0 %

Thanks a lot for being with us!
We are re-constructing our website!
Sorry for this temporary inconvenience
We are coming to you with a fresh look and design from 1 January 2022!
Till then! Stay connected!

পরিচয় (সিজন-৭)


আবিরের ধারণাতীত বিয়ে
লেখক সাদাত আলম প্রতীক


(২০১)

কেটে গেছে প্রায় ৭টা বছর । পরিবেশ অনেক বদলে গেছে । কমলাপুর রেইলওয়ে স্টেশনে জেজেএ রেস্টুরেন্টের নাম গন্ধ পর্যন্ত নেই । ষ্টেশনের এক পাশে বস্তি অবশ্য রয়েছে একটা, তবে সেখানে আবিরের পরিচিত কেউ নেই । সবাই নতুন । এদিকে আবিরের “দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো” সাড়া বাংলাদেশে এই ৭টা বছর ব্যাপক সাড়া ফেলেছে । আবির এইচএসসি শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাপ্লায়েড ফিসিক্স নিয়ে পড়েও তা ওর ক্যারিয়ারে কোন কাজেই লাগে নি । কারণ এই দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো-তেই আবির যে পরিমাণ টাকা জোগাড় করেছে, তা দিয়ে ও একটা গার্মেন্টস কোম্পানি খুলেছে । কিছু টাকা  চয়নিকার বাবা দিলেও আবির বলেছে গার্মেন্টস খোলার পর তা থেকে যা অর্থ পাবে তা দিয়ে সব শোধ করে দেবে । গার্মেন্টস কোম্পানির নাম চয়বির । চয়নিকার “চয়” আর আবিরের “বির” মিলে “চয়বির”। এখন আবির “দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো” এর শুটিং আর এই গার্মেন্টস দুটো একসাথে চালায় । চয়নিকা বায়োলজির ওপর পড়াশুনা করে ডাক্তার হবার জন্য চেষ্টা করছে । এখন ও একটা মেডিক্যাল ভার্সিটিতে পড়ে । আঁখি সাবিত নামের এক ছেলেকে বিয়ে করেছে । আঁখি একটা বেসরকারি ভার্সিটির লেকচারার । আর অয়ন কেমিস্ট্রি নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে । সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র এখন অয়ন । চয়নিকার বাবা আর কিছুদিন বাদেই রিটায়ার্ড করবেন । বেচারার একটাই কষ্ট ছেলের চাকরি হবার আগেই রিটায়ার্ড করছেন । যতোই হোক, মেয়ের জামাইয়ের কাছ থেকে তো আর ছেলের জন্য টাকা চাওয়া যায় না । ব্যাংককে কিছু টাকা জমিয়েছেন, তাতে কতদিন চলবে তা জানা নেই তার । তবে আবির লোকটাকে শান্তুনা দিয়েছে এই বলে আবির এই বাড়িতে ছেলের মতো থেকেছে, অয়ন ওর ভাইয়ের মতো, দায়িত্ব আবির নিলেও কোন ক্ষতি নেই । আবির শুধু যে কোম্পানির মালিক বলেই পরিচিত তা কিন্তু নয়, আবির একজন ভালো মানুষ হিসেবেও পরিচিত ওর কোম্পানিতে । সবাইকে আবিরকে বেশ ভালোবাসে । ওদিকে আবিরের বিয়ের বিষয়ে কথাবার্তা চলছে । আর ৩দিন পর থেকে সব কিছুর আয়োজন শুরু হবে । বিয়ের নানা ব্যাস্ততা, তারপর আবার হানিমুন, এসব কিছু মিলিয়ে “দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো” এর ৫টা এপিসোড এর শুটিং আগে থেকেই করে রাখছে আবির । ৩টে শুটিং হয়ে গেছে,আর ২টা করলেই হয়ে যাবে । সপ্তাহে ১দিনই তো প্রচারিত হয় । ৫টা  এপিসোডে অনায়াসে ১মাস কেটে যাবে । গার্মেন্টস এর  কাজ শেষে ফিরছিল আবির, গাড়িতে উঠতে যাবে, এমন সময় দারোয়ান আবিরকে দেখে ডেকে  উঠলো, “স্যার!” আবির দাঁড়িয়ে গেলো । পেছন ফিরে তাকালো । মুখে চাপদাড়ি, চোখে চশমা তো ওর আগে থেকেই । গায়ে কোট-টাই-প্যান্ট । আবির দারোয়ানের  ডাক শুনে দারোয়ানের কাছে যেয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, “জি চাচা বলেন ।” দারোয়ান বলল, “স্যার, আমার মাইয়া যহন অসুস্থ হইয়া গেছিলো, আমার মাইয়ার চিকিৎসার লাইগা আপনে ট্যাকা দিছিলেন, তাই আমার মাইয়া আপনের ওপর খুব খুশি হইছিলো, তাই ওরে যহন কইলাম, আপনের বিয়া হইব, ও আপনের লাইগা এইডা বানায়া দিছে ।” বলে খাকি শার্টের পকেট থেকে কাগজের বানানো একটা পাখি বের করে আবিরের হাতে দিলো দারোয়ান । তাতে লেখা “শুভ বিবাহ স্যার ।” দারোয়ান বলল, “ও আপনের ইনভেস্টো ওই টিভির অনুষ্ঠানডা দ্যাখে । ও আপনের অনেক বড় ফ্যান ।”  আবির পাখিটা দেখে হাসিমুখে বলল, “বাহ! দারুণ হয়েছে তো পাখিটা!” এরপর আবির পকেট থেকে ১০০টাকা বের করে লোকটার হাতে দিয়ে বলল, “আপনার মেয়ের জন্য কিছু কিনে দেবেন ।” দারোয়ান ইতস্তত বোধ করে বলল, “ছি!ছি! স্যার, আপনের   কাছে এমনিতেই আমি ঋণী, আবার এইগুলা ক্যান?” আবির বলল, “ঋণী বলবেন না । বলবেন ভালোবাসা । আর ওগুলোতো  আপনাকে ধার দেই নি, আপনি আমার বাবার মতো, আর আমার  মা বাবা কেউ নেই, তাদের  খোঁজ ও জানি না । তাই এই  বাবার  জন্য কিছু  করলে তা কোন ঋণের কাতারে পড়ে না ।”   দারোয়ানের চোখ ছলছল করছে খুশিতে । আবির বলল, “সাবধানে থাকবেন,  আসি তাহলে । আর  পারলে আপনার  মেয়েকে আনবেন একদিন, দেখা  করবো আমি ।”  দারোয়ান মাথা ডানে কাত করে বলল,  “আইচ্ছা স্যার ।”  এরপর আবির গাড়িতে  উঠে বসলো । কাগজের দেয়া পাখিটা গাড়ির সামনে রেখে গাড়ি চালিয়ে বাড়ির পথে রওনা হল । ইদানীং আবহাওয়া কেমন যেন যাচ্ছে, এই  রোদ, তো এই বৃষ্টি । আজ আবার মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মাঝে রোদের দেখা মিলেছে, কিন্তু রাস্তাঘাট এখনও ভেজা । আবিরের কোম্পানি তেজগাঁও শিল্প এলাকায় । সেখান থেকে মতিঝিল চয়নিকাদের বাসায় আসতে প্রায় ২০-২২মিনিট মতো লাগে । মগবাজার রোড ধরে আসছিলো আবির এমন সময় রাস্তার পাশে তাকিয়ে দেখল, অয়ন একটা কেকের দোকানের ঢুকল । আবির গাড়ি থামিয়ে সেই কেকের দোকানে ঢুকল । দোকানে আরও দোকানদার আর ৫-৬ জন কাস্টমার ছিল । অয়ন এক দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলো, “আঙ্কেল ভ্যানিলা কেক আছে?” আবির একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে । দোকানদার  আবির কিছু নেবে কিনা এমন কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তার আগেই আবির ঠোঁটে তর্জনী ধরে ইশারায় চুপ করতে  বলল । অয়ন এখনও আবিরকে দেখে নি । দারোয়ান অয়নকে একটা কেক দেখাল, প্রায় ৩পাউন্ড মতো হবে । অয়ন দোকানদারকে বলল, “আঙ্কেল এতো বড় না, একটু ছোট দেখান, ১পাউন্ড মতো ।” দোকানদার ১পাউন্ড সাইজের একটা কেক দেখাল অয়নকে । অয়ন তখন বলল,  “আরেকটু বেশি ডিজাইন করাটা নেই, মানে একটা মেয়ের জন্য কিনতাম তো, ফুল একটু বেশি দেয়া এরকম টাইপের নেই?” এবার আবির অয়নের পাশে এসে পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কোন মেয়ের জন্য কেক?” অয়ন চমকে আবিরের দিকে তাকাল ।






(২০২)

অয়ন কি বলবে বুঝতে পারছিল না । আমতা আমতা করছিলো, এমন সময় আবির ইয়ার্কি করে জিজ্ঞেস করলো, “না বাসায় দুজন মেয়ে আছে, এক তোর বোন আঁখি, আরেক আমার হবু বউ চুনি, হ্যাঁ এও তোর বোন । তবে দুজনেরই কারোরই তো আজ বার্থডে না?” অয়ন তখন হালকা হাসবার চেষ্টা করে বলল, “ইয়ে, মানে, আছে একটা মেয়ে, আরকি, ভার্সিটিতে ।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “ও ওয়াও, না থাকতে পারে । ক্ষতি কি ।” বলে আবির দোকানদারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “থাকতে পারে না?” দোকানদার হাসিমুখে ওপর নিচ মাথা নাড়াল । আবির অয়নকে তখন বলল, “তোর তো কতো মেয়ে বন্ধুই আছে, ছেলে বন্ধুও আছে, তা কোন দিনও শুনলাম না কারো জন্য কেক কিনেছিস, আজ হঠাৎ কি হল?” অয়ন একটু ভেবে জবাব দিলো্, “কিনেছি তো! কিনেছি! এই যে, আজ তুমি না এলে যেমন জানতে পারতে না, তেমনি ওগুলোও জানতে পারো নি । এইতো, এই দোকান থেকেই কিনেছি!” বলেই অয়ন দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বলল, “কি আঙ্কেল, কিনেছি না?” বলেই অয়ন চোখ টিপ দিলো, যেন দোকানদার আবিরকে হ্যাঁ জবাব দেয় । দোকানদার হাসিমুখে ওপর নিচ মাথা নাড়ল আবার । আবির তখন দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার পেছনের আয়নাটা তো বেশ সুন্দর, এরকম ফুল এইচডি আয়না থাকলে যে কারো চোখ টিপ দেয়া বেশ সহজে বোঝা যায় ।” অয়ন দেখাল, দোকানদারের পেছনে একটা আয়না মতো আছে, সেখানে আবির অয়নের চোখ টিপ দেয়া দেখে ফেলেছে । দোকানদারও তাই দেখল । এরপর দোকানদার বলল, “সরি স্যার, ইনি বলেছিলেন দেখে হ্যাঁ বলেছি,  ইনি আজই প্রথম এসেছে দোকানে ।” আবির বলল, “না, ইটস ওকে । সমস্যা নেই ।” ঠিক সেই সময় দোকানদার বলল, “আপনাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে!” আবির কিছু বলার আগেই আরেক দোকানদার বলে উঠলো, “আরে! আপনি দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো এর সালমান খান আবির স্যার না?” দোকানদারের এই কথা শুনে দোকানের আর সব কাস্টোমার আর দোকানদার আবিরের  কাছে  এগিয়ে এলো ।  আবির ভদ্রতার খাতিরে সবার সাথে কথা বলল, সবাই আবিরের দ্যা ইনভেস্টিগেশন  শো এর  প্রশংসা করলো, আবিরের সাথে ছবি তুলল, আবিরের অটোগ্রাফ নিলো, সব শেষে আবির খেয়াল করলো, অয়ন সেই ফাঁকে দোকান থেকে পালিয়েছে ।

“টিং টং!” আওয়াজ  হল দরজায় । জরিনা “আইতাছি” বলে একটু পর দরজা খুলে দিলো । দরজা খুলে বলল, “আবির ভাইয়া আইছেন!” আবির বলল, “হ্যাঁ আপু, তোমার কি খবর?” জরিনা বলল, “হ ভাইয়া   ভালা ।” আবির পাশে বসে জুতো খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলো, “তা, আজ কি রান্না করলে?”

- “মুরগীর মাংস ভুনা কইরা রান্না করছি, লগে তিল ভর্তা আর ডাইল ।” বলল জরিনা ।

- “আহা! আজ তো দেখছি  দারুণ খাওয়া দাওয়া হবে! তবে এখনই খেয়ে আবার শুটিং এর জন্য বেরোতে হবে ।” বলল আবির ।

- “আমি তাইলে ভাত বাইরা দেই?” জিজ্ঞেস করলো  জরিনা ।

- “আরে না আপু, সমস্যা নেই, সারাদিন কতো কাজ করো তুমি, এটুকু আমিই করতে পারবো ।” বলল আবির ।

- “না আমি বাইড়া দিতেছি ভাত, আপনে আসেন ।”  বলেই জরিনা আবিরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলো ডাইনিং রুমের দিকে । আবিরের তাড়া থাকে বলে সকালে আর রাতে গোসল করে, দুপুরে গোসল করাটা হয়ে ওঠে না । জুতোটা খুলে দারোয়ানের মেয়ের দেয়া ওই কাগজের পাখিটা নিজের রুমে কর্নারে রাখল আবির । সেখানে ওই কাগজের পাখিই যে রয়েছে তা কিন্তু না, আরও অনেক লোকের দেয়া এরকমই কমদামি বা বেশি দামি, বা হাতে বানানো দেয়া কিছু বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে আবির । ওর মতে কেউ যদি ভালোবেসে কিছু দেয়, তবে সেই ভালোবাসা নিজের কাছী রেখে দিতে হয় । সাধারণ একটা জিনিস নষ্ট হলে হয়তো আবার কেনা যায় কিংবা পাওয়া যায়, কিন্তু ভালোবাসার জিনিস হারালে ভালোবাসাটাও হারিয়ে যায় সেই সাথে । হাত ধুয়ে টেবিলে বসে পড়লো আবির । জরিনা আপু খাবার বেড়ে দিয়েছে । খেতে খেতে আবির বলল, “উমহ! কি দারুণ রান্না হয়েছে না! জোশ হয়েছে আপু!” জরিনা রান্না ঘর থেকে বলে উঠলো “ঠাঙ্কউ ভাইয়া!” খাওয়া প্রায় শেষের দিকে, এমন সময় আবিরের মোবাইলে একটা কল এলো । দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো এর ডিরেক্টর ফোন করেছে । ফোন ধরে আবির বলল, “হ্যালো স্যার, বলেন ।” ডিরেক্টর বলল, “শুটিং এ আসবে কখন?” ডিরেক্টর এর গলায় কেমন একটা হতাশার ভাব দেখল আবির । আবির জবাব দিলো, “এইতো খেয়ে বেরবো এখন । কেন কিছু হয়েছে?” ডিরেক্টর বলল, “একটু ঝামেলা হয়েছে, তুমি পারলে একটু তাড়াতাড়ি এসো ।” আবির বলল, “আচ্ছা, আমি একটু পরই আসছি ।” বলেই আবির খাওয়া দাওয়া শেষ করে জরিনা আপুকে বলে বেড়িয়ে গেলো শুটিং এর জন্য ।




(২০৩)

যে চ্যানেলে আবির কাজ করে ওটা কারওয়ান বাজারে, আবিরের গার্মেন্টস থেকে খুব বেশি দূরে নয় । তাই সেখানে যেতে কোম্পানি থেকে বাসায় আসতে যেরকম সময় লেগেছিল প্রায় ওরকমই সময় লাগে । আবির চ্যানেল ভবনের নিচে গ্যারেজে গাড়ি রেখে বিল্ডিং-এ ঢুকল । তারপর যে স্টুডিওতে আবির কাজ করে সেখানে গেলো । ডিরেক্টর বেশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বসে আছেন । আবির কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে স্যার?” ডিরেক্টর তার পাশে রাখা একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল, “বসো ।” আবির বসে জিজ্ঞেস করলো, “হ্যাঁ বলেন কি হয়েছে?” ডিরেক্টর তখন আবিরকে জিজ্ঞেস করলো, “এ পর্যন্ত যতো ইনভেস্টিগেশন আমরা দেখিয়েছি, সবগুলোই তো তুমি খোঁজ করেছো, তাই না?” আবির বলল, “হ্যাঁ কিন্তু কেন?”

- “লাস্ট ইনভেস্টিগেশনটাও তো তুমি সংগ্রহ করেছো, তাই না?” জিজ্ঞেস করলো ডিরেক্টর ।

- “লাস্ট বলতে যে তিনটার এক্সট্রা শুটিং হয়েছে সেটার তৃতীয়টা?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “না, যেটা লাস্ট টিভিতে দেখানো হয়েছে ।” বলল ডিরেক্টর ।

- “ও, ড্রাগসের যে ক্রাইমটা?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “হুম ।”

- “হ্যাঁ, ওটাও তো আমিই সংগ্রহ করেছি । কিন্তু হয়েছে কি?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “তুমি জানো, ওই ঘটনায় যে মূল আসামী সে কে?” প্রশ্ন করলো ডিরেক্টর ।

- “কে?”

- “উনি আফজাল হোসেন নামক এক বিরাট ক্ষমতাধর মেয়রের ছেলে । উনার বড় বড় পুলিশের সাথে মেলামেশা আছে, উনি চাইলে আমাদের এই পুরো চ্যানেল বন্ধ করে দিতে পারে ।” বলল ডিরেক্টর ।

আবির কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না । ডিরেক্টর একটু থেমে আবার বললেন, “উনি ইতোমধ্যে উনার ছেলেকে জেল থেকে ছাড়া দিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আমাদের এই শোতে উনার ছেলের নাম নেয়ায় উনি বলেছেন এই শো বন্ধ করতে নইলে উনি আমাদের চ্যানেলই বন্ধ করে দিবেন ।” বলল ডিরেক্টর । আবির জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু আমরা কি কিছুই করতে পারি না?” ডিরেক্টর বলল, “না আবির, কিছু বলার নেই । এখন উনি চাইলে পুলিশের বড় বড় কর্মকর্তাদের কাছে আমাদের নামে মিথ্যা কেস ঠুকে দিলেই আমাদের রক্ষা নেই ।” আবির আর কিছু বলল না । একটু থেমে বলল, “তাহলে উপায়?”  ডিরেক্টর বলল, “কোন উপায় নেই আবির । ইউটিউব থেকে  ইতোমধ্যে এই এপিসোডটা  ডিলিট করে দেয়া হয়েছে । আর এই স্টুডিওটা একটা রিয়েলিটি শো এর জন্য দিয়ে দেয়া হয়েছে ।” আবির মাথা নিচু  করে হতাশার  দম  ফেলে বলল, “এই শোটা আমার জন্য লাইফ চেঞ্জিং শো ছিল ।” ডিরেক্টর  আবিরের দিকে তাকিয়ে  বলল,  “কিছু করার  নেই আবির । এখন যে  রিয়েলিটি শো হচ্ছে, তার ডিরেক্টিং-ও আমি করছি । তুমি তার হোস্ট হবে?” আবির বলল, “আমি ইনভেস্টিগেশন ভালোবাসি, ইনভেস্টিগেশন না করলেও এই সম্পর্কিত প্রোগ্রামের হোস্ট হওয়াটাই আমার জন্য একটা ভালোবাসার কাজ ছিল । আশা করি রিয়েলিটি শো-তে এই ভালোবাসাটা আমি পাবো না ।” ডিরেক্টর আর কিছু বলল না । “এখানে থেকে আর কোন কাজ নেই । আমি যাই তাহলে । ভালো থাকবেন, ইনশাল্লাহ দেখা হবে আবার ।” বলে স্টুডিও থেকে চলে এলো আবির । আসবার সময় স্টুডিওটা দেখতে লাগলো । এমন সময় আবিরের পরিচিত এই চ্যানেলের এক খবর পাঠক ও উপস্থাপকের সাথে দেখা আবিরের । নাম সামি । সামি বলল, “আরে আবির, কি খবর?” সামি আবিরকে ভালোবেসে তুই করে ডাকে । আবির বলল, “এইতো সামি ভাই, মোটামুটি । আপনার কি খবর?” সামি বলল, “আমারও একই অবস্থা । চলছে । কিরে তোর মন খারাপ কেন?” আবির চুপ করে রইল । সামি আবার জিজ্ঞেস করলো, “কিরে, কি হয়েছে বল?” আবির বলল, “আমার ইনভেস্টিগেশন শো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ।” সামি অবাক হয়ে গেলো । বলতে উঠলো, “কি বলছিস তুই! কিন্তু কেন?” আবির সবটা খুলে বলল । সামি বলল, “হায় আল্লাহ! এ কেমন কথা!” আবির বলল, “জি ভাই, এটাই হয়েছে ।” সামিকে এমন সময় এক লোক বলে উঠলো, “সামি, তাড়াতাড়ি খবরের স্টুডিওতে যাও, দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!” সামি লোকটাকে “যাচ্ছি!” বলে আবিরকে বলল, “আচ্ছা সামি, পড়ে কথা হবে, তোর এই কথাটা শুনে খুব খারাপ লাগলো!” আবির বলল, “দেখা যাক কি হয়, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই তো করেন ।” সামি চলে গেলো খবরের স্টুডিওতে আর আবির ফিরে এলো বাসায় ।

বিকেলের দিকের কথা । চয়নিকা এসেছে মেডিকেলের ট্রেনিং শেষে । সকালে যায় আর এরকম  সময়ই আসে । অয়ন যদিও বিকেল ৪টার দিকে আসে কিন্তু আজ এখনও আসে নি অয়ন । আর চয়নিকার বাবা আসে রাত ৮টার দিকে । চয়নিকা বাসায় এসে নিজের রুমে ঢুকতে  গিয়ে অয়নের রুমে আবিরকে দেখে অবাক হয়ে গেলো । অয়নের রুমের বারান্দায় আবির দাঁড়িয়ে । চয়নিকা যেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি ব্যাপার, আজ এতো তাড়াতাড়ি, শুটিং ছিলো না?” আবির কিছু বলল না । চয়নিকা বলল, “কি হল, কিছু বলো?” আবির  চয়নিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো বন্ধ হয়ে গেছে । আর কোনোদিন অন এয়ার হবে না সেটা ।” চয়নিকা কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো । বলে উঠলো “কি!”




(২০৪)

আবির বলল, “যা শুনেছ তাই সত্যি । এই দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো আর চলবে না, এবং সালমান খান আবির নামেও কেউ আর হোস্ট থাকবে না ।” চয়নিকার মন খারাপ হয়ে গেলো । কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আবিরকে শান্তনা দিয়ে বলল, “আচ্ছা, সমস্যা নেই । আল্লাহর রহমতে এখন চয়বির তো আছেই । তা থেকেই তো তুমি অনেক টাকা পাবে, সেটা দিয়ে আমাদের সংসার বেশ চলবে ।” আবিরও হালকা হাসিমুখে বলল, “দ্যাখো, টাকাটা বড় কথা না । আমার এই গোয়েন্দা বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে কেন যেন খুব ভালো লাগে । তাই আর কি ।” চয়নিকা বলল, “আচ্ছা বাদ দাও এসব এখন । বাবা কিন্তু আজ আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবেন । মনে আছে তো?” আবির বলল, “হ্যাঁ আছে ।”

সন্ধ্যা ৭টার দিকের কথা । অয়ন রুমে ঢুকল । দরজা খুলে আগে দেখে নিলো রুমে কেউ আছে কি না । তারপর ভেতরে ঢুকল । আবির  সাধারণত অন্যান্য দিন এরকম সময়ে আসে না, তাই রুমে ঢুকেই যখন দেখল বিছানায় আবির শুয়ে মোবাইল চালাচ্ছে, তখনই চমকে দাঁড়িয়ে গেলো । ভাবল রুম থেকে বেড়িয়ে যাবে, কিন্তু আবির সেই সময় ডেকে উঠলো, “দাঁড়া!” দাঁড়িয়ে গেলো অয়ন । আবির উঠে বসলো । তারপর অয়নের সাথে ইয়ারকি করা শুরু করলো । জিজ্ঞেস করলো, “কিরে, চলে যাচ্ছিস কেন?” অয়ন আমতা আমতা করে বলল, “ইয়ে মানে খেতে!” আবির বলল, “ব্যাগ না রেখেই খেতে যাবি ।” অয়ন, “ও হ্যাঁ!” বলেই ব্যাগ রেখে রুম থেকে আবার বেরোতে যাবে আবির আবার ডাকলো অয়নকে । অয়ন দাঁড়িয়ে গেলো । আবির জিজ্ঞেস করলো, “মেয়েটা কে?” অয়ন বলল, “ওইতো………ফ্রেন্ড!” আবির জিজ্ঞেস করলো, “ফ্রেন্ডই যদি হতো তখন দোকান থেকে পালিয়ে গেলি কেন?” অয়ন বলল, “এমনি, দেরি হয়ে যাচ্ছিলো, তাই ।” আবির বলল, “তাই! নাকি আমার সামনের মেয়ের জন্য কেক কিনতে কষ্ট হচ্ছিলো!” অয়ন এবার আবিরের কাছে বসে আবিরের হাত ধরে বলল, “এ আবির ভাই, শোনো না, প্লিজ কাউকে বোলো না!” আবির বলল, “আরে না পাগল, কাউকেই বলবো না । এবার বল, কে মেয়েটা?”

- “আমার গার্লফ্রেন্ড ।” বলল অয়ন ।

- “আরি বাবা! গার্লফ্রেন্ড বানিয়ে  ফেললি পুরো!” অবাক হয়ে বলল আবির ।

- “এ বয়সে এমন হয়ই ।” বলল অয়ন ।

- “হুম, তাও একটা কথা, এ বয়সে এমন হয়ই । তা নামটা কি আমার শালাবাবুর গার্লফ্রেন্ডের?” জিজ্ঞেস  করলো আবির ।

- “মাইশা ।” লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে অয়ন ।

- “ওয়াহ! পুরো সোনায় সোহাগা, মাই শালার গার্লফেন্ড মাইশা । ওয়াহ! তা কতোদিনের রিলেশন?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “২ মাসের ।” বলল অয়ন ।

আবির কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল । তারপর বলল, “তা মাই শালা, আপনার মাইশা আসবেন না আমার বিয়েতে?” অয়ন বলল, “হ্যাঁ, সব বন্ধুরা তো আসবেই, তার সাথে মাইশাও আসবে ।” আবির বলল, “ওকে মাই শালা, যাও তাহলে, খেয়ে নাও, মাইশার বার্থডে ছিল দেখেই মনে হয় কেক কিনেছিলে, তা ওকে আমার পক্ষ থেকে উইশ করে দিয় ।” অয়ন আবার অনুরোধের সুরে বলল, “আবির ভাই, বোলো কাউরে বলবা না, প্লিজ!” আবির হেসে বলল, “আচ্ছা যা, কাউরে বলবো না । খুশি?” অয়ন আবিরকে জড়িয়ে ধরে “থ্যাংকস! সেই পরিমানে খুশি!” বলে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো ।

চয়নিকার বাবা অফিস থেকে ফিরেই আবিরের রুমে গেলো । আবির মোবাইলে কি কাজ করছিল, চয়নিকার বাবাকে দেখে উঠে বসে সালাম জানালো । চয়নিকার বাবা সালামের জবাব দিয়ে আবিরের পাশে বসে বললেন, “আবির, তোমার দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো  এর বন্ধ হবার কথা শুনলাম । খুব খারাপ লাগলো শুনে । কিন্তু কি আর করি বলতো, আমি প্রোগ্রামের আইডিয়া দেবার কাজ করলেও তা তো অন্যান্যরা হবে কি হবে না, চলবে কি বন্ধ হবে তার দায়িত্বে থাকে । আর এখানে সরাসরি রাজনীতির প্রভাব, এখানে চ্যানেলের হেড এরও কিছু করার নেই ।” আবির কিছু বলল না । মাথা নিচু করে রইল । চয়নিকার বাবা বলল, “তবে যাই হোক, ওই প্রোগ্রাম থেকে অর্জিত টাকা দিয়ে তুমি যে নিজের বুদ্ধিমত্তার সাপেক্ষে একটা গার্মেন্টস খুলেছো, এটাও প্রশংসার যোগ্য । আর গার্মেন্টস থেকেও তুমি প্রচুর টাকা পাবে, যদিও আমি জানি, এ কাজটা তোমার অনেক পছন্দের একটা কাজ ছিল, তবুও । যাই হোক, আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন, এখন আসো, তোমার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলি । কবে থেকে ফ্রি আছো তুমি?” আবির একটু লজ্জা করে বলল, “ইয়ে মানে, নিজের বিয়ের ব্যাপারে নিজে কি আর বলবো, বাড়ির অন্যান্যরাও আসুক একসাথে পরামর্শ করি!” চয়নিকার বাবা  হেসে উঠে বলল, “হাহাহাহা! আচ্ছা । এই চুনি! অয়ন! জরিনা! কোথায় তোমরা! একটু এসো তো, পরামর্শ করবো! কই!” ডাক শুনে সবাই এলো রুমে ।




(২০৫)

চয়নিকা জিজ্ঞেস করলো, “কি হল বাবা কি হয়েছে?” চয়নিকার বাবা বলল, “তোদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলছি । আয় ।” অয়ন বলল, “আব্বু, আমার কিন্তু ব্লেজার লাগবে, আগের ব্লেজারটা পুরনো হয়ে গেছে ।” চয়নিকার বাবা বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, ওই ব্যাপারে পড়ে আসছি আগে………।” চয়নিকার বাবা কথা শেষ করার আগে চয়নিকা বলল, “আব্বু, আমার কিন্তু টকটকে লাল শাড়ি লাগবে বিয়ের জন্য, গাঢ় রঙ কিন্তু আমার ভালো লাগে না ।” চয়নিকার বাবা তখন বলল, “হয়েছে তোদের? তোরা  থামলে আমি এবার  শুরু করতে পারি কি?” জরিনা তখন বলল, “খালু, আমার  একখান কথা আছিলো ।”  চয়নিকার বাবা বলল, “হ্যাঁ অবশ্যই, বলো ।” “খালু, আপনেগো পরিবারের ব্যাপার, কিন্তু আমারে ডাইকলেন যে!” বলল জরিনা । চয়নিকার বাবা হেসে বলল, “আরে, তুমি তো আমাদের পরিবারেরই একজন, সুতরাং নো টেনশন, ডু পরামর্শ অফ আবির চুনি বিবাহ ।” বাকিরা একসাথে, “ইয়ে!!” বলে চেঁচিয়ে উঠলো । চয়নিকার বাবা বলল, “কাল আঁখি আর সাবিত আসবে, এই বিয়ের কটা দিন থাকবে ।” আবির তখন জিজ্ঞেস করলো, “আঙ্কেল, একটা  কথা জিজ্ঞেস করতাম যদি কিছু মনে না করেন ।” চয়নিকার বাবা ইয়ার্কি করে বলল, “হ্যাঁ বলো । এখন তুমিও জরিনার মতো কিছু বোলো না!” বলে হেসে উঠলো  চয়নিকার বাবা । আবির তখন বলল, “দেখুন আমি এতিম, মা বাবা ছাড়া ছোটবেলা থেকে আল্লাহর রহমতে কীভাবে এতোটাদুর এসেছি আমি নিজেও এটা মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হয়ে যাই ।” কিন্তু সম্পর্ক কেমন হয় এটা আমি জানি । মায়ের বোনকে খালা, মায়ের ভাইকে মামা, বাবার বোনকে ফুপি, বাবার  ভাইকে কাকু ডাকা হয়, আমি এতিম বলে কোনদিন কাউকে এসব ডাকিনি, কিন্তু এতগুলো বছর আমি এখানে আছি, কোনোদিন চুনির কোন কাকা কাকি, মামা মামি দেখিনি, এমনকি আঁখি আপুর বিয়ের  সময়ও আমি কাউকে আসতে দেখিনি । চুনি আমাকে বলেছিল ওর বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত ওর মা এখানে আসবেন না । সেজন্য ওর মা আসবেন না বা আসেন নি ধরে নিলাম । কিন্তু  আপনাদের আর সব আত্মীয়রা কোথায়?” চয়নিকার বাবা কিছু বলল না । একটু আগে উনার যে হাসিখুশি মুডটা  ছিল,  তাও মুহূর্তেই চলে  গেলো । চয়নিকা আবিরকে বলল, “আবির তোমাকে  আমি বলেছিলাম না, এসব কথা বিয়ের আগে প্লিজ তুলো না!”  আবির তখন বলল, “তুমি তো তোমার মায়ের কথা বলেছ!” চয়নিকা জবাব দিলো, “এটাও একই প্রসঙ্গ । খুশি এবার?” আবির কিছু বলল না । চুপ করে রইল । চয়নিকা বাবা রুম থেকে যেতে যেতে বলল, “এখন আমার মুড নেই । ওদের বিয়ের ব্যাপারে পড়ে কথা হবে ।” চয়নিকার বাবা রুম থেকে বেড়িয়ে যাবার পর একে একে অন্যান্যরাও রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো । আবির মনে মনে বলল, “কিছু একটা ঘটনা তো আছেই, যা এরা আমার কাছ থেকে লুকোচ্ছে!”

