0 %

Thanks a lot for being with us!
We are re-constructing our website!
Sorry for this temporary inconvenience
We are coming to you with a fresh look and design from 1 January 2022!
Till then! Stay connected!

ছ্যাঁচড়ামি

Double tap for full screen/exit full screen
×

ছ্যাঁচড়ামি

“উফ! কি যে গরম পড়েছে বাবা! এর মধ্যে আর বাচা যায় না!” বলতে বলতে একখানা ছাতা মাথায় নিয়ে ভার্সিটির দিকে যাচ্ছিলো আরিনা । প্রচণ্ড রোদ পড়ছে আজকাল । এই রোদে মেয়েদের যেন ভয় একটু বেশিই থাকে । মূলত ঘামে মেকআপ উঠে যাবার ভয় । তবে আরিনার সেই ভয় নেই । ওর আবার মেকআপ উঠে যাবার চিন্তা নেই । মুখে মেকআপ না লাগিয়েও আরিনা দেখতে বেশ সুন্দরী । তবুও রোদের ইউভি রশ্মি যেন তকের ক্ষতি না করে সেজন্য ছাতাটা সঙ্গে থাকে । ভার্সিটির গেইটের কাছে কাছে আসবে, এমন সময় একটু দূরে আরিনা একটা বেশ বড় সড় ভিড় দেখতে পেলো । ভীরের মাঝ থেকে আওয়াজ আসছে, “আমি পাগল! আমি ঘাস খাই! আমি পাগল! আমি পাগল! বার বার বলে উঠছে ।” ঘটনা আরিনার মনে পড়বার আগেই আরিনাকে দেখে আরিনার কাছে চলে এলো আরিনার বান্ধবী মিমি । মিমি এসে আরিনাকে বলল, “দোস্ত! তুই নিলয়কে যা করতে বলেছিস! নিলয় সত্যি সত্যি তাই করেছে!” আরিনার ভ্রু দুটো সংকুচিত হল । নিলয় । ভার্সিটির অত্যন্ত চঞ্চল ও হাসিখুশি একটা ছেলে । শুরু থেকেই সবার বেশ পছন্দ করেছিলো । কিন্তু ওর এই হাস্যজ্জল মুখের হাসিটা কেড়ে নেয় আরিনার রুপ । আরিনাকে যেদিন থেকেই নিলয় দেখে, সেদিন থেকেই ওর হাসিমুখ দেখার একটাই উপায় ছিল, দিনে অন্তত নিলয়কে আরিনাকে দেখতেই হবে । তা না হলে কেউ ওর হাসিমুখ দেখতোই না । এভাবে তাও দিনকাল কোনোরকমে চলছিলো, একদিন সাহস করে নিলয় আরিনাকে বলেই ফেলে যে ও আরিনাকে পছন্দ করে । আরিনা ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি না নিয়ে নিলয়কে দিয়ে ভালোবাসার পরীক্ষার নিতে থাকে । আরিনা যা বলতো, নিলয় তা-ই করতো । কখনো প্রিন্সিপ্যালের রুম থেকে টিস্যু পেপারের বক্স গায়েব করে দিত, কখনো ক্লাস টিচারের আপ্রোনের পেছনের দিকে বড় বড় করে লিখে দিত, “হারামগাধা” এরকম আরও অনেক কাজও করতো । এমনকি মেয়েদের ওয়াশরুমে যেয়ে লাইট চুরি করার কাজটা করতে যেয়ে ধরা খেয়েও সে আরিনার পিছু ছাড়ে নি । তাই এবার আরিনা ওকে বলেছিল, “যদি সত্যি এতো ভালোবাসো, তাহলে খালি গায়ে হাফ প্যান্ট পড়ে ভার্সিটির সামনের যে কাঁদা জমে থাকে, ওখানে কাল আমি আসার আগে থেকে শুয়ে গড়াগড়ি করবে আর জোরে জোরে বলবে, “আমি পাগল! আমি ঘাস খাই!” আর এমন ভাবে বলবে যেন সবাই তোমাকে দেখতে ভিড় করে ।” ছেলেটা বেশ সাহস নিয়ে বলেছিল, “খুব পারবো ।” আরিনা ভেবেছিলো ছেলেটা এবার নিশ্চয় পালাবে । কিন্তু না । সত্যি ছেলেটা নিজের কাজ করেছে । আরিনা ভিড় মিমির সাথে ভীড় ঠেলে ভেতরে গেলো । আরিনা দেখল, সত্যি নিলয় কাদায় খালি গায়ে হাফ প্যান্ট পড়ে গড়াগড়ি করছে আর বলছে, “আমি পাগল! আমি ঘাস খাই! আমি পাগল! আমি ঘাস খাই!” আরিনা এবার রেগে গিয়ে বলল, “নিলয়! প্লিজ এসব ঢং বন্ধ করো!” নিলয় আরিনাকে দেখে বলল, “আরিনা! তুমি এসছো! দ্যাখো! আমি তোমার দেয়া কাজ সম্পূর্ণ করেছি! আই লাভ ইউ আরিনা! এবার প্লিজ তুমি আমাকে বলো, আই লাভ ইউ টু বলো! আরিনা হাতের ছাতাটা ছুঁড়ে মারলো নিলয়ের দিকে । ছাতার একটা ভাঙ্গা অংশ লেগে নিলয়ের হাত কেটে গেলো । তবুও নিলয় থামল না । বলল, “আই লাভ ইউ আরিনা! আই লাভ ইউ!” আরিনা রাগ আর কান্না একসাথে মিশিয়ে বলল, “তোর মতো পাগলকে আমি কেন! দুনিয়ার কোন মেয়েই ভালবাসবে না!” বলে ভার্সিটি থেকে চলে এলো আরিনা ।
বাসার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল । দরজার কাছে তখন বসে আরিনার বাবা সোহান । গায়ে কোট প্যান্ট টুলে বসে জুতোর ফিতেটা বাধছিলেন । ফিতে বাঁধতে বাধতেই মেয়ের দিকে একবার হালকা তাকিয়ে আবার জুতো লাগানোয় মন দিলো সোহান আর বলল, “কিরে! ভার্সিটি যাস নি? আচ্ছা এসেছিস ভালোই হল । শোন, আমি একটু বাইরে যাবো । এক ঘণ্টার মধ্যে তোর কাকু আসবেন, আমাকে নিয়ে একটু প্রোজেক্টের ওখানে যাবেন, তুই কিন্তু সাবধানে থাকিস ।” জুতো বাধা শেষ হল সোহান । উঠে দাঁড়িয়ে কোটটা টেনে সোজা করে এবারে ভালো করে আরিনার দিকে তাকালো । আরিনা এখনও বিষণ্ণ । সোহান আরিনার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে, কি হয়েছে তোর?” আরিনা সোহানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল ।
“ও, এই কথা ।” আরিনার মুখে সবটা শুনে বলল সোহান । আরিনা বলল, “বাবা, তুমি বলো ছেলেটা এমন কেন! ও এরকম কেন করলো! আজব না! এখন ওর জন্য আমার খারাপ লাগছে । আর যাই হোক, আমার জন্যই তো ওর মান সম্মান গেলো ।” সোহান বলল, “দ্যাখ দুনিয়াটাই এরকম । এই বয়সে এরকমটা হয়ই । তবে তুই যেটা করেছিস, সেটা ঠিক করিস নি । ছেলেটাকে মেনে নিতে না পারিস, অন্তত এভাবে মানসিকভাবে আঘাত দেয়াটা উচিৎ হয় নি ।” আরিনা কিছু বলল । আবার নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগলো । সোহান হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেলো । তারপর সেভাবেই বলল, “তোর এই কথা শুনে আমার স্কুল লাইফের শেষ বছরের ঘটনা মনে পড়ে গেলো ।” আরিনা সোহানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিসের ঘটনা?” সোহান আরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের ছ্যাঁচড়ামির ঘটনা । দাঁড়া তোকে শোনাই ।” সোহান আরিনাকে শোনাতে লাগলো গল্প । ঠিক গল্প নয়, ঘটনা । যার নাম দেয়া যেতে পারে ছ্যাঁচড়ামি ।
প্রায় ৪৫ বছর আগের কথা । আজ সোহানের নতুন স্কুলে প্রথম দিন । যদিও এটা ফার্স্ট ডে অ্যাট স্কুল প্যারাগ্রাফের মতো নয় । কারণ ওর ফার্স্ট ডে অ্যাট স্কুল হয়ে গেছে, ছেলে এখন টিনেজার । ভালো স্কুল, তাই এস এস সি ভালো রেজান্ত করে নাইনটা শেষ করেই নতুন স্কুলে আসা । নাম বি এ এফ শাহীন কলেজ যশোর । প্রতিষ্ঠানের নামের সাথে কলেজ থাকলেও এখানে স্কুল কলেজ সব ই হয় । স্কুলে পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা “আমি কলেজে পড়ি” বলে ভাব নেয়ার একটা সুযোগ পায় আরকি । সোহানের কিন্তু প্রথম দিন তেমন একটা ভালো লাগছে না । না লাগাটাও অস্বাভাবিক নয় । পুরনো স্কুলের কথা মনে পড়ছে । গেইটের সামনে স্কুলবাস এসে নামিয়ে দিয়েছে । ভেতরে ঢুকে একটু দূরে স্কুল গেইট । পাশে একটা মাঝারি আকারের মাঠ আছে । যার এপাশে কিন্ডারগার্ডেনের বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন খেলনা সামগ্রী আর একটু দুরেই বেশ কিছু গাছ । ওপরের দিকে তাকালে বেশ বড় বড় গাছ দেখা যাচ্ছে । যেগুল দেখতে অনেকটা তাল গাছের মতো হলেও তাল গাছ নয় । “ওমারে!” হঠাৎ একটা আওয়াজ আর স্পর্শে হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো সোহান । দেখল, অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে গিয়ে একটা ছেলের গায়ে ধাক্কা লাগিয়ে তার হাত থেকে বই খাতা সব ফেলে দিয়েছে সোহান । ছেলেটা মাটিতে বসে বইগুলো তুলতে শুরুও করে দিয়েছে । ৩টি বই আর ২টো খাতা ছিল । সোহান তুলতে সাহায্য করার আগেই ছেলেটা সব তুলে ফেলল । ছেলেটা উঠে দাঁড়ালে সোহান বলল, “সো সরি আমি বুঝতে পারিনি ।” ছেলেটা মেয়েলি ভঙ্গিমায় বলে উঠলো, “না, ঠিক আছে ভাইয়া, ভুল তো মানুষেরই হয় । আর আমরা তো মানুষই ।” সোহান অনুতপ্ত হবার চেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো বেশি । মাথা নাড়িয়ে বলল, “জি জি জি।” ছেলেটা বলল, “আমার নাম আতিফ । তোমার নাম কি?” সোহান জবাব দিলো, “আমার নাম সোহান ।”
- “ওওও তুমি কি কলেজে নতুন এসেছো?” জিজ্ঞেস করলো আতিফ ।
- “হুম । ক্লাস টেনে ভেনাস শাখায় ।”
- “ও মা! কি ভালো ভালো! আমিও ওই শাখায়, যাও তাহলে, দেখা হবে । বাই!” বলে চলে চলে গেলো আতিফ । সোহানের তো এমনিতেও ভালো লাগছিল না, তার ওপর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো এই ভেবে ওর ক্লাসে একটা হিজরাও আছে ।
স্কুলটা ভি আকৃতির । এর দু পাশে তিনতলা স্কুল, আর দুই বিল্ডিঙের জোড়ার কাছে টিচার্স রুম, অফিস রুম ইত্যাদি ইত্যাদি । এই দু পাশে তিন তলা ক্লাসগুলো প্রতিটা সিড়িতে ছয়টা করে ক্লাসরুম । ক্লাসরুম গুলোর মাঝে সিঁড়ি আর সিঁড়ির পেছনেই প্রতি সিড়িতেই টয়লেট । টয়লেটের দুপাশেই তিনটে তিনটে করে ছয়টা ক্লাসরুম । বা পাশে নিচে ক্লাস ১ ও ২ । দোতলায় ক্লাস থ্রি ফোর । তিনতলায় কিন্তু আবার ক্লাস ফাইভ এইট । সিক্স সেভেন আলাদা একটা বিল্ডিঙে যা এই ভি আকৃতির বিল্ডিং থেকে বিচ্ছিন্ন । ওই ক্লাস সিক্স সেভেনের বিল্ডিঙের পাশের আছে ইংলিশ ভার্সনের বিল্ডিং । ক্লাস এইটের ক্লাসরুম গুলো । বা ভি এর বা পাশের বিন্ডিংটার তিনতলায় হয়ে ভালোই হয়েছে ক্লাসটেনের ছেলেমেয়েদের । কেন, তা একটু পরেই বোঝা যাবে । ভি আকৃতির ডান পাশের বিল্ডিং এর নীচতলায় ক্লাস নাইন আর বিভিন্ন ল্যাব । দোতলায় ক্লাস টেন আর অডিটোরিয়াম । তিনতলায় কলেজের ক্লাস হয় । ক্লাস টেনের অনেক ছেলেমেয়ে ক্লাস এইটের মেয়েদের সাথে লাইন মারে । এই ক্লাস ফাকি দিয়ে এই তিনতলা থেকে সামনের ক্লাস এইটের ক্লাসরুম সহজেই দেখা যায় । তাইতো ক্লাস টেনের সুবিধা হয়েছে তিনতলায় ক্লাস এইটদের দিয়ে । টিচার ধরবে, তার সুযোগ নেই । সিঁড়ির দু পাশে টয়লেটের দরজা টিচার আসার আগেই টয়লেটে সব ঢুকে যায় । আর যদি টিচার টের পেয়ে যায়, তবে এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেড়িয়ে যায় আর টিচার চেহারা না দেখতে পারলে এ যাত্রায় বেঁচে যায় । নিজের ক্লাস রুমে আসতে আসতে এসব নানা নিদর্শন চোখে পড়লো সোহানের । ভুলে সোহান তিনতলায় উঠে গিয়েছিলো । একজনে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো ক্লাস টেন দোতলায় । সেই সময় দুটো ছেলেকে ওয়াশরুম থেকে স্যারকে ফাঁকি দিয়ে বেড়িয়ে এলো । সোহানের কাছাকাছি আসতেই ওরা বলল, “পালা পালা!” সোহান পালাতে লাগলো । পেছনে টিচার । সিঁড়ি দিয়ে ছেলে দুটোর সাথে দোতলা আসতেই সোহানের খেয়াল হল ও কেন পালাচ্ছে । এরই মধ্যে টিচার এসে সোহানের ব্যাগ টেনে ধরল । তারপর বলল, “এইতো ব্যাটা পালাবি কোথায়! ক্লাস শুরু হয়েছে আর তোরা এখানে এসেছিস ফুর্তি করতে না?” সোহান ঘুরে স্যার এর দিকে তাকিয়ে বলল, “সরি স্যার, ওই ছেলে দুটো পালিয়েছে, আমি তো আজই নতুন এসেছি ।” স্যার বলল, “মিথ্যে কথা বলবি না! আমার কিন্তু মিথ্যে সহ্য হয় না!” সোহান বলল, “মিথ্যে না স্যার!” বলেই ব্যাগ থেকে ভর্তির কাগজ দেখাল স্যারকে । স্যার বলল, “হুম, তাই তো দেখছি । আচ্ছা, তুমি কি ওদের চেহারা দেখেছ?” সোহান চেহারা দেখেছে ছেলে দুটোর, তবুও বলল, “না স্যার।” স্যার জিজ্ঞেস করলো, “নাম কি?”
- “সোহান ।”
- “হুম । তুমি তো আজই নতুন না?”
- “ভর্তির কাগজটা আবার দেখাবো স্যার?”
- “ও ভুলেই গিয়েছিলাম । শোনো, আমি প্রবোধ কুমার । আমি আইসিটির শিক্ষক । তোমার যদি কিডনি বা শ্বসন তন্ত্র অধ্যায়ে কোন সমস্যা থাকে, আমার কাছে কোচিং করতে এসো । মাত্র ৫০০ টাকা । বুঝেছো?” সোহান আন্দাজে মাথা নাড়ল । কিন্তু এটা বুঝল না স্যার কি আসলেই আইসিটির টিচার, নাকি বায়োলজির টিচার ।
“স্যার আসবো?” গেইটের ওপর নেপচুন নাম দেখে ক্লাসরুমের সামনে এসে পারমিশন নিতে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো সোহান । ক্লাসে ক্লাসটিচার ওয়াহিদ স্যার । বোর্ডে নাম লেখা । সোহানকে দেখিয়ে ক্লাসের সবাইকে বলল, “এইযে এই ছেলেটা! তোমাদেরকে বলি না! আমি প্রতিদিনই চিনি কে কে লেট করে আসো! আমি প্রতিদিনই এই ছেলেটাকে লেট করে আসতে দেখি । মানে কি পাইছো না তোমরা!” তারপর সোহানের কাছে এগিয়ে এসে ওয়াহিদ স্যার বলল, “কি সমস্যা কি তোমার?” সোহান হালকা ভয়ে ভয়ে বলল, “স্যার! আমি তো আজই নতুন এসছি!” ক্লাসের সবাই হেসে উঠলো । ওয়াহিদ স্যার লজ্জা পেয়ে গেলে । তারপর বলল, “প্রথম ক্লাসেই লেট হল কেন?”
- “স্যার ইচ্ছে করে না, কলেজ বাস লেট করেছে, দোষটা তো কলেজেরই ।”
- “ঠিক আছে, ভেতরে এসো ।”
সোহান ভেতরে ঢুকল । পুরো ক্লাসে ছাত্র ভরা । শুধু ফার্স্ট বেঞ্চে মাত্র একটা ছেলের ব্যাগ, ছেলেটা হয়তো কোথাও গেছে, এখানে একটু জায়গা আছে আর লাস্ট বেঞ্চে দুটো ছেলে বসেছে, সেখানে একটু জায়গা আছে । লাস্ট বেঞ্চের ছেলে দুটোকে দেখে চিনতে পারলো সোহান । একটু আগে যে ছেলে দুটো টয়লেট থেকে দৌড়ে নেমেছিল এরা তাঁরা । সোহান অন্তত ওদের পাশে বসবে না । সোহানের ব্যাকবেঞ্চার হবার ইচ্ছে নেই । তাই ফাস্ট বেঞ্চেই বসলো । ফাস্ট বেঞ্চে যে বসেছে, তার পাশে তো সবারই বসা উচিৎ, সে নিশ্চয় ভালো ছাত্র হবে । তবে ফাস্ট বেঞ্চ ফাঁকা কেন? বুঝতে পারলো না সোহান । ক্লাস শুরু হল । “স্যার, আসবো?” আবার সেই মেয়েছেলে কন্থের ডাক । সোহান দরজার দিকে তাকাল । চিনতে ভুল হল না । আতিফ ।
- “হ্যাঁ হ্যাঁ, আসো, ম্যামকে দিয়েছো বইখাতা গুলো?”
- “জি স্যার। দিয়েছি ।”
- “আচ্ছা যাও, বসো ।”
এরপর আতিফ সোহানের বেঞ্চের দিকেই এগিয়ে এলো । এবার সোহান বুঝল কেন ফাস্ট বেঞ্চে কেউ বসে না । সোহানের পাশে যার ব্যাগ, ওটা আতিফের । আতিফ সোহানের পাশে বসে বলল, “ওমা! তুমি এখানেই বসেছো! কি ভালো কি ভালো ।” সোহান কিছু বলল না । পুরোটা ক্লাস আতিফ সোহানকে কতো কি-ই যে বলল, সোহান তার আগা মাথা কিছু বুঝল না । কখন কি কি জবাব দিয়েছে, তাও সোহানের জানা নেই ।
“এই জানো, আমার না নতুন বন্ধু বানাতে খুব ভালো লাগে । আমার পছন্দের খাবার কি জানো বিরিয়ানি । ও মা! তোমারও! কি মিল! কি মিল! দেখেছ, এই যে তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব হল এখনও আমরা তুই হয়ে উঠিনি । শোন না, অ্যাই, আমার সাথে যাবি? কলেজের পেছন দিকে না অনেক সুন্দর একটা বটগাছ আছে । শারীরিক শিক্ষা ক্লাসে সবাই যখন ফুটবল খেলে আমরা তখন । কি, তোরও ফুটবল খেলতে ভালো লাগে? ইশ , কি ভাগ্য! কি ভাগ্য! আমার ভাগ্যটাই খারাপ জানিস তো । ছোট বেলা থেকেই আমি অদ্ভুত । তবে আমার খারাপ লাগে না । আমি নিজেকে অনেক ভালো মনে করি । এই তোর গার্লফ্রেন্ড আছে? জানিস, আমি না একটা মেয়েকে প্রোপোজ করেছিলাম, মেয়েটা আমাকে কেন যে থাপ্পড় মারলো, আমি জানি না । ও বলল মুরগীতে মুরগীতে বিয়ে হয় না । কি জানি, কেন এমন বলেছিল । এই জানিস, আমার না কুতকুত খেলতে খুব ভালো লাগে । তুই খেলবি! চলনা, টিফিন পিরিয়ডে খেলবো । বল খেলবি? বল? বল খেলবি? বলনা! এই! বলনা! এই! এই ! এই!” “ক্যাপ্টেন!” আর সহ্য না করতে পেরে সোহান ক্যাপ্টেনকে ডাকলো । প্রথম পিরিয়ড ততোক্ষণে শেষ হয়ে গেছে । ক্যাপ্টেন বোর্ডে নাম লিখছিল । সোহানের ডাক শুনে এগিয়ে এলো । বলল, “কি হয়েছে?” সোহান বলল, “আমি বেঞ্চ চেঞ্জ করতে চাই!” ক্যাপ্টেন বলল, “জানতাম এমন হবে ।” তারপর ক্যাপ্টেন আতিফকে বলল, “কিরে, তুই কি এসব অ্যাডামটিজিং বন্ধ করবি না?” আতিফ বলল, “কি করেছি আমি, আমি তো শুধু খেলতে বলেছি, আর কিছু না ।” এরপর আতিফ সোহানের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই খুব দুষ্টু । কি খারাপ কি খারাপ ।” ক্যাপ্টেন বলল, “লাস্ট বেঞ্চে জায়গা আছে, ওখানে চলো ।” সোহান লাস্ট বেঞ্চে ছেলেদুটোর দিকে তাকাল । তারপর ক্যাপ্টেনকে বলল, “ওরা একটু বদমাইশ, না?” তুষার বলল, “না, একটু দুষ্টুমি করে । আর স্কুল লাইফে একটু আধটু দুষ্টুমি না করলে তোমার জীবনের ষোল আনা-ই বৃথা ।”এরপর ক্যাপ্টেন সোহানকে লাস্ট বেঞ্চে নিয়ে গেলো । সোহান বলল, “তুমি অনেক ভালো । আমি সোহান । তুমি?” ক্যাপ্টেন বলল, “আমি তুষার ।” এমন সময় ক্লাসে টিচার ঢুকলো । তুষার সোহানকে, “স্যার এসেছে, পড়ে কথা হবে ।” বলে চলে গেলো তুষার । ওই বেঞ্চে আর যে দুইজন ছেলে ওরা দুজনের একজন বলল, “আমি সাকিব ।” অন্যজন বলল, “আমি ইকবাল ।” সোহান ওদের দিকে তাকাল । ওরা হ্যান্ডশেক করার উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিলেও সোহান হ্যান্ড শেক করলো না । সোহান ওদের ওপর একটু রেগেই আছে । সেদিন সোহানের সাথে আর তেমন কিছু ঘটলো না । শুধু ইকবাল ও সাকিবের ক্লাস বাঙ্ক দিয়ে বাইরে চলে যেতে খেয়াল করেছে । আর যাওয়ার কি অভিনব সিস্টেম, সামনের দুজনের ব্যাগের মধ্যে নিজেদের ব্যাগ ঢুকিয়ে তারপর যায়, যেন টিচাররা ব্যাগ নিয়ে যেয়ে অভিভাবকের কাছে বিচার দিতে না পারে ।
পরদিনের কথা । স্কুল বাস থেকে নেমে স্কুল ভবনের দিকে যাচ্ছিল সোহান এমন সময় গেইটের সামনেই একটা ছেলে পা পিছলে পড়ে গেল। আশেপাশে অনেকে হাসাহাসি করলেও সোহান তাকে ওঠাতে এগিয়ে গেল । হাত বাড়িয়ে দিল সোহান, ছেলেটা সোহানের হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "থ্যাঙস এ লট ।" সোহান বলল, "ওয়েলকাম ।" ছেলেটা সোহানের আপাদমস্তক ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে জিজ্ঞেস করলো "এই তুমি আমাদের সেকশনে গতকাল ই নতুন এসেছ না?"
- আ....ম কোন সেকশনে তুমি?"
- ভেনাস ।
- হ্যা, বাট আ'ম সো সরি, তোমাকে মেয়েবি খেয়াল করিনি আমি ।
- আরে, সরি বলার কি হলো এতে? আমি রাগিব । নাইস টু মিট ইউ ।
- নাইস টু মিট ইউ টু । চলো, তাহলে একসাথেই ক্লাসে যাই ।
সোহান আর রাগিব একসাথে ক্লাসে গেলো । ক্লাসরুমে ঢুকতেই রাগিবের দেখা আরেকটা ছেলের সাথে । রাগিব ছেলেটাকে বলল, "কিরে আরিফ, কোথায় যাস?" আরিফ বলল, "আর বলিস না, ইন্জিনিয়ার আমার বই নিয়া দৌড় দিছে ।" রাগিব বলল, "ইন্জিনিয়ারের আর কাজ নাই খালি অকাজ ।" আরিফ "আচ্ছা, আমি যাই, ওরে খুজি ।" বলে ক্লাসরুমের বাইরে চলে গেল । সোহান রাগিবকে জিজ্ঞেস করল, "ইন্জিনিয়ার কে?" রাগিব জবাব দিলো, রাহাত নামে একটা ছেলে । ইলেকট্রনিক্সের জিনিস সম্পর্কে ওর ভালো জ্ঞান আছে তো, তাই আমরা ওকে ইন্জিনিয়ার বলি ।" সোহান মাথা নাড়ল শুধু, কিছু বলল না । তৃতীয় বেঞ্চে তুষারের সাথে দেখা সোহানের । সোহান বলল, "হাই তুষার, আমি কি এখানে বসতে পারি?"
- "হ্যা অবশ্যই, তবে মাঝখানে বসো । আমার প্রায়ই ওঠা লাগে তো ।" বলল তুষার । সোহান মাঝখানে বসলো । সোহানের অন্যপাশে আরেকটা ছেলে ছিল । ছেলেটা সোহানের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, "হাই!" সোহানও ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, "হাই ।" সোহান হয়তো আরও কিছু জিজ্ঞেস করতো, কিন্তু সোহানের মনোযোগ চলে গেল লাস্ট বেঞ্চের দিকে । শুধু সোহান না, আশেপাশের সবাই লাস্ট বেঞ্চে তাকিয়ে । কারণ হলো, সাকিব আর ইকবাল মেয়েদের বেঞ্চের দিকে কাকে যেন শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে,
"ডাক ডাক বেলি, আমরা সবাই খেলি,
ডাক ডাক সেলিনা , আমরা কেউ খেলিনা"
বার বার বলছে সাকিব আর ইকবাল । সোহান একটু মেয়েদের বেঞ্চের দিকে তাকালো । দুটো মেয়েকে দেখলো সোহান, যাদের চেহারা দেখলেই বোঝা যায় এদের উদ্দেশ্য করে বলছে সাকিব আর ইকবাল । তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো একটা মেয়ে সাকিব আর ইকবালের কর্মকাণ্ড দেখে হাসছে আর অন্য জন বিরক্ত হচ্ছে । একটু পর মেয়ে দুটো চলে গেলে সাকিব আর ইকবালও থেমে গেল । সোহান তখন তুষারকে জিজ্ঞেস করলো, "সাকিব আর ইকবাল মেয়ে দুটোকে দেখে এমন করলো কেন?" তুষার বলল, "এই মেয়ে দুটোর একজনের নাম বেলি, অন্য জনের নাম সেলিনা । সাকিব বেলিকে পছন্দ করে, আর ইকবাল পছন্দ করে সেলিনাকে । ওরা বেলি আর সেলিনার অ্যাটেনশন পাওয়ার জন্য এমন করে । " সোহান আবার জিজ্ঞেস করলো, আমি খেয়াল করলাম একটা মেয়ে কেমন খুশি খুশি ভাব নিয়ে ছিল, অন্য মেয়েটা বিরক্ত ছিল । কিন্তু কেন? "
তুষার বলল, "যে বিরক্ত ছিল ও বেলি । ও এসব ভালোবাসার মাঝে নিজেকে জড়াতে চায় না । যার জন্য সাকিবের মুখ থেকে এসব কথা শুনে বিরক্ত হয় । আর অন্য জন সেলিনা । ওর আবার ইকবালকে ভালো লাগে । যার জন্য ইকবালের মুখে কথা শুনে ও খুশি হয় ।"
- "তুমি এতো কিছু কি করে জানলে?"
- "আহা! আমি একা কেন, পুরো ক্লাস এসব কথা জানে ।
সোহান আর কিছু বলল না ।
ক্লাস শুরু হল । টিচার এলেন, ক্লাস নিচ্ছিলেন, এমন সময় সোহান খেয়াল করলো, ওর অন্য পাশে বসা ছেলেটা যে ওকে “হাই” বলেছিল সে ফুটবলের ছবি আকছে, গোলপোস্টের ছবি আকছে, একজন দৌড়ে এসে ফুটবলটায় লাথি মারছে এরকমভাবে এখন একটা মানুষ আকছে । সোহান জিজ্ঞেস করলো, “তোমারও ফুটবল ভালো লাগে?” ছেলেটা বলল, “হুম, প্রচুর । তোমারও ভালো লাগে?”
- “হ্যাঁ, আমারও প্রচুর ।”
- “ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা?”
- “অবশ্যই মেসিকে ভালোবেসে আর্জেন্টিনা ।”
- “ও, আমি ব্রাজিল, তবে মেসিকেও ভালো লাগে ।”
- “হুম । মেসি আর নেইমার কিন্তু ভালো বন্ধু, অথচ আমাদের দেশের কিছু পাবলিক এই দুই দেশের জন্য কি মারামারিটাই না করে!”
- “হাহা, ঠিক বলসো ।” হেসে কথাটি বলে ছেলেটা আবার ছবি আকায় মনোনিবেশ করলো । সোহান তখন বলল, “বাই দ্যা ওয়ে, আমি সোহান ।” ছেলেটা হ্যান্ডশেক করবার উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “হাই, আমি অনিক ।” সোহান আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলো, এমন সময় সামনে থাকা স্যার কড়া কণ্ঠে ধমক দিয়ে বলে উঠলো, “ওই! কথা কিসের এতো! হ্যাঁ! দাঁড়া! কিরে! দারাইতে কইতাছি না!” সোহান আর অনিক দাঁড়ালো । স্যার আবার বলে উঠলো, “কান ধর! কান ধর! কিরে, কথা কানে যায় না! কান ধর!” সোহান আর অনিক কান ধরল । তারপর স্যার আবার ক্লাস নেয়া শুরু করলো । সোহান অনিককে বলল, “সরি! আমার জন্য তোমাকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ।”
- “আরে চিল, প্যারা নাই, স্যারদের জন্য এটা সাজা হলেও আমাদের জন্য এটা স্কুল লাইফের মজা ।” বলল অনিক । অনিকের কথা শুনে মুচকি হাসল সোহান । তবে কথাটা অনিক মিথ্যে বলে নি । সত্যি এটা স্কুল লাইফের মজা এরকম মজা স্কুল লাইফ শেষ হলে কোথায় যে হারিয়ে যায় ।
বলতে বলতে থেমে গেলো সোহান । আরিনা জিজ্ঞেস করলো, “বাবা, তুমি না বললে তোমার স্কুল লাইফের ছেচরামির গল্প, কিন্তু আমি তো তোমার কোন ছ্যাঁচড়ামির ভাবই দেখলাম না ।” সোহান বলল, “ওরে গল্প তো শুরুই হল কেবল, এখনও তো অনেক গল্প বাকি । শোন ।”
টিফিন পিরিয়ডের কথা । সোহান বসে বেঞ্চে । তুষার গেছে লাইব্রেরীতে, আর অনিক গেছে মাঠে ফুটবল খেলতে । সোহানকে যেতে বলেছিল অবশ্য, কিন্তু সোহান যায় নি । নতুন জামা, ময়লা লেগে যেতে পারে । সোহান টিফিন খেয়ে ব্যাগে টিফিন বক্স রাখছিল, সে সময় একটা ছেলে এসে সোহানের বেঞ্চের পাশে দাড়ালো । তারপর সোহানকে তুষারের ব্যাগ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার পাশের ছেলেটা কোথায়?” সোহান বলল, “তুষার তো লাইব্রেরীতে গেছে ।” ছেলেটা মাথা চুলকে বলল, “ধুর! খালি লাইব্রেরী ।” সোহান জিজ্ঞেস করলো, “কেন, কোন দরকার ছিল কি? আমাকে বলো, আমি ওকে বলে দেবো ।” ছেলেটা বলল, “না, তেমন দরকার না । ওর পিসিতে কি নাকি সমস্যা হইছে, বিস্তারিত আমাকে জানানোর জন্য দেখা করতে বলছিল ।” সোহান বলল, “ও তুমি-ই তাহলে ইঞ্জিনিয়ার রাহাত?” ছেলেটা সোহান দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তুমি জানলা ক্যামনে?”
- “আরিফ নামের একটা ছেলে বলেছে ।”
- “ও, মুরগী! ওর কোন কাজ কাম নাই, খালি ডিম পারা ।”
- “মুরগী?”
- “হ, আরিফের নিকনেম । আমারে ও ইঞ্জিনিয়ার ডাকে, আমিও ওরে মুরগী ডাকি ।”
- “ও আচ্ছা ।”
- “তুমি মনে হয় নতুন আসছো ।”
- “হ্যাঁ, আমি সোহান ।”
- “আমার নাম তো শুনছোই, রাহাত ।” সে সময় ক্লাসে ঢুকল তুষার । তুষারকে দেখে রাহাত তুষারের কাছে চলে গেলো । সোহান ক্লাসরুম থেকে বাইরে যাবার জন্য বেঞ্চ থেকে বেরোল । ক্লাসরুম থেকে বেরোনোর দরজার কাছে যেতেই সোহান ধাক্কা খেলো একটা মেয়ের সাথে ।
“এটা নিশ্চয় মা?” গল্প বলার মাঝে হঠাৎ কথা বলে উঠলো আরিনা । সোহান বলল, “আরে, আগে শোন তো ।” আরিনা আবার বলল, “না, আগে বলো ওটা মা ছিল নাকি ছিল না ।” সোহান একটু থেমে একটা দম নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, ওটাই তোর মা ছিল ।” আরিনা বলল, “তাহলে এখান থেকে থেকেই তোমার ছ্যাঁচড়ামির গল্প শুরু, শুরু করো তাহলে ।” সোহান বলল, “আমার না, আমাদের ।”
- “আমাদের বলতে?”
- “আগে শোন, তারপর বুঝতে পারবি ।”
- “আচ্ছা, শুরু করো ।”
- “মেয়েটার সাথে ধাক্কা খেয়ে মেয়েটা কেন যেন অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিল । আমি সরি বলছি, অথচ মেয়েটা আমার থেকে চোখ সরায়ই না । কিন্তু একটু পর মেয়েটা বলে উঠলো,
“ইকবাল ভাইয়াকে চেনেন?” সোহান বলল, “ইয়ে মানে, হ্যাঁ । কেন?”
- “ইকবাল ভাইয়া তো ক্লাসে নেই, উনার ব্যাগ কোনটা, বলতে পারবেন?”
সোহান ইকবালের সাথে সেভাবে বন্ধুত্ব না করলেও ওরা প্রতিদিন কোথায় বসতো তা ওর জানা ছিল । মেয়েটাকে সেই ব্যাগটা দেখিয়ে দিলো সোহান । মেয়েটা বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ সোহান ভাইয়া ।” সোহান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি আমার নাম জানলে কি করে?” মেয়েটা বলল, “নাম জানানোর ইচ্ছে না থাকলে নেমপ্লেটটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখবেন ।” সোহান নিজের নেমপ্লেটের দিকে তাকাল । বুঝল, সোহানের নেমপ্লেট দেখেই মেয়েটা সোহানের নাম জেনেছে । মেয়েটার নাম আর সোহানের দেখে হল না, কারণ মেয়েটা ততোক্ষণে উল্টো ঘুরে গেছে । ইকবালের ব্যাগের দিকে যাচ্ছে । কিন্তু সোহানের যেয়ে মেয়েটার নাম জানতেই হবে । তাই সোহান দাঁড়িয়ে রইল মেয়েটার আবার এদিকে আসার অপেক্ষায় । সোহান খেয়াল করলো মেয়েটা ইকবালের ব্যাগে একটা কাগজ ঢুকিয়ে আবার সোহানের দিকে আসতে লাগলো । সোহান মেয়েটার নেমপ্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখল, মেয়েটার নাম মিম । মেয়েটা সোহানের কাছে এসে বলল, “একই ট্রিক্স খাটিয়ে লাভ নেই । এটা আমার বোনের নেমপ্লেট ।” বলেই মেয়েটা সোহানের পাশ দিয়ে চলে গেলো । ক্লাস রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মেয়েটা বলে উঠলো, “আর হ্যাঁ, আমার নাম জিম ।” সোহান পেছন ফিরে ক্লাসরুমের দরজার দিকে তাকাল । মেয়েটা সোহানের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে । কিছুক্ষণ তাকিয়ে মেয়েটা চলে গেলো । মেয়েটা সোহানের হৃদয়ে এক প্রকার ছোটখাটো দোলা দিয়ে চলে গেলো । “হাহাহাহাহাহা” হঠাৎ অট্টহাসি হেসে উঠলো আরিনা । সোহান জিজ্ঞেস করলো, “কিরে, হাসছিস কেন?” আরিনা বলল, “তোমাদের তো দেখি প্রথম দর্শনেই প্রেম হয়ে গিয়েছিলো ।” সোহান বলল, “আরে, তুই না, গল্প বলার মাঝে শুধু ডিস্টার্ব করিস । আর বলবই না, যা ।” আরিনা কোনোরকমে হাসি থামিয়ে বলল, “আচ্ছা বলো বলো, আর ডিস্টার্ব করবো না ।” সোহান বলল, “সেইদিনের পর থেকে আমার আর জিমের প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোনভাবে দেখা হতোই । কখনো লাইব্রেরীতে, কখনো টিচার্স রুমে, কখনো স্কুলে ঢোকবার সময়, একবার তো ওকে দেখতে দেখতে স্কুল বাস থেকে নামার সময় পা পিছলে পড়েও গিয়েছিলাম । আর ওই যে কাগজটা জিম ইকবালের ব্যাগে রেখে দিয়েছিলো, ওটা ছিল ইকবালের জন্য সেলিনার লেখা লাভ লেটার । সেদিন থেকে ইকবাল রিলেশনে । আর সাকিবের বেলি তখনও পটে নি । এভাবে কেটে গেলো প্রায় এক মাস । ফেব্রুয়ারির দিকে কথা । সেদিন দ্বিতীয় পিরিয়ডে ছিল শারীরিক শিক্ষা ক্লাস । আমি মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ……………।”
“কিরে নিউ বয়, এক মাস হয়ে গেলো এখনও আমাদের সাথে বন্ধুত্ব করলি না?” হঠাৎ পেছন থেকে এসে সোহানকে বলল ইকবাল । সাথে সাকিবও ছিল । সোহান বলল, “নিউ বয় আর কোথায় আছি, এখন তো আমি এক মাস ওল্ড বয় ।” সাকিব বলল, “তা কেমন চলছে?” সোহান বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন চলছে মানে?” ইকবাল বলল, “না, ইদানীং তোমাকেও তো দেখা যায় ওয়াশরুমে দাঁড়িয়ে ক্লাস এইটের দিকে তাকাতে!” সোহান বলল, “হ্যাঁ তো? আমি তো আর ক্লাস ফাঁকি দেই না, আসলে ওই বিল্ডিঙের ক্লাস রুম গুলো সুন্দর তো, তাই তাকিয়ে থাকি ।” সাকিব বলল, “উহু! ক্লাসরুম না, ক্লাসরুমের ভেতরের কিছু সুন্দর ।” ইকবাল বলল, “আমাদের সাথে যাবা?” সোহান বলল, “কোথায়?” ইকবাল জবাব দিলো, “ফ্যালকন পার্কে ।” সোহান জিজ্ঞেস করলো, “পার্কে যেয়ে কি করবো?” সাকিব বলল, “আরে, তোমাকে যেতেই হবে । কাজ আছে ।” সোহান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কাজ? আমাকে দিয়ে?” ইকবাল বলল, “হ্যাঁ, তোমাকে দিয়ে ।” সোহান বলল, “কিন্তু ক্লাস ফাঁকি দিয়ে? কোন টিচার যদি ধরে ফেলে?” সাকিব বলল, “আরে! আমাদের ধরা কি এতো সোজা? টিফিন পিরিয়ডে পর থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রোগ্রামের রিয়ারসেল হবে, আমরাও প্রোগ্রাম করবো বলে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে যাবো, সেই সময় দেয়াল টপকে আমরা ফ্যালকন পার্কে যাবো । ঠিক আছে?” সোহান বলল, “আচ্ছা । কিন্তু দেয়াল টপকে কেন? গেইট দিয়েও তো যাওয়া যায় ।” ইকবাল বলল, “আরে ধুর! তোমার কি মাথা খারাপ নাকি! গেইট দিয়ে গেলে তোমার বের হতে দেবার বদলে বাঁশ দেবে ।” সোহান আর কিছু বলল না, নীরবে সম্মতি জানালো ।
টিফিন পিরিয়ডের পরের পিরিয়ডে যখন ডাক এলো যারা যারা রিয়ারসেল করবে তাঁরা মাঠে শহীদ মিনারের কাছে চলে এসো, সে সময় সাকিব ইকবাল আর সোহানও ক্লাসের আরও কিছু অংশগ্রহনকারীর সাথে দাঁড়িয়ে গেলো । তুষার পাশে তাকিয়ে দেখল সোহানও দাঁড়িয়েছে, তুষার জিজ্ঞেস করলো, “ওয়াও! তুইও অংশগ্রহন করবি?” ততদিনে তুষার, রাগিব, আরিফ, রাহাত, অনিক এদের সাথে সোহানের তুই করে কথা বলা শুরু হয়ে গিয়েছিলো । সোহান মাথা চুলকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় সাকিব আর ইকবাল পাশ দিয়ে যাবার সময় সাকিব বলল, “সোহান তাড়াতাড়ি আয় ।” তুষার একবার সাকিবের দিকে তাকিয়ে আবার সোহানের দিকে তাকিয়ে বলল, “বুঝেছি, তুইও এই ছ্যাঁচড়াদের খাতায় নাম লেখালি। তা কি করতে নাম লেখালি?” সোহান বলল, “ছ্যাঁচড়ামি করতেই ।” তুষার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “হোয়াট! মানে তুইও কোনো মেয়েরে পছন্দ করছিস নাকি?” সোহান বলল, “সত্যি কথা বলতে হ্যাঁ, তবে এখন কি করতে যাচ্ছি আমারও জানা নেই ।” বলে সোহান চলে গেলো । তুষারের সামনে বসে ছিল আতিফ । আতিফ পেছন ফিরে তুষার বলল, “এই! আমি কিন্তু জানি, সাকিব, সোহান আর ইকবাল রিহারসেল করতে যায় নি । ওরা ইটিশ পিটিশ করতে গেছে । কি ছ্যাঁচড়া! কি ছ্যাঁচড়া!” তুষার বলল, “তোর ইটিশ পিটিশ করতে ইচ্ছে করে?” আতিফ বলল, “না, আমি ওদের মতো ছ্যাঁচড়া না ।”
- “তাহলে চুপ করে সামনে তাকা ।” আতিফ সামনে তাকাল । আর ঠোঁট বাকিয়ে ভেংচি কেটে বলল, “হুহ! কি ঢং কি ঢং!”
পার্কটা বেশ সুন্দর । কলেজের পাশেই পার্কটা । পার্কে যে শুধু ইকবাল আর সাকিবই আসে তা কিন্তু না । সোহান দেখল আরও দুটো মেয়ে পার্কের একটা দোলনায় বসে । সোহানের বিপরীত দিকে বসে থাকায় চেহারা দেখা যাচ্ছে না । সোহান বলল, “তোমরা বললে কি যেন কাজ, কি কাজ?” ওরা তিনজন ওই দোলনাটার প্রায় কাছাকাছি চলে গেছে । সাকিব তখন শিস বাজালো । আর ঠিক তখনই দোলনায় বসে থাকা মেয়ে দুটো পেছন ফিরে সোহানের দিকে তাকাল । চিনতে ভুল হল না সোহানের । একজন সেলিনা, অন্য জন জিম । সেলিনা দৌড়ে ইকবালের পাশে এসে দাঁড়ালো । ঠিক তখনই জিম পেছন থেকে একটা কাগজ বের করে সোহানকে দেখালো । তাতে লেখা, “আই লাভ ইউ সোহান ।” সোহানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো । পার্কে অনেক গাছ রয়েছে, শীতের শেষের দিকে হলেও অনেক গাছের পাতা এখনও ঝরে পড়ছে । সেই পাতার মাঝে একটা অপূর্ব রোমান্টিক পরিবেশের সৃষ্টি । সোহান জিমের কাছে যাবার জন্য একটা দৌড় দিলো । দেখে মনে হচ্ছে লায়লির জন্য মজনু যাচ্ছে, জুলেখার জন্য ইউসুফ যাচ্ছে, মমতাজের জন্য শাহজাহান যাচ্ছে, লুতফুন্নেসার জন্য সিরাজ-উ-দোলা যাচ্ছে । জিমের কাছে এসে ডান পা সামনে রেখে বা পায়ের হাটু ভাজ করে মাটিতে রোমান্টিক স্টাইলে সোহান যেই না বসলো, অমনি ছ্যাঁত করে একটা আওয়াজ হল । আওয়াজটা বাকিরাও শুনতে পেলো । সাকিব জিজ্ঞেস করলো, “কি হল? ” সোহান মাটির ওপর পা ভাজ করে বসে বলল, “প্যান্ট ছিঁড়ে গেছে ।” জিম চোখ বন্ধ করে সেলিনার পাশে এসে দাঁড়ালো ।
“হাহাহাহাহাহা” হো হো করে হেসে উঠলো আরিনা । সোহান আবার বলল, “হাসিস না হাসিস না, প্রথম প্রেমের দিন এরকম ঘটনা মনে হয় আর হয় নি । তারপর আসি, এই দিন বাদ দেই ।” আরিনা বলল, “না না, তুমি বলো, তোমার প্যান্ট ছিঁড়ে যাবার পর কি হয়েছিলো?”
- “আআআআ! বলাই লাগবে?”
- “হ্যাঁ, অবশ্যই । অসম্পূর্ণ রেখো না । বলে যাও ।”
- “ও হ্যাঁ! ওইদিনের তো আরও ঘটনা আছে, সেগুলো তো বলতেই হবে । আচ্ছা শোন । সেদিন জিম আর সেলিনা চলে যায় নিজেদের ক্লাসে । বেচারি জিমের আর আমার সাথে কথা বলা হল না । এখন সমস্যা হল আমি কি করে ক্লাসে পৌছব তা নিয়ে । কারণ এমনি দাঁড়িয়ে থাকলে বোঝা না গেলেও হাঁটার সময় ঠিকই বোঝা যায় । এখন কেউ একজন পেছন পেছন আসলে তাও হয়, কিন্তু পার্ক থেকে সেই কলেজ পর্যন্ত এতোটা দুর এরকম একজন পেছন পেছন যাওয়াও তো সম্ভব নয় । এমন সময় ইকবাল একটা বুদ্ধি বের করলো ।”
- “শোন সাকিব, আমার প্যান্ট তো সোহানের গায়ে লাগবে না । একটা কাজ করি, সোহান, তুমি এখানে বইসে থাকো । আমি আর সাকিব যাই, সাকিব ওয়াশরুমে যামু । সাকিব ওর প্যান্ট খুলে আমারে দেবে আর সাকিব টয়লেটে বইসে থাকবে । আমি তারপর তোর কাছে আসমুনে, এরপর তুই সাকিবের প্যান্ট পইড়া টয়লেটে যাইস । পড়ে তুই সাকিবের প্যান্ট সাকিবরে দিবি, আর তোর প্যান্ট তুই পড়বি । ক্লাস পর্যন্ত বাকিটা আমি তোর পেছন পেছন যাবোনে, ব্যাস!” সোহান আর সাকিব নিরব , তবে এই নীরবতা জানান দিলো, ওরা এই অদ্ভুত কাজ করতে রাজি । তো প্ল্যান অনুযায়ী যা করতে হবে তাই করতে লাগলো ওরা । প্রথমে ইকবাল আর সাকিব স্কুলে যেয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে প্যান্ট খুলে ইকবালের হাতে দিলো । ইকবাল প্যান্ট নিয়ে আবার ফিরে এলো সোহানের কাছে । সোহান তখন পার্কের টয়লেটে যেয়ে সাকিবের প্যান্ট পড়ে আবার রওনা হল স্কুল বিল্ডিং এর দিকে ।
আরিনা এমন সময় বলে উঠলো, “ওয়াও, কি দারুণ ছ্যাঁচড়ামি কাহিনী তোমার! গিয়েছিলে ছ্যাঁচড়ামি করতে, ছিলে গেলো প্যান্ট!” বলে হেসে দিলো আরিনা । সোহান বলল, “হ্যাঁ রে । ওই দিন অনেক মজা হয়েছিলো । তবে একটা কথা সত্য, ওইদিনের পর আমি সাকিব আর ইকবাল বেশ ভালো বন্ধু হয়ে যাই । স্কুলের সবার কাছে তিন ছ্যাঁচড়া খেতাবও পাই । কিন্তু কাহিনী কিন্তু এখানেই শেষ হয় নি, কাহিনী কিন্তু আরও আছে । ওইদিন আমাদের কম কষ্ট ভোগ করতে হয় নি । শোন ।”
স্কুলের বাউন্ডারির কাছে পৌঁছে গেলো সোহান আর ইকবাল । সোহানের হাতে ওর ছেঁড়া প্যান্টটা ছিল । সেটা হাতে নিয়েই উঠেছিল, কিন্তু সেটা হাতে নিয়ে নেমে আসাটা ছিল একটু কষ্টকর । তাই সোহান দেয়ালে উঠে ইকবালের হাতে প্যান্টটা দিয়ে দিলো । তারপর নেমে গেলো স্কুল বাউন্ডারির ভেতর । এরপর ইকবালের উঠে আসার পালা । ইকবাল ওই প্যান্টটা কাঁধে নিয়েই উঠে পড়লো । সোহান বলল, “দোস্ত প্যান্টটা আমারে দে, তোর কষ্ট হবেনে ।” কিন্তু ইকবাল বলল, “আরে ভাই চিন্তা করিস না । পারমু ।” বলে ইকবাল দেয়াল পার হয়ে লাফ দিলো । এমন সময় ছ্যাঁত করে আবার একটা আওয়াজ । সোহান জিজ্ঞেস করলো, “কি হল ।” ইকবাল বলল, “ভাই! পুরো প্যান্টটাই গেছে এইবার!”
“তাড়াতাড়ি বাইর হবি দেরি করবি না ।” রাহাত বলতে বলতে এক টয়লেটে ঢুকল আরিফ, আর অন্য টয়লেটে ঢুকল রাহাত । টয়লেটে ঢুকেই আরিফ আর রাহাত আবার গল্প শুরু । আরিফ বলল, “এ রাহাত, ওই গেইমটা খেলছিস?”
- “কোন গেইম?” জিজ্ঞেস করলো রাহাত ।
- “আরে তোরে ওইদিন যে দিলাম ।”
- “ও হ মনে পড়ছে, আমি ইন্সটল করার টাইম-ই পাই নাই ।”
সাকিব টয়লেট থেকে ওদের কথা শুনে বলল, “কিরে ভাই? আরিফ আর রাহাত না?”
রাহাত চেঁচিয়ে বলল, “কিরে আরিফ! তুই সাকিব না?” আরিফ বলে উঠলো, “হ, কিরে সাকিব? কই ছিলি?” সাকিব বলল, “ভাই আর কইস না, আমি টয়লেটে বন্দি ।” রাহাত আর আরিফ ততোক্ষণ বাইরে বেড়িয়ে এলো । দেখল, সাকিব অন্য একটা টয়লেটের ভেতরে ঢুকে আছে । রাহাত বলল, “স্যার এর দাবড়ানি খাইসিস মনে হয়, আর বাইরে আয় ।”
সাকিব বলল, “না রে ভাই, আমি ভেতরে জাইঙ্গা পইড়া বইসা আছি!”
রাহাত আর আরিফ একসাথে বলে উঠলো, “কি!”
- “হ রে ভাই, ইকবাল আর সোহানরে দেখলে একটু কইস তাড়াতাড়ি আইতে ।” বলল সাকিব ।
- “তোর এই অবস্থা ক্যামনে হইল সাকিব?” জিজ্ঞেস করলো আরিফ ।
- “ভাই আর কইস! পার্কে গেছিলাম সোহানরে জিমের সাথে দেখা করাইতে নিয়া গেছিলাম, সোহানের প্যান্ট ফাইটা গেছে, তাই জন্য ইকবাল আমারে টয়লেটে আইনা আমার প্যান্ট নিয়া সোহানরে পড়াইয়া আনতে গেছে ।” রাহাত আর আরিফের কোন জবাব পেলো না সাকিব । সাকিব বলে উঠলো, “কিরে রাহাত! আরিফ! কই গেলি! একটু কথা বল! ভালোই তো লাগতেছিল! ওই?”
“আমি সাথে কথা বললে ভালো লাগবে?” হঠাৎ প্রবোধ কুমার যার এর কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলো সাকিব ।
এদিকে ক্লাসরুমের দিকে যেতে যেতে আরিফ রাহাতকে বলল, “যাক বাবা! টাইমলি টের পাইছিলাম স্যার আসতেছে, নাইলে আজকে আর ফেরা হইত না । কিন্তু বেচারা সাকিব?”
- “ভাই ওরা আগেও ধরা খাইছে, এইবারও ধরা খাইলে কিছু হবেন না । ওরা স্যাররে ম্যানেজ কইরা নিতে পারবে ।”
“কি বৎস? নিজে নিজেই বাইরে বেড়িয়ে আসবে? নাকি দরজা ভাঙ্গা লাগবে?” সাকিবকে বলল প্রবোধ কুমার স্যার । সাকিব বলল, “ও স্যার, একটু বোঝার চেষ্টা করেন! আমার প্যান্ট পড়া নাই!” প্রবোধ কুমার স্যার বলল, “ও, কণ্ঠ শুনেই ধইরা ফেলসি, সাকিব না? অজুহাতের তোমার শেষ নাই । বাইরে না আসার নতুন বুদ্ধি বাইর করছিস! আয় বাইরে আয়!” সাকিব বলল, “স্যার সত্যি বলছি স্যার! অযুহাত না!” স্যার বলল, “আরে তুই আগে বাইর হ!” ধমকের সুরে বলল প্রবোধ স্যার । অবশেষে সাকিব ছিটকিনি খুলল । তারপর ধীরে ধীরে দরজাটা খুলল ।
“ছি!” সাকিব দরজা খুলতে না খুলতেই টয়লেটে ধুকছিল আতিফ । সাকিবকে এই অবস্থায় দেখে এরকম রিয়েকশন দিলো সে । তারপর, “এ আমি কি দেখলাম! ছিছিছি! আআআআ!” সাকিবও তাড়াতাড়ি করে দরজা আটকে দিয়েছে । স্যারও সাকিবের এই অবস্থা দেখে গলা খাখরে বলল, “থাকো তুমি ভেতরেই থাকো, আমি দেখি তোমার কোন জামাকাপড়ের ব্যাবস্থা করতে পাড়ি কি না ।”
“ছিছিছি! এসব দেখার আগে আমার চোখ ব্লাস্ট হয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল! ছি! আজ তো আমার চোখ স্যাভলন দিয়ে ধুয়ে দিলেও ঠিক হবে না! কি লজ্জা কি লজ্জা!” বলতে বলতে ক্লাসরুমে ঢুকছিল আতিফ, ওর মুখে কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে গেলো রাগিব । সোহান আর ইকবাল তখন এদিকেই আসছিলো । ওদের দেখে রাগিব জিজ্ঞেস করলো, “কিরে, আতিফ এমন করছে কেন?” ইকবাল জিজ্ঞেস করলো, “কি করছে?”
- “ওয়াশরুমে গিয়েছিলো, আসার পর বলছে কি নাকি দেখে ফেলেছে, স্যাভলন দিয়ে ধুলেও যাবে না?” ইকবাল সোহানের দিকে তাকিয়ে বলল, “দোস্ত কোন ঝামেলা হয় নাই তো!” সোহান বলল, “আচ্ছা, যাচ্ছি-ই তো সাকিবের কাছে ।” এরপর সোহান রাগিবকে বলল, “রাগিব, একটা সাহায্য করনা দোস্ত, তোর বাসা তো কাছেই, একটা প্যান্ট আনতে পারবি?” রাগিব জিজ্ঞেস করলো, “কেন, কি হয়েছে?” সোহান রাগিবকে সব খুলে বলল । রাগিব বলল, “ইয়া আল্লাহ! আমি এখনই যাচ্ছি ।” বলেই বাসার দিকে যাবার জন্য এক কদম পা ফেলতে গিয়েও ফেলল না রাগিব । ফেলতে পারলো না । সামনের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেলো সাথে সোহান আর ইকবালও সামনের দিকে তাকিয়ে । দেখল, প্রবোধ স্যার সাকিবকে স্কুলের পেছনে পড়ে থাকা পুরনো পাতলা পর্দাগুলোর একটা এনে লুঙ্গির মতো পড়িয়ে টিচার্স রুমের দিকে নিয়ে যাচ্ছে । সোহান ইকবালকে বলল, “ইকবাল, চলো আমার সাথে ।” ইকবাল জিজ্ঞেস করলো, “কোথায়?”
“স্যার ওয়াহিদ স্যার কোথায়?” টিচার্স রুমে থাকা একজন টিচার জানালো ওয়াহিদ স্যার ক্লাস এইটের মেঘনা শাখায় । সাকিবের চোখদুটো ভয়ে বড় বড় হয়ে গেলো । কারণ ওই শাখায়েই রয়েছে সাকিবের ক্রাশ বেলি । লাস্ট পিরিয়ড চলছিলো তখন । প্রবোধ স্যার সাকিবকে নিয়ে যাবার সময় যারাই সাকিবের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো, তাঁরাই সাকিবের দিকে তাকিয়ে হাসছিল, কেউ চোখ বন্ধ করে ফেলছিল । কিন্তু সাকিবের সেদিকে কোন মনোযোগ নেই । সাকিবের শুধু চিন্তা বেলি ওকে দেখলে কি বলবে সেই নিয়ে । ক্লাসরুমের কাছাকাছি যেতেই বেলি সাকিবকে দেখে ফেলল এই অবস্থায় । কারণ বেলি একদম সামনের বেঞ্চেই বসে । সাকিবকে ক্লাসরুমে ঢুকিয়ে দিলো প্রবোধ স্যার । সাকিবকে দেখে পুরো ক্লাসরুম চুপ । কিছু ছেলে মুচকি মুচকি হাসছে, আর মেয়েরা সবাই চোখ বন্ধ করে আছে । ওয়াহিদ স্যার হ্যাঁ করে তাকিয়ে আছে । বলল, “স্যার! এই তিনজন লুঙ্গি পড়া পাবলিক কোত্থেকে পেলেন!” এই তিনজন…………তিনজন!” কথা বলতে বলতে অবাক হয়ে থেমে গেলো প্রবোধ স্যার । পেছনে তাকাল উনি । সাকিবও তাকাল । দেখল, দাঁড়িয়ে আছে সোহান আর ইকবাল, সাকিবের মতোই পর্দা লুঙ্গির মতো করে পড়ে । সাকিব এবার খুশিতে মুখে হাত দিলো । সোহান আর ইকবাল খেয়াল করলো, সাকিব ওদের পেছনেও আরও কাউকে দেখছে । সোহান আর ইকবাল পেছনে তাকিয়ে দেখল ওদেরই মতো পুরনো পর্দা লুঙ্গির মতো করে পড়ে দাঁড়িয়ে রাগিব, অনিক, আরিফ, রাহাত, তুষার । প্রবোধ স্যার আর ওয়াহিদ স্যার কি বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলো না ।
এদিকে ক্লাস এইটের সবাই ওদের বন্ধুত্ব দেখে দাঁড়িয়ে হাততালি দেয়া শুরু করলো । জিম আর সেলিনাও দিলো । সাকিব দেখল, বেলিও হাততালি দিচ্ছে, সাকিবের দিকে তাকিয়ে ।
এমন সময় আরিনার মোবাইলে একটা কল এলো । আরিনা দেখল, মিমির কল । আরিনা বাবাকে বলল, “বাবা, এক মিনিট, আমি একটু কথা বলে আসি ।” বলে আরিনা একটু দূরে সরে গেলো । তারপর মিমিকে বলল, “হ্যাঁ দোস্ত বল ।”
- “দোস্ত, ভার্সিটি থেকে অভি জানালো, নিলয় নাকি সুইসাইড করেছে ।”
- “কি!” চিৎকার করে উঠলো আরিনা । আরিনার চিৎকার শুনে দৌড়ে এগিয়ে এলো আরিনার বাবা । আরিনা বাবাকে জরিয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো ।
কিছুক্ষণ পর আরিনার কান্না থামলে আরিনা বলল, “বাবা, তোমার গল্পের পরের অংশ শুরু করো ।” সোহান বলল, “না থাক, এখন তোর মন মেজাজ ভালো নেই, আমি না হয় পড়েই তোকে বাকিটা বলবো ।” আরিনা বলল, “না বাবা, দুটো ব্যাপারে একসাথে ধৈর্য ধরতে পারবো না ।” সোহান বুঝতে পারলো আরিনা কাহিনীটা শোনায় বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে । তাই আর না করলো ।
- “সেদিন সাকিবের দিকে তাকিয়ে বেলি হাততালি দিয়েছিলো দেখে সাকিব ধরেই নিয়েছিলো বেলিকে পটানোর এই তো উপায়, তাই আমরা সিদ্ধান্ত নেই আজ বিকেলে আমরা বেলিদের বাসায় যাবো বেলিকে পটাতে । সেদিন বাসায় পৌঁছেছিলাম ওই পর্দা গায়ে দিয়েই । শুধু তাই নয় আমি যে বাসে ছিলাম সে বাসে আরও কিছু ছেলে ছিল যারা ক্লাস এইটে পড়ত । ওরাও দেখি আমাকে একা লজ্জায় না ফেলতে নিজেরাও পর্দা পড়ে বসে আছে । বিকেলে আমি সাকিব আর ইকবাল জিমের দেয়া ঠিকানার মাধ্যমে চলে যাই বেলিদের এলাকায় । মোটামুটি গ্রামের মধ্যে একটা প্রাচীর ঘেরা উদ্যানের ভেতর বেলিদের বাড়ি । আমাদের গলার সমান ছিল প্রাচীর ।”
- “দোস্ত! কিছুই তো দেখি না!” বলল সাকিব ।
- “ভাই, তুই কালকে কালকে ক্লাসেই ওর সাথে কথা বলতে পারতি ।” বলল ইকবাল ।
- “ভাই তোমরা থামো! ওই দ্যাখো! বেলি জানালার পর্দা খুলে দিচ্ছে!” বলল সোহান ।
সাকিব আর ইকবালও দেখল বেলি জানালার পরজা খুলে দিলো । রুমের ভেতর অন্ধকার । বেলি যতক্ষণ জানালার কাছে ছিল, ততোক্ষণ বেলিকে দেখা গেলো । বেলি জানালার কাছ থেকে সরে যেতেই অন্ধকারের মধ্যে মিশে গেলো । ইকবাল বলল, “কিরে সাকিব, চলে গেলো তো । কি করবি?” সাকিব বলল, “এক কাজ করি, ঢিল মারি ।” বলেই সাকিব পায়ের কাছ থেকে একটা মোটামুটি সাইজের ইট নিয়ে মারল একটা ঢিল । সেই ঢিল সোজা ঢুকে গেলো জানালা দিয়ে ভেতরে আর তখনই একটা চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পেলো ওরা । সোহান বলে উঠলো, “ভাই ভাগ! দৌড় দে!” সাকিব সোহান আর ইকবাল উল্টো ঘুরে একটা দৌড় দিলো । দৌড়াতে দৌড়াতে ইকবাল বলল, “কিরে সাকিব, কার কোন জায়গায় মারলি?” সোহান বলল, “চুপ কইরা দৌড়াও, নাইলে সাকিবের শ্বশুরের হাত থেকে আজকে আর নিস্তার নাই ।” ইকবাল সাকিব আর সোহান ওইদিন বাসায় চলে এলো । সাকিবের কাজ আর হল না দেখে সিদ্ধান্ত হল পরদিন ক্লাসের তাহলে সাকিব বেলাকে সব কথা বলবে । কিন্তু পরদিন বেলা ক্লাসে এলো না । জিম সোহানকে বলল, “আজ সকালেই বেলার বাবা মারা গেছে, আঙ্কেল একটা অ্যাকসিডেন্ট করেছিলেন, সেই অপারেশন শেষে ওর বাবা দুদিন হল বাড়ি এসেছিলেন । গতকাল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন, সেজন্য হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো ওরা, আজ সকালে স্কুলে আসার সময় মায়ের কাছ থেকে শুনলাম ওর বাবা মারা গেছেন ।” সোহান সাকিবকেও সব কথা জানালো । সাকিব শুনে যে বেশ কষ্ট পেলো তা ওর চেহারা দেখেই বোঝা গেলো । সেদিন থেকে সাকিবের মন কেমন বিমর্ষ হয়ে যায়, হয়তো বাবার মৃত্যুতে বেলাও বেশ কষ্টে আছে সেজন্য । সোহান ইকবালের সাথে আর সাকিব ক্লাস বাঙ্ক দিয়ে বাইরে বের হয় না । ওর মনে যেন এক অজানা চিন্তা ঘিরে ধরেছে । পরদিনও সাকিব ভেবেছিলো হয়তো আজ আসবে বেলা, কিন্তু বেলা পরদিনও এলো না । এভাবে প্রায় প্রতিদিনই সাকিব বেলার অপেক্ষায় থাকে । প্রতিদিনই সাকিব নিজের ক্লাসে আসার আগে বেলার ক্লাসরুম ঘুরে আসে দেখতে আজ বেলা এসেছে কি না । দেখতে দেখতে প্রায় আরও ১ মাস কেটে গেলো । মার্চের শুরুর দিকের কথা । একদিন সেলিনা আর জিম ক্লাসরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলো, এমন সময় সাকিব এলো । সেলিনা সাকিবকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “সাকিব ভাইয়া, আপনি?” সাকিব হালকা হাসবার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করলো, “বেলা এসেছে?” সেলিনা জবাব দিলো, “না ভাইয়া । আপনার প্রতিদিন এভাবে আসার দরকার নেই তো, আমি তো বলেইছি, বেলা এলে আমি আপনাকে জানাবো ।” সাকিব কিছু না বলেই চলে গেলো । সেলিনাকে তখন জিম জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, বেলা আসে না কেন কলেজে? ওর কি কিছু হয়েছে?” সেলিনা বলল, “ওর বাবা মারা গিয়েছে তো, সেজন্য হয়তো ।” জিম বলল, “আঙ্কেল তো মারা গেছে ১মাস হতে চলল, তাও দেরি যে কেন আসছে না আল্লাহই জানেন ।”
- “তুই না সাকিব ভাইয়াকে বেলার বাসার অ্যাড্রেস দিয়েছিলি?”
- “আরে ওটা তো আমি আরেকটা মেয়ের কাছ থেকে নিয়েছি, বেলাদের এলাকায়েই থাকে ।”
- “তাহলে ওই মেয়েকে জিজ্ঞেস কর, তাহলেই তো হয় ।” বলল সেলিনা ।
- “আমি জিজ্ঞেস করছিলাম ওকে । বেলার সাথে ওর তেমন খাতির নাই । ও শুধু বলেছে বেলা নাকি বাসা থেকেই বের হয় না ।” বলল জিম ।
- “ও, আশা করি ওরা সবাই ভালোই আছে ।” বলল সেলিনা ।
- “হুম……কবে যে বেলি…………………বেলি!” কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ বেলি ওদের সামনে দেখে বেলিকে ডেকে উঠলো জিম । সেলিনা বলল, “অবশেষে তুই এলি! সাকিব ভাইয়া তোকে কিছু বলতে চায়, দাঁড়া, আমি উনাকে ডেকে আনি ।” বলেই সেলিনা বেরোতে যাবে, এমন সময় সেলিনার হাত ধরে সাকিবের কাছে যাওয়ায় বেলিকে বাধা দিলো । “কিরে সাকিব! আর কতদিন মন খারাপ করে থাকবি?” সাকিব ক্লাসে ঢুকে সেকেন্ড বেঞ্চের কাছে আসতেই সাকিবকে বলল তুষার । সাকিব হালকা হাসবার চেষ্টা করে বলল, “আরে না রে ইয়ার, আমি ঠিক আছি ।” সাকিবকে দেখে অনিকও এগিয়ে এসে বলল, “না রে, তুই ঠিক নাই, বল কি হইছে ।” রাহাত এগিয়ে এসে বলল, “তোর পিসি নষ্ট হইছে, আমারে দিস ঠিক কইরা দিমুনে ।” রাগিবও এসে বলল, “সাকিব চল, আবার পর্দা লুঙ্গির মতো পইড়ে ক্লাস করি ।” ইকবাল বলল, “হ, তার আগে চল সোহানের প্যান্ট ছিঁড়ে দেই!” সোহান বলল, “না, আজকে ইকবালের প্যান্ট ছিরমু!” এদিকে সেকেন্ড বেঞ্চে বসে থাকা আরিফ “সাকিব এদিকে তাকা ।” বলে হাতে থাকা কম্পাস নিয়ে সামনের বেঞ্চে বসা আতিফকে মারল একটা গুতা । “আ....আহ! নটি!” বলে চেঁচিয়ে উঠলো আতিফ । সোহানও সেটা শুনে বলে উঠলো, “আ…আহ!নটি!” রাহাত আর তুষারও তাল মেলাল । “আ…আহ! নটি!” আরিফ রাগিব, অনিক, রাহাত ইকবালও তাতে তাল মেলাল, “আ……আহ! নটি!” সবাই একসাথে বলতে লাগলো এই কথা । মাঝখান বিরক্ত হয়ে আতিফ বলেছিল, “এই! আমাকে নিয়ে মজা করবে না! কি দুষ্টু কি দুষ্টু!” কিন্তু ওর কথা কারো কানে যায় নি, কারণ সবার মুখে একই শব্দ, “আ…আহ!নটি!” ওরা যখন বলছিল হঠাৎ কেন যেন মনে হল একটা মেয়ে কণ্ঠও যেন এই শব্দ বলছে । সবাই থেমে গেলো । দরজা থেকে আসছে আওয়াজ । সবাই দরজার দিকে তাকাল । সাকিব হা করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । কারণ দরজায় সামনে দাঁড়িয়ে বেলা বলছে, “আ…আহ! নটি!” কিছুক্ষণ বলার পর বেলি ওদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, “কি ব্যাপার? থামলে কেন তোমরা?” কেউ কিছু বলল না । বেলি বলল, “আচ্ছা বাদ দেই সেসব । যে জন্য এসেছিলাম ।” বলে বেলা সাকিবের সামনে এসে দাঁড়ালো । তারপর ঠোঁটের কোণে রিদু হাসি নিয়ে বলল, “আচ্ছা, আমাকে সেই সুযোগটা দেবে, যে সুযোগ পেলে তুমি আমায় একদিন ফোন করে বলবে, চাকরীটা আমি পেয়ে গেছি বেলি শুনছো ।” সাকিব বুঝতে পারলো না । প্রশ্ন করলো, “মানে?” বেলি তখন বলল, “বাবা চলে যাবার পর আমি বেশ একাকি ফিল করছি । আসলে আমি এতদিন বাবার সাথে আমি অনেক ভালো বন্ধুর মতো ছিলাম তো । আজ মনে হচ্ছে একজন বয়ফ্রেন্ড হলে ভালো হয় । তুমি কি আমার বয়ফ্রেন্ড হবে?” সাকিব সব বুঝলেও এটা বুঝতে পারছে না কি জবাব দেবে । তুষার বলল, “সাকিব! এটাই সুযোগ! বল কিছু! বল!” সাকিব কিছু বলল না । আগের মতোই তাকিয়ে আছে । একটু পর তুষার “আরে সাকিব যা!” বলে সাকিবকে হালকা ধাক্কা দিয়ে সাকিবকে বেলার আরও কাছে পাঠিয়ে দিলো । পাশে বলে আতিফ বলে উঠলো, “হুহ! নেকা । কি ঢং! কি ঢং!” হুহ । বলেই আতিফ ক্লাস রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো । ইকবাল তখন বলল, “সাকিব! বল!” সাকিব অবশেষে মুখ খুলল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি!” বেলা জবাব দিলো, “আমিও।” এরপর বেলা ক্লাস রুম থেকে চলে গেলো । সাকিব বেলার দিকে তাকিয়ে রইল ।
“এই থেকে শুরু আমাদের ছ্যাঁচড়ামির গল্প । প্রায় প্রতিদিনই যখন সুযোগ পেতাম, ক্লাসের ফাঁকে বা ক্লাস বাঙ্ক দিয়েই হয় ফ্যাল পার্কে, নয়তো ক্যান্টিনে, নয়তো স্কুলের ছাদে গল্প করতাম । আমাদের তিন বন্ধুর প্রেম করার ধরণ ছিল তিন রকম । ইকবাল আর সেলিনার প্রেম ছিল ঢং আর নেকামিতে ভরা । ওদের প্রেমের একটু গল্প শোনাই ।”
“বাবি, খাইসো?” জিজ্ঞেস করলো সেলিনা । ইকবাল জবাব দিলো, “হ্যাঁ বাবি খাইসি । কি দিয়ে খাইসো?”
সেলিনাঃ পরোটা আর ডিম ভাজি । তুমি?
ইকবালঃ সত্যি! ওমা! আর আমিও তাই খেয়েছি । পরোতা গরম গরম খেয়েছো, না ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ।
সেলিনাঃ গরম গরম খেয়েছি । তুমি?
ইকবালঃ বাবি! আমিও তো গরম গরম পরোটা খেয়েছি!
সেলিনাঃ ওমা! তোমার আর আমার কত্ত মিল!
ইকবালঃ বাবি! তুমিও এক সময় আমাকে পরোটা বানিয়ে খাওয়াবে ।
সেলিনাঃ শুধু পরোটা কেন, বিরিয়ানি, রোস্ট, কাবাব যা চাবে তাই-ই খাওয়াবো ।
ইকবালঃ বাবি, আই লাভ ইউ!
সেলিনাঃ আই লাভ ইউ টু বাবি!
ইকবালঃ আই লাভ ইউ থ্রি!
সেলিনাঃ আই লাভ ইউ ফোর!
ইকবালঃ আই লাভ ইউ ফাইভ সিক্স সেভেন এইট!
সেলিনাঃ আই লাভ ইউ নাইন টেন ইলেভেন টুয়েল্ভ!
আরিনা তখন বলল, “বাহ, সে কি প্রেম! আচ্ছা, বাবি মানে কি?” সোহান বলল, “ওরাই বানিয়েছে, বাবু আর বেবি থেকে বাবি ।” আরিনা হালকা হেসে বলল, “ও আচ্ছা । তোমার আর মায়ের প্রেম কেমন ছিল?” সোহান বলল, “এখন যেমন, ওরকমই । দশটা কথা হলে সাতটা কথাই ঝগড়ার হতো ।” আরিনা মন খারাপ করে বলল, “সেই ঝগড়ার জন্যই এখন তোমার আর মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে না?” সোহান চুপ হয়ে গেলো । কিছু বলল না । একটু থেমে স্কুল লাইফে ওদের কি ধরণের কথা হতো তা বলা শুরু করলো ।
জিজ্ঞেস করলো, “আমার একটা প্র্যাকটিকাল করে দিবা ।” সোহান জিজ্ঞেস করলো, “কিসের?”
জিমঃ আইসিটি প্র্যাক্টিকাল ।
সোহানঃ এই তোমাদের টিচারদের আক্কেল না আমি বুঝি না । ক্লাস এইট হল জেএসসির মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ একটা জিম সময় এর মধে আবার দেয় প্র্যাক্টিকাল ।”
জিমঃ তুমি কিন্তু হ্যাঁ না কিছুই বলছ না!
সোহানঃ আচ্ছা, চেষ্টা করবো ।
জিমঃ চেষ্টা করবা! মানে কি!
সোহানঃ চেষ্টা করবো মানে, দিও দেখি!
জিমঃ দিও দেখি মানে! তুমি করবা!
সোহানঃ হ্যাঁ, বললাম তো, করবো ।
জিমঃ তোমাকে ইদানীং কেমন যেন সন্দেহ হয় ।
সোহানঃ এই তুমি না মোটা হয়ে যাচ্ছো! ওজন কমাও!
জিমঃ তোমার চেয়ে চিকন আছি! মোটা কুত্তা!
সোহানঃ কি মুখের ভাষা হয়েছে! কয়েকদিন্ পর আরও কি কি যে বলবা, আল্লাহই জানেন ।
জিমঃ কি বললা তুমি! তোমার মতো ওরকম আজে বাজে ভাষায় কথা বলার মেয়ে না আমি ।
সোহানঃ এই সমস্যা কি তোমার! এতো অল্পতেই রাগ কেনো হয় তোমার!
জিমঃ কি বললা! আমি রাগ করি!
সোহানঃ অবশ্যই! মানে তোমার এতো রাগ যে কোত্থেকে আসে! আল্লাহই জানেন!
জিমঃ বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সোহান!
সোহানঃ বেশি বেশি তো তুমি-ই করছো!
জিমঃ তোমার সাথে রিলেশন করাই আমার ভুল হয়েছে ।
সোহানঃ ভেবোনা তোমার সাথে রিলেশন করে আমি খুব সুখী হয়েছি ।
জিম আর সোহান একসাথেঃ হুহ!
এরপর মিনিট পাচেক দুজন দুজনের বিপরীত দিকে তাকিয়ে বসে রইল । এরপর সোহান জিমের দিকে তাকিয়ে বলল, “শোনো, সরি । আমার এরকম বলাটা মনে হয় উচিৎ হয় নি ।” জিমও সোহানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমিও সরি । আসলেই আমি একটু বেশি রাগি ।”
সোহানঃ না না, ঠিক আছে । দোষটা আমারই ।
জিমঃ কে বলেছে! দোষটা আমার ।
সোহানঃ তুমি কিন্তু আবার রেগে যাচ্ছ!
জিমঃ ও! আমি একটু রাগি স্বীকার করেছি দেখে আবার আমাকে খেপানো শুরু করছো!
সোহানঃ জিম পচা ডিম কোথাকার!
জিমঃ কি বললা! মোটা কুত্তা! ঢেঁড়স! পটল! কুমড়া কোথাকার!
সোহানঃ কুটনি! শাঁকচুন্নি! পেত্নী! ঢঙ্গী! ডাইনী! বুড়ি! শয়তানী! ফাজিল! হারামজাদি!...............
জিমঃ দৈত্য! ইবলিশ! মির জাফর! হারামজাদা! শয়তান! বেয়াদব! কাউয়া!............
হেসে দিলো আরিনা । আরিনার মুখে হাসি দেখে মনটা ভালো হয়ে গেলো সোহানের । আরিনা তখন বলল, “সাকিব ভাইয়া আর বেলি আপুর কেমন প্রেম ছিল?” সোহান বলল, “ওদের প্রেম ছিল নরমাল, রোমান্টিক আর ওদের কোথায় কবি কবি ভাব ছিল । শোন তাহলে ওদের কথা ।”
সাকিব ধীরে ধীরে হাত ধরল বেলির । বেলি বলল, “আজকের আকাশটা খুব সুন্দর, তাই না?”
বেলি জবাব দিলো, “হুম । পেজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে । জানোতো এই সময় কাশফুল অনেক ফোটে ।”
সাকিবঃ চলনা, একদিন তুমি আর আমি যাই, দুজনে কাশ বনে দৌড়ে বেড়াবো?”
বেলিঃ দেখি, সময় পেলে অবশ্যই যাবো ।
সাকিবঃ কেন, সময় হবে না?
বেলিঃ চাইলেই তো সব করা যায়, সব উদ্দেশ্যের নিয়ত ঠিক থাকে না ।
সাকিবঃ মানে?
বেলি হালকা হেসে বলল, “কিছু না । কি বলতে কি যে বলে ফেলি আজকাল । বাবা মারা যাবার পর থেকে এমন হয়ে গেছি ।”
সাকিবঃ আল্লাহ তোমার বাবাকে জান্নাত দান করুক দোয়া করি ।
বেলিঃ হুম, আর পৃথিবীর যতো শয়তান আছে তাদের শাস্তি দিক ।
সাকিবঃ এর মধ্যে শয়তান কোত্থেকে এলো?
বেলিঃ জীবনে কতো শয়তান আমার বাবাকে কষ্ট দিয়েছে, তাদের কথাই বলছি ।
সাকিবঃ হুম । তারাও শাস্তি পাবে । আমিও দোয়া করবো যেন তাঁরা শাস্তি পায় ।
বেলিঃ সারাজীবন এই দোয়া কোরো । সাকিবের দিকে তাকিয়ে বলল বেলি ।
সাকিবঃ তোমার জন্য সব করতে পারি ।
বেলিঃ তাই, ওই আকাশ থেকে এক টুকরো মেঘ এনে দাও তো ।
সাকিবঃ ওটা তো সম্ভব না, তবে বুকের বা পাশ থেকে এক টুকরো রিদয়্ দিতে পারি ।
বেলিঃ আচ্ছা, আমি যদি কখনো তোমায় ছেড়ে চলে যাই, তুমি কি খুব কষ্ট পাবে?
সাকিবঃ খুব । পাগল হয়ে যাবো আমি ।
আরিনাঃ ও । এতোটা ভালোবাসো তুমি আমায়!
সাকিবঃ হয়তো যতোটা তুমি ভাবছো, তার চেয়েও বেশি ।
এরপর সাকিব আর আলিয়া দুজন দুজনের দিকে চেয়ে রইল । অনেকক্ষণ ।
সোহান আরিনাকে বলল, “শুধু তাই না, আমরা কবিতাও এক লাইন বাড়িয়ে দিয়েছিলাম ।” আরিনা জিজ্ঞেস করলো, “কোন কবিতা?” সোহান বলতে লাগলো । একদিন দ্বিতীয় পিরিয়ড শেষে বেলি, সেলিনা আর জিম আসে এই ক্লাসে । তখন সাকিব আর ইকবাল বলে উঠলো, “ডাক ডাক বেলি, আমরা সবাই খেলি! ডাক ডাক সেলিনা, আমরা তো কেউ খেলি না!” সোহান বলল, “ভাই আমারডারে নিয়া কিছু বানা?” ইকবাল বলল, “জিমের সাথে ডিম মেলে ।” সাকিব বলল, “তাইলে বলবো ডাক ডাক জিম, আমরা ঘোড়ার ডিম” ইকবাল বলল, “একসাথে শুরু করি চল।” এরপর সোহান, সাকিব ইকবাল একসাথে বলে উঠলো, “ডাক ডাক বেলি, আমরা সবাই খেলি, ডাক ডাক সেলিনা, আমরা তো কেউ খেলি না, ডাক ডাক জিম, আমরা ঘোড়ার ডিম ।
সোহান এটুকু বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো । আরিনা জিজ্ঞেস করলো, “ওয়াও, সাকিব ভাইয়া আর বেলি আপু এখনও খুব সুখী আছে তাই না?” সোহান আরিনার দিকে তাকাল । তারপর বলল, “গল্পটা শেষ করতে দে ।” আরিনা বলল, “আচ্ছা । তোমরা এই তিনজন ছাড়া আর কেউ প্রেম করতো না? তুষার ভাইয়া, রাহাত ভাইয়া, অনিক ভাইয়া, আরিফ ভাইয়া, রাগিব ভাইয়া?” সোহান বলল, “না, ওরা ওদের প্রেম ছাড়া লাইফেই অনেক হ্যাপি ছিল । আমার মনে হয় আসলেই ওই লাইফটাই হ্যাপি । কারণ প্রেম করে আমরা তিনজন এখন যেরকম লাইফ লিড করছি, ওরা প্রেম না করেও তার চেয়েও অনেক হ্যাপি আছে এখন সংসার জীবনে ।” আরিনার চোখে মুখে একটা ভয়ের ছাড় দেখা দিলো । বলল, “তার মানে তোমার যেমন ডিভোর্স হয়ে গেছে উনাদেরও তেমন ডিভোর্স হয়ে গেছে!” সোহান আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমাকে শেষ করতে দে গল্পটা?” আরিনা আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না ।
অক্টোবর মাসের দিকের কথা । আন্ত হাউজ ফুটবল ম্যাচ হচ্ছে । আজ সেমি ফাইনাল, কাল ফাইনাল । ইকবাল সোহান আর অনিক এরা তিনজনই খেলায় অংশগ্রহন করেছে । হাউজ চারটা । ইগল, ফ্যালকন, মারলিন, রবিন । অনিক আর ইকবাল ইগল হাউজে, আর সোহান ফ্যালকন হাউজে । আগের দিনের ম্যাচে ফ্যালকন হাউজ ফাইনালে উঠে গেছে । আজ ইগল আর রবিনের ম্যাচ । যে টিম জিতবে, সেই ফাইনালে । মাঠের পাশে টানানো তাবুর নিচে সেলিনা চিল্লাচ্ছে, “ইকবাল! অনিক ভাইয়া! ইকবাল! অনিক ভাইয়া! ইগল! ইগল! ইগল! ইগল!” সেলিনাকে এরকম চেচাতে দেখে সেলিনাদের ক্লাসের অন্য একটা মেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে, তুই না রবিন হাউজে?” সেলিনা হাসি মুখে জবাব দিলো, “তুই জানিস না, স্বামীর পরিচয়েই স্ত্রীর পরিচয়?” মেয়েটা জিজ্ঞেস করলো, “মানে?” সেলিনা বলল, “তুই ওসব বুঝবি না, বাদ দে ।” বলে আবার সেলিনা চেচাতে লাগলো, “ইকবাল! অনিক ভাইয়া! ইকবাল! অনিক ভাইয়া!” মাঠের মাঝখানে সেলিনার উৎসাহ শুনে অনিক ইকবালকে বলল, “ইকবাল রে, নিজের গার্ল ফ্রেন্ড না হোক, ভাবির কাছ থেকে অন্তত উৎসাহ পাচ্ছি ।” ইকবাল বলল, “দেখতে হবে না, কার গার্ল ফ্রেন্ড ।” এদিকে সোহান আর জিম ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে । জীম জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কোন টিম জিতলে খুশি হবে ।” সোহান বলল, “জানি না । আসলে ইকবাল আর অনিক হারলে ওরা কস্ট পাবে, আবার ওরা জিতলে কাল ওদেরকে নিজের প্রতিপক্ষ ভেবে খেলতে হবে । তাই আল্লাহ যা ভাগ্যে রাখছে তাতেই আমি খুশি ।” জিম বলল, “আহা! কি ভালো ছেলে!” সোহান বলল, “আচ্ছা, এখানে আবার শুরু কোরো না ঝগড়া । ওদিকে দ্যাখো ।” বলে সোহান জিমকে সামনের দিকে ঈশারা করে দেখাল । আতিফ একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে । মেয়েটা আতিফকে বলল, “ভাইয়া আপনি না অনেক কিউট ।” আতিফ লজ্জায় হাসিমুখে বলল, “ওমা! এই তুমি নোয়াখালীর না, কোথায় যেন শুনেছি নোয়াখালীর মানুষ অনেক সত্য কথা বলে ।”
- “আপনি অনেক হ্যান্ড সাম!”
- “ইশ! এতো সত্য কথা তুমি কি করে বলো!”
- “কিন্তু ভাইয়া, আপনি একটা হিজরা ।”
- “উফ! তোমাকে সত্যবাদী অ্যাওয়ার্ড দেওয়া উচিৎ……………ওয়েট, কি বললে তুমি?”
সোহান আর জিম ওদের কাহিনী দেখে হেসে উঠলো । তারপর সোহান বলল, “চলো, ওদিকে যাই ।” এরপর সোহান আর জিম অন্য দিকে চলে গেলো ।
ওদিকে সাকিব আর বেলি একটা ফাঁকা ক্লাসরুমে বসে আছে । বেলি সাকিবকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি ফুটবল খেলো না কেন?” সাকিব জবাব দিলো, “পারি না তো । ক্রিকেট ভালো পাড়ি । তা আন্ত হাউজ ক্রিকেট তো হয়-ই না ।” বেলি বলল, “কাল তোমাকে একটা জিনিস দেবো ।” সাকিব জিজ্ঞেস করলো, “কি জিনিস?” বেলি বলল, “সারপ্রাইজ দেবো একটা । কিন্তু ফ্যালকন পার্কে । প্রথম পিরিওড শেষেই চলে আসবে ।” সাকিব বলল, “প্রথম পিরিওড শেষে! কিন্তু কালতো মাত্র তিনটা ক্লাস! ফাইনাল ম্যাচ আছে, তিনটা ক্লাস শেষেই না হয় আসি?” বেলি বলল, “না, তা হবে না, আমাকে তিনটা ক্লাস শেষেই চলে যেতে হবে ।” সাকিব বলল, “কাল প্রধান অতিথি আসবে, অনেক কড়াকড়ি থাকবে তো ।” বেলি বলল, “ঠিক আছে, তাহলে আমাকে ছেড়ে যেতে পারো ।” সাকিব ভয় পেয়ে বলল, “না বেলি, এরকম বোলো না । আচ্ছা আমি আসবো ।” বেলি বলল, “লাভ ইউ ।” সাকিবও বলল, “লাভ ইউ টু ।”
এদিকে ম্যাচে জয়ী হল মারলিন হাউজ । ইগল হাউজ ২গোল করেছে তাও ২টা গোলই অনিক করেছে, তা সত্ত্বেও ইগল হাউজের বাজে গোলকিপারের জন্য রবিন হাউজ করেছে ৪টা গোল ।
পরদিনের কথা । ১ম পিরিয়ড শেষ হয়েছে । সাকিব ইকবাল আর সোহানকে বলল, “দোস্ত, একটু ফ্যালকন পার্কে যেতে হবে, যাবি?” সোহান বলল, “দোস্ত আমার তো ম্যাচ আছে রে ।” সাকিব বলল, “আচ্ছা, ইকবাল যাবি?” ইকবাল বলল, “চল যাই, ম্যাচ তো আর নাই ।” বলে সাকিব আর ইকবাল তুষারের কাছে গেলো । সাকিব তুষারকে বলল, “তুষার, আমরা ফ্যালকন পার্কে যাচ্ছি ।” তুষার বলল, “সাকিব না! ওয়াহিদ স্যার কিন্তু বলেছেন আজ যেন ভুলেও কেউ ক্লাসরুম থেকে বের না হয়!” সাকিব বলল, “আমার যাওয়াই লাগবে রে ।” ইকবাল সাকিবকে বলল, “সাকিব, আজকে বাদ দে না!” এদিকে আতিফ সাকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, “হুহ! ঢং । যেয়ে দ্যাখো, আমি স্যারকে বলে দেবো ।” সাকিব রেগে গিয়ে আতিফকে মারার জন্য এগিয়ে আসতে আসতে বলল, “তোরে কিছু বলছি আমি! তুই এতো ভাব দেখাস ক্যান!” আতিফ ভয়ে উঠে বাইরে চলে গেলো । তুষার সাকিবকে বলল, “সাকিব, প্লিজ তুই কথা শোন!” ইকবাল বলল, “হ সাকিব, আজকে বাইরে যাইস না ।” তুষার আর ইকবালের কোন কথা না শুনে দৌড়ে বাইরে গেলো সাকিব । সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে দারোয়ান । সাকিবকে দেখে দারোয়ান বলল, “নিচে যাওয়া যাবে না, প্রধান অতিথি আসার জন্য লাল গালিচা বিছাইতেছে ।” সাকিব দারোয়ানের কথা না শুনে জোর করে নিচে চলে গেলো । পরিষ্কার লাল গালিচার সাকিবের জুতোর ছাপ পড়ে ময়লা হয়ে গেলো । এরপর দেয়াল টপকে সাকিব চলে গেলো বাইরে । দেয়াল থেকে লাফ দিতে গিয়ে সাকিব পড়ে পা মচকে গেলো । তবু সাকিব থামল না । খোঁড়াতে খোঁড়াতে সাকিব পৌঁছে গেলো ফ্যালকন পার্কে । পার্কের রেস্ট রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেলি । তবে বেলির ঠোঁটের কোণে হাসি নেই । বোধ হয় সাকিব একটু দেরি করেছে বলে রাগ করেছে । সাকিব হাসিমুখে সামনের দিকে এগোতে যাবে, এমন সময় সাকিবের মুখের হাসিও ধীরে ধীরে চলে গেলো । সাকিব আর সামনের দিকে এগোল না । রেস্ট রুম থেকে বেড়িয়ে এলো প্রবোধ স্যার আর ওয়াহিদ স্যার । বেলির দিকে তাকিয়ে সাকিব দেখল বেলি কাঁদছে । প্রবোধ স্যার বলল, “মেয়েদের সাথে জোর কইরা প্রেম করো, রাস্তায় রাস্তায় ডিস্টার্ব করো, না?” সাকিব অবাক হয়ে গেলো । বলল, “স্যার এসব মিথ্যা কথা!” ওয়াহিদ স্যার বললেন, “তোমার কাছ থেকে সত্য মিথ্যা জানার দরকার নেই! বেলিই আমাদের সবটা বলেছে!” সাকিব বেলির দিকে তাকাল । তারপর জিজ্ঞেস করলো, “বেলি! আমি তোমাকে ডিস্টার্ব করতাম! আমি তোমাকে ভালবাসতে জোর করেছি!” বেলি কিছু বলে না । শুধু কাঁদে । প্রবোধ স্যার বলল, “সাকিব, টয়লেটে অনেক খুজেছি, আজ পার্কেই পেয়ে গেছি । ম্যাচটা আজ শেষ হোক, তোমার বিচার প্রিন্সিপ্যাল স্যার এর রুমেই হবে ।” “কিরে, কোথায় ছিলি তুই?” আতিফকে ক্লাসে ঢুকতে দেখে বলল তুষার । আতিফ বলল, “আমি ওয়াশরুমে ছিলাম ।” তুষার বলল, “আজিব! সাকিব একটা পাগলামি করেছে বলে তুইও পাগলামি করবি ।” আতিফ বলল, “দ্যাখ! যার তার সাথে আমার তুলনা দিবি না ।” তুষার আরও কিছু বলতে যাবে, তার আগেই হঠাৎ সাকিব এসে মারতে লাগলো আতিফকে । ক্লাসের সবাই সাকিবের রাগ দেখে ভয় পেয়ে গেলো । তুষার সাকিবকে থামাতে গেলেও সাকিব কথা শুনলো । সাকিব আতিফকে একের পর একটা মারতেই লাগলো! আর আতিফ আর্তনাদ করতে লাগলো । আতিফের চোখ মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে । তবুও সাকিব থামছে না আরিফ রাহাত অনিক, রাগিব, তুষার, ইকবাল, সোহান, সবাই সাকিবকে থামানোর চেষ্টা করছে, ক্লাসের অন্যান্য সবাই সাকিবকে থামতে বলছে, কিন্তু সাকিব থামছে না । একটা সময় সাকিব থামলো । আতিফ আর নড়াচড়া করছে না । চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে । আর্তনাদও করছে না । এমন সময় সাকিব সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল সবাই ভয়ে বড় বড় চোখ করে কেউ সাকিবের দিকে কেউ সাকিবের পেছনের দিকে তাকিয়ে আছে । সাকিব পেছনে তাকিয়ে দেখল, প্রধান অতিথি, প্রিন্সিপ্যালসহ আরও অনেকে ক্লাস পরিদর্শন করতে এসে সাকিবের কাণ্ড দেখে ফেলেছে । ওয়াহিদ স্যার বলল, “সাকিব! আজ তোমাকে আমি এই স্কুল থেকে বরখাস্ত করে দেবো!”
ঘটনার এই মুহূর্তে সোহান আবার থেমে গেলো । আরিনা জিজ্ঞেস করলো, “সাকিব ভাইয়া আতিফকে মারছিল কেন?” সোহান বলল, “সাকিব ভাবছিল স্যারদের আতিফই বলেছে । আর বেলা ভয় পেয়ে স্যারদের মিথ্যে কথা বলেছে ।”
- “সাকিব ভাইয়া কি পড়ে বরখাস্ত হয়েছিলো?”
- “স্কুল ওকে পুরোপুরি বরখাস্ত করে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সাকিবের মা বাবার অনুরোধে জানানো হয় সাকিবকে এসএসসি পরীক্ষার দিতে দেয়া হবে, কিন্তু সাকিব আর কোনদিন স্কুলে আসতে পারবে না । এসএসসির জন্য যা যা দরকার হয় সাকিবের বাব নিয়ে যাবে স্কুল থেকে ।” আরিনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “সাকিব ভাইয়ার আতিফ ভাইয়াকে মারা উচিৎ হয় নি ।” সোহান বলল, “ঘটনার প্রায় শেষ দিকে চলে এসেছি । শেষটা শুনলে তুই আরও চমকে যাবি ।” আরিনা বলল, “ঠিক আছে বলো ।” সোহান বলল, “ওই ঘটনার পর ইকবালের সাথে সেলিনারও ঝগড়া হয়ে ব্রেকআপ হয়ে যায় । ইকবাল সেলিনাকে প্রশ্ন করেছিলো তোমার বান্ধবী এতো খারাপ কেন । আর সেলিনা বলেছিল আমার বান্ধবি নিয়ে কথা বলার তুই কে । আমি আর জিমও এ ব্যাপারে কথা বলেছিলাম, কিন্তু ওরা জিমের অতোটাও ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল না বলে জিমের সাথে আমার তেমন ঝগড়া হয় নি । আর তাছাড়া জিমের সাথে ছোটখাটো খুনসুটি আমার হয়ই । ওদিকে আমরা কিছুদিন পর খবর পাই আতিফ কোমায় চলে গেছে । এদিকে সাকিব প্রতিদিন কলেজের সামনে অপেক্ষা করতো বেলির দেখা পাওয়ার জন্য । ও মনে প্রাণে বিশ্বাস করে বেলি সেদিন ভয় পেয়ে এসব বলেছিল । কিন্তু কেন যেন সাকিবের সাথে বেলির দেখাই হতো না । কখন বেলি ক্লাসে ঢুকত, কখন বেড়িয়ে যেতো, সাকিব যেন টেরই পেত না । এদিকে বেলির জেএসসি শেষ হল, ক্লাস নাইনেও ভর্তি হল, আর আমাদের এসএসসিও এগিয়ে এলো । যেখানে সবাই এসএসসি পরীক্ষার পড়া নিয়ে ব্যাস্ত, সেখানে সাকিব বেলির সাথে কথা বলার অপেক্ষায় ব্যাস্ত । সেদিন ছিল আমাদের ক্লাস টেনের শেষ ক্লাস । আমি টিফিন পিরিয়ডে জিমের সাথে দেখা করার জন্য বেরোতে যাচ্ছিলাম । এমন সময় জিমই দেখি ক্লাসরুমের দিকে দৌড়ে আসছে । জিম আমার কাছে আসতেই আমি জিমকে জিজ্ঞেস করলাম ।
“কি হয়েছে? তুমি এভাবে দৌড়ে আসছো কেন?” জিম বলল, “সোহান, আজই এই স্কুলে বেলির শেষ ক্লাস । কাল বেলি পরিবার নিয়ে চলে যাবে ঢাকায় ।”
- “কি বলছ তুমি!” ভয় পেয়ে বলল সোহান ।
- “হ্যাঁ, সাকিব ভাইয়া প্রতিদিনই বেলির জন্য অপেক্ষা করতো, তাই খবরটা তোমাকে দিতে এলাম । তুমি যদি পারো সাকিব ভাইয়াকে খবরটা দিয়ে আসো ।”
সোহান আর অপেক্ষা করলো না । স্কুল গেইটের কাছে চলে গেলো । সাকিব সেই এক পুরনো জামা আর প্যান্ট পড়ে বসে আছে , ময়লা হয়ে গেছে । চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে । চেহারা অনেক কালো হয়ে গেছে । সোহান সাকিবের কাছে যেয়ে ডাকলো, “দোস্ত!” সাকিব পাগলের মতো করে বল উঠলো, “বেলি! এসছো! না, সোহান! বলনা! বেলি কোথায়! তোরা ওকে আমার কাছে আসতে বলিস নি কেন?” আসলে ইচ্ছে করেই ওরা কোনোদিন বেলির কাছে যায় নি । সেদিন বেলি মিথ্যে বলেছিল বলে ওরা বেলির ওপর রাগ করে আছে । সোহান সাকিবের কথার জবাব না দিয়ে জিমের কাছে যা শুনেছে তা বলল । সাকিব কথা শুনে এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সেখান থেকে দিলো এক দৌড় । দারোয়ান সাকিবের পথ আটকালে সাকিব দারোয়ানকে একটা ঘুশি মেরে গেলো । ক্লাস এইটে ক্লাস রুমে ঢুকতেই ক্লাসে সবাই থেমে গেলো । সেদিনও ফাস্ট বেঞ্চে বেলি । সাকিবকে দেখে বেলি অনেক চমকে গেলো । ক্লাসে জিম আর সেলিনাও ছিল । ইকবাল, সোহান, আরিফ, রাগিব, তুষার, রাহাত, অনিকও এসেছে সোহানের কাছে সবটা শুনে । সাকিব বেলির কাছে এসে বেলির গালে হাত রেখে বলল, “বেলি বলো! তুমি সেদিন ভয় পেয়ে স্যারকে মিথ্যে বলেছিলে! বলো! তুমি আমাকে এখনও ভালোবাসো! বলো! কি হল! বলো! বেলি, আমিও তোমার সাথে ঢাকা যাবো! আমরা সংসার করবো! তুমি মেঘ চেয়েছিলে না! আমি তোমাকে এনে দেবো! আমরা কাশফুলের মাঝে দৌড়ে বেড়াবো, যাবে না বলো বেলি! যাবে না! প্লিজ বেলি কিছু বলো! নয়তো আমি এখন পাগল হয়ে যাবো! বেলি! পাগল হয়ে যাবো! আমাকে আর শাস্তি দিয়ো না বেলি! আমি অনেক কষ্টে আছি! আমাকে আর কষ্ট দিয় না!” “আমিও তো এটাই চেয়েছিলাম সাকিব! তোমাকে কষ্ট দিতে!” বেলির মুখ থেকে কথাটা শুনে থমকে গেলো সাকিব । জিম আর সেলিনাও অবাক হয়ে গেলো । সেলিনা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, “তুই এসব কি বলছিস বেলি!” বেলি সেলিনার কথার জবাব না দিয়ে সাকিবকে বলল বলল, “মনে আছে সাকিব! আমি একদিন তোমাকে বলেছিলাম, আমি চাই আমার বাবাকে যেসব শয়তানরা কষ্ট দিয়েছে তাঁরা সবাই শাস্তি পাক, তুমিও দোয়া করেছিলে না, সেটা কবুল হয়েছে ।” জিম বলল, “কিরে, তুই এসব কি বলছিস!” বেলি জিমের কথার জবাব না দিয়ে সাকিবকে বলল, “সেদিন আতিফকে আমিই অন্য একটা মেয়ের মাধ্যমে বলেছিলাম পরদিন ও যেন টিচারকে সব বলে দেয় ।” সে সময় সেই মেয়েটা এলো যে আতিফকে বলেছিল সব কথা । সোহান আর জিম চিনল একে । ওরা আতিফকে এই মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখেছে কিন্তু পুরো কথা না শোনার আগেই ওরা সেখান থেকে চলে গিয়েছিলো, পুরো কথা মেয়েটাই শোনাল ।
এটা সেই ফুটবল ম্যাচের সেমি ফাইনালের দিনের ঘটনা ।
- “আপনি অনেক হ্যান্ড সাম!”
- “ইশ! এতো সত্য কথা তুমি কি করে বলো!”
- “কিন্তু ভাইয়া, আপনি একটা হিজরা ।”
- “উফ! তোমাকে সত্যবাদী অ্যাওয়ার্ড দেওয়া উচিৎ……………ওয়েট, কি বললে তুমি?”
সোহান আর জিম ওদের কাহিনী দেখে হেসে উঠলো । তারপর সোহান বলল, “চলো, ওদিকে যাই ।” এরপর সোহান আর জিম অন্য দিকে চলে গেলো । এদিকে মেয়েটা আতিফকে বলল,
- “ভাইয়া একটু মজা করলাম । আপনাকে একটা কাজ করতে হবে পারবেন?” বলল আতিফের সাথে থাকা মেয়েটা ।
- “হ্যাঁ বলো কি কাজ?” জিজ্ঞেস করলো আতিফ ।
- “কাল বেলি আর সাকিব ভাইয়া দ্বিতীয় পিরিয়ডে ফ্যালকন পার্কে যাবে । আপনি তখন কথাটা প্রবোধ স্যারকে বলে দেবেন ।”
- “ছি ছি, তা কেন বলবো । ওই দুটো টোনাটুনি কি সুন্দর ইটিশ পিটিশ করে, শুধু শুধু মাঝখানে আমি ভিলেন হবো কেন?”
- “না ভাইয়া, প্রবোধ স্যার যদি ওদের আপনার মাধ্যমে খুঁজে পায়, প্রবোধ স্যার আপনার অনেক প্রশংসা করবে, তখন আপনি হিরো হয়ে যাবেন ।”
- “কিন্তু তাই বলে ওদের কষ্ট দেবো ।”
- “ভাইয়া আমাকে বেলিই এসব কথা আপনাকে বলতে বলেছে ।”
- “অ্যাঁ! এসব কি বলছ!”
- “হ্যাঁ ভাইয়া, সত্যি বলছি । পারবেন?”
- “ইশ! মেয়েটা কি দুষ্টু! কি দুষ্টু । আচ্ছা, আমি যখন হিরো হবো, আর টুনিই যখন করতে বলেছে তখন আমি রাজি ।”
সাকিব বেলির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । রাগিব বলে উঠলো, “তুমি এটা কেন করেছিলে বেলি?” তুষার বলল, “ছেলেটা তোমার কি ক্ষতি করেছিলো?” আরিফ বলল, “তোমার মন মানসিকতা এতো খারাপ কেন বেলি?” রাহাত বলল, “মানুষের মন নিয়ে খেলার অধিকার কে দিয়েছে তোমাকে?” অনিক বলল, “তুমি নিজেও একদিন টের পারে তুমি কতো বড় ভুল করেছো!” ইকবাল বলল, “কোন দোষে তুমি সাকিবকে এভাবে শাস্তি দিলে বেলি?” বেলি তখন বলে উঠলো, “সাকিব আমার বাবাকে খুন করেছে!” ক্লাসের সবাই হতবাক হয়ে গেলো । সাকিব খুল করেছে বেলির বাবাকে! বেলি বলল, “আজ থেকে অনেক দিন আগের কথা । আমার বাবা একটা অ্যাকসিডেন্টে আহত হন । কিছুটা সুস্থ হলে বাবাকে বাসায় আনা হয়, কিন্তু ডাক্তার জানান স্যালাইন এখনও হাতের রগের মাধ্যমে শরীরে দিতে হবে । আমি বাবার একেকটা স্যালাইন বদলে দিতাম । সেদিনও আমি বদলাতে রুমে ঢুকেছিলাম । সে সময় কারেন্ট চলে গিয়েছিলো দেখে আমি জানালাটা খুলে দিলাম । আমি যখন বাবার হাতের রগে স্যালাইনের সুচ দিয়ে অন্য রুমে যাই । অন্য রুম থেকে আমার চোখ যায় বাইরের দিকে । তাকিয়ে দেখি, আমার বাবা যে রুমে শুয়ে আছে সে রুমের দিকে তাকিয়ে সাকিব, ইকবাল ভাইয়া আর সোহান ভাইয়া । একটু পর দেখি সাকিব ভাইয়া আমার বাবার রুমে একটা ঢিল ছোঁড়ে, আর তখনই আমি বাবার চিতকার শুনতে পাই । রুমে যেয়ে দেখি ঢিলটা স্যালাইনের সুচের ওখানে লেগে ডিসপ্লেসমেন্ট হয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে । হসপিটালে বাবাকে সেদিন নিয়ে যাওয়া হল, পরদিনই বাবা মারা যায়। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নেই সাকিবকে শাস্তি দিতে হবে । কিন্তু এমনি এমনি দিলে চলবে না, এমনভাবে দিতে হবে যেন সারাজীবন সাকিব কষ্ট পায় । তাই তো আমার করা এতদিনের ছ্যাঁচড়ামির অভিনয় । সাকিবের সাথে প্রেমের অভিনয় করে ছেঁকা দিয়ে কষ্ট দেয়া, আর আমি তাতে সফল হয়েছি!” সবাই অবাক হয়ে গেলো । এতক্ষণ ধরে যা শুনলো তার কিছুই যেন বিশ্বাস হতে চাচ্ছে না ওদের । সাকিব অপলক দৃষ্টিতে বেলির দিকে তাকিয়ে । চোখ দিয়ে খানিক পর জলও গড়িয়ে পড়লো ওর ।
পি পিপ । বাইরে গাড়ির হর্নের আওয়াজ শুনে থেমে গেলো সোহান । তারপর আরিনাকে বলল, “ওই, তোর কাকু চলে এসেছে, আমাকে যেতে হবে রে ।” আরিনা জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু বাবা, তারপর কি হয়েছিলো?” সোহান বলল, “তারপর আর বলার মতো তেমন কিছু নেই, পরদিন ওই বেলি ঢাকায় চলে যায়, সাকিবও আর স্কুলে আসে না, আমাদের এসএসসি হয়, সাকিব পরীক্ষার দেয় না । পড়ে জানতে পারি সাকিবকে পাগলাগারদে ভর্তি করা হয়েছে । বাকি কারো সাথে আর যোগাযোগ নেই, শুধু তোর মা-ই আমাকে বিয়ে করেছিলো, আমাদের তো ডিভোর্স ও হয়ে গেলো । একবার শুনেছিলাম ইকবাল নাকি আজও বিয়ে করেনি । কিন্তু আর কোন খোঁজ পাইনি ওর ব্যাপারে । আর বেলিরও কোন খোঁজ পাইনি ।” আরিনা আর কিছু বলল না । শুধু বলল, “ওওও ।” “আমি যাই তাহলে?” বলল সোহান। আরিনা মাথা ডানে কাত করলো । সোহান চলে গেলো বাইরে । আরিনা নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল । এখনও আরিনার মনের মধ্যে বাবার সেই ছ্যাঁচড়ামির গল্পটা ঘুরপাক খাচ্ছে । সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে সাকিবের জন্য । কে জানে, কেমন আছে ও । একবারটি ঘুম থেকে উঠে আরিনা বাবার রুমে গেলো । বাবার পুরনো অ্যালবাম ঘেটে একটা ছবি পেলো । পর্দা লুঙ্গির মতো করে পড়া ৮টা ছেলে আর ২টা মেয়ে । আরিনা বুঝতে পারলো মেয়ে দুইটা একজন ওর মা, অন্যজন সেলিনা । বাবার কাছে শোনা গল্প অনুযায়ী বেলির এ ছবিতে থাকার কথা না । আর ছেলেদের মধ্যে আরিনা কেবল নিজের বাবাকেই চিনতে পারলো, আর কাউকেই চিনতে পারলো না ।
পরদিন সকালের কথা ঘুম থেকে উঠে আরিনা দেখল একজন মহিলা । চোখ রগড়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখল ওর মা জিম । আরিনা উঠে মাকে জড়িয়ে ধরল । জিম জিজ্ঞেস করলো, “কিরে? কেমন আছিস?” আরিনা বলল, “ভালো আছি মা, তুমি কেমন আছো?” জিম আরিনার মাথায় আদর করে বলল, “ভালো আছি ।” আরিনা বলল, “জানো মা, বাবা গতকাল তার স্কুল লাইফের শেষ বছরের ছ্যাঁচড়ামির গল্প শুনিয়েছেন । জিম বলল, “হ্যাঁ, জানি । সেজন্যই আমি এসেছি । আর শুধু আমি না, আরও অনেকে এসেছে?” আরিনা অবাক হয়ে গেলো । বলল, “কারা এসেছে?” জিম পেছন ফিরে বলল, “কি ভাইয়ারা, ভেতরে আসবেন না?” সবাই ভেতরে ঢুকল । কাউকে আরিনা না চিনলেও গতকালকের ছবি অনুযায়ী আরিনা এটা বুঝল এটা ওর বাবার যশোর শাহীনের সব বন্ধু । শুধু দুজন কম । সাকিব, আর বেলি । আরেকটা মেয়েও এসেছে । আরিনা বুঝল, এটা সেলিনা । সোহান আরিনাকে বলল, “বলতো এরা কারা?” আরিনা খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল, “বাবা! তোমার সব বন্ধুরা!”
“গতকাল তোকে গল্প বলার পর মনে হল সবার সাথে তোর দেখা করালে তোর ভালো লাগবে, তাই প্রোজেক্ট শেষে তোর মায়ের সাহায্যে সবাইকে খুঁজে তোর সাথে দেখা করাতে আনলাম । যদিও বেলির কোন খোঁজ পাইনি, ওর খোঁজ রাখারও ইচ্ছে নেই ।” বলল সোহান ।
- “হাই আরিনা, আমি তুষার । তোমার বাবা যা ছ্যাঁচড়া ছিল না, ওকে ক্লাসে রাখাই ছিল আমার পক্ষে কষ্টকর ছিল ।” বলল তুষার ।
- “হাই আরিনা আমি রাগিব । নিশ্চয় শুনেছো, একবার পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম সেখান থেকে তোমার বাবার সাথে আমার বন্ধুত্ব ।” বলল রাগিব ।
- “হাই আরিনা আমি অনিক, তোমার বাবা কিন্তু বেশ ভালো ফুটবল খেলত । সেবারের ফাইনালে কিন্তু তোমার বাবা ৩টা গোল করেছিলো!” বলল অনিক । আরিনা বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, “বাবা! তুমি এটা তো বলো নি আমাকে!” সোহান বলল, “ভুলে গিয়েছিলাম রে ।”
- “হাই আরিনা, ধারণা করতো আমি কে, তোমার বাবার প্যান্ট কাঁটাতারে লাগিয়ে ছিঁড়ে দিয়েছিলাম ।”
আরিনা বলল, “ইকবাল ভাইয়া, তাইনা!” ইকবাল বলল, “যাক, চিনতে পেরেছো তাহলে ।”
জিম বলল, “ভাইয়া! তোর আঙ্কেল হয় ।” আরিনা বলল, “মা, আমি এমনভাবে গল্পের ভেতর ঢুকে গেছি, যে আমার এখন এনাদের ভাইয়া মনে হচ্ছে ।” সবাই আরিনার ভাইয়া ডাকটাই পছন্দ করলো এবং কেউ আপত্তি জানালো না ।
- “হাই আরিনা, তোমার কি কোন ইলেক্ট্রনিক জিনিস নষ্ট আছে? থাকলে দাও, আমি ঠিক করে দেই ।” আরিনা বলল, “আপনি ইঞ্জিনিয়ার রাহাত ভাইয়া, তাই না!” রাহাত বলল, “আরে বাহ! আমাকেও দেখছি চিনতে পেরেছো!” এরপর আরেকটা ছেলে বলল, “আমাকে মুরগী বলতো সবাই, বলতো আমি কে?” আরিনা বলল, “আরিফ ভাইয়া, তাইনা!” আরিফ বলল, “হ্যাঁ, আমিই আরিফ । তবে আমি ডিম পাড়ি না কিন্তু!” আরিনা হেসে উঠলো । অন্য মেয়েটা কিছু বলার আগেই আরিনা বলল, “তুমি সেলিনা আপু, না?” সেলিনা বলল, “হ্যাঁ আম্মুটা, আমি তোমার সেলিনা আপু । যাক, চিনতে পেরেছো, ভালোই লাগলো ।” সোহান তখন বলল, “আরিনা, রেডি হয়ে যা, আমরা সবাই এক জায়গায় যাবো ।” আরিনা জিজ্ঞেস করলো, “কোথায়?”
