পরিচয়(সিজন-৫)(১ম অংশ) (পর্ব-১০১- ১৩৯)
ভালোবেসে সবটা
(১)
আজ সকালটা বেশ দারুন ।
একে আকাশ মেঘলা, তার ওপর নেই বৃষ্টি । এরকম আবহাওয়া কে না ভালবাসে এই গরমে? নেই রৌদ্রের তাপ, নেই বৃষ্টিতে বাইরে বেরোতে না পারার কষ্ট । সাথে মৃদু ঠাণ্ডা হাওয়া । তবে
বৃষ্টি যে পড়ে আসবে না, তার কোন গ্যারান্টি নেই । আজ ৪
এপ্রিল শনিবার । ক্যালেন্ডারের পাতা সেটাই জানান দিচ্ছে । হালকা খুলে থাকা জানালা
দিয়ে আসা বাতাসে ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো উড়ছে । এরই মাঝে বিছানায় কাথা গায়ে দিয়ে
এখনও শুয়ে আছে আবির । কাথা থেকে এক পা বেড়িয়ে আছে । ঘুমের ঘোরে বলল, "এই পরশ, জানালাটা আটকায় দে না, বাতাস আইতাছে ।" পরশের কোন জবাব পেলো না আবির ।
আবির হাত দিয়ে পরশকে ডাকতে চেষ্টা করলো কিন্তু পরশের স্পর্শ পেলো না । কোনোরকমে
তাকিয়ে দেখল, পাশে পরশ নেই । অবাক হল একটু, কি ব্যাপার! অন্যান্যদিন তো পরশ আবিরের পড়ে আসে,
আজ হঠাৎ কি হল? আবির মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল,
সকাল সাড়ে ৯টা বাজে । এতক্ষণ ঘুমিয়েছে! দেখে
নিজেই অবাক হয়ে গেলো । চোখ দুটো বড় বড় করে এক মুহূর্তের জন্য ফোনটার দিকে তাকাল ।
তারপর ফোনটা রেখে একটা লম্বা হাই তুলল আবির । বুঝলো, আগের
দিন যা খাটাখাটনি খেটেছে, তাতে এতক্ষণ ঘুমানো অস্বাভাবিক না
। দরজা খুলে ডাইনিং রুমে এলো । খেয়াল করলো, জামি আর শিমুলের
রুমে দরজা খোলা । আবির যেয়ে উঁকি দিতেই দেখল, ওরাও ঘরে নেই ।
আবির আরও অবাক হয়ে গেলো । আর যাই হোক, ছুটির দিনে এই দুজন তো এতো তাড়াতাড়ি ওঠার কথা না,
ছুটি পেলেই তার আগের রাতে জামি আর শিমুল নিজেদের রুমে কাথার নিচে
শুয়ে মোবাইলে সুন্দর সুন্দর ভিডিও দ্যাখে । আজ হঠাৎ কি হল?" আবির এক মুহূর্তের জন্য ভাবল, আজ আসলেই শনিবার তো?
তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকে ক্যালেন্ডারটা দেখল । আজ তো শনিবারই, তাহলে ওরা গেলো কোথায়? আবির আবার ডাইনিং রুমে এলো ।
কেন যেন মনে হল ঘরের দরজা থেকে কেউ একজন দৌড়ে চলে গেলো ছাদের দিকে । এতক্ষণ উঁকি
দিচ্ছিল । আবিরও কে দৌড়ল তা দেখবার জন্য দরজার কাছে গেলো । কাউকে দেখা যাচ্ছে না্ কিন্তু খেয়াল
করে দেখল, নাবিলা আর
নিশির ঘরের দরজাটা খুলে আছে । দরজার
সামনে জুতোও নেই । মানে, ওরাও কোথাও গেছে । এমন সময় মনে হল
সিঁড়ি থেকে কেউ উঁকি দিচ্ছে আবিরের দিকে । আবির সেদিকে চোখ দিতে সে চলে গেলো সেখান
থেকে । এবার আবির দেখার জন্য যখন জুতো পড়তে যাবে, তখন খেয়াল
করলো, ওর নিজের
জুতোটাও দরজার সামনে নেই । বা পায়েরটা সিঁড়ির ওপর । আবির সেখানে যেয়ে জুতোটা পড়লো । সেখানে যেয়ে দেখল, ডান পায়ের জুতোটি ছাদের দরজার সামনে । আবির এক পায়ের লাফাতে লাফাতে ছাদের
দরজার সামনে এসে অন্য জুতোটাও পড়ে নিলো । তারপর সামের দিকে তাকাতেই দেখল, একটা টি-টেবিলে কেক । আবির ঘুম ঘুম চোখে তখনও ঠিক
মতো বুঝতে পারছে না, ওটা কি । কাছে এগিয়ে গেলো । দেখলো,
একটা বার্থডে কেক । ওপরে ১৬টা মোমবাতি জলছে আর লেখা, "হ্যাপি বার্থডে আবির " পাশে ব্রাকেটে লেখা "ছোটু" আবিরের পড়া শেষ হয় নি, এমন সময় পেছন থেকে অনেকগুলো মানুষ একসাথে বলে উঠলো, "হ্যাপি বার্থডে আবির!" আবির পেছন ফিরে তাকালো ।
দেখল, জামি, শিমুল, পরশ, নাবিলা, নিশি, সায়রা, সানি, পাপলু আঙ্কেল,
সোমা আপু, রাকিব ভাই আর হোস্টেলের এবং
অন্যান্য ক্লাসের পরিচিত অনেকে । এতক্ষণ সবাই ছাদের দরজার পাশে এমনভাবে দাড়িয়ে ছিল,
যেন আবির ভেতরে ঢুকলে ওদের দেখতে না পায় । ওরা সবাই আবিরের কাছে এলো
। আবিরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। জামি বলল, "এ, তোরে প্রত্যেক বছর উইশ করি,
আর তুই এক বছরও মনে রাখোস
না?" আবির বলল, "আমি সত্যি
ভুইলা গেছি রে । কিন্তু আমি তোদের এখন কি
খাওয়াই!" সোমা আপু বলল, "আবির
প্রতি বছর তোর মুখে একই প্রশ্ন । আরে, তুই কি চাকরি করিস
নাকি যে আমাদের খাওয়াতে হবে, আমিই তোদের খাওয়াবো প্রতি বছরের
মতো ।" আবির বলল, "আপু,
আপনি না, সত্যি অনেক ভালো একজন মানুষ । আপনার
মতো যদি সবাই হইতো ।" নিশি বলল, "আপু দেখছেন, প্রতি বছর আবির একই ঢং করে । আরে, আপু খাওয়াচ্ছে,
আপু । আমাদের বোন । এতে এতো ঢং করার কি আছে?" পরশ বলল, "ঠিকই তো, আমরা
সবাই একটা পরিবার, আর আপু আমাদের অভিভাবক । আপু খাওয়াবে না
তো কে খাওয়াবে?" রাকিব ভাই তখন ইয়ার্কি করে বলল,
"বাহ! সবাই আপুর কি প্রশংসা করছে,
আর ভাইয়া তো বানের জ্বলে ভেসে এসেছে ।" সবাই
তখন বলল, "না বাবা না, মায়ের কথা
বলছি বাবার কথা ভুলে যেতে পারি?" রাকিব ভাই খুশি হয়ে
গেলো । বলল, "বাহ, একেবারে ভাইয়া
থেকে বাবা, এতো ভালোবাসা কোথায় রাখি ।" সোমা আপু বলল, "হয়েছে তোদের তর্ক বিতর্ক? এবার
কি কেকটা কাটতে পারে আবির?" সবাই বলল, "হ্যাঁ অবশ্যই!" আবিরের হাতে ছুরি দিয়ে সোমা আপু
বলল, "নে আবির, কেকটা কাট ।"
আবির ছুরিটা হাতে নিয়ে বলল, "নাও,
তোমরাও ধরো ।" যতজন পারলো, ধরল কেকটা । আবির মোমবাতি নিভিয়ে কেকটা কাটল । সবাই একসাথে বলে উঠলো,
"হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে
টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ ডিয়ার আবির, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ ।" হাততালির আওয়াজে
চারপাশ মুখরিত হল । কেকের একটা টুকরো নিয়ে আবির একটু সোমা আপুকে খাওয়ালো, তারপর রাকিব ভাইকে । এরপর পরশকে খাওয়াতে যাবে, এমন
সময় পরশ আবিরের হাত ধরে বলল, "উহু, মা বাবার পরে একটু স্পেশাল কাউকে আগে খাওয়া ।" আবির
ঠিক বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, "স্পেশাল কাউকে মানে?"
জামি ইয়ার্কি করে বলল, "আহা! ছেলে যেন কিছু বোঝে না । কচি খোকা ।" আবির বলল, "না আমি সত্যি কিছু বুঝতে
পারছি না ।" শিমুল তখন বলল, "আরে তোর নাবিলা রে, নাবিলা ।" আবির বলল, "ধ্যাৎ! কি সব
যে বলিস না । কই নাবিলা?" আবির নাবিলাকে খুজল । শিমুলও
চারপাশে তাকিয়ে দেখে বলল, "এখানেই তো ছিল, গেলো কোথায়?" সোমা আপু বলল, "চলে গেছে বোধ হয় । ওর কি কিছু হয়েছে? আমাদের সাথে
যখন ছিল তখন ওর মন খারাপ ছিল ।" আবিরের মনে পড়লো,
গতকাল আবির নাবিলাকে ধমকেছিল । বুঝল, সেজন্যই
হয়তো নাবিলার মন খারাপ । কিছু আর বলল না । রাকিব ভাই তখন বলল, "নিশি, আপু তুমি একটু যেয়ে দেখ তো, নিচে রুমে আছে কি না নাবিলা ।" নিশি "আচ্ছা" বলে ঘোরে চলে গেলো । যেয়ে দেখলো,
টেবিলের বই নিয়ে বসে পড়ছে নাবিলা । নিশি নাবিলার কাছে এসে কাধে হাত
রেখে বলল, "কিরে নাবিলা, তুই চলে
এলি কেন?" নাবিলা হঠাৎ চোখ মুছে বলল, "না এমনি । চোখ জ্বলছিল কেন
যেন খুব ।" নিশি বলল, "আচ্ছা
তোর হয়েছে কি বলতো? এমন করছিস কেন তুই? আসলেই কি তোর চোখ জলছে, নাকি কিছু হয়েছে আর তুই
কাদছিলি? তুই কিন্তু গতকালও কেদেছিলি অনেক । তবে কি আবিরের
সাথেই তোর কিছু হয়েছে?" নাবিলা একটু হাসবার চেষ্টা করে
বলল, "না না, ওর সাথে আবার কি হতে
যাবে? সত্যি চোখ জ্বলছিল ।" নিশি
বলল, "তোর চোখের ভাষা কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে ।
এদিকে ছাদে আবির বলল, "আচ্ছা
নাবিলা আসতে থাক, আমি তোদের খাওয়াইতে থাকি ।" তারপর আবির সবাইকে খাওয়াতে লাগলো । একে একে জামি, শিমুল,
পরশ, পাপলু আঙ্কেল এবং অন্যান্য সবাইকে ।
সবাইও আবিরকে একটু করে খাওয়ালো । খাওয়ানো শেষ হলে সোমা আপু বলল, "আচ্ছা, এবার আমি কেকটা পিস করছি । তোমরা মিশন ডএফ
শুরু করো ।" ডিএফ মানে ডিম ফাটানো । সবাই ইয়ার্কি করে
এভাবে বলে । আবির বলল, "এই না, একদম
না!"বলতে বলতেই খেয়াল করলো, আবিরের
চারপাশে দড়ি আগে থেকেই ছিল, এখন টাইট করে বাঁধল । এরপর
একেকজন হাতে আটা আর ডিম এনে ইচ্ছে মতো আবিরের মাথায় মাখিয়ে দিল । অনেক মজা করলো
সবাই । আবিরের মুখখানা ডিম আর আটার সংমিশ্রণে একদম সাদা হয়ে গেলো । যা হয় আর কি
সবার বার্থডে তে এ যুগে । সবাই মিলে অনেক মজা করলো । এরই মাঝে খাবার নিয়ে হাজির হল
সোমা আপু । বিরিয়ানির প্যাকেট । সোমা আপু বলল, "খাবার রেডি!" জামি তখন নিজের ভুড়ি হাতাতে
হাতাতে বলল, "আহা! কিছুদিনের
মাথায়েই আবার বিরিয়ানি । এরকম যদি সবার জন্মদিন হতো, সাথে
প্রতিদিনই সোমা আপু একটা করে বাচ্চা হতো, কতই না ভালো হতো ।"
আবির পরশের কাছ থেকে পানি নিয়ে মুখটা মুছে নিলো । পরশ তখন জামির
উদ্দেশ্যে বলল, "মোটু, তুই একটু
ভুঁড়ির দিকে নজর দে । হাতি হয়ে যাচ্ছিস ।" আবির নিজের
নিজের মুখ মোছার সাথে সাথে পরশ আর শিমুলকেও ভিজিয়ে দিল । পরশ বলল, "ধুর! করতেছোস কি?" আবির
কিছু বলল না, জাস্ট ইয়ার্কিই ছিল । রাকিব ভাই তখন ছাদের
দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, "নিশি আর নাবিলা এখনও এলো না ।"
আবিরও খেয়াল করলো । তারপর আবির সোমা আপুকে বলল, "সোমা আপু, কেকের পিসগুলো কোথায় রাখসো?"
"তোদের ঘরের ফ্রিজে দ্যাখ ।" আবির
বলল, "আচ্ছা, তুই সবাইরে খাইতে
দাও, আমি একটু আইতাছি ।" আবির
নিচে চলে এলো । ফ্রিজ থেকে এক পিস কেক বের করে নিশি আর নাবিলার ঘরের দরজার সামনে
দাড়িয়ে নিশিকে ডাকল । "নিশি! একটু
এইদিকে আয় না ।" নিশি নাবিলার সাথে কথা বলছিল । আবিরের
ডাক শুনে রুমের দরজার দিকে তাকাল । তারপর বলল, "দ্যাখ,
চলে এসেছে দাড়া শুনে আসি ।" নিশি চলে এলো
। নাবিলা আটকাতে চাইলো, কিন্তু তার আগেই নিশি চলে গেলো ।
ঘরের দরজার সামনে যেয়ে দেখল, আবির কেকের পিস নিয়ে দাড়িয়ে ।
আবির জিজ্ঞেস করলো, "নাবিলা কোথায়?" নিশি কানে কানে বলল, "ভেতরে যেয়ে ওকে খাইয়ে
দিয়ে আয় ।" আবির ভ্রু-কুঁচকে
ফিসফিসিয়ে বলল, "পাগল নাকি তুই! মেয়েদের
রুম এটা!" নিশি বলল, "চিল
মামা, কেউ তো দেখছে না, তোমার সিমরান
একাই আছে, আমি উপরে যাইয়া একটু ভুঁড়ি ভোজ করি ।"
বলে নিশি চলে গেলো । আবির নিশিকে কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু তার আগেই নিশি ওপরে চলে গেলো । আবির ঘরের দিকে তাকাল । যাবে?
নাকি যাবে না? দোটানায় পড়ে গেলো বেচারা । এর
আগে কোন ছেলে মেয়েদের হোস্টেলে যায় ওই অর্ক ছাড়া । এখন আবির যাবে? অনেকক্ষণ ভাবল । তারপর নিজেই নিজেকে বলল, "না
যাই । যা আছে কপালে হবে।" আবির ভেতরে ঢুকল । ধীর পায়ে
এগিয়ে গেলো নাবিলার রুমে । দরজা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, নাবিলা
মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে । আবির একটা ঢোক গিলল । তারপর বুকে ফু দিয়ে চাপা কণ্ঠে
ডাকল, "নাবিলা!" নাবিলা
প্রথমে চমকে গেলো । তারপর দ্রুতবেগে উঠে দাড়িয়ে আবিরের দিকে ঘুরে দাড়িয়ে বলল,
"একি! তুমি ভেতরে এসেছ কেন!"
আবির ভয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল, "ন...না ম...মানে......" কথা
শেষ করতে না দিয়ে নাবিলা কাছে এসে বলল, "তোমার লজ্জা
নেই! মেয়েদের রুমে ঢুকেছ! আজব! কেউ দেখলে কি হব জানো!" আবির বলল,
"কেকটা খাওয়াতে......" আবিরের কথা
শেষ করতে না দিয়েই আবিরের হাত থেকে কেকটা কেরে নিয়ে মুখে দিয়ে নাবিলা বলল,
"খেয়েছি, খুশি!" আবির বলল, "আ...আমি তো
আমার হাতে খাওয়াতে চেয়েছিলাম!" "খাওয়াতে পেরেছি,
এতেই খুশি থাকো ।" আবির বলল,
"মন খারাপ করেই থাকবে? একটু হাসবে?"
নাবিলা তখন বিরক্তি হয়ে বলল, "কেন?
আমি হাসলে তোমার কি?" আবির বলল,
"আ...আমার......" আবিরের কথা শেষ হতে না হতেই দরজা থেকে নিশি, জামি,
পরশ, শিমুল বলে উঠলো, "কুচ কুচ হোতা হেয়!" আবির আর নিশি দরজার দিকে তাকাল
। বুঝল, এতক্ষণ ওরা দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে আবির আর নাবিলার
কাহিনী দেখছিল ।
আবির আর নাবিলা দরজার
দিকে তাকাতেই ওরা দৌড় দিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে । আবির সামনের দিকে তাকাতেই
নাবিলাও দরজাটা আটকে দিল ।
(২)
দুপুরে ছাদের খাটটার ওপর
বসেছিল আবির । ভাবছিল, সেদিন যে নাবিলাকে ধমকেছিল সেই ব্যাপারটা । অবশ্য ধমকানোর
একটা কারণ ছিল । আবির এমনিতেও সে সময় জবাব খুজে পাচ্ছিল না অনামিকার খুন করবার
ব্যাপারটার তার ওপর যদি একটা মেয়ে এসে ন্যাকামো করে, তাহলে
রাগ করাটা অস্বাভাবিক না । খানিক বাদে পরশ এলো । আবিরের কাধে হাত রেখে বলল,
"কি অবস্থা বার্থডে বয়?" আবির জবাব
দিল, "আমি কখনো খারাপ থাকি না ।" "হ, তা তো দেখতেই পাইতাছি । যার মুখে হাসি নেই, ভালো
আছি বলে সেই, তাই না?" আবির হেসে
দিয়ে বলল, "আরে না রে, সেইজন্য না
। এমনিতেই ভাললাগতেছে না । খুব ইচ্ছা হইতাছে নিজের টাকা দিয়ে সবাইকে কিছু খাওয়ানোর
। কিন্তু আমার কাছে ইতোমধ্যে এ মাসে স্কুল থেকে দেয়া হাত খরচের ৫০০ শেষ মাত্র ৪
দিনেই । বাকি ৫০০ দিয়ে পুরো মাসটা চলতে হইবো ।" "ও,
এই ব্যাপার! আমার কাছে সাড়ে ৮০০ আছে এহনও ।
লাগলে নিস ।" আবির তখন পরশের দিকে তাকিয়ে বলল,
"আচ্ছা মামা, একখান কথা জিগাই?"
"জিগা।" আবির প্রশ্ন করলো,
"ধর আজকে আমি মইরা গেলাম । তোর কাছে অনেকগুলা শর্ত আছে যেইগুলা
মিলাইলে আমার খুনিরে তুই ধরতে পারবি । কিন্তু শর্তের কিনারা তুই কিছুতেই করতে
পারতেছোস না, ভাবতে ভাবতে তোর মাথা ব্যাথা শুরু হইয়া গেলো ।
এমন সময় কোন মাইয়া আইসা তোর লগে ন্যাকামি শুরু করলো । তুই কি করবি?" পরশ ভ্রু কুঁচকে বলল, "মানে কি!" আবির বলল, "আরে ভাই ক না তুই কি করবি? মন থেইকা ক?" পরশ একটু ভেবে বলল, "উমম,সত্যি কথাই কই, যদি মাইয়া
এমন করতো, আমি ওরে ছাদ থেইকা ফালায় দিতাম ।" আবির বুকে হাত দিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, "যাক, আমি তাও কম বাঁশ দিছি ।" পরশ ভয়ে উঠে দাড়িয়ে বলল, "আয় হায়! কারে কি করছোস তুই!" "আরে, কিছুই না । বাদ দে ।" পরশ আবারো কিছু একটা বলতে
যাবে, এমন সময় গাড়ির হর্নের আওয়াজ শুনে থেমে গেলো । আওয়াজটা
হোস্টেল বিল্ডিং এর সামনে থেকেই এসেছে । সেদিকে তাকিয়ে পরশ অবাক হয়ে বলল,
"কি ব্যাপার! এইহানে গাড়ি লইয়া কে আইল?"
সাধারণত প্রিন্সিপ্যাল স্যার ছাড়া এখানে আর কেউই গাড়ি নিয়ে আসে নি ।
কিন্তু প্রিন্সিপ্যাল স্যার তো পুলিশের হেফাজতে, আর রাশেদ
স্যারকে অস্থায়ী প্রিন্সিপ্যাল করা হয়েছে, তাহলে এখন আবার
গাড়ি নিয়ে কে এলো? দেখার জন্য পরশ ছাদের রেলিঙের কাছে এগিয়ে
গেলো । দেখল, একটা প্রাইভেট কার দাড়িয়ে আছে । হাতে একটা
লাগেজ নিয়ে দাড়িয়ে একটা বেশ হ্যান্ডসাম একটা ছেলে । চোখে সানগ্লাস, গায়ের রঙ ফর্সা, বেশ লম্বা । মুখে চাপদাড়ি । পড়নে
হলুদ গেঞ্জি, কালো জিনস । হাতে একটা আইফোনে কি যেন দেখছিল ।
পাশেই বেরোলেন আরেকজন ভদ্রলোক । তিনিও ফর্সা, লম্বা । শুধু
বয়স অনেক বেশি । হাতে একটা লাঠি । চোখে গোল ফ্রেমের চশমা । মুখে বেশ বড় বড় দাড়ি ।
পরশ বুঝতে পারলো না, ঠিক কে এসেছে । ভর্তি হতে? তাহলে পাশে ওটা কে? বাবা, না
ভর্তি হয় তো অনাথরা, যাদের বাবা মা নেই । তাহলে? ঠিক বুঝতে পারলো না পরশ । তাকিয়ে দেখল, রিসিপশন রুম
থেকে দৌড়ে আসছে পাপলু আঙ্কেল । তাহলে খুব সম্ভবত ভর্তি হতে এসেছে । নিচে দাড়িয়ে
থাকা ছেলেটা হঠাৎ ওপরে তাকাল । এই দেখে তাড়াতাড়ি করে রেলিং থেকে চলে এলো পরশ ।
আবির জিজ্ঞেস করলো, "কে এসেছে রে?" "নতুন কেউ ভর্তি হয়েছে মনে হয় ।" আবির কোন জবাব
দিল না । আবির আর পরশ অন্য প্রসঙ্গে গল্প করছিলো, এমন সময়
ছাদে এলো পাপলু আঙ্কেল । এসে পরশকে বলল, "তোকেই
খুজছিলাম । শোন, তুই আগে যে বাসাটায় ছিল, ওটার যে রুমে রিভু ছিল, সেখানে নতুন একটা ছেলে এসেছে
। তুই আবার নিজের রুমে চলে আয় ।" পরশ পাপলু আঙ্কেলের
কথার কোন জবাব না দিয়ে প্রশ্ন করলো, "কে আইছে পাপলু
আঙ্কেন? গাড়িটারি নিয়ে একদম হাইফাই স্টাইল-এ?" পাপলু আঙ্কেল বলল, "আরে, এক বিরাট বড় ব্যাবসায়ীর ভাতিজা । নাম রাজ । তা
ছেলের চাচি আবার এরে সহ্য করতে পারে না । তাই শেষে চাচা বাধ্য হয়ে ভাতিজাকে দিয়ে
গেলো ।" পরশ কপালে হাত রেখে বলল, "হায়রে আমার কপাল! প্রত্যেকবার ওই বাসাতেই একেকটা
নবাবের বাড়ির ভাতিজাই আসে! আল্লাহ! তোমার
কাছে বিচার দিলাম!" পাপলু আঙ্কেল বলল, "যা ভাবো আর কি । তবে ছেলে দেখে মনে হয় না অর্কর মতো খারাপ । চেহারাও কি
সুন্দর, আমার মেয়ে-টেয়ে থাকলে বিয়ে করিয়ে
দিতাম ।" পরশ বিরক্ত হয়ে বলল, "তুমি বিয়া করোগা যাও । আল্লাহই জানে! কি আছে কপালে ।"
পাপলু আঙ্কেল বলল, "হেহ! কি সব বলে । আচ্ছা আমি যাই, কাজ আছে ।" বলে চলে গেলো পাপলু আঙ্কেল ।
আবির বলল, "যাক,
একদিক থেইকা ভালো হইছে । আমার আর তোর লগে শোয়া লাগবো না ।"
পরশ বলল, "ভাই সে তো বুঝলাম, কিন্তু এও যদি অর্কর মতো আরেক মাল হয়?" "দেখা
যাক, কি হয় । অর্ক তো আসার পর থেকেই আচরণে দেখিয়ে দিয়েছিলো
এক নাম্বারের অসভ্য । পাপলু আঙ্কেল যখন বলে গেলো, হয়তো এ
ভালো ছেলে ।" পরশ
কিছুক্ষণ চুপ করে মাথা নিচু করে রইল । আবির তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল । সারাদিন
ঘন মেঘে আচ্ছন্ন আকাশটায় সূর্য উঁকি দেবার চেষ্টা করছে । সেদিকে চোখ গেলো আবিরের ।
কি একটা কথা পরশকে বলতে গেলো, এমন সময় পরশ বলল,
"দোস্ত, একটা বুদ্ধি আইছে ।"
আবির পরশের দিকে তাকাল । জানতে চাইলো, "কি?"
"শোন, আমি এক কাজ করি । আমার জিনিসগুলো তো
তোর রুমেই আছে," আবির ডানে বামে মাথা নাড়ল । "তাই এখন শুধু শুধু টেনে না নিয়ে যেয়ে আগে ওই ছেলেটার সাথে কথা বলে আসি,
দেখি ছেলেটা কেমন, তারপর যদি মেশার মতো হয়
তাহলে ভালো, নাহলে তোর লগেই ঘুমামু ।" পরশের কথা শুনে আবির বলল, "লাইত্থামু তোরে,
আইজকা শুইতে দিছি ভয় পাবি বইলা, আল্লাহ রহম
কইরা আইজকাই একজনরে পাঠাইছে, আর তুই এহন ভয় পাইতাছোস ।"
পরশ বলল, "আচ্ছা, তোর
সাথে ঘুমানোর ব্যাপার পড়ে বোঝা যাবে, আগে দেইখা তো আসি,
ছেলে কেমন?" আবির বলল, "যা ভাল্লাগলে বিয়াও করিস ।" পরশ আবিরের মাথার
পিছে একটা থাবা দিয়ে বলল, "হারামি! আমার কথা আমারেই কস!" আবির হাসতে লাগলো । পরশ
বিছানা থেকে নেমে জুতোটা পড়ে বলল, "যাই, দেইখা আসি, থাক ।" বলে
চলে গেলো পরশ । আবির "আচ্ছা বলে আবারো আগের মতো বসে
পড়লো । আবারো মাথায় সেই চিন্তা, নাবিলাকে ধমক দেয়াটাকি ঠিক
হয়েছে?
এদিকে নাবিলা বাসা থেকে
বেড়িয়ে কোথায় যেন যাবার জন্য জুতো পড়ছিল । ভেতর থেকে নিশি বলে উঠলো, "ওই
নাবিলা কই যাস?" নাবিলা জবাব দিল, "কিছু জিনিস কেনা লাগবে রে, একটু পরেই আসছি ।"
বলে নাবিলা নেমে গেলো । তিনতলায় আসতেই ছেলেদের পাশের বাসাটা থেকে
বেড়িয়ে এলো । একটা ছেলে । নাবিলা একবার ছেলেটার দিকে তাকাল । কি সুন্দর দেখতে
ছেলেটা, যেন ছোটবেলায় শোনা রূপকথার গল্পের রাজপুত্র, ছেলেটাও অল্প একটু ক্ষণের জন্য নাবিলার দিকে তাকাল । তারপর দরজায় ছিটকিনি
আটকে দিল । ছেলেটা আর কেউ নয়, এই হোস্টেলের নতুন সদস্য,
রাজ । নাবিলা ছেলেটার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো । কারণ নাবিলা বুঝতে
পারলো, ছেলেটার দিকে তাকালেই ছেলেটার প্রতি ওর কেমন একটা
দুর্বলতা জেগে উঠছে । ছেলেটাকে পেরিয়ে দোতলার দিকে যাবার জন্য নাবিলা নামছিল,
এমন সময় ছেলেটার ডাকে থেমে গেলো, "শুনছেন!" নাবিলা দাড়িয়ে গেলো, কিন্তু কোন জবাব দিল না ।
ছেলেটা আবারো বলল, "এক্সকিউজ মি!" নাবিলা তখন পেছন ফিরে তাকাল । নাবিলা ছেলেটার দিকে না তাকিয়েই বলল,
"আমাকে বলছেন?" রাজ বলল,
"জি । আসলে আমি এই একটু আগেই এখানে এসেছি । আমার কিছু জিনিস
কেনা লাগতো । বাট আনফরচুনেটলি আমি এই এলাকার কিছুই চিনি না । আর আমি যে বাসায় উঠেছি, এখানেও কেউ
নেই । আপনি যদি একটু সাহায্য করতেন, একটু ভালো
হতো ।" নাবিলা
কোনোরকমে নিজের দুর্বলতাকে সামলে ছেলেটার
দিকে তাকাল ।
তারপর হালকা হাসিমুখে বলল,
"জি অবশ্যই ।" নাবিলার জবাব
শুনে ছেলেটাও হাসিমুখে বলল, "থ্যাংকস ।"
হাসিমুখে ছেলেটাকে দেখতে আরও সুন্দর লাগে । নাবিলা ছেলেটার চোখ থেকে
যেন চোখ সরাতেই পারছিল না । ছেলেটা তখন
নাবিলার কাছে এসে বলল, "চলুন ।" নাবিলা বলল,"হ্যাঁ!...ও
হ্যাঁ, চলুন ।"
নাবিলা আর রাজ নিচে চলে এলো । পরশ তখন তিনতলায় এসে দেখল, বাসার দরজা ছিটকিনি লাগানো । ছিটকিনি খুলে ভেতরে গেলো । রিভু যে রুমে
থাকতো, মানে এখন রাজ যে রুমটায় থাকে সে রুমটায় উঁকি দিল ।
ভেতরে ব্যাগ, জিনিসপত্র সব আছে । পরশ নিজেকে বলল,
"সবই তো আছে, তাহলে গেলো কোথায় ছেলেটা?"