রাত ১টার দিকের  কথা । আবিরের ঘুম আসছিলো না দেখে আবির বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল । বাইরের জ্যোৎস্না রাতের চাঁদের আলো আবিরের শরীরের অর্ধেকটা আলোকিত করে রেখেছে । এমন সময় আবিরের মোবাইলে একটা কল এলো । এতো  রাতে  অচেনা একটা নাম্বার থেকে কল! একটু অবাক হল আবির । ফোন ধরে বলল, “হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন ।” ফোনের ওপাশ থেকে মাঝ বয়স্ক পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজ এলো, “ওয়ালাইকুম আসসালামু আলাইকুম । এটা কি দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো এর আবির?”

- “ জি, বাট আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না?”

- “আমি হাসান বলছি, বাড্ডা থেকে, আসলে এতো রাতে ফোন দেয়াটা আমার উচিৎ হয় নি, কিন্তু খুব টেনশনে ছিলাম সারাদিন ফোন দেবো কি দেবো না এই ভেবে । তার মধ্যে এতো সময় কেটে যাবে বুঝতেই পারিনি । আজকাল অনেকেই তো রাত জাগে, তাই ভাবলাম, আপনাকেও দিয়ে দেখি, যদি পাই আর কি ।” বলল হাসান নামের মাঝবয়সী লোক ।

- “জি বলুন, কি বলবেন ।” বলল আবির ।

- “আসলে আমি ফোনে কথা বলতে চাচ্ছি না, সামনাসামনি কথা হলে ভালো হতো ।” বলল হাসান ।

- “কি ব্যাপারে সেটা জানতে পারলে আমি যাওয়ার ব্যাপারে সম্মতি জানানোর ব্যাপার নিয়ে ভেবে দেখতে পারি ।” বলল আবির ।

“না আসলে………” বলে একটু থেমে লোকটা আবার বলল, “আপনি তো দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো তে শুধুই একজন উপস্থাপক ছিলেন, কিন্তু এও শুনেছি আপনি ভালো গোয়েন্দাগিরি বা ওই ইনভেস্টিগেশন করতে পারেন । আমারও এরকম একটা ব্যাপারে সাহায্য লাগতো আরকি ।” ইনভেস্টিগেশনের কথা শুনে আবির আর না করলো না । সরাসরি বলল, “কখন কোথায় দেখা করতে হবে?” ফোনের ওপাশ থেকে লোকটা বলল, “কাল সকালেই আসুন না, আমার বাড়িতেই, আমি মেসেজ করে ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিচ্ছি    ।” বলে লোকটা ফোন রেখে দিয়ে ঠিকানাটা  আবিরকে মেসেজ করে দিলো । এমন সময় পেছন থেকে কার যেন আওয়াজ এলো, “ভাই, ঘুমাবা না?” আবির পেছনে তাকিয়ে দেখল, অয়ন । আবির বলল, “ঘুম   আসছে না রে, তাই এখানে  দাঁড়িয়ে আছি ।”

- “টেনশন হচ্ছে, তাইনা?”  প্রশ্ন করলো অয়ন ।

- “আরে না না, কি ব্যাপারে টেনশন হতে যাবে ।” হালকা হেসে বলল আবির ।

- “আমি জানি, তখন বাবাকে যে কথা জিজ্ঞেস করেছিলে সেটা নিয়েই ভাবছ ।” বলল অয়ন ।

আবির কিছু বলল না, কারণ অয়ন ভুল বলে নি । একটু পর অয়ন আবিরকে বলল, “আমার মাথায়ও না এই একই প্রশ্ন  ছোটবেলা থেকে ঘুরপাক খায় মাথায় ।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “তুই কোনোদিন এই প্রশ্ন করিস নি ।” অয়ন বলল, “করেছিলাম তো, ওরা বলেছিল বড় হলে আমি সব জানতে পারবো, কিন্তু কবে যে বড় হবো এদের চোখে, আল্লাহই জানেন । আর তাছাড়াও আমারও মনে হয় এরা আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছে ।” আবির আর কিছু বলল না । চুপচাপ চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল ।




(২০৬)

অয়ন তখন জিজ্ঞেস করল, “কে ফোন করেছিলো?” আবির বলল, “এক লোক, চিনি না । কাল যেতে বলল উনার বাসায় কি একটা ইনভেস্টিগেশনের জন্য ।” অয়ন বলল, “আমাকে নিয়ে যাবে?” আবির একটু ভেবে বলল, “আচ্ছা, যাইস ।” 

পরদিন সকালের কথা ১০টা মতো বাজে । চয়নিকার বাবা অফিসে যাবার জন্য জুতো পড়তে পড়তে অয়নকে ডাকলো, “অয়ন! এই অয়ন!” জরিনা রান্নাঘর থেকে এসে চয়নিকার বাবাকে বলল, “ওরা তো বাড়িত নাই খালু, অয়ন ভাইয়া আবির ভাইয়ার লগে  কই জানি গেছে ।” চয়নিকার  বাবা  জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় গেছে, কিছু বলে গেছে কি?” জরিনা বলল, “না তো খালু, আমারে তো কিছুই কইয়া যায় নাই ।” চয়নিকার বাবা জুতো বাধা শেষ করে গায়ের শার্টটা একটু টেনে জরিনাকে বলল, “আচ্ছা শোন জরিনা, আজ দুপুরে তোমার আখি আপু আর সাবিত ভাইয়া আসবে, তুমি চুনিকে বাজারে পাঠিয়ে দিও, অয়নকেই পাঠাতাম, তা ও তো নেই ।” জরিনা বলল, “আমিই যামুনে খালু, চুনি আপা খালি খালি কষ্ট ক্যান করবো?” চয়নিকার বাবা বলল, “নানা, তুমি এমনিই বাসার কত কাজ করো, তোমার ওপর বাড়তি চাপ ফেলতে চাই না । আর তাছাড়া চুনিরও তো  বাইরে যেয়ে কাজ করার অভ্যাসটা করা উচিৎ, তাই না?” জরিনা কিছু বলল না । চয়নিকার বাবা জরিনার হাতে টাকা দিয়ে বলল, “নাও, এই টাকাটা রাখো, চুনি ঘুম থেকে  উঠলে পাঠিয়ে দিও বাজারে ।” জরিনা মাথা  ডানে কাত করে, “আইচ্ছা খালু ।” বলল শুধু ।

এদিকে আবির আর অয়ন এসেছে গতকালকের সেই লোকের দেয়া ঠিকানায় । দরজায় কলিংবেল  চাপতেই ভেতরে টিংটং আওয়াজ এলো । দরজা খুলল  মাঝবয়সী এক মহিলা । আবির বলল, “আসসালামু আলাইকুম, আমি, আবির ।” মহিলাটা দাঁত বের  করে হাসি আর খুশি একসাথে  মিশিয়ে  বলে উঠলো, “আরে! দ্যা ইনভেস্টিগেশনের আবির স্যার! আসুন আসুন, ভেতরে আসুন ।” আবির  আর অয়ন  ভেতরে  ঢুকল ।  আবির জিজ্ঞেস করলো, “আআআ………এই বাড়িতে হাসান নামে কেউ আছেন কি?”  মহিলাটা বলল, “হ্যাঁ! হ্যাঁ! উনি তো আমার স্বামী! আর আমি উনার স্ত্রী, রেহানা ।” আরও অনেক কথা বলতে বলতে রেহানা নামের মহিলা আবির  আর অয়নকে হাসান নামের  লোকটার ঘরে নিয়ে গেল । বলা চলে মধ্যবিত্ত একটা পরিবার । ঘরের আসবাব পত্রগুলোও সেই ধাচেরই । তবে যেভাবে ঘরগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে তাতে তাদের রুচির প্রশংসা করতে হয় । লোকটা এতক্ষন বিছানায় বেশ টেনশন নিয়ে বসে ছিল, আবির আর অয়নকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো । বছর ৫০ মত হবে, মাথার মাঝে চুল নেই, বয়সের ছাপ চেহারায় সেভাবে না পড়লেও দাঁড়ি আর সাইড দিয়ে থাকা চুলগুলোর ঠিকই প্রকাশ পেয়েছে । লোকটা আবিরকে সামনে থাকা একটা চেয়ারে বসতে বলল । তারপর  নিজের স্ত্রীকে বলল, “এই রেহানা, এই ছেলেটার জন্যও একটা চেয়ার  নিয়ে এসো ।” অয়নের জন্য বলল লোকটা । রেহানা চলে গেলো । আবির চেয়ারে  বসলো । হাসান নামের লোকটা বলল, “আমি গতকাল আপনাকে ফোন করেছিলাম, একটা ইনভেস্টিগেশনের কাজে, মনে আছে তো?” আবির বলল, “জি, মনে আছে । আপনি বলতে পারেন আপনার সমস্যা ।” লোকটা বলল, “আসলে ব্যাপারটা হল, আমার বয়স হয়েছে, এখনও তেমন না হলেও হচ্ছে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমার কাছে দিন দিন যা সব হুমকি আসছে, তাতে মনে হয় বয়স হবার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে ।” ততক্ষণে রেহানা নামের মহিলা চেয়ার এনে অয়নকে দিলো । অয়ন তাতে বসলো । আবির হাসানকে জিজ্ঞেস করল, “কিসের হুমকি?” লোকটা মোবাইলের কি যেন ঘাটাঘাটি করতে করতে বলল, “খুনের হুমকি, ১মিনিট ।” বলেই লোকটা মোবাইলে একটা অডিও রেকর্ড চালু করে দিল । সেখানে এক ঘেঁষা কণ্ঠের লোক বলছে, “হাসাইন্না রে! তরে যদি হাতের কাছে পাই! গলা টিপ্পা মাইরালামু ।” আবির তখন জিজ্ঞেস করলো, “সরাসরি খুনের হুমকি! কিন্তু,   আপনাকে ফোন করে এতো বড় একটা হুমকি দিলো, অথচ আপনি কিছুই বললেন না?” হাসান নামের লোকটা বলল, “কি করে বলব, ওরা তো হ্যালো বলার  আগেই এসব কথা বলে ফোন কেটে দিলো ।” আবির জিজ্ঞেস করল, “আপনার কি মনে হয় আপনি কি এমন কিছু করেছেন, যাতে আপনাকে কেউ হুমকি দিতে পারে?” হাসান বলল, “আমার জানামতে না ।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “আপনি পেশায় কি করেন?” হাসান জবাব দিলো, “এক সময় সাংবাদিক ছিলাম । সাংবাদিক তো সব ক্ষেত্রে সত্যটা প্রচার করতে পারে না, আমিও তার ব্যাতিক্রম ছিলাম না । কিন্তু এমন কিছু আমি করিনি যাতে আমাকে কেউ হুমকি দিতে পারে ।” আবির বলল, “আপনার ছেলে  মেয়ে কয়জন?” হাসান বলল, “আমার এক  ছেলে, বিয়ে করে এখন চিটাগাং থাকে, মাঝে মাঝে আসে । নৌ বাহিনীতে চাকরি করে ।” পাশেই রেহানা নামের মহিলা দারিয়ে ছিল । আবির ওই মহিলাকে প্রশ্ন করল, “আপনার কি মনে হয়, আপনি এমন কিছু করেছেন যার জন্য হয়তো কেউ আপনার স্বামীকে হুমকি দিচ্ছে?” রেহানা বলল, “না না, তা কেন করবো ।” আবির মনে মনে নিজেই নিজেকে বলল, “হুমম, ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখতে হবে ।”




(২০৭)

এর মধ্যে রেহানা নাস্তার দিয়ে এলো । ট্রে তে দুটো বাটিতে মিষ্টি, এক বাটিতে চানাচুর, এক বাটিতে বিস্কুট, পানি, কেটে রাখা পেয়ায়া । ঘরের এক পাশে রাখা একটা টি-টেবিলের ওপর রেখে আবির আর অয়নের সামনে এগিয়ে দিয়ে গেলো । আবির আতিথেয়তার খাতিরে বলল, “ইশ! আবার এগুলোর কি দরকার ছিল!” হাসান বলল, “আরে খাও খাও, তোমাদের আনটির বানানো মিষ্টি ।” অয়ন একটা মিষ্টি কাঁটাচামচে দিয়ে মুখে দিলো । তারপর বলল, “বাহ, দারুন হয়েছে তো!” রেহানা বলল, “আরেকটু দেবো বাবা?” অয়ন বলল, “না আনটি, আমার আবার ডাইবেটিস এর ভয় খুব ।” হাসান হেসে বলল, “হায়রে ছেলে, এই বয়সেই যদি ডাইবেটিস এর ভয় করো, তাহলে কি করে হবে? এই তো বয়স ফুর্তি করার ।” আবিরও হেসে বলল, “ওদের কি আর এসবে ফুর্তি আছে নাকি, ওদের ফুর্তিতো এখন ওই মোবাইলে, ল্যাপটপে ।” হাসান বলল, “একদম মনের কথাটা বলেছ । আমার ছেলেটা ঢাকায় আসে, অথচ তাও সারাদিন ওই ল্যাপটপ নিয়ে পড়ে থাকে ।” এমন সময় হাসানের মোবাইলে একটা ফোন এলো । ফোন ধরতেই ফোনের ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো, “ওই হাসাইন্না! লাভ নাই, তর মরন ঘনাইয়া আইছে! কোন টিভির উপস্থাপকরে ধইরা লাভ নাই, উল্টা তুই ওরে বিপদে ফালাইয়া দিলি!” লোকটা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো । আবির জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে?” হাসান বলল, “এজন্যই তোমাদের ডাকবো কি ডাকবো না এ নিয়ে টেনশনে ছিলাম ।” আবির জিজ্ঞেস করল, “কেন কি হয়েছে?” হাসান বলল, “ও এবার আমার সাথে সাথে  তোমাকেও হুমকি দিয়েছে!” অয়ন একটু ভয় পেলেও আবির একটুও ভয় পেলো না । কি যেন ভাবতে লাগলো । একটু থেমে তারপর বলল, “আচ্ছা, যা বুঝলাম, অপরাধী ২৪ ঘণ্টাই আপনার ওপর নজর  রাখছে ।” হাসান নামের লোকটা বলল, “তোমাদের চ্যানেলের সাংবাদিক সামির কাছ থেকে তোমার নাম্বার পেয়েছিলাম । আমার মনে হয় তোমাদের বিপদে ফেলে দিলাম ।” আবির বলল, “না, আমাদের ভয় নেই, আপনি সাবধানে থাকবেন, আর পারলে আপনাদের ছেলেকে ফ্যামিলি নিয়ে এখানে আসতে বলবেন, তাহলে যদি একটু সেইফ থাকতে পারেন ।” হাসান বলল, “আপনার পেয়েমেন্টটা কত যদি একটু বলতেন?” আবির হালকা  হেসে বলল, “আপনি তো আমাকে এবার  সত্যিই লজ্জায় ফেলে দিলেন, আমি লাইফে এই প্রথম গোয়েন্দাগিরির সাথে নিজেকে নিযুক্ত করছি, তাও আমি প্রোফেশনাল নই । পেয়েমেন্ট এর  ব্যাপারে কোন ধারনা নেই আমার ।” লোকটা তখন বলল, “তাহলে আমি হাজার ৫ দিলে……………।”  আবির বলল, “না, আমি একজন শখের গোয়েন্দা, টাকা লাগবে না, বলেছেন এতেই আমি খুশি ।” হাসান লোকটা আর কিছু বলল না ।

হাসানের  বিল্ডিং থেকে নেমে গাড়িতে যখন আবির আর অয়ন উঠলো, অয়ন তখন আবিরকে বলল, “ভাই, আমার কিন্তু খুব ভয় করছে ।” আবির বলল, “কেন? কি হয়েছে?” অয়ন বলল, “ওই যে, ওই লোকটা যে নিজের সাথে সাথে তোমাকেও বিপদে ফেললো, আর শুধু তুমি কেন, আমাদের পুরো ফ্যামিলিটাকেই তো বিপদে ফেললো ।” আবির হালকা হেসে বলল, “ভয় নেই রে পাগলা, তোর আবির দুলাভাই আছে না, সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ ।” অয়ন বলল, “ভাই সেটা আসল কথা না, সামনে তোমার আর চুনি আপুর বিয়ে, আমি চাইনা তোমাদের বিয়েতে কোন ঝামেলা হোক ।” আবির কিছু বলল না । কারণ ওরও জানা আছে যে যেকোনো সময় বিপদ চলে আসতে পারে । আবির তখন বলল, “ইশ! একটা কাজ করতে ভুলে গেলাম ।” বলে আবির মোবাইল ওপেন করে হাসানকে একটা কল করল । ফোন ধরতেই আবির বলল, “জি শুনুন, যে আপনাকে হুমকি দিচ্ছে, তার ফোন নাম্বারটা আমাকে দিতে পারবেন কি?” ফোনের ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো, “ওই লোক তো একেক সময় একেক নাম্বার থেকে কল করে, কোনটা দেবো?” আবির বলল, “আপনি সবগুলোই দিন, আর আপনার ছেলের ফোন নাম্বারটাও আমাকে দিন ।” লোকটা তখন বলল, “আমার ছেলের নাম্বার দিয়ে কি করবেন?” আবির বলল, “আপনি নিশ্চয়ই জানেন এসব ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট প্রমান ছাড়া কাউকেই অপরাধীর বাইরে ধরা যায় না!” লোকটা কিছুক্ষন ভেবে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, পাঠিয়ে দেবো ।” এরপর আবির ফোন কেটে দিলো । অয়ন জিজ্ঞেস করল, “উনার ছেলের নাম্বার দিয়ে কি করবে?” আবির বলল, “এমনি, কথায় আছে না, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দ্যাখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন ।” অয়ন আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার মনে হচ্ছে আমি ফেলুদার পাশে বসে আছি, আর নিজেকে তোপসে মনে হচ্ছে, শুধু একজন জটায়ুর জুটলে ষোল কলা পূর্ণ হবে ।” আবির অয়নের কথা শুনে হালকা হাসল, কিছু বলল না ।




(২০৮)

বাসার দিকে যাবার জন্য গাড়ি স্টার্ট করলো আবির । বাসার দিকে আসার পথে ওদের এলাকার বাজার পার হয়ে আসতে হয় । বাজারের মধ্য দিয়ে আসছিলো আবির এমন সময় অয়ন বলে উঠলো, “দাড়াও! দাড়াও!” আবির গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কিরে, কি হয়েছে?” অয়ন বাইরের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, “ওটা চুনি আপু না?” আবির অয়নের আঙ্গুলের দিক অনুযায়ী তাকিয়ে দেখল, একটা দোকানে চয়নিকা । আবির বলে উঠলো, “তাইতো! ও বাজারে কি করছে? ওর হাতে তো দেখি বাজারের ব্যাগ, তাহলে কি ও বাজার করতে এসেছে!” আবিরের কথা শুনে অয়ন হেসে বলল, “মানে সিরিয়াসলি! শেষ ক বছর আগে চুনি আপু বাজারে এসেছিলো আমার জানা নেই ।” অয়ন বলল, “চলতো একটু যেয়ে দেখি ।” আবির আর অয়ন চুপি চুপি যেয়ে চয়নিকা যে দোকানে দাড়িয়ে তার পাশের দোকানে যেয়ে দাঁড়ালো । তারপর শুনতে লাগলো চয়নিকা আর দোকানদারের কথোপকথন । চয়নিকা এতক্ষণ আলু, পটল, পেঁয়াজ এগুলো ধরে ধরে দেখছিল । মাত্র মুখ খুলল । হাতে তখন ওর একটা বেগুন । চয়নিকা বলে উঠলো, “আচ্ছা আঙ্কেল, ৭জনের খাওয়ার জন্য তরকারিতে কততা বেগুন লাগে?” দোকানদার  হেসে উঠে বলল, “এইডা কি কইলেন আপা! আপনেরা কুত্থানি খাইবেন তা মুই  ক্যামনে কমু?” চয়নিকা বলল, “কি জানি বাবা বুঝি না । বেশি নিলে যদি পচে যায়! আবার কম নিলে যদি কম পড়ে যায়! জানি না বাবা! আমাকেই কেন এই বাজারে পাঠাল ।  বলল আলু, পটল, বেগুন আদা আনতে, কতটুকু আনতে হবে তা আমাকে বলেও দিলো না, আমারও শুনে আসতে মনে নেই ।” দোকানদার বলল, “আপা কি এই পরথম আইসেন বাজারে?” চয়নিকা বলল, “না, অনেক আগে একবার এসেছিলাম একবার ।” দোকানদার তখন বলল, “তাইলে একখান কাম করেন, ৪ডা লইয়া যান, বাইচা গেলে ফিরিজে রাইক্ষা দিয়েন, না বাচলে তো আলহামদুলিল্লাহ্‌!” চয়নিকা একটু ভেবে বলল, “আচ্ছা দেন! আবির যে কোথায় গেলো! আল্লাহই জানেন ।” দোকানদার বলল, “আপনে দ্যা  ইনভেস্টিগেশন শো দ্যাহেন?” চয়নিকা বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু হঠাৎ এ কথা কেন?” “না, আপনে কইলেন আবির, ওই প্রোগ্রামে যেই লোক কথা কয়, উনিই তো আবির ।” চয়নিকা আর কিছু বলল না । একটু মাথায় ভুত চাপল নিজেকে সেলিব্রেটি ভাবার, তাই ওর মন চাইল বলতে ও ওই আবিরের হবু স্ত্রী, অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলো কথাটা ও বলবে, হাসিমুখে যেই না কথাটা চয়নিকা বলতে যাবে, এমন সময় পাশের দোকানদার চেচিয়ে  উঠলো, “আরি আল্লাহ! এ আফনি সালমান খান আবির ভাই না?” আবির ওই দোকানদারের দিকে তাকাল । চয়নিকা তাকিয়ে দেখল আবির অয়ন দাঁড়িয়ে আবিরও দোকানদারের থেকে চোখ সরিয়ে চয়নিকার দিকে তাকাল । চয়নিকা ভ্রু কুচকে বলে উঠলো, “আবির! অয়ন! তোমরা এখানে কি করছো!” এরই মধ্যে চয়নিকা যে দোকানে ছিল, সেই দোকানদার বেগুন দেয়া বাদ দিয়ে আবিরের কাছে গেলো । চয়নিকা দোকানদারকে বলল, “আরে বেগুন তো দিয়ে যান!” কিন্তু দোকানদার শুনল না । আবিরের চারপাশে ইতোমধ্যে ছোটখাট ভির জমে গেছে । সবাই আবিরের সাথে সেলফি তোলায় ব্যাস্ত । চয়নিকা রাগ করেই দোকান থেকে চলে গেলো ।

একটু পরই বাড়ি ফিরল ওরা । চয়নিকা প্রথমে, তারপর অয়ন, অয়নের সাথে সাথেই আবির । চয়নিকার চেহারায় বিরক্তির ছাপ আবির আর অয়ন মুচকি হাসছে । চয়নিকা বাজারের ব্যাগ রান্নাঘরে রেখে নিজের  রুমে চলে গেলো । আবির আর অয়ন রুমে যেয়ে ঢুকল । অয়ন বিছানার ওপর শুয়ে হাহা করে  হাসতে লাগলো । আবির বিছানায় বসলো । ওর মুখেও হাসি, তবে অয়নের মতো অট্টহাসি নেই । শার্টের বোতাম একটা দুটো খুলছিলো আবির এমন সময় ওর  চোখ গেলো  রুমের কর্নারের দিকে । গতকালকে দারয়ানের মেয়ের  দেয়া  সেই কাগজের পাখিটা মেঝেতে পড়ে আছে । কিন্তু এটা কি করে হয়? কর্নার তো কাচ দিয়ে আটকানো, কেউ না খুললে পড়ে যাবার সম্ভাবনাই নেই, আর তাছাড়া কেউ তো ওতে হাতও লাগায় না । আবির কাছে এগিয়ে গেলো । কাগজের পাখিটা হাতে নিয়ে দেখল, কেউ এর ভাজ খুলেছিল এবং এ ঘটনার খুব বেশিক্ষণ হয় নি । কারণ বেরনোর আগেও আবির পাখিটাকে দেখেছে যেরকম দারোয়ান দিয়েছিলো সেরকম । অয়নের হাসি থেমেছে ততক্ষনে । ও উঠে বসে আবিরের দিকে তাকাল । বলে উঠলো, “কি হয়েছে ভাই?” আবির কোন জবাব দিলো না । আবির ভাজটা আবার খুলল । দেখল, ভেতরে লেখা, “হাসানের কেসটা হাতে নিস না, তোর পরিবারের সবাইরে কিন্তু আমি মাইরা ফালামু! জানান দিয়া গেলাম, তর বাড়ির ঠিকানা যাইনা গেছি!”  অয়ন উঠে  দাড়িয়ে আবিরের দিকে আসছে টের পেয়ে আবির আবার তাড়াতাড়ি কাগজের পাখিটা ভাজ করে আবার পাখির মত করল । অয়ন কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে ভাই?” আবির বলল, “না, পাখিটা এখানে পড়ে আছে, তাই তুলতে এলাম । আমাদের কোম্পানির দারোয়ানের মেয়ে বানিয়েছে আমার জন্য, সুন্দর না?” অয়ন বলল, “হুম খুব সুন্দর ।” আবির অয়নকে আসল কথাটা বলল না আর । কাগজের পাখিটা কর্নারে রেখে দিলো ।




(২০৯)

রাতের কথা । ৯টা বাজতে  আর মাত্র ২মিনিট বাকি । টিভিতে শুরু হবে “দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো । পরে তো আর দেখা হবে না নতুন পর্ব, তাই শেষ ৩টা পর্ব দেখে মনের কষ্ট একটু মেটাতে চায় । ৯টা বাজতেই শুরু হয়ে গেলো প্রোগ্রাম কিন্তু একি! এতো দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো না! দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো এর শুরুতে যে মিউজিক হতো এটা সেই মিউজিক না । সবাই টিভির দিকে তাকিয়ে । এতো টকশো হচ্ছে! তাহলে কি আবিরের সেই অনুষ্ঠান দেখানো হবে না? আবির ফোন করলো দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো এর ডিরেক্টরকে । ফোন ধরতেই ফোনের ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো, “আমি ব্যাস্ত পরে কথা বলছি!” ডিরেক্টর ফোন কাটার আগেই আবির বলল, “১টা মিনিট প্লিজ! দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো চলছে না কেন?” ডিরেক্টর বলল, “ওটা আর প্রচারিত হবে না ।” আবির বলল, “কিন্তু আমি যে ৩টার শুটিং করলাম!” ডিরেক্টর বলল, “ওগুলো ডিলিট করে দেয়া হয়েছে । দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো আর হবে না । বাই ।” বলে ফোন কেটে দিলো আবির । কিছু বলল না । রাগ করে নিজের রুমে চলে গেলো ।

রাত ১১টার  দিকের কথা । বারান্দায় বসে ছিল আবির । অয়ন মোবাইল চালাচ্ছিল । এমন সময় মোবাইলে কি একটা  দেখে আবিরের কাছে এনে আবিরের  হাতে  দিয়ে বলল, “আবির ভাই, দ্যাখো, দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো এবং যে চ্যানেলে হতো তার ফেসবুক পেইজে সবাই কমেন্ট করে ভরে ফেলেছে ।” আবির অয়নের হাত থেকে মোবাইল নিলো । স্ক্রুল করে দেখতে লাগলো । কেউ লিখেছে এই টিভি চ্যানেল বয়কট করবে, কেউ লিখেছে এই শো চালু করার জন্য দরকার হলে রাস্তায় নামবে, অনেকে আবার আসল কারণটাও লিখেছে । হয়তো কোথাও থেকে খোজ পেয়েছে । আবির কিছু না বলে অয়নের হাতে মোবাইল দিয়ে দিলো । অয়ন বলল, “আবির ভাই,  পাবলিক এখন খেপেছে । দেখো, তোমার এই শো আবার চালু হবেই!” আবির হালকা হেসে বলল, “ওরা চালু করলেই কি আর আমি যাচ্ছি নাকি ।” অয়ন তখন জিজ্ঞেস করলো, “কেন?” “ওরা আমাকে তাড়িয়ে  দিয়েছে, এক প্রকার অপমান বলা চলে এটাকে, আমার কি মান সম্মান বলে কিছুই নেই? যারা আমাকে অপমান করেছে তাদের কাছেই আবার ফিরে যাবো?” অয়ন কিছু বলল না । একটু থেমে অয়ন জিজ্ঞেস করলো, “ঘুমোবে না?” আবির বলল, “তুই শুয়ে পড়, আমি আসছি ।” বলে আবির রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো ।

আজ আখি আর সাবিত আসতে পারে নি । কি একটা কাজে আটকে গেছে । রাতে আখির বাবা বিছানায় শুয়ে ছিল, সে সময় আখির কল এলো । আখির বাবা ফোন ধরল । বলল, “হ্যাঁ মা বল ।” আখি ফোনের ওপাশ থেকে বলল, “বাবা, ঝামেলা হয়েছে একটা ।” বাবা জিজ্ঞেস করলো, “কি ঝামেলা?” আখি বলল, “পাশের বাসার আনটি বোধহয় কোনভাবে চুনি আর আবিরের বিয়ের কথা জেনে গেছে । মা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল আবিরকে বলেছি কি না চুনির কথাটা, কিন্তু আমি যখন বললাম না বলিনি, মা তখনই রাগ করলো । অনেক বোঝালাম, কিন্তু মা বুঝল না । অবশেষে মা ডিসিশন নিয়েছেন বিয়ের আগেই মা চলে আসবেন । এখন কি করবা বলো ।” আখির বাবা মাথার ঘাম মুছতে মুছতে বলল, “হায় আল্লাহ! কি বলছিস এসব! তুই আমাকে টেনশনে ফেলে দিলি!” আখি বলল, “বাবা, টেনশনের কিছু নেই, এখন  কাজের কাজ একটাই, মা আসার আগেই চুনি আর আবিরের বিয়ে যেভাবেই হোক, দিয়ে দিতে হবে ।” আখির বাবা বলল, “আমি তো চাইছিলাম শনিবার গায়ে হলুদ করিয়ে রবিবার বিয়েটা দিয়ে দিতে, বউভাত না হয় সোমবার করা যাবে, যদিও আবিরের পরিবারের কেউ নেই, কিন্তু সমস্যা হল, তোর মা যদি তার আগেই উটকো ঝামেলাটা নিয়ে আসে! সব তো নষ্ট হয়ে যাবে! চুনির জন্য তাও পাত্র পেয়েছিলাম, আর পাবো কি না সন্দেহ ।” আখি বলল, “যা করার তাড়াতাড়ি করো, বেশি লোক ডাকার দরকার নাই, আর কালই তো তোমরা শপিং এ যাবা, না?” আখির বাবা বলল, “হ্যাঁ ।” আখি বলল, “তাহলে এক কাজ করো, শুক্রবারই আবির আর চুনির গায়ে হলুদ দিয়ে শনিবারই বিয়ের ব্যাবস্থা করো । আমি আর সাবিত কাল চলে আসবো । আজ তো সাবিতের অফিসের একটা জরুরী মিটিং-এর জন্য যেতে পারলাম না ।” আখির বাবা বলল, “হ্যাঁ, দেখি কি ব্যাবস্থা করা যায় ।” “আসবো আঙ্কেল?” কথা শুনে চমকে পেছন ফিরে তাকালো আখির বাবা । দেখল, দাড়িয়ে আবির । আবির কি তাহলে সব শুনে ফেললো! আখির বাবার কপাল বেয়ে ভয়ে ঘাম ঝরতে লাগলো ।




(২১০)

চয়নিকার বাবা কিছু বলার আগেই আবির বলল, “আঙ্কেল, আপনি এতো রাতে জেগে আছেন? কিছু হয়েছে কি? কার সাথে কথা কথা বলছিলেন?” চয়নিকার বাবা বলল, “না, আসলে, আখি ফোন দিয়েছিলো, তোমার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে ।” আবির হালকা হেসে বলল, “ও, তাই বলুন । তা আখি আপু আর সাবিত ভাই কাল আসছেন তো?” চয়নিকার বাবা মনে মনে বলল, “তার মানে আবির কিছু  শোনে নি!”  তারপর আবিরের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে বলল, “আরে তোমার আর চুনির বিয়ে আর ওরা আসবে না?” আবিরও হালকা হাসল । তারপর বলল, “শুয়ে পড়ুন আঙ্কেল, আপনি তো সাধারণত এরকম রাত জাগেন না ।” চয়নিকার বাবা বলল, “আরে যাও, মাঝে মাঝে এরকম রাত জাগা হয়-ই, আর তাছাড়া সামনে তোমার বিয়ে, একটু টেনশন তো আছেই ।” আবির আর কিছু বলল না, চলে এলো সেখান থেকে ।

