গোয়েন্দা আরিফ-২ - অদ্ভুত চুরি
অদ্ভুত
চুরি
লেখকঃ
সাদাত আলম প্রতীক
"রাজধানী ঢাকায়
বেড়েই চলেছে চোরের সংখ্যা ৷ কখনও ব্যাংকে চুরি, কখনো পকেট থেকে চুরি,
আবার
কখনও বাসা থেকে চুরি ৷ এ পর্যন্ত চোরকে ধরতে পারে নি কেউ ৷ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে
পুলিশ ৷" টিভিতে খবরটা দেখতে দেখতে সোফায় বসে চা খাচ্ছিলো আরিফ ৷ পেছন দিয়ে
যাবার সময় খবরটা চোখে পড়লো মিজানেরও ৷ "ছোটসাহেব, তোমাকে মনে হয় আবার কাজে নামতে হইবে ৷"
কথাটি বলেই মিজান চলে গেলো রান্নাঘরের দিকে ৷ ঠিক তার একটু পরেই কল আসে আরিফের
মোবাইলে ৷ ফোনটা ছিল ওর খুব কাছের বন্ধু সাকিবের ৷ "কীরে, কেমন আছিস?" ফোনটা কানে নিয়ে কথাটা বলল আরিফ ৷ ফোনের ওপাশ থেকে সাকিব
বলল, "আর ভালো থাকা ৷
বেশ সর্বনাশের মুখোমুখি হয়েছি ৷ এখন কী ভালো থাকা যায়?" আরিফ চায়ের কাপটা টেবিলে
রেখে বলল, "কেন? কী হয়েছে?" "খবরে দেখছিস না,
টাকা
চুরি হচ্ছে?" "ও হ্যাঁ, কেবলই দেখলাম ৷ তা তোরও কী সেই কেস?"
"তার চেয়েও সাংঘাতিক ৷ জীবনে প্রথম চাকরীর ৩ লাখ টাকা বেতন পেয়েছি ৷ তারপর এই
চুরি হবার কথা শুনে বেতনের টাকা আর বাবার পেনশনের টাকাগুলো কায়দা করে মাছ-মাংসের
প্যাকেটে ভরে ফ্রিজে রেখেছিলাম ৷ সেটাও চুরি হয়ে গেছে ৷ আমার নিজেরও যেন বিশ্বাস
হতে চাচ্ছে না ৷" আরিফ একটু অবাক হয়ে গেল ৷ সাকিব আবার বলল, "ফেসবুকে রাহাত বলল তুই
নাকি গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দিয়েছিস ৷ এর একটা সমাধান কর দোস্ত ৷" "আচ্ছা
কাল একবার সময় করে তোর সাথে দেখা করবো ৷ তুই এক কাজ কর, সকাল দশটায় আমার বাসায় চলে আসিস ৷"
"আচ্ছা ৷" বলেই ফোনটা রেখে দিলো সাকিব ৷ আরিফ ভাবতে থাকে কে হতে পারে এই
চোর ৷
পরদিন সকাল ১০টার দিকে আরিফের বাসায় আসে
সাকিব ৷ আরিফ সাকিবকে ভেতরে এনে বসতে বলে ৷ তারপর বলে, "কী খাবি বল ৷"
সাকিব বলল, "নারে ৷ কিছুই
খাবো না ৷ টেনশনে আমার কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না ৷" আরিফ একটু হেসে বলল, "আরে ভাই, আমি যখন আছি, টেনশন করার কিছু নাই ৷" তখন পেছন ফিরে তাকিয়ে
রান্নাঘরে থাকা মিজান কাকুকে বলল,
"মিজান কাকু, দুই কাপ কফি আনো
আর আমার ল্যাপটপ টা এনো ৷" তারপর সাকিব বলল, "টেনশন কি শুধু আমার
একার রে, টেনশন তো যাদের চুরি
হয়েছে তাদের সবারই হয়েছে ৷" আরিফ একটু নড়ে বসে বলল, "আমার কথা সেটা না ৷
অদ্ভূতভাবে এই তোর বাসার ফ্রিজের ভেতর মাছ-মাংসের প্যাকেটে যে টাকা গহনা আছে, চোর সেটা জানলো কি করে সেটাই আমার কথা ৷
আচ্ছা শুধু কি তোরই এরকম অদ্ভুদ চুরি হয়েছে নাকি অন্যান্য সবারও?" "না, সেরকম তো কিছু জানিনা ৷ তবে হ্যা, একজনের ঘটনা শুনেছিলাম ৷ উনারা টাকা পলিথিনে
ভরে ফ্ল্যাশ ট্যাংকের ভেতরে উপরের অংশে আটকে রেখেছিলেন ৷ প্রায় ১ লাখ হবে ৷ সেই
টাকাও চুরি করেছে ৷" এর মাঝে মিজান কাকু দু কাপ কফি আর আরিফের ল্যাপটপ দিয়ে
গেল ৷ আরিফ সাকিবের কথা শুনে ল্যাপটপ অন করতে করতে প্রচুর হাসলো ৷ সাকিব আরিফকে
হাসতে দেখে বলল, "তুই হাসছিস? আর যাদের টাকা চুরি হচ্ছে তাদের কি অবস্থা
বুঝতে পারছিস?" আরিফ নিজের হাসি
থামাতে থামাতে বলল, "আরে, সেজন্য হাসছি না ৷ হাসছি মানুষের বুদ্ধি
দেখে ৷ ফ্ল্যাশ ট্যাংকের ভেতর টাকা ৷ কিন্তু চোর তার চাইতেও ধূর্ত ৷" সাকিব
আর কিছু বলল না ৷ আরিফ ল্যাপটপটা অন করে কিছুক্ষণ দেখতে লাগলো ৷ ঠিক সেই সময় ওর
বাড়ির কলিংবেল বেজে উঠলো ৷ "একটু বোস,
আমি
দেখে আসি কে এলো ৷" সাকিবকে কথাটি বলে আরিফ চলে গেলো দরজা খুলতে ৷ দরজা খুলেই
দেখলো, পুলিশ অফিসার লিমন হাসান ৷ আরিফ জিজ্ঞেস করলো, "আপনি?" লিমন বলল, "দেখুন ক্ষমা করবেন না
বলে চলে আসায় ৷ আসলে আপনার কথা অনেক শুনেছি ৷ আপনি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে যোগ
দেবার অভিনয় করে যেভাবে আপনার বাবা মায়ের খুনিদের ধরিয়ে দিলেন, সেটা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য ৷"
"আর লজ্জা দেবেন না ৷ ভেতরে আসুন?"
অফিসার
লিমন তখন বলল, "না, আমি এখন বসবো না ৷ আমি আপনার কাছে কিছু
সাহায্য চাইতে এসেছি ৷" আরিফ বললো,
"জি বলুন, কি সাহায্য
৷" অফিসার লিমন বললেন,
"টাকা চুরির কেসটা আপনি শুনেছেন?"