কিছুক্ষণ দাড়িয়ে আবার বলল, "না যাই,
আবিরের কাছে যেয়ে গল্প করি । এই ছেলের ব্যাপারটা পড়ে দেখা যাবে ।"
পরশ আবার চলে গেলো আবিরের
কাছে ।
(৩)
এদিকে নাবিলা আর রাজ
গেইট দিয়ে বাইরে চলে এলো । রিসিপশনে পাপলু আঙ্কেল দেখল ওদের দুজনকে । মুখে উনার
একটা চিন্তার ছাপ চলে এলো । কারণ সবাই চায় আবির আর নাবিলার একটা ভালো সম্পর্ক হোক, কিন্তু
এই ছেলেটা সেই সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না তো? এতক্ষণ
পর্যন্ত কেউ কারো সাথে কোন কথা বলে নি ।
বাইরে এসে ওরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে লাগলো । রাজ বলল, "এলাকাটা খুব সুন্দর ।" নাবিলা একবার রাজের দিকে
তাকাল । কিছু বলল না । রাজ আবারও বলল, "আমার এরকম এলাকা
খুব ভালো লাগে ।" নাবিলা এবারও কোন জবাব দিল না ।
ছেলেটাও এবার কিছু বলা বন্ধ করে দিল ।
নাবিলা বার বার ছেলেটার চোখের দিকে তাকাতে
লাগলো । ছেলেটা আবার রাগ করলো না তো? চেহারা দেখে তেমন কিছু
বুঝতে পারলো না । তাই নিজেই এবার প্রশ্ন করলো, "আপনার
নাম?" রাজ নাবিলার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল । তারপর বলল,
"বাহ! আপনি কথা বলতে পারেন! আমি ভেবেছিলাম পারেন না ।" নাবিলা লজ্জায় মুচকি
হেসে কানের পাশের চুলগুলো সরিয়ে ঘাড়ের অপাশে নিলো । রাজ বলল, "যাই
হোক, আমি রাজ ।"
নাবিলা খিল খিল করে হেসে উঠলো । রাজ নাবিলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস
করলো, "হাসছেন যে?" "না,
আমার সেই রাজ সিমরানের কথা
মনে পড়ে গেলো আরকি।" "তোর আপনি কি সিমরান?"
রাজের কথাটা শুনে নাবিলা থেমে
গেলো । এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাজের দিকে । রাজও থেমে তাকিয়ে রইল নাবিলার
দিকে ।
কিছুক্ষণ পর রাজ জিজ্ঞেস
করলো,
"কি হল?" নাবিলা কিছু বলল না । দুজনে আবার হাঁটা শুরু করলো । রাজ জিজ্ঞেস
করলো, "নামটা কিন্তু বললেন না ।" "ও হ্যাঁ, আমি নাবিলা" "ও আচ্ছা । খুব সুন্দর নাম । আমার মায়ের নামও নাবিলা ।" নাবিলা রাজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, "আপনার
মা?" "মারা
গেছেন যখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়তাম । বাবা
জন্মের আগেই মারা গিয়েছিলেন ।"
নাবিলা "ও আচ্ছা ।" বলে আবারও মাথা নিচু করলো । রাজ জিজ্ঞেস করলো, "ভালো কথা, আপনি বোধ হয় কোথাও যাচ্ছিলেন, আমার
জন্য আপনার কোন প্রবলেম হল না তো?"
নাবিলা হাসিমুখে বলল, "না না, আমি কিছু সাবান আর
শ্যাম্পু কিনতে যাচ্ছিলাম । শেষ হয়ে গেছে তো, তাই যাচ্ছি
কিনতে । কাল গোসল করতে লাগবে ।" রাজ
যেন খুশি হল । আনন্দের সাথে বলল, "বাহ! আমিও একই কাজে যাচ্ছি । চাচার বাড়ি থেকে এলাম, কিন্তু এসে দেখি আনতে ভুলে গেছি
। এখন আমার গোসল করা লাগবে । অনেক দূর থেকে জার্নি করে এসে শরীরটা কেমন ম্যাজ ম্যাজ করছে ।" নাবিলা আর রাজ একটা দোকানে ঢুকল । যা যা কেনার কিনল । নাবিলা যখন টাকা দিতে যাবে, ঠিক তখন রাজ বলল, "দেয়া লাগবে না, আমি দিয়ে দিয়েছি ।" নাবিলা অবাক হয়ে বলল, "সেকি! আপনি দিলেন কেন?" রাজ বলল, "আপনি আমাকে এতো সাহায্য করলেন, যদি
বন্ধু ভাবেন, এটুকু তো করতেই পারি ।" নাবিলা দেখল, রাজ হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে
দিয়েছে । নাবিলা একবার রাজের হাতের দিকে তাকাল, একবার মুখের
দিকে তাকাল । রাজ বলল, "কি হল, বন্ধু
হবে না?" নাবিলা ধীরে ধীরে হাতটা বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক
করলো । রাজ বলল, "চলুন যাই ।" দুজনে দোকান থেকে বেড়িয়ে এলো ।
অনেকক্ষণ পর সূর্যটা অবশেষে উঠেছে । দেখে মনে হচ্ছে উজ্জ্বল একটা কমলা লেবুর মতো ।
সাথে ঠাণ্ডা হাওয়া । গায়ে লাগলে মনে হয় চারপাশ থেকে রূপকথার পরীরা গায়ে নরম ঠাণ্ডা
পালকের স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে । এরকম বাতাসে যে কারোরই ইচ্ছে করে, যতোটা দূর পারা যায়, দৌড়ে আসি । নাবিলারও সেরকম
ইচ্ছে হল । তবে হুট করে দৌড়নোটাতো সম্ভব নয়, লোকে দেখলে পাগল
ভাববে । তাই রাজকে জিজ্ঞেস করলো, "আবহাওয়াটা খুব সুন্দর,
তাইনা?" রাজ বলল, "জি অবশ্যই । আপনার মতো ।" "চলুন ঘুরে আসি
আশপাশ দিয়ে?" রাজ কিছু বলল না । কি যেন ভাবতে শুরু করলো
। নাবিলা তখন রাজের দিকে হাসিমুখে বলল, "কি হল? যাবেন না?" রাজ নাবিলার হাসিমুখটা দেখে কেমন
দুর্বলতা বোধ করলো । এরকম একটা হাসিমুখে কেউ যদি এরকম একটা অনুরোধ করে, সেটা তো আর ফেলা যায় না । রাজও হাসিমুখে বলল, "ঠিক
আছে, চলুন ।" সামনেই একটা মাঠ ।
লোকে নাম দিয়েছে গুপীর মাঠ । নাবিলা ওর হাতে থাকা জিনিস গুলো রাজের হাতে দিয়ে বলল, "এগুলো একটু ধরবেন?"
রাজ জিনিসগুলো হাতে নিলো । নাবিলা তখন হাত দুটো দুপাশে ছড়িয়ে হাসতে
হাসতে মাঠের দিকে দিল এক দৌড় । বাতাসে নাবিলার লাল ওড়নাটা উড়ছে । চুলগুলোও উড়ছে ।
রাজ "আরে দাঁড়ান......আরে..."
বলে নিজেও হাসতে হাসতে জিনিসগুলো সাথে নিয়েই মাঠের দিকে দৌড় দিল ।
এদিকে ছাদে তখনও আবির আর
পরশ । আবির খাটের একপাশে পা ঝুলিয়ে বসে আছে, আর পরশ আবিরের পায়ের ওপর মাথা রেখে শুয়ে
আছে । পরশ বলল, "দোস্ত, আর
ভাল্লাগেনা বুঝলি, ফেসবুকে সারাদিন দেহি পোলাপাইন
গার্লফ্রেন্ড নিয়া ঘোরে, আর আমি এহনও সিঙ্গেল । আবির বলল,
"ভাইরে ভাই, এহন এইসব আউফাউ কাজে জড়াইস
না । মাইয়া তো চিনোস না, সব ন্যাকামো দিয়া ভরা । আগে নিজের
লাইফটা স্যাটেল কইরা নে, তারপর ভাবিস এইসব ।" পরশ অনুকম্পার হাসি হেসে বলল, "হুম, নিজের তো একখান আছে, তাই কইতাছোস ।" আবির বলল, "হুর হারামি । সেজন্য না । ভাইবা
দ্যাখ, আর সব পোলাপাইনের তো একখান সাপোর্ট আছে । মা-বাবা; মা বাবা না থাকলেও অন্যান্য সব আত্মীয়,
কিন্তু আমাগো কিডা আছে ক? আমাগো আগে নিজের
পায়ে দাঁড়াইত হইবো । তারপর এইসব যা করার করিস ।" পরশ
ডানদিকে কাট হয়ে বলল, "আইচ্ছা আব্বা । য্যামনে কস,
মাঝে মাঝে মনে হয় তুই আমার দাদার বয়সী ।" এমন সময় ছাদে এলো নিশি । আবিরের সামনে এসে বলল, "নাবিলারে দেখছিস?" আবির বলল, "না তো, আমরা তো দুপুর থেইকা ছাদে । নাবিলা তো আসে
নাই । ক্যান?" নিশি বলল, "না
ও কইলো কি কিনতে যাইবো, সেই কখন গেছে, ১
ঘণ্টা হইতে চলল, এহনও আসে নাই । ও তো এতক্ষণ বাইরে থাকে না?"
পরশ উঠে বসে বলল, "দ্যাখ গিয়ে, তার ভালোবাসার জন্য মনে হয় বার্থডে গিফট কিনতে গেছে ।" আবির পরশের পিঠে একটা থাবা দিয়ে বলল, "খালি
ফাইজলামি ।" নিশিও হাসিমুখে বলল, "হ, ভুল কস নাই ।" আবির
বিরক্ত হয়ে ভ্রু-কুঁচকে বলল, "তুইও!"
নিশি আর পরশ হেসে দিল ।
আবির বলল,
"একটু বেশিই বেশি করোস ।" নাবিলাও
খানিকটা ইয়ার্কির সাথে আবার বলল, "না যাবার সময় ও
বলেছিল, কিছু কিনতে যাচ্ছে, তাই কইলাম
আর কি?" আবির কিছু বলতে গেলো, তার
আগেই পরশ আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, "তা আবির বাব,
ফেসবুকে তো ম্যালা দেখছি, গার্লফ্রেন্ড
বয়ফ্রেন্ডরে শার্ট কিনা দেয় । এইখানে তো আবার বাজেট কম, তোর
জন্য কি স্যান্ডো গেঞ্জি আর জাঙিয়া কিনতে গেছে নাকি?" নিশি
আর পরশ অট্টহাসি হেসে উঠলো । বেচারা আবির আর নিতে না পেরে "উফ!" ধরণের একটা বিরক্তিসূচক আওয়াজ করে সেখান
থেকে চলে যাচ্ছিলো, তখন পরশ যেয়ে আবিরকে ঠেকাল । আবিরের
সামনে দাড়িয়ে পথ আটকে দিল । আবির বলল, "সর বলতেছি,
আমারে যাইতে দে ।" পরশ আবিরের কাধে হাত
রেখে বলল, শোন ভাই, একটু মজা করতেছিলাম
আর কি ।" আবির হালকা রাগ দেখিয়ে বলল, "বেশি মজাও কিন্তু ভালো লাগে না" পরশ একটু হেসে
বলল, "তোর কি মনে হয়, নাবিলা
সত্যি তোর জন্যও গেঞ্জি জাঙিয়া আনবে, দেখিস, ও যদি সত্যি তোর জন্য কিছু কিনতে যায়, ভালো কিছুই
আনবে । নিজের সাধ্যের মধ্যে যতোটা ভালো পারে, ততোটা ভালোই
আনবে । আবির কিছু বলল না । ভাবতে লাগলো, কি আনতে পারে মেয়েটা? থাক যা-ই আনুক, আনবে যে এটাই অনেক । কিন্তু আফসোস, মেয়েটার বার্থডেটা আবির জানে না, জানলে আবিরও টাকা
জমিয়ে কিছু একটা কিনে দিতো ভালো । "কিরে? ভাবতেছোস কি?" বলে উঠলো পরশ । পরশের কথা শুনে
অবচেতন মন থেকে ফিরে এলো আবির । পরশের দিকে তাকিয়ে বলল, "হ্যাঁ? কি বললি?" পরশ বলল,
"না কিছু না । চল বসি ।" আবির আর
কিছু বলল না । পরশের সাথে যেয়ে বিছানায় বসলো । নিশিও একপাশে বসে পড়েছে । ওরা বসে
বসে গল্প করতে লাগলো ।
সূর্যটা প্রায় পশ্চিম
দিকে ঢলে পড়েছে । আকাশের মেঘলা ভাবটাও কেটে গেছে । আর একটু পর মসজিদ থেকে আজান
শোনা যাবে । গুপীর মাঠের পাশেই একটা ছোট পার্ক রয়েছে নামটা গুপীর সাথে মিলিয়েই
রাখা । গাইন পার্ক । পার্কে প্রতিদিন কতো ছেলেমেয়ে ঘোরাফেরা করে, কতো
লোকজন ঘোরাঘুরি করে, আজও কম লোক নেই । তবে সন্ধ্যা হয়ে যাবে
বলে অনেকেই বাড়ি চলে গেছে, অল্প কয়েকজন আছে । পার্কার মাঝে
রয়েছে একটা গলাকার খাল । খালটা একটা দ্বীপকে কেন্দ্র করে বইছে । খালের চেয়ে লোকজন
লেকের ধার বলেই বেশি ডাকে । এই খালের নাম বাঘা, আর দ্বীপের
নামতা বাইন । কে যে গুপী গাইন বাঘা বাইন নামের মতো করে এই জায়গার নাম রেখেছিল,
তা কেউ জানে না । তবে সে যে লেখক সত্যজিৎ রায়ের খুব বড় একজন ভক্ত,
তা বোঝা ঠিকই বোঝা যাচ্ছে । বাইন দ্বীপের চারপাশে খালের ধারে বসানো
আছে অনেকগুলো সিট যেখানে লোকজন বসে গল্প করে আড্ডা দেয় । এরকমই একটা নারকেল গাছের
নিচে সিটে বসে নাবিলা আর রাজ । এখান থেকে খালের ওপর সূর্যের প্রতিফলন স্পষ্ট দেখা
যাচ্ছে । রাজের কাধে মাথা রেখে বসে আছে নাবিলা । রাজ বলল, "চলো নাবিলা, দেরি হয়ে যাচ্ছে এবার ।" নাবিলা রাজের হাত ধরে বলল, "আর কিছুক্ষণ,
মাগরিবের আজানটা দিক, তারপরেই যাবো ।"
রাজ কিছু বলল না । কিন্তু প্রথম দেখাতেই নাবিলার এমন ঘনিষ্ঠতা তেমন
পছন্দ হল না রাজের ।
(৪)
মাগরিবের আজান দিলে নিশি
বলল,
"চল দোস্ত, নিচে যাই । আজান দিছে,
এখন ছাদে থাকা ঠিক না ।" পরশ বলল,
"চল যাই, নাইলে নিশির মাথায় জিন আদর
করবেনে ।" আবির
নাবিলা আর নিশি নিচে নামছিল, এমন সময় দেখা হল পাপলু আঙ্কেলের
সাথে । পাপলু আঙ্কেল আবিরকে বলল, "এ আবির, শোন না, আমার মাথা ব্যাথার ওষুধটা শেষ হয়ে গেছে ।
আমার এখন আবার স্কুল বিল্ডিং- এ একটা আজে যেতে হবে । একটু
এনে দিতে পারবি?" আবির বলল, "আচ্ছা যাচ্ছি ।" পাপলু আঙ্কেল আবিরকে টাকা দিতে
গেলো, এমন সময় আবির বলল, "ধুর!
টাকা লাগবো না । আমার কাছে আছে ।" পাপলু
আঙ্কলের আবিরকে একটু আদর করে দিয়ে চলে গেল । আবির পরশকে বলল, "দোস্ত, যাবি?" পরশ যেন
আগে থেকেই রাজি ছিল এমন একটা ভাব নিয়ে বলল, "যাচ্ছিই তো
।" পাশ থেকে নিশিও বলল, "আমিও
যাবো, চল ।" অগত্যা তিনজনই রওনা
হল ওষুধটা কিনতে । রাস্তা দিয়ে গেইটের দিকে যাচ্ছিলো, ঠিক
সেই সময় গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকল নাবিলা আর রাজ । দুজনে বেশ হাসতে হাসতে আইসক্রিম
খেতে খেতে এদিকেই আসছে । আবির আর পরশ
মোবাইলে কি যেন দেখতে দেখতে আসছিলো তাই টের পেলো না । রোড লাইটের আলোয় নাবিলাকে ঠিক-ই
চিনতে পেরে নিশি বলল, "এই দ্যাখতো, ওটা নাবিলা না?" আবির আর পরশও সেদিকে তাকাল আর
এক মুহূর্তের জন্যই ওদের দেখে দাড়িয়ে গেলো । পরশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"ওটা তো নাবিলাই, কিন্তু পাশে কে ওটা?"
আবির কিছু বলল না । নির্বাক মূর্তির মতো দাড়িয়ে দেখছিল ।
মনে মনে ভাবছিল, এটা যেন
ওর মনের ভুল হয় । কিন্তু না । যতো কাছে এলো নাবিলা আর রাজ, ততোই
মনের ভাবনাটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে লাগলো । একেবারে কাছে যখন এলো, অবাক হয়ে গেলো আবির, নিশি আর পরশ তিনজনই । ওরা যেন
এই নাবিলাকে চিনতে পারছে না । রাজের হাত ধরে একদম ঘনিষ্ঠভাবে । যেই নাবিলা এতদিন
আবিরের সাথে এতোটা ক্লোজ ছিল, আজ যেন এক মুহূর্তেই সব পাল্টে
গেলো । কাছে আসতেই হাসিমুখেই নাবিলা রাজকে বলল, "নাও
মিট মাই ফ্রেন্ডস ।" একে একে সবাইকে দেখাতে দেখাতে
নাবিলা বলল, "এ হল পরশ, এ নিশি,
আর এ আবির ।" রাজও সবাইকে "হাই! বলে বলে পরিচিত হয়ে নিলো । নিজের নামটাও জানালো
। পরশ বলল, "কোথায় গিয়েছিলি তুই?" নাবিলা এমনভাবে জবাব দেয়া
শুরু করলো, যেন এমন
একটা প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিল সে । আনন্দের সাথে হাসিমুখে বলল, "ও হ্যাঁ,
আজ কে আমি আর রাজ অনেক ঘুরেছি, অনেক মজা করেছি
। ও নিজেও আমার সাথে অনেক মজা করেছে । আমি ওর সাথে অনেক দুষ্টুমি করেছি, অনেক ন্যাকামি করেছি তবুও ও আমাকে কিছু বলে নি ।" এই শেষ বাক্য "তবুও ও আমাকে কিছু বলেনি"
বলবার সময় নাবিলার গলা হালকা পরিবর্তন হয়ে যায় । কেমন একটা ঘেঁষা গলায়
কথাটা বলল । একই সাথে এই সময় নাবিলা
তাকিয়ে থাকে আবিরের দিকে । রাজ তখন বলল, "নাবিলা,
থাকবে নাকি যাবে? না মানে, আমার গোসলটা করা লাগবে তো ।" নাবিলা রাজের কাধে
হাত রেখে বলল, "আরে, প্যারা নাও
কেন, আমিও তো গোসল করতেই যাবো । চলো যাই ।" তারপর আবির, নিশি আর পরশকে বিদায় জানিয়ে হোস্টেলের
দিকে পা বাড়াল নাবিলা আর রাজ । নিশি আর পরশ নিজেদের মাঝে কি যেন বিড়বিড় করতে লাগলো,
আর আবির, পেছন ফিরে তাকিয়ে নাবিলাকে দেখতে
লাগলো । মনে মনে ও হতবাক হয়ে যাচ্ছে । এটা কি সেই নাবিলা? নাকি
নতুন কেউ? এমন সময় পরশ আবিরের কাধে হাত রেখে বলে,
"কি হল এটা আবির?" আবির কোন জবাব
দিল না । পরশ আবারো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় আবির
বিষণ্ণ গলায় বলল, "চল ওষুধটা আনতে যাই ।" আর কোন কথা না বলেই আবির পা বাড়াল । নিশি আর পরশও কিছু বলল না । ওরা বুঝতে
পারছে আবিরের মনের অবস্থা । আবির যতোই বলুক, নিশিকে ও সেরকম
চোখে দ্যাখে না, কিন্তু মানুষের মনের আর মুখের কথা সবসময় এক
হয় না ।
সেই দুপুরে ঘুমিয়েছিলো
জামি আর শিমুল । মাত্র ঘুম ভাঙল জামির । অন্যান্যরা কি করছে তা দেখতে শিমুলের রুমে
আসতেই ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এলো শিমুল । জামি বলল, "কিরে? কি অবস্থা?" তয়লা দিয়ে ভেজা মুখটা মুছতে মুছতে
শিমুল বলল, "আর বলিস না, সেই
দুপুরে ঘুমাইছিলাম, মাত্র উঠলাম । এতো ক্যামনে ঘুমাইলাম,
আল্লাহই জানে ।" জামিও বলল,
"হ রে, আমিও মাত্র ঘুমাইলাম । অবশ্য
গতকাল অনেক রাত জাগছিলাম, আবার আইজকা অনেক সকালে উঠছিলাম,
এর জন্য হয়তো এতো ঘুম ধরছিল ।" শিমুল বলল,
"যা, ভেতরে যাইয়া ফ্রেশ হইয়া আয় ।"
জামি ভেতরে গেলো । শিমুল নিজের রুমে যেয়ে বারান্দায় তয়লাটা দড়িতে
ছড়িয়ে ঝুলিয়ে দিল । শিমুলের রুম থেকে
রাস্তাটা দেখা যায় । দুইপাশের বিল্ডিংগুলোর মাঝের রাস্তাটা । শিমুল বারান্দা থেকে রুমে ঢুকছিল, এমন সময় চোখ গেলো রাস্তার দিকে । নিশি না ওটা? রোড
লাইটের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । হ্যাঁ, নিশিই তো । কোন
একটা ছেলের সাথে হাসাহাসি করে কথা বলতে বলতে আসছে । মূলত এখানে আবির থাকার কথা ছিল,
কিন্তু না । এটা তো আবির না? নতুন মুখ । শিমুল
তাড়াতাড়ি করে নিজের ওয়াশরুমের দরজার সামনে এসে বলল, "ওই
জামি, তোর এতক্ষণ লাগে?" ভেতর
থেকে জামি বলল, "বন্ধু, আমি
হাগতেছি ।" শিমুল বমি করার ভঙ্গিতে বলল, "ইস!! ছি! তুই তাইলে আমার
ওয়াশরুমে ঢুকলি ক্যান! নিজের রুমে একখান আছে না?"
ভেতর থেকে জামি আবারো জবাব দিল, "বন্ধু,
চাইপা গেছে, কি করমু । দাড়া আইতাছি ।"
শিমুল একবার আবিরের রুমে যেয়ে আবিরকেও খুজে এলো, কিন্তু পেলো না । অনেকক্ষণ দাড়িয়ে অপেক্ষা করবার পর বেড়িয়ে এলো জামি ।
শিমুল একটু দূরে সরে যেয়ে বলল, "হাত ধুইছোস?"
জামি বলল, "হ, ভালো
কইরা সাবান দিয়া ধুইছি ।" শিমুল তখন বলল, "ওই, নতুন কেউ আইছে নাকি হোস্টেলে?" কিছুক্ষণ ভেবে বলল, "কি জানি, তয় গাড়ির আওয়াজ শুনছিলাম । হইতে পারে কেউ আইছে । ক্যান? কি হইছে?" শিমুল পুরো ঘটনা খুলে বলল জামিকে ।
জামি শুনে বলল, "কস কি তুই! গতকাল
এক ঝামেলা যাইতে না যাইতেই আরেক ঝামেলা হাজির?" শিমুল
বলল, "আমি জানি না আমাগো কপালে কি আছে । কিন্তু আবির তো
ভালো একখান মাইয়া পাইছিল, নাবিলা এমন ক্যামনে করতে পারলো?"
জামি কোন জবাব দিল না । চুপচাপ দাড়িয়েই রইল । খানিক পর শিমুলই বলল,
"আবিরকে একটা ফোন দে তো ।"জামি
ফোনটা বের করে আবিরকে কল দিল । কিছুক্ষণ আওয়াজ হবার পর ফোন তুলল আবির । ফোনের ওপাশ
থেকে বিষণ্ণ কণ্ঠে আবির বলল, "হ্যাঁ জামি, বল ।" জামি বলল, "কিরে,
কই তুই?" "আমি তো পাপলু আঙ্কেলের
ওষুধ আনতে যাচ্ছি । কেন?" আবিরের মুখে আঞ্চলিক ভাষার
ভাবটা নেই শুনেই বোঝা যাচ্ছে আবিরের মন খারাপ । জামি জিজ্ঞেস করলো, "কিরে, তোর মন খারাপ নাকি?" আবির সে কথায় কান না দিয়ে পরশকে বলল, "দোস্ত,
যা তো, একটু কিনা নিয়া আয় । আমি একটু কথা
বলতেছি?" পরশ গেলো ওষুধটা আনতে, সাথে
নিশিও গেলো । আবির তখন বলল, "হ্যাঁ, বল । কোন দরকার ছিল কি?" জামি জবাব দিল,
"না......" আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো
জামি, কিন্তু তার আগেই আবির বলল, "দরকার নেই তো অসময় কল দেয়ারও তো মানে হয় না কোন । রাখছি ।" বলে ফোনটা কেটে দিল আবির । জামি, কয়েকবার "হ্যালো! হ্যালো!" বলবার
পর টের পেলো, ফোনটা কেটে গেছে । তারপর জামি শিমুলকে বলল,
"কেটে দিল ।" শিমুল ভ্রু কুঁচকে
মাথা নিচু করে এক হাত কোমরে রেখে অন্য হাত থুতনিতে ঠেকিয়ে বলল, "হুম । ঝামেলা হয়েছে কিছু একটা ।
প্রায় আধ ঘণ্টা পর রুমে এলো আবির । সাথে পরশ আর নিশিও
ছিল । আবিরের জন্য দরজার সামনেই অপেক্ষা করছিলো শিমুল আর জামি । আবিরের পেছনেই পরশ
ছিল । শিমুল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু পরশ ইশারায় চুপ করতে বলল আবির নিজের
রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল । পরশ তখন জামি আর শিমুলকে নিয়ে গেলো ছাদে । সাথে নিশিও
গেলো । শিমুল যেমন খুলে বলল ও কি দেখেছে, পরশও তেমন পুরোটা
খুলে বলল আসলে কি ঘটেছে । জামি বলল, "বলতেছিস কি ভাই!
এ তো মারাত্মক কাণ্ড! নাবিলা এমন করলো ক্যামনে?"
শিমুল বলল, "আচ্ছা, নাবিলা তো না-ও করতে পারে, হতে
পারে ছেলেটা নাবিলাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিজের করে নিয়েছে । আর ছেলেটা যা দেখলাম,
দেখতে আবিরের চেয়েও সুন্দর আছে । তাই হয়তো নাবিলাও ওর প্রতি দুর্বল
হয়ে গেছে ।" পরশ বলল, "সে
হোক, কিন্তু নাবিলা যেমন মানুষ, তাতে
তো ওর ওই ছেলের কথায়ই নিজেকে ওই ছেলের প্রতি দুর্বল করার কথা না । পরিশেষে দোষটা
কিন্তু নাবিলারই ।" নিশি বলল, "পরশ, মনে আছে, নাবিলা কিন্তু
আবিরের দিকে তাকিয়ে বলছিল, ওই কি জানি, ন্যাকামি করছে, তাও এই ছেলে কিছু কয় নাই ।"
পরশ নিজেও এমনটা ভেবেছে এমন একটা ভাব নিয়ে বলল, "হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিও ব্যাপারটা খেয়াল করছি । আবির কি
কিছু করছে নাকি নাবিলার সাথে?" শিমুল তখন নিশিকে বলল,
"ওই নিশি, তোর মনে আছে, গতকাল নাবিলা কাঁদতে কাঁদতে রুমে ঢুকছিল?' নিশি জবাব
দিল, "ও হ্যাঁ! কিন্তু ও আমারে
কিছু বলে নাই । আমি শুধু কইছিলাম তোর লগে কেউ যদি খারাপ কিছু করে, তার লগে কথা কইছ না ।" জামি বলল, "তাইলে আবিরই কিছু করলো নাকি?" এমন সময় পেছন
থেকে কেউ বলল, "হ আমি করছি ।" জামি, শিমুল, পরশ আর নিশি পেছন
ফিরে দেখল, আবির দাড়িয়ে । মুখে হাসি নেই চোখের পাতা পড়ছে না,
হাতদুটো পকেটে রেখে সটান হয়ে দাড়িয়ে আছে । কিছুক্ষণ পর কাছে এসে বলল,
"ও আমার লগে ন্যাকামি করছিলো, তাই আমি
ওরে ধমকাইছি ।" শিমুল বলল, "ক্যান
আবির? কি করছিলো ও?' আবির বলল,
"ও সময় নাই, কিছু নাই, খালি আমার কাধে মাথা রাখতে চাইতো, খালি আমার হাত
ধরতে চাইতো, যেসব আমার একদমই ভালো লাগে না ।" শিমুল আবারও বলল, "তাই বলে তুই ওরে ধমকাইলি?
তুই কি জানোস না? মেয়েরা তো এমনই হয় । ওরা তো
এমন করবোই । তাই বইলা তুই যে ওরে ধমকাইলি, ও কতো কষ্ট পাইছে
তুই বুঝোস?" আবির এবার জোর গলায় চোখ বড় বড় করে কাছে
এগিয়ে এসে বলল, "তোরে আমি দু দুবার নাকে ঘুষি মারলাম,
কই? তুই তো এহন আমার লগে কথা কইতাছোস । আর ওরে
সামান্য কিছু কথা কইলাম বইলা ও আমার লগে কথা বলাই বন্ধ কইরা দিবো?" শিমুল বলল, "আবির, আমরা
ছেলে । ছেলের মন শক্ত হয় । আমাদের মাইরা ফেললেও আমরা আমাদের কিছু হয় না । কিন্তু ও
তো মাইয়া, নরম মন । সামান্য ধমকেই কষ্ট পায় যেই আঘাতটা আমারে
ঘুষি মারা চেয়েও বেশি লাগে ।” আবির আবারো কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় নিশি ওদের
মাঝে এসে দাড়িয়ে দুজনকেই হাতের তালু দেখিয়ে থামতে বলে বলল, "থাম তোরা, এমনে তর্ক করিস না ।" তারপর নিশি আবিরকে বলল, "আবির, এইবার তুই বল, তুই কি ভাবছোস?" আবির শান্ত গলায় জবাব দিল,
"আমি হয়তো কখনোই নাবিলাকে ভালো রাখতে পারবো না । তাই যদি
রাজ আর নাবিলা দুজন দুজনকে ভালোবাসে, তাহলে থাক না, আমার তো এতো প্যারা
নাই ।" জামি হালকা রাগ দেখিয়ে বলল, "নিজেরে নিজেই বাঁশ দিস না আবির, এহন কিন্তু তুই-ই ন্যাকামি করতেছোস!" আবির কিছু একটা বলতে
যাচ্ছিলো, এমন সময়
একটা মেয়ের হাসির আওয়াজ এলো । খুব সম্ভবত সিরিঘরের ওপাশের ছাদের অংশ থেকে । নিশি
ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো, "ছাদের ওপাশে কারা রে?"