রাত ১টার দিকের কথা । বারান্দায় বসে আবির । আকাশের চাঁদ আজ মেঘের নিচে ঢাকা পড়েছে । হঠাৎ করে পায়েল আর ইফাজের কথা মনে পড়ছে খুব । সাথে দ্বীপের কথাও । আল্লাহই জানেন ছেলেটা কোথায় আছে, কি করছে, আদৌ বেঁচে আছে, নাকি মা-বাবার কাছে চলে গেছে আল্লাহই ভাল জানেন । তারপর আবিরের মনে পড়লো ওই মূর্তিটার কথা, যে মূর্তির আসল মানুষগুলো ওকে ছোটবেলা থেকে মানুষ করেছে । এরাও ওর আসল মা-বাবা না । এখনও আবির একজনের বাড়িতে রয়েছে, তাদের আশ্রয়ে বড় হচ্ছে । আর স্কুল লাইফটা তো কেটেছে আশ্রমেই, আশ্রমের কতো বন্ধু ছিল, তাদের সাথে আজ আর যোগাযোগ নেই । আবিরও ওদের খোঁজ নেয় না, ওরাও আবিরের  খোঁজ নেয় না । আবির ভাবতে লাগলো, জীবনটা কি  অদ্ভুত! একসময় সবাইকে বলতো কাউকে ভুলবে না, অথচ এখন সবাইকে ভুলে গেছে । বিশেষ করে রাজ । হঠাৎ রাজের কথা মনে পড়তেই আবিরের মনে পড়ে গেলো সেই বিস্ফোরণের দিনের কথা! রাজ ফোন দিয়েছিলো বলে আবির দাড়িয়ে গিয়েছিলো! আবির যদি না দাঁড়াতো, তাহলে হয়তো বিস্ফোরণ থেকে সবাইকে বাঁচাতে পারতো । আচ্ছা আসলেই কি বাঁচাতে পারতো? কে জানে । বেচারা রেস্টুরেন্টের মানুষগুলো হয়তো ছড়িয়ে পড়া গ্যাসের গন্ধ বুঝতে পারে নি । ইফাজ কিংবা পায়েল হয়তো বুঝেছিল, হয়তো বোঝে নি, হয়তোবা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব ঘটে  গেছে । এসব পুরনো নানা ধরনের কথা ভাবতে ভাবতে আবির মোবাইল ওপেন করলো । একটা আনরিড মেসেজ । আবির ওপেন করলো সেটা । আবির দেখল, সকালে হাসান পাঠিয়েছিলেন সেই হাসানকে হুমকি দেয়া লোকের নাম্বার । ৬-৭ টা নাম্বারের পর  একটা নাম্বারের পাশে স্পেশালভাবে লিখে দেয়া, “আমার ছেলে ।” আবির একেকটা নাম্বারে ফোন দিতে লাগলো ।

পরদিন সকালের কথা । আবির, চয়নিকা, অয়ন আর চয়নিকার বাবা এসেছে ট্রিল্ড শপিংমলে বিয়ের শপিং করতে । এখানেই আখি আর সাবিত আসবে বলে জানিয়েছে তারপর সবাই একসাথে বাসায় যাবে । চয়নিকা বাবার সাথে একটা দোকানের পাশে শাড়ি দেখছিল । আবির আর অয়ন ছেলেদের এপাশে শেরওয়ানী দেখছিলো । অয়ন একটা কালো পাঞ্জাবী আবিরকে দেখিয়ে বলল, “ভাই! জোস লাগতেছে না!” আবির বলল, “পছন্দ হলে নিয়ে নে ।” অয়ন বলল, “পাগল! দাম দেখছো! সাড়ে তিন হাজার । আব্বু ১হাজারের ওপরে উঠবে কি না সন্দেহ ।” আবির বলল, “তাহলে এক কাজ কর, তোর বাবার টাকা দিয়ে তো একটা পাবিই, এইটাও নিয়ে নে আমার টাকা দিয়ে ।” অয়নের ঠোটের কোণে বেশ একটা হাসি দেখা  গেলো । তারপর আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “সত্যি?” আবির বলল, “বাহ, তোকে মনে হয় কিছু দেই-ই না!” অয়ন বলল, আরে ভাই! কিযে বলো না । থ্যাংক ইউ অ্যান্ড লাভ ইউ!” আবির বলল, “হয়েছে, আর ঢং করা লাগবে না ।” আবির একবার চয়নিকার দিকে তাকাল । দেখল, একটা শাড়ি নিয়ে ট্রায়াল রুমে যাচ্ছে । চয়নিকা ট্রায়াল রুমের দিকে যাচ্ছে, আর আবির চয়নিকার দিকে তাকিয়েই আছে । “আবির! অয়ন!” এমন সময় একটা ডাক শুনে সামনের দিকে চোখ গেলো আবিরের । তাকিয়ে দেখল, আখি আর সাবিত একসাথে আসছে । অয়ন “আখি আপু!” বলে দৌড়ে আপুর কাছে গেলো । আবিরও হাঁটতে হাঁটতে গেলো ওদের কাছে । আখি অয়নকে দেখে বলল, “কিরে, কেমন আছিস?” অয়ন বলল, “আছি ভালো । তুমি কেমন আছো?” আখি বলল ভাল । সাবিত আবিরকে দেখে বলল, “ইয়ো হবু জামাই,  কি অবস্থা?” “এইতো ভাই, চলতেছে আরকি । তোমার কি খবর?” সাবিত চোখ দিয়ে ইশারা করে আঁখিকে দেখিয়ে বলল, “বিয়ের পর টের পাবা, কেমন থাকা হয় ।” আবির আর অয়ন হেসে উঠলো । আখি বলল, “এই, তুমি কি বললা? শিওর চোখ দিয়ে আমার দিকে ইশারা করছো, না?” সাবিত বলল, “ইয়ে মানে, এই তুমি না বললা তোমার সালোয়ার কামিজ লাগবে, চল কিনে দেই?” আখি বলল, “বা বা! এতো ভাল হলা কবে?” সাবিত আবার আবিরকে বলল, “শিখে নাও, শিখে নাও, বিয়ের পর ঠাণ্ডা করার এসব টেকনিক কাজে লাগবে ।” আবির আর অয়ন আবার হেসে উঠলো । আখি রেগে গিয়ে বলল, “বাসার চলো! আজকে তোমারে ভাত দেয় কে দেখবো আমি ।” আবির বলল, “হইছে, এবার তোমরা থামো । এবার………………।” “আআআআ………………………।” হঠাৎ একটা চিৎকারের আওয়াজ শুনে কথা শেষ করতে পারল না আবির । গলাটা চয়নিকার, আর আওয়াজটা এসেছে ট্রায়াল রুম থেকে ।




(২১১)

আবির এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে পা দৌড় দিলো ট্রায়াল রুমের দিকে । আখি, অয়ন আর সাবিতও গেলো সেদিকে । চয়নিকার বাবাও  চিৎকার শুনে সেদিকে যেতে লাগলো । আবির ট্রায়াল রুমের দরজার কাছে আসতেই চয়নিকা তাড়াতাড়ি করে বেড়িয়ে আবিরকে জড়িয়ে ধরল আর বলতে লাগলো, “আবির!!......... আবির!!......... ভেতরে!!......... ও!!......।” আবির চয়নিকার কথা  শুনে চমকে উঠলো । চয়নিকা এতোটাই ভয় পেয়েছে  পুরো কথা বলতে পারছে না । আবির চয়নিকাকে  বাবার কাছে যেতে বলে ট্রায়াল রুমের দরজার দিকে  গেলো । চয়নিকা বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো । আবির ট্রায়াল রুমের দরজার পাশেই একটা হ্যাঙ্গার পেলো,  সেটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে দরজার দিকে  হাত বাড়াল । তারপর  দরজায় হাতের স্পর্শ পড়তেই আবির দরজায় ধাক্কা দিয়ে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে দাঁড়ালো কিন্তু ভেতরে তো কেউ নেই! তাহলে? আবির চয়নিকাকে জিজ্ঞেস করলো, “চুনি, কিছুই তো নেই!” চয়নিকা কাঁদতে কাদতেই রাগ দেখিয়ে  জবাব দিলো, “নিচে তেলাপোকা দেখতে পাচ্ছ না!” আবির নিচে তাকিয়ে দেখল, একটা তেলাপোকা । তারপর চয়নিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি এর জন্য চিৎকার দিয়েছো?” চয়নিকা বলল, “এগুলো কি ভয়ানক  জানো!” চয়নিকার কথা শুনে আবির ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পড়ে যায় যায় অবস্থা । অয়ন তো হাসাহাসি করা শুরু, সাথে তাল মিলিয়ে সাবিতও । চয়নিকার বাবা চয়নিকাকে বলল, “চুনি! এই তোর আক্কেল?” আখি বলল, “এই মেয়েরে নিয়ে যে কিভাবে তুমি এতোগুলা বছর কাটাইছো আল্লাহই জানেন!” আবির সাবিতকে বলল, “ভাই, তুমি তো বিয়ের পরের জ্বালার ব্যাপারে সাবধানতা জানিয়েছিলে, এখন তো দেখছি বিয়ের আগেই শুরু!” সাবিত বলল, “তাহলে বোঝ অবস্থা, তোর আখি আপুকে নিয়ে কিভাবে………” কথা আর শেষ করলো না সাবিত । তাকিয়ে দেখল আখি ওর দিকে রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে । সাবিত মুচকি হাসল কেবল, কিছু বলল না ।

দুপুরের দিকে সবাই বাসায় এলো । জরিনা ঘর গুছিয়ে রেখেছে । ঘরে আসতেই জরিনা সবাইকে লেবুর শরবত এনে দিলো । আখি জিজ্ঞেস করলো, “কি খবর জরিনা আপু, কেমন আছেন?” জরিনা বলল, “হ আফা, ভালা । আফনেরা ভালো আছেন?” আখি বলল, “হ আফা, ভালো ।” চয়নিকার বাবা তখন একটা ব্যাগ জরিনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও জরিনা, এই শাড়িটা তোমার জন্য ।” জরিনা বলল, “হায় আল্লাহ! এইডা আবার ক্যান আনছেন খালু, আফনেরা গত বছরই তো দিছিলেন একখান জামা ।” চয়নিকা বলল, “আরে আপু! এটা আমার বিয়ের জন্য । তুমি এই শাড়িটা পড়ে এলে আমি খুব খুশি হবো । আসবেনা?” জরিনা হাসিমুখে জবাব দিলো, হ আফা, অবশ্যই আমুনে । দাঁড়ান আমি আফনেগো খাওয়ার ব্যাবস্থা করিগা ।” বলেই জরিনা চলে গেলো । আখি বাবাকে, “বাবা, আমরা রুমে যেয়ে ড্রেসটা চেঞ্জ করে আসি ।” বলে রুমে গেলো । সাথে সাবিতও । ওর বাবাও রুমে গেলো ড্রেস চেঞ্জ করতে চয়নিকাও রুমের দিকে যাচ্ছিল, আবির তখন চয়নিকাকে শুনিয়ে শুনিয়ে অয়নকে বলল, “অয়ন, তুই না সেদিন চুনির ঘরে ৭টা তেলাপোকা দেখেছিলি?” আবিরের কথা শুনে চয়নিকা দাঁড়িয়ে গেলো । অয়ন বুঝতে পারলো আবির চয়নিকার সাথে মজা করছে । তাই আবিরের সাথে তাল মিলিয়ে চয়নিকাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, “হ্যাঁ তো, এইতো কাল রাতেই তো দেখলাম! কি বড় বড়, দুটো বোধ হয় উড়তেও পারে ।” চয়নিকা পেছন ফিরে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল, “হয়েছে! আর ভয় দেখানো লাগবে না! যত্তসব!” বলেই চয়নিকা চলে গেলো নিজের রুমে । আবির আর অয়ন হাসতে লাগলো ।

দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে চয়নিকা ছিলো নিজের রুমে, চয়নিকার বাবাও নিজের রুমে পেপার পড়ছিলো, আখি আর সাবিত ছিল ছাদে, জরিনা টিভি দেখছিলো, আর অয়ন ভার্সিটিতে । আবির নিজের রুমে শুয়ে কি যেন কাজ করছিলো, হঠাৎ একটা কল এলো ওর মোবাইলে । আবির দেখল, চয়নিকা কল করেছে । আবির কল ধরতেই একটা আতংক মিশ্রিত গলায় চয়নিকা বলল, “আবির একটু আমার রুমে আসতে পারবা?” আবির হালকা হেসে বলল, “কেন, আবার কি তেলাপোকা দেখলে নাকি?” চয়নিকা বলল, “না না, অন্য একটা ব্যাপার ।” আবির বলল, “আচ্ছা, আসছি ।” আবির চয়নিকার ঘরের যাবার জন্য রুম থেকে বেরোল । চয়নিকার রুমের দিকে যাচ্ছিলো, এমন সময় জরিনার সাথে দেখা আবিরের । জরিনা আবিরকে বলল, “ভাইয়া, আপনের লগে একটু কথা ছিল ।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “হুম বলেন কি কথা ।” জরিনা  তখন বলল, “ভাইয়া, গতকাইল একখান ফকির আইছিলো, আমি ওই ফকিররে চাউল দেয়ার লাইগা রান্নাঘরে আইছি, আর দেহি ওই ফকির আপনের ঘরে ঢুইকা পড়ছে! আমির ওই ফকিররে চেক করছি কিছু চুরি টুরি করছে কি না, কিছু করে নাই দেইহা ছাইড়া দিছিলাম । আইজকা আবার আমি চয়নিকা আফার রুম পরিষ্কার করার লাইগা উনার রুমে যেইনা আইলাম, ওমনি কেডা জানি জানালা থেইকা সইরা গেলো । মানে জানালা দিয়া উকি দিয়া কি জানি দেখতেছিল । আমি চেক করলাম, তয় কিছু চুরি টুরি করে নাই । আবির বলল, “এই কথা আগে জানান কি কেন?” জরিনা বলল, “গতদিনের কথা বলতে ভুইলা গেছিলাম, আর আইজকার কথা আফনেরেই খালি জানাইলাম, আর সবাইরে কইলে ভয় পাইতে পারে এই জন্যে ।  আফনে তো গোয়েন্দার মতোন, আফনে হয়তো কিছু সমাধান করতে পারবেন ।” আবির বুঝতে পারলো। গতকালকের কাগজের লেখা হুমকি বার্তা হয়তো সেই ফকিরই লিখে গিয়েছিলো । আবির জরিনাকে বলল, “অনেক ধন্যবাদ, আপনি যান তাহলে, আর কাউকে এসব বলার দরকার নেই ।” বলে আবির চয়নিকার রুমের দিকে যেতে লাগলো, আর জরিনা টিভির রুমে গেলো ।




(২১২)

আবির চয়নিকার রুমে ঢুকতেই দেখল, চয়নিকা একটা কাগজে কি যেন পড়ছে আবিরকে ঢুকতে দেখেই কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে আবিরের দিকে তাকাল । আবির চয়নিকার কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?” চয়নিকা হাতের কাগজটা আবিরের হাতে দিয়ে বলল, “দ্যাখো, কেউ আমাদের হুমকি দিচ্ছে । পড়ে দ্যাখো, কি লেখা ।” আবির কাগজটা হাতে নিলো । দেখল, তাতে লেখা, “তুই এহনও এই কাম করতেছোস! গতকাইল রাইতে তুই নাম্বারগুলায় ট্রাই করছোস! ভালোয় ভালোয় কইতাছি! সইরা যা এইসব ঝামেলা থেইকা । নাইলে তর বউ বিয়ার আগেই বিধবা হইয়া যাইবো!” আবির অবাক হয়ে গেলো । গতকাল আবির ফোন করেছিলো যতোগুলো নাম্বারে, সবগুলোর সুইচড অফ পেয়েছিলো । তাহলে যে এসব হুমকি দিচ্ছে, সে জানলো কি করে তাকে কল দেয়া হয়েছে! তবে কি আবিরের বিল্ডিঙ্গের চারপাশে হুমকিদাতা ঘুরে বেড়াচ্ছে? চয়নিকার বিয়ের জন্য বিল্ডিং-এর বাহিরটা রঙ করা হচ্ছে নতুন করে । রঙ করার জন্য যে মই তা সে সময় চয়নিকার জানালার সামনেই ছিল, যেখানে উঠেই হুমকিদাতা হয়তো  কাগজটা দিয়েছে, কিন্তু জানলো কি করে কল দেয়ার ব্যাপারটা? আবিরের চেহারার মধ্যে চিন্তার ছাপ  ফুটে ওঠায় ভয়  পেয়ে গেলো চয়নিকা । জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে আবির? তুমি কিসের সাথে জড়িয়ে গেছো?” আবির চেহারায় হাসি এনে চয়নিকার দুই কাধে হাত রেখে বলল, “কিচ্ছু হবে না, চিন্তা  কোরো না । এসব কিছুই না, কেউ হয়তো আমাদের সাথে মজা করেছে ।” চয়নিকার চেহারা থেকে ভয় কিন্তু গেলো না । সেই ভয়ের মাঝেও হালকা রেগে চয়নিকা বলল, “এটা কোন ধরণের মজা আবির! আমাদের বিয়ের আগে এসব কি হচ্ছে? তুমি কিসের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছো?” আবির  কোন  জবাব  দিলো  না, চয়নিকার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলো ।  একটু থেমে চয়নিকা বলল, “আবির, আমার মনে হয়, তুমি আমাদের কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছো!” আবির চয়নিকার কাধ থেকে  হাত সরিয়ে নিলো । তারপর বলল, “তোমরাও তো আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছো, আমি কি তার জবাব পাবো?” চয়নিকা মাথা নিচু করলো । আবির বলল, “তোমাদের গোপন কথা জানতে আমাকে আগে যেহেতু কাগজে কলমে তোমার স্বামী হতে হবে, তাই আমার গোপন কথা জানতে আগে তোমাকে কাগজে কলমে আমার স্ত্রী হতে হতে হবে, কথাটা মাথায় রেখো ।” বলেই  রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো আবির ।

সন্ধ্যায় আবির গেলো হাসানের বাড়ি । আবিরের কথাগুলো শুনে হাসান মাথা নিচু করে বলল, “হুম, আমার এখন সত্যি খুব খারাপ লাগছে । আমি তোমাদের পরিবারকে বিপদে ফেলে দিলাম বোধ হয় ।” আবির কিছু বলল না । চুপচাপ বসে বসে কি যেন ভাবতে লাগলো । হাসান নামের লোকটা তখন জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, সব নাম্বারে কল  করার পর তুমি আমাকে  মেসেজ দিয়েছিলে, সেখানে লিখেছিলে সব নাম্বার বন্ধ, কিন্তু আমার ছেলের নাম্বার তো বন্ধ থাকার কথা না!” আবির বলল, “আপনার ছেলেকে ফোন দেই নি । এমনিই অনেক রাত ছিল, আমি চাইনি আপনার ছেলেকে ডিস্টার্ব করতে ।” হাসান কিছু বলল না । আবিরও চুপ  হয়ে গেলো । হাসানের স্ত্রী এরই মধ্যে নাস্তা নিয়ে এলো ।  তারপর আবিরকে বলল, “দ্যাখো তো বাবা, এই বুড়ো বয়সে আমরা দুই বুড়ো বুড়ি ছেলেপেলে ছাড়া থাকি । এসব হুমকি নিয়ে কি শেষ এই বয়সগুলো শান্তিতে থাকা যায়?” আবির বলল, “হুম, আমি একটা সমাধান পেয়েছি ।” হাসান ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো, “সমাধান পেয়েছো?” আবির বলল, “হুম। আপনি কি স্মার্টফোন ইউজ করেন?” হাসান বলল, “হ্যাঁ কেন?” “আপনার মোবাইলে কি আপনার এবং আপনার স্ত্রীর কোন ছবি আছে?” জিজ্ঞেস করলো আবির । হাসান বলল, “হ্যাঁ আছে তো!” আবির বলল, “সেগুলো দিন আমাকে ।” হাসান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ছবি দিয়ে তদন্ত?” আবির বলল, হুম ।” আপনি ছবিগুলো দিন । লোকটা একটু অবাক হল । তারপর ছবি শেয়ার করার অ্যাপ ওপেন করে আবিরের মোবাইল কানেক্ট হবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো । অনেক্ষণ হয়ে গেলো আবিরের মোবাইল কানেক্ট হচ্ছে না । আবির বলল, “ও, আমার মোবাইলে একটু সমস্যা আছে । আমার কাছে দিন ফোনটা, আমি কানেক্ট করে নিচ্ছি ।” লোকটা আবিরের হাতে মোবাইল দিলো । আবির অনেক্ষন ধরে কাজ করতে করতে লোকটার সাথে কিছু কথাবার্তা বলতে বলতে প্রায় আধ ঘণ্টা কাটিয়ে দিলো । তারপর আবির লোকটার হাতে মোবাইল দিয়ে বলল, “হয়ে গেছে । এবার হুমকিদাতা শিওর ধরা পড়বে ।” বলে আবির বিদায় নিয়ে চলে এলো ।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ৭টা মতো বেজে গেলো । আবির ঘরে ঢুকেই দেখলো, চয়নিকার বাবা পায়চারি করছে ঘরের ভেতর বাইরের দরজার সামনে । আবিরকে দেখেই উনি আবিরের  সামনে এসে বলল, “আবির!  তোমার কি কাণ্ডজ্ঞান নেই? কাল তোমার গায়ে গায়ে হলুদ আর আজ তুমি বাসায় নেই!” আবির ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো, “কাল গায়ে হলুদ! আপনি তো শনিবার গায়ে হলুদ করার প্ল্যান করেছিলেন!” চয়নিকার বাবা বলল, “করেছিলাম, কিন্তু শিওর হবে তা কিন্তু বলিনি । এখন কাল গায়ে হলুদ শিওর তোমাকে জানালাম, রেডি থেকো । আজ আমারও দোষ ছিল যদিও, তোমাকে জানানো হয় নি  । যাও রুমে যেয়ে  ফ্রেশ হয়ে নাও ।” বলে চয়নিকার বাবা নিজের রুমে চলে গেলো । আবিরও কি যেন ভাবতে ভাবতে নিজের রুমে চলে গেলো ।





(২১৩)

অয়ন বসে বসে মোবাইল চালাচ্ছিল, আবিরকে দেখেই  উঠে এসে বলল, “আরে দুলাভাই!” কোথায় ছিলে?” আবির হালকা হেসে বলল, “কাজে ।” অয়ন বলল, “সেই হাসান আঙ্কেলের হুমকিদাতার খোঁজে?” আবির নিজের ঠোঁটের সামনে তর্জনী ঠেকিয়ে বলল, “আস্তে কথা বল কেউ যেন জানতে না পারে ।” অয়ন তখন ফিসফিসিয়ে বলল, “আচ্ছা, আস্তেই বলছি । এবার বল, কেইস এর দরজা কদ্দুর খুলল ।” আবির বলল, “খেলা এখনও জমে নি সেভাবে, জমলে তোকে জানাবো ।” অয়ন এবার না ফিসফিসিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বলল, “আচ্ছা ওসব বাদ । কাল তো গায়ে হলুদ, ফিলিংস কি?” আবির বলল, “গায়ে হলুদ লাগাবে, কেমন আর ফিলিংস থাকবে ।” অয়ন বলল, “আজ আর কালকের রাতটাই তুমি আমার সাথে আছো তারপর থেকে তো চুনি আপুর সাথে ঘুমাবে । রাতে আর কারো সাথে মারামারি, কাথা নিয়ে কাড়াকাড়ি, বালিশ ছোড়াছুড়ি হবে না । আবির অয়নের মাথায় আদর করে বলল, “ওরে, টেনশন করিস না । আমি তো বাসায়ই আছি নাকি!” অয়ন বলল, “তা আর কদিন । সামনের মাসেই তো ভাড়া বাসায় চলে যাবে । আর যাই হোক, বিয়ের পর মেয়ে তো বাবার বাসায় থাকে না ।” আবির বলল, “আচ্ছা যা, আমি এই বিল্ডিঙের সামনের বাসাটাই ভাড়া নেবো । হ্যাপি?” অয়ন বলল, “তাও, যাকগে, ব্যাপার না । তোমাদের থাকার জন্য একটা বাড়ি বানাবে বলেছিলে, সেটার কি খবর?” আবির বলল, “জায়গা দেখেছি বেশ কয়েকটা । পছন্দ হলেই বাড়ি বানানোর কাজ শুরু করবো ।” অয়ন আর কিছু বলল না । আবির মোবাইলে কি যেন দেখতে দেখতে বারান্দায় চলে গেলো ।

পরদিনের কথা । আজ বাড়িতে একটা  উৎসবমুখোর পরিবেশ । সবাই বেশ মজা করছে আবিরকে  হলুদ দেবার জন্য আনা হয়েছে ছাদে । চয়নিকাকে ঘরেই একটা রুম ফাকা করে গায়ে হলুদ দেয়া হচ্ছে । বিল্ডিং কিছু লোকজন এসেছে । চয়নিকার কিছু বান্ধবী এসেছে, আবিরের গার্মেন্টসের লোকেরা এসেছে, আবিরের টিভি শো-এর ওখানে পরিচিত লোকেরা এসেছে ।  এদের দিয়েই পুরো বাড়ি যেন ভরে গেছে আজ তো তাও কম এসেছে, কাল আরও আসবে, যেহেতু কাল বিয়ে । সবাই আবিরকে গায়ে হলুদ দিচ্ছে, এদিকে চয়নিকাকে গায়ে হলুদ দিচ্ছে । আবির বার বার মোবাইলে কি যেন দেখছে । আবিরের অফিসের সংবাদ পাঠক সামি যখন আবিরকে হলুদ দিতে এলো আবির উনার সাথে কথা বলতে লাগলো, “ভাই, আপনার  সাথে কথা ছিল ।” সামি বলল, “হুম বল, কি বলবি ।” আবির বলল, “আপনার পরিচিত একজন আছে না, কল সেন্টারে কাজ করে?” সামি বলল, “হুম, কেন?” আবির বলল, “আমি আপনাকে  একটা নাম্বার দেবো । তার বাসা কোথায় সেই ডিটেইলসটা আমার লাগবে ।” সামি বলল, “নাম্বারটা দে, দুই মিনিটের মধ্যে আমি তোকে জানাচ্ছি ।” বলে আবির নাম্বারটা মেসেজ করে দিলো সামিকে । কথা বলার মাঝেই সামি আবিরকে হলুদ দেয়া সহ আর যা যা করার করলো । মিনিট পাচেক পর সামি আবিরকে একটা  মেসেজ করলো, “এর বাসা মিরপুরে ।” সাথে কোন গলি, কত  নং বাসা তাও লিখে দিয়েছে সামি । আর নামটাও  লিখেছে । নাম, আনিস । আবির সামিকে মেসেজ করে লিখল, “আরেকটা হেল্প করুন, আপনার অপু নামের পুলিশ অফিসার যিনি আছেন উনার নাম্বারটা একটু দিন । লাগবে ।”

বিকেলের দিকে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হল । ড্রইংরুমে সবাই বসে বিয়ের প্ল্যানিং করছিলো । বিয়েটা একটা কমিউনিটি সেন্টারে হবে । সবাই যখন প্ল্যানিং করছিলো, তখন সবাই দেখল, আবির গেঞ্জি গায়ে দিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে । চয়নিকার বাবা  জিজ্ঞেস করলো, “আবির, কোথায় যাচ্ছো?” আবির, “কাজ আছে ।” বলেই আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়েই বেড়িয়ে চলে গেলো । চয়নিকার বাবা বলল, “না, এই ছেলেটা কি যে করে না, কাল বিয়ে, আর আজ কি করতে বেরোল, আল্লাহই জানেন ।” তারপর সেখানে বসে থাকা সবাইকে “তোমরা প্ল্যান ট্যান করো, আমি যাই, একটু রুমে যেয়ে রেস্ট নেই ।” বলেই চয়নিকার বাবা নিজের  রুমে চলে গেলো । আখিও সবাইকে বলল, “তোরা কথা বার্তা  বল আমিও একটু আসছি ।” বলে চলে  গেলো আখি । চয়নিকা মন খারাপ করে বলল, “ধুর! মজাটাই নষ্ট হয়ে গেলো ।” জরিনা তখন বলল, “আমাগো গেরামের মেলা ভুতের গল্প আছে, হুনবা নাকি?” অয়ন বলে উঠলো, “সত্যি! শুরু করেন আপু!” সাবিত বলল, “লাইটটা অফ করে দেই, অন্ধকারে শুনতে আরও মজা  লাগবে ।” চয়নিকা বলল, “না, আমার ভয় লাগে ।” জরিনা বলল, “তার চেয়ে চল ছাদে যাই, ওইহানে হুনতে বেশি মজা পাইবা ।” সবাই তখন সম্মতি  জানালো । জরিনা, “তোমরা যাও, আমি তোমাগো লাইগা নাস্তার লইয়া আইতাছি ।” বলে জরিনা রান্নাঘরের দিকে গেলো,  আর বাকিরা ছাদের দিকে গেলো ।




(২১৪)

“আসবো আব্বু?” বাবার দরজার সামনে এসে বলল আখি । আখির বাবা বলল, “আয় মা, আয় ভেতরে ।”

আখি ভেতরে ঢুকল । বাবা জিজ্ঞেস করলো, “তোর মায়ের আসার খবর কি?” আখি বলল, “মা আজ রাতে রওনা হবেন । বাংলাদেশের সময় অনুযায়ী অনেক রাতে ।” হিসেব করলে দেখা যায় সকাল ১০টা মতো বাজতে পারে এয়ারপোর্ট-এ আসতে । তার চেয়ে একটু কম সময়ও লাগতে পারে, কিন্তু বেশি লাগবে না । যদিও ভরসা এই এয়ারপোর্ট-এ চেকিং, আর নানা কাজ করে এখানে আসতে আসতে হয়তো ১ঘণ্টা মতো লাগবে । চয়নিকার বাবা বলল, “আমি কাজি সাহেবকেও কাল সকাল ১০টায় আসতে বলেছি ।” সময় মতো সব হলে বাচি ।

রাত ১১টার দিকের কথা । আবির এখনও  বাসায় ফেরেনি । টেনশনে চয়নিকার বাবা বসে আছেন বাইরের  দরজার সামনে । অপেক্ষা করছে আবিরের আসবার । চয়নিকা রুমেই ছিল, বিরক্ত হয়ে আখি চয়নিকার রুমে যেয়ে বলল, “কিরে? আবির কোথায়?” চয়নিকা  উঠে বিছানায় শুয়ে  ছিল । উঠে বসে বলল, “কি জানি, ও সেই যে গেলো, আর তো এলো না ।” আখি বলল, “নিজের স্বামীকে বিয়ের আগেই সামলাতে পারছিস না! বিয়ের পর কি হবে?” চয়নিকা বলল, “জানি না । তবে আবির কিছু একটা করছে এটা শিওর । সম্ভবত আমাদের কাছ থেকে ও সেটা লুকোতে চাচ্ছে ।” আখি বলল, “কি লুকায় এতো ও? অনাথ ছেলেপেলের লুকানোর কি আছে? ভাগ্যক্রমে আমাদের বাড়ির জামাই হতে চলেছে তো, ভাবটা যেন একটু বেশিই দেখাচ্ছে । তুই ওকে জিজ্ঞেস করতে পারলি না কোথায় যায়?” চয়নিকা বলল, “করেছিলাম ।”

- “কি জবাব দিয়েছে?”  জিজ্ঞেস করলো আখি ।

- “বলেছে, আমরাও ওর কাছে কিছু লুকোচ্ছি, এটা ওকে যখন জানাই নি, তখন ও নিজেও ওর কথাটা আমাদের বলবে না ।” বলল চয়নিকা ।

- “সাহস কত্ত বড়! আজকে আসুক বাসায় । ফোনটও ধরছে না । কি করছে আল্লাহই জানেন ।”

কথাটি বলে রুম থেকে যেই না চয়নিকা বেরোতে যাবে, অমনি চয়নিকা বলে উঠলো, “আমরা ওর সাথে যা করছি, এটা কি আমাদের উচিত হবে?”

“আচ্ছা, তোদের পরিবারে কিছু ঝামেলা আছে কি?”  অয়নের রুমে অয়নকে জিজ্ঞেস করলো সাবিত ।

- “হয়তোবা আছে, কিন্তু ঠিক কি সেই ঝামেলা, তা আমার জানা নেই ।” বলল অয়ন ।

- “ঝামেলা যে আছে সেটা তো আমিও বুঝেছিলাম । নেহাত আঁখিকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি বলে, না হলে এতো ঝামেলাওয়ালা একটা বাড়িতে বোধ হয় বিয়ে করতাম না ।” বলল সাবিত ।

- “তুমি কখনও আখি আপুকে জিজ্ঞেস করেছো কি ঝামেলা আছে?” জিজ্ঞেস করলো অয়ন ।

- “তা তো কতবার জিজ্ঞেস করেছি । শেষ জিজ্ঞেস করেছিলাম গত মাসেরই শেষের দিকে । আমাকে বলেছিল সেটা চুনির বিয়ের পর আমাকে জানাবে । তুই কখনও জিজ্ঞেস করিস নি?” বলল সাবিত ।

- “করেছি তো, কিন্তু জবাব একটাই পেয়েছি, বড় হ জানতে পারবি । কিন্তু কবে যে সেই কথা শোনার মতো বয়স আমার হবে আল্লাহই জানেন ।” বলল অয়ন ।

- “হুম । আমার সন্দেহ শুরু হয় বিয়ের দিন থেকেই, একটা মেয়ের বিয়েতে মেহমান থাকবে না এটা কোন কথা? যা মেহমান এসেছিলো, তাদের একজনও তোদের রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় না । কেউ ভাড়াটিয়া, কেউ অফিস কলিগ । আচ্ছা, আত্মীয় না আসুক, অ্যাট লিস্ট মা, উনি তো আসবেন, কিন্তু তাও না । আমার বাসার সবাই হয়তো না করে দিত, কিন্তু আমি আঁখিকে ভালবাসতাম বলে মুখ খোলেন নি ।” বলল সাবিত ।

- “আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করেছো?” জিজ্ঞেস করলো অয়ন ।

- “কি?”

