । ঠিক আছে । যাবোনে ।
জিতুঃ ৭ তারিখে কোর্টে যেতে হবে । আমি আপনাকে নিজ দায়িত্বে নিয়ে যাবো । আপনি কি যাবেন?
রেজাঃ ঠিক আছে । যাবো ।
মাঠে হেটে বেড়াচ্ছিল ইশাদ । বাগানের পাশ দিয়ে । আগের দিনের মতো আজও বিল্লাল পরিচর্যা করছে বাগানের । ইশাদ সেদিকে না তাকালেও হঠাৎ বিল্লাল ইশাদকে ডাকলো । “এ! শুন!” ইশাদ তাকাল বিল্লাল্লের দিকে ।
বিল্লালঃ এদিকে আয় ।
ইশাদ বিল্লালের দিকে এগিয়ে গেলো ।
বিল্লালঃ কিরে, তুই কয়েদি তো হোস নি, এক কাম কর, আমার লগে কাম কর, পড়ে কয়েদি হইলে কাম কইরা আরাম পাবি ।
ইশাদঃ কি কাজ করবো আমি?
বিল্লালঃ গাছগুলায় পানি দে । আমি মুইতা আসি ।
বিল্লাল ইশাদে হাতে পানি দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো । সেদিন এবং পরের দিন অর্থাৎ ৮ জানুয়ারি ২০২০-এ তেমন কিছু ঘটলো না বলার মতো । বাকি দিনগুলোর মতই দিন কাটছিলো সবার । শুধু ইশাদের বাবার শরীরের আরও অবনতি হল ।
৯ জুলাই ২০২০ ।
আদালতে সবাই এসে হাজির হল । জদুও এসেছে। রেজা-ও এসেছে ।
অপরপক্ষের অর্থাৎ লাশের হয়ে লড়ছে একজন মহিলা লয়ার, রাইসা বেগম । রাইসা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ইয়োর অনার, আমি আপনার অনুমতি পেলে তাকে ডেকে নিতে চাই, ।” জজ বললেন, “অনুমতি দেয়া হল ।” জদু এসে কাঠগড়ায় দাঁড়ালো । এক লোক উঠে এসে বলল, “শপথবাক্য পাঠ করুন, যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না ।” জদু বলল কথাটা । “যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না ।”
রাইসাঃ আপনার নাম?
জদুঃ জদু সেন ।
রাইসাঃ আপনি তো এলাকার কাউন্সিলরের ছেলে, না?
জদুঃ জি ।
রাইসাঃ তো আপনি কি করে লাশটাকে দেখলেন একটু জানান ।
জদুঃ আমি সেদিন ওই হোটেলে একটা রুম বুক করার জন্য গিয়েছিলাম । যেই দিন থেকে আমই হোটেলে উঠবো, সেদিন ফাকা হবে এমন কিছু রুম দেখতে যাচ্ছিলাম, সে সময় আমরা ওই রুমটায় যাই, যে রুমে লাশটা ছিল । আমরা লাশ দেখেই ভয়ে দৌড়ে কর্তৃপক্ষকে জানাই । তখন পুলিশকে জানান হয়, আশেপাশে জানাজানি হয়, আর সিসিটিভি ফুটেজ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় ইশাদ ভাই-ই ওই রুম থেকে বেড়িয়েছিলেন ।
রাইসাঃ ইয়োর অনার, শুনতেই পেলেন, আমাদের কাছে সিসিটিভি ফুটেজ আছে, আমরা আদালতে সেগুলো জমা দিয়েছি, সেগুলো চেক করলেই আপনি সব দেখতে পারবেন ।
বলে রাইসা বসে গেলো । জজ জিতুকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি কিছু জিজ্ঞেস করতে চান?” জিতু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “জি ইয়োর অনার, আমি উনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই ।” বলে জিতু সামনে এলো ।
জিতুঃ তবে তার আগে ইয়োর অনার, আমি একটা কথা বলে নিতে চাই । আমাদের ইন্সপেক্টর মিনহাজ এখনও লাশের পরিবারকেই খুজে বের করেন নি । অথচ সেই লাশের খুনের বিচারে একজন লয়ার রেখে কেস লড়ছেন ।
রাইসাঃ অব্জেকশন ইয়োর অনার! উনি কোন প্রমাণ ছাড়া একজনকে ইন্সপেক্টরকে অপমান করছেন ।
জিতুঃ অপমান না ইয়োর অনার, আমি জাস্ট বললাম ব্যাপারটা খানিক অড ।
জজ রাইসাকে, “আপনি বসুন!” এবং জিতুকে, “আপনি জিজ্ঞাসা শুরু করুন ।” বললেন ।
জিতুঃ আপনার নাম?