যশোর মানসিক হাসপাতাল । দুটো গাড়ি ঢুকল । একটা সোহানের গাড়ি, অন্যটা তুষারের । এতে করে সব বন্ধুরা এসেছে সাকিবের সাথে দেখা করতে । হাসপাতালের সামনে গাড়ি পার্ক করে ওরা ভেতরে ঢুকল । দুপাশে সারি সারি ছোট রুম, আর তার সামনে রড দিয়ে আটকে দেয়া । একটা দরজা আছে ভেতরে যাবার জন্য, বলতে গেলে একটা জেলখানার মতো । আরিনা যেতে যেতে দু পাশে তাকিয়ে সবাইকে দেখছে । কেউ মাথা চুল্কাচ্ছে অদ্ভুত ভাবে, কেউ আবার জিভ বের করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে, কেউ আবার ওদের দেখে এগিয়ে এসে বলছে, “মাল খাবি! মাল! আয়! আয়!” কিছুদুর যাবার পর একটা রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা । ভেতরে একটা খাটের ওপর কে যেন শুয়ে । গায়ে কাথা মুড়ি দেয়া । সোহান আরিনার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, “একবার জোরে বল, ডাক ডাক বেলি ।” আরিনা বলল, “ডাক ডাক বেলি ।” কিছু হল না । জিম বলল, “একটু জোরে বল ।” আরিনা জোরে বলল, “ডাক ডাক বেলি!” সাথে সাথে বিছানায় শুয়ে থাকা লোকটা গায়ের ওপর থেকে কাথা সরিয়ে বলতে লাগলো, “আমরা সবাই খেলি! ডাক ডাক বেলি!” তারপর গ্রিলের কাছে এগিয়ে আসতে লাগলো । গ্রিলের কাছে এসেই বলতে লাগলো, “বেলি কোথায়! তোমরা আমার বেলিকে দেখেছো! এই তুমি বেলি! না তো । এই! তুমি বেলি! আমার বেলি কোথায়! এই তোমরা আমার বেলিকে এনে দিতে পারবে! বলো না! এই!” কারো মুখে কোন কথা নেই । সবার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে । আরিনা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সাকিবের দিকে । চেহারা কালো হয়ে গেছে, ঠোঁটের পাশে খাবার লেগে আছে । গায়ে ময়লা একটা জামা আর পাজামা । সাকিব কোন জবাব না পেয়ে মাটিতে বসে পড়লো । তারপর পাশে থাকা খাবার ভরা খাবারের থালাটা ছুঁড়ে দিলো দূরে । আরিনা এই রুমটার চারিদিকে তাকাল । দেখল, দেয়ালে লেখা, “বেলি, আমি তোমাকে ভালোবাসি” কোথাও লেখা, “ডাক ডাক বেলি, আমরা সবাই খেলি!” কোথাও লেখা, “বেলি আমি তোমার বাবার খুনি নই!” আরও অনেক কিছু লেখা দেয়ালে । তুষার তখন বলল, “ডাক্তার বলেছে বেলিকে পেলে হয়তো সাকিব ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে যেতে পারে । কিন্তু বেলি হয়তো অন্য কাউকে বিয়ে করে আজ সুখী হয়ে আছে । কে জানে, কোথায় আছে, আদৌ দেশে আছে কি না ।” আরিনা আবার সাকিবের দিকে তাকাল । সাকিবের জলে ভরা চোখদুটো দেখে আরিনার মন খারাপ হয়ে গেলো । হয়তো এরকমই ওকে নিলয় ভালবাসতো ।
হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় আরিফ জিজ্ঞেস করলো, “কিরে ইকবাল, তুই কি বিয়ে করছিস নাকি?” ইকবালের কাছ থেকে কোন জবাব এলো না । অনিক আশপাশে তাকিয়ে ইকবালকে খুঁজে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে ইকবাল কই?” রাহাত বলল, “সেলিনাও তো নাই, কই গেলো ওরা?” একটু পর ওরা দেখল ইকবাল আর সেলিনা হাতে হাত রেখে ওদের দিকে আসছে । সবাই অবাক হয়ে ওদের দুজনের দিকে তাকাল । কাছে আসতেই ইকবাল বলল, “দোস্ত, আমি সেলিনারে বিয়া করমু ।” রাগিব জিজ্ঞেস করলো, “কি! তুই এখনও বিয়ে করিস নি!” ইকবাল কিছু বলার আগেই সেলিনা বলল, “শুধু ইকবাল না, আমিও বিয়ে করিনি, তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা । তাই না বাবি?” ইকবাল বলল, “আমার আর সালমান খানের একই লাইফ কাটল রে ভাই, এই বয়সে বিয়ে, যদিও সালমান খানের এখনও হয় নি । তবে হয়তো ভাগ্যের লিখন তাই ছিল, আমার আর কোন বিয়ে হবে না, শেষ মেশ স্কুল লাইফের গার্লফ্রেন্ডের সাথেই হবে ।” সবাই বেশ খুশি হল সেদিন । শুধু আরিনার ঠোঁটের কোণের হাসিটা অল্প সময় ধরে ছিল । কারণ সবাই আবার খুশি হলেও সাকিব এখনও খুশি হতে পারে নি । সেই থেকে আরিনা সপ্তাহে একবার করে বিভিন্ন মানসিক হাসপাতালে ঘুরে বেড়ায়, আর সে হাসপাতালে থাকা মানসিক রোগীদের জীবনের অজানা গল্প সংগ্রহ করে । কাজটা করতে ওর ভালোই লাগে । সোহান আর জিমেরও আবার মিল হয়ে যায় । ওরা আবার নতুন করে সংসার শুরু করে, ওদিকে ইকবাল আর সেলিনা দুই বাবিও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় ।
এক মাস পরের কথা । কোন এক মেঘলা দিনে আরিনা এসেছে একটা মানসিক হাসপাতালে । গাজীপুর মানসিক হাসপাতাল । সেই হাসপাতালের মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীদের জীবনের অজানা গল্প সংগ্রহ করতে । হাসপাতালে ঢুকল আরিনা । দুপাশের ছোট রুমগুলোতে মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীদের দেখছিল । একটা রুমে এক রোগীর সাথে দেখতে আসা কাউকে দেখে আরিনা ভাবল এর জীবনের গল্প নেয়া যাবে আত্মীয়ের কাছ থেকে । আরিনা সেজন্য ব্যাগ থেকে টেপরেকর্ডারটা বের করে সামনের দিকে এগোতে যাবে, এমন সময় একটা মেয়ে কণ্ঠের আওয়াজ কানে এলো আরিনার । “ডাক ডাক বেলি!” আরিনা থমকে গেলো । আরিনা আবার শুনলো, “ডাক ডাক বেলি!” আরিনা শব্দের উৎস অনুযায়ী যেতে লাগলো । আওয়াজ আসছেই, “ডাক ডাক বেলি! ডাক ডাক বেলি!” আরিনা একটা গলির কাছে এলো যে গলি থেকেই আওয়াজটা আসছিলো । কিন্তু গলির কাছেই আসতেই শব্দটা থেমে গেলো । আরিনা ডান পাশের রুমটা দেখল, তার সামনেরটা দেখল, তার পাশেরটা দেখল, আবার তার সামনেরটা দেখল, তার পাশেরটা দেখল, আবার তার সামনেরটা………………দেখতে গিয়েও গেলো না আরিনা, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল । দেয়ালে দেয়াল লেখা, “সাকিব! আমাকে ক্ষমা করে দাও! আমি তোমাকে ভালোবাসি সাকিব! সাকিব আমাকে মাফ করো! সাকিব! আমাকে তোমার জীবন সঙ্গী হিসেবে মেনে নাও!” আরো অনেক কিছু লেখা । আরিনা ভেতরে থাকা এক মহিলাকে দেখল । চুল উশখুশকো । জামা ময়লা । ঠিক সাকিবের মতোই অবস্থা । চেহারাটা এখনও আরিনা দেখতে পায় নি । কারণ মহিলাটা উল্টো ঘুরে বসে আছে । আরিনা ডাকলো মহিলাটাকে, “ডাক ডাক বেলি!” মহিলাটা মাথা উচু করলো । তারপর বলে উঠলো, “আমরা সবাই খেলি!” এরপর মহিলাটা আরিনার দিকে তাকাল । দৌড়ে এসে বলল, “এই, তুমি চেনো সাকিবকে! সাকিব কোথায় জানো! আমাকে সাকিবের কাছে নিয়ে যাবে! এই, বলোনা! এই! এই!” আরিনা হতবাক হয়ে গেলো । সে সময় ডাক্তার এলো সেখানে আরিনা জিজ্ঞের করলো, “এনার নাম কি বেলি?” ডাক্তার বলল, “হ্যাঁ । উনি বেলি । উনি হয়তো সাকিব নামে কাউকে খুঁজে বেরান , তাকে পেলে আবার উনি স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে পারেন ।” আরিনা আর সেখানে দাঁড়িয়ে রইল না । তাড়াতাড়ি এসে ঢাকার বাস ধরে ঢাকায় চলে এলো । বাসায় যেয়েই বাবাকে ডাকা শুরু করলো, “বাবা! বাবা!” সোহান আর জিম তাড়াতাড়ি করে আরিনার কাছে এলো । সোহান জিজ্ঞেস করলো, “কিরে মা! কি হয়েছে?” আরিনা বলল, “বাবা, সেদিন সাকিব ভাইয়াকে আরিনা আপু যে কথাগুলো শুনিয়েছিল, তারপর কি আরও কিছু হয়েছিলো?” সোহান বলল, “কি হতে যাবে?” আরিনা বলল, “বাবা, তুমি বলেছিলে বলার মতো তেমন কিছু নেই, কিন্তু কিছু একটা তো হয়েছে!” সোহান বলল, “হ্যাঁ, সাকিবও বেলিকে কিছু কথা শুনিয়েছিল, কিন্তু তা বললেও কি না বললেও কি, ওই মেয়ে তো বদমাইশ, ওর গায়ে লাগবে না ।” আরিনা জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছিলো বাবা?”
“হাহাহাহা” বেলির কথা শুনে হেসে উঠলো সাকিব । বেলি বলল, “সাকিব! তোমার লজ্জা নেই! তুমি তাও হাসছ!” সাকিব বলল, “হাসছি তোমায় দেখে । সেদিন হয়তো আমি সত্যি একটা ভুল করে ফেলেছি । কিন্তু আমি তো আর নিজের ইচ্ছেতে সবটা করিনি । কিন্তু আমি ইচ্ছে করে করিনি এটা জেনেও তুমি আমাকে এরকম একটা শাস্তি দিলে, শয়তানটা তাহলে এখানে কে হল বেলি! আমি না তুমি! একদিন তুমিও দেখো, তুমিও আমার জন্য আফসোস করবে । তুমিও চিন্তা করবে এ আমি কি করলাম! একদিন তুমিও সেই যন্ত্রণায় ভুগবে যেই যন্ত্রণায় আমি এতদিন ধরে ভুগে আসছি এবং এখনও ভুগছি । ভালোবাসার মানুষকে হারানোর কষ্ট ।” বলেই সাকিব ক্লাসরুম থেকে বেড়িয়ে যায় । আর বেলির চোখে তখনই জল দেখা যায় । হয়তো এতদিনের হৃদ্যতায় বেলিও সাকিবকে ভালোবেসে ফেলেছিল ।
ঘটনা বলার পর সোহান জিজ্ঞেস করলো, “হুম বললাম, এবার বল কি হয়েছে?” আরিনা বলল, “বাবা আমি বেলি আপুকে খুঁজে পেয়েছি । আমার মনে হয় সাকিব ভাইয়ার সাথে সে কদিনের ভালোবাসায় বেলি আপুও ভালোবেসে ফেলেছিল সাকিব ভাইয়াকে । যার জন্য আজ উনিও মানসিক রোগী!” সোহান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি বলছিস তুই!” আরিনা বলল, “হ্যাঁ বাবা! গাজীপুর মানসিক হাসপাতালে ।”
“ডাক ডাক বেলি!”
“ডাক ডাক বেলি ।”
“এই! তুমি বেলি!”
“হ্যাঁ! তুমি সাকিব!”
“হ্যাঁ! আমি তোমাকে ভালোবাসি!”
“আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি!”
সাকিব আর বেলি দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিল । দুজনে বসে ফ্যালকন পার্কে । আরিনার মুখে বেলির খোঁজ পাওয়ার পরই সোহান সব বন্ধুদের ডেকে সাকিব আর বেলিকে আবার একত্র করেছে পুরনো জায়গায়, ডাক্তার বলেছে এতে ওরা তাড়াতাড়ি সুস্থ উঠবে । সবাই আবার আগের মতো এক সাথে একই জায়গায় । আজ আরিনার ঠোঁটের কোণে হাসি যেন থামছেই না । কারণ সেদিন যার কমতি ছিল তা আজ পূরণ হয়ে গেলো । এমন সময় একটা ছেলে এলো ওদের কাছে । গায়ে একটা সাদা টি-শার্ট আর কালো প্যান্ট । চোখে কালো সানগ্লাস । সানগ্লাসটা খুলে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে ছ্যাঁচড়ার দল, কি অবস্থা?” ইকবাল জিজ্ঞেস করলো, “আপনাকে তো চিনতে পারলাম না?” ছেলেটা তখন মেয়েলি ভাবে বলল, “আ……আহ! নটি!” আরিনা বলল, “আতিফ ভাইয়া!” লোকটা বলল, “হ্যাঁ, আমি আতিফ । মনে পড়েছে ।” সবাই খুশি হয়ে অবাক দৃষ্টিতে আতিফের দিকে তাকাল সোহান তখন বলল, “তুই স্বাভাবিক হলি কি করে?” আতিফ বলল, “কোমায় যাবার পর চিকিৎসা করিয়ে ঠিক হয়েছিলাম, তখন একজন সাইকোলজিস্টের আন্ডারে ছিলাম । উনার সাহায্যেই ঠিক হয়েছি ।” আরিফ তখন বলল, “দোস্ত, চল, এবার মনে হয় সেলফি টাইম ।” বলে আরিফ মোবাইলটা হাতে নিলো । অন করতে গিয়ে দ্যাখে অন হচ্ছে না । রাহাত বলল, “আমারে দিস। । ঠিক কইরা দিবানে ।” অনিক বলল, “চল ফুটবল খেলি ।” রাগিব বলল, “ভাই এই বয়সে ফুটবল খেইলা হাত পা ভাঙবো নাকি!” ইকবাল বলল, “চলো বাবি, আমরা ইটিশ পিটিশ করি ।” সেলিনা বলল, তুষার বলল, “আরে, থাম না, আগে ছবিটা তোলা হোক, সবই হবে । কিরে আরিফ, ফোন অন হইছে?” আরিফ বলল, “না রে, কি যে হইল বুঝতেসি না ।” জিম বলল, “সোহান, তুমি তুলতে পারতেছো না?” সোহান পকেট থেকে মোবাইল বের করে সামনে এসে ছবি তোলার জন্য ফোন ওপরে তুলল । একটা তুলল । আরিনা বলল, “বাবা নিচে বসে একটা তোলো, সাকিব ভাইয়া আর বেলি আপু বসে আছেন তো ।” সোহান ডান পা সামনে দিয়ে বা পায়ের হাঁটু মাটিতে লাগিয়ে মোবাইল সামনে ধরল । তারপর শাটার বাটনে ক্লিক করতেই আওয়াজ এলো “ছ্যাঁত ।” অনিক বলল, “চল, পিক তোলা হইছে আমরা ফুটবল খেলি ।” সোহান বলল, “ভাই এটা পিক ওঠার আওয়াজ না, আমার প্যান্ট ছিড়া গেছে ।”