- “চুনি আপু আর আবির ভাই-এর বিয়ের জন্য একটু বেশিই তাড়াহুড়া করছে । শপিং এর পরদিনই গায়ে হলুদ । এটা কোন ধরণের কথা?” হালকা ক্ষোভ নিয়ে বলল অয়ন । অয়নের কোথায় সায় দিয়ে ওপর নিচ মাথা নাড়ল ।

“এই! হারামজাদী! দোষ করেছিস নিজে আর এখন বড় বড় কথা না!” চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রাগান্মিত স্বরে চয়নিকাকে বলল আখি । চয়নিকা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “কিন্তু আমার ভুলের শাস্তি কেন অন্য কেউ পাবে? আমি যে আজ থেকে……………।” চয়নিকার কথা শেষ হতে না হতেই চয়নিকার মুখ চেপে ধরল আখি । তারপর বলল, “চুপ! একদম চুপ! একটা কথাও বলবি না! কাল বিয়ের আগ পর্যন্ত যদি মুখ খুলিস, তাহলে তোর আর কোন জন্মে বিয়ে হয় আমি দেখবো । ভাগ্য করে একটা  পেয়েছিলি । বাবা তো বাসায় ছেলেই আসতে দিতো না, একে তো দিয়েছে, তাও তোকে বিয়ে করার জন্য এ রাজি হয়েছে জেনেই তো বাবা খুশি । আর কোন দিন তোর মতো নষ্ট মেয়ের জন্য ছেলে বাবা পাবে কি না সন্দেহ । তাই তোর ভালোর জন্যই বলছি, চুপ হয়ে যা ।” চয়নিকা আর কিচ্ছু বলল না । নীরবে কাঁদতে লাগলো ।

হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো চয়নিকার বাবা । আবির এসেছে । আবিরকে দেখেই চয়নিকার বাবা জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় ছিলে!” আবির হালকা হাসবার চেষ্টা করে বলল, “ইয়ে মানে আঙ্কেল, একটা………কাজ ছিল……।” চয়নিকার বাবা ধমকের স্বরে বলল, “বিয়ের আগের রাতে কি কাজ তোমার!” আবির বলল, “সরি মাফ করবেন আঙ্কেল, আমি বলতে পারবো না ।” চয়নিকার বাবা গলার জোর আর বাড়িয়ে বলল, “কেন পারবে না! কি এতো গোপন কাজ তোমার যে আমাদের বলা যাবে  না! কি লুকোচ্ছ তুমি আমাদের কাছ থেকে?” আবির এতক্ষণ বিনয়ের সাথে জবাব দিচ্ছিল । এখন একটু মেজাজ দেখিয়ে বলল, “আপনারাও তো আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছেন!”





(২১৫) 

চয়নিকার বাবা থেমে গেলো । তার বলার কিছু বাকি রইল না । আখি আবিরের কথা বলার সময় রুমের দরজার কাছেই ছিল । আবিরের কথা শুনে রাগ দেখিয়ে আবিরের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, “এই বদমাইশ ছেলে! যে লোকটা তোমাকে আশ্রয় দিয়েছে, তার মুখে মুখে এতো বড় বড় কথা বলছো!” আবির বলল, “একটু ভুল বললেন আখি আপু, আমি মোটেও উনার মুখে মুখে উনাকে অসম্মান করে কথাগুলো বলিনি । আমি কখনই হয়তো এ বাড়িতে আসতাম না যদি না উনি আমকে আশ্রয় দিতেন । আমি কিন্তু নিজে থেকে আসি নি । যদিও আমি উনার প্রতি এজন্য অনেক কৃতজ্ঞ, উনি আমার লাইফে যা দিয়েছেন তার ঋণ আমি কখনই শোধ করতে পারবো না । কিন্তু তার মানে এই নয়, আমার গোপনীয়তাও উনার কাছে প্রকাশ করতে হবে । আমি শুধু উনাকে এটাই বুঝিয়েছি উনার গোপনীয়তার যেমন দাম রয়েছে, তেমনি আমারও গোপনীয়তার দাম রয়েছে । আর কথাটা আমি উনার জামাই হিসেবে বলিনি, একজন মানুষ হিসেবে বলেছি । আশা করি একজন মানুষের একান্তই গোপন কথা জোরপূর্বক জানতে চাওয়ার অধিকার উনি রাখেন না!” আখি তখন ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, “অনাথ বস্তর ছেলে একটা! এতো বড় বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে দেখে ভাব বেড়ে গেছে খুব না!” আবির হালকা হেসে বলল, “তাই, এটাই মনে হয় আপনাদের? চুনিকে ভালোবেসেছিলাম বলেই বিয়েটা আমি করছি, নয়তো আপনাদের পরিবারের কিছু একটা গোলমালের জন্য আমি কখনই রাজি হতাম না । আমি আপনাদের পরিবারের গোপনীয়তার প্রতি সম্মান রেখে কিছু জিজ্ঞেস করিনি আপনাদের । আর আজ যদি আপনাদের তাই মনে হয়, যে আমি আপনাদের পরিবারে এসে নিজের ভাব বাড়িয়েছি……।” একটু থেমে আবির বলল, “তাহলে নির্দ্বিধায় বিয়েটা ক্যানসেল করতে পারেন । ভালোবাসা হতে পারে, কিন্তু সম্মান হারিয়ে বিয়ে আমি করতে রাজি নই ।” বলে আবির রুমের দিকে গেলো । আখি ওর বাবাকে বলল, “দেখেছো বাবা, কত বড় বড় কথা বলছে আজকাল! সেদিন যদি তুমি ওকে বাড়িতে না আনতে না, তাহলেই বোধ হয় সব ঠিক হতো ।” চয়নিকার বাবা বলল, “না রে মা, কিচ্ছু ঠিক হতো না । আবির কিন্তু  ঠিক-ই বলেছে, আমাদের পরিবারের গোলমালের ব্যাপারটা আঁচ করতে পারা সত্ত্বেও ও চুনিকে ভালোবাসে বলে বিয়েটা করছে । আর কোন ছেলে হলে কি করত বিয়েটা?” আখি একটু চুপ থেকে বলল, “আমার আর কিচ্ছু ভাল্লাগছে না ।” বলেই আখি নিজের রুমে  চলে গেলো ।

এদিকে আবির নিজের রুমে এসে বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো । অয়ন টেবিলে বসে কি যেন লিখছিল, আবিরকে এভাবে বসতে দেখে  উঠে আবিরের পাশে এলো । তারপর জিজ্ঞেস করলো, “আবির ভাই, কি হয়েছে?” আবির কিছু বলল না । অয়ন আবারও জিজ্ঞেস করলো, “ভাই, ঠিক আছো?” আবির বলল, “হ্যাঁ ঠিক আছি ।” অয়ন জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় গিয়েছিলে তুমি?” আবির বলল, “তোর তো বোঝা উচিৎ, কোথায় গিয়েছিলাম ।” অয়ন একটু ভেবে বলল, “ও হ্যাঁ! মনে পড়েছে, তা অপরাধী পেলে?” আবির বলল, “শুধু অপরাধী না, আসল কারণও জানতে পেরেছি ।” অয়ন জিজ্ঞেস করলো, “কি কারণ?” আবির বলল, “আজ না, কাল বলবো । কাল একটা দারুন নাটক হবে ওই হাসানের বাড়িতে । তুই আমার সাথে যাবি ।” অয়ন জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু কাল না তোমার বিয়ে?” আবির বিছানায় শুয়ে বলল, “হুম… ওটাই তো আসল ঝামেলা । কবুল বলে তাড়াতাড়ি রীতিনীতি সেরে তারপর আমায় যেতে হবে সেখানে । কিন্তু কাহিনী ঘটার সাথে সাথেই সবটা করতে হবে আমাকে ।” অয়ন আর কিছু বলল না । তবে চেহারা দেখে বেশ বুঝতে পারছে ও আগামী কালকের জন্য বেশ উৎসাহিত ।

“আসবো বাবা?” বাবার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল চয়নিকা । চয়নিকার বাবা বলল, “আয় মা, ভেতরে আয় ।” চয়নিকা ভেতরে ঢুকল । চয়নিকার বাবা বিছানায় বসে ছিল । চয়নিকা বাবার পাশে যেয়ে বসলো । চয়নিকা বলল, “বাবা, আমার মনটা কেমন যেন কু-ডাক ডাকছে । আর তাছাড়া বিয়ের পর তোমাকে ছেড়ে থাকতেও খুব খারাপ লাগছে ।” চয়নিকার বাবা মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলল, “মন খারাপের কি আছে মা, প্রতিটা মেয়েরই এরকম একটা দিন আসেই, আর তাছাড়া তোর বিয়ে হলে তোর মা আবার আমার কাছে ফিরে আসবে, তখন আমরা দুজন একসাথে বেশ শেষ বয়সটা কাটিয়ে দিতে পারবো ।” চয়নিকা জিজ্ঞেস করলো, “মনে আছে বাবা, ছোটবেলায় আমি যখন তোমার আঙ্গুলটা শক্ত করে ধরে রাখতাম, তুমি আমায় বলতে, হাত ছাড়িস না কখনোই । আমিও তোমার হাত ছাড়তাম না । ভয় হতো, নিজে হারিয়ে যাবার ভয় না, বাবা যদি হারিয়ে যায়, আজ সেই তোমাকে ছেড়ে অন্য বাড়িতে চলে যেতে হবে আমাকে । তাই খুব খারাপ লাগছে ।” চয়নিকার বাবা হালকা হেসে বলল, “ওরে পাগলী! বিয়ে করা মানেই কি বাবার হাত ছেড়ে দেয়া নাকি? বিয়ে মানে নতুন কারো সাথে ঘর করা । তার মানে এই না যে সে বাবার হাত ছেড়ে দেয় । তুই তো আমার সাথে প্রায়ই দেখা করতে আসবি, তাহলে এতো টেনশন কেন করছিস?” চয়নিকা বলল, “টেনশন আরেকটা ব্যাপারেও আছে ।” “কি ব্যাপারে?” জিজ্ঞেস করলো চয়নিকার বাবা । চয়নিকা জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা বাবা, আমি আমার অতীতকে সঙ্গে নিয়ে সুখী হতে পারবো তো?”





(২১৬)

চয়নিকার বাবা কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে রইল । চয়নিকা তখন জিজ্ঞেস করলো, “কিছু বলো বাবা!” চয়নিকার বাবা মাথা উচু করে হালকা হেসে বলল, “শোন, অতীত তো অতীত-ই । কেউ ভুল করলে সেটা  ততোক্ষন পর্যন্ত ভুল থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত সে ওই ভুল স্বীকার না করে এবং নিজেকে শুধরে নেবার প্রতিজ্ঞা না করে । তুই তোর ভুল স্বীকার করেছিস, নিজেকে শুধরেও নিয়েছিস । সুতরাং তোর ভুলটা এখন তোর জন্য আর ভুল নেই । আল্লাহর কাছে ক্ষমা চা, আল্লাহও মাফ করে দেবেন তোকে ।” চয়নিকা বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে  লাগলো । চয়নিকার বাবা চয়নিকাকে শান্তনা দিতে লাগলেন ঠিক-ই কিন্তু মনে মনে তিনিও মেয়ে কাল চলে যাবে দেখে কষ্টে আছেন ।

“জি, আপনাকে কিন্তু অবশ্যই দরকার……………আপনি যেভাবে সাহায্য করলেন, এটা সত্যিই আমার খুব উপকার করলো……………জি, ঘটনা ঘটা মাত্রই আমি আপনাকে জানিয়ে দেবো ।…………হ্যাঁ হ্যাঁ, বিয়েতে আসতে ভুলবেন না……………থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ।” বলেই মোবাইল কেটে কি যেন কাজ করতে লাগলো আবির । অয়ন আবিরের কথা শুনে ঘুম থেকে উঠে পড়লো । পাশে থাকা মোবাইল নিয়ে দেখল, রাত ২টা বাজে । অয়ন বারান্দায় গেলো । আবির অয়নকে দেখে বলল, “সরি রে, আমার কথায় তোর ঘুম ভেঙ্গে গেলো বোধ হয় ।” অয়ন বলল, “না না ভাই, সমস্যা নেই । কিন্তু তুমি এতো রাত অবধি জেগে আছো কেন?” আবির বলল, “আরে এমনি একটু কাজ ছিল ।” অয়ন জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু কাল না তোমার বিয়ে? এতো রাত জাগলে কাল ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যাবে তো ।” আবির বলল, “তুই চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে । যা তুই ঘুমিয়ে পর ।” অয়ন তখন জিজ্ঞেস করলো, “কার সাথে কথা বললে?” আবির বলল, “একজন পুলিশ অফিসারের সাথে । অপু নাম ।” অয়ন একটু ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “পুলিশ! আবির ভাই! ঘটনা পুলিশ অবধি গড়িয়েছে!” “কেন, তাতে কি হয়েছে?” “ভাই, যাই করো, এমন কিছু কোরো না, যাতে রিস্ক রয়েছে । আমার মনে হচ্ছে এই ঘটনার মধ্যে কিছু একটা গণ্ডগোল আছে । প্লিজ ভাই, এমন কিছু কোরো না, যাতে বিয়েতে কোন গণ্ডগোল হয় ।” আবির হালকা হেসে বলল, “বাহ, তুই-ও দেখছি তোর বাবার মতো কথা বলছিস, যাকগে, তোদের পরিবারের গণ্ডগোলের ব্যাপারে যেহেতু জানিস না, তাই তোকে কিছু বললাম না । তবে এটুকু তোর ভয় কাটানোর জন্য জানিয়ে রাখি, রিস্কের যেটুকু ছিল, তা আজ-ই হয়ে গেছে, পরবর্তী কাজে এক ফোঁটাও রিস্ক নেই । অপুও আমাদের সাথে কাজ করেছেন । বাই দ্যা ওয়ে, উনি আমার সমবয়সী বলেই নাম ধরে ডাকলাম ।” অয়ন জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে আজ?” “কাল-ই সবটা জানতে পারবি, আরেকটু ধৈর্য ধর ।”

সকাল শুরু হতেই বিয়ের আয়োজন শুরু । সকালেই সবাই কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে গেলো । আবির, বর যেখানে বসার সেখানে বসেছে । সকাল ৯টা ৩০ মতো বাজে । মেহমানের প্রায় ৯০শতাংশ এসে গেছে, আরও অল্প কজন বাকি আছে । চয়নিকার বাবা আখির সাথে দাঁড়িয়ে । দুজনে কথা বলছে, এমনভাবে বলছে যেন আশেপাশে কেউ শুনতে না পারে । আঁখিকে জিজ্ঞেস করলো, “তোর বান্ধবী কি খবর দিলো?” আখি বলল, “১০টার আশেপাশে ল্যান্ড করবে বিমান বাবা ।”

“কি বলছিস তুই! হুজুরও তো ওই সময়ই আসবে ।” অবাক হয়ে বলল ওর বাবা ।

“চিন্তা কোরো না বাবা । মায়ের এয়ারপোর্ট-এ কাজ করতে করতে আর এখানে আসতে আসতে ১ঘণ্টা মতো লেগে যাবে । ততোক্ষণে বিয়ে শেষ হয়ে যাবে ।” বলল আখি ।

“হুম, তাও আগে তো বাসায় যাবে, কোন কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে হচ্ছে তা তো আর জানে না । এতে আরও আধ ঘণ্টা মতো দেরি হতে হতে পারে । মানে আবিরের বিয়ে হবার পরও আরও দেড় ঘণ্টা মতো সময় পাচ্ছি আমরা । এর মধ্যেই মেহমান সরানোর চেষ্টা করতে হবে । আর আই হোক মেহমানদের সামনে এসব কথা বলা যাবে না।” বলল আখির বাবা ।

এমন সময় চয়নিকাদের পাশের বাসার আন্টি এলো দাওয়াতে । এসেই আখি আর ওর বাবার কাছে এলো । তারপর বলল, “আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন আপনারা?”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম, আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো আছি ভাবি, আপনি আসতে দেরি করলেন যে ভাবি?” জিজ্ঞেস করলো চয়নিকার বাবা ।

“না আসলে আমি ভাবলাম চয়নিকার মা এসেছে । পড়ে শুনলাম এখনও পৌঁছেয় নি । আমি উনার জন্য বৃথা অপেক্ষা করছিলাম । উনি আসবেন কখন?” জিজ্ঞেস করলো পাশের বাসার আন্টি ।

“আসবে, আন্টি, আসলে মাকে সঠিকভাবে কমিউনিটি সেন্টারের নামটা বলা হয় নি তো, আসলে আমরাও সেভাবে শিওর ছিলাম না, তাই হয়তো মা আগে বাসায় যাবে তারপর এখানে আসবে ।” বলল আখি ।

“আরে না না, আমি উনাকে কমিউনিটি সেন্টারের ঠিকানাটা বলেছি । উনি বলেছেন এয়ারপোর্ট থেকেই এখানে আসবেন ।” বলল পাশের বাসার আন্টি ।

আখি আর ওর বাবা একে অপরের দিকে তাকাল । দুজনেই একটু টেনশনে পড়ে গেলো । একটু পর আখির বাবা পাশের বাসার ভাবিকে একটা রুম দেখিয়ে বলল, “ভাবি, ওই রুমে যান, চয়নিকা আছে, দেখে আসুন ।” মহিলাটা হালকা হেসে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ওটাই জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম চয়নিকা কোথায় । যাই তাহলে ।” বলেই সেই মহিলা চয়নিকাকে দেখতে চলে গেলেন । আখির বাবা জিজ্ঞেস করলো, “এবার কি হবে?” আখি বলল, “চিন্তা কোরো না বাবা । হাতে তাও এক ঘণ্টা সময় আছে ।” ওর বাবা ওপর নিচ মাথা নাড়ল শুধু কিছু বলল না ।




(২১৭)

“তা আবির বাবা, কেমন লাগছে?” আবিরের পাশে বসে বলল সাবিত । আবির হালকা হেসে বলল, “বোরিং ।” সাবিত ভ্রু-কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “বোরিং! কিন্তু কেন?” আবির বলল, “কি যে বলেন ভাই, এমনে কতক্ষণ বসে থাকা যায় বলেন ।” সাবিত বলল, “একটু ড্যান্স করা চলবে নাকি?” আবির জিজ্ঞেস করলো, “ড্যান্স!” সাবিত একটু হেসে অয়নকে ডেকে বলল, “অয়ন মিউজিক!” এরপর অয়ন একটা সাউন্ড বক্সে গান ছাড়ল ।

“আজ বিয়ে বাড়ির সিন নাচে গানে মেডিসিন…………” 

আবির খুব খুশি হল ব্যাপারটা দেখে । যদিও আবিরের অর্ধেকটা  মন পড়ে আছে হাসানের সেই কেইসের দিকে । কিন্তু আবির যেই না ভালো করে নাচে মনোযোগ দিলো, অমনি ওর মনোযোগের প্রায় পুরোটাই যেন নাচের দিকে চলে গেলো । প্রায় ৩০-৩৫ জন তাল মেলাচ্ছে, তাদের সামনে নাচ্ছে তিনজন মেইন ড্যান্সার হিসেবে । একদম ডানে সাবিত নাচছে, একদম বামে নাচছে অয়ন । কিন্তু মাঝের মেয়েটা কে?

চয়নিকার বাবা বাইরে থেকে গান শুনে আঁখিকে জিজ্ঞেস করলো, “গান বাজছে কিসের?” আখি বলল, “ভেতরে আবিরের সামনে সবাই মজা করে নাচছে ।”

“সবাই মানে?” জিজ্ঞেস করলো আখির বাবা । 

“সবাই মানে, অয়ন সাবিত ওরা ।” বলল আখি ।

আখির বাবা হেসে উঠলো । জিজ্ঞেস করলো, “মেয়ে কণ্ঠের গানে ছেলেরা নাচছে?” আখি বলল, “না না, তোমার ছেলের গার্লফ্রেন্ড নাচছে ।” আখির বাবার হাসি থেমে গেলো । জিজ্ঞেস করলো, “কি! অয়নও গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলেছে!” আখি বলল, “ও, তুমি তো আবার জানো না । যদিও ও কাউকে বলতে চায় নি, ওর গার্লফ্রেন্ড-ই আমাদের সব বলেছে ।”

নাচ শেষ । আশেপাশের সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো । অয়ন সাবিত আর মাঝের মেয়েটা এগিয়ে গেলো আবিরের দিকে । অয়ন তখন আবিরকে বলল, “দুলাভাই! মিট মাই গার্লফ্রেন্ড, মাইশা ।” আবির মাইশার দিকে তাকাল । বেশ মিষ্টি দেখতে মেয়েটা । অয়নের সাথে বেশ মানাবে মেয়েটাকে । মাইশা আবিরকে কংগ্রাচুলেশন আবির ভাইয়া ।” মেয়েটা যেমন মিষ্টি , তেমনি দারুণ মিষ্টি গলা ।

“দেখেছো, আমাদের চুনি কত ভাগ্যবান, কত ভালো একটা ছেলে পেয়েছে!”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, মানুষ কত পছন্দ করে, এক কোথায় দারুন একটা ছেলে ।”

“হয়েছে হয়েছে, আমাদের চুনিও কোন অংশে কম না । দুজনে যেন একদম সোনায় সোহাগা ।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমরা দেখো, বিয়ের পর ওরা খুব সুখি হবে ।”

“এই তোমরা জানো, সেদিন কিছু বাজে লোকজন দেখলাম আলোচনা করছিলো, আবির চুনিদের বাসায় আগে থেকে থাকতো, বিয়ের পর ঘরজামাই হবে, ইত্যাদি না না ধরণের আজব আজব কথা বলছিল ।”

“আরে ওদের কথা বাদ দাও তো! নিন্দুকেরা ওসব বলবেই । আর ও বাড়িতে আবির থেকেছে নেহায়াতই ভাগ্যের খাতিরে ।”

“হ্যাঁ, আসলেই । অনেকে আবার শুনলাম এও বলছে চয়নিকারা আবিরকে আশ্রয় দিয়েছিলো বলে ঋণ মেটাতে বিয়ে করছে । এটা কোন ধরণের কথা বলতো!”

“আসলেই । আমাদের চুনির পরিবার  কখনোই অন্য কাউকে ঠকাতে পারে না ।”

চয়নিকা যে রুমে কনের সাজে বসে ছিল, সে রুমে উপস্থিত ওদের বিল্ডিং-এর কিছু মহিলা বলাবলি করছিলো এসব কথা । শেষ কথাটা চয়নিকার মনের মাঝে কাটার মতো বিঁধল “আমাদের চুনির পরিবার  কখনোই অন্য কাউকে ঠকাতে পারে না ।” চয়নিকার কানে কথাটা যেন ৪-৫বার বেজে উঠলো । চয়নিকা তখন “না!” বলে একটা চিৎকার করে কেদে উঠলো ।

বাইরে চয়নিকার বাবা আঁখিকে বলল, “কিরে, চুনির চিৎকার না?” আখি বলল, “হ্যাঁ তাইতো, দাড়াও আমি দেখে আসছি ।” বলে আখি গেলো ।

এদিকে আবির চিৎকার শুনে বলল, “কি হল?” অয়ন বলল, “আরে, টেনশন করো না ভাইয়া, আপুর মেকআপে পানি পড়েছে মনে হয় ।” আবির বলল, “না, তাই বলে এভাবে চিৎকার করবে!” সাবিত বলল, “বাহ, বিয়ের আগেই এতো টেনশন, বিয়ের পরে কি হবে!” আবির একটু লজ্জা পেলো । সাবিত বলল, “আচ্ছা দাড়া, আমি দেখে আসি কি হয়েছে ।” বলে চলে গেলো সাবিত ।

এদিকে চয়নিকার চিৎকার শুনে এক সবাই ওর দিকে তাকাল । এক মহিলা জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে মা?” চয়নিকা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আনটি আমি আবিরের কাছে যাবো!” মহিলাটি বলল, “বিয়েটা হয়ে যাক মা, তারপর যেয়ো?” চয়নিকা বলল, “না আন্টি প্লিজ! আমি এখনই যাবো ।” সব মহিলারা তখন নিজেদের মধ্যে “কি হল!” “কেন যেতে চাইছে!” “ভয় পেয়েছে নাকি!” ইত্যাদি নানা কথা বলতে লাগলো । চয়নিকাদের পাশের বাসার সেই মহিলা তখন বলল, “চল চয়নিকা, আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি ।” বলেই চয়নিকাদের পাশের বাসার আন্টি যেই চয়নিকা নিয়ে এক কদম এগোতে যাবেন, অমনি আখি বলল, “না, ও কোথাও যাবে না ।” চয়নিকা আঁখির দিকে তাকাল । আখি পাশের বাসার আন্টিকে বলল, “আন্টি, আপনি বসুন ।” পাশের বাসার আন্টি বসে পড়লো । চয়নিকার কানের কাছে আখি তখন বলল, “আর একটু ক্ষণ বাকি, ঝামেলা করিস না কিন্তু!” চয়নিকা কিছু বলল না । বসে পড়লো আবার । বলে আখি চলে যাচ্ছিলো রুম থেকে দরজার সামনে সাবিতের সাথে দেখা । সাবিত আঁখিকে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?” চয়নিকা সাবিতকে বলল, “সাবিত ভাই, একটু শুনবেন?” সাবিত চয়নিকার কাছে যেতে নেবে, এমন সময় আঁখির সাবিতের হাত ধরে বলল, “সাবিত বাইরে চল ।” সাবির আঁখিকে জিজ্ঞেস করলো, “চয়নিকা ডাকছে তো!” আখি বলল, “যা কথা বিয়ের পরে হবে । এখন চল ।” “কিন্তু……” সাবিতকে কিছু বলতে না দিয়েই ধমকের স্বরে আখি বলে উঠলো, “চলো বলছি!” সাবিত আর কিছু বলল না । একবারটি চয়নিকার জলে  ভেজা চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে আঁখির সাথে বাইরে চলে গেলো । চয়নিকা কাঁদতেই লাগলো ।




(২১৮)

“থাঙ্কস এ লট!” মাইশার অভিবাদনে বলল আবির । সাবিত বলল, “শোন আবির, ভাবছি তোর বিয়ের পর পরই এদের বিয়ে দিয়ে দেবো, কেমন হবে বল?” আবির বলল, “আরে সাবিত ভাই! একদম আমার মনের কথা বলেছ । নইলে  এই মেয়ের ওপর তো অন্য কারো নজর লেগে যাবে ।” মাইশা বলল, “সমস্যা   নেই, কারো  নজর লাগলেও আপনি ইনভেস্টিগেশন করে বের করতে পারবেন কার নজর লেগেছে । আমি কিন্তু আপনার দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো এর  অনেক বড় একজন  ভক্ত । কিন্তু শেষ সপ্তাহে হল না কেন শো-টা?” আবিরের মন খারাপ হয়ে গেলো । সাবিত কথা ঘোরানোর জন্য বলল, “আচ্ছা আবির, তোর সামি বলে সিনিয়র কলিগ ছিল না? সে কোথায়?” আবির তখন কি নিয়ে চিন্তিত  হয়ে  পড়লো । মনে মনে বলল, “ঠিকই তো, সামি আর অপু একসাথে থাকবে বলেছিল, সবকিছু ওরা ঠিক ঠাক করতে পারলে হয় । আলাহ! আমার জন্য ওদের যেন কোন বিপদ না হয় । অপু আছে বলে ভয় নেই, কিন্তু তাও কেমন চিন্তা হচ্ছে ।” সাবিত জিজ্ঞেস করলো, “কিরে আবির কি এতো ভাবছিস?”

“কিরে, কি হয়েছিলো রে?” আখি ওর বাবার কাছে আসতেই বাবা প্রশ্ন করলো । আখি বলল, “আর বোলো না বাবা, চুনি আরেকটু হলেই সবটা নষ্ট করে দিচ্ছিলো আমার মনে হয় ও আবিরকে সবটা বলে দিতে চাচ্ছে ।”

“সর্বনাশ! এখন ওই রুমে যারা আছে তাদের যদি চুনি বলে দেয়!” জিজ্ঞেস করলো আঁখির বাবা ।

“তা বলবে না । কারণ ঘরের মানুষকে বলা আর বাইরের মানুষকে বলা দুটো আলাদা ব্যাপার । আমি চুনিকে যতদুর চিনি ও কাউকে কিছু বলবে না ।” বলল আখি ।

এমন সময় আঁখির মোবাইলে একটা কল এলো । ফোন ধরে আখি কথা বলল, “হ্যাঁ বল দোস্ত ।…………কি!............আচ্ছা…………থাঙ্কস বন্ধু, একটু কষ্ট দিলাম ।” বলেই ফোন রেখে আখি বলল, “বাবা, কাজী সাহেব কোথায়! এখনও আসছে না কেন?” আঁখির বাবা হাতের ঘড়িতে  সময়  দেখে বলল, “কি জানি! বুঝতেই তো পারছি না কেন আসছে না ১০টা পাঁচ বেজে গেছে । কেন কি হয়েছে?”  আঁখি বলল, “মায়ের বিমান ল্যান্ড করেছে । এয়ারপোর্ট এর কাজ সেরে এখানে আসতে আসতে হয়তো ১ঘন্টা মতো লাগবে । তুমি তাড়াতাড়ি কাজি সাহেবকে আসতে বলো ।” “আচ্ছা, দাড়া আমি উনাকে ফোন দিচ্ছি ।” বলে চয়নিকার বাবা কাজি সাহেবকে ফোন করলো । ফোন ধরতেই কাজি সাহেব বলল, “হ্যাঁ আসসালামু আলাইকুম ভাই, আমি তো জ্যামে আটকাইয়া গেছিলাম, আর ১০মিনিট মতো লাগবো আইতে ।” আঁখির বাবা বলল, “আচ্ছা একটু তাড়াতাড়ি আসবেন ।” ফোন কাটতেই আঁখি প্রশ্ন করলো, “কি হয়েছে?” আঁখির বাবা বলল, “জ্যামে আটকে ছিলেন । আসছেন এখন, ১০মিনিট মতো লাগবে ।” আঁখি একটু বিরক্ত  হয়ে বলল, “আজকে যে আর কত ঝামেলা হবে! আলাহই জানেন ।”

“না ভাই, তেমন কিছুই না ।” সাবিতের প্রশ্নের জবাবে বলল আবির । মাইশা অয়নকে বলল, “আচ্ছা, চয়নিকা আপু কোথায়?” অয়ন জিজ্ঞেস করলো, “তুমি এখনও আপুকে দেখো নি?” মাইশা বলল, “না, আমি আসার সাথে সাথেই তো নাচ শুরু হল ।” অয়ন তখন বলল, “চল, আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি আপুর কাছে ।” সাবিত মনে মনে বলল, “চয়নিকা হয়তো কিছু বলতে চাইছে, কিছু একটা নিয়ে নিশ্চয় ও  চিন্তিত, আঁখি তো আমাকে শুনতে দিলো না, এই সুযোগে শুনে নিতে হবে ।” তারপর সাবিত অয়নকে বলল, “আচ্ছা অয়ন, আমি ওকে নিয়ে যাই ।” অয়ন জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”অয়ন তখন বলল, “না, ওখানে অনেক আন্টিরা আছে তো, দুটো অবিবাহিত ছেলেমেয়েকে একসাথে দেখলে কি কি বলে তা তো তোর জানা ।” অয়ন একটু ভেবে বলল, “ভুল বলোনি ভাই । মাইশা, তুমি ভাই এর সাথে যাও ।” মাইশা বলল, “আচ্ছা, চলুন ভাইয়া ।” বলে মাইশাকে নিয়ে চয়নিকার কাছে যেতে লাগলো সাবিত । আবিরের রুম থেকে বেরোতেই ওদের দেখল আঁখির বাবা । দেখে  আঁখিকে প্রশ্ন করলো, “ওইযে সাবিতের সাথে চুনির রুমের দিকে যাচ্ছে ওই মেয়েই কি অয়নের গার্লফ্রেন্ড?” আঁখি পেছন ফিরে তাকাল । তারপর, “বাবা চুনি সাবিতকেও সব বলে দিতে যাচ্ছিলো ।” বলে সেদিকে এগিয়ে গেলো । তারপর সাবিত আর মাইশা যেই না রুমে ঢুকতে যাবে, অমনি সামনে এসে দাঁড়ালো আঁখি । তারপর আঁখি বলল, “কোথায় যাচ্ছো?” সাবিত বলল, “ইয়ে মানে, মাইশা চুনিকে দেখতে চাচ্ছিল ।” তোমার যাওয়া লাগবে না, ভেতরে  সব মেয়ে মানুষ । আমি নিয়ে যাচ্ছি । মাইশা, চল ।” বলে মাইশাকে নিয়ে ভেতরে গেলো আঁখি । সাবিত মনে মনে ভাবল, “সিরিয়াস কিছু একটা তো হয়েছেই ।”

একটু পর সাবিত আবিরের কাছে ফিরে এলে অয়ন জিজ্ঞেস করলো, “কি হল ভাই? যাও নি?” সাবিত বলল, “আঁখি নিয়ে গেছে । ভেতরে সব মেয়ে মানুষ তো ।” এরপর সবাই যে যার যার মতো চুপচাপ রইল । অয়ন পরিচিতজনদের সাথে কিছু সেলফি তুলল, আর আবির বার বার মোবাইল দেখছে । একটা কলের জন্য অপেক্ষা করছে । একটু পর সাবিতের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো, “ওর কাছে না যেতে পারি, ওর কাছে ফোন তো রয়েছে, চুনিকে একটা ফোন দেই তাহলে ।” বলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে চয়নিকাকে কল করলো সাবিত ।





(২১৯)

“ওকে আপু, তোমার মন খারাপের কারণটাতো জানতে পারলাম না, তবে অনেক ভালো থেকো, অনেক সুখে থেকো, দোয়া করি ।” চয়নিকার সাথে নানান কথা বার্তা বলার পর বলল মাইশা । চয়নিকা হালকা হাসবার  চেষ্টা করেও পারলো না । আঁখি  মাইশাকে যেই না বলল, “চলো যাই ।” অমনি চয়নিকার মোবাইলে সাবিতের কল এলো । আঁখি দেখে ফেললো, সাবিত ফোন করেছে । আঁখি চয়নিকার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলল, “বিয়ের পর মোবাইল পাবি ।” মাইশা অবাক হল ব্যাপারটা দেখে, কিন্তু কিছু বলতে পারলো না ।

এদিকে ফোন কেটে যাওয়ায় অবাক হয়ে গেলো সাবিত । মনে মনে বলল, “কেটে গেলো কেন?” এমন সময় আবিরের মোবাইলে একটা কল এলো । কল ধরল আবির, “হ্যালো! কি! কি বলছেন এসব! আচ্ছা,  আমি এক্ষুনি আসছি ।” বলেই উঠে দাঁড়ালো আবির । অয়ন জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে ভাই?” আবির বলল, “হাসানের স্ত্রী রেহানা মারা গেছে ।” অয়ন ভয় পেয়ে গেলো । জিজ্ঞেস করলো, “কি বলছ এসব!” আবির বলল, “হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি চল, আমরা এখন হাসানের বাড়িতেই যাবো ।” সাবিত বলল, “কি! কিন্তু  আবির তোমার এখন বিয়ে!” আবির “মাফ করবেন ভাই, এই কাজ আমার বেশি জরুরী!” বলেই আবির উঠে বাইরে গেলো । আঁখির বাবা নানা প্রশ্ন করবে  দেখে আবির আঁখির বাবা ডাকা সত্ত্বেও কাছে গেলো না । গাড়ি নিয়ে অয়নের সাথে বাইরে যাবার সময় শুধু বলে গেলো, “মাফ করবেন আঙ্কেল, আমার হাতে সময় নেই, এসে আমি সব জানাচ্ছি ।” আঁখি সে সময় চয়নিকার রুম থেকে বেড়িয়েছে কেবল, আবিরকে যেতে দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো । তারপর বাবার কাছে এসে বলতে লাগলো, “ও কোথায় গেলো বাবা!” আঁখির বাবা ক্ষিপ্ত গলায় বলে উঠলো, “জানি না! কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না!” আঁখিও ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, “তুমি আটকাতে  পারলে না!” আঁখির বাবা বলল, “আমাকে আটকাতে দিলে তো আটকাবো!” আঁখি মাথায় হাত দিয়ে পাশে থাকা একটা চেয়ারে বসলো । এই সুযোগে সাবিতও চলে গেলো চয়নিকার কাছে ।

“টিংটিং!” মিস্টার হাসানের বাসায় কলিংবেলের আওয়াজ হতেই একটু পর এসে দরজা খুলল বছর ৩০ এর এক মহিলা । আবিরকে দেখে মহিলা বলল, “ও আপনি এসে পড়েছেন! আসুন, ভেতরে আসুন ।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না!” মহিলা তখন বলল, “আমি উনার ছেলে দিহানের বউ তিশা । আমি আপনাকে কি করে চিনেছি তা নিশ্চই বুঝতে পারছেন ।” আবির বুঝল দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো ইনিও দেখত বলে চিনতে পেরেছে  আবিরকে । মহিলাটা আবিরকে ভেতরে ঢুকতে বলল । মিস্টার হাসানের রুমে  যেতে যেতে আবির তিশাকে  জিজ্ঞেস করলো, “আপনারা কবে এলেন?” তিশা বলল, “গতকাল রাতেই এসেছি, আসলে মা বাবাকে সারপ্রাইজ দেবো ভেবেছিলাম । কিন্তু গতকাল মা নাকি দিহানের কাকুর বাসায় গিয়েছিলেন । আজ আসবে বলেছিলেন, কিন্তু তার আগেই এতকিছু ঘটে গেলো । যদিও মায়ের  সাথে কথা বলা হয় নি আর তার আগেই এসব হয়ে গেলো ।” আবির রুমের দরজা থেকেই কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলো শুরুতে ভেবেছিলো মিস্টার হাসানের, কিন্তু ভেতরে এসে দেখল,  মিস্টার হাসানের ছেলে দিহান কাঁদছে । পাশেই মিস্টার হাসান মুখ গোমড়া করে মাথা নিচু করে বসে আছে । আবিরকে দেখেই মিস্টার হাসান বলল, “ও, আপনি এসেছেন, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম   ।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “কি করে কি হল?” মিস্টার হাসান বলল, “আর বলবেন না, গতকাল সকালে ও বাজার থেকে আসছিলো, তখন ওকে কে নাকি খুব বিরক্ত করেছে । আমি তো বুঝেই গেলাম, এটা হুমকি দাতাদেরই একজন । তাইতো আমি ওকে আমার ভাইয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম ।” রাতেই দেখি ছেলে আর বউমা বাড়ি চলে  এসেছে, তাই ওকে আজ আসতে বলেছিলাম, ছেলেমেয়েদের কথা তখনি বলিনি, ওকেও সারপ্রাইজ দেবো ভেবেছিলাম কিন্তু এর মদ্ধেও কি যে হ………।” বলতে বলতে কেদে ফেললো মিস্টার হাসান । কিছুক্ষণ কাঁদার পর মিস্টার হাসান দিহানের কাছে যেয়ে বলল, “চল বাপ, তোর মায়ের কাছে যাই ।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “লাশ কি এখানে আনা হবে না?” মিস্টার হাসান বলল, “আসলে আমার ভাইয়ের বাসার পাশেই একটা পারিবারিক কবরস্থান, ওখানেই ওর কবর দেবো ।” দিহানের কান্না একটু থেমছে । উঠে দাঁড়ালো দিহান । তারপর বেরনোর জন্য বাবাকে বলল, “চলো বাবা ।”

আবির তখন বলে উঠলো,  “এক মিনিট, আগে আপনাদের কিছু  জিজ্ঞেস করতে চাই ।” মিস্টার হাসান তখন বলল, “আবির বাবা তোমার যা জিজ্ঞেস করার পড়ে কোরো, এখন প্লিজ এই সিচিউশনে কিছু জিজ্ঞেস কোরো না ।” আবির তখন বলল, “না তো, আমার  তো মনে হচ্ছে এটাই আসল সময় সব জিজ্ঞেস করার ।” দিহান তখন হালকা রাগ করে বলল আপনার মাথা ঠিক আছে! এরকম সময়ে কেউ প্রশ্ন করে নাকি!” আবির বলল, “কিন্তু প্রশ্নগুলো জানা যে আমার জরুরী!” দিহান তখন বলল, “তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করুন । আর জিজ্ঞেস করে চলে যান । মনে তো হচ্ছে বিয়ে থেকে চলে এসেছেন । আপনার মতো ফালতু লোক আমার মায়ের মৃতদেহর পাশে যাক, তা আমি চাই না ।” আবির বলল, “প্রশ্ন করার সুযোগ দেবার জন্য ধন্যবাদ । যা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম তা হল, আপনারদের কি পরিমান জমিজমা আছে? স্পেশালি আপনার মায়ের নামে?” প্রশ্ন শুনে সবাই অবাক হয়ে গেলো । দিহান জবাব না দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে রইল ।




(২২০)

আবির একটু ইয়ার্কি করে বলল, “ওভাবে ভ্রুটা কুচকাবেন না, জোড়া লেগে যাবে ।” মিস্টার হাসান রেগে গিয়ে বললেন, “একটা দুঃখের সময়ে ইয়ার্কি করছো! লজ্জা করে না!” আবির বলল, “জানি, এটা বলাই স্বাভাবিক, কিন্তু আপানাদেরও এটা ভাবা উচিত, কোন না কোন কারণে আমি এরকম কথা বলছি, তাই না?” পাশে  দাঁড়িয়ে থাকা তিশা বলল, “আবির, আপনি কি বলছেন আমার জানা নেই, কিন্তু আমার মনে হয় না এই মুহূর্তে এসব কথা বলা উচিৎ ।” আবির বলল, “দেখুন আপু, আপনি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন, আমি যা করছি, ভালোর জন্যই করছি ।” এরপর আবির দিহানকে জিজ্ঞেস করলো, “এবার আপনাদের জমিজমার ব্যাপারটা বলুন ।” দিহান কান্নাকাটি করে বলে উঠলো, “আপনি প্লিজ থামুন! আমার মা মারা গেছে! আপনি বুঝতে পারছেন! হ্যাঁ জমিজমা আছে, কিন্তু সেসবের কোন খোঁজ-ই আমি রাখি নি রাখবার ইচ্ছেও নেই ।” আবির তখন বলল, “মিস্টার দিহান, সরি আমি আপনাকে একটু কষ্ট দিচ্ছি, কিন্তু একটু আমার কথা শুনুন, দেখবেন কষ্ট চলে যাবে । তবে একান্তই আপনি যখন বলতে চাইছেন না, তখন আমিই বলি ।” বলে আবির একটু হাটল । তারপর বলল, “আগে আমি একথা বলতে চাই আসলে খুনটা কে করেছে ।” মিস্টার হাসান তখন বলল, “কে আবার, আমাকে যে হুমকি দিতো, তুমি এ পর্যন্ত তাকে খুজে দিতে পারলে না, অকাজের গোয়েন্দা একটা ।” মিস্টার হাসানের কথা শুনে আবির হোহো করে অট্টহাসি হেসে উঠলো । মিস্টার হাসান জিজ্ঞেস করলো, “হাসছো কেন?” আবির বলল, “আমার তদন্ত হুমকিদাতা আর খুনি দুজনকেই গতকাল রাতেই খুজে ফেলেছে ।” মিস্টার হাসান তখন ভ্রু কুঁচকে বলল, “কি আমাকে জানাও নি কেন?” আবির তখন বলল, “জানানোটা প্রয়োজনবোধ করিনি ।” মিস্টার হাসান তখন বলল, “তাহলে আসল কারণটা জানতে পারি?” আবির একটু থামলো । তিশা বলল, “আপনি যা করার তাড়াতাড়ি করুন, প্লিজ!” আবির একবার মিস্টার হাসানের দিকে তাকাল, তারপর তিশার দিকে তাকাল, তারপর দিহানের দিকে তাকাল । অয়ন আবিরকে জিজ্ঞেস করলো, “আবির ভাই, তাড়াতাড়ি করো! তোমার বিয়ে তো!” আবির বলল, “আরে, একটু সবুর কর। সবুরে মেওয়া ফলে জানিস না?” অয়ন বলল, “আচ্ছা অন্তত এটা বলো, আসল হুমকিদাতা আর খুনি কে?” আবির বলল, “ওরে, আসল হুমকিদাতারও এখন আদেশকারী রয়েছে ।” দিহান জিজ্ঞেস করলো, “আদেশকারী?” আবির বলল, “হ্যাঁ, মানে হুমকিদাতাকেও একজন আদেশ দিতো ।” তিশা জিজ্ঞেস করলো, “কে সে?” আবির বলল, “সে হচ্ছে………।” নামটা বলতে গিয়ে থেমে গেলো আবির । একবার চারপাশে তাকিয়ে সবার চেহারার অবস্থাটা দেখতে লাগলো ।

“হ্যালো!.........কি!.........আচ্ছা্‌!.........।” বলেই ফোন কেটে দিলো আঁখি । আঁখির বাবা তখন বলল, “কিরে কি বলল তোর বান্ধবী?” আঁখি বলল, “বাবা, এখনও ওই বিমানের সব যাত্রী এয়ারপোর্ট থেকে বের হয় নি বিমান থেকে । বলতে পারছি না ঠিক ।” আঁখির বাবা বলল, “দোয়া করি যারা এখনও এয়ারপোর্ট-এ যারা আছে তাদের মধ্যেই যেন তোর মা থাকে ।” আঁখি আশেপাশে তাকাল । মাইশাকে দেখল কিন্তু সাবিতকে দেখল না । মাইশাকে জিজ্ঞেস করলো, “মাইশা সাবিতকে দেখেছো?” মাইশা বলল, “সাবিত ভাইয়া তো অনেক আগেই চয়নিকা আপুর রুমে গেছে ।” আঁখি “ইয়া আল্লাহ!” বলে চেচিয়ে কনের রুমে গেলো, দেখল, চয়নিকা নেই । ওই রুমে থাকা পাশের বাসার আন্টিকে জিজ্ঞেস করলো, “আন্টি চুনি কোথায়?” পাশের বাসার আন্টি বলল, “ও তো তোমার বরের সাথে একটু ছাদে গেলো কি যেন বলতে ।” আঁখি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো । তাড়াতাড়ি করে ছাদে উঠলো আঁখি, ছাদের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই যা দেখল, তা দেখে আঁখির আরও যেটুকু ভয় পাবার বাকি ছিল, সেগুলো পেয়ে যাওয়ার অবস্থা । ছাদের রেলিঙ্গের সাথে হেলান দিয়ে বসে কি নিয়ে প্রচন্ড টেনশন করছে সাবিত । কথা শুনে যে ও মারাত্মকভাবে মন থেকে আঘাত পেয়েছে তা আঁখি বুঝতে পারছে । পাশেই দাঁড়িয়ে কাঁদছে চয়নিকা । আঁখি কাছে এগিয়ে গেলো । তারপর সাবিতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ক……কি……কি হয়……ছে সাব……সাবিত?” সাবিত আঁখির দিকে তাকিয়ে বলল, “চুনি আমাকে সবটা বলেছে! জানি চুনি ভুল করেছিলো, এখন সেটা স্বীকার করছে, কিন্তু………………তার শাস্তি তোমরা আবিরকে কেন দেবে!”

“কি হল বলো! কার এতো বুকের পাটা আমাক হুমকি দেয়!” আবিরের মুখে নামটা এখনও না শোনায় জিজ্ঞেস করলো মিস্টার হাসান । আবির তাও কিছু বলল না । একটু দেখতে চাইছে সবার মুখের কথা । দিহান জিজ্ঞেস করলো, “প্লিজ হেয়ালি করবেন না! বলুন!” তিশা বলল, “হ্যাঁ আবির, প্লিজ কিছু বলুন!” এরপর আবির একটু নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনার বাবার হুমকিদাতার আদেশকারী হচ্ছে……………”

সবাই আবিরের দিকে তাকিয়ে । সবাই খুব এক্সাইটেড কার নাম আবির বলবে তা শোনার জন্য । সবার মনেই যেন একটা অদ্ভুত আশংকার জন্ম দিয়েছে, সবাই ভাবছে কে এই হুমকিদাতা আর কে-ই বা এই হুমকিদাতার আদেশকারী । দিহান বলে উঠলো, “প্লিজ বলুন! কে সে?” আবির বলল, “আপনার বাবার হুমকিদাতার আদেশকারী আপনার বাবা নিজেই, আর উনি-ই উনার স্ত্রী এবং আপনাদের মাকে খুন করেছে ।” আবিরের কথা শুনে সেখানে থাকা  সকলেই হতভম্ব হয়ে গেলো ।




(২২১)

মিস্টার হাসান রেগে গিয়ে বলতে উঠলো, “এই তোমার সাহস কি করে হয় এসব বলার! তোমাকে আমি গোয়েন্দাগিরি করতে পাঠিয়েছি, আর তুমিই কি না আমাকে এসব বলছ!” আবির বলল, “হ্যাঁ, আপনি আমায় ডেকেছিলেন, কিন্তু তার একটা আলাদা উদ্দেশ্য ছিল আপনার ।” দিহান জিজ্ঞেস করলো, “উদ্দেশ্য! কি উদ্দেশ্য?” আবির বলল, “তার আগে আমি আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি, আপনার বাবা আপনার মা-কে কতটা ভালোবাসতেন?” দিহান বলল, “আমার বাবা মা-কে তো অনেক ভালোবাসতেন, ইভেন আমার মা-ও বলতেন, এনার মতো স্বামী পেয়ে উনি গর্বিত ছিলেন ।” আবির একটু হেসে বলল, “জানেন তো, মানুষ মানুষকে দুভাবে ভালোবাসে । এক মন থেকে ভালোবেসে, দুই তার ধন-সম্পদকে ভালোবেসে । আর আপনার বাবা এই ধন-সম্পদকে ভালোবেসে নিজের স্ত্রীকে ভালোবাসা মানুষের মধ্যে একজন ।” তিশা তখন বলল, “আমি বুঝতে পারছি আপনি অনেক জরুরী একটা কথা বলছেন, কিন্তু আমার মনে হয় এখন মায়ের কাছে যাওয়া উচিৎ, পরে না হয় এসব ব্যাপারে জানা যাবে ।” আবির তখন বলল, “যাওয়াটা কি খুব জরুরী?” দিহান অবাক হয়ে বলল, “মানে?” আবির তখন বলে উঠলো, “সময় হয়ে গেছে, ভেতরে আসুন ।” এমন সময় দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল মিস্টার হাসানের স্ত্রী রেহানা, সাথে সামি । আর তারই সাথে দিহানের কাকু, মানে মিস্টার হাসানের ভাই, আনিস । আনিসকে ধরে আছে পুলিশ অফিসার অপু । পুলিশ দেখে একটু শিউরে উঠলো মিস্টার হাসান । দিহান মাকে দেখে খুশি হয়ে মায়ের কাছে যেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো, “মা! তুমি ঠিক আছো! আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম মা! আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!” তিশা যেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আসসালামু আলাইকুম আম্মা! আলহামদুলিল্লাহ আপনি ঠিক আছেন আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম ।” রেহানা ছেলে আর বউমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “হ্যাঁ রে, আমি ঠিক আছি । কিন্তু আমি  আজ ঠিক থাকতাম না, যদি না তোর এই ইবলিস বাবার  হাত থেকে এই আবির ছেলেটা আমাকে বাঁচাত ।” দিহান আবিরের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু আসলে হয়েছেটা কি!” আবির বলল, “শুরু  থেকেই শুরু  করি তাহলে সবটা!”

“প্লিজ সাবিত! সিন ক্রিয়েট কোরো না! আমি চাই না চুনির এই ক্ষতিটা করতে ।” সাবিতকে বলল আঁখি । সাবিত আঁখিকে বলল, “কিন্তু আবিরের যে ক্ষতিটা তোমরা করছো তার বেলায়?” পাশে চয়নিকা তখনও কেঁদেই চলেছে ।

“বলতেছিলাম কি, বিয়া শুরু হইবো কখন?” চয়নিকার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো কাজী সাহেব । চয়নিকার বাবা হাত জোড় করে বলল, “প্লিজ কাজী সাহেব!  আর একটু অপেক্ষা করুন! জামাই একটু পরেই চলে আসবে ।” “সেই কখন থেইকাই তো একই কথা বলতেছেন! আর কতক্ষণ!” বলল কাজী সাহেব । চয়নিকার বাবা কোন জবাব দিতে পারলো না । কাজী চলে গেলো সেখান থেকে । আঁখি এখনও আসছে না দেখে চয়নিকার বাবা একটু চিন্তিত হয়ে গেল । নিজেই নিজেকে বলল, “এখনও আসছে না কেন! দেখি তো একটু যেয়ে ।”

“প্লিজ আপু! আমার ওকে ঠকিয়ে বিয়েটা করতে ইচ্ছে করছে না!” কাঁদতে কাঁদতে আঁখিকে বলল চয়নিকা । আঁখি মেজাজ দেখিয়ে চয়নিকাকে বলল, “এই শোন! একটা কথা বলবি না! চুপচাপ বিয়েটা করবি!” সাবিতও প্রায় কেদে দিয়েছে । আঁখিকে বলল, “আঁখি! প্লিজ, আমার এই বিষয়টা মোটেও ভালো লাগছে না! প্লিজ আবিরকে এভাবে ঠকিও না!” আঁখি জবাবে বলল, “কে আবির! তোমার আপন ভাই? নাকি তোমার বাচ্চাকালের বন্ধু যে এতো চিন্তা করছ?” সাবিত হালকা হেসে বলল, “ও আমার আপন ভাইও না, বাচ্চাকালের বন্ধুও না, কিন্তু ও আমার কাছে তার চেয়েও অনেক কিছু । ছেলেটার জন্য খুব মায়া হয় । সেই আমার আর তোমার বিয়ে থেকে দেখছি, কি সুন্দর হাসিখুশি চুপচাপ ছেলেটা, যে কেউ ছেলেটাকে ভালোবাসতে বাধ্য । ওকে দেখলে কেউ  বলবেই না যে ও এতিম । কিন্তু মনের মধ্যে তবুও ওর মা বাবা হারানোর কষ্ট আছেই । সবচেয়ে বড় কষ্ট ও ওর মা বাবা কাউকে দেখেও নি । আপন বলতে শুধু আমরাই তো আছি ওর, তাহলে সেই আমরা কি করে ওকে ঠকাবো! তুমিই ভেবে দ্যাখো!” আঁখি কিছু জবাব দিতে পারলো না । হয়তো একটুর  জন্য  কিছু না কিছু ওর বিবেককে জাগ্রত করেছে । সাবিত একটু থেমে বলল, “এবার বল, বিয়ের আগে আবিরকে সত্যিটা বলবে, নাকি বলবে না!” “না বলবে না!” আওয়াজ শুনে সাবিত আঁখি চয়নিকা ছাদের দরজার দিকে তাকাল । দেখল, ওদের বাবা দাঁড়িয়ে । আঁখি বাবার কাছে যেয়ে বলল, “দেখেছো বাবা! যা তোমায় বলেছিলাম সেটাই হল । এখন তুমি-ই তোমার জামাইকে বোঝাও ।” আঁখির বাবা সাবিতের সামনে এসে বলল, “দ্যাখো বাবা, আমি চাই আমার চুনি ভালো থাক, তোমরাও ভালো থাকো । তাই তুমি এমন কিছু কোরো না, যাতে আমার চুনি মা’র খারাপ হয় ।” সাবিত বলল, “আঙ্কেল, আপনিই বলুন, বিয়ের পর এসব কথা শোনার পর আবির যদি চয়নিকাকে ঘৃণা করতে শুরু করে, তখন কি আপনার মেয়ে  খুব সুখী হবে?” চয়নিকার বাবা বলল, “জানা নেই। আমি  শুধু এটুকু জানি, আগে ওদের বিয়েটা হবে, তারপর ধীরে সুস্থে আবিরকে বোঝানো যাবে ।” সাবিত বলল, “কিচ্ছু হবে না আঙ্কেল, কিচ্ছু না, আবির আমার আরেক মায়ের ভাই, আমি কখনই ওর কোন ক্ষতি হতে দেবো না! আমি এখুনি ওকে ফোন করে সব জানিয়ে দেবো ।” বলে সাবিত পকেট থেকে মোবাইল বের করে যেই আবিরকে  কল করতে যাবে, অমনি আঁখি সাবিতের কান থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিলো । তারপর বলল, “আজ তুমি যদি কাউকে কিছু বলো, আমি তোমাকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হবো!” সাবিত অবাক হয়ে গেলো ।




(২২২)

আঁখির বাবাও অবাক হয়ে গেলেন । একটু ভয়ও পেলেন । চয়নিকা কাঁদতে কাঁদতেই অবাক হয়ে হা করে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল । সাবিত আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি এসব কি বলছো আঁখি!” আঁখি বলল, “যা বলছি ঠিকই বলছি । এবার বলো, কাকে চাও তুমি, তোমার ওই এতিম ভাইকে বাঁচাতে, নাকি আমাদের সংসার না ভাংতে!” সাবিত মাথায় হাত চেপে ধরল । কেমন একটা অস্থির ভাব শুরু হয়েছে ওর মনে । যেন কিচ্ছু ভালো লাগছে না ওর । কিছুক্ষণ কিসব ভেবে “কিচ্ছু ভালো লাগছে না আমার! কিচ্ছু না! আমি এই  বিয়েতেই থাকবো না!” বলে  সেখান থেকে চলে গেলো সাবিত । আঁখির তখন চয়নিকার কাছে যেয়ে বলল, “চুপচাপ বিয়েটা করবি! আর কাউকে যদি বলিস না, তাহলে বিয়ের পর তোর আবিরকে নিয়ে তুই  আর কোনদিন আমাদের বাড়িতে ঢুকতে পারবি না!” চয়নিকা কান্না করেই চলেছে ।

এদিকে আবির সবাইকে শোনাতে  লাগলো ওর ইনভেস্টিগেশনের কাহিনী, “এই মিস্টার হাসান আমায় একদিন ডেকে বলেন উনাকে কেউ মারার চেষ্টা করছেন । সব সময় উনাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে । এমনকি উনি আমাকে জানান উনাকে খুন করতে চাওয়ার তেমন কোন কারণই উনি জানেন না । সব কয়টা ব্যাপার আমার কাছে গোলমেলে লাগে । কারণ একে তো কেউ সত্যি মারতে চায়, তবে তো বাড়িতে ঢুকেই মারতে পারে, তার ওপর কারণ ছাড়া কাউকে মারতে চাইবে ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত, তবুও ব্যাপারটা আমার কাছে স্বাভাবিকই লাগলো । এরপর আবার দেখলাম হুমকিদাতা আমার বাড়িতেও পৌঁছে গেছে । এটাও স্বাভাবিক নিলাম, প্রথম দিন আমি উনার কাছ থেকে যে নাম্বারগুলো থেকে হুমকি এসেছিলো, সেগুলো চাইলাম । রাতেই উনি আমাকে নাম্বারগুলো দিলেন, আমি সব নাম্বারে কল দেই কিন্তু  একটা নাম্বারেও কল ঢোকে নি । এরপর মিস্টার হাসান একটা ভুল করে বসলেন । নাম্বারে যে কল ঢোকে নি এই ব্যাপারটা আমি শুধুমাত্র মিস্টার হাসানকে জানিয়ে ছিলাম । অথচ হুমকিদাতা আমাকে হুমকি দেয় আমি নাম্বারে ট্রাই কেন করেছি । হুমকিদাতার তো বোঝারই কথা না আমি তাদের কল করেছি, কারণ আমি ওদের কাছে আমার কল তো যায়-ই নি । এরপর মিস্টার হাসানের প্রতি আমার সন্দেহ শিওরিটির দোরগোড়ায় পৌঁছে যায় । আমি এরপর উনার বাসায় আসি । উনার মোবাইল থেকে উনার আর উনার স্ত্রীর ছবি নেবো বলে আমি উনার নাম্বার দিয়ে উনার নাম্বার যে অপারেটরের সে  অপারেটরের মোবাইল অ্যাপ-এ লগইন করে যেখানে  কল  হিস্টোরি দেখা যায় । বাসায় এসে হিস্টোরি চেক করে দেখি, উনি আমাকে যে কয়টা হুমকিদাতার নাম্বার দিয়েছেন, তার একটা থেকেও গত একমাসে উনার মোবাইলে একটা কলও আসে নি । উনার বেশিরভাগ কথা হয়েছে দুটো নাম্বারে । এক উনার ছেলে। উনার ছেলের নাম্বারটাও উনি আমাকে দিয়েছিলেন, তাই চিনতে অসুবিধা হয় নি । অন্য নাম্বারটার ওপর আমার সন্দেহ হয় । তাই আমার গায়ে হলুদের দিন আমি সামি ভাই এর এক বন্ধুর সাহায্যে যে কল সেন্টারে চাকরি করে তার মাদ্ধমে এই নাম্বারের তথ্য সংগ্রহ করি । জানতে পারি, এই লোকের নাম আনিস, আর এ থাকে মিরপুরে । সামি ভাই-এর দেয়া সেই ঠিকানা অনুযায়ী আমি বিয়ের আগের রাতেই মানে গতকালই যাই ওই বাড়িতে সামি ভাই এর আরেক পরিচিত বন্ধু অপুর সাহায্যে । অপু সামি ভাইয়ের ছোট বন্ধু আর আমি অপুর সমবয়সী । অপু একজন পুলিশ অফিসার । উনার নিকট আমি অনেক কৃতজ্ঞ । যাই হোক। সেই বাড়িতে যেয়ে আমরা আনিসকে ধরে ফেলি । জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারি, এই আনিস হচ্ছে এই মিস্টার হাসানের ভাই । মিস্টার হাসান উনার স্ত্রীকে খুন করার জন্য আনিসকে বলে রেখেছেন । যখন জানতে পারলাম পরদিন মানে আজই উনি উনার স্ত্রীকে এই আনিসের মাদ্ধমে হত্যা করাবেন, তখন আমরা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলি । এই ভেবে, সময়মতো তাহলে আসতে পেরেছি । আমরা সে বাড়িতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি । আনিসের কাছে জানতে পেরেছিলাম মিসেস রেহানা একটু পাড়া বেড়াতে গেছেন । অনেকদিন পর চেনা এলাকায় গেলে যা হয় আরকি । মিসেস রেহানা ফিরে এলে উনাকে আমরা সব জানাই । আনিসের কাছে জানতে পারি, মিস্টার হাসান চেয়েছিলেন, আজ সকালে আটটার দিকে উনি উনার ভাই আনিসের সাহায্যে রেহানাকে মেরে আনিসের বাড়ির পেছনের পুকুরে ফেলে আসবেন, পরে লোকজনকে জানাবেন উনার স্ত্রীকে সেই হুমকিদাতারাই হত্যা করেছে । আমরা তখন উল্টো ফন্দি আটি । সকাল হলে আনিসকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে বলাবো আনিস ওর কাজ করেছে, আর মিস্টার হাসান সেই শুনে আমাকে কল করবেন । এই তো, তারপর আমি এলাম, আপনারাও এখানে, বাকিটা যা হল চোখের সামনেই তো দেখলেন ।” সবাই বেশ অনেক্ষণ চুপচাপ বসে রইল । মিস্টার হাসানের পা কাঁপছে, খেয়াল করলো আবির । একটু পর তিশা জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু উনি তো এমনিই বলতে পারতো উনার স্ত্রীকে হুমকিদাতা হত্যা করেছে, কিন্তু আপনাকে কেন ডাকলো?” আবির বলল, “দেশে আমার একটা ফেমাসিটি আছে, তাই পুলিশ তদন্ত করতে এলে আমার কথা শুনে অনেকটাই শিওর হয়ে যেতে পারতো যে সত্যি তাহলে এর পেছনে কোন হুমকিদাতার হাত আছে । উনি ভেবেছিলেন এতে উনার উপকার হবে, কিন্তু আমি উনার সব কিছু বানচাল করে দিলাম ।” দিহান জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু এই হত্যা করার কারণটা কি?” আবির বলল, “আপনার চাচা আনিসের কাছে যতদুর জানতে পারলাম, আপনাদের দাদা, মানে মিস্টার হাসানের বাবা মিস্টার হাসানকে পছন্দ করতেন না । কারণ মিস্টার হাসান ছোটবেলা থেকেই বদমেজাজি ছিলেন । তাই মিস্টার হাসানের বাবা নিজের সব সম্পত্তি নিজের বউমা, মানে মিসেস রেহানার নামে লিখে দিয়েছিলেন, সাথে এও লিখে দিয়েছিলেন, রেহানার মৃত্যুর পরেই এই মিস্টার হাসান সব সম্পত্তির মালিকানা পাবে । তাই মিস্টার হাসানের এই প্রচেষ্টা ।” অয়ন বলল, “ভাই! তুমি তো পুরাই কাঁপায় দিলা! চোখের সামনে ফেলুদাকে দেখছি মনে হচ্ছে! কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন, উনি এতো বছর কিছু করলেন না, এই সময় কেন সম্পত্তির জন্য এমন করছেন?” আবির মিস্টার হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, “সেটা আমারও প্রশ্ন । কোন জবাব পাওয়া যাবে কি?” মিস্টার হাসান লজ্জায় মাথা নিচু করে বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো ।





(২২৩)

আবির বলল, “কাজটা করার আগে আপনার লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল । এখন লজ্জা না পেয়ে বলুন কি হয়েছিলো আসলে ।” মিস্টার হাসান কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুখ খুলল, “আসলে……আপনারা সবাই তো জানেন, আমি একজন সাংবাদিক ছিলাম, সামির ছেলেটার সাথেও আমার পরিচয় ছিল । চাকরি থেকে আমি বিদায় নিয়েছি বছর তিন হল । কিন্তু শেষ দিন আমি মাদক চোরাচালানের ভিডিও ধারণ করেছিলাম এক ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক ব্যাক্তির । আফজাল হোসেন নাম উনার । আমার তখন টাকার লোভ জাগে খুব । আমি এই ভিডিও তাদের দেখিয়ে তাদের বলি আমারে লাখ ৩০টাকা দিতে, তা না হলে আমি এই ভিডিও ভাইরাল করে দেবো । সেই আফজাল হোসেন আমাকে মাসে মাসে ১ লাখ করে দেবে বলে জানায় । এভাবে প্রতি মাসে টাকা দিতে থাকে সেই আফজাল হোসেন । মাঝে মাঝে  ৫০,০০০ করেও দিতো,  তবে দিতো । এভাবে গত সপ্তাহেই টাকা দেয়া শেষ হয়েছে । টাকা দেয়া শেষ হতেই আমার কাছে আফজাল হোসেন সেই ভিডিও চাওয়া শুরু করে । আমি ভাবি এই ভিডিও দিয়ে কি আর হবে । দিয়েই দেই । একটা মেমোরি কার্ডে রেখেছিলাম সেই   ভিডিওটা, বেশ যত্ন করে । আমার খাটের পাশের ড্রয়ারেই রেখেছিলাম । কিন্তু খুঁজতে গিয়ে দেখি, মেমোরি  কার্ডটা  নেই । আমি ওদের যখন জানাই মেমোরিকার্ড  খুজে পাইনি, ওরা আমার কাছ থেকে ১০দিনের ভেতর টাকা ফেরত চায় । নইলে ওরা আমায় দিয়ে মিথ্যে মামলা করিয়ে জেলে ভরিয়ে দেবে বলেছিল । তাই অল্প সময়ে এতো টাকা জোগাড় করতেই আমার এই সিদ্ধান্তে আসা ।” দিহান “এক মিনিট” বলে ব্যাগ থেকে একটা মেমোরি কার্ড বের করে ওর বাবাকে দিয়ে বলে, “বাবা, এটাই  কি  তোমার সেই  মেমোরি কার্ড?” মিস্টার হাসান বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ! এটাই তো আমার মেমোরি কার্ড, তোর কাছে গেলো কি  করে?” দিহান বলল, “শেষবার যখন আমি এসেছিলাম, তোমার ড্রয়ারে  এটা পেয়েছিলাম । তাই আমি  নিজের কাছে  রেখে দিয়েছিলাম, তোমার কাজে লাগছে না, আমার  কাজে লাগতে পারে এই ভেবে কিন্তু এর  মধ্যে এই ভিডিও দেখে বুঝি তোমার জরুরী কিছু বোধ হয় ভিডিওগুলো । তাই  আসবার সময় মেমোরি কার্ডটা এবার আনলাম । গতকাল  দিতে মনে ছিল না । তবে ভালই হয়েছে, গতকাল দিলে হয়তো আজ তোমার আসল রূপ দেখতে পারতাম না ।” পুলিশ অফিসার অপু দিহানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ওটা আমায় দিন ।” দিহান পুলিশ অফিসার অপুর হাতে মেমোরি কার্ডটা দিলো । অপু তখন বলল, “আজ এই আফজাল হোসেন পুলিশের হাতে ধরা পড়বে, ও ক্ষমতাশালী হলে কি হবে, ওর চেয়েও ক্ষমতাশালীদের আমার চেনা আছে ।” মিস্টার হাসান বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই শয়তানদের শাস্তি হওয়াই উচিত ।” অপু বলল, “আপনার এতো খুশি হবার দরকার নেই । শাস্তি আপনারও হবে মিস্টার হাসান ।” এরপর অপু সাথে থাকা আরও কিছু পুলিশদের কি ইশারা করতেই মিস্টার হাসানের হাতে হাতখরা পড়িয়ে দিলো । তারপর মিস্টার হাসানকে নিয়ে  যেতে লাগলো । যাবার সময় নিজের স্ত্রীকে বলল, “আমায় ক্ষমা কোরো রেহানা ।” রেহানা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তোমায় আমি ভালোবেসেছিলাম, তোমায় আমি বিশ্বাস করতাম । তুমি সে  বিশ্বাসের মূল্য এভাবে দিলে? তুমি এমনি বললেও তো  সব সম্পত্তি আমি তোমার নামে করে দিতাম!” মিস্টার হাসান আর কিছু বলতে পারলো না । পুলিশ ওকে বাইরে নিয়ে গেলো । পুলিশ অফিসার অপু আবিরের কাছে এসে বলল, “আপনি সত্যি একটা অসাধারণ কাজ করেছেন, আমার নাম্বার তো আপনার কাছে আছেই, কখনও দরকার পড়লে অবশ্যই কল করবেন কিন্তু ।” আবির বলল, “জি অবশ্যই, আপনি তো একে আমার অনেক উপকার করলেন, তার  ওপর আমার সমবয়সী, বলতে গেলে ক্লাসমেটের মতোই, ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না আপনাকে, তবে আমার নাম্বারটাও কিন্তু আপনার কাছে আছে, দরকার হলে আমাকে মনে করতে ভুলবেন না যেন ।” “এবার তাহলে আসি?” বলল অপু । আবির জিজ্ঞেস করলো, “সেকি! আপনার কিন্তু আমার বিয়েতে দাওয়াত ছিল!” অপু হালকা হেসে বলল, “দেখুন, আমরা পুলিশের চাকরি করি, সবসময় তো আর ফ্রি থাকা সম্ভব হয় না, তবু, আপনি যখন বললেন, পরে একদিন ভাবির হাতের রান্না কবজি ডুবিয়ে খাবো ।” আবির বলল, “মনে থাকে যেন?” অপু হেসে বলল, “হ্যাঁ, অবশ্যই, আজ আসি তাহলে ।” বলে অপু চলে গেলো । মিসেস রেহানা, দিহান আর তিশাও আবিরের কাছে এলো । মিসেস রেহানা বলল, “বাবা, তুমি আমাদের অনেক বড় সাহায্য করলে । তোমায় যে কি করে ধন্যবাদ দেব!” দিহান বলল, “জি সত্যিই! আপনি না থাকলে আজ হয়তো আমার মাকে আমি আর……………থাক সেসব কথা । আপনার বিয়ে থেকে এসেছেন, তাই আর আপনাকে এখানে বসে সময় নষ্ট করতে বলবো না । তবে আমরা আপনার নিকট ঋণী হয় গেলাম, এ ঋণ কখনোই হয়তো শোধ করতে পারবো না ।” আবির বলল, “আর লজ্জা দেবেন না আমাকে । তবে আপনাদের পরিবারের ওপরও অনেক ধকল গেছে আজ । আপনাদের বিয়েতে দাওয়াত দিলেও আপনারা মানা করবেন জানি । তবু, বিয়ের পর আপনারা বাসায় আসবেন কিন্তু ।” রেহানা বলল, “হ্যাঁ বাবা, অবশ্যই যাবো, তুমিও এসো কিন্তু বাসায় ।” আবির “আচ্ছা” বলে সালাম জানিয়ে অয়ন আর সামির সাথে বেড়িয়ে এলো । বাইরে এসে সামি বলল, “আবির আমি তাহলে যাই রে ।” আবির বলল, “যাই  মানে, কোথায় যাবা?” সামি বলল, “কেন, বাসায়?” আবির বলল, “কি যে বলো না ভাই! সবাইকে কিছু বলিনি, তাই বলে তোমাকে আমি ছাড়ছি না! আমার আপন ভাই  নাই । তুমি আর সাবিত ভাই  আমার আপন ভাইয়ের মতো । তোমাদের উপস্থিতি ছাড়া আমার বিয়ে সম্ভব না ! চলো!” সামি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, আবির সুযোগ না দিয়েই বলল, “আর কোনো কথা না! তুমি চলো!” অবশেষে সামি গেলো আবির আর অয়নের সাথে ।




(২২৪) 

“প্লিজ আপু! আমার ওকে ঠকিয়ে বিয়েটা করতে ইচ্ছে করছে না!” “আঁখি! প্লিজ, আমার এই বিষয়টা মোটেও ভালো লাগছে না! প্লিজ আবিরকে এভাবে ঠকিও না!” “কে আবির! তোমার আপন ভাই? নাকি তোমার বাচ্চাকালের বন্ধু যে এতো চিন্তা করছ?” “আজ তুমি যদি কাউকে কিছু বলো, আমি তোমাকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হবো!” “এবার বলো, কাকে চাও তুমি, তোমার ওই এতিম ভাইকে বাঁচাতে, নাকি আমাদের সংসার না ভাংতে!” ড্রাইভিং করতে করতে এসব কথা বার বার ঘুরপাক খাচ্ছিলো সাবিতের । গাড়ির স্পিড ও যে এর মধ্যে বাড়িয়ে ফেলেছে তা ঠিক বুঝতে পারছে । এমন সময় সামনে থেকে আসা একটা মিছিল দেখতে পেয়ে গাড়ি একপাশে সরিয়ে নিলো সাবিত । দেখল, আবিরের দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো আবার চালু করার জন্য মিছিল হচ্ছে । লোকেরা স্লোগান দিচ্ছে, “টিআইস টিআইএস,  ফেরত চাই চাই, ফেরত চাই! আমাদের দাবি মানতে হবে! টিআইএসকে আনতে হবে” টিআই এস এর পূর্ণরূপ দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো । সাবিত অপেক্ষায় রইলো মিছিল শেষ হবার । মিছিলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছিল, “সারা দেশবাসি আবিরকে কত ভালোবাসে, অথচ ওর এতদিনের পরিচিত লোকেরা ওর এতো বড় একটা ক্ষতি করছে ।” এমন সময় সাবিত খেয়াল করলো, ভীড় থেকে এক মহিলা একটা বাচ্চাকে নিয়ে কোনোরকমে এলো এদিকে । সাবিতের গাড়ি দেখে সাবিতের দিকেই এগিয়ে এলো । তারপর সাবিতের গাড়ির জানালায় নক করলো । সাবিত জানালার কাচ নামিয়ে দিতেই মহিলাটা বলল, “বাবা, আমার একটা সাহায্য করবে? আমাকে দ্রুত একটা জায়গায় যেতে হবে । আমায় একটু নিয়ে যাবে প্লিজ!”

“চুনিকে রেখে এসেছিস?” ছাদে দাঁড়িয়েছিলো আঁখির বাবা, চয়নিকাকে নিচে রেখে আবার আঁখি ছাদে এসেছে । আঁখি বলল, “হ্যাঁ এসেছি ।” আঁখির বাবা জিজ্ঞেস করলো, “ওর রুমে কেউ নেই?”

“আছে, কিছু আন্টিরা ।” বলল আঁখি ।

“কি বলছিস! চুনি যদি উনাদের কিছু বলে দেয়!” জিজ্ঞেস করলো আঁখির বাবা ।

“কিচ্ছু বলবে না বাবা । আমি ওকে খুব ভালো করে চিনি । ও অন্তত বাইরের লোকেদের কিছু বলবে না ।” বলল আঁখি ।

“কিন্তু নিচে অয়নের গার্লফ্রেন্ড মাইশা আছে তো!” বলল আঁখির বাবা ।

“হুম! তাও তো একটা কথা!” একটু টেনশন নিয়ে বলল আঁখি ।

“তাড়াতাড়ি নিচে চল কিছু কাহিনী ঘটিয়ে ফেলবার আগেই! কিছুতেই ও যেন কাউকে কথাগুলো বলতে না পারে । তাহলে কিন্তু আবির ওর সাথে আর বিয়ে করতে চাইবে না ।” আঁখির বাবা দেখল আঁখির কি যেন দেখে ভয় পেয়ে গেছে । চয়নিকার বাবা আঁখির দৃষ্টি অনুযায়ী সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল, আবির আর অয়ন দাঁড়িয়ে ছাদের দরজার কাছে ।

“এদিকে তো সব আন্টিরা, ভেতরে যাই কি করে?” চয়নিকাকে দেখতে চয়নিকার রুমের সামনে এসে ভেতরে সব মহিলা মানুষ দেখে মনে মনে কথাটা বলল সামি । এমন সময় মাইশা এসে সামিকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি কাউকে খুজছেন?” সামি বলল, “হ্যাঁ মানে………না……আসলে, আবির আমার ছোট  ভাই এর মতো, ও যে চ্যানেলে দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো করত, সেই  চ্যানেলেরই খবর পাঠক আমি ।” মাইশা বেশ খুশি হয়ে বলে উঠলো, “ওয়াও! তাহলে আমি ঠিকই ধরেছি! আপনাকে আমি টিভিতে অনেক দেখেছি ।” সামি হালকা হাসিমুখে বলল, “হ্যাঁ, আসলে আবিরের স্ত্রীকে দেখতে এসেছিলাম,  আবির আর অয়ন কোথায় যেন গেল । কারা যেন বলল ওর স্ত্রীর বোন আর বাবা ছাদে তাই ছাদে গেলো । আমি এদিকে এসে দেখি ভেতরে সব মহিলা মানুষ । তাই কেমন কেমন লাগছে ।” মাইশা বলল, “আরে, সমস্যা নেই, আসুন আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি ।” সামি “থ্যাঙ্কস” বলে মাইশার সাথে ভেতরে গেলো ।

“আপনারা কোন জরুরী পারিবারিক গোপন কথা বলছিলেন মনে হয়, ডিস্টার্ব করলাম ।” হালকা হাসিমুখে বলল আবির । আঁখি আর ওর বাবা বুঝতে পারলো, আবির কিছুই শোনে নি । আঁখির বাবা আবিরের কাছে হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে বলল, “আরে না না, সমস্যা নেই । চল, অনেক দেরি করে ফেলেছো, কাজি সাহেব অনেক্ষন ধরে অপেক্ষা করছেন ।” আবির বলল, “আঙ্কেল! আপনার তো রেগে যাওয়ার কথা, কিন্তু রাগলেন না যে?” আঁখির বাবা বলল, “আজ বিয়ের দিন রাগ করতে নেই, চল যাই ।” বলে আবির, আঁখির বাবা, আর অয়ন নিচে গেলো । আঁখি মনে মনে বলল, “রাগে নি সাধে! বাবা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন আবির সবটা শুনে ফেলেছে কিনা, তাই রাগেন নি । তা না হলে আবিরের ওপর যে কি পরিমাণ রাগ ঝাড়তেন! যাই হোক, মা এখনও পৌঁছেই নি, এই অনেক । যাই, বিয়েটা তাড়াতাড়ি করিয়ে ফেলি ।” এরপর আঁখিও নিচে চলে গেলো ।

“অনেক ভালো লাগলো কথা বলে । তোমার আবির আমাকে নিজের বড় ভাইয়ের মতো ভালোবাসে । তাই তুমিও আমাকে নিজের দেবরের মতো ধরে নিতে পারো ।” চয়নিকার সাথে অনেক কথাবার্তা বলার পর এসব বলল সামি । এমন সময় চয়নিকা বলল, “সামি ভাই, আপনাকে শুধু দেবর না, ভাই ভেবে একটা সাহায্য চাই, আমাকে সাহায্য করবেন?” সামি ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চয়নিকার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “হ্যাঁ………অবশ্যই, বলো ।” চয়নিকা আশপাশে তাকিয়ে দেখে নিলো, আঁখি বা ওর বাবা আছে কি না ।




(২২৫) 

তারপর চয়নিকা বলতে লাগলো, “আসলে আপনাকে আবিরকে একটা কথা বলতে হবে । আমি……………।” কথা শেষ করার আগেই বাইরে থেকে আওয়াজ এলো, “এই সব ছেলেরা কোথায়! বর তো এখন কবুল বলবে, আয় তাড়াতাড়ি!” সামি চয়নিকাকে, “আচ্ছা, আমি ওদিকে যাই তাহলে, সব কথা পরে শুনবো ।” বলে তাড়াতাড়ি করে চলে গেলো সামি । চয়নিকা কিছু বলতে গিয়েও পারলো না । আবার কেদে ফেলল ।

এদিকে আবির জিজ্ঞেস করলো, “সাবিত ভাই কোথায়? উনাকে দেখছি না যে?” মাইশা বলল, “উনাকে দেখলাম তাড়াতাড়ি করে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে যেতে, কিছু হয়েছে কি?” চয়নিকার বাবা তখন বলল, “মানে আসলে, ওর হঠাৎ একটু পেটখারাপ হয়েছে তো, সেজন্য বাসায় গেছে ।” আবির বলল, “সে কি, এখানেও তো টয়লেট ছিল, ভাই বাসায় গেলো যে?” চয়নিকার বাবা বলল, “না না, এখানকার টয়লেটে একবার যাওয়া যায়, বারবার যাওয়া যায় নাকি, ওর পেটের অবস্থা খুব সিরিয়াস ।” আবিরের মনটা খারাপ হয়ে গেলো । বলল, “ইশ! ভাইকে ছাড়া কেমন লাগছে ।” চয়নিকার বাবা বলল, “কাজি সাহেব, এবার শুরু করেন ।” কাজি সাহেব  জিজ্ঞেস করলো, “বরপক্ষের কাউরেই  তো দেখতেছি না? বরের অভিভাবক কই?” আঁখির বাবা বলল, “দেখুন, ওর বাবা মা নেই, ছোট বেলা থেকে যারা ওকে পালন করেছে, তারাও নেই, আমাদের কাছেই তো পালিত হয়েছে ।” “কে কইছে ওর কেউ নাই?” কথা শুনে সবাই রুমের দরজার দিকে তাকাল । দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একজন পুরুষ, দুজন মহিলা । এই পুরুষ মানুষটা আবিরের সেই রায়হান ভাই, আর মহিলাদের একজন কলিমা আপু অন্যজন রায়হান ভাই এর স্ত্রী । আবিরও সেদিকে তাকিয়ে খুশি হয়ে গেলো । চয়নিকার বাবা জিজ্ঞেস করলো, “একি, আপনারা কারা?”  আবির বলল, “ছোটবেলা থেকে আমাকে যারা পালন করেছেন, তাদের মধ্যে এনারা দুজন । আমার বিয়ের অভিভাবক এনারাই, আমার বোন, আর আমার ভাই । আমি উনাদের খবর দিয়ে রেখেছিলাম, তা উনারা আসতে একটু দেরি করে ফেললো ।” রায়হান কাজি সাহেবের কাছে যা যা বলার তা বলল । এরপর কাজি সাহেব নিয়ম মোতাবেক যা যা বলার, সব বললেন, তারপর আবিরকে বললেন, “বলেন কবুল!” আবির বলল, “কবুল ।” কাজি সাহেব আবার বলল, “বলেন কবুল?” আবির আবার বলল, “কবুল ।” কাজি সাহেব বলল, “শেষবারের মতো বলুন, কবুল!” আবির বলল, “কবুল ।” বলে আবির লজ্জায় মুচকি হাসতে হাসতে মাথা নিচু করলো । কাজি সাহেব বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ্‌!” আবির এরপর কাবিননামায় সই করলো । অয়ন বলল, “ভাই,  অবশেষে তুমি আমাদের চুনি আপুর স্বামী হলে ।” কাজি সাহেব বললেন, “না, এখনও বউয়ের কাছ থেইকা কবুল শোনা বাকি ।” মেয়েরা সবাই কাজী সাহেবকে নিয়ে বউয়ের  ঘরে গেলো ।  সাথে গেলো, অয়ন আর চয়নিকার বাবা-ও । সামি আবিরের গাল টেনে ইয়ার্কি করে বলল, “কিরে জুনিয়র, বিয়েটা অবশেষে করেই ফেললি, তা বাবা হবার সুখবরটা কবে শুনবো?” আবির বলল, “ভাই, কি যে বলেন না, আগে বিয়েটা হোক, পরে বোঝা যাবে ।” “স্যার, আমু?” ডাকটা শুনে দরজার দিকে তাকাল আবির । দেখল, ওর চয়বির গার্মেন্টসের দারোয়ান, সাথে উনার মেয়ে । আবির হাসিমুখে দাঁড়িয়ে বলল, “আরে চাচা! আসেন আসেন ।” দারোয়ান আবিরের কাছে গেলো । বলল, “স্যার, আইতে একটু দেরি হইয়া গেলো । আমার মাইয়া আপনেরে দেখতে চাইল তো, তাই লইয়া আইলাম ।” আবির দারোয়ানের মেয়েটাকে কোলে তুলে নিলো । তারপর বলল, “কি খবর আম্মু, নাম কি তোমার?” মেয়েটা বলল, “আনতেল, আমি দন্না, আমি আপনান অনুত্তানের অনেক বদো বক্ত ।” আবির বলল, থ্যাঙ্ক ইউ! কিন্তু নামটা এখনও বুঝলাম না কিন্তু । দারোয়ান বলল, “স্যার, ওর নাম ঝর্না, এহনও কথা কওয়া শেখে নাই তো ।” আবির বলল, “বাহ খুব কিউট নাম । আপনি যান, ওদিকে বউয়ের কাছ থেকে তিনবার কবুল শোনার জন্য সবাই গেছে, আপনি যান, দেখে আসুন, আর আমার স্ত্রীকে দেখে আসুন । আর না খেয়ে যাবেন না কিন্তু!” দারোয়ান ডানে মাথা কাত করে “আইচ্ছা স্যার!” বলে চলে গেলো । এদিকে কাজি সাহেব চয়নিকার সামনে যা যা বলার বলে জিজ্ঞেস করলেন, “বলেন মা কবুল ।” চয়নিকা কিছু বলে না । নীরবে চোখের পানি ফেলতে থাকে । কাজি সাহেব আবার বলে, “বলেন কবুল!” চয়নিকা তাও কিছু বলে না । সবাই অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাতে থাকে, কেউ কেউ বলতে থাকে “কি হল!” “কবুল বলছে না কেন” ইত্যাদি ইত্যাদি । কাজি সাহেব বললেন, “আপনি কি আমার কথা শুনতে পান নি? বলেন কবুল!” চয়নিকা তাও চুপ । কাজি সাহেব আবার বললেন, “বলেন মা কবুল!” আঁখির চয়নিকার কানের কাছে  এসে ফিস ফিস করে বলল, “সিন ক্রিয়েট করিস না প্লিজ! কবুল বল!” কাজি সাহেব আবার বললেন, “বলেন মা কবুল?” চয়নিকা অবশেষে কবুল বলল । কাজি সাহেব বললেন, “ আরেকবার বলেন কবুল?” চয়নিকা আবার বলল, “কবুল ।” কাজি সাহেব বললেন, “আরেকবার বলেন মা কবুল?” চয়নিকা শেষ  বারের মতো কবুল বলে কেদে ফেললো । আশেপাশের সবাই বেশ খুশি হল, কাজি সাহেব বলে উঠলেন আলহামদুলিল্লাহ্‌ । চয়নিকা কাবিননামায় সই করলো । এরপর আবিরকে এনে চয়নিকার পাশে বসানো হল । কাজি সাহেব মোনাজাত ধরলেন, কাজি সাহেব আল্লাহ তায়ালার কাছে আবির আর চয়নিকার সাংসারিক জীবনে সুখ সহ আরও নানা  ব্যাপারে দোয়া করলেন । মোনাজাত শেষে কাজি সাহেব বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ্‌, আপনারা এখন ধর্মীয় ও  রাষ্ট্রীয় নিয়ম মোতাবেক স্বামী স্ত্রী । আপনাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে ।” “না!!” হঠাৎ কান্না মিশ্রিত এক মহিলা কণ্ঠের আর্তনাদের আওয়াজে সবাই দরজার দিকে তাকাল ।






(২২৬)

আশেপাশে থাকা যারা বসে ছিল সবাই দাঁড়িয়ে গেলো । মহিলাটার সাথে একটা বছর ১১-র একটা বাচ্চা ছেলে, সাথে সাবিতও রয়েছে । মহিলাটার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে । মহিলাটার পাশে থাকা বাচ্চা ছেলেটা হা করে তাকিয়ে আছে । সাবিতও নিজের মুখের ওপর হাত চেপে ধরল কিছু একটা করতে পারে নি দেখে আফসোস করছে । মহিলাটার হাতে একটা ভ্যানিটি ব্যাগ ছিল, সেটা মেঝেতে পরে গেলো, তারপর মহিলাটা মাটির ওপর বসে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো । আশেপাশে থাকা সব অতিথিরা শোরগোল শুরু করে দিলো । আবির সাবিতকে জিজ্ঞেস করলো, “ভাই! কে উনি! আর এভাবে কাঁদছেন কেন?” সাবিত কিছু বলল না । সাবিতের খুব মন খারাপ হয়ে গেছে । সাবিত কিছুই জবাব দিতে পারলো না । আবির জিজ্ঞেস করলো, “ভাই! কি হল! কিছু বলো!” সাবিত নিজেকে খানিক সামলে নিয়ে বলল, “আবির শোন, তোকে এখন এমন কিছু কথা শুনতে হবে যা শুনলে তুই হয়তো স্বাভাবিক নাও……………।” সাবিতের কথা শেষ হতে না হতেই চয়নিকা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “উনি আমার মা!” আবির কথাটা শুনে খুব খুশি হল । বলল, “উনি তোমার মা! মানে আমার শাশুড়ি মা! আমার মা!” পরক্ষনেই আবিরের মুখ থেকে হাসিটা চলে গেলো । অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু মা কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে উনার?” কেউ কোন কথা বলল না । আবির আবার জিজ্ঞেস করলো, “আর ওই বাচ্চাটা কার?” কেউ কোন কথা বলল না । সবাই চুপ । আবির সবার চেহারার দিকে তাকাল । সবাই যে কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত তা ঠিকই বুঝতে পারছে । আবির চয়নিকাকে জিজ্ঞেস করলো, “চুনি! কিছু বল! কি হয়েছে!” চয়নিকা কিছুই বলে না । শুধুই কাদে । আবির চয়নিকার বাবার কাছে গেলো । বলল, “আঙ্কেল! প্লিজ বলুন না! কি হয়েছে!” চয়নিকার বাবা মাথা নিচু করে । কোন জবাব দেয় না । আবির আঁখির কাছে যায় । জিজ্ঞেস করে, “আপু তুমি তো অন্তত বলো কি হয়েছে?” আঁখিও কিছু বলে না । মাথা নিচু করে আবিরকে নিরাশ করে । আবির অয়নের কাছে যায় । বলে, “তুই তো কিছু বল!” অয়ন জবাব দেয়, কিন্তু তা আবিরের প্রশ্নের জবাব মিটায় না, “ভাই, আমি আগেও বলেছি, একই প্রশ্ন আমারও, আমার পরিবারের সাথে কিছু একটা ঝামেলা রয়েছেই, যা আমার অজানা ।” আবির সাবিতের কাছে যায় । বলে, “ভাই, তুমি কিছু বলো! তুমি প্লিজ আমাকে নিরাশ কোরো না!” সাবিত বলে, “আবির, তোকে বলার মুখ নেই আমার রে, আমি তোকে সাহায্য করতে পারলাম না, বড় ভাই হিসেবে নিজের কর্তব্য পালন করতে পারলাম না । সরি রে ।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “কর্তব্য! কিসের কর্তব্য! কিছু বলো ভাই! ভাই!!” সাবিত মাথা নিচু করে, কিছু বলে না । আবির এবার যায় ওর শাশুড়ি মায়ের কাছে । মাটিতে হাটু গেড়ে বসে শাশুড়ি মায়ের দু কাধে হাত রেখে আবির জিজ্ঞেস করে, “মা কি হয়েছে আপনার?” চয়নিকার মা আবিরের দিকে তাকায় । হালকা কান্না থামে উনার । তারপর হাত দিয়ে আবিরের গাল ছুয়ে সে হাতে চুমু খেয়ে বলে, “আমায় ক্ষমা কোরো বাবা, আমি সাবিতের মতোই বলবো, আমিও তোমার মা হিসেবে নিজের কর্তব্য পালন করতে পারলাম না ।” বলে চয়নিকার মা আবার কান্না করতে থাকে । আবির আর কিছু জিজ্ঞেস করে না । জানে জবাব পাবে না । ছেলেটার দিকে তাকায় । কি সুন্দর নিষ্পাপ একটা মুখ । এর কাছে কোন জবাব আবির পাবে না জানেই । আবির দাঁড়িয়ে চেচিয়ে বলে ওঠে, “কেউ কিছু তো বলো! হচ্ছে টা কি এখানে! কিসের কর্তব্যর কথা বলছে!” চয়নিকা কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো, “তোমাকে ঠকানোর হাত থেকে বাঁচানোর কর্তব্য ।” আবির চমকে ওঠে । ভ্রু কুঁচকে যায় । চয়নিকার মায়ের দিকে তাকায় একবার । তারপর চয়নিকার কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করে, “কর্তব্য! কিসের কর্তব্য?” কেউ কিছু বলে না । আবির আবার চেচিয়ে ওঠে, “কি হল! কেউ কিছু বলো!” সামি এগিয়ে এসে বলে, “আবির শান্ত হ! এখানে অনেক লোকজন আছে!” সাবিত বলে উঠলো, “থাকুক! লোকজনের দেখা উচিত আমার শশুরবাড়ির লোকজন কত বড় ঠকবাজ ।” সাবিতের গলায় ক্ষিপ্ততা প্রকাশ পায় । আঁখি ইশারা করে সাবিততে চুপ থাকতে বলে, কিন্তু সাবিত সেটা না শুনে বলে, “উহু, আজ আমি আর তোমার কথা শুনবো না, তাতে তুমি আমাকে ডিভোর্স দাও আর যাই করো ।” এরপর সাবিত আবিরের কাছে যেয়ে আবিরকে বাচ্চাটাকে দেখিয়ে বলে, “ওই যে বাচ্চা ছেলেটা দেখছিস, কে ওটা জানিস?” আবির বাচ্চাটার দিকে তাকায় । কিছু বলে না । সাবিত বলে, “ওটা তোর স্ত্রী চয়নিকার ছেলে!” আবির পাথর হয়ে যায় । এক দৃষ্টিতে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থাকে । চয়নিকা কাঁদতে থাকে । লোকজন শোরগোল করতে থাকে । অয়নও অবাক হয়ে যায় । যেন কিছুই ওর মন বিশ্বাস করতে চাইছে না । আবির বেশ অনেক্ষন পর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “না না না,  এ………এটা কিছুতেই সত্যি হতে পারে না! আমি বিশ্বাস করি না ।” আবির চয়নিকার কাছে যেয়ে বলল, “চুনি! বলো এটা মিথ্যা! বলো সাবিত ভাই মিথ্যা বলছে বলো!” চয়নিকা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “না আবির! সাবিত ভাই যা বলছে সবটা সত্য । আমি ক্লাস এইট থেকে ওই বাচ্চার মা ।” বলে কাঁদতে কাঁদতে মাটির ওপর হাটু গেড়ে বসে পড়লো চয়নিকা । তাও কাঁদছে । সামি তাড়াতাড়ি করে একটা চেয়ার এনে আবিরকে বলল, “আবির বোস এখানে ।” আবির চেয়ারে বসলো ঠিকই, কিন্তু ওর যেন হুশ থেকেও নেয় । এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, যেন কোথায় হারিয়ে গেছে আবির ।





(২২৭)

এবার আবিরের শাশুড়ি মুখ খুলল, “আজ থেকে প্রায় ১১ বছর আগে কথা । আমরা সপরিবারে যশোরে ছিলাম । সে সময় আমার মেয়ে চয়নিকা ক্লাস এইটে পড়ত ও তখন একটা ছেলের সাথে রিলেশনে ছিল । হঠাৎ একদিনের দুজনকেই বোধ হয় ইবলিশ পথভ্রষ্ট করে জঘন্য কাজে লিপ্ত করেছিলো । যার দরুন আমার এই মেয়েটা সন্তান সম্ভবা হয়ে যায় । আমরা মান সম্মানের ভয়ে ঢাকায় চলে আসি । আল্লাহর রহমতে ওর চাচা নিজের বিল্ডিংটা আমাদের নামে লিখে দেন । আর ওর বাবা অনেক কষ্টে আপনজনদের সহায়তায় একটা বেসরকারি টিভি চ্যানেলের প্রোগ্রাম ম্যানেজার হয়ে যায় । কিন্তু সমস্যা থাকে এই মেয়ের অপ্রাপ্ত বয়সে মা হবার খবর শুনলে লোকে তো ছি ছি করবে, তাই আমরা আঁখির পড়াশুনার জন্য জমানো টাকা দিয়ে আমি চয়নিকার এই ছেলেকে নিয়ে লন্ডন চলে যাই । সেখানে একটা ছোটোখাটো চাকরিও পাই, প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি । এভাবেই আমাদের চলছিলো । চুনির বিয়ের আগে দেশে আসবো না ঠিক করেছিলাম। আমি চেয়েছিলাম চুনির বিয়ে যার সাথে হবে সে যেন সত্যটা শুনে তবেই বিয়ে করে । কিন্তু আঁখির কাছে যখন জানতে পারলাম ওরা তোমাকে কিচ্ছু জানায় নি, তাড়াতাড়ি করে চলে এলাম । কিন্তু আমি অনেক দেরি করে ফেলেছি!” শেষ লাইন বলতে বলতে মহিলা আবার কেদে ফেললো । আবির এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে, যদিও ওভাবেই সবটা শুনেছে আবির, ওভাবেই তাকিয়ে থেকে হঠাৎ আবির বলে উঠলো, “ছেলেটার নাম রাজ, তাই না?” চয়নিকা, ওর বাবা, আঁখি, ওর মা, সবাই অবাক হয়ে গেলো । আঁখি জিজ্ঞেস করলো, “তু…তুমি জানলে কি করে?” আবির বলল, “রাজ আমার ভাই ছিল বলতে গেলে, কিন্তু এখন আমি ওকে ঘৃণা করি ।” তারপর আবির ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই ছেলেটা যদি রাজের না হয়ে অন্য কারো হতো তাহলেও কষ্টটা আমার একটু হলেও কম হতো ।” কেউ আর কোন কথা বলল না । একটু আগেও এখানে যে আনন্দটা ছিল, এখন তার কিছুই নেই । সাবিত মেহমানদের উদ্দেশ্য করে বলল, “আজ যা হয়েছে তার জন্য আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি, আপনারা প্লিজ খাবারের ওখানে যান, না খেয়ে যাবেন না প্লিজ!” তারপর একে একে সব মেহমান খাবারের ওখানে চলে গেলো । শুধু রইল চয়নিকাদের পাশের বাসার আনটি । উনি বলল, “সাবিত বাবা, আমার মনে হয় এখন ভাবির কাছে থাকা উচিৎ, আমি তোমাদের অবস্থাটা বুঝতে পারছি, টেনশন কোরো না, আমি ভাবির সাথে আছি ।” বলে পাশের বাসার আনটি চয়নিকার মা-কে নিয়ে একটা চেয়ারে বসাল । এদিকে ছোট ছেলেটা আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে অনেক্ষন থেকে । একটু পর ও আবিরের কাছে গেলো । সবাই দেখছে, কি করে ছেলেটা । আবিরের কাছে যেয়ে ছেলেটা বলল, “তুমি কি আমার বাবা?” আবির ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকে । যাই হোক, ছেলেটার তো কোন দোষ নেই, ও তো নিষ্পাপ । কিন্তু কেন যেন আবিরের মন মানতে চায় না । ছেলেটা হয়তো আবিরের কাছে বাবার আদর পেতে এসেছিলো, আবিরের হাতে ছেলেটা যেই হাত রাখল, আবির দাঁড়িয়ে গেলো । ছেলেটা ভয়ে চয়নিকার মায়ের কাছে চলে গেলো । বাইরে থেকে সে সময় আজানের আওয়াজ এলো । আবির, “আমি নামাজে যাচ্ছি ।” বলে চলে গেলো সেখান থেকে । চয়নিকার আবার কান্না শুরু করে দিলো । চয়নিকার মা ছেলেটাকে চয়নিকার দিকে ইশারা করে দেখিয়ে বলল, “ওইযে, উনি তোর মা, যা ওর কাছে ।” ছেলেটা চয়নিকার কাছে গেলো । ডেকে উঠলো, “মা!” চয়নিকা ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো ।

সন্ধার দিকে কথা । মসজিদ থেকে সবাই মাগরিবের নামাজ পড়ে বেরোচ্ছে, বিয়ে থেকে সবাই বেড়িয়ে গেছে, চয়নিকারা সব বাসায় ফিরে এসেছে । কমিউনিটি সেন্টারে ছিল সাবিত আর অয়ন আবিরের অপেক্ষায় । কিন্তু মাগরিবের নামাজ শেষ হয়ে গেলো আবিরের এখনও ফেরার নাম নেই, সেই যে যোহরের নামাযে গিয়েছিলো । অয়ন বাইরে যতো মসজিদ আছে সেগুলোয় খুজে এসে  সাবিতকে বলল, “না ভাই, কোথাও পেলাম না । আবির ভাই যে কোথায় গেছে ।” সাবিত বলল, “কোথায় গেলো তাহলে! ফোনটাও সুইচড অফ করে রেখেছে ।”

এদিকে বাসায় তখন ড্রইং রুমে বসে চয়নিকার বাবা, চয়নিকার মা, পাশের বাসার আনটি, আঁখি, রায়হান, রায়হানের স্ত্রী, আর কলিমা । কলিমা জিজ্ঞেস করলো, “আবিররে পাইল নাকি ওরা? এহনও আইতাছে না যে?” চয়নিকার বাবা বলল, “দাড়াও আমি ফোন করি ।” বলে চয়নিকার বাবা ফোন করলো সাবিতকে ।

“জি আঙ্কেল বলেন ।” ফোন ধরে বলল সাবিত ।

“আবির কি এসেছে বাবা?” জিজ্ঞেস  করলো চয়নিকার বাবা ।

“না আঙ্কেল, এখনও আসে নি ।” বলল সাবিত ।

“হায় হায়! তাহলে  ছেলেটা  গেলো কোথায়? মসজিদে দেখেছো?” জিজ্ঞেস করলো চয়নিকার বাবা ।

“জি আঙ্কেল, মসজিদেও নেই । আমার মনে হয় আবির নামাজ পড়ে অন্য কোথাও গেছে ।” বলল সাবিত ।

“অন্য কোথায়! আর কোথায় যাওয়ার জায়গা আছে ওর?” জিজ্ঞেস করলো চয়নিকার বাবা ।

চয়নিকার বাবার কথা শুনে রায়হান বলল, “আছে! ওর একখান জায়গা আছে!” চয়নিকার বাবা রায়হানের দিকে তাকাল । রায়হান বলল, “ওর যখন মন খারাপ হইত, তখন ও রেইলইস্টিশনের পাশে বইসা থাকতো ।” চয়নিকার বাবা সাবিতকে বলল, “হ্যালো সাবিত বাবা, একটু কমলাপুর স্টেশনের ওখানে যেয়ে দ্যাখো তো, পাও কি না ।” সাবিত জিজ্ঞেস করলো, “স্টেশনের ওখানে?” চয়নিকার বাবা বলল, “হ্যাঁ, ওখানে থাকতে পারে আবির ।”





(২২৮)

সাবিত ফোন রেখে বলল, “অয়ন চল ।” বলে গাড়িতে উঠতে লাগলো । গাড়িতে উঠতে উঠতে অয়ন জিজ্ঞেস করলো, “কোথায়?” সাবিত বলল, “কমলাপুর রেইলওয়ে স্টেশন ।”

“আল্লাহ! কি থেইকা যে কি হইয়া গেলো ।” বলে উঠলো কলিমা । আঁখি বলল, “কি দিয়ে কি হয়েছে মানে!” রায়হান বলল, “ক্যান! আপনাগো জইন্যেই তো হইছে! এহন ভালো সাজেন ক্যান!” আঁখি রেগে যেয়ে বলল, “এ! শাট আপ! নিজের স্ট্যাটাস দেখে কথা বলবেন!” কলিমা বলল, “আমগোরে ইস্ট্যাটাস  দেহান! আরে মনের ইস্ট্যাটাসে বড় কেডা তা তো দ্যাহেন!” আঁখি আরও রেগে  যেয়ে বলল, “এই! আমি কিন্তু আপনাদের বাড়ি থেকে বের করে দিতে বাধ্য হবো!” রায়হানের স্ত্রী বলল, “আহ! রায়হান, কলিমা, তোমরা থামো দেহি!” আঁখির বাবাও বলল, “হুম, আঁখিও থাম । যা হবার, তা তো হয়েই গেছে । আচ্ছা, চুনি কোথায় রে?”

“মা, আমরা কি আবার তোমাকে ছেড়ে চলে যাবো?” চয়নিকাকে জিজ্ঞেস করলো ওর ছেলে । চয়নিকা কোন জবাব দেয় না । বারান্দায় ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আবিরের অপেক্ষায় । চয়নিকার ছেলে অনেক্ষন ধরেই নানা প্রশ্ন করছে, কিন্তু চয়নিকা কোন জবাব দেয় না । একটু পর চয়নিকার মা আসে চয়নিকার রুমে । তারপর নাতিকে কোলে নিয়ে বলে, “আয়, আমার কাছে আয়, চল আমরা বাইরে যাই, মা-কে একটু একা থাকতে দে ।” চয়নিকার তখনও চুপ কিছুই বলছে না । চয়নিকার ছেলে নানিকে জিজ্ঞেস করলো, “নানি, মা কেন কথা বলছে না?” চয়নিকার মা বলল, “তোর মায়ের মন খারাপ, তুই-ও তো আমার সাথে এমন করিস, করিস না?” চয়নিকার ছেলে বলল, “নট অল দ্যা টাইম, বাট যখন আমার এরকম মন খারাপ হতো, কোন না কোন কারণ থাকতো, মায়ের কেন মন খারাপ?” চয়নিকার মা বলল, “সেটা মায়ের মন খারাপ চলে গেলে জিজ্ঞেস করিস?” চয়নিকার ছেলে  আর কিছু বলল না । চয়নিকার মা চয়নিকার ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলল, “যা, নানার কাছে ।” নানির কথায় মাথা কাত করে সম্মতি জানিয়ে নানার কাছে চলে গেলো চয়নিকার ছেলে । চয়নিকার মা চয়নিকার কাছে এগিয়ে এসে চয়নিকার কাধে হাত  রেখে বলল, “মন খারাপ করিস না মা, দেখিস, সব ঠিক হয়ে যাবে ।” চয়নিকা এতক্ষণ পর মুখ খুলল । বলল, “আমি কিন্তু চাই নি আবিরকে ঠকাতে, আমি আবিরকে বলে দিতে চেয়েছিলাম সব বিয়ের আগেই, কিন্তু আপু আর বাবা আমাকে অনেক বাধা দিলো ।  আমি আর কি করতাম বলো মা? আমার কি দোষ এখানে?” চয়নিকার মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে বলল, “ওরে, চিন্তা করিস না । তোর কোন দোষ নেই । দেখিস, সব ঠিক হয়ে যাবে ।” চয়নিকা জিজ্ঞেস করলো, “সত্যিই কি সব ঠিক হয়ে যাবে মা? আবির কি আমার সাথে সংসার করতে রাজি হবে?”

“ভালো  করে দ্যাখ, দেখতে পাশ নাকি আবিরকে ।” গাড়িতে করে যেতে যেতে চারপাশে তাকিয়ে দেখতে দেখতে অয়নকে কথাটা বলল সাবিত । একটু দুরেই রাস্তা শেষ । এরপরে রেইল লাইনটা অন্য দিকে ঘুরে গেছে । সেদিকে গাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব না । সাবিত বলল, “এদিক দিয়ে তো গাড়ি যাবে না । ওদিকেই তো জেজেএ রেস্টুরেন্ট ছিল মনে হয় । ওদিকেই কি আবির আছে?” অয়ন জিজ্ঞেস করলো, “আমি যেয়ে দেখে আসবো?”  সাবিত বলল, “না না, এতো রাতে তুই একা যাস না । এই জায়গা-ও তেমন সেইফ না ।” অয়ন জিজ্ঞেস করলো, “তাহলে কি করবো?” সাবিত কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “চল, দুজনেই যাই । গাড়িটা এখানে রেখে ।” অয়ন আর সাবিত গাড়ি থেকে নামলো । তারপর রেইললাইনের পথ ধরে হাঁটা শুরু করলো ।

“আসুক ছেলেটা, আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো । আমার ওর সাথে ওই অল্প ক্ষণের পরিচয়েই যা মনে হল, ছেলেটা তেমন খারাপ নয় ।” চয়নিকাকে বলল চয়নিকার মা । চয়নিকা নিজেকে একটু স্বস্তি দেবার জন্যই মাকে জিজ্ঞেস করলো, “খেয়েছো?” চয়নিকার মা বলল, “তুই এখনও খাস নি, বাড়ির কেউ এখনও খায় নি, আমি কি করে খাই বলতো?” চয়নিকা কিছু বলল না । একটা গাড়ির আওয়াজে বাইরের দিকে তাকাল, কিন্তু এটা আবিরের বা সাবিতের না । অন্য কোন গাড়ি । চয়নিকার মা তখন বলল, “চল তাহলে, আমরা খাওয়া দাওয়া করি?” চয়নিকা বলল, “তোমরা করলে করো, আমি আবির এলেই খাবো ।” চয়নিকার মা হাসিমুখে বলল, “বাহ, বিয়ে হতে না হতেই আমার মেয়ের দেখি বরের প্রতি এতো যত্ন!” চয়নিকা লজ্জা পেয়ে মুচকি হেসে মাথা নিচু করলো কিছু বলল না ।

এদিকে বেশ খানিকটা পথ রেললাইনের ওপর দিয়ে হেটেও আবিরের খোজ পেলো না অয়ন আর সাবিত । সাবিত অয়নকে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে! এদিকেও তো নেই । তবে কি আবির এদিকেই নেই?” অয়ন বলল, “কি জানি । তবে আরেকটু সামনের দিকেই সেই জায়গা যেখানে জেজেএ রেস্টুরেন্ট ছিল ।”সাবিত সামনের দিকে  তাকাল । অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না । বলে উঠলো, “ওদিকে তো বেশ অন্ধকার রে ।” ওদিকে থেকেই একটা ট্রেন আসার আওয়াজ শুনল । আওয়াজটা আরও আগে  থেকেই শুনেছে, তবে এখন মনে হচ্ছে প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে । একটু পরই ট্রেন ওদের দৃষ্টি গোচর হল । একটু পর ট্রেন আরও কাছে এলো । ট্রেনের সামনের লাইটে যদ্দুর দেখল, মনে হল কেউ একজন ট্রেনের সামনে বসে আছে, আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ট্রেন তার ওপর দিয়ে যাবে । অয়ন আর সাবিত ভালো করে তাকাল সেদিকে । অয়ন বলল, “ওটা কি আবির ভাই!” সাবিত ভয় পেয়ে বলে উঠলো, “আবির চলন্ত ট্রেনের সামনে কি করছে!” আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ট্রেনটা লোকটার ওপর দিয়ে যাবে, এমন একটা অবস্থা । অয়ন আর সাবিত প্রচন্ড ভয়  পাচ্ছে । বেশ কয়েকবার “আবির! আবির!” বলে চেঁচাল, কিন্তু ট্রেনের আওয়াজের জন্য সে আওয়াজ বোধ হয় ওই লোকটার কানে পৌঁছেই নি ।





(২২৯) 

এই ট্রেন লোকটাকে চাপা দিলো বলে! এমন সময় অয়ন আর সাবিত চোখ বন্ধ করে ফেললো । এরকম মর্মান্তিক দৃশ্য কে দেখতে চায় । তবে কোন চিৎকারের আওয়াজ শুনতে  পেলো না । একটু পর চোখ খুলে চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে আসা আলোর সাহায্যে দেখলো, লোকটা ট্রেনের নিচে চাপা পড়ার আগেই সরে গেছে সেখান থেকে । সাবিত আর অয়ন দৌড়ে গেলো সেখানে  । কাছে আসতেই দেখলো, আসলেই এটা আবির । আবিরও ওদের দেখেছে । আবির কিছু বলার আগেই সাবিত বলে উঠলো, “আবির! তুই ঠিক আছিস! কি করতে যাচ্ছিলি তুই! কিছু হয় নি তো!” আবির হালকা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, “আমি কি করতে যাবো?” সাবিত হালকা রেগে গিয়ে বলল, “আরেকটু হলেই তো ট্রেনের নিচে চাপা পড়তি তুই!” আবির হেসে উঠে বলল, “আরে ও কিছুই না, আর ট্রেন আমার থেকে তো অনেক দুরেই ছিল, তোমরা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছো বলে হয়তো তোমাদের মনে হয়েছে ট্রেন আমার অনেক কাছে ।” অয়ন জিজ্ঞেস করলো, “তুমি আমাদের না বলে এখানে কি করছো!” আবির বলল, “আমার মন খারাপ হলেই আমি এখানে আসতাম, এখানে এলেই আমার কেন যেন পুরনো কথা মনে পড়ে যায়, আর মন ভালো হয়ে যায় ।” সাবিত জিজ্ঞেস করলো, “এখানে কি কোন পরী এসে তোরে জাদু করে দিয়ে যায়?” আবির আবার হেসে বলল, “না ভাই, দেখবে, কি করে মন ভালো হয়?” সাবিত কিছু বলল না । অয়ন বলল, “দেখবো ।” আবির বলল, “তাহলে ট্রেনটা যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো ।” কিছুক্ষনের ভেতর ট্রেন চলে গেলো । ধীরে ধীরে জায়গাটা নিস্তব্ধ হয়ে গেলো । চারপাশে ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে । আবির বলল, “একটু ওপরে তাকাও দুজনেই ।” অয়ন আর সাবিত ওপরে তাকালো । যেন মনে হচ্ছে ওরা মহাকাশে চলে এসেছে, কোটি কোটি তারা দেখা যাচ্ছে  আকাশে । সাবিত বলল, “ওয়াও! সিরিয়াসলি বলছি, বহুদিন পর এমন দৃশ্য দেখলাম ।” আবির বলল, “হুম, আলোয় ভরা ঢাকা শহরে এসব দেখাও কষ্টকর, এই জায়গাটা অন্ধকার বলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ।” একটু পর পর মৃদু  বাতাস  বইছে । সেটাও অনুভব করতে বেশ লাগছে । আবির জিজ্ঞেস করলো, “বাতাসটা অনুভব করতে পারছো বোধ হয়?” দুজনেই হুম বলে উঠলো । আবির বলল, “আরও একটা জিনিস আছে ।” অয়ন আর সাবিত আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে আবিরের দিকে তাকাল । সাবিত জিজ্ঞেস করলো, “কি?” আবির রেললাইনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, “এদিকে আসো ।” তারপর আবিরের সাথে অয়ন আর সাবিত গেলো রেল লাইনের কাছে । আবির রেল লাইনের থামের ওপর কান পাতলো আর অয়ন আর সাবিতকেও বলল কান পাততে । দূরে কোথাও ট্রেনের চলছে, তার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । এ শব্দ শুনলে পুরনো দিনের কথাগুলো মনে পড়ে যায় । বিশেষ করে পথের পাঁচালী গল্পের অপু আর দুর্গার মতো শিশুদের কথা । তারপর থাম থেকে সবাই কান সরাল । আবির বলল, “এখানে এসে আমি তাদের সাথে  সময় কাটাই, যারা আমাদের সাহায্য করছে, অথচ আমরা  তাদের ক্ষতি করছি । আমি সময় কাটাই বায়ুর সাথে, আমাদের অক্সিজেন দিচ্ছে, তা সত্ত্বেও আমরা বায়ু দূষণ করছি । আর এই রেইললাইনের থামের ওপর কান পাতলে অন্যরকম একটা অনুভূতি হয়, আর আকাশের সৌন্দর্যের কথা আলাদা করে বলার কিছুই নেই । এখানে থাকলে কার ই বা মন ভালো হবে না ।” সাবিত আর অয়ন অনেক্ষন চুপ ছিল । একটু থেমে অয়ন বলল, “কিন্তু ভাই, আমাদের একটু বলে আসতে পারতে, আর ফোনটাও তো আনো নি ।” আবির বলল, “ফোনটা আমার গাড়ির সামনে বক্সে ছিল, সাইলেন্ট করা, আনা হয় নি রে । আচ্ছা চল, গাড়িটাও তো নিয়ে যাওয়া লাগবে ।” সাবিত বলল, “সমস্যা নেই, তোর গাড়ি সামি ড্রাইভ করে দিয়ে গেছে, আমি আর অয়ন সেই সন্ধ্যা থেকে তোকে খুজে বেড়াচ্ছি, তোর কোন খোঁজ নেই । মেহমান সন্ধ্যার আগে চলে গেলো, তারপর তোর জন্য আমি আর অয়নই শুধু ছিলাম, বাকিরা বাসায় চলে গেছে ।” আবির বলল, “সরি ভাই!” সাবিত বলল, “না ঠিক আছে । কিন্তু আমার একটা প্রশ্নের জবাব দে তো, চয়নিকা এরকম একটা বাজে কাজ করেছে, তোকে জানায়ও নি, এ ব্যাপার নিয়ে তোর কষ্ট হচ্ছে না তো?” আবির হালকা হেসে বলল, “আচ্ছা ভাই, আপনার ধরুন আপনার ভাই একজনকে ভালোবেসেছে, তাদের একটা সন্তানও হয়েছে, এরপর একদিন আপনার সাথে আপনার ভাইয়ের সেই ভালোবাসার মানুষের বিয়ে ঠিক হল, কেমন লাগবে আপনার?” সাবিত ভ্রু-কুঁচকে বলল, “কি যা-তা বলছিস তুই?” আবির বলল, “হ্যাঁ ভাই, চুনির যে বাচ্চাটা, ও আমার ভাইয়ের মতো এক বন্ধুরই । আর তাছাড়া, সেই বন্ধুর সাথে আমার যোগাযোগও নেই, শেষ যেদিন কথা বলেছিলাম, সেদিন ওর ওপর প্রচুর রাগ হয়েছিলো । আর কোনোদিন কথা বলবো না বলেছিলাম । এখন নিজের কাছে একটা অন্যরকম ফিল হচ্ছে ।” অয়ন বলল, “ভাই, তুমি আপুকে ভালোবাসো না?” আবির বলল, “বাসিতো, কিন্তু…………।” বলতে গিয়ে থেমে গেলো আবির । সাবিত জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু কি?” আবির বলল, “না, কিছুই না, সবটা শুধু টেম্পোরারি কষ্ট, একটু আনন্দের সাথে থাকলেই চলে যাবে বোধ হয় ।” সাবিত বলল, “আচ্ছা, এসব বাদ দে, এবার বাসায় চল ।” আবির ওপর নিচ মাথা নেড়ে বলল, “হুম। চলো ।” এরপর সাবিত আবির আর অয়ন বাসার দিকে রওনা হল ।





(২৩০)

“আচ্ছা, থাক তাহলে এখানে, আমি যাই, দেখি জরিনা কি রান্না করলো ।” বলে চয়নিকার মা চলে গেলো বারান্দা থেকে । চয়নিকা আবার বারান্দা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল, আবিরের অপেক্ষায় । চয়নিকার মা এদিকে আসবার সময় দরজার কাছে দেখে চয়নিকার ছেলে দাঁড়িয়ে । চয়নিকার মা ওকে কোলে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে, তুই এখানে এখনও দাঁড়িয়ে?” ছেলেটা জবাব দিলো, “তোমার জন্যই দাঁড়িয়ে ছিলাম ।” চয়নিকার মা নাতির গালে চুমু খেয়ে বলল, “আচ্ছা, চল এবার, আমরা খাওয়া-দাওয়া করবো এখন ।” বাইরের রুমে এসে চয়নিকার মা দেখল, বাকিরা সবাই বসে আছে । চয়নিকার ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে দিতেই দৌড়ে চলে গেলো চয়নিকার বাবার কোলে । চয়নিকার বাবা নাতিকে কোলে নিলো । চয়নিকাদের পাশের বাসার আনটি চয়নিকার মায়ের কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ভাবি, খাওয়া-দাওয়া করবেন না?” চয়নিকার মা বলল, “হ্যাঁ ভাবি, দেখতেই এলাম জরিনা কি রান্না করেছে ।” পাশের বাসার আনটি বলল, “ভাবি টেনশন কইরেন না, বিয়ে বাড়ির খাবার অনেক ছিল, সেখান থেকে সাবিত আপনাদের জন্য প্যাক করে রেখেছে ।” চয়নিকার মা বলল, “তাহলে তো ভালোই হল, জরিনা মেয়েটাও একদিন একটু কাজ থেকে মুক্তি পেলো । মেয়েটা অনেক কাজ করে । কই ও?” চয়নিকার বাবা বলল, “বাজারে গিয়েছে, আমার ওষুধ শেষ হয়ে গেছে সেটা আনতে ।” চয়নিকার মা তখন বলল, “ওওও, আচ্ছা, বলছিলাম কি, চুনিদের ওই ভাড়া বাসায় নতুন ফার্নিচার আনা,ওদের খাট ফুল দিয়ে  সাজানো এগুলো কি হয়েছে?” চয়নিকার  বাবা বলল, “ফার্নিচার আনা হয়েছে, কিন্তু………………।” চয়নিকার মা বলল, “কিন্তু? ফুল দিয়ে খাট সাজানো হয় নি, তাই তো?” আঁখি বলল, “মা, তোমার কি মনে হয়, এ ঘটনার পরও ওরা এক বিছানায় রাত কাটাতে রাজি হবে?” আঁখির মা বলল, “হুম। ছেলেটা খুব কষ্ট পেয়েছে । আচ্ছা, সাবিত কি পেলো ওকে?” আঁখি বলল, “কি জানি, সাবিত তো কিছু  জানাল না, দাড়াও, সাবিতকে একটু কল করি ।” আঁখি সাবিতকে কল করলো । “হ্যালো!............ও আচ্ছা, আচ্ছা আসো তাহলে……………আচ্ছা!” ফোন কেটে আঁখি বলল, “মা, আবিরকে পেয়েছে ওরা, প্রায় চলে এসেছে ।” চয়নিকার  মা বলল, “যাক, আলহামদুলিল্লাহ্‌, ছেলেগুলো আসুক, আমি টেবিলে খাবার বেড়ে দিচ্ছি ।” এরই মধ্যে জরিনা চলে এলো । চয়নিকার বাবার হাতে ওষুধগুলো দিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলো, চয়নিকার মা বলল, “শোনো মা, তোমার সাবিত ভাইয়া এলে খাবার আনবে, সেগুলো গরম করো, আর আমাকে ডেকো কিন্তু, তুমি একা করতে গেলে  বেশি কষ্ট হবে তোমার ।”  জরিনা, “আইচ্ছা আফা ।” বলে রান্নাঘরে চলে গেলো । চয়নিকার মা চয়নিকার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে, তোর খিদে পেয়েছে?” চয়নিকার ছেলে বলল, “নট সো মাচ নানি, আমি পরেই খাবো,  আফটার অল সবার সাথেই তো খাবো ।” কলিমা বলল, “বা বা! পোলা তো মেলা সুন্দর ইংলিশ  কয়!” চয়নিকার মা হালকা হাসিমুখে বলল, “হ্যাঁ, ওখানে তো ওর ক্লাস, ক্লাসমেট সবাই ইংরেজিতে বলে, তবু আমি যদ্দুর পেরেছি, ওকে বাংলা শিখিয়েছি, আর বাঙালি বন্ধু-ও ওর কম না ।”

এদিকে বারান্দায় চয়নিকা আবিরের জন্য অপেক্ষা করতে করতে দেখল, সাবিতের গাড়ি চলে  এসেছে ।  চয়নিকা বারান্দা থেকে দৌড়ে চলে এলো । বাইরের রুমে এসে দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় চয়নিকার মা  জিজ্ঞেস করলো, “কিরে, কোথায় যাচ্ছিস?” চয়নিকা যেতে যেতেই জবাব দিলো, “আবির এসেছে ।” বলে নিচে চলে গেলো । লিফট  নিচে যেয়ে যেই না খুলল, আবির, সাবিত আর  অয়ন ঢুকতে গিয়ে দেখল চয়নিকা দাঁড়িয়ে । সাবিত জিজ্ঞেস করলো, “আরে চুনি, তুমি?” চয়নিকা বলল, “হ্যাঁ মানে বারান্দা দিয়ে দেখলাম, তাই এলাম ।” আবির অয়ন আর সাবিত ঢুকল ভেতরে, আবির লিফট থেকে বেড়িয়ে বলল, “ভাই, আমি গাড়ি থেকে মোবাইলটা  নিয়ে আসি ।” চয়নিকা বলল, “আমি তোমার সাথে…………।” চয়নিকাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই আবির বলে উঠলো, “তোমার বোধ হয় আমার সাথে আসাটা উচিৎ হবে না ।” বলে চলে গেলো  আবির ।  চয়নিকা কথাটা  শুনে বেশ আঘাত পেয়েছে তা ওর  চেহারা দেখেই  বোঝা যাচ্ছে । লিফটের  দরজা বন্ধ  হওয়া পর্যন্ত চয়নিকা আবিরের দিকে তাকিয়ে রইল । সাবির চয়নিকাকে বলল, “টেনশন কোরো না চুনি, সব ঠিক হয়ে যাবে ।” চয়নিকা কান্না মাখা গলায় বলল, “কিচ্ছু ঠিক হবে না সাবিত ভাই, কিচ্ছু ঠিক হবে না ।” অয়ন বলল, “আপু, আল্লাহর  কাছে দোয়া করো, দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে ।” চয়নিকা বলল, “সেই বিয়ে যেদিন থেকে ঠিক হয়ে আছে, সেদিন থেকেই দোয়া করে যাচ্ছি, আমি পাপী বলে হয়তো আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করছেন না ।” সাবিত বলল, “মন থেকে অনুতপ্ত হয়ে যদি তুমি সত্যি ক্ষমা চাও, আল্লাহ নিশ্চয় তোমাকে ক্ষমা করে দেবেন, আর দোয়াও কবুল করবেন, দেখো ।” চয়নিকা কিছু বলল না । ওপরের  দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলো ।

 



(২৩১)

রুমে ঢুকেই চয়নিকা নিজের রুমে যেয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো । চয়নিকাকে এভাবে নিজের রুমে যেতে দেখে সবাই অবাক হয়ে গেলো । একটু পরে বাসায় এলো অয়ন আর সাবিত । আঁখি জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে ওর?” সাবিত বলল, “তেমন কিছু না, একটু মনোমালিন্য হয়েছে, টেনশন কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে ।” চয়নিকার ছেলে অয়নের কাছে যেয়ে বলল, “তুমি আমার মামা, তাইনা?” অয়ন নিজের ভাগ্নেকে কোলে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ মামা, আমি তোমার মামা হই ।” চয়নিকার বাবা জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, মামা, আমার বাবার কি হয়েছে?” অয়ন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল । সাবিত  কথা ঘোরাতে বলল, “আচ্ছা, তুমি তো ক্লাস ফাইভে পড়ো, অনেক বড় হয়েছো, তাও  সবাই তোমাকে কোলে নেয়, কেমন লাগে তোমার?” চয়নিকার ছেলে বলল, “আই অলসো থিঙ্ক সো, নানি তো মোটেও আমাকে কোলে নেয়া ছাড়বে না মনে হয়, এখানে এসেও দেখি সবাই আমাকে কোলে নিচ্ছে, খারাপ লাগে, বাট হালকা অড লাগে ।” অয়ন বলল, “শোন, তোকে ছোটবেলায় তো পাইনি সেভাবে, তাই এখনই কোলে নিচ্ছি, পড়ে ভুটুশ হয়ে গেলে তো নিতে পারবো না ।” চয়নিকার ছেলে জিজ্ঞেস করলো, “ভুটুশ, হোয়াটস দ্যাট?” অয়ন বলল, “দ্যাট মিনস, মোটা, ফ্যাট ।” চয়নিকার ছেলে হেসে উঠে বলল, “আমি ট্রাই করবো না হওয়ার, তবে হয়ে গেলে আর কি? ভুরির সাথে মজা করবো ।” আঁখি এদিকে আবিরের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, “এই, আবির কোথায়?” সাবিত বলল, “ও মোবাইল আনতে গেছে, ওর গাড়ির সামনের  বক্সে ওর মোবাইল রেখেছে ।” আঁখি বলল, “বাহ, তুমি ওকে একা ছাড়লে?” সাবিত কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময়  আবির দরজার সামনে এসে বলল, “কেন, আমি  একা  গেলে আপনার ভয় লাগে বুঝি?” আঁখি আবিরের দিকে তাকাল । আবিরের হাতে আলুমিনিয়াম  ফয়েলে মোড়ানো বক্স । অয়ন বলল, “ওহহো! খাবারগুলোও তো আনতে ভুলে গিয়েছিলাম আমরা, ভাই এনেছে ।” আবির অয়নকে বলল, “এটা নিয়ে যা তো রান্নাঘরে ।” অয়ন চয়নিকার ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে আবিরের হাত থেকে খাবার নিয়ে চলে গেলো রান্নাঘরের দিকে । চয়নিকার ছেলে আবিরের দিকে তাকিয়ে । আবির দেখেছে, কিন্তু কিছু বুঝতে দিলো না ছেলেটাকে । আঁখি আবিরের কাছে এসে বলল, “আবির, আমি কিন্তু বয়সে তোমার বড়, তাই একটু বুঝেশুনে কথা বলবে!” আবির বলল, “আপনি বয়সে বড় এবং আপনি আবার বড় বোনের মতো বলে আমি আপনাকে অনেক সম্মান করি । সেই সম্মানের প্রতিদানটা আপনি যে এভাবে দেবেন তা আমি কখনও ভাবিনি ।” বলে নিজের রুমে চলে গেলো আবির । আঁখি সাবিতকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই সাবিত বলে উঠলো, “তোমার লজ্জা পাওয়া উচিৎ ।” আবির নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিলো সে সময় রায়হান, কলিমা আর রায়হানের স্ত্রী উঠে এলো আবিরের কাছে । রায়হান বলল, “আবির, আমাগো যাইতে হইবো রে ।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “সেকি! আজই যাবে?” কলিমা বলল, “হ রে, রাইতে ট্রেইন আছে একখান, সেইডাত কইরা যামু ।” রায়হান বলল, “আর যা যা হইল, তারপর এই বাড়িত আমরা একখান আলাদা বোঝা হইয়া যামু ।” চয়নিকা মা তখন বলল, “ছি ছি! এভাবে কেন বলছো তোমরা! তোমরা তো আমাদের জামাইয়েরই আপনজন । তোমরা কেন আমাদের  বোঝা হবে?” রায়হানের স্ত্রী বলল, “না আন্টি, আমগো নিজেগোর কাছেই খারাপ লাগবোনে । আর তাছাড়া গেরামেও মেলা কাম আছে ।” আবির বলল, “আচ্ছা ভাই, তাহলে তোমাদের আমি স্টেশন পর্যন্ত দিয়ে আসি?” রায়হান বলল, “আরে ধুর পাগল! লাগবো না!” চয়নিকার মা বলল, “কিছু খেয়ে তো যাও!” রায়হান বলল, “আন্টি, দুপুরে যা খাইসি! তাতেই পেট ভইরা গেছে । আর আমার খিদা নাই, একটু আগে আপনেগো বাড়িত কিছু ভাত আছিল, যামুগা বইলা কলিমা আর আমার স্ত্রী খাইয়া নিছে ।” তারপর আরও অনেক কথাবার্তা বলে চলে গেলো রায়হান, কলিমা আর রায়হানের স্ত্রী ।

খাবার টেবিলে সবাই বলে খাচ্ছিল, চয়নিকার মা দেখল, জরিনা নিচে খাচ্ছে । চয়নিকার মা বলল, “কিরে তুই নিচে বসে কেন?” সাবিত বলল, “একি! জরিনা আপু তো টেবিলেই খায় আজ নিচে কেন?” অয়ন বলল, “বুঝেছি, আজ মা আর চুনির আপুর ছেলের জন্য দুটো চেয়ারই ভরা বলে বোধ হয়ে নিচে বসেছে ।” চয়নিকার বাবা বলল, “আর চেয়ার কোথায়?” আঁখি বলল, “ওগুলো বোধ হয় বিয়ের কাজে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, আনা হয় নি ।” জরিনা বলল, “সমেস্যা নাই আফা, আমি নিচেই ঠিক আছি ।” চয়নিকার মা বলল, “না, তুমি আমাদের পরিবারের আরেকজন সদস্য, এভাবে পরিবারের সদস্যকে নিচে বসিয়ে রেখে খাওয়া যায় নাকি?” বলেই অয়নকে বলল, “যা তো, তোর পড়ার টেবিল থেকে চেয়ারটা নিয়ে আয় ।” জরিনা বারণ করলো, অয়ন তাও চেয়ার আনল । তারপর জরিনা চেয়ারে বসে সবার সাথে খেতে লাগলো । আবির তাকিয়ে দেখল, চয়নিকা আসে নি । চয়নিকা এলে আরেকটা চেয়ার দরকার হবে বলেই কি আসে নি? আবির জিজ্ঞেস করলো “চুনি কোথায়?” চয়নিকার মা বলল, “ও নিজের রুমে কাদছিল, ঘুমিয়ে পড়েছে ।” আবির আর কিছু বলল না । চয়নিকার মা আবিরকে বলল, “দ্যাখো বাবা, আমার মেয়েটা ভুল করেছে ঠিকই, কিন্তু ও তোমাকে খুব ভালোবাসে । তুমি ওকে আর কষ্ট দিও না! তোমার কাছে আমার অনুরোধ ।” আবির আর জবাব না দিয়ে খাওয়া শেষ করে, “আমার খাওয়া হয়ে গেছে ।” বলে চলে গেলো । চয়নিকার ছেলেও সেই দেখে তাড়াতাড়ি খেতে লাগলো ।





(২৩২)

তারপর খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে চলে গেলো আবিরকে খুঁজতে । দেখল, আবির দরজা খুলে বাইরে গেলো । চয়নিকার ছেলেও আবিরের সাথে যাওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু দরজার সামনে আস্তেই দেখল,  লিফট উপরে যেতে শুরু করেছে ।  চয়নিকার ছেলে বুঝল, আবির ওপরে যাচ্ছে । হয়তোবা ছাদে । চয়নিকার ছেলে লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে লিফটের বাটন চাপ দিয়ে লিফট আসবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল । কিছুক্ষণ পরই লিফট এসে চয়নিকার ছেলের সামনে দাঁড়ালো, তারপর খুলে গেলো । চয়নিকার ছেলে ভেতরে ঢুকল । লিফট সবচেয়ে ওপরের তলায় এসে থামল । চয়নিকার ছেলে সিরি বেয়ে ছাদের দরজার সামনে এসে দেখল, আবির দাঁড়িয়ে রেলিং-এর পাশে । চয়নিকার ছেলে ধীরে ধীরে যেয়ে আবিরের পাশে যেয়ে দাঁড়ালো । আবির একবার ওর  দিকে তাকাল, তারপর আবার সামনের দিকে তাকাল । চয়নিকার ছেলে একটু পর বলে উঠলো, “তুমি ছাদে কি করছো?” আবির কোন দিলো না । ছেলেটার দিকে তাকালেই  ওর একটা অজানা রাগ জেগে উঠছে । মনে পড়ছে সেদিনে কথা! রাজ ফোন করেছিলো যার জন্য ও ইফাজকে কল করতে পারে নি, পড়ে একটা ট্রেন সামনে চলে এসেছিলো, আবির আর সামনে এগোতে পারে নি, আর তখনই ঘটেছিলো………। আর ভাবতে চায়না আবির । নিজের চোখ বন্ধ  করে  ফেললো । চয়নিকার ছেলে প্রশ্ন করলো, “কি ভাবছো  তুমি?” আবির হালকা রাগ নিয়ে বলল, “দ্যাটস নান অফ ইওর বিজনেস ।” ছেলেটা বলল, “ও রিয়েলি?” আবির অবাক হয়ে  ছেলেটার দিকে তাকাল, পরে আবার স্বাভাবিক হয়ে  সামনের  দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেকে বলল,  “ভুলেই গিয়েছিলাম তুই লন্ডনে ছিলি, ইংরেজি জানাটা অস্বাভাবিক না ।” ছেলেটা হেসে উঠলো । আবির কিছু বলল ওর হাসি দেখে । একটু পর আবির খেয়াল করলো, ছেলেটা ছাদের রেলিং-এ ওঠার চেষ্টা করছে । আবির ভয় পেয়ে “এই!এই! কি করছিস!” বলতে বলতে ওকে রেলিং থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলো । তারপর ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলো, “মাথা ঠিক আছে?” চয়নিকার ছেলে জিজ্ঞেস করলো, “মাথা ঠিক থাকবে না কেন?” আবির বলল, “এখান থেকে যদি পড়ে যেতি পুরো ২০তলা বিল্ডিং তুই পড়ে যেতি, বুঝতে পারছিস?” চয়নিকার ছেলে  বলল, “কেন, রেলিং-এর ওই সাইডে খানিকটা বারতি জায়গা নেই?” আবির বলল, “না ।”  চয়নিকার ছেলে বলল, “ও, আমি লন্ডনে স্কুলে পড়তাম সেখানে তো ছিলো, এখানে   কেন নেই?” আবির বলল, “সব বিল্ডিং এক হয় না । আর তুই লন্ডনে কত তলার ওপরে বসে থাকতি?” চয়নিকার ছেলে বলল, “ওটা তো এক তলাই ছিল ।” আবির বলল, “তাহলে? ২০ তলা আর এক তলার ডিফারেন্স বুঝিস?” চয়নিকার ছেলে কি যেন ভাবল । আবিরও খানিক্ষণ চুপ করে রইল । তখন আবির জিজ্ঞেস করলো, “দ্যাখ, এ পর্যন্ত তোর নামটাই শোনা হয় নি ।” চয়নিকার ছেলে বলল, “আমার নাম বকর আহমেদ নিশান ।” আবির হঠাৎ কি যেন ভাবতে লাগলো । মনে পড়লো, প্রথম আঁখির কাছে ও আর চয়নিকা ধরা পড়ার  পর আঁখি চয়নিকাকে একবার  বলেছিল, “তোর লজ্জা নাই! আজ তোর জন্য মা এতো কষ্ট করে লন্ডনে নিশানকে মানুষ করছেন, আজ তোর জন্য বাসায় কোন পর পুরুষ আসতে পারে, আর তুই আবার শুরু করলি! সেই একই ভুল আবার করার জন্য!” তবে সেদিন তাহলে এই নিশানের কথা-ই বলছিল আঁখি! আবির নিশানের দিকে তাকাল । নিশান জিজ্ঞেস করলো, “কি দেখছ?” আবির বলল, “কিছু না ।” তারপর ছেলেটাকে আবির কাছে টেনে নিলো  । বলল, “আমি তো তোর বাবা, তাই না?” নিশান বলল, “কেন অন্য কেউ হওয়ার কথা ছিলো কি?”  আবির হালকা হেসে বলল, “না ছাদে একবারও আমাকে বাবা বলে ডাকলি না, তাই আরকি ।” নিশান ডাকলো, “বাবা! এইতো, ডেকে দিলাম  ।” আবির হালকা হেসে নিশানের কপালে চুমু খেলো । আবির মনে মনে নিজেই নিজেকে বলল, “ইশ! কত বড় ভুল করছিলাম আমি । দোষ করলে যা করেছে সব রাজ আর চুনি করেছে, এই নিষ্পাপ ছেলেটা কি করেছে!” নিশান আবিরকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা বাবা, আমার একটা প্রশ্নের জবাব দেবে?” আবির বলল, “হুম বল ।”

“আচ্ছা, বাবা, তুমি কেন মা-কে কষ্ট দিচ্ছো?” প্রশ্ন করলো নিশান ।

“মানে?” বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো আবির ।

“আজকে সন্ধ্যার দিকে মা আর নানি কথা বলছিল, আমি আড়াল থেকে শুনেছি, কিছু একটা মা তোমাকে বলতে চেয়েছিল, কিন্তু আঁখি খালামনি নাকি বলতে দেয় নি । তুমি নাকি সে জন্য মাকে কষ্ট  দিচ্ছো ।” বলল নিশান ।

আবির কিছুক্ষণ চুপ করে  রইল । তারপর বলল, “মন খারাপ অল্প সময়ের জন্য হয়, এই দ্যাখ, একটু আগেও আমি তোর ওপর রাগ করেছিলাম, এখন তো আবার তোর সাথে আমার সম্পর্ক ঠিকঠাক হয়ে গেছে ।” নিশান প্রশ্ন করলো, “মা’র সাথেও ঠিকঠাক হবে তো?”






(২৩৩)

আবির কিছু বলল না, আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে লাগলো ।

জানালা  দিয়ে ধীরে ধীরে সূর্যের আলোটা যেই না চোখের ওপর পড়লো, অমনি ঘুম ভেঙ্গে গেলো চয়নিকার । ঠিকমতো ভাঙতে  চাইছে না যেন ঘুমটা । গতকাল রাতে কান্নাকাটির পর  লম্বা একটা ঘুম দিয়েছে । বিছানায় উঠে বসে আড়মোড়া ভেঙ্গে যেই না খাটের পাশের ড্রেসিং-টেবিলের দিকে তাকাল, অমনি দেখল, কে যেন চুল আঁচড়াচ্ছে । চোখ থেকে এখনও ভালোমতো ঘুম যায় নি, তাই সব একটু ঝাপসা দেখছে চয়নিকা । চোখ ভালো করে রগড়ে ড্রেসিংটেবিলের দিকে তাকালো চয়নিকা । অবাক হয়ে গেলো । দাঁড়িয়ে আছে আবির । বলে উঠলো, “আবির!” আবিরের ঠোঁটে হাসি । সেই হাসিমুখ নিয়েই বলল, “কি মিসেস কামহিলা, ঘুমটা তাহলে ভাঙল?” চয়নিকা আবিরের কাছে যেয়ে পেছন থেকে জাপটে ধরে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি আমাকে ক্ষমা করেছো?” আবির কিছুই জানে না এমন একটা ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কিছু করেছো নাকি, যে তোমাকে ক্ষমা করতে হবে?” চয়নিকা বলল, “না মানে, আমাদের বিয়েতে যা কিছু হল, তাতে তো তোমার মন খারাপ হবার কথা ।” আবির আবার চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, “কি হয়েছিলো, মনে পড়ছে না, ভুলে গেছি হয়তো, তুমিও চাইলে ভুলে যেতে পারো ।” চয়নিকা আবিরের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে হাসতে হাসতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো । আবির হালকা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, “এটা কি হল! এতো সুন্দর করে আঁচড়ালাম!” পরবর্তীতে আবার আয়নায় নিজেকে দেখে চুল আঁচড়াতে লাগলো, আর হালকা হেসে উঠলো, সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে সেই খুশিতে ।

এদিকে রান্নাঘরে রান্না করছিলো চয়নিকার মা আর জরিনা । জরিনা সব সবজি কাটাকাটি করছিলো আর চয়নিকার মা চুলোর পাশে দাঁড়িয়ে খানিক পর পর তরকারিটা নাড়িয়ে দিচ্ছিল । এমন সময় চয়নিকা মায়ের কাছে এলো । চয়নিকার মা জিজ্ঞেস করলো, “মা, জানো কি হয়েছে?” চয়নিকার মা বলল, “হ্যাঁ জানি ।” চয়নিকা অবাক হয়ে গেলো । জিজ্ঞেস করলো, “জানো মানে?” চয়নিকার মা বলল, “ওরে, সকালে আবির আমাদের সবাইকে বলেছে ।” চয়নিকা হালকা  রাগ করে  বলল, “ও, আমাকে খুশি করার কথা ও আমাকে  জানাবে তা না, সবাইকে জানিয়ে বেড়াচ্ছে ।” জরিনা সবজি কাটতে কাটতে ইয়ারকি করে বলে উঠলো, “ওরে ভালোবাসা, নায়িকা শাবানা আর নায়ক সালমান শাহ ।” চয়নিকা হালকা লজ্জা পেয়ে বলল, “হয়েছে জরিনা আপু, আর বলতে হবে না । তুমি বুঝি তোমার স্বামীকে ভালোবাসো না?” জরিনা তখন উঠে দাঁড়িয়ে, “ওইদিকে মেলা কাম আছে, ওইদিকে যাই!” জরিনা যেতে যেতে চয়নিকা হাসতে হাসতে বলতে লাগলো, “হাহা! পালাচ্ছে! পালাচ্ছে! জরিনা আপু! তোমার স্বামীর আমি তো নেবোই! তারপর দেখবো তোমাদের জুটি কাদের মতো ।” বলেই চয়নিকা আবার হাসতে লাগলো । চয়নিকার মা মেয়েকে হাসতে দেখে মেয়ের দিকে অনেক্ষন ধরে তাকিয়ে রইল । চয়নিকার যখন বুঝল তখন বলল, “কি হয়েছে মা, কি দেখছ?” চয়নিকার মা মেয়ের গালে হাত রেখে বলল, “সারাজীবন এরকম হাসিখুশি থাক মা । আমার ঘোর বিশ্বাস যে আবির  তোকে  অনেক সুখী রাখবে ।” এরই মধ্যে আবির রান্নাঘরে এসে বলল, “হুম, আমি ওকে খুশি রাখবো আর ও আমার জীবনটা জলে ডোবা করে দেবে ।” চয়নিকার মা জিজ্ঞেস করলো, “কেন কি হয়েছে?” আবির বলল, “দেখেন না মা, সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি চুলগুলো  এলোমেলো হয়ে গেছে, আধঘণ্টার প্রচেষ্টার পর কোনোরকমে ঠিক করলাম, আপনার মেয়ে আবার এলোমেলো করে দিলো ।” চয়নিকার মা বলল, “কিরে চুনি, কথা কি সত্য?” চয়নিকা বলল, “তুমি এই কাপুরুষের কথায় এতো রিয়েক্ট কোরো না তো, চুলই এলোমেলো করে দিয়েছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেই নি ।” চয়নিকার মা অবাক হয়ে চয়নিকার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কাপুরুষ?” আবির বলল, “দেখেছেন মা, আপনার মেয়েটা কেমন আমাকে কাপুরুষ বলে ।” চয়নিকাও বলে উঠলো, “ও! নিজে যে আমাকে কামহিলা ডাকো সে কথা বললা না?” আবির বলল, “কামহিলা বলে কোন শব্দ ডিকশনারিতে আছে নাকি দেখে আমাকে জানাও তো!” চয়নিকা বলে উঠলো, “কিন্তু মিন করো তো কাপুরুষের মতোই!” চয়নিকার মা বিরক্ত  হয়ে বলল, “উফ! থাম দুজনে!” বলে চয়নিকার মা তরকারিটা  একপাশে  রেখে চায়ের কেটলি তুলে দিলো  চুলোয় । আবির আর চয়নিকা কিন্তু থামলো না । আবির বলল, “ঠিক আছে, তুমি একটা কুত্তা, আমি  মিন করলাম ভদ্র মেয়ে ।” চয়নিকা বলল, “তুমি একটা গরু! আমি মিন করলাম বিখ্যাত উপস্থাপক ।” আবির বলল, “উহু, আমি তো বিখ্যাত উপস্থাপক না!” চয়নিকা বলল, “ছিলে তো!” আবির বলল, “এখন তো আর নই ।” চয়নিকা বলল, “ঠিক আছে যাও । আমিও ভদ্র মেয়ে না ।” আবির হোহো করে হেসে উঠলো । চয়নিকার মা-ও মুচকি হেসে উঠলো । চয়নিকা নিজের ভুল বুঝতে পেরে দাঁত দিয়ে জিভ চেপে ধরল । আবির চয়নিকার মা-কে হাসতে হাসতে বলল, “দেখেছেন মা, নিজেই স্বীকার করলো ও ভদ্র মেয়ে না ।” চয়নিকা বলল, “তার মানে তুমি আমাকে কথার জালে ফেললে?” আবির বলল, “হোক, কিন্তু তুমি স্বীকার তো করেছো!” চয়নিকার মা বলল, “হয়েছে হয়েছে, দুজনেই থেমে যাও এবার ।”  চয়নিকা উঠে দাঁড়ালো । চলে যাচ্ছে রান্নাঘর থেকে । আবিরের পাশে আসতেই রাগী চেহারা নিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে রইল । আবির এখনও মুচকি  মুচকি হাসছে । এমন সময় হঠাৎ  চয়নিকা আবিরের চুলগুলো আবার এলোমেলো করে দিয়ে  হাসতে হাসতে চলে এলো রান্নাঘর থেকে । আবির আবার বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, “তুমি আবার এই কাজ করলা!”





(২৩৪)

চয়নিকার মা মুচকি হেসে উঠলো ।

সকাল সাড়ে সাতটার দিকের কথা । সবাই খাবার টেবিলে খেতে বসেছে । চয়নিকার মা এসে খাবার পরিবেশন করছে । প্রথমে চয়নিকার মা চয়নিকার স্বামীকে খাবার বেড়ে দিলো, তারপর আঁখিকে খাবার বেড়ে দিলো । তারপর যে-ই না আবিরকে খাবার বেড়ে দিতে যাবে, অমনি চয়নিকা চেয়ার থেকে উঠে বলল, “মা, আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি ।” বলে মায়ের কাছে যেয়ে হাত থেকে খাবারের বাটিটা নিলো । খাবার টেবিলে বসে থাকা অয়ন আর সাবিত লম্বা টানে বলে উঠলো, “উও……………!!!!!!!” সাবিত বলল, “চুনিরে, শুধু স্বামীকে দিলেই চলবে নাকি, আমাদের একটু দ্যাখো ।” অয়ন বলল, “ভাই, আপু আজ শুধু আবির ভাইকেই দেখবে । আমাদের দেখবে না ।” চয়নিকা লজ্জা পেয়ে বলল, “আরে বাবা, দেবো দেবো, সবাইকেই দেবো ।” বলে চয়নিকা ওর মা-কে বলল, “মা তুমি বোসো ।” জরিনা জগ থেকে সবার গ্লাসে পানি ঢালছিল, চয়নিকা ওকে বলল, “জরিনা আপু্‌ তুমিও বোসো, আজ আমি তোমাকেও খাবার বেড়ে দেবো ।” জরিনা বসলো । চয়নিকা আবিরকে খাবার বেড়ে দিতে লাগলো । আবির চয়নিকার দিকে তাকিয়ে আছে । দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে । চয়নিকার খাবার  দেয়া শেষ, তবু চয়নিকা তাকিয়ে আছে আবিরের দিকে । আবিরও  তাকিয়ে চয়নিকার দিকে । অনেক্ষণ ধরে । সাবিত অয়নের কানে ফিসফিসিয়ে বলল, “আজ আমাদের খাওয়া হবে না রে ।” পাশ থেকে নিশান কেশে বল উঠলো, “এখানে বাচ্চারা আছে, এগুলো চলবে না এখানে ।” এ কথা শুনে তারপর দুজন দুজনের থেকে চোখ সরাল । দুজনেই লজ্জা পেয়ে গেলো । চয়নিকা সবাইকে খাবার বেড়ে দিতে লাগলো ।

খাওয়া শেষে বারান্দায় যেয়ে বসলো আবির । সাথে সাবিত । সাবিতের কোলে নিশান । সাবিত আবিরকে বলল, “বুঝলি আবির, এই অফিসের ঝামেলা আর ভালো লাগে না । মানে সারাদিন মিটিং, প্রোজেক্ট এই সেই । তুইই ভালো আছিস, কোম্পানি যাওয়া আর আসা । এতদিন যদিও তোর  ওই শোটা ছিল । ও হ্যাঁ, ভালো কথা মনে পড়েছে! শোন, তোদের বিয়ের দিন আমি তোর শো এর ভক্ত কয়েকজনকে আন্দোলন করতে দেখেছি । তোকে যে বলবো মনেই ছিল না ।” আবির হালকা হেসে বলল, “তাই! কিন্তু আমার ভক্তরা একটু বেশিই পাগলামো করছে । ওদের যদি কোন ক্ষতি হয় তার দায়ভার কি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ নেবে?” সাবিত বলল, “তা বলতে পারি না, তবে তোর শো হয়তো আবার ফিরে আসতে পারে বলে মনে হয় ।” এমন সময় আবিরের মোবাইলে একটা কল এলো । সামির কল । আবির ফোন ধরল, “জি আসসালামু আলাইকুম সামি ভাই!” সামি খুব খুশি মনে বলে উঠলো, “আবির! তুই বিশ্বাস করবি না কি হয়েছে!” আবির অবাক হয়ে গেলো । দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?” সামি বলল, “শোন! তোর শো একজন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক লোকের জন্য বন্ধ হয়েছিলো, মনে আছে?” আবির বলল, “হ্যাঁ কেন?” সামি জিজ্ঞেস করলো, “ওই লোকের নাম শুনেছিস?” আবির একটু মনে করে বলল, “কি যেন? বলেছিলো হয়তো পরিচালক । ভুলে গিয়েছিলাম । কিন্তু কেন?” সামি বলল, “ওই লোকের নাম আফজাল হোসেন, যার আরেকটা অপরাধ যার সমাধান তুই মিস্টার হাসানের কেইসে করেছিস, সেটার জন্য অপু ওকে ধরতে পেরেছে । এখন চ্যানেল মালিক চান অনুষ্ঠান আবার শুরু হোক ।” আবির খুব খুশি হল । বলল, “তাই! তাহলে তো খুব ভালো ।” সামি বলল, “আরে ভালো মানে! ফ্রি আছিস?” আবির বলল, “জি অবশ্যই ।” সামি বলল, “জানি বিয়ের পরদিন তোর অনেক ব্যাস্ততা আছে, তবে আমার মনে হয় এই খুশির খবরটা তোর সব ব্যাস্ততাকে হার মানাবে ।” আবির বলল, “তা আর বলতে ভাই! আমি এখনই আসছি ।” বলে আবির বাসা থেকে বেরোলো । চ্যানেলের ভবনে এসেই সামির দেখা পেলো না আবির । সামি তখন অন এয়ারে সংবাদ পড়ছে । আবিরের সাথে দেখা ডিরেক্টর এই । ডিরেক্টর বলল, “আরে আবির! খবর পেয়েই নিশ্চয়ই এসেছো ।” আবির বলল, “জি! এবার বলুন, প্ল্যান কি?” ডিরেক্টর বলল, “প্ল্যান পড়ে, আগে চ্যানেলের মালিক তোমার সাথে কথা বলতে চায় ।” আবির বলল, “আচ্ছা ।” বলে চ্যানেল মালিকের রুমের দরজার  সামনে এসে বলল, “মে আই কাম ইন স্যার?” চ্যানেল মালিক বলল, “আরে হ্যাঁ! অবশ্যই এসো এসো ।” আবির ভেতরে গেলো । চ্যানেল মালিক বলল, “বোসো।” আবির সামনে থাকা চেয়ারে বসলো । চ্যানেল মালিক বলল, “তা তোমার কোম্পানি কেমন চলছে?” আবির বলল, “জি স্যার, আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো । দ্যা ইনভেস…………।” আবিরের  কথা শেষ করতে না দিয়েই চ্যানেল মালিক বলল, “আরে সে কথায় আসছি, তার আগে কিছু প্রশ্ন করতে চাই ।” আবির একটু অবাক হয়ে বলল, “জি স্যার!” চ্যানেল মালিক প্রশ্ন করলো, “তা আবির, তোমার সেই চয়বির কোম্পানি থেকে খুব টাকা  আয় হচ্ছে, তাই না?” আবির বলল, “জি স্যার!” চ্যানেল মালিক বলল, “আর তুমি কি অস্বীকার করবে, এই কোম্পানির পুরো অর্থ না  আধা অর্থ, না আধার চেয়ে একটু বেশি, আচ্ছা যাই হোক, তোমার এই শো থেকে  আয়  করা  অর্থ থেকে নেয়া, তাই না?” আবির হালকা বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনি কি বলতে চাইছেন একটু খোলাসা করে বলবেন প্লিজ!” চ্যানেল মালিক বলল, “না আসলে বলতে চাইছিলাম কি, আমি চাচ্ছি আগে যে টাকা পেতে তুমি, এখন তার ৩০% তোমায় দেবো ।” আবির কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই চ্যানেল মালিক বলল, “ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা, চ্যানেল থেকে কম মাল কামালে না, ক্ষতিও কম করলে না, যদিও তুমি চলে যাওয়ায় আরও বেশি ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু আমি চাই এখন থেকে সত্য ঘটনা আমরা প্রচার করবো না । ছোটোখাটো ঘটনাকে একটু নাটকীয়তার সাথে উপস্থাপন করবো । চাইলে তুমি করতে পারো, না চাইলেও আমার কিছু করার নেই । তুমি কি রাজি?” আবির হতভম্ব হয়ে গেলো ।





(২৩৫)

কিছুক্ষণ   চুপ করে রইল । চ্যানেল মালিক জিজ্ঞেস করলো, “জবাব কিন্তু পেলাম না এখনও?” আবির চ্যানেল মালিককে প্রশ্ন করলো, “আপনি কি আমাকে অপমান করতেই ডেকেছেন?” চ্যানেল মালিক বলল, “আরে না না! তুমি কি অস্বীকার করো যে তোমার চয়বির কোম্পানির প্রায় ৯০% মতো আমাদের এখান থেকে আয় করা টাকার একটা অংশ?” আবির বলল, “দেখুন, কথা বলার একটা সিস্টেম আছে, আপনাকে বোধ হয় সেই সিস্টেমটা কেউ শেখায় নি । আমার কাছে টাকাটাই বড় না, একাজটাকে  আমি  ভালোবেসে করতাম । আপনি আমাকে টাকা না দিলেও আমি কাজটা করতাম । আচ্ছা, টাকার কথা রাখি । আপনি বললেন এখন সাধারণ ঘটনা অতিরিক্ত নাটকীয়তার সাথে দেখাবেন, মানে এগুলোর মানে কি? আপনার কি মনে হয় এতে সাধারণ মানুষের হয়রানী হবে? এমনিতেই দেশে হলুদ সাংবাদিকের অভাব নেই ।” চ্যানেল মালিক বলল, “দ্যাখো আবির, সব বার কিন্তু এরকম বড়  বড় ক্ষমতাধর লোকেরা জেলে যাবে না, সুতরাং আমাদের জন্য মাঝে মাঝেই রিস্ক হয়ে যেতে পারে । বুঝতে পারছো?” আবির বলল, “ঠিক আছে, আপনার যা ইচ্ছা, করেন । তবে আমি আর করতে চাই না এ অনুষ্ঠান ।” চ্যানেল মালিক বলল, “ঠিক আছে, গো অ্যাহেড । রুমের দরজাটা খোলাই আছে ।” আবির বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে বেড়িয়ে  এলো । অনুষ্ঠানের ডিরেক্টরের সাথে দেখা । আবির কিছু বলার আগেই ডিরেক্টর বলল, “জানি ভেতরে কি হয়েছে ।”  আবির জিজ্ঞেস করলো, “কি করে জানলেন? ডিরেক্টর বলল, “উনি আসলে তোমাকে এ কাজ দিতে চান না । উনি নিজের ছেলেকে দেশের মানুষের কাছে বিখ্যাত করার জন্য নিজের ছেলেকে এ অনুষ্ঠানের উপস্থাপনার কাজ দিতে চান । তাই তোমাকে অপমান করে বের করে দিলেন ।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “তুমি জানতে চাইবে না, আমি কেন আগে তোমাকে বললাম না?” আবির বলল, “কারণ আপনি বললেও আমি যেতাম, না বললেও যেতাম । সুতরাং আপনি নিজের মুখে আমাকে বলাটা সমীচীন মনে করেন নি ।” ডিরেক্টর বলল, “বাহ! তুমি তো দেখছি আসলেই গোয়েন্দা, অবশ্য যা তুমি করেছো, তার কাছে এটা তো কিছুই না । গতকালকের তোমার ইনভেস্টিগেট করা সেই মিস্টার হাসানের কেসটা তো ফেসবুকে ভাইরাল!” আবির বলল, “আমি ফেসবুক চালাই না তো, তাই জানি না । হোয়াটস অ্যাপ দিয়েই অনলাইনের সব কাজ করি ।” ডিরেক্টর বলল, “তুমি আসলেই একজন অসাধারণ মানুষ  । অন্য কেউ হলে ফেসবুকে নিজেকে সেলিব্রেটি ভাবা শুরু করতো ।” আবির বলল, “আসলে আমি ছোটবেলায় একটা এতিমখানায় ছিলাম । আমাদের তো ফ্যামিলি নেই, তবে ওরা সারাদিন ফেসবুকে বসে থাকতো, আমাদেরও তেমন সময় দেয়ার সময়ও যেন ওদের হতো না । সবাই না, আমি কয়েকজনের কথা বলছি । ওদের দেখেই ফেসবুক চালানোর ইচ্ছা মন থেকে উঠে  যায় আর এখন তো ফ্যামিলি হয়েছে আমার, ওদের সময়  দিতে চাই ।” ডিরেক্টর বলল, “ভালো কথা মনে করেছো, গতকাল তো তোমার বিয়ে ছিল, আমায় দাওয়াত দিয়েছিলে, কিন্তু কাজের চাপে যেতে পারলাম না । কেমন কাটল বিয়ে?” আবির বলল, “আর বলবেন না ভাই ও কথা, সময় করে একদিন বলবো ।” ডিরেক্টর জিজ্ঞেস করলো, “সামি বলছিল কি নাকি ঝামেলা হয়েছিলো?” আবির বলল, “জি, বলতে গেলে এটা ছিল আমার ধারণাতীত বিয়ে ।” ডিরেক্টর জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছিলো?” আবির বলল, “ওই তো, বললাম না, একদিন সময় করে বলবো, আজ একটু কাজ আছে, যাই ।” ডিরেক্টর বলল, “ঠিক আছে, ভালো থেকো ।” এরপর বিদায় নিয়ে চলে এলো আবির ।

দুপুরে আবির চয়নিকা আর নিশান আসে ওরা থাকার জন্য যে বাসাটা ভাড়া নিয়েছে সেখানে । সকালে অয়ন, সাবিত আর আঁখি যেটুকু গোছগাছ করার বাকি ছিল সেটা করেছে । এমনকি ওদের বাসর ঘরের বিছানাও ফুল  দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে । আবির সব রুম দেখে এই রুমে আসতেই চয়নিকাকে বলল, “এই  প্রথম বোধ হয় কেউ বাসর ঘরে ছেলের সাথে কাটাবে, তাও নিজের নয় ।” নিশান জিজ্ঞেস করলো, “নিজের নয় মানে?” আবির কথা ঘুড়িয়ে বলল, “আরে, তেমন কিছু না রে, বাড়িটার কথা বলছিলাম । বাড়িটা তো নিজের না ।” নিশান জিজ্ঞেস করলো, “আমাদের বাড়ি কবে হবে বাবা?” আবির বলল, “হবে সোনা, আর ১বছরের মধ্যেই হয়ে যাবে ।” নিশান বলল, “আচ্ছা বাবা, বাসর ঘর কি?” আবির আর চয়নিকা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল । তারপর চয়নিকা বলল, “বাসর ঘরে, এ ঘর তেমন কিছুই না, বিয়ের আগে তো স্বামী স্ত্রী একসাথে এক বিছানায় থাকা হারাম, এই বাসর ঘরেই ওরা একসাথে এক বিছানায় থাকবে ।” নিশান বলল, “আমার কথা বাদ দিলে কেন? আমি থাকবো না?” আবির ছেলেকে কোলে নিয়ে বলল, “অবশ্যই থাকবি! ১২ বছর বয়স হতে তো দেরি নেই, তারপর তো তুই একা থাকবি, ততদিন আমাদের সাথেই থাক তুই ।” তারপর তিনজনে বিছানায় যেয়ে বসলো । চয়নিকা আর আবির, ওদের মাঝে নিশান । নিশানকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আবির বলল, “আজ থেকে শুধু জামাই না, আমি বাবা পরিচয়ও পেলাম । আমরা একটা সুন্দর সংসার গড়ে তুলবো ।” এরপর আবির আর চয়নিকা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিলো ।