গোয়েন্দা আরিফ-৩ - ফেসবুক প্রতারণা
ফেসবুক প্রতারণা
লেখকঃ সাদাত আলম প্রতীক
দক্ষিণা হাওয়ায় জানালার পর্দাটা দুলছে । আকাশে
মেঘলা ভাব এখনও কাটে নি । এরকম
সময়ে বাইরে যেতে ইচ্ছে করলেও পথের কাদাগুলো পথের কাটা হয়ে থাকায় আর যাওয়া হয়না ।
যতই সাবধানে হাঁটি না কেন,
জুতার মাধ্যমে কাদা ছিটে জামায় লাগবেই । আর ফ্লোর
টাচ ড্রেস!! থাক ।
এর কথা আর না বলাই
ভালো । বাইরের আকাশটা আরও কালো
হয়ে গেলো । এ যেন
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কালাভুনার চেয়েও কালো । তারপর আবার বৃষ্টি
। ঝমঝমিয়ে । কেবলি ভেবেছিলো বান্ধবীর বাসায় যাবে এখন
সেটাও হয়ে উঠলো না । তবে
হ্যাঁ, বাইরে যেতে না
পারলেও এরকম সময়ে মোবাইলে গান শোনার মজাই আলাদা । তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে
টেবিল থেকে ফোনটা নিলো সামিরা । ফোনটা ওপেন করে
দেখলো, কেউ মেসেঞ্জারে
ম্যাসেজ পাঠিয়েছে । শেষবার নেট চালানোর
পর নেটটা অফ করতে খেয়াল
ছিল না ওর ।
মেসেঞ্জারে ঢুকতেই ওর চোখ যেন
কপালে উঠলো । হাত থেকে
ফোনটা পড়ে গেলো । ওর হাত
থর থর করে কাঁপতে
লাগলো । “না।”
বলে জোরে একটা চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো । কিন্তু ওর চিৎকার
আর কান্নাকাটির আওয়াজ বৃষ্টির একটা বজ্রপাতের আওয়াজের সাথে মিশে যাওয়ায় হয়তো ঘরের বাইরে আর কেউ শুনতে
পেলো না ।
সেদিন রাতের কথা ।
ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছে আরিফ আর মিজান । খেতে
খেতে আরিফ জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা মিজান আঙ্কেল, তুমি
রান্না শিখেছ কার কাছে?” মিজান নিজের হাতের আঙ্গুল চাঁটতে চাঁটতে বলল,
“ছোট বেলায় আমার মায় আমারে শিখাইসিলো । হেয় জানো
তো, মেলা মজার
খাবার বানাইতে পারতো ।” “আপনার খাবারও তো অনেক
সুন্দর হয় ।
Just amazing.” “আইচ্ছা, সারাজীবন তো আমি বাইচা
থাকমু না । বয়স
হইসে, কখন যে
মরি, তারও কোন
ঠিক নাই । তুমি এহন
একখান বিয়া কইরা ফেলো ।” কথাটা শোনার সাথে সাথেই
আরিফ কেশে উঠলো । গলায় খাবার
আটকেছে । মিজান তাড়াতাড়ি করে পানি
ভরা গ্লাসটা এগিয়ে দিলো । কিছুক্ষণ পর আরিফের
কাশি থামলো । আরিফ তখন
অভিমান করে বলল, “খাওয়ার সময় এইসব
কথা ভালো লাগে?” মিজান বলল,
“বলমু না ক্যান?
তোমারেই তো বউ খুইজা
আনতে হইবো । মাইয়া কি একা
একাই আইবো বাসায়?” ঠিক তখনই কলিংবেলটা বেজে উঠলো । মিজান তখন দরজার
দিকে তাকিয়ে বলল, “এই সময়
আমার কিডা আইল?” আরিফ ইয়ার্কি
করে বলল, “দেখো ।
আমাকে বিয়ে করার জন্য মেয়েটেয়ে এলো কি না ।” মিজান বলল, “তুমি যাও
বাবা । এমন সময়
তো সাধারণত কেউ আসে না । তুমি
যাও বাবা আমার ভয় করে ।” আরিফ হালকা হেসে ভাত মাখা হাত নিয়েই এগিয়ে গেলো দরজার কাছে । বা হাত
দিয়ে দরজার ছিটকিনিটা খুলে দরজাটা টেনে খুলল আরিফ । সামনে দাঁড়িয়ে সত্যিই একটা মেয়ে
। গায়ে সালোয়ার কামিজ । হাতে ছাতা
। চেহারা একদম পূর্ণিমার চাদের মতো । চোখদুটো টলমল করছে
। বাতাসে চুলগুলো উড়ছে । আরিফ মেয়েটার
দিক থেকে নিজের নজর সরাতেই পারছে না । মেয়েটাও
কেন যেন নিজের নজর সরাতে পারছে না । দুজনে
দুজনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল । ওদের দুজনের সময় যেন
থেমে গেছে । মেঘলা দিনের ঠাণ্ডা
হাওয়া আরিফের মনে যেন এক অন্যরকম দোলা দিয়ে
গেলো । হঠাৎ ওদের
মাঝে মিজান কাকু এসে বলল, “কে আইসে?” দুজনেই আবার স্বাভাবিক হয়ে গেলো । আরিফ তখন
হালকা কেশে বলল, “কাকে চাই?” মেয়েটা আর কেউ নয়, সামিরা । মেয়েটা বলল,
“আমি সামিরা । আপনি গোয়েন্দা?”
মিজান উৎফুল্লের সাথে কিছু বলতে গেলো কিন্তু আরিফ মিজানকে থামিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে বলল, “মানে,
প্রফেশনাল গোয়েন্দা না হলেও এমনি
গোয়েন্দা । ভেতরে আসুন ।” আরিফ কেন যেন খুব খুশি । ও যেন
এতোটা খুশি আগে কখনো হয় নি ।
তাই কি হয়েছে সামিরার তা না
শুনেই ভেতরে আসতে বলল সামিরাকে । সামিরার মনে এখনও
অন্যরকম ভয়ের ছাপ । সোফায় বসে আরিফ
জিজ্ঞেস করলো, “এবার বলুন
কি বলবেন ” মেয়েটা কেমন যেন
একটু সংকোচ বোধ করছে । কিছুক্ষণ চুপ করে
থাকলে আরিফ মেয়েটাকে বলল, “ভয় পাবেন
না । আমি আপনাকে
সবরকম সাহায্য করবো ।” এরপর মেয়েটা
বলা শুরু করলো ।
সামিরা বাবা মা-র একমাত্র মেয়ে । ব্যাস্ত শহরের মাঝে একাকীত্বের
সাথে ওর বেড়ে ওঠা
। বাবা মা চাকরি করেন বলে তাদের
সাথে রাতটুকুই যা দেখা হয়
। সারাদিন কাটায় বাসার কাজের লোকের সাথে । এভাবেই ও বড়
হতে থাকে । স্কুল,
কলেজ, তারপর ভার্সিটি । ভার্সিটি
লাইফে ওর জীবনে আসে এক
নতুন মোড় । পেয়ে যায়
একটা বয়ফ্রেন্ড । নাম সামি
। নামের যেমন মিল, মনেরও তেমন মিল
ওদের । সামিও সম্ভ্রান্ত পরিবারের একমাত্র ছেলে ।
সামিকে আবার পছন্দ করতো অন্য একটা মেয়ে যাকে সামি একটুও পছন্দ করতো না । তবুও
মেয়েটা সামির সাথে ঘুরঘুর করতো । মেয়েটার নাম অনি
। অনির একটা প্রতিভা ছিল । সে খুব
ভালো ছবি আর ভিডিও এডিট করতে
পারতো । যেদিন অনি জানতে
পারলো সামি সামিরাকে ভালবাসে, সেদিন থেকে অনি
কেমন যেন হয়ে গেলো । খুব নেশা
করতো আর ভার্সিটিতে কেউ ওকে
রাগালে ও ছেলে মেয়ে
সবাইকে ধরে মারতো । এভাবে কিছুদিন কেটে যাবার
পর আজ সকালে হঠাৎ মেসেঞ্জারে
অনি সামিরাকে ফেসসবুক পোস্টের একটা লিঙ্ক পাঠায় । সেটা ছিল
একটা ভিডিওর লিঙ্ক যেটায় দেখা যাচ্ছে সামি আর সামিরা একটা অবৈধ
শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছে । যদিও ভিডিওটা
এডিট করা, কিন্তু এমন ভাবে
এডিট করা যে, কেউ দেখলে
নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করে ফেলবে । সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার ইতোমধ্যে ভিডিওটা ১লাখ শেয়ার
হয়ে গেছে । মান সম্মানের
ভয়ে কি করবে ভেবে
না পেয়ে অনি আরিফের কাছে এর সমাধানের জন্য এসেছে
। আর সামিও নিজের ঘরে বসে
প্রচুর টেনশন করছে ।
থেমে গেলো
সামিরা । চোখ দিয়ে
ওর জল পড়ছে ।
ওর চোখের জল বিশ্বাস করাতে বাধ্য যে ও
সত্যি কথা বলছে । আরিফের খুব খারাপ
লাগলো কথাগুলো শুনে । তবে বেশি
খারাপ লাগলো সামিরার বয়ফ্রেন্ড আছে এটা শুনে ।
মেয়েটাকে কাঁদতে দেখে আরিফ বলল, “দেখুন, কান্নাকাটি করবেন না
। আমি আপনাকে সাহায্য অবশ্যই করবো ।” মেয়েটা দিব্যি কেদেই গেলো । খানিক বাদে মেয়েটা
নিজেই আবার বলল, “আমি আপনাকে আরেকটা কথা বলতে চাই । আসলে আমি বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি
। আমায় যদি আপনার বাসায় ঠাই দেন, তাহলে খুব উপকার হয় ।” আরিফ তখন একটা শ্বাস ফেলে বলল, “জী অবশ্যই । মিজান আঙ্কেল, তুমি
উনাকে গেস্ট রুমে নিয়ে যাও ।” মিজান বলল, “গেস্ট রুমে তো তালা দেয়া । ম্যালাদিন ধইরা
গেস্ট রুম খোলা হয় না । ভেতরডায় মনে হয় ভ্যাপসা গন্ধ উইঠা গেছে ।” আরিফ বলল, “তাহলে
এক কাজ করো, উনাকে তুমি মায়ের রুমে নিয়ে যাও ।” মিজান এর পর মেয়েটাকে ওর মায়ের রুমে
নিয়ে গেলো ।
সেদিন রাতে আরিফ যখন ফেসবুকে, তখন আরিফ ওর বন্ধুর শেয়ার করা
একটা ইউটিউব লিঙ্ক দেখল । তাতে ওর বন্ধু ক্যাপশন দিয়েছে, “মানুষ এতো খারাপ হয়! ছি!”
ভেতরে ঢুকে ভিডিওটা দেখতে না দেখতেই আরিফ ভিডিওটা রেখে দিলো । অল্প যেটুকু দেখেছে,
সেটুকুতেই বুঝে গেছে এটা সামিরাকে নিয়ে বানানো ফেইক ভিডিও । নিজের অজান্তেই ভাবতে লাগলো, এরা কি মানুষ? লজ্জা, ভালোবাসা ভুলে অন্যের
ক্ষতি করে । পরক্ষনে উঠে মেয়েটার কাছে যেতে লাগলো । আরিফ যখন দরজার কাছে প্রায় এসেছে,
মিজান তখন মেয়েটার জন্য খাবার নিয়ে প্রায় ভেতরে ঢুকবে । আরিফ মিজান আঙ্কেলের হাত থেকে
খাবারটা নিয়ে বলল, “আঙ্কেল, তুমি যাও, আমি ওকে দিচ্ছি খাবারটা ।” এরপর আরিফ দরজাটা
খুলতেই মেয়েটা চমকে উঠলো । সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আরিফের মা বাবার ছবি দেখছিল
। আরিফ বলল, “I’m really sorry. আপনাকে বলে রুমে ঢোকা উচিত ছিলো ।” সামিরা ছবিটা রেখে
আরিফকে বলল, “না না, ঠিক আছে । এটা তো আপনারই বাসা । পারমিশনের দরকার নেই ।” আরিফ খাবারটা
টেবিলে রেখে বলল, “আপনার খাবারটা নিয়ে এলাম ।” সামিরা বলল, “ইশ! কষ্ট করে আনতে গেলেন
কেন? আমি আপনাদের সাথেই না হয় খেতাম ডাইনিং টেবিলে ।” আরিফ বলল, “না আসলে আমাদের খাওয়া
শেষ তো, তাই আপনাকে আলাদা করে দেয়া ।” আরিফ খাবারের ঢাকনা খুলে মেয়েটার হাতে দিলো ।
মেয়েটা আরিফের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি দিলো । আরিফ তখন বলল, “মুখে সবসময়
এরকম হাসি রাখবেন । এভাবেই আপনাকে অনেক সুন্দর লাগে । হাসি ছাড়া আপনাকে সাদাকালো যুগের
সিনেমার মতো লাগে ।” আরিফের কথা শুনে সামিরা আবার শব্দ করে হাসতে লাগলো । অনেকক্ষণ
হাসল । সেই হাসি দিয়ে যেন মুক্ত ঝড়ে পড়ছে । আরিফ এক দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো
। হাসি থামলে মেয়েটা খাওয়া শুরু করলো । বেশ তাড়াহুড়া করে খেতে লাগলো । দেখেই বোঝা যাচ্ছে,
খুব খিদে পেয়েছে ।
আরিফ আর কিছু না বলে চলে এলো ড্রইং রুমে । টিভিটা অন করে খবর
দেখল আরিফ । হঠাৎ এক পর্যায়ে খবর পাঠিকা বললেন, “রাজধানীর মিরপুর১ এর শেষের দিকে একটি
বাসার মেয়ের সামিরা ও তার বয়ফ্রেন্ড সামির অবৈধ শারীরিক সম্পর্কের ভিডিও ভাইরাল পুরো
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে । পুলিশ জানায় সামিরা নাকি আজ সন্ধ্যায় বাসা থেকে পালিয়েছে
। সামি ও সামিরার বাবা মাকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাইলে তারা কিছুই বললেননি । তাই পুলিশ ধারনা করছে
হয়তো এই ক্ষেত্রে তাদের বাবা মাও তাদের এ ধরনের এক খারাপ কাজ করতে আগ্রহ দিয়েছে ।”
খবর শুনে আরিফে হা করে তাকিয়ে রইল । তাই বলে তাদের বাবা মাকে এভাবে অপমানিত করলো? আরিফ
কেবল ভাবছে । না জেনেশুনে অন্যান্য সাধারণ মানুষ ফেসবুকে ঐ ভিডিওটা শেয়ার করে ২টা পরিবারের
অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলেছে । পরদিন সকালে খবরের বলা কথা অনুযায়ী আরিফ চল গেলো মিরপুর২
এর শেষের দিকে । এক পথচারি মহিলাকে বলল, “আচ্ছা, এখানে সামিরা নামের মেয়েটার বাসা কোথায়
বলতে পারেন ।” মহিলাটা বলল, “এহ! মুখপুরী মাইয়া । হেয় তো নিজের মান সম্মান ডুবাইসে,
নিজের মা বাপের নামও ডুবাইসে । তা বলি, আপনি কেডা?” আরিফ নিজেকে সামিরার বন্ধু পরিচয়
দিলো । মহিলাটা তখন বলল, “এসব বন্ধুগুলাই তো যতো নষ্টের গোঁড়া । ঐ দিকে যাও, বাসার
সামনে বড় কইরা “সামিরা ভিলা” দেখতে পাইবা । অইডাই সামিরার বাসা ।” আরিফ থ্যাংকস জানিয়ে
চলে গেলো সেদিকে । আরিফ বাসার সামনে যেয়ে নক করলো । দরজা খুলতেই বেড়িয়ে এলো সামিরার বাবা । মেয়ে যে
তার সারারাত বাড়িতে নেই তার কোন টেনশনও তার চোখেমুখে নেই । আরিফ জিজ্ঞেস
করলো, “আ…আ…আপনি কি
সামিরার বাবা?” সামিরার বাবা কিছুক্ষন
আরিফের দিকে তাকিয়ে রইল । এমনভাবে তাকিয়ে রইল,
যেন উনি প্রথমবার মানুষ দেখছেন । একটু পর
আরিফ বলল, “আ,
আপনি কি শুনতে পেয়েছেন? আপনি
কি সামিরার বাবা?” সামিরার বাবা আরিফের
পায়ের কাছে থুতু ফেলে বললেন, “ছি!
লজ্জা করলো না আমার মেয়ের
সাথে এসব করতে? সামিরা নামে আমার
কোন মেয়ে নেই । যে ছিল, সে গতকালই মারা গেছে ।” আরিফ কিছু
বলার আগেই দরজাটা আটকে দিলেন সামিরার বাবা । আরিফের বুঝতে বাকি রইল না
যে সামিরার বাবা আরিফকে সামি ভেবে ভুল করছে । আরিফ আর কিছু বলারই সুযোগ পেলো না । বাড়ির
পথে রওনা হল আরিফ । মাথার ভেতর অনেক চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে । বুঝতে পারছে না কি
করে ও সামিরার সাহায্য করবে । এমন সময় এক মাতাল লোকের সাথে ধাক্কা খেলো আরিফের গাড়িটা
। গাড়িটা থেকে বেড়িয়ে দেখল, মাতাল হয়ে পড়ে আছে সামিরার বয়সি একটা মেয়ে আর একটু দুরেই ছিল আরেকটা মাতাল ছেলে, যে এই
মেয়েটাকে অ্যাকসিডেন্ট করতে দেখে মাতাল অবস্থায় এগিয়ে আসছে ।
সেদিন রাতের কথা । জানালার ধারে বসে রাস্তার ওপর গাড়ির আনাগোনা
দেখছিল সামিরা । সে সময় রুমের দরজার বাহির থেকে ভেসে এলো আরিফের গলা, “আসতে পারি?”
সামিরা বলল, “জী আসুন ।” আরিফ ভেতরে এলো । সামিরা আরিফকে বলল, আপনি কিন্তু আমাকে লজ্জা
দিচ্ছেন । আমি আপনার বাড়ির একজন আশ্রিতা । আর আপনার বাড়ির রুমে ঢুকবেন, এতে পারমিশনের
কি আছে?” আরিফ বলল, “আপনি এবার আমায় আর লজ্জা না দিয়ে একবার নিচে আসুন ।” সামিরা অবাক
হল । জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু কেন?” “আ আম……ধরুন আপনার জন্য অনেক স্পেশাল কিছু আছে ।”
সামিরা কিছু বুঝতে পারলো না । ওর মাথায় শুধু একটাই ব্যাপার ঘুরপাক খাচ্ছে । এই মুহূর্তে
এই বড় বিপদটা থেকে মুক্তি ছাড়া ওর কাছে স্পেশাল কিছুই নেই । তাও কিছু জিজ্ঞেস না করে
এগিয়ে চলল আরিফের সাথে । ডাইনিং রুমটা অন্ধকার । সামিরা আরিফকে জিজ্ঞেস করলো, “এতো
অন্ধকার কেন?” আরিফ উলটো গুনতে লাগলো । “৩……২……১……০” ঠিক তখনই আলো জালালো মিজান । সামিরা
দেখল সামনে একটা কেক রাখা আর ডাইনিং রুমটা খুব সুন্দর করে বেলুন দিয়ে সাজান । আরিফ আর মিজান দুজনেই একসাথে বলে উঠলো, “Happy
Biirhtday সামিরা ।” সামিরা খুব খুশি । আরিফকে বলল, “বাহ! আমার তো নিজেরই মনে ছিল না
আজ আমার জন্মদিন । কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?” আরিফ বলল, “আসলে আপনার ফেসবুক আইডিতে
দেখেছি ।” মিজান তখন বলল, “তাইলে এইবার কেকটা কাটো ।” আরিফ বলল, “আরে মিজান আঙ্কেল,
আগে ওর সারপ্রাইজটা দিয়ে নেই ।” মিজান বলল, “ও হ ।” আরিফ তখন দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভেতরে আসুন ।” দরজার সামনে সাদা পর্দা দেয়া । কারো একটা ছায়া দেখা যাচ্ছে । হাতে কিছু
একটা নিয়ে এগিয়ে আসছে পর্দার ওপর ছায়া দেখে তেমন কিছু বুঝতে পারছে না সামিরা । কিছুক্ষণ
পর । পর্দাটা সরিয়ে ভেতরে এলো দরজার ওপারে থাকা মানুষটা । দেখে সামিরা খুশিতে আহ্লাদে
আটখানা । এটা সামিরার বয়ফ্রেন্ড সামি । সামিরা এক দৌড়ে কাছে যেয়ে জড়িয়ে ধরল সামিকে
। সামিও জড়িয়ে ধরলো সামিরাকে । দুজনেই খুব খুশি । সেই চেনা মুখ, সেই চেনা গন্ধ, সেই
চেনা মানুষ । সামিরা তখন বলল, “তুমি এখানে কি করে?” সামি কিছু বলার আগেই আরিফ বলল,
“উ…হু, এখনই না । আমি বলেছিনা, কালকের আগে কিছুই হবে না । কাল সবটাই জানতে পারবে ।
সামিরা জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু কেন?” আরিফ বলল, “এখন কোন প্রশ্ন নয়, কাল সব কথা হবে
। এবার তোমার জন্মদিনটা পালন করে নেই । এরপর ওরা খুব মজা করে সামিরার জন্মদিন পালন
করলো । রাত ৩টার কথা । আরিফ তখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন । হঠাৎ চাকু নিয়ে কেউ এগিয়ে আসতে লাগলো আরিফের দিকে । ইচ্ছে করে পাশে
থাকা ফুলের টবটা ফেলে দিলো সে । শব্দে
ঘুম ভাঙল আরিফের । “কে?
কে?” বলে উঠে
বসতেই সেই মানুষটা দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেলো আর ছুরিটা ফেলে গেলো
আরিফের ঘরে । আরিফের তাড়াতাড়ি করে উঠে
দরজা খুলতেই আর কাউকে দেখতে পেলো না
। শুধু দেখল, দরজার পেরেকে আটকে আছে
যে এসেছিলো তার কাপড়ের একটা অংশ । খুব সম্ভবত
এটা কারো ওড়নার কাপড় ।
আরিফের
গাড়িতে করে যাচ্ছে সামিরা আর সামি । সামিরা বার বার জিজ্ঞেস করছে ওরা কোথায় যাচ্ছে
কিন্তু সামি কিছুতেই বলছে না । আরিফ ওকে বারণ করেছে । তবুও সামিরা বারবার জিজ্ঞেস করেই
যাচ্ছে । সামি আর সয্য করতে না পেরে বলল, “আরিফ ভাই তোমাকে বলতে মানা করেছিলো । তাও বলছি । আমরা যাচ্ছি একটা বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ।” সামিরা বলল, “কিন্তু কেন?” “কিন্তু আরিফ ভাই কোথায়?” “একটা জরুরী কাজে গেছে । উনি কাজ শেষে পৌঁছে যাবে । আমাদের চলে যেতে বলেছেন ।” “অদ্ভুত ব্যাপার তো! টেলিভিশন
চ্যানেলের অফিসে যেয়ে কি করবো আমরা?” সামি আর কিছুই বলল না । অবশেষে ওরা পৌঁছে গেলো
এক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল “পিপিটিভি” এর ভবনের সামনে । আরিফের কথা মতো ওরা চলে
গেলো ৪তলায় । আরিফ জিজ্ঞেস করলো, “রাস্তায় কোন অসুবিধা হয় নি তো?” ওরা কোন অসুবিধা
হয় নি বলল । এরপর ওরা চলে গেলো একটা স্টুডিওতে । সেখানে ঢুকতেই সামিরা আর সামি অবাক
। বলে আসে সামিরার সম্মানহানি করার জন্য দায়ী সেই মেয়ে অনি । তারই পাশে বসে একজন পুরুষ,
আরেকজন মহিলা । আসলে এরা গতকালকে আরিফের গাড়ির সাথে ধাক্কা খাওয়া সেই মহিলা আর ওর ধাক্কা
খাওয়া দেখে এগিয়ে আসা সেই পুরুষ । সামিরা তখন বলল, “আরিফ ভাইয়া? আপনি আমাদের এ কোথায়
আনলেন?” আরিফ বিড়বিড় করে বলল, “ভাইয়া বললে খারাপ লাগে গো ।” সামিরার কথাটা অস্পষ্ট
শুনতে পেলে বলল, “বুঝলাম না ঠিক কি বললেন?” আরিফ তখন বলল, “না মানে, কিছুই না । আপনি
সবটাই জানতে পারবেন, আগে এখানে বসুন ।” বলেই সামিরা আর সামিকে একটা চেয়ার দেখিয়ে সেখানে
বসালো আরিফ । ঠিক ১০টা বাজতে না বাজতেই শুরু হয়ে গেলো অনুষ্ঠান । সারা বাংলাদেশের মানুষ
লাইভ দেখতে শুরু করলো । অনুষ্ঠানের উপস্থাপক শুরু করলেন অনুষ্ঠান, “ভালোবাসা বা ভাললাগা
দুটোই নিত্যদিনের ব্যাপার । কিন্তু দুটোই যদি হয় আমাদের সম্মানহানির কারণ, তবে সেটাকে
ঠিক কি বলা যায়, আমার জানা নেই । সেরকমই একটা গল্প যেটার একটা মিথ্যে অংশ ছড়িয়েছেন
আপনারা, সেটার বাস্তবতা আজ আমরা আপনাদের জানাবো ।”
সামিরার মা চুলোয় ভাত বসাচ্ছিলেন । হঠাৎ পাশে বাসার এক পরিচিত
মহিলা এসে বলল, “ও সামিরার মা, দেইখা যাও, তোমার মাইয়া টিভিতে আইসে ।” সামিরার মা তাড়াতাড়ি
যেয়ে টিভির কাছে বসলেন । সামিরার বাবাকেও ডাকলেন । সামির মাও টিভির চ্যানেল পাল্টাতে
পাল্টাতে হঠাৎ সামিকে দেখে অবাক ।”
উপস্থাপক বললেন, “চলুন, শুরু করি মোঃ আরিফকে দিয়ে ।” এরপর আরিফ
শুরু করলো, “এই তো কিছুদিন আগের কথা । আপনারা সবাই না যেনে শেয়ার করেছিলেন একটা পোস্ট
যেটা আসলে ছিল এডিট করা যেটা করেছে সামিরার বয়ফ্রেন্ডকে ভালবাসে অন্য একটা মেয়ে সে
। সামিরা আর সামি কিন্তু কিছুই করে নি ।” এরপর আরিফ সেই পুরুষ আর মহিলাটাকে দেখিয়ে
বলল, “এই যে এরা দুজন, এরা ছিল ভিডিওটার আসল লোক । কিন্তু সামিরা সেই ভিডিওটা এডিট
করে সেখানে সামিরা আর সামির মাথা লাগিয়ে দিয়েছে । এটা সে করেছে শুধুমাত্র সামি ওকে
ভালোবাসা দেয় নি বলে । কিন্তু এটা যে কত বড় ভুল করেছে সেটা সে নিজেও জানেনা । গতকাল
আমার গাড়ির সাথে এই মহিলা ধাক্কা খান । এরপর আমি গাড়ি থেকে বেড়িয়ে উনাদের কাছ থেকে জানতে পারি, এনারাই আসলে সেই লোক । পরবর্তীতে
আমি এনাদের কাছ থেকে আসল ভিডিও সংগ্রহ করে অনিকে ব্ল্যাকমেইল করে অফিসার লিমনের মাধ্যমে
ধরে আনি । পরবর্তীতে এই অনি সব স্বীকার করে ।” এরপর অনিও ওর দোষ স্বীকার করে । আরও
অনেক কথাবার্তার মাধ্যমে বাকি অনুষ্ঠান শেষ হয় । অনুষ্ঠান শেষে সামিরা আর সামি আরিফের
গাড়িতে করে সামিরাদের বাসায় আসে । সামিরাদের বাসার সামনেই দাঁড়িয়ে সামি আর সামিরার
বাবা মা । গাড়ি থেকে নেমে ছুটে ওরা চলে যায় নিজেদের বাবা মায়ের কাছে । আরিফ কিছুক্ষণ
ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে । তারপর কিছু না বলে গাড়ি নিয়ে চলে আসে । সামি আর সামিরা পেছন
ফিরে আরিফকে না দেখে অবাক হয় ।
একপাশে গাছপালা, অন্যপাশে বিরাট খাল মাঝখানে রাস্তার ওপর দিয়ে
গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে আরিফ । আরিফের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে । বারবার সামিরার কথা মনে পড়ছে
। সামিরার চোখ, সামিরার মুখ, সামিরার বাতাসে ওরা চুল, সামিরার সেই হাসি । হঠাৎ আবার
বৃষ্টি শুরু হল । আরিফ গাড়িটা রাস্তার পাশে থামাল । গাড়ি থেকে নেমে বৃষ্টিতে ভিজতে
লাগলো । বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা ওর মনের দুঃখটাকে যেন ধুয়ে ফেলছে । আড়াল করেছে চোখের
পানি । আরিফ শুধু ভাবছে । কেউ কি আসবে না ওর জীবনে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে?
{সমাপ্ত}