"হ্যা শুনেছি তো," বলেই সাকিবের
দিকে ইশারা করে বলল, "ওই যে, আমার বন্ধুও এই ব্যাপারেই কথা বলতে এসেছে
৷" লিমন তখন বলল, "এই কেসটা সল্ভ
করতে আপনার সাহায্য আমার খুব প্রয়োজন৷" আরিফ বলল, “আগে ভেতরে এসে তো বসুন,
তারপর একসাথে কথা বলে ব্যাপারটা সমাধান করা যাক ।” অবশেষে অফিসার লিমন ভেতরে এসে
বসলেন । আরিফ মিজান আঙ্কেলকে আরও এক কাপ কফি আনতে বলল । আরিফ বলল, “আমি ল্যাপটপ-এ
দেখছিলাম “প্রাক্তন” নামের একটা হোটেলে প্রথম এই ঘটনা ঘটেছে ।” অফিসার লিমন তখন
বললেন, “আরে হ্যাঁ তো । উনিই তো সকালে পুলিশ স্টেশনে এসেছিলেন ।” সাকিব হঠাৎ
জিজ্ঞেস করলো, “কি নাম বললি?” আরিফ বলল, “প্রাক্তন ।” সাকিব হঠাৎ অবাক হয়ে বলল,
“প্রাক্তন? এক মিনিট । আমার বাসায় চুরি হওয়ার আগেই আমি প্রাক্তনের খাবার অর্ডার করেছিলাম
।” পুলিশ অফিসার বলল, “বাহ, তাহলে তো কাজটা আরও সহজ হয়ে গেলো । ওরা কেউ যদি
চোরটাকে দেখে থাকে, তাহলে......” আরিফ একটু হেসে বলল, “কিছু মনে করবেন না । আপনি
একজন পুলিশ অফিসার হয়েও যদি এরকম কথা বলেন, তাহলে......না থাক । আর কিছু বললাম না
।” অফিসার লিমন বলল, “সে জন্যই আপনার কাছে আসা । আর তাছাড়া আদিত যেভাবে আপনাকে
ঠকিয়েছে, তাতে আশা করি অন্যান্য পুলিশ অফিসারদের ওপর আপনার বিশ্বাস অনেকটাই কমে
গেছে । তবুও, আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন ।” আরিফ বলল, “শুনে ভালো লাগলো । আচ্ছা
সাকিব, তোর বাড়িতে কি কি ঘটনা ঘটেছিলো চুরি হবার আগে?” সাকিব একটু ভেবে বলল, “না,
তেমন কিছুই তো ঘটে নি, অন্যান্য দিনের মতোই স্বাভাবিক ছিলো ।” আরিফ কিছু বলল না ।
শুধু মাথা নাড়লো ।
সেদিন রাতে নিজের ঘরে পায়চারী করতে করতে
ভাবছিল কি এমন হতে পারে এই চুরির কারণ, আর কেই-ই বা করতে পারে এই চুরি । এমন সময়
সাকিবের ফোনটা বেজে উঠলো । ফোনটা ছিল অফিসার লিমনের । ফোন ধরে বলল, “জী অফিসার,
বলুন ।” ফোনের ওপাশ থেকে অফিসার লিমন বলল, “হ্যাঁ আরিফ সাহেব, আপনার সাথে
“প্রাক্তন” রেস্টুরেন্ট এর মালিক দেখা করতে চান ।” “কোথায় যেতে হবে আমাকে?” “আপনি
আমার পুলিশ স্টেশনে চলে আসুন । এখানেই উনি এসেছেন ।” আরিফ “ঠিক আছে” বলেই গাড়ি
নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো পুলিশ স্টেশনের দিকে । সেখানে পৌঁছে প্রাক্তন কোম্পানির সেই মালিককে বাইরে থেকেই দেখলো আরিফ । হঠাৎ
আরিফ খেয়াল করলো, একটা গাড়ি ওর পাশ কেটে চলে গেলো । গাড়িতে বসে ছিল এক মহিলা ।
কায়দা করে মহিলাটার চেহারা দেখল আরিফ । এতক্ষন ফলো করছিলো আরিফকে ঐ গাড়িটা ।
স্টেশনে ঢুকতেই উঠে দাঁড়ালো অফিসার লিমন । “আসুন আসুন । বসুন ।” বলে অভ্যর্থনা
জানালো আরিফকে অফিসার লিমন । প্রাক্তন রেস্টুরেন্ট এর মালিকের পাশে রাখা একটা
চেয়ারে বসলো আরিফ । প্রাক্তন রেস্টুরেন্ট এর মালিক তখন বলল, “আপনিই সেই আরিফ?”
আরিফ বলল, “হ্যাঁ । আমিই আরিফ ।” প্রাক্তন রেস্টুরেন্ট এর মালিক তখন বলল, “আমি মি.
জারিফ । প্রাক্তন রেস্টুরেন্ট এর মালিক । আসলে আমার রেস্টুরেন্ট থেকে কয়েক লক্ষ
টাকা চুরি হয়ে গেছে । আমি খুব লোকসানের মুখে পড়েছি । আমাকে প্লিজ এখন বাচান । শুধু
আমিই না, ঐ চোর ব্যাটাকে ধরলে সবারই অনেক উপকার হবে ।” আরিফ বলল, “দেখুন আমি এ
বিষয়টা নিয়ে Already ভাবছি । আপনি টেনশন করবেন না ।” অফিসার লিমন বললেন,
“দেখুন আরিফ সাহেব, টেনশন হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না । আমরা সবাই এখন আপনার
সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি । আপনার যতো সাহায্যের দরকার, আমাকে বলবেন । আমি আপনাকে
সব ধরনের সাহায্য করবো ।” আরিফ কিছু বলল না । কিছুক্ষণ পর মি. জারিফ বলল, “দেখুন আরিফ সাহেব, সবার ফ্রিজ
থেকে, ফ্লাস ট্যাংক থেকে যেভাবে টাকা চুরি হচ্ছে, মনে হয় চোর কোন জ্যোতিষী । সব
আগে থেকেই জানতে পারে ।” আরিফ বলল, “হতেও পারে । কিন্তু সে জ্যোতিষী হোক, আর যাই
হোক, ধরা সে পড়বেই ।” হঠাৎ জারিফের ফোনে একটা কল এলো । কল ধরে বলল, “হ্যালো!......হ্যাঁ......আচ্ছা......আচ্ছা আমি
আসছি......আচ্ছা ঠিক আছে ।” বলে ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে বলল, “আমি একটু উঠি ।
রেস্টুরেন্টে যেতে হবে ।” বলে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন মি. জারিফ ।
গাড়ি নিয়ে পুলিশ ষ্টেশন থেকে চলে যাবার পরেই আরিফ জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, অফিসার,
সাকিবের বাসায় যে চুরি হয়েছে, সেটা কি আপনি কাউকে বলেছেন?” “না তো । কেন?” আরিফ
বলল, “না এমনি । আমিও তাহলে এখন উঠি ।” বলেই আরিফও বেড়িয়ে এলো পুলিশ ষ্টেশন থেকে ।
গাড়ি স্টার্ট করতে গিয়ে খেয়াল করলো, গাড়ি অন হচ্ছে না । সামনে যেয়ে গাড়ির হুড খুলে
দেখতে লাগলো । ইঞ্জিনে খুব ময়লা জমেছে । সেটা পরিস্কার করতে লাগলো এমন সময় দূর
থেকে কার যেন গলা শুনতে পেলো । মহিলা কণ্ঠে কেউ বলছে, “হ্যাঁ আমি অফিসার লিমনের
কথা মতো আরিফের ছবি তুলেছি । আরে না না, উনিই তো কায়দা করে আজ আরিফ লোকটাকে এনেছেন
। আরে না, দেরি হল ঐ জারিফ লোকটার জন্য । উনির আসার জন্যই তো ছবি তুলতে ঝামেলা
হচ্ছিলো । হ্যাঁ । আরে জানিস না? অফিসার লিমন তো অফিসার আদিত আর তার ভাই রাফির
কাজিন । হ্যাঁ । এই আরিফের জন্যই তো উনারা জেলে । তাইই তো অফিসার লিমন এর প্রতিশোধ
নিচ্ছেন । এই রাখি রে, কখন কে শুনে ফেলবে, তার ঠিক নেই । কাল কথা হবে । আর হ্যাঁ,
এই আরিফের ছবিটা এমন ভাবে এডিট করে একটা সিসিটিভি ফুটেজের মতো বানিয়ে দিয়ো, যেন
দেখলে মনে হয় আরিফই সেই চোর । আচ্ছা, রাখছি ।” আরিফ পুরো অবাক হয়ে গেলো । কি যে
হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারলো না ।
যাই হোক, কোনোরকমে গাড়িটা ঠিক করে সেখান
থেকে চলে এলো আরিফ । রাত ১২ পর্যন্ত আরিফ মেসেঞ্জারে । কার সাথে অনেকক্ষণ ধরে
চ্যাট করছে । আরিফ এখনও ঘুমায়নি দেখে ওর রুমে চলে এলো মিজান । এসে বলল, “কি
ব্যাপার আরিফ? এহনও তুমি ঘুমাও নাই?” আরিফ শুধু বলল, “খুশি হয়েছি ।” মিজান অবাক
হয়ে প্রশ্ন করলো, “ ক্যান? আমি আবার কোন মহান কামডা কইরলাম?” আরিফ বলল, “তুমি আমার
নাম ধরে ডেকেছ, আবার আমাকে তুমি বলে ডেকেছ । এজন্যই আমি খুব খুশি ।” মিজান আবেগে
মুচকি মুচকি হেসে বলল, “ও তাই কও । থাঙ্কু থাঙ্কু । আইজকা সকালে একটু আমাগো তালতলা
বস্তিতে গেসিলাম ।” আরিফ জিজ্ঞেস করলো, “ও তাই, আনটি কেমন আছে?” “হ, হ্যায় তো
আমারে ছাড়া ভালোই থাকে । আমি গেলেই যে ঝগড়া শুরু হইয়া যাইবো ।” আরিফ একটু হাসল ।
তারপর জিজ্ঞেস করলো, “আর তোমার মেয়েটা কেমন আছে?” “হ । সেও ভালো আসে । কেলাশ থিরি
তে পড়ে । তোমারে খুব দেখতে চায় ।” “একদিন আইনেন বাসায় । আমরা সবাই না হয় একসাথে
খাব ।” “তা আনমুনে । আর জানো তো, ঐ বস্তিতে কিছু মহিলা এই শহরের বাসা বাড়ি গুলাতে
ঘর মোছা, কাপড় কাচা, ইত্যাদি কাজ করে । ওদের কাছ থেইকা শুনি । লোকজন নাকি টাকা
চুরি হওয়ার ভয়ে কমোডের কি একখান ট্যাংক আছে, তাতে ঢুকাইয়া রাখে, ফিরিজের মধ্যে
ঢুকাইয়া রাখে, মশলার বক্সের মধ্যে ঢুকাইয়া রাখে ।” আরিফ বলল, “ও আচ্ছা ।” হঠাৎ
আবার পড়িমরি হয়ে বিছানা থেকে উঠে বলল, “কি বললে?” মিজান আরেকবার বলল কথাটা । আরিফ
তখন প্রচণ্ড খুশি হয়ে বলল, “মিজান আঙ্কেল, তুমি নিজেও জানো না তুমি আমার কত বড়
উপকার করলে । আমি বেরোচ্ছি ।” বলেই মিজানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেড়িয়ে গেলো
আরিফ । গাড়ি বের করে ফাঁকা রাস্তা গাড়ি চালাতে চালাতে সাকিবকে একটা ফোন করলো । কিছুক্ষণ কথা বলে
চলে গেলো নিজের গন্তব্যে ।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মিজান আরিফের ঘরে যেয়ে দেখলো, আরিফ ঘুমাচ্ছে
। যে আরিফ এই সময় উঠে চা খায়, সে এখনও ঘুমাচ্ছে । মিজান আঙ্কেল ডাক
দিয়ে বললেন, “কি রে আরিফ, তোমার কি আইজকা ঘুম থেইকা উঠার
কোন ইচ্ছা নাই?” ঘুম ঘুম কণ্ঠে আরিফ বলল, “মিজান কাকু, তুমি যাও । আজকে আমি দেরিতে উঠবো ।” মিজান আর
কিছু বলল না । আরিফের ঘুম ভাঙলো ১২টার দিকে । ঘুম থেকে উঠেই রেডি । কোথাও যাবে । তাড়াতাড়ি করে শার্টের
হাতা গোটাতে গোটাতে ব্রেকফাস্ট করার জন্য টেবিলে এসে বসলো আরিফ । মিজান খাবার নিয়ে
এসে বলল, “কি ব্যাপার আরিফ? আবার যাইতেসো কই? গতকাইল সারা রাতই তো বাড়ি ছিলা না ।” আরিফ একটু
মুচকি হেসে বলল, “আচ্ছা মিজান কাকু, চোর
যখন ধরা না দেয় তখন কি করতে হয়?” মিজান একটু চিন্তা করে বলল,
“কি জানি বাবা । কি করতে হয়?” আরিফ বলল, “চোরকে ধরে আনতে হয় ।” আরিফের হাতে ছিল একটা মেমোরি কার্ড । সেই মেমোরি কার্ড
ডাইনিং টেবিলে রেখে খেতে বসলো আরিফ । খাওয়া দাওয়া করে তারাহুরা করে বেরোতে গিয়ে ভুলে মেমোরি কার্ডটা টেবিলের ওপরেই রেখে এলো আরিফ । এদিকে মিজান নিজের মোবাইলে গান শুনতে শুনতে টেবিলের
কাছে এলো । আরিফের খেয়ে দেয়ে রেখে যাওয়া প্লেটগুলো নিতে যেতে হাত থেকে পড়ে
যায় মোবাইল । মোবাইল খুলে ব্যাটারি, মেমোরি কার্ড সব খুলে যায় । মিজান প্রথমে প্লেটটা
রেখে মেমোরি কার্ডটা তুলে টেবিলে রাখতে গিয়ে পড়ে যায় আবার কিন্তু তা খেয়াল করে না । মোবাইল তুলে ব্যাটারি
লাগিয়ে টেবিলের ওপর আরিফের রাখা মেমোরি কার্ডটা মোবাইলে লাগিয়ে প্লেটগুলো নিয়ে চলে গেলো রান্নাঘরে । আরিফ গাড়ি বের করতে
গিয়ে মনে পড়লো, ওর মেমোরি কার্ডটা আনতে ভুলে গেছে । আবার বাসায় ঢুকে
ডাইনিং রুমে এলো আরিফ । টেবিলে কোথাও মেমোরি কার্ড খুজে না পেয়ে টেবিলের আশেপাশে খুজতে
খুজতে মেঝেতে পেয়ে গেলো কার্ডটা তারপর বেড়িয়ে এসে রওনা হল নিজ গন্তব্য, পুলিশ ষ্টেশনের
দিকে । সেখানে
আগে থেকেই উপস্থিত ছিল সাকিব, অফিসার লিমন, আর অফিসার লতিফ । এই পুলিশ স্টেশনে মুলত
অফিসার লতিফই কাজ করেন । আর অফিসার লতিফ অফিসার লিমনের চেয়েও সিনিয়র । হঠাৎ সাকিব বলল,
“আচ্ছা, প্রতীক আর কতদুর?” লতিফ বললেন, “প্রায় এসে গেছেন মনে হয় । আর একটু অপেক্ষা
করুন ।” অফিসার লিমন বলল, “স্যার, উনি আসলে কি করবেন?” অফিসার লতিফ বললেন, “সেটা আমিও জানি না । আরিফ আমাকে কিছু দেখাতে চান এবং
চান আমাদের সবাইকে একসাথে সেটা দেখাতে । তাই সবাইকে ডেকেছেন । কিন্তু গতকাল রাতে উনি
কেন যেন আপনার পরিচয় জানতে চাচ্ছিলেন । আপনার কোন ভাই আছে কি না, আপনার জন্ম সাল কত
ইত্যাদি ।” অফিসার লিমন বললেন, “আমার পরিচয়?” অফিসার লতিফ উপর নিচ মাথা নাড়লেন । অফিসার
লিমন হালকা অবাক হয়ে বললেন, “কিন্তু কেন?” “সেটা বলতেই তো আপনাদের ডেকেছি ।”-বলেই সবার
সামনে হাজির হল আরিফ । অফিসার লতিফ বললেন, “এইতো,
এসে গেছে আরিফ ।” অফিসার লিমন বলল, “আপনি…আমার পরিচয় কেন জানতে চেয়েছেন? মানে,
কিছু মনে করবেন না । এমনিই জানতে চাইলাম । আপনি কি আমাকেও……” লিমনের কথা শেষ করতে না
দিয়েই আরিফ একটু হেসে বলল, “কেন অফিসার লিমন, আপনিই তো সেদিন বলেছিলেন, আমার মা বাবার খুনের ব্যাপারে অন্য এক অফিসার যখন প্রতারনা করেছিলো, তখন আপনার ওপর আমার ভরসা হারাতেই পার ।” অফিসার লিমন হালকা রাগ করে বললেন, “দেখুন আরিফ, সেটা তো আমি একটা কথার কথার বলেছি । কিন্তু তাই বলে আপনি শুধু শুধু আমার ওপর সন্দেহ করবেন, সেটা তো হয় না ।” আরিফ অফিসার লিমনের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, “আইনের লোক হয়ে এটাও জানেন না, আইনের চোখে সবাই অপরাধী?” অফিসার লিমন আর কিছু বললেন
না । আরিফ তখন বলল, “যাই হোক, ভুল কিছু বললে ক্ষমা করে দেবেন । আসল কথায় আসি ।” বলেই
পাশের রুমে যেয়ে দুজনকে নিয়ে হাজির করলো অফিসার
লতিফ, অফিসার লিমন আর সাকিবের সামনে । একজন “প্রাক্তন” কোম্পানির মালিক, অন্যজন সাকিবের
বাসার কাজের লোক । রাতে খুব মারা হয়েছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে । হাত পা বাধা ছিল, দাগগুলো
দেখেই বোঝা যাচ্ছে । সাকিব অবাক হয়ে বলল, “এ কি, তুই উনাকে কেন এনেছিস? উনি তো একজন
ভালো মানুষ ।” আরিফ বলল, “সেটাই । আমরা অনেকেই মানুষ চিনতে পারি না । এটা আমাদের অনেক
বড় একটা ভুল । আর তাই, কে ভালো আর কে খারাপ সেটা আমাদের জানাটা খুব দরকার ।” অফিসার
লতিফ তখন মাথার ক্যাপ নামাতে নামাতে বললেন, “আচ্ছা আরিফ সাহেব, আমি কিছুই বুঝতে পারছি
না । যদি পুরো ব্যাপারটা একটু খুলে বলতেন ।” আরিফ বলল, “সেটা বলার জন্যই আপনাদের এখানে
ডাকা । এবার শুনুন তাহলে । এই যে প্রাক্তন কোম্পানির মালিককে দেখছেন, এ ছিল একটা ছিঁচকে
চোর । আর সাকিবের বাসার কাজের লোকটা এর বউ । এর আগে যিনি প্রাক্তন কোম্পানির মালিক
ছিলেন, তখন উনি একটা বিরাট ক্ষতির মুখোমুখি হয় । যার জন্য উনার প্রচুর টাকার প্রয়োজন
হয় । সেই টাকা যোগাতে আনলেন এই চোরকে, যে টাকা চুরির কার শুরু করলেন । কিন্তু এই চোরই
পড়ে ষড়যন্ত্র করে সেই লোককে মেরে কোম্পানি নিজের নামে করে ফেলেন । কিন্তু এ তো আধা
শিক্ষিত । সেই শিক্ষা দিয়ে তো আর এতো বড় খাবারের কোম্পানি চালানো এতো সোজা না । এরও
ক্ষতি হতে শুরু করলো । তারপর থেকে সে আবার চুরি করার ফন্দি আঁটল । কিন্তু এবার সে আর
চুরি করতে পারে না । কারণ সব লোক তাদের জিনিসপত্র বিভিন্ন অদ্ভুত জায়গায় লুকোনো শুরু
করলো । এবার সে নিজেও একটা ফন্দি এটে এই মহিলাকে বিয়ে করে, যে সাকিবের বাসায় কাজ করতো
। এই মহিলা যেই বস্তিতে থাকতো, সেই বস্তির অন্যান্য মহিলা এই এলাকার বিভিন্ন লোকের
বাসায় কাজ করতো । আর তাদের কাছ থেকেই খোঁজ পেতো কে কোথায় কি লুকিয়ে রেখেছে ।” অফিসার
লতিফ বললেন, “ও মাই গড! আপনি এতো কিছু জানলেন কি করে?” আরিফ বলল, “গতকাল আপনার স্টেশনের
৩জন পুলিশের সাহায্যে আমি ওদের ধরেছি । আর রাতে উত্তম মধ্যম দিয়ে সব স্বীকার করিয়েছি ।” অফিসার লতিফ বললেন, “কিন্তু
আপনার কাছে প্রমান আছে?” আরিফ মুচকি হেসে প্যান্টের পকেটে হাত রাখতেই হাসিটা হারিয়ে
গেলো । বলে উঠলো, “কি ব্যাপার? মেমোরি কার্ডটা কোথায়?” হঠাৎ পাশে থাকা সাকিবের বাসার
সেই কাজের লোক হাত বাড়িয়ে বলল, “আমার কাছে ।” হাতে সত্যিই সেই মেমোরি কার্ড । আরিফ
মেমোরি কার্ডটা নেবার আগেই মহিলাটা সেই মেমোরি
কার্ড ভেঙে ফেলল । আরিফ এবার কি করবে ভেবে পেলো না । সেই মহিলা আর প্রাক্তন কোম্পানির
মালিক শয়তানের মতো করে হাসতে লাগলো । অফিসার লতিফ বলল, “কি হয়েছে? ঐ মেমোরি কার্ডে
কি ছিল?” আরিফ বলল, “গতকাল ওদের কথা আমি ভিডিও করেছিলাম । সেটাই ছিল এই মেমোরি কার্ডে
।” ঠিক সেই সময় আরিফের মোবাইলে একটা কল এলো । মিজান কাকু কল করেছে । ফোন ধরতেই ফোনের
অপাশ থেকে মিজান কাকু বললেন, “আরিফ, এ আমার মেমোরি কার্ড তুমার মেমোরি কার্ডের সাথে
কিভাবে জানি অদল বদল হইয়া গেছে । আমার মেমোরি কার্ডে কি সুন্দর সুন্দর গান আছিল । আর
তোমার এই কার্ডটায় কি কারে জানি মারতেসে সেই ভিডিও । আরিফের আর বুঝতে বাকি রইল না,
মহিলাটা যে মেমোরি কার্ডটা ভেঙেছে, সেটা মিজানের । এরপর অফিসার লতিফ ওদের এরেস্ট করলো,
আর আরিফ প্রমানগুলো পরে দেবে বলে গাড়ির কাছে
যেতে লাগলো । আরিফ গাড়িতে উঠতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ লিমন এলো । লিমন আরিফকে জিজ্ঞেস
করলো, “আপনি কিন্তু এখনও বললেন না কেন আপনি আমার পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন । আরিফ জানালো,
আগের দিন রাতে এই মহিলা আরিফের আগের কেসের সাথে মিল করে অফিসার লিমনকে ফাঁসাতে চেয়েছিলো
।
(সমাপ্ত)