পরিচয়(সিজন-৫)(২য় অংশ) (পর্ব-১৩৯-১৬১)
চায়ের কাপে শেষ চুমুক
দিয়ে দারোয়ানকে ডেকে পাপলু আঙ্কেল বলল, "এ লেবু! চায়ের
কাপটা নিয়ে যা তো! চায়ের দোকানের ওই শাকের নামের ছেলেটা আসলে
দিয়ে দিস ।" দারোয়ানের নাম লেবু মিয়া । সে এসে চায়ের কাপ নিয়ে
গেলো । পাপলু আঙ্কেল জানালার পাশ থেকে চলে আসছিলো, এমন সময় খেয়াল করলো,
পরশ এদিকেই আসছে । পরশ জানালার কাছে আসতেই পাপলু আঙ্কেল বলল, "কিরে
কি অবস্থা তোদের! আজ তো আর এলি না দেখা করতে!" পরশ বলল, "আঙ্কেল অনেক ঝামেলা ছিল, তাই পারি নাই ।" পাপলু আঙ্কেল ভ্রু-কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো কেন রে! আবার কি সমস্যা হল?" "পড়ে সব কমুনে,
আগে কও তো, রাশেদ স্যার আইছে কি না?"
পাপলু আঙ্কেল বলল, "হ্যাঁ, এসছে তো । স্কুল বিল্ডিঙের মাঝের যে বাগানটা ওখানে নাকি কি গাছ
লাগাবে, তাই দেখার জন্য । কোন গাছ লাগালে ভালো হবে ।" পরশ আবারো
জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা, আর কেউ কি আইছিলো?"
পাপলু আঙ্কেল জিজ্ঞেস করলো, "না, কেন?" পরশ প্রশ্নের জবাব না দিয়েই বলল,
"আচ্ছা, আমাগো প্রাচীর টপকায় আসার কোন
ওয়ে আছে কি?" পাপলু আঙ্কেল বলল, "না তো, প্রাচীরের উপরে তো তারকাটা দেয়া । কেন হয়েছেটা কি?" পরশ
এবারও কোন জবাব না দিয়ে, "থ্যাংকস, বাই!" বলে সেখান থেকে চলে এলো । পাপলু আঙ্কেল
ডাকল কয়েকবার, "আরে! কি হয়েছে বলে তো যা! আরে! শোন!" কিন্তু পরশ
পেছন ফিরে আর তাকাল না । পাপলু আঙ্কেল
একটা হতাশার দম ফেলে বিছানাটায় বসতে বসতে নিজেকে বলল, " হায়রে!
কি যে হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছি না । আল্লাহ! সব তুমি
ঠিক করে দাও!"
"ও, তাহলে এই ঘটনা!" আবির আর রাজের মুখে সমস্তটা শুনে
বলল নিশি । রাজ বলল, "এই, তুই আবার
নাবিলারে কইস না! কি কাণ্ড ঘটাবে পড়ে দেখা যাইবো সব প্ল্যান
শেষ ।"
আবির
রাজ আর নিশি ছাদের ওই খাটটায় বসে ছিল । নিশি খাট থেকে উঠে দাড়িয়ে রেলিঙের কাছে
যেতে যেতে বলল, "কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না..................।"বলতে গিয়ে থেমে
গেলো নিশি । তাকিয়ে দেখল, পরশ দৌড়ে হোস্টেলের দিকে আসছে । নিশি রাজ আর আবিরকে
ডাকল,
"ওই! দ্যাখ!" আবির
আর রাজও রেলিং-এর কাছে এলো। পরশকে দেখে আবির
জিজ্ঞেস করলো, "ও এভাবে দৌড়ায় আসতেছে ক্যান?" রাজ ইয়ার্কি করে বলল, "মনে হয় হাগা চাপছে ।" এরকম একটা
সিরিয়াস মুহূর্তে ইয়ার্কি করাতে বিরক্ত চেহারায় রাজের দিকে তাকাল আবির আর নিশি
দুজনেই । রাজ ওদের দিকে একবার তাকিয়ে গলা খাখরে বলল, "না, মানে, হতেই পারে ।" পরশ ছাদে এসেই
আবির রাজ কিংবা নিশি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ওদের কাছে এসে বলল, "শোন,
রাশেদ স্যার স্কুলে আসছে!" আবির রাজ আর
নিশি হতবাক হয়ে গেলো । সামান্য এই কথা বলার জন্য ও এভাব্র দৌড়ে আসছিলো!" রাজ
জিজ্ঞেস করলো, "ভাই এতে কি হল!" পরশ বলল, "আরে, বুঝতেছোস
না, আমি খেয়াল করলাম আরও কেউ একজন ছিল ভেতরে । যদিও আমি
চেহারা দেহি নাই, কিন্তু মনে হইল রাশেদ স্যার কারো ডাকে সেদিকে গেলো!"
পরশ জোরে জোরে হাফাচ্ছে । এতদূর দৌড়ে এসে সিঁড়ি
বেয়ে ছাদে উঠে এরকম হাফানোটা অস্বাভাবিক না হলেও ওর কথাটা আবির রাজ আর নিশির কাছে
অস্বাভাবিক লাগলো । আবিরও ইয়ার্কি করে বলল, "তুই একটা কাজ কর,
হেগে আয় । তোর মনে হয় আসলেই হাগা চাপছে!" নিশি
আর রাজ মুচকি হেসে উঠলো ।" রাজ বলল, "ধুর! তোরা একটু
গুরুত্ব দিয়ে দ্যাখ না!" আবির পরশের কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
"আচ্ছা, দোস্ত, তুই
কি দেখছোস, ভেতরে কেউ ছিল কি না?" পরশ কিছুটা শান্ত হল । বলল, "না, কিন্তু
দেখে মনে হইলো কেউ রাশেদ স্যাররে ডাকল!" আবির বলল,
"হতেই পারে স্যার এমনিই গেছে, আর তোর অমন
মনে হইছে! পারে না!" পরশ কিছু বলল
না । আবির আবারো বলল, "আর তাছাড়া এমনও তো হতে পারে, ভেতরে
কিছু হয়েছিলো বলে স্যার গিয়েছে, কারো ডাক শুনে না, ধর ভেতরে কিছু পড়ে গিয়েছিলো কিংবা অন্য কিছু, পারে
না?" উপর নিচে মাথা নাড়ল পরশ । আবির বলল, "তাহলে
চিন্তা করিস না । রাজ, চল নামায পড়তে যাই । পরশ তুই যাবি
নাকি?"
এমনিতেও পরশ নামাজি না, তার ওপর এখন ওর যেতে
ইচ্ছে করছে না । এখন নামাযের ব্যাপার না-ও বলতে পারছে না । কিন্তু জোর করে
কি লাভ, সাওয়াব যদি কেউ পেতে চায়, তার নিজের থেকে পেতে হবে । তাই আবির আর
জোর না করে বলল, "আচ্ছা, তুই রুমে যা তাইলে । রাজ চল ।" রাজ ইয়ার্কি করে পরশকে বলল, "তুই যা! হাগ!" পরশের মুখে এতক্ষণে হাসি দেখা গেলো । ইয়ার্কি করে
রাজের পেছনে একটা মারল । নিশি আবিরকে বলল, "এ আবির, চল না,
আমিও যাই, তোরা যতক্ষণ নামাজ পড়বি, ততোক্ষণ শারীরিক শিক্ষার ল্যাবে থাকবোনে, আর পড়ে তো
তোরা সেখানেই আসবি ।" আবির বলল, "আচ্ছা, চল যাই ।"
পরদিন হঠাৎ করেই স্কুলে
অ্যাসেম্বলি । এই কয়েকদিন অ্যাসেম্বলি হয় নি বৃষ্টিতে মাটি ভেজা থাকার জন্য । আজ হচ্ছে । আগে আবির জামি
আর শিমুলের সাথেই দাঁড়াতো, তবে ইদানীংকালে রাজের সাথেই অ্যাসেম্বলিতে
দাঁড়ায় । তাতে অবশ্য জামি আর শিমুল নিজেদের মাঝে আবিরের সমালোচনা
করে বলে,
"দেখছোস! রাজ এহন আবিররে একটু ত্যালাইছে,
আর আবির যাইয়া রাজের লগে সারাদিন মেশে । অথচ আমরা যে ওর লগে
এতদিন মিশছি, আমরা যে ওর রুমমেট, এইদিকে আবিরের কোন
খেয়াল নাই!" আবিরের থিয়োরিটা অবশ্য আলাদা । ওর কাছে বন্ধু
সবাই সমান । কার সাথে বেশি মিশলো, কার সাথে কম মিশলো এসব বন্ধুত্বের মাঝে
তেমন কোন প্রভাব ফেলে না । এখন রাজ যেহেতু আবিরকে একটু বেশিই ভালোবেসে ফেলেছে, তখন
ওকেও একটু বেশি ভালোবাসাই যায় । কারণ যে বেশি ভালোবাসে তাকে ভালবাসাটাই
শ্রেয় । তা না হলে নিজে থেকে যদি কাউকে বেশি ভালোবাসা হয়, দেখা
যায় তারাই শেষে ধোকা দেয় । এইযে যেমন আবির আর নাবিলা কিংবা রাজ আর শৈলী! যদিও
শৈলীই রাজকে লাভ লেটারটা দিয়েছিলো, কিন্তু তারপর শৈলীকে
কিন্তু রাজই বেশি ভালোবেসে ফেলেছিল । তবে ভালোবাসাটা এতোদুর চলে যাবে ভাবতেই
পারে নি বেচারাটা । এখন সে তার পাপের জন্য অনুতপ্ত ।
"আজ, ফজরের নামাজে আইলি না ক্যান?" আবিরকে জিজ্ঞেস
করলো রাজ । আবির রাজের সামনেই দাড়িয়ে ছিল । আবির বলল, "আর
কইস না মামা, ফোনটা অ্যালার্ম দিছিলাম, কিন্তু কহন যে বারান্দায় রাখছিলাম, খেয়ালই করি নাই । তুই-ও মনে হয়
ফোন দিছিলি ।" "একবার-দুইবার না, পুরা সতের
বার!" আবির একটু হেসে বলল, "ওই
হল আরকি ।" সামনে থেকে শারীরিক শিক্ষার শিক্ষকের কমান্ড এলো, "স্টুডেন্টস,
সাবধান হবে, সা...বধান!"
সবাই সাবধানে দাঁড়ালো । আবির ফিসফিসিয়ে রাজকে
বলল,
"বাকি কথা পড়ে হবে মামা ।" এরপর শুরু হল
অ্যাসেম্বলি । যথারীতি যা যা হয়, তাই হল । এরপর রাশেদ স্যার এসে দাঁড়ালো সামনে বক্তব্য রাখা শেষে । অনান্য
প্রিন্সিপ্যাল স্যার এলে আগে সালাম দিত, জিজ্ঞেস করতো কেমন আছো, এই ওই, কিন্তু ইনি প্রিন্সিপ্যালও না, ভারপ্রাপ্ত, এসেই ধমকের স্বরে বলা শুরু করলো,
"হেই ছেলেপেলে! যারা অনাথ তাদের বলছি!
কি এতো ভাব নেও কেন তোমরা! তোমাদের যারা নতুন
এসছে । ওরা টাকা দিয়ে পড়ে! ওদের একটা স্ট্যাটাস আছে! তোমরা ওদের কথা মেনে চলবে আর তোমরা ওদের সাথে বেয়াদবি করছো! হোয়াট কাইন্ড অফ ম্যানার ইজ দিস! তোমাদের বাবা মা কি
ম্যানার শেখায় নাই! নাকি
তোমাদের বাপ মা-ও অসভ্য ছিল যেজন্য তোমরাও অসভ্য হয়েছো!"
সবাই হতবাক । কি বলছে এসব স্যার! নতুন ছাত্রছাত্রীরা যদিও তেমন মাথা
ঘামাচ্ছে না, তবে যারা অনাথ ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে
স্যার এসব বলছে টা কি! শুধু তা-ই নয়, টিচাররা-ও নিজেদের মাঝে বলাবলি শুরু করে দিলো, রাশেদ স্যার
এসব কোন ধরণের কথাবার্তা বলছে! লাইনের মাঝে দাড়িয়ে থাকা আবির
রাগ কন্ট্রোল না করতে পেরে চিৎকার
করে বলে উঠলো, "তোর বাপ-মা
তোরে ম্যানার শেখায় নাই!" কথাটা কোলাহলের মাঝে যদিও
স্যার এর কানে পৌঁছায় নি, কিন্তু ওখানে আশেপাশে যারা ছিল,
তারা ঠিকই আবিরের কথা শুনে আবিরের
দিকে তাকাল । আবির যে প্রচুর রেগে গেছে তা ওর চেহারা আর শ্বাস
নেয়ার ধরণ দেখেই বোঝা যাচ্ছে । আরও কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু রাজ আটকাল । আবির নিজের রাগ
কন্ট্রোল করলো । রাশেদ স্যার নিজের মতো আরও অনেক কথা বলে গেলো যা ছিল
পুরোপুরি নতুন যেসব ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়েছে তাদের পক্ষে, অনাথ
ছেলেমেয়েদের বিপক্ষে ।
অ্যাসেম্বলি শেষে সবাই
ক্লাসে ফিরে আসছিলো, তখন আবির আর রাজ একসাথে ওয়াশরুমে গেলো । আয়নায় চেহারা
দেখতে দেখতে আবির বলল, "আজকে যা রাগটা উঠেছিলো, ইচ্ছে
করছিলো রাশেদ স্যার কে ইচ্ছা মতো গালি গালাজ করার ।" রাজ পাশেই
দাড়িয়ে । কিছু জবাব দিলো না । আবির বলল, "আমি বুঝলাম না,এটা
আসলেই রাশেদ স্যার তো! যদি রাশেদ স্যার হয়, খবর আছে স্যার এর আর যদি রাশেদ স্যার না হয়......" থেমে গেলো আবির । তারপর মুখটা ধুয়ে বলল, "সে তো কখনোই সম্ভব না
।"
ঠিক
তখন একটা কাগজ এসে লাগে রাজের গায় । রাজ একবার কাগজের দিকে তাকিয়ে দরজার দিকে তাকালো, মনে হল
কেউ কাগজটা ছুঁড়ে দিয়ে দৌড় দিয়েছে । আবির এখনও কিছু টের পায় নি । রাজ কাগজটা
খুলে পড়লো । তারপর আবিরকে ডাকল, "আবির!" আবির
আয়নার দিকে নিজের চেহারার দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো, "বল
।"
"তোর জন্য একটা চিঠি ।" আবির রাজের দিকে তাকাল । রাজ আবিরের দিকে কাগজটা
এগিয়ে দিলো । আবির কাগজটা হাতে নিয়ে পড়লো । ওতে লেখা, "আবির, আমি সুমন
স্যার বলছি । আজ থেকে কিন্তু আমাদের মিশন শুরু হয়ে গেছে । খুব সম্ভবত
তোমাকে আমাকে কেউ ফলো করছে । তাই আজ থেকে খুবই গোপনে কাজ করতে হবে । তোমায় আমি যা
জানাবো, তা তুমি অন্য কাউকে জানাবে না । আজ থেকে আমার সামনে এ
ব্যাপারে কথা বলবে না, আমাদের যা কথা, কাগজেই হবে । তুমি প্রতিদিন
পাপলু আঙ্কেলের কাছ থেকে সন্ধায় যেয়ে আমার দেয়া চিঠি নিয়ে আসবে এবং কিছু জানানোর
হলে এশার নামাযের সময় পাপলু আঙ্কেলের কাছে দিয়ে আসবে । তবে হ্যাঁ, চিঠি
আনা নেয়ার মাঝে তোমায় কিন্তু গোপনীয়তা অবলম্বন করতে হবে । আর শোনো, আমি
যেভাবে লিখবো, তা বোঝা কিন্তু কঠিন হবে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তুমি সেগুল বুঝবে । কাগজ ভুলে অন্য
কারো হাতে গেলেও যেন বিপদ না হয়, তাই এরকমটা করা । অল দ্যা বেষ্ট ।" কাগজটা পড়ার পর
আবির একটা টয়লেটে ঢুকে পানিতে ফ্ল্যাশ করে দিলো । রাজ জিজ্ঞেস করলো, "এটা
কি করলি?" আবির একটু হেসে বলল, "গোপনীয়তা । ঝুকি নিতে রাজি নই ।" রাজ আবারো জিজ্ঞেস করলো, "আমি যে জেনে গেলাম ।" আবির রাজের
কাঁধে হাত রাখল । তারপর বলল, "তুই আর আমি, আর
কেউ জানবে না । চল যাই ।" এরপর ওরা ক্লাসরুমের দিকে যেতে লাগলো । ক্লাস সিক্সের
ক্লাসরুমের সামনে সুমন স্যার এর সাথে দেখা । আবিরকে দেখে স্যার এমন একটা ভাব নিলো, যেন স্যার
কিছুই জানে না । আবিরের কাছে এসে বলল, "কি খবর আবির? তোমার
খাতাটা পেয়েছো?" আবির বলল, "জি
স্যার ।"
সুমন
স্যার একটু হেসে বলল, "ঠিক আছে । তোমার হাতের লেখা ঠিক করো । আমি তোমার
ক্লাসের টিচার হলে তো তোমাকে আরও কম নামবার দিতাম ।" আবির বলল, "ঠিক
আছে স্যার ।" সুমন স্যার আবারো বলল, "বেশি বেশি হাতের লেখা প্র্যাকটিস করে
খাতাগুলো ফেলে দিয়ো । বেশি খাতা জমে গেলে ঘোর বিপদ । আমার ওই খাতায় লিখে
দেয়া উচিৎ ছিল । বেশি খাতা জমে গেলে তোমার নিজের কাছেই লজ্জা লাগবে । মনে হবে
কিন্ডার গার্ডেনের স্টুডেন্ট ।" আবির একটু হেসে বলল, "অবশ্যই স্যার ।" বলে স্যার চলে
গেলো । রাজ কিছু বুঝতে না পারলেও আবির বুঝতে পেরেছে । স্যার খাতা বলতে ওই
কাগজটার কথা জিজ্ঞেস করেছে, আর খাতা নষ্ট করে দেয়া বলতে যেরকমটা আবির
একটু আগে করলো ওরকমভাবে কিংবা পুড়িয়ে যেভাবেই হোক নষ্ট করার কথা বুঝিয়েছে । আর এও বলেছে, স্যার
আগের কাগজে এটা লিখতে ভুলে গিয়েছিলো । রাজ জিজ্ঞেস করলো, "কিসের
খাতা রে?" আবির বলল, "একটা
পরীক্ষার খাতা ম্যাথ, অনেক আগের । তুই ছিলি না
তখন । খায়রুল স্যার আমার খাতা খুঁজে পান নি বলে বলেছিলেন পড়ে দেবেন, এখন বোধ
হয় পেয়ে গেছেন, তাই সুমন স্যার এর মাধ্যমে পেয়ে গেছেন । রাজ "ও"
ছাড়া আর কিছু বলল না ।
টিফিন পিরিয়ডের কথা । আবির আর রাজ
ক্যান্টিনের পাশে দাড়িয়ে টিফিন খাচ্ছিল । প্রায়
৫-৬মিটার দূরে দাড়িয়ে নাবিলা । ও শুধু তালে আছে
সুযোগ খোজার এবং প্রেম আর বন্ধুত্বের
মধ্যে যে প্রেমের সম্পর্কটাই বেশি মজবুত । আশেপাশে তাকাতে
তাকাতে নাবিলা খেয়াল করলো, ওর ডানে
একটু দুরেই দাড়িয়ে রাজেশ নারায়ণ আর ওর
গ্যাং । আজ সকালেই রাজেশ নতুন ছেলেদের দিয়ে একটা গ্যাং বানিয়েছে । হঠাৎ করেই
নাবিলার মুখে একটা হাসি ফুটে উঠলো । এ হাসি তখনই ফোটে, যখন মানুষের মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি চলে
আসে । নাবিলা রাজেশের কাছে দৌড়ে গেলো । রাজেশের সামনে দাড়িয়ে বেশ করে একটা হাসল, আর
এমনভাবে দাঁড়ালো, যেন ওকে দেখে রাজেশ আকর্ষিত হয় । চুলগুলো বার
বার বাতাসে ওড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো, অবশেষে চুল না উড়লে বিরক্ত হয়ে থামিয়ে দিলো
চুল ওড়ানোর চেষ্টা । তারপর আবার রাজেশের দিকে মন ভোলানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, "হাই
হ্যান্ডসাম!" রাজেশ বুকে হাত দিয়ে মোলায়েম কণ্ঠে বলল,
"আহ! মনের মধ্যে যেন একশ প্রজাপতি ডানা
মেলে গেলো ।" "এবার আমার ডানায় চেপে একটু শোনো না গো ।" রাজেশ একটু হাসল, তারপর
সিরিয়াস মুডে এলো । বলল, "এই প্রথম কোন মেয়ে নিজে থেকে এসে
আমার সাথে কথা বলছে । তা বলো ।" তারপর নাবিলা আবির আর রাজের দিকে দেখিয়ে বলল, "ওই
যে দেখছ দূরে ক্যাপ্টেন আর ক্যাপ্টেনের পাশে একটা ছেলে ।" "হুম"- আবির
আর রাজের দিকে তাকিইয়ে আওয়াজ করলো রাজেশ । নাবিলা বলতে লাগলো, "ওই
ক্যাপ্টেনের পাশের ছেলেটাকে মারতে হবে । আর এমন সময় মারতে এমন
জায়গায় হবে, যেন ওই গায় ওই ক্যাপ্টেন আর ওর পাশের ছেলেটা ছাড়া আর কেউ না
থাকে, আর ওই ক্যাপ্টেন যেন সে সময় আসেপাশেই থাকে আর ওকে
বাঁচানোর চেষ্টা করে, কিন্তু ও যেন না পারে । তখন আমি আসবো, আর ছেলেটাকে
বাঁচাবো ।" রাজেশ বলল, "কে হয় ছেলেটা তোমার?" নাবিলা লজ্জার সাথে জবাব দিলো, "বয়ফ্রেন্ড ।" রাজেশ বলল, "ও
। তা আসলেই মারবো? নাকি......" রাজেশের কথা শেষ হতে
না হতেই নাবিলা বলল, "আরে! আসলেই
মারবা । মরবে না তো আর!" রাজেশ কিছুক্ষণ চুপ রইল । নাবিলা জিজ্ঞেস করলো, "পারবা?"
রাজেশ বলল, "হ্যাঁ পারবো ।" "কখন করবে?" "স্কুল শেষে । যখন সবাই চলে যাবে ।" "কিন্তু ওরা যদি সবাই চলে যাওয়া পর্যন্ত না
থাকে?"
রাজেশ জবাব দিলো, "ওরা এমনিতেও থাকে,
তা-ও যদি না থাকে, আমি
ম্যানেজ করে নেবো ।"
মাঠের মধ্যে বসে গোল হয়ে
গল্প করছে নিশি, পরশ, জামি, শিমুল । গল্প করছে । একটু পর ওদের
মাঝে এসে যোগ দিলো নাবিলা । জ্ঞান গাইছিল নিশি । নাবিলা এসে কিছু বলতে যাচ্ছিলো, পরশ
ইশারায় নাবিলাকে চুপ করতে বলল । নিশি
গান গাচ্ছে, "তুই আমার জীবন, তুই ছাড়া মরণ,
তুই যে আমারই............।" নিশির গান গাওয়া
শেষ হলে সবাই প্রশংসা করলো । জামি বলল, "বাহ, সুন্দর
গাইছোস তো!" পরশ বলল, "জানুয়ারির
কম্পিটিশনে নাম দেস না ক্যান! তাইলেই তো তুই ফাস্ট হইতি ।" নিশি সবাই
ধন্যবাদ জানিয়ে নাবিলাকে বলল, "কিরে নিশি? তুই
কোথায় ছিলি?" নাবিলা বলল, "এইতো,
ছিলাম আরকি, ক্যান্টিনের দিকে । নিশি আশেপাশে
তাকিয়ে বলল, "আবির আর রাজ কই রে?" জামি
বলল, "ওরা দুইজন তো মনে হয় আঠার মতো লাইগা থাকে । আমাগো লগে
মেশেই না!"
নিশি বলল, "তুই নেগেটিভ ভাবোস, কে কইছে মেশে না?" জামি কিছু বলল না । আর কেউও কিছু
বলল না । নিশি বলল, "আচ্ছা
বাদ দে, আর কেউ জ্ঞান ধর, আমি তো
গাইলাম-ই ।" জামি বলল, "আমি গাই? আমি
গাই?" পরশ ইয়ার্কি করে বলল, "না ভাই! আগে আমার কানে তুলাটা লাগাইয়া লই!"
শিমুল বলল, "হ, ওর
গানের চেয়ে কাকের ডাক ম্যালা ভালো ।" নিশি বলল, "আরে, তোরা বাদ
দে তো, গাইতে দে পোলারে ।" জামি শুরু করলো
ওর বেসুরা গলার গান । সবাই শুনতে না চাইলে ভালো লাগছে এমন একটা ভাব ধরলো ।
(২)
ক্লাস শেষে আগের দিনের
মতো বসে ছিলো রাজ আর আবির । রাজ থার্ড বেঞ্চে বসে একটা স্কেল হাতে বসে, আর আবির
বোর্ড মুছছে । রাজ দরজার অন্যদিকে মুখ করে ছিল । ফলে কেউ যদি দরজা দিয়ে
ঢোকে, তাহলে টের পাবে না রাজ । আবিরও বোর্ড মুছছিল, ফলে
আবিরও বুঝতে পারবে না সহজে । রাজ জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা, আমি
কিন্তু একটা ব্যাপারে সন্দেহ করছি আমাদের কিংবা ওই স্যারটাকে রাকেশের ভাই রাজেশ যে
এখানে আছে ও ফলো করছে না তো?" আবির বলল, "তুই চুপ থাক না, গোপনীয় কথা এসব ।" রাজ বলল, "বাপ
রে বাপ! তুই তো দেহি একদম গোয়েন্দা হইয়া গেলি । ফেলুদা, ব্যোমকেশ
বক্সি!" আবির শুধু হাসল । রাজ জিজ্ঞেস করলো , "আচ্ছা,
এই যুগেও যদি ফেলুদা আর ব্যোমকেশ বক্সি থাকতো তাইলে ওরা মোবাইল
হ্যাক, জিপিএস ট্র্যাক, এইসব কইরা গোয়েন্দাগিরি করতো । তাই না?" আবির
হেসে বলল, "গাধা, ওটা তো দুটো চরিত্র মাত্র । আসল হিরো তো
এসব গল্পের লেখক । বুঝলি?" রাজের কাছ থেকে কোন জবাব শুনল না
আবির । খানিক পরেই আবির শুনতে পেলো বেঞ্চে লাথি লাগার শব্দ, আর একটা
নাক দিয়ে আসা গোঙানির শব্দ । আবিরপেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, রাজেশ বেঞ্চের ওপর বসে আর
রাজের দুইহাত দুইপা ধরে রেখে রাজেশের গ্যাং-এর দুইজন,
আর একজন রাজের মুখ চেপে ধরে আছে । আবির অবাক হয়ে গেলো । রাজকে বাঁচাতে
এগিয়ে যাবার জন্য পা বাঁড়াতে গেলো, এমন সময় রাজেশ চিৎকার করে বলে উঠলো,
"দাঁড়া!" আবির দাড়িয়ে গেলো । রাজেশ কারো
একটা নাম মুখে নিলো আবির খেয়াল করে দেখল, যে ছেলেটা এতক্ষণ রাজের মুখ চেপে ধরেছিলো, সেই
ছেলেটা এক হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেই অন্য হাত দিয়ে প্যান্টের পেছন থেকে একটা ধারালো
চাকু বের করলো । তারপর সেটা রাজের গলায় ধরল । রাজেশ বলে উঠলো, "আর
এক পা এগোলে ওকে এখানেই কেটে দেবো ।" আবির দাড়িয়েই রইল । রাজের চেহারার দিকে তাকিয়ে চোখ কেমন ছল ছল
করছে । তার ওপর ওর গলায় চাকু! আবিরের বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো । এরই মাঝে ঘটলো
আরেক ঘটনা । দরজার আড়ালেই খুব সম্ভবত দাড়িয়ে দেখছিল নাবিলা, রাজের গলায় চাকু ধরা দেখে
ভেতরে ঢুকে নাবিলা ভীতি মিশ্রিত কম্পিত কণ্ঠে বলল, "আমি
কিন্তু খুন খারাবি করতে বলিনি!" রাজেশ নাবিলার দিকে
তাকিয়ে ঈশারা করে চুপ করতে বলল । আবির আর রাজ দুজনেই একবার নাবিলার দিকে
তাকাল । অবাকও হল নাবিলার কথাটা শুনে । রাজেশ আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, "খুব
ভালো বন্ধু, না! ভাই! বাপরে বাপ! তা ওর জন্য তুই কি করতে পারিস?"
আবির বলল, "হেয়ালি না করে নিজেই বল না কি
করতে হবে?রাজেশ মুচকি হাসল । তারপর আবার কাকে যেন
ঈশারা করতেই ক্লাস রুমে ঢুকল আরেকটা ছেলে । হাতে একটা ব্যাগ । রুমের জানালার
পর্দাগুলো আগে থেকেই চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো যেন বাহির থেকে কেউ দেখে ঝামেলা না করে । এবার দরজাটাও
লাগিয়ে দিলো শেষে ভেতরে ঢুকল । নাবিলা ঠিক বুঝতে পারলো না হচ্ছে টা কি কিন্তু কিছু না বলে
দেখতে লাগলো । ছেলেটা আবিরের কাছে এসে ওর হাতে থাকা ব্যাগটা আবিরের হাতে দিলো । রাজেশ বলল, "এতে
কিছু জামাকাপড় আছে, ওগুলো পড়ে নে । চেঞ্জ করার
দরকার নেই,
ইউনিফর্মের ওপরেই পড়ে নে ।" আবির ব্যাগ খুলে
দেখল, একটা লাল রঙের ফ্রক, লাল মেয়েদের পাজামা, ওড়না, লিপস্টিক, কিছু কাচের
চুড়ি, আর একটা রূপোর মালা । আবির জিজ্ঞেস করলো, "এসব
তো মেয়েদের পোশাক!" রাজেশ হো হো করে হেসে উঠলো । বলল, "হ্যাঁ
তো, এবার আবির সাজবে মেয়ে আর নাচবে সাকি সাকি গানে ।" আবির অবাক হয়ে
প্রশ্ন করলো, "মানে?" "মানে, বন্ধুকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় ।" আবির রাজের
চেহারার দিকে তাকাল । রাজ কিন্তু একটুও ভয় পাচ্ছে না, ওর
শরীরে অনেক শক্তি, কিন্তু এতোজনের সাথে পেরে উঠছে না,
তার ওপর ধরেছে চাকু । তবুও ক্ষিপ্ত মেজাজে বলল, "আবির,
বাদ দে! এসব করিস না!" আবির রাজের চেহারার দিকেই তাকিয়ে রাজেশকে বলল, "গলা থেকে চাকুটা অন্তত সরা?" রাজেশের ঈশারা
রাজের গলা থেকে চাকুটা সরানো হল । কিছুক্ষনের মাঝেই আবির পোশাকগুলো
ইউনিফর্মের ওপর পড়ে নিলো । ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, হাতে চুড়ি, গলায় মালা,
মাথায় ওড়না । লাল ফ্রক আর পাজামা তো আছেই । রাজেশ আবার ইশারা করলো, তারপর
শেষে যেই ছেলেটা ভেতরে ঢুকল, সে ভিডিও করা শুরু করলো । আবির আরও একবার
রাজের দিকে তাকাল । রাজ আবিরের এই বেহাল দেখে কাঁদছে, তবে সে
কান্নার মাঝেও ওর ক্ষিপ্ততা দেখা যাচ্ছে । রাজেশ এবার পকেট থেকে
মোবাইল বের করে গান ছেড়ে দিলো । কথা অনুযায়ী আবির নাচতে শুরু করলো । হাত পা কোমর মেয়েদের
মতো দুলিয়ে কোনোরকমে মেয়েদের মতো নাচল আবির । দাড়িয়ে দেখল সবাই । নাবিলা মাঝে
মাঝে মুচকি হাসছে । ও তো ধরেই নিয়েছে আবিরকে শায়েস্তা করার জন্যই হয়তো রাজেশ
এরকমটা করছে । আর রাজ ইচ্ছে করেই কিছু দেখছে না । মাঝে মাঝে যখন চোখটা আবিরের দিকে চলে
যাচ্ছে, মনে হচ্ছে, এরকম কষ্ট আগে কখনো পায় নি রাজ । গান শেষ হলে
আবির থামল । এরপর রাজেশ হাততালি দিলো । দিতে দিতে আবিরের কাছে গেলো । আবিরের সামনে দাড়িয়ে
বলল,
"জানিস আবির, তোকে না আজ দারুন দেখতে
লাগতেছে । না, তোর এই বাজে মেয়েলি চেহারার জন্য বলতেছি না,
তোর ভালোবাসা দেখে ।" আবিরের এবার অবাক হবার পালা । রাজেশের মুখে ভালোবাসা
শব্দটা হঠাৎ এলো কোত্থেকে? রাজেশ যেই ছেলেটা ভিডিও ধারণ করছিলো,
তাকে ডেকে তার কাছ থেকে মোবাইলটা নিয়ে আবিরকে ভিডিওটা দেখাল । আবির কিন্তু
ভিডিওটা দেখে মোটেও লজ্জা পেলো না কিংবা রাগ করলো না বরং এক মুহূর্তের জন্য
নাবিলার দিকে তাকাল । নাবিলাও তখন আবিরের দিকেই তাকিয়ে ছিল, তাই
ওদের চোখে চোখ পড়লো । আবির নাবিলার দিকে তাকাতেই নাবিলা চোখ সরিয়ে নিলো । তারপর রাজেশ
মোবাইল থেকে ভিডিওটা ডিলিট করে দিয়ে বলল, "আসল কথাটা তাহলে বলেই দেই ।" তারপর নাবিলার
দিকে ঈশারা করে রাজেশ বলল, "এই মেয়েটা আমাদের ঠিক করেছিলো তোর
ভাই রাজকে মারার জন্য । আবির ভ্রু কুঁচকে নাবিলার দিকে তাকায় । নাবিলা ভয় পেয়ে
যায় । কিছু বলে না । রাজও অবাক হয়ে যায় । নাবিলার দিকে ও নিজেও একবার তাকায় । রাজেশ বলতে
লাগলো,
"আসলে মেয়েটা প্রমান করতে চেয়েছিলো প্রেম আর বন্ধুত্বের মাঝে
প্রেম-ই আসল । বন্ধুত্বটা নকল । কিন্তু আমরা ওকে একটু
দেখিয়ে দিলাম বন্ধুত্বটা কতোটা আসল । বলেই রাজেশ একবার নাবিলার দিকে তাকাল । নাবিলা ভয়ে
মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আঙুল ফোটাচ্ছে । রাজেশ, "এ চল ।" বলে ওর গ্যাঙের
বাকি সদস্যের নিয়ে চলে গেলো । যাবার সময় আবিরকে বলে গেলো, "কাল সকালে জিনিসগুলো
স্কুলে আনিস ।" রাজেশ আর ওর গ্যাং চলে যেতেই রাজ এসে আবিরকে জড়িয়ে ধরলো, তারপর
কাঁদতে কাঁদতে বলল, "ভাই আমাকে মাফ করে দিস! আমি তোকে এভাবে দেখবো কখনোই ভাবি নি !" আবির
কিন্তু তাকিয়ে নাবিলার দিকে । নাবিলা তখন মাথা নিচু করে দাড়িয়ে । আবির রাজের চোখের জল
মুছে দিয়ে একটু হেসে নাবিলার কাছে এসে দাঁড়ালো । তারপর বলল, "আসলে
কি জানতো, প্রেম আর বন্ধুত্ব দুটো না ভিন্ন ধাঁচের ভালোবাসা
আর ভিন্ন ধাঁচের কিছুর মাঝে তুলনা হয় না । যে পারে, প্রেম
আর বন্ধুত্ব দুটো ভালোবাসাই দিতে পারে, আর যে পারে না,
সে কোনটাই পারে না ।" বলেই ওখান থেকে বেড়িয়ে গেলো আবির । রাজ যাচ্ছিলো, কিন্তু
নাবিলা পিছু ডাকল । নাবিলা কিছু একটা বলতে যাবে, রাজই প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে
বলল, "তোমার কাছে কখনো আমি এটা আশা করিনি নাবিলা,
তোমাকে আমি আলাদা ভেবেছিলাম, আর তুমি-ই কি না......।" আর কথা বেরোল না
রাজের মুখ দিয়ে । শেষে "ছি!" উচ্চারন
করে ধিক্কার জানিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে । নাবিলা যেন নিজের ভুলটা
বুঝতে পারলো । সমস্যাটা আবিরের না, আসলেই ন্যাকামো জিনিসটা সবসময় সহ্য করার
মতো না । এতোদিন পড়ে বুঝতে পারলো নাবিলা । সাথে এটাও বুঝতে পারলো, প্রেম
আর বন্ধুত্বের মাঝে কখনোই বন্ধুত্ব প্রেমের বাধা হয়ে দাঁড়ায় না । উল্টো দুটোই
ভিন্ন ধাঁচের দুটি ভালোবাসার সম্পর্ক ।
সন্ধ্যার কথা । রিসিপশনের
জানালার কাছে মুখ বাড়িয়ে বার দুয়ে বাইরে
চোখ মেলে তাকাল পাপলু আঙ্কেল । তারপর রুমের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারী করতে লাগলো । এরপর আবার বার
দুয়ের বাইরে চোখ মেলে তাকাল । তারপর আবার পায়চারী শুরু । কিছুক্ষণ পর দারোয়ান
হাতে একটা চায়ের কাপ নিয়ে এলো । রিসিপশনের জানালার কাছে এসে দাড়িয়ে বলল, "পাপলু
ভাই, চা আইছে ।" পাপলু আঙ্কেল চায়ের কাপটা হাতে নিলো । বলল, "ঠিক
আছে যা ।" এরপর দারোয়ান চলে গেলো । চায়ের কাপে কিন্তু চা
ছিল না, ছিল একটা ভাজ করা কাগজের টুকরো । পাপলু আঙ্কেল চা খাওয়ার
অভিনয় করলো কিছুক্ষন । তারপর চায়ের কাপটা রিসিপশনের জানালার সামনে রাখল । আবার পায়চারী
শুরু । আবারও কিছুক্ষণ পর পর জানালা দিয়ে বাইরে চোখ মেলছে । এরপর এলো আবির আর রাজ
মাগরিবের নামাজ পড়ে ফিরছিল ওরা । আবির পাপলু আঙ্কেলের জানালার সামনে এসে দাড়িয়ে হেসে বলল, "কি
খবর আঙ্কেল? কেমন আছো?" পাপলু
আঙ্কেল হ্যান্ডশেক করার ভঙ্গিতে আবিরের হাতে বেশ গোপনে আবিরকে একটা কাগজ দিয়ে বলল,
"এইতো, ভালো ।" আবির কিন্তু আগে
থেকে ঠিক বুঝতে পারে নি পাপলু আঙ্কেল ওকে এভাবে কিছু দেবে । আবির তখনই বুঝল কাজটা
খুবই গোপনীয়ভাবে পাপলু আঙ্কেলও করছে । আবির এবার রিসিপশনের জানালা দিয়ে ভেতরে হাত
ঢুকিয়ে টেবিলে রাখা পাপলু আঙ্কেলের চশমাটা হাতে নিয়ে বেশ কায়দা করে হাতে থাকা ওর
অন্য একটা কাগজ টেবিলে রাখল । ব্যাপারটা খেয়াল করলো পাপলু আঙ্কেল । তারপর আবির চশমাটা
দেখতে দেখতে বলল, "একি! নতুন চশমা কবে কিনলে?"
পাপলু আঙ্কেল হেসে বলল, "এইতো, খুব বেশিদিন না, ৩-৪দিন হবে ।" আবির হাত বের
করলো । বলল,
"বাহ, দারুন তো! যাই
আঙ্কেল, পড়ে কথা হবে ।" "আচ্ছা!"
জবাব দিলো পাপলু আঙ্কেল । এরপর পাপলু আঙ্কেল টেবিলের কাগজটা চায়ের কাপের মধ্যে রেখে
দারোয়ানকে ডাকল । "লেবু! ওই লেবু!"
খানিকবাদে দারোয়ান লেবু এলো । "জি
ভাই!" পাপলু আঙ্কেল চায়ের কাপটা দারোয়ানের হাতে দিয়ে
বলল, "নে, কাপটা নিতে আসলে দিয়ে
দিস ।"
লেবু
চায়ের কাপটা নিয়ে চলে গেলো । এতক্ষণে পাপলু আঙ্কেলের পায়চারী বন্ধ হল । বিছানায় গা
এলিয়ে দিয়ে একটু শুয়ে পড়লেন, এমন সময় মেয়ে কণ্ঠে কেউ ডাকল,
"পাপলু আঙ্কেল?"
"আবির? কাগ......।" কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো রাজ, আবির ওকে থামাবার জন্য বলল,
চল তোকে এক যায়গায় নিয়ে যাবো ।" রাজ জিজ্ঞেস
করলো,
"কোথায়?" আবির বলল, "চল তো, বেশ সুন্দর একটা জায়গা, আজ থেকে ওখানে রোজ আড্ডা দেবো ।" রাজ বলল, "চল
যাই ।"
এরপর
আবির আর রাজ কথা বলতে বলতে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে লাগলো ।
"কি হইছে? ডাকলি ক্যান?" ছাদে রেলিঙের পাশে দাড়িয়ে থাকা
নিশিকে বলল পরশ । নিশি পরশকে দেখে কাছে এসে বলল, "আমি
নিজেও বুঝতেছি না রে, সকাল থেইকা নাবিলার মন মেজাজ ক্যান
জানি ভালো নাই । খাইতেছে না, একা একা বইসা আছে ।" পরশ বলল, "কই,
ক্লাসে তো বেশ ছিল, আমাদের লগে মজা কইরাই তো
কথা কইতেছিলো । হঠাৎ কইরা কি হইল আবার?" "কি জানি । কিন্তু চিন্তা
হইতেছে?"
"রাজের লগে কিছু হইছে নাকি?" নিশি
ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, "না, রাজের সাথে ওরে তো আজকে দেখিই নাই । রাজ তো সারাদিন আবিরের
সাথেই থাকে ।"
পরশ
বলল,
"যা ওরে ছাদে নিয়া আয় । দেখিস ওর ভাল্লাগবে ।" নিশি বলল, "আরে
ও তো কথাই কয় না, আনমু কি?" "আরে জোর কইরা আন! কিয়ের বন্ধু তুই?" নিশি "আচ্ছা, দাঁড়া । চেষ্টা করতেছি ।" বলেই নিচে চলে
গেলো । পরশ ছাদের সেই খাটের ওপর বসে মোবাইল চালাতে লাগলো । ফেসবুকে স্ক্রুলিং
করছিলো । মিনিট দুয়েকের মধ্যে নিশি আসে । দেখে বোঝা যাচ্ছে তাড়াতাড়ি করে দৌড়ে এসেছে, জোরে
জোরে শ্বাস নিচ্ছে । চেহারায় ভয়ের ছাপ । প্রায় কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে পরশকে বলল, "নাবিলা
দরজা খুলতেছে না!"
পাপলু আঙ্কেল উঠে বসলো । জানালার দিকে
তাকিয়ে দেখল, সোমা আপু এসেছে । পাপলু আঙ্কেল উঠে
দাড়িয়ে জানালার কাছে গেলো । ঠোঁটে একটা হাসি ফুটে উঠলো । জিজ্ঞেস করলো, "আরে
সোমা যে, কি অবস্থা শরীরের?" সোমা
আপু হেসে বলল, "জি আঙ্কেল, আলহামদুলিল্লাহ
ভালো । আপনারা কেমন আছেন?" পাপলু আঙ্কেল জবাব দিলো, "এইতো
ভালো । তা তুমি তো আসোই না । রাকিব আসে নি?" সোমা আপু বলল, "না আঙ্কেল । ওর কি একটা কাজ পড়ে আছে তাই আসে নি ।" পাপলু আঙ্কেল
বলল,
"তা তুমি এই অবস্থায় একা একা আসতে গেলে কেন? যদি কিছু হয়ে যেতো! বাচ্চাটার কথা ভাবতে হবে তো নাকি"
সোমা আপু একটু হেসে বলল, "ইনশাল্লাহ
আল্লাহর রহমতে এবং আপনাদের দোয়ায় কিছুই হবে না আঙ্কেল । আসলে একটা
দরকারে আসতেই হল ।" "তুমি তো একটা দরকারেই প্রায় সময় আসো । আজও কি তাই?" সোমা
আপু বলল, "জি । ক্লাস টেনের একটা মেয়ে । আমার বাসার
সামনে এসে কান্নাকাটি করছিলো । জিজ্ঞেস করলাম, বলল আজ ওর বাবা মারা গেছে । তাই ভাবলাম
এখানে ভর্তি করা যায় কিনা । নিশি আর নাবিলার বাসায় একটা রুম আছে না ফাঁকা?" পাপলু
আঙ্কেল বলল, "হ্যাঁ আছে । ওটাই শেষ রুম ফাঁকা । তবে চিন্তা করো
না, সিদ্ধান্ত হয়ে পুরো একেক রুমে একজন করে রেখে যদি ভরে যায়, তাহলে দুজন করে একেক রুমে থাকবে । তাই ক্লাস টেনের কাউকে
পড়ে পেলেও এনো কিন্তু ।" সোমা আপু হেসে বলল, "আচ্ছা আঙ্কেল ।" পাপলু আঙ্কেল
চাবি আর ফর্ম দিলো । তারপর বলল, "কই? সে মেয়ে কই?"
সোমা আপু পেছনে তাকিয়ে বলল, "কই আয়?"
কিছুক্ষণ পর মেয়েটা সামনে
এলো পাপলু আঙ্কেলের । মেয়েটার মন খারাপ । সম্ভবত বাবা মারা গেছে সেজন্যই পাপলু
আঙ্কেল জিজ্ঞেস করলো, "কি নাম তোমার?" মেয়েটা জবাব
দিলো, "রিতা ।" এ সেই রিতা, যে রিতা
নাবিলাকে বলেছিলো রাজেশ নারায়ণের কথা ।
আবির রাজকে নিয়ে স্কুল
মাঠের একদম মাঝখানে এলো । রাজ জিজ্ঞেস করলো, "কিরে? এখানে
কেন আনলি?" আবির বলল, "এবার
শোন, এই জায়গাটা আমাদের কথা বলার জন্য একদম সেইফ । এইখানে বইসা
কথা কইলে কেউ শুনতে পাবে না । আশেপাশে কেউ আসতে চাইলেও দেখতে পাব । সমস্যা নেই । অন্তত লুকিয়ে
লুকিয়ে কেউ শুনতে পারবে না ।" রাজের ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠলো । বলল, "তোর
কি বুদ্ধি রে ভাই! আচ্ছা এবার বল । কাগজটা সুমন
স্যার দিয়েছে, তাইনা?" আবির বলল, "হুম । আমিও দিলাম । রাজেশ নারায়ণের সব কথা লিখে দিলাম যেগুলো নাবিলার ডায়রিতে
পেয়েছিস তুই । সাথে ওই রাকেশ নারায়ণ, রাজেশ নারায়ণ ওদের কথাবার্তাগুলোও দিলাম । আজ তো স্যার এর সাথে কথা বলতেই পারলাম না ।" রাজ কিছু বলল না
। আবির কাগজটা
খুলল । তাতে লেখা, "বিদেশীরা দেখতে বেশ । ছোটবেলা থেকেই
বিদেশীদের দেখলে ইচ্ছে করতো দেশের কিছু দেই ওদের । তা হোক একটা লজেন্স, হোক তা
খণ্ড । এতে অসহায় নারাজ থাকলেও বুদ্ধি খাটাতে হবে ।" রাজ অবাক হয়ে
গেলো । জিজ্ঞেস করলো, "এ আবার কেমন কথা? এর মধ্যে বিদেশী এলো কোত্থেকে?" আবির ভাবতে লাগলো । রাজ আবিরের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে আরও একবার পড়লো । বলল, "ভাই
এই অসহায়ের খণ্ডটা আবার কি জিনিস?" আবির কয়েকবার উপর
নিচ মাথা নাড়ালো । রাজ আবিরকে ধাক্কা দিয়ে বলল, "ওই! বল না!" আবির বলল, "আচ্ছা
তুই-ই বলতো আমরা কি?" হঠাৎ এরকম
অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো রাজ । তবে আবির যে ইয়ার্কি
করছে না এটা ও শিওর । কথার ভেতর জগাখিচুড়ি আঞ্চলিকতা নেই । রাজ বলল, "কি
আবার মানুষ, তুই লেজবিহীন বানর হইলেও হইতে পারোস ।" আবির রাজের
ইয়ার্কিটাকে মোটেও তেমন গুরুত্ব দিলো না । ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বলল, "উহু
। আমরা অসহায় । কারণ আমরা এতিম ।" রাজ বলল, "কিন্তু আমাদের খণ্ড মানে?"
আবির বলল, "আমাদের খণ্ড মানে এই যে
আশ্রমটা । খুব সম্ভবত স্যার বোঝাতে চাচ্ছেন এই জমিটা বিদেশি কারো
কাছে বিক্রি করে দেয়ার চক্রান্ত চলছে ।" রাজ হেসে দিলো । আবির জিজ্ঞেস করলো, "হাসছিস
কেন?" "আরে সে তো বুঝলাম, কিন্তু
তার সাথে এতো ছাত্রছাত্রী ভর্তি করার সম্পর্ক কি? ওতে তো
আমাদের আরও এই আশ্রম থেকে সরিয়ে দেয়ার কথা ছিল ।" আবির এবার
চিন্তায় পড়ে গেলো । আসলেই তো, এতো উল্টো কাজ চলছে । আবিরের তখন মনে
পড়ে যায় নাবিলার ডায়রিতে লেখা ছিল জমি সংক্রান্ত কিছু কথা । প্রদেশ নারায়ণ আর ওর
স্ত্রী মানে জমিদার কাশেম আহমেদের বদমেজাজি মেয়ে বিদেশ যায় নি । রাজ তখন হঠাৎ
করে সিরিয়াস হয়ে গেলো । জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা আবির, তুই
একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিস?" আবির অন্যমনস্ক হয়েই
জিজ্ঞেস করলো, "কি?" রাজ বলল,
"আজকে রাজেশ যেটা করলো, তাতে মনে হল না ও আমাদের শত্রু । শত্রু হলে ও
মোটেও এরকম করে আমাদের নাবিলার কথা বলতো না ।" আবির হঠাৎ করে
টপিকের বাইরে কথা বলা শুরু করলো । রাজের দিকে তাকিয়ে বলল, "শোন, তুই ওর ওপর রাগ করেছিস?" রাজের চেহারা দেখে মনে
হল ওর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো । বলল, "এরকমটা দেখলে কারই বা রাগ হবে না বল?"
আবির বলল, "হুম । তবে আমার মনে
হয় না ও পরবর্তীতে এরকমটা আর করবে । তুই ওকে কিছু বলিস না ।" রাজ হঠাৎ করে
প্রশ্ন করে বসলো, "আচ্ছা তুই ওর সাথে কথা বলিস না কেন?"
নিশি আর পরশ নিচে নেমে
এলো । দরজায় বেশ কয়েকবার জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে নাবিলাকে ডাকলো, কিন্তু
নাবিলার কোন সাড়া পাওয়া গেলো না । বাসার দরজা খোলাই ছিল । তাই চেঁচামেচির
শব্দ বাইরেও যাচ্ছিলো । চেঁচামেচির শব্দে পাশের বাসা থেকে বেড়িয়ে এলো শিমুল আর
জামি । দরজার সামনে দাড়িয়ে জামি জিজ্ঞেস করলো, "কিরে কি হইছে?" পরশ বলল, "নাবিলা দরজা খুলছে না ।" নিশি পরশকে বলল, "দরজাটা
ভেঙ্গে ফেল! দেরি করিস না!" পরশ
জামিকে আর শিমুলকে উদ্দেশ্য করে বলল, "তোরাও একটু আয়,
দরজা ভাঙ্গা লাগবো ।" জামি ইতস্তত করে বলল, "মেয়েদের বাসা তো!" পরশ রেগে গিয়ে বলল, "আরে রাখ তুই! একটা সিরিয়াস সময় অতো নিয়ম মানা লাগবো না । আয় ভেতরে ।" শিমুল আর জামি
ভেতরে ঢুকল । তিনজন মিলে জোরে জোরে দরজায় আঘাত করলো । একবার, দুবার......। তৃতীয়বাড়ে
দরজার ভেতরের ছিটকিনিটা ভেঙ্গে দরজা খুলে গেলো আর সবাই যা দেখল তা দেখার জন্য কেউই
হয়তো মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না । ফ্যানের সাথে গলায় ওড়না পেচিয়ে ঝুলছে নাবিলার দেহ । মুখ লাল হয়ে
গেছে চোখের সাদা অংশ পুরো লাল হয়ে বীভৎস দেখা যাচ্ছে । লাল বর্ণের দৃষ্টিতে
তাকিয়ে নাবিলার সবার দিকে ।
(৩)
আবির জবাব দিতে গিয়ে
হালকা হিমশিম খেয়ে গেলো । বলল, "ওইতো, তুই তো জানিস-ই, ও ন্যাকামো করেছিলো, তাই ধমকেছিলাম, পড়ে ও আমার
সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলো তারপর থেকে আমিও কথা বলা বন্ধ করে দিলাম ।" রাজ বলল, "আচ্ছা
এটার জবাব দিতে পারবি? আমি কিন্তু খেয়াল করি, তুই আর নাবিলা মাঝে মাঝে একে অপরের দিকে কেমনভাবে তাকাস ।" আবির রাজের দিকে
তাকাল । সত্যি জানার আগ্রহ ওর চেহারায় । কিন্ত সত্যটা তো আর বলা সম্ভব নয় । আবির বলল, "ভালো
বন্ধু ছিলাম তো, তাই ।" "তো এই বন্ধুত্ব
কি আবার গড়ে তোলা যায় না?" আবির এবার আর হিমশিম খেলো না । বলল, "তোকে
আমি একবার বলেছিলাম, ছোটবেলা থেকেই আমার প্রচুর জেদ । সেই জেদের বশে
আমি ওইটুকু বয়সে বাড়ি ছেড়েছিলাম । আর এই বয়সে এই জেদ আমার এতো সহজে ভাংবে?" রাজ
প্রশ্ন করলো, "আচ্ছা ব্যাপারটা যদি আমার সাথে ঘটতো তবেও
কি তুই একই কথা বলতি?" আবির অট্টহাসি হেসে উঠলো । বলল, "আরে,
তুই কি ওর মতো ন্যাকামো করস নাকি?" রাজ
কিছুক্ষণ চুপ রইল । তারপর বলল, "আমার মনে হয় তোরা আমার কাছে কিছু
লুকোচ্ছিস!" আবির এবার কিছুক্ষণ চুপ । তারপর বলল, "সব
কথা সবসময় বলা যায় না রে । পার্সোনালিটির একটা ব্যাপার আছে ।" "আরে আমি আর তুই একে অন্যের সাথে কতো কথা শেয়ার করেছি, আমি
আমার এমন একটা জঘন্য কথা শেয়ার করেছি যা তুই ছাড়া আর কেউ জানেনা । তাহলে তুই কেন
এ কথা বলছিস না? আমি তো আর কাউকে বলছি
না!" আবির বলল, "সময় হলে
বলবো সবটা দোস্ত ।" রাজ আবারো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময়
আবিরের মোবাইলে একটা কল এলো । পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখল, নিশির
কল । ফোনটা ধরল আবির । হ্যালো বলার
আগের ফোনের ওপাশ থেকে পরশ কম্পিত আর ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠলো, "আবির
কই তোরা! একটা বাজে ঘটনা ঘটছে, নাবিলা
গলায় ফাসি দিছে । এখনও মরে নি কিন্তু হাসপাতালে নিয়া যাওয়া লাগবে, তাড়াতাড়ি
আয়!" আবির চিৎকার দিয়ে দাড়িয়ে গেলো, "কি বলছিস এসব! হ্যালো! হ্যালো!"
পরশ বলল, "হ্যাঁ তুই তাড়াতাড়ি আয়,
আর রাজকেও নিয়ে আয়!" রাজও উঠে দাঁড়ালো । পরশ ফোন কেটে
দিয়েছে । রাজ জিজ্ঞেস করলো, "কিরে
কি হয়েছে?"
ফর্মটা পূরণ করা শেষ হলে
পাপলু আঙ্কেলের হাতে দিয়ে হোস্টেলের দিকে আসতে লাগলো সোমা আপু । রিতা জিজ্ঞেস
করলো,
"আপু, তুমি কি আমার মতো এখানকার সবাইকে
ভর্তি করিয়েছো?" সোমা আপু একটু হেসে বলল, "না । কাউকে কাউকে আমি এনেছি, কাউকে এনেছে অন্য কেউ । কেউ বা নিজের
ইচ্ছেতেই এসেছে ।" "ও আচ্ছা ।"-বলল রিতা । সোমা আপু বলল, "তবে
এটা সত্য এখানকার প্রায় তিন ভাগের দু ভাগ ছাত্রছাত্রী-ই আমার
হাত ধরে এখানে এসেছে ।" বলতে বলতে হঠাৎ থেমে দাড়িয়ে গেলো সোমা আপু । পেটে হঠাৎ
ব্যাথা শুরু হয়েছে । হালকা চিৎকার করলো । তারপর ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে গেলো । রিতা বলল, "তোমার
বেবি হবে?" সোমা আপু হেসে বলল, "কেন? দেখে মনে হয় অন্য কিছু হবে? রিতা একটু লজ্জা পেলো । সোমা আপু ওকে আদর করে বলল, "মজা
করলাম । রাগ করিস না ।" সোমা আপু সে সময় রাস্তার
এমন পজিশনে ছিল, যেখানে একপাশে ক্লাস এইটের হোস্টেল বিল্ডিং, অন্যপাশে ক্লাস থ্রি এর হোস্টেল বিল্ডিং । আর ক্লাস আর এক বিল্ডিং
পরেই ক্লাস টেনের বিল্ডিং, কিন্তু সোমা আপু এমন সময় লক্ষ করলো আবির আর
রাজ তাড়াতাড়ি করে দৌড়ে হোস্টেল বিল্ডিং-এ ঢুকল । সোমা আপু একবার
ডাকল, কিন্তু আবির আর রাজ হয়তো শুনতে পায়নি । রিতা জিজ্ঞেস করলো, "ওরা
কারা সোমা আপু?" "ওরা তোমার ক্লাসমেট হতে চলেছে ।" রিতা আর কিছু
বলল না । এমন সময় পেছন থেকে ডেকে উঠলো পাপলু আঙ্কেল । সোমা আপু ঘুরে দাঁড়ালো । দেখল, তাড়াতাড়ি
করে হাঁটতে হাঁটতে এদিকেই আসছে পাপলু আঙ্কেল । চেহারায় ভয়ের ছাপ । পাপলু আঙ্কেল
সোমা আপু কাছে আসতেই সোমা আপু জিজ্ঞেস করলো, "কি হয়েছে আঙ্কেল, আপনাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?" পাপলু
আঙ্কেল বলল, "চলো, আগে হোস্টেলে
চলো । নাবিলা নামের যে মেয়ে ও নাকি গলায় ফাসি দিয়েছিলো, আল্লাহর
রহমতে বেচে গেছে ।" সোমা আপুও ভয় পেয়ে উঠলো । "কি!"
পাপলু আঙ্কেল বলল, "তুমি আসতে আসতে আসো,
তাড়াতাড়ি আসার দরকার নাই, তোমার পেটে কিন্তু
বাচ্চা । আমি একটু তাড়াতাড়ি
যাই ।"
সোমা
আপু বলল,
"আচ্ছা আঙ্কেল ।" সম্মতি জানালেও সোমা আপু কিন্তু আগের চেয়ে একটু তাড়াতাড়িই
হাঁটছে । রিতা কিন্তু নাবিলাকে চিনল । সোমা আপুকেও কিছু জিজ্ঞেস করলো না বা কিছু জানালো না ।
ঘরে ঢুকেই রাজ আর আবির
দেখলো, নিশিরা ইতোমধ্যে নাবিলাকে ফ্যান থেকে নিচে নামিয়েছে । নিশি নাবিলার পাশে বসে
হাত মালিশ করে দিচ্ছে । হোস্টেলের আরও অনেকে এসে দেখছে । এতক্ষণ নিশি চোখ বন্ধ
করে ছিল । রাজ ভেতরে আসতেই নাবিলার পাশে বসে নাবিলার অন্য হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, "কেন
এমন করলে তুমি! আমি তো
তোমার ওপর রাগ করিনি! তাহলে তুমি কেন এতো বড় একটা
স্টেপ নিলে তুমি?" নাবিলা একবার রাজের দিকে তাকাল তারপর আবিরের দিকে । সেই যে আবিরের দিকে
তাকালো, আর আবিরের থেকে চোখ
সরাল না । আবির একবার
নাবিলার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো । তারপর জামিকে বলল, "তোরা
কি গাধা! এরকম একটা
সিচুয়েশনে তোরা হা করে কি দেখছিস!
অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছিস!" জামি ইতস্তত
হয়ে বলল, "না
মানে, টাকা লাগবে তো, পাপলু আঙ্কেলকে
ফোন করেছি । আসছে বলল ।" আবির বিরক্ত হয়ে
গেলো । জামিকে একটা মারতে যেয়েও মারল না । তারপর "ধ্যাত!" ধরণের
একটা আওয়াজ করে চলে যাচ্ছিলো, তখন বাসায় ঢুকল পরশ । আবির জিজ্ঞেস
করলো, "কিরে,
তোরা অ্যাম্বুলেন্স ডাকিস নি কেন?" পরশ
বলল, "হ্যাঁ আমি ডেকেছি । অ্যাম্বুলেন্স
আসছে বলল, শিমুলকে
বললাম মোড়ে দাঁড়াতে, অ্যাম্বুলেন্সওয়ালা যেন রাস্তা চিনতে পারে ।" আবির আরও একবার
নাবিলার দিকে তাকাল । নাবিলা তখনও আবিরের দিকে
তাকিয়ে । রাজও কিন্তু একবার
নাবিলার দৃষ্টি লক্ষ করে আবিরের দিকে
তাকাল । আবির নাবিলার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটু
হেসে চলে গেলো । সে হাসিটা যেন
নাবিলাকে ঈশারা করে বলল, "সব ঠিক
হয়ে যাবে ।" রাজ কাঁদতে
কাঁদতে নাবিলার মাথার কাছে একটা কাগজ দেখতে পেলো । চুলের আড়ালে পড়ে আছে
বলে সবাই হয়তো খেয়াল করে নি । রাজ কাগজটা হাতে নিয়ে একটু দেখল । সুইসাইড নোট । নাবিলা যা
লিখেছে তা দেখে কাগজটা নিজের পকেটে রাখল রাজ ।
"ডাক্তার আঙ্কেল কি
অবস্থা?" ইমারজেন্সি রুমটা থেকে ডাক্তারকে বেরোতে দেখে
জিজ্ঞেস করলো নিশি । সাথে আরও এসেছে আবির, রাজ, জামি আর শিমুল । পরশ আসে নি
হোস্টেলের দেখাশোনা করবে বলে আর পাপলু আঙ্কেল আসতে চেয়েছিলো, কিন্তু
উনার অনেক কাজ থাকে বলে আবির আর আসতে না করলো । সোমা আপুও আসতে
চেয়েছিলো কিন্তু আবিরই না করলো, এই অবস্থায় যাওয়ার দরকার নেই । পাপলু আঙ্কেলও
না করলো সাথে । নিশির প্রশ্নের জবাবে ডাক্তার বলল, "আল্লাহর কাছে দোয়া করো । আর যদি কয়েক
সেকেন্ড ঝুলে থাকতো, তাহলে তো মারা-ই যেতো ।" সবাই মনে মনে
আল্লাহর কাছে দোয়া করলো । নিশি বলল, "থ্যাঙ্ক ইউ ডাক্তার আঙ্কেল । আচ্ছা টাকা
পয়সা কি করবো?" নিশির প্রশ্ন শুনে ডাক্তার বলল, "আচ্ছা,
হসপিটালে ফোন দিয়েছিলো কে?" জবাবে নিশি
পরশের নাম বলল । ডাক্তার বলল, "ওর
কাছ থেকেই না হয় শুনে নিয়ো ।" নিশি পরশকে ফোন করলো । ফোনের ওপাশ থেকে
পরশ বলল,
"কিরে কি অবস্থা? কেমন আছে নাবিলা?"
"আলহামদুলিল্লাহ, বিপদ নেই কোন এই যা ।" ওপাশ থেকে পরশও
স্বস্তি পেলো । বলল,
"আলহামদুলিল্লাহ ।" নিশি তখন পরশকে
ডাক্তারের কথাটা বলল । পরশ বলল, "ও, ওই ডাক্তার
আমাদের আগের প্রিন্সিপ্যাল স্যার এর বন্ধু ছিলেন । আমি আমাদের স্কুলের
পাশে ডাক্তার তারেক আঙ্কেলের কাছ থেইকে
আনছি । উনার কাছে প্রিন্সিপ্যাল স্যার
দিছিলো নাম্বার । কোনোদিন লাগে নাই, আজ
লাগলো ।"
নিশি
একটু হেসে বলল, "ও আচ্ছা ।"
রাত তখন প্রায় ১০টা । সোমা আপু
অপেক্ষা করে বসে আছে যদি নাবিলাকে হসপিটাল থেকে ছাড়ে তাহলে একটু দেখে যাবে । কিন্তু পরশ ফোন
দিয়ে জানতে পারলো নাবিলাকে এখনই ছাড়বে না, পরশু অবস্থা বিবেচনা করতে ছাড়তে পারে । পরশ এসে বলল, "সোমা
আপু, তুমি আজ না হয় এখানেই থাকো, এতো
রাতে আবার যাবে?" "কি আর করবো । যেতে হবে । তোর রাকিব
ভাইয়া আবার চিন্তা করবে আমার জন্য ।" পরশ "ও" আওয়াজ
করলো । রিতা একপাশে বসে চুপ করে কথা শুনছে । সোমা আপু উঠে দাড়িয়ে ভ্যানিটি ব্যাগটা
কাঁধে নিয়ে বলল, "আচ্ছা, থাক তাহলে, আমি যাই ।" পরশ বলল, "চলো, তোমাকে
একটু এগিয়ে দিয়ে আসি । মোড়ে রিকশা পাওয়া যায়, উঠিয়ে দিয়ে আসি ।" সোমা আপু বলল, "আরে
পাগল, থাক । আমি যেতে পারবো ।" পরশ বলল, "তুমি
পারবে বললেই তো আমি ছাড়ছি না, চলো ।" "হোস্টেল তাহলে
দেখবে কে?"
পরশ রিতার দিকে তাকিয়ে বলল, "ও দেখবে । পারবে না?" রিতা
জবাব দিলো, "হুম পারবো ।" সোমা আপু বলল, "ঠিক আছে চল ।" যাবার সময় রিতার
উদ্দেশ্যে বলে গেলো, "শোন, কোন
সমস্যা হলে এদের জানাস কিন্তু, এরা কিন্তু তোর বন্ধু ।" সোমা ডানে মাথা
কাত করলো । কিন্তু পরশের কিন্তু মোটেও ভালো লাগছে না । কারণ মেয়েটাকে ও আগের
স্কুলে দেখেছে । কই? তখন তো এতিম ছিল না!
ইমারজেন্সি রুমের সামনে
চেয়ারে বসে আবির আর নিশি । নাবিলাকে ভেতরে
ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে । জামি
আর শিমুল ওয়াশরুমে গিয়েছিলো । এসে জামি জিজ্ঞেস করলো, "কিরে? রাজ কই রে?" আবির জবাব দিলো, "ও একটু হালকা খাবার আনতে গেছে ।" জামি একটু লজ্জা
নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "বলছি কি, তোরা কি এখানে থাকবি?"
আবির একবার জামির দিকে তাকাল । আবিরের দৃষ্টি দেখে
জামি একটু ভয় পেয়ে গেলো । শিমুল বলল, "আচ্ছা জামি, তোর
কি একদিন ঘুমাইলে এতো ক্ষতি হইয়া যাইবো?" আবির বলল,
"কারো থাকা লাগবো না । আমি আর রাজ আছি, তোরা যা ।" নিশি বলল, "আমি
থাকি?" আবির বলল, "না তুই যা
। চিন্তা করিস না । তার ওপর হোস্টেলে একটা নতুন মেয়ে এসছে, ও একা
একা ভয় পাবে ।" নিশি তখন হঠাৎ-ই কি একটা মনে পড়ে গেছে
এমন একটা ভাব ধরে বলল, "ও হ্যাঁ শোন, তোরে তো একটা কথা বলতে মনেই নাই, ওই মেয়েরে আমিই
আগেও দেখছি, তখন তো এতিম ছিল না, ২দিনেই
এতিম হইয়া গেলো?" আবির কিছু বলল না । কিছুক্ষণ
কি একটা ভাবল, তারপর
বলল, "আচ্ছা, যা তুই । আর ওর ওপর একটু নজর
রাখিস ।"
নিশি
আবারো মন খারাপ করে বলল, "আমার থাকতে ইচ্ছা করছিলো রে!" আবির বলল, "আচ্ছা যা না, কাল না হয় তুই থাকিস?" নিশি
ইশারায় "আচ্ছা" জবাব
দিলো । তারপর ওরা চলে গেলো । প্রায় মিনিট দশেকের
মাথায় রাজ এলো । হাতে ২টা খিচুরির প্যাকেট নিয়ে । আবির রাজ আবিরের পাশে এসে বসে একটা প্যাকেট দিলো । আশেপাশে নাবিলা, পরশ,
জামি ওদের দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, "ওরা
চলে গেছে?" আবির জবাব দিলো হুম ।" এরপর ওরা খাওয়া
শুরু করলো । খাওয়ার সময় ওরা একটা কথাও বলল না । খাওয়া শেষে দুজন একটু বাইরে যেয়ে
হাসপাতালের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো । আবির রাজের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কিরে?
তুই কিছু বলছিস না যে?" রাজ বলল,
"তুইও তো কিছু বলছিস না ।" আবির সামনের
দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল । সামনে গাড়ি চলছে একের পর এক । মোড়ের ধারের দোকানগুলো
খোলা । আকাশেও আজ চাঁদ দেখা যাচ্ছে । আবির বলল, "কি থেকে কি যে হয়! যাক, খারাপ কিছু হয় নি, এটাই
অনেক । হঠাৎ রাজ আবিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "তুই আর নাবিলা একে
অপরকে এক সময় ভালবাসতি, তাই না?"
(৪)
আবির ঘুরে রাজের দিকে
তাকাল । ওর দৃষ্টি দেখে মনে হয় না আন্দাজে কথা বলছে । আবিরের মনে প্রশ্ন
জাগলো রাজ কি করে জানলো, সে প্রশ্ন বুঝতে পেরে রাজ পকেট থেকে
নাবিলার বিছানায় পাওয়া সেই সুইসাইড নোটটা আবিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
"এটা দেখে বুঝলাম । নাবিলার সুইসাইড নোট ।" আবির কাগজটা
হাতে নিয়ে ভাজ খুলে পড়লো । তাতে লেখা, "আমি সত্যি ভুল করেছি, কিন্তু সত্যি কথা বলতে আবির, আমি তোমাকে যতোটা
ভালবাসতাম, এখন ঠিক ততোটাই ঘৃণা করি । তোমার এই জেদ
কখনোই তোমাকে সুখী করবে না, দেখো! আমি রাজকেই
ভালোবাসি, আমি রাজকেই পেতে চাই ।" আবির কাগজটা পড়ে
মুচকি হাসল । তারপর কাগজটা রাজের হাতে দিয়ে বলল, "এমনি এমনি কি আমি ওকে ভালোবাসার আগে
ভেবেছিলাম? ভালো হয়েছে কখনো কাউকে আমি মুখ ফুটে বলিনি যে ওকে
আমি ভালোবাসি । কোনটা রাগ কোনটা জেদ্ সেটাও বোঝে না ।" রাজ বলল, "আবির,
একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?" আবির একটু থেমে
বলল,"দেরি করছিস কেন, জিজ্ঞেস কর।" "এখনও কি তুই
নাবিলাকে.........।" কথা শেষ করার
আগেই আবির জবাব দিলো, "না!" তারপর রাজের দিকে
তাকিয়ে বলল, "ইভেন তখনও বাসতাম না । তুই চাইলে
সবাইকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারিস, কেউ আমার মুখে কোনোদিনই শোনে নি আমি
নাবিলাকে ভালোবাসি ।" রাজ আর কিছু বলল না । আবির সামনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "রাগ
করলি?" রাজ হালকা হেসে বলল, "ভালোই তো বাসিস নি, রাগ করার কি আছে ।" আবিরও মুচকি
হাসল, কিছু বলল না । রাজ বলল, "চল নামাজটা পড়ে আসি ।"
এদিকে নিশি জামি আর
শিমুল হোস্টেলে ফিরে এলো । জামি আর শিমুল আগেই রুমে ঢুকেছে, নিশি
একটু পরশের সাথে কথা বলে এলো । বাসায় এসে দরজা খুলতেই নিশি অবাক । নতুন যে মেয়েটা
এসেছে, মানে রিতা, সে নাবিলার রুম থেকে বের হচ্ছে । দরজা খুলবার
আওয়াজ শুনে রিতা চমকে উঠলো । নিশি জিজ্ঞেস করলো, "এই! তুমি
নাবিলার রুমে কি করছিলে? রিতা ওর হাতে থাকা ফোনতা দেখিয়ে বেশ
শান্তশিষ্টভাবে বলল, "আমি যখন এসেছিলাম, তখন তো এই রুমেই এসেছিলাম, সবাই যেহেতু ছিলো,
তো ফোনটা এই রুমে রেখে গিয়েছিলাম । এখন নিতে এলাম ।" নিশি "ও"
ছাড়া আর কিছু বলল না । রিতা চলে যাচ্ছিলো, এমন সময়
দাড়িয়ে যেয়ে নিশিকে জিজ্ঞেস করলো, "মেয়েটা কেমন আছে?"
নিশি বিরক্তির চেহারা নিয়েই বলল, "ভালো ।" রিতা আর কিছুই
বলল না । নিজের রুমে চলে গেলো । নিশিও চলে গেলো
নিজের রুমে ।
পরদিনের কথা । টিফিন পিরিয়ড । আবিরকে না দেখে
রাজেশ পরশকে জিজ্ঞেস করলো, "এ! ওই
ক্যাপ্টেনটা কই রে? দেখতেছি না যে?" পরশ বলল, "ও একটা কাজে গেছে, তাই আসে নাই ।" রাজেশ কিছু বলল
না । খানিক পর সুমন স্যার এসে ক্লাস রুমে উঁকি দিয়েও দেখল আবির আছে কি না । কিন্তু না পেয়ে
চলে গেলো ।
"কেন
এমন করলে তুমি?" নাবিলাকে জিজ্ঞেস করলো রাজ । আবির বাইরেই
বসে ছিল । নাবিলার চোখ এখনও লাল হয়ে আছে । গলার নিচে দড়ির দাগ পড়ে গেছে । অনেক কষ্টে নাবিলা মুখ
দিয়ে আওয়াজ বের করলো, "আমাকে ক্ষমা করেছো?" রাজ
নাবিলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, "আরে পাগলি! রাগ করার কি আছে? মানুষ মাত্রই ভুল করে, তাই বলে তুমি এমন করবে? একটুও কি তোমার মনে হল না
কাজটা কতো বড় পাপ?" নাবিলা আরও কিছু বলতে চাইছিল,
কিন্তু ওর গলায় প্রচুর ব্যাথা করছে বলে স্পষ্ট বলতে পারলো না । রাজ বলল, "আচ্ছা,
পড়ে কথা বোলো, এখন শুয়ে থাকো ।" নাবিলা চোখ বন্ধ
করলো । রাজ উঠে বাইরে এলো । আবির বলল, "কিরে? কথা বলল?"
"হুম । কিন্তু গলায় বোধ ব্যাথার জন্য কথা বলতে পারছে না ঠিক মতো ।" আবির বলল, "ও,
ওটা ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ । ওষুধগুলো এনেছিল?" "হ, ফজরের নামাজের পর যে বাইরে গেলাম, তখন এনেছিলাম একটা দোকান খোলা দেখে ।" আবির বলল, "ও
আচ্ছা । ঠিক আছে ।"
খানিকক্ষণ
দুজনেই চুপ রইল । তারপর রাজ জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা, তুই আর নাবিলা কি আবার বন্ধু হয়ে যেতে পারিস না?" আবিরের চেহারা দেখে মনে হল ও একটু বিরক্ত হয়েছে প্রশ্নটা শুনে । কোন জবাবও দিলো
না । রাজ আবার বলল, "প্লিজ আবির!" আবির বলল,
"আমার পক্ষে এটা আর সম্ভব নয় ।" রাজ তখন হালকা
রেগে গিয়ে বলল, "আবির প্লিজ! জেদটা কিন্তু এবার
একটু অতিরিক্তই হয়ে যাচ্ছে!" আবির তখন বলল,
"ও নিজে থেকেই যদি আমার সাথে কথা বলতে না চায় আমি কথা বলার কে?"
রাজ তখন অনুরোদের সাথে বলল, "প্লিজ ভাই!
দ্যাখ, আমার মনে হয় ও তোর জন্য কষ্ট পেয়ে
এরকমটা করেছে । তুই ওর কাছে ক্ষমা চা, ওকে বন্ধু হওয়ার জন্য
অনুরোধ কর, দেখবি, ও মানবে, সবটা ঠিক হয়ে যাবে ।" আবির বলল, "ক্ষমা চাইবো! আমি!
তোর কি মনে হয় দোষটা কি আমার ছিল?" "না থাকলেও এটা ছাড়া আর কোন উপায় নেই!" আবির
অবাক হয়ে গেলো । রাজের এরকম অবনতি! কোনটা ভালো কোনটা খারাপ সেটার পার্থক্য
করাটাও কি ভুলে গেলো? আবির রাজের দিকে তাকিয়ে উচু গলায় বলল,
"এতোগুলো দিনও তো ও আমার বন্ধু ছিল না, এতদিন
তো কিছু করে নি, গতকালই ও সুইসাইড করলো । গতকাল কি
হয়েছিলো তা তুই ভালো করেই জানিস! তারপরেও তুই বলবি ভুল আমার!" রাজ বলল, "দ্যাখ আমি কিন্তু ওভাবে কিছুই বলিনি!"
"না না! তোর কথাগুলোর কিন্তু ওরকমই মানে
বোঝায়!" "আবির, আমি কিন্তু
মোটেও এরকমটা বলিনি, আর তুই তো আসলেই ভুলটা করেছিস আমাকে
সবটা না জানিয়ে! আগে যদি জানাতি, কিছুই
হতো না তাহলে । তুই জানাসনি কারণ তুই চেয়েছিলি নাবিলা যেন আমার সাথে থেকে
তোকে না পাওয়ার কষ্টে ভোগে ।" আবির এবার সত্যি বিরক্ত হয়ে গেলো । বলল, "ইনাফ
রাজ! তোরে আমি ভালো ভাই ভাবছিলাম! আর
তুই!" রাজ হেসে বলল, "ভাই না!"
তারপর আবিরের মুখে একটা ঘুষি মেরে ক্ষিপ্ত গলায় বলল, "দ্যাখ কেমন ভাই!" আবির মেঝেতে পড়ে গেলো । আবির উঠে
দাড়িয়ে পাল্টা রাজকে মারতে গেলো, কিন্তু পারলো না । কষ্ট লাগছিলো । কিন্তু রাজ
কিন্তু একটুও অপেক্ষা করলো না । আবার আবিরকে একটা মেরে দিলো । সে সময় ডাক্তার সেদিক
দিয়েই যাচ্ছিলো, বলল, "আরে! কি
শুরু করলে তোমরা!" আবির উঠে দাঁড়ালো । ডাক্তার রাজের
আর আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, "এটা হাসপাতাল, কোন
মারামারি করার জায়গা না!" বলেই ডাক্তার ইমারজেন্সি রুমে
চলে গেলো । আবির খেয়াল করলো, রাজের মার খেয়ে নাক দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে ওর । মুখ ধোয়ার জন্য
ওয়াশরুমে যাচ্ছিলো, এমন সময় রাজ বলে উঠলো, "তুই
স্কুলের ভালো করবি না! দাঁড়া না! তোর
আর সুমন স্যার এর প্ল্যান সব ফাঁস করে দেবো! বুঝবি! কেমন কষ্ট লাগে!" আবির দাড়িয়ে গেলো । রাজের দিকে
ঘুরে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল, "তোর মতো ধর্ষকের কাছে এর চেয়ে বেশি
কিচু আশা করা যায় না ।" রাজের এবার রাগটা চরম পর্যায়ে উঠে গেলো । হাতের পাশেই একটা লোহার ফুলদানি ছিল, সেটা হাতে নিলো রাজ । আবিরকে মারার জন্য এগিয়ে
আসছিলো, এমন সময় পেছন থেকে ফুলদানীটা কেউ টেনে ধরলো । রাজ ফুলদানিটা নামিয়ে পেছন ফিরে
তাকিয়ে দেখল, সোমা আপু আর রাকিব ভাই । সোমা আপু
আবিরের দিকে এগিয়ে গেলো । রাকিব ভাই ধমক দিয়ে বলল, “কি করছ এসব তোমরা?” রাজ
কোন জবাব দিলো । “একে তো এমন বাজে সিচুয়েশন তার মধ্যে আবার নিজেরা নিজেরা ঝগড়া! তোমরা
মানুষ হবে না!”-বলল রাকিব ভাই । সোমা আপু আবিরের নাকে রক্ত দেখে নিজের ওড়না দিয়ে মুছে
দিতে দিতে বলল, “তোর এই অবস্থা কেন?” আবির একবার রাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “ও কিছু না,
সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলাম ।” রাজ আবিরের দিকে তাকিয়ে উচু গলায় বলল, “ঢং করিস না! আমি
তোকে মেরেছি বললেই হয়!” রাকিব ভাই রাজকে থামাতে ধমকের স্বরে বলল, “আবার কথা বলছিস!”
সোমা আপু একবার রাজের দিকে তাকিয়ে তারপর আবিরকে বলল, “যা, তুই ওয়াশরুমে যা।” মুখটা
ধুয়ে আয় ।” আবির ওয়াশরুমের দিকে গেলো । সোমা আপু রাজের কাছে এলো । তারপর বলল, “আমি
জানি না তুমি ওকে কেন মেরেছো, তোমার সাথে আমার
সেভাবে পরিচয়ও নেই, তুমি আসার পর এখানে আমি তেমন আসিও নি । কিন্তু তুমি আসার পর যা
যা হয়েছে সবটা কাল শুনলাম । পরশ আমাকে জানিয়েছে । তুমি নাকি আর আবির নাকি খুব ভালো
বন্ধু! তাহলে কি করে মারামারি করো!” রাজ কিছু বলল না, কিন্তু চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে
সোমা আপুর কথা ওকে সন্তুষ্ট করছে না । সোমা আপু বলল ইমারজেন্সি রুমের দিকে ঈশারা করে
বলল, “ওই যে ভেতরে যে শুয়ে আছে সুইসাইড করে, ওই মেয়েটাকে এক সময় আবির ভালোবাসতো । কোনদিনও
আবির আর নাবিলা মুখ ফুটে কথাটা বলে নি, আবিরও কখনো বলে নি কথাটা, বরং আবির আরও বলেছে,
আমরা ভুল ভাবি । শেষে কি হলো! যখন ও দেখল তুমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছো, তখন আবির ওকে ভুলে
যাওয়া শুরু করলো । শুধুমাত্র তোমার জন্য ।
যেন তুমি আর নাবিলা দুজনেই খুশি হতে পারো । এমনকি জামি, শিমুল, পরশ তোমাদের সম্পর্কটা ভেঙ্গে দেবার চেষ্টা করেছিলো,
আবিরই ওদের থামিয়েছে । শুধু তোমার জন্য আর সেই তুমি-ই কি না!” এতক্ষণে রাজের চেহারার
পরিবর্তন দেখা গেলো । নিজের ভুলটা যেন এতক্ষণে ও বুঝতে পেরেছে । সোমা আপু একটু থেমে
বলল, “আমি জানি না ভালো বন্ধু হিসেবে তুমি ওর জীবনে কতোটা ভুমিকা রেখেছো, কিন্তু আমি
বলবো ও যেরকম স্যাক্রিফাইস তোমার জন্য করেছে, এরকমটা এ যুগে একজন আপন ভাইও বোধ হয় করে
না ।” সোমা আপু আরও কিছু বলতো, আবিরকে দেখে থেমে গেলো । আবিরের কাছে যেয়ে বলল, “শোননা,
ব্যাথা করছে! একটা প্যারাসিটামল খা । আমার কাছে আছে ।” সোমা আপু ব্যাগ থেকে ওষুধটা
বের করতে যাচ্ছিলো, আবির বলল, “থাক আপু, সমস্যা নেই । আর তুমি এতক্ষণ দাড়িয়ে আছো কেন?
শরীর খারাপ করবে তো!” সোমা আপু ইয়ার্কি করে চড় দেখিয়ে বলল, “একটা মারবো! বেশি বড় হয়ে গেছিস না! আমি যা বলছি তাই কর
।” রাজ কিন্তু সেই তখন থেকে আবিরের দিকে তাকিয়ে । অনুতপ্ত রাজ । কিন্তু কাছে সোমা আপু
আর রাকিব ভাই থাকার জন্য কিছু বলতে পারছে না আবিরকে । আবির ওষুধটা খেয়ে বলল, “তোমরা
কতক্ষন থাকবে?” সোমা আপু বলল, “বেশিক্ষন না রে, একটু দেখে চলে যাবো । তোর রাকিব ভাইয়ের
আজ আবার দুপুরে অফিস ।” আবির এতক্ষণ রাকিব ভাইকে খেয়াল করে নি । রাকিব ভাইয়ের কাছে
যেয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল, “কেমন আছো ভাই!” রাকিব ভাই একটু ইয়ার্কি করে বলল, “বিয়ে করার
পর দেখিস, কেমন থাকা যায় বউয়ের জ্বালায় ।” আবির হাসল, সোমা আপুও হালকা রাগ করে বলল,
“এই কি বললা! বাসায় চলো! ঝাড়ু আজকে তোমার গা থেকে সরবে না ।” সোমা আপুর রাগটাও নেহাত
ইয়ার্কিই ছিল । সোমা আপু আবিরকে জিজ্ঞেস করলো, “তা হঠাৎ এরকম প্রশ্ন করলি যে?” আবির
বলল, “না, এমনি । যাওয়া লাগবে হোস্টেলে । মোবাইলে চার্জ নেই ।” সোমা আপু রাজকে দেখিয়ে
জিজ্ঞেস করলো, “তাহলে আজ কি ও একা থাকবে?” আবির জবাব দিলো, “না, নিশি আসবে । নিশি গতকালও
থাকতে চেয়েছিলো তা হোস্টেলে তুমি যাকে কাল আনলে, ওর প্রথম দিন ছিল বলে আমি ওকে বললাম
হোস্টেলেই থাকতে । সোমা আপু বলল, “ও আচ্ছা ।” এতক্ষণে রাজের দৃষ্টি আবিরের দিকে সরে
গেলো । আবির তখন একবার রাজের দিকে তাকাল । রাজ কাকে যেন একটা ফোন করতে সেখান থেকে চলে
গেলো । সেই সময় ইমারজেন্সি রুম থেকে বেড়িয়ে এলো ডাক্তার । সোমা আপু ডাক্তারের কাছে
যেয়ে বলল, “স্যার, মেয়েটা এখন কেমন আছে?” ডাক্তার বলল, “হ্যাঁ ভালো আছে । চোখের লালচে
ভাবটা কমেছে । এখন গলার ব্যাথাটাও কিছুটা কমেছে । কথা বলতে পারছে ।” সোমা আপু বলল,
“আমরা কি একটু দেখা করতে পারি?” ডাক্তার বলল, “হ্যাঁ অবশ্যই, যাও । আচ্ছা তুমি কি সোমা?”
সোমা আপু হালকা চমকে গেলো । নাম জানলো কি করে? সোমা আপু জবাব দিলো, “জি, কিন্তু কেন?”
ডাক্তার একটু হেসে বলল, “তোমাদের যিনি আগের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন, উনি আমার বন্ধু ।
উনার কাছে অনেক শুনেছি তোমার নাম ।” সোমা আপু ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো ।
স্কুল শেষে নিশি তাড়াতাড়ি
করে হাসপাতালে যাবার জন্য আসছিলো, সে সময় হঠাৎ রাজেশ ওকে ডাকল । নিশি ঘুরে তাকাল ।
রাজেশ নিশির কাছে এলো । নিশি জিজ্ঞেস করলো, “কি চাই আপনার?” রাজেশ বলল, “তুই ওই ক্যাপ্টেনদের
হোস্টেলেই তো থাকিস, তাই না?” নিশি উপর নিচে মাথা নাড়ল । রাজেশ শার্টের পকেট থেকে একটা
কাগজ বের করে নিশির হাতে দিয়ে বলল, “এটা ওই ক্যাপ্টেনরে একটু দিস ।“ নিশি কাগজটা হাতে
নিয়ে বলল, “কি এটা?” রাজেশ বলল, “সেটা তোর বুঝে কাজ নাই । শুধু দিয়ে দিস । আর হ্যাঁ,
নিজে কিন্তু খুলে দেখিস না! কেউ চাইলেও কিন্তু দিস না! এতে ওই ক্যাপ্টেনের ক্ষতি হয়ে
যাবে কিন্তু!” নিশি আর কিছু বলার আগেই রাজেশ চলে গেলো । নিশি কাগজ্টা ব্যাগে রেখে হোস্টেলের
দিকে ফিরতে শুরু করলো । একটু পরেই এলো শিমুল । নিশিকে দেখে নিশির সাথেই ফিরতে শুরু
করলো হোস্টেলের দিকে । জিজ্ঞেস করলো, “কিরে? তুই ওর সাথে কি কথা কইতেছিলি?” নিশি ছেলেটা
কাউকে দিতে বারণ করেছে বলে সতর্কতার খাতিরে শিমুলকে কিছু জানালোও না । বলল, “আরে, তেমন
কিছুই না ।” এমন সময় নিশির মনে হল, ওর ব্যাগ ধরে কেউ টানল । পেছনের ঘুরে গেলো । দেখল,
কেউ নেই । নিশিকে পেছনে ঘুরতে দেখে শিমুলও
তাকালো । শিমুল জিজ্ঞেস করলো, “কিরে? কি হয়ছে?” “না, মনে হল কে যেন ব্যাগ ধরে টানলো
।” শিমুল হেসে বলল, “কই, কেউই তো নেই! তোর মনের ভুল হবে ।” নিশি একটু ভয় পেলো । কেউ
আবার কাগজটা নিয়ে গেলো না তো? নিশি ব্যাগটা কাঁধ থেকে খুলে দেখল, ব্যাগের চেইন খোলা
। তারপর ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেখল, কাগজ ভেতরেই আছে । কিন্তু এই কাগজটা কেমন অন্যরকম লাগছে
না? নাকি! না, মনের ভুল হবে হয়তো । শিমুল জিজ্ঞেস করলো, “কিরে? হল কি তোর?” নিশি আর
সাত পাঁচ না ভেবে কাগজটা ম্যাথ বইয়ের মধ্যে রেখে ভালো করে চেইন আটকে কাঁধে নিয়ে বলল,
“না কিছু না । তাড়াতাড়ি চল ।” শিমুল বলল, “হ্যাঁ যাচ্ছি-ই তো । নাবিলার ওখানে যাবি
না?” নিশি বলল, “হুম, আজকে ওখানে থাকমু ।” শিমুল বলল, “হুম । আমিও আজকে ওইখানে থাকমু
।” নিশি ভ্রুকুঁচকে শিমুলের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুইও যাবি? কই আবির তো জানাইল না! আবির
তো কইলো আমি আর রাজ থাকমু ।” শিমুল হেসে বলল, “ভালো । আমারে রাজ কইলো ।”
দরজা খোলার শব্দ শুনে বিছানা
থেকে উঠে বসলো রাজ । উঠে ডাইনিং রুমে গেলো । জামি এসেছে । আবিরকে দেখে জামি বলল, “হেই
ব্রো! কি অবস্থা?” আবির বলল, “এইতো মোটু! ভালোই । তোর?” “হ মামা, ভালোই । নাবিলার কি
অবস্থা?” আবির জবাব দিলো, “আগের চেয়ে ভালো । পরশ, শিমুল, নিশি কই?” জামি জুতোটা রেখে
শার্টের ইঙ্ক খুলতে খুলতে বলল, “পরশ আজকে ক্যাপ্টেনের কাম করছে, শিমুলরে খায়রুল স্যার কি কামে জানি ডাকছিলো, আর নিশির লগে দেখা হয় নাই
।” আবির বলল, “ও আচ্ছা । তুই যা তাহলে, জামা ছেড়ে গোসল করে নে।” জামি ওর রুমে চলে গেলো
। আবিরও নিজের রুমে ঢুকে গেলো ।
“তুমি আর আবির মারামারি করলে
কেন?” রাজকে বলল নাবিলা । রাজ মাথা নিচু করলো । বুঝলো, বাহিরে হয়তো সোমা আপুর কথা শুনেছে
। নাবিলা একটু থেমে বলল, “দ্যাখো, দোষটা সত্যিই কিন্তু আমারই ছিল, আবিরের কিন্তু কোন
দোষ ছিল না । দোষটা আমারই ছিল । যতোই হোক, আমি তো ওদের বলেছিলাম তোমাকে মারতে । রাজ
বলল, “এখন ওসব কথা থাক । তোমার কথা বলার দরকার নেই ।” নাবিলার চেহারা দেখে মনে হল ও
সন্তুষ্ট নয় । ও রাজের মুখে আবিরের বিরুদ্ধে কিছু শুনতে চেয়েছিলো হয়তো । নাবিলা আবার
বলল, “আবির ঠিকই বলেছে । যে পারে, সে বন্ধুত্ত আর প্রেম দুটোই একসাথে করতে পারে । আর
ও নিজেই বা আমার সাথে প্রেম করতে পারলো কই? ওর জেদই তো আমার ভালো লাগে না । তাই তো
ওর সাথে কথা বলা বাদ দিয়ে দিয়েছি ।” রাজ বলল, “না নাবিলা, জেদ না, রাগ । আর ওর সেদিন
রাগ করাটা অযৌক্তিক ছিল না, ও বলেছে, কোন একটা মেয়ে মারা গিয়েছিলো । আর ওরকম সময় তুমিও
আমার সাথে যদি ন্যাকামো করতে, তাহলে আমিও তোমার ওপর রাগ করতাম ।” নাবিলা যেন একটু রাগ
করলো আবিরের পক্ষ নিয়ে কথা বলায় । কিছু একটা বলতে চাইছিল, কিন্তু পারলো । গলায় আটকে
গেলো । কাশতে শুরু করলো । পাশেই একজন নার্স ছিল, এগিয়ে এসে রাজকে বলল, “আরে! তুমি আর
কতো কথা বলবে? যাও এখন বাইরে যাও ।” রাজ বাইরে চলে গেলো । নাবিলা আর রাজের দিকে ফিরেও
তাকাল না । মনে মনে বলল, “আবির! তুমি যতোই ভালো হও! সেদিন ফোনে তুমি আমার নামে যা বলেছিলে
সবটা আমি শুনেছি । আমি ওই কথাগুলো কখনোই ভুলবো না । আমার মতো মেয়ে তোমার পাশে মানায়
না! আমি তোমার যোগ্য নই! আমার চেয়ে অনেক গুণ ভালো মেয়েই তোমার পাশে মানায় তাই না! তাহলে
আমি-ই এবার বেমানান হয়ে যাই না তোমার কাছে । দেখো, আমি কতোটাই বেমানান তোমার জন্য!”
দরজা খুলেই নিশি দেখল, আবির
দাড়িয়ে । নিশি গোসল করে উঠে চুল মুছছিল । আবিরকে দেখে বলল, “আরে! তুই কখন এলি! তুই
না বললি আমরা গেলে আসবি!” আবির বলল, “ভালো লাগছিলো না রে, তাই আরও আগে এসেছি ।” “শিমুলের
সাথে দেখা হইছে?” আবির বলল, “না, ও বোধ হয় দ্যাখে নি আমি এসছি । আমিও দেখি নাই ওরে
। তুই যাবি কখন?” নিশি জবাব দিলো, “এইতো, শিমুল রেডি হইলেই আমি যামু ।” আবির অবাক হয়ে
জিজ্ঞেস করলো, “শিমুল! ও যাবে?” নিশি বলল, “হুম, আজকে ও আর আমি থাকমু তো ।” আবির জিজ্ঞেস
করলো, “ওরে কি রাজ বলছে?” নিশি বলল, “হুম ।” আবির কিছু বলল না । নিজের রুমে ফিরে আসছিলো,
এমন সময় নিশি আবার পিছু ডাকল, “ও আবির শোন, তোর জন্য একটা জিনিস আছে ।” আবির ঘুরে দাঁড়ালো
। জিজ্ঞেস করলো, “কি জিনিস ।” নিশি বলল, “একটু দাঁড়া ।” তারপর নিশি নিজের রুমে যেয়ে
ব্যাগটা খুলে ম্যাথ বই বের করলো । তারপর বইয়ের ভেতর খুজতেই দেখল, কাগজটা ওর ভেতর নেই
। নিশি ভয় পেয়ে গেলো । নিশি আরও ভালো করে ম্যাথ বইটার পেইজ উলটেপালটে দেখতে লাগলো ।
কিন্তু কাগজটা পেলো না । অন্যান্য বইও তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখল, কিন্তু ওই কাগজটা
কোথাও নেই । নিশি ফিরে এসে ভয়ে ভয়ে আবিরকে ফিস ফিস করে বলল, “আবির! রাজেশ নামের ওই
ছেলেটা আমারে একটা কাগজ দিয়ে বলছিল তোরে দিতে, বলছিল আমি যেন খুইলা না দেখি, কাউরে
না দেখাই । কিন্তু এখন আর খুইজা পাইতেছি না । ওটা না পাইলে তোর নাকি অনেক ক্ষতি হবে
।” আবির একটু হেসে বলল, “আচ্ছা, চিন্তা করিস না । কিচ্ছু হবে না । তুই রেডি হ ।” নিশি
আচ্ছা বলে ভেতরে নিজের রুমে চলে গেলো । আবির বাসায় ফিরে দরজা লাগিয়ে শিমুলের রুমের
দিকে যাচ্ছিলো, এমন সময় শিমুলই দরজা খুলে বাইরে এলো । হাতে একটা কাগজ । আবিরকে দেখে
বলল, “এইতো আবির, এলি কখন?” আবির বলল, “এইতো মামা, মাত্র আইলাম ।” শিমুল তখন হাতের
কাগজটা আবিরের দিকে ধরে বলল, “ধরতো, কেউ মনে হয় তোরে এই ফালতু জোকস পাঠাইছে ।” আবির
কাগজটা হাতে নিয়ে একটু হেসে বলল, “তাই নাকি! তা পেলি কোথায়?” শিমুল বলল, “নিশিরে দেখলাম
রাজেশ দিলো । তা আমিও ইয়ার্কি কইরা আমার সাডেন টেস্টের কাগজটা ওর ব্যাগে রাইখা এই কাগজটা
বাইর কইরা নিছি । বাট কিছু বুঝতে পারি নাই এইডা পইড়া ।” মানে তখন যে নিশির ব্যাগে টানটা
লেগেছিলো ওটা শিমুলই দিয়েছিলো । নিশির ব্যাগ থেকে কাগজটা বের করার সময় টান লেগে গিয়েছিলো
। আবির প্রথমে এমনটা করার জন্য রাগ করতে যাচ্ছিলো, কিন্তু পরক্ষনেই বলল, “ভালো করেছিস
।” প্রশংসা করার কারণ এখন যদি শিমুল কাগজটা না নিতো, নিশির ব্যাগ থেকে কাগজটা হারিয়ে
যেতো । আর পড়ে আবির সেটা পেত না । আবির শিমুলকে বলল, “তুই নাকি নাবিলার ওইখানে যাবি?”
শিমুল বলল, “হ, এইতো এখন রেডি হমু ।” আবির বলল, “আচ্ছা যা, রেডি হ । নিশি তোর জন্য
বইসা আছে ।” শিমুল, “ওকে ব্রো ।” বলে রুমে চলে গেলো । আবিরও নিজের রুমে এসে দরজা আটকে
দিয়ে কাগজটা ভালো করে পড়লো । ওতে লেখা, “ইন্সপেক্টর ভুল, আপনি যে কেইসটা আমরা যে কেইসটা
সল্ভ করছিলাম, এবারের মতো সেই কেইস ফাইলটা বন্ধ থাক । আগামী বছর জানুয়ারিতে সেটা আবার
খোলা হবে । জুতা মাইন্ড করবে না কিন্তু । রঙের কাজ আবার হবে ।” নিচে ছোট করে ব্রাকেটে
লেখা আবির । এটা দেখেই হয়তো শিমুল বুঝেছে এটা আবিরের চিঠি । আবির চিঠিটা বুঝল । ভুল
এর ইংরেজি wrong, এই ইংরেজি wrong কে বাংলা করলে হয় রঙ যার সমার্থক আবির । আর এখানে জুতা ইংরেজি সু আর মাইন্ড
বাংলা মন মানে চিঠিটা সুমন স্যার এর । সুমন স্যার এখন এই রাশেদ স্যার, রাকেশ নারায়ণের
ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি করতে মানা করেছে আর বলেছে
আগামী জানুয়ারিতে আবার সব শুরু হবে । আবিরের মনে তিনটে প্রশ্ন জাগলো প্রথম প্রশ্ন
স্যার হঠাৎ মানা করলো কেন ইনভেস্টিগেশন করতে?
দ্বিতীয় প্রশ্ন সুমন স্যার এর চিঠি ভিলেন রাকেশ নারায়ণের ভাই রাজেশ নারায়ণের হাত থেকে
কেন এলো? তৃতীয় প্রশ্ন নিশির কাছ থেকে খুব সম্ভবত কেউ এই চিঠিটা নিতে চেয়েছিল ভুলে
নিয়ে গেছে শিমুলের সাডেন টেস্টের কাগজ । কিন্তু কে নিতে চাইবে? ওই রুমে নিশি ছাড়া আর
একজনই তো আছে । সে হল নতুন মেয়ে রিতু ।
মাগরিবের নামায শেষে আবির
হোস্টেলের দিকে আসবার সময় আবির আবারও পাপলু আঙ্কেলের রিসিপশন রুমের সামনে আগেরদিনের
কায়দায় কাগজটা নিলো । কাগজ নিয়ে সোজা একাই চলে গেলো মাঠের মাঝখানে । সেখানে লেখা,
“আমি জানি ইন্সপেক্টর ভুল, আপনি অনেক আসামিকে ধরে মনের মাঝে পুশে রেখেছেন । আমি আপনার
আসামিগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই ।” আসামি বলতে সুমন স্যার এখানে সকালে আবিরের পাওয়া
কাগজের লেখা পড়ে আবিরের মনে জাগা প্রশ্নগুলো বোঝানো হয়েছে । আবির কাগজ পড়লো, “আমি সন্দেহে
আছি, টকুরচি আপনার হাতে পৌঁছেছে কিনা তা নিয়ে । কারণ ওটা পাঠাতে আমাকে অনেক ভুগতে হয়েছে
।” টকুরচি উল্টো করলে হয় চিরকুট । এই লেখার পরই সুমন স্যার সকালের চিঠি আবার লিখেছেন
। তারপর লেখা, “আপনার সবচেয়ে বড় আসামি, আপনার কেসটা কেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেই আসামি,
আসলে প্রধান আসামির প্ল্যান অনুযায়ী চলতে হলে আমাদের এই উপায় অবলম্বন করতেই হবে । আপনার
দ্বিতীয় যে আসামি আমি কেন আপনাকে মেয়ে বানানো ছেলেটাকে দিয়ে আপনাকে কাগজ দিলাম । ওর
কথা আপনি নিজেই এক সময় জানতে পারবেন । কিন্তু খবরদার, এ আপনার সাথে যাই ভালো কাজ করুক,
আপনি কাউকে তা বলবেন না । আপনার তৃতীয় আসামি, ওই টকুরচির এতো গোপনীয়তা সত্ত্বেও কেন
আপনার নাম লিখলাম ।” আবিরের মনে এই প্রশ্ন না জাগলেও ব্যাপারটা যে ভাববার বিষয় ছিল
তা এখন বুঝল আবির । “আসলে ওর গায়ে আমি আবির লিখিনি, লিখেছে আপনাকে মেয়ে বানানো ছেলেটা
। আমি পড়ে জানতে পেরেছি কিন্তু ওকে এই ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছি । আশা করি সব জবাব
পেয়ে গেছেন? এবার এই আসামিদের বের করে দিন, এবং সাবধানে থাকুন । আরেকটা কথা, চাঁদরি
এর চাঁদ গেলে মুরগী মা হতে যা দেয় তা কিন্তু মোটেও সুবিধের নয় । খুব সাবধান!” শেষ কথাটা
আবিরের বোধগম্য হল না । তবে দুটো প্রশ্নের জবাব পেলেও একটা প্রশ্নের জবাবও কিন্তু আবির
পেলো না । চিঠিটা আসলে কে নিয়েছে?
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই আসেপাশের
দোকানেই পাবি………গতকাল আমিও খিচুরিই খেয়েছিলাম । আর নাবিলার কি অবস্থা?............ও,
আচ্ছা । আচ্ছা, থাক তাহলে । আচ্ছা, ভালো থাকিস ।” এশার নামাজ পড়ে এসে ছাদে দাড়িয়ে শিমুলের
সাথে কথা বলছিলো আবির । খোঁজ খবর নিচ্ছিলো, আর খাওয়া দাওয়ার জন্যও বলছিলো দোকানে খোঁজ
করতে । আজকে আকাশে তারা তেমন দেখা যাচ্ছে না । চাঁদটাও মেঘের আড়ালে যেন লুকোচুরি খেলছে
। ঠাণ্ডা হাওয়া ছেড়েছে । দুপুরে রাজ এসেছিলো
কিন্তু আবির কোন কথা বলে নি ওর সাথে । এই যে এশার নামায পড়ে এলো, এখনও আবির অন্যান্য
দিনের মতো রাজের সাথে যায় নি । রাজ যদিও অনেকবার আবিরের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো, কিন্তু
আবির ওকে সুযোগ দেয় নি । দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ছিল আবির । এমন সময় রাজ এসে
পেছন থেকে আবিরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, “ভাই সরি রে! মাফ করে দে আমারে!
আমি তোর কাছে মাফ চাইতেছি! প্লিজ ভাই……! আমার সাথে কথা বল! প্লিজ! তুই এমন……।” আবির
রাজকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিলো । আবির সেখান থেকে চলে আসতে যাবে,
পথ আটকে আবিরের দিকে চেয়ে বলল, “তোরে সরি বললাম তো দোস্ত! মাফ কর! প্লিজ!” আবির বলল,
“আমি কারো ওপর রাগ করি না, সো এখানে মাফ করারও কোন প্রশ্ন আসে না ।” আবির চলে আসতে
লাগলো । রাজ একবার “আবির!” বলে ডেকেছিলো, কিন্তু আবির পেছন ফিরে তাকায় নি । আবির যখন
সিরিঘরের দরজার কাছে, তখন রাজ বলে উঠলো, “ছাদ থেকে লাফ দিলে খুশি হবি?” আবির এবার দাড়িয়ে
গেলো । পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো, রাজ ছাদের
রেলিঙের ওপর দাড়িয়ে, চিকন্ন রেলিঙের ওপর ভারসাম্য ঠিক মতো রাখতে পারছে না, যেকোনো সময় পড়ে যাবে! আবির ভয় পেয়ে
তাড়াতাড়ি করে দিলো এক দৌড় । আরেকটু হলে রাজ পড়ে যাবে, এমন সময় আবির সেখানে যেয়ে রাজের
হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দেয় । রাজ পড়ে যায় একপাশে, আবির পড়ে যায় আরেক পাশে । তারপর দুজনেই
উঠে দাঁড়াতেই আবির রাজের গালে কষে একটা চড় মারে । তারপর ক্ষিপ্ত গলায় বলে, “পাগল হইছিস
নাকি তোরা? রাজ কোন কথা বলল না । কিন্তু কষ্ট পেলো না । বরং আবিরের কথা শুনে যেন ওর
ভালোই লাগছে । আবির বলল, “এক জন গলায় দড়ি দিয়ে কোনোরকমে বেঁচে গেছে, এখন আরেকজন ছাদ
থেকে লাফ দিতে চায় । মানে পাপের সাথে মরার খুব শখ না?” রাজ আবিরের দিকে তাকাল । ঠোঁটের
কোণে হাসি ফুটে উঠলো । আবিরের গলা একটু পরিবর্তন হল । করুণার স্বরে বলল, “চাইলেই এতো
সহজে সবাইকে ভোলা যায় না দোস্ত । যেমন তুই, আর চাইলেও অনেক মানুষকে খুব সহজে ভোলা যায়,
যেমন নাবিলা । ও যে দোষটা করেছে, সেটা কেউই ভুলতে পারবে না । তোরা বলিস আমার জেদ বেশি
। কিন্তু আমার জেদের চেয়ে নাবিলার জেদ আরও অনেক বেশি । মেয়েদের ন্যাকামো সবাই পছন্দ
করে এটা আমাকে বোঝাতে ও তোকে ভালোবেসেছে । বন্ধুত্ব আর প্রেমের মাঝে প্রেম বেশি গুরুত্বপূর্ণ
এটা বোঝাতে ও তোকে মারতে গুন্ডা লাগিয়েছে । ওর এই প্রমান করতেই হবে এটা কি জেদ না?” রাজ কিছু বলল না । আবিরও চুপ হয়ে গেলো । আবির ছাদের
রেলিঙের ওপর হাত রেখে দাঁড়ালো । রাজও দাঁড়ালো । কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ । শুধু বাতাস,
আর আশেপাশে ঝিঝি পোকার শব্দ । সাথে কিছুটা দুর থেকে ভেসে আসা যান্ত্রিক শহরের শব্দ
। রাজ হঠাৎ করে গেয়ে উঠলো,
“সেই যে হলুদ পাখি, বসে জামরুল
গাছের ডালে………” থেমে গেলো রাজ । ভেবেছিলো আবিরও হয়তো গাবে । রাজ আবিরের দিকে তাকাল
। তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে নিয়েই গাইতে যাবে, এমন সময় আবির গেয়ে উঠলো,
“করতো ডাকাডাকি, আমার শৈশবের
সকালে ।” তারপর দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল । এবার দুজন একসাথেই সুর ধরল,
“সেই যে হলুদ পাখি, বসে জামরুল
গাছের ডালে,
করতো ডাকাডাকি আমার শৈশবের
সকালে,
সেই যে হলুদ পাখি বসে জামরুল
গাছের ডালে,
করতো ডাকাডাকি, আমার শৈশবের
সকালে,
একদিন গেলো দূরে, জানি না
কোন সুদূরে,
ফিরবে না, সেকি ফিরবে না?
ফিরবে না আর কোনোদিন,
ফিরবে না সেকি ফিরবে না?
ফিরবে না আর কোনোদিন?”
গান শেষে আবার দুজনে চুপ
। রাজ নিজের বা কাঁধে ডান হাত দিয়ে ডলতে ডলতে বলল, “উফ! কি যে ব্যাথা করতেছে! বুঝতেছি
না ক্যান!” আবির বলল, “গতকাল জিম করছিলি?” রাজ কারণ বুঝতে পেরে বলল, “হ রে, করতে করতে
অভ্যস্ত তো, একদিনে না করলেও ব্যাথা শুরু হইয়া যায় । যাবি?” “চল যাই ।” আবির আর রাজ
শারীরিক শিক্ষা ল্যাবে গেলো ।
(৫)
“আচ্ছা নিশি, মানুষ মাত্রই
তো ভুল করে তাই না?” নাবিলার পাশে নাবিলার হাত ধরে একটা টুলের ওপর বসেছিল নিশি সেই
সময়েই নিশিকে কথাটি বলল নাবিলা । নিশি উপর নিচ মাথা নাড়ল । নাবিলা কিছুক্ষণ চুপ করে
রইল নিশি একবার পেছন ফিরে দরজার দিকে তাকাল । শিমুল বাইরে গিয়েছিলো খাবার আনতে, এসেছে
কি না সেটা একবার দেখল আর কি । আসলে অবশ্য শিমুল ডাকতো নিশিকে, তবুও নিশি একটু দেখে
নিলো আর কি । তারপর নিশি নাবিলাকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, তুই কেন এরকম একটা স্টেপ নিলি?”
নাবিলা নিশির দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন? রাজ আর আবির তোদের কিছু বলে নি?” “কই না তো?” নাবিলা আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল । তারপর বলল, “সেদিন
ছাদে আমি……।” এরপর পুরো ঘটনা নিশিকে বলল নাবিলা । পুরো ঘটনা শুনে নিশি অবাক হয়ে বলল,
“এসব তুই কি বলছিস!” নাবিলা উপর নিচ মাথা নেড়ে বলল, “হুম । এতোটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিলাম
আমি । কিন্তু……।” কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলো নাবিলা কিন্তু থেমে গেলো । নাবিলা থেকে যাওয়ায়
নিশিই প্রশ্ন করলো, “কিন্তু কি?” নাবিলা ডানে বামে মাথা নাড়ল । বলল, “না, কিছু না ।”
নিশি কিন্তু মনে মনে বেশ কষ্ট পেলো নাবিলার এই কুকর্মের জন্য । কিন্তু এই অবস্থায় কি
কিছু বলা যায়? পেছন থেকে তখন ডাক শুনল নিশি । শিমুল ডেকে উঠলো, “নিশি!” নিশি উঠে দাড়িয়ে
রুমের দরজাটা চাপিয়ে দিলো । তারপর শিমুলের সামনে এসে দাঁড়ালো । শিমুলের হাতে দুটো খিচুরির
প্যাকেট । “নে ধর”- নিশির দিকে একটা খাবারের প্যাকেট এগিয়ে ধরে কথাটি বলল শিমুল ।
স্মিথ মেশিনের ভারি পাথর
লাগানো দন্ডটা ধরে ব্যায়াম করছিলো রাজ । আবির পাশেই বসে মাগরিবের সময় সুমন স্যার এর দেয়া
কাগজটা দেখছিলো । কাগজটা নিয়ে রাজকে কিছু বলছে না আবির । বলা যায় না, কেউ যদি আবার
ফলো করে? রাজ মাঝে মাঝে নানা কথা বলছিল, কিন্তু
আবির “হুম” ছাড়া বেশি কিছু বলছিল না । রাজ বলল, “আজকে বুঝলি, মাগরিবের নামাজে একটা ভুদাই পোলার লগে দেখা
হইছিল, পোলায় আইসা কয়, বাইয়া বাইয়া আপনে কি খাইয়া এইরকম বডি বানাইছেন, আমি ইয়ার্কি
কইরা কইলাম, করলার জুস খাইছি । তুমিও খাইও ।” বলেই রাজ হেসে দিলো । আবিরের একই জবাব,
“হুম ।” রাজ আবারও বলল, “আইজকা আসার সময় এক পাগলের লগে দেখা । সেই পাগল নাকি ভবিষ্যৎ
কইতে পারে । পাগল আমারে কয় কি, তোমার এক বন্ধুর নাম কও । আমি কইলাম আবির । পাগল কয়,
তোমার বন্ধু বির । আমি জিজ্ঞেস করলাম, ক্যামনে? পাগল কয় আবিরের আ গেলে বির-ই তো থাকে
। কেমন আজিব ভবিষ্যৎ বাণী তাইনা?” রাজ আবারো হাসল । আবির কিন্তু এবার আর হুম আওয়াজ
করলো না । জিজ্ঞেস করলো, “মুরগী মা হতে কি দেয় রে?” রাজ পাথর লাগানো দন্ডটা তুলতে যাচ্ছিলো,
আবিরের প্রশ্ন শুনে নামিয়ে দিলো । অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এ আবার কেমন প্রশ্ন?” আবির
বলল, “আহা, বল না!” রাজ একটু ভেবে বলল, “উমম,
কি আর দেবে, মোরগরে সময় দেয় ।” আবির বিরক্ত হয়ে বলল, “তোর মনে এইসবই আইবো ।
আর কি দেয়?” “ডিম দেয় । আর কি?” আবির বলল, “ডিমে কি দেয়?” রাজ বলল, “কি আর দেবে, তা
দেয় ।” আবির হঠাৎ দাড়িয়ে বলল, “চল, আমরাও একটু তা দিয়ে আসি । বলে বাইরে চলে গেলো ।
রাজ উঠে চেয়ারের ওপর গেঞ্জিটা গায়ে দিয়ে রুমে ফ্যান লাইট সব অফ করে দরজা আটকে আবিরের
দিকে গেলো । আবির মাঠের মাঝখানে চলে গেলো । তারপর রাজ এসে বসে বলল, “কিরে? হয়েছেটা
কি?’ আবির সবটা খুলে বলল, “আজকে সন্ধায় সুমন স্যার এর একটা চিঠি পাইছি । তাতে অনেক
কিছুই লেখা ছিল, তবে শেষে একটা সতর্কবার্তা লেখা ছিল । এটা ছিল এমন, চাঁদরির চাঁদ গেলে
মুরগী মা হতে যা দেয় তা কিন্তু সুবিধের নয় । আমি এই ধাঁধাঁটা প্রথমে ঠিক বুঝতে পারিনি
। এবার বুঝলাম ।” রাজ তখন বলল, “আবিরের আ গেলে বির হয়, তেমনি চাঁদরির চাঁদ গেলে রি
হয়, তাই না?’ আবির উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলল, “হুম । আর মুরগী মা হওয়ার জন্য ডিমে তা
দেয় । তাহলে ধাঁধাঁর সমাধান কি দাঁড়ালো?” রাজ জবাব দিলো, “রিতা!” মানে নতুন মেয়েটা!”
আবির আবার চিন্তায় ডুবে গেলো । রাজ বলল, “কিন্তু ওই মেয়েটা আমাদের জন্য কেন ক্ষতিকর?”
আবির বলল, “দ্যাখ, আমি সেটা বলতে পারি না, তবে আজ সকালে স্যার আমাকে একটা চিঠি দিয়েছিলেন
রাজেশের মাধ্যমে, রাজেশ দিছিল নিশির কাছে, ইয়ার্কি করে ওইটা শিমুল নিয়া ওই জায়গায় রাখছিল
ওর সাডেন টেস্টের কাগজ ।” রাজ প্রশ্ন করলো, “কার নিশির না শিমুলের?’ “আরে, শিমুল নিজের
টেস্টের কাগজ রাখছিল । পড়ে নিশির ব্যাগ থেকে ওই সাডেন টেস্টের কাগজ চুরি হয়ে যায় কিন্তু
শিমুল আগে থেকেই কাগজ নিয়েছিলো বলে আমরা এ যাত্রায় রক্ষা পাই । মানে শিমুল যদি ইয়ার্কিটা না করতো, তাইলে ওই আসল কাগজ চোরের
কাছে যেতো ।” রাজ বলল, “ওই রুমে নিশি ছাড়াও রিতাও তো ছিল, তাই না?’ আবির উপর নিচ মাথা
নাড়ল । বলল, “হুম ।”
খেতে নিশি শিমুলকে নাবিলার মুখে শোনা কথাগুলো বলছিল । শিমুল বলল, “আমার তো মনে হয় আবির না, জেদ বেশি নাবিলারই ।” নিশি হঠাৎ
করে ভ্রুকুঁচকে শিমুলের দিকে তাকিয়ে হালকা ধমকের স্বরে ফিসফিস করে বলল, “আস্তে কথা
বল! ভেতরে ও শুনতে পাবে না!” শিমুল কিছু বলল না । একটু পর বলল, “আমার সাডের টেস্টের
খাতাটা দেখেছিস?” নিশি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিসের খাতা?” শিমুল বলল, “আরে, সকালে
রাজেশ নামের ছেলেটা তোকে যে কাগজ দিলো, ওই কাগজটা আমি ইয়ার্কি করে নিয়ে ওর জায়গায় আমার
সাডেন টেস্টের কাগজটা রেখেছি ।” নিশি রেগে শিমুলের দিকে তাকিয়ে উচু গলায় বলল, “তার
মানে তুই ওটা নিছোস!” শিমুল হেসে বলল, আরে চিন্তা করিস না, ওটা আবিরকে দেবার ছিল, আমি
আবিরকে দিয়ে দিয়েছি ।” কথাটা শুনে নিশির রাগ কিছুটা কমলো । কিন্তু পরক্ষনেই অবাক হয়ে
গেলো । তাহলে সাডেন টেস্টের কাগজটাই বা কে নিতে যাবে?”
“চল এবার রুমে যাই ।” বলে আবির উঠে দাঁড়ালো । রাজও
উঠে দাঁড়ালো । হঠাৎ করে রাজের মনটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে উঠলো । আবির জিজ্ঞেস করলো, “কিরে?
মন খারাপ হয়ে গেলো কেন তোর?” রাজ জবাব দিলো, “হঠাৎ করে নাবিলার কথা খুব মনে পড়ছে ।”
আবির বলল, “চিন্তা করিস না, কালই তো মনে হয় ছেড়ে দেবে ।” রাজ এরপর একটু সিরিয়াস হয়ে
বলল, “আচ্ছা, আজকে কিন্তু নিশি আর নাবিলা দুজনেই হসপিটালে ।” আবির প্রশ্ন করলো, “হ্যাঁ
তো!” রাজ বলল, “ওই বাসায় কিন্তু মেয়েরা একা আছে!” আবির দাড়িয়ে গেলো । রাজ একটু থেমে
বলল, “তার ওপর নাবিলার ডাইরিটাও কিন্তু ওর রুমে আছে ।” আবির রাজের দিকে তাকাল একবার
।
“কিরে কি অবস্থা?” পরশের রুমে ঢুকেই কথাটা বলল
জামি । পরশ পড়ছিল । বইটা বন্ধ করে ঘুরে বসে বলল, “আরে! মোটু যে! আয় বস ।” জামি এসে
বিছানার ওপর বসলো ।” জামি বলল, “ভাল্লাগতেছে না রে, রুমে আবিরও নাই, শিমুলটাও গেছে
নাবিলার কাছে । একা একা আর ভাল্লাগতেছিল না, তাই কথা কইতে আইলাম আর কি ।” পরশ বলল,
“হ রে, রাজও গেছে গা আবিরের লগে । কি যে করে ওরা আল্লাহই জানেন ।” “এই তুই রাজেশ নারায়ণ
রাকেশ নারায়ণ এইসব নাম শুনছোস কি?” পরশ হেসে উঠলো । বলল, “এ আবার কেমন নাম?” জামি এমন
একটা ভাব নিলো, যেন ও কি না কি বলেছে । তারপর বলল, “ওইতো ভায়া! বুঝতে হয়! তুই ক্যামনে
বুঝবি!” পরশ জিজ্ঞেস করলো, “তা তুই এইসব না দিয়া করোছ কি?” জামি মাথা নেড়ে বলল, “আরে
আমি না, আবির কি জানি করতেছে । ক্লাসে প্রায়ই দেহি ওরা এইসব নিয়া কি হালকা পাতলা কথাবার্তা কয় । ওরা যদিও এমনভাবে কয় যেন কেউ না
শোনে, কিন্তু আমি লুকায় লুকায় শুনি ।” পরশ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় মনে হল
ওপরের রুমে কি যেন ভারি কিছু একটা পড়ে গেলো । ঠিক মাথার ওপরে যে রুমটা আছে, সেই রুমটা
থেকে । জামি আর পরশ দুজনেই ওপরের দিকে তাকাল । তারপর পরশ জামির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই
না কইলি রুমে কেউ নাই?” জামিও ওপর থেকে চোখ সরিয়ে পরশের দিকে তাকিয়ে বলল, “হ তাই তো!”
পরশ জিজ্ঞেস করলো, “তুই তালা লাগাস নাই!” “তালা লাগানোর দরকার পড়ে না! লাগামু ক্যান!”
পরশ বলল, “চল দেইখা আসি!” জামি আর পরশ তাড়াতাড়ি করে ওপরে চলে গেলো । কিন্তু ছিটকিনি
আটকানোই আছে! তাহলে শব্দটা এলো কোথা থেকে! পরশ বলল, “দরজাটা খোল!” জামি দরজা খুলল ।
জামি আর পরশ ভেতরে ঢুকল, যে রুম থেকে শব্দটা এসেছে, পরশের রুমের ঠিক ওপরের রুম অর্থাৎ
আবিরের রুমে সেই রুমের ছিটকিনি খুলে ভেতরে ঢুকল ওরা দুজন । না, এখানেও তো কিছু পড়ে
গেছে বলে মনে হচ্ছে না । ওরা ছিটকিনি আটকে দিলো । আবির নেই, ওর রুমে ঢোকা ঠিক হবে না
। বাইরে বেড়িয়ে আবার ছিটকিনি আটকে দিলো । পরশ জিজ্ঞেস করলো, “তাহলে কিসের শব্দ ছিল?”
জামি বলল, “আমি ক্যামনে কমু!” “ছাদ থেইকা আইছে নাকি!”-জিজ্ঞেস করলো পরশ । এমন সময় সিঁড়ি
দিয়ে উঠে এলো আবির আর রাজ । পরশ আর জামির চেহারা দেখেই বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে
। আবির জিজ্ঞেস করলো, “কিরে? কি হয়েছে?” পরশ জবাব দিলো, “আরে কইছ না, তোর রুম থেইকা
কি একটা পইড়া যাওয়ার আওয়াজ হইলে ।” আবির একবার মেয়েদের বাসার দরজার দিকে তাকাল । ছিটকিনি
দেয়া । তারপর নিজেদের বাসার ঢুকে নিজের রুমের ভেতরে ঢুকল আবির । সাথে
জামি, পরশ আর রাজও ঢুকল । আবির চারপাশটা ভালো করে দেখল । আবিরের পড়ার টেবিলের খানিকটা
সামনে হালকা পানি এমনভাবে ছিল কেউ পা পিছলে পড়ে গেলে যেরকমটা হয় সেরকম । তবে এখন দাগটা
অনেক হালকা হয়ে গেছে । তারপর আবির জামির দিকে তাকিয়ে ইয়ার্কির স্বরে বলল, বোধ হয় ভুত
এসেছিলো ।” জামি হালকা কেপে উঠলো । ছেলে আবার ভুতে ভারি ভয়
পায় । তার ওপর আজকে বাসায় লোক একজন কম ।
ওর ধারণা,বাসায় লোকসংখ্যা যতো বেশি,
ভুতের উপদ্রব হওয়ার সম্ভাবনা ততো কম । জামি
কাপা গলায় বলল, “কইছ না ভাই! ভয় করে!”
আবির বলল, আচ্ছা দোস্ত, তাইলে যা তোরা, আজকে সারাদিন কিচ্ছু পড়া হয় নাই । গতকাল তো
আরও পড়া মিস গেছে!” সবাই আবিরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে গেলো । জামি পরশের সাথে আড্ডা
দেবে বলে পরশের রুমে গেলো । আবির ওদের এগিয়ে দেয়ার জন্য দরজায় দাড়িয়ে ছিল । সিঁড়ি দিয়ে
নামতে নামতে যতক্ষণ ওদের দেখা যায় ততোক্ষণ দাড়িয়ে ছিল । এমন সময় আবির দেখল, একটা মেয়ে
উঠে আসছে । তিন তোলা আর চারতলার মাঝে দুই সিঁড়ি মাঝখানে এসে ঘুরে দাড়িয়ে আবিরকে দেখেই
মেয়েটা হালকা চমকে উঠলো । মেয়েটা আবিরকে বুঝতে না দিলেও আবির কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারলো,
মেয়েটা ইতস্তত বোধ করছে । মেয়েটা সিঁড়ি দিয়ে চারতলায় উঠে এলো । আবির কিন্তু এখনও দরজায়
দাড়িয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে । মেয়েটার হাতে এক প্যাকেট ওষুধ । প্যারাসিটামল । মেয়েটা
ওদের বাসার দরজা খুলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় আবির বলে উঠলো, “আমার রুমে তুমিই এসেছিলে,
তাই না?”
পরদিন সকালের কথা । ৪মে সোমবার । টিচার্স রুমে
সুমন স্যার কিছু খাতা দেখছিল, সে সময় পাশে এসে বসলো বকর স্যার বলল, “কিরে, কি অবস্থা!”
বকর স্যারকে দেখে সুমন স্যারের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা গেলো । হ্যান্ডশেক করবার উদ্দেশ্যে
হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এইতো দোস্ত, চলে যায় দিনকাল ।” বকর স্যার হ্যান্ডশেক করলো ।
তারপর সুমন স্যারই আবার জিজ্ঞেস করলো, “তোর খাতা দেখা হল?” বকর স্যার হালকা রাগ করে
বলল, “এ! খাতা দেখার কথা আর বলিস না! কষ্ট লাগে! আমার খাতা দেখার যা হাল! তার ওপর এতো
স্টুডেন্ট বাপরে!” সুমন স্যার হেসে বলল, “বাহ! কি কথা । একজন টিচার হয়ে এসব কথা কি
মানায় !” বকর স্যার জবাব দিলো, “একজন টিচার হয়ে জেলখানায় যাওয়াটা বুঝি খুব মানায়!”
সুমন স্যার বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে বকর স্যার এর দিকে তাকাল । এরপর বকর স্যার হো হো করে
অট্টহাসি হেসে বলল, “আরে বাবা রাগ করিস কেন? না, গতকাল তোকে দেখালাম জেলখানা থেকে বেরোতে
। তা হঠাৎ জেলখানায় কেন?” এতক্ষণে সুমন স্যার এর চেহারা স্বাভাবিক হল । তারপর বলল,
“আর বলিস না, আমার এক কাজিন মাদক পাচারকারিদের সাথে পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে, অথচ ও
কখনোই মাদক পাচার করে নি । আসলে যারা মাদক পাচার করতো তাদের কয়েকজন ওর বন্ধু ছিল ।
এখন বন্ধুরাতো আর ওকে বলে বেড়ায় নি যে ওরা মাদক পাচার করে, তাই বন্ধুত্ব ভাঙ্গেও নি
। কিন্তু পুলিশ আবার একেও নিয়ে গেছে হয়তো কোন যোগসূত্র আছে এই ভেবে । তাই ওকে ছাড়ানোর
প্রচেষ্টায় আছি আরকি ।” বকর স্যার “ও” বলে উঠলো । এমন সময় আবির এসে ভেতরে ঢুকল । বকর
স্যার এর পাশেই দাঁড়ালো, আবির দুজনকে সালাম জানালো । সুমন স্যার বলল, “আরে, আবির যে,
হঠাৎ আমার কাছে!” আবির বলল, “না স্যার, একটু কথা ছিল ।” এমন সময় হঠাৎ বকর স্যার এর
হাতের ধাক্কায় টেবিলের ওপর থাকা একটা কলম পড়ে গেলো । বকর স্যার এরই পায়ের কাছে । বকর
স্যার তুলবার আগেই আবির সম্মানার্থে উপুড় হয়ে কলমটা তুলতে গেলো, কিন্তু কি একটা দেখে
থমকে গেলো । বেশ অনেকক্ষণ ধরেই আবিরকে উপর হয়ে থাকতে দেখে সুমন স্যার ইয়ার্কির ছলে
জিজ্ঞেস করলো, “কি ব্যাপার আবির! নিচে সোনা পেলে নাকি!” বলে সুমন স্যার হেসে উঠলো । বকর স্যারও হালকা হাসল । আবির কলমটা দেখতে দেখতে উঠে
দাঁড়ালো । তারপর বলল, “না স্যার, আসলে কলমটা খুব সুন্দর তো, তাই ।” বলে আবির কলমটা
আবার টেবিলের ওপর রেখে দিলো । বকর স্যার উঠে দাড়িয়ে
সুমন স্যারকে বলল, “আচ্ছা, তোরা কথা বল, আমি তাহলে যাই!” সুমন স্যার বলল, “আচ্ছা বন্ধু!
যা তাহলে ।” বকর স্যার চলে গেলো । আশে
পাশে আর কোন টিচার ছিল না, সবাই ক্লাস নেয়ার জন্য ক্লাসরুমে
ছিল । আবির সুমন স্যারকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই সুমন স্যার হাসিমুখেই বলল, “আমি বলেছিলাম
তো, যা হবে সব কাগজে কলমে, এভাবে না!” আবিরও হাসিমুখে বলল, “কিন্তু স্যার, ইমারজেন্সি
বলেও তো একটা শব্দ ডিকশনারিতে আছে, তাই না?” সুমন স্যার কিছুক্ষণ ভাবল । তারপর নড়েচড়ে
বসে জিজ্ঞেস করলো, “হুম বলো ।” একটু দুরেই একটা স্যার খাচ্ছিল, আর খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে
এদিকেই তাকাচ্ছিল । সেটা খেয়াল করলো আবির । তার গোপনেই বলল, “আসলে স্যার, আমার চাকুরিদিনের
সাথে একটু দেখা করা দরকার । জীবনের বিজয় নিশান ওড়াতে হবে যে । সুমন স্যার বুঝল আবিরের
গোপন ঈশারা । চাকুরি ইংরেজি জব আর দিনের ইংরেজি বার, মিলে হয় জব্বার আর পরের বাক্যে
তো সরাসরি নিশান শব্দটাই বলেছে । মানে আবির বোঝাতে চাইছে, ও এখনকার মেয়র জব্বার নিশানের
সাথে দেখা করতে চায় । সুমন স্যার বলল, “এটা কি খুব জরুরি!” আবির এক মুহূর্তও না ভেবে
সরাসরি বলল, “জি স্যার!” সুমন স্যার আবিরকে ভালো করে একবার পরোখ করে কাগজে কি একটা
লিখে আবিরের হাতে দিয়ে বলল, “এটা নাও, তোমাকে যেতে সাহায্য করবে । আর হ্যাঁ, পরিচয়
জানতে চাইলে বলবে তুমি এমনি ম্যাগাজিনে কিছু লিখবে বলে এসেছো, আর কিচ্ছু ভুলেও বলবে
না । নাহলে কিন্তু জবটা হাতছাড়া হয়ে যাবে ।” আবির কাগজটা একবার দেখল । সেখানে কিছুই
নেই, শুধু লেখা, “মান্নাকে দেখে চুপ থাকবে, একটুও মুখ খুলবে না ।” আবির ঠিক বুঝতে না
পারলেও সুমন স্যারকে বুঝতে দিলো না যে আবির বোঝে নি । স্যারকে ধন্যবাদ দিয়ে আবির বাইরে
বেড়িয়ে এলো । তারপর ক্লাসরুমের দিকে আসতে আসতে শব্দটা নিয়ে বার বার ভাবতে লাগলো । মান্না!
এই মান্নাটা আবার কে!
বিকেলে আবির ভালো জামাকাপড় পড়ে পারফিউম মাখছিল,
সে সময় ভেতরে এলো রাজ । আবিরকে ফিটফাট দেখে বলল, “কিরে ভাই? তুই কি কাউরে প্রোপোজ করতে
যাইতেছোস নাকি!” আবির চুলটা ঠিক করতে করতে বলল, “হুম, অনেকটা তাই ব্রো ।” রাজ এসে বলল,
“তা তুই এই পড়ে যাবি! প্রথম দেখাতেই তো ব্রেকআপ । আবির চেহারাটা আয়নায় দেখতে দেখতে
বলল, “তা আর কি পড়বো! মাসে যা টাকা দেয় তাই দিয়েই গত ঈদে কোনোরকমে কিনেছিলাম । বেশি
দামি না । আমাদের কি আর ওতো দামি কেনার সাধ্য আছে?” রাজ আবিরের কাছে এসে আবিরের কাঁধে
হাত রেখে বলল, “দোস্ত, শোন না, আমার একটা ব্লেজার আছে, ওটা পড়, দেখিস, তোরে সেই লাগবে!”
আবির রাজের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “আরে ধুর, মজা করলাম । কোথাও না, এমনি বাইরে যাচ্ছি
।” রাজ বলল, “তাও, পড় না! প্লিজ! তুই তো আমার ভাই! সো আমরা তো শেয়ার করতেই পারি!” আবির
বলল, “যখন লাগবে তোর দেয়া লাগবে না, আমি নিজেই নিমুনে, খুশি!” রাজের ঠোঁটের কোণে একটু
হাসি দেখা গেলো । কিন্তু রাজ যে একটু কষ্টই পেয়েছে, তা আবির বেশ বুঝতে পেরেছে ।
অটো থেকে
নেমে ড্রাইভারকে ভাড়াটা দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো আবির । বিরাট একটা বাড়ি
এই প্রায় ৫০০ মিটার দুর থেকেও দেখা যাচ্ছে
। এ পথটা আবির অটোতেই যেতে পারতো, কিন্তু আবির হেটেই যাচ্ছে । অনেকদিন পর এরকমভাবে
বাইরে এলো আবির । বেশ লাগছে । রাস্তার দু-পাশে দারুণ সব গাছপালা । কয়েকটা আম গাছে এখনো
কিছু আম ঝুলছে । কাঁঠাল গাছগুলোতেও বেশ কাঁঠাল
। চারপাশে কাঁঠালের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে । বেশিরভাগই আম আর কাঁঠাল গাছ হলেও এখানে জাম, বড়ই, পেয়ারা সেগুন,
মেহেগনি গাছ ও আছে । তবে উল্লেখ করার মতো রয়েছে বাঁশঝাড় । গাছের পাশ দিয়েই লোকজনের
বসতি । টিনের বাড়ি । মাটির বাড়ি দেখাই যায় না এখন আর, তার মধ্যে কিছু কিছু ইটের বাড়িও
রয়েছে । আবিরের একটু আফসোস হল, সকাল হলে গ্রামের বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে মাটির চুলোয় রান্না করবার এক দারুন ঘ্রাণ ভেসে আসে, কিন্তু
এখন এই বিকেল বেলায় সেই ঘ্রাণটা তেমন পাওয়া যায় না । বাড়িঘরগুলোর ওপাশেই উঠোন । গরু
ছাগল, হাসমুরগীর ডাক শোনা যাচ্ছে । মাঝে মাঝে কিছু চায়ের দোকানও চোখে পড়ছে কিছুক্ষণ
পর পরই । রাস্তা দিয়ে ভালোই যানবাহন চলে । বেশিরভাগই সাইকেল, তবে তাও মোটরসাইকেল, অটো,
রিকশা চোখে পড়ে । এসব দেখতে দেখতে বাড়িটার কাছাকাছি চলে এলো আবির । বাড়ির চারপাশ ঘিরে বাউন্ডারি দেয়া । সামনে একটা বিরাট বড় মাঠ । আবির
বাউন্ডারির গেইটের কাছে আসতেই গেইটে বসে থাকা এক মাঝ বয়সী দারোয়ান পথ আটকে দাঁড়ালো,
“এ ভাই, যাসসেন কনে?” আবির বলল, “আ, আমি আবির ।” দারোয়ান একটা ভাব নিয়ে বলল, “আবির
না কবির সিং তা দিয়া আমি কি করবান? এই বাড়ি চেনো? কিডা থাকে?” আবির বলল, “জি, জব্বার
নিশান আঙ্কেল থাকে ।” “তুমি কিডা?”- জিজ্ঞেস করলো দারোয়ান । আবির জবাবে বলল, “আমি ভেকুটিয়া
অনাথ আশ্রমের ছাত্র, আমাকে জব্বার আঙ্কেলই তো ডেকেছেন ।” মাঠের মাঝে একটা লোক বছর দশেকের
একটা ছেলের সাথে হাঁটছিল । গেইটের সামনে দারোয়ানকে আবিরের সাথে কথা বলতে দেখে হাঁটতে
হাঁটতে এদিকেই এগিয়ে এলো । দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে ।” দারোয়ান লোকটাকে উদ্দেশ্য করে সম্মানের
সহিত বলল, “স্যার, এই পোলায় আপনের লগে দেখা করতি চায় ।” আবির লোকটার দিকে তাকাল । বুঝল,
এই-ই তাহলে জব্বার নিশান । বয়স প্রায় ২৭ মতো হবে । মুখে দাড়ি, গোঁফ নেই । মাথার মাঝে
চুল নেই, পাশ দিয়ে আর পেছন দিয়ে কিছু চুল এখনও জীবিত আছে কোনোমতে । পড়নে পাঞ্জাবি আর
পায়ের টাখনুর ওপর অবধি পায়জামা । পায়ে চটি । লোকটা বেশ গম্ভীর দেখতে হলেও পোশাক আশাক
আবার সিধেসাদা । নামাজ কালাম পড়ে দেখেই বোঝা
যাচ্ছে । লোকটাকে দেখতে স্কুলের অনেকটা বকর স্যার এর মতোই লাগে । সাথের ছেলেটাকে উদ্দেশ্য
করে জব্বার বলল, “রাজু, যাও, তুমি ভেতরে যাও ।” ছেলেটা ভেতরে যেয়ে মাঠে খেলতে থাকা
আরও কিছু ছেলেমেয়েদের কাছে গেলো । তার জব্বার আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি আবির?”
আবির ওপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলল, “জি ।” জব্বার দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে নরম স্বরেই বলল,
“তোমাকে আমি অনেকবার বলেছি এভাবে কারো সাথে কথা বলবে না, সে হোক আমার পরিচিত বা অপরিচিত
।” দারোয়ান মাথা নিচু করে সরি বলল ।” তারপর জব্বার আবিরকে নিয়ে ভেতরে গেলো । মাঠের
পাশ দিয়ে রাস্তা । প্রায় ১০০ মিটার দূরে বাড়ি । পুরনো ধাঁচের রাজবাড়ির মতো বিরাট একটা
বাড়ি, তবে এখনও যে বাবার ভিটের যত্ন নেয়া হয়
তা দেখেই বোঝা যায় । আবির চারপাশ দেখছিল আর নিজের পরিচয় জব্বারকে দিচ্ছিল ।
জব্বার তখন আবিরকে বলল, “তোমার কথা অনেক শুনেছি তোমাদের প্রিন্সিপ্যাল স্যার এর কাছ
থেকে । তুমিই তো ওই স্কুল বিল্ডিংটা করার জন্য আমাকে বলেছিলে?” আবির উপর নিচ মাথা নেড়ে
বলল, “জি।” তারপর আবির জিজ্ঞেস করলো, “যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস
করতে পারি?” লোকটা মুখে কিছু না বললেও আবিরের দিকে এমনভাবে তাকাল, যেন লোকটা কথা শুনতে
রাজি । আবির জিজ্ঞেস করলো, “আপনার মাধ্যমেই কি ওখানে কারা ভর্তি হবে না হবে সে ব্যাপার
নিয়ন্ত্রিত হয়?” জব্বার আবিরের থেকে চোখ সরিয়ে হতাশার শ্বাস ফেলে বলল, “না । ওটা তোমাদের
স্কুলের প্রিন্সিপাল থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় । তবে আমি চাইলে তখন নাকচ করতে পারতাম । এমনটা
হবে আমি ভাবিনি ।” আবির কিছু বলল না । জব্বার তখন জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা ভালো কথা, তুমি
কি যেন কাজে এসেছিলে?” আবির বলল, “আমি চাইছিলাম আমাদের কলেজের এবার যে ম্যাগাজিন বের
হয়েছে জব্বার বলল, “চলো আগে ভেতরে যাই, তারপর বলি?” আবির বলল, “জি আচ্ছা ।” আবির আর
জব্বার বিরাট বাড়িতে প্রবেশ করলো । ঢুকতেই বেশ বড় একটা করিডোর । করিডোরের দুপাশে শুধু ছবি । পরিবারের ছবি, ভাইবোনদের ছবি । জব্বার
আবিরকে ছবিগুলোর মানুষদের সাথে পরিচয় করাতে লাগলেন । আবির একটা ছবি দেখে দাড়িয়ে গেলো
। একটা ছবিতে পাশাপাশি দাঁড়ানো দুই ভাইকে একই রকম দেখতে লাগছে না? আবির জিজ্ঞেস করলো,
“এই দুই ভাই জমজ?” জব্বার বলল, “হ্যাঁ, এর একটা আমি, অন্যটা আমার ভাই সোবহান আহমেদ
।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “আপনার এই ভাইও কি বাকি ভাই বোনদের চলে গেছে?” জব্বার ওপর নিচ
মাথা নাড়ল । আবির ছবিটা ভালো করে দেখতে লাগলো । বেশ বড় একটা
ফ্রেমেই বাধানো এই ছবিটা । দুটো ৭ বছরের ছেলে একই রকম দেখতে একজন আরেকজনের হাত ধরে
হাসিমুখে দাড়িয়ে । গায়ে হাতা কাটা গেঞ্জি,
আর হাফ প্যান্ট । খালি পায়ে খুব সম্ভবত মাঠে তোলা হয়েছে ছবিটা । আবির জব্বারকে জিজ্ঞেস
করলো, “আচ্ছা, এর মধ্যে আপনি কোনটা আর আপনার ভাই কোনটা?” জব্বার দেখিয়ে দিলো । আবির
সোবহানের পায়ের দিকে নজর দিলো । কেমন একটা দাগ না পায়ে? আবির জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা,
আপনার ভাইয়ের পায়ে কি হয়েছে?” জব্বার বলল, “আসলে অনেক ছোটবেলায় আমার ভাইয়ের পা পুড়ে
গিয়েছিলো, সেই থেকেই আরকি এরকমটা হয়েছে ।” আবির কথা বুঝতে পেরে ওপর নিচ মাথা নাড়ল ।
জব্বার আবিরকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল । ঢুকতেই ড্রইং রুম । বিরাট বড় একটা ড্রইং রুম । ওপরে
একটা ঝাড়বাতি ঝুলছে । জলছে না এখন যদিও । আবিরকে একটা সফায় বসতে দিয়ে জব্বার ঠিক সেই
সোফার ৯০ডিগ্রি কোণে রাখা আরেকটা সোফায় বসে কাকে যেন ডাকল, “এই করিম! কই তুই?” খানিক
পর এক লোক এলো একটা সাধারণ জামা পাজামা পড়ে । মাথায় গামছা বাধা, মুখে দাড়ি, হাতে রান্না
করার চামচ । আবির লোকটাকে দেখে মারাত্মক চমকে গেলো । এ তো রাজেশ না!” ওদের স্কুলের
রাজেশ! এবার আবির বুঝল সুমন স্যার এর সেই মান্না কথার মানে । এতো সেই গানকে ইঙ্গিত
করে, “আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না । Istanbul
গিয়ে Japan Kabul গিয়ে শিখেছি সহজ এই রান্না ।” এখানে আসলে সুমন স্যার বুঝিয়েছিল বাসার
রাধুনীকে দেখে চমকে না উঠতে । তাই আবির আর কিছু বলল না । রাজেশ কিন্তু একবারের জন্যও
আবিরের দিকে তাকাল না । জব্বার রাজেশ ওরফে ছদ্মবেশী করিমকে কিছু চা নাস্তার ব্যাবস্থা
করতে বলল । তারপর আবিরের সাথে কথা বলা শুরু করলো । বলার মতো জানা সেই ইতিহাসই জব্বার
আবিরকে বলল, ছোট বেলায় ভাই বোনেরা, বাড়ি থেকে বিদেশ গিয়েছিলো, উনার বাবা অনেক কষ্টে
অনাথ আশ্রমের বিল্ডিং বানিয়েছিলেন, কিন্তু পড়ে বিদেশ থাকা ছেলেমেয়ে আর টাকা খরচ করতে
মানা করায় লোটা আর স্কুল বিল্ডিংটা বানাতে পারেন নি, মারা যাবার আগে ছোট ছেলে জব্বার
নিশানকে ক্ষমতা দিয়ে যান, আর এই জব্বার নিশানই এই স্কুল বিল্ডিংটা সামলায় । বাকি ছেলেমেয়ে
আর কোন খোঁজ খবর নেয় না । এই । এর বাইরে আর তেমন কোন কাহিনীই জব্বার নিশান বললেন না
। আবির একটু সাহস করে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, রাজেশ নারায়ণটা কে?” জব্বার ভ্রু কুঁচকে
আবিরের দিকে তাকাল । তারপর জিজ্ঞেস করলো, “তুমি এ নাম কি করে জানলে?” আবির বলল, “না,
ইদানীং শুনছি লোকজন বলাবলি করছে । জব্বার একটু বিরক্তভাব প্রকাশ করে বলল, “উফ! আমি
কলিকে বলেছিলাম কাউকে না বলতে । ওই বোধ হয় লোকজনকে বলে বেড়িয়েছে এসব ।” কলি জব্বারের
স্ত্রী । কথার মাঝে আবিরকে বলেছিল । আবির তখন বলল, “কে সে রাজেশ নারায়ণ?” জব্বার বলল,
“একটা শর্তে বলতে পারি, তুমি এসব ম্যাগাজিনে লিখো না ।” আবির সম্মতি জানালো । লোকটা
বলা শুরু করলো । এটাও সেই নাবিলার ডাইরিতে পাওয়া রিতার বলা একই গল্প । উনার এক বোন
খুব জেদি, সব কিছু নিজের করতে চাইতো, এক সময় রাজেশ নামের এক হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করে,
ফলে ওর বাবা ওকে বাড়ি থেকে বিদেয় করে দেয় । এরপর সম্পত্তির ভাগ চেয়েছিল কিন্তু ওর বাবা
দেয় নি । এরপর ওদের আর তেমন কোন খোঁজ ছিল না । আবির জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, অনেকে বলাবলি
করছে ওই রাজেশ নারায়ণ আর তার ভাই রাকেশ নারায়ণ নাকি ফিরে এসেছে?” জব্বার বলল, “তা তো
বলতে পারি না, তবে তোমাদের ওই হোস্টেলের ওই জমিটার জন্য ইদানীং আমাকে কারা যেন হুমকি
দিচ্ছে । তাই আমার মনে হয় ওরা হলেও হতে পারে । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমি ওদের কাউকে
কোনোদিন দেখিনি । এ বাড়ির কেউ কোন দিন দেখে । বাবা দেখছিল, মা দেখেছিলো । কিন্তু বাবা
মা কেউই তো আর বেঁচে নেই ।” আবির আর কথা বাড়াল না ।
(৬)
মাগরিবের নামাজটা আবির স্কুলের পাশের মসজিদেই পড়লো
। নামাজ শেষে ব্বের হয়েই দেখলো রাজ দাড়িয়ে
। আবির কাছে যেয়ে জিজ্ঞেসে করলো, “কিরে? কি অবস্থা?” রাজ বলল, “ভালো দোস্ত । আচ্ছা তুই গিয়েছিলিটা কোথায়?” আবির বলল, “সেইফ
জোনে চল, বলছি ।” সেইফ জোন মানে মাঠের মাঝখান । তারপর দুজনে আশ্রমের দিকে আসতে লাগলো । আবির জিজ্ঞেস করলো,
“নাবিলা এসেছে?” রাজ বলল, “হ্যাঁ, ডাক্তার বলেছে আজ সারাদিন ঘুমোবে । ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে । এখন নিজের রুমে
ঘুমিয়ে আছে ।” আশ্রমের ঢুকে পাপলু আঙ্কেলের কাছে যেয়ে আগের কৌশলে কাগজ পেলো আবির ।
ভেবেছিলো আজ পাবেনা যেহেতু আগের দিন সুমন স্যার বলেছিল আবার জানুয়ারিতে সব কাজ শুরু
হবে । কিন্তু আজও পেয়ে গেলো । চিরকুট পাওয়াতে
আবির আর হোস্টেলে না যেয়ে রাজকে নিয়ে গেলো
মাঠের মাঝখানে । তারপর কাগজটা খুলল । লেখা,
“হ্যালো ভুল, শুরুতেই বলি আজ চিঠি দেবো না বলেছিলাম তবে সঙ্গত কিছু কারণে দিতেই হল । প্রথমত তুমি আজ চাকরি দিনের কাছে গিয়েছিলে, সেখান মান্নার সাথে হয়তো তোমার দেখা হয়েছে । ভয়
পাওয়ার কিছু নেই, মান্না শুধু রান্না
করছে না, খোঁজ খবর নিচ্ছে তদন্ত্যে সহয়তায় । এরপর যা বলতে চাই,
গতকাল কিন্তু বলেছিলাম, তার থেকে সাবধান, তবুও
সে তোমার ঘরে কি করছিলো কাল রাতে? সাবধান হয়ে
যাও । নইলে কিন্তু ঘোর বিপদ । শত্রুর কথায় কান দিতে নেই । ঘরের শত্রু বিভীষণ হইয়ো না
।” আবির এবার অবাক হয়ে গেলো । রাজকে শুনিয়েই বলল, “একি! রিতা গতকাল আমার রুমে এসেছিলো
সুমন স্যার এটা জানলো কি করে!” রাজ জিজ্ঞেস করলো, “রিতা তোর ঘরে এসেছিলো?” আবির ওপর
নিচ মাথা নাড়ল । বলল, “গতকাল তুই আর আমি যখন
এলাম তখন পরশ আর জামি যে আমার রুমে এসেছিলো মনে আছে?” রাজ বলল, “হ্যাঁ আছে, ওরা বলছিল
কি একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ পাইছিলো।” “হুম । আসলে আমার রুমে এসেছিলো রিতা ।” “কি!”-চমকে উঠে বলল রাজ । আবির বলল, “হ্যাঁ । তোরা
চলে যাওয়ার পর পরই ও নিচ থেকে উঠে আসে এবং আমি ওকে ওর রুমে ঢোকার সময় দেখি ওর হাতে প্যারাসিটামল । আসলে ও আমার রুমে পা পিছলে
পড়ে গিয়েছিলো । সে জন্য ওই প্যারাসিটামল আনা । আর ওই পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনেই
পরশ আর জামি ওপরে এসেছিলো ।” রাজ প্রশ্ন করলো, “হ্যাঁ, গতকাল নামার সময় দেখছিলাম ওরে । কি চালাক! আগে ভাগে নাইমা
গেছে যেন কেউ ওরে সন্দেহ না করে । কিন্তু তোর রুমে ওর কি কাজ?” আবির বলল, “শোন তাহলে
। ও যখন বাসায় ঢুকতে যাচ্ছিলো, আমি তখন ওকে বলি, আমার রুমে তুমিই ঢুকেছিলে তাই না?
তারপর………।”
রিতা আবিরের
দিকে এগিয়ে এলো । নিচু গলায় বলল, “জায়গাটা
সেইফ না । যদি আপনি আমাকে ভরসা করেন, আমি কি
ভেতরে আসতে পারি? কিছু কথা ছিল ।” মেয়েটার চাহনি দেখে মনে হচ্ছিলো না ওকে ভরসা করে
ভুল কিছু হবে । অবশ্য যদি না ভালো অভিনেতা হয় । রুমে ঢুকে রিতাকে বিছানায় বসতে দিয়ে
টেবিলের পাশ থেকে চেয়ারটা টেনে রিতার কয়েক হাত সামনে বসলো আবির । রিতা বলল, “শুনুন,
আপনি এতো সহজে আমাকে বিশ্বাস করবেন না আমি জানি । আমি আপনাকে বলবোও না এখনই আমাকে বিশ্বাস
করতে । কিন্তু আপনি তো অনেক বুদ্ধিমান, তাই বলছি, ভুল করবেন না । বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ
করুন ।” আবির বলল, “আচ্ছা, তোমার কেন এমন মনে হয়?” রিতা জবাব দিলো, “সেসব বলা এখনই
যাবে না । শুধু কাল স্কুলে যেয়ে একটা ব্যাপার খেয়াল করবেন । আপনার স্যার কে যেয়ে একবার
বলবেন আপনি জব্বার নিশানের সাথে দেখা করতে চান । আমি নিশ্চিত, উনি না করবেন ।”
কথা বলার এই মুহূর্তে আবির থেকে গেলো । দেখল, রাজ
হাসছে । আবির জিজ্ঞেস করলো, “কিরে? হাসছিস
কেন?” “আরে শালা! ভেবে দ্যাখ, মেয়েটা বলেছিলো স্যার মানবে না ও শিওর । কিন্তু স্যার
তো মেনে গেলো, তার মানে মেয়েটা ঠক, স্যার ই ঠিক, তাই না?” “কিন্তু স্যার যদি ঠক হয়
এবং গতকাল কোনোভাবে আমাদের কথাবার্তা শুনে ফেলেন, তখন যদি নিজে ভালো সাজার জন্য আমাকে অনুমতি দেন তখন?”-
বলল আবির । রাজের হাসিটা থেকে গেলো, ফুটে উঠলো চিন্তার ছাপ । কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ
বসে রইল । তারপর রাজ বলল, “আচ্ছা, আজ জব্বার নিশানের বাড়ি যেয়ে কি দেখলি?” আবির বলল, “তেমন কিছু না, শুধু জানতে
পারলাম, জব্বার নিশানের একটা জমজ ভাইও ছিল । সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে ছোটবেলায় ।” রাজেশকে ও বাড়িতে যে আবির দেখেছে তা
আর আবির বলল না রাজ কে । আবির উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “চল যাই, ভাবির লগে দেখা কইরা
আসি ।” রাজ হেসে দিয়ে বলল, “হ, চল, আমার প্রাক্তন ভাবি আর তোর এখনকার ভাবি ।” তারপর দুজনে খুনসুটি করতে করতে
চলে এলো হোস্টেলে
নাবিলার রুমে আসতেই রাজ আর আবির দেখল, নাবিলা বিছানায়
ঘুমিয়ে আছে । পাশে বসে সোমা আপু আর তার পাশে দাড়িয়ে রাকিব ভাই । আবির আর রাজ ভেতরে
ঢুকল । সোমা আপুর ভালো লাগলো এই দেখে যে দুজনে আবার বন্ধুত্ব করে ফেলেছে । নিশি রুমের
দরজার পাশে দাড়িয়ে । জামি, শিমুল আর পরশ সম্ভবত ছিল, চলে গেছে এখন । আবির নাবিলাকে
কিছুক্ষণ দেখল । গলায় দাগটা এখনও রয়েছে । আবির নিশিকে জিজ্ঞেস করলো, “ওষুধ দিয়েছে নাকি
কোন?” নিশি বলল, “হ্যাঁ, রাজ সেগুলো এনেও রেখেছে ।” আবির শুধু বলল, “ও আচ্ছা ।”
রাত ৮টার দিকে রুমে এসে বসলো বসলো আবির । অবশ্য
বেশিক্ষন বসতে হবে না, কারণ একটু পরেই এশার নামাযে যেতে হবে । সাড়ে ৮টায় নামায । এই
কিছুক্ষণ মোবাইল চালালো ও । আসবার সময় জব্বার নিশানের বাড়িতে এবং জব্বার নিশানের সাথে
কিছু ছবি তুলেছিল সেটা দেখতে লাগলো । ৮টা ২০ বাজতেই উঠে গেলো অজু করতে । অজু করে ভেজা
পা নিয়ে এলো । হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গেলো আবির । অবশ্য এটাই প্রথমবার না, টাইলসের মেঝেতে
প্রায় পা পিছলে পড়ে যায় আবির । কিন্তু এবার যখন পড়ে গেলো, আবিরের হাত যেয়ে পড়লো সেদিন
স্কুল শেষে রাজেশের দেয়া সেই সালোয়ার কামিজ ওড়না যে ব্যাগে রেখেছিলো তার ওপর । আবির
উঠে বসলো। সালোয়ার কামিজ ওড়না ব্যাগ থেকে অনেকটাই বেড়িয়ে গেছে । আবির ওটা ব্যাগে রাখতে
রাখতে নিজেই নিজেকে বলল, “আরে! সেই কবে দেয়ার কথা ছিল, অথচ এই বিপদের কারণে দেয়াই হল না
।” বলে সালোয়ার কামিজ ওড়নাটা রাখছিল আবির হঠাৎ কি একটা দেখে থেমে গেলো । ওড়নার
একটা কোণায় একটা গিট না? ভেতরে
কি এর? আবির গিটটা খুলল । দেখল, একটা
অডিও ক্যাপচার ডিভাইস । তাহলে কি রাজেশ এই ডিভাইসটার মাধ্যমেই আবিরের কথা শোনে? কিন্তু
চিঠি তো লিখেছে সুমন স্যার । সুমন স্যার এর সাথে রাজেশের একটা সম্পর্ক আছে তা যদিও
আবির জানে, কিন্তু স্যার যখন আবিরকে এতোটাই
ভরসা করে, তাহলে এই অডিও ডিভাইসের কি মানে? জবাব পেলো না আবির । এখন নতুন করে সব কিছু
কেমন যেন ধোঁয়াশার মতো মনে হচ্ছে । মনে হচ্ছে নতুন একগুচ্ছ কুয়াশা এসে সব ঝাপসা করে
দিয়েছে । আসল ব্যাপার বুঝতে হলে এই কুয়াশা সরে যাওয়া দরকার, তার জন্য দরকার ধৈর্য ধারণ
করা । আবির সেই অডিও ক্যাপচার ডিভাইসটা শাড়ির ভেতরে রেখেই শাড়িটা ব্যাগে ঢুকিয়ে চলে
গেলো এশার নামাজে ।
নামাজ থেকে ফিরে ওরা গেলো শারীরিক শিক্ষার ল্যাবে
। রাজ জিম করছিলো, সে সময় আবির বলল, “দোস্ত, তুই একটু জিম করতে থাক, আমি একটু আইসিটি ল্যাব থেকে আসি ।” রাজ জিজ্ঞেস
করলো, “কেন কি করবি?”
“তুই এখানে শরীরের ব্যায়াম করতেছোস, আমি একটু মাথার ব্যায়াম কইরা আসি বলে চলে গেলো আবির । যাবার সময় বলে গেলো জিম হয়ে গেলে আইসিটি ল্যাবে যেন ডাকতে আসে ।
জিম করা শেষে রাজ গেলো আইসিটি ল্যাবে । দরজার সামনে
দাড়িয়ে দেখল আবির ফটোশপ-এ কি যেন করছে । আবির ফটোশপ বেশ ভালোই পারে । ক্লাসে বইয়ের
চ্যাপ্টার দেখে আর ইউটিউব-এর ভিডিও দেখে অনেককিছু
শিখেছে । রাজ ভেতরে আসতেই আবির কি একটা মিনিমাইজ
করলো । রাজ ইয়ার্কি করে জিজ্ঞেস করলো, “কি ভায়া! কি দেখছো তুমি! ঠিক না এসব!” আবির বলল, “আমি তোর মতো ছ্যাসরা না । কাজ করতেছিলাম
। ম্যাম ফটোশপ প্র্যাকটিকাল দেখতে চাইসে সেইগুলা ।” রাজ আবিরের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আরে ডিউড! তুই তো ম্যাডামের চেয়েও ভালো পারোস, এতো টেনশন লস ক্যান?” আবির কিছু বলল
না । কথা বলার মাঝে রাজ খেয়াল করলো আবির ইউটিউব এর হিস্টোরি ডিলিট করলো । একটা কোনোরকমে
দেখল, যার বাংলা হয়তো এমন হবে, কিভাবে কারো দাড়ি মোচ সরানো যায় ।” রাজ কিছু জিজ্ঞেস
করলো না । আবির কম্পিউটারটা শাট ডাউন দিয়ে বলল, “চল, যাই ।”
পরদিন ৫ মে মঙ্গলবার । টিফিন পিরিয়ডে যখন রাজেশ
নারায়ণ দাড়িয়ে ছিল, তখন আবির রাজেশের কাছে গেলো । রাজেশ আবিরকে দেখতেই আবিরকে নিয়ে
একটু নিরিবিলি জায়গায় গেলো যেখানে ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনা কম । আবির বলল, “এখানে আনলি
কেন?” রাজেশ বলল, “অনেক কথা আছে । তার আগে তুই বল তুই এখানে কেন?” আবির বলল, “আরে,
তেমন কিছু না । ওই তোর সেদিনের শাড়িগুলো দেয়া হয় নি, তাই সরি বলতে এলাম । আমি আজও আনতে
ভুলে গেছি ।” রাজেশ সিরিয়াস মুডে বলল, “ওগুলো নিজের কাছেই রাখ, হারাবি না । পড়ে সময়মতো
কাজে লাগবে ।” তারপর দোষ করেছে আবির এমন একটা মেজাজে রাজেশ আবিরকে বলল, “আর তুই গতকাল
ওই জব্বার নিশানের বাড়ি গিয়েছিলি কেন?” আবির বলল, “কেন? আমি তো স্যার এর পারমিশন নিয়েই
গিয়েছি ।” রাজেশ কিছু বলল না । একটু থেমে রাজেশ
বলল, “শোন, তোকে একটা কথা সুমন স্যার বলতে বলেছে । ভেবেছিলো কখনো বলবে না, কিন্তু বলতে
এবার হবে ।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “কি কথা?”
“উফ! আর ভাল্লাগে না । রোজ রোজ টিফিনে এই একই কেক!
ধুর ধুর! মুখটা কেমন হয়ে গেলো । বলতে বলতে কেক খাচ্ছিল রাজ । নিশি শুনে বলল, “ঢং! এহন
পকেটের ট্যাকা খরচ করিস না, দেখবি পড়ে তোর আর ট্যাকা নাই । সামনে ঈদ আসতেছে, তার ওপর
তোর গার্লফ্রেন্ডও আছে তোর লগে । রাজ ইয়ার্কি করে বলল, “ধুর! ধুর! ওই গার্লফ্রেন্ড
আমার করবে কি । তাছাড়া চোখ আর গলার যা অবস্থা করেছে, এবারের ঈদ এ ওর আর বাইরে বেরোনো
লাগবে না ।” নিশি ইয়ার্কি করে বলল, “তাই নাকি! আচ্ছা । একবার তো তাহলে নাবিলাকে বলাই
লাগে!” হাত জোর করে বলল, “প্লিজ! দোস্ত, বলিস না! প্লিজ!” “না না না না! আমি তো বলবোই!”-আবারো
ইয়ার্কির ছলে বলল নিশি । রাজ বলল, “প্লিজ কইস না!
তুই ক কি খাবি! আমি তোরে খাওয়াতেছি!” নিশি রাজের শেষ কথাটা শুনল না । ও কি যেন একটা দেখে অবাক হয়ে বলল,
“আরে দ্যাখ! মোটু, মানে আমাদের জামি ক্যামনে খাইতেছে!” রাজ তাকাল জামির দিকে । বার্গার
খাচ্ছে, দাম প্রায় ৫০টাকা । রাজ বলল, “প্রায়-ই খায়, ওর পকেট মানির টাকা ওই দিয়েই শেষ
হয় । নিজে কিছু কেনেও না ।” নিশি হাসতে হাসতে বলল, “এজন্যই তো কই, জামি এতো পুরনো জামাকাপড়
পড়ে ক্যান! কয় বছর পর পর চেঞ্জ করে আল্লাহই জানেন ।” রাজও ইয়ার্কি করে বলল, “হ, এক
জাইঙ্গা মনে হয় পাঁচ বছর ধইরা পড়ে ।” নিশি
অট্টহাসি হেসে উঠলো । রাজও হাসছে । নিশি বলল, “তুই জানলি ক্যামনে? মানে কোন
সমস্যা আছে নাকি তোর?” রাজ ভেবেছিলো নিশিও হয়তো হাসির কিছু বলবে । তাই হাসতে গিয়েও
বিরক্ত প্রকাশ করে বলল, “তুই না! খালি নেগেটিভ ভাবোস! মানে একটা আজিব মাইয়া তুই!” নিশি
কিন্তু হাসতেই লাগলো । রাজ অন্যদিকে তাকিয়ে রইল । এমন সময় কি একটা দেখে নিশির হাসি
থেমে গেলো । নিশি রাজকে ডাকল, “দোস্ত দেখ!” রাজ বলল, “তুই একাই দেখ ।” নিশি এবার বিরক্ত
হয়ে বলল, “আরে হারামি সিরিয়াস ব্যাপার!” রাজ নিশির দিকে তাকিয়ে বলল, “কি!” নিশি রাজকে
ইশারা করে সামনে তাকাতে বলল । রাজ তাকাল । রিতা আর বকর স্যার । কি যেন কথা বার্তা বলছে
। রিতার হাতের খাতা আর কলম দেখে যে কেউই ভাবতে পারে রিতা হয়তো স্যার এর সাথে কিছু একটা
বলছে । কিন্তু আসলেই কি তাই!
“শোন, তুই যার সাথে দেখা করতে গেছিলি, উনিই আসলে
রাকেশ নারায়ণ!” রাজের পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেলো । রাকেশ নারায়ণ জব্বার নিশান!
একটু বেশি কাকতালীয় হয়ে যাচ্ছে না ব্যাপারটা! কিন্তু আবির “কি!” বলে একটা চিৎকার করা
ছাড়া আর কিচুই বলল না । রাজেশ বলল, “হ, আর ওই রিতা এই রাকেশের চ্যালা । ও তোর কাছ থেকে
আমাদের তথ্য নিয়া আমাদের সব প্ল্যান নষ্ট করতে চায়!” আবির জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু আমি
ওকে তো দেখলাম না উনার ওখানে!” রাজেশ বলল, “তুই আমাকে এসব কি শোনাচ্ছিস!” রাজেশ বলল,
“হ্যাঁ! সাবধানে থাকিস ওই রিতা থেকে! সময় কিন্তু খুব খারাপ চলছে এখন!” আবির জিজ্ঞেস
করলো, “তুই যে বলেছিলি তুই ওই রাকেশ নারায়ণের ভাই!” রাজেশ বলল, “ওটা তো শুধু ওই রাকেশ
নারায়ণকে চমকে দেয়ার জন্য ছিল যেন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে রাজেশ নারায়ণ এলাকায় এসেছে আর উনি
টেনশনে পড়ে যায়!” আবির আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু সে সময় রাজেশ বলল, “এখন আর কোন
কথা নয়, আসে পাশে অনেকে আছে, কিছু জানার থাকলে পাপলু আঙ্কেলকে সন্ধায় কাগজে লিখে দিস
।” বলে সেখান থেকে চলে এলো রাজেশ ।
সেদিন পঞ্চম পিরিয়ডে ওয়াশরুমে গেলো আবির । আজ ওর
কিছুতেই ক্লাসে মন বসছে না । টয়লেট থেকে বেড়িয়ে মুখটা ধুয়ে ক্লাসরুমের দিকে হাঁটা ধরলো
। এমন সময় আবির দেখল, হাঁটতে হাঁটতে আবিরের দিকেই আসছে রিতা । আবিরের কাছাকাছি আসতেই
রিতা আবিরের হাতে বেশ কায়দা করে একটা কাগজের টুকরো দিলো । আবির রিতাকে ডাকতে চাইলো,
কিন্তু রিতা চলে যাবার ধরণ দেখে মনে হল, এখন না ডাকাটাই সুবিধার । আবির কাগজটা খুলল
। তাতে লেখা, “আজকে ৫ম পিরিয়ড শেষে সবার চোখের আড়ালে তারেক আঙ্কেলের চেম্বারে এসো একটু
। তোমার সাথে খুবই জরুরি একটা কথা আছে ।” আবির অবাক হয়ে গেলো । এই সময় আবার কিসের কথা?
যাই হোক, যেয়ে একবার দেখতে হবে । যদি খুন টুন করে! না, তারেক আঙ্কেল আছে । সমস্যা নেই
। আবির ক্লাসে চলে গেলো ।
(৬)
৫ম পিরিওড শেষে আবির রাজকে নিজের ব্যাগ দিয়ে বলল,
“শোন, আমার ব্যাগটা তুই হোস্টেলে ।” রাজ জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাবি তুই?” আবির বলল,
“এখন বলা যাবে না । পড়ে বলবো ।” বলেই আবির
ক্লাস থেকে চলে গেলো । এদিকে আগে থেকেই পরশকে আবির বলে রেখেছিলো আবির যখন বেরোবে পরশ
যেন তখন রাজেশকে কথায় ভুলিয়ে রাখে । বেরোনোর সময় আবির একবার পরশের দিকে তাকাল । এখনও
কথা বলছে । টের পায়নি আশা করা যায় । আবির বেড়িয়ে এলো ক্লাসরুম থেকে ক্লাস ক্যাপ্টেনে
ব্যাচটা খুলে পকেটে রাখলো । ক্যাপ্টেন এই সময় বাইরে গেছে কেউ দেখলে আবার বিপদ । অনেক
কষ্টে আবির হোস্টেলে এসে ড্রেস পাল্টে চলে গেলো তারেক আঙ্কেলের চেম্বারে । কিন্তু চেম্বার
তো বন্ধ! শাটার নামানো! তাহলে! আবির দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো । খানিক পর ভেতরে থেকে
শাটার খুলে বাইরে এলো তারেক আঙ্কেল । আবিরকে দেখে তারেক আঙ্কেল বলল, “আবির, ভেতরে এসো
। বেশ গোপনীয় কিছু কথা আছে ।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “শাটার বন্ধ ছিল কেন?” তারেক আঙ্কেল
বলল, “ভেতরে চলো, আবার বন্ধ হয়ে যাবে । বুঝতেই পারছো, গোপনীয় ব্যাপার!” আবির ভেতরে
ঢুকল । তারেক আঙ্কেল ভেতরে ঢুকল । তারপর শাটার অফ করে দিতেই ভেতরটা অন্ধকার হয়ে গেলো
। তারেক আঙ্কেল মোবাইলের আলোটা জালালো । শাটারের বিপরীত দেয়ালে একটা দরজা আছে যা দিয়ে
চেম্বারের পেছনের দিকে ড্রেসিং রুমে যাওয়া যায় । তারেক আঙ্কেল আবিরকে নিয়ে সেই রুমে
গেলো । তারপর লাইট জ্বালাতেই আবির দেখল, রুমে তারেক আঙ্কেল ছাড়াও আরও একজন আছে । বকর
স্যার ।
স্কুল শেষে রাজ আবিরের ব্যাগসহ নিজের ব্যাগ নিয়ে
হোস্টেলের দিকে আসছিলো । সাথে ছিল শিমুল আর জামি । জামি বেচারার মনটা খারাপ । শিমুল
রাজকে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে? তুমি আবিরের ব্যাগ নিয়া যাস ক্যান? আবির কই?” রাজ বলল,
“ও কি একটা কাজে গেছে ।” শিমুল বলল, “ও আচ্ছা । ওর তো সারাদিনই কতো কাজ । আচ্ছা, নিশি
কই রে?” রাজ বলল, “ও মনে হয় তাড়াতাড়ি গেছে, নাবিলা একা তো, দেখতে গেছে ।” শিমুল বলল,
“ও আচ্ছা ।” রাজ জিজ্ঞেস করলো, “ক্যান কি হইছে?”
শিমুল বলল, “আর কইছ না, কে জানি বেচারার জাইঙ্গা নিয়া কি কইছে, তাই মন খারাপ কইরা বইসা
আছে । কে কইছে তা আর নিশি কই নাই ।” রাজ একবার জামির দিকে তাকাল । নিশি একথা জামিকে
বলে দিয়েছে! আবার নাবিলাকে ওই কথাটা না বলে দেয়! রাজ ইয়ার্কি করে জামিকে বলল, “আরে
দোস্ত, আর মন খারাপ কইরা থাকিস না । ছোট ছোট দেশে এরকম ছোট ছোট জামাকাপড় নিয়ে একটু
আধটু ইয়ার্কি হয়-ই । এতে মন খারাপ করার কিছু নাই!” জামি বলল, “তাই বইলা এমনে অপমান!”
রাজ কিছু বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় দেখল, আবির হাত একটা ব্যাগ নিয়ে এদিকেই আসছে । আবিরকে
দেখে রাজ, “ওই তো আবির!” বলে আবিরের কাছে দৌড়ে গেলো । সাথে জামি আর শিমুলও গেলো । আবির
বলল, “জামি, শিমুল, তোরা যা, আমরা পড়ে আসতেছি!” জামি বলল, “ক্যান কি কবি তুই ওরে যে
আমাগো কওয়া যায় না!” আবির বিরক্ত হয়ে বলল, “প্লিজ যা না!” জামি, “হুহ! ঢং! চল শিমুল
।” জামি আর শিমুল চলে গেলো, আবির একবার পিছু ফিরে বলল, “লাভ ইউ ডিউডস!” জামি আর শিমুল
একবার পিছু ফিরে তাকাল, জামি শুধু ক্ষেপে জবাব দিলো, “হেইট ইউ কুত্তা!” রাজ তখন বলল,
“কিরে! গেছিলি কই তুই!” আবির বলল, “আজ থেকে এক সপ্তাহ পর তুই সব কিছুর জবাব পাবি ।
কিন্তু তোরে একটা কাজ করতে হবে!” রাজ জিজ্ঞেস করলো, “কি কাজ?” “স্কুলের সবাইরে বলবি,
আমি এক সপ্তাহের জন্য ঢাকা গেছি জন্ম নিবন্ধনির কিছু কাজ করতে । পারবি!” রাজ বলল,
“তুই সত্যি ঢাকা যাবি!” আবির বলল, “আরে না! কিন্তু এই এক সপ্তাহ আমি তোদের কাছেও থাকবো
না ।” রাজ বলল, “কেন?” আবির বলল, “সবটার জবাব পড়ে পাবি । প্লিজ এখন কিছু জিজ্ঞেস করিস
না!” রাজের মনটা খারাপ হয়ে গেলো । বলল, “ঠিক আছে, বাট তোরে অনেক মিস করবো ।” আবির হালকা
হাসিমুখে বলল, “মিস তো আমি তোরেও করমু রে শালা! বাট আমি একটা রিস্কের মধ্যে যাচ্ছি
। দোয়া করিস, যেন জিতে ফিরি!” রাজ বলল, “দোয়া তোর জন্য সবসময় আছে দোস্ত ।” আবির বলল,
“লাভ ইউ ব্রো!” রাজ জিজ্ঞেস করলো, “লাভ ইউ টু, বাট হঠাৎ সবাইকে লাভ ইউ বলছিস যে?” আবির
হালকা হেসে বলল, “ভালোবেসে সবটা জয় করতে চাই । মা বাবা তো নাই, আছিস তুই, আমার ভাই,
আর ওই কুত্তাগুলা!” রাজ একটু হাসল । আবির পিছু ঘুরলো চলে আসবার জন্য । একবার শুধু পেছন
ফিরে বলল, “শোন না, আমার রুমে একটা ব্যাগে একটা সালোয়ার কামিজ ওড়না দেখতে পাবি, ওটা
এক বালতি পানির ভেতর এই কয়েকদিন চুবিয়ে রাখিস, আর হ্যাঁ, রুমে ঢুকে একটা কথাও বলবি
না!” রাজ বলল, “আচ্ছা দোস্ত । টাটা। ” আবিরও বলল, “টাটা দোস্ত!” আবির চলে এলো । রাজ
ওখানেই দাড়িয়ে আবিরকে যেতে দেখতে লাগলো যতক্ষণ না আবির দৃষ্টির বাইরে চলে না যায় ।
১ সপ্তাহ না! কীভাবে কাটবে সময়টা! কার সাথে নামাজে যাবে! কার সাথে ওই শারীরিক শিক্ষা ল্যাবে জিম করবে! কার সাথে ছাদে
দাড়িয়ে জ্ঞান গাইবে “সেই যে হলুদ পাখি! বসে জামরুল গাছের ডালে………!” জানে না রাজ । আচ্ছা
১টা সপ্তাহই তো । এতো চিন্তা করছে কেন? যাই হোক রিস্ক আছে বলল না? আল্লাহ ভরসা । সব
ঠিক হয়ে যাবে । এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হোস্টেলে ফিরে এলো রাজ ।
দেখতে দেখতে কেটে গেলো ১টা সপ্তাহ । ১২ মে মঙ্গলবার । আজ হঠাৎ-ই একটা মিটিং-এর আয়োজন করা হয়েছে স্কুলের হল রুমে । সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্কুলের সব শিক্ষক-শিক্ষিকা,
নিশি, রাজ, পরশ, জামি, শিমুল, রাজেশ, রিতা, পাপলু আঙ্কেল, এলাকার মেয়র জব্বার নিশানও
পর্যন্ত ছিল সেখানে । নাবিলা আসে নি, যেহেতু নাবিলার চোখ আর গলার দাগ এখনও যায় নি ।
যদিও মিটিং জব্বার নিশান ডেকেছে বলে সবাই জানে, কিন্তু আসলে তা নয় । অনেকক্ষণ ধরে সবাই অপেক্ষা
করছে, কিন্তু মিটিং শুরু হবার কোন নাম গন্ধ নেই । একটু পর রাশেদ স্যার জব্বার
নিশানের কাছে যেয়ে বলল, “স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, মিটিংটা শুরু হবে কখন?” জব্বার
নিশান বলল, “প্লিজ, আরেকটু অপেক্ষা করুন, এখনই শুরু হবে ।” রাশেদ স্যার কিছু বলল না
। যেহেতু জব্বার নিশান উনার বড় পোস্টের একজন ব্যাক্তি, তাই আর কিছু বলতেও সাহস পায়
নি রাশেদ স্যার ।
এদিকে ফিসফিস করে কথা বলছিল সুমন স্যার আর রাজেশ
। সুমন স্যার রাজেশকে বলল, “আবির কোথায়?” রাজেশ বলল, “জানি না । শুনেছি ১সপ্তাহ ও ঢাকায়
গেছে ।” “ওর রুমে কিছু আওয়াজ পেয়েছো?” রাজেশ জবাব দিলো, “না, শেষ আওয়াজটা ছিল পানিতে
চুবানোর । সম্ভবত ও জামাকাপড়গুলো ধুয়ে দিয়েছে সে সময় পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে অডিও
ক্যাপচার ডিভাইসটা ।” একটু পরেই একজন পুলিশের পোশাকধারী একজন লোক ভেতরে এলো । মুখে
পাকা দাড়ি মোচ, মাথার চুলও সাদা, ক্যাপের আড়ালে যেটুকু বেড়িয়ে আছে তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে
। হলরুমটা ৩টা ক্লাসরুম মিলিয়ে তৈরি । তাই এর দরজা ৬টা । অন্যান্য দরজা বন্ধই ছিল,
এই পুলিশ লোকটা এসে এই দরজাটাও আটকে দিলো । এরপর জব্বার নিশান দাড়িয়ে বলল, “ওই তো,
অফিসার এসে গেছেন এখন উনিই তো মিটিং করবে ।” সুমন স্যার চমকে গেলো । চমকে গেলো রাজেশও
। রাশেদ স্যার তো ভয়ে বলল, “একি! পুলিশ অফিসার!” পুলিশের পোশাকধারী লোকটা হাতে একটা
পুলিশের লাঠি নিয়ে এগিয়ে এলো ধীরে ধীরে রাশেদ স্যার এর কাছে । তারপর বলল, “আপনি এতো
ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনি কি কিছু করেছেন?” রাশেদ স্যার কোনোরকমে নিজের ভয় লুকাবার চেষ্টা
করে বলল, “না, আমি, কেন কিছু, করতে যাবো!” পুলিশের পোশাকধারী লোকটা কিছু বলল না । রাজ
পুলিশের পোশাকধারী লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে । কেমন চেনা চেনা লাগছে না এই অফিসারকে!”
অনেকক্ষণ ধরে সুমন স্যার আসেপাশে কি যেন দেখছে এবং কাকে যেন খুজছে পুলিশ অফিসার জব্বার
নিশানের কাছে যেয়ে বলল, “এই যে মিস্টার, ইনোসেন্ট
হয়ে বসে থাকবেন না, দোষ কিন্তু আপনারও আছে ।” জব্বার নিশান ভ্রু কুঁচকে বলল, “আপনি
প্লিজ হেয়ালি না করে বলুন তো হয়েছেটা কি!” অফিসার একটু হেসে বলল, “সবুর করুন, সবুরে
মেওয়া ফলে ।” জব্বান নিশান আর কিছু বলল না । অফিসার এবার গেলো রাজেশের কাছে । বলল, “অন্যের রুমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে অডিও ডিভাইসের
মাধ্যমে কথা শোনা হয় তাই না রাজেশ?” রাজেশ চমকে গেলো । জিজ্ঞেস করলো, “আপনি আমার নাম কি করে জানলেন?” অফিসার কোন জবাব
দিলো না । রাজ তখন পরশকে বলল, “দোস্ত, এই অফিসারটাকে আগে কোথাও দেখছি বলে মনে হইতেছে
না?” পরশ ওপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলল, “হ রে, অই অনামিকার ডেথ কেইসে এসছিলো নাকি?” রাজ
বলল, “কি জানি, হইতে পারে ।” অফিসার তখন গেলো সুমন স্যার এর কাছে । জিজ্ঞেস করলো,
“কি সুমন স্যার, এভাবে আশেপাশে তাকিয়ে কি দেখা হচ্ছে? কাকে খোঁজা হচ্ছে?’ সুমন স্যার
অবাক হয়ে বলল, “কই, কাউকেই না তো!” অফিসার হেসে বলল, “আপনি কি বকর স্যারকে খুঁজছেন?”
সুমন স্যার অবাক হয়ে গেলো । শুরু থেকেই বকর স্যার এখানে উপস্থিত নেই । তাই সুমন স্যার খোজার চেষ্টা করছিলো এখানে বকর স্যার আসলেই নেই
কি না । অফিসার কি করে বুঝল তা ভেবে অবাক হয়ে গেলো সুমন স্যার । জিজ্ঞেস করলো, “আপনি
কে আসলে? আমাদের সম্পর্কে এতো কিছু কি করে জানেন?” অফিসার হাসিমুখে সবার থেকে একটু
দূরে চলে গেলো । তারপর বলল, “আমি এখানকারই একজন এতিম ।” সবাই অবাক হয়ে গেলো । এই কথাটা
বলার সময় গলাটা কেমন পাল্টে গেলো না!” এবার পুরোপুরি সবার চেনা মনে হচ্ছে লোকটাকে ।
এরপর অফিসার মাথা থেকে ক্যাপটা নামিয়ে চুল ঝেরে সাদা করার জন্য পাউডার সরিয়ে নকল দাড়ি
মোচ তুলে ফেলল । এটা আর কেউ না, আবির । সবাই অবাক হয়ে গেলো । টিচাররা নিজেদের মাঝে
কথা বলা শুরু করে দিলো । শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সুমন স্যার, রাজেশ, জব্বার নিশান,
রাশেদ স্যার । একটু পর জব্বার নিশান রেগে গিয়ে বলল, “এই ছেলে! তোমার এতো বড় সাহস! পুলিশের
পোশাক পড়ে আমাদের ভয় দেখাচ্ছ!” আবির বলল, “একটু অপেক্ষা করুন না, সবটা আগে বলে নেই
।” এরপর আবির যে দরজা দিয়ে এসেছিলো, সে দরজার কাছে যেয়ে বলল, “ভেতরে আসুন ।” ভেতরে
এলো বকর স্যার আর তারেক আঙ্কেল । বকর স্যার এর হাতে একটা কাগজ ।” আবির একবার রাজের
দিকে তাকাল । অনেকদিন পর ভাইকে দেখে বেশ খুশি রাজ । আবির এক চোখ বন্ধ করে রাজকে জানিয়ে
দিলো, আবির জয়ী হয়েছে । রাজও খুশি হল । এরপর আবির সবার উদ্দেশ্যে বলল, “সবার কাছে ক্ষমা
চাইছি, কারণ সুমন স্যার এর বাসায় তল্লাশি করতে গিয়ে একটু দেরি হয়ে গেলো ।” সুমন স্যার
ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল, “তোমাদেরকে আমার রুম তল্লাশি করার অধিকার কে দিয়েছে!” আবির হেসে
বলল, “এই যে স্যার, আমার এই পোশাকটা যাদের তারা দিয়েছে ।” সুমন স্যার আর কিছুই বলল
না । টিচারদের মধ্যে একজন বলল, “আবির, এবার তুমি বলো আসলে কি হয়েছে ।” খায়রুল স্যার
বলল, “হ্যাঁ আবির, আমরা অনেকক্ষণ ধরে দাড়িয়ে আছি ।” আবির তখন বকর স্যারকে বলল, “স্যার,
আমি বলবো, নাকি আপনি বলবেন?” বকর স্যার বলল, “না গোয়েন্দা জুনিয়র, তুমিই বলো ।” আবির
বলল, “বেশ তবে শুরু করা যাক । আমাদের সবারই জানা আছে এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতার কিছু
ইতিহাস, আমাদের এই জব্বার নিশান আঙ্কেলের বাবা কাশেম আহমেদ । উনার ছেলে মেয়ে মানুষ
হয় নি, সবাই যার যার মতো বিদেশে যেয়ে যার যার মতো বেঁচে আছে, এখানকার কোন খোঁজ খবর
নেয় না, কাশেম আহমেদ উনার ক্ষমতা আর জমিজমা উনার ছেলে জব্বার নিশানকে দিয়ে যান তাই
তো?” সবার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায় কেউ কথাও বলে । আবির এরপর বলল, “এর মাঝে একটা ইতিহাস
কিন্তু বাদ পড়ে যায় যা আমরা অনেকেই জানি না । তা হল, এই কাশেম আহমেদের একটা মেয়ে বিয়ে
করে হিন্দু ছেলেকে, যার নাম রাকেশ নারায়ণ । এর জন্য উনি উনার মেয়েকে বাড়ি থেকে বের
করে দেন ।” সবাই অবাক হয়ে গেলো । জব্বার নিশান বিরক্ত হয়ে বলল, “আবির, এসব এখন বলে
কি লাভ?” আবির বলল, “লাভ আছে আঙ্কেল, অনেক লাভ আছে । আপনিই তো বলেছিলেন রাকেশ নারায়ণ
ফিরে এসেছে । বলেন নি?” জব্বার শেখ উপর নিচ মাথা নাড়ল । আবির বলল, “আমি যদি বলি সেই
রাকেশ নারায়ণ আমাদের এই ক্লাসরুমেই আছে?” জব্বার নিশান উঠে দাঁড়ালো । বলল, “হোয়াট!”
আবির বলল, “হুম আঙ্কেল । এরপর আবির ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো সুমন স্যার এর কাছে । তারপর
বলল, “প্ল্যানটা ভালোই এঁটেছিলেন রাকেশ নারায়ণ, ওরফে সুমন স্যার ।” সুমন স্যার ক্ষেপে
গিয়ে বলল, “কি যা তা বলছো আবির!” আমি তোমাদের সাহায্য কর…………।” সুমন স্যার এর কথা শেষ
না হতেই আবির রাজেশের ঘাড় ধরে নিজের ওই নকল দাড়ি মোচটা রাজেশের মুখে জোর করে লাগিয়ে
জব্বার নিশানের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল, “দেখুন তো, একে চেনেন কি না?” জব্বার নিশান যেন
আকাশ থেকে পড়ল । বলে উঠলো, “এ যে আমার রাঁধুনি করিম!” আবির বলল, “হ্যাঁ, এই আসলে রাকেশ
নারায়ণের ভাই রাজেশ নারায়ণ ।” জব্বার শেখ ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো । সুমন স্যার তখন
বলল, “উলটা পাল্টা কি বলছ আবির? কি প্রমান আছে তোমার কাছে?” আবির তারেক আঙ্কেলকে কি
ঈশারা করতেই তারেক আঙ্কেল চলে গেলো রাজের দিকে । আবির তখন বলল, “হ্যাঁ, তাহলে শুরু
থেকে শুরু করা যাক । ঘটনার শুরু আমাদের আগের প্রিন্সিপ্যাল, মানে আমাদের সবার প্রিয়
যে প্রিন্সিপ্যাল স্যার চলে গিয়েছিলেন এবং এখন রাশেদ স্যার যে ভারপ্রাপ্ত আছেন এর মাঝে
যে লোকটা অল্প কয়েকদিন রাজত্ব করে জেলে চলে যান অর্কর সাথে সে লোকটা থেকেই । আপনারা
সবাই জানলে অবাক হবেন, ওই লোকটা আর কেউ নয়, উনি রাকেশ নারায়ণ আর রাজেশ নারায়ণের বাবা
প্রদেশ নারায়ণ ।” সবার মাথায়ই যেন এবার আকাশ ভেঙ্গে পড়ে । এতোটা নিখুঁত প্ল্যানিং!
আবির বলতে থাকে, “আসলে এই সুমন স্যার কয়েক
বছর আগে এই কলেজে এসেছিলেন পরিস্থিতি দেখবার জন্য । যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়, স্কুলের
প্রিন্সিপ্যাল হিসেবে আনলেন বাবা প্রদেশ নারায়ণকে । কিন্তু নিজের বাবা যখন ফেসে যায়,
তখন পড়ে যায় বিপদে । ভারপ্রাপ্ত হয়ে যায় রাশেদ স্যার, উনিও তখন পায়তারা করে অন্য লোককে
দিয়ে রাশেদ স্যারকে হুমকি দেখিয়ে কলেজে আনেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের যাতে আমরা সবাই ওদের এখানে আনার কারণ খোঁজে, অন্য কিছু না
ভাবে আর বেশি ছাত্রছাত্রীর আড়ালে রাকেশ নারায়ণ মানে আমাদের এই সুমন স্যার সহজেই যেন
নিজের কার্যসিদ্ধি করতে পারেন ।” খায়রুল স্যার তখন জিজ্ঞেস করলো, “সেই কাজটা কি ছিল
আবির?” আবির একটু থেমে বলল, “শ্বশুরের সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা নেয়া ।” পাপলু আঙ্কেল
বলে উঠলো, “ধুর! বুঝি না! সব গোয়েন্দা কাহিনীতে শুধু এই টাকা আর সম্পত্তি থাকে কেন!”
আবির বলল, “বুঝেন না পাপলু আঙ্কেল, ওই টাকা আর সম্পত্তির লোভই তো মানুষের মনুষ্যত্ব
হারাবার অন্যতম কারণ ।” পাপলু আঙ্কেল বলল, “হ্যাঁ আবির । কিন্তু আমাকে ক্ষমা করে দিয়
। আমিও ওই সুমন লোকটার চিঠি তোমাকে দিতাম ।” আবির বলল, “এতে আপনার দোষ নেই আঙ্কেল ।
আপনি তো আর সবটা জানতেন না ।” আবির এরপর আবার কাহিনীতে ফিরে এলো । “এই রাকেশ নারায়ণ
নিজের ভাই রাজেশকে জব্বার নিশানের বাড়ি পাঠান সময় মতো জমিজমার কাগজে সই করাতে এবং গত
দুদিন আগে সফলও হয়েছিলো ।” এরপর আবির বকর স্যার এর হাতের কাগজ জব্বার নিশানকে দেখিয়ে
বলল, “এই যে আঙ্কেল, দেখুন ।” জব্বার নিশান কাগজ দেখে প্রচন্ড রেগে গেলো । রাজেশকে
উদ্দেশ্য করে বলল, “হারামজাদা! এই ছিল তোর মনে!” খায়রুল স্যার জিজ্ঞেস করলো, “তুমি
এতো কিছু জানলে কি করে আবির?” আবির জব্বার নিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা জব্বান
আঙ্কেল, আপনি এবার একটু বলবেন আপনি কেন মিথ্যে বললেন?” জব্বার আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি! কি মিথ্যে বলেছি?” আবির এরপর বকর স্যারকে বলল, “স্যার আপনি একটু এদিকে আসবেন?”
বকর স্যার আবিরের কাছে গেলো । তারপর আবির নিজের দাড়ি স্যারকে পড়তে বলল এবং চশমাটা খুলতে
বলল । বকর স্যার তাই করলো । আবির এরপর সবার উদ্দেশ্যে বলল, “বকর স্যারকে টাক তো অন্তত
করতে পারছে না, কিন্তু সবাই দেখুন তো, এদের এক রকম দেখা যাচ্ছে কি না?” সবাই অবাক হয়ে
গেলো । আসলেই তো! এরা দুজনেই তো একই রকম! কিন্তু কি করে! আবির বলল, “আসলে এরা দুজনে
জমজ ভাই । জব্বার নিশান উঠে দাড়িয়ে বকর স্যারকে দেখল । খুব খুশি হল ভাইকে পেয়ে । জড়িয়ে
ধরে বলল, “তুই এতো কাছে অথচ তাও আমি তোকে চিনতে পারিনি?” বকর স্যার বলল, “হ্যাঁ রে,
কিন্তু কি করবো, এখানে এসে যা দেখলাম, তাতে নিজের পরিচয়টা আগেই দিতে পারিনি । আবির
তখন বলল, “এবার আপনাদের একটা অদ্ভুত কাহিনী বলি । জব্বার নিশান আর সোবহান আহমেদ আহমেদ
দুই ভাই । কিন্তু আপনারা এতদিন যাকে জব্বার নিশান নামে চিনতেন, উনিই আসলে সোবহান আহমেদ
। আর পাশে যে দাড়িয়ে, উনি জব্বার নিশান ।” সবার মনের মাঝে কি যে চলছে কেউ জানে না ।
এতগুলো অজানা ব্যাপার হঠাৎ একদিন এভাবে সবার সামনে আসবে কেউ কোনোদিন হয়তো ভাবতেই পারে
নি । বকর স্যারও আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “আবির, আমি তো তোমাকে কিছুই বলিনি যে আমি
ওর ভাই কিংবা আমি জব্বার নিশান, তুমি কি করে জানলে?” আবির বলল, “আসলে আমি সেদিন টিচার্স
রুমে আপনি যখন সুমন স্যার এর সাথে কথা বলছিলেন, তখন কলম তুলতে গিয়ে আপনার পায়ে পুড়ে
যাবার দাগ দেখেছিলাম । ওইদিনই আপনাদের বাড়ি যেয়ে আমাদের জব্বার নিশান আঙ্কেল মানে আসল
সোবহান আঙ্কেল আমাকে একটা ছবি দেখান যেটা আপনাদের দুজনেরই ছিল এবং উনি পা পুড়ে যাওয়া
লোকটার নাম বলেন সোবহান । তাছাড়া আমি জব্বার আঙ্কেলের একটা ছবি তুলেছিলাম সেটা এনে
ফটোশপ দিয়ে এডিট করে দাড়ি মোচ সরিয়ে চশমা লাগিয়ে চুল লাগিয়ে দেখেছিলাম দেখতে হুবহু
বকর স্যার । আমিও হয়তো আপনাকে সোবহানই ভাবতাম কিন্তু গতকাল তারেক আঙ্কেলের বাবার ডায়রিতে
আপনার পা পোড়া ছবি দেখেছিলাম, যাতে আপনার নাম লেখা ছিল জব্বার নিশান । এবার বলুন তো,
আসল কাহিনী কি?” জব্বার নিশান মানে আসলে যিনি সোবহান শেখ উনি বলল, “আমি বলছি । আসলে
ছোটবেলা থেকে আমার বাবা কাশেম আহমেদ আমার চেয়ে জব্বারকে বেশি ভালবাসতেন । বাবার ওপর
রাগ করে যেদিন জব্বার বাড়ি ছেড়ে চলে যায় সেদিন মা আমাকে জব্বার সাজান যেন বাবা কষ্টটা
একটু হলেও কম পান । বাবা হার্টের রোগী ছিলেন তো, সেই থেকেই আমাকে সবাই জব্বার নিশান
নামে চেনে আর সবাই জানে সোবহান আহমেদ চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে ।” বকর স্যার মানে সোবহান
বলল, “সত্যি আবির, তুমি দারুন একটা গোয়েন্দা ।” আবির বলল, “আমি না হাফিয়ে গেছি, বাকি
কাহিনীটা এবার আপনি বলুন না স্যার?” বকর স্যার মানে সোবহান বলল, “হ্যাঁ অবশ্যই । আমি
অনেক বছর পর মাটির টানে এই বছরের শুরুর দিকেই এই স্কুলে চাকরি নেই । আমার আবার বিয়ে
ঠিক হয়ে আছে তো একটা চাকরিরও দরকার ছিল । এখানে এসে সুমনের সাথে আমার ভালো বন্ধুত্ব
হয় । কিন্তু এই-ই যে রাকেশ নারায়ণ, তা আমি বুঝি নি । বুঝেছিলাম ওর ব্যাগে অর্ধেক বেড়িয়ে
থাকা জন্ম নিবন্ধনি দেখে যাতে স্পষ্ট ওর নাম লেখা ছিল রাকেশ নারায়ণ । এরপর থেকেই আমি
ওকে ফলো করা শুরু করি । যেদিন জানতে পারি স্কুলে নতুন ছেলেমেয়ে ভর্তি করার খবর প্রথম
আমি ওর কাছেই পাই । তখন আমি ভাবি তারেকের মেয়ে রিতাকে ভর্তি করিয়ে কিছু কাজ করানো যাবে
। আবিরের নামটা তো আমি আগেই শুনেছিলাম, তাই ওর বন্ধু নাবিলাকে রিতার মাধ্যমে কিছু ইতিহাস
বলাই যেন সেটা আবিরের কানে যেতে পারে । রিতার সাথে বাবা হিসেবে অন্য কেউ গিয়েছিলো যেন
নাবিলা রিতাকে চিনতে না পারে । আমার জানা ছিল না আবিরের সাথে নাবিলার মনোমালিন্য ছিল,
কিন্তু তবুও ভাগ্যক্রমে সব কথা আবির জানতে পারে । এরপর কোনোভাবে এরা রিতার ওপর সন্দেহ
করে, ফলে রিতার নিরাপত্তার খাতিরে ওকে আমি এতিমখানার হোস্টেলে উঠতে বলি । সেখান থেকেই
ও জানতে পারে আবির সুমন স্যারকে বিশ্বাস করে কাজ করছে । কিন্তু সুমন স্যার ওকে দিয়ে
কেন কাজ করাচ্ছে বুঝতে পারলো না রিতা । আসলে সুমন চেয়েছিল আবিরকে বোকা বানিয়ে যদি কোন
কাজে লাগানো যায় কিন্তু যখন বুঝলো আবিরকে দিয়ে ওর সুবিধার চেয়ে ক্ষতিই বেশি, তখন আবিরকে
বলল, এখন ওরা কিছুই করবে না, যা করার জানুয়ারিতে করবে ।” আবির সামনে এসে বলল, “বাকিটা
তাহলে আমি বলি । সুমন স্যার যেমন প্ল্যান করেছেন, বকর স্যারও তেমনি প্ল্যান করেছেন
। কিন্তু সুমন স্যার জানতো না বকর স্যারই সব প্ল্যান করেছে । ওদিকে বকর স্যার লুকিয়ে
আমাদের কথা গতকাল শুনেছিলেন সুমন স্যার রাজেশের মাধ্যমে আমাকে মিথ্যে কথা ছড়াচ্ছে,
আসলে রাকেশ নারায়ণ এই জব্বার নিশান মানে আসল সোবহান আহমেদ । তখনই উনি চিন্তা করেন সবটা
বলার এখনই সময়!” পরশ তখন প্রশ্ন করলো, “আবির তোর মনে আছে! আমি একবার রাশেদ স্যারকে
দেখেছিলাম কাকে যেন ডেকেছিলেন?” আবির বলল, “হ্যাঁ । ওটা ছিল রাজেশ । রাশেদ স্যার ওর
রাতে সবার চোখের আড়ালে স্কুলে ঢোকার ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন । যাই হোক এবার আসি আসল
কাহিনীতে ।” খায়রুল স্যার বলল, “আসল কাহিনীই এখনও হয় নি! বাপরে বাপ! আমার মাথা ঘুরছে!”
আবির বলল, “গতকাল রিতার মাধ্যমে আমাকে বকর স্যার তারেক আঙ্কেলের চেম্নারে ডাকেন । সেখানে
যেয়ে আমাকে উনি যে এতদিন সব প্ল্যান করেছেন সবটা জানালেন । সাথে এও জানালেন সুমন স্যার
প্রতিদিন জেলে যেয়ে কিছু একটা করেন, কারো সাথে দেখা করতে যান । আমি তখন জানাই আমি নকল
অফিসার সেজে সবটা পরোখ করে দেখতে চাই । পড়ে ঢাকায় গিয়েছি বলে আমি আসলে এতদিন ওই পুলিশ
স্টেশনে ছিলাম এবং ওখানেই সুমহান সুমন স্যার মানে রাকেশ নারায়ণকে প্রদেশ নারায়ণের সাথে
কথা বলতে দেখি এবং সবটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় । আমি প্রমানও রেখে দিয়েছি ।” এরপর
আবির মোবাইল থেকে ভিডিও বের করে সবাইকে কিছু অংশ দেখাল । এরপর আবির সুমন স্যার এর কাছে
যেয়ে বলল, “আর কিছু বলার আছে সুমন স্যার, রাকেশ নারায়ণ!” সুমন স্যার কিছু বুঝে ওঠার
আগেই বা হাত দিয়ে আবিরকে জাপটে ধরে ডান হাত দিয়ে প্যান্টের পেছন থেকে একটা বন্দুক বের
করে আবিরের কপালে ধরে বলল, “যথেষ্ট হয়ে আবির, পুচকে হারামজাদা! আসল চেহারা যখন দেখায়
দিলি! তখন দেখুক সবাই।” এরপর সুমন স্যার মানে রাকেশ নারায়ণ বকর স্যার মানে আসল জব্বার
নিশানকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কি হে বন্ধু! এই ছেলেকে জ্যান্ত চাস! নাকি কাগজে সইটা করেই
দিবি?” আবির তখন সুমন স্যার মানে রাকেশ নারায়ণকে বলল, “একটু ডান দিকে তাকাবেন স্যার?”
সুমন স্যার ডান দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো কারণ সুমন স্যার এর কপালে গুলি তাক করে দাড়িয়ে রাজ । আর রাজেশের কপালে গুলি তাক করে দাড়িয়ে
পরশ । আসলে তখন আবির যে ঈশারা করেছিল তারেক আঙ্কেলকে, তারেক আঙ্কেল তখন পরশ আর রাজকে
বন্দুক দুটো দিয়ে এরকম মুহূর্তে কাজে লাগানোর কথা বলেছিল । আবির সুমন স্যার ডানে তাকাতেই
সুমন স্যার এর হাত থেকে বন্দুকটা কেড়ে নিলো । তারপর বলল, “আপনার খেল খতম স্যার । কিন্তু
আপনার মেধাটা ভালো কাজে লাগালেও পারতেন । দেশের উন্নতি হতো ।” সুমন স্যার আর কিছু বলল
না । সে সময় ভেতরে এলো এক দল পুলিশ সাথে আসল অফিসার । আবির বলল, “আঙ্কেল, সবটা তো আপনাদের
বলাই হয়েছে । এবার এদের এরেস্ট করুন ।” পুলিশের লোকজন রাকেশ নারায়ণ বা সুমন স্যার ও
তার ভাই রাজেশ নারায়ণকে ধরে নিয়ে গেলো । আবির রাজের কাছে যেয়ে রাজকে জড়িয়ে ধরল রাজ
খুশিতে বলল, “তোরে জোস লাগতেছে মামা!” আসল সোবহান আহমেদ বকর স্যার বা জব্বার নিশানকে
বলল, “শোন ভাই, ক্ষমতা চাপ আর আমি নিতে পারছি না, এবার তুই সব দায়িত্ব নে । এসব এতো
সম্পত্তিও দরকার নেই আমার । বকর স্যার বলল, “না ভাই, তুই দায়িত্ব নিয়েছিস, তুইই ভালো
দেখতে পারবি । আমি এখানেই থাকবো, সমস্যা নেই । শুধু বিয়ের ব্যাবস্থা কর, ৭টা মেয়ের
পর এবারের ৮নাম্বার মেয়ের পরিবার রাজি হয়েছে বিয়েতে!” সোবহান আহমেদ বলল, “সত্যি! আগে
বাড়ি চল, তখন সব কথা হবে ।” বকর স্যার আবিরের কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুমি একদিন
অনেক বড় গোয়েন্দা হতে পারবে ।” আবির হাসিমুখে স্যার এর দিকে তাকিয়ে রইল । রাশেদ স্যার
বলল, “সত্যি বাবা! কি লোকরে! এই-ই একদিন আমার কাছে এসে দয়া দেখিয়ে বলেছিল নতুন ছাত্রছাত্রী
এলে এতিমদের সমস্যা হবে, এহ! কি অভিনয় করে!” আবির রাশেদ স্যার এর দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনার তো অভিনয় ছিল না স্যার, টাকা পাবেন ভেবে নিজেও তো কেমন ভিলেনের মতো হয়ে গিয়েছিলেন!”
রাশেদ স্যার লজ্জা পেয়ে হেসে বলল, “হে হে, মাফ করে দাও! ভুল হয়ে গেছে । আর হবে না ।”
আবির তখন সোবহান আঙ্কেলের কাছে যেয়ে বলল, “জব্বার……সরি, সোবহান আঙ্কেল, আমার একটা অনুরোধ
রাখবেন?” সোবহান আঙ্কেল বলল, “হ্যাঁ বলো?” আবির বলল, “আমি চাই বকর স্যার মানে এখনকার
জব্বার স্যার আমাদের স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল হোক ।” সবাই আবিরের কথায় সম্মতি জানালো
। বেচারা ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপ্যাল রাশেদ স্যারও অনেক কষ্টে বলল, “হ্যাঁ, অবশ্যই, ভালোই
হয়, খারাপ না ।” বকর স্যার কিছু বলল না । শুধু হাসিমুখে সবার দিকে তাকাল । এতদিনের
একটা ঝামেলা চলে যাওয়ায় আজ অনেক হালকা হালকা লাগছে ।
(৭)
সেদিন রাতে এশার নামাজ থেকে আসার সময় রাজ আবিরকে
জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে আবির, তুই সেদিন সবাই কে লাভ ইউ, লাভ ইউ বলছিলি কেন রে?” আবির
বলল, “শোন, জব্বার স্যার মানে বকর স্যার, গুলিয়ে ফেলিস না, সেদিন আমাকে বলেছিলেন আমি
যদি সত্যি কাউকে ভালোবাসি, তবে সে ভালোবাসার কথা ভেবে সবটা করতে পারবো । আমার তো মা
বাবা নেই, আত্মীয়ও নেই । আছে আমার এই বন্ধু বান্ধব, আর টিচার আরও কয়েকজন মানুষ । তার
মধ্যে তুই আমার ভাই । তাই সেই ভালোবাসার কথা মাথায় রেখে আমি কাজটা করেছিলাম ।” আবির
বলল, “সেটা কীভাবে?” “তুই সিনেমা দেখেছিস, ওতে দেখবি হিরো অন্য মানুষকে বাঁচানোর চেয়ে
নিজের আপন মানুষকে যাকে সে বেশি ভালোবাসে তাকে বাঁচাতে বেশি আগ্রহী হয় এবং সফলতাও লাভ
করে । তেমনি আমিও ধরে নিয়েছি এই কাজে আমি সফলতা না পেলে আমার ভালোবাসার মানুষগুলোর
ক্ষতি হবে, ওটাই আমাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে আর কি । এক কোথায় বলতে গেলে জব্বার স্যার
আমাকে বলেছিল ভালোবেসে সবটা করতে ।” রাজ বলল, “এহ! কি ভালোবাসা! চলনা, গানটা গাই”
“কোন গান?” “আরে ওই যে, হলুদ পাখি ।” আবির হেসে উঠলো । রাজ জিজ্ঞেস করলো, “হাসছিস কেন?”
আবির বলল, “দিনের বেলায় তুই পাখি দ্যাখোস কই?” রাজ ক্লাস এইটের একটা বারান্দায় ঈশারা
করে বলল, “ওই দ্যাখ পাখি ।” আবির বলল, “শালা ও তো মাইয়া!” রাজ বলল, “হ, তো পাখিই তো!”
আবির একটা মেরে বলল, “হারামি তোর না গার্ল ফ্রেন্ড আছে?” দুজনে আবার খুনসুটি শুরু করে
দিলো । আবার ফিরে এলো স্কুলের স্বাভাবিক পরিবেশ । এতি ছাড়া যারা নতুন ভর্তি হয়েছিলো
তাদের জন্য সোবহান আহমেদ অন্য একটা স্কুলের যাবার জন্য স্কুল বাসের ব্যাবস্থা করে দেন
আর এই স্কুলটা অনাথদের জন্যই থাকে । স্কুলের প্রিন্সিপ্যালও হল জব্বার স্যার ।
এরপর কাটতে থাকে দিন । এরই মাঝে ওরা জব্বার স্যার
এর বিয়ের দাওয়ার খায়, বেশ মজা করে । ঈদ আসে, স্কুলের পরীক্ষা হয়, সেপ্টেম্বর মাসের
দিকে সোমা আপুর একটা মেয়ে বাবু জন্ম নেয়, তারপর দিনও ওরা অনেক মজা করে । সোমা আপু সুস্থ
হলে সবাইকে বিরিয়ানি খাওয়ায় । একেকজনের জন্মদিনের খাওয়ায় । শীতকাল আসে । এরপর আসে এস
এস সি পরীক্ষা । সবাই বেশ ভালোই পরীক্ষা দেয়, রেজাল্টও সবার ভালো হয় । জামি আর শিমুল
বাদে সবাই এ প্লাস পায়, জামি পায় জিপিএ 4.30 আর শিমুল পায় জিপিএ 4.55 । এরপর হয় ওদের
ভর্তি যুদ্ধ । কে কোন কলেজে ভর্তি হবে সেটা । জামি আর শিমুলের চান্স আসে যশোর শাহীনে,
নিশি, নাবিলা, পরশ আর রাজের হয় ক্যান্টনমেন্ট কলেজে । রিতার হয় ক্যান্টনমেন্ট কলেজে,
তবে রিতা যশোর শাহীনে ভর্তি হয় । সবাই এই হোস্টেল থেকে চলে যাবার পর সোমা আপুর আলোকিত
সংঘের সাহায্যে অন্য কোথাও থাকবে আর ওদেরই টাকায় পরাশুনা চলবে । তাছাড়া সোবহান আঙ্কেলও
ওদের সাহায্য করবেন বলেছেন । আর আবির? কাউকে আবির জানায় না আবির কোথায় ভর্তি হয়েছে
। আসলে আবিরের চান্স হয়েছে ঢাকার একটা কলেজে, নাম, মিরপুর সরকারী বিজ্ঞান কলেজ । আসলে
আবির এই এলাকা থেকে যেতে চায় নি কিন্তু সোমা আপু জোর করেছিলো আবিরকে ঢাকায় আসার জন্য
। বলেছিল, “আবির! তুই ভালো রেজাল্ট করেছিস! তোকে ঢাকায় ভর্তি হতেই হবে । দ্যাখ আমি
যাদের এনেছি এই এতিম খানায় সবাইকেই আমি ঢাকায় যেতে বলেছি, কারণ যশোরের এইচএসসির প্রশ্ন
অনেক কঠিন হয় । জানি তুই এই প্রশ্নেই পারবি, কিন্তু ঢাকায় গেলে তুই আরও উন্নতি করতে
পারবি । অনেক হেল্প হবে ঢাকায় গেলে তোর । জামি আর শিমুল তো ভালো রেজাল্ট করে নি, আর
নাবিলাকে আমি বলেছিলাম, ও কি কারণে যেন যেতে চায় না ঢাকায় । এখন শুধু তুই-ই আছিস ।”
আবির জিজ্ঞেস করেছিলো, “ওখানে থাকবো কোথায় আমি?” সোমা আপু বলেছিল, “আমাদের আলোকিত সংঘের
একটা শাখা আছে ওখানে আবির, আবির ওদের সাথে কথা বলে নেবো, তুই চিন্তা করিস না ।” অগত্যা
আবির রাজি হয়েছিলো । বলতে গেলে সবই হয়েছিলো শুধু একটা ব্যাপারই হয় নি । নাবিলার সাথে
আবিরের কথা ।
৩০ জুনের কথা । ফজরের নামাজ পড়ে এসে ছাদে রাজের
সাথে বসে আবির । রাজ বলল, “আজ কখন তোর ট্রেন?” আবির বলল, “সাড়ে সাত টায় ।” রাজ বলল,
“সবার কাছে বিদায় নিবি না?’ “নিয়েছি রাতেই । এখন আর এই ভোরে আর কাউকে ডিস্টার্ব করতে
চাই না ।” রাজ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো । আবির বিছানাটার দিকে তাকাল একবার । কতো স্মৃতি
জড়িয়ে আছে এই বিছানাটার সাথে । এই ছাদের সাথে । রাজ রেলিঙের ওপর হাত রেখে দাঁড়ালো ।
আবিরও যেয়ে দাঁড়ালো । নারকেল গাছে বাবুই পাখির বাসাটা ভেঙ্গে গেছে ঝড়ে । ইদানীং খুব
ঝড় হয় । অবশ্য মৌসুমটা ঝড় বৃষ্টিরই আকাশে এখনও মেঘ জমে আছে । বৃষ্টি যেকোনো সময় আসতে
পারে ।” রাজ হঠাৎ জ্ঞান গেয়ে উঠলো, “সেই যে হলুদ পাখি, বসে জামরুল গাছের ডালে……।” আবির
পরের লাইন ধরল, “করতো ডাকাডাকি, আমার শৈশবের সকালে……।” এরপর দুজন দুজনের দিকে তাকাল
। তারপর দুজন একসাথেই গেয়ে উঠলো,
“সেই যে হলুদ পাখি, বসে জামরুল গাছের ডালে,
করতো ডাকাডাকি, আমার শৈশবের সকালে,
একদিন গেলো উড়ে, জানি না, কোন সুদূরে
ফিরবে না, সেকি ফিরবে না, ফিরবে না আর কোনোদিন
ফিরবে না, সেকি ফিরবে না, ফিরবে না আর কোনোদিন
।”
বলেই দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে
দিলো । কারো মুখ থেকে কথা বেরোচ্ছে না । দুজনেই যেন বোবা হয়ে গেছে ।
৬টার দিকে রাজ একটা রিকশা নিয়ে এলো । আবির একটা
ট্রলি ব্যাগ আর কাঁধ ব্যাগ নিয়ে দাড়িয়ে ছিল । রাজ এসে রিকশা থেকে নেমে
আবিরের ব্যাগটা রিকশায় রাখল । এরপর আবিরও উঠলো । গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে । সাথে
আরও ছিল নিশি, পরশ আর পাপলু আঙ্কেল । নাবিলা, জামি, শিমুলকে আর ডাকে নি ওরা ঘুমোচ্ছে
বলে । আবির রিকশায় ওঠার আগে আরও একবার পাপলু আঙ্কেল, পরশ, রাজকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলো
। নিশির সাথেও হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিলো । আবির রিকশায় উঠে বসলো । পরশ বলল, “পৌঁছে
ফোন দিস ।” আবির মাথা ডানে কাত করলো । কিছু বলল । এরপর রিকশাওয়ালাকে বলল, “মামা চলেন
।” রিকশাওয়ালা প্যাডেল দিলো । বৃষ্টি আরেকটু জোরে শুরু হয়েছে বলে আবির রিকশার হুডটা
উঠিয়ে দিলো । বার বার হুডের পেছনের ফাঁকা অংশ দিয়ে পেছন ফিরে দেখছিল সবাইকে । সবাইও
আবিরের দিকে তাকিয়ে । আবিরের গাল বেয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে । পাপলু আঙ্কেল বলে
উঠলো, “আল্লাহ! সময় যে কীভাবে কেটে যায়!” অনেকটা যেয়ে রিকশা ডানে মোড় নিয়ে সবার চোখের
আড়াল হয়ে গেলো । রাজ তখনই হাটু গেড়ে মাটির ওপর বসে জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো । বৃষ্টিও
যেন এর সাথে পাল্লা দিয়ে জোরে পড়তে শুরু করলো । সবাই ভিজছে, কিন্তু কোন পাত্তা নেই
। সবারই আজ মন খারাপ আবির চলে যাওয়ায় ।
স্টেশনে আবিরের জন্য অপেক্ষা করছিলো সোমা আপু আর
রাকিব ভাই । আবির যেতেই সোমা আপু আবিরকে আবিরের সিটে নিয়ে গেলো । সোমা আপুর কোলে উনার
ছোট মেয়েটা , না রেখে নামিরা । সোমা আপু জানালার কাছে দাড়িয়ে ছিল, আবিরকে ভেতরে নিয়ে
গিয়েছিলো সোমা আপু আবিরকে বলল, “ওইটুকু ছিলি
তুই, আমি তোকে দেখেছিলাম । আর আজ তুই
চলে যাচ্ছিস আমাদের ছেড়ে । ভালো থাকিস । আর
খারাপ লাগলে অবশ্যই যশোর আসিস কিন্তু ।” আবির হাসিমুখে বলল, “জি আপু । আপনার
ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না । আপনার আমাদের
সবার মা ।” সোমা আপু বলল, “থাক, এখন এসব কথা বলিস না, তুই ভালো থাকিস ।” সেই সময় ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠলো
। ট্রেন ধীর গতিতে চলতে শুরু করলো । রাকিব ভাই যাবার সময় আবিরের মাথায় হাত রেখে আদর করে বলল, “ভালো থাকিস
চ্যাম্প!” তারপর রাকিব ভাই ট্রেন থেকে নেমে এলো । শেষ সোমা আপু একটা কথাই বলল, “পৌঁছে
ফোন দিস ।” আবির “আচ্ছা” বলেছিল, কিন্তু সোমা আপু শুনেছিলো কি না, জানা নেই । আবির
জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো রাকিব ভাই এর বুকে
মাথা রেখে কাঁদছে সোমা আপু । আবির ততোক্ষণ
তাকিয়ে রইল যতক্ষণ সোমা আপুকে দেখা যায় । ঠিক আপু না, মা কে ।
সকাল ১০টার
দিকের কথা । নিশি ডাইনিং টেবিলে বসে কি একটা বানাচ্ছিলো, এমন সময় কলিংবেলের
আওয়াজ । নাবিলা দরজা খুলল । ভেতরে এলো সায়রা । নাবিলা বলল, “কেমন্ন আছো সায়রা?” সায়রা
জবাব দিলো, “ভালো আছি আপু, তুমি কেমন আছো?” নাবিলা বলল, “হ্যাঁ ভালো?” এরপর সায়রা নিশির কাছে গেলো । নাবিলা দরজা
আটকাতে যাবে এমন সময় এলো পরশ । ভেতরে এসেই নিশিকে বলল, “এ নিশি, একটু নিচে আয় না, দ্যাখ রাজের কান্না থামতেছেই না!”
নিশির মনটা খারাপ হয়ে গেলো । সায়রা বলল, “আবির ভাইয়া চলে গেছে, না?” নিশি বলল, “হুম
। তোমার সাথে দেখা করেছে?” সায়রা বলল, “জি । আমার সাথে গতকালই দেখা করেছিলো ।” নাবিলার
ভ্রু কুঁচকে বিরক্তিভাব প্রকাশ করে বলল, “কিরে? আবির কখন গেলো?” নিশি উঠে দাড়িয়ে হালকা
রাগ দেখিয়ে বলল, “বা বা, দরদ দেখছি উতলে উঠছে?” নাবিলা বলল, “দ্যাখ, দরদের ব্যাপার
না । কথা না বলি, যাবার সময় একটু দেখা তো করে যেতে পারতো । অবশ্য আমার সম্পর্কে যা
বলেছে, তাতে তো ওর কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো আচরন এক্সপেক্ট করা যায় না ।” নিশি জিজ্ঞেস
করলো, “কি বলেছে?” “ও আমাকে বলছে আমার মতো মেয়ে নাকি ওর পাশে মানায় না, ও বলছে রাস্তায়
দাঁড়াইলে আমার চেয়েও ভালো মেয়ে পাবি, ও বলসে আমার চেয়ে ওর স্ট্যাটাস অনেক উচুতে ।”
সায়রা তখন বলল, “নাবিলা আপু, তোমার কথার মাঝে কথা বলার জন্য সরি, কিন্তু তোমার ভুল
ভাঙ্গানোর জন্য বলতেই হচ্ছে । আসলে সেদিন আবির ভাইয়া আমাকে ইচ্ছে করেই কথাগুলো বলেছিল
যেন আমি তোমার আর আবির ভাইয়ার রিলেশন না হওয়ায় কষ্ট না পাই ।” নাবিলা একটু অবাক হল
। তারপর বলল, “মহৎ সাজে না! খুব মহৎ সাজে!” নিশি তারপর রেগে গিয়ে বলল, “না রে, মহৎ
না, ও ভালোবেসে সবটা করেছে । ও তোকে ভালোবাসতো, ও রাজকে ভালোবাসতো, ও আমাদের সবাইকে
ভালোবাসতো । তোর কি একবারও মনে হয় নি, ও কেন এসব বলবে যে আবির সবার উপকার করে? তা কেন
হবে? তোর তো শুধু এটাই প্রমান করতে ইচ্ছে করে মেয়েরা ন্যাকামো করবে আর ছেলেদের সেটা
সহ্য করতে হবে, কিংবা প্রেম আর বন্ধুত্বের মাঝে প্রেম উত্তম । আর আবির ভালবেসেই সবটা
সমাধান করে ফেললো ।” নাবিলা আর কিছু বলতে পারলো না । নিশি পরশকে বলল, “চল পরশ, সায়রা
তুমিও আসো ।” বলে পরশ নিশি আর সায়রা চলে গেলো । নাবিলা দাড়িয়ে রইল একটা চেয়ারের ওপর
হাত রেখে । নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছে । আসলেই ওর সত্যিটা না জেনে এসব করা উচিৎ হয় নি
। একটুও না । নিশি নিজের প্রতি রাজে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো । মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে
বসে পড়লো । কিন্তু করার কি আছে সময় তো আর নেই ।
ওদিকে ট্রেনে বসে ট্রেনের জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে
বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল আবির । বিস্তর ধান খেতের মাঝ দিয়ে চলছে ট্রেন । আবিরের
কষ্ট লাগলেও ঠোঁটে হাসি । কারণ ও ভালোবেসে সব কঠিন হিসেব সমাধান করেছে । ভালোবেসে সবটা
।