ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের
সাল ১৯০১
প্যারিসের এক এটর্নি জেনারেলের আসে এক বেনামি চিঠি । নাম স্বাক্ষর বিহীন সেই চিঠিতে লেখা ছিল,
“Monsieur Attorney General: I have the honor to inform you of an exceptionally serious occurrence. I speak of a spinster who is locked up in Madame Monnier’s house, half starved, and living on a putrid litter for the past twenty-five years – in a word, in her own filth.”
মাদাম মনিয়ের এলাকার একজন বেশ নাম করা মহিলা । তার বিরুদ্ধে এরকম একটা চিঠি নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে যান এটর্নি জেনারেল । তার প্রয়াত স্বামী এমিলি মনিয়ের ছিলেন শহরের আর্ট ফ্যাকাল্টির ডিরেক্টর এবং তার ছেলে মার্সেল মনিয়ের ছিলেন একজন স্বনামধন্য উকিল । তার ওপর মাদাম মনিয়ের দানশীলতার জন্য এলাকায় প্রসংসিত এবং এ কাজের জন্য তিনি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি-ও পেয়েছেন । এরকম এক পরিবারের বিরুদ্ধে এরকম এক মর্মান্তিক চিঠি সত্যি অবিশ্বাস্য । অনেক চিন্তার পর এটর্নি জেনারেল স্থানীয় পুলিশকে ২১ রিউ ডি ল্যা ভিজিটিশনের মাধ্যমে মাদাম মনিয়ের বাড়িতে তল্লাশি চালানোর আদেশ দেন ।
মাদাম মনিয়েরের বাড়ি তল্লাশি করে কিছুই পাওয়া গেলো না । অবশেষে হার মেনে পুলিশ যেই না বাড়ি থেকে বেরোতে যাবে, সে সময় এক অফিসারের নাকে এক উৎকট গন্ধ ধরা পড়ে । সেই গন্ধ অনুসরন করে পুলিশ বাহিনী পৌছায় তালাবদ্ধ এক চিলেকোঠার ঘরে । ঘরের একটা জানালা ছিল, তবে তা ভেতর থেকে কালো পর্দায় ঢাকা । ঘরের কাছে আসতেই গন্ধটা আরও তিক্ত রূপ ধারণ করলো । অফিসার আর দেরি না করে পুলিশ নিয়ে জানালা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করলেন । কিন্তু তারপর যা দেখা গেলো, তা যেন সিনেমাকেও হার মানায় ।
সাল ১৮৪৯
মাদাম মনিয়ের আর এমিলি মনিয়ের ঘরে জন্ম নেয় ফুটফুটে এক কন্যা, যার নাম দেয়া হয় ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের । তার জন্ম হয়েছিলো ১ মার্চ । মেয়েটা ধীরে ধীরে বড় হয়, তার ভাই মার্সেল মনিয়ের হয় বেশ নামকরা একজন উকিল, মনিয়ের পরিবারের দিন কাল বেশ ভালোই চলছিল । ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের দেখতে ছিল বেশ সুন্দরি । এলাকায় সবাই তার চেহারা দেখে না প্রশংসা করে থাকতো না ।
সাল ১৮৭৪
ব্ল্যাঞ্চ মনিয়েরের পরিবার যখন তার বিয়ের দেবার জন্য পাত্র খোজায় ব্যাস্ত, তখন ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের শহরের আরেক উকিলকে ভালোবেসে তাকে বিয়ে করার আশায় অপেক্ষা করছে । তাই নিজের ভালোবাসার কথা সে সরাসরি তার পরিবারকে জানিয়ে দেয় । ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের তার ভালোবাসার মানুষটিকে পরিবারের সবার সামনে হাজির করলেও তার মা মাদাম মনিয়ের আপত্তি করেন । কারণ, ব্ল্যাঞ্চ যে উকিলকে ভালবেসেছে, তার পারিবারিক মর্যাদা ব্ল্যাঞ্চ মনিয়েরের পরিবারের চেয়ে কম । এছাড়া ছেলেটা ব্ল্যাঞ্চ মনিয়েরের চেয়ে বেশি বয়স্ক । ব্ল্যাঞ্চ মনিয়েরের মা সরাসরি না করে দেয় । কিন্তু ব্লেঞ্চ মনিয়ের নাছোড়বান্দা । সে নিজের ভালোবাসা ছাড়া আর কাউকে বিয়ে দেবে না । এদিকে ওর মা-ও নাছোড়বান্দা । নিজের মেয়েকে নিজের পছন্দের পাত্র ছাড়া বিয়ে দেবেন না, ব্ল্যাঞ্চ মনিয়েরের ভালোবাসার মানুষের সাথে মোটেও না । ব্ল্যাঞ্চ মনিয়েরের ভাই মার্সেল মনিয়েরও মায়ের পক্ষ নিয়ে বোনের সিদ্ধান্তে আপত্তি করে, কিন্তু ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের তার নিজের সিদ্ধান্ত থেকে অনড় । অবশেষে মাদাম মনিয়ের মেয়ে একটা শিক্ষা দেবার জন্য ফন্দি একটা ফন্দি আটলেন ।
রাতে প্রেমিকের সাথে দেখা করে বাড়ি ফিরে এলো ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের । সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ ওর দুই হাত চেপে ধরে ওর মা, আর ভাই । এতক্ষণ উনারা সিঁড়ির আড়ালেই ছিলেন । তারপর ব্ল্যাঞ্চ মনিয়েরের মা আর ভাই মিলে ব্ল্যাঞ্চকে বন্দি করে দেন ঘরের চিলেকোঠার অন্ধকার কুঠুরিতে । শর্ত দেন মায়ের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হলেই মুক্তি মিলবে । কিন্তু মেয়েও জেদ ধরে বসে । সে তার প্রেমিককেই বিয়ে করবে, অন্য কাউকে না ।
এদিকে এলাকায় মাদাম মনিয়ের রটিয়ে দেয় তার মেয়ে রহস্যজনকভাবে হঠাৎ উধাও । পুলিশ তদন্তে নামলেও ব্যাপার থেকে যায় অমীমাংসিত, আবার কিছুদিন যেতে না যেতেই তদন্ত থামিয়ে দেয়া হয় ।
এদিকে ১৮৮৫ সালে ব্ল্যাঞ্চ মনিয়েরের প্রেমিক মারা গেলেও মায়ের মন দমে না । তারওপর সমাজে উনি রটিয়েছেন মেয়ে হারিয়ে গেছে । এখন যদি মেয়েকে ছেড়ে দেয়, তাহলে সমাজে তার হালটা কি হবে সেই ভেবেই মেয়েকে আর মুক্তি দেন নি ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের । সেই অন্ধকার কুঠুরিতেই কাটতে থাকে ব্ল্যাঞ্চ মনিয়েরের জীবন । কেবল খাবার দিয়ে যাওয়া হয়, এই ।
সাল ১৯০১
হ্যাঁ, শুরুর প্যারায় পুলিশ বেনামী চিঠির হাত ধরে মাদাম মনিয়েরের বাড়িতে ঢুকে পুলিশ যাকে দেখেছিল, সে অন্ধ কুঠুরিতে বদ্ধ ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের । শরীরের মাংস যেন চামড়ার সাথে লেগে গেছে । দেহ প্রায় উলঙ্গ । পায়ে শেকল বাধা । ঘরের দুর্গন্ধ আর পরিবেশে বেশ কয়েকজন পুলিশ বমি পর্যন্ত করে দেন । মেঝেতে এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাবার, রুটি, মাছ মাংস ইত্যাদি । ঘরের ভেতরেই পড়ে আছে মলমুত্র । মারাত্মক গন্ধে বেশিক্ষণ ঘরে থাকা সম্ভব হয় নি পুলিশের পক্ষে ।
এ ঘটনার পর ব্ল্যাঞ্চ মনিয়েরকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় । এলাকায় ঘটনা জানাজানি হলে সবাই মা ও ছেলের শাস্তির জন্য আন্দোলন করতে থাকে । মাদাম মনিয়ের জামিন দিয়ে ছাড়া পেলেও জনতার বিক্ষোভে দুশ্চিন্তায় ঘটনার ১৫ দিনের মাথায় হার্ট অ্যাট্যাক করে মারা যান মাদাম মনিয়ের । অন্য দিকে মার্সেল মনিয়েরকে আটক করা হলেও ১৫ বছরের জেল দেয়া হলেও প্রভাব খাটিয়ে বেড়িয়ে আসেন । তবে তৎকালীন ফরাসি পেনাল কোড মতে তিনি অপরাধী নন বলে আদালত জানিয়েছিল ।
এদিকে ২৫ বছর পর উদ্ধার হওয়া ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন । আলো দেখলেই অস্থির হয়ে যেতেন । তার সুস্থতার জন্য তাকে ফ্রান্সের একটা সাইক্রিয়াটিক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় । সেখানেই বাকি জীবন কাটে ব্ল্যাঞ্চ মনিয়েরের । তিনি আর কোন দিন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন নি । যতদিন বেঁচে ছিলেন, প্রেমিকের ঘোরেই আচ্ছন্ন ছিলেন । ঘটনার ১২ বছর পর ফ্রান্সের সাইক্রিয়াটিক হাসপাতালেই ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের ১৯১৩ সালের ১৩ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন ।
অনেকেই ধারণা করেন ব্লেঞ্চ মনিয়েরের প্রেমিকের সাথে মনিয়ের বাড়ির কাজের লোকের যোগাযোগ ছিল, যে ১৯০১ সালে কাজ ছেড়ে দেয়, এবং পুলিশের কাছে সেই বেনামী চিঠি প্রেরণ করেন ।