পরশ "চল দেইখা আসি ।" বলে দৌড় দিল
সাথে অন্যান্যরাও গেলো । ছাদে চাঁদের আলো আছড়ে পড়েছে । সেই আলোতে ওরা স্পষ্ট
দেখতে পেলো, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে দাড়িয়ে বেশ হাসিখুশি ভাবে কথা বলছে । ওরা আর কেউ নয়, নাবিলা
আর রাজ । যেন ওরা কতদিনের পরিচিত
। ওরা যেন একে অপরকে সেই
ছোটবেলা থেকে চেনে । যেন একে অপরের
হাসি, কান্না, আনন্দ, দুঃখ, রাগ,
ক্ষোভ সবটা চেনে, সবটা । অচেনা কেউ
দেখলে কিছুতেই বলবে না, আজই এদের দেখা হয়েছে । আর পাশাপাশি দুজনকে
দেখতে কি সুন্দর লাগছে, যেন
রাজার পাশে রাণী । দুজনে কতো কথা বলছে । রাজ একেকটা কথা বলছে, আর
নাবিলা হাসছে । সেই হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে রাজ । আবার নিজের খানিকটা
হাসবার চেষ্টা করে । নিশি ফিসফিসিয়ে গম্ভীর গলায় বিরক্তির সাথে বলে উঠলো, "আবির,
আমার কিন্তু এসব ভালো লাগছে না ।" আবির কোন জবাব দিচ্ছে না দেখে আবিরের চোখের দিকে
তাকাল পরশ । আবির এক দৃষ্টে তাকিয়ে নাবিলা আর রাজের দিকে । আবিরের ঠোঁটের
কোণে ফুটছে একটা আনন্দ আর কষ্ট মিশ্রিত হাসি । কষ্টটা প্রিয় মানুষকে
হারাবার, আর আনন্দটা প্রিয় মানুষকে হারিয়েও প্রিয়
মানুষটা যে ভালো আছে, সেটার । পরশ আরও খেয়াল করলো, আবিরের চশমার লেন্সে জলের
ফোঁটা । ওটা আর কিছুর নয়, চোখের জলের । খানিক বাদে কপোল বেয়েও গড়িয়ে পড়লো সে জল । কিন্তু আবির
এখনও নির্বাক । হঠাৎ কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই আবির সেখান থেকে দ্রুতবেগে চলে এলো । আবিরকে চলে
যেতে দেখে ওরা একে অপরের দিকে তাকাল । খানিক বাদে
ওরাও নিচে চলে গেলো । ছাদের পাশে দাড়িয়ে
রাজ নাবিলাকে বলছে, "আজকের চাঁদটা অনেক সুন্দর, তাইনা?" নাবিলাও হাসিমুখে জবাব দিচ্ছে, "হ্যাঁ, ঠিক তোমার
ওই বাঁদরের মতো মুখখানার মতন।" বসে খিল খিল করে
হেসে দিল নাবিলা ।
(৫)
নিচে এসেই বা হাত দিয়ে চশমাটা খুলে বা হাতের বাহু
দিয়ে চোখের জল মুছল আবির । কান্না পাচ্ছে, কিন্তু সেটা সবাইকে বুঝতে দেয়া যাবে না । তাহলে ওরা নাবিলা আর
রাজকে এক থাকতে দেবে না ।আবির ডাইনিং টেবিলে রাখা টিস্যু বক্সটা থেকে একটা টিস্যু নিয়ে চশমাটা মুছে নিলো । তারপর চোখে
পড়লো । সেই সময় ঘোরে প্রবেশ করলো পরশ, জামি, শিমুল । নিশি
দরজার কাছেই দাড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে
দাড়িয়ে রইল । জামি আবিরের কাছে এসে ভ্রু কুঁচকে হালকা রাগ দেখিয়ে
বলল, "আবির, তুই কিন্তু
মন থেইকা নাবিলারে ভালবাসোস, আমাগো মিথ্যা কইয়া লাভ
নাই কিন্তু!" আবির একটু হেসে জামির পেতে
হালকা করে কয়েকটা ঘুষি দিয়ে বলল,
"আরে মোটু চিল! প্যারা নিস না । আরে ধুরু, নাবিলা
তো আমাগো বন্ধু না, অয়
খুশি থাকলে আমরাও তো খুশি থাকমু । দেখলি না, ওরা কি সুন্দর একে অপরের লগে ভালো ছিল ।" শিমুল বিরক্ত
হয়ে বলল, "আরে ভাই! তুই এমন করস ক্যান! মানুষের মুখের কথা আর মনের কথা দেখলেই বোঝা যায় ।" আবিরও বিরক্ত হয়ে
বলল, " আরে! এইসব তো তোরাই আমারে ইয়ার্কি কইরা
কছ, আমি কি
কিছু কই নাকি? আজিব পোলাপাইন তোরা!" নিশি দরজার সাম্ননে দাড়িয়ে নাবিলার প্রতি
ক্ষোভ দেখিয়ে বলল, "আইজকা নাবিলা রুমে
আসুক, দ্যাখ
ওর আমি কি করি ।" আবির এবারে সিরিয়াস
হয়ে গেলো ভ্রু কুঁচকে নিশির সাম্ননে যেয়ে
বলল,
"শোন! বাড়াবাড়ি করিস না কিন্তু নিশি । আমি কিন্তু একবারও কই
নাই আমি নাবিলারে ভালবাসি । তুই শুধু ওরে এইসব
বইলা কষ্ট দিস না ।" শিমুল আবিরের দিকে এগিয়ে এসে বলল, "শুধু
শুধু মানে কি? হ্যাঁ? তুই আমারে ছুইয়া ক তো, যে তুই
নাবিলারে ভালোবাসিস না । পারবি?" আবির অট্টহাসি হেসে উঠলো । তারপর শিমুলের কাঁধ হাত রেখে বলল, "বাহ!
কি হাসা হাসালি আমারে, আরে শালা আমি তোর বন্ধু,
তুই তোর বন্ধুরে বিশ্বাস করস না?" শিমুল
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু আবির সেখান থেকে নিজের রুমের দরজার
দিকে আসতে আসতে বলতে লাগলো, "তোরা পারিসও বটে ।" এরপর আবির দরজাটা আটকানোর জন্য দরজাটা ধরে ওদের বলল, "আমায় একটু একা থাকতে
দে ।"
এবার
আবিরের কণ্ঠে ক্রন্দনের কম্পন স্পষ্ট
বোঝা গেলো । আবির দরজাটা ধাম
করে আটকে দিয়ে ভেতরর থেকে
ছিটকিনি লাগিয়ে দিল । দাড়িয়ে থাকা ৪ জন
কিছুক্ষণ আবিরের দরজার দিকে পলকহীনভাবে
তাকিয়ে রইল । একটু পর জামি শিমুলকে বলল, "এ ভাই, চলতো,
রুমে চল । এ যদি নিজের
ভালোই না বোঝে, আমরা
কওয়ার কে?" শিমুলও
তাতে সম্মতি জানালো । তারপর দুজনেই নিজেদের রুমে চলে গেলো । নিশিও বিরক্ত হয়ে নিজে
রুমে চলে গেলো । যাওয়ার সময় বলে
গেলো,
"আমি জাস্ট পাগল হয়ে
যাবো এখন ।" দাড়িয়ে রইল শুধু
পরশ । নিশি চলে গেলে চোখ ফিরিয়ে একবার তাকাল আবিরের দরজার দিকে । কাছে এগিয়ে গেলো । দরজায় কান পেতে
শুনবার চেষ্টা করলো কিছু । হ্যাঁ , স্পষ্ট
শোনা যাচ্ছে, ভেতরে
আবির নিজের কান্না কোনোরকমে আটকে
রাখবার চেষ্টা করছে । মাঝে মাঝে হালকা আওয়াজ
শোনা যাচ্ছে । পরশ একবার ভাবল
নক করবে, হাতও বাড়াল, কিন্তু আবার থেমে গেলো । নিঃশব্দে দরজার ওপর হাত রেখে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইল । তারপর মাথা তুলে নিজেই নিজেকে বলল, "আজ
ছেলেটা আসুক একবার রুমে ।"
সেদিন রাতে একটা শব্দের
জন্য নিজের রুমে পায়চারি
করছিলো পরশ । একবার বারান্দার দরজা
থেকে রুমের দরজা, আবার রুমের দরজা থেকে বারান্দার দরজা । মাঝে মাঝে মোবাইলটা অন
করে মাঝে মাঝে পায়চারি করতে করতে সময় পার করছিলো । অনেকক্ষণ হয়ে গেলো, শব্দটা
সে পেলো না । অবশেষে প্রায় আধ ঘণ্টা পর পরশ যখন রুমের দরজা থেকে
বারান্দার দরজার দিকে যাবার জন্য পা বাড়াবে, ঠিক সেই সময় পেলো সেই আওয়াজটা । দরজা খোলার
আওয়াজ । পরশ তাড়াতাড়ি করে রুমের দরজা হালকা খুলে উঁকি দিল । ঘরে এসেছে রাজ নামের
ছেলেটা । দরজাটা লাগিয়ে নিজের রুমে ঢুকে গেলো । দরজাটা চাপিয়ে দিল আটকালো না । পরশ কিছুক্ষণ
অপেক্ষা করলো । যে করেই হোক, ওকে এমন কিছু কথা বলতে হবে, যেন ও
নাবিলাকে অপছন্দ করতে শুরু করে । কিন্তু কীভাবে? কোত্থেকে কথা বলা শুরু করবে এসব ভাবছিলো পরশ । অবশেষে সাহস
করে ছেলেটার দরজার সামনে গেলো পরশ । ভেতর থেকে একটা শব্দ আসছে । শিস বাজানোর আর
শাওয়ারের পানি পড়বার । পরশ দরজায় নক করলো । ভেতর থেকে কোন আওয়াজ এলো না । পরশ আবারো নক
করলো । এবারো কোন আওয়াজ পেলো না পরশ । এভাবে ৪-৫বার নক করার পরও যখন কোন আওয়াজ পেলো না পরশ,
তখন সিদ্ধান্ত নিলো, দরজাটা খুলবে । ধীরে ধীরে
দরজাটা খুলে ভেতরে তাকাল পরশ । বুঝল, রাজ গোসল করছে । রাজের বাথরুম
থেকেই শিস বাজানোর আর পানি পরবার আওয়াজটা আসছে । পরশ আবারো দরজাটা
চাপিয়ে দিয়ে ডাইনিং রুমে বসেই অপেক্ষা করতে লাগলো ।
এদিকে নিশি গিয়েছিলো
বাজারে । মোবাইলে রিচার্জ করার জন্য । আসবার পথে দেখা সায়রার সাথে । নিশিকে দেখেই হালকা
হাসিমুখে বলল, "নিশি আপু! কেমন আছো?"
নিশি সায়রার গাল ছুঁয়ে একটু আদর করে বলল, "হ্যাঁ আপু, ভালো আছি । তুমি কেমন আছো?" সায়রা
বলল,"ভালো আছি
আপু । পরক্ষনেই বিষণ্ণ মনে বলল, "শুধু অনামিকার কথা খুব মনে পড়ছে ।" নিশিরও মন খারাপ
হয়ে গেলো । অবশ্য হবারই কথা । এরা দুজন ছিল একদম বোনের মতো । আমাদের দেশে বেশীরভাগ
মেয়েরাই তাদের বান্ধবীদের দেখে আড়ালে হিংসে করে । অথচ সামনে কতো ন্যাকা
ন্যাকা কথা বলে । কিন্তু অনামিকা আর সায়রা
মোটেও সেরকম ছিল না সবাই সেটা জানে এবং দেখেছেও । অনামিকার হালকা শান্তনার
হাসি হেসে বলল, "দ্যাখো
সায়রা, আল্লাহ আমাদের বানিয়েছেন, আল্লাহই
আমাদের মৃত্যু দেবেন, এটাই স্বাভাবিক । এই যে, আমাদের
সবার মা বাবা কেউ নেই । তাদের তো আল্লাহই আবার নিয়ে গেছেন দুনিয়া থেকে । সুতরাং কষ্ট
পেও না । বেশি বেশি নামায পড়ে দোয়া করো তোমার মা বাবার জন্য, তোমার
বন্ধুর জন্য ।" অনামিকা
হালকা মাথা নাড়িয়ে নিচু স্বরে বলল, "হুম ।" অনামিকা তখন বলল, "আচ্ছা শোনো । তোমায়
একটা সাহায্য করতে হবে, পারবে?"
সায়রা মাথা তুলে তাকিয়ে বলল, "হ্যাঁ আপু ,
বলো, আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো । অনামিকা তখন নাবিলা আর
রাজের একসাথে মেলামেশা দেখা থেকে শুরু করে পুরোটা খুলে বলল সায়রাকে । শুনে সায়রার
চোখে মুখে একটা চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো । ভ্রু কুঁচকে বলল, "সেকি!
আবির ভাইয়া নাবিলা আপুকে ভালবাসতো না?" "হ্যাঁ, তবে সে ভালোবাসা ঠিকমতো শুরু হবার আগেই তো
এরকম একটা ঝামেলার উদয় হল । রাজও আবার স্বীকার করছে না যে ও নাবিলাকে ভালবাসে । ও চায় নাবিলা
যদি রাজকে নিয়ে ভালো থাকে, তাই যেন হয়?" "কিন্তু নাবিলা আপু এমন করলো কেন?" নিশি একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেলল । তারপর বলল, "সেটাও আমি বুঝতে পারছি না ।" সায়রা প্রশ্ন
করলো,
"আমাকে কি করতে হবে?" "তুমি আবিরের ছোট । আমাদের সাথে ও কথা বলতে গেলে গালিগালাজ দেবে, বলতে
চাইবে না, হেয়ালি করবে । কিন্তু ও তো আর তোমাকে গালিগালাজও করবে না, রাগও
করবে না । তুমি ওকে একটু বোঝাতে পারবে?"
দরজা খোলার আওয়াজ । সাথে শিস দেবার
শব্দটা আরও স্পষ্ট হল । শুনে ডাইনিং টেবিলে বসে থাকা পরশ উঠে দাড়িয়ে রাজের দরজার
সামনে গেলো । একদম হালকা খুলে থাকা দরজার ফাক দিয়ে দেখা গেলো, বাথরুম
থেকে বেড়িয়েছে রাজ । পরশ এবার সাহস করে দরজায় নক করলো । ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, "খোলা
আছে ।"
পরশ
ভেতরে ঢুকল । একটা টাওয়েল পড়ে খালি গায়ে দাড়িয়ে রাজ । অন্য একটা টাওয়েল দিয়ে
মাথা মুছছে । বডি দেখে হ্যাঁ করে তাকিয়ে রইল পরশ । একদম সুঠাম দেহ, সিক্স প্যাক রয়েছে । হাতের
বাহুগুলোও মোটা মোটা । খুব সম্ভবত চাচার বাসায় থাকতে নিয়মিত জিম করতো । রাজ মাথা মুছে টাওয়েলটা
বিছানায় রেখে বলল, "কিছু বলবেন?" পরশ কিঞ্চিৎ
কেপে উঠলো । ভয় পাচ্ছে বলতে । যদি আবার রেগেমেগে কয়েক ঘা উত্তম-মধ্যম
দেয়? রাজ আবারো বলল, "এক্সকিউজ মি?
আপনি কি কিছু বলবেন?" পরশ বুকে ফু দিয়ে
গলা খাখরে বলল, "ইয়ে মানে, আমি
পরশ, ওই যে, সন্ধায় দেখা হয়েছিলো যে?"
রাজ হাসি মুখে পরশের কাছে এগিয়ে এসে বলল, "ও ইয়েস, মনে পড়েছে । সরি, আমি
তোমাকে চিনতে পারিনি ডিউড!" বলে হাত বাড়িয়ে দিল
হ্যান্ডশেক করার জন্য ।পরশ হ্যান্ডশেক করে হালকা ভয় মিশ্রিত হাসি হেসে বলল, "ইটস
ওকে ।"
রাজ
পরশকে বসতে বলে বিছানায় থাকা ব্যাগ থেকে ট্রাউজার বের করে পড়ে নিলো । পরশ বসলো
বিছানায় । জিজ্ঞেস সাহস করে বলল, "আমি তোমার পাশের রুমের থাকি । রাজ খুশি হয়ে
বলল,
"ওহ! গ্রেট! সো
ফ্রম নাও তোমার সাথে আমার রেগুলার দেখা হবে তাই না?" বলতে
বলতে একটা শার্ট গায়ে দিয়ে পরশের পাশে এসে
বসলো রাজ । বোতামগুলো খোলাই রইল । পরশ উপর নিচে মাথা
নাড়িয়ে বলল, "হ্যাঁ ।" পরশ জিজ্ঞেস করলো, "এখন গোসল করলে যে? তুমি তো সন্ধ্যায়েই করলে একবার?" রাজ ভ্রু
কুঁচকে জানতে চাইলো, "সন্ধায় করেছি কে বলল তোমায়?"
"না, তুমি নাবিলাকে বলছিলে গোসল করবার
কথা, তাই বললাম ।" রাজ হেসে দিয়ে
বলল,
"ও আচ্ছা । তখন গোসল করতে যাইনি । নিশি আমাকে নিয়ে
ছাদে গিয়েছিলো । তাই এখন করলাম আরকি ।" পরশ বলল, "ও
আচ্ছা ।" রাজ জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা
ডিউড, এখানে আশেপাশে কোন এলাকায় জিমন্যাসিয়াম নেই?"
পরশ বলল, "না, সেরকম
তো নেই, তবে জিম করার সব উপকরণ আছে আমাদের শারীরিক শিক্ষার
ল্যাবে আছে ।"
জুতোটা রেখে দরজা খুলে
ভেতরে এলো নিশি । নাবিলার রুম
থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসছে । নাবিলা-ই গাচ্ছে "মে
তেরি কাবিল হু ইয়া তেড়ে কাবিল নেহি ।" নিশি নাবিলার রুমের দরজার কাছে এসে দেখল, বেশ
আনন্দের সাথে ভেজা চুল গামছা দিয়ে মুছছে আর গান গাচ্ছে । নিশি
স্বাভাবিকভাবে ডাকল, "নাবিলা!" নাবিলা চুল মুছতে
মুছতেই এক মুহূর্তের জন্য নিশির দিকে তাকালো । তারপর আবার কাজে মন দিয়ে
বলল,
"কই ছিলি রে? কতক্ষন তোর জন্য অপেক্ষা
করতেছিলাম ।" নিশি ধীরে ধীরে নাবিলার কাছে গেলো । নাবিলার চোখে মুখ দেখে
বোঝা যাচ্ছিলো, সে খুব খুশিতেই আছে । সারাদিন বেশ ভালো একটা
দিন কাটিয়ে বাড়ি এলে যেরকম মুডে থাকে, ঠিক তেমন । নাবিলা ইয়ার্কির সাথে
জিজ্ঞেস করলো, "ছিলি কোথায় রে? বয়ফ্রেন্ড
জুটিয়েছিস নাকি?" নিশি ঠাস করে একটা চড় লাগিয়ে দিল
নাবিলার গালে ।
"ও আচ্ছা । একটা কথা
জিজ্ঞেস করবো?" "ইয়া অবভিয়াসলি ডিউড?" একটু
থেমে পরশ জিজ্ঞেস করলো, "নাবিলা তোমার বন্ধু হল কি করে?"
রাজ একটু হাসল । তারপর বলল, "আর বোলো না । আজকে কিছু
জিনিস কিনতে বাইরে যাচ্ছিলাম, তা আমি তো এলাকার কিছু চিনি না, নাবিলার সাথেই আগে দেখা হল, ওকে নিয়েই গেলাম আরকি । বাট ও যেয়ে
আমার সাথে অনেকক্ষণ বাইরে ঘুরে বেড়াল । ইভেন সন্ধ্যায়ও আমার সাথে ছাদে কাটালো । তো এই সময়টা
মিশতে মিশতেই ওর সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ।" পরশ মন দিয়ে শুনল
কথাগুলো । একটু পরে আবারো জিজ্ঞেস করলো, "ওকে কি তোমার ভালো লেগে গেছে? হ্যাঁ হ্যাঁ! বলো! বলো!"
পরশ ইয়ার্কি মিশিয়ে কথাগুলো বলছে রাজকে যেন রাজ
সন্দেহ না করে । এই সেই মুহূর্ত । এখনই সেই সময় যার ওপর নির্ভর করছে রাজকে
পরশ নাবিলার থেকে দূরে থাকার জন্য উল্টোপাল্টা কিছু বলবে কি না । যদি রাজ হ্যাঁ
বলে, তবেই পরশ এমন কিছু বলবে, যাতে এরপর থেকে নাবিলার
কাছে যেতে দশবার ভাবতে হয় রাজকে । আর যদি না বলে? আরে!
এটা তো ভাবা হয় নি? যাকগে, দেখা যাক কি বলে, না বললে পড়ে ভাবা যাবে । রাজ একটু হেসে
জবাব দিল,
"সত্যি কথা বলতে কি জানো, ছোটবেলা থেকেই
আমি ছিলাম সব মেয়েদের পছন্দের কেউ । নিজের বড়াই করা হয়ে যাচ্ছে, তবুও
কথা প্রসঙ্গে বলতেই হয় আমি দেখতে খুব স্মার্ট, হ্যান্ডসাম,
আর আমার বডি ফিগার তো দেখেছোই । মেয়েরা ক্রাশ খাওয়ার
জন্য যথেষ্ট । তো ছোটবেলায় অতো কিছু তো বুঝতাম না, তবে ক্লাস এইটে উঠে বুঝলাম । তখন যদিও আমার
সিক্স প্যাক ছিল না, কিন্তু বডি ফিগার ভালো ছিল । একটা মেয়ে, শৈলী
নামের আমাকে পছন্দ করেছিলো । আরও অনেক মেয়েও করতো, কিন্তু ওকে আমার বেশি ভালো লাগতো শেষমেশ
আমাদের রিলেশনটা হয়েই গেলো । প্রায় ছয় মাস বেশ চলছিলো আমাদের । ওরই অনুরোধে আমি সিক্স
প্যাক বানিয়েছিলাম । কিন্তু ছয় মাস পর আমাদের ব্রেকআপ হয়ে যায় । আর কারণ হল, ও আমার
চেয়েও সুন্দর একটা ছেলেকে পেয়ে ওর ওপর ক্রাশ খেয়েছে । তারপর থেকেই মেয়েদের
আমার আর ভালো লাগে না । কেউ প্রপোজ করলে রিজেক্ট করে দেই । প্রেম-টেম ও আর
ভালো লাগে না ।" পরশ মনে মনে খুব খুশি হল । রাজের কথাগুলো না কেই
নির্দেশ করছে । পরশ নিশ্চিন্ত হল এই ভেবে রাজ তাহলে নিশিকে
ভালবাসে না । তাহলে আর নাবিলার নামে
মিথ্যে বলে রাজকে দ্বিধায় ফেলে কি লাভ? সাত পাঁচ না ভেবে পরশ নিজের মতো খুশি মনে একটানা বলা শুরু করলো, "ও আচ্ছা,
তা অবশ্য ঠিক
বলেছ, কিন্তু
কি বলতো, আমাদের নাবিলা আবার অমন মেয়ে নয় । ও আবার
ছেলেদের মন নিয়ে ছেলেমানুষি করে না । কাউকে ঠকায়ও না
। তোমার সাথে ওকে
দেখতে ভালোই লাগছিলো, কিন্তু তুমি যখন বললে নাবিলাকে
তোমার ভালো লাগে না........."
পরশের কথা শেষ করতে না
দিয়েই রাজ হালকা হেসে বলল, "আমি কখন বললাম আমার
নাবিলাকে ভালো লাগে না?" "না, তা তুমি.........বলোনি!" আগের সেই খুশি খুশি ভাবটা নিয়েই কথা টা বলতে যেয়ে হালকা
থেমে শেষ শব্দটা অবাক হয়ে বলল পরশ । গলার স্বর টা শেষ শব্দে ধীরে ধীরে কমলো । আর ভাবল, সত্যিই
তো!"
(৬)
"আমাকে মারলি কেন তুই?"
গালে হাত বোলাতে বোলাতে বড় বড় চোখে নিশির দিকে তাকিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে
কথাটি বলল নাবিলা । নিশিও পাল্টা ঘৃণা আর ক্ষোভ মিশ্রিত গলায় বলল, "ছি
নাবিলা! তোর কাছ থেকে এসব কেউ এক্সপেক্ট করে নি । তুই শেষমেশ
আবিরকে এভাবে ঠকালি? " নাবিলা গাল থেকে হাত নামিয়ে বলল, "ঠকিয়েছি কোথায়? দেখিয়েছি । মেয়েরা
ন্যাকামি করলে ছেলেদের সেটা সহ্য করবার ক্ষমতা থাকতে হয় ।" "তাই বলে এভাবে
অন্য একটা অচেনা অজানা ছেলের সাথে সারাদিন কাটিয়ে?" নাবিলা কিছু না বলে
বসে পড়লো । তারপর চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে দুঃখ প্রকাশ করে বলল,
"তুই আমাকে মেরেছিস, তোর লগে কথা
নাই ।"
নিশি
"উফ" গোছের একটা বিরক্তিসূচক আওয়াজ করে
বলল, "এবার
তোর ন্যাকামো দেখে আমিই কিন্তু বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি ।" নাবিলা কোন জবাব
দিল না । যেন ও কিছু শুনতেই পায় নি ।" নিশি এবার বেশ সিরিয়াস হয়ে আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, "আমরা
সবাই চেয়েছিলাম তুই আর আবির যেন খুব ভালো থাকিস । শুধু তাই নয়, আবিরও
সেটা চেয়েছিল । গতকাল অনামিকার মৃত্যুর ব্যাপারে আবির খুব
দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়েছিল বলে তোর সাথে
একটু রাগ করেছে । আর এরকম একটা সময়ে ন্যাকামো করলে কারই বা ভালো লাগে না
বলতো?"
নাবিলা মুহূর্তের মধ্যেই উঠে দাড়িয়ে দ্রুতবেগে বলল, "আমি কি একবারও বলেছি আমি রাজকে ভালোবাসি কিংবা আবিরকে বাসি না?"
নিশি আরও অবাক হয়ে নাবিলার
দিকে তাকিয়ে আরও ঘৃণ্যতার সাথে বলল,
"নাবিলা! তুই কি রে! তুই ভালোবাসা নিয়ে খেলছিস! তুই কি জানিস! এতে দুটো ছেলের জীবন নষ্ট হতে পারে!" "তাতে
আমার কি । আমার যা করার ছিল আমি করেছি । এখন তুই এর মধ্যে নাক গলাস না ।" যা করেছে, ঠিক
করেছে এরকম একটা ভাব নিয়ে কথাটা বলল নাবিলা । নিশি এবার প্রায় কাঁদো
কাঁদো কণ্ঠে বলল, "আরে গাধি আবির তোরে ভালোবাসে, এতোটাই
ভালবাসে যে ও কইছে তুই যদি রাজরে নিয়া খুশি থাকোস তাইলে তাই হইবো, আর তুই দুইডা পোলার লগে প্রেম প্রেম খ্যালোছ! আল্লাহ
তোরে মাফ করুক । ওদের দুইজনের যদি সত্যি কিছু হয় তুই কিন্তু জীবনেও নিজেরে
ক্ষমা করতে পারবি না । জীবনেও না ।" বলেই সেখান থেকে নিজের ঘরে যেয়ে দরজা আটকে দিলো নিশি । এতক্ষণে
নাবিলার মাঝে একটা আবছা চিন্তার জাগরণ ঘটলো । এটা কি একটু বেশিই হয়ে
গেলো নাকি?
কিছুক্ষণ ভাবল, শেষে দেখল, আসলেই একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে । রাজকে ওর ভালো লাগে, রাজের
চেহারা আবিরের চেয়েও সুন্দর কিন্তু নাবিলার তো আবিরকেই ভালোবাসে । একটা সামান্য
ব্যাপারে ছেলেটাকে এতোটা কষ্ট দেয়া উচিৎ হয় নি । নাবিলা ওদের বাসা থেকে বেড়িয়ে পাশের বাসায় চলে গেলো । ওর তখন খেয়াল
নেই, ও ছেলেদের হোস্টেলে ঢুকছে । জামি আর শিমুলের রুমের দরজা আটকানো থাকলেও
আবিরের রুমের দরজাটা খোলা । বোধ হয় কোন কারণে বেরিয়েছিল, পড়ে আটকাতে ভুলে গেছে । নাবিলা কিছু না
বলেই ভেতরে ঢুকল । আবির রুমে নেই, বারান্দায় দাড়িয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা
বলছে । বারান্দার দরজার কাছে এলো নাবিলা । আবির অন্যদিকে ঘুরে দাড়িয়ে ছিল বলে নাবিলার
উপস্থিতি টের পায় নি ও । নাবিলা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময়
আবির ফোনের ওপাশের মানুষটাকে বলল, "আমি কখন বলেছি আমি
নাবিলাকে ভালোবাসি? আমার পাশে ওর মতো মেয়েদের মানায় নাকি?
আমার পাশে মানাবে আরও ভালো, আরও স্টাইলিশ,
আরও গ্ল্যামারাস মেয়ে । এসব ফালতু মেয়ে এখন চলে
নাকি?"
"হ্যাঁ আমি যে তোমাকে
বললাম, প্রেম ট্রেম ভালো লাগে না, এটা
সত্য , কিন্তু নাবিলা আমার সে ধারণাটাই পাল্টে দিয়েছে । প্রথম প্রথম
যখন ও আমার সাথে একদম ঘনিষ্ঠভাবে মিশবার চেষ্টা করে, তখন আমার বিরক্ত লেগেছিল । কিন্তু পড়ে
দেখলাম, না, এ তেমন মেয়ে মোটেই হতে পারে না । যে এতো সুন্দর, প্রথম দেখাতেই এতো
বন্ধুসুলভ যে, সে আর যাই হোক, অন্তত
শৈলীর মতো মেয়েদের থেকে অনেক গুণ ভালো ।" পরশ থ হয়ে গেলো । এখন কি হবে? কি জবাব
দেবে এবার? চেয়েছিল নাবিলার নামে উল্টাপাল্টা কিছু বলবে । এখন তো প্রশংসা
করে ফেলেছে, আবার যদি খারাপ কিছু বলে ছেলেটা কি বিশ্বাস করবে? তার ওপর রাজও নাবিলার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে, এখন
নাবিলার নামে কিছু বলতে গেলে যদি মার-টার দিয়ে বসে? কি বলবে ভাবতে লাগলো পরশ । অনেক ভেবে চিনতে কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময়
দরজায় নক করবার আওয়াজ । রাজ দরজার দিকে তাকিয়ে দরজার ওপাশে থাকা লোকটার উদ্দেশ্যে
বলল,
"খোলা আছে ।" দরজা খুলে ভেতরে এলো পাপলু আঙ্কেল । রাজ পাপলু আঙ্কেলকে
দেখে উঠে দাড়িয়ে সালাম জানালো । পাপলু আঙ্কেল সালামের জবাব দিয়ে পরশকে উদ্দেশ্য করে বলল, "দ্যাখ
দ্যাখ, শেখ কিছু । তোরা যে শেষ কবে সালাম
দিয়েছিলি তাই-ই তো আমার মনে পড়ে না ।" তারপর রাজের
দিকে তাকিয়ে বলল, "শোনো বাবা, তোমার চাচা ফোন
করেছিলেন । বললেন তোমার নাকি জিম করবার অভ্যাস, এখন
নিয়মিত না করলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে । তাই ভাবলাম তোমাকে একটু
স্কুলের শারীরিক শিক্ষার ল্যাবটা দেখিয়ে দিয়ে আসি ।" রাজ বলল, "জি
অবশ্যই ।" তারপর রাজ পরশের দিকে তাকিয়ে বলল, "তুমি
যাবে নাকি?" রাজ হালকা হেসে ডানে বামে মাথা নাড়াল । রাজ তখন, "ওকে
ডিউড, সি ইউ লেটার । বাই ।" বলে শার্টের
বোতাম লাগাতে লাগাতে বেড়িয়ে গেলো । পরশ ওখানেই বসে ভাবতে লাগলো, এখন কি করা উচিৎ ।
সায়রা বেশ ইমোশনাল একটা
মেয়ে । অন্যের জন্য বেশ কাঁদে সে । তাই যখন আবিরের মুখে শুনল আবির নাবিলাকে ছোট করে কথাটা
বলেছে, তখন সে আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না । কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে
উঠলো,
"আবির ভাইয়া, তুমি মিথ্যে বলছ । তুমি নাবিলা
আপুকে অনেক ভালোবাসো ।" কিন্তু এদিকে আবির যদি সত্যটা বলে যে সে নাবিলাকে সত্যি
ভালোবাসে আর শেষে যদি দ্যাখে নাবিলার আবিরকে ছেড়ে রাজের সাথে সম্পর্ক তৈরি করছে, তখন
সায়রা আরও কষ্ট পাবে । তাই সত্যিটা বলার চেয়ে মিথ্যেতেই অটুট থাকাটাই শ্রেয় মনে
হল আবিরের কাছে । বলল, "শোনো সায়রা, সবটা
তুমি বুঝবে না । তুমি এখনও আমার চেয়ে ২বছরের ছোট, সুতরাং
তোমার চেয়ে ২বছরের বেশি অভিজ্ঞ আমি । তোমার নাবিলা আপু ওই রাজ ভাইয়ার সাথেই
থাকুক না, আমার তাতে কোন সমস্যা নেই, কোন কষ্ট নেই । বরঞ্চ আমার
সাথে থাকলে ওর যন্ত্রণায় আমি অতিষ্ঠ থাকতাম । আপদ বিদেয় হয়েছে, ভালো
হয়েছে ।"
"কিন্তু তোমার কি হবে আবির ভাইয়া?" "আরে, আমি
রাস্তায় দাঁড়ালেই কতো মেয়ে আমার পেছনে লাইন লাগাবে, এদের
কাছে এই নাবিলা তো তুচ্ছ ।" আবির নেহাত এসব বলছে সায়রার সাথে ইয়ার্কি করে, সায়রাকে
আবির বোঝাতে চাচ্ছে নাবিলাকে আবির ভালোবাসে না । কিন্তু দরজার কাছে
দাড়িয়ে থাকা নাবিলা, ও সবটাকে সত্যি ধরে নিয়েছে । মুহূর্তের মধ্যেই চোখটা
ছল ছল করতে লাগলো । দু এক ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়লো নাবিলার কপোল বেয়ে । আর কিছু শুনল
না নাবিলা । সেখান থেকে দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলো । নিশি নাবিলার রুমে ঢোকার ব্যাপারটা টের
পেয়ে বেড়িয়ে এলো ঠিকই, কিন্তু আর কোন খোঁজ নিলো না নাবিলার ।
(৭)
ট্রিং ট্রিং ট্রিং......। ঘণ্টার আওয়াজের
ধ্বনি ভেসে এলো কানে । আর কিছুক্ষনের মাঝেই শিক্ষক এসে পড়বেন । প্রথম ক্লাস
খায়রুল স্যার এর । আবির ক্লাসে সবাইকে সামলাচ্ছিল, সবাইকে
যার যার বেঞ্চে বসবার জন্য অনুরোধ করছিলো । সেই সময় আবির খেয়াল
করলো, থার্ড বেঞ্চে বসে থাকা রাজের পাশে দাড়িয়ে রাজেরই সাথে বেশ হাসিখুশি ভাব
নিয়ে কথা বলছে নাবিলা । আবির প্রথমে কিছু বলার ইচ্ছে পোষণ করলো না । কিন্তু ফার্স্ট
বেঞ্চে বসে থাকা আবিরের অন্য একটা বন্ধু ইয়ার্কি করে বলল, "কিরে
আবির! নিজের গার্লফ্রেন্ড বলে ছেড়ে দিবি? ওরে কিছু বলবি না?" আবির কিন্তু ইয়ার্কিটাকে
সিরিয়াস চোখে দেখলো এবং বলল, "ও আমার গার্লফ্রেন্ড না ।" আবির আর দাড়িয়ে
না থেকে ভাবল এবার তবে বলাই লাগে । নাবিলার কাছে এসে বলল, "নাবিলা, আমার মনে হয় তোমার এখন নিজের বেঞ্চে বসা উচিৎ ।" নাবিলা বেশ একটা
মাস্তানের মতো করে বলল, "ও হ্যালো! কোথাকার মাল রে তুই যে
তোর কথা শুনবো?" আবির হতবাক হয়ে গেলো । এ কোন নাবিলাকে
দেখছে ও? শুধু আবিরই না । পুরো ক্লাস তাকিয়ে নাবিলার দিকে । এ সত্যি নাবিলা তো! নাকি
জীনে ধরেছে! এক রাতে এতো পরিবর্তন! নাবিলা আবারো বলে উঠলো, "আরে
সালা! দাড়িয়ে দেখছিস কি? যা ফোট এখান
থেকে!" আবির কিন্তু গেলো না । ওর চোখে মুখে
বিস্ময়য়ের ভাব এখনও কাটে নি । শুধু তাই নয়, রাজও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নাবিলার দিকে । নাবিলা এবার বেশ গাম্ভীর্যের সাথে তাচ্ছিল্যের
স্বরে আবিরকে বলল, "আরে যা, সামনে যেয়ে বদনখানা দেখা,
দ্যাখ কতো মাইয়া তোর পিছে ঘোরে ।" আবির বুঝতে
পারছে না হচ্ছে টা কি । তবে কি নাবিলা গতকালকের কথাগুলো শুনে ফেলেছে? আবির আর কিছু বলল না । সেখান থেকে চলে
এলো । আজ আবির ফার্স্ট বেঞ্চে বসেছে । সেখানেই বসলো । মনে মনে অবশ্য খুশিই হল । তবে খারাপ
লাগলো, তবে কি নাবিলাকে বন্ধু হিসেবেও আর পেলো না আবির? রাজ
ফিসফিস করে নাবিলাকে জিজ্ঞেস করলো, "তুমি কি ঠিক আছো?
হয়েছে কি তোমার? নাবিলা রাজের হাত ধরে বলল,
"ঠিক আছি । টেনশন কোরো না ।" রাজও নাবিলার
হাতটা শক্ত করে ধরে রইল । খানিক পরেই ক্লাসে এল খায়রুল স্যার । সবাই নিয়মমতো দাড়িয়ে
সালাম জানালো, স্যারও সালামের জবাব দিয়ে বসতে বলল । অন্যান্যদিনের
মতো আজও নাম ডাকা হল । তারপর স্যার বলল, "আচ্ছা শোনো, তোমাদের
প্রতিবছর নতুন জামাটা জানুয়ারীতেই দেয়া হয়, কিন্তু এবার
এলাকার যিনি মেয়র, উনি সরকারের কাছ থেকে শুরুর দিকে
নির্বাচনী ঝুট ঝামেলার জন্য টাকা জোগাড় করতে পারেন নি, তো
তোমাদের জামাটা এসে গেছে, নতুন যারা এসেছ তাদের তো যেটুকু
টাকা ছিল তাই দিয়েই বানিয়ে দেয়া হয়েছে, আর তোমাদের জামাও
নতুন, তাই তোমাদের আর নতুন ড্রেস নেয়া লাগবে না । কিন্তু যারা
পুরনো আছো তাদের তো লাগবে, তোমরা একটু যাও, পাপলু
আঙ্কেলের কাছে যেয়ে নিয়ে এসো ।" যেহেতু আবির ক্লাস ক্যাপ্টেন, তাই স্যার আবিরকে ডেকে আনতে
বলল । আবির আনবার জন্য দরজা অবধি পৌঁছেছে, এমন সময় স্যার আবিরকে ডেকে বলল,
"এই আবির, দাঁড়াও দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমি একা পারবে না ।" খায়রুল স্যার এর চোখ যায় রাজের দিকে । যেহেতু রাজ গতকালই নতুন
এসেছে, তাই ও স্কুল ইউনিফর্ম পায় নি আর আজ সিভিল ড্রেসে এসেছে । খায়রুল স্যার
রাজকে উদ্দেশ্য করে বলল, "এই যে স্যার, আপনি
একটু আসেন তো ।" রাজ উঠে দাড়িয়ে স্যার এর কাছে গেলো । খায়রুল স্যার বলল, "আপনিও একটু যান, আবিরকে একটু সাহায্য করুন ।" রাজ বেশ খুশি মনেই বলল, "ইয়েস স্যার, আ'ম রেডি ।" অগত্যা আবির আর
রাজ রওনা হল পাপলু আঙ্কেলের উদ্দেশ্যে । ক্লাসরুমগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো
আবির আর রাজ । আবির কোন কথা বলছে না, চুপচাপ
হেঁটে যাচ্ছে । রাজ যেতে যেতে ক্লাসরুমগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে । কোন ক্লাসে
হচ্ছে বাংলা, কোন ক্লাসে ইংলিশ রাইম পড়ছে একটা ছোট মেয়ে । কোন ক্লাসে
আবার স্যার কিছু ছেলে নীলডাউন হয়ে বসে আছে । ক্লাসরুমের সিমানা পেরিয়ে যখন ওরা হোস্টেল
বিল্ডিংগুলোর মাঝের রাস্তায় এলো, তখন মুখ খুলল রাজ । বলল, "হেয়
ম্যান! তোমার সাথে তো গতকালই দেখা হল, অথচ
আমি বুঝতেই পারিনি তুমি আমাদের ক্লাসের প্রিফেক্ট!" আবির
একটু হাসল । কিছু বলল না । রাজ আবারো বলল, "বাই
দা ওয়ে, নামটা যেন কি?" আবির বলল,
"আবির ।" "ও ইয়া, আবির । সো, তুমি
কিন্তু আমাকে নিজের বন্ধু বানালে না, হোয়াই ম্যান হোয়াই?"
আবিরের একটু কষ্ট হল । সত্যিটা কি আর এভাবে বলা যাবে? তবে তাই
বলে নাবিলার জন্য ছেলেটার সাথে রাগ করে কি লাভ? দোষ তো করেছে
নাবিলা । রাজ তো আর করেনি । আবির একটু হাসিমুখে রাজের দিকে হাত বাড়িয়ে
দিলো । রাজও হাসিমুখে হাত মেলাল । তারপর রাজ বলল, "আচ্ছা ডিউড, আমরা
তো এই স্কুলের বেতন দেই না, তাহলে স্কুল চলে কি করে?"
আবির বলল, "আমাদের স্কুলটা সরকারী স্কুল । এখানে সরকারী
টাকায় সবটা চলে আরকি, তবুও যারা বিত্তবান আছে, তারাও নিজেদের
থেকে যা পারে, দেন ।" রাজ আরও একবার
চারপাশটা চোখ বুলিয়ে নিলো । তারপর বলল, এরকম ওয়ান্ডারফুল একটা আইডিয়া এসেছিলো কার
মাথা থেকে?" "উম... যদ্দুর
শুনেছি, এর আগে যিনি এলাকার মেয়র ছিলেন, মান এই মেয়রের বাবা, তিনি ছিলেন এতিম । ছোটবেলা থেকে
উনিও একটা অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছেন । কিন্তু উনি দেখলেন, দেশের অনাথ আশ্রমগুলো একদম জঘন্য । সেখানে না আছে
ভালো থাকার যায়গা, না আছে নিয়ম কানুন । তাই উনি উনার এই হিউজ
প্রোপার্টিতে দুপাশে সারি সারি পাঁচটা পাঁচটা করে বিল্ডিং মুখোমুখি বানিয়ে তৈরি
করলেন একটা আশ্রম । উনি ভেবেছিলেন লোক হয়তো তেমন হবে না, কিন্তু
ধীরে ধীরে অনেক লোক হয়ে গেছে । যাই হোক, উনি সরকারী টাকার চেয়েও
নিজের টাকাই বেশি খরচ করেছেন এতিমদের এতো সুব্যাবস্থার জন্য । শোনা যায়
তখনকার হিসেবে প্রায় সাড়ে বাহাত্তর কোটি টাকা খরচ হয়েছিলো এটা বানাতে । কিন্তু
দুর্ভাগ্যবশত উনার ছেলেমেয়েরা আর উনাকে টাকা খরচ করতে দেন নি । ফলে তখন স্কুল
বিল্ডিংটাই আর বানানো হয় নি । সবাই ক্লাস করতো ছাদে । উনার ছিল চার ছেলে, তিন
মেয়ে । একমাত্র উনার ছোট ছেলে ছাড়া বাকি ছয় ছেলেমেয়ে হয়েছে অমানুষ । তাই উনি বুদ্ধি
করে উনার ছোট ছেলের ওপরেই রাজনৈতিক ব্যাপারগুলো সামলাবার দায়িত্ব দিয়ে উনার ছোট
ছেলেই এখনকার মেয়র । বাকি ছেলেমেয়েগুলো বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে । তাদের কোন হদিস
নেই । উনার ছোট ছেলে অনেকদিন ধরেই চাচ্ছিলেন একটা স্কুল বিল্ডিং বানাবেন, কিন্তু
যেই জায়গাটা স্কুল বিল্ডিঙের জন্য রাখা হয়েছিলো, সেই যায়গাটা
নিয়ে একটু ঝামেলা বাধে । অবশেষে অনেক সংগ্রামের পর উনি এই স্কুল বিন্ডিংটা বেশ যত্ন
করে বানাতে সক্ষন হন । এইতো, ক বছর আগেই এই স্কুল বিল্ডিংটা তৈরি হয়েছে ।" রাজ হেসে হেসে
বলল,
"ওয়াও, এখন যেমন আমরা বাংলাদেশ ও বিশ্ব
পরিচয়ে রাজাদের কথা শুনছি, ভবিষ্যতে আমাদের ছেলেমেয়েরা হয়তো
এনার ইতিহাস পড়বে ।" আবিরও মুচকি হাসল । কিছু বলল না । ক্লাস টেনের ছাত্র সংখ্যা ২০ । মোট জামা এসেছে ২২টা, নতুন
কেউ যদি আসে, তার জন্য রিজার্ভ রাখার জন্য । একটা সাদা
শার্ট, কালো প্যান্ট আর মেয়েদের জন্য
সাদা ফ্রক, কালো পাজামা । সবার জন্য সাদা জুতো । আবির ধরলো ১০টা
আর রাজ ১২টা । আবির বলেছি ১১টা করে নিতে, তা রাজ-ই বলল,
ও পারবে, আবিরকে কষ্ট দিতে চায় না । ক্লাসে এসে
স্যার এর ডেস্কের ওপর জামাগুলো রাখে আবির আর রাজ । এরপর স্যার ওদের
দুজনকেই দায়িত্ব দেয় সবাইকে একটা করে দেবার জন্য । ইউনিফর্মের শার্টের
পকেটে সবার এপ্রিল মাসের পকেটমানিও রাখা আছে । ১০০০টাকা । রাজ আর আবির
মিলে সবাইকে ইউনিফর্ম দিচ্ছিল আবির মেয়েদের পাশে, রাজ ছেলেদের পাশে । ফার্স্ট বেঞ্চে
দিয়ে সেকেন্ড বেঞ্চে গেলো । সেকেন্ড বেঞ্চেই বসে ছিল নাবিলা । আবির নাবিলাকে জামাটা
দিয়ে নাবিলার পাশের মেয়েটাকে যখন দিলো, এরই মাঝে নাবিলা নিজের জামাটা পেছনের
বেঞ্চে দিয়ে দিলো । আবির খানিকক্ষণ নাবিলার মুখের দিকে তাকাল । তারপর নাবিলাকে
আরেকটা দিয়ে পেছনের বেঞ্চে দিতে গেলো, নাবিলা আবার আবিরের দেয়া জামাটা পেছনের
বেঞ্চে ছুঁড়ে মারলো ।এদিকে রাজের সবাইকে দেয়া শেষ । আবির নাবিলার কাছে যেয়ে
ফিসফিসিয়ে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল, "এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে
নাবিলা!" নাবিলা আবিরের কথার কোন ভ্রুক্ষেপ না করে
রাজকে ডাকল । রাজ কাছে এসে বলল, "কি হয়েছে?" "এই, তুমি ওর হাত থেকে একটা জামা নিয়ে আমাকে দাও না!"
অনুরোধের স্বরে রাজকে কথাটা বলল নাবিলা । রাজ ঠিক বুঝল
না কি হয়েছে । তাই আবিরের দিকে একবার তাকিয়ে নাবিলাকে প্রশ্ন করলো, "হোয়াই?
হোয়াট হ্যাপেন্ড?" নাবিলা বিরক্তের স্বরে
বলল, "আর বোলো না, আবির আমার সাথে
ইয়ার্কি মারছে । আবির ভ্রু কুঁচকে নাবিলার দিকে তাকাল । শেষমেশ আবিরকে
মিথ্যে দোষারোপ করাও শুরু হয়ে গেলো! পেছন থেকে নিশি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো
রাজকে আবির ইশারায় থামিয়ে দিলো । রাজ হালকা হেসে বলল, "কাম
অন! আবির মোটেও এরকম ছেলে না । ইয়ার্কি করলেও ও তোমাকে
ফেরত দেবে ।"
নাবিলা
বিরক্ত হয়ে বলল, "উফ! তুমি-ই
দাও না!" রাজ আবারো কিছু একটা বলতে যাচ্ছি নাবিলাকে,
কিন্তু আবির রাজকে একটা জামা এগিয়ে দিয়ে বলল, "বলছে যখন, দাও না!" নাবিলা
আবিরের চোখের দিকে তাকাল । কিছু বোঝার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না । রাজ প্রথমে
আবিরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল । রাজ নিচ্ছেনা দেখে আবির আবারো বলল, "কি
হল, নাও!" রাজ ধীরে ধীরে জামাটা
নিলো । তারপর নাবিলাকে দিলো । ঠিক বুঝতে পারলো না, কেন নাবিলা এমনটা করলো । স্যার সে সময়
নাম ডাকার খাতায় কি একটা কাজ করছিলেন বলে কিছু টের পাননি ।
টেবিলের ওপর পরীক্ষার
খাতাগুলো অর্ধেকের বেশি-ই এখনও নাম্বার ছাড়া পড়ে আছে । দেখা হয় নি । যদিও সংখ্যাটা
বেশি না, তবে বেশি বেশি না করে কোন একদিন দেখা হয়ে যাবে এরকম একটা মনোভাব নিয়ে
এতদিন বেশ সময় পার করেছিলো বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ের শিক্ষক বকর স্যার । লোকটার বছর খুব
বেশি না, ২৭ মতো হবে । বিয়ে করেন নি, তবে একটা সম্বন্ধ দেখা হয়েছে যদিও এখনও ঠিক
হয় নি বিয়ে তার সাথেই হবে কি না । চেহারা শ্যামলা । মুখে চাপদাড়ি । মোটামুটি
গোলগাল মুখটা । চোখেও গোল ফ্রেমের একটা চশমা । গায়ে সাদা শার্ট, নেভি ব্লু প্যান্ট । ৪-৫টা খাতা
দেখে বসে বসে ভাবছিলেন ১ দিনের মধ্যে বাকি খাতাগুলো কীভাবে দেখবেন । যদিও অভিজ্ঞ
শিক্ষকরা এক দিনে অনেক খাতায় দেখতে পারে, কিন্তু এ অভিজ্ঞ নয় । এ বছরই এসেছে । আর কোথাও চাকরি
না পেয়ে এই স্কুলে জয়েন করল আর কি । খানিকক্ষণ কিছু ভাবার পর সামনে রাখা আরেকটা চেয়ারে এসে
বসলো আরেকজন শিক্ষক সুমন স্যার । এই স্যার বিজ্ঞান নেয় । এই সিট তার না, জাস্ট
কিছুক্ষনের জন্য কথা বলার জন্য বসা আরকি । সুমন স্যার বকর স্যার
এর সমবয়সী,
কিতু সুমন স্যার ২৫ বছর বছর থেকেই এই স্কুলের শিক্ষক । বকর স্যার এর
সাথে তার বেশ ভালোই গলায় গলায় ভাব । সুমন স্যার বলল, "কিরে? কি এতো
ভাবছিস?" বকর স্যার ভাবনার মাঝে ডুবে থেকেই বলল,
"তেমন কিছু না । এতগুলো খাতা শেষ করবো কীভাবে তাই চিন্তা
করছি ।" "তোকে আগেও অনেকবার বলছি, কাজগুলো
শেষ করে রাখ, কাজগুল শেষ করে রাখ, কিন্তু
তুই তো শুনিস-ই নি, দ্যাখ এবার,
মজা বোঝ ।" এবার বকর স্যার ভাবনা থেকে ফিরে এলো । সুমনের দিকে তাকিয়ে বলল, "আচ্ছা,
ভাবছি এই কটা খাতা-ই আমি দেখতে পারি না,
কিন্তু ভালো চাকরীর খোঁজে যদি অন্য কোথাও যাই, সেখানে যদি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি হয়, তখন কি
হবে?" শুনে সুমন স্যার খিল খিল করে হেসে দিলো । সুমন স্যারকে
হাসতে দেখে বকর স্যার জিজ্ঞেস করলো, "তুই হাসছিস!" "আরে, তোর আর যাওয়া লাগবে না কোথাও । এই স্কুলেই
সামনের মাস থেকে তোকে অনেক অনেক খাতা দেখতে হবে ।" বকর স্যার ভ্রু-কুঁচকে
সুমন স্যার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলো । তারপর বলল, "মেয়াদ
উত্তীর্ণ গাজা খেয়েছিস নাকি?" সুমন স্যার বলল,
"না তুই-ই দ্যাখ, ক্লাসরুম
গুলো কতো বড়, একেক রুমে ১০০জন ছাত্র-ছাত্রি
আটবে ।"
সুমন
স্যার আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তাই আগেই বকর স্যার বেশ সিরিয়াস মুডে বলল, "তা
১০০ জন এতিম কি পুরো বিশ্ব থেকে ধরে আনবে, নাকি দেশের অন্য
সব এতিমখানা বন্ধ হয়েছে, নাকি এই এতিমখানা ভিন্ন রকম বলে ওরা
এখানে আসবে, নাকি তোরা ঘোরে ঘোরে যেয়ে যেয়ে ছেলেমেয়েদের এতিম
বানিয়ে ধরে ধরে আনবি?" বকর স্যার এর কথাশুনে সুমন স্যার
বেশ হাসল । তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, "আরে
থাম ভাই, থাম । এর কিছুই না । খানিক আগে রাশেদ স্যার
আমাকে ডেকেছিলেন ।" "কি বললেন?" সুমন স্যার বকর স্যার
এর টেবিল থেকে বোতলটা চেয়ে নিয়ে খেতে পানি খেতে খেতে বলল, "বললেন, উনি ভেবেছেন এলাকার মেয়রের সাথে কথা বলে এই
স্কুলের একটা নতুন ব্যাবস্থা নেবেন । এতিমরা তো আছেই, ওদের
থাকার জায়গাও আছে, তার সাথে শুধু এই প্রতিষ্ঠানে পড়ার জন্য
উনি বাইরে থেকে আরও স্টুডেন্ট ভর্তি করাবেন যারা এতিম না । তাদের কাছ থেকে
আবার টাকাও নেবেন শুনলাম ।" বকর স্যার হালকা ভয় পেলো । বলল, "সেকি!
সত্যি বলছিস?" "হ্যাঁ, তাইতো শুনলাম । রাশেদ স্যার তো তাই-ই বললেন ।" বকর স্যার আর কিছু বলল
না । সুমন স্যারও পানি খেয়ে বোতলের মুখটা আটকে টেবিলে রাখল । তারপর বকর স্যার এর
মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, তার চেহারায় ভীতির ছাপ । কোন দিকে এক
দৃষ্টিতে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে । সুমন স্যার মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো, "কিরে?
তুই ভয় পাচ্ছিস কেন?" বকর স্যার একবার
সুমন স্যার এর দিকে তাকাল, তারপর আবার আগের স্থানে দৃষ্টি
ফিরিয়ে বলল, "তুই বুঝতে পারছিস, একই
স্কুলে এতিম আর বাবা মায়ের আশ্রয়ে থাকা ছেলেমেয়ে পড়বে, এতে
এই দু ধরণের ছেলেমেয়েদের মধ্যে কতো ঝামেলা হবে?" এবার
সুমন স্যারও চিন্তায় পড়ে গেলো, আসলেই তো!"
সেদিন বিকেলে ছাদে
দাড়িয়ে সেই খাটে বসে ছিল আবির । বার বার সকালের কথাটা মনে পড়ছিল । যদিও আবির জানে নাবিলা
কেন এমনটা করলো, কিন্তু সে মনে মনে খুশিই হল, যাক,
অন্তত নাবিলাকে হারাবার কষ্টটাও কিছুটা হলেও লাঘব হবে । আকাশের দিকে
তাকিয়ে আরও কতো কথা ভাবছে । ছোটবেলার কথা, ইফাজের কথা, পায়েলের
কথা, দ্বীপের কথা, সেইদিনের কথা যেদিন
নাবিলা প্রথম আবিরের বাসায় এসেছিলো আবিরকে বন্ধু বানাবার, সেইদিনের
কথা, যেদিন আবির এই স্কুলে প্রথম এসেছিলো, সেইদিনের কথা যেদিন এই স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল স্যার চলে গেলেন । "হে
ব্রো!" হঠাৎ ডাকটা শুনে চমকে পেছন ফিরে তাকাল আবির । দাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে
আবিরের পাশে এসে বসলো রাজ । ওই কথাটা বলেছে
। রাজ হ্যান্ডশেক
করে বলল,
"সো, তুমি কি রাইটার?" আবির হালকা হেসে বলল, "না তো, কেন?" "না, রাইটাররা
এরকম ন্যাচারের প্রতি বেশি আকৃষ্ট থাকে । আর তোমাকে তো প্রায়
সময়েই ছাদে দেখি । তাই বললাম ।" আবির একটু নড়ে বসলো । তারপর বলল, "রাইটার ছাড়া কি কেউ
ছাদে আসে না?" "আরে কূল, আমি
তো মজা করছিলাম রাগ কোরো না ।" আবির বলল, "আরে, এতে রাগ
করবার কি আছে । আসলে আমি ছোটবেলা থেকেই একাকীত্ব বোধ করলে ছাদে বসে থাকি ।" রাজ মাথা নাড়ল । কিছু বলল না । আবির উঠে
দাড়িয়ে ছাদের রেলিংটার পাশে দাঁড়ালো । রাজ স্পষ্ট দেখতে পেলো, আবিরের
চখেমুখে বিষণ্ণতার ছাপ । কোন একটা কষ্ট আবিরের মনে খেলা করছে স্পষ্ট বুঝতে পারছে
রাজ । রাজও উঠে দাড়িয়ে আবিরের থেকে খানিকটা দূরে রেলিং ধরে আবিরেরই ভঙ্গিতেই
দাঁড়ালো । রাজ জিজ্ঞেস করলো, "মন খারাপ?" আবির একবার রাজের
দিকে তাকাল । তারপর আবার সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, "না,
শুধু পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে । রাজও একটা বিষণ্ণতার
শ্বাস ফেলল । তারপর ওরও যেন মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেলো । বলল, "হুম
। আমারও যখন পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে, আমারও খারাপ লাগে খুব । যেমন এখন তোমার
কথা শুনে আমারও পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেলো ।" আবির কিছু বলল
না । সামনের দিকেই তাকিয়ে রইল । খানিক পর নারকেল গাছে একটা বেশ সুন্দর দেখতে হলুদ পাখি
দেখল আবির । রাজকে দেখিয়ে বলল, "দ্যাখো, কি সুন্দর একটা হলুদ পাখি!"
রাজও দেখল, মুখে কিছু বলল না । দুজনেই
অনেকক্ষণ ধরে পাখিটার দিকে তাকিয়ে রইল, নিঃশব্দে । হালকা হাওয়া বইছে । হাওয়ার দুজনেরই
চুলগুলো উড়ছে । এমন সময় রাজ একটা গান ধরল ।
"সেই যে হলুদ পাখি,
বসে জামরুল গাছের ডালে
করতো ডাকাডাকি, আমার
শৈশবের সকালে"
এই দুই লাইন গান অনুযায়ী
দুইবার গাওয়ার কথা থাকলেও প্রথমবার গেয়ে দ্বিতীয় লাইন রাজ গাওয়ার আগেই গেয়ে উঠলো
আবির । তারপর রাজ গাইল ।
"একদিন গেলো উড়ে......"
আবির গাইলো ।
"জানি না, কোন সুদূরে ।"
এরপর দুজন একসাথে সুর
ধরল ।
"ফিরবে না? সেকি ফিরবে না? ফিরবে না আর কোনোদিন?
ফিরবে না? সেকি
ফিরবে না? ফিরবে না আর কোনোদিন?"
দুজনের চোখেই কোণে জল
দৃশ্যমান হল । দুজনের চোখ মুছল । অনেকক্ষণ কেউ কিছু বলল না । শুধু বাতাসের আওয়াজ । আশেপাশে আর কোন
শব্দ নেই । তারপর কষ্ট মাখা হাসিমুখে রাজ আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, "তুমিও গানটা শুনেছ?"
আবিরও একই রকম কষ্টমাখা হাসি নিয়ে বলল, "হুম
। আমার খুব পছন্দের ।" রাজ বলল, "বাহ! আমারও খুব
পছন্দ গানটা । তোমার আমার দেখি অনেক মিল ।" আবির বলল, "তুই
করে ডাক না, কেমন যেন বন্ধুত্বটা কম কম লাগছে ।" রাজ হেসে আবিরের
দিকে তাকিয়ে রইল । আবির তখন রাজের দিকে তাকিয়ে বলল, "অভাবে
তাকাস না, আবার প্রেম না হয়ে যায় তোর সাথে ।" রাজ এবার আরও
হাসল । আবিরও । খানিকক্ষণ আগের যে কষ্টটা ওদের ভেতর ছিল, সেটা মুহূর্তের মধ্যেই কথার
মাঝে বিলীন হয়ে গেলো ।
(৮)
বাটিতে শেষ বিস্কিটটা হাতে নিলো জামি । এতক্ষণ জামি, শিমুল
আর পরশ শিমুলের রুমে বসে পরামর্শ করছিলো । উদ্দেশ্য, রাজকে
হটিয়ে আবিরকে নাবিলার মনে জায়গা করে দেয়া । জামি শেষ বিস্কুটটা
খেতে খেতে বলল, "তা কি করবি এখন? গতকাল ও জিমে
গেলো গা, আসার পর তুই কিছুই করতে পারলি না?" পরশ বিরক্ত হয়ে বলল, "ধুরু! ক্যামনে করমু । রাতে ঘুম পাইছিল, ঘুমায় গেছিলাম ।" জামি আবারো বলল, "তার
এখন এইখানে আইছিস কি করতে?" পরশ ভ্রু-কুঁচকে অবাক হয়ে বলল, "এ কেমন কথা কস তুই?
আমি তো আইছি তগো লগে পরামর্শ করতে ।" জামি গ্লাসে
রাখা পানিটা খেয়ে বলল, "আমরা ভাইবা রাখছি, আবিরের
ব্যাপারে আর মাথা ঘামামু না । ও তো নিজেই নিজের ভালো বুঝতাছে না, আমি
কওয়ার কেডা?" এতক্ষণ শিমুল চুপ ছিল, এখন মুখ খুলল, "আহ জামি! থামতো!"
তারপর পরশকে উদ্দেশ্য করে বলল, "বল পরশ,
তুই কি ভাবছোস?" পরশ বলল, "আমি ভাবছি, ওই রাজ নামের ছেলেটারে দিয়া এমন কিছু করামু,
যাতে অর কামগুলা দেইখা নাবিলাই ওরে ঘৃণা করতে শুরু করে ।" জামি আর শিমুল
একবার দুজন দুজনের দিকে তাকাল । তারপর আবার দুজনে পরশের দিকে তাকাল । শিমুল বলল, "তোর
কি মনে হয়, আমরা পারমু?" পরশ বেশ
আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, "আলবাদ পারমু!" শিমুল আর কিছু না ভেবে বলল, "প্ল্যান কবে থেইকা
শুরু করবি?" পরশ বলল, "কাল
সকাল থেইকা ।"
রাত ৮টার দিকের কথা । নিশি ডাইনিং
টেবিলে বসে প্র্যাকটিকালের কাজ করছিলো । নিজের টেবিলে বসেই করতে পারত, কিন্তু
ডাইনিং টেবিল একটু বড় তো, তার ওপর প্র্যাকটিকাল খাতা ভাজ করা
যায় না । অনেকে খাতাগুলো শক্ত মলাট থেকে খুলেও করে, তবে এটা
নিশির পছন্দ না । তাই এইভাবে কাজ করা আরকি । কি একটা ছবি আঁকছিল, বায়োলজির
। এমন সময় খেয়াল করলো, নাবিলা রুমে থেকে বেড়িয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে । নিশি ছবি আঁকতে
আঁকতেই জিজ্ঞেস করলো, "কোথায় যাচ্ছিস?" নাবিলা "ছাদে" বলেই দরজা আটকে চলে গেলো । নিশি এক
মুহূর্তের জন্য দরজার দিকে তাকাল । আরেকটু একে খাতাটা বন্ধ করে সে নিজেও ছাদে চলে গেলো । ছাদের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখল, আবির
বসে আছে বিছানাটার ওপর কিন্তু নাবিলা নেই । সিঁড়িঘরের ওপাশে থাকতে
পারে ভেবে দেখতে গেলো, কিন্তু না । সেখানেও নেই । নিশি আবিরের কাছে যেয়ে
বসলো । তারপর ভ্রু কুঁচকে হালকা বিরক্তির সাথে বলল, "কিরে? তুই কি এখন দেবদাস হয়ে যাবি নাকি? সারাদিন ছাদে বসে
থাকিস? পড়াশুনা নাই?" আবির কোন
জবাব দিলো না । এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে । নিশি আবারো প্রশ্ন করলো, "কিরে?
কিছু বল?" আবির নিশির প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে বলল, "আচ্ছা
নিশি, নাবিলা তো তোর খুব ভালো বন্ধু, তাই
না?" "হেহ! ভালো বন্ধু,
ওরে এহন দেখলে খালি গাইলাইতে আর থাপড়াইতে মন চায় ।" নাবিলার প্রতি
ক্ষোভ প্রকাশ করে কথাটা বলল নিশি । আবির এতক্ষণে নিশির দিকে তাকাল । তারপর বলল, "না,
ধরে নে ও তোর খুব খুব খুব ভালো বন্ধু, ধর এতো
ভালো বন্ধু, এমন ভালো বন্ধুত্ব আর পৃথিবীতে নাই, তুই ওর জন্য মরতেও পারস ।" নিশি হেসে উঠলো । আবির জিজ্ঞেস করলো, "কি
হল?" "ওতো শখ নাই আমার ।" আবির একটু হতাশ
হল । আর কোন কথা বলল না । নিশির তখন আবিরের চেহারা দেখে একটু মায়া হল । আবার কষ্টও
পেলো । কথা না শোনায় হয়তো আবির কষ্ট পেয়েছে । নিশি বলল, "আচ্ছা বল ।" "না থাক ।" নিশি জোরাজুরি
শুরু করে দিলো । আবির বলল, "আরে বাদ দে দোস্ত । যতোসব ফাউ
প্যাঁচাল কইরা লাভ নাই ।"
আজ আকাশে বড় একটা
পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে । সাথে কোটি কোটি তারা । বাইন দ্বীপটা থেকে সে
সময় আকাশের চাঁদের আলোর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বাঘা খালের ভেতর । মৃদু
দোদুল্যমান সেই খালের মাঝে প্রতিফলনটাও কাঁপছে । এমন সময় সেই প্রতিফলনের
ওপর একটা ঢিল ছুঁড়ে মারল পারে সিটে বসে থাকা রাজ । প্রতিফলনটা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন
হয়ে ধীরে ধীরে জোড়া লেগে শান্ত হচ্ছে রাজ অপেক্ষা করছে নাবিলার । আরেকটা ঢিল ছুঁড়তে
যাচ্ছিলো, এমন সময় নাবিলা এসে পাশে বসলো । রাজ জিজ্ঞেস করলো, "এতক্ষণ
লাগলো?" নিশি হাফাতে হাফাতে বলল, "আর বোলো না, আমার রুমমেট নিশিকে হাজারটা কৈফিয়ত দিতে
হবে সেই ভয়ে ভাবছিলাম কি করবো । অবশেষে তাড়াতাড়ি করে দৌড়ে চলে আসলাম, আর ওকে
বলে আসলাম আমি ছাদে গেছি । বেচারি মনে হয় আমাকে এখনও ছাদে খুজছে ।" বলেই খিল খিল
করে হেসে উঠলো নিশি । রাজ তখন বলল, "বাহ, ভালো তো । তা......" আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো রাজ কিন্তু ঠিক সে সময় নাবিলা কিঞ্চিৎ রেগে বলল,
"এই তুমি বিকেলে কোথায় ছিলে? ফোনটাও ধরনি?"
রাজ বলল, "ও আচ্ছা, ছাদে ছিলাম ।" নাবিলা বলল, "ছাদে!" নাবিলার
মনে পড়লো, ও নিজেও ছাদে গিয়েছিলো, কিন্তু
আবিরকে দেখে আর ভেতরে যায় নি । রাজ তখনো ছাদে আসে নি । নাবিলা জিজ্ঞেস
করলো,
"ছাদে কি করছিলে?" রাজ বলল,
"ওই আরকি, ঘুরতে ।" নাবিলা "ও"
বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল । ভাবল, রাজের
সাথে আবিরের দেখা হয় নি তাহলে । রাজ বেশ একটা হাসিমুখে বলল, "আজ
জানো, একটা ছেলের সাথে পরিচিত হলাম ।" নিশি আবার সে
স্বস্তিটা ফিরে পেয়েছিলো, মুহূর্তের মধ্যেই তা হারিয়ে ফেলল আর ফিরে
এলো একটু রাগ । রাজ বলল, "ছেলেটা অনেক
ভালো জানোতো, সাধারণত ছেলেরা একটু মাস্তান টাইপের হয়,
কিন্তু ও অতোটাও ওরকম না । একদম আমার মতো । আর ওর সাথে
আমার অনেক মিল । ছেলেটার নাম........." "আবির, তাইনা?" রাজের কথা শেষ করতে না দিয়েই বলল
নাবিলা ।" রাজ হাসিমুখে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময়
নাবিলা বলল, "হয়েছে, আর আদিক্ষেতা
দেখানো লাগবে না ।" রাজ নাবিলার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল । জিজ্ঞেস করলো, "কেন?
কি হয়েছে?" নাবিলা আবিরের প্রতি ক্ষোভ
প্রকাশ করে বলল, "ওই বদমাইশটা নিজে ন্যাকামো করে,
আর মানুষ ন্যাকামো করলে ওর গায়ে লাগে ।" রাজ জিজ্ঞেস
করলো,
"কেন?" নাবিলা সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, "তুমি
বলো, তুমি আর ওর সাথে মিশবে না!" রাজ
সম্ভবত নাবিলার কথার প্রতিবাদে কিছু একটা বলার ভাব ধরেছিল, কিন্তু
নাবিলা তার আগেই বলল, "তাহলে কিন্তু তুমি আমার মতো একটা
বন্ধুকে হারাবে!" এবার রাজ থেমে গেলো । কি বলবে বুঝতে
পারলো না । নাবিলা বলল, "বলো বলবে না!" রাজ কিছু বলল
না । নাবিলা এরকম আরও কয়েকবার জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু রাজ হেয়ালি করতে লাগলো । অবশেষে নাবিলা
বিরক্ত হয়ে উঠে দাড়িয়ে বলল, "থাকো তুমি তোমার আবিরকে নিয়ে । আমার সাথে
তোমার মেশা লাগবে না ।" বলেই ওঠার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো নাবিলা, এমন সময়
রাজ এক প্রকার নিজের ওপর জোর খাটিয়েই বলল, "আচ্ছা যাও,
আমি ওর সাথে আর কথা মিশবো না ।" নাবিলা ঘুরে
তাকিয়ে কিছুক্ষণ মুখটা গোমড়া করে রাজের দিকে তাকিয়ে রইল । রাজ হালকা ভয় পেলো । পরক্ষনেই আবার
নাবিলা হেসে রাজের কাঁধে মাথা রেখে বলল, "তারপর বলো, কেমন
আছো?"
পরদিন ছিল সোমবার । ৬ এপ্রিল । ক্লাস শুরু
হবার এখনও মিনিট সাতেক বাকি । সবাই ক্লাসে মধ্যে যে যার যার মতো কথাবার্তা বলছে, চিল্লাপাল্লা
করছে । রাজ তখন বোর্ডে ডেট, টিচারের নাম, এগুলো
লিখছিল, এমন সময় মানডে টা ইংরেজিতে লিখতে গিয়ে ভুল হয়ে গেলো । এন লিখতে গিয়ে
ভুলে এম লিখে ফেলেছে । রাজ ডাস্টারটা খুঁজতে লাগলো, কিন্তু পেলো না । নিশ্চয় পাশের
ক্লাসে নিয়ে গেছে । ফার্স্ট বেঞ্চে বসে ছিল রাজ । আবির রাজের কাছে যেয়ে
বলল,
"রাজ, আমারে একখান কাগজ দিতে পারবি?"
রাজ, "ইয়েস ব্রো, ওয়েট" বলে ব্যাগ থেকে যেই না কাগজ বের করতে যাবে, চোখ
গেলো নাবিলার দিকে । চোখের পাপড়ি সংকুচিত করে রাগি মেজাজে তাকিয়ে আছে রাজের
দিকে । রাজ একটা ঢোক গিললো । তারপর আবিরের দিকে তাকাল । আবির জিজ্ঞেস করলো, "কিরে?
দে?" রাজ আবার একবার নাবিলার দিকে তাকাল । সেই একই
ভঙ্গিতে এখনও তাকিয়ে আছে নাবিলা । রাজ তখন আবিরকে তর্জনী আঙ্গুল দেখিয়ে কোনোরকমে রেগে যাবার
অভিনয় করে বলল, "দ্যাখ আবির, ভালো হয়ে যা, এভাবে তাকালেই যে আমি তোর প্রপোজ মেনে নেবো, এমন কিন্তু
না!" আবির অবাক হয়ে গেলো । জিজ্ঞেস করলো, "কিরে!
তুই ঠিক আছোস!" রাজের কপালে হাত দিয়ে বলল,
"জ্বর টর আসে নাই তো?" রাজ এক
মুহূর্তের জন্য আবারো নাবিলার দিকে তাকাল । নাবিলা আরও রেগে আছে । পাশের একটা
মেয়ে তখন জানালা দিয়ে ওর বয়ফ্রেন্ডকে বলছে, "কবে বিয়ে করবা?" । রাজ আবারো একটা ঢোক গিলে তর্জনী উঁচিয়ে বলল, "দ্যাখ আবির, তুই বলবি বলেই যে আমি তোকে বিয়ে করবো এমনটা কিন্তু না?" আবির ভয়ে কেপে উঠলো । বলে কি এ! রাজের পেছনেই একটা ছেলে পানি খাছিল,
রাজের কথা শুনে মুখ থেকে সব পানি ফেলে দিলো । আবির বলল, "ওই
শালা! পাগল হইলি নাকি!" রাজ আবারো
নাবিলার দিকে এক মুহূর্তের দিকে তাকাল । নাবিলা এবার এমনভাবে
তাকিয়ে আছে, যেন মনে হচ্ছে এখনই এসে রাজকে ধরে মারবে । পাশেই বসে থাকা
মেয়েটা জানালায় ওর বয়ফ্রেন্ড কে হাত দিয়ে ঈশারা করে লিপকিস করার ব্যাপারটা দেখাল । রাজ আবারো
তর্জনী উঁচিয়ে বলল, "আবির! তুই বললেই যে আমি তোকে
লিপকিস করবো তা কিন্তু না!" আবির এবার দূরে সরে গেলো,
চোখে মুখে ভয়ের ছাপ, শার্টটা একটু টেনে বুকে
ফু দিলো । নাবিলা এবার আর না পেরে রেগে উঠে আসতে যাচ্ছিলো, কিন্তু
এদিকে রাজ-ই উল্টো উঠে জানালার দিকে যেতে লাগলো যেখানে ওই
মেয়েটা নিজের বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে । নিশি যখন রাজের
কাছাকাছি এলো, রাজ নিশিকে পাত্তা না দিয়ে পাশ কেটে এসে জানালা দিয়ে হাত
বাড়িয়ে ওই মেয়েটার বয়ফ্রেন্ডকে কয়েকটা থাপ্পর মেরে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,
"ওই হারামজাদা! এতো পিরিত ক্যান তোর!
ওই!" ওই মেয়ের বয়ফ্রেন্ড ভয়ে সেখান থেকে
চলে গেলো । মেয়েটার ভয়ে চুপসে গেলো । ক্লাসে সবাই রাজের দিকে
তাকিয়ে । রাজ তখন আবিরের দিকে দ্রুতবেগে এসে বলল, "আর শোন, তুই আজ
থেকে আমার সাথে মিশবি না!" আবির অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"হঠাৎ!" রাজ বলল, "আমার ইচ্ছা হয়েছে, তাই । গো টু হেল।" বলে নিজের
বেঞ্চে বসে পড়লো রাজ । আবির অবাক হয়ে রাজের দিকে তাকিয়ে রইল । হল টা কি হঠাৎ
করে ছেলেটার? মনে একটা মুখে একটা প্রশ্নের ছাপ ফুটে উঠলো আবিরের । তবে কি নাবিলা? আবির
নাবিলার দিকে তাকাল । নাবিলার চেহারা দেখেই বুঝতে পারলো, নাবিলাই
ওকে হয়তো আবিরের সাথে মিশতে নিষেধ করেছে । আবিরের মুখ থেকে
প্রশ্নের ছাপটা চলে গেলো । আবির একবার রাজের দিকে তাকাল । রাজ আবিরকে দেখে পাশে
থুথু ফেলল ঘৃণার ভাব দেখানোর জন্য । আবির কিছু বলল না । রাজের পাশের ছেলেটা আবিরের হাতে একটা কাগজ
দিয়ে বলল,
"আবির, এটা নে ।" আবির ছেলেটার
হাত থেকে কাগজটা নিয়ে বোর্ড মুছতে লাগলো । আর ভাবতে লাগলো, সম্পর্ক
কি এমনই! একটা গড়তে গিয়ে আরেকটা ভাঙ্গা, কখনো নিজের ভালোর জন্য যেমনটা রাজ নাবিলার সাথে মেশার জন্য করলো, আবার কখনো নিজে কষ্ট পাবে ভেবেও অন্যের ভালোর জন্য যেমন আবির ভাঙল নাবিলার
আর রাজের সম্পর্কটা বজায় রাখতে? কাহিনী দেখে পরশ শিমুলকে বলল,
"ছেলের ভাব দেখেছিস! আবির কিন্তু কিচ্ছু
করেনি, অথচ কেমন ভাবটা নিলো!" জামিও
বলল, "ইচ্ছে করছিলো কাছে যেয়ে দেই কয়েকটা!"
শিমুল বলল, "স্কুল শেষে, তাই না?" পরশ রাগান্বিত চেহারায় রাজের দিকে
তাকিয়ে মাথা উপর নিচে নাড়িয়ে বলল, "হুম ।"
"তা সুমন সাহেব! কি
ভাবলেন?" কাগজে কি সব লিখতে লিখতে সুমন স্যারকে কথাটা
বলল রাশেদ স্যার । সুমন স্যার গলা খাখরে বলল, "না মানে, স্যার আপনার আইডিয়াটা ভালো, কিন্তু......"
সুমন স্যার এর কথা শেষ করতে না দিয়েই রাশেদ স্যার বলল,
"নো কিন্তু স্যার, আমি যা বলেছি, সেটাই হবে । প্রিন্সিপ্যালের গদিতে কিছুদিনের জন্য বসেছি, এর
মধ্যে যদি নিজেদের সুবিধার কার্যসিদ্ধি করতে পারি!" মুহূর্তেই
রাশেদ স্যার এর ভেতরে কেমন একটা আলাদা জোশ চলে এলো । সেই জোশ নিয়ে বলল, "ওহ!
ভাবতেই আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে না!" সুমন
স্যার কিছুক্ষণ ভেবে ভীতির সহিত বলল, "কিন্তু স্যার,
একটা সমস্যা আছে ।" রাশেদ স্যার চশমার ফ্রেমের ওপর দিয়ে সুমন স্যারকে একটু মেপে
নিলো । তারপর আবারো লিখতে লিখতে জিজ্ঞেস করলো, "কি সমস্যা?" "স্যার এতে যারা এতিম তাদের অনেক সমস্যা হবে, যারা
এতিম না, তারা নিজেদের পারসোনালিটি নিয়ে বড়াই করবে, এতে যারা এতিম তারা ক্ষিপ্ত হবে, বুঝতে পারছেন স্যার
কতো বড় ঝামেলা বাজবে তখন?" রাশেদ স্যার খেপে গিয়ে
টেবিলে হাত দিয়ে জোরে একটা আঘাত করে উচু গলায় বলল, "আপনাকে
এতো কিছু ভাবতে বলেছে কে! আমি যা বলেছি! তাই হবে । ওদের ভালো দিয়ে আমাদের কি!" সুমন স্যার "সরি স্যার! সরি।" বলে উঠে দাঁড়ালো
। রাশেদ স্যার
বসে পড়লো । আবারো লেখায় মনোনিবেশ করলো । সুমন স্যার বেরোনোর জন্য পা বাড়াচ্ছিল, এমন সময়
রাশেদ স্যার পিছু ডাকল । সুমন স্যার পেছন ফিরে তাকাল । রাশেদ স্যার বলল, "এসব
কথা আর কেউ যেন না জানে ।" সুমন স্যার ডানে মাথা কাত করে হ্যাঁ সূচক ভাব প্রকাশ করল
ঠিকই তবে তার চেহারায় শঙ্কাটা এখনও লক্ষণীয় ।
"কানামাছি ভোঁ ভোঁ,
যাকে পাবি তাকে ছো, কানামাছি ভোঁ ভোঁ......"
বলতে বলতে স্কুল মাঠে কানামাছি খেলছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়ার । পাশে দাড়িয়ে
টিফিন পিরিয়ডে ওদের খেলা দেখছিল আবির । বেশ লাগছে দেখতে, আজকাল
তো এসব খেলা কেউ আর তেমন খেলেই না । এমন সময় আবিরের কাছে এলো রাজ । আবিরের হাত
দুটো ধরে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে রাজ বলল, "দোস্ত!
রিয়েলি ভেরি সরি! আমার কিছুই করার ছিল না!
প্লিজ রাগ করিস না!" রাজ জিজ্ঞেস করলো,
"তুমি নাবিলার কোথায় এমন করেছিস, না?"
রাজ কিছুক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে রইল । ইতস্তত করে কিছু বলতে
চাইলো,
"না মানে......ইয়ে......আরকি......ইয়ে......" আবিরই
বলে দিলো, "হ্যাঁ টাই মুখে আসছে না । রাজ থেমে গিয়ে
নিজেরই ওপর রাগ দেখিয়ে বলল, "হ্যাঁ, আমি ওর
কথাতেই করেছি ।" তারপর আবারও আবিরের হাত ধরে বলল, "কিন্তু
দোস্ত, প্লিজ তুই আমার সাথে মেশা বন্ধ করিস না! প্লিজ!" আবির বলল, "আমার
সাথে মিশলে নাবিলা যদি তোর সাথে না মেশে?" রাজ আবারো
ইতস্তত করে বলল, "আমি তো নাবিলাকে তেমন ভাবি না,
মানে, বন্ধু......মানে......খুব ভালো বন্ধু......জাস্ট ফ্রেন্ড......"
আবির আবারো বলে উঠলো, "গার্লফ্রেন্ড
কথাটাই মুখে আসছে না, না?" রাজ
এবার আর নিজের ওপর রাগ করলো না । বলল, "না, শি ইজ নট
মাই গার্লফ্রেন্ড ।" "মন থেকে তো ওকে
ভালবাসিস তুই!" বলল আবির । রাজ এবার কিছু বলল না । ইতস্ততও করলো
না । আবির বলল, "তাহলে? ও যদি তোকে ছেড়ে চলে যায়,
তোর কষ্ট হবে না?" "তুই গেলেও কষ্ট
হবে দোস্ত!" আবির হালকা হেসে বলল, "আমার সাথে না মিশলেও চলবে, কিন্তু ও তো তোর
গার্লফ্রেন্ড" আবিরের কথা শেষ হতে না হতেই রাজ বলল,
"আর তুই আমার ভাই, আমার বাডি, আমার ডিউড, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড!" রাজ জিজ্ঞেস করলো, "বা বা! এক দিনের দেখাতেই বেষ্ট ফ্রেন্ড!" রাজ এবার
কেঁদে ফেলল । আবিরের হাতদুটো কপালে ঠেকিয়ে কেঁদে কেঁদে বলল, "প্লিজ
দোস্ত! প্লিজ!" আবির এবার কষ্ট
পেলো । রাজকে বুকে জড়িয়ে বলল, "আচ্ছা! আচ্ছা থাম!
আমি তোর সাথে মিশবো যা! বললাম তো!"
রাজ আবিরকে জড়িয়ে ধরে আবিরের কাঁধে মাথা রেখেই কাঁদতে লাগলো । চারপাশে আর কোন
আওয়াজ নেই । শুধু আওয়াজ আসছে, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ.........।
(৯)
সেদিন স্কুল শেষে আবির
বোর্ডটা মুচ্ছিল । আর সবাই ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেছে । স্কুলের গেইট দিয়ে
কেবলই বেরিয়েছে নাবিলা আর রাজ । দুজনে একসাথে
কথা বলতে বলতে আসছিলো । নাবিলা জিজ্ঞেস করলো, "আজ তো ক্লাসে তুমি ফাটিয়ে দিয়েছো!"
রাজ শুধু হাসল, কিছু বলল না । একটু দূরে রাজের
পিছু নিয়েছে পরশ, জামি আর শিমুল । কিন্তু ওরা যা করতে চাইছে তা নাবিলার জন্য
পারছে না । পরশ শিমুলকে বলল, "দোস্ত! নাবিলা আছে তো! ক্যামনে যামু ওর কাছে!" শিমুল কিছুক্ষণ ভাবল । তারপর জামিকে
বলল,
"মোটু, এক কাজ কর । তুই যা ।" "কই যামু
ক্যান্টিনে?" বলল জামি । জামির কথা শুনেই শিমুল
জামির গালে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিলো । তারপর বলল, "খালি খাই খাই করস
ক্যান?" তুই নাবিলার কাছে যাবি । যাইয়া কইবি
খায়রুল স্যার ডাকছে, ওরে যাইতে কইছে ।" জামি বলল, "আইচ্ছা
।"
জামি
গেলো নাবিলার কাছে । জামিকে দেখে নাবিলা বলল, "কিরে মোটু? কি অবস্থা?" জামি হালকা হাসল । নাবিলা রাজের
সাথে জামির পরিচয় করিয়ে দিলো । এরপর জামি বলল, "নাবিলা, খায়রুল
স্যার তোমারে একটু ডাকতেছিল!" নাবিলা হাঁটতে হাঁটতে
থেমে গেলো, সাথে জামি আর রাজও । নাবিলা জিজ্ঞেস করলো, "আমাকে!
হঠাৎ?" "কি জানি, আমারে কইলে তো কইতামই!" জবাব দিলো জামি । নাবিলা তখন রাজকে বলল, "চলো না, তুমিও আমার সাথে চলো?"
রাজ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময়
জামি তাড়াহুড়া করে বলল, "না না না না না! স্যার কইছে, শুধু তোমারে নিয়া যাইতে, আর কেউ যেন না আসে!" নাবিলা একবার জামির দিকে
তাকাল । তারপর রাজের দিকে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল, "যাই
তাহলে, টাটা!" রাজও "টাটা" বলে বিদায় জানালো । জামি নাবিলাকে
দিয়ে চোখের আড়াল হয়ে যেতেই পরশ আর শিমুল চলে এলো রাজের কাছে । প্রথম প্রথম শিমুল কথা
বলতে ভয় পাচ্ছিলো, শিমুলই ওকে জোড় করে রাজের সাথে ধাক্কা খাওয়াল । রাজ পরশের দিকে
তাকাল । পরশ হাসিমুখে হ্যান্ডশেক করে বলল, "হাই! আমি পরশ!"
রাজ হ্যান্ডশেক করে বলল,
"হাই!" পরশ শিমুলকে দেখিয়ে বলল,
"আর এ শিমুল ।" শিমুলও রাজের সাথে হ্যান্ডশেক করলো । পরশ বলল, "আমরা
নাবিলার খুব ভালো বন্ধু ।" রাজ তখন হালকা হেসে বলল, "ও আচ্ছা, আমি রাজ । নাইস টু মিট ইউ ।" পরশ ইয়ার্কির সাথে বলল, "তা তুমি তো দেখছি
নাবিলাকে একদম ভালোবেসে ফেলেছো! হু!হু!"
রাজ অনুকম্পার হাসি হেসে বলল, "তা
খানিকটা, তবে এখনও ওরকম পর্যায়েও যায় নি ।" শিমুল বলল, "আরে ওরকম পর্যায়ে যায় নি, এখন নিয়ে যাও না, দেরি কিসের?" রাজ বলল, "কিন্তু......" "কোন কিন্তু নয়, আরে ব্যাটা এটাই তো বয়স, এখন না তো কখন?" পরশ আর
শিমুল রাজের চেহারাটা একটু দেখল, কাজ হচ্ছে তাহলে, মনে মনে ছেলের লাড্ডু ফুটছে মনে হচ্ছে! কি যেন ভাবছে
মনে মনে । খুব সম্ভবত
নাবিলার কথা । খানিকক্ষণ পর পরশ বলল, "এইযে বাছা! কি ভাবছ?" রাজ কল্পনা থেকে ফিরে এসে বলল,
"তেমন কিছু না । ওকে প্রপোজ করবো কি?" পরশ
আকস্মিক চেঁচিয়ে বলল, "না না না না না! এখনই না! আরে, প্রথম ধাপ ওকে
ইম্প্রেস করা লাগবে । ওর মন জয় করে নিতে হবে ।" রাজ জিজ্ঞেস
করলো,
"করেছে তো? শুরুতে ওই আমাকে নিজের ক্লোজ
করে নিয়েছে?" শিমুল বলল, "আরে,
এটাই তো যথেষ্ট না, ওকে তোমার প্রতি আরও
আকৃষ্ট করাতে হবে ।" রাজ উপর নিচ মাথা নাড়ল । বলল, "হুম
। বুঝলাম । কিন্তু কীভাবে করবো? ওর ভালো-মন্দ পছন্দ
অপছন্দ কিছুই তো আমি জানি না?" শিমুল বলল,
"আচ্ছা পরশ, নাবিলার পছন্দের খাবারটা যেন
কি রে?" রাজ পরশের দিকে তাকাল । পরশ ভেবে বলল, "উমম...!
হ্যাঁ! নাবিলা টাইগার এনার্জি ড্রিঙ্ক খেতে
পছন্দ করে ।" রাজ বলল, "হেহ! ওগুলোতে
তো কেমন মদ মদ গন্ধ, আমি নিজেই পছন্দ করি আর নাবিলা! ডোন্ট ফরগেট শি ঈজ আ গার্ল!" পরশ হেসে উঠলো । বলল, "আরে
ভাই রে ভাই, কে তুমি, এই যুগে আইসাও
যদি এইসব কথা কস! আরে ভাই, বিদেশে তো
মাইয়ারা মদ গাঞ্জা সব খায়, আর এইডি তো আর সত্যি মদ না,
শুধুই কেমন গন্ধ, এই ।" রাজ কি একটা
ভাবনায় ডুবে গেলো । শিমুল বলল, "আরে কি এতো ভাবছো! এখনই কিনে আনো যাও!" রাজ শিমুলের দিকে তাকাল । বলল, "সত্যি
বলছ? ও পছন্দ করবে?" পরশ বলল,
"আরে হ্যাঁ! দেখো, তোমাকে
জড়িয়েও ধরতে পারে ।" পরশের কথার মাঝে বেশ আত্মবিশ্বাস দেখতে পেলো রাজ । একটু আশ্বস্ত
হল । তারপর রাজ, "আচ্ছা, আমি যাই তাহলে ।" হাসিমুখে এই
কথাটা বলে চলে গেলো দোকানের দিকে । রাজ অনেকটা দূর যাবার পরই পরশ আর শিমুল হেসে উঠলো । শিমুল জিজ্ঞেস
করলো,
"মামা! কাজ হবে তো?" "আরে হবে না মানে! নিশি একদিন কইছিলো, নাবিলার ওই জিনিস দেখলেই বমি আসে ।" "আফসোস হইতাছে! কহন
দিবো নাবিলারে জানতে পারলে সেই হইতো, নাবিলা ওরে কি কয়,
দেখতে মন চাইতাছে খুব!" বলল শিমুল ।
অনেকক্ষণ ধরে নাবিলাকে
নিয়ে টিচার্স রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে জামি । বাহির থেকে ঠিক দেখা
যাচ্ছে না ভেতরে কে কে আছে না আছে । নাবিলা জিজ্ঞেস করলো, "কিরে মোটু? কই
খায়রুল স্যার?" জামি হালকা ভয় মিশ্রিত হাসি হেসে বলল,
"আরেকটু! আসছে স্যার ।" "আরে
ভেতরে যাইতে কি হইতাছে তোর?" জামি বলল, "আরে না, স্যার ভেতরে যাইতে মানা করছে।" এমন সময় ভেতর
থেকে বেড়িয়ে এলো বকর স্যার । স্যার ওদের দেখে জিজ্ঞেস করলো, "কি
স্যাররা, কেমন আছেন?" জামি কিছু
বলার আগেই নাবিলা বলল, "জি স্যার, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি । আপনি কেমন আছেন?" বকর
স্যার টিচার্স রুমের দরজাটা লাগিয়ে দিতে দিতে বলল, "এইতো,
আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি । স্যারকে দরজা
আটকাতে দেখে জামি ভয়ে দাঁত দিয়ে জিভ চেপে ধরল । নাবিলা স্যারকে বলল, "স্যার,
দরজা লাগাচ্ছেন যে? ভেতরে খায়রুল স্যার নেই?"
বকর স্যার তালা লাগাতে লাগাতে বলল, "না
তো, খায়রুল স্যার তো আজকে পঞ্চম পিরিয়ডেই কি একটা কাজের জন্য
চলে গেছেন!" নাবিলা এবার রেগে গেলো । "মোটু!"
বলে ডেকে উঠে পাশে তাকিয়ে দেখল, জামি নেই ।
ক্লাসরুমে ঢুকে আজ যে
বেঞ্চে বসেছিল, সেই বেঞ্চের কাছে এলো আবির । হ্যাঁ, ঠিকই
ধরেছে, এখানেই ওর কেমিস্ট্রি প্র্যাক্টিকাল খাতাটা । ভুলে রেখে গেছে
। আরেকটা বন্ধু
চেয়েছিলো খাতাটা ওকে দিতে যেয়ে দেখে, খাতাটা নেই । তখনই বুঝল, বেঞ্চে
হয়তো রেখে গেছে । এখানে এসে দেখলোও তাই । খাতাটা নিয়ে আবির
বেরোতে লাগলো । দরজার কাছে এসে ব্যাগটা হাঁটুর সাথে ঠেকিয়ে চেইনটা খুলে খাতাটা ঢোকাতে লাগলো । কয়েক হাত দুরেই
সে সময় অ্যাপ্রোন গায়ে হাতে ব্যাগ নিয়ে এদিকেই আসছিলো সুমন স্যার । স্যার এর মনটা
তেমন ভালো নেই । বার বার উনার
রাশেদ স্যার এর বলা কথাটা মনে পড়ছে । ঠিক হচ্ছে কি? কোন
বড়সড় ঝামেলা বাধবে না তো?" এমনিতেও এলাকায় বেশিরভাগ
ছেলেমেয়ে অশিক্ষিত । এই এলাকার বেশিরভাগ লোকজন বাপের সম্পত্তিতে বাড়ি বানিয়ে
সেখানে থাকে । নিজে অশিক্ষিত ছেলে মেয়েদেরও পড়ালেখার ব্যাপারে তেমন চিন্তা করে না । কাছেপিঠেও তেমন কোন
ভালো স্কুল নেই যেখানে সবাই পড়ালেখা করাতে
পারবে । তাই এই স্কুলের যদি তাদেরও সুযোগ দেয়া হয়, তবে লোকের অভাব হবে না । কিন্তু সেটা কি
এই মা বাবাহীন এতিম ছেলেমেয়ে গুলোর জন্য ভালো হবে? না, না-ও হতে পারে । কিন্তু যদি হয়? সুমন স্যার নিজেও বুঝতে পারছে না উনি কি ভাবছে । অন্যমনস্ক হয়ে
এসব কথাই ভাবছিলো এক দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে । আশেপাশে কি হচ্ছে সে
বিষয়ে স্যার অবহিত নয় । ক্লাস টেনের ক্লাসরুমের কাছে যখনি এলো, ঠিক সেই
সময় আবিরও ব্যাগটা কাঁধে নিতে নিতে সামনের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে ধাক্কা খেল সুমন
স্যার এর সাথে । স্যার কল্পনা থেকে ফিরে এলো স্যার এর হাত থেকে ব্যাগটা পড়ে
গেলো । আবির শুধু ধাক্কা খেয়ে একটু দূরে সরে গেলো । আবির তাড়াতাড়ি করে এসে
স্যার এর ব্যাগটা স্যার এর হাতে তুলে দিয়ে বলল, "এক্সট্রিমলি সরি
স্যার! আমি খেয়াল করিনি!" স্যার
হালকা হেসে বলল, "ইট'স ওকে ।" স্যার এর চোখ
গেলো আবিরের নেমপ্লেটের দিকে । নাম লেখা, আবির । তারপর স্যার পাশের
ক্লাসরুমটার দরজার দিক তাকালো । ক্লাস টেন । আবির চলে যাচ্ছিলো, এমন সময় স্যার আবিরকে ডাকল, "এইযে শুনছো?" আবির দাড়িয়ে গেলো । স্যার এর দিকে
ঘুরে তাকিয়ে বলল, "জি স্যার বলুন ।" সুমন স্যার বলল, "তুমি
কি এই ক্লাস টেনের আবির?" আবির খানিকক্ষণ স্যারকে ভালো করে দেখে বলল, "জি
স্যার!" সুমন স্যার হেসে বলল, "ও, হাই, আমি এই স্কুলের সুমন
স্যার । ক্লাস এইটের ক্লাস নেই । তুমি যখন ছিলে এইটে তখন ছিলাম না ।" আবির সম্মান
দেখাতে হাসি মুখে উপর নিচ মাথা নাড়ল । সুমন স্যার বলতে লাগলেন, "আসলে
তোমাদের খায়রুল স্যার প্রায়-ই তোমার কথা বলেন । আর এই ২-৩দিন আগে
ওই যে অনামিকা মেয়েটার হত্যার ঘটনা, ওটার যে সমাধান করলে,
তারপর থেকেই আরও ভালো করে চিনেছি । তোমার নাম ওই ক্লাসের
বেশীরভাগ ছেলেমেয়েরা প্রায়-ই করে । আর সায়রা নামের মেয়েটা
তো বলে আমার ভাই ।" আবির হেসে বলল, "জি স্যার, ও
আসলেই আমার ছোট বোন ।" সুমন স্যার বলল, "ভালো কথা, তুমি
যে এতো সুন্দর গোয়েন্দার মতো করে সবটা বের করলে, এই দক্ষতার
জন্য তোমাকে অভিনন্দন জানাই । দোয়া করি তুমি একদিন যেন অনেক বড় আর ভালো পর্যায়ে যেতে
পারো ।"
বলেই
স্যার চলে গেলো । আবির "থ্যাঙ্ক ইউ স্যার" ছাড়া আর কিছু বলল না । তবে গোয়েন্দার কথাটা বলল কেন?
বিকেলে আবির ছাদে উঠবার
জন্য উঠেছিলো, কিন্তু দরজার সামনে দাড়িয়ে নাবিলার আর রাজকে একসাথে দেখে আর
গেলো না । নিচে এসে আবির নিজের রুমে চলে গেলো । ছাদে তখন সেই খাটের ওপর
রাজের কাঁধে মাথা রেখে বসে ছিল নাবিলা । কথার বলছিলো অনেক কথার মাঝে হঠাৎ রাজ বলল, "নাবিলা,
তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি ।" "ও ওয়াও! আমার
জন্য! দেখি কি এনেছ?" রাজ খাটের
নিচ থেকে দুটো ব্ল্যাক হর্স কোল্ড ড্রিংক্সের ক্যান বের করলো একটা নিজের বা হাতে
রেখে ডান হাতেরটা নাবিলার দিকে এগিয়ে ধরল । নাবিলা সেটার দিকে
তাকিয়ে রইল । কিছুক্ষণ ধরে থাকার পরও যখন নাবিলা সেটা নিলো না, রাজ
জিজ্ঞেস করলো, "কি হল? পছন্দ হয় নি?"
নাবিলা কোনোরকমে হাসবার চেষ্টা করে বলল, "হ্যাঁ......হয়ে...ছে তো......"
রাজ বুঝল নাবিলার অভিনয় । গোমড়া মুখ করে বলল, "তুমি
পছন্দ করো নি । অথচ এটা তুমি কতো পছন্দ করো ।" নাবিলার অবাক
হয়ে রাজের দিকে তাকাল । জিজ্ঞেস করলো, "এটা আমার পছন্দ? কে বলেছে তোমাকে?" রাজ একটা শ্বাস ফেলে বলল,
"তোমার বন্ধু । পরশ আর শিমুল ।" নাবিলার মনে
পড়লো সকালে জামি ওকে ছেড়ে চলে এসেছিলো তখন । তার মানে এটা ওদের প্ল্যান! নাবিলার
মনের ভেতর একটা প্ল্যান তখন উঁকি মেরে উঠলো না । এদের শায়েস্তা করার
ব্যাবস্থা এদের প্ল্যানের মাধ্যমেই করা যাবে । নাবিলা হঠাৎ হাসি মুখে
রাজের হাত থেকে কোল্ড ড্রিঙ্কসের ক্যানটা কেড়ে নিলো। তারপর সেটা খুলে খাওয়া শুরু করলো । রাজও খুশিমনে
জিজ্ঞেস করলো, "তোমার এটা পছন্দ হয়েছে?" নাবিলা
মুখটা মুছে মিষ্টি হেসে বলল, "খুব! এটা তো আমার পছন্দই, তার ওপর তুমি এনেছ, ভেবে দ্যাখো, কতোটা পছন্দ হয়েছে আমার!" রাজও খুব খুশি হয়ে উঠলো তা ওর চেহারা দেখেই বোঝা গেলো । নিজেও হাতের
ক্যানটা নিয়ে খাওয়া শুরু করলো ।
টয়লেট থেকে বেড়িয়ে
লাইটটা অফ করলো আবির । অনেকক্ষণ ধরে ফোনটা বাজছে ভেতর থেকেই শুনতে পেয়েছিলো । খাটের পাশে টি-টেবিলে
ফোনটা । আবির তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে যেয়ে ফোনটা হাতে নিলো । নিশি ফোন করেছে । ফোনটা ধরে কানে
নিলো আবির । "হ্যালো!" বলল আবির । ফোনের অপাশ
থেকে অভিমানী স্বরে নিশি বলল, "এই আবির, কই রে
তুই?" "রুমে আছি, কেন?"
"একবার গাইন পার্কে আসতে পারবি?" আবির
হাতে দেখল, পাঁচটা দশ বাজে । জিজ্ঞেস করলো, "কেন?"
নিশি একটু বিরক্তির স্বরে বলল, "আরে বাবা
আয় না! এমনেই ডাকতেছি নাকি?" আবির
বলল, "আচ্ছা আমি আসতেছি ।" আবির ফোনটা রেখে
রেডি হতে লাগলো ।
"নাহ, কাজটা তোরা ঠিক করলি না । তোরা ছেলেটাকে এভাবে কেন কষ্ট দিবি! দোষ তো
আমি সব নাবিলারই দেখছি!" রাজকে মিথ্যে বলে নাবিলা আর
রাজের সম্পর্কের ভাঙন ঘটানোর প্রথম প্ল্যান শেয়ার করতেই কথাটা বলল পাপলু আঙ্কেল । রুমে বসে জামি, শিমুল,
পরশ । পরশ বলল, "আহ, পাপলু
আঙ্কেল, তোমার এতো প্যারা নেয়া লাগবো না । আমরা বুইঝা
লমুনে । তুমি খালি কাউরে কইও না ।" পাপলু আঙ্কেল বলল, "তোরা যে কি করিস না, অবশ্য বয়সটাও এমন ঠিক বেঠিক কিছুই বোঝে না ।" শিমুল তখন পাপলু
আঙ্কেলের দিকে চোখ দুটো সঙ্কুচিত করে
দুষ্টুমির হাসি মুখে নিয়ে ইয়ার্কি করে পাপলু আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে বলল, "কেন
কেন? তোমার এই বয়স আসে নি? তুমি প্রেম-ট্রেম করো নি? ভুল করো নি? হুম?
হুম?" পাপলু আঙ্কের রাগ আর হাসি দুটো
মিশিয়েই বলল, "ধুর! কি সব যে বলিস
না তোরা, মানুষ হবি না তোরা ।" জামিও ইয়ার্কি
করে পরশকে বলল, "আর ক্ষ্যাপাস না পরশ, কোনদিন
দেখবি পাপলু আঙ্কেলের পুরনো স্বভাব ফিরে এসেছে ।" পাপলু আঙ্কেল
জামির কথা কোন জবাব দিলো না । জানালা দিয়ে আবিরকে বাইরে যেতে দেখে ডেকে বলল, "আবির!
যাচ্ছ কোথায়?" আবির দূর থেকেই,
"গাইন পার্কে যাচ্ছি আঙ্কেল, পড়ে দেখা
করছি ।"
পাপলু
আঙ্কেল আর কিছু বলল না । মুখটা কেমন গোমড়া হয়ে গেলো । আবিরকে যেতে দেখে জামি
শিমুল আর পরশও জানালা দিয়ে আবিরকে দেখবার চেষ্টা করলো । পাপলু আঙ্কেল হতাশার
নিশ্বাস ফেলে বলল, "আহারে, ছেলেটা আর আগের মতো তেমন
হাসি-খুশি নেই ।"
(১০)
গাইন পার্কে এসময় ছোট
ছোট ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে । সাথে অনেক মহিলারাও হাঁটাহাঁটি করেন । অনেক বাবারাও মাঝে মাঝে
আসে, তবে তেমন একটা চোখে পড়ে না ।
টিনেজ ছেলেমেয়েও কম পাওয়া যায় না । কেউ কেউ বন্ধুদের সাথে একসাথে ৩-৪ জন, কেউ কেউ
গার্লফ্রেন্ড কিংবা বয়ফ্রেন্ডের সাথে দুজন । এদের মাঝে আবিরের
পক্ষে নিশিকে খোঁজা আসলেই কষ্টকর, কিন্তু
নিশিকে খুঁজতে তেমন দেরি হল না আবিরের । কারণ নিশিই
আবিরকে দেখে একটা বসার সিটের ওপর থেকে
ডাকল । আবিরও সেখানে যেয়ে নিশির পাশে বসলো । নিশির চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ও
আবিরের ওপর রাগ করেছে । আবির বসতেই নিশি জিজ্ঞেস করলো, "তুই
সায়রাকে কি কইছোস? আবির এমন একটা ভাব নিলো, যেন কিছুই জানে না । একটু হেসে বলল, "কই, আমি আবার
ওরে কি কইতে যামু ।" নিশি হঠাৎ চোখ গরম করে আবিরের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে
চেঁচিয়ে বলল, "ভাব নিস না আবির! তুই সায়রাকে কস
নাই নাবিলার মতো মাইয়া তোর পাশে মানায় না! তুই সায়রারে কস
নাই তোর লগে নাবিলার মতো ফালতু মাইয়া
মানায় না! তুই কস নাই তুই দাঁড়াইলে মাইয়ারা তোর লাইগা লাইন
লাগাইবো!" আবির একটু মুখ তুলে চারপাশে তাকাল । নিশির রাগ দেখে
আশপাশ দিয়ে যারা হাঁটছিল, তারা হাঁটার গতি মন্থর করে নিশি আর আবিরের
দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । নিশিও এক নজর তাকাল চারপাশে । আবির মাথায় হাত
দিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল । নিশি এবার বিনয়ের সাথে বলল, "ক্যান আবির! তুই এমন করছ ক্যান! আবির কিছু বলল না । নিশি খানিক
থেমে বলল,
"তুই কি বুঝস না? তুই নাবিলারে ভালবাসোস?"
রাজ তখন প্রায় কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, "না
আমি বাসি না!" আবিরের মুখ কাঁপছে! চোখ ছল ছল করছে । জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে সে । নিশিও আর কিছু বলতে
পারলো না আবিরকে এভাবে দেখে । আবির তখন বিরক্ত আর কষ্ট দুটো মিশিয়েই বলল, "আমি
তো অনেকবার বলেছি আমি নাবিলাকে ওরকম
ভালোবাসি না, যেটুকু বাসতাম, সেটুকুও
আর না । তোরা কেনো বুঝিস না! বারবার কেন আমাকে মনে করিয়ে দিস! এতো ভালো লাগে তোদের! আমার যেতা ভালো লাগে না সেটা
কেন আমাকে জোর করে করাচ্ছিস তোরা!" আবির একটু চুপ হয়ে
গেলো । নিশি কিছু বলতে পারছিল না । আবির মাথা নিচু করে কান্না থামানোর প্রচেষ্টা করছে । নিশি সেই ফাঁকে
জিজ্ঞেস করলো, "তাই বলে তুই সায়রাকে......।" নিশির কথা শেষ
করতে না দিয়েই আবির আবার সেই আগের ভঙ্গিতে বলল, "ওকে আমি এমনি এমনি
ওসব বলিনি! তুই জানিস মেয়েটা কতোটা কষ্টে আছে অনামিকার জন্য,
তার ওপর ও যদি আমার আর নাবিলার এই ভাঙনের কথা শোনে তাহলে আরও কষ্ট
পাবে, তাই আমি ওর সামনে এমন একটা ভাব নিয়েছি, যেন ও বুঝতে পারে আমি নাবিলাকে ভালোবাসি না!" "তার মানে তুই নাবিলাকে ভালোবাসতি!" নাবিলার কথা
শেষ হতে না হতেই আবির বলল, "এক প্রশ্নের জবাব কয়বার
দেবো তোকে?" নিশি মাথা নিচু করলো । আবির কাঁদতে
লাগলো । সামনাসামনি আবিরকে এই প্রথম নিশি কাঁদতে দেখল । অবশ্য ছেলেরা স্বভাবতই
সবার আড়ালে কাঁদে, তবে আজ আবির আর কান্না আটকাতে পারলো না । নিশি কিছু বলল
না । শুধু নিচু গলায় বলল, "সরি ।" দুজনেই কিছুক্ষণ
নীরবে চুপচাপ বসে রইল । কান্না শেষ হলে চোখ মুছে আবির বলল, "রাজ
ছেলেটা কেন যেন আমার নিজের ভাই মনে করে । ওর সাথে মিশতে মিশতে
আমারও এখন ওকে ভালোই লাগে । বেশ চঞ্চল, হাসিখুশি ছেলেটা । তবে বেশ ভালো । ওই ছেলেটা
পছন্দ করেছে নাবিলাকে । কিন্তু আমি জানি, আজ যদি ও জানতে পারে আমি এক সময় নাবিলাকে ভালবাসতাম, তাহলে ও নিজে যতো কষ্টই পাক, নাবিলাকে ছেড়ে দিত । কিন্তু এটা তো
ঠিক না! ও কেন কষ্ট পাবে এভাবে! ও তো কোন দোষ করে নি!
ও তো নাবিলার কাছে যেয়ে নাবিলাকে ভালোবাসার কথা বলে নি! নাবিলা নিজেই তো আসল দোষটা করেছে । আমি জানি না ও কেন এমন
করেছে, কিন্তু আমি ঢের বুঝতে পারছি ও আমার ওপর রাগ করে এসব করছে, আমাকে দেখিয়ে এসব করছে ।" আবির আবার একটু থামল । তারপর নিশির দিকে
তাকিয়ে বলল, "জানিস, আমি যখন সায়রার সাথে কথা
বলেছিলাম, নাবিলা তখন আমার সব কথা শুনেছে ।" নিশি ভয় মিশ্রিত
চেহারায় আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, "কি!" "হুম । কিন্তু ভালোই হয়েছে, এতে ও নিজেও হয়তো বুঝে গেছে আমি ওকে আসলেই
ভালোবাসি না । এতে ওর মনে আমার জন্য যতোটুকু ভালোবাসা ছিল, সেটাও
চলে যাবে । ভালোই তো হল, তাই না?" নিশি
বলল, "কিন্তু আবির! তুই এভাবে
ওদের সামনে খারাপ সাজবি?" আবির হালকা কষ্ট মেশান হাসি
হেসে বলল, "হই না, সমস্যা কি?
এতে যদি অন্যেরা ভালো থাকে, তাহলে তো ভালোই । তুই একটা কথা
দিবি?"
নিশি বুঝতে পেরেছে আবির ওকে কি বলবে । তবুও বলল, "কি
বল?" "তুই এসব কথা কাউকে বলবি না?" নিশি কিছু বলল না । চেহারা দেখে মনে হল ঠিক ডিসিশন নিতে পারছে না কি করবে । আবির আবারো বলল, "অন্তত
আমি যতদিন সবার সাথে আছি ততদিন! প্লিজ তুই এসব কথা কাউকে
বলিস না! দ্যাখ আমি খারাপ থাকি তো থাকি, কিন্তু তুই ভেবে দ্যাখ, সবটা সবাইকে জানালে কিন্তু
আমি নাবিলা রাজ কেউই আর সুখি থাকবে না । প্লিজ!" নিশি
খানিকক্ষণ আবিরের চোখেমুখে তাকাল । ও জানে, আবির এতক্ষণ যা বলেছে,
সিরিয়াসলি বলেছে । মিথ্যে বলেনি, কিংবা
ইয়ার্কিও করে নি । কারণ যদি তাই করতো, তাহলে ওর মুখে শুদ্ধ আর আঞ্চলিক ভাষার
মিশ্রণ দেখা যেতো । নিশি উপর নিচে মাথা নেড়ে বলল, "হুম
।"
রাতে টেবিলে বসে পড়ছিল
আবির । মন ওর পড়ায় নেই । বইয়ের পাতার ওপরের কোণাটা ডান হাতের আঙুল দিয়ে ভাজ করতে
করতে সামনের দিকে তাকিয়ে কিসব যেন ভাবছে । প্রথমত নাবিলার কথা । না, ঠিক
নাবিলার না, নাবিলার নিষ্ঠুর অতীতের কথা ওর বাবা মানুষ মেরে
লাশ কাটে । এও কি সম্ভব? একটা একজনকে খুন করতে গেলে একজন সিরিয়াল
কিলারও তো বোধ শ-খানেকবার ভেবে নেয় আর এতো পুরো লাশ কেটে......। এতো নোংরা হতে
পারে মানুষ! আবিরের মনের মাঝে হঠাৎ করে এরকম একটা দৃশ্যের কল্পনা ভেসে
উঠলো । চারপাশে অনেক লাশ, সব কেটে-কুটে একাকার করেছে কেউ । কোন লাশের মাথা
ছিন্ন বিচ্ছিন্ন, কোন লাশের পেটের মাঝখান দিয়ে ফেরে ভেতরের নাড়িভুঁড়ি বের করে
দেয়া, কোন লাশের মুখের চামড়া ছিঁড়ে আছে, চোখের কোটর থেকে চোখ বেড়িয়ে আছে, একটা নালির সাথে
ঝুলছে । "হেয় ব্রো!" হঠাৎ ডাকটা শুনে চমকে পেছন ফিরে
তাকাল আবির । দরজায় দাড়িয়ে রাজ । একটা ব্ল্যাক হাফ প্যান্ট আর একই রঙের
গেঞ্জি গায়ে দিয়ে । আবিরকে চমকে উঠতে দেখে নিজেও খানিকটা চমকে উঠলো । আবির নিজের বুকে
ফু দিয়ে উঠে দাড়িয়ে রাজকে বলল, "ও তুই, ভেতরে
আয় । রাজ ভেতরে এলো । ইয়ার্কি করে বলল, "কি চলছিলো ব্রো! এভাবে চমকে উঠলে কেন! আমি কিন্তু সব বুঝি!"
এতক্ষণে আবিরের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো । রাজের পেটে
হালকা করে একটা ঘুষি দিয়ে শুধু বলল, "ধুর শালা ।" রাজ আবিরের
বিছানায় বসলো । হাতে মোবাইল ছিল, কি যেন দেখল খানিকক্ষণ । আবির ততোক্ষণে ফ্রিজ
থেকে বিস্কিট চানাচুর নিয়ে এলো । রাজ বলল, "ডিউড! থাকি একই
হোস্টেলে আর তুই এমন করিস যেন আমি ঘুরতে আসি ।" আবির পাশে বসে
বলল,
"হইছে! তোর আদর্শ বাণী থামাইয়া কি কবি ক ।" "আরে তেমন কিছু
না, জাস্ট সকাল বাদে আজ তোর সাথে আর দেখা হল, সো,
আসলাম আরকি, দ্যাট'স দা
রিজন ।"
আবির
বলল,
"তারপর বল, কি খবর?" আবির আর রাজ নিজেদের মতো কথা বার্তা বলতে লাগলো । পাশের রুম থেকে
রাজের গলা শুনে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো জামি । নিজের রুমের দরজায় দাড়িয়ে খানিকক্ষণ আবিরের
দরজার দিকে তাকাল । দরজা বন্ধ । জামি শিমুলের দরজায় যেয়ে নক করলো । শিমুল দরজা খুলে কিছু
একটা বলতে যাচ্ছিলো, জামি নিজের ঠোঁটে তর্জনী আঙুল ঠেকিয়ে ইশারায় থামিয়ে দিলো
শিমুলকে । তারপর আরও একবার আবিরের দরজার দিকে তাকিয়ে শিমুলের কানের
কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, "রাজ ওই রুমের ভেতর । আবিরের লগে কথা কয় ।" শিমুল খানিকটা
আশ্চর্য হয়ে বলল, "বলিস কি! অয় না আবিরের ওপর রাগ
করছিলো! কইছিল আর কথা কইবো না!" জামিও
অবাক ভঙ্গিতে বলল, "আমিও তো বুঝতেছি না, আইছে ক্যান আবার? শিমুলের ঠোঁটের কোণে হঠাৎ-ই একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো । তারপর বলল, দোস্ত, মনে হয় কাজে দিয়েছে!
নাবিলার লগে মনে হয় ব্রেক আপ হইছে! তাই আইসা
মনে হয় আবিরের লগে আবার বন্ধুত্ব দেখাইতাছে ।" জামির মুখেও একই
ভাব ফুটে উঠলো । খুশির সাথে বলে উঠলো, "আরে! এইডা তো
ভাবি নাই? তুই খাড়া, আমি পরশরে লইয়া
আসি ।"
জামি
নিচে নেমে এলো । শিমুল সেই সময় দরজায় আড়ি পাতলো । ভেতরে রাজ আবিরকে বলছে, "আই
ডোন্ট নো, তবে সত্যি কথা বলতে আমি আর এসব রিলেশনে জড়াতে
চাইনি । কিন্তু নাবিলা আমাকে এমনভাবে আকৃষ্ট করেছে, যে আমিও দুর্বল হয়ে
গিয়েছিলাম ।" কথা শুনে মুচকি হাসল শিমুল । ভাবল, আহারে,
ছেলেটা ব্রেকআপ করে এসে এখন পুরনো কথা আবিরকে বলে নিজের মনকে
শান্তনা দিচ্ছে ।" ভেতর থেকে আবির আবারো বলল, "ব্যাপার মা, এটা ন্যাচারাল । সবারই হতে পারে । কিন্তু তুই এতো কষ্ট পাচ্ছিস কেন?" বাইরে
দাড়িয়ে শিমুল নিজেই নিজেই প্রশংসা করছে,
"উফ! যা চাল ছিল না! অবশ্য আসল প্ল্যান পরশেরই, ওরে ট্রিট দিমু কাল ।" ভেতরে রাজ তখন আবিরের কথার জবাব দিতে গিয়ে বলল, "জানিস,
আগে আমিও শৈলী নামে একটা মেয়ের সাথে রিলেশন করেছিলাম । মেয়েটা অনেক
ভালো ছিল । কিন্তু আনফরচুনেটলি অন্য একটা ছেলে জাস্ট আমার চাইতেও হ্যান্ডসাম বলে আমাকে
ছেড়ে চলে গিয়েছিল ।" বাহিরে শিমুল আবারো মুচকি হেসে উঠলো । রাজ বলতে লাগলো, "তাই
ভয় হয়, যদি নাবিলাও আমাকে ছেড়ে কোনোদিন চলে যায়?"
শিমুল আবারও মুচকি হাসি দিতে যাচ্ছিলো, কিন্তু
তার বদলে ভ্রু-টা কুঁচকে গেলো । যদি ছেড়ে যায় মানে? ছাড়ে নি?"
শিমুল ভালো করে কান পেতে শুনতে লাগলো । আবির বলল, "আচ্ছা,
তুই ওকে প্রোপোজ করছিস না কেন?" কথা শুনে
বোঝাই যাচ্ছে আবির নিজের কষ্ট লুকিয়ে কথাগুলো বলছে । কারণ ওর কথায় সেই
মিশ্রিত আঞ্চলিকতা নেই । রাজ আবিরের প্রশ্নের জবাবে বলল, "সেটাই
করবো । তবে আগে ইমপ্রেস করতে হবে না ওকে? আজ ওকে টাইগার কোল্ড ড্রিঙ্কস খাইয়েছি । বেশ খুশি হয়েছে
।" পরশ অবাক হয়ে
গেলো । “খুশি হয়েছে?” আবিরও চমকে উঠলো, আবির জানতো নাবিলা এই
ড্রিঙ্কস পছন্দ করে না, কোন একদিন বলেছিল নাবিলা । জিজ্ঞেস করলো, "সত্যি
পছন্দ করেছে?" রাজ আশ্চর্য প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করলো,
"কেন? খুশি হবার কথা ছিল না নাকি?
ওটা তো ওর ফেভারিট ।"ততোক্ষণে পরশকে নিয়ে হাজির জামি । পরশের মুখেও জামির মতোই
খুশির ছাপ । ভেতরে এসেই বলল, "কই রে? চামচিকাডা কই?"
সাথে সাথে শিমুল পরশের গালে চড় লাগিয়ে বলল, "একটা কামও ঠিক মতো করতে পারোস না? ওইডা নাবিলার
পছন্দ হইছে ।" কথাটা বলার পর দরজা খুলল আবির । জামি আর পরশ দরজার দিকে
মুখ করেই দাড়িয়ে ছিল কিন্তু শিনুল উল্টো দিকে ঘুরে ছিল । আবিরকে বেরোতে দেখেই
জামি শিমুলকে ঘুরিয়ে দিলো । শিমুল ভয় পেয়ে গেলো । শুনে ফেলল না তো আবার? কিন্তু
আবিরের কথা শুনে স্বস্তি ফিরে পেলো । "কিরে? কি হয়েছে?"
হাসিমুখেই কথাটা বলল আবির । সবার ঠোঁটের কোণে তখন
কাষ্ঠ হাসি । আবির বলল, "কিরে? কিছু বলবি? অনেক ভাবনা চিন্তার পর শিমুল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, ঠিক তখন আবির দরজাটা পুরোপুরি খুলে দিয়ে বলল, "আয়,
ভেতরে আয়, তোদের সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দেই ।" রাজ এতক্ষণ
বিছানা থেকেই বাইরে কে দেখবার চেষ্টা করছিলো, এখন দরজাটা পুরোপুরি খুলে দেয়ায় দেখতে পেলো
। বাইরে দাড়িয়ে থাকা পরশকে চিনতে একটুও দেরি হল না । রাজ পরশকে চিনতে পেরে
উঠে যেয়ে আবিরকে পাশ কাটিয়ে পরশকে জড়িয়ে ধরে বলল, "ইয়ো ব্রো, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ! তোমার জন্য আজকে নাবিলা আমার
প্রতি ইম্প্রেসড হয়েছে । আর বেশিদিন না, আমি খুব শীঘ্রই নাবিলাকে প্রোপোজ করবো । পরশ আবিরের
দিকে তাকিয়ে আবিরের অনুভূতিটা বোঝার চেষ্টা করলো । আবির একই সাথে অবাক আর
খুশি দুটো ভাব নিয়েই আছে । খুশি কারণ রাজ ওদের চেনে এটা দেখে আর অবাক কারণ পরশের জন্য
ইম্প্রেসড হয়েছে কথাটা ঠিক বুঝতে না পেরে । আবির অবাক হয়ে রাজকে জিজ্ঞেস করলো, "তুই
এদের চিনিস?" রাজ হাসিমুখে জবাব দিলো, "হ্যাঁ! এরাই তো সকালে আমাকে বলেছিলো, ওই ড্রিঙ্কসটা নাবিলার পছন্দের । আবির এবার সবটা বুঝল, কিন্তু
রাজের সামনে কিছু বলল না ।
রাত ১০টার দিকের কথা । জামি, শিমুল
আর পরশ ছাদের দিকে যাচ্ছে । আবির ডেকেছে । উঠতে উঠতে তিনজনে বেশ বুঝতে পারছে আজ আবির
বেশ রাগ করবে । একে অপরের দিকে তাকানো ছাড়া আর কোন কথা বলল না ওরা । ছাদে এসে দেখল, আবির
ছাদের রেলিং প্রায় ঘেঁষে হাত বুকে জড়ো করে দাড়িয়ে আছে । ভীতি মিশ্রিত
কণ্ঠে পরশ ডাকল, "আবির!" বলতে না বলতে দ্রুত
বেগে পিছু ফিরে উচু গলায় চোখ গরম করে তাকিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে আবির বলল,
"এতো বার মানা করার সত্ত্বেও তোরা কেন এরকম করছিস! তোদেরকে আমি বলেছিনা আবির নাবিলাকে ভালোবাসি না, ভালোবাসি
না, ভালোবাসি না! তোদের কি কানে কথা
যায় না? ভালো লাগে না? নাকি সারাদিন
চুলকায় তোদের?" আবির একটু থামল । জামি, শিমুল
আর পরষ মাথা নিচু করলো । আবির আবারো শুরু করলো, "তোরা আমার বন্ধু,
আর যদি রাজের জায়গায় তোরা কেউ থাকতি তাহলেও আমি তাই করতাম । কিন্তু তোরা কি
নিজেদের রাজের জায়গায় বিবেচনা করে দেখেছিস! ছেলেটার কি আদৌ কোন দোষ আছে?" পরশ ভীতি মিশ্রিত কণ্ঠেই বলল, "না!"