জদুঃ জদু সেন ।
জিতুঃ আপনার তো এই এলাকায়েই বাসা, তাই না?
জদুঃ হ্যাঁ । তো?
জিতুঃ আপনি হঠাৎ বাসা রেখে হোটেল কেন বুক করতে যাচ্ছিলেন নিজ এলাকায়?
জদুঃ ইয়ে, আমার বেশ ক জন বন্ধু আসবে বলেছিলো, ওরা থাকবে কোথায় তাই আরকি ।
জিতুঃ বাহ, প্রথমবার এমন শুনলাম, বন্ধুদের বাসায় না রেখে হোটেলে বুক করা হয় ।
রাইসাঃ অব্জেকশন ইয়োর অনার! কে কাকে কোথায় রাখবে সেটা তার পার্সোনাল ব্যাপার, এর সাথে উনি কি প্রমাণ করতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি না!
জিতুঃ ইয়োর অনার আমি কিছু মোটেও এখনও এমন কিছুই বলিনি, উনি কিন্তু শুধু শুধু আমাকে ডিস্টার্ব করছেন!
জজঃ অব্জেকশন ওভাররুল্ড!
রাইসা বসে পড়লো ।
জিতুঃ থাঙ্ক ইউ ইয়োর অনার ।
তারপর জিতু জদুকে প্রশ্ন করা শুরু করলো ।
জিতুঃ আচ্ছা, আমার মক্কেল অভিযোগ করেছেন, আপনি নাকি উনাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই হোটেলে? তারপর সেন্সলেস করে দিয়েছিলেন?
জদু হেসে উঠলো । তারপর বলল, “আমি! কেন আমি কেন এ কাজ করতে যাবো!”
জিতুঃ সেটা তো আপনিই ভালো বলতে পারেন ।
জদুঃ এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা!
জিতু জজের সামনে এসে বলল, “ইয়োর অনার! আমার মক্কেল আগেই জানিয়েছেন, উনি রেজা ফার্মেসী নামক একটা দোকানের সামনে ওষুধ কেনার সময় এই জদু সেন তাকে এই বলে নিয়ে যায় যে, সে নাকি হোটেলে রুম বুক করেছে গার্লফ্রেন্ডের সাথে রাত্রিযাপনের জন্য এবং রুম বুক করে বাইরে যেয়ে আবার ফিরে এসে দেখে রুমে একটা লাশ । সেটার জন্য সাহায্য চাইতে সে আমার মক্কেলের কাছে আসে । আমি সেই রেজা ফার্মেসীর দোকানদার রেজাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাই । যদি আপনি অনুমতি দেন তো ।” জজ বললেন, “অনুমতি দেয়া হল ।” সামনে থাকা লোকটি দাঁড়িয়ে বললেন, “রেজা ফার্মেসীর রেজা হাজির!” রেজা হঠাৎ চমকে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ! আমার নাম ধরে কি ডাকলো নাকি!” পেছনের রুমন ছিল । বলল, “জি! আপনাকে কাঠগড়ায় যেতে বলেছে!” রেজা কাঠগড়ায় এসে দাঁড়ালো সেই সাথে জদু নিজের জায়গায় চলে গেলো । শপথবাক্য শেষে জিতু জিজ্ঞেস করলো, “আপনার নাম?”
রেজাঃ রেজাউল করিম রেজা ।
জিতুঃ এবার আপনি বলুন, সেদিন কি আপনার দোকানের সামনে ইশাদকে জদু রিকোয়েস্ট করে নিয়ে গিয়েছিলো, কথাটা সত্যি না মিথ্যা?
রেজাঃ মিথ্যা!
জিতু চমকে উঠলো । বলল, “কি বলছেন আপনি! আপনি কিন্তু ভুলে যাওয়ার স্বভাব আছে! আপনি ভালো করে মনে করে বলুন!”
রেজাঃ আরে হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন? ওইদিন আসলে ইশাদ ছেলেটার খোঁজ খবর নিতে জদু এসেছিলো । আর ইশাদ কেমন দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলো । কি জানি ভয়ে ভয়ে আছে ইশাদকে দেখে মনে হচ্চিলো ।