0 %

Thanks a lot for being with us!
We are re-constructing our website!
Sorry for this temporary inconvenience
We are coming to you with a fresh look and design from 1 January 2022!
Till then! Stay connected!

পরিচয়(সিজন-৬) (১৬২-২০০)

পরিচয়(সিজন-৬)

তুমি আর ক্রাইম 

লেখকঃ সাদাত আলম প্রতীক



 

(১)

ধীরে ধীরে ট্রেনটার গতি  কমতে লাগলো । গতিটা শুন্য মিটার প্রতি সেকেন্ড হল স্টেশনে । আর থামতে না থামতেই লোকজনের তাড়াহুড়া  শুরু, কে কার আগে নামবে কিংবা কে কার আগে উঠবে । সূর্যের আলো তির্যকভাবে এসে পড়েছে । এতে রাস্তায় লোকজনের ছায়াগুলো বেশ বড় দেখাচ্ছে । একটু পড়েই সূর্য ডুবে যাবে । অনেক কষ্টে ট্রেনে ওঠা লোকদের ধাক্কা সহ্য করে ট্রেন থেকে নামলো  আবির । কমলাপুর ষ্টেশন । অনেক শুনেছে এর নাম আবির, কিন্তু দেখা হয় নি আগে । সত্যি কথা বলতে ইফাজের কাছে যখন ছিল, তখন ইফাজই এখানে আনতে চাইতো না, যদি  আবির পুরনো স্মৃতি দেখে আবিরকে ছেড়ে   চলে যায় । আসলে জেদটা একটু বেশিই ছিল তো । ট্রেন থেকে নেমে হাঁটতে লাগলো আবির । রাস্তার  পাশে এক লোক  বসে কান্নাকাটি শুরু করেছে, আর কিছু লোকজন সেই লোকটার চারপাশে ঘিরে দেখছে । আবিরও একটু এগিয়ে গেলো  । উঁকি মেরে দেখল, বছর ৩০-এর এক লোক কাঁদছে । আবির একজন জিজ্ঞেস করলো, “ভাই উনার কি হয়েছে?” লোকটা পান চিবোচ্ছিল । চিবোতে চিবোতেই বলল, “আবে হালার পকেট মাইরা দিছে কিছু পকেটমার হালায় । তাই কানতাছে ।” আবির শুধু “ও আচ্ছা” বলল । কিছুক্ষণ মাঝবয়সী লোকটার দিকে তাকিয়ে বেড়িয়ে এলো । এটা দেখার মতো কি এমন হল? সাহয্যের নাম নেই, দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখে । আবিরের আবার ভালোই লাগলো । মানুষে মানুষে হানাহানির এই সময়ে অন্তত মানুষের কান্না তো লোকজন দেখে । এমন সময় আবির দাড়িয়ে গেলো । ওর পকেট কাটল না তো কেউ? তাড়াতাড়ি প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখল, টাকা পয়সা মোবাইল সব ঠিকই আছে । আবির হাফ ছেড়ে বাঁচল । একটু পরেই ট্রেনটা ষ্টেশন ছাড়ল, আর সেই সাথে লোকজনের ভিড় অনেক কমে গেলো । পরবর্তী ট্রেন এলে আবার হয়তো ভিড় হবে । সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয় নি । একটু পর মাগরিবের আজান দেবে । নামাজটাও পড়া হয় নি যোহরের । আসরের নামাজের ওয়াক্ত শেষের পথে । আবির তাড়াতাড়ি করে একটা মসজিদ খুঁজে তাড়াতাড়ি আসরের নামাজ পড়লো । এরপর সূর্য অস্ত গেলে যোহরের নামাজটাও কাযা করে নিলো । তারপর অপেক্ষা করলো মাগরিবের আজানের । মসজিদের বারান্দায় যেয়ে ফোন করলো রাজকে । পুরো ট্রেন আবির কারো সাথেই কথা বলে নি । কিছুক্ষণ আওয়াজ হবার পর ফোনটা রিসিভ হল । আবির বলল, “হ্যালো?” ফোনের অপাশ থেকে কোন আওয়াজ নেই । আবির আবার বলল, “হ্যালো রাজ, আমি আবির বলছি । এবার হালকা কান্নার আওয়াজ এলো । আবির বলল, “হ্যালো!” রাজ এরপর কাঁদতে কাঁদতে বলল, “পৌঁছেছিস?” রাজের গলা ভেঙ্গে গেছে বলে মনে হচ্ছে! আবির জিজ্ঞেস করলো, “হ্যাঁ কিন্তু কিরে? তোর শরীর খারাপ হইছে নাকি!” রাজ কান্নাটা কিছুটা কমিয়ে বলল, “না না, শরীর খারাপ হবে ক্যান, ওই ঠাণ্ডা লাগছে ।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “তুই আজকেও নিশ্চয় বৃষ্টিতে ভিজছোস! তোরে না মানা করছি বৃষ্টিতে অতো ভেজার দরকার নাই!” রাজ আর কোন কথা বলে না । পাশ থেকে নিশি, “দে ফোনটা আমাকে দে ।” বলে রাজের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে আবিরকে বলল, “শোন! সকালে তুই সেই যে গেলি, ছেলে বৃষ্টিতে ভিজে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করছে, ওইটার জন্য অতো কিছু হয় নাই, আজকে সারাদিন কানতে কানতে গলা ভাংছে । সকালে ব্রেকফাস্টও করে নাই, দুপুরে খায়ও নাই । এক গ্লাস পানিও না ।” আবির একটা কষ্টের দম ফেলল । তারপর  জিজ্ঞেস করলো, “দে ওকে ফোনটা ।” নিশি ফোনটা রাজকে দিলো । আবির বলল, “কিরে? কি শুনতেছি?” রাজ কোন জবাব দেয় না । আবির বলল, “যা কিছু খা, আর পানি তো বেশি করে খাবি নাকি! নাইলে হিশু করতে গেলে দেখবি হলুদ পাখি বেরোচ্ছে!” এতক্ষণ পর একটু হাসল রাজ । তারপর বলল, “শালা! আমি কি তোর মতন নাকি!” আবিরও হালকা হাসল । তারপর বলল, “ছাদে নাকি তোরা?” রাজ বলল, “হ । তুই ক্যামনে বুঝলি?” আবির বলল, “নিশি তো তোর রুমে সচরাচর আসার কথা না, তুইও যাওয়ার কথা না, তাই আরকি ।” রাজ বলল, “হ, আমি, নিশি আর পরশ আছি বইসা । জামি আর শিমুল তোর ওপর রাগ করছে ।” আবির জিজ্ঞ্রস করলো, “ক্যান?” “ওই, তুই যাওয়ার সময় ওদের ডাকোস নাই, তাই ।” আবির বলল, “রাতে তো দেখা করছিলাম, আর ওরা বেশি রাত জাগে বইলাই তো আর কষ্ট কইরা ডাইকা তুললাম না ।” রাজ বলল, “আর হ্যাঁ, শোন, নিশি বলছিল, নাবিলা তোর কাছে ক্ষমা চেয়েছে ।” আবির থেমে গেলো । নাবিলার কথা এতক্ষণ ওর মনেই ছিল না । কতো সময় পার করেছে নাবিলার সাথে, কিন্তু সেই নাবিলা………! থাক সেসব ভেবে আর কি হবে । ভুলে যে গেছে, এতেই আবির খুশি । আবির কিছু বলছিলো না দেখে রাজ জিজ্ঞেস করলো, “কিরে? শুনতে পাচ্ছিস?” আবির অন্যমনস্কতা থেকে ফিরে এসে একটু হেসে বলল, “হ, পাচ্ছি । ওরে বলিস, আমি কারো ওপর রাগ করি না, সো এতে মাফ চাওয়ার কিছু নাই ।” রাজ কিছু বলল না । আবির আবার বলল, “হ্যাঁ রে, বাকিরা সব ভালো আছে? পাপলু আঙ্কেল সায়রা, পরী, হোস্টেলের অন্যান্যরা, রিতা?” রাজ বলল, “হুম, ভালোই আছে, শুধু তুই চলে গেছিস বলে হালকা কষ্টে আছে সবাই ।” আবির দেখল, সোমা আপু কল করেছে । রাজকে বলল, “হ্যালো দোস্ত, সোমা আপু কল করছে, পড়ে কথা বলি?” রাজ বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, লাভ ইউ ব্রো ।” আবির জবাব দিলো, “লাভ টু ডিউড ।” বলেই ফোনটা কেটে সোমা আপুর ফোন ধরল, “হ্যাঁ সোমা আপু বলো ।” সোমা আপু জিজ্ঞেস করলো, “পৌঁছেছিস?”আবির বলল, “জি আপু ।” সোমা আপু বলল, “যাক, আলহামদুলিল্লাহ । শোন, মাগরিবের পর একটা ছেলে আসবে আমাদের আলোকিত সংঘের । নাম রাসেল । তুই ওখানকার জেজেএ রেস্টুরেন্টে যাইস । ওখানেই পাবি । আমি তোকে ফোন নাম্বার টেক্সট করে দিয়েছি, তুই ফোন দিলেই ওকে পেয়ে যাবি ।” আবির একটু হেসে বলল, “তুমি যে আমার কতো বড় উপকার করেছো এতোকাল জুড়ে, ইভেন এখনও করছ, তোমার ঋণ আমি কিছুতেই শোধ করতে পারবো না ।” সোমা আপু হেসে বলল, “ধুর পাগল, সকালেই তো বললি আমি তোর মা । মা ছেলেকে কিছু দিলে ছেলে কখনো এভাবে বলে নাকি?” আবির একটু হাসল । এমন সময় সোমা আপুর মেয়ে নামিরা কাঁদছে । আবির জিজ্ঞেস করলো, “কি ব্যাপার? নামিরা কাঁদছে যে?” সোমা আপু বলল, “সকাল থেকেই কাঁদছে রে । অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়েছিলাম, উঠে পড়েছে বোধ হয় । আমি যাই রে, ওকে একটু দেখি ।” আবির বলল, “আচ্ছা আপু ।” সোমা আপু বলল, “শোন, কোন সমস্যা হলে আমাকে জানাস কিন্তু, আর মনে করে জেজেএ রেস্টুরেন্টে যেয়ে রাসেলকে ফোন করিস ।” আবির বলল, “আচ্ছা আপু ।” এরপর বিদায় নিয়ে ফোনটা কেটে দিলো সোমা আপু । মসজিদে তখন মাগরিবের আজান দিলো ।

 

 

 

 

(২)

নামাজটা জামাতের সাথে পড়ে আবির বেড়িয়ে এলো । খুঁজতে লাগলো জেজেএ রেস্টুরেন্ট । ভেবেছিলো হয়তো বেশ ভালো রেস্টুরেন্ট হবে, কিন্তু তেমন একটাও না । আশেপাশে রেস্টুরেন্টগুলোর চেয়ে এই রেস্টুরেন্টটা অনেকটাই পুরনো দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সামনে একটা মূর্তি । একজন মহিলা আর একজন পুরুষের । আবির সামনে যেয়ে মূর্তিটা দেখল । এটা আবিরের ছোটবেলার সেই বাবা মা যারা ওকে রাস্তার ধারে কুড়িয়ে পেয়েছিল । আবির তা জানে না । আবির রেস্টুরেন্টের দিকে পা বাড়াল । সামনে নাম লেখা, “জয়নাল জামেনা আলি রেস্টুরেন্ট” আবির ভেতরে ঢুকল । বেশ লোকজন আছে ভেতরে । সামনে বসে রায়হান । সেই রায়হান, যার বুদ্ধির জোরে এই রেস্টুরেন্টের অপমান রক্ষিত হয়েছিলো । আবির রায়হানকেও চেনে না । এখন মোটামুটি বয়স হয়ে গেছে । রায়হান একটা ওয়েটারের সাথে কথা বলছিল । সেই সময় একটা মেয়ে টাকা দিতে দিতে বলল, “রায়হান ভাই, আপনার রেস্টুরেন্টের খাবার কিন্তু বেশ হয় । রায়হান বলল, “আরে আপা! দেখতে হবে না কার রেস্টুরেন্ট, আরে বলিউডে আছে সালমান খান, ঢালিউডে সাকিব খান, আর এই কমলাপুর বস্তিতে, আশেপাশে থাকা কিছু ওয়েটার বলে উঠলো, “রায়হান! রায়হান!” রায়হানের কর্মকাণ্ড দেখে আবির হাসল । তারপর বসলো একটা টেবিলে । দুপুর থেকে কিছু খাওয়া হয় না । সেই সকালে খেয়ে এসেছিলো হোস্টেলে,  তারপর পেটে আর কিছুই পড়ে নি । একটা ওয়েটার এসে বলল, “স্যার, আপনাকে কি দেবো?” আবির সামনে থাকা খাবারের কাগজটা নিলো । আবিরের সাধ্যের মধ্যে ডিম, ডাল আর ভাতটাই পড়ে । আবির বলল, “ডিম, ডাল আর ভাত দিন হাফ প্লেট ।” ওয়েটার, “ওকে স্যার” বলে চলে গেলো । আবির মোবাইলটা হাতে নিয়ে সোমা আপুর টেক্সট করা নাম্বারে কল দিলো । কল ধরে ফোনের ওপাশ থেকে একজন বলে উঠলো, “হ্যালো! কিডা কইতাছেন?” আবির বলল, “আসসামু আলাইকুম, আমি আবির বলছি, সোমা আপু আপনার নাম্বারটা দিয়েছিলো ।” লোকটা বলল, “হ আমি আইতাছি । খাড়াও ।” আবির বসে রইল । কিছুক্ষণ পর খাবার এলো । খেয়ে দেয়ে বসে রইল, তবুও লোকটা আসছে না । প্লেটের ওপর ওয়েটারের টিপস দিয়ে সামনে গেলো আবির । বিলটা দিয়ে রায়হানকে বলল, “ভাই, আমাকে একটা স্পা এর পানি দেবেন?” রায়হান বলল, “ক্যান? পানি দেয় নাই আপনেরে!” বলেই কোন এক ওয়েটারকে ডাকতে যাচ্ছিলো রায়হান, আবির বলল, “না না ভাই পানি দিয়েছে, আসলে এমনিই কেনার জন্য ।” রায়হান বলল, “ও আচ্ছা, তাই কন ।” রায়হান একটা পানির বোতল দিলো আবিরকে । আবির পকেটে হাত দিয়ে দেখল শুধু এক হাজার টাকার একটা নোটই বাকি আছে । আবির বলল, “ভাই, ১০০০টাকা ভাংতি হবে?” রায়হান বলল, “হ হবে ।” বলে ড্রয়ার খুলে দেখল, টাকা নেই । রায়হান কাকে যেন ডেকে বলল, “কিরে! টাকা নিয়া গেলি কই!” একটু দুর থেকে একটা ওয়েটার বলল, “আপনের বোন বস্তিত নিয়া গেছে ।” রায়হান বিরক্ত  হয়ে বলল, “উফ! কলিমাটা কি যে করে না!” ওরে এইবার শ্বশুর বাড়ি পাঠাইয়াই দিমু ।” আবির বলল, “তাহলে ভাই বোতলটা রেখে দেন ।” রায়হান বলল, “আরে, রাইখা দেন, ব্যাপার না ।” আবির বলল, “কিন্তু টাকাটা?” রায়হান একটু হেসে বলল, “আরে ধুর, মাত্র ১৬টাকা । ব্যাপার না ।” আবির হাসিমুখে বলল, “আপনি আসলেই খুব ভালো মানুষ ।” রায়হান হেসে বলল, “আরে দেখতে হবে না আমি কে, বলিউডে আছে সালমান খান, ঢালিউডে শাকিব খান, আর এই কমলাপুর বস্তিতে!” আবার কিছু ওয়েটারের আওয়াজ, “রায়হান! রায়হান!” আবির একটু হেসে বেড়িয়ে এলো । এমন সময় আবিরের ফোনে কল এলো । সেই রাসেল ভাই বোধ হয় ফোন করেছে । আবির ফোন ধরে বলল, “কি ব্যাপার! আপনি কোথায়!” রাসেল নামের লোকটা বলল, “আরে বাবা এতো অধৈর্য ক্যান তুমি! এইযে আমি তো জেজেএ রেস্টুরেন্টের সামনেই, তুমি কই?” আবির আশেপাশে দেখতে দেখতে বলল, “জি আমিও এইখানেই ।” এমন সময় আবির একটা লোককে কানে মোবাইল দিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখল আবির । ফোনে সেই রাসেল ভাই বলল, “তা কই! দেখতেছি না তো তোমারে!” চারপাশের আলোতে আবির স্পষ্ট দেখতে পেলো এই লোকটারও ঠোঁট নাড়ানোর সাথে ফোনের রাসেল ভাই এর কথার মিল । আবির এগোতে এগোতে বলল, “এই যে এই দিকে তাকান ডানে!” লোকটা ডানে তাকিয়ে আবিরের দিকে তাকাতেই আবির হাত উঠিয়ে ঈশারা করে দেখাল । তারপর ফোনটা কেটে দিলো । লোকটাও আবিরের দিকে গেলো ।” আবির হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে বলল, “আমি আবির ।” লোকটা হ্যান্ডশেক করে বলল, “আমি কবির” আবির ভ্রু কুঁচকে বলল, “কবির! সোমা আপু যে বলল আপনার নাম রাসেল!” লোকটা মাথা চুলকে বলল, “একই তো, রাসেল কবির ।” আবির “ও আচ্ছা বলে মৃদু হাসল । কিন্তু মনে কেমন যেন একটা খটকা লাগছে । সোমা আপুর বন্ধু সোমা আপুরই বয়সের হবে, কিন্তু একে দেখে তো মনে হয় ৪০-৫০ বছর হবে । লোকটা আবিরের সাথে হাঁটতে হাঁটতে অনেক কথা বলল, আবিরও অনেক কথা বলল লোকটার সাথে । এরপর একটা ট্যাক্সি নিয়ে লোকটার সাথে রওনা হল আবির । ট্যাক্সির মধ্যে লোকটার সাথে আর তেমন একটা কথা হয় নি আবিরের ।” এমন সময় সোমা আপুর ফোন এলো । আবির ফোনটা নিয়ে বলল, “হ্যালো সোমা আপু! হ্যাঁ! হ্যালো!” আবির ঠিক সোমা আপুর কথা শুনতে পাচ্ছে না । পাশে থাকা কবির বলল, “এইখানে নেটওয়ার্কে সমস্যা । লাউডস্পিকারে দেও, পারলে শুনতেও পারো ।” আবির ফোনটা লাউড স্পিকারে দিলো । এবার সোমা আপুর কথা স্পষ্ট শোনা গেলো । আবির হ্যালো বলার আগেই সোমা আপু বলল, “হ্যালো আবির! তুই শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা! শোন! রাসেলের টাকা, মোবাইল সব পকেটমার ছিনতাই করেছে, আমাকে মনে হয় ছিনতাইকারীই বলেছিল জেজেএ রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়াতে, তুই অন্যকারো সাথে যাসনা কিন্তু!” আবিরের বুকতা ছ্যাঁত করে উঠলো । পাশ ফিরে লোকটার দিকে তাকানোর আগেই লোকটা আবিরের মুখের ওপর একটা রুমাল চেপে ধরল । ধীরে ধীরে আবির জ্ঞান হারাল ।

 

 

 

 

(৩)

জ্ঞান ফিরতেই আবির দেখলো, ও একটা রুমের মধ্যে শুয়ে আছে ।  হাত  পা বাধা । রুমে একটা কোণে একটা অল্প পাওয়ারের হলুদ বাল্ব জলছে । চারপাশে প্রায় ৭-৮জন লোক বসে নেশা করছে । আবির অনেক কষ্ট করে উঠে বসলো । আবিরকে উঠে বসতে দেখে আসে পাশে নেশা করতে থাকা লোকজন উঠে  দাঁড়ালো । একজন কাকে যেন ডাকল, “ভাই! জ্ঞান ফিরছে!” আবির দেখল, যে লোকটা ডাকল, সেই আবিরকে রাসেল সেজে ধরে এনেছে । কিছুক্ষণ পর একটা লোক ভেতরে এলো । গায়ে কালো গেঞ্জির ওপর বোতাম খোলা ময়লা সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট আর পায়ে চটি । বয়স প্রায় ৫০মতো হবে । গায়ের রঙ মোটামুটি শ্যামলা বা তার চেয়ে একটু কম হবে । ভেতরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসলো আবিরের ঠিক সামনে । তারপর সিগারেট থেকে ধোঁয়া টেনে আবিরের মুখের  ওপর ধোঁয়াগুলো বের করলো । আবির গন্ধে কেশে উঠলো । লোকটা বলল, “আমি মারুফ । এলাকার সবডি আমারে বস কয়, আমারে ভয় পায় । তুই কিডা রে?” আবির কিছু বলল না । কিন্তু ভয়ও পাচ্ছিলো না । বুকে সাহস সঞ্চার করে বলল, “আমাকে ধরে আনার কারণটা কি জানতে পারি?” আবিরের কথা শুনে মারুফ হাসল । তারপর আবার সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়াটা আবিরের মুখে ফেলতে গিয়ে অন্য দিকে ফেলল । আবির মুখ বন্ধ করেছিলো সে সময় । মারুফ বলল, “এতো সাহস কেনো মিস্টার আবির!” আবির অবাক হল । নাম জানল কি করে? হয়তো যে লোকটা  আবিরকে এনেছে সে বলেছে অথবা আবিরের ব্যাগ সার্চ করেছে । মারুফ আবিরের দিকে একটু মাথা এগিয়ে বলল, “ইফাজ, পায়েল দ্বীপ, চিনোস নাকি?” আবির এবার অবাক হল । এটা তো কেউ জানার কথা না! আবির জিজ্ঞেস করলো, “কে আপনি!” মারুফ আবিরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে মৃদু হাসল । তারপর পেছনে দাড়িয়ে থাকা লোকেদের বলল, “যা, শালারে লইয়া আয় । পেছনে দাড়িয়ে থাকা একজন রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো । তারপর ধরে নিয়ে এলো দ্বীপকে । আবির দ্বীপকে দেখেই বলে উঠলো, “দ্বীপ তুই!” আবির দ্বীপের দিকে তাকাল । মারুফ বলল, “চিনোস ওরে!” আবির বলল, “হ্যাঁ, ও তো আমার ছোট ভাই ।” মারুফ হো  হো করে অট্টহাসি হেসে উঠলো । তারপর বলল, “এমন হারামজাদারে তোর ভাই না বলাই ভালো ।” আবির ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “মানে?” মারুফ দ্বীপকে কাছে ডাকল । দ্বীপ কাছে এসে মারুফের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “ভাই! কিছু কইরেন না ভাই! মাফ কইরা ছাইড়া দেন!” মারুফ দ্বীপের ঘারে হাত রেখে বলল, “তোরে আমি কিছু কইছি!” দ্বীপ ডানে বামে মাথা নাড়ল । মারুফ বলল, “তাইলে চুপ থাক ।” দ্বীপ কিছু বলল না । মারুফ এরপর আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর ভাই খুব ডেঞ্জারাস । খুনে ও বাকিদের চেয়ে সেই ভালো । জানোস তোর ভাই এইসব কিয়েল্লাইগা করে! নেশার লাইগা নেশা!” আবির দ্বীপের দিকে তাকাল । কিছু বলতে পারলো না । মারুফ তখন বলল, “তয় আইজকা অয় একখান ভালা কাম করছে । কইছে তোরে ছাইড়া দিতে ।” আবির কিছু বলল না । ও তখনও দ্বীপের দিকেই তাকিয়ে । মারুফ তখন দ্বীপকে বলল, “ওরে ছাইড়া দিলে আমরা কি পামু!” দ্বীপ ভয়ে ভয়ে বলল, “ভাই! ওই লোকরে ছিনতাই কইরা তো ম্যালা টাকা কামাইছেন! আর আপনে যদি কন এই সপ্তায় আরও করমু ভাই! আপনে কইলে মালও কম লমু!” মারুফ আবার ঠোঁট বাকিয়ে হাসল । বলল, “তোর ভাই খুশি হইছে । যা, তোর কিছু করা লাগবো না । তোর ভাইরে লইয়া যা ।” মারুফ আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই আমাগো লগে কাম করবি!” আবির ডানে বামে মাথা নাড়ল । মারুফ বলল, “আইচ্ছা যা, সমস্যা নাই, তয় আমাগো কথা যদি ফাঁস কইরা দেস, তোর কিন্তু আগা গোরা মাঝখান সব কাইটা দিমু ।” আবিরের ভেতর কোন প্রকার ভয় নেই । মারুফ তখন যেন মাস্তান না, একদন একজন ভালো মানুষের মতো বলল, “আমরা তো ইচ্ছা কইরা এই লাইনে আসি না, জীবনের ম্যালা খারাপ সময় আইলে আইতে হয় আর কি  আমাগো দেখারও লোক নাই । তুই দ্বীপের ভাই বইলা বাইচা গেলি । অন্য কেউ হইলে ছাড়তাম । কোন সমস্যা হইলে জানাইস, আমরা তোর ভাইয়ের মতো সাহায্য করমুনে ।” আবির মারুফের চোখে মুখে তাকাল । একজন খারাপ মানুষের মাঝেও ভালো একটা মন যে আছে, সেটাই দেখতে পারলো মারুফের হাসি আর দৃষ্টিতে ।

রাত প্রায় ৩টা । রেইললাইনের পাশ দিয়ে বাড়ির দিকে হেঁটে ফিরছিলো আবির আর দ্বীপ । দ্বীপের চোখের নিলে কালো হয়ে গেছে । ও যে নেশা করে সেটা ওকে দেখলেই বোঝা যায় । আবির জিজ্ঞেস করলো, “তুই এসব কবে থেকে শুরু করলি!” দ্বীপ কোন কথা বলে না । আবির আবার জিজ্ঞেস করলো, “কিরে!” দ্বীপ আবিরের দিকে একবার তাকিয়ে থেমে থেমে বলল, “ওই, ওরা আমারে ধইরা নিয়া গেছিল আরকি……ইচ্ছা ছিল না……তাও……জোর কইরা……নেশাগ্রস্থ বানায় দিলো……” আবির একটু হেসে বলল, “তুই জানিস না আমি আগে যেখানে ছিলাম সেখানে সবাই আমাকে গোয়েন্দা বলতো  । সো বুঝতেই পারছিস, আমাকে মিথ্যে বলে পার পাবি না!” দ্বীপ আবারো থেমে থেমে বলল, “কই……মিথ্যা……বলতেছি না তো……সত্যি কথা ।” আবির ধমক দিয়ে বলল, “আমাকে একটু আগে মারুফ বলল ও কাউকে জোর করে দলে নেয় না । আর তুই আমাকে মিথ্যে বলিস, না!” দ্বীপ আর কিছু বলল না । আবিরের মোবাইলে তখন ফোন এলো । আবির দেখল, সোমা আপুর ফোন । দ্বীপ তখন বলল, “আমি একটু আইতাছি ।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাচ্ছিস!” দ্বীপ জবাব দিলো, “মুইতা আইতে ।” আবির একটু থেমে বলল, “যা ।” বলে সোমা আপুর ফোন ধরে দ্বীপ কোনদিকে যাচ্ছে তা দেখতে লাগলো । আবির ফোন ধরে বলল, “হ্যালো আপু!” সোমা আপু কণ্ঠে কেমন টেনশনের ভাব । বলল, “হ্যাঁ আবির কিরে! তুই ফোন ধরছিলি না কেন!” আবির বলল, “না আপু, আসলে ফোন-এর চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিলো । মাত্র একটা দোকান থেকে চার্জ দিয়ে এলাম । সোমা আপু বলল, “ও আচ্ছা । আসলে রাসেলের কথা তো বললাম-ই, এখন ওকে কীভাবে যে বলি, তুই কোথায় থাকবি!” আবির বলল, “চিন্তা কোরো না । ২-৩দিন যেখানে ছোটবেলায়  আশ্রিত ছিলাম, সেখানেই  না হয়  থাকবো, তারপর  একটা ব্যাবস্থা হয়ে যাবে আমার ।”  সোমা আপু বলল, “ও । কিন্তু ওরা কি তোকে এখন আশ্রয় দেবে?” আবির বলল, “এটা সত্য ওরা আমাকে মা বাবার কথা না বলে ঠকিয়েছে, তবে মানুষ হিসেবে উনারা ভালো । সোমা আপু বলল, “যাক, তাও চিন্তা মুক্ত হলাম ।” আবির বলল, “আচ্ছা আপু, ঘুমাও, অনেক রাত হয়েছে ।” সোমা আপু বলল, “ঠিক আছে রে, সকালে ফোন দিয়ে জানাস কিন্তু গেছিস কি না ।” আবির আচ্ছা বলে বিদায় নিয়ে ফোনটা কেটে দিলো । আবির খেয়াল করেছিলো দ্বীপ গিয়েছে স্টেশনের ওয়াশরুমে । বেশিক্ষন তো লাগার কথা না । এতক্ষণ কি করছে ও!

 

 

 

 

 

(৪)

আবির এগিয়ে গেলো ষ্টেশনের ওয়াশরুমের  দিকে । ভেতরে ঢুকে দেখল, হাতে কি একটা সাদা রঙের পাউডার নিয়ে অন্য  হাতের এক আঙুল দিয়ে নাকের একপাশ চেপে  অন্য পাশ দিয়ে পাউডারগুলো শ্বাসের সাথে টানছে আর কেমন মাতালের মতো করছে । আবির  তাড়াতাড়ি দ্বীপের কাছে যেয়ে  হাত থেকে পাউডারগুলো ফেলে দিলো । দ্বীপ এর সাথে সাথে কেঁদে উঠলো, তাড়াহুড়া করে মাটিতে বসে  পাউডারগুলো  খুঁজতে  লাগলো ।  আবির দ্বীপকে টেনে দাঁড়  করালো । কাঁদতে কাঁদতে দ্বীপ শুধু বলল, “ক্যান করলা! আমি ওইগুলা ছাড়া বাচমু না!” বলেই কাঁপতে  লাগলো । আবির ওকে নিয়ে বাইরে এলো । দ্বীপ হাঁটতে পারছে না । বেশিই নেশা  করে ফেলেছে । স্টেশনে পাশে একটা  বেঞ্চে দ্বীপকে বসিয়ে দিল আবির । দ্বীপ বিছানায় শুয়ে পড়ল । আবির একটু সামনে যেয়ে দাঁড়ালো । এরই মধ্যে একটা ট্রেনও ষ্টেশন ছেড়ে গেলো ।

সকাল ৮টার দিকের কথা । তরকারিতে কয়েকটা এলাচ ছেড়ে দিলো পায়েল । কাজের লোকেদের মধ্যে এখন শুধু হালিমা চাচি । চাচির বেশ বয়স হয়েছে । উনার স্বামীও প্যারালাইজড বলে  কাজে আসতে পারে না । আর গণি চাচা মারা গেছেন বছর ৩ হল । হালিমা চাচি সবজি কাটছিল । পায়েল জিজ্ঞেস করলো, “তোমার স্বামী কেমন আছে চাচি?”

- “আছে, ভালোই । খারাপ না ।” জবাব দিলো হালিমা চাচি ।

- “সবজি কাটা হল?”

- “হ, হইয়া গেছে  প্রায় ।” বলে কিছু সবজি একটা ডালির ভেতর রেখে পায়েলের দিকে এগিয়ে দিয়ে  বলল, “এই কয়েকটা লন ।” পায়ল সেগুলো হাতে নিয়ে সিঙ্কের ভেতর ধুতে লাগলো । সে সময় দরজা  খোলার শব্দ । শুনে একটা  হতাশার শ্বাস ফেলে পায়েল বলল, “এলো । আজও সারারাত বাইরে কাটিয়ে এলো ।  মানুষ করতে পারলাম না ওকে ।। কিছু বলতে গেলে তো ভাংচুর শুরু করবে । চাচি, তুমি একটু এদিকটা দ্যাখো, আমি দেখি, দ্বীপ সকালের নাস্তা খাবে কি না ।” হালিমা চাচি ডানে  মাথা কাত করলো । পায়েল গেলো ড্রইং রুমের দিকে । যেতে  যেতে দ্বীপকে  উদ্দেশ্য  করতে বলতে  যাচ্ছিলো, “দ্বীপ, তুই  কি  এখন……।” থেমে গেলো পায়েল । কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তারপর চেঁচিয়ে ইফাজকে ডাকল, “ইফাজ! ইফাজ!” কিছুক্ষণ পর এক পা  খোঁড়াতে খোঁড়াতে নিচে নামতে খানিকটা চুল পেকে যাওয়া ইফাজ বলল, “কি হয়েছে!”  তারপর পায়েলের দৃষ্টি লক্ষ করে সামনে দিকে তাকিয়ে দেখল, দ্বীপের সাথে দাড়িয়ে আবির।

সোফায় বসে পায়েল আর ইফাজ । সামনের সোফায় দ্বীপ আর আবির । একটু পর হালিমা চাচি এসে দু কাপ কফি দিয়ে গেলো । ইফাজ জিজ্ঞেস করলো, “চলে গিয়েছিলি কেন না বলে?” আবির মাথা নিচু করে থেমে থেমে বলল, “তোমরা আমাকে ঠকিয়েছ ।” এরপর ধমকের স্বরে উচু গলায় ইফাজ বলল, “তাহলে এতো বছর  পর  কেন এলি!” আবির চুপ করে রইল । দ্বীপও ভয় পেলো । পায়েল ইফাজের কাঁধে হাত রেখে বলল, “শান্ত হও, ছেলেটা কেবল এসেছে, এখনই এসব বোলো না,  তাছাড়া তোমার শরীর ভালো নেই, আবির  মাথা তুলে ইফাজকে বলল, “শরীর খারাপ! কি হয়েছে আপনার!” আবিরের কথা শেষ  হতে না  হতেই আবিরকে থামিয়ে  ইফাজ বলল,  “থাক! এতো  খোঁজ নেয়া লাগবে না ।”

- “তুই কোথায় পেয়েছিস  ওকে!” দ্বীপকে উদ্দেশ্য করে  বলল পায়েল ।

- “আমার ঠিক মনে নেই, শুধু এটুকু মনে আছে   আমি  ওর সাথে  ক্লাব থেকে স্টেশন পর্যন্ত  গিয়েছিলাম ।” জবাব  দিলো দ্বীপ । দ্বীপের কথাশুনে রেগে গিয়ে  ইফাজ বলল, “জানবি  কি করে!  তুই কি নেশা ছাড়া থাকিস নাকি কখনো! আর তোর তুই কোন ক্লাবে যাস না যাস আমরা  কিছু বুঝি না, তাই না!” দ্বীপও রেগে একটা কফি কাপ হাত দিয়ে ফেলে ভেঙ্গে উঠে দাড়িয়ে  বলল, “তোমার কি তাতে!  আমার জীবন আমি দেখবো…………।” “দ্বীপ! চুপ কর!”-আবিরের ধমকে থেমে বসলো দ্বীপ । ইফাজও চোখ বন্ধ  করে রাগ দমন করে কপালে হাত দিলো । আবির তারপর বলল, “আমি এসে বোধ হয় তোমাদের মাঝে এতো বছর এসে আমি বোধ হয় সমস্যা ডিস্টার্ব করলাম । আমি যাই!”

- “ভাইয়া তুমি যাবা না” বলতে লাগলো দ্বীপ ।

- “ইফাজ কি করছো আবিরকে যেতে বারণ করো!” ইফাজকে বলতে লাগলো পায়েল ।

- “জাহান্নামে যাক ও! ওর কেউ না আমরা!” পায়েলকে  বলতে লাগলো  ইফাজ ।

আবির অনেকটা দুর গিয়েছিলো, কিন্তু এদের কথাবার্তা শুনে বিরক্ত হয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে হাত জোর করে বলল, “স্টপ দিস ননসেন্স প্লিজ!” সবাই চুপ হয়ে গেলো । “আমি চাই না আমার জন্য তোমাদের অশান্তি হোক প্লিজ! এতদিন আমাকে ছাড়া যেমন ছিলে তেমনি থাকো! আমি তোমাদের কথা আর ভাবছি না । যতোই পুরনো স্মৃতি মনে করে আঙ্কেল থেকে বাবা বলি, আন্টি থেকে মা বলি, আপনি থেকে তুমি বলি! মনে রেখো! আমার কাছে তোমরা ঠকবাজ!” বলেই দরজার দিকে পা বাড়াল আবির । আর কেউ কোন কথা বলল না । আবির যখন প্রায় দরজার কাছে, ইফাজ তখন বলে উঠলো, “দাঁড়া!” আবির দাড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাল । তারপর আবির বলল, “তোর সাথে একটু কথা আছে, একটু দাঁড়া ।” বলে নিজের রুমের দিকে গেলো ইফাজ । আবির দাড়িয়ে রইল । একটু পর একটা পেনড্রাইভ, একটা বক্স আর গাড়ির চাবি নিয়ে এলো ইফাজ । বক্স আর পেনড্রাইভ আবিরের হাতে দিয়ে বলল, “এই বক্সে একটা চেইন আছে, যেটা ছোট বেলায় তোর গলায় ছিল । আবির বক্সটা খুলে চেইনটা দেখল । তার পাশে একটা মেমোরি কার্ড আর কাগজে লেখা একটা লিঙ্ক । জিজ্ঞেস করলো, “এই মেমোরি কার্ড আর কাগজের লিঙ্ক কিসের!” ইফাজ বলল, “খুব সম্ভবত মেমোরি কার্ড আর এই লিঙ্কে একই জিনিস ছিল, তবে আমার হাতে আসার পর এই মেমোরি কার্ডটা ড্যামেজ ছিল । তাই আমি এর ভেতরের কিছু দেখতে পারিনি । তবে এই লিঙ্কে একটা অডিও পেয়েছিলাম, লিঙ্কটা এখনও আছে কি না আমি জানি না, তবে আমি  এই পেনড্রাইভে ভরে দিয়েছি । তোর কোন কাজে লাগতে পারে ।” আবির পেনড্রাইভটা দেখল । তারপর বলল, “থ্যাংকস, কিন্তু, এসব দিলেই যে আমি এই বাড়িতে ফিরে আসব সেটা ভাববেন না!” ইফাজ বলল, “থাকতে তোকে আমি বলিও নি । চল আমার সাথে ।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “কোথায়?” ইফাজ জবাব দিলো, “তোর জয়নাল জামেনার ছেলে পরিচয়ের কাছে ।”

 

 

 

 

(৫)

আবিরকে নিয়ে রেইলওয়ে ষ্টেশনের কাছে  সেই জে জে রেস্টুরেন্টের সামনে এলো গাড়ি থেকে নেমে আবিরকে নিয়ে এলো রেস্টুরেন্টের সামনের মূর্তিটার  কাছে ।  তারপর আবিরকে বলল, “জানিস  এরা  কারা?”

- “কারা?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “এরা তোকে  ছোটবেলায় মানুষ করেছিলেন ।”

- “এরাই  কি আমার মা বাবা?” খুশি মনে জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “ভালো হতো যদি তোকে  হ্যাঁ বলতে পারতাম । এরা তোকে  কোথা থেকে পেয়েছে,  তার কিছুই জানি না  । সবাইকে এরা জানিয়েছে তুই ওদেরই ছেলে । কাউকে এরা কিচ্ছু জানায় নি, সেটাই আমার জন্য  আসল  সমস্যা  হয়ে দাঁড়িয়েছে  । আমি  বুঝতেই পারিনি তোর  আসল বাবা মা আসলে কে । অনেক খুজেছি, পাইনি ।” বলে মাথা নিচু করলো ইফাজ । আবির  একবার ইফাজের  চোখের দিকে তাকাল । দেখে  মনে হয় না মিথ্যে বলছে । তারপর আবির মূর্তি দুটোর দিকে তাকাল । জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি করে জানলেন এরা আমার আসল বাবা মা নন?” ইফাজ সাথে সাথে জবাব দিলো, “কারণ এর মহিলার শারীরিক সমস্যার কারণে মা হবার ক্ষমতা হারিয়েছিলেন । নিজের গ্রাম ফকিরাপুল থেকে বেউতা গ্রামে কয়েক বছর কাটিয়ে আবার ফকিরাপুল গ্রামে যেয়ে সবাইকে এই দম্পতি জানায় এরা নাকি চিকিৎসা করিয়েছে । কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি এরকম কোন চিকিৎসার  ব্যাপারে শুনিনি । এদের তো এতো টাকাও ছিল না যে বিকল্প পদ্ধতি বেছে নেবে ।  তার চেয়েও বড় প্রমান তোর  চেহারার সাথে এদের চেহারার মিল  নেই । তার ওপর তোর গলায় যেই চেইনে লিঙ্কের ভেতর অডিওটা পেয়েছি, সেটা শুনে যা মনে হয়, হয়তো তোর বাবা সোহেল নামের কেউ ছিলেন । কিন্তু কে সেই সোহেল, তা আমার জানা নেই ।” আবির মূর্তিটার দিকে তাকিয়েই আছে । সেদিকে তাকিয়ে  থেকেই বলল, “মানে এরাও আমাকে ঠকিয়েছে, না?” ইফাজ আবিরের দিকে তাকাল । হালকা রাগ  দেখিয়ে বলল, “আবির! এনারা না থাকলে তুই ছোটবেলায় কার কাছে আশ্রয়ে বাচতি?”

- “কেন? ছোট বেলায় কি কোন যুদ্ধ লেগেছিল নাকি যে আমাকে আমার মা বাবা ছেড়ে কারো আশ্রয়ে বাচা লাগতো? অথবা এনাদেরই কে বলেছিল আমি তাদের সন্তান না এটা সবাইকে না বলতে?” মাথা  নিচু করলো ইফাজ । এর জবাব ওর  কাছে  নেই । আবির জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি করে……আপনি কি  করে জানলেন এদের পরিচয়?” ইফাজ আবিরের দিকে তাকাল । বলল, “কারণ এদের প্রতিবেশী এখানেই   আছে ।” আবিরকে ইফাজ সবটা  খুলে  বলল যা ও রায়হানের পরিবারের কাছে  শুনেছে ।”  আবির বলল, “বাহ, এতবছর পর নিজেকে দেখে মনে হচ্ছে একটা সিনেমার শুটিং  করছি যার গল্পের  কূল কিনারা  এখনও পরিষ্কার না ।”

- “জীবন কি আমাকেও ভালো কিছু দিয়েছে? বাবাকে কষ্ট দিয়েছিলাম,  আজ  তারই  খেসারত হয়তো আমাকে দিতে হচ্ছে । হায়! দ্বীপ যদি কিঞ্চিৎ  তোর মতো  হতো! তাও আমি খুশি হতাম ।” বলেই চুপ হয়ে গেলো ইফাজ । আবির ইফাজের দিকে তাকিয়ে দেখল, ইফাজের  চোখ দিয়ে জল পড়ছে । আবির বলল, “ঠিক আছে, আমি যখন এসেছি, দেখি ওকে বোঝাতে  পারি কি না ।” ইফাজ ডানে বামে মাথা নেড়ে বলল, “না রে, যে ছেলে মা বাবার কথা শোনে না, সে অন্যের  কথা কি করে শুনবে!”

- “চেষ্টা তো করে দেখতে পারি!” বলল আবির । ইফাজ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় মেয়েলি কণ্ঠে কেউ ডেকে উঠলো, “আরে ইফাজ আঙ্কেল!” ইফাজ সামনের দিকে তাকাল । রেস্টুরেন্টের সিঁড়ির ওখানে থেকে নেমে ইফাজের কাছে আসছে একটা মেয়ে । ইফাজের চিনতে ভুল হল না, এটা কলিমা । কলিমা ইফাজের কাছে এসে ঠোঁটে একটা মিষ্টি হাসি নিয়ে দাঁড়ালো । কলিমা বলল, “আরে ইফাজ আঙ্কেল! কেমন আছেন!” ইফাজ বলল, “এইতো মা, ভালো । তুমি কেমন আছো?” কলিমা বলল, “হ, ভালা আছি । আপনে কতো বছর ধইরা আসেন না কন তো!” এরপর কলিমা আবিরের দিকে তাকিয়ে আবার ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “এইডা আপনার পোলা দ্বীপ, না? ওরে তো কখনো দেখিই নাই । মাশাল্লাহ, দেখতে শুনতে  ভালোই হইছে আপনের পোলা ।” ইফাজ মাথা নিচু করে বলল, “ও দ্বীপ না, ও আবির ।” কলিমার মুখের হাসিটা চলে গেলো । আবিরের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ । তারপর জিজ্ঞেস করলো, “আবির! আপনে না কইছিলেন আবির বাসা থেইকা চইলা গেছে!”

- “হ্যাঁ, আজই ও ফিরেছে ।” কলিমা আবিরের গালে হাত রাখল । আবিরের হাত ধরলো । তারপর  জিজ্ঞেস   করলো, “সত্যি কইতাছেন!  এইডা আমাগো সেই পিচ্চি আবির!” ইফাজ বলল, “হুম ।”

 

 

 

 

 

(৬)

কলিমা আনন্দের সাথে বলল, “আল্লাহ! কি পিচ্চি দেখছিলাম! আর অয় তো এহন আমার চেয়েও লম্বা হইয়া গেছে! আল্লাহ বাচায় রাখুক । তা আসেন, রেস্টুরেন্টে খাইয়া যান কিছু!”

- “হ্যাঁ, এসেছি যখন না খেয়ে যাবো না ।” হাসিমুখে ইয়ার্কির সাথে বলল ইফাজ ।

- “হ, যাইয়া দ্যাহেন, ভেতরে ভাইয়া আছে , আমি একটু আইতাছি ।” বলেই বস্তির দিকে চলে গেলো কলিমা ।

ইফাজ আবিরকে নিয়ে ভেতরে গেলো । রিসিপশনে থাকা রায়হানকে চিনতে ভুল হয় না আবিরের । গতকালই তো লোকটা আবিরকে ফ্রিতে পানির বোতল দিয়েছে । আবির খেয়াল করলো ইফাজ এই রিসিপশনের লোকটার কাছেই যাচ্ছে । তবে কি এই-ই বাইরে থাকা ওই কলিমা নামের আপুটার ভাই? হতে পারে । এসব ভাবতে ভাবতে ইফাজের সাথে এগোচ্ছিল আবির । ইফাজ সত্যি রায়হানের কাছে গেলো । আবির রায়হানের নাম জানে না । রায়হান মোবাইলে কি যেন দেখছিল । ইফাজ রায়হানের সামনে এসে উঁকি মেরে কি যেন দেখল রায়হানের মোবাইলে । রায়হান মাথা নিচু করে থাকায় দেখতে পেলো না । আবিরও দেখার চেষ্টা করলো ইফাজ কি দেখছে । দেখল, রায়হান মোবাইলে একটা মেয়ের ফেসবুক প্রোফাইল দেখছে । আর ছবিতে লাভ রিয়েক্ট দিচ্ছে । ইফাজ একটু কেশে বলল, “তো, বিয়েটা কবে হচ্ছে?” কথা শুনে মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে ইফাজের দিকে তাকাল রায়হান । খুশি মনে বলল, “আরে স্যার আপনি!” তারপর মোবাইলটা সামনে রেখে দাড়িয়ে সালাম জানালো । ইফাজ সালামের জবাব দিয়ে বলল, “ভালোই তো ব্যাবসা চলছে মনে হয়, কার যেন ছবি দেখা হচ্ছিলো?” রায়হান একটু লজ্জা পেলো । তারপর আমতা আমতা করে বলল, “দেখে ফেলেছেন তাহলে!” ইফাজ একটু হাসল । তারপর বলল, “তারপর, রেস্টুরেন্ট কেমন চলে?”

- “এইতো, আল্লাহর রহমতে আর আপনাদের দোয়ায় খুব ভালো, বাইচা আছি, এক কালে যতোটুকু ভালো থাকমু ভাবছিলাম, তার চেয়েও ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ ।” বলল রায়হান ।

- “যাক, ভালোই হলেই ভালো । তা, মেয়েটা কে ছিল শুনি?” ইয়ার্কি করে বলল ইফাজ ।

- “আর বইলেন না, একটা মাইয়া প্রতিদিন আসে রেস্টুরেন্টে । প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আইসা খাইয়া যায়, আর যাওয়ার সময় আমার সাথে কথা বইলা যায় । আমি ওরে দেইখা পছন্দ করছি তা না, ও-ই আমারে দেখে নাকি পছন্দ করছে । একদিন দেখি ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট-ও পাঠাইছে । তাই আর কি । তবে পছন্দ করি না দেইখা মাইয়া যে দেখতে খারাপ তা কমু না ।” বলল রায়হান ।

- “ও, মানে বোঝা গেছে, তুমি পড়েছ প্রেমের  ফাঁদে ।” ইয়ার্কি করে বলল ইফাজ ।

আবির এতক্ষণ কথাগুলো শুনছিল আর হালকা হাসছিল । এক পর্যায়ে ইফাজকে বলল, “ইনি খুব ভালো মানুষ, গতকাল এই রেস্টুরেন্টে এসেছিলাম, উনি আমাকে উনার পানির বোতল ফ্রিতে দিয়ে  দিয়েছেন ।” রায়হান এতক্ষণ আবিরকে খেয়াল করে নি । আবির কথা বলে উঠতেই আবিরের দিকে তাকিয়ে রায়হান হাসিমুখে বলল, “আরে আপনে!” ইফাজ রায়হানকে বলল, “একি, আপনি কেন বলছিস, এ তো তোদের জয়নাল চাচা আর জামেনা চাচির ছেলে, আবির, রায়হান কথাটা শুনে আবিরের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ । তারপর বলল, “আবির! সত্যি এইডা আবির!” ইফাজ বলল, “হ্যাঁ রে হ্যাঁ, এটা সেই পিচ্চি আবির ।” রায়হান জিজ্ঞেস করলো, “ও নাকি চইলা গেছিলও আপনাদের ওপর অভিমান কইরা?”

- “হ্যাঁ, কালই আবার ফিরেছে ।” বলল ইফাজ ।

রায়হান হাসিমুখে বলল, “যাক, আলহামদুলিল্লাহ ।” তারপর আবিরকে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে, আছিস কেমন?”

- “আলহামদুলিল্লাহ, ভালো । আপনি?” বলল আবির ।

- “একটু আগেও এতোটা ভালো ছিলাম না যতোটা তোর পরিচয় জাইনা ভালো  লাগতেছে ।” বলল রায়হান ।

আবির একটু হাসল  কিছু বলল না । রায়হান ইফাজকে বলল, “আরে,  আমি কি ব্যাক্কেল!   আপনাদের  দাঁড়  করাইয়া  রাখছি! বসেন আমি  আপনাদের কিছু নাস্তার  ব্যাবস্থা করি ।” বলে ইফাজ আবিরকে নিয়ে যেতে  লাগলো । রায়হান খেয়াল করলো ইফাজ খোঁড়াচ্ছে, কিন্তু কিছু আর জিজ্ঞেস করলো না তেমন । টেবিলে বসে আবির জিজ্ঞেস করলো, “কিছু মনে কোরো না । এই যা! আবার তুমি বলে ফেললাম, সরি, আপনার পায়ে কি হয়েছে?”

- “তেমন কিছু না । বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম ।” বলল ইফাজ ।

আবির কিছু  একটা বলতে যাবে এমন সময় এক ওয়েটার এসে বলল, “আরে স্যার! আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন?” ইফাজ চিনল একে । এক সময় যেসব ছোট পিচ্চিদের নিয়ে এলাকায় ঘুরে  বেড়াতো রায়হান, তাদেরই এক পিচ্চি, এখন যদিও আর পিচ্চি নেই,  আবিরে চেয়েও বড় । ইফাজ হাসি মুখে বলল, “হ্যাঁ,  আলহামদুলিল্লাহ  ভালো,  তুমি কেমন আছো?”

- “জি স্যার, আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি । কি খাবেন স্যার বলুন, রায়হান ভাই পাঠাল ।” -বলল ওয়েটার ।

ইফাজ জিজ্ঞেস করলো, “কি কি আছে?” ওয়েটার একটা কার্ড ইফাজের হাতে দিলো । কার্ড দেখে ইফাজ বলল, “তিন প্লেট কাচ্চি বিরিয়ানি দাও, আর রায়হানকে বলো ও যেন একটা আমাদের এখানে আসে ।” ওয়েটার “আচ্ছা স্যার, আসসালামু আলাইকুম ।” বলে সেখান থেকে চলে গেলো । আবির জিজ্ঞেস করলো, “তিন প্লেট?” ইফাজ বলল, “হুম । তোর, আমার আর রায়হানের ।

- “রায়হান বলতে রিসিপশনে যিনি ছিলেন উনি?”-জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “হুম ।” বলল ইফাজ”

 

 

 

 

 

 

(৭)

একটু পর রায়হান রিসিপশনে অন্য কাউকে বসিয়ে দিয়ে এলো আবির  আর ইফাজের কাছে । রায়হান ইফাজকে বলল, “স্যার, আমাকে নাকি ডাকছেন?”

- “হ্যাঁ, আসলে কতো বছর পর এলাম, একটু কথা বলি না হয় তোর সাথে ।” হাসিমুখে বলল ইফাজ ।

- “হ, বলেন । সমস্যা নাই । আপনার বাসার সবাই কেমন আছে?” জিজ্ঞেস করলো রায়হান ।

- “আছে । আলহামদুলিল্লাহ ভালো । আসলে, চাকরি শেষ হবার  পর থেকেই টাকা পয়সা নিয়ে একটু ঝামেলা  হচ্ছিলো, এখন একটা কোম্পানিতে কাজ নিয়েছি, দেখি, কদ্দুর পারি ।” বলল ইফাজ ।

- “আপনেরা এতো বড়লোক মানুষ, তাও ট্যাকা নিয়া সমস্যা?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো রায়হান ।

ইফাজ আর কোন জবাব দিলো । আবির কিছু না জিজ্ঞেস করলেও বুঝতে পারলো, দ্বীপের জন্য ইফাজের আর এরকম দুর্দশা । নিজের বাড়িটা ছিল আর কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে, এই রক্ষে । তা না হলে আজ হয়তো পথে বসতে হতো । ইফাজের ফোনে তখন একটা কল এলো । কোম্পানি থেকে হয়তো কল করেছে । আবির  জিজ্ঞেস করলো, “কার কল ?” ইফাজ আবিরের জবাব না দিয়ে “তোরা কথা বল, আমি একটু কথা বলে আসি” বলেই উঠে বাইরে চলে গেলো । রায়হান তখন আবিরকে জিজ্ঞেস করলো, “তা আবির, তুই কি আবার চইলা যাবি, নাকি থাকবি?

- “না না, এবার থাকতে এসেছি ।” জবাব দিলো আবির ।

- “হ, ছোটবেলায় জয়নাল চাচা আর জামেনা চাচি চইলা যাওয়ার পর ইফাজ স্যার তোমারে বাড়িত নিয়া যাইয়া নিজের পোলার মতো মানুষ করছে । তুই তো রাগ কইরে চইলা গেলি । তাও দেখিস, লোকটা তোর কতো যত্ন করে ।” হাসিমুখে বলল রায়হান ।

আবির  কিছুক্ষণ থেমে বলল, “না না, আসলে আমি ইফাজ আঙ্কেলদের বাসায় যাবো না ।” রায়হানের হাসিমুখটাও চলে গেলো । আবির আরও বলল, “আমি কোথায় থাকবো নিজেও জানি না । আমার এক মাতৃতুল্য আপু  আমাকে এখানে পাঠালেন উনার একটা সেবা সংঘের এখানে একটা শাখা আছে । সেখানে থাকতে ।” রায়হান একটু থেমে বলল, “কেন, তুই ইফাজ স্যার এর বাসায় থাকবি না ক্যান?”

- “ওটা তো আমার নিজের পরিচয় না, তাইনা? অন্যের আশ্রয়ে বাঁচতে নিজের কাছে কেমন যেন লাগে । আগে তো অনাথ আশ্রমে ছিলাম । তবে অনাথ আশ্রম আর বাসা তো এক না ।” রায়হান তখন আবার বলল, “আচ্ছা, তুই ইফাজ স্যার এর বাসায় না থাক, আমাদের বস্তিতে থাক, তোরে যারা পালতো, তারা তো এইখানেই ছিল এক সময় ।”

- “উনারাও তো আমার  আসল বাবা মা ছিলেন না, তাই না?” বলল আবির ।

- “আরে তাতে কি? বস্তিতে সব পরিবার একসাথে থাকে । এইখানে তো মানুষের আশ্রয়েই জন্যেই আসে । আর তোর তো এইখানে আমাদের দয়ায় বাচা লাগবে না, তুই চাইলে, এইখানে আমাদের হোস্টেলে কাম করতে পারিস । নিজের টাকায় খাবি, এইবার ঠিক আছে?” বলল রায়হান ।

আবির চিন্তা করতে লাগলো । কথা ভুল বলে নি । একটু পরই কথা বলা শেষে ইফাজ এলো । ইফাজ এসে বসতেই খাবার নিয়ে হাজির ওয়েটার । তিনটা প্লেট এনে টেবিলে রাখল । রায়হান ওয়েটারকে বলল, “কিরে? তিনটে কেন আনছিস, এরা ২জন না? কানে কি একটু বেশি শুনিস নাকি?” ইফাজ বলল, “আরে না না, আমি-ই তিনটে অর্ডার করেছি । তুইও আজ আমাদের সাথে খাবি ।” রায়হান বলল, “আপনি পারেনও স্যার, তবে বিল তো  আপনাদের আমি দিতে দেবো  না ।

- “এ কি কথা, বিল দিতে দিবি না মানে? ঢং করিস না ।” বলল ইফাজ ।

- “স্যার, আপনি আমাদের এই বস্তিবাসীর জন্য যা করছেন, এইডা কি কম না, আপনার ঋণ হয়তো শোধ করতে পারবো না, তবে এইটুকু আবদার অন্তত রাখেন, প্লিজ!” অনুরোধের সাথে বলল রায়হান । তিনজনই খাওয়া শুরু করলো । খাওয়া শেষে আবিরকে নিয়ে ইফাজ আশপাশ ঘুরে দেখাল, বস্তিটাও দেখাল । খারাপ না । আগে তো আরও নোংরা ছিলো, এখন তো তাও ভালো আছে সেই এক কালে ইফাজ পরিকল্পিতভাবে টিনের বাড়ি করে দিয়েছিলো বলে ।

যোহরের নামায শেষে মসজিদ থেকে বেড়িয়ে রায়হান আর ইফাজকে রেস্টুরেন্টের সামনেই পেলো আবির । এগিয়ে গেলো ওদের দিকে । ইফাজ বলল, “তোকে যা দেখানোর ছিল, তা দেখান হয়ে গেছে । এবার চল, যাই ।” আবির তখন বলল, “আমি একটা কথা বলবো ।” ইফাজ রায়হানকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, থেকে যেয়ে আবিরের দিকে তাকাল । আবির বলল, “আমি চাই এই বস্তিতেই থাকতে, আর এই রেস্টুরেন্টে কাজ করে টাকা উপার্জন করতে ।” ইফাজ কিছু বলল না । চেহারায় কোন পরিবর্তন না এলেও মনে হয় না এ কোথায় ও অসন্তুষ্ট হয়েছে । রায়হান কিন্তু বেশ খুশি হল । বলল, “বাহ! এতো ভারি খুশির খবর! আমার পাশেই একখান রুম ফাঁকা আছে । যদিও ছোট, কিন্তু বস্তির লোকেরা তো ওই রুমেই ৪-৫ জন থাকে ।” আবির একটু হেসে বলল, “আরে ধুর, আমার জন্য এতোটাও স্যাক্রিফাইস করার দরকার নেই ।”

- “আরে! তুমি ছাত্র মানুষ । এইখানে কি একখান কলেজে ভর্তি হইছো, তোমার জন্য বেশি যায়গাই দরকার । পড়াশুনা করা লাগবে না?” বলল রায়হান ।

আবির কিছু বলল না । ইফাজ তখন থেকে আবিরের দিকে তাকিয়ে । রায়হান বলল, “দাঁড়া, ওই রুমটা একটু এলোমেলো হইয়া আছে মনে হয়, আমি একটু ঠিক কইরা দিয়া আসি ।” রায়হান চলে যাচ্ছিলো, ইফাজ ডেকে দাঁড় করিয়ে বলল, “শোনো রায়হান, আমি তাহলে চলে যাবোনে, ভালো থেকো ।” রায়হান ইফাজকে, “আচ্ছা স্যার, আপনিও ভালো থাইকেন, মাঝে মাঝে আইসেন ।” বলে চলে গেলো রায়হান । আবির ইফাজের সাথে গাড়ির কাছে গেলো । আবির গাড়িতে সব জিনিস এনেছিলো । সেগুলো বের করে নিলো । ইফাজ গাড়িতে উঠে বসলো ।

 

 

 

 

 

(৮)

আবির জানালার কাছে দাড়িয়ে বলল, “তুমি মিথ্যে বলেছিলে, বাথরুমে পিছলে তোমার পা ভেঙ্গে যায় নি । তোমার পা ভেঙ্গেছে দ্বীপের অসভ্যতামোর জন্য । আমি দেখেছি ফেসবুকে ।” ইফাজ কিছু বলল না । আবির একটু থেমে বলল, “ও সরি, আবারও তুমি বলে ফেললাম ।” ইফাজ কিছুক্ষণ সামনের দিকে তাকিয়ে তারপর আবিরের দিকে তাকাল । তারপর আবিরের গালে হাত বুলিয়ে বলল, “সরি বলার কিছুই নেই, তুই আমাকে বাবা না-ই ভাবতে পারিস, কিন্তু আমি তোকে এখনও নিজের ছেলের মতো ভালোবাসি । বলে গাড়িটা স্টার্ট করে চলে গেলো ইফাজ । আবির ইফাজের গাড়ির দিকে যতদূর দেখা যায়, তাকিয়ে রইল । আবিরের নিজেকে কেমন যেন দোষী মনে হচ্ছে । জেদটা কি আসলেই একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে?

বস্তির দিকে আর গেলো না আবির । রেস্টুরেন্টেই গিয়ে বসলো । ঢোকার সময় একবার জয়নাল আর জামেনার মূর্তিটার দিকে তাকাল । মোবাইলটা হাতে নিলো । রাত থেকে যা হচ্ছে, মোবাইলটা ধরার-ই সময় পায়নি । দেখল, রাজের ৩২টা মিসকল আর সোমা আপুর ৪টা কল । আবির রাজের আগে সোমা আপুকেই কল করলো, কারণ এখন সোমা আপুকেই আগে জানানো দরকার, নিজের একটা ঠাই সে করতে পেরেছে । সোমা আপুকে কল করতেই কল ধরল রাকিব ভাই । ফোন ধরেই রাকিব ভাই বলল, “হ্যালো আবির, কিরে ফোন ধরিস না কেন?” আবির থেমে থেমে বলল, “না রাকিব ভাই, আসলে পুরনো স্মৃতি দেখতে গিয়ে মোবাইলের কথা ভুলে গিয়েছিলাম ।”

- “হুম বুঝেছি, ছোট বেলার কোন বান্ধবীরে পেয়েছিস বোধ হয় ।” ইয়ার্কির সাথে বলল রাকিব ভাই ।

- “কি যে বলেন না ভাই ।” হালকা কষ্টের মাঝেও একটু হাসবার চেষ্টা করে বলল আবির ।

- “আচ্ছা বাদ দে, তোর সোমা আপু টেনশন করছিলো । জানতে চাচ্ছিলো কোন ব্যবস্থা করেছিস কি না নিজের । আসলে ওই ওদের সংঘের ঢাকার সদস্যদের সাথে কথা বলা লাগবে তো ।” জানতে চাইলো রাকিব ভাই ।

- “জি ভাই, একটা ব্যবস্থা হয়েছে আমার, আলহামদুলিল্লাহ, অনেক ভালো একটা ব্যাবস্থা ।” বলল আবির ।

- “সত্যি! যাক আলহামদুলিল্লাহ । কোথায় থাকার ব্যবস্থা হল তাহলে?” খুশিতে জানতে চাইলো রাকিব ভাই ।

- “ভাই, জানতে না চাইলে খুশি হবো ।” বলল আবির ।

“কিন্তু……।” কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো রাকিব ভাই কিন্তু আবির তার আগেই বলল, “প্লিজ ভাই!” রাকিব ভাই আর কিছু বলল না । তবে একটু আগে রাকিব ভাই যেটুকু খুশি ছিল, সেটুকু যে বিদায় নিয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে । আবির জিজ্ঞেস করলো, “সোমা আপু কোথায়?”

- “তোর সোমা আপু বাবুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে ।” বলল রাকিব ভাই ।

- “ডাক্তারের কাছে! কি হয়েছে?” হালকা ভয় পেয়ে জানতে চাইলো আবির ।

- “আরে না না, তেমন কিছু না । ওই হালকা ঠাণ্ডা কাশি । তা ভুলে মোবাইলটা ফেলে গেছে বলে আমি  ধরলাম ।” হালকা হেসে বলল রাকিব ভাই । আবির আর কিছু বলল না । রাকিব ভাই বলল, “আচ্ছা, থাক তাহলে, তোর সোমা আপু এলে আমি জানিয়ে দেবো ।” আবির বলল, “আচ্ছা ভাই, আসসালামু আলাইকুম ।” তারপর ফোন কেটে দিলো । রাজকে ফোন দিতে  যাবে, এমন সময় রায়হান আর কলিমা এলো রেস্টুরেন্টে । ঢুকেই রায়হান কলিমাকে আবিরকে দেখিয়ে বলল, “ওই যে দ্যাখ আবির ।” তারপর কলিমা আর রায়হান আবিরের কাছে এলো । আবির ওদের দেখে উঠে দাঁড়ালো । দুজনেরই মুখে হাসি । আবির জিজ্ঞেস করলো, “আপনারা, আমাকে খুঁজছেন কি?” রায়হান বলল, “আরে আপনি কেন, আমরা তো তোর ভাই বোন, তুমি কইরা বলবি । কোন সমস্যা নাই । হ শোন, চল, তোরে দেখাই তোর রুমডা ক্যামনে সাজাইছি ।” আবির হালকা হেসে বলল, “আরে, তোমাদের এতো পাগলামো করার কি দরকার ছিল?” রায়হান বলল, “আরে, আমাদের আমাদের জন্য করছি, পাগলামির কি আছে, তুই-ই ক? চল যাই, তোরে নিয়া দেখাই ।” আবির বলল, “ঠিক আছে, চলো ।” আবির গেলো কলিমা আর রায়হানের সাথে । আবিরের জন্য ওদের রাখা রুমটা দেখাল । ভেতরে ঢুকেই চারপাশে তাকাল আবির । টিনের দেয়াল, টিনের চাল । তবে আসবার সময় অন্যান্য যে সব রুমগুলো দেখেছে, তার চেয়ে মোটামুটি ভালোই বড় তবে অতোটাও বড় নয় । একটা চারপায়ায় নতুন চাদর বিছিয়েছে, বালিশ আর কোলবালিশও আছে সাথে । এক পাশে একটা টেবিল । টেবিলের পেছনের ডানপাশের পায়াটা খানিক ভাঙ্গা, ইট দিয়ে সেটাও সোজা করে দাঁড় করিয়েচ রাখা হয়েছে । মাটির মেঝে । এমনিতে তেমন সুন্দর না হলেই বস্তির অন্যান্য বাড়ির সাথে তুলনা করলে বেশ ভালো । বস্তির অন্যান্য বাড়ির চেয়ে বড় হলেই মাত্র এই একটা টেবিল আর চারপায়া থাকা সত্ত্বেও মনে হচ্ছে যেন ঘরটা কতো কিছু দিয়ে ভরা । আবিরের কিন্তু এসব জিনিসের দিকে তেমন খেয়াল নেই । ও শুধু তাকিয়ে বারবার কলিমা আর রায়হানের চেহারা দেখছে । এ যুগেও এমন ভালো মানুষ আছে, আপন নয়, তবুও যেন আপনের চেয়েও বেশি কেউ । বস্তির অন্যান্য লোকেরাও এসেছি আবিরকে দেখতে ।

 

 

 

 

 

(৯)

একটু পর রায়হান সবাইকে “এই যাও যাও তোমরা, ছেলেটাকে একটু বিশ্রাম নিতে দাও ।” বলে সেখান থেকে সরিয়ে দিলো । তারপর কলিমা বলল, “কিরে ভাই, পছন্দ হইছে?” আবির হাসিমুখে বলল, “হুমম, যতোটা এই রুমটা পছন্দ হয়েছে, ততোটা পছন্দ হয়েছে তোমাকে আর রায়হান ভাইকে পেয়ে । সত্যি, আমি খুব ভাগ্যবান ।” কলিমা হালকা হেসে বলল, “আরে, লজ্জা দিস না, যাইয়া একটু ঘুমা তো এইবার, সকাল থেইকা ঘুরতেছোস । দুপুর তো হইয়াই আইলো, কি খাইবি, বল ।” আবির বলল, “না না আপু, এখন কিছু খাবো না । একটু আগে কাচ্চি বিরিয়ানি খেয়েছি । একেবারে রাতে খাব । আর আমার খাওয়া নিয়ে চিন্তা করা লাগবে না । তোমরা যা চাও, তাই আমাকে দিয়ো ।” কলিমা হালকা হেসে বলল, “আইচ্ছা, এখন তাইলে তোরে একটু একা থাকতে দেই ।” বলে রায়হানকে নিয়ে চলে গেলো কলিমা । রায়হান আর কলিমা চলে গেলে আবির ব্যাগগুলো রুমের এক পাশে রেখে দরজা আটকে দিয়ে চারপায়ায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো । গত রাতে ঘুম হয় নি । তাই খুব ক্লান্ত লাগছে । টিনের চালের একটা ছিদ্র দিয়ে হালকা আলো আসছে । আবির সেদিকেই তাকিয়ে রইল । বারবার ইফাজের কথাটা মনে পড়ছে । লোকটা বোধ হয় খুব কষ্ট পেয়েছে আবিরের জেদের জন্য । যাই হোক, একটা ব্যবস্থার দরকার ছিল, আল্লাহর রহমতে হয়ে গেছে, আবির এতেই খুশি । আচ্ছা, রেস্টুরেন্টে কাজ করা লাগবে তো । খুব সম্ভবত ওয়েটারের কাজ । তখন আবিরের পরিচয় কি হবে, ওয়েটার আবির । না? ভাবতেই আবিরের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো । আরও অনেক উল্টোপাল্টা কথাবার্তা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলো আবির ।

ঘুম ভাঙল মাগরিবের আজান শুনে । এতো সময় হয়ে গেছে টেরও পায় নি । উঠে বসলো আবির । মনে পড়লো, আসরের নামাজটা পড়া হয় নি ওর । উঠে মসজিদে যেয়ে মাগরিবের নামাজ পড়ে পরে আসরের নামাজটাও কাযা করে নিলো । মসজিদের দিকে যাবার সময় কলিমা বা রায়হান কারো সাথেই আবিরের দেখা হয় নি তবে মসজিদ থেকে ফিরবার পথে দেখা এক লোকের সাথে । হেঁটে হেঁটে যাবার পথে লোকটাকে দেখছিল আবির । মোটামুটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে বলেই মনে হচ্ছে । আবির লোকটা দিকে নজর দিলো এ কারনেই, লোকটা বার বার বস্তির দিকে তাকাচ্ছে আর কি নিয়ে যেন খুব চিন্তা করছে । আবির তবু পাত্তা না দিয়ে চলে যেতে নিলেও লোকটা আবিরকে পিছু ডাকলো । বলল, “এই যে ভাই, একটু শুনবেন প্লিজ?” আবির লোকটার কাছে । গেলো । জিজ্ঞেস করলো, “আমাকে ডাকছেন?” লোকটা বলল, “ইয়ে মানে, তুমি এই এদিকে  কোথাও যাচ্ছ?” বস্তির  দকে  ঈশারা করে  দেখিয়ে লোকটা  বলল ।

- “কে  আপনি? আমি কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি এটা জেনে আপনার কি?” জিজ্ঞেস  করলো আবির ।

- “আহহা! রাগ করছ  কেন? আমি তো আর  কোন গোয়েন্দা  পুলিশ  টুলিশ না ।”  আবিরকে অভয় দিয়ে বলল লোকটা ।

- “আপনি যে গুন্ডা মাস্তান বা গুপ্তচর নন তার-ও তো কোন গ্যারান্টি নেই, তাই না?” হালকা বিরক্ত হয়েই কথাটা বলল আবির ।

- “আরে না না!  এসব  কিছুই না । আসল……।” কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো লোকটা, কিন্তু আবির না শুনেই চলে গেলো । লোকটা থেমে যেয়ে দাঁড়িয়েই রইল । নজর উনার আবিরের দিকেই । আবির যেই না বস্তির দিকে যাচ্ছিলো, এমন সময় লোকটা “দাঁড়াও!  দাঁড়াও!” বলতে বলতে আবিরের কাছে গেলো । আবির লোকটার ডাক শুনে দাড়িয়ে গেলো । লোকটা তখন বলল, “আরে! তুমি তো এদিকেই যাচ্ছ দেখছি! তা শোনো না খোকা………।” আবির লোকটাকে থামিয়ে হালকা রেগে বলল, “দয়া করে খোকা বলবেন না প্লিজ! আমি আপনার সামনে জলজ্যান্ত এক তরুন ।”

- “আচ্ছা ঠিক আছে তরুন । আমাকে একটা কাজ করে দিতে পারবে তরুন?” বলল  লোকটা ।

- “শুনুন, আমার নাম আবির আমাকে আবির বলেই ডাকবেন ।” আবারও বিরক্ত হয়ে বলল আবির ।

- “আচ্ছা আবিরুন……।”

- “আবিরুন না আবির আবির!” আরও বিরক্ত হয়ে বলল আবির ।

- “ভাই মাফ করো! এইবার কথাটা শোনো প্লিজ?” হাত জোড় করে অনুরোধের সাথে বলল লোকটা।

- “ঠিক আছে, শুরু করেন ।” বলল আবির ।

 

 

 

 

 

 

(১০)

লোকটা বলা  শুরু  করলো, “আমি শাফায়েত রহমান শাফি । এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে । আমি পড়াশুনা করেছি ক্লাস নাইন পর্যন্ত । তারপর থেকে বাবার  দোকানে কাজ করতাম । পড়াশুনা  আর হয়  নাই । বাপের  দোকানের কাজ-ই আমার  পেশা হয়ে যায়     মতিঝিলেই রাস্তার পাশে এক দোকানে কাজ করি । একদিন ঘটনাক্রমে দেখা হয় কলিমার সাথে । ও আমার চেহারার চেয়ে   ভাষার পাগল ছিল । আমি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলি । ওর সাথে আমার বিয়েই  হয়েছে, কিন্তু এই নিয়ে ৩৪বার ও বাসা থেকে রাগ করে চলে এলো ।” আবির শুনছিল । লোকটার কথা শেষ হলে আবির ওপর নিচ মাথা নেড়ে বলল, “তা এখন কি চান?”

- “আমার বউয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে ওকে নিয়ে যেতে চাই ।” বলল লোকটা ।

- “আপনি কি রায়হান্ ভাইয়ের বউ কলিমা  আপুর কথা বলছেন?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

লোকটার চোখে মুখে আনন্দের ছাপ ফুটে উঠলো । আনন্দের সাথে বলল, “আরে রে রে রে রে! কলিমা বুঝি তোমার পরিচিত?”

- “হুম, আমার বোন হয়ে, আপন না, প্রতিবেশী বোন বলতে পারেন । তবে আপন বোনের চেয়ে কম না ।” বলল আবির ।

- “বা বা বা বা, তাহলে কাজতো খুব সহজ হয়ে গেলো । শোনো………।”

আবারও শাফির কথা শেষ করতে না দিয়েই আবির বলে উঠলো, “এটা কি পার্সোনাল ব্যাপার নাকি? আমার আবার অন্যের পার্সোনাল ব্যাপার শুনতে ভালো লাগে না ।” শাফি  লোকটা  প্রায়  কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “ওরে ভাই না রে, না!  পার্সোনাল ব্যাপার না! তুমি কি এখন আমাকে  কিছু বলতে দেবে?”  আবির মুচকি মুচকি হাসল । কিছু বলল না । লোকটা আবার শোনো বলতে  যাবে, এমন সময় বস্তির মধ্যে কি দেখে দিলো বস্তির বিপরীত দিকে এক দৌড় । আবির কিছুক্ষণ লোকটার দিকে তাকিয়ে আবার পেছন ফিরে বস্তির দিকে তাকিয়ে দেখল, কলিমা আপু হাতে লম্বা একটা ঝাড়ু নিয়ে আসছে । মনে যেন সিংঘাম কোন চোরকে ধাওয়ার করতে আসছে । আবির প্রথমে বুঝতে পারে নি এটা কলিমা আপু । ভয়ে নিজেও দৌড় দিতে যাচ্ছিলো, এমন সময় কলিমা আপু আবিরকে থামাল । বলল, “এ আবির! তুই পালাস ক্যান? দাঁড়া!” আবির দাড়িয়ে গেলো । শাফি নামের লোকটা এতক্ষণে দৃষ্টির বাইরে চলে গেলো । আবির কলিমা আপুকে বলল, “উফ আপু!  যা একটা দৌড় দিয়েছ  না!  আমি নিজেই ভয়  পেয়ে  গেছি!” কলিমা  আপু আবিরের মাথায় হাত রেখে বলল, “আরে, ভয় নাই । চল যাই ভেতরে । এইসব লোকের লগে  কথা কইবি না ।” আবির  আর কলিমা বস্তিতে ঢুকল ।  নিজেদের রুমের  দিকে দিকে যেতে যেতে  কিছু কথা বলল । আবির কলিমা আপুকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা আপু,  ভাইয়ার সাথে কি ব্যাপারে   ঝগড়া হয়েছে?”

- “আর কইস না । এ জামাই এক নাম্বারের ভাদাইম্মা । সেইদিন ওরে কইছি লাউ আনতে । হেয় বাজারে গেছে । দেখছে ছোট লাউয়ের যা দাম, বড় লাউয়েরও তাই দাম ।  হেয়  বড় লাউ কিনা বাসায়  আইনা কয় জিতা গেছে । পড়ে ভাদাইম্মা   এই জানে না, ছোট কচি লাউ খাইতে বেশি মজা । এহন আইসা বস্তির যারেই পায়, তার হাতেই কিছু না কিছু দিয়া আমারে পাঠাইয়া আমার রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে ।” বলল কলিমা আপু 

- “এই একটা ব্যাপারেই এতো ঝগড়া?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “আরে না না । এইরকমই প্রতিদিনই ও কিছু না কিছু গাধার মতন কাম করে ।” বলল কলিমা আপু ।

- “ও আচ্ছা । যাক, তাও ভালো । ভালোবাসায় একটু ঝগড়া না থাকলে ঠিক জমে না ।” বলল আবির ।

কলিমা আপু   এতক্ষণ শাফির ওপর রাগ দেখিয়ে অনেক কথাই বলছিল । এখন একটু রাগ  কমিয়ে বলল, “ভালো তো ওরে আমি বাসি । এইসব  কারণেই তো ভাল্লাগে না । তার  ওপর মা বাপ মইরা যাওয়ার পর ভাইয়াডা একা  এই রেস্টুরেন্ট সামলায় । তাই  ভাইয়ার লগে দেখা করতে  আসি । বাসা তো আমার  শ্বশুর বাড়ি  তো বেশিদুরে না । যাবি নাকি একদিন?” আবির ডানে মাত্থা কাত করে বলল, “আচ্ছা, যাবো কোন একদিন । রায়হান ভাইয়া কোথায়? আমি রেস্টুরেন্টে কাজ  করবো না?” কলিমা আপু বলল, “আরে! তুই  এতো  ব্যাস্ত  হস  ক্যান? আইজকাই  আসলি,  এক দিন না হয় রেস্ট কর!”

- “আচ্ছা রায়হান ভাই কোথায় সেটা তো বলো?” জিজ্ঞেস  করলো আবির ।

- “হেয় তো রেস্টুরেন্ট ছাড়া আর কোথাও  যায় না । দেখ, ওইখানেই আছে ।” বলল কলিমা আপু ।

আবির, “আচ্ছা” বলে রেস্টুরেন্টের দিকে পা বাড়াল ।

 

 

 

 

 

 

 

(১১)

ক্যাশ কাউন্টারেই বসে ছিল রায়হান ভাই । আবির ভেতরে যেয়ে বসলো । রায়হান ভাই ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আচ্ছা, আচ্ছা আসো তাইলে, আচ্ছা বাই ।” ফোনটা সামনে রেখে  আবিরকে জিজ্ঞেস  করলো, “কিরে আবির কি অবস্থা?”

- “এইতো ভাই, চলতেছে ।” জবাব দিলো আবির ।

- “আচ্ছা, তোর কলেজ কবে থেকে রে?” জানতে চাইলো রায়হান ভাই ।

- “এইতো, পরশুদিন নবিন বরণ । তারপর থেকেই ক্লাস শুরু ।” বলল আবির ।

- “তোর ইউনিফর্ম  বানানো লাগবো না?” জানতে চাইলো রায়হান ভাই ।

- “হুম, তা তো লাগতোই । আমার কাছে  কিছু টাকা আছে, ওখান থেকে ম্যানেজ করে নেবো ।”

- “পারবি তো? নাহলে কিন্তু আমার কাছ  থেকে  নিস । লজ্জা করিস না, নিজের  ভাই ভেবে নিস ।” বলল রায়হান ভাই ।

- “আচ্ছা  ঠিক আছে ।” হেসে হেসে জবাব দিলো আবির । এরই মধ্যে কাউন্টারে এক কাস্টমার এলো ক্যাশ দিতে । রায়হান ভাই ক্যাশ নিতে লাগলো । আবির এর মাঝে বলল, “আজকে কলিমা আপুর স্বামী এসেছিলো । আমাকে দিয়ে কলিমা আপুকে কিছু দিয়ে রাগ ভাঙ্গানোর জন্য ।” রায়হান ভাইয়ের মুখের ভঙ্গির কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা গেলো না । সে টাকা গুণতে  গুণতেই বলল, “আহাম্মকটা মানুষ হবে না ।” আবির আর কিছু বলল না । টাকা দেয়া হলে কাস্টমার চলে গেলে তাদের পেছন থেকে একটা মেয়ে  সামনে এলো । বেশ সুন্দর-ই দেখতে । ক্যাশ কাউন্টারে এসে রায়হান ভাইয়ের কাছেই এলো । আবির মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে মেয়েটা মেয়েটা আবিরের দিকে তাকিয়ে হাত তুলে হাসিমুখে বলল, “হাই!” আবিরও হাই জানালো, তবে মুখের হাসিটা জোড় করে বের করলো । রায়হানের কাছে আসতেই আবির রায়হান ভাইয়ের মুখের ভঙ্গি দেখতে চাইলো । যা বুঝল, রায়হান ভাই চেনে । রায়হান ভাই আবিরকে দেখিয়ে মেয়েটাকে বলল, “এ আমার জয়নাল চাচা আমি জামেনা চাচিমার ছেলে, বলতে গেলে আমার ভাই! আবির ।  পুরো নাম সালমান খান আবির ।” মেয়েটা ইয়ার্কি করে বলল, “বাহ! নামেও যেমন নায়কদের বাহার, চেহারাও তেমন মাশাআল্লাহ নায়কদের মতোই । আমার তো এখন তোমাকে ছেড়ে ওর সাথে প্রেম করতে ইচ্ছে করছে । আবির মুচকি হাসল । রায়হান ভাই বলল, “হ্যাঁ করো না, সমস্যা নেই ।” আবির দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার নামটা জানতে পারি?” মেয়েটা হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে বলল, “হাই দেওর, আমি লিলি । শারমিনা আক্তার লিলি ।” আবির হ্যান্ডশেক করলো । তারপর রায়হান ভাই আবিরকে বলল, “আবির, তুই একটু যা, পড়ে আসিস আবার ।” লিলি রায়হানকে বলল, “থাকুক না, সমস্যা কি? আমরা তো এমন কিছু প্রাইভেট কথা বলি না ।” আবির হাসিমুখে বলল, “না না লিলি আপু, আপনারা কথা বলুন, আমি আসছি ।” বলে আবির চলে এলো । লিলি ক্যাশ কাউন্টারের ভেতর ঢুকে বসলো । তারপর রায়হানকে বলল, “তোমার এই ভাইকে তো আগে কোনদিন দেখিনি?” রায়হান বলল, “শোনো……।” এরপর রায়হান লিলিকে আবিরের সম্পর্কে বলতে লাগলো ।

আবির নিজের রুমে ঢুকল । নামাজে মোবাইলটা নিয়ে যাওয়া হয় নি । মোবাইলটা হাতে নিলো । দেখল, রাজের এতোগুলো  কল । নিশি, নাবিলা, পরশ, জামি, শিমুলের কলও আছে, সোমা আপুরও কল আছে, তবে রাজের কল বেশি । আবির  ভুলেই গিয়েছে সবার কথা । বিশেষ করে যে রাজের  সাথে এতোটা ক্লোজ ছিল, সে রাজকে অন্তত ভোলা উচিৎ না । আবির কল করা বাদ দিয়ে একটা চিন্তায় ঢুকে গেলো । লাইফটা কি আজব! যতোই বলি, ভুলবো না আপনাকে, ভুলবো না তোমাকে, ভুলবো না তোকে, একদিন ঠিকই সবটা ভুলেই যাওয়া হয় । আবির কল করলো রাজকে । অপাশ থেকে কেউ কল ধরতেই আবির বলল, “ হ্যালো!”

“তুমি কি পাগল! ছেলেটা কলেজে পড়ে আর তুমি ওকে দিয়ে রেস্টুরেন্টে কাজ করাবে?” রায়হানের মুখে  আবিরের সম্পর্কে জেনে বলল লিলি । রায়হান বলল, “তাছাড়া  কি করবো, ছেলের  তো আর কোন ইনকাম সোর্স নেই । আমরা কতটুকুই বা সামলাতে পারবো?” লিলি রায়হানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল, “কেন যে তোমাকে অশিক্ষিত করলো তোমার মা বাবা কে জান । দেখি আমি কিছু করতে পারি কি না ।” রায়হান বলল, “আরে, বাদ দাও না, তুমি কেন কষ্ট করতে যাবে?” লিলি বলল, “ছেলেটা এখান থেকে যাবে কলেজে, প্রায় ৪৫ মিনিটের মতো রাস্তা, আবার আসবে ৪৫ মিনিটের মতো রাস্তা । আবার মনে করো এই রেলওয়ে স্টেশনে কতো লোক আসবে । কোনদিন ওর কলেজের কোন বন্ধু যদি দেখে ও এই রেস্টুরেন্টে কাজ করে ওর কি ভালো লাগবে?” কিছু বলল না রায়হান । সম্ভবত নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জায় নীরব হয়ে গেলো ।

 

 

 

 

 

(১২)

আবিরের হ্যালোর কোন সাড়া এলো না । আবির আবারও বলল, “হ্যালো রাজ, শুনতে পাচ্ছিস?” তাও কোন আওয়াজ এলো না । আবির হালকা বিরক্ত হয়ে বলল, “দ্যাখ, এবার কিন্তু আমি বিরক্ত হচ্ছি!” এবার ফোনের অপাশ থেকে ঠিক  আবিরের মতোই বিরক্তির  সাথে রাজ বলল, “বিরক্ত কি এরকম আমি  হই না?” আবির কিছু বলল না । রাজ বলল, “ওখানে যেয়ে কি সংসার শুরু করলি নাকি যে আমাদের ভুলে গেলি? আবির একটু মন খারাপ করে বলল, “না রে, আসলে  এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছি না, তাই আর  কি খোঁজ নেবার সময় হয় নি । তারপর বল তোরা কেমন  আছিস?” এরপর  আবির রাজের সাথে কথা বলা শুরু করলো । রাজের  আশেপাশে অন্যান্য সবাইও ছিল তাদের সবার সাথেই কথা বলল ।

“তাহলে এখন কি করবো?” লিলির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো রায়হান ।

- “দাঁড়াও দেখি, কি করা যায় । আমার এখানে অনেক পরিচিত লোক আছে যারা নিজেদের ছেলে মেয়ের জন্য টিউশন খুজছে । দেখি, তাদের মধ্যেই কারোর সাথে আবিরের ব্যাবস্থা করা যায় কি না ।” বলল লিলি ।

- “ও আচ্ছা । তুমি আমার চোখ খুলে দিলে ।” হাসিমুখে বলল রায়হান ।

- “হুহ! তোমার চোখ  খোলাই আছে । ব্রিটিশ আমলের ডাইলোগ না মেরে কিছু কি দেবে না খেতে?” ভেংচি কেটে বলল লিলি ।

- “হ্যাঁ হ্যাঁ, দিচ্ছি দিচ্ছি ।” বলেই রায়হান এক ওয়েটারকে ডেকে বলল, “লিলির জন্য পিজ্জা নিয়ায় তো ।”

“আচ্ছা, তাহলে, আর কি বলবো, কতদুর চলে এলাম তোদের ছেড়ে ।” ফোনে নিশিকে বলল আবির । ফোনের ওপাশ থেকে নিশি জবাব দিলো, “হুম, বুঝেছি, তোর কথা বলা শেষ । নে ধর, রাজের লগেই আবার কথা বল ।” বলে নিশি রাজের হাতে ফোন ধরিয়ে দিলো । আবির জিজ্ঞেস করলো, “হ্যাঁ রে, তোদের সবার সাথেই কথা বললাম, নাবিলা কোথায়?”

- “ও তো একটু বাইরে গেছে । মেয়েটাও না বুঝলি, প্রত্যেক দিন ফুচকা খায়, আজও গেছে এই রাতের বেলায় ফুচকা খেতে ।” আবির কিছু বলল না । রাজ এরপর বলল, “তারপর আর কি, থাক তাহলে, পড়ে আবার কথা হবে ।” আবিরও বলল, “হুম, বাই রে ।” “বাই” বলে ফোন কেটে দিলো রাজ । আবির বিছানার ওপর গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল । রাজের মধ্যেও আবির নিজের পরিবর্তনটা খুঁজে পেলো । ধীরে ধীরে আবিরকে ও নিজেও ভুলে যাচ্ছে হয়তো । অথচ যেদিন আবির চলে আসবে, সেদিন রাজ কি কান্নাটা-ই না কাদল । এটাই জীবন, তাইনা? ধীরে ধীরে হয়তো এমনও হবে রাজের কথা আর তেমন মাথায়-ই আসছে না । যশোরে ফেলে আসা ওই বন্ধুগুলোর কথা হয়তো আর মাথায়-ই আসছে না । এবং তা হলও । ধীরে ধীরে এই বস্তিতে আবিরের দিন কাটতে লাগলো । আবির রেস্টুরেন্টে কাজ করতে চাইলেও রায়হান আর কলিমা বাধা দিত । আবির কলেজেও গেলো । প্রথম কয়েকদিন সিভিল ড্রেসেই গিয়েছে, দু সপ্তাহ পর ইউনিফর্ম পড়ে যাওয়া শুরু করেছে । কলেজেও নতুন বন্ধুবান্ধব হয়েছে । এভাবে প্রায় ১ মাসের মতো কেটে গেলো ।

আগস্ট মাসের শুরুর দিকের কথা । একদিন কলেজ থেকে ফিরে নিজের রুমে এসে ব্যাগ রেখে বিশ্রাম নিচ্ছিল আবির । এমন সময় কলিমা এলো । তারপর আবিরকে বলল, “এ আবির, তোরে লিলি আপা ডাকতেছে । যা!” আবির বিছানায় শুয়ে ছিল । অন্যদিকে কাত হয়ে বলল, “ভালো লাগছে না ধুর ।” কলিমা আপু হালকা রাগ করে আবিরের পিঠে হালকা করে একটা মেরে বলল, “আরে যা হারামজাদা! তোর টাকা পাওয়ার কথা কি জানি কইল ।” আবির পেছন ফিরে কলিমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার চাকরীর কথা?”

“হ্যাঁ, পারবে?” লিলিকেও একই প্রশ্ন করায় লিলি জবাবটা দিলো । ওরা রেস্টুরেন্টেরই একটা টেবিলে বসে । রায়হান ভাই যদিও ক্যাশ কাউন্টারে । আবির বলল, “আমাকে তো বললেই না কি কাজ?”

- “টিউশনি ।” বলল লিলি ।

- “টিউশনি?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো আবির ।

- “হ্যাঁ । আমার একটা পরিচিত বান্ধবী আছে । ওর ছোট ভাইয়ের ম্যাথ খুব প্রবলেম । কিছুই বোঝে না ম্যাথ এর । ক্লাস এইটে পড়ে, অথচ পিথাগোরাসের উপপাদ্যই ঠিকমতো পারে না । তুই পারবি ওকে বোঝাতে?” জানতে চাইলো লিলি ।

- “আরে, এ আর এমন কি । আমি তো ম্যাথ এর জাহাজ, টাইটানিক!” গর্ব করে বলল  আবির ।

- “হইসে, থাম । আবার বরফের সাথে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যাইস না ।” আবিরের ওভার কনফিডেন্স কমাতেই বলল লিলি । আবির আর কিছু বলল না । শুধু মুচকি হাসল ।

 

 

 

(১৩)

লিলি আপু বলল, আচ্ছা, কাল আমার সাথে বিকেলে যাইস, তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো ।” আবির ডানে মাথা কাত করলো । লিলি আপু চলে যেতেই আবির রায়হান ভাই এর কাছে এলো । বলল, “ভাই, একটা চিপস নিলাম ।” বলে একটা চিপস ছিঁড়ে নিলো আবির । রায়হান জিজ্ঞেস করলো, “হ্যাঁ রে, লিলি কি বলল?” আবির একটা চিপস মুখে দিয়ে বলল, “বলল, উনি আমাকে ভালোবাসে, তোমাকে না ।” রায়হান “শালা!” মলে মারার জন্য হাতটা উঠিয়েছে, আবির হাসতে হাসতে দৌড়ে চলে এলো সেই সময়ই । বাইরে এসে মূর্তিটার দিকে তাকাল । এনারা না থাকলে আবির আজ কোথায় থাকতো, কে জানে । কলিমা রেস্টুরেন্টের দিকে যাচ্ছিলো, আবিরকে দেখে বলল, “কিরে, আবির, এতো খুশি ক্যান? লিলি আপা কি কইল?”

- “চাকরি একটা পেয়েছি আপু! ম্যাথ করাতে হবে ।” হাসিমুখে বলল আবির ।

- “কি! মেত?” ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো কলিমা ।

- “আরে তুমি বুঝবে না । গণিত, গণিত, পড়াশুনার ব্যাপার সেপার ।”

- “ও । যা, রুমে যা । গোসল কইরা খাওয়া-দাওয়া কইরা নে । আর ইউনিফর্ম তারে শুকায় রাখবি কিন্তু, আগের তুই কিন্ত রাইখা দেস ঘুচি কইরা । ঘামের গন্ধ হইয়া যাইবো কিন্তু ।” বলেই চলে গেলো কলিমা । আবির রুমের দিকে ফিরছিল আর মনে মনে ভাবছিল, কাল থেকে চাকরি করবে, টাকা আয় করবে! নিজের টাকায় খাবে । নিজের টাকায় আয় করে খাওয়ার মজা তা অনুভব করবে!”

সেদিন রাতে আবিরের ঘুম আসছিলো না । শুধু ভাবছিল কি করে পড়াবে, কি ভাবে একটা ছেলেকে পড়ানো যায়, কি করে পড়ালে সে বুঝতে পারবে, আরও কতো কিছু ভাবছিল । বস্তির আর সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে । আবির পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো, রাত দুটো মতো বাজে । এখানে আসার পর এতো রাত পর্যন্ত জেগে থাকা এই প্রথম । আবির উঠে বসলো । দুর থেকে ট্রেনের আওয়াজ আসছে । খুব সম্ভবত একটা ট্রেন আসছে এদিকেই । আবির বাইরে গেলো । স্টেশনের পাশে রাখা একটা বেঞ্চের ওপর বসলো । রাতের বেলা জায়গাটা কি সুন্দর লাগছে । দিনের বেলায় কি ভীর থাকে, রাতে তা বোঝাই যায় না । একটু পরই ট্রেনটা কাছাকাছি চলে এলো । স্টেশনে এসে ট্রেনটা থামলো । কিছু যাত্রি নামলো, কিছু মিনিট ১৫ পর ষ্টেশন ছেড়ে চলে গেলো ট্রেনের সাথে । আবার একটু পর পুরো স্টেশন চুপচাপ হয়ে গেলো । একটু পর আবির দেখল, রেল লাইনের ওপাশ থেকে কে যেন মাতালের মতো হেলে দুলে গান গাইতে গাইতে এদিকেই আসছে । আবির ভালো করে খেয়াল করার চেষ্টা করলো । কে ওটা? কণ্ঠটা খুব চেনা চেনা লাগছে । সামনে থাকা লোকটা ধীরে ধীরে আবিরের দৃষ্টিগোচর হল । এতক্ষণ আধারে বোঝা যাচ্ছিলো না । ওটা আর কেউ নয়, দ্বীপ । আবির দৌড়ে দ্বীপের কাছে গেলো । দ্বীপকে ধরে বলল

- “দ্বীপ! ওই দ্বীপ!”

- “এ কুত্তা, কে রে তুই!” মাতালের মতো হয়ে বলল দ্বীপ ।

- “দ্বীপ! ঠিক মতো কথা বল! আমি আবির!” হালকা রেগে বলল আবির ।

- “ও । এ মাল আমার লাগবে না, রিনা টিনা মিনা থাকলে বলিস!” আবারও মাতালের মতো করে বলল দ্বীপ । আবির ঠাস করে দ্বীপের গালে একটা চড় মারল । দ্বীপ বলল, “মারলি! তুই আমাকে মারলি! আমি সব ধংস করে দেবো! সব! কাউকে বাঁচতে দেবো না! কাউকে না! এ ও ছেরি ও ছেরি ও ছেরি তোরে! এককালে ভালো বাসিতাম!.........।” গাইতে গাইতে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো । দ্বীপের এই বাজে অবস্থা দেখে আবিরের বেশ খারাপ লাগলো । একবার ডাকলো, “দ্বীপ!” দ্বীপ সাড়া দিলো না । আবির ওখানেই দাড়িয়ে । একটু দুর যেতেই দ্বীপ ঠাস করে পড়ে গেলো । এতোটাই নেশা করেছে যে হাঁটার শক্তি নেই ওর মধ্যে আর । মেঝেতে শুয়েই বির বির করে গান গাইতে লাগলো দ্বীপ ।

সকালে ৭টার দিকে ঘুম ভাঙল দ্বীপের । দেখল ও একটা অচেনা জায়গায় । ধীরে ধীরে উঠে বসে চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলো । ঘরটা ফাঁকা । দ্বীপ উঠে  দাঁড়ালো । একটু পরই আবির এলো রুমে । আবির গিয়েছিলো ইউনিফর্মটা চেঞ্জ করতে । এসে দ্বীপকে দেখে হাসিমুখে  বলল, “ঘুম ভাঙল তাহলে, গুড মর্নিং!” দ্বীপ কিছু বলল না । তবে গতকালকের   ঘটনাটা মনে পড়ে গেলো ওর । আবির বলল, “একটু বোস, তোকে নাস্তার ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি, আমি কলেজ যাবো, যাবার পথে তোকে বাসায় দিয়ে যাবো ।” বলে আবির ব্যাগ গুছাতে লাগলো । দ্বীপ চারপাশে তাকাল । তারপর আবিরের কাছে এসে মাথা নিচু করে বলল, “কাল রাতের জন্য সরি ।” আবির একটা বই ব্যাগে ঢোকাতে যাচ্ছিলো, দ্বীপের কথা শুনে থেমে গেলো । একটু পর কি যেন ভেবে আবার ব্যাগে বইটা ঢুকিয়ে বলল, “বাদ দে । তোকে অনেকবার বলেছি, এসব কুকর্ম বাদ দিতে, ওটা তো আর বাদ দিস নি, তাই এখন আজাইরা মাফ চাওয়ার কথাটাই না হয় বাদ দে ।” দ্বীপ হঠাৎ করে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে আবিরের পা জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো, “মাফ করে দাও! প্লিজ! সরি!” আবির দ্বীপকে দাঁড় করাতে করাতে বলল, “আরে পাগল! কি করছিস! ওঠ!” দ্বীপ উঠে দাঁড়ালো ।

 

 

 

 

 

(১৪)

আবির বলল, “শোন, তোর সামনে দুটো পথ আছে । প্রথমত, সামনের বছর তোর এস এস সি, ভালো করে  পড়াশোনা করে ভালো একটা রেজাল্ট করে, কলেজেও ভালো রেজাল্ট করে পড়ে ভালো একটা ভার্সিটিতে পড়ে ভালো একটা চাকরি কর । মা বাবার সেবাও করতে পারবি, নিজেকে ভালো একটা পজিশনে নিয়েও  যেতে পারবি ।”

- “আর দ্বিতীয় পথ?” আবিরের দিকে  তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো দ্বীপ । আবির  কিছুক্ষণ দ্বীপের দিকে তাকিয়ে রইল । তারপর আবারও ব্যাগ গোছানোয় মনোযোগ দিয়ে বলল, “এই  এখন যেমন চলছে, চালিয়ে যা । নেশা কর, রিনা টিনা মিনার সাথে লাইন মার, বাবা মা-র মাথা  হেট কর । তোর জন্য ভালোই  তো  ।” আবিরের ব্যাগ গোছানো শেষ । ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বলল, “এক দিক দিয়ে আজ থেকে এতগুলো বছর আগে যখন আমি ক্লাস থ্রিতে আর তুই  টু তে, তখন একটা বিষয় কিন্তু ভালোই হয়েছিলো । তোর সাথে আমার ঝগড়া হয়েছিলো । তা যদি না হতো, তাহলে আজ  হয়তো আমি এই পজিশনে আসতে পারতাম না । সারাজীবন একটা ভুল বাড়িতে একটা ভুল পরিচয়ে বেড়ে উঠতাম ।” আবির কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে রইল । দ্বীপ আবিরের দিকে তাকিয়ে রইল । একটু পর  আবির মাথা উচু করে হালকা হেসে দ্বীপকে বলল, “যাকগে এসব কথা । আমি তোর নাস্তার আর টাকাটা নিয়ে আসি ।” বলেই আবির বেড়িয়ে গেলো । নাস্তা নিয়ে এসে দেখল, রুমে দ্বীপ নেই । আশেপাশে খুজল, টয়লেটে খুজল, কোথাও নেই । রাগ করে চলে গেছে হয়তো । ছেলেটার মনে কখন যে কি চিন্তাভাবনা আসে, আল্লাহই ভালো জানেন । কি আর করার নাস্তাটা আবির-ই খেয়ে বেড়িয়ে গেলো ।

বিকেলে আবির লিলি আপুর সাথে রিকশা করে মতিঝিল এলো । রিকশা ভাড়া আবির দিতে চাইলো, লিলি বলল, “তুই কি চাকরি করিস?” আবির ডানে বামে মাথা নাড়ল ।” লিলি বলল, “তাহলে টাকাটা পকেটে ঢোকা ।” আবির পকেটে টাকা ঢোকাল । লিলি রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে নামলো । আবির লিলির সাথে গেলো । মতিঝিলের একটা বিরাট বড় বিল্ডিং । প্রায় ২০ তোলা হবে । এর ১৪ তলায় থাকে লিলির বান্ধবী যার ভাইকে আবির পড়াবে । নিচতলায় গ্যারেজ । ঢোকার সময় এক বয়স্ক দারোয়ানকে বলে ঢুকতে হয়েছে কার বাসার যাবে, কি পরিচয়, কয়জন যাবে এসব বলে । লোকটাকে দেখে আবিরের পাপলু আঙ্কেলের কথা মনে পড়ে গেলো । লিফটে  উঠে ১৪ তলায় গেলো আবির আর লিলি । উঠতে উঠতে লিলি জানালো, লিলির বান্ধবীর নাম আখি আর আখির ভাই, অর্থাৎ আবির যাবে পড়াবে তার নাম অয়ন । একেকটা সিঁড়িতে ৪টা করে বাসা । যে তলায় বাসা, সেই তলার সাথে A,B,C ও D যোগ করে বাসার নামকরণ করা । যেমন ৪ তলার ৩য় বাসাটা হবে 4/C ১৭ তলার ১ম বাসাটা হবে 17/A । এই নামকরণ অনুযায়ী আখিদের বাসা 14/D । আবির আর লিলি ১৪ তলায় পৌছাতেই লিলি ১৪ এর ডি নাম্বার বাসার সামনে গেলো । দরজার ওপর ৩টে নাম বেশ ডিজাইন  করে লেখা । প্রথমে লেখা  আখি, নিচে চয়নিকা, তার নিচে  অয়ন । লিলি কলিংবেল চাপল । আবির লিলিকে  জিজ্ঞেস করলো, “আপনি বললেন আখি আপু আর  এই  অয়ন এর নাম, কিন্তু এই চয়নিকা কে?” লিলি বলল, “ও! এর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম । এ ওর আরেক বোন, চয়নিকা । তিন ভাই বোনের মধ্যে চয়নিকা মেঝো । কিন্তু কোন ক্লাসে যে পড়ে!”

- “ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার” একটা বেশ মিষ্টি গলায় কেউ কথাটা বলে দরজা খুলল । কথাটা শুনেই আবির আর লিলি দরজার দিকে তাকাল । দাড়িয়ে চয়নিকা । চেহারা । লম্বায় আবিরের একটু ছোট । মুখটা হালকা গোলাকার । চুলগুলো বেশ বড় আর ঘন । ঠোঁট যেন রক্তজবা । চোখের ভেতর যেন ঝরনার জল । পড়নে একটা পেস্ট কালার সালোয়ার কামিজ আর নীল কালার ওড়না । দেখে মনে হয় মিস ওয়ার্ল্ড হবার যোগ্য । আহা! কী রূপ! শুধু চেয়েই থাকতে ইচ্ছে করে! “আবির!” হঠাৎ লিলির ডাক শুনে হুশ এলো আবিরের । চয়নিকাকে দেখে এতক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলো । লিলি বলল, “কিরে, ভেতরে যেতে বলল তো, চল?” আবির বলল, “হ্যাঁ? হ্যাঁ হ্যাঁ । চলেন ।” আবির আর লিলি ভেতরে গেলো । আবির আর লিলি ভেতরে ঢুকতেই চয়নিকা দরজা আটকে দিলো । আবির পেছন ফিরে একটা চয়নিকার দিকে তাকালো । চয়নিকা যেই আবিরে দরজা লাগিয়ে এদিকে মুখ ফেরাবে, তার আগেই আবির সামনের দিকে তাকাল । ঘরটা বেশ সুন্দর । ঘরের প্রতি দিকে আভিজাত্যের ছোঁয়া । বড় বড় পাচটা রুম, একটা ডাইনিং রুম, আর একটা ড্রইং রুম নিয়ে বিল্ডিংটা । একটা কিচেনও আছে ডাইনিং রুমের সাথে, সেটাও বেশ বড় । ঘরের সবকিছুই দেখার মতো । তার চেয়েও দেখার মতো চয়নিকা । এসব ভাবতে ভাবতে আবির যেই চয়নিকার দিকে তাকাল, অমনি চয়নিকাও আবিরের দিকে তাকাল । দুজন দুজনের চোখে চোখ পড়ে গেলো । আবির বেচারা একটু লজ্জা পেয়ে গেলো । চয়নিকা কিছু মনে করলো না যদিও ।

 

 

(১৫)

ড্রইং রুমেই বসলো আবির আর লিলি । লিলি চয়নিকাকে বলল, “কি ব্যাপার চয়নিকা, আখি কোথায়?”

- “আপু আসছে, একটু বসুন । আসলে শুক্র আর সোমবার বাদে প্রতিদিন এই সময়  আপুর ভার্সিটিতে কি একটা কাজ  থাকে, সেজন্যই গিয়েছে । আপু আসে সন্ধারও পড়ে, আজ আপনারা আসবেন বলে আপু তাড়াতাড়ি আসছেন ।” লিলি বলল, “ও আচ্ছা ।” তারপর লিলি আবিরের সাথে চয়নিকার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, “এ হচ্ছে আবির পুরো নাম সালমান খান আবির ।” চয়নিকা আবিরের একটু সামনেই ছিল আবিরের দিকে তাকিয়ে  হাসিমুখে আবিরের কাছে এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নাইস টু মিট ইউ আবির ।” আবির প্রথমটায় হাত বাঁড়াতে ইতস্তত করলো । পড়ে লিলি আপু বলল, “কিরে, লজ্জা পাচ্ছিস কেন, তোর তো সমবয়সীই ।” তখন আবির ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলো । সে সময় বেশ কিছুক্ষণ আবির আর চয়নিকা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল । হ্যান্ডশেক করা হলে চয়নিকা বলল, “আপু, আপনারা একটু বসেন, আমি অয়নকে ডাকি আর আপনাদের জন্য কিছু নাস্তার ব্যাবস্থা করি ।” লিলি বলল, “আরে ধুর, কষ্ট করে নাস্তার ব্যাবস্থা করা লাগবে না । তুমি শুধু অয়নকে ডাকো তাতেই হবে ।” চয়নিকা চলে গেলো । একটু পর অয়নকে নিয়ে এলো । অয়ন আবিরের পাশের সমকোণে রাখা একটা সোফায় বসলো । অয়ন বলল, “আসসালামু আলাইকুম স্যার ।”

- “ওয়ালাইকুমুস সালাম, তুমি আমাকে স্যার না ডেকে ভাইয়া ডাকতে পারো ।” হাসিমুখে বলল আবির ।

- “ওকে ভাইয়া, আসলে আপনাকেও স্যার ডাকতে আমারও ভালো লাগবে না । আপনার মতো এরকম হ্যান্ডসাম একটা ভাইয়া । ভাইয়া এখন কি করছেন?” জিজ্ঞেস করলো অয়ন ।

- “এইতো ভাইয়া, কলেজ ফার্স্ট ইয়ার ।” বলল আবির ।

- “ওয়াও, তাহলে আপনি তো আমার চুনি আপুর সমান ।” হাসিমুখে জবাব দিলো অয়ন ।

- “চুনি আপু?” অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “মানে, চয়নিকা আপু । নামটা বেশি বড় তো, তাই আমি চুনি আপু বলেই ডাকি । বাই দা ওয়ে, আমার মা কিন্তু আমার চুনি আপুর জন্য আপনার মতোই হ্যান্ডসাম ছেলে চায় ।” বলল অয়ন ।

কথাটা শুনে বেশ লজ্জায় পড়ে গেলো আবির । চয়নিকা গিয়েছিলো এই ফাঁকে একটু নাস্তার ব্যাবস্থা করতে  । ট্রে তে করে সেই নাস্তার এনে রুমে ঢুকতেই অয়নের মুখে কথাটা শুনে সে-ও লজ্জায় পড়ে গেলো । আবিরের লজ্জা ভাঙ্গাতে একটু পর চয়নিকাই গলা খাখরে ভেতরে ঢুকে ট্রেটা টেবিলের ওপর রেখে বলল, “এই যে, আপনাদের জন্য নাস্তা ।” লিলি বলল, “আরে! কি কষ্ট করলা! তোমাকে বললাম দরকার নেই!” চয়নিকা হালকা হেসে বলল, “কি যে বলেন না, আমার ভাই অয়ন তো নিজের স্যারকে আমার জামাই বানিয়ে ফেলল । জামাইয়ের আতিথেওতাটা তো অন্তত করতে দিন ।” বলেই আবিরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে রুম থেকে চলে গেলো চয়নিকা । আবির চয়নিকার দিকেই তাকিয়ে রইল । কথাটা ওর মনের মাঝে গেথে গেলো । কি বোঝাতে চাইছে মেয়েটা! তবে কি আবিরের মনে যেমন ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে মেয়েটার মনেও কি সেরকম ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে? এসব ভাবনার মাঝে ডুবে গিয়েছিলো আবির, ভাবনা ভাঙল দরজা খোলার আওয়াজ শুনে । রুমে এলো আখি । আকি ঢুকতেই আবির আর লিলি দাড়িয়ে গেলো । আবির সালাম জানালো । আখিও সালামের জবাব দিয়ে বলল, “সরি রে লিলি, রাস্তায় এতো জ্যাম! তোদের আগে আসতে পারলাম না । একটু বোস, আমি ব্যাগটা রেখে আসছি । বলেই আখি ভেতরে যেয়ে ব্যাগটা রেখে এসে বসলো আবির আর লিলির সাথে । অয়নও ছিল । আখি আবিরকে জিজ্ঞেস করলো, “কি খবর স্যার, স্টুডেন্ট কেমন লাগলো আপনার?” আবির হালকা হেসে বলল, “একদম মন মতো । যেরকমটা সব সময়ই চেয়েছিলাম ।” আখি একটু হেসে বলল, “বাহ, তাহলে তো হয়েই গেলো ।” আখি তখন লিলিকে বলল, “আখি শোন, তুই তো জানিস, বাবা বাসায় কোন বাইরের ছেলে আসা সাপোর্ট করে না, সেজন্য আমি জাহিরাকেও বলেছিলাম আমার ভাইকে পড়াবে কি না । হায়রে ওর ঢং বাড়ছে! মানে জায়গায় কোচিং পেয়ে এখন সে আর আমাদের সময়ই দিতে পারে না । অথচ দিব্যি বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “আপনাদের বাসায় বাইরের ছেলে আসা সাপোর্ট করে না মানে?” আখি বলল, “আসলে একটু পারিবারিক ব্যাপার তো, না জানতে চাইলে খুশি হবো । কিন্তু তুমি চিন্তা কোরো না । তুই যেহেতু লিলির পরিচিত, বাবা কিছু বলবেন না । লিলি তো আমার ছোট বেলার বন্ধু ।” লিলি হালকা হাসল ।

 

 

 

 

 

(১৬)

আখি বলল, “আচ্ছা ভালো কথা, তুমি কবে কবে কখন কখন আসতে পারবে?” আবির বলল, “আমি প্রতিদিনই ফ্রি আছি । আপনি যখন বলবেন তখনই আসবো ।” আখি বলল, “তাহলে তুমি রবি মঙ্গল বৃহস্পতি এসো । শনি সোম বুধ ওর গণিত আর ইংরেজি অন্যান্য সব সাবজেক্টের একজন ম্যাডাম পড়াতে আসে ।” আবির জানতে চাইলো, “আমি তো ম্যাথ পড়াবো, ইংরেজি কে পড়ায়?” আখি বলল, “ইংরেজি চুনিই পড়ায় । আসলে ও আবার অঙ্কে কাচা তো, তাই তোমাকে ডাকলাম । নাহলে তো চুনিই নিতো । তার ওপর চুনিও সেভাবে সময় করে উঠতে পারে না ।” আবির কিছু বলল না । আখি বলল, “একি! তোমরা তো কিছু খাচ্ছোই না, খাও! লিলি! তুই এতো ভদ্রতা কেন দেখাচ্ছিস!” লিলি বলল, “খাচ্ছি । তার আগে একটু ওয়াশরুমে যাবো রে, নিয়ে চলনা!” আখি বলল, “আচ্ছা চল, আমার রুমে চল ।” এরপর লিলি আর আখি চলে গেলো আখির রুমে । অয়ন আবিরকে বলল, “ভাই, যদি পারমিশন দেন, একটু আমি রুমে যাই? মানে পাবজি খেলতেছিলাম তো!” বলেই মুচকি হেসে দিলো অয়ন । আবিরও হালকা হেসে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে । কিন্তু আমি পড়ানো শুরু করে দিকে কিন্তু এসব কমাতে হবে ।” অয়ন, “পাক্কা প্রমিস ভাই!” বলেই চলে গেলো অয়ন । আবির একা একা বসে বসে মোবাইল চালানো শুরু করলো । পুরনো ছবি ঘাটা শুরু করলো । এর মধ্যে নিশি, নাবিলা এদের ছবি-ও দেখছিল, এমন সময় কোন সময় চয়নিকা যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টের-ই পায়নি আবির । চয়নিকা আবিরকে জিজ্ঞেস করলো, “গার্লফ্রেন্ড, নাকি জাস্ট ফ্রেন্ড?” আবির মোবাইলটা অফ করে ইতস্তত করে হালকা হাসবার চেষ্টা করে বলল, “আরে না, ফ্রেন্ড ।” চয়নিকা খিলখিল করে হেসে বলল, “জানতাম ।”

- “কি করে জানলেন?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “আপনার কোন ফেসবুক আইডি নেই, তাইনা?” বলল চয়নিকা ।

- “হুম। আপনি কি করে জানলেন?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “বসবো?” আবিরের পাশে ঈশারা করে বলল চয়নিকা ।

- “আপনার বাসা, আপনি বসবেন, এতে জিজ্ঞেস করার কি আছে?” বলল আবির ।

চয়নিকা বসলো আবিরের পাশে ।

- “প্রশ্নের জবাব পেলাম না ।” বলল আবির ।

- “কোন প্রশ্ন?”  জিজ্ঞেস করলো চয়নিকা ।

- “এই যে, আমার যে ফেসবুক আইডি নেই আপনি জানলেন কি করে ।” বলল আবির ।

- “এটা শিওর হয়ে বলিনি । আসলে ফেসবুকে আপনার নাম দিয়ে সার্চ দিলাম, পেলাম না । তাই আন্দাজেই বললাম । সেটা যে সত্যি হবে তা ভাবিনি ।” বলল চয়নিকা ।

- “ওওও” বলল আবির । 

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল । একটু পর আবির বলল, “একটু আগে আমার গার্লফ্রেন্ড নেই শুনে হাসলেন যে?”

- “এমনি, ইচ্ছে হল তাই ।” বলল চয়নিকা ।

আবির কিছু বলল না । একটু পর চয়নিকা বলল, “আমার ভাইকে পড়াতে আসবেন কবে কবে?”

- “রবি মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার ।” বলল আবির ।

- “কয়টার সময়?” বেশ আগ্রহের সাথে  জানতে চাইলো চয়নিকা ।

- “এখনও ভাবিনি ।” বলল আবির ।

- “এক কাজ করবেন, বিকেল ৫টার দিকে আসবেন ।” বলল চয়নিকা ।

- “কেন?” জানতে চাইলো আবির ।

- “এমনি, সাজেস্ট করলাম ।” বলল চয়নিকা ।

- “৪টায় বা ৬টায় আসলে সমস্যা?” চয়নিকার দিকে তাকিয়ে বলল আবির ।

চয়নিকা কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় লিলি আর আখিকে কথা বলতে বলতে এই রুমের দিকে আসতে টের পেয়ে সেখান থেকে উঠে চলে গেলো । লিলি আর আখি আসতেই আবির উঠে দাঁড়ালো । লিলি আবিরকে বলল, “চল আবির, যাই তাহলে ।” আবির লিলির কাছে গেলো । আখি তখন বলল, “ও ভালো কথা, টাইমটাই তো জানা হল না রবি মঙ্গল বৃহস্পতি কয়টার  সময় আসতে পারবে ।”

আবির দেখল, একটু দরজে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে চয়নিকা । খুব সম্ভবত আবিরের মুখের জবাবটা শোনবার জন্য । আবির সাত পাঁচ না ভেবে চয়নিকার কথা মতোই  বলে দিলো, “৫টার সময়?” আখি বলল, “ঠিক আছে । এ সময় তো আরও ভালো হয় । চুনির আবার রবি মঙ্গর বৃহস্পতি সাড়ে ৬টায় কোচিং থাকে । আর ওর কলেজ শেষ হয় সাড়ে ৪টায় । মাঝখানে ৫টা থেকে ৬টায় তাও আবিরকে সময় দিতে পারবে । আমি তো থাকবো না ।” আবির এবার বুঝল চয়নিকা কেন ৫টায় পড়ানোর কথা বলেছে আবিরকে । আবির দেখল চয়নিকা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে আবিরকে ইশারায় বাই বলে ভেতরে চলে গেলো । আবির শুধু তাকিয়ে দেখল ।

 

 

(১৭)

বাড়ি ফেরবার পথে আবির লিলিকে শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করেছিলো, “আচ্ছা, উনি যে বলল  উনাদের বাসায় বাইরের ছেলে আসা সাপোর্ট করে না কেন?”

- “কি জানি, হয়তো আঙ্কেল ধার্মিক । আমার এতোটাও ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল না তো আখি ।” জবাব দিলো লিলি ।

আবির সাড়া রাস্তা আর একটা কথাও বলল না । শুধু মনে মনে কল্পনা করে গেলো চয়নিকাকে ।

বিকেলে আবির রেস্টুরেন্টে বসে বসে চয়নিকার কথাই ভাবছিল । এমন সময় রায়হান এসে আবিরের পাশে বসলো । প্রথমবার ডাকলো,  “আবির!” আবির কোন সাড়া দিলো না । রায়হান আবারও আবিরের দিকে ভালো করে  তাকিয়ে ডাকল, “এই আবির!” আবির  চমকে রায়হানের দিকে তাকাল । বলে উঠলো, “কে কে! ও  ভাই, তুমি । বলো ।”

- “ঠিক  আছিস!”  জানতে চাইলো রায়হান ।

- “কেন ঠিক থাকবো না, ঠিক না থাকার মতো কিছু  হয়েছে নাকি?” জবাব  দিলো আবির ।

- “না, এমন দেবদাস হয়ে বসে আছিস, ব্যাপার কি? পারোর দেখা পেলি নাকি?” ইয়ার্কি করে বলল রায়হান ।

- “পারো?” চিনতে না পেরে  প্রশ্ন করলো আবির ।

- “দেবদাসের গার্ল ফ্রেন্ড ।” বলল রায়হান ।

- “ধুরু! ইয়ার্কি কোরো না তো ।” বিরক্ত হয়ে বলল আবির । রায়হান হো হো করে হেসে উঠলো ।

- “আরে, ব্যাপার না, আমারও ওরকম ফিলিংস হয়েছে । আর এরকম ফিলিংস কখন হয়, আমার জানা আছে ।” বলল রায়হান ভাই , আবির রায়হান ভাইয়ের কথার কোন জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা রায়হান ভাই, আমি তো এই বয়সে প্রেমে পড়লাম, তুমি এতো দেরিতে কেন? না মানে, কম করে হলেও তোমার তো বয়স ৩০-৩৫ হবে ।” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

রায়হান ভাই বলল, “তার মানে স্বীকার করলি, তুই প্রেমে পড়েছিস?” আবির কপাল হাত ঠেকাল । আর নিজেই নিজেকে বলল, “উফফ! আমি একটা গাধা । বলেই দিলাম সব!” রায়হান আবারো হেসে উঠলো । আবির তখন বলল, “আচ্ছা, জেনেই যখন গিয়েছো, তখন জবাবটা দাও!”

- “আসলে দ্যাখ,আমার আগে কলিমার বিয়ে করানোর ইচ্ছে ছিল । আহাম্মক হোক আর যাই হোক, একজনের সাথে অন্তত বিয়ে তো দিয়েই দিয়েছি । নিজের বিয়ে নিয়ে কখনো ভাবিনি । রেস্টুরেন্টে অনেক মেয়ে আসতো, তাদের দেখলে মনের মাঝে কেমন একটা অনুভব হতো । ঠিক তোর মতো । কিন্তু আমার মতো এই রেস্টুরেন্টের ক্যাশ কাউন্টারে বসা একটা ছেলেকে কেই বা বিয়ে করবে? অবশেষে এতো বছর পর লিলির মতো একটা ভালো মেয়ে এলো । ও তো বলেছে আমাকে ”বিয়ে করবে । দেখা যাক, কি হয় ।” আবির আর কিছু বলল না । রায়হান জিজ্ঞেস করলো, “তা হ্যাঁ রে, কার প্রেমের ফাঁদে পড়লি একটু নামটা শুনি!” আবির বলল, “না ভাই, এসব তেমন কিছুই না, বাদ দেন এসব কথা ।”

- “না ভায়া, নামটা তো বলতেই হবে!” ইয়ার্কির সাথে বলল রায়হান ।

আবির আবারো কিছু একটা বলতে যাবে,  এমন সময় রেস্টুরেন্টে রাগ নিয়ে ঢুকে আবিরেরই দিকে এগিয়ে ইফাজকে এগিয়ে  আসতে  দেখে সেদিকে  তাকালো আবির । ইফাজের বা হাতে একটা কাগজ । আবির দাঁড়ালো । প্রথমে ও  বুঝতে পারে নি ইফাজ রেগে  আছে । “কেমন আছেন?” বলতে যাবে তার আগেই ইফাজ ডান হাত উঁচিয়ে রেস্টুরেন্ট ভর্তি মানুষের সামনে আবিরের গালে মারল ঠাস করে একটা চড় । আবির গালে হাত রাখল । রেস্টুরেন্টের সবাই চুপচাপ হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল । আবির বুঝতে পারলো না কি হয়েছে । রায়হান ইফাজকে শান্ত করার জন্য বলল, “স্যার, ওইদিকে চলেন, এইখানে লোকজন আছে । খারাপ দেখাবে ব্যাপারটা ।” রায়হানের কথা  শেষ হতে  না  হতেই ইফাজ প্রচণ্ড রাগ নিয়ে জোর গলায় বলল, “দেখুক! আমার কিচ্ছু যায় আসে না । আমি আজ এই আবিরের একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বো!” রেস্টুরেন্টের সব ওয়েটাররা সেদিকে গেলো । সবাই ইফাজকে অনুরোধ করলো রেস্টুরেন্টের  ভেতরে একটা রুমে যেতে । অবশেষে নিজের রাগটা খানিক  কমিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতর ওয়েটিং রুমে যেতে রাজি হল ইফাজ । রেস্টুরেন্টের ভেতরে গেলো ইফাজ, রায়হান আর পেছন পেছন আবির । যেয়ে আবির জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?” আবিরের কথা শুনেই আবিরের দিকে আবিরকে মারার জন্য তেড়ে আসছিলো ইফাজ  কিন্তু কাছাকাছি আসতেই থেমে  গেলো । তারপর একটা কাগজ ছুঁড়ে মারল আবিরের  দিকে আর বলল, “কাগজটা খুলে দ্যাখ! কি মহৎ কাজ তুই করেছিস!” আবির কাগজটা খুলে দেখল, এতে একটা চিঠি । দ্বীপের চিঠি । দ্বীপ তাতে লিখেছে, “বাবা, আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি । আমার মনে হয় নিজেকে ভালো ভাবে গড়ে তোলার আগে তোমাদের সামনে আসা ঠিক হবে না । তাই আমি তোমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি দূরে কোথাও । আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো । কারণ হয়তো তোমাদের সামনে দেখা করার আগ পর্যন্ত আমি না-ও বেঁচে থাকতে পারি । হয়তো একটা ভালো দ্বীপ রুপে নাও তোমাদের সামনে দাঁড়াতে পারি । আর আবির ভাইয়াকে আমার ভালোবাসা জানিও । আবির ভাইয়াই আমাকে বুঝিয়েছে সবটা ।” তারপর একটু নিচেই লেখা, “ইতি, তোমার অনাদরের, দ্বীপ ।”

 

 

 

 

 

(১৮)

আবির থমকে গেলো । দ্বীপ যে এতোটা সিরিয়াসলি ব্যাপারটা নেবে তা আবির কখনোই ভাবতে পারে নি । তবে এতদিন ছেলেটা যা  ছিল, ওর খেয়াল তো ইফাজ আর পায়েল রাখতো কি না সন্দেহ । এখন নিজের খেয়াল নিজে রাখুক, যদি ভালো কিছু হতে পারে, আলহামদুলিল্লাহ, আর না হতে পারলে চেষ্টা যে  করতে চাইছে, এই অনেক । কিন্তু ইফাজের এতো রাগের কারণ কি? আবির ইফাজের দিকে তাকাল । আবিরকে তাকাতে দেখে ইফাজ হালকা ক্ষোভ নিয়ে বলল, “একটা মাত্র ছেলে আমার । একে কুড়িয়ে এনে ভেবেছিলাম আরেকটা ছেলে হবে আমাদের, না, সে তো আবার জেদী । আমরা তো ঠকবাজ ।  এ তো বাড়ি থেকে  গেলোই, ওটাকেও বাড়ি  থেকে যেতে উৎসাহ দিলো । এখন এই বুড়ো বেকার বাবা মাকে কে দেখবে?” আবির একটু  ইফাজের দিকে এগিয়ে  এলো । বলল, “তুমি……সরি । আপনি টাকার অভাবে ভুগছেন, তাইনা?” ইফাজ একবার আবিরের দিকে তাকিয়ে  মাথা নিচু  করে হতাশার শ্বাস ফেলল । একটু চুপ থেকে বলল, “শুধু তাই না, আমার বাকি যা জমিজমা সব তো বিক্রি করে দিয়েইছি, এখন এই বাড়িটাও বিক্রি করার জন্য নিলামে তুলেছি । দ্বীপ বলেছিল কিছু ড্রাগস পাচার করে টাকার ব্যাবস্থা করবে । তা তো……” কথা শেষ  করতে পারলো না ইফাজ । আবির কিছু বলল না । খানিকক্ষণ চুপ থেকে রায়হান বলল, “আপনি আমাদের সাথে থাকুন না স্যার, আমাদের এখানে । এটা তো আপনারই জায়গা ।” ইফাজ কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই আবির ইফাজকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, “অন্তত আপনার মতো মানুষের কাছে এটা আমি প্রত্যাশা করিনি । টাকার জন্য অবৈধ উপায় বেছে নিলেন শেষ অবধি!” ইফাজ একটু লজ্জা পেলো । তারপর বলল, “কি করবো বল । মানুষ অভাবে পড়লে কি যে করে তা যে করে, সে-ই বুঝতে পারে । তুই পড়লে বুঝতি ।” “আমি অভাবে পড়লে আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম আর ধৈর্য ধরতাম । তবু অবৈধ, হারাম কিছু করতাম না আশা করি ।” ইফাজ কিছু বলল না । আবির বলল, “রায়হান ভাই তো ঠিক-ই বলেছে । এখানে তো থাকা-ই যায় । আপনি আর পায়েল আঙ্কেল চলে আসুন এখানে ।” ইফাজ একটু কি ভাবল । তারপর বলল, “গাড়িটা আমার খুব শখের ছিল । ওটা সাথে রেখে বাকি সব বিক্রি করে দিতে চাই । আমি আসছি ।” বলে চলে গেলো ইফাজ । কিন্তু শিওর করে কিছু বলল না এখানে আসবে কি আসবে না । রায়হান আবিরকে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে, দ্বীপ কখন এসেছিলো?” আবির বলল, “গতকাল রাতে । নেশা করে বাড়ির পথে যাচ্ছিলো, সে সময় । বেশি নেশা করে ফেলায় রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো । আমি ওকে তুলে এনে আমার রুমে রেখেছিলাম ।” রায়হান আর কিছু বলল না ।

পরদিন ছিল সোমবার । আজ কোচিং নেই । আগেরদিনের মতো আজও বিকেলে রেস্টুরেন্টের একটা ফাঁকা টেবিলে বসে ছিল আবির । মেয়েটাকে দেখার জন্য আবিরের মনটা কেমন উতলা হয়ে রয়েছে । কেন, সে জবাব ওর জানা নেই । এরকমটা আবিরের লেগেছিল যখন নাবিলার সাথে ওর পরিচয় হয়েছিলো  তখন । আচ্ছা, এমন হবে না তো, যেভাবে নাবিলা আবিরের সাথে রাগ করে চলে গিয়েছিলো সেভাবে এই চয়নিকাও যদি চলে যায়? আবির নিজে নিজে ভাবতে ভাবতেই হেসে উঠলো । তারপর আবার নিজেই নিজেকে বলতে লাগলো, “ধুর! কি সব ভাবছি, এনার সাথে তো আমার সেভাবে পরিচয়ই হয় নি । পরিচয়! হঠাৎ করে শব্দটা আবিরকে বিষণ্ণ করে তুললো । এ জীবনে কতো মানুষের সাথ পরিচয়ই না হল, নিজেও কতো মানুষকে কতো পরিচয়ই না দিলো, অথচ এ পর্যন্ত নিজের আসল পরিচয় কি তাই-ই জানে না আবির । এমন সময় রুমে এলো লিলি । আবিরকে দেখে আবিরের কাছে যেয়ে বসলো । তারপর বলল, “কিরে, কি অবস্থা?” আবির বলল, “এইতো, মোটামুটি । কোনোরকম চলছে আরকি ।” লিলি বলল, “কেন? মোটামুটি কেন? তোর তো আজকে জোশ থাকার কথা । কাল থেকে তুই চাকরি করবি! নিজে টাকা আয় করবি! এটা কি মোটামুটি থাকার মতো খবর?” আবির বলল, “না না, সেজন্য না । অন্য কারণে মোটামুটি আছি ।” লিলি জিজ্ঞেস করলো, “কি কারণে রে? তোর আর চয়নিকার ভাব স্বভাব কিন্তু আমার কাছে ভালো ঠেকছে না!” আবির লিলির কথার জবাব না দিয়ে বলল, “আচ্ছা, উনাদের বাসায় কি উনাদের মা বাবা নেই?” লিলি বলল, “যদ্দুর শুনেছি ওদের মা লন্ডনে একটা ব্যাবসা করে । আর ওদের বাবা একটা বেসরকারি টিভি চ্যানেল কোম্পানির ওই কি একটা পদে আছে, চ্যানেলের কি ধরণের প্রোগ্রাম দিলে ভালো হবে, এসবের প্ল্যান করেন উনি । সকালে ১০টায় অফিসে যান, আর রাত ৮টায় আসে বাসায় । শুক্র শনি বাদে প্রতিদিন অফিস ।” আবির কিছু বলল না । ওপর নিচ মাথা নেড়ে বোঝাল ওর জবাব পেয়ে গেছে ।




(১৯)

রাতে বিছানায় শুয়ে ছিল আবির । বাহির থেকে ট্রেন চলে যাওয়ার  আওয়াজ এলো । মাত্রই একটা ট্রেন ষ্টেশন ছাড়ল । আবিরের মনে  এখনও সেই মেয়ের চেহারা ভেসে বেড়াচ্ছে । আবির মোবাইলটা হাতে নিলো । পুরনো ছবিগুলো দেখতে লাগলো শুয়ে শুয়ে । সে সময় হঠাৎই রাজের  সাথে  একটা ছবি দেখে রাজের  কথা মনে পড়ে গেলো  আবিরের । ফোন করলো রাজকে । কিছুক্ষণ পর ফোনের ওপাশ থেকে রাজ বলল, “কিরে, কেমন  আছিস?” আবির বলল, “এইতো  ভালো, তোর কি খবর?”

- “এই, চলে যায় আরকি দিনকাল ।” বলল রাজ ।

- “ও” বলল আবির ।

- “খোঁজ খবর তো নিস না আর ।” অভিমানের সাথে বলল রাজ ।

- “তুইও তো নিস না । ভুলেই গেছিস একদম ।” বলল আবির ।

- “হুম রে । সময় পাই না । আসলে পড়ার চাপ থাকে তো, তারপর অনেক কাজ থাকে ।” বলল রাজ ।

- “হুম, নতুন অনেক বন্ধুও আছে, তাদেরও তো সময় দিতে হয় ।” হালকা হেসে বলল আবির ।

রাজ নিশ্চুপ । আবিরও কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলো, “তারপর, ভাবির কি খবর?”

- “ভাবি বলতে, নাবিলা?” জিজ্ঞেস করলো রাজ ।

- “তা নয় কি, এতদিনে নাবিলা যে তোর বউ হয়ে গেছে প্রায়, তা-ও ভুলে গেলি? নাকি নতুন কারো পিছে পড়েছিস?” ইয়ার্কি করে বলল আবির ।

- “আরে না না । তোর ভাবি থাকতে নতুন কাউকে ধরা যায় নাকি । তারপর, তুই কি কাউকে পেলি নাকি?” আবিরকে জিজ্ঞেস করলো রাজ ।

- “ধুরু, এখন ওসব প্রেমের ঝামেলায় জড়াতে চাইনা । ভালো লাগে না এসব । এখন এসব প্রেম মানে ভবিষ্যতে নিজের গারলফ্রেন্ড হয় অন্যের বউ, আর অন্যের গার্লফ্রেন্ড হয় আমার বউ ।” হালকা হেসে বলল আবির ।

- “হুম, যেমন এখন তোর গার্লফ্রেন্ড আমার বউ ।” হালকা লজ্জা নিয়ে কথাটা বলল রাজ ।

- “আরে! তুই এভাবে বলছিস কেন, আমি তো এখন আর রাগ করে নেই । আর তাছাড়া তোদের দুজনকে ভালোবেসেই তো আমি স্যাক্রিফাইসটা করেছি ।” রাজ যেন নিজেকে দোষী না ভাবে, তাই কথাটা বলল আবির ।

- “হুম । ভালো লাগতো যদি স্যাক্রিফাইসটা আমি করতে পারতাম । শুরুটা তো তোকে দিয়েই হয়েছিল ।” বলল রাজ ।

আবির আর কিছু বলল না । অনেকক্ষণ দুজনেই চুপ । এতক্ষণ চুপ থাকায় রাজ ভাবল লাইন কেটে গেছে । জিজ্ঞেস করলো, “হ্যালো! আবির আছিস!” আবির বলে উঠলো, “হুম আছি, বল ।”

- “জীবনটা কেমন যেনো, তাই না রে?”

- “কেমন বলতে?” জানতে চাইলো আবির ।

- “এই যে দ্যাখ, এক সময় আমি আর তুই ছিলাম একদম একসাথে । কতো ঘুরেছি একসাথে, মানে নিজের আপন ভাইয়ের চেয়েও বেশি । অথচ দূরে চলে যাওয়ার পর দ্যাখ, কেমন যেন নিজেদের মাঝে সেই ভালবাসাটা, সেই টানটা কমে যাচ্ছে , আগে যেখানে সারাদিন একসাথে থাকতাম, এখন সেখানে সপ্তাহে ১বারও কল করে কথা বলার সময়টুকুও হয় না ।” হালকা আবেগপ্রবণ হয়ে কথাটা বলল রাজ ।

- “হুম । লাইফ এমনই । এর কোন ঠিক ঠিকানা নেই । তুই যেটা কাউকে করতে মানা করিস, হয়তো একদিন তুই নিজেই তাতে আসক্ত হয়ে পড়বি । আবার তুই যেটা করিস, অন্য কেউ তোকে তা করতে মানা করে, হয়তো একদিন তুই সেটা আর করতেই চাইবি না । এটাই হল লাইফ । লাইফের কখন যে কি মোড় আসে, বলা যায় না ।” বলল আবির ।

রাজ আবার চুপ । একটু পর একটু হতাশার শ্বাস ফেলে রাজ বলল, “আচ্ছা, রাখি রে, আবার পড়ে কথা হবে ।” আবিরকে বাই বলার সুযোগটুকুও না দিয়ে ফোন কেটে দিলো রাজ । আবির হালকা কষ্ট পেলো । যে বন্ধু আবির চলে আসার দিন এতো কেদেছিল, আজ সে এমন করলো! আবির ব্যাপারটাকে পজিটিভলি ধরে নিলো । হয়তো নেটওয়ার্ক প্রবলেম । কিন্তু তবুও, মনের মাঝে  কেমন যেন করলো আবিরের । কিন্তু ওদিকে রাজ ফোন ইচ্ছে করেই কেটেছে । চোখ দিয়ে নীরবে জল ফেলছে রাজ । কথা বললে বুকের মাঝে কণ্ঠটা বাধা পড়ে, তা আবিরকে না বুঝতে দেবার জন্য আগেই ফোনটা কেটে দিলো ।

 

পরদিন বিকেলের কথা । অয়নকে পড়াতে আবির গেলো অয়নদের বাসার । দরজায় কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলল চয়নিকা । “আসুন, ভেতরে  আসুন ।” আবিরকে বলল চয়নিকা । আবির ভেতরে ঢুকল । 

চয়নিকা বলল, “আপু বলেছে আপনার দিকে নজর রাখতে, কেমন পড়াচ্ছেন সেটা খেয়াল  করতে হবে তো ।” আবির হালকা হেসে বলল, “তাই, নাকি  আপনি  নিজে থেকেই আমার দিকে নজর রাখতে চাইছেন?” চয়নিকা আবিরের কথা না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো, “মানে?” আবির বলল, “কিছু না । মজা করলাম । চলুন ।” চয়নিকা আবিরকে নিয়ে অয়নের রুমে গেলো । অয়ন বই নিয়ে টেবিলে বসে । আবির চয়নিকার সাথে  ভেতরে গেলো । আবিরকে দেখে অয়ন বলে উঠলো, “আসসালামু আলাইকুম  ভাই । কেমন আছেন?” আবির বলল, “ভালো ।”  বলেই আবির আর কিছু না বলে অয়নের সামনে যেয়ে অয়নের বইয়ের নিচ থেকে একটা মোবাইল বের করে চয়নিকার হাতে দিলো । অয়নের মুখে হালকা ভয়ের ছাপ । চয়নিকা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে! তোরে না পড়তে বসায় রেখে গিয়েছিলাম, আর তুই মোবাইল চালাচ্ছিলি?” অয়ন লজ্জা পেয়ে গেলো । ঠোঁটে ওর কাষ্ঠ হাসি ফুটে উঠলো । 





(২০)

চয়নিকা আবিরকে রাগের সাথে বলল, “শুনুন, ও যদি পড়া না পারে,  ওরে ধরে মারবেন আচ্ছা  মতো । লাঠি লাগলে আমি এনে দেবো ।” আবির হালকা হেসে বলল, “না না, ঠিক আছে । আমি ওকে সামলে নেবো ।”  আবির অয়নের টেবিলের পাশে চেয়ারে বসলো, অয়নও চেয়ারে বসলো । আবিরের ঠিক সামনে একটা চেয়ারে বসলো চয়নিকা । আবির পড়ানো শুরু করলো । আবির অয়নকে ম্যাথ বোঝাচ্ছে, আর চয়নিকা অয়নের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । আবির ব্যাপারটা খেয়াল করেছে, কিন্তু আবির চয়নিকাকে পাত্তা না দেবার চেষ্টা করছে । একটু পর রুমে একটা মেয়ে ঢুকল হাতে নাস্তা নিয়ে । বয়সে কলিমা আপুর বয়সী । গায়ে একটা সাদা সালোয়ার কামিজ ওড়না । হাতে  একটা আংটি । তাতে খোদাই করে লেখা, “মোখলেস” গায়ের পোশাক আশাক দেখে সচ্ছল মনে হলেও চেহারাই বলে দেয়, এ এই বাড়ির কাজের লোক । হয়তো চয়নিকারা তাদের ভালো জামাকাপড় দেয় । মেয়েটা নাস্তা টেবিলের ওপর রেখেই চলে  গেলো । আবির বুঝল, এ  কাজেরই লোক । তবুও  মনের  সন্দেহ মেটাতে চয়নিকাকে জিজ্ঞেস  করলো, “কে উনি?”

- “শিউলি আপু । আমাদের বাসায় কাজ করেন ।” জবাব দিলো চয়নিকা ।

- “আর মোখলেসটা কে?” জানতে চাইলো আবির ।

আবিরের মুখে নামটা শুনে অবাক হয়ে গেলো  চয়নিকা । জিজ্ঞেস করলো, “মোখলেস তো  উনার স্বামীর নাম, তুমি কি করে জানলে উনার নাম?” আবির বলল, “আমার সবদিকে নজর থাকে সবসময় ।” চয়নিকা ইয়ার্কি করে বলল, “মেয়েদের দিকেও?” বেচারা আবির লজ্জা পেলো । গলা খাখরে অয়নের দিকে তাকিয়ে দেখল, অয়নও হাসছে । আবির অয়নকে হালকা ধমকের স্বরে বলল, “তুমি হাসছো কেন, কি যেন বোঝাচ্ছিলাম?” বলে বোঝানোয় মন দিলো আবির । অয়ন বেশ জোড় করেই হাসি  আটকে রাখল । আর চয়নিকা মনোযোগ দিলো আবিরের  দিকে । কোচিং শেষে আবিরকে চয়নিকা বলল, “যাবেন?” আবির জানতে চাইলো, “কোথায়?” “ছাদে”-জবাব দিলো চয়নিকা । আবির বলল, “না । আজ সময় নেই । বাসার ফিরতে হবে ।” চয়নিকা বলল, “ঠিক আছে, তাহলে আপনার ফোন নাম্বারটা দিন!” আবির বলল, “ফোন নাম্বার? তা তো আপনার বোনের কাছেই আছে ।” চয়নিকা ভ্রু কুঁচকে আবিরের  দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাকে দিলে কি হয়?” আবির কিছু না বলে লিফটে  উঠে গেলো । লিফটের  দরজাটা লাগার আগেই চয়নিকা এসে দরজার  মাঝে হাত রেখে লিফটের দরজা  আবার খুলে দিয়ে হালকা রাগ দেখিয়ে  বলল, “কাপুরুষ!” তারপর চলে গেলো চয়নিকা । বস্তির দিকে আসার সময় আবিরের দেখা কলিমা আপুর স্বামী শাফির সাথে । আজও  বেচারা দাঁড়িয়ে কলিমাকে নিয়ে যাবার জন্য । শাফি আবিরকে ডাকল, “এই! এই যে! খোকা!” এমনিতেও আবির যেতো না, তার ওপর খোকা ডাকার আবির আরও গেলো না । রুমে এসে ফ্যান ছেড়ে গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো ।

রাতের কথা । আবির রেস্টুরেন্টে রায়হান ভাইয়ের সাথে কিছু কথা বলে নিজের রুমের দিকে  ফিরছিল, সে সময় একটা কল এলো আবিরের মোবাইলে । ফোন ধরতেই দেখল, আখি, মানে অয়নের বড় বোন ফোন করেছে । আবির ফোন ধরতেই ফোনের ওপাশ থেকে আখি বলল, “আমি কি আবিরের সাথে কথা বলছি?” আবির বলল, “জি আপু, আমি আবির ।”

- “ও আচ্ছা, আবির আমি আখি আপু বলছি, অয়নের বড় বোন ।” বলল আখি ।

- “জি আপু, কণ্ঠ শুনে চিনতে পেরেছি । বলুন ।” বলল আবির ।

- “না আসলে ওইদিন একটা বড় ভুল হয়ে গেছে ।” বলল আখি ।

- “কি ভুল হয়েছে আপু?” ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো আবির ।

- “না মানে, এই যে তুমি অয়নকে সপ্তাহে ৩ দিন গণিতের প্রাইভেট পড়াবে, তা তুমি মাস শেষে বেতন কতো নেবে?” জিজ্ঞেস করলো আখি আপু ।

আবির কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় অয়নের গলা । কোনোরকমে শুনতে পেলো অয়ন আখিকে বলল, “আপু! শিউলি আনটি রান্নাঘরে পড়ে গেছে!” আখি “কি বলছিস এসব!” বলে ফোনটা অয়নের হাতে দিয়ে সেখান থেকে চলে  গেলো আখি । অয়ন ফোন কানে নিয়ে  বলল, “ভাই, কেমন আছেন?” আবির বলল, “ভালো, কিন্তু কি হয়েছে শিউলি আনটির?” অয়ন হালকা হেসে বলল, “কিছুই হয় নি, আপুর সাথে জাস্ট মজা করছি ।” আবির অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “মজা! এটা কি ধরণের মজা!” এরপর আর কোন আওয়াজ না । আবির কিছুক্ষণ “হ্যালো! হ্যালো!” করলো, কিন্তু কোন আওয়াজ এলো না । আবির ফোন কাটতে যাবে, এমন সময় আখির গলা শুনতে পেলো আবির । আখি বলল, “থাপড়াইয়া তোর দাঁত ফালায় দেবো! মজা ইয়ার্কি করিস, না!” আবির শুনতে পেলো অয়ন বলল, “সরি আপু! বাই!” আখি ফোন কানে নিয়ে বলল, “সরি আবির, অয়নটা যা বদমাইশ হয়েছে!” আবির হালকা হেসে বলল, “ঠিক আছে, সমস্যা নেই ।”





(২১)

আখি বলল, “হুম, এবার বলুন, কতো নেবেন?” আবির বলল, “আসলে, জীবনে প্রথমবার উপার্জন করছি, তাই ঠিক ধারণা নেই বেতন কতো  পাওয়া যায় । আপনারা খুশি হয়ে যা দেবেন, তাই-ই নেবো ।” আখি বলল, “আসলে, এরকম এক সাবজেক্টে যারা পড়ান, তাঁরা সাধারণত তিন  হাজার করে নেন । তুমি কি ৩০০০ পেয়ে  সন্তুষ্ট?  যদি চাও আমরা আরও বেশি দেবো ।” আবির বলল, “না না, সমস্যা নেই । আমার জন্য ৩০০০-ই যথেষ্ট ।” আখি বলল, “তুমি অনেক ভালো মানুষ । আশা করি তোমাকে বাবা মেনে নেবেন ।” আবির জানতে চাইলো, “আমাকে মেনে নেবেন মানে?” আখি বলল, “ওই যে বললাম না, বাবা বাসায় ছেলেদের সাপোর্ট করে না ।” আবির শুধু “ও আচ্ছা ।” বলল আর কিছু বলল না । আখি তখন বলল, “আজ অয়ন কেমন পড়লো?” আবির বলল, “ভালো, একটু দুষ্টু হলেও পড়ায় ভালো আছে, ভালোই মেধাবী ছাত্র ।” আখি বলল, “তাহলে তো ভালোই, অয়নও তোমার বেশ প্রশংসা করলো । ও নাকি আজকে বেশ ভালো ম্যাথ বুঝেছে ।” আবির বল্লল, “যাক, আলহামদুলিল্লাহ ।” আখি বলল, “ঠিক আছে, এসো তাহলে পরশু । আমি তো আর থাকতে পারবো না, চুনি থাকবে ।” আবির বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে ।” এরপর আখি ফোন কেটে দিলো । আবির নিজের রুমে চলে এলো । টেবিলে বই নিয়ে বসলো । কিছুক্ষণ পড়ল । একটু পর আবার একটা কল । একটা অচেনা নাম্বার । আখি আপুর নাম্বার একটু আগেই আবির সেইভ করে রেখেছে, তাই  এটা নিঃসন্দেহে আখি আপু নয় । আবির ফোন ধরে বলল, “আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?” ফোনের ওপাশ থেকে মেয়েলি গলায় আওয়াজ এলো, “আমি কি মিস্টার কাপুরুষের সাথে কথা বলছি?” গলাটা চিনতে ভুল হল না আবিরের । চয়নিকা । আবির জানতে চাইলো, “আপুর কাছ থেকে ফোন নাম্বার নেয়াও শেষ?”

- “না মিস্টার কাপুরুষ, আপু এতো সহজে দিত না । আপুর সাথে কথা বলার সময় অয়নের গলা শোনেন নি? অয়নই তো আপুকে মিথ্যা বলে আপুকে সরিয়ে আপনার ফোন নাম্বার দিলো ।” বলল চয়নিকা ।

আবির বইটা বন্ধ করে হালকা হেসে বলল, “এবার বুঝলাম, কার আশকারায়  ছেলেটা বদমাইশ হচ্ছে ।”

- “উহু, সে কথা বলবেন না, এ কাজ করতে ও আমার কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়েছে । নিজের  কাছেই ৫০০ থাকে, তার মধ্যে ১০০  নিয়ে নিলো ।” বলল চয়নিকা ।

- “বাজে কথা না বলে কি কারণে ফোন দিয়েছো তাই আগে বলো ।” বলল আবির ।

- “এমনিই দিলাম, খোঁজ খবর নিতে ।” বলল চয়নিকা ।

- “তা হয়ে গেলে এবার রাখি?” বলল আবির ।

- “সেকি, এখনই কেন? কেবলই তো ফোন দিলাম ।” বলল চয়নিকা ।

- “আচ্ছা, বলো, কি বলবে ।” বলল আবির ।

- “কি করো?” জানতে চাইলো চয়নিকা ।

- “পড়তে বসেছিলাম, তুমি মনোযোগটা নষ্ট করে দিলে ।” বলল আবির ।

- “এহ! কি পড়, এই দ্যাখো, আমি তোমার কাছে ফোন  দিয়ে কথা বলছি পড়ালেখা বাদ দিয়ে, অথচ তুমি আমার সাথে কথা বলছ না পড়ালেখার অজুহাতে ।” হালকা বিরক্তির সাথে বলল চয়নিকা । আবির হেসে উঠলো । চয়নিকা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “হাসছো কেন?”

 

- “এমনি, মানে, এরকম হঠাৎ দেখাতেই প্রেমে পড়ে যাওয়া যাওয়া পাবলিক প্রথম দেখলাম ।” হেসে হেসে বলল আবির ।

- “কি! আমি তোমার প্রেমে পড়েছি বলেছি একবারও?” হালকা রাগ নিয়ে বলল  চয়নিকা ।

- “শুনলে বোঝা যায়, কে কেমন পাবলিক ।” বলল আবির ।

- “এহ! এসছে, অবশ্য এটা সত্যি, তোমায় দেখলে কেমন কেমন লাগে । মনে হয় তোমাকে সিদ্ধ করে খেয়ে ফেলি ।” বলল চয়নিকা ।

- “যাক, তাহলে প্রেম করার কথা যা ভাবলাম, তা সত্যি প্রমানিত হল ।” বলল আবির ।

- “ও হ্যালো! ঝড়ে বক মরেছে, ফকিরের কেরামতি বেড়েছে! ভাগো! কাপুরুষ ।” বলল চয়নিকা ।

- “তুমি ভাগো, কামহিলা!” ইয়ার্কি করে বলল আবির ।

- “বাহ! নামটা তো বেশ লেগেছে! শোনো, আমার যেমন তোমাকে ভালো লেগে গেছে, তোমারও যদি আমাকে ভালো লাগে,  তাহলে কন্টাক্ট লিস্টে আমার নাম সেইভ কোরো কামহিলা, ওকে?” হাসিমুখে বলল চয়নিকা ।

- “আজাইরা কথা  বাদ দিয়ে ভালো কিছু বলার  থাকলে  বলো, নাহলে রাখো ।” বলল আবির ।

- “এহ, এসছে” অভিমান করে বলল চয়নিকা । “এই, দ্যাখো! কথা বলতে বলতে আমরা কখন একে অপরকে তুমি করে বলা শুরু করেছি খেয়ালই করিনি!” আবারও হাসিমুখে বলল চয়নিকা ।

- “তাই  তো! আমিও খেয়াল করিনি!” অবাক হয়ে জবাব দিলো আবির ।

- “হুম, ভালোবাসার এই তো শুরু । ঠিক আছে, রাখি, টাটা!” বলল চয়নিকা ।

আবিরও “টাটা” বলে ফোন রেখে দিলো । বাহির থেকে এশার আজান ভেসে এলো । আবির টেবিল থেকে উঠে মসজিদে নামাযে যাবার জন্য অজু করতে গেলো ।





(২২)

“চুনি, দাখতো কে এসেছে ।” নিজের রুম থেকে চয়নিকাকে কথাগুলো বলল আখি । চয়নিকা “যাই” বলে দরজার কাছে এলো । দরজা খুলে দেখল বাবা এসেছে । বাবার মনটা তেমন একটা ভালো না । চয়নিকা জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে বাবা, তোমাকে  এরকম মনমরা লাগছে কেন?”

- “আর বলিস না, অফিসে একটা নতুন প্রোগ্রাম চালু করার জন্য প্ল্যান দিয়েছে, তার জন্য আজ  থেকে  কাজ আবার বেড়ে গেলো ।” বলতে বলতে ঘরে ঢুকে দরজার পাশেই রাখা একটা টুলে  বসে জুতো খুলতে  লাগলো চয়নিকার বাবা ।

- “ও, কি প্রোগ্রাম?” জানতে চাইলো চয়নিকা ।

- “বিভিন্ন ক্রাইমের খবর তুলে ধরার শো, নাম দিয়েছে দ্যা ডিটেক্টিভ শো ।” বলল চয়নিকার বাবা ।

- “ও ।” আর কিছু বলল না চয়নিকা । চয়নিকার বাবার জুতো খোলা শেষ হলে বক্সে রেখে যেতে যেতে শুধু জিজ্ঞেস করলেন, “খেয়েছিস তোরা?” চয়নিকা জবাব দিলো, “না বাবা তোমার জন্য বসে আছি ।”

এদিকে নামাজ পড়ে নিজের রুমে ফিরল আবির । আবার টেবিলে বসলো । মনে মনে একবার চয়নিকার কথা ভাবলো । তারপর আবার পড়ায় মন দিলো । সে সময় এলো একটা ফোন । আবির ভাবল হয়তো চয়নিকার কল, তাই তাড়াতাড়ি করে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল, এটা চুনির কল না । রায়হান ভাইয়ের কল । আবির কল ধরে বল, “হুম ভাই বলো ।”

- “হ্যাঁ আবির? তুই একটু আসতে পারবি রেস্টুরেন্টে?” বলল রায়হান ভাই ।

আবির রেস্টুরেন্টে গেলো । যেয়ে দেখল, ব্যাগপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে ইফাজ আর পায়েল । গাড়িতে জামাকাপড়, আর প্রয়োজনীয় হাতে গোনা ৪-৫টা আসবাবপত্র ভ্যানে রেস্টুরেন্টের সামনে রাখা । রায়হান ভাই আবিরের কাছে এসে বলল, “আবির, কিছু মনে করিস না, স্যার উনার স্ত্রীকে নিয়ে থাকবেন, একটা বড় রুম………” আবির বুঝতে পেরেছে রায়হান ভাই কি বলতে চাচ্ছেন, তাই রায়হান ভাইয়ের কথা শেষ করতে না দিয়েই আবির বলল, “আরে ভাই, কি বলছেন এসব আপনি, এটা কি আমার নিজের নাকি, যিনি এসেছেন থাকতে তার-ই তো রুম, আপনারাই যেহেতু সামলাচ্ছেন, তাই আপনাদের যা করতে ইচ্ছে হয় তাই করুন না ।” রায়হান আর আবির একটু ফিসফিসিয়ে ইফাজের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথা বললেই ইফাজ কিন্তু ঠিকই বুঝে গেলো ওরা কি নিয়ে কথা বলছে । ও বলল, “সমস্যা নেই, রায়হান, তুমি এক কাজ করো । রেস্টুরেন্টের যে রুমে সেদিন আমি আবিরকে দ্বীপের চিঠি দেখিয়েছিলাম, আমি ওই রুমে থাকলে কোন আপত্তি আছে কি?” রায়হান বলল, “ছি ছি, কি যে বলেন না স্যার, আপনার বাড়ি, আমাদের কেন আপত্তি………” “আমরা ওখানেই থাকবো ।” রায়হানের কথা শেষ হতে না হতেই বলল ইফাজ । আবির ইফাজের চেহারা দেখে বুঝল, নিজের রাগ দিয়ে কষ্ট ঢেকে রাখা ব্যর্থ চেষ্টা করছে ইফাজ । আবির বলল, “আমি মালপত্র আনা নেয়ার কাজ করছি ।” বলেই আবির রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোতে যাবে, এমন সময় ইফাজের  কথা শুনে  আবির  দাঁড়িয়ে গেলো । ইফাজ বলল, “দরকার  নেই । আমি এমন কাউকে দিয়ে এ কাজ করাই  না, যার জেদটা একটু বেশি ।” আবির কিছু বলল না । তবে আবির কষ্ট  পেলো  না । এটুকু বুঝল, ইফাজ আবিরের  ওপর বেশ রেগে আছে । কিছু লোকজনই মালামাল নিয়ে ওই ঘরটায় নিয়ে গেলো । একটা ফ্রিজ, একটা খাট, একটা ড্রেসিং  টেবিল    , একটা আলমারি আর একটা ট্রাঙ্ক দেখল  আবির । রায়হান আর আবির একে  অপরের  দিকে তাকাল, কিন্ত কিছু বলল না ।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আবির খেয়াল করলো, কলিমা আপু দরজায় নক করছেন । আবির উঠে দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে আপু?” কলিমা বলল, “আবির, গতকাল যে ইফাজ স্যার আর উনার বউ আইছে, উনারা কি শুরু কইরা দিছে । পায়েল আপা রান্না করতে চাইতেছে, আর ইফাজ স্যার ওয়েটার হইতে চাইতেছে ।” আবির অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি? কেন?” কলিমা বলল, “কি জানি, উনারা চায় নিজেরা নিজেদের ব্যাবস্থা করতে, অন্য কারো দয়া নিতে চান না । কি করি বলতো, ভাইও বিপদে পইড়া গেছে । ভাইয়ের  কথা  শুনতেছেই না ।” আবির বলল, “আচ্ছা আমি যেয়ে দেখি ।”  আবির গেলো রেস্টুরেন্টে । ঢুকেই দেখল, ইফাজ কিছু লোকেদের খাবার দিচ্ছে, সকালে তেমন লোক হয়  নি এখনও । বাকি ওয়েটারদের খুব অল্প কয়েকজন কাজ করছে, অন্যরা দাঁড়িয়ে ইফাজের কাজ দেখছে । রায়হান মাথায় হাত  দিয়ে ক্যাশ কাউন্টারে বসে । আবির রান্নাঘরে যেয়ে দেখল, পায়েলই রুটি বানাচ্ছে, ভাজছে । কেউ যদি বলতে আসে, “আমি আপনেরে সাহায্য করি?” তাহলেই পায়েল বলে, “প্লিজ না, আমাকে করতে দিন ।” আবির রান্নাঘর থেকে আবার চলে এলো । ইফাজ রায়হানের  কাছে  এসে জানতে চাইলো, “বার্গার  কোথায় রাখা আছে?” রায়হান বলল, “স্যার! আপনি অনেক  করছেন, আমাদের জন্য,  এর  ঋণ কখনো শোধ  হবে না, এবার প্লিজ স্যার, আপনে আমাদের আপনার  কিছু সাহায্য করার সুযোগ দেন!” ইফাজ বলল, “তুমি যতবার একই প্রশ্ন  করবে, আমিও  ততবারই একই জবাব দেবো । আমি কারো অনুগ্রহ নিয়ে বাঁচতে চাই না! ঠিক আছে, বলা লাগবে না বার্গার কোথায় আছে । আমি নিজেই খুঁজে নিচ্ছি ।” ইফাজ সেখান থেকে চলে যাচ্ছিলো, এমন সময় আবির বলে উঠলো, “এবার আপনার নিজের জেদটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না কি?”









(২৩)

ইফাজ আর কিছু বলল না । নিজের প্রতি ইফাজ যে একটু লজ্জা পেয়েছে, সেটা ইফাজের চেহারা দেখেই বোঝা গেলো । আবির বলল, “কাইন্ডলি আপনারা নিজের ঘরে যান! প্রথম দিনই এসে এমন কিছু করবেন না, যাতে এই রেস্টুরেন্টের সম্মান নষ্ট হয়, এই বস্তির যে মানুষগুলো খেটে চলেছে রেস্টুরেন্টের উন্নতিতে, তাদের অসম্মান করবেন না, আর এই রেস্টুরেন্ট কিন্তু তাদের নামে যারা আমাকে পালন করেছে আর যিনি আপনাকে পালন করেছেন!” ইফাজ সামনের দিকে তাকাল । সবাই ইফাজের দিকে তাকিয়ে আছে, ইফাজের আচরণে সবাই যে অসন্তুষ্ট হয়েছে, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে । বেশ কয়েকজন কাস্টোমার “কি ফালতু রেস্টুরেন্ট, খাবোই না ।” বলে চলে যাচ্ছে তাও দেখলো ইফাজ । পড়ে নিজের প্রতি এক প্রকার রাগ করেই পায়েলকে রান্নাঘর থেকে নিয়ে নিজেদের রুমে গেলো । রায়হান আবিরের কাছে এসে বলল, “আবির, তোর কলেজ আছে না?” আবির বলল, “হুম, আমি যাই ।” রায়হান বলল, “রেডি হয়ে আয়, আমি তোর খাবারের বাবস্থা করছি ।” আবির যেতে যেতে বলল, “দরকার নেই, দেরি হয়ে গেছে এমনিতেই ।”

দুপুরে কলেজ থেকে আসার পর আবির ইফাজের রুমের দিকে যাচ্ছিলো, দরজার কাছে আসতেই চুপি চুপি আবিরকে সেখান থেকে দূরে ক্যাশ কাউন্টারে নিয়ে গেলো আবির জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”

- “তোর ওপর রেগে আছেন স্যার । অনেক কষ্টে ঠাণ্ডা করেছি । এখন আর যাস না ।” বলল রায়হান ।

- “যাবো না মানে, ভুল করবেন উনি, আর দোষ ধরবেন আমার?” রাগের বশে জোরে জোরে বলল আবির ।

- “আস্তে বল আস্তে! শুনতে পাবে তো!” প্রায় ফিসফিসিয়ে আবিরকে বলল রায়হান ।

- “কি বলেছেন উনি?” জানতে চাইলো আবির ।

- “তেমন কিছু না । এই যে তুই উনাকে সকালে কথাগুলো শোনালি, তাই বলল, তোর ভদ্রতা সভ্যতা কিচ্ছু নেই, তুই একটা বদমাইশ ।” বলল রায়হান ।

- “আর তুমি কি বললে?” বলল আবির ।

- “আমি আর কি, বুঝিয়েছি?” বলল রায়হান ।

- “না, কি বুঝিয়েছো, তা বলো!”

- “আরে, এই ওই বলে বুঝিয়েছি । যে আবিরের মাথা ঠিক ছিল না, আবির ভুলে বলে ফেলেছে ।” বলল রায়হান ।

আবির কিচ্ছু বলল না । তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রায়হানের দিকে তাকিয়ে রইল । একটু থেমে রায়হান জিজ্ঞেস করলো, “কিরে?”  আবির বলল, “মানে আমার কথা তোমাদের কাছেই ভুল, তাই না?” রায়হান আবিরকে রাগ না করার জন্য বলল, “আরে! ওই সময় কি আর করতাম, বল!” আবির কিছু না বলে চলে গেলো । রায়হান, “আবির! আবির!” বলে আবিরকে ডাকলো, কিন্তু আবির সাড়া দিলো না । সোজা চলে গেলো নিজের রুমে ।

রাতের বেলার কথা । নিজের টেবিলে বসে আবির পড়ছিল, এমন সময় এলো একটা ফোন । কানে নিয়ে বলল, “হ্যালো! কে বলছেন?” ফোনের ওপাশ থেকে চয়নিকার গলার আওয়াজ এলো, “কি মিস্টার কাপুরুষ, এখনও আমার নাম্বার সেইভ করেন নি? বলেছিলাম আমাকে পছন্দ হলে কামহিলা দিয়ে সেইভ করতে?” আবির বলল, “না, সময়ের অভাবে সেইভ করা হয় নি । আর কি নাম দেবো তা একান্তই আমার ব্যাপার । আর তুমি যে আমাকে আপনি করে ডাকছো, এতেই ভালো লাগলো । আবার আপনিতে চলে গেলাম ।” চয়নিকা হেসে উঠলো । আবির বলল, “হাসছো কেন?” চয়নিকা বলল, “আমি তো একবারই আপনি বললাম, আর তুমি তো এখনও তুমি করে ডেকে চলেছো, তাহলে কি করে আমরা আপনি-তে ফিরে গেলাম?” আবির নিজের মুখের ওপর হাত রেখে আফসোস করলো । চয়নিকা বলল, “তা, খাওয়া দাওয়া হয়েছে?” আবির বলল, “না, তোমার হয়েছে?” আবির “না” বলতে যাবে, এমন সময় দরজা খুলে কেউ ভেতরে ঢুকল । আবির তাকিয়ে দেখল, ইফাজ । আবির চয়নিকাকে, “আচ্ছা, আমি পড়ে কথা বলছি” বলে ফোন কেটে দিলো । আবির উঠে দাঁড়ালো । ইফাজ বলল, “আমার সাথে একটু বাইরে আসবি?”

আকাশে আজ যেন তারার মেলা বসেছে । তারই মাঝে আধখানা চাঁদ । আবির আর ইফাজ দুজনেই ওই চাঁদের দিকে তাকিয়ে রেইল লাইনের পাশে বসে আছে । একটা ট্রেন ওদের সামনে দিয়ে চলে গেলো । খুব সম্ভবত এই স্টেশনে থামবে না । ইফাজ তখন বলতে লাগলো, “তুই ঠিকই বলেছিস । আমার জেদটা আসলেই একটু বেশি । ঠিক তোর মতো । যার জন্য এক সময় আমার মা কি করেছিলেন তার ঠিক খোঁজ না নিয়েই আমি আমার বাবাকে দোষারোপ করে চলে এসেছিলাম । বাবার কোন খোঁজও নেই নি পড়ে । বাবা মরার পর জানতে পারলাম সব দোষ মায়েরই ছিল । আজ হয়তো বাবাকে দেয়া কষ্টেরই ভুলের মাশুল আমাকে দিতে হচ্ছে ।” আবির কিছু বলল না ।










(২৩)

ইফাজ আবারও বলল, “আসলে আমার জীবনটাই আজব । মায়ের ধোঁকায় পড়লাম, বাবার অভিশাপের ভাগীদার হলাম । আজ সেই  অভিশাপে আমার ছেলে আমায় ছেড়ে চলে গেলো । হয়তো আমার জন্য আরও অনেক খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে । কিন্তু আমার জন্য সব ভুগতে হচ্ছে পায়েলকে ।” আবির এবারও চুপ করে রইল ।

“ম্যাডাম আসমু?” দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পায়েলকে বলল কলিমা । কলিমা একা একা বিছানায় বসে বাইরে দিকে তাকিয়ে ছিল । কলিমার কথা শুনে কলিমার দিকে  তাকাল পায়েল । তারপর হালকা হাসতে চেষ্টা করে বলল, “হ্যাঁ, এসো  কলিমা ।” পায়েলের কাছে গেলো কলিমা । তারপর বলল, “আইলাম, আপনে কি খাইবেন না খাইবেন, সেই ব্যাপারে শুনতে ।” পায়েল বলল, “সে খাবো, তোমরা যা খাও, তাই-ই দিয়ো । তুই বোসো, একটু কথা বলি ।” কলিমা মেঝেতে বসতে যাচ্ছিলো, পায়েল বলল, “আরে আরে কি করছো! আমার পাশে এসে বোসো!” কলিমা একটু অবাক হল । পায়েল অভয় দিয়ে বলল, “লজ্জা কোরো না । আমি কোন রাজাবাদশার মেয়ে নই । আর তাছাড়া আমিতো এখন তোমাদের বস্তিরই একজন বাসিন্দা ।” কলিমা তবুও গেলো না । দাঁড়িয়েই রইল । পায়লে বলল, “আহহা! এসো না ।” কলিমা পায়েলের  পাশে যেয়ে বসলো । পায়েল বলল, “তুমি খাওয়া দাওয়া করেছো?” কলিমা বলল, “না । আসলে আপনে কি খাইবেন, তাই ভাতেছিলাম ।” পায়েল বলল, “টেনশন কোরো না । আমিও তো তোমাদের মতোই মানুষ, তোমরা যা খাবে, আমিও তাই খাব । আমি তোমার সময় নষ্ট করছি না তো?” কলিমা হালকা হাসিমুখে বলল, “না ম্যাডাম, আপনে কোন কি কইবেন ।” পায়েল বলল, “তুমি বিয়ে করেছো, তাই না?” কলিমা ওপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলল, “হ ম্যাডাম, তয় আমার জামাই ভালানা । কেমন জানি ।” পায়েল ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন মানে? মারধর করে নাকি?” কলিমা বলল, “না, তা না । তয় একটু হাবাগোবা ধরণের ।” পায়েল হালকা হেসে বলল, “ও । তাই বলো ।” কলিমা জিজ্ঞেস করলো, “আপনের  স্বামী  আপনেরে খুব ভালোবাসে । তাই না?” পায়েল হুম । আমার স্বামী একজন ভালো মানুষ, কিন্তু আমার স্বামীর অনেক সমস্যা আছে । সে আবিরের মতোই  জেদি । সামান্য  একটা  ব্যাপারে  বেশ জেদ করে । আর সামান্য ব্যাপারেই রাগ করে বসে ।”

“আসলে জেদ জিনিসটা জানিস তো, সবারই আছে । কারো কম কারো বেশি ।”ওদিকে আবিরকে বলল ইফাজ । আবির এখনও চুপ । কিছু বলছে না । কি বলবে তাই খুঁজে পাচ্ছে না । ইফাজ আবারও বলল, “পায়েলের মতো স্ত্রী পাওয়া ছিল আমার জন্য ভাগ্যের ব্যাপার । ও ছিল বলেই আজ আমি এতোটা দুর এসেছি ।” এতক্ষণে আবির মুখ খুলল, “কেন?”

“ও আমার কথা শুনেই তোমাদের এই রেস্টুরেন্ট বানানোর কাজে সাহায্য করেছিলো । আমি না থাকলে হয়তো ও এই কাজটা করতো না । অবশ্য এখানে আমারই পুরো ক্রেডিট নেই । ইফাজ ওর বাবার ডায়রিতে আসল সত্যটা জানতে  পেরেই মূলত রেস্টুরেন্ট বানানোর কাজে এগিয়ে গিয়েছে । তবে আমার যেমন মনে হয় আমার মতো স্ত্রী পেয়ে ও খুব গর্ব বোধ করে, তেমনি ওর মতো একজন স্বামী পেয়েও আমি গর্ব বোধ করি ।” কলিমা প্রশ্ন করলো, “কেন?”

“আজ পর্যন্ত আমি  কখনো ওর ওপর রাগ করিনি । ওর সব কথা শুনবার চেষ্টা করেছি । তুই খুঁজে দ্যাখ, এ যুগে কয়টা পরিবারে এরকম ঝগড়া ছাড়া পরিবেশ থাকে । তাই আমার মনে হয় হয়তো আমার মতো একজন স্বামী পেয়ে ও গর্ব বোধ করে ।” আবিরেরও একই প্রশ্নের জবাবে বলল ইফাজ । আবির আবার চুপ হয়ে গেলো । কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ রইল । তারপর আবির প্রশ্ন করলো, “জীবনে পায়েল আনটিকে ছেড়ে কি অন্য কাউকে ভালো লেগেছে?”

“না না, ওর মতো একজন স্বামী যার আছে, তার অন্য কাউকে কি করে ভালো লাগবে ।” কলিমারও একই ধরণের প্রশ্নের জবাবে বলল পায়েল । কলিমা জিজ্ঞেস করলো, “ইশ, আমি যদি আপনের স্বামীর মতো একজন ভালো স্বামী পাইতাম ।” পায়েল হালকা হেসে বলল, “দেখো, তোমার স্বামীও একদিন তোমাকে  ভালবাসবে ।” কলিমা বলল, হুহ, আর বাসছে ভালো । ও খালি ঘোর জামাই হইতে চায় । কি জন্যে আল্লাহই জানেন । খালি এইখানে আইসা থাকতে চায় । আর আমি আমার শ্বশুরবাড়ি থাকতে ও কার লগে জানি প্রায়ই দেখা করতে যাইত । আমাকে কইতো না কার লগে । তাই আরও রাগ করছি ওর ওপর ।” পায়েল প্রশ্ন করলো, “তোমার শ্বশুর শাশুড়ি কি করেন?” কলিমা বলল, “শ্বশুর নাই । শুনছি, এক সময় আমার শ্বশুররে কি একখান কামে জেলে নিয়া গেছিলো । কি অপরাধ করছিলো । আর শাশুড়ি খারাপ না, তয় আমার সাথে তেমন একটা কথা কইতে চাই না । কেন যে, আল্লাহই জানেন ।” পায়েল আর কিছু বলল না । একটু পর কলিমা বলল, “আপনে বসেন, আপনার জন্য খাবার লইয়া আসি ।” পায়েল কিছু বলল না, শুধু ডানে মাথা কাত করলো । কলিমা সেখান থেকে চলে এলো ।

“আচ্ছা, তুই কি কাউকে ভালোবেসেছিস?” আবিরকে প্রশ্ন করলো ইফাজ । আবির বলল, “একজনকে ভালো লেগেছিল, কিন্তু আমার আগেই ও আমার এক বন্ধুর হয়ে গেছে । আর সত্যি কথা বলতে এখন একজনকে কেন যেন ভালো লাগে । যদিও মন থেকে প্রেম করার ইচ্ছে ছিল না ।” ইফাজ তখন বলল, “বিয়ের আগে না করাটাই ভালো । তবে যদি করিস, নিজেকে এটা বুঝিয়ে করিস যে সারাজীবন ওর সাথে থাকতে পারবি, বা ও সারাজীবন তোর সাথে থাকতে পারবে । এ যুগে ওরকম একসাথে সারাজীবন থাকার মতো প্রেম ২০ কেজি  চালের মাঝে এটা আধভাঙ্গা চাল খোজার মতো কঠিন ।” আবির কিছু বলল না । হঠাৎ করে কেন যেন চয়নিকার কথা মনে পড়ে গেলো ।









(২৪)

পরদিন ছিল মঙ্গলবার । বিকেলে অয়নকে পড়াতে যাচ্ছিলো আবির, এমন সময় চয়নিকাদের বিল্ডিং-এর নিচেই আবিরের দেখা কলিমার স্বামী শাফির সাথে । শাফি আবিরকে দেখেই বলল, “আরে খোকা, কেমন আছো?” আবির হালকা বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনাকে বলেছি না আমাকে খোকা ডাকবেন না! আর আপনি এখানে কি করছেন?” শাফি বলল, “আমি তো এদিকেই থাকি । তা তুমি এখানে কি করছো খোকা?” আবির ভাবল, এখানেই যেহেতু লোকটা থাকে, সেহেতু আবির কোথায় প্রাইভেট পড়ায় তা বললে প্রতিদিন এসে লোকটা আবিরকে এরকম বিরক্ত করতে পারে । তাই আবির বলল, “এমনি, আমার এক বন্ধু থাকে ওর প্রাক্টিকাল খাতাটা নিতে এসেছি ।” লোকটা আবার অনুরোধের সুরে বলল, “প্লিজ! খোকা, আমাকে কলিমার কাছে নিয়ে যাও না খোকা! প্লিজ!” আবির, “ধ্যাত!” বলে চয়নিকাদের বিল্ডিং-এ না যায়া ওই জায়গা থেকে বেশ দূরে চলে গেলো । তারপর উঁকি দিয়ে দেখল শাফি লোকটা গেছে কি না । শাফি লোকটা দৃষ্টির আড়াল হতেই আবির আবার ফিরে এসে চয়নিকাদের বাসায় ঢুকল ।

“আচ্ছা রায়হান, তুমি কি সেদিনের জন্য রাগ করেছো আমার ওপর?” ক্যাশকাউন্টারে রায়হানের পাশে বসে রায়হানকে বলল ইফাজ । রায়হান বলল, “স্যার, আপনে যে কি কন । আপনে ভালো মানুষ । এইজন্য আপনে চান নাই কারো দয়ায় এইভাবে থাকতে । কিন্তু ভাইবা দ্যাখেন, এই জায়গাটা তো আপনেরই । আপনেই তো এই জায়গার মালিক । আর আমরা এই জায়গার ওপর ভরসা কইরা বাইচা ছিলাম । এহন আপনার সেবা করার সুযোগ পাইছি, তাই করতেছি । এতে আপনের ঋণ তো শোধ করতে পারবো না, তাও মনের শান্তি ।” ইফাজ বলল, “কেন যেন ইদানীং মনে হয় জীবন আর বেশিদিন নেই । হয়তো বেশিদিন আর বেঁচে থাকা হবে না । কি জানি, কেন এমন মনে হয় ।” রায়হান বলল, “আল্লাহ ভরসা স্যার । আল্লাহ যতদিন বাচায় রাখে, ততদিন আমরা বাইচা থাকবো । এমন হইতে পারে আপনার আগে আমি মরলাম ।” ইফাজ আর কিছু বলল না । চুপ করে রইল ।

“এই সাধারণ ম্যাথটাও পারো না! উফ! এদিকে দাও আবার বোঝাচ্ছি ।” বলে অয়নের কাছ থেকে খাতাটা নিলো আবির । তারপর অয়নকে বোঝাতে  লাগলো ম্যাথটা কি করে সল্ভ করতে হয় । এমন সময় আবিরের ফোন বেজে উঠলো । আবির ফোনের দিকে তাকাতে যাবে, এমন সময় দেখল, চয়নিকা আবিরের ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে । অবাক দৃষ্টিতে চয়নিকা দেখছে, আবির চয়নিকার নাম্বার সেইভ করেছে কামহিলা দিয়ে । চয়নিকা আবিরের  দিকে তাকাল আবির লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলো । চয়নিকা আবিরের হাতে একটা কাগজ দিয়ে গেলো । আবির কাগজটা খুলে দেখল, তাতে লেখা, “কোচিং শেষে  ছাদে  দেখা হচ্ছে ।”

কোচিং শেষে আবির চলে গেলো ছাদে । চয়নিকা ছাদের একপাশে রাখা কিছু ফুল গাছের কাছে দাঁড়িয়ে । আবির চয়নিকার কাছে যেয়ে বলল, “কি ব্যাপার, ছাদে ডাকলে কেন?”

- “আমায় পছন্দ হয়েছে তাহলে?” হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো চয়নিকা ।

- “হুম ।” বলল আবির । চয়নিকার চেহারায় আনন্দের ছাপ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো ।

- “তবে বোন হিসেবে ।” আবিরের কথা শুনে চয়নিকার মুখ থেকে হাসি বিদেয় হল ।

আবির হেসে উঠলো । তারপর বলল, “আরে, রাগ করছো কেন, মজা । করলাম ।” 

চয়নিকার আবিরের দিকে তাকাল । তারপর বলল, “সত্যি?” আবির বলল, “হ্যাঁ সত্যি । মানে তোমার মতো আজব মেয়ে আমি প্রথম দেখলাম, যে কিনা একটা ছেলেকে প্রথম দেখেই ভালোবেসে ফেলে । অবশ্য আমাকেও সে ফাঁদে জড়িয়ে ফেলেছো ।” চয়নিকা তখন বলল, “তো, আমার সম্পর্কে তো তুমি অনেক কিছুই জানো, তোমার সম্পর্কে কিছু বলো ।”

- “আমার সম্পর্কে কি বলবো?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “এই, তোমার মা বাবা কে, তোমার ভাই বোন কয়জন ।” বলল চয়নিকা ।

এতক্ষণ আবির হাসিমুখে ছিল, কিন্তু চয়নিকার কথা শুনে মুখটা আবার গোমড়া হয়ে গেলো । চয়নিকা আবিরকে এরকম গোমড়া হতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কি হল?” আবির হালকা হাসবার চেষ্টা করে বলল, “আমি এতিম ।” চয়নিকা কষ্ট পেয়ে বলল, “ও, আ’ম সো সরি, আমি বুঝতে পারিনি ।”

- “ইট’স ওকে । তুমি তো জানতে না ।” বলল আবির ।

“কার কাছে তাহলে থা………” চয়নিকা পুরো প্রশ্নটা করার আগেই চয়নিকার মোবাইলে একটা কল এলো । অয়নের কল । চয়নিকা ফোন কানে নিতেই অয়ন হালকা ভয়ের সাথে বলল, “আপু, আবার সেই চোর এসেছিলো, চুরি হয়েছে বাসায় ।” চয়নিকা আর আবির নিচে নেমে এলো । দেখল সোফার ওপর বসে অয়ন আর পাশে দাঁড়িয়ে কাজের লোক শিউলি দারিয় আছে । অয়ন কেমন যেন ভয় পেয়েছে । চয়নিকা অয়নের কাছে যেয়ে অয়নকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কিরে! ঠিক আছিস তুই?” অয়ন বলল, “হ্যাঁ আপু ঠিক আছি ।” চয়নিকা জিজ্ঞেস করলো, “তুই ভয় পেয়েছিস কেন?” অয়ন বলল, “আমি আজকে চোরটাকে দেখেছি । মুখ ঢাকা ছিল । বাবার লকারের ওখানেই ছিল । আমি লাঠি নিয়ে মারার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন ওই লোকটা টের পেয়ে আমার হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে চাকু দিয়ে মারতে নেয় । তখন শিউলি আপু এসে চোরটাকে আরেকটা লাঠি দিয়ে মারে । চোর বাড়ি থেকে তারপর পালিয়ে যায় ।” আবির আর চয়নিকা দুজনেই শিউলির দিকে তাকাল । চয়নিকা শিউলিকে বলল, “থ্যাংকস শিউলি ।”











(২৫)

আবির শিউলিকে জিজ্ঞেস করলো, “আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?”

- “জি, জিগান ।” বলল শিউলি ।

- “আপনি চোরকে মারলেন ভালো কথা, কিন্তু এতো আস্তে মারলেন যে চোরের কিছুই হল না?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “আবির! এটা কেমন প্রশ্ন! উনার এতোটাও শক্তি আছে নাকি? আর উনি তো তখন ভয় পেয়েছিলেন ।” হালকা বিরক্তির সাথে বলল চয়নিকা । শিউলিও তাতে সায় দিয়ে মাথা নাড়ল । আবির আর কিছু বলল না । একটু পর অয়ন বলল, “আপু, বাবাকে  ফোন করে জানিয়েছি, বাবা খুব তাড়াতাড়িই চলে আসবে ।” চয়নিকা ভয় পেয়ে  বলে উঠলো, “কি!”  তারপর আবিরের হাত ধরে আবিরকে দরজার বাইরে রেখে বলল, “আবির! তুমি তাড়াতাড়ি চলে যাও! বাবা দেখলে ঝামেলা হয়ে যা………” কথা শেষ হল না চয়নিকার, কারণ এরই মধ্যে ওর বাবা লিফট থেকে বেরোলো । চয়নিকা ওই যা কথাটা  থেকেই  শুরু করলো, “যান, আর শুনুন! নেট লাইনটা একটু ঠিক করবেন!  টিভি ঝির ঝির দেখা যায়!” চয়নিকার বাবা দরজার কাছে এগিয়ে এসে একবার আবিরের দিকে তাকিয়ে তারপর চয়নিকাকে বলল, “কিরে? নেটের লাইনে  টিভি ঝিরঝির হয় নাকি, আর ইনি কে?” চয়নিকা চয়নিকা আর আবির একসাথে  কথা  বলে উঠলো । চয়নিকা বলল, “নেটওয়ালা!” আবির বলল, “ডিসওয়ালা!” এরপর দুজন দুজনের দিকে তাকাল । আবার দুজনে একসাথে কথা বলে উঠলো । আবির চয়নিকা বলল, “ডিসওয়ালা!” আবির বলল, “নেটওয়ালা!” চয়নিকার বাবা মাথা চুলকাতে লাগলো । তারপর বলল, “আমি তো কিছুই বুঝতে  পারছি না, কে তুমি ছেলে?” আবির একটু হেসে বলল, “ইয়ে মানে, আঙ্কেল আপনাদের এখানকার নেটের অফিসে কাজ করি, আমি নেটের বিল কালেক্ট করি আরকি, তো এ মাসে ডিসলাইনের অফিসেও কাজ নিয়েছি, তাই এখন থেকে নেটের বিল আর ডিসের বিল একসাথে কালেক্ট করতে এসেছি ।” চয়নিকার বাবার চেহারা থেকে ভয়ের ছাপটা চলে গেলো । তারপর বলল, “ও আচ্ছা, তাই বলো । কিন্তু চয়নিকা, বিল তো রেখে গিয়েছিলাম, চোর নাকি চুরি করে নিয়ে গেছে অয়ন বলল, তুই দিলি কোত্থেকে?” চয়নিকা বলল, “না বাবা, টাকা দেবো কোত্থেকে, উনি তো এই এলেন, টাকা নেই বলেইতো উনাকে যেতে বলছিলাম, আর নেটের লাইনের একটু প্রবলেম হয় বলে দেখতে বলছিলাম, টিভি বেশি বাফার করে বলতে গিয়ে ঝির ঝির করে বলে ফেলেছি ।” চয়নিকার কথা হতে হতে চয়নিকার বাবা পকেট থেকে টাকা বের করে আবিরের হাতে নেটের বিল ১০০০ আর ডিসের বিল ৪০০ এগিয়ে দিলো । আবির জিজ্ঞেস করল, “কিসের টাকা?” চয়নিকার বাবা বলল, “সেকি, কিসের টাকা মানে?” আবির মনে পড়েছে এমন একটা ভাব নিয়ে বলল, “ও হ্যাঁ নেট আর ডিসের বিল ।” বলে আবির নিলো হাতে টাকা তারপর আবির চলে গেলো । চয়নিকার বাবাও ভেতরে চলে গেলো ।

রাতের কথা । আজ চয়নিকা ফোন দেবার আগেই আবিরই ফোন দিলো চয়নিকাকে । ফোন ধরে চয়নিকা বলল, “কি ব্যাপার, সূর্য আজ কোন দিকে উঠেছে?”

- “যথারীতি পূর্ব দিকে, সূর্য তো আর তোমার মতো অবাধ্য নয় ।” বলল আবির

- “এই, শুরু হল, মানে সব কিছুতেই তোমার আমাকে জড়াতে হবেই!” বলল চয়নিকা ।

- “আচ্ছা, বাদ দাও, তোমার বাবা কি বলল চুরির ব্যাপারে?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “এই যে মিস্টার কাপুরুষ, আমাদের বাড়ির ব্যাপারে আপনার এতো মাথা ব্যাথা কেন?” বলল চয়নিকা ।

- “বাহ! আমাকে নিজের স্বামী বানিয়ে ফেলেছ, আর শ্বশুর মশাই চুরির ঘটনায় কি মতামত দিলেন তার খোঁজ একটু নেয়া লাগবে না?” বলল আবির ।

- “যাক, ভালোবাসা তাহলে এতোদুর পেরিয়ে গেছে!” খুশি হয়ে জবাব দিলো চয়নিকা ।

- “এই যা, মনে হয় একটু বেশিই বলে ফেললাম ।” লজ্জা পেয়ে বলল আবির ।

- “ব্যাপার না । আচ্ছা, তুমি কি এর আগে কাউকে ভালোবেসেছ?” জিজ্ঞেস করলো চয়নিকা ।

- “তোমার কাছে লুকবো না । সত্যি কথা বলতে একজনকে লেগেছিলো ভালো । তবে আমার অন্য এক খুব ভালো বন্ধু ওকে পছন্দ করেছিলো বলে আর কাউকে তা বুঝতে দেই নি । এখন ওই মেয়ে আমার বন্ধুরই আছে ।” বলল আবির ।

- “এহ! এ কেমন বন্ধু তোমার? নাম কি?”

- “হুম, অনেক ভালো বন্ধু ও আমার, ওর নাম…………” নামটা আর বলা হল না আবিরের । তার আগেই চয়নিকা কলিংবেলের আওয়াজ শুনে বলল, “এই এক মিনিট, আমি একটু আসছি হ্যাঁ?” আবির বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, পড়ে কথা বোলো । ও ভালো কথা, টাকাগুলো কি করবো?” চয়নিকা ইয়ার্কি করে বলল, “ওটা দিয়ে একদিন আমরা ডেট করতে যাবো । রাখি ।” বলে ফোন কেটে দিলো চয়নিকা । আবির চেয়ারের সাথে হ্যালান দিয়ে চয়নিকার চেহারাটা কল্পনা করতে লাগলো । অবশেষে ও বয়ফ্রেন্ড পরিচয় পেতে চলেছে । একদিন পাবে জামাই পরিচয় ।









(২৬)

একটু পর আজানের আওয়াজ এলো । আবির টেবিল থেকে উঠে গেলো অযু করে নামাযে যাবার জন্য ।

দরজা খুলল চয়নিকা । দেখল নেটওয়ালা দাঁড়িয়ে । বলল, “আপা, আপনাদের নেটের বিলটা বাকি ছিল ।” এমন সময় চয়নিকার বাবা ডাইনিং রুমে যাবার সময় চয়নিকাকে  দরজার সামনে  দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে মা, কে এসেছে?” চয়নিকা দাঁত দিয়ে জিভ চেপে ধরল, তারপর একটু ভেবে বলল, “বাবা, ময়লার বিল নিতে এসেছে । নেটওয়ালা বলল, “ময়লার বিল!” চয়নিকা ফিস ফিস  করে নেটওয়ালার কানের কাছে এসে বলল,  “এখন প্লিজ ময়লার বিল নিয়ে যান, কাল আমি আপনার নেটের বিল দিয়ে দেবো ।  অনেক কাহিনী ভাই! আমি বিপদে পড়বো ।” নেটওয়ালা জিজ্ঞেস করলো, “কিসের ঝামেলা?” চয়নিকা বলল, “ভাই, প্রেমের কাহিনী, বুঝতেই তো  পারছেন আশা করি ।” নেটওয়ালা  মুচকি হেসে বলল, “আইচ্ছা, বুঝসি ।” চয়নিকা বাবার কাছ থেকে দেড়শো টাকা এনে নেটওয়ালাকে দিতে গেলে নেটওয়ালা বলল, “রাইখা দেন, ময়লাওয়ালা আসলে দিয়া দিয়েন ।” চয়নিকা নেটওয়ালাকে থ্যাংকস জানালো । তারপর নেটওয়ালা  চলে  গেলে দরজা লাগিয়ে দিলো । একটু পর আবার কলিংবেলের আওয়াজ । চয়নিকা রুমে  ঢুকতে  গিয়ে আবার বাসার দরজার দিকে গেলো । দরজা খুলে দেখল, একটা লোক । বলল, “আপা ডিসের বিলটা ।”

নামাজ পড়ে আবির গেলো ইফাজের রুমে । দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে নক করলো, ইফাজ জিজ্ঞেস করলো, “কে?” আবির জবাব দিলো, “আমি আবির বাব……আঙ্কেল ।” ইফাজ বলল, “ও, আয় ভেতরে আয় ।” আবির ভেতরে ঢুকলো । ইফাজ শুয়ে  ছিল এতক্ষণ, আবিরকে দেখে  উঠে  বসলো । আবির বলল, “শুতে ছিলেন, আমি ডিস্টার্ব করলাম ।” ইফাজ একটু হেসে বলল, “আরে না না, ডিস্টার্ব কিসের । আয় বোস ।” আবির বসলো । জিজ্ঞেস করলো, “কেমন লাগছে এখানে?”

- “আছি, ভালোই । এখন ভালো থাকলেই কি, না থাকলেই বা কি ।” বলল ইফাজ ।

- “পায়েল আনটি কোথায়?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “ও বোধ হয় কলিমার সাথে বাইরে গেছে । ঘরে কতক্ষন বসে থাকা যায় বল ।” বলল ইফাজ ।

- “ও, আচ্ছা ।” আর কিছু বলল না আবির ।

- “আচ্ছা, তোর বয়স ১৮ হয়েছে না?” জিজ্ঞেস করলো ইফাজ ।

- “না, আপনি আমাকে দত্তক হিসেবে যে বার্থ সার্টিফিকেট বানিয়ে দিয়েছিলেন, সেই হিসেবে সামনের বছর ৪এপ্রিলে ১৮ বছর হবে আমার । কিন্তু কেন?” বলল আবির ।

- “শোন না, আমার যে গাড়িটা আছে কাল থেকে ওটা তোকে চালান শেখাবো ।” বলল ইফাজ ।

- “বাহ! কিন্তু হঠাৎ এই ইচ্ছে জাগলো?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “এমনিই । কতদিন বাচি না বাচি, গাড়িটা একজনকে দিয়ে যেতে হবে তো । তুই ১৮ বছর হলে লাইসেন্স বানিয়ে নিস, আমি তোকে চালানো শিখিয়ে দেবো ।” বলল ইফাজ ।

- “সে আপনি আমার ১৮ বছর বয়স হলে শিখিয়ে দিয়েন । এতো তাড়াহুড়ার দরকার নেই ।” বলল আবির ।

- “না রে, ভয় হয় । শুধু মনে হয় আর হয়তো বেশিদিন বাঁচবো না ।” বলল ইফাজ ।

- “শুরু হল না! আপনার এসব উল্টাপাল্টা কথাই না খুব রাগ ধরে শুনলে । মানে ভালো কিছু মুখে আসে না, যতসব ।” একটু রাগ করে বলল আবির ।

- “আচ্ছা। যাই হোক, আমার কাছ থেকে ড্রাইভিং শিখে নিস । কাল থেকেই তাহলে ট্রেনিং শুরু করি?”

আবির ডানে বামে মাথা নাড়ল, আর কিছু বলল না । ইফাজের রুম থেকে নিজের রুমে আসার পর পরই আবিরের মোবাইলে একটা কল এলো । চয়নিকার কল । আবির ফোনটা রিসিভ করতেই চয়নিকা বলে উঠলো, “আবির! তুমি টাকাগুলো ঠিকমতো রেখেছ!”

- “হ্যাঁ, ঠিক মতোই তো রেখেছি, কেন?” বলল আবির ।

- “উফ! বাচলাম ।” স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল চয়নিকা ।

- “কেন কি হয়েছে?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “আজ নেটওয়ালা ডিসওয়ালা দুজনেই এসেছিলো । নেটওয়ালা যখন এসেছিলো তখন বাবা ছিল কাছেই, তাই নেটওয়ালাকে ময়লাওয়ালা সাজিয়ে নেটওয়ালাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিদেয় করেছি । আর ডিসওয়ালা সময় বাবা ছিল না, ডিসওয়ালাকেও বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিদেয় করেছি । এখন তোমার কাছে যে টাকা আছে, ওটা উনাদের ফেরত দিতে হবে । পরশু মনে করে এনো কিন্তু ।” বলল চয়নিকা ।

- “না আনবো না, ওই টাকা দিয়ে অন্য কিছু করবো ।” বলল আবির ।

- “ইশ! ঢং । বিয়ের আগেই শ্বশুরের টাকা মেরে দেয়া শুরু ।” বলল চয়নিকা ।

- “বাহ, বউ আমার কতো ভালো বোঝে, শুধু বিয়েটা হলেই হয় ।” বলল আবির ।

- “বিয়েটা হলেই হয় মানে! তুমি আমাকে বাদ দিয়ে আবার অন্য কাউকে ধরবে নাকি?” জিজ্ঞেস করলো চয়নিকা ।

- “আরে না, এখন থেকেই বাবার চক্ষুর আড়ালে  রাখছ, ভবিষ্যতে না আবার যেয়ে ডাইলোগ দিতে হয়, চৌধুরী সাহেব! আপনার মেয়েকে আমি চাই! চাই!” বলল আবির ।

- “না ওরকম কিছু হবে না ।” হেসে হেসে বলল চয়নিকা ।

ওরা একসাথে অনেকক্ষণ এভাবে কথা বলল । পরদিন  থেকে আবিরকে ড্রাইভিং শেখাতে লাগলো ইফাজ । তারপর দিন বিকেলে আবার চয়নিকার সাথে প্রাইভেট পড়াতে  গিয়ে প্রেম । এভাবে  কেটে যেতে লাগলো সময়, কেটে  যেতে  লাগলো দিন । আবির আর চয়নিকাও বেশ ঘনিষ্ঠ হতে লাগলো । এখন আবির চয়নিকাকে চুনি বলে ডাকে ।












(২৭)

প্রায় ১মাস পরের কথা । কোন এক বৃহস্পতিবার অয়নকে  পড়িয়ে ছাদে যাবার জন্য বেরোচ্ছিলো চয়নিকা আর আবির, এমন সময় শিউলি চয়নিকাকে বলল, “আফা, তরকারি ফ্রিজে রাখা লাগতো, ফ্রিজটা একটু খুইলা দেন ।” চয়নিকা “আচ্ছা দিচ্ছি ।” বলে ফ্রিজ খুলে তরকারিটা ভেতরে ঢুকিয়ে আবার তালা লাগিয়ে ফ্রিজের চাবি নিজের রুমে রেখে এলো । আবির জিজ্ঞেস করলো, “কি ব্যাপার! ফ্রিজ তালা দেয়া! আবার চাবিও তোমার কাছে?” চয়নিকা বলল, “আসলে বাবা একটা প্রোজেক্টের কাজে লাখ তিনেক টাকা তুলে রেখেছেন । এখন চোরের ভয় তো আছেই, তাই বাবা টাকাগুলো একটা পলিথিনে ভরে আটার গোলা বানিয়ে  তার ভেতর ভরে ফ্রিজে তালা দিয়ে আটকে রেখেছেন । যেন চোর ফ্রিজ খুলতে না পারে, আর পারলেও যেন টাকা না পায় ।”

- “চাবি তোমার কাছে কেন? ওই শিউলি আপুর কাছে দিলেও তো হয় ।” বলল আবির ।

- “শিউলি আপু বাজারে যায়, কতো কাজ করে, এর মধ্যে যদি অসচেতনবশত বা অন্য কোন কারণে চাবি হারিয়ে গেলে বা অন্য কারো হাতে চলে গেলে আবার ঝামেলা । তাই বাবা আমার কাছেই রেখে দিয়েছেন ।” বলল চয়নিকা ।

- “আচ্ছা, তোমার কি শিউলি আপুকে সন্দেহ হয়?” বলল আবির ।

- “আবির! কি যে বলো না, এই বাড়ি তৈরি হয়েছে ৫ বছর আগে, আমরা এসেছি প্রায় আড়াই বছর আগে । এই শিউলি আপু ৫বছর আগে থেকেই এই বাড়ি দেখাশুনা করছে । উনি কি করে এটা করবেন । আর তাছাড়া উনি যেহেতু বাড়িতেই আছে, চাইলে উনি সব টাকা নিতে পারতেন, বা টাকা নিয়ে আমরা যেন সন্দেহ না করি সেজন্য পালিয়েও যেতে পারতেন, তাও করেন নি । তার ওপর উনি চুরি করলেও া আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে তাহলে কে চুরি করছে?” বলল চয়নিকা ।

- “হুম । তাও একটা কথা । আচ্ছা, ৫ বছর আগে বিল্ডিং তৈরি হয়েছে, আর তোমরা এসেছ মাত্র আড়াই বছর আগে? কেন?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “আসলে এই বাড়ি, এই জমি আমার বাবার ছিল না । আমার চাচার ছিল, মানে আমার বাবার ভাইয়ের ।” বলল চয়নিকা ।

- “তোমার বাবার ভাই তোমার বাবাকে এই বাড়ি দিয়ে দিলেন! ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত হয়ে গেলো না?” বলল আবির ।

- “আরে না না, আমার চাচা অনেক ভালো মানুষ । আজ থেকে প্রায় আড়াই বছর আগে একটা ঘটনা ঘটেছিলো, যার প্রেক্ষিতে আমার এখানে আসা ।” বলতে বলতে হালকা বিমর্ষ হয়ে গেলো চয়নিকা ।

ওদিকে বাসায় অয়ন পাবজি খেলছিল, এমন সময় আখি ঘরে ঢুকল । “চুনি, এই চুনি! চুনি?” কয়েকবার দেকেও সাড়া পেলো না চুনির । আখি অয়নের রুমে যেয়ে ডাকলো অয়নকে, “অয়ন চুনি কোথায় রে?” অয়নের কানে ইয়ারফোন থাকায় শুনতে পেলো না অয়ন । আখি এসে চয়নিকার এক কানের ইয়ার ফোন খুলে দিলো । অয়ন এতে একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “কি হয়েছে!”

- “চুনি কোথায়?” জিজ্ঞেস করলো আখি ।

- “ছাদে গেছে ।” বলল অয়ন ।

- “ছাদে! এই সময় তো ও আগে ছাদে যেতো না! কার সাথে গেছে?” জিজ্ঞেস করলো আখি ।

- “আবির ভাইয়ের সাথে ।” বলল অয়ন ।

- “আবির! মানে তোর টিচার!” অবাক হয়ে বলল আখি ।

অয়ন আর কিছু বলল না । কানে ইয়ারফোন আবার গুজে নিলো ।

ওদিকে ছাদে চয়নিকাকে আবির জিজ্ঞেস করলো, “কি ঘটনা?” চয়নিকা কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল । তারপর কি ভেবে যেন কেঁদে উঠলো । আবির বলল, “আহ! কাঁদছ কেন! কি হয়েছে?” চয়নিকা কিছু বলল না । আবির চয়নিকার আরও কাছে এগিয়ে এসে চয়নিকার চোখের পানি মুছে দিয়ে চয়নিকার দুই গালে হাত রেখে বলল, “আমাকে বলো কি হয়েছে, আমাকে তুমি তো ভালোবাসো, তবে আমায় তোমার আড়াই বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা বলতে কেন এতো ভয় পাচ্ছো?” চয়নিকা চোখের জল মুছে দেয়া থেকে আবিরের বলা শেষ কথাটাও ছাদে এসে শুনে ফেলল আখি । আখি তখন হালকা কড়া  গলায় ডাকলো, “চুনি!” চুনি আর আবির দূরে সরে গেলো । দুজনেই হালকা ভয় পেয়ে গেলো । আখি চয়নিকার কাছে এগিয়ে এলো । তারপর চয়নিকার হাত ধরে নেচে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “নিচে চল, কথা আছে ।” আবির ভয় পেয়ে গেলো । চয়নিকাকে মারবে না তো । আবিরও একটু পর নিচে নামলো । আখির রুমের  দরজার সামনে এসে দাড়াতেই শুনতে পেলো ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে, চয়নিকাকে আখি কড়া ভাষায় বলছে, “তোর লজ্জা নাই! আজ তোর জন্য মা এতো কষ্ট করে লন্ডনে নিশানকে মানুষ করছেন, আজ তোর জন্য বাসায় কোন পর পুরুষ আসতে পারে, আর তুই আবার শুরু করলি! সেই একই ভুল আবার করার জন্য!” ভেতর থেকে চয়নিকার আওয়াজ এলো, প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “আপু! প্লিজ! আমি আর আগের ভুল করবো না!” আখি আবার বলল, “শোন, বেশি বুঝিস না । দাঁড়া, আমি  বাবাকে বলে খুব তাড়াতাড়ি তোর বিয়ের ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি ।” বলে রুম থেকে বেরোনোর জন্য দরজা খুলতেই আবিরকে দেখল আখি । আখি আবার রুমে ঢুকে ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে লাগলো । এরই মধ্যে আবির চয়নিকার দিকে তাকাল । চয়নিকা কাঁদছে । একটু পর আখি আবিরের হাতে টাকা দিয়ে বলল, “যা পড়িয়েছো, যথেষ্ট পড়িয়েছো । এবার দয়া করে যাও! প্লিজ!” আবির চয়নিকার দিকে তাকিয়ে আছে । হাত থেকে টাকা পড়ে গেলো আবিরের । আখি যখন বুঝল আবির চয়নিকার দিকে তাকিয়ে তখন প্রচণ্ড রেগে বলল, “এই ছেলে! কাটাচামচ দিয়ে চোখ তুলে ফেলবো কিন্তু! যাও!” এক  প্রকার ধাক্কা দিয়ে দিয়েই আবিরকে বাসা থেকে বের করে দিলো আখি । বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আবির । চয়নিকাও উঠে এসেছে আবিরকে দেখতে । দূরে দরজার আড়াল  থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে আবিরকে । আবির চয়নিকার দিকে তাকিয়ে । আখি “গেট লস্ট!” বলে দরজা  আটকে দিলো । যতক্ষণ পর্যন্ত দরজা দিয়ে চয়নিকাকে দেখা যায়, ততোক্ষণ  আবির চয়নিকার দিকে তাকিয়ে ছিল । ধীরে  ধীরে দরজা সম্পূর্ণ আটকে  গেলো ।











(২৮)

রাতের কথা । বিছানায় শুয়ে ছিল আবির । পড়ায় আজ মন বসছে না । শুধু চয়নিকার জলে ভেজা চোখদুটোর  কথা মনে পড়ছে । এমন সময় আবিরের  মোবাইলে একটা কল এলো । স্ক্রিনে ভেসে উঠলো নাম, “কামহিলা” । আবির তাড়াতাড়ি করে উঠে বসে ফোন ধরল । ফোনের ওপাশ থেকে চয়নিকা বলল, “কি ব্যাপার মিস্টার  কাপুরুষ! কেমন আছো?” আবির তো পুরোই অবাক, যা শুনছে ঠিক  শুনছে তো? চয়নিকা  এতো হাসিখুশি  কি করে? আবির বলল, “চুনি! তোমার কষ্ট হচ্ছে না?” চয়নিকা হেসে বলল, “এমনি এমনি  তোমাকে কাপুরুষ বলি নাকি? আরে চলে গেছো তাতে কি, ফোনে তো কথা হবেই, আর তাছাড়া আমার বাইরে বেরোনো তো বন্ধ হয় নি । দেখা হয়ে যাবে না হয় ।” আবির বলল, “বাহ! তুমি তো আসলেই খুব ইঁচড়ে পাকা!” চয়নিকা বলল, “এই! আমাকে ইনসাল্ট করবে না । এহ! এসেছে আররেকজন ।” দুজনে আবার বেশ কিছুক্ষন কথা বলল ।

পরদিন সকালের কথা । সেদিন ছিল শুক্রবার । আবির ঘুম থেকে রেস্টুরেন্টে গেলো । রায়হান আর লিলি বসে ক্যাশ কাউন্টারে । আবিরকে দেখেই লিলি উঠে দাঁড়িয়ে হালকা রাগ নিয়ে বলল, “আমি বুঝতে পেরেছিলাম তোর সাথে চয়নিকার কিছু একটা আছে ।” আবির বলল, “হুম তো?” লিলি অবাক হয়ে বলল, “মানে! তুই যে প্রাইভেট হাতছাড়া করলি, কিছু বুঝতে পারছিস!” আবির বলল, “আবার চলে আসবে হাতে ।” লিলি অবাক হয়ে বলল, “মানে?” আবির একটু হেসে বলল, “তুমি বুঝবে না ।” তারপর আবির রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলল, “কি খবর ভাই, খুব খুশি খুশি লাগছে তোমাকে?” রায়হান কিছু বলার আগেই লিলি বলল, “তোর ভাই তো  লটারি জিতে ১০০সিলিন্ডার গ্যাস ফ্রি পেয়েছে ।” আবির বলল, “বা! বা! ১০০ সিলিন্ডার গ্যাস! তা কবে দেবে?” রায়হান বলল “পরশু দেবে বলেছে ।” আবির বলল, “বাহ, খুব ভালো খুব ভালো ।”

বিকেলের কথা । মতিঝিলের এক বাজারে এমনি হেঁটে বেড়াচ্ছিল আবির । এমন সময় একটা চাবির দোকানের সামনে আবিরের দেখা শাফির সাথে । হাতে একটা আটার গোলা নিয়ে দাঁড়িয়ে । আটার গোলার  ওপর চাবির ছাপ । বেশ সাবধানে ধরে রেখেছে, চাপ  পড়লে  চাবির ছাপটা নষ্ট হয়ে  যাবে । আবিরকে শাফি দেখতেই বলল, “আরে, এইতো খোকা, কেমন আছো?”

- “আপনাকে বলেছি না, আমাকে  খোকা ডাকবেন না ।” বলল আবির ।

- “আহা! খোকা, রাগ করে  কেন?” বলল শাফি ।

- “আবার!” হালকা বিরক্ত হয়ে বলল আবির ।

- “আচ্ছা, ছেলে, তোমাকে আমি ছেলে বলেই ডাকবো । খুশি খোকা?” বলল শাফি ।

- “আবার খোকা! আচ্ছা বাদ দেন । হাতে কি?” বলল জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “আর বোলো না খো……ছেলে, বাসার চাবি  দুটো করে রাখা ছিল । একটা আজ হারিয়ে গেলো । তাই আরেকটা দিয়ে নতুন চাবি বানিয়ে রাখছি । তোমার  কলিমা আপু  এলে  চাবি না পেলে আমায়  ছাড়বে না ।” বলল শাফি ।

আবির শুধু  “হুম” বলে  পকেট  থেকে  মোবাইল বের  করে  আটার একটা  ছবি তুলতে লাগলো । শাফি জিজ্ঞেস করলো, “কি করছো খোকা……মানে ছেলে?” আবির জবাব দিলো, “কিছু না, একটু ফটোগ্রাফি আরকি । একটা সময় খুব করা হতো, এখন আর তেমন হয় না । তাই একটু করার ইচ্ছে হল আরকি ।” শাফি  একটু হেসে বলল, “বাহ বাহ, খুব ভালো কথা তো । তা আমার একটা ছবি তুলে নাও । তোমার কলিমা আপুকে দেখিও । দেখে ইম্প্রেসড হয়ে একটু শ্বশুর বাড়ি ফেরত আসে আরকি ।” আবির প্রথমে একবার শাফির দিকে তাকাল, তারপর শাফির একটা  ছবি তুলে নিলো । রাতে আবির চয়নিকার সাথে কথা বলছিল । কথার মাঝে একসময় আবির জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, তোমার বোন বলেছিল তোমার  বাবাকে বলে দেবে, বলেছে  নাকি?”

- “আরে না । আপু অতোটাও কঠোর না । আপু জানে বাবাকে বললে প্রচুর রাগ করবেন তাই বাবাকে বলে নি ।” বলল আবির ।

- “আচ্ছা, তোমার সাথে আড়াই বছর আ………………………………।” কথা শেষ হল না আবিরের । চয়নিকার ফোন থেকে একটা চিতকারের  আওয়াজ  শুনতে পেলো । আবির জিজ্ঞেস করলো, “কি ব্যাপার, কি হল!” চয়নিকাও অবাক হয়ে বলল, “শিউলি আপুর গলা মনে হল, দাঁড়াও তো আবির, আমি একটু দেখে আসি!” বলেই ফোন কেটে চলে গেলো চয়নিকা । আবির চিন্তায় পড়ে গেলো, কি আবার হল । মিনিট দশেক পর চয়নিকার ফোন এলো । ফোন ধরতেই ফোনের ওপাশ থেকে চিন্তিত গলায় চয়নিকা বলল, “আবির! সর্বনাশ হয়ে গেছে!” আবির জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?” চয়নিকা বলল, “ফ্রিজে রাখা বাবার লাখ তিনেক টাকা আমাদের চোখের সামনে চোর চুরি করে নিয়ে গেলো!” আবির হতবাক হয়ে বলল, “কি!”










(২৯)

- “হ্যাঁ, চিৎকার শুনে আমি গেলাম, যেয়ে দেখি পুরো শরীর কালো কাপড়ে ঢাকা একটা লোক দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেলো । আমি, বাবা, অয়ন আমরা সবাই দেখেছি । আর দেখলাম ফ্রিজ খোলা । কিন্তু এদিকে ফ্রিজের চাবি দেখি আমার কাছেই । ফ্রিজের কাছে যেয়ে দেখি ও  ফ্রিজের তালা কেটে ফেলেছে ।” বলল চয়নিকা ।

- “আচ্ছা, আমি তোমাকে একটা ছবি পাঠাতে চাই, কিভাবে পাঠাবো?” বলল আবির ।

- “কিসের ছবি?”  জিজ্ঞেস করলো চয়নিকা ।

- “আহা, আগে বলতো কীভাবে পাঠাবো ।” বলল আবির ।

- “হোয়াটস অ্যাপ ইন্সটল করো, ওখান থেকে তুমি ছবি পাঠাতে পারবে ।” বলল চয়নিকা ।

- “কীভাবে কি করে?” জিজ্ঞেস করলো চয়নিকা ।

চয়নিকা আবিরকে  সব বুঝিয়ে দিলো  । এরপর আবির বলল, “ঠিক আছে, আমি এক্ষুনি লগ ইন করছি ।” আবির হোয়াটস অ্যাপে লগ ইন করলো । কন্টাক্ট লিস্ট থেকে চয়নিকার নাম্বার অ্যাড করলো আবির । সাথে লিলির নাম্বারটাও পেয়ে অ্যাড করলো আবির । কাজে লাগতে পারে  দেখে । আরওদেখল, রাজেরও হোয়াটস অ্যাপ আইডি রয়েছে । কিন্তু  এখন রাজের  সাথে কথা বলার সময়  নেই আবিরের । আবির দেখল  চয়নিকা মেসেজ দিয়েছে, “পাঠাও তুমি  কি  পিক  পাঠাবে ।” আবির শাফির ছবিটা সেন্ড করলো চয়নিকাকে । আর লিখল,  “তুমি কি এনাকে চেনো?” চয়নিকা একটু পর মেসেজ পাঠাল, “হ্যাঁ, চিনবো না কেন, ইনিই তো আমাদের শিউলী আপুর স্বামী, মোখলেস ।” আবির হতবাক হয়ে গেলো । মোখলেস! আবির দেখলো চয়নিকা মেসেজ পাঠিয়েছে, “তুমি এনাকে চিনলে কি করে?” আবির সেই মেসেজের রিপ্লাই না দিয়ে লিখলো, “তোমাদের ফ্রিজের চাবির দুটো ছবি দাও তো, এপিঠ ওপিঠের ।” চয়নিকা আবিরের কথামতো ফ্রিজের চাবির ছবি পাঠালো । আবির এবারেও হতবাক হয়ে গেলো । কারণ আবির শাফির হাতে যে আটার গোলার ভেতর চাবির ছাপ দেখেছিলো, ওটা এই চাবিরই ছিল । আবির চয়নিকাকে মেসেজ করলো, “তোমার শিউলি আপু যদি বাইরে বের হয়, আমাকে একটু জানিও ।” চয়নিকার পরের মেসেজের জন্য আবির মোটেও প্রস্তুত ছিল না । চয়নিকা লিখেছে, “শিউলি আপু তো শ্বশুর বাড়ি গেছে, হঠাৎ খবর এসেছে উনার শাশুড়ি নাকি খুব অসুস্থ ।” আবির চয়নিকাকে হোয়াটস অ্যাপে কল দিলো ।

- “তুমিই মোখলেস ভাইয়াকে চিনলে কি করে?” জিজ্ঞেস করলো চয়নিকা ।

- “চুনি, আমি তোমাকে সব খুলে বলবো, তুমি আগে এটা বলো, তোমার শিউলি আপুর শ্বশুর বাড়ি কোথায়?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “আমাদের বাসার পেছনের রোডের ওই পাড়ে একটা বস্তিতে ।” বলল চয়নিকা ।

- “আচ্ছা, আমি পড়ে কথা বলছি ।” বলে ফোন কেটে দিলো আবির । তারপর চলে গেলো রেস্টুরেন্টে । ক্যাশ কাউন্টারেই পেয়ে গেলো কলিমা আপুকে । আবির কাছেই যেতেই শুনলো রায়হান ভাই ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, জেজেএ রেস্টুরেন্ট । আরে সামনে একটা মূর্তি আছে, দেখলেই চেনা  যায়, কাল সকাল ১০টায়?..................আচ্ছা আচ্ছা । আচ্ছা ঠিক আছে । আচ্ছা ।” বলেই  ফোন কেটে দিলো রায়হান । আবির জিজ্ঞেস করলো, “কে ফোন দিয়েছিলো?” রায়হান হাসিমুখে বলল,  “আরে, আমাকে ১০০ গ্যাস সিলিন্ডার ফ্রিতে যে দেবে বলেছিল, তারা কাল সকাল ১০টায় আসবে বলেছে ।” আবির রায়হানকে আর  কিছু না বলে কলিমাকে জিজ্ঞেস করলো, “আপু, তোমার শ্বশুর বাড়ি কোথায়?”

- “ক্যান, কি করবি আমার শ্বশুর বাড়ি কই জাইনা?”

- “আহা! বলো না কোথায় ।” হালকা বিরক্ত হয়ে বলল আবির ।

- “না, তুই আগে ক কি করবি ।” ইয়ার্কি করে বলল কলিমা ।

- “প্লিজ আপু! এটা  ইয়ার্কি করার সময় না, আমাকে বলো কোথায়  তোমার শ্বশুর  বাড়ি ।”

- “দ্যাহতো কাণ্ড, তুই আমার শ্বশুর বাড়ি  কই তা জাইন্না কি করবি?”  বলল কলিমা ।

আবির বিরক্ত হয়ে, “আজ  দেখি, আমাকে কে খাওয়ায় ।” বলে  রেস্টুরেন্টে থেকে  বেরোনোর জন্য  হাঁটা  ধরল, এমন সময় কলিমা ডাকলো আবিরকে ।  বলল, “আইচ্ছা, কইতাছি । শোন ।” আবির দাঁড়িয়ে গেলো । এরপর কলিমার কাছে  শ্বশুর বাড়ির যে ঠিকানা  পেলো আবির, তা হুবহু চয়নিকার কাছে পাওয়া ঠিকানার  সাথে মিলে  গেলো । আবিরকে  কলিমা জিজ্ঞেস করলো, “এইবার ক, তুই কি করবি?” আবির কলিমার কথা না শুনেই বেড়িয়ে গেলো আবির । রায়হান জিজ্ঞেস করলো, “আবিরের আবার কি হইল?” কলিমা বলল, “আমিও তো বুঝতে পারতেছি না ।”

ওদিকে আবির চলে গেলো সেই ঠিকানা অনুযায়ী চয়নিকাদের বিল্ডিং এর পেছনের রোডের ওপাশের বস্তিতে । রাস্তাটা আলোকিত হলেও বস্তিটা  ঠিকই অন্ধকারাচ্ছন্ন । আবির গায়ে একটা চাদর  পেচিয়ে সেখানে গেছে, যেন কেউ চিনতে না পারে । অন্ধকারাচ্ছন্ন হলেও জায়গাটায় কিন্তু লোক সমাগম  অনেক । এমন সময় আবির একটা দোকানে কাউকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলো মোখলেস বা শাফি  নামে কেউ  এখানে থাকে কি না, কিন্তু আর আবির জিজ্ঞেস করলো না । কারণ দোকানের ভেতরেই আবির মোখলেস বা শাফি আর শিউলির দেখা পেয়ে গেলো । আবির এই দোকানের জলা মোমবাতির অল্প আলোর  মাঝে মোখলেস আর শিউলির পাশে মাটির ওপর বসলো । শিউলি আর মোখলেস একে ওপরের সাথে কথা  বলছে ।













(৩০)

- “তোমার কি মনে হয়, আমরা পারুম?” জিজ্ঞেস করলো মোখলেস ।

- “যেই কামের জন্য এতদিন ধইরা প্ল্যান করছি, সেই কামে সফল হওয়াই লাগবো ।” জবাব দিলো শিউলি । মনে শিউলির কিসের  জন্য যেন ক্ষোভ ।

- “দেহা যাক কি হয় ।” বলল মোখলেস ।

- “দেহা যাক কও ক্যান, এতো বছর এই দিনডার লাইগা বইসা ছিলা, এহন আসল সময় আইসা গেছে, আর তুমি যদি এহন এই কও, কিছু আর কওয়ার নাই ।” বলল শিউলি ।

- “শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা শিখেছি, অশুদ্ধ ভাষায় তো আগে থেইকাই কই, একখান মাইয়ার লগে মিথ্যা বিয়ার অভিনয় করছি, চুরি করছি, কাইল সেই সময় যার লাইগা আমরা বইসা আছি, অথচ তাও মনের মধ্যে কেমন জানি করতাছে ।” বলল মোখলেস ।

- “কাইল সকাল দশটা পর, সব শেষ হইয়া যাইবো, সব । সব ভাববো গ্যাস বিস্ফোরণ, কিন্তু না!” বলল শিউলি ।

আবির মনে মনে ভাবল কাল সকাল ১০টায় কি করতে যাচ্ছে এরা? ভাবতে গিয়ে একটু পড়ে যেতে নিলো আবির, নিজেকে সামলে  নিতে গিয়ে বেঞ্চের ওপর বসে এক লোকের মোবাইল পড়ে গেলো । এরপর লোকটা ভাবল, এটা হয়তো চোর । লোকটা আবিরকে ধরে চিৎকার করে উঠলো, “ভাই! চোর চোর!” আবির হয়তো এদের বললেই সমস্যা মিটে যেতো কিন্তু সমস্যা হল যদি শিউলি আর মোখলেস ওকে দ্যাখে, তাহলে সমস্যা হয়ে যাবে । তাই আবির লোকটার হাতে কামড় দিয়ে  লোকটাকে ধাক্কা মেরে বেঞ্চের ওপর লাফ দিয়ে দিলো এক দৌড় । দোকানে বসে থাকা সবাই দৌড় দিলো । মোখলেসও দৌড় দিতে চাইলো, কিন্তু শিউলি আটকাল ওকে । অন্ধকারের মধ্যে কাকে কাকে ধাক্কা দিয়ে যে আবির পথ পাড়ি দিয়েছে, তা আবিরের জানা নেই । অনেক দুর আসার পর আবির খেয়াল করলো, একটু সামনে জায়গাটা আলোকিত । আবির পেছনে তাকিয়ে দেখল, আবিরের পেছনে আসা লোকের সংখ্যা আরও বেড়ে গেছে । সবার মুখে একই ধ্বনি, “চোর! চোর! ধরো! ধরো!” ওদের এই চোর চোর ডাক শুনেই আরও অনেকে এদের ভীরে এসে মিশেছে । আবিরের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো । চোখের চশমাটা খুলে পকেটে রেখে গায়ের চাদর  ঢিল মেরে ফেলে  দিয়ে গায়ের জামা কোমরে বাঁধল, এবং কাজটা আবির একটু সাইডে দাঁড়িয়ে করলো, যেখান থেকে ওরা আবিরকে দেখতে পাবে না । এরপর ওরা এদিকে এগিয়ে এসে আবির সামনের দিকে ঈশারা করে বলে উঠলো, “ওই চাদর গায়ে দেয়া পোলা ওইদিকে গেছে!” লোকজন আবিরের দেখানো দিকে চলে গেলো । আর আবির এপাশ দিয়ে চলে এলো রেস্টুরেন্টে । আসার আগে গায়ের জামাটা পড়ে নিয়ে চাদরটা নিয়ে এলো ।

পরদিন শনিবার । সকাল ৯টা ৩০ মিনিট । আবির ভাবছে ১০টার কি এমন হবে যার জন্য ওরা কালকে এতো কথা বলছিল! একটু পর রায়হান আবিরের রুমে এলো কলিমার সাথে । রায়হান কলিমাকে বলছিল, “ওরা একটু পরেই কিন্তু চইলা আইবো, আর শোনো, নতুন সিলিন্ডার, ওরা কইছে রেস্টুরেন্টে ঢোকানোর সময় যেন আগুন না জলে ।” আজ সিলিন্ডার আসবে দেখে রেস্টুরেন্ট বন্ধ রেখেছে রায়হান । কলিমার সাথে কথা বলা শেষে আবিরকে রায়হান বলল, “কিরে আবির, সিলিন্ডার আসতেছে, তুই হেল্প করবি না?” আবির বলল, “হুম, আসলে আমাকে জানিও, আমি চলে যাবো ।” রায়হান বলল, “আচ্ছা ।” এরপর রায়হান আর কলিমা চলে গেলো । একটু পর আবিরের মোবাইলে চয়নিকার ফোন এলো । আবির ফোন ধরে বলল, “কি খবর, কেমন আছো?”

- “ভালো না, খুব খারাপ ।” বলল চয়নিকা ।

- “কেন, কি হয়েছে?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “১০টা থেকে গ্যাস থাকবে না, আর শিউলি আপুর আসার নাম নেই ।” বলল চয়নিকা ।

আবির হতবাক হয়ে গেলো । তবে কি ১০টার সময় চয়নিকাদের বিল্ডিং-এ গ্যাস বিস্ফোরণ ঘটাবে শিউলি আর মোখলেস! আবিরের বুকটা ধরাস করে উঠলো । আবির চয়নিকাকে বলল, “চুনি, আমি বাসায় আসছি তোমাদের!” চয়নিকা বলল, “আরে! কি করছো তুমি! বাবা বাসায়, আপুও বাসায়, ঝামেলা হবে!” আবির বলল, “চুনি! জীবন মরনের ব্যাপার, শোন, আমি যদি ৯টা ৪৫এর মধ্যে তোমাদের ওখানে পৌছাতে না পারি, তাহলে বিল্ডিং এর সবাইকে নিয়ে নিচে নামবে! বুঝলে!” চয়নিকা অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু কেন!” আবির আর কোন জবাব দিলো না । চয়নিকা ২-৩ বার “হ্যালো! হ্যালো!” বলার পর দেখল আবির ফোন কেটে দিয়েছে । ইফাজের গাড়ির চাবি আবিরের কাছেই ছিল । আবির সেই চাবি নিয়ে রুম থেকে বেরোলো । রায়হান ভাই তখন রেস্টুরেন্টের সামনেই ছিল । সিলিন্ডারের গাড়ি এসে গেছে । মাস্ক, সানগ্লাস আর মাথায় ক্যাপ পড়া একটা ট্রাক ড্রাইভার ট্রাক থেকে নামলো । আবির রায়হানের কাছে যেয়ে বলল, “ভাই! কিছু মনে কইরেন না! আমারে যাওয়া লাগবে! আমি সিলিন্ডার তুলতে সাহায্য করতে পারছি না এখন ।” রায়হান বলল, “হ্যাঁ যা কিন্তু তুই এতো ভয়ে ভয়ে আছিস ক্যান?” আবির বলল, “ভাই আমি এসে সব জানাবো ।” বলে আবির চলে গেলো । গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে গেলো আবির ।











(৩১)

চয়নিকার বাসার কাছাকাছি যেতেই আবির খেয়াল করলো গাড়ির তেল শেষের পথে তবে ভাগ্য ভালো এই তেলে চয়নিকাদের বাসা পর্যন্ত অন্তত যাওয়া যাবে । আবির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ১০টা ৪৫বাজতে আর মাত্র ৪ মিনিট বাকি । আবির গাড়ির স্পিড বাড়ালো । এদিকে চয়নিকা ১০টা ৪৫ প্রায় বেজে গেছে দেখে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে । তারপর অয়নকে ডেকে বলল, “তাড়াতাড়ি আপু আর আব্বুকে নিয়ে নিচে চলে যা ।” চয়নিকাও বেড়িয়ে পাশের বাসার সবাইকে ডাকার জন্য নক করলো । এই ইউনিটের বাকি চারজন বেড়িয়ে এলো । তাদের চয়নিকা যেই বলল, “আপনারা তাড়াতাড়ি নিচে চলে যান ১০টার মধ্যে! ঝামেলা হবে একটা!” ঠিক সেই সময় আবির লিফট থেকে বেড়িয়ে এলো । আবির উনাদের বলল, “আপনারা তাড়াতাড়ি নিচে চলে যান! এই বিল্ডিং-এ গ্যাস বিস্ফোরণ হবে!” সবাই কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলো । একজন প্রতিবেশী ভদ্রমহিলা তখন বলে উঠলো, “আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম! কিছু একটা ঘটবে!” আবির জিজ্ঞেস করলো, “কি করে?” ভদ্রমহিলা বলল, “আমাদের যে দারোয়ান আছে! সে ওইদিন চয়নিকাদের দারোয়ানের সাথে এই ব্যাপারে কি যেন বলছিল ।” আরেকজন প্রতিবেশী বলে উঠলো, “ও হ্যাঁ! আমিও দেখেছিলাম, ওই শিউলির স্বামীও ছিল এদের সাথে, আমি দেখেছি, ওর স্বামী বোধ হয় পড়ে এসেছিলো বলে আপনি দাখেন নি ।” আবির আরও হতভম্ব হয়ে গেলো । তার মানে এর সাথে দারোয়ানও জড়িত!” আবির চয়নিকাকে বলল, “চুনি, আমি নিচে দারোয়ানকে ধরছি! তুমি সবাইকে নিচে নামতে বলো ।” একজন প্রতিবেশী ভদ্রলোক বলল, “দারোয়ান তো আজ আসে নি, আজ তো কেয়ারটেকার পাহাড়া দিচ্ছে ।” আবির কপালে হাত রাখল । আর বলল, “শিট!” অন্য একজন প্রতিবেশী ভদ্রলোক বলল, “গ্যাস বিস্ফোরণ  যদি ওরা ঘটায়, তাহলে বিল্ডিং-এর পিছে ওরা থাকবে, কারণ গ্যাসের লাইন সব ওখানেই ।” আবির বলল, “চুনি আমি তাহলে ওখানেই যাচ্ছি ।” আবির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ১০টা বাজতে আর ১০ মিনিট  বাকি । আবির লিফটের  অপেক্ষায় না  থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিল, এমন সময় চয়নিকে চেঁচিয়ে উঠলো, “শিউলি আপু!” আবির থেমে গেলো । লিফট থেকে তখন বের হল শিউলি । শিউলি বুঝতে পারেনি কি হয়েছে । চয়নিকা শিউলিকে কিছু বলতে যাবে এমন সময় আবির এসে শিউলির গলায় একটা চাকু ধরে বলল, “শিউলি আপু! বলো! এই বিল্ডিং-এর গ্যাস বিস্ফোরণ কোথায় হচ্ছে! আর কেন হচ্ছে!” শিউলির গলায় চাকু থাকা সত্ত্বেও শিউলির ভয় নেই । হো হো করে হেসে উঠলো । আবির বলল, “শিউলি আপু! বাড়াবাড়ি কোরো না কিন্তু! সোজা গলায় ঢুকিয়ে দেবো কিন্তু!” শিউলি  আবার হেসে বলল, “লাভ নাই মাস্টার ভাই, লাভ নাই!  এহন সত্যি জাইনা কোন লাভ নাই! আর আমারে মারবা, মারো! নারী নির্যাতন আর খুনের মামলায় তুমিই ফাইসা যাইবা ।” আবির চাকুটা ফেলে দিয়ে হাত জোর করে শিউলির সামনে এসে বলল, “প্লিজ! আমি চুনিকে ভালোবাসি! ওর কোনো ক্ষতি কোরো না প্লিজ!” অয়ন, আখি আর ওদের  বাবা ততোক্ষণে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে । ওরাও শুনল আবিরের কথা । শিউলি তখন বলল, “তোর চুনির ক্ষতি করমু ক্যান আমি, যা ক্ষতি করার ওর বাপের করছি, প্রতিশোধের একখান অংশ হিসাবে, চুরি করছি ওর বাপের টাকা! আর সেই টাকা দিয়া ১০০সিলিন্ডার কিনা আমার  আর মোখলেসের  বাপের ফাসি কার্যকর করা লোকেদের মারার  ব্যাবস্থা করছি ।” আবির এবার আর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে  পারলো না । সিঁড়ির ওপর বসে পড়লো । একটু থেমে বলল, “জেজেএ রেস্টুরেন্ট! মানে তোমরা ওই রেস্টুরেন্ট বিস্ফোরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছো!”

“আপনের সিলিন্ডার ভেতরে ঢুইকা গেছে ।” বলল ট্রাক ড্রাইভার । রায়হান বলল, “এখন আগুন জালাইতে পারমু?” ট্রাক ড্রাইভার বলল, “না, পাঁচ মিনিট পর । আমি যাই তাহলে । বলে ট্রাক ড্রাইভার চলে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে ট্রাকে উঠে চোখের সানগ্লাস আর মুখের মাস্কটা খুলে ফেলল । এটা আর কেউ নয়, মোখলেস । রেস্টুরেন্ট আর রেস্টুরেন্টের সামনে থাকা মূর্তির দিকে তাকিয়ে হেসে বলে উঠলো, “যেই রেস্টুরেন্টের জন্য আমার বাবা, আমার স্ত্রী শিউলির বাবা মরেছে! সেই রেস্টুরেন্টের বিস্ফোরিত ভবিতব্য দেখতে আর তর সইছে না আমার!” বলেই ট্রাক নিয়ে সেখান থেকে একটু নিরাপদ দূরত্বে চলে গেলো ওদিকে রায়হান রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোচ্ছিল, এমন সময় ইফাজ বলে উঠলো, “রায়হান বাবা, তোমার পায়েল আনটিকে দেখলে একটু রুমে আসতে বোলোতো” রায়হান বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে ।” রায়হান বেরোনোর আগে এক রাঁধুনিকে বলল, “মিনিট পাঁচেক পর চুলা জালাইয়া রান্না কইরো, আইজ আমরা সবাই বিরিয়ানি খামু!” বাইরে এসে রায়হান দেখল, কলিমা আর পায়েল মূর্তির নিচেই বসে । রায়হান পায়েলকে বলল, “আনটি, আপনেরে আঙ্কেল ডাকতেছে ।” পায়েল বলল, “আচ্ছা, আমি তাহলে যাই, দেখি উনি কি আবার বলেন ।” বলে পায়েল চলে গেলো ইফাজের কাছে যাবার উদ্দেশ্যে । রায়হান কলিমাকে বলল, “চল, মিষ্টি আনতে যাই ।” কলিমা জিজ্ঞেস করলো, “কিসের মিষ্টি?” রায়হান বলল, “আরে, এই যে আমরা লটারি জিতা পুরস্কার পাইছি, এই মিষ্টি!” কলিমা বলল, “আইচ্ছা, চল ।”

ওদিকে গাড়ি চালিয়ে দ্রুত বেগে বস্তির দিকে রওনা হল আবির । এক ফাঁকে চয়নিকাকে একটা  ভয়েস মেসেজ পাঠাল, “সময় পেলে জেজেএ   রেস্টুরেন্টে এসো, যদি বিস্ফোরণ না ঘটে তাহলে  কাছে যেয়ো না  কিন্তু ।” ওর কানে এখনও শিউলির কথা বাজছে । শিউলি বলেছে, শিউলির বাবা লাল্টু আর মোখলেসের বাবা মিজান একদিন এই বস্তিতে আগুন ধরিয়েছিল দেখে তাদের ফাসি দেবার জন্য আন্দোলন করেছিলো বস্তিবাসি, আর বস্তিবাসিদের সাপোর্ট করেছিলো ইফাজ । আর তাই আজ তার প্রতিশোধে এই প্ল্যান করা ওদের! আবির ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল আর মাত্র ২ মিনিট আছে । আবিরের আবার কানে বাজতে লাগলো চয়নিকার বাবার কথা । চয়নিকার বাবা বলেছিলেন গাড়ির চাবি হাতে দিয়ে বলেছিলেন, “যাও আবির! তোমার আপনজনদের বাচাও!” তাই আবির চয়নিকার বাবার গাড়ি চালিয়ে এসেছে । ইফাজের গাড়িতে তেল ছিল বলে আবির এমনটা করেছে । আবির ঘড়ির দিকে তাকাল । আর মাত্র তিন সেকেন্ড! ২! ১! ঠাস……………………! বিকট একটা আওয়াজে চোখ বন্ধ করে গাড়ি থামিয়ে দিলো আবির ।














(৩২)

বুক ধুক ধুক করছে ওর । মন কেঁদে উঠলো সবাইকে হারানোর ভয়ে । আবির সামনের দিকে তাকাল । কই, কোন আগুন বা ধোয়া তো নেই! তাহলে  আওয়াজ কিসের ছিল? গাড়ি থেকে নেমে দেখল, গাড়ির টায়ার পামচার হয়ে গেছে । আবির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, ১০টা পার  হয়ে গেছে । আবির ভাবতে  লাগলো, বিস্ফোরণ হল না কেন? তখন হঠাৎ আবিরের  খেয়াল হল এটা তো টাইম  বোমা না যে ঠিক ১০টার সময়ই ফেটে যাবে । আবির আর কিছু চিন্তা না করে তাড়াতাড়ি করে দৌড় দিলো মিনিট দুই লাগলো আবিরের পৌছাতে । রেস্টুরেন্টের থেকে ১০০   মিটার  দূরে  আবির । দুর থেকে আবির দেখলে রায়হান আর কলিমা একটা ট্যাক্সি করে কোথায় যাচ্ছে । আবির যে ওদের ডাকবে তারও সুযোগ নেই । কারণ ওরা গাড়িতে উঠে ইতোমধ্যে চলে গেছে । খুব সম্ভবত ওরা এতক্ষণ  ট্যাক্সির জন্যই অপেক্ষা করছিলো । আবিরের তখন মাথায় এলো ইফাজকে ফোন  করেই জানানো যায় তো । আবির মোবাইল হাতে নিলো । হাত কাঁপছে আবিরের । বলা যায় না কখন দুর্ঘটনাটা ঘটে । আবির অনেক কষ্টে নাম্বারটা কল করে যেই না কল দিতে যাবে! এমন সময় কার যেন কল এলো এবং আবির খেয়াল না করেই ভুলবশত সেটা ধরে ইফাজকে কল দিয়েছে ভেবে কানে নিলো । আবির শুনতে পেলো গান বাজছে ।

“সেই যে হলুদ পাখি বসে জামরুল গাছের ডালে, করতো ডাকাডাকি আমার শৈশবের সকালে………………” কণ্ঠটা আবিরের চেনা রাজ ফোন দিয়েছে । হোয়াটস অ্যাপে । আবির ফোন দেখে বুঝল সেটা । রাজ বলল, “কিরে, হোয়াটস অ্যাপ খুললি আর একটু জানালিও না!” আবির রাজের কল কাটতে যাবে, এমন সময় চোখের সামনে পুরো একটা বিরাট আলোর বিচ্ছুরিত রশ্মি, আগুন,  ধোয়া ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না আবিরের,  কিছুক্ষণের মধ্যেই ধোয়ায় চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেলো । রেস্টুরেন্টের সামনে থাকা  মূর্তি দুটোও পড়ে গেলো । আবিরের  হাত থেকে মোবাইল  পড়ে গেলো । আবিরের পুরো শরীর কাঁপতে  শুরু করেছে । ওর সামনে যা ঘটছে, তার কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না আবির । ওর ইফাজ আর পায়েলের চেহারাটা বার বার চোখের সামনে ভাসছে । মিনিট দুই আবির মূর্তির  মতো দাঁড়িয়ে ছিল । রেস্টুরেন্টের সামনে ইতোমধ্যে ভিড় জমে গেছে । আবির একটু পর খেয়াল করলো, ওর   ফোন থেকে হালকা আওয়াজ আসছে । “আবির  আছিস লাইনে! কিরে  তুই ঠিক আছিস! হ্যালো! আওয়াজ কিসের হল! আবির কথা  বলছিস না কেন । আবির!” রাজের কণ্ঠ । কল এখনও কাটে নি রাজ । আবিরের রাজের ওপর রাগ উঠতে লাগলো । ফোনটা কানে নিয়ে বলল, “গো টু হেল! তোর সাথে আমার আর কোন প্রকার সম্পর্ক নেই!” বলেই ফোন কেটে আবির ভিড় ঠেলে রেস্টুরেন্টের  সামনে গেলো । সবাই সামনেই যে দুটো লাশ পড়ে, তা ইফাজ আর পায়েলের । দুজন দুজনের হাত ধরে মাটির ওপর । পুড়ে সেদ্ধ হয়ে গেছে শরীর । এখনও ধোয়া উড়ছে শরীর থেকে । আবির মাটিতে বসে পড়ল । কতক্ষন  লাশদুটোর দিকে তাকিয়ে আবির এভাবে বসে ছিল আবিরের খেয়াল নেই । ওর শুধু কানে এসেছে বস্তির অন্যান্যদের কান্নার আওয়াজ, যাদের আপনজন এই রেস্টুরেন্টের কর্মকর্তা ছিল । আবিরের হুশ  এলো রায়হান আর  কলিমাকে আসতে দেখে । কলিমাও আবিরের কাঁধে হাত রেখে কাঁদতে শুরু করলো । রায়হান নিজেকে শক্ত রাখার  চেষ্টায় ব্যাস্ত । রায়হান যেয়ে সবগুলো লাশ দেখতে লাগলো কোনটা বেঁচে আছে কি না । ইফাজ আর পায়েলের লাশ দেখল, বেঁচে নেই । তারপর সামনে আরও  কিছু  লাশ দেখল রায়হান যারা এই রেস্টুরেন্টের কর্মকর্তা ছিল । আবির রায়হানের দিকে তাকিয়ে ছিল আর গুণছিলো কতো মানুষ মারা গেলো এই বীভৎস এক দুর্ঘটনায় । হঠাৎ  আবির খেয়াল করলো রায়হান একটা লাশের কাছে যেয়ে নিজেকে আর শক্ত রাখতে পারলো না । আবির উঠে দাঁড়ালো । রায়হান লাশটাকে বুকে নিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে । আবির  আর  কলিমা চোখের পানি মুছে এগিয়ে গেলো । কাছে যেয়ে দেখল, ওটা লিলির লাশ । আবির হতভম্ব হয়ে গেলো । লিলি আপু কি করছেন এখানে! এই সময় কখনো তো উনি এখানে আসতেন না! আবির মনে মনে নিজেকে শান্তনা দিলো এই ভেবে, মানুষের মৃত্যু হয়তো এরকমই অদ্ভুতভাবে ঘটে । রেস্টুরেন্টে এখনও আগুন জ্বলছে । বস্তির একটা অংশও পুড়ে  গেছে । একটু পরই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এলো, পুলিশের গাড়ি এলো, সাংবাদিক  এলো, অ্যাম্বুলেন্সের গাড়ি এলো আরও কতো গাড়ি এলো । আবির শুধু আকাশের দিকে চেয়ে রইল । আর নিজের প্রতি আফসোস করতে লাগলো । চয়নিকাদের বাড়ি চুরি হয়েছিলো দেখে আবির ভেবেছিলো ঘটনা হয়তো চয়নিকাদের বাড়িতেই ঘটবে । কিন্তু এদিকে ১০টায় ফ্রি-তে দেয়া ১০০সিলিন্ডার গ্যাস যে মোখলেস আর শিউলির পাতানো মরণ ফাঁদ তা আবির একবারের জন্যও ভাবতে পারে নি । আবির দেখলো আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে ।












(৩৩)

দুপুর ১টা মতো বেজে গেছে । লাশগুলোকে এক এক করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । একটু  আগেই লিলির আম্বুলেন্স নিয়ে যাওয়া হল । সাথে লিলির পরিবারের লোকেরাও গেছেন । রায়হানও যেতে চেয়েছিলো, কিন্তু রায়হানকে লিলির  পরিবারের লোকেরা যেতে দেয় নি । তাদের ধারণা আজ লিলি যদি রায়হানকে না ভালোবাসতো, তবে হয়তো লিলির এ অবস্থা হতো না । শেষ বারের মতো অ্যাম্বুলেন্সের দরজা আটকে যাওয়া পর্যন্ত রায়হান লিলির লাশের দিকে তাকিয়ে ছিল । তারপর অ্যাম্বুলেন্স চলে গেলো । রায়হান মাটিতে বসে কাঁদতে শুরু করলো । বাকি আর ২টা লাশ । ইফাজ আর পায়েলের । আবির ওদের সামনে বসেছিল আর কাঁদছিল । এখনও কাঁদছে । যারা লাশ ওঠাচ্ছিলেন, তাদের আবিরই অনুরোধ করেছিলো এই লাশ দুটো শেষে ওঠাতে । এখন ওঠাবার সময় এসেছে । লোকগুলো আবিরের চোখের সামনে পায়েল আর ইফাজের লাশদুটো ওঠাল । সে সময় ইফাজের হাত থেকে পায়েলের হাত ছাড়িয়ে গেলো । বৃষ্টি শুরু হয়েছে । তাই তাঁরা তাড়াতাড়ি করে লাশ নিয়ে আম্বুলেন্সে ওঠাল । আবিরও পেছনে পেছনে এলো । লাশ দুটোকে বেডে রেখে যেই না অন্য এক লোক অ্যাম্বুলেন্সের দরজা আটকাতে যাবে, এমন সময় আবির বলল, “এক মিনিট ।” লোকটা দরজা আটকাল না । আবির অ্যাম্বুলেন্সের কাছে এলো । তারপর ইফাজের হাতের ওপর পায়েলের হাত দিয়ে বলল, “এবার যান ।” লোকটা দরজা আটকে দিলো । ধীরে ধীরে দরজা আটকে গেলো । তারপর সে অ্যাম্বুলেন্সও বিদায় নিলো সেখান থেকে । আবির সে অ্যাম্বুলেন্সের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল । বিকেলে আবির গেলো চয়নিকাদের বাসায় । নক করতেই অয়ন দরজা খুলল । অয়ন বলল, “আবির ভাই, আপনার কিছু হয় নি তো?”

- “না, ঠিক আছি ।” হালকা হাসবার চেষ্টা করে বলল আবির ।

- “ভাই, বাসার সবাই তো পুলিশ স্টেশন গিয়েছে ।” বলল অয়ন ।

- “কেন?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “আপনি যাবার পর বাবা পুলিশ স্টেশনে কল করেছিলেন । পুলিশ এসে শিউলি আর মোখলেসকে ধরে নিয়ে যায় আর বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায় । সাথে আখি আপু আর চুনি আপুও গিয়েছে যেহেতু ওরা অনেক কিছুই জানে ।” বলল অয়ন ।

- “পুলিশ ষ্টেশন কতদুর রে?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “বেশিদুর না, বাসার সামনের রোডের আপনি যেদিক দিয়ে আসেন, তার বিপরীত দিকের মাথায়ই পুলিশ ষ্টেশন ।” বলল অয়ন ।

 

“এ তো বিরাট ক্রিমিনাল! প্ল্যান তো আজ থেকে কয়েক বছর আগে থেকেই এদের করে রাখা!” জেলখানার ভেতর থেকে এসে জানালেন পুলিশ অফিসার । চয়নিকার বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “তার মানে?” পুলিশ অফিসার বললেন, “বলছি বলছি, আগে বলুন, এই ক্রিমিনালের প্ল্যান ঘটার আগেই কি করে জেনে ফেললেন আপনি?” চয়নিকার বাবা বলল, “ইয়ে মানে, আমি তো কিছুই জানতাম না, আমার ছেলে অয়নের টিচার আবির কি করে কি বলল, আর এরাই স্বীকার করে ফেলল সব ।” পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, “কই সেই আবির?” ঠিক সে সময় পুলিশ স্টেশনে ঢুকেছিল আবির । বলে উঠলো, “আমিই আবির অফিসার ।” সবাই আবিরের দিকে তাকাল । পুলিশ অফিসার বললেন, “ও, আচ্ছা,  এসো সামনে  এসো ।” আবির পুলিশ অফিসারের  সাম্নেন যেয়ে দাঁড়ালো । তারপর অফিসার জিজ্ঞেস  করলেন, “তা তুমি কি করে সবটা বুঝলে ।”  আবির বলল, “শুরু থেকে শুরু করি অফিসার?”  অফিসার তখন বলল, “হ্যাঁ অবশ্যই ।” আবির বলতে লাগলো, “ঘটনার যে পুরুষ ক্রিমিনাল তাকে আমি আগে থেকেই চিনতাম । কিন্তু  মোখলেস নামে কিংবা শিউলির স্বামী হিসেবে না । তাকে আমি চিনতাম শাফি নামে এবং কলিমা আপুর স্বামী হিসেবে ।”  অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, “এই কলিমা আপু কে?” আবির বলল, “জেজেএ রেস্টুরেন্টের ক্যাশ কাউন্টারে বসে থাকা রায়হান নামের এক লোকের বোন । একদিন আমি চয়নিকাদের বাসার পড়াতে আসি । সেখানে শিউলির হাতে একটা আংটি দেখতে পাই যাতে লেখা মোখলেস । আমি চয়নিকাকে জিজ্ঞেস করি কে এই মোখলেস, চয়নিকা আমাকে জানায় এ শিউলির স্বামীর নাম । এতোটুকু পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল । চুনিদের বাসায় বার বার চুরি হচ্ছিলো । একদিন চুনির    কাছে জানতে পারি চুরির জন্য ওর বাবা  ফ্রিজ তালা দিয়ে চাবি চুনির কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নেন তার আরেকটা কারণ ফ্রিজে চুনির বাবার জরুরী মোটা অঙ্কের টাকা রাখা ছিল । সেদিনই আবার এক চাবির দোকানে এই শাফি ওরফে মোখলেসকে দেখতে পাই । আটার গোলার ওপর লেখা মোখলেস, যার ডিজাইনটা ছিল হুবহু শিউলি আপুর আংটির ওপর লেখা মোখলেস ডিজাইনের মতো । আমি ফটোগ্রাফি তোলার কথা বলে সে ছবি তুলে নিয়েছি ।” আবির সবাইকে ছবিটা দেখাল । তারপর বলল, “এরপর আমি মোখলেসেরই কোথায় ওরই একটা ছবি তুলি । তাতে অবশ্য আমার লাভই হয়েছিলো । রাতে যখন চুনির কাছ থেকে  জানতে  পারি ওদের বাসায় এবার  ফ্রিজ থেকেই চুরি হয়েছে, তখনই আমি চুনিকে বলি ওদের ফ্রিজের একটা চাবি পাঠাতে । ফ্রিজের চাবি দেখে বুঝলাম, এটা সেই চাবি যা সকালে আমি শাফির হাতের আটার গোলার চাবির ছাপে দেখেছি । আবির তখনই চুনিকে শাফির  যে ছবিটা তুলেছিলাম, সেটা  দিলাম । এবং  জানলাম, এটা শিউলির স্বামী । আমি তখনই কলিমা আপুর কাছ শাফিদের ঠিকানা জেনে  ছদ্মবেশে যেয়ে এক দোকানেই শুনে ফেললাম ওরা আজ ১০টায় গ্যাস বিস্ফোরণের প্ল্যান ঘটাচ্ছে । আমি ভেবেছিলাম  হয়তো চুনিদের বাসায়ই এ কাজ করার প্ল্যান করেছে যেহেতু চুনিদের বাসায়ই চুরি করছে । তাই  পরদিন  মানে আজ যখন জানতে পারলাম ১০টা থেকে চুনিদের বাসায় গ্যাস থাকবে না, তখন ভাবলাম হয়তো এটাই ওদের প্ল্যান । কিন্ত এসে দেখলাম ঘটনা একদম উল্টো । ওরা ওই রেস্টুরেন্ট উড়িয়ে দেবার প্ল্যান করেছে । বাকিটা আশা করি আপনি চুনির বাবার কাছে শুনেছেন, কিন্তু ওরা  এটা  কেন করলো তাই আমি বুঝতে পারছি না ।”  অফিসার বললেন, “কারণটা তবে এবার তোমাদের  শোনাই ।”











(৩৪)

বলেই অফিসার চেয়ার থেকে উঠলেন । তারপর চেয়ারের পেছনেই পায়চারী করতে করতে বলতে লাগলেন, “আজ থেকে অনেকবছর আগের কথা । প্রায় ৭-৮মতো হবে তখন এই কমলাপুর রেইলওয়ে স্টেশনে তেমন কোন দোকান ছিল না, ছোটখাটো চায়ের দোকান ছিল শুধু । একদিন জয়নাল আর কিছু লোক মিলে মি ইফাজের সহায়তায় এখানে গড়ে তোলে এই রেস্টুরেন্ট । যেহেতু এই এলাকায় বড়বড় লোকেদেরও আনাগোনা হতো, তাই তাদের এই রেস্টুরেন্ট হয়ে ভালোই সুবিধা হয়েছিলো, কিন্তু ব্যাবসায় লস হতে  থাকে ছোটখাটো চা দোকানদারদের । ফলে এখান থেকে অন্যান্য সব দোকানদার সব কিছু নিয়ে চলে গেলেও দুজন এখানেই থেকে যায়, লাল্টু আর মিজান । এই লাল্টু আর মিজান রেস্টুরেন্ট বন্ধ করতে উঠে পড়ে লাগে, কিন্তু রেস্টুরেন্টের সুনাম এতো পরিমানে বেড়ে যায় যে ওরা চাইলেও কিছু করতে পারে নি । অবশেষে ওদের মনের প্রতিশোধের স্পৃহা এতো পরিমানে বেড়ে যায় যে ওরা সিদ্ধান্তু নেয় এই রেস্টুরেন্ট আর বস্তি পুড়িয়ে দিতে । কিন্তু শুধু  পুড়িয়ে দেয়ার  ইচ্ছে থাকলেও কেন যেন বিস্ফোরিত হয় বস্তি । সেখানে মারা যায় জয়নাল জামেনাসহ বস্তির অনেকে । সেদিনের পর ইফাজ এই রেস্টুরেন্ট নতুন করে গড়ে তোলে আর ইফাজেরই সহায়তায় আর বস্তির সকলের অনুরোধে লাল্টু আর মিজানের ফাসি হয় ।” চয়নিকা এমন সময় বলে উঠলো, “কিন্তু এর সাথে এদের এই কাজের সম্পর্ক কি?” অফিসার বললেন, “ওই যে লাল্টু, তার মেয়ে এই শিউলি, আর ওই যে মিজান, তার ছেলে এই মোখলেস । ওরা সে সময় বছর ১৪ মতো ছিল । নিজেদের বাবা অপরাধ করা সত্ত্বেও  বাবার এই মৃত্যুর প্রতিশোধে ওরা এই কাজ করেছে । প্ল্যান তো সেই সময় থেকেই করেছে ওরা ।” ওরা আগে থেকেই এই বাড়িতে কাজ করতো । এখানকার আগের যিনি মালিক, তিনি  এদের কাজের কথা জেনে গিয়েছিলেন । কিন্তু এরা বলেছিল মুখ খুললে খুন করে দেবে । তাই আগের মালিক এই বাড়ি আপনার কাছেই বিক্রি করে দিয়ে যায় ।” শেষটাই অফিসার চয়নিকার বাবার দিকে তাকাল । চয়নিকার বাবা বলল, “বলেন কি! আমার ভাই উনি! উনিই এ কাজ করলেন! ইচ্ছে করে আমাকে বিপদের কথা না বলেই বিক্রি করে দিলো বাড়ি? এজন্যই তো বলি, নিজের জমি কেউ কাউকে কি এমনি এমনি দিয়ে দেয়!” পুলিশ অফিসার  বললেন, “কি আর বলবো বলেন, এ যুগের মানুষগুলো চাচা আপন প্রাণ বাচা কিংবা আগে আপনি বাচলে বাপের নাম সূত্র মেনে চলে ।” আখি জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু ওরা টাকা চুরি করতো কেন?” অফিসার বললেন, “১০০সিলিন্ডার কেনা কি যে সে ব্যাপার? ওই মোখলেস এ কাজ করার জন্য রেস্টুরেন্টের ক্যাশকাউন্টারে বসা রায়হান নামের এক ছেলের বোন কলিমাকে বিয়েও করেছে । শেষটায় যখন ইফাজ এই রেস্টুরেন্টে চলে আসে, তখন এরা বুঝে যায় এই তো সুযোগ! তাই এরা এটাই মোক্ষম সময় ভেবে কাজটা অবশেষে সেড়েই ফেললো ।” সবটা শুনে পুলিশ অফিসার আবিরের দিকে তাকালেন তারপর দেখলেন আমি মন দিয়ে সবটা শুনেছে তবে আবিরের চেহারায় বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট । অফিসার আবিরকে বললেন, “আবির, তুমি যে কাজটা করেছো, এটা  সত্যি অনেক প্রশংসনীয় ।” আবির বলল, “তারপরও, আমি রেস্টুরেন্ট এবং ইফাজ আঙ্কেল আর পায়েল আনটিকে বাঁচাতে পারলাম না ।” অফিসার বললেন, “এভাবে বোলো না আবির, তুমি চেষ্টা  করেছো । আর তাছাড়া কখন কোন বিপদ আসে তা বলা যায় না ।” আবির অফিসারকে কিছু বলল না । চয়নিকাকে বলল, “তুমি একটু  আসবে বাইরে?” চয়নিকা আবিরের সাথে বাইরে গেলো । আবির বলল, “তোমায় হোয়াটস অ্যাপে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিলাম, দেখেছিলে কি?” চয়নিকা জিজ্ঞেস  করলো, “কিসের মেসেজ?”

- “যেতে বলেছিলাম বস্তিতে । আচ্ছা যাই হোক, তুমি  এখানে এসেছো বলে হয়তো যেতে পারো নি ।”

- “কখন যেতে বললে তুমি?” জিজ্ঞেস করলো চয়নিকা ।

- “তুমি হোয়াটস অ্যাপ চেক করো নি?” জিজ্ঞেস করলি চয়নিকা ।

- “আবির! তুমি আসার  একটু আগেও  আমি তোমাকে মেসেজ করেছি, কই  তোমার তো কোন মেসেজ দেখিনি আমি!” বলল চয়নিকা ।

- “হোয়াট! সত্যি বলছ?” ভ্রু-কুঁচকে বলল আবির ।

- “হ্যাঁ, এই  দ্যাখো ।” বলল চয়নিকা ।

- “তাহলে কার  কাছে পাঠালাম  মেসেজ আমি!”

বলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে হোয়াটস অ্যাপ বের  করলো আবির । যা দেখল, তা দেখার জন্য আবির মোটেও প্রস্তুত  ছিল না । মেসেজ দেখে পুতুল হয়ে গেলো আবির । এক  দৃষ্টিতে  তাকিয়ে মোবাইলের  দিকে । চয়নিকা জিজ্ঞেস করলো, “কি হল, কি হয়েছে?” আবির কিছু বলে না । চয়নিকা আবার বলল, “আরে হয়েছেটা কি?” আবির বলল, “আমি ভুলে লিলি আপুকে মেসেজটা দিয়েছি ।” চয়নিকা জিজ্ঞেস করলো, “তা  এতে এতো অবাক হবার কি হল?”  আবির বলল, “লিলি আপু  সাধারণত” এ সময় রেস্টুরেন্টে যায় না, কিন্তু আজ গেছে এই মেসেজ দেখে! আর…………।” থেমে গেলো আবির । চয়নিকা জিজ্ঞেস করলো, “আর?” আবির বলল, “আর লিলি আপুও এই বিস্ফোরণে মারা গেছে ।” চয়নিকাও এবার হতভম্ব হয়ে গেলো ।








(৩৫)

জিজ্ঞেস করলো, “কি বলছ তুমি!” আবিরের মুখ থেকে কোন আওয়াজ এলো না । চয়নিকা খেয়াল করলো আবিরের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ।

রেস্টুরেন্টের সামনের জায়গাটা  এখনও ছাই হয়ে আছে । বস্তির যে অংশ পুড়ে যায় নি সে অংশও ভেঙ্গে গেছে । রেইল চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে । বস্তির সবাই যার যার ঠিকানায় চলে যাচ্ছে । তাদের মধ্যে দুজন কলিমা আর রায়হান । একটা কাপড়ের পুটলি কাঁধে নিয়ে রওনা হয়েছে কেবল । একবারটি পুড়ে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া রেস্টুরেন্টের দিকে তাকাল ওরা । কতো স্মৃতি, কতো কাহিনী, কতো  আবেগ জড়িয়ে আছে এই যায়গার সাথে ওদের । জয়নাল আর জামেনার ভেঙ্গে যাওয়া মূর্তিটাও সরিয়ে নেয়া হয়েছে । এখন রাস্তা পরিষ্কারের কাজ চলছে । বস্তির এক পরিচিত লোক রায়হানকে বলল, “এ বাবা, তোমরা তো আমাগো পাশের গেরামেই থাকো, আমরা এক লগেই যামুনে তাইলে, একটু খারাও, তোমার কাকি আইতেছে ।” রায়হান আর কলিমা দাঁড়ালো । কলিমা তখন জিজ্ঞেস করলো, “ভাইয়া, শাফি একবারও আইলো না? ও কি খবর পায় নাই?” রায়হান কলিমার মাথায় হাত রেখে আদর করে বলল, “যাবি ওর সাথে দেখা করতে?” কলিমা কিছু বলার আগেই পেছন থেকে আওয়াজ এলো, “তা আর সম্ভব নয় ।” রায়হান আর কলিমা পেছন ফিরে তাকাল । দেখল, আবির আর একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে । রায়হান বলল, “কই ছিলি আবির? তোকে কতো খুজলাম ।” আবির বলল, “ভাই, শোনো, তোমাদের এখানে যা হয়েছে সব প্ল্যান করে হয়েছে ।” কলিমা জিজ্ঞেস করলো, “কি কইতাছোস তুই?” আবির সব ঘটনা খুলে বলল । ঘটনা শুনে রায়হানের হাত থেকে কাপড়ের পুটলিটা মাটিতে পড়ে গেলো । কলিমা মূর্তির, মতো দাঁড়িয়ে রইল । রায়হান যে রেগে গেছে তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে । আবির বলল, “ভাই, চিন্তা কোরো না, ওরা এখন পুলিশের কাছে ।” রায়হান কথাটা শুনে একটু স্বস্তি পেলো বটে তবে রাগটা ততোটাও কমলো না । চয়নিকা তখন জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা কোথায় যাচ্ছো?” কলিমা বলল, “না গেলে থাকমু কই?” বলে কলিমা ভেঙ্গে যাওয়া বস্তির দিকে ঈশারা করে দেখাল । আবির বলল, “আল্লাহ! এ কি অবস্থা!” তারপর আবির ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু তোমরা চলে গেলে আমি যাবো কোথায়? তোমরাই তো ছিলে আমার অভিভাবক?”  রায়হান বলল, “যাবি আমাদের সাথে? ফকিরাপুল গ্রামে? ওখানে জয়নাল চাচা আর জামেনা চাচির বাড়ি আছে, পুরা বাড়িই তো তোর । যাবি আমাদের সাথে?” আবির একবার চয়নিকার দিকে তাকাল । তারপর কি একটু ভেবে বলল, “আমার যে কলেজ এখানে?” কলিমা জিজ্ঞেস করলো, “তা হোক, কিন্তু তুই এইখানে কই থাকবি?” এমন সময় একটা লোকের আওয়াজ এলো, “ও আমার বাড়িতে থাকবে ।” ওরা তাকিয়ে দেখল, ওদের পাশেই দাঁড়িয়ে চয়নিকার বাবা । চয়নিকা বাবার দিকে তাকিয়ে খুশি হয়ে উঠলো । চয়নিকার বাবা ওদের দিকে এগিয়ে এলো । আবির বলতে গেলো, “কিন্তু আঙ্কেল………………।” চয়নিকার বাবা বলল, “উহু, কোন কিন্তু নয়, আর আঙ্কেল না, আমাকে আজ থেকে বাবা বলতে শেখো ।” সবাই অবাক হয়ে গেলো, সাথে খুশিও  হল । আবির চয়নিকা খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরল । চয়নিকার বাবার পেছনেই ছিল আখি । আখিও খুশিই হলেও কি একটা বিষয় নিয়ে যেন আখি চিন্তিত ছিল তা ওর চেহারা দেখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো । এমন সময় একটু আগের রায়হানের সেই পরিচিত লোকটা তার স্ত্রীকে নিয়ে এদিকে এসে বলল, “চলো বাবা, রওনা হই, গেরামে যাওয়ার একখানই বাস, তাও একটু পড়েই যাইবো, দেরি করলে পামু না ।” রায়হান ওপর নিচে মাথা নাড়িয়ে আবিরের দিকে তাকাল । তারপর বলল, “আসি?” আবির রায়হান আর কলিমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এ কটা দিন তোমাদের সাথে অনেক ভালো সময় কাটিয়েছি । অনেক ধন্যবাদ সবকিছুর জন্য । কলিমা বলল, “ভালো থাকিস রে, আমাগো মোবাইল নাম্বার তো তোর কাছে আছেই, খোঁজ খবর লইস ।” আবির ডানে মাথা কাত করলো শুধু, কিছু বলল না । কলিমা আর রায়হান যাবার জন্য পা বাড়াবে, এমন সময় আবির ডেকে উঠলো, “রায়হান ভাই!” রায়হান আর কলিমা দাঁড়িয়ে গেলো । আবির রায়হানের কাছে যেয়ে বলল, “একটা কথা বলবো, জানি এটা শুনল হয়তো আপনি আমার ওপর রাগ করতে পারেন, কিন্তু না  বলা পর্যন্ত  আমি মনে শান্তি পাচ্ছি না ।” রায়হান একবার ভ্রু কুঁচকে কলিমার দিকে তাকাল । তারপর জিজ্ঞেস করলো, “হ্যাঁ বল কি বলবি?”

“গতকাল সবটা আমি যখন জানতে পারলাম, আমি তখন চয়নিকাকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিলাম এখানে আসতে । কিন্তু ভুল করে সেই মেসেজ চলে গিয়েছিলো লিলি আপুর কাছে । যার জন্য লিলি আপু এখানে এসেছিলো, এরকম সময়ে কখনো উনি এখানে আসেন না  তা সত্ত্বেও ।”  বলে রায়হানের দিকে তাকিয়ে  রইল আবির । রায়হান চোখ বন্ধ করে আছে  । সবাই ধরেই নিয়েছে আবিরকে এখনই প্রচণ্ড রেগে আক্রমন করবে রায়হান, কিন্তু না । একটু পরই রায়হান হালকা হাসবার চেষ্টা করে বলল, “যা হয়েছে, হয়েছে । আল্লাহ ওর  কপালে  মৃত্যু রাখছিলেন, তাই  ওর মৃত্যু হয়েছে । এতে যে তোরই দোষ তা বলা উচিৎ না ।” বলে রায়হান আর কলিমা রওনা হল । আবির আর কিছু বলল না । জায়গায় দাঁড়িয়েই দেখতে  লাগলো কিছু ভালোবাসার মানুষের  চলে যাওয়া । ধীরে ধীরে রাস্তার ওপারে যেতে ব্যাস্ত শহর ঢাকার যানবাহনের মধ্যে চোখের অন্তরালে চলে গেলো কলিমা আপু আর রায়হান ভাই, সাথে উনাদের পরিচিত সেই দুজন দম্পতি । চয়নিকা আবিরের  কাঁধে হাত রেখে শান্তনা জানালো ।









(৩৬)

“আসসালামু আলাইকুম এবং শুভ সন্ধ্যা, সবাই জানাই দ্যা ইনভেস্টিগেশন শো তে স্বাগতম । আজ আমরা আপনাদেরকে শোনাবো সেই গল্প, যে গল্প হার মানাবে একটা সিনেমার  গল্পকেও । প্রায় ৭ বছর পর এক  পুরনো ঘটনার প্রতিশোধ নেবার গল্প, কমলাপুর  রেলওয়ে ষ্টেশনের  জেজেএ রেস্টুরেন্টের বিস্ফোরণের গল্প । তবে শুরু  করা যাক?  তবে চলুন চলে যাই ইনভেস্টিগেশনের জগতে, শুনে আসি এক দারুণ ঘটনা ।” আবির এ পর্যন্ত বলতেই “কাট” বলে উঠলো প্রোগ্রামের ডিরেক্টর । বিস্ফোরণের ঘটনার প্রায় সপ্তাহখানেক পরের ঘটনা । আবিরকে চয়নিকার বাবা  অনুসন্ধানীমূলক অনুষ্ঠানের হোস্ট বানাতে স্টুডিও নিয়ে গেছে । তারই শুটিং চলছিলো । ডিরেক্টর কাট বলতেই ক্যামেরা ম্যান, লাইট ম্যান একটু রেস্ট নেয়া শুরু করলেন । ডিরেক্টর তখন চয়নিকার বাবাকে বলল, “আপনি যা নিয়ে এসছেন না! প্রোগ্রাম তো এবার পুরো হিট হবে! আর আপনার এই অনুসন্ধানীমূলক অনুষ্ঠানের বুদ্ধিটাও দারুণ ছিল । অনেক অনেক ধন্যবাদ ।” চয়নিকার বাবা বলল, “আরে ধন্যবাদ আমায় না, ওই ছেলেকে দিন । ছেলেটা শুধু হোস্ট না, এই প্রোগ্রামের একজন অনুসন্ধানকারীও হতে পারবে । ছেলের গোয়েন্দাগিরির তুলনা হয় না । জেজেএ রেস্টুরেন্টের কাহিনীর অর্ধেক তো ওই অনুসন্ধান করেছে ।”  প্রোগ্রামের ডিরেক্টর “তাই!” বলে আবিরের দিকে  তাকিয়ে বলল, “তাহলে তো দেখছি দুধের সাথে দইও ফ্রি পেলাম ।” আবির কথা শুনে হালকা হাসলো, কিছু বলল না । পরক্ষনেই আবার ইফাজ আর পায়েলের মুখখানা ভেসে উঠলো চোখের   সামনে । ডিরেক্টর তখন বলে উঠলো, “হ্যাঁ আবির রেডি হও নেক্সট শটের জন্য ।” আবির সহ সবাই রেডি হয়ে গেল নেক্সট শটের জন্য ।

রাত ১০টার দিকের কথা । শুটিং শেষে বাড়ি ফিরেছে আবির আর চয়নিকার বাবা । দরজায় নক করতেই দরজা খুলল চয়নিকা । চয়নিকা জিজ্ঞেস করলো, “কি ব্যাপার, শুটিং কেমন হল?” আবির বলল, “তোমার মুখ দেখে গেলে শিওর খারাপ যেতো  কিন্তু আখি আপুর মুখ দেখে গিয়েছি বলে দারুণ গেছে ।”

- “শুরু হল তোমার ইয়ার্কি, না?” হালকা রাগ করে বলল চয়নিকা ।

- “আচ্ছা থাম থাম । তোরা তো দেখছি এখনি ঝগড়া শুরু করে দিলি । বিয়ের পর যে কি করবি, আল্লাহই জানেন ।” হালকা হেসে বলল চয়নিকার  বাবা ।

- “আহ বাবা, বিয়ের বহু দেরি, তার আগেই আপনার মেয়েকে একটু ঝগড়ার  সাথে অভ্যস্ত করে দিচ্ছি আর কি ।”

সে  সময় আখি রুমে এসে বাবাকে বলল, “বাবা, একটু আমার  রুমে এসো, কথা আছে ।” ওদের বাবা বলল, “আচ্ছা যা আমি আসছি ।” আখি চলে গেলো । চয়নিকা আবিরের দিকে তাকিয়ে জিভ বের করে ভেংচি কাটল ।  আবিরও চয়নিকার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে চলে গেলো অয়নের রুমে । এ বাড়িতে আসার পর আবির অয়নের সাথেই থাকে । চয়নিকা হালকা চোখ গরম করে নিজের রুমে চলে গেলো ।  আর চয়নিকার বাবা গেলো আখির রুমে । যেয়ে আখিকে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে মা, কি হয়েছে ।”

- “সন্ধ্যায় মা ফোন করেছিলো ।” বলল আখি ।

- “ও আচ্ছা, তা কি বলল তোর মা?” জিজ্ঞেস করলো আখির বাবা ।

- “মাকে পাশের বাসার আনটি আজ গতকাল নাকি আবিরের কথা বলেছে । ভাগ্য ভালো এটা বলেনি আবিরের সাথে চুনির বিয়ে দেবার চিন্তা করেছো তুমি ।” বলল আখি ।

আঁখির কথা শুনে একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো ওর বাবা । জিজ্ঞেস করলো, “কি বললি তুই?”

- “মা জিজ্ঞেস করলো আমরা আগে জানাই নি কেন, আমি বললাম তুমি টেনশন  করবে  সেজন্য, এরপর মা জিজ্ঞেস করলো কি করছে আমাদের বাড়িতে, আমি বললাম অয়নের টিচার হিসেবে থাকছে আর ওর আশ্রয় নেই বলে বাবা আশ্রয় দিয়েছে । আরও অনেক কথা বলে মাকে কোনোরকমে বুঝিয়েছি  ।” বলল আঁখি ।

- “হুম । ওর আর চয়নিকার বিয়ের কথা কাউকে বলার দরকার নেই । আমি ছেলেটার নিজের  পায়ে দাঁড়ানোর অপেক্ষায় আছি, তাহলেই ওর সাথে চুনির বিয়ে দেবো । কিন্তু ততদিনে তোর মা কোন সময় বাসায় এলে তো আবার সমস্যা ।” বলল ওর বাবা ।

- “কিন্তু বাবা, এটা কি ঠিক হচ্ছে, হোক ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে, কিন্তু এমনও তো হতে পারে চুনির অতীত জেনে ওর চুনির প্রতি সে ভালবাসাটাই আর রইল না ।” বলল আঁখি ।

- “চুপ থাক, ভ্রুনাক্ষরেও  এ কথা যেন আবির না জানতে পারে । ছেলে তো  পেয়েছি, আর কখনো কেউ রাজি হবে কি না সন্দেহ, এর সাথে দেবার সুযোগ পেয়েছি, হাতছাড়া করা যাবে না । যেভাবেই হোক, বিয়েটা দিলে তাও চুনির বিয়ের চিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে ।” বলল আঁখির বাবা ।

- “কিন্তু মা কি এই বিয়ে মেনে নেবে?” জিজ্ঞেস  করলো আঁখি ।

- “তোর মা জানবেই  বিয়ের  পর,  তাহলেই তো  হল ।” বলল আঁখির বাবা ।

আঁখি আর  কিছু বলল না ।












(৩৭)

পরদিন ছিল শুক্রবার । আবিরের ছিল না কলেজ, চয়নিকার ছিল না কলেজ, আঁখির ছিল না ভার্সিটি আর ওর বাবার ছিল না অফিস । ছুটির দিনে আবির ফজরের নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে যায় । উঠতে উঠতে প্রায় সকাল ১০টা মতো বাজে । এখন বাজে সাড়ে ৯টা । নতুন কাজের বুয়া জরিনা । ওদের বাবাকে চা দিয়ে কাজ করতে চলে গেলো । আঁখি ভার্সিটির কি একটা কাজ করছে । চয়নিকা গেছে ছাদে গাছে পানি দিতে আর অয়ন রুমেই পড়াশুনো করছে । অয়ন টেবিলে আর আবির বিছানায় । শরীরের ওপর থেকে কাথার অর্ধেকটা সরে গেছে বালিশের প্রায় কোণায় মাথা দিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে আপন মনে ঘুমাচ্ছে । একটু পর চয়নিকা ছাদ থেকে এসেই অয়ন আর আবিরের রুমে এলো । অয়নকে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে, ওঠেনি তোর দুলাভাই?” অয়ন হালকা হেসে বলল, “এ কি চুনি আপু, তুমি হবু দুলাভাইকে সরাসরি দুলাভাই  বানিয়ে দিলে?” চয়নিকা বলল, “হয়েছে থাম । ওর সাথে থাকতে থাকতে  তুইও এর মতো হয়ে যাচ্ছিস ।” বলেই চয়নিকা আবিরের দিকে তাকাল । তারপর বলল, “কি সুন্দর! কি দিন দুনিয়া এলো!” প্রায় প্রতিটা ছুটির দিনে এরকম জমিদারের মতো শুয়ে শুয়ে ঘুমায়!” চয়নিকা এবার অয়নের টেবিল থেকে পানির বোতল নিয়ে আবিরের মুখে ওপর ঢেলে দিলো পানি । আবির সাথে সাথে “এ! কি হচ্ছে টা কি!এ!এ!” বলতে বলতে ধরফরিয়ে উঠে বসলো । তারপর মুখ মুছে রাগি মেজাজে চয়নিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা কি হল!” চয়নিকা বেশ একটা ভাব নিয়ে বলল, “এটা অ্যালার্মের কারাতে সিস্টেম ।”

- “কারাতে না ছাই! আমার এতো সুন্দর ঘুমটার ১৩টা বাজিয়ে দিলো!” আক্ষেপ করে বলল আবির ।

- “ঘড়ির কাটায় ১৩ নেই মিস্টার কাপুরুষ!” হালকা হাসতে হাসতে বলল চয়নিকা ।

- “আরে কামহিলা! এটাই তো রহস্য! দুর্দান্ত একটা স্বপ্ন দেখছিলাম! কি দারুণ একটা এলাকা! কি দারুণ পরিবেশ! কিন্তু সমস্যা হল এলাকার সব জায়গায় ঘড়ির কাটায় ১২ এর পর ১৩ লেখা থাকে । সেই রহস্যের কিনারা করতেই আমাকে পাঠানো হয়েছিলো সেই এলাকায়! আর তুমি দিলে আমার তদন্তে জল ঢেলে ।” রাগ করে বলল আবির ।

- “হয়েছে মিস্টার কাপুরুষ, এবার থামেন । স্বপ্নে অনেক তদন্ত করেছেন, এবার একটু বাজারটা করে আনেন যান!” বলল চয়নিকা ।

- “বাজার! মানে সকালের নাস্তা না করেই!” বলল আবির ।

- “বলি পড়ে পড়ে যদি এভাবে ঘুমান, তাহলে নাস্তার কি দরকার! স্বপ্নের মধ্যেই নাস্তা করে নিতে পারেন! যতসব!”

বলেই চয়নিকা রুম থেকে বেরোচ্ছিল, এমন সময় খেয়াল করলো অয়ন আবিরের এই দশা দেখে  ইয়ারকি করে আবিরের দিকে তাকিয়ে জিভ তালুর সাথে লাগিয়ে “চ্ চ্” ধরণের আওয়াজ করছে । সেই দেখে চয়নিকা অয়নের দিকে তাকিয়ে  বলল, “আর এই যে অয়নের বাচ্চা, তুই এতো হাসিস না, তোরেও বাজারে যাইতে হবে ।” অয়ন বলল, “আমি! আমার পড়াটা কমপ্লিট করতে হবে!” আবির অয়নের দিকে তাকিয়ে বলল, “এহ, কতো যে পড়ে, তা আমার জানা আছে ।” অয়ন আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “হবু দুলাভাই! ঠিক হচ্ছে না কিন্তু!” আবির বলল, “আরে আমি তো তাও দুলাভাই, তুই তো শালা! শালার ঘরের শালা!” অয়ন আরও কথা শুরু করলো, আবিরও আরও কথা শুরু করলো । এরই মধ্যে বিরক্ত হয়ে চয়নিকা বলল, “স্টপ ইট!” দুজনেই থামল । চয়নিকা তখন অয়নের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই যখন  পড়ছিস পড় । আবিরই বাজা…………।” চয়নিকার কথা শেষ হতে না হতেই আবির উঠে অয়নের বইয়ের নিচ থেকে মোবাইলটা বের করে বলল, “এই হল ওর পড়ালেখা ।” আবির একবার ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই তাড়াতাড়ি করে চোখ বন্ধ করে ফোন লক করে দিলো । তারপর বলে উঠলো, “নাউজুবিল্লাহ!” চয়নিকা বলল, “কি হয়েছে আবির! আর অয়ন! তুই কি করছিলি পড়া বাদ দিয়ে ফোনে!” অয়নের কাছ থেকে কোন জবাব এলো না । চয়নিকা আবিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আবির কি ছিল ওর ফোনে?” অয়ন আবিরের দিকে তাকাল । তারপর এমন একটা ভঙ্গিতে তাকাল যেন ও আবিরকে মানা করছে বলতে আবির ওর ফোনে কি দেখেছে তা । চয়নিকা কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় অয়ন বলল, “আপু! আমি বাজারে যাবো! দুলাভাই! চলো যাই!” চয়নিকা আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “না আবির তুমি বলো কি দেখেছো ওর ফোনে!” আবির একটা ঢোক গিলল । তারপর বলল, “টম অ্যান্ড জেরি!”








(৩৮)

চয়নিকা জিজ্ঞেস করলো, “টম অ্যান্ড জেরি! অয়ন এই বয়সে টম জেরি দেখবে! আর যদি দেখেও  থাকে এভাবে রিয়েক্ট করার কি কারণ?” আবির বলল, “না, টম আর একটা মেয়ে ইদুরের রোমান্সের দৃশ্য চলছিলো তো, তাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ।” চয়নিকা, “আজাইরা কাণ্ড! যতসব!” বলে রুম  থেকে চলে  গেলো । আবির অয়নের কাছে  মুখ বাড়িয়ে   জিজ্ঞেস করলো, “কিরে! এসব কি দেখিস তুই! মেয়েটা কে?” অয়ন বলল, “বলিউডের নায়িকা । জোস দেখতে না?” আবির ধমক দিয়ে বলল, “বাজারে চল! আর তোর এসব দেখা বার করছি দাঁড়া!” বলেই আবির  বাইরে চলে এলো । চয়নিকা আর আবিরের ঝগড়ায় মাঝখান থেকে বেচারা অয়ন ধরা পড়ে গেলো ।

১১টার দিকের কথা । বাজার এনে ঘরে ঢুকল আবির । চয়নিকার বাবা রুমে চলে গেছে । আবির বাজারের ব্যাগটা রান্নাঘরে রেখে চয়নিকা খুঁজতে যেয়ে দেখল, চয়নিকা রুমে নেই । বোধ হয় অন্য কোথাও আছে । চয়নিকা তখন আঁখিকে প্রোজেক্টের কাজে সাহায্য করছিলো । এক একটা ছোট শহরের মতো বানাচ্ছে ওরা, সেখানে এরকম কিছু দেখাবে দিনের আলোয় রোড  লাইট অটো বন্ধ হয়ে যাবে আর রাতে অটো জলে উঠবে, কিন্তু অযথা জলে বিদ্যুৎ অপচয় করবে না । একটা জায়গায় তার জোড়া লাগাতে হবে । আঁখি চয়নিকাকে জিজ্ঞেস করলো, “শোন, আমার আঠাটা শেষ হয়ে গেছে । তোর কাছে আছে নাকি?” চয়নিকা বলল, “হ্যাঁ, আমার টেবিলের  ওপরেই আছে ।”

- “একটু নিয়ে আয় না?” বলল আঁখি ।

- “এহ! আমাকে দিয়েই সব কাজ  করাও!” ইয়ার্কির সাথে  বলল চয়নিকা ।

আঁখি চয়নিকার ইয়ার্কিকে সিরিয়াসলি ভেবে বলল, “বুঝেছি! তোকে দিয়ে কিছু হবে না ।” বলে আঁখি চলে এলো । চয়নিকা যে ইয়ার্কি করেছে তা বলার সুযোগও দিলো না । 

এদিকে আবির চয়নিকাকে রুমে না পেয়ে রুম থেকে বেরোতে যাচ্ছিলো, এমন সময় চয়নিকার বিছানার ওপর  রাখা চয়নিকারই মোবাইলে একটা কল এলো । আবির চয়নিকার  কাছে মোবাইল নিয়ে  যাওয়ার জন্য মোবাইল হাতে নিতেই দেখল, চয়নিকার মা ফোন করেছে মেসেঞ্জারে । আবির নিজেই নিজেকে শুনিয়ে বলল, “চয়নিকার মা! আচ্ছা, ওরা আমাকে  ওর  মা সম্পর্কে কিছু বলে না কেন? আর আনটি কি কখনোই দেশে আসবেন না?” একটু থেমে আবার আবির নিজেই  নিজেকে শুনিয়ে বলল, “একটু ধরে কথা বলবো নাকি?” আবির আবার একটু ভেবে কলটা ধরতে যাবে এমন সময় আঁখি আবিরের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে কল কেটে দিয়ে বলল, “না আবির, ভুলেই এ কাজ কোরো না ।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “কেন?” আঁখি বলল, “দ্যাখো আবির, আসলে, আমার মা পরহেজগার মানুষ তো, উনি যদি জানতে পারেন তুমি একজন বাইরের ছেলে এ বাড়িতে এসেছ যেখানে তার দুই যুবতী মেয়ে  থাকেন তাহলে  অনেক কষ্ট পাবেন ।” আবির “ও” ছাড়া আর কিছু বলল না । আঁখি রুম থেকে  আঠা আর চয়নিকার মোবাইল নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো ।

সেদিন বিকেলের কথা । আবির আর চয়নিকা ছাদে দাঁড়িয়ে ।

- “আচ্ছা, তোমার মা খুব পরহেজগার?” জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “কেন?” জিজ্ঞেস করলো চয়নিকা ।

- “না, তোমার বোন বলছিলেন । তোমার মা আজ ফোন দিয়েছিলেন, আমি ধরতে গিয়েছিলাম, তখন আঁখি আপু বললেন আমার সাথে তোমার মায়ের কথা বলতে দিলেন না, বললেন তোমার মা পরহেজগার মানুষ, উনার  বাসায় বাইরের একটা ছেলে এসে উঠেছে তা জানলে হয়তো রাগ করবেন ।” বলল আবির ।

চয়নিকা  শুধু “হু”  ধরণের আওয়াজ করলো, আর  কিছু বলল  না । আবির  তখন জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, তোমার মা যদি এ বাড়িতে চলে আসেন আর আমাকে দেখেন তাহলে কি হবে?” 

- “মা আমার বিয়ের আগে এ বাড়িতে আসবেন না ।” বলল চয়নিকা ।

- “কি? কিন্তু কেন?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো আবির ।

- “পারিবারিক পার্সোনাল ব্যাপার । বলা যাবে না ।” কেমন বলতে বলতে মন  খারাপ হয়ে গেলো চয়নিকার । আবির হেসে জিজ্ঞেস করলো, “আমি তোমার পরিবারেরই একজন হয়ে গেছি, আমার কাছে বলা যাবে না?” চয়নিকা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “এখনও হও নি আবির, তোমার আমায় বিয়ে করা দেরি আছে ।” আবির কিছুক্ষণ চুপ থাকল ।  তারপর আকাশের  দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা, আমার সাথে সুখী হতে পারবে তো?” চয়নিকা জিজ্ঞেস করলো, “কেন?” আবির বলল, “না, এই ছোটবেলা থেকে আমি আর ক্রাইম কেমন যেন জুড়ে গেছি । আমি যেখানেই যাই, সেখানেই যেন ক্রাইম চলে আসে । তেমনি তোমার লাইফে এলেও যদি কোন ক্রাইমের সম্মুখীন হই, তখন?” চয়নিকা হালকা হেসে বলল, “ইনশাল্লাহ হবে না । তবে যদি হয়, তবে আমি এই দুজনের সাথেই থাকবো ।” আবির ভ্রু-কুঁচকে চয়নিকার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “দুজনের সাথেই থাকবে মানে?” চয়নিকা আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি আর ক্রাইম ”