"তাহলে কেন এমন করলি তোরা এতবার বারণ করা সত্ত্বেও! তোরা কি চাস ওরা কষ্টে থাকুক? তোরা কি চাস একটা
মিষ্টি সম্পর্ককে ভেঙ্গে দিতে?" জিজ্ঞেস করলো আবির । খানিকটা সাহস
সঞ্চার করে জামি বলল, "কিন্তু ওরা যে তোরে কষ্ট দিছে, তোর
সম্পর্ক ভাঙছে! সে বেলায়?" আবির
চুপ হয়ে গেলো । শুধু জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে । রাগ আর কষ্ট একসাথে
মিশে আছে ওর ভেতর । কিছু বলতে যেয়েও পারছে না । আবিরকে দেখে খারাপ
লাগলো ওদের তিনজনেরই । পরশ এমন সময় বলে উঠলো, "কিন্তু আমি এটা বুঝতে
পারছি না, নাবিলা ড্রিঙ্কসটা পছন্দ করলো কেন?" আবির কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় মেয়েলি কণ্ঠে
কেউ বলে উঠলো, "রাজকে ভালোবেসে ।" সবাই ছাদের
সিঁড়িঘরের দিকে তাকাল । দাড়িয়ে আছে নিশি । কাছে এসে বলল, "আমাকে
আবির অনেকক্ষণ আগে ফোন করে তোদের ফাইজলামির কাহিনী কইছে । তার একটু আগেই
নাবিলা ডাইরি লিখতেছিল । আমি জানি উচিৎ না, ক্কিন্তু সত্য জানার জন্য আমারে নাবিলার
ডাইরি খুইলা দেখতে হইতে । নাবিলাকে রাজ
বলছিল তোরা নাবিলাকে বলছিস ওই ড্রিঙ্কস নাবিলার পছন্দের তাই নাবিলা খাইছে । এরপর নাবিলা
আরও লিখছে রাজকে ও এতো পছন্দ করে যে বিষ আনলেও নাবিলা খাইতে রাজি ।" আবির আর দাড়িয়ে
থাকতে পারলো না । ওর পুরো শরীর কাঁপছে । ওখানেই বসে পড়লো । ওর মনের ভেতর
কি চলছে কেউই বুঝতে পারছে না । হঠাৎ আবির উঠে দাঁড়ালো । তারপর নিজের ওপর জোর
করেই হাসতে লাগলো, "শোন! তোরা আর কোন কিচ্ছু করবি না,
নাবিলা ওর সাথেই ভালো আছে । আমি নাবিলাকে ভালোবাসি
না! আর তোরা বলিস আমি কষ্টে আছি না!" তারপর আবারো
নিজের ওপর জোর করে অট্টহাসি হেসে উঠলো আবির । আবির বলল, "দ্যাখ,
আমি ভালোই আছি, বুঝলি! প্লিজ!
তোদের কাছে আমার রিকুয়েস্ট,
আর প্লিজ ওদের সম্পর্কে বাধা দিস না! প্লিজ!
প্লিজ! প্লিজ!" বেশ
অনুনয়ের সাথে রিকুয়েস্ট করে চলে গেলো আবির পরশ যেতে চাইলো সাথে, কিন্তু নিশি বলল, "ওকে একা থাকতে......।" কথাটা শেষ হতে
না হতেই একটা শব্দ এলো সিড়িঘর থেকে । কিছু একটা পড়ে যাবার শব্দ । ওরা চারজন দৌড়ে সিঁড়ির
কাছে গেলো । তাকিয়ে দেখল, সিঁড়ি থেকে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে আবির । কপালে কেটে
খানিকটা রক্তও পড়েছে ।
রাত প্রায় ৩টা । আবহাওয়াটা তেমন
ভালো না । বোধ হয় ঝড় আসবে । দূর কোথাও থেকে মেঘের গর্জনের আওয়াজ আসছে । জানালা দিয়ে শির
শির করে ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরে প্রবেশ করছে । আবির চোখ খুলেই দেখল, ঘরের
লাইটটা জলছে । ডান পায়ে খুব ব্যাথা । আর মাথাটাও কেমন ঝিম
ঝিম করছে । খানিকটা নড়ে তাকিয়ে দেখল, আবিরের পড়ার টেবিলের পাশে রাখা চেয়ারটায়
বসে রাজ । এতক্ষণ মোবাইল চালাচ্ছিল, আবিরকে নড়তে দেখে ঠোঁটের
কোণে হাসি ফুটে উঠলো । আবিরের পাশে এসে বসে বেশ আনন্দের সাথে বলল, "যাক,
অবশেষে জ্ঞানটা ফিরল ।" আবির উঠে বসার চেষ্টা করছিলো, কিন্তু পারলো না । রাজ বলল, "শুয়ে
থাক, ডাক্তার বলেছে শুয়ে রেস্ট করতে ।" আবির আর উঠলো না
। কিছুক্ষণ
চারপাশটা দেখে প্রায় ফিসফিসিয়ে দুর্বলতার সাথে বলল, "আর কেউ নেই?"
"ছিল, বেচারা রাত ১টা পর্যন্ত ছিল । এখন ঘুমাচ্ছে ।" আবির রাজের
চেহারার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল । জিজ্ঞেস করলো, "আর তুই?" রাজ
একটু হেসে বলল, "আমার কথা ভাবিস না । এমনিতেই ঘুম
ধরছে না তো, তাই বসে আছি । বলা যায় না, তোর যদি কোন সমস্যা হয় ।" আবির নিজের
কপালে হাত দিলো । কিছু একটা শক্ত শক্ত অনুভব করলো । কপাল পুরোটা কপাল আর
মাথার চারদিকে ব্যান্ডেজ । আবির কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই ওর অঙ্গভঙ্গি দেখে
রাজ বলল,
"তোর কপালে সিরির রোডের সাথে লেগে বেশ কেটে গেছে, তাই ব্যান্ডেজ । আবির আর কিছু বলল না । চোখটা বন্ধ করলো । চোখ খুললেই
মাথাটা কেমন যেন করছে । বোধ হয় ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছে ।
সেদিন ভোর থেকেই প্রচণ্ড
ঝড় হয়েছিলো । সকালের দিকেই থেমে গেছে অবশ্য । তারপর প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে । মুষলধারে বৃষ্টির পরই
ছিল গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি । খুব বেশিক্ষন হয় নি বৃষ্টি থেমেছে । কালো মেঘের আড়াল দিয়ে
সূর্য উঁকি দিচ্ছে । আবিরের রুমটাও মুহূর্তের মধ্যে বাইরের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে
উঠলো । অনেক কষ্টে চোখটা খুলল আবির । মাথার ঝিম ঝিম ভাবটা এখন আর নেই, তবে ডান
পায়ের ব্যাথাটা রয়েছে এখনও । আবির অনেক কষ্টে উঠে বসলো । জানালা দিয়ে বাইরের
দিকে তাকিয়ে আছে । ছাত্রছাত্রীদের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, তাহলে
বোধ হয় স্কুল মাত্রই ছুটি হয়েছে । আবির মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল, দুপুর
২টা বাজে । নিশি আর পরশ একসাথে স্কুল থেকে ফিরছিল । পরশ বলল, "আবিরের
কি অবস্থা রে?" "জানি না, সকালে
আর যাওয়া হয় নি । রাজ বলল ঘুমাইতেছে ।" পরশ বলল, "হুম, ছেলেটা
কতো ভালো বলতো, আমরা ঠিকই ঘুমালাম, অথচ
ও ঘুমাল না । তাও এমন না যে ও আবিরের ছোট বেলার বন্ধু মাত্র ২-১ দিনের
বন্ধুত্বেই এতো কিছু ।" নিশি রাজের কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল, "হুম
। আর তোরা অরেই ফাঁসানোর লাইগা কি করতেছিলি ।" পরশের মুখটা
ফ্যাকাশে হয়ে গেলো । নিশি সেটা বুঝতে পেরে বলল, "জানিস তো, এই হারামজাদী নাবিলার এতো খারাপ! আমি আগে ভাবি নাই ।" রাজ জিজ্ঞেস
করলো,
"ক্যান?" "আর কইছ না, গতকাল ওর কাছে শুনলাম নাবিলা নাকি ওরে আবিরের লগে মিশতে মানা করছে ।" এমন সময় পেছন
থেকে নাবিলার আওয়াজ এলো । "নিশি! পরশ!
দাড়া!" পরশ পেছন ফিরে তাকাল । অনেকটাই দূরে
আছে এখনও । জোরে জোরে হেঁটে আসছে । পরশ আর নিশি দাঁড়ালো । পরশ বলল, "একটা
কাজ করতে পারবি?" নিশি জানতে চাইলো, "কি?" এরপর পরশ নিশিকে ফিসফিসিয়ে কি যেন বলল,
নিশির চেহারা দেখেই বোঝা গেলো, ও রাজি । নাবিলা ওদের কাছে আসতেই
ওরা হাঁটা শুরু করলো । পরশের সাথে হ্যান্ডশেক করে নিশি বলল, "কিরে
কেমন আছিস?" "ভালো।" জবাব দিলো পরশ । এরপর নাবিলা
নিশির দিকে হাত বাড়াল । কিন্তু নিশি হ্যান্ডশেক করলো না । নাবিলা নিশির কাঁধে হাত
রেখে কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু নিশি নাবিলার হাত সরিয়ে দিয়ে পরশের
অন্য পাশে চলে গেলো । নাবিলা তখন পরশকে জিজ্ঞেস করলো, "কিরে?
কি হয়েছে রে ওর?" পরশ এমন একটা ভাব ধরল,
যে ও সব জানে, কিন্তু কিছু বলতে পারবে না । নিশি কিছুই বলল
না । নাবিলা তখন বলল, "পরশ, বল কিন্তু!" পরশ একবার নিশির দিকে তাকাল । নিশি নাবিলাকে শুনিয়েই
বলল,
"বলে দে ।" পরশ তখন নাবিলার দিকে তাকিয়ে বলল, "শোন
ওর একটা বয়ফ্রেন্ড হয়েছে ।" নাবিলা খুশি হয়ে গেলো । নিশির দিকে তাকিয়ে বলল, "কি
রে! সত্যি নাকি রে, ট্রিট হবে মামা,
ট্রিট হবে ।" তারপর আবার পরশের দিকে তাকিয়ে বলল, "কিন্তু
আমার সাথে কথা বলে না ক্যান?" পরশ বলল, "শোন, ওর বয়ফ্রেন্ড ওরে কইছে, ও
যেন তোর লগে না মেশে, নাইলে ওর বয়ফ্রেন্ড ওর লগে ব্রেকআপ
কইরা ফেলবো ।" নাবিলা নিশি কাছে যেয়ে অভিমানের সাথে বলল, "এই
তোর বন্ধুত্ব, প্রেমের জন্য বন্ধুরে ভুইলা যাবি? আর কেমন হারামজাদা বয়ফ্রেন্ড বানাইছোস যে নিজের গার্লফ্রেন্ডরে তার বন্ধুর
লগে মিশতে দেয় না?" নিশি এতক্ষণে নাবিলার চোখের দিকে
তাকাল । তারপর অভিমান আর রাগ মিশিয়ে ঘেঁষা কণ্ঠে বলল, "রাজ কে রে তোর কথা
শুনে নিজের বন্ধুত্ব নষ্ট করার? আর তুইও বা কেমন মেয়ে যে তার
বয়েফ্রেন্ডকে তার বন্ধুর সাথে মিশতে নিষেধ করে?" নাবিলা
ত্থ বনে গেলো । এতদিনে যেন ওর টনক নড়ল । নাবিলা ওখানেই দাড়িয়ে
রইল, রাজ আর নিশি সামনের দিকে এগিয়ে গেলো । যেতে যেতে দুজন দুজনের
দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে উঠলো । পেছন ফিরে একবার নাবিলার দিকে তাকালো, নাবিলা
এখনও মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে । কি যেন ভাবছে ।
(১১)
রুমের দরজাটা খুলে ভেতরে
ঢুকল রাজ । হাতে ওষুধের প্যাকেট । আবিরকে বিছানায় না দেখে প্রথমে একটু চিন্তিত হল বটে, পড়ে
খেয়াল করে দেখল, আবির টয়লেটে গেছে । আবিরের বিছানার
ওপর ওষুধের প্যাকেটটা রাখল রাজ । ব্যাগটা চেয়ারে রেখে শার্টের ইঙ্কটা খুলে ফেলল । গতকাল আবির পড়ে
গিয়েছিলো সিঁড়িতে, অমনিই ধরে এনে শুইয়ে দেয়া হয়েছিলো বিছানায় । গায়ে যেটুকু
ময়লা লেগেছিল, তা বিছানায় পড়ে আছে । দরজার আড়াল থেকে ঝাড়ুটা
বের করে বিছানাটা ঝারতে লাগলো । এরই মধ্যে আবির বাথরুমের দরজাটা খুলল । রাজ বিছানা
ঝাড়ু দিচ্ছে দেখে আবির আর বিছানার দিকে এগিয়ে এলো না । বাথরুমের দরজার সাথেই
হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রইলো । রাজ ঝাড়ু দিতে দিতেই ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে কিছুক্ষণ পর পর
আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, "হেয় বাডি! হোয়াটস
আপ!" আবির হালকা দুর্বলতা মিশ্রিত হেসে বলল, "হুম । তুই একদম স্কুল থেকেই চলে এলি?" "হুম । আর বলিস না, মেডিসিনগুলো কিনে আনলাম, তাই দেয়ার জন্য রুমেই চলে এলাম ।" বলে রাজ ঝাড়ুটা
রাখতে যাচ্ছিলো, তখন রাজ বলল, "তুই মেডিসিন না
আনলেও আসতি ।" রাজ একটু দাড়িয়ে আবিরের কিছু তাকিয়ে একটু হাসল । তারপর ঝাড়ুটা
রেখে আবিরের কাছে এগিয়ে এসে বলল, "শোননা, তুই কি
গোসল করবি?" আবির বলল, "করা
তো লাগতোই ।" "একা একা পারবি তো নাকি আমার হেল্প লাগবো?" আবির
হেসে বলল, "ধুরু শালা, পারমু,
বাচ্চা বা বুইড়া নাকি আমি যে পারমু না?" রাজও
হেসে উঠলো । তারপর বলল, "তাহলে গোসলটা করে নে, আমিও রুম থেকে গোসলটা সেরে আসি ।" আবির বলল, "আচ্ছা
যা ।"
রাজ
উল্টো ঘুরে দরজার দিকে যাবার জন্য পা বাড়াতেই ঘরে ঢুকল নাবিলা । রাজ আর আবির
দুজনেই নির্বাক হয়ে গেলো । রাজের ভয়, যদি
নাবিলা ওর সাথে ব্রেকআপ করে? রাজ নাবিলার কাছে যেয়ে অনুনয় করতে লাগলো, "নাবিলা...সরি নাবিলা......কথা
দিচ্ছি! ও যেই কয়েকটা দিন সিক থাকবে, জাস্ট
এই কয়েকটা দিন......প্লিজ! মাইন্ড কোরো
না...হেয় নাবিলা!" নাবিলা কোন
জবাব দিলো না । এক দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে রইলো । আবির চুপচাপ
দাড়িয়ে আছে । ও নিজেও কিছুক্ষণ নাবিলার দিকে তাকিয়ে ছিল । তারপর চোখ অন্য কিছুর
দিকে নিয়ে যায় । নাবিলা গতকাল নিশির কাছে শুনেছিলো আবির নাকি সিঁড়ি থেকে
পড়ে যেয়ে আহত হয়েছে, কিন্তু নাবিলা বিশ্বাস করে নি, ভেবেছিলো
পরশ, জামি আর শিমুল এখন হয়তো নিশিকে দলে ভিরিয়ে এসব করছে । তার ওপর
ফিসিক্স প্র্যাক্টিকাল করছিলো দেখে আর বাইরেও আসে নি । রাজ এতক্ষণ কি বলছিল
সবটা শুনলেও কিছুই বলল না নাবিলা । এক পর্যায়ে রাজ থেমে যায় । কিছুক্ষণ নাবিলার দিকে
তাকিয়ে রইল । তারপর ভয় মিশ্রিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, "নাবিলা!" নাবিলা
এতক্ষণে রাজের দিকে তাকাল । তারপর নাবিলার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো । রাজের গালে হাত
বুলিয়ে বলল, "আমি আর তোমাকে মানা করবো না । তুমি তোমার
বন্ধুর সাথে ইচ্ছে মতো কথা বোলো ।রাজ খুব আনন্দিত হল । জিজ্ঞেস করলো, "সিরিয়াসলি!"
নাবিলা বলল, "হুম ।" রাজ আবিরের কাছে
এগিয়ে এসে আবিরকে জড়িয়ে ধরল । বলল, "ডিউড, আর কোন
ঝামেলা নাই!" আবিরের ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে উঠলো । আবির কিন্তু
নাবিলার দিকেই তাকিয়ে আছে, আর নাবিলা রাজের দিকে । নাবিলা চলে
যাচ্ছিলো, ঠিক তখনই আবির ডেকে উঠলো , "নাবিলা!"
নাবিলা দাড়িয়ে গেলো । আবারো আবিরদের দিকে ঘুরে তাকাল । আবির বলল, "নাবিলা,
আমি তোমার সাথে আর কখনো কথা বলতে চাই না । কিন্তু শেষ
একটা কথা বলার ছিল ।" নাবিলাও হাসি মুখে বলল, "আমিও তোমার সাথে আর
কখনো কথা বলতে চাইনা, তবে তোমার যখন এটাই শেষ, আমারও শেষ ।" আবির একবার রাজের দিকে তাকাল । তারপর রাজকে নাবিলার দিকে ঘুড়িয়ে দাঁড় করাল । বলল, "আমাকে
ছেলেটা সবটা বলেছে । এই ভালোলাগার শুরুটা তুমি করেছো । আর ভালোবাসার শুরুটা
রাজ করতে চায় ।"
নাবিলা
রাজের দিকে তাকাল । রাজ কেমন চুপসে গেছে । ভয়ে নাকি লজ্জায়, তা
অবশ্য বোঝা গেলো না ঠিক । আবির বলল, "রাজ, বল!"
রাজ কোন কথা বলল না । নাবিলার দিকে তাকিয়ে রইল । আবির আবারও বলল, "কিরে?
বল?" রাজ আবারো কিছুক্ষণ নাবিলার দিকে
তাকাল । যখন কিছু বলতে পারছিল না, তখন নাবিলাই বলল, "আমি জানি, ওর সাহসটা একটু কম । যতোই ভালো বডি
থাকুক, আমি জানি এই বডি নিয়ে ও ভালো লড়াই করতে পারবে না ।" রাজ এবার একটু
বিরক্ত হয়ে বলল, "তুমি কিন্তু এবার আমার অপমান করছো, কে বলেছে আবার সাহস নেই । এই যে বলে দিচ্ছি ।" সে সময় বাসার
এসেছিলো শিমুল, জামি, পরশ আর নিশি । যেহেতু মেয়েদের
ঢোকা নিষেধ, তাই নিশি ঢুকত না, কিন্তু নাবিলাকে দেখে
ঢুকলো । আবিরের রুমে এখনও যায় নি, যাবে যাবে ভাবছিল, কিন্তু
রাজের কথা শুনে দাড়িয়ে গেলো । রাজ বলতে লাগলো, "আই লাভ ইউ নাবিলা, আই লাভ ইউ । দেখলে বলে দিলাম! শুধু আবির কেন, আরও
অনেক মানুষের সামনে বলার সাহসও আমি রাখি । বুঝলে ।" সেই সময় ঘরে উঁকি
দিলো জামি,
শিমুল, পরশ আর নিশি । ওদের দেখে লজ্জা পেলো রাজ । আবিরের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, "রাবিশ!
সান অফ বিচ! তুই এটা করতে পারলি! আমার মান সম্মান সব খাইলি!" নাবিলা তখন আবিরকে
ঈশারা করে রাজকে ডাকতে বলল, "আবির রাজকে আবারো নাবিলার
দিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করালো । নিশি, "আই লাভ ইউ টু ।" বলে লজ্জা পেয়ে
নিজের রুমের দিকে দৌড় দিলো । রাজ অবাক হয়ে দাড়িয়ে রইল । ওর মনের ভেতর একটা
প্রেমের দোলা খেয়ে গেলো ।
সেই থেকে শুরু । এভাবে কাটতে
থাকে ওদের দিন । সকালে ক্লাস করে, দুপুরে একসাথে ফিরে আসে, আবির অবশ্য প্রথম কয়েকটা দিন একা যেতে পারে নি পায়ে ব্যাথার জন্য । কোনদিন শিমুল, কোনোদিন
জামি, কোনোদিন রাজ কিংবা কোনদিন পরশের সাথে গেছে । তবে অর্ধেকের
বেশীরভাগ দিনই গেছে রাজের সাথে । আবিরের সাথে রাজের একটা বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো । এতোটা ভালো, যে
এতোগুলো বছর আবিরের সাথে জামি কিংবা শিমুলের সাথেও এতো ভালো বন্ধুত্ব হয় নি । মূলত রাজই
আবিরের সাথে বেশি মিশতে চাইতো । কেন, আবির তা জানেনা । তবে আবিরেরও
ভালোই লাগতো ওর সাথে মিশে । অন্তত ও জামি। শিমুল কিংবা সেই রিভুর মতো না, যারা
প্রয়োজনের সময় সবসময় পাশে থাকে না । পরশ অবশ্য অমন না, তবে
রাজকে বেশি ভালো লাগে কারণ রাজ পরশের চেয়েও ভালো, আর উপকারি । তবে যাই হোক, বন্ধু
তো বন্ধুই, রাজ বেষ্টফ্রেন্ড হলেও বাকিরা তো শত্রু হয়ে যায়
না । বেশ কাটছিল দিনকাল । আবিরের পায়ের ব্যাথাও ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়, সব
বন্ধুরা আবার আগের মতো হাসি খুশি দিন যাপন করতে থাকে । আবিরও আগের মতো
হাসিখুশি হতে থাকে । ভুলে যেতে থাকে, এক সময় নাবিলাকে ও ভালোবাসতো । একটা জিনিস কিন্তু সত্য, যতোই সবাই বলুক, তোমায় ছাড়া আমি বাঁচবো না, আমি তোমাকে কখনো ভুলবো না,
প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষই কিন্তু এসব বলেও পরে ঠিকই ভুলে থাকতে পারে । পারে ১শতাংশের
কেউ কেউ বলে না, কারণ জানে সে পারবে পারবে না, কেউ কেউ
আবার সত্যি বেশি ভালোবাসে । তবে গুরুজনদের কথা মতো বেশি বেশি কোন কিছুই ভালো না, আবার
ভণ্ডামি কোন কিছুও ভালো না । রাজ কিন্তু প্রায়ই নাবিলার সাথে সময় কাটায় । তবে রাজ জীবনের
সব কথা শুধু আবিরের সাথেই শেয়ার করে । নাবিলার সাথে হালকা পাতলা যেগুলো অন্যান্য
বন্ধুদের সাথেও করে থাকে । চৈত্র চলে যায়, আসে বৈশাখ । হোস্টেলের আশেপাশের আম
গাছগুলোতে বেশ আম ধরেছে । ওপাশে একটা জাম গাছও আছে, তবে এখনও কাচা বেশীরভাগ । ক্লাস টু এর
হোস্টেলের পেছনে একটা বরই গাছ আছে । বেশ মিষ্টি । প্রায় সময়ই ওরা সেখানে হানা দেয় তবে ক্লাস ওয়ান থেকে ফোর
পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের হোস্টেলে একটা করে সিনিয়র কেউ সারাদিন থাকে । ছোট মানুষ তো, সব
পারবে না বলে । ওদেরই অনেকে মাঝে মাঝে বাধা দেয়, সে বাধা
শোনে কে? ওর যায়, বরই খায়, কাউকে যদি ধমকাতে বা লাঠি নিয়ে তেড়ে আসতে দেখে, তাহলে
দেয় এক দৌড় । বাইরে বৃষ্টি এলে সব বন্ধুরা একসাথে ভেজে । বেশ লাগে ওদের, মাঝে
মাঝে মাঠে যেয়ে কাদায় মাখামাখি হয়ে আসে । মেয়েরা অবশ্য এসব পছন্দ
করে না । ওরা একটু কাঁদা থেকে দূরেই থাকে । বেশির ভাগ সময় ছেলেদের থেকে দূরে । মেকআপ উঠে
যাওয়ার একটা ব্যাপার আছে তো । এদিকে রাজও আগের যে ইংলিশ বলার ঝোঁক, তা
কমিয়ে ফেলেছে । এখন মাঝে মাঝেই ওদের মতো আঞ্চলিকতা মিশিয়ে বলে । যাকে বলে
জগাখিচুড়ি বাংলা ।
দেখতে দেখতে এপ্রিল
মাসটাও শেষের দিকে । আজ ৩০ এপ্রিল । বিকেলের দিকে আবির ছাদে উঠে বসে
ছিল । আজ ওরা সব বৃষ্টিতে ভিজেছে । আবির তো মাঠের মধ্যে প্রায় ১ঘণ্টা কাদায় মাখামাখি করেছে । তার ওপর সবাই
ভিজে রুমে চলে এলেও আবির আবার ভেজা শরীর নিয়ে গিয়েছিল আম পারতে । এনে যদিও
সবাইকে খাইয়েছে, তবে নিজে পড়েছে বিপাকে । ঠাণ্ডা লেগে গেছে । তাই ছাদের ওপর
বসে বসে মাঝে মাঝে হাচি দিচ্ছে, আর নাক টানছে । কিছুক্ষণ পর রাজ এসে
আবির পায়ের ওপর মাথা রেখে শুয়ে বলল, "কিরে মামা! কি
করোস?" আবির আরেকবার হাচি দিয়ে নাক টেনে বলল,
"কইছ না, ঠাণ্ডায় বাচতেছি না ।" "হুম চল, আরেকটু
ভিজা আইসা ওই শরীরেই আম পাইরা আসি ।" আবির রাজকে ইয়ার্কির করে মারতে যাচ্ছিলো, রাজ
হেসে আবিরের থেকে দূরে সরে বসলো । আবির বলল, "খাইছোস?" "হ। তুই?" আবির
আবার একটা হাচি দিয়ে বলল, "হ । খাইয়া আইসাই
বইসা আছি । ভাল্লাগতেছে না ক্যান জানি ।" রাজ ইয়ার্কি করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো হয়তো, কিন্তু
হঠাৎ করে কি যেন মনে পড়ায় সিরিয়াস হয়ে গেলো । জিজ্ঞেস করলো, "ওই,
আজ সকালে স্কুল থেইকা আসার সময় দেখলাম অনেক পোলাপাইনরে রিসিপশন রুমে
। ক্যান রে?" আবির বলল, "কইতে পারি না ।অ্যাঁ আইজকা
পাপলু আঙ্কেলের রুমেও যাওয়া হয় নাই ।" যাবি?" আবির রাজের দিকে তাকাল । ওর দৃষ্টি
হ্যাঁ কেই ইঙ্গিত করছে ।
"হুম । অনেকেই এসেছিলো
। এই কলেজে ভর্তি
হতে ।"
সকালে
অনেক ছেলেমেয়ে কেন এসেছিলো রাজ আর আবিরের সেই প্রশ্নের জবাবে বলল পাপলু আঙ্কেল । তবে উনার
চেহারাটা মোটেও ভালো দেখাচ্ছিল না । কি যেন একটা অজানা ভীতি উনার চেহারায় । আবির আর রাজ
অবশ্য খুশিই হল কথাটা শুনে । রাজ বলল, "ভালোই তো, নতুন
নতুন বন্ধু হইবো ম্যালা পোলাপাইন নিয়া ক্লাস করমু, ভালোই তো ।" আবির ইয়ার্কি
করে রাজের দিকে তাকিয়ে বলল, "হ, তুইও নতুন
নতুন মাইয়া পাইবি ।" রাজ বিরক্ত হয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, "আমার
আছে ভাই, তোর মতো ছ্যাঁচড়া না আমি, বাইনটুট
।"
"টুট কইলি ক্যা! আসলডাই ক!" "আমি খারাপ শব্দ
উচ্চারন করি না ।" পাপলু আঙ্কেল ওদের কাণ্ডকারখানা দেখে যেন অনেক কষ্টে হাসল । তারপর বলল, "আমিও
প্রথমে তাই ভেবেছিলাম । কিন্তু তোদের সুমন স্যার যা বলল, তাতে
আমার এখন চিন্তা হচ্ছে ।" আবির আর রাজ পাপলু আঙ্কেলের দিকে তাকাল । আবিরই জিজ্ঞেস
করলো,
"কি বলেছেন স্যার?" পাপলু আঙ্কেল
জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন, "তোরা ছোটবেলা থেকেই এই আশ্রমে আছিস, যদিও একটা
আশ্রমের চেয়ে অনেক বড় কিছু আমি বলবো । ছোটবেলা থেকেই এ
আশ্রমের লোকজনদের ঘিরেই তোদের জগত । আর তাই তোরা সবাই একই ধাঁচে একই পরিবেশে বড় হয়েছিস, তোরা
ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছিস, কিন্তু তোদের জীবনে যা বাদ
পড়েছে, তা হল বাইরের মানুষের সংস্পর্শ, যেখানে ভালো খারাপ মিশে থাকে । তোরা জানিস না, কিছু
মানুষ কতোটা খারাপ, এসব ছেলেমেয়েদের বাবা মা এমনিতেই আঙুল
ফুলে কলাগাছ হয়েছে, তার ওপর তাদের ছেলেমেয়ের পড়ালেখার তেমন
খোঁজ খবরও রাখে অশিক্ষিত হিসেবে । ছেলে মানুষ হল নাকি উচ্ছন্নে গেলো, তারও
খোঁজ রাখে না । ওরা পরশু থেকে তোদের সাথে ক্লাস করবে । বুঝতে পারছিস, ওদের মা
বাবা আছে, নিজস্ব একটা পরিচয়ও আছে, ওরা
এই স্কুলের টাকা দিয়ে পড়বে, আর তোরা? তার
কিছুই নেই তোদের । ওরা যখন তোদের সাথে ক্লাস করবে, তখন
নিজেদের নিয়ে বড়াই করবে, তোরা বুঝিস, এতে
তোদের কতজনের সাথে ওদের ঝামেলা হবে?" রাজ ব্যাপারটা
সিরিয়াসলি নিলেও আবির কিছুক্ষণ পাপলু আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে দিলো । তারপর আবির বলল, "পাপলু
আঙ্কেল, কি যে বলো না? ওসব তো মুভিতে
হয়, মানুষ কি এতোটাও খারাপ নাকি? ২-১টা আছে ওই অর্কর মতো, ওদের আমি দেইখা লমুনে,
আর তাই বইলা কি সব মানুষই খারাপ নাকি?" পাপলু
আঙ্কেল ভীতির সাথে বিরক্তি মিশিয়ে বলল, "আবির, তুই বুঝতে পারছিস না কেন? এলাকার বেশীরভাগ
ছেলেমেয়েদের বাবা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, আর এরা মোটেও
সুবিধের হয় না, আর তার ওপর টাকা দিয়ে কোন গরীবও এই কলেজে
পড়তে আসবে না এই স্কুলে, শহরের ওদিক থেকে তো মোটেও আসবে না
কারণ ওদিকের স্কুলগুলোর মতো এই স্কুলের সুনাম এখনও সেভাবে হয় নি!" আবির আবারও হেসে বলল, "তুমি শুধু শুধুই টেনশন
করছো, কিছুই হবে না । আর এরা তো ভালোই দেখি, জুম্মার
নামাযে দেখি, বাইরে গেলেও মাঝে মাঝে দেখি, খারাপ তো মনে হয় না?" "আবির তুই কি রিভুর
কথা ভুলে যাচ্ছিস? ওকে কি প্রথম দেখে তুই ভালো ভেবেছিলি?"
পাপলু আঙ্কেলের এই কথাটা শুনে আবির এতক্ষণে ব্যাপারটা কিছুটা
সিরিয়াসলি নিলো । কি যেন ভাবতে লাগলো আবির । পাপলু আঙ্কেল আবারো বলল, "তোর
যদি আরও জানতে ইচ্ছে থাকে, তোর বন্ধু রাজকে জিজ্ঞেস কর,
ও তো বাইরের পরিবেশে এতো বছর মিশে এসেছে!" রাজ আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, "আবির, পাপলু আঙ্কেল সত্যি বলছেন, এসব ছেলেমেয়েদের প্রায়
৯৫শতাংশই খারাপ হয়, নিজেদের নিয়ে বড়াই করে!" আবির কোন জবাব দিলো না । যদিও এখনও ওর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না
ব্যাপারটা তেমন সিরিয়ালি নিয়েছে আবির । উঠে দাড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল, "চল
রাজ, হোস্টেলে যাই ।" পাপলু আঙ্কেলকে
বিদায় জানিয়ে আবারও ছাদে চলে এলো ওরা । সূর্য প্রায় অস্ত যাবে যাবে ভাব । শেষ বিকেলের
একটা গাঢ় হলদেটে আলো ওদের মুখে এসে পড়েছে । আবির রাজকে বলল, "আচ্ছা
রাজ, আমারে সত্যি কইরা একখান কথা কইবি?" রাজ ফোন চালাচ্ছিল । সেদিকেই মন রেখে জবাব দিলো, "হুম ক । আর তোরে তো আমি
কোনোদিন মিথ্যা কই না ।" আবির রাজের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "তুই
আমার সাথে তোর জীবনের অনেক কথাই শেয়ার করেছিস, কিন্তু এমন
কিছু একটা আছে, যা তুই আমার সাথে শেয়ার করিস নি । কি সেটা?" রাজ
ফোন চালাতে চালাতে থেমে গেলো । খানিকক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবল । তারপর ফোনটা
পকেটে রেখে হালকা হেসে বলল, "আমি কিছুই লুকাই নাই । তুই ভুল
ভাবতেছোস ।"
আবির
তখন বলল,
"দ্যাখ তুই তো আমার সাথে সব শেয়ার করেছিস, তোর চাচি তোকে পছন্দ করতেন না বলে তুই কথা দিয়েছিলি ক্লাস ১০-এ ওই বাড়ি ছাড়বি বলে এখানে আসা, ছোটবেলা থেকেই তোর মেয়েদের
প্রতি মারাত্মক আকর্ষণ ছিল সেই কথা, তুই ক্লাস এইটে একটা
মেয়ের সাথে প্রেম করেছিলি, পড়ে মেয়েটা তোর সাথে ব্রেকআপ
করেছিলো বলে তুই কষ্ট পেয়ে প্রেম করবি না ভেবেছিলি, পড়ে তুই
নাবিলাকে দেখে সব ধ্যান ধারণা পাল্টে ফেললি, সব বলেছিস,
কিন্তু এরই মাঝে কিছু একটা গোপন করেছিস, কি
বলতো?" চাচির কথাটা বলবার সময় রাজের চেহারাটা
স্বাভাবিকই ছিল, কিন্তু পরের কথাগুলো শুনে রাজের চেহারা
ফ্যাকাশে হয়ে যায় । সেই চেহারায় কেমন যেন লজ্জা, ভয় নিজের প্রতি ধিক্কার
মিশে থাকে । আবির বলল, "ঠিক এটাই কারণ,
প্রত্যেকবার যেখানে তোর এই প্রেমের কথা ওঠে তোর মনের ভেতর কেমন যেন
একটা ভীতি খেলে যায় । আর সেই কারণটাই তুই আজ পর্যন্ত আমাকে বলিস নি । শুধু তাই নয়, পাপলু
আঙ্কেলের ওখানেও আমি খেয়াল করেছি আঙ্কেল যখন বড়াই করার কথা বলল, তোর মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেলো । কেন বলতো?" আবির
ইয়ার্কি করছে না তা বোঝাই যাচ্ছে, কারণ এখন ওর মুখে
আঞ্চলিকতা নেই । রাজ অন্য কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো । আবির রাজের হাতটা ধরে
নরম স্বরে হালকা হাসি নিয়ে বলল, "এভাবে কষ্ট লুকিয়ে রাখিস না দোস্ত,
আমাকে বিশ্বাস করে অনেক কথাই তো বলেছিস, এটাও
এটা কেন বাকি রাখছিস?" রাজ কিছু ভাবল । আবির বলল, "কিরে?
বলবি না?" রাজ আবিরের কথার জবাব না দিয়েই
না বলা কথাটা বলতে শুরু করলো । "আমি তোর কাছে একটা না, অনেক কথাই লুকিয়েছি । মূলত বলতে চাইনি লজ্জায় কি না কি ভাববি সেজন্য, কিন্ত
মনের ভেতরেও রাখতে কেমন কেমন লাগছিল, তাই তুই যখন জোর করছিস,
তখন বলি । একটু আগে পাপলু আঙ্কেলের মুখে যে বড়াই করার কথা শুনলি, আমি
ওরকমই একটা ছেলে ছিলাম । ছোটবেলা থেকেই আমি অ্যাডাল্ট মুভি দেখতাম । আসলে শাসন করার
কেউ ছিল না তো, আমাকে দেখারও কেউ ছিল না কি করছি না করছি । সেই থেকেই আমার
বাজে হওয়ার শুরু । মুভি দেখে দেখে আমার মনে এই ভাবনার সঞ্চার হয় ছেলেদের সাথে
বন্ধুত্ব করা যাবে, ছেলে ছেলে লড়াই করার জন্মেছে, আর ছেলে
মেয়ে প্রেম করার জন্য জন্মেছে । আমি আমার স্কুলের ছেলেদের সামনে একটা আলাদা
ভাব নিয়ে থাকতাম । মাঝে মাঝে মারতাম । সামনে ওরা কথা বলতে ভয় পেত ঠিকই, কিন্তু
পেছনে ওরা ঠিকই আমার নামে সমালোচনা করতো । আর মেয়েদের সামনে
আজেবাজে অঙ্গভঙ্গি করতাম । ওরা অবশ্য বলতো না কাউকে আত্মসম্মানের ভয়ে । এভাবে দিন
কাটতে থাকে । বড় হতে হতে বেশ কয়েকটা মুভিতে দেখলাম, না, ছেলেরা শুধু
মারামারির জন্য না, ওরা বন্ধুও হতে পারে । কয়েকটা বন্ধু
বানালাম, কিন্তু তখন বুঝিনি, এখন বুঝি, ওরা
সুবিধাবাদী । আমার কাছ থেকে সুবিধা পাবে বলেই আমার বন্ধু হয়েছিলো । এরপর একদিন
দেখলাম চারপাশে সব প্রেম করছে । আর আমি বসে থাকবো কেন? কিন্তু একদিন দেখি একটা
মেয়ে আমাকে লাভলেটার পাঠিয়েছে । আমি সাতপাঁচ না ভেবেই ওর প্রোপোজাল একসেপ্ট
করেছিলাম । মেয়েটার নাম তোকে বলেছি, শৈলী ।" আবির উপর নিচে
মাথা নেড়ে বলল, "হুম ।" রাজ বলতে লাগলো, "মেয়েটার আমার সাথে এমনভাবে মিশত,
ওর প্রতি আমার অন্যরকম মোহ তৈরি হতো । মনে হতো শুধু প্রেম না, আমার
আরও বেশি মজা চাই । মেয়েটাও মাঝে মাঝে ওরকম ভাব ধরত ।" রাজ একটু থেমে
আবিরের দিকে তাকাল । আবির অস্তমিত সূর্যের দিকে তাকিয়ে কথাগুল শুনছিল । রাজ বলল, "একটা
কথা শুনে তুই অবাক হয়ে যাবি । বলা যায় না, এখানেই সেন্সলেস হয়ে যেতে পারিস ।" আবির রাজের দিকে
তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কি?" রাজের কথায় আবির এবার
আরও বেশি মনোযোগ দিলো । রাজ বলল, "আমি কিন্তু এক সন্তানের বাবা ।" আবির চোখ কপালে
উঠলো । বলে কি এ! ক্লাস টেনে এক সন্তানের বাবা! আবির
প্রায় পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিলো । চেঁচিয়ে উঠলো, "কিহ!"
রাজ বলল, "হ্যাঁ । ক্লাস এইট
থেকেই আমি বাবা ।" আবির এবার আরও বিস্মিত হল । অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "তার
মানে তুই ক্লাস এইটেই শৈলীর সাথে......।" আবিরের মুখে আর
কথা বেরোলো না । রাজ বলল, "হুম । তুই যা ভাবছিস তাই ।" রাজকে অর্কর কথা
বলেছিল আবির । অর্কর মতো ধর্ষক ভেবে আবির ভুল বুঝতে পারে ভেবে রাজ বলল, "আমি
কিন্তু ধর্ষণ করিনি, মেয়েটারও এতে মত ছিল ।" আবির এখনও
বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । রাজ বলতে লাগলো, "এরপর তোকে তো বলেইছি, ও আরেকটা ছেলেকে পছন্দ করে চলে গিয়েছিলো । তখনও এতোটাও কষ্ট আমার
লাগে নি । মনে মনে এমন একটা ভাব নিয়ে ছিলাম, একটা গেছে তো কি, আরও
আসবে!" কিন্তু আসল ধাক্কাটা খাই তখনই, যখন জানতে পারি মেয়েটা প্রেগন্যান্ট । আর কেউ না জানলেও আমি
আর ওই মেয়েটাই কেবল জানতো ওটা আমার আর ওর বাচ্চা । কিন্তু এরপর থেকে আমি
হতবাক হয়ে যাই । নিজেকে দোষী মনে হতে লাগলো । এ কি করলাম আমি! আমি
এতোটা নিচ হতে পারলাম! বাস্তবিক ধ্যান-ধারণা,
ভালো-খারাপ সব ভুলে এতো নিকৃষ্ট আমি হতে
পারলাম! আমি জানি না মেয়েটা কেন সবাইকে বলে নি ওর পেটে আমার
বাচ্চা । বললে আমার চাচা-চাচির কাছে হয়তো ওর মা-বাবা নালিশ নিয়ে আসতো । আর
ওর বাচ্চা হয়েছে নাকি নষ্ট করে দিয়েছে, তাও আমি জানি না । কারণ ওরা পুরো
পরিবার নিয়ে এই ঘটনার পর আত্মসম্মানের ভয়ে পরদিনই ঢাকায় চলে গিয়েছিলো ।" রাজ কিছুক্ষণ
থামল । আবিরের চোখে মুখে এখনও বিস্ময়য়ের ছাপ । রাজ বলল, "এরপর থেকে আমি নিজেকে ভালো করার চেষ্টা করে । মেয়েদের সম্মান
দিতে চেষ্টা করি, ছেলেদের ভাইয়ের মতো ভালোবাসার চেষ্টা করি, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার চেষ্টা করি । কিন্তু এবার কেউ আর
আমাকে পাত্তা দেয় । এবার সবাই নিজেকে নিয়ে বড়াই করা শুরু করে, আর আমার
পুরনো কর্মকাণ্ড নিয়ে আমাকে খোঁটা দেয়া শুরু করে । অনেক কষ্টে নাইনের
বছরটা পার করেছি, ক্লাস টেনের প্রথম তিনটে মাস অনেক কষ্ট করেছি স্কুল চেঞ্জ
করার, অবশেষে পারলাম এবং এই স্কুলে আসলাম । আশা করি এই
কথাগুলোর সাথে তুই এরও জবাব পেয়েছিস কেন আমি তোদের এতো ভালো বন্ধু ভাবি?" রাজ
শেষ কথাটা আবিরের দিকে তাকিয়ে বলেছিল । আবিরও কথা শেষে একবার
রাজের দিকে তাকাল । এমনিতেও আবির রাজকে বিশ্বাস করে । চেহারা দেখেও বোঝা যাচ্ছে, মিথ্যে বলছে না । রাজের চোখ দিয়ে
জল বেড়িয়ে এলো । নিজের কাজের জন্য যে অনুতপ্ত, তা
প্রকাশ করলো । আবির নিজেই হতবাক হয়ে গেছে এসব কথা শুনে । রাজ আবিরের
বুকে মাথা রেখে আবিরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, "আমি
অনেক খারাপ রে দোস্ত আমি অনেক খারাপ!" আবির কি বলবে
নিজেই বুঝতে পারছে না । সবটা কেমন যেন এলোমেলো লাগছে । কেবল অন্যমনস্ক হয়ে
রাজের মাথায় হাত বোলাতে লাগলো ।
"দোস্ত! ওই! আছোস!" বলতে বলতে
শিমুলের রুমের দরজায় নক করলো জামি । শিমুল ঘুম ঘুম চোখে উঠে এসে দরজা খুলে ঘুম
ঘুম ভাব নিয়ে বলল, "কি চাই!" জামি নিজের দিকে তাকিয়ে হালকা
একটু চিৎকার দিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে শিমুলকে বলল, "দোস্ত,
ঘুমের মধ্যে মনে হয় তোর লুঙ্গি খুইলা গেছে, যাইয়া
পইড়া আয় । শিমুল নিচে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি করে দরজা আটকে দিলো । জামি আবার
সামনের দিকে তাকাল । শিমুলের ঘুম ঘুম ভাব এতে বেশ পুরোপুরি চলে গেছে লুঙ্গির
গিট লাগাতে লাগাতে দরজার কাছে এসে বিরক্তির বলল, "বল কি চাই!"
"দোস্ত, শোননা, আমার
মোবাইল চার্জারটা কাজ করতেছে না, চার্জও নাই, তোর চার্জারটা একটু দে দোস্ত!" শিমুল রেগে
একটা চড় লাগিয়ে দিয়ে বলল, "শালা হারামজাদা কুত্তার
বাচ্চা, এর জন্য তুই আইসা আমার মান সম্মান ডুবাইলি!"
জামি বলল, "সরি দোস্ত, আমি কিছু দেখি নাই, আর আমরা আমরাই তো! দে না!" শিমুল "দিতেছি!"
বলে ভেতরে গেলো । বাইরে মাগরিবের আজান হচ্ছে । ঘরে এলো আবির । কেমন অন্যমনস্ক
হয়ে আছে । আবিরকে দেখে জামি
জিজ্ঞেস করলো, "কিরে মামা? কি অবস্থা?"
আবির কোন জবাব দিলো না । শিমুল এসে জামির হাতে
চার্জারটা দিয়ে আবিরের দিয়ে তাকিয়ে বলল, "কিরে? কি
অবস্থা?" আবির কিছুই বলল না । কেবল ডান হাত
উঁচিয়ে ইশারায় জানান দিলো, "ভালো ।" শিমুল জামির
দিকে তাকাল । জিজ্ঞেস করলো, "কি হইছে রে অর?" জামি বলল,
"কি জানি!"
(১২)
"নিশি, শোন না দোস্ত, আমার এই দুইটা একটু আইকা দিবি দোস্ত!" নিশিকে
উদ্দেশ্য করে বলল নাবিলা । নিশি বলল, "ক্যান, তুই
আঁকতে পারস না?' নাবিলা ইয়ার্কির করে বলল, "দে না দোস্ত, দে না! প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ!" নিশিও
ইয়ার্কি করে বলল, "তুই কি সিমরান হইতে যাইতেছোস?'
নাবিলা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে মুচকি হাসল । নিশি বলল, "হ
যা, তোর তো কামের মধ্যে দুই, খাই আর
প্রেম করি ।" নাবিলাও ইয়ার্কি করে বলল, "শোন, আসলটা হচ্ছে কাজের মধ্যে দুই, খাই আর শুই, আমি শুইয়া শুইয়া সময় নষ্ট করি না, অন্তত প্রেন করি । বুঝসোস? টাটা!"
বলতে বলতে বেড়িয়ে গেলো নাবিলা । নিশি ফু গোছের একটা
আওয়াজ করলো কেবল । তিনতলায় এসে ছেলেদের এপাশে নক করলো নাবিলা । আজ নাবিলা বেশ
করে সেজেছে । রাজ ওকে দেখে কতই না প্রশংসা করবে! রাজের কাঁধে মাথা রেখে
লেকের ধারে বসে থাকাটা অভ্যাস হয়ে
গেছে । একদিন না গেলে কেমন কেমন লাগে, কিন্তু
কেউ দরজা খুলছে না কেন? রাজ না খুললেও পরশের তো খোলার কথা!
নাবিলা আবারো নক করে । এবার আগের চেয়ে জোরে জোরে । একটু পর পরশ
এসে দরজা খুলল । নাবিলা হাসিমুখে বলল, "কিরে? কেমন
আছিস?" "ভালো, তুই?"
জবাবা দিলো পরশ । নাবিলা বলল, "হ্যাঁ ভালো ।" রাজকে ডাকার কথা
বলতে যাবে,
তার আগেই পরশ বলল, "দাড়া, আমি ডেকে দিচ্ছি ।" বলে রাজের রুমের দরজার সামনে যেয়ে নক করলো পরশ । দ্বিতীয় বার নক
করতে যাবে,
এমন সময় পরশ খেয়াল করলো, ভেতর থেকে কান্নার
আওয়াজ আসছে । পরশ একবার নাবিলার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল । তারপর আবার নক
করতে করতে ডাকল, "রাজ! ওই রাজ! দোস্ত আছোস? ওই! দ্যাখ নাবিলা
আইছে! দোস্ত!" কয়েকবার ডাকার পর
অবশেষে দরজা খুলল রাজ । চোখ মুছেছে, কিন্তু চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এতক্ষণ
কাঁদছিল । রাজ দরজা খুলে পরশকে জিজ্ঞেস করলো, "কি
হয়েছে?" পরশ বলল, "নাবিলা
এসেছে, তোকে ডাকছে ।" রাজ দরজার দিকে
তাকাল । তারপর হালকা হাসবার চেষ্টা করে বলল, "নাবিলা, আজ আর
যাবো না, ভালো লাগছে না ।" নাবিলা অবাক হয়ে
বলল,
"কেন যাবানা!" রাজ বলল,
"প্লিজ নাবিলা, ভালো লাগছে না আজ আর না ।" "আরে কারণটা তো
বলো?"
এবার রাজ ক্ষিপ্ত হয়ে নাবিলাকে বলল, "তোমাকে
যেতে বলেছি না! এতো ঢং করছো কেন!" নাবিলা কিছুক্ষণ রাজের দিকে তাকাল । তারপর নিজেও রাগ করে
উপরে চলে গেলো । রাজ ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো । রাজের ক্ষিপ্ততা দেখে
পরশও কিছু জিজ্ঞেস করবার সাহস পেলো না ।
নিজের রুমে বিছানায় শুয়ে
শুয়ে আবির ভাবছিল রাজের কথা । এতক্ষণ যা শুনল, তার কিছুই যেন ওর কাছে সত্যি বলে মনে হচ্ছে
না । মনে হচ্ছে কেবলই একটা দুঃস্বপ্ন দেখল । কিন্তু, এটা তো বাস্তবেই ঘটেছে তা
অস্বীকার করবার উপায় নেই । এমন সময় ফোন কলের আওয়াজ এলো । আবিরের মোবাইলটা বাজছে । ধরল আবির । "হ্যালো!"
কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে ফোনের ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো “দোস্ত, আমি আর পারছি না রে, মনের ভেতর
পুরনো কষ্টটা আবারও কেমন যেন
নতুন করে জেগে উঠলো । আমারে হেল্প কর
দোস্ত! আমি আর পারছি না!" বলেই
কাঁদতে লাগলো রাজ । আবির একটু হেসে
নরম গলায় বলল, "আরে পাগল, ভুলতো মানুষই করে তাইনা?
এতে কষ্টের কি আছে? তুই তো তাও নিজেকে শুধরে নিচ্ছিস, অথচ
দ্যাখ, দুনিয়াতে আরও কতো
মানুষ আছে, যারা পাপগুলো
কন্টিনিউ করে যাচ্ছে, নিজের ভুলটা বুঝতে পারছে না!" "কিন্তু
আমি যে ভুলটা বুঝতে পারলেও ভুলটা ভুলতে
পারছি না রে?" আবির আবারো বলল, "শোন, এতো কষ্ট পাওয়ার কি আছে? তুই
আল্লাহর কাছে দোয়া কর, দেখবি, আল্লাহ
তোকে ক্ষমা করে দিয়েছেন ।" এরপর রাজের গলাটা কেমন যেন পাল্টে গেলো । কাঁদো কাঁদো
গলাটা কমে গেলো ঠিকই চলে এলো একটা ভয় আর আনন্দ মিশ্রিত গলা, "জানিস
দোস্ত, এসব ঘটনা যখন ঘটে, তারপর যখন
নিজের ভুলটা বুঝতে পারি, তখন থেকে
আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামায শুরু
করি । অনেক দোয়া করি আল্লাহর
কাছে, যেন উনি আমাকে ক্ষমা করে দেন । কিন্তু, এখন আর
নামাযটা পড়া হয় না রে ।" আবিরেরও মনটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেলো । একটা হতাশার শ্বাস ফেলে
বলল,
"হুম রে, আমারও এই কাজটাই করা হয় না । কতো বড় একটা
ইবাদত যে বাদ দিয়ে যাচ্ছি, জানি না পরকালে আমার কি হবে ।" রাজ বলল, "কাল
থেকে চল নামায পড়া শুরু করি ।" "ঠিক আছে ।" "রাজের মনটা
এতক্ষণে কিছুটা ভালো হয়েছে বলে মনে হচ্ছে । যেন নামাযের কথা আসতেই মনটা ভালো হয়ে গেলো । বলল, "আচ্ছা
দোস্ত, থাক তাহলে, কাল ফজরের নামাযের
সময় তুই উঠলে আমাকে ডাকিস, আমি উঠলে তোকে ডাকবোনে ।" আবির বলল, "আচ্ছা
দোস্ত । তুই আজকে জিম করেছিস?" "না রে, যাওয়া
হয় নি । প্রতিদিন এই সময়ই তো যাই, আজ ওই কষ্টের জন্য যাওয়া হয় নি ।" " চল তাহলে, একসাথে
যাই?" রাজও বলল, "চল ।"
শুক্রবারটা ওদের
অন্যান্য ছুটির দিনের মতোই স্বাভাবিকই গেলো । শনিবারের কথা । ২মে । সকালে ঘুম থেকে
উঠেই বাইরে বেশ আওয়াজ শুনতে পেলো আবির । অন্যান্যদিও শোনা যায়, তবে তা
বেশ অল্প । সবাই স্কুল গেলে কোলাহলের যে আওয়াজ হয়, সেই
আওয়াজ । আজ যেন শব্দটা একটু বেশি । আবির উঠে বসলো । ওর রুম থেকে ঠিক রাস্তাটা দেখা যায় না । তাই আবির ছাদে
চলে গেলো । ছাদে যেয়ে দেখল, খালি গায়ে একটা ট্রাউজার পড়ে নিশির সাথে দাড়িয়ে গল্প করছে রাজ
আর নিচের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পর পর দেখছে । সকালে ফজরের নামাজ পড়ে
বোধ হয় আর রুমে যায় নি । বলেছিল ছাদে হালকা
ব্যায়াম করবে, আবিরের ঘুম পেয়েছিলো বলে আর আসে নি । নিশির পড়নে
হলুদ থ্রি পিস আর ওড়না। ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকা । আবির এগিয়ে গেলো । ওদের মাঝে এসে
কি অবস্থা?
এখানে কি করিস? এসব স্বাভাবিক প্রশ্ন জিজ্ঞেস
করে নিজেও নিচের দিকে তাকাল । এতো ছাত্রছাত্রি! আবির রাজের দিকে তাকাল, "রাজ!
পাপলু আঙ্কেল বলেছিল আজই ই তো, তাই না?
রাজ উপর নিচে মাথা নাড়াল । বলল, "হ
রে, আমি জানি না আইজকা ক্লাসে কি হইবো । আবির মূলত কোন
টেনশন করছিলো না, কিন্তু তবুও কিছু
বলল না । রাজ আবার পুরনো কথা মনে করে কষ্ট পেতে পারে ।
আবিরের খেতে খেতে একটু দেরি হয়ে গেছে । তাই ক্লাসে
আসতে অন্যান্যদিনের চেয়ে একটু দেরি হয়ে গেলো, যদিও ক্লাসের টাইম অনুযায়ী ও লেট হয় নি । টিচার এখনও আসে
নি । ক্লাস শুরু হওয়ার এখনও ৫ মিনিট বাকি । আবির ক্লাসে ঢুকতেই অবাক । এতো
ছাত্রছাত্রী! আবির সবার
চেহারার দিকে তাকাল । হোস্টেলে যারা
থাকে তাদের মুখটা কেমন যেন গোমড়া হয়ে আছে, কারো
কারো মনের ভেতর প্রতিশোধ নেবার ভাব ফুটে
উঠছে । আর যারা আজ নতুন এসেছে, ওরা এমন
একটা ভাব নিচ্ছে, যেন
হোস্টেলের এতিম ছেলেমেয়েরা ওদের কাছে চাকরের মতো । আবিরকে দেখে নতুন
ছেলেমেয়েগুলো আবিরের দিকে তাকাল । মূলত ওর হাতের
ক্যাপ্টেন ব্যাচ দেখে । আরও একটা ব্যাপার খেয়াল করলো আবির । হোস্টেলের ছেলেমেয়েরা
সবাই পেছনের বেঞ্চে বসে । একজনও সামনের দিকে
বসে নি । আবির খেয়াল করলো, ওদেরই হোস্টেলের একটা মেয়ে এক নতুন ছাত্রীর পাশে বসে ভালো মতো
হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো, মেয়েটা ঘৃণাযুক্ত
অঙ্গভঙ্গি করে বলল, "ইইই! হাও
ডেয়ার ইউ! আমার টাচ করবে না! গেট লস্ট
ফ্রম মাই বেঞ্চ!" মেয়েটা বেঞ্চ থেকে চলে গেলো । আবির রাজের
দিকেও একবার তাকাল । কেমন রেগে আছে মনে হচ্ছে । কেউ হয়তো কিছু করেছে । আবির নিজের
সিটের দিকে যাচ্ছিলো, এমন সময় দেখতে ফর্সা
রকম একটা মাস্তানের মতো ছেলে আবিরের কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দিলো । চেহারাটা দেখে
মনে হচ্ছে না কোন বাজে মতলব আছে । আবির ভালো মতো বন্ধু বুঝে হ্যান্ডশেক করলো । বলল, "হাই,
নাইস টু মিট ইউ ।" পরক্ষনেই ছেলেটা গম্ভীরভাবে বলল, "মিস্টার
ক্যাপ্টেন, তাই না?" আবির ঠিক
বুঝল না ছেলেটার কথার মানে । জিজ্ঞেস করলো, "আমি তোমার কথা শুনতে পাইনি ।" মুহূর্তের
মধ্যেই কিছু বুঝে উঠবার আগেই ছেলেটা আবিরের মুখে জোরে একটা ঘুষি লাগিয়ে দায় । পাশেই বেঞ্চের
ওপর প্রায় শুয়ে পড়ে আবির বেঞ্চে দুটো মেয়ে ছিল ওরা কেমন একটা ঘৃণার ভঙ্গি
ধরে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো । আবির উঠে দাঁড়ালো । ঠোঁটের ওপর হাত দিয়ে দেখলো, নাক
দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে । রাজ উঠে আসতে চাচ্ছিল, কিন্তু জামি আর শিমুল রাজকে
আটকালো । সামনে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটা আবিরের দিকে সেই একই ভঙ্গিতে
তাকিয়ে । আবির কিছুক্ষণ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল । ছেলেটাও আবিরের দিকে
তাকিয়ে যেন আবির এখন ছেলেটাকে মারবে আর ছেলেটা এই মারটার জন্যই অপেক্ষা করছে । কিন্তু
কিছুক্ষণ বাদেই আবির একটু হেসে বলল, "রাজেশ নারায়ণ, তাই
না?" ছেলেটার ভ্রু কুঁচকে গেলো । বলল, "তুই
কি করে জানলি?" আবির একবার রাজের দিকে তাকাল । রাজ ঈশারা করে
দেখাল রাজেশকে মারার জন্য, কিন্ত আবির কেবল চোখ দুটো একবার ধীরে ধীরে
বন্ধ করে শান্ত থাকার জন্য বলল রাজকে । তারপর রাজেশের দিকে
তাকিয়ে বলল, "নেমপ্লেটটা তো আর এমনি এমনি দেয় নি ।" রাজেশ একবার
নিজের নেমপ্লেটের দিকে তাকিয়ে আবিরের নেমপ্লেট এর দিকে তাকাল । রাজেশ হালকা
হাসল । তারপর বলল, "আবিরের মানে বুঝিস?" "রঙ
বা কালার ।" জবাব দিলো আবির । রাজেশ ওপর নিচ মাথা নাড়ল । কিছু একটা বুঝতে
যাচ্ছিলো, এমন সময় আবির বলল, "আমার ভাবতেই অবাক লাগছে তোর
মতো একজন মাস্তান নাকি সুইসাইড করার চেষ্টা করতে পারে । সবাই অবাক হয়ে
আবিরের দিকে তাকাল । রাজেশের ভ্রু আগের চেয়ে এবার বেশি কুঁচকে গেলো । আবির আরও বলল, "লাস্ট
সপ্তাহেও মনে হয় চেষ্টা করেছিস ।" রাজেশ জিজ্ঞেস করলো, "তুই জানলি কি করে?" আবির জবাব দিলো, "হাতের কাটা দাগগুলো স্পষ্ট
দেখা যাচ্ছে ।" রাজেশ একবার নিজের হাত দেখল । রাজেশ হয়তো বলতে
যাচ্ছিলো অন্য কিছুতেও তো কাটা হতে পারে, কিন্তু
রাজ তার আগেই বলে দিলো, "কিন্তু ব্লেডের দাগের মতো এতো সোজা দাগ হয় না, আর
ব্লেডের কয়েকদিনের ব্যাবধানে আশা করি অসাবধানতাবশত এতবার কাটে না?" রাজেশ চুপ হয়ে গেলো । অবাক হয়ে গেলো আবিরকে দেখে । আবির বলল, "একে
তো নতুন, তার
ওