ব্রো এর ঝুলি - কুৎসিত নবাবকন্যা
ব্রো এর ঝুলি-১
লেখকঃ সাদাত আলম প্রতীক
এবারের গল্প-কুৎসিত নবাবকন্যা
“তাই আমি বৃষ্টি এলেই……… ওপস! তোমরা এসে গেছো? আমি তো কেবলই তোমাদের কথা
ভাবছিলাম, দেরি করছ কেনো । তোমাদের কথা ভাবছিলাম, আর গান গাচ্ছিলাম
। যাই হোক, পরিচয়টা দেই, আমি………। না না না না না, নামটা তো বলা যাবে না, তোমরা বরঞ্চ
আমাকে ব্রো বলেই ডেকো । কেননা, আমরা ঠাকুরমার ঝুলির ঠাকুমার নাম জানতাম না, যেহেতু
আমি ঠাকুমার চাকরিটাই নিয়েছি, তাই তার মতো করেই না হয় সব কিছু করি । বাই দা ওয়ে, আমি
কিন্তু শুধু যে ওই পশুপাখি, রাজারানী, ভুত-পেত্নীর গল্পই বলবো, তা কিন্তু নয়, আমি কিন্তু
এ যুগের গল্পও বলবো । বিজ্ঞান, সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি, মোবাইল, আরও কতো কিছু নিয়ে গল্প
। প্রেমের গল্পও থাকবে । না, না তরুণেরা, এতো লাফালাফির কিছু নেই । আমি এতে নোংরা কন্টেন্ট
রাখবো না । যতোই হোক, বাচ্চাকাচ্চারাও গল্প শুনতে এসেছে, তাদের সামনে এসব বলা অনুচিত
হবে । তবে কথা দিচ্ছি, গল্প হবে এমন, ইনজয় করবে সব বয়সী লোকজন । প্রথম দিন একটু বেশিই
বক বক করা হল, গল্প শুরু করি তাহলে? এই যা! ঠাকুমা যেন কি বলে শুরু করতেন? কি যেন?
কি যেন? হ্যাঁ, মনে পড়েছে । তোমরা তাহলে চুপ করে বসো, আমি আমার ঝুলি থেকে গল্প বের
করি । শোনো ।”
রাজ্যের নাম সুন্দরীগড় । এ রাজ্যের প্রকৃতি, গাছপালা,
বারিঘর, সব দেখলে যে কেউই আসলেই সুন্দর বলতে বাধ্য । এ রাজ্যের নবাব শাহেদ । তার বেগম
হাফিজাতুন্নেসা । নবাব আর তার বেগম বেশ ছিলেন তাদের রাজ্য নিয়ে । বিয়ের পর থেকেই বেশ
সুখেই দিন পার করছিলেন । তাদের বিয়ের ১ বছরের মাথায় ঘরে আগমন ঘটে নতুন এক সদস্যের,
তাদের কন্যা সন্তান । নাম, লাবনী । নবাব আর তার বেগম ভেবেছিলেন তাদের মেয়ে তাদের গ্রামের
মতোই সুন্দরী হবে, তাই নাম রেখেছিলেন লাবনী লাবণ্য থেকে যার উৎপত্তি । কিন্তু হায়!
খুব ছোটবেলায় কি একটা বিষাক্ত ফলের কষ লাবণ্য মুকে পড়ায় মুখের অর্ধেক পুড়ে যায় । এরপরই
সে হয়ে যায় কুৎসিত । নবাব আর তার বেগম এতে হালকা
কষ্ট পেলেও তারা নিজেদের সামলে নিয়েছিলেন
। যতোই হোক, তাদেরই তো মেয়ে । আল্লাহর ভরসায় তাকে লালন পালন করতে লাগলেন । সে কালে
একটা রীতি ছিল, যা ছিল খুবই বাজে । যাদের চেহারা খারাপ, তারা না শাসন করতে পারতো, না এলাকায় মাথা উচু করে থাকতে পারতো । যদিও এই রাজ্য সেই রীতি মেনে চলতো না ।
তাই নবাব কন্যা লাবণী মানুষের ভালোবাসায়েই বড় হতে থাকে । তার মনে এ নিয়ে কোন কষ্ট নেই । সে সবসময় বোরখা পড়ে থাকতো বলে তার এই
কুৎসিত চেহারা কেউ দেখত না । কিন্তু তবুও অচেনা কেউ কখনো কোনোভাবে দেখে ফেললে মনে একটু কষ্ট
পেত । পড়ে আবার নিজেকে সামলে নিত ।
দিন যতো যেতে থাকে, সেও বড় হতে থাকে । অস্ত্র বিদ্যায় বেশ পারদর্শী । তলোয়ারের আঘাতে সে একাই ১০ সৈনিককে কুপোকাত করতে সক্ষম ।
দিনের বেলা সে জ্ঞানার্জন করে, দুপুরে সে নিজের অস্ত্রবিদ্যাকে আরও শক্তিশালী করতে
অনুশীলন করে । আর বিকেলে সে তার রাজ্যের কিছু সইদের সাথে এলাকায় ঘুরে বেড়ায়, কখনো খেলে
। বয়স এখন প্রায় ১৮ । সেদিন সকালে নবাব বাহাদুর বাগানে তার নায়েব আসালাম আকরাম এর সাথে
হাঁটছিলেন । সময়টা তখন যোহরের প্রায় আগ মুহূর্ত । সভা তখন শেষ । নবাব তার নায়েবকে জিজ্ঞেস
করলেন, “নায়েব, আমি আমার কন্যাকে নিয়ে বড়ই চিন্তিত । বিশেষ করে ওর তো বিয়ের বয়স চলেই
এলো ।” নায়েব বলল, “জি নবাব বাহাদুর । আমি বুঝতে পারছি । আপনার হয়তো ইচ্ছে ছিল আপনি
কোন ভালো নবাব পুত্রের সাথে আপনার কন্যার বিবাহ দেবেন । কিন্তু হায় আপনার কপাল । তবে
চিন্তা করবেন না, আল্লাহ ভরসা ।” নবাব শাহেদ একটা হতাশার শ্বাস ফেলে বললেন, রাব্বুল
আলামিনের ভরসায়েই তো এতোটা দুর এসেছি । আচ্ছা, রাজ্যে কি তেমন কোন সুযোগ্য পাত্র নেই
আমার মেয়েকে বিবাহ করার জন্য?”
- “মার্জনা করবেন নবাব বাহাদুর । রাজ্যের লোকেরা
হয়তো আপনার মেয়ের জন্য কষ্ট পায় না ঠিকই, তবে আমার মনে হয় না আপনার মেয়েকে কেউ বিবাহ
করতে রাজি হবে ।
- “না না, ঠিক আছে । ভুল তো কিছু বলো নি ।
এমন সময় এক পেয়াদা নবাবের কাছে এসে বলল, “হুজুর,
কুৎসিত নগরী থেকে এক নায়ের এসেছে । তাদের নবাব আপনার কন্যার সাথে তাদের নবাব পুত্রের
বিবাহ দিতে চান ।” নবাব শাহেদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো । নায়েবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“দেখলে নায়েব! অবশেষে আমার অপেক্ষার অবসান হল । আলহামদুলিল্লাহ!” তারপর নবাব পেয়াদার
দিকে তাকিয়ে বললেন, “যাও, তাকে এক্ষুনি আমার কাছে নিয়ে এসো ।” পেয়াদা তখন হালকা ফিসফিসিয়ে
বলল, “যদি কিছু মনে না নেন, আরেকটা কথা বলি । নায়েব দেখতে কেমন যেন কালো ।” খানিক আগে
মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব আসায় যেই নবাবের মুখে হাসি ফুটে উঠেছিলো, সেই নবাবের চেহারায়-ই এখন কেমন
যেন চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো । কুৎসিত নায়েব? রাজ্যের পুত্র-ও আবার কুৎসিত হবে না তো? না না, না-ও তো
হতে পারে । নবাব হালকা হাসবার চেষ্টা করে পেয়াদাকে
বললেন, “তুমি যাও, তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো ।” পেয়াদা মাথা “যা হুকুম করবেন ।” বলে
চলে গেলো । নবাব তখন নায়েবকে বললেন, “নায়েব, কিছু বলো, পেয়াদা কি বলল শুনলেই তো । যদি
ওদের পুত্র-ও দেখতে অসুন্দর হয়?”
- “আপনি শুধু শুধুই চিন্তা করছেন নবাব বাহাদুর
। পেয়াদা দেখতে কুৎসিত হতেই পারে, তা বলে যে তাদের নবাবপুত্রও যে কুৎসিত হবে তা-তো
নয় । আর তাছাড়া আমাদের রাজ্যে সাদা কালো, সুন্দর কুৎসিত এসব বিবেচনা করা হয় না । সবাই
আল্লাহর সৃষ্টি । তবে আপনি কেন এতো ভাবছেন?” বলল নায়েব ।
- “তারপরেও । জানি না । মনটা কেমন কু-ডাক ডাকছে
। তারওপর রাজ্যের নামও কুৎসিত নগরী । দেখা যাক কি হয় ।”
“আসসালামু আলাইকুম নবাব” হঠাৎ ডাক শুনে সামনের
দিকে তাকালেন নবাব শাহেদ । এটা কুৎসিত নগরীর নায়েব । পেয়াদা যা বলেছিল, ভুল বলে নি
লোকটা আসলেই খুব কুৎসিত । মহারাজ এই কুৎসিত কালো লোকটাকে দেখেই প্রথমেই একটা কথা তার
মাথায় এলো । অন্য রাজ্যে তো কুৎসিত লোকেদের বড় কোন কাজে নিয়োগ দেয়া হয় না, তবে এই লোক
নায়েব কি করে নিযুক্ত হল? কুৎসিত নগরীর নায়েব যেন নবাব শাহেদের চেহারা দেখেই বুঝতে
পেরে বলল, “নবাব বাহাদুর, আমি জানি আপনি কি ভাবছেন । খুব সম্ভবত আপনি ভাবছেন আমি কি
করে কালো হওয়া সত্ত্বেও সেই রাজ্যের নায়েব হয়েছি । নবাব বাহাদুর, সত্যি কথা বলতে আমাদের
রাজ্যের সাথে আমাদের সবকিছুর বেশ মিল । কিন্তু হতাশ হবেন না । আমাদের রাজ্যের সবাই
কালো হলেও, আমাদের নবাবপুত্র দেখতে অপূর্ব । তার রুপে পশুপাখি পর্যন্ত পথ দিয়ে যেতে
গিয়ে থেমে দাড়িয়ে দেখতে থাকে ।” নবাব শাহেদ একটু অবাক হলেন । কালো ঘরে সুন্দর পুত্র?
জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব?”
- “জি নবাব বাহাদুর, এটা অনেক বড় একটা কাহিনী ।
অনুমতি দেন তো শুরু করি ।” বলল কুৎসিত নগরীর নায়েব ।
- “জি অবশ্যই, কিন্তু আপনি আমাদের অতিথি, আপনাকে
তো এখানে দাঁড় করিয়ে রেখে কথা শুনতে পারি না, আসুন প্রাসাদে আসুন ।” বলেই নবাব শাহেদ
তার রাজ্যের নায়েব এবং কুৎসিত নগরীর নায়েবের সাথে নিজের কক্ষে গেলেন । খানিক পর দাসিরা
ফলাহার নিয়ে এলো । নবাব শাহেদ বললেন, “এবার বলুন, কি যেন বলছিলেন ।” কুৎসিত নগরীর নায়েব
ফলাহার গ্রহন করতে করতে বলতে লাগলেন তার রাজ্যের কাহিনী ।
কুৎসিত নগরী একসময় মোটেও কুৎসিত ছিল না । এক সময়
এটা ছিল সুন্দরীগড়ের মতোই বেশ সুন্দর । বর্তমানে কুৎসিত নগরীর নবাব আকরাম খাঁ । আকরাম
খাঁ এর প্রপিতামহের সময় থেকেই রাজ্য কুৎসিত হয়ে যায় । সে সময় ঘটেছিল এক সাংঘাতিক ঘটনা
। আকরাম খাঁ এর প্রপিতামহ ভালোবেসে বিবাহ করেন এক সুন্দরী রমনিকে । সে দেখতে বেশ ছিল
। কিন্তু বিবাহের পর হঠাৎ একদিন নবাব আকরাম খাঁ এর প্রপিতামহ খেয়াল করেন, বাস্তবে তার
স্ত্রী মোটেও দেখতে সুন্দর না, সব ছিল তার প্রসাধনীর মাধ্যমে গড়া কৃত্রিম চেহারা ।
এটা দেখে নবাব প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যান । যদি তার একটা জেদ ছিল, তার স্ত্রী হবে দুনিয়ার
সবচেয়ে সুন্দরী, কিন্তু এখন দেখছেন, তার স্ত্রী-ই রাজ্যের সবচেয়ে কুৎসিত । তিনি তার
স্ত্রীকে কিছু বলেন নি । তার স্ত্রী-ও কিছু বুঝতে পারে নি । হঠাৎ করেই সেই নবাব সিদ্ধান্ত
নেন, রাজ্যের যতো ভালো দেখতে পুরুষ আর মহিলা আছে, সবাইকে খুন করা হবে । অবশেষে তার
যতো কুৎসিত সিপাহি ছিল, তাদের দিয়ে প্রথমে খুন করলো প্রাসাদের সব কুৎসিত কর্মকর্তাদের
। তারপর অন্যান্য দেখতে ভালো সিপাহিদের । এরপর একে একে রাজ্য থেকে দেখতে ভালো সব লোককে
খুন করে ফেলা হল । এতে যারা দেখতে খারাপ, তারা ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিবাদ শুরু করে । একদিন
সেই নবাবের বেগম সবটা জানতে পেরে নবাবকে জিজ্ঞেস করলে সেই নবাব সব কথা বলেন তার স্ত্রীকে
। ভেবেছিলেন তার স্ত্রী হয়তো খুশি হবে, কিন্তু না । তার স্ত্রী সে সময় মৌনতা পালন করলেও
মনে মনে ঠিকই খুব কষ্ট পেলো । এরপর একদিন সেই
বেগম তার স্বামীর কর্মের শাস্তি স্বরূপ তার স্বামীকে হত্যা করে । এতে রাজ্যের লোকেরা
তাদের নবাবের বেগমের ওপর সন্তুষ্ট হন । নবাবের বেগম তখন রাজ্য পরিচালনা শুরু করে ।
১-২ মাসের মধ্যেই তার পেটে একটা সন্তান আসে । ভেবেছিলেন তার সন্তান হয়তো পিতার চেহারা
পাবে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা হয় না । সে তার মায়ের রূপ আর চেহারা পায় । এরপর সেই রাজ্য
সেই বেগম চালাবার পর তার পুত্রের সাথে রাজ্যেরই এক কন্যার বিবাহ দেন । এরপর থেকে রাজ্যের
কেউই সুন্দর সন্তান জন্ম দিতে পারেন না । সবার ঘরেই কুৎসিত সন্তান জন্ম নেয় । ধীরে
ধীরে বংশানুক্রমে এই নবাব আকরাম খাঁ গদিতে বসবার পর যখন পিতা হলেন, বশগতির ধারায় তার
পুত্র পায় তার প্রপিতামহের রূপ । এতো বছর পর রাজ্যে সস্তি এলো । তাদের পুত্রের নাম
ইয়াকুব খাঁ । ইয়াকুব সর্ব গুনে গুণান্বিত । এখন সে প্রায় বছর ২০এর যুবক । নবাব আকরাম
খাঁ চেয়েছিলেন তার পুত্রকে বিবাহ দেবেন অন্য কোন রাজ্যের সুন্দরী কোন কন্যার সাথে ।
কিন্তু রাজ্যের মসজিদের হুজুর এসে হঠাৎ বলেন, তাকে নাকি একটা জীন এসে বলেছে তার পুত্রকে
এই সুন্দরী গড়ের কুৎসিত নবাবকন্যা লাবনীর সাথে বিবাহ দেয়া হয় । আর তাই সেই রাজ্যের
নায়েবের এখানে আসা । ঘটনা শুনে নবাব যতোটা না অবাক হলেন তার চেয়ে বেশি খুশি হলেন ।
অন্তত পাত্র তো সুন্দর । নবাব বললেন, “আপনার যদি সমস্যা না থাকে, আমি আজই আপনাদের রাজ্যের
গিয়ে আপনাদের পুত্রকে একবার নিজ চোখে দেখতে চাই ।” কুৎসিত নগরীর নায়েব খুশি হয়ে বললেন,
“জি নবাব বাহাদুর, এটা তো আমাদের জন্য আনন্দের সংবাদ ।” নবাব শাহেদ তার নায়েবকে বললেন,
“নায়েব, ঘোড়ার গাড়ি বের করো, আমি তুমি আর হাফিজা এখুনি রওনা হবো ।” নায়েব, “যা হুকুম
করবেন নবাব” বলে গাড়ি বের করার জন্য বের হল । মাত্র আধ প্রহরের পথ । রাজ্যে যেয়ে আসলেই
একটাও সুন্দর দেখতে লোক নজরে এলো না নবাব শাহেদের । তার সাথে এ-ও খেয়াল করলেন, রাজ্যের
কারো মুখে হাসি নেই । সবাই যেন কি কষ্টে আছে । নবাব শাহেদ কুৎসিত নগরীর নায়েবকে জিজ্ঞেস
করলেন, “আচ্ছা, এরা সবাই এমন মনমরা হয়ে আছে কেন?”
- “এরা সবসময়েই এরকম থাকে । এদের ধারণা, কালো মানুষরা
হয়তো দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় । এরা তো অন্য রাজ্যেও যেতে পারে না । মনে কষ্ট লাগে । অন্য
রাজ্যের কালো লোকেদের দাস দাসিরুপে দেখা হয় তো ।” বলল কুৎসিত নগরীর নায়েব । রাজ্যের নবাব আকরাম খাঁ এর সাথে পরিচিত
হতে পেরে ভালো লাগলো নবাব শাহেদের । দু পরিবারের চার সদস্য,
নবাব গন ও তাদের বেগম, এমন সময় হন্ত
দন্ত হয়ে ছুটে এলো রাজ্যের সেনাপতি । নবাব
আকরাম খাঁ জিজ্ঞেস করলেন, “নবাব বাহাদুর, খুবই খারাপ খবর আছে, আমাদের সময় এখন খুব খারাপ
।”
- “কি হয়েছে সেনাপতি?” জিজ্ঞেস করলেন নবাব আকরাম
খাঁ ।
- “গুল্মনগরী থেকে ফরমান পাঠানো হয়েছে । তারা পরশু
আসবে আমাদের রাজ্য দখল করতে । আক্রমন করবে আমাদের রাজ্যে ।”
নবাব হতাশ হয়ে পড়লেন । নবাব শাহেদ জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে?”
- “আর বলবেন না, আমরা কালো বলে আমাদের ক্ষমতায়
থাকা আশেপাশের রাজ্যের লোকেরা মেনে নিতে পারে না । তাই প্রায়-ই তারা আমাদের সাথে যুদ্ধ
করে আমাদের রাজ্য দখল করতে । এতদিন আল্লাহর রহমতে তারা পারে নি আমাদের রাজ্য দখল করতে,
কিন্তু এখন পরিস্থিতি খুব খারাপ । আমাদের সৈন্য তেমন একটা নেই । তার ওপর অস্ত্রাগারে
অস্ত্রেরও সংকট ।” বললেন নবাব আকরাম খাঁ ।
নবাব শাহেদ অভয় দিয়ে বললেন, “আমি আমার রাজ্যের
সৈন্য পাঠাবো আপনার রাজ্য রক্ষা করতে । আর সাথে আমার অস্ত্রও দেবো আপনাদের ।” নবাব
আকরাম খাঁ খুশি হয়ে বললেন, “আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেবো!” নবাব শাহেদ বললেন, “ধন্যবাদের
কিছু নেই । আপনি বরঞ্চ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিন ।” আকরাম খাঁ ওপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সেনাপতিকে
বলল, “যাও, তাদের ফরমানের জবাব পাঠাও, আমরা প্রস্তুত ।” এরপর সেনাপতি চলে গেলো । নবাব
আকরাম খাঁ তখন বলল, “এ সময় না হয় বিয়ের কথা থাক, যুদ্ধ শেষ হলে ভাবা যাবে ক্ষণ ।” এমন
সময় এলো মসজিদের হুজুর । বললেন, “না নবাব, এ ভুল করবেন না ।” নবাব আকরাম খাঁ জিজ্ঞেস
করলেন, “কেন?”
- “আমাকে সে জীন বলেছে, যুদ্ধে আগেই তাদের বিয়ে
করাতে হবে ।” বলল বয়স্ক হুজুর । অবশেষে যুদ্ধের আগের দিনই তাদের বিয়ে সম্পন্ন হল ।
পরদিন যুদ্ধের দিন । শুরু থেকে যুদ্ধ বেশ চলছিলো,
কিন্তু মাঝপথে এসে কুতসিৎ নগরীর সব সৈন্য প্রাণ হারাল । সাথে সুন্দরীগড়েরও সৈন্যরাও
। আর যে শ তিনেক সৈন্য আছে, তাদের পিছপা হয়েছে । কারণ তাদের বিপক্ষে এখনও হাজার ৩ সৈন্য
। নবাব আকরাম খাঁ চিন্তিত হয়ে পড়লেন । তার সাথে ছিলেন নবাব শাহেদ । তিনিও চিন্তিত হয়ে
পড়লেন । তাদের পুত্র আর কন্যাকে তারা যুদ্ধের ময়দানে আনেন নি । নতুন বিয়ে হয়েছে, এ
সময় না হয় না-ই বা তারা যুদ্ধের ঝামেলায় জড়ালো । কুৎসিত নগরীর সৈন্য কেউ কেউ নিজেদের
বলছিল, “আমরা পারবো না । আমরা দেখতে ভালো না……।” শত্রু পক্ষের সেনাপতি ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে
এসে বলল, ‘কি নবাব আকরাম খাঁ, যুদ্ধে হেরে গেলেন নাকি? তা আরও চলবে, নাকি মাথা নত করবেন?”
নবাব আকরাম খাঁ বুঝতে পারছিলেন না কি করবেন, এমন সময় শত্রু পক্ষের সেনাপতির দু দিক
থেকে দুটো তীর এসে তার মাথা ফুটো করে দিলো
। নবাব আকরাম খাঁ আর নবাব শাহেদ এ দেখে অবাক হয়ে গেলেন । দুদিক থেকে ঘোড়া নিয়ে তখন
ময়দানের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো দুই ছদ্মবেশী । তাদের চেনা যাচ্ছে না । তবে এটুকু বোঝা
যাচ্ছে, একজন পুরুষ, একজন নারী । সেই দুই ছদ্মবেশী শত্রুপক্ষের সৈন্যের কাছে যেয়ে ছদবেশ খুলে ফেলল । এরা আর কেউ
না, একজন অপরুপ নবাবপুত্র, ইয়াকুব খাঁ, আর কুৎসিত নবাব কন্যা, লাবনী । শত্রু পক্ষের
সৈন্যরা কেমন ঘাবড়ে গেলো । ওরা এক দিকে ইয়াকুব খাঁ এর রুপে মুগ্ধ হয়ে ইয়াকুব খাঁ এর
চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল, অন্যদিকে লাবনী চেহারা দেখে অনেকে ভয় পেলো । কি করবে সৈন্যরা
বুঝতে পারছে, তার ওপর ওদের সেনাপতিও প্রাণ হারিয়েছে । ওরা তাল হারিয়ে বেতাল হয়ে গেলো
। সেই সুযোগে লাবনী আর ইয়াকুব তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে যেয়ে দুজনেই খতম করলো প্রায় ১ হাজার
সৈন্য । এ দেখে কুৎসিত নগরীর কালো সৈন্যরা উৎসাহ পেলো । কুৎসিত নবাব কন্যা যদি পারে,
তবে তারা কেন পারবে না? তারাও এগিয়ে গেলো । সব সৈন্যকে তারা খতম করলো, আর আটক করলো
শত্রু রাজাকে ।
সেই থেকে কালো লোকেরা মাথা উচু করে বাচত । কালো
সাদা কেউ আলাদা নয় । সবাই এক । সবাই সব পারে । কিন্তু তবুও একদল সাদা লোক নিজেদের রুপের
বড়াই করে, আর কালো লোকেদের অবহেলা করে । তাদের বলা উচিৎ এই কবিতার লাইন, “কালো আর ধলো
বাহিরে কেবল, ভেতরে সবাই সমান রাঙা ।”
আমার গল্প ফুরলো, নটে গাছটি মুড়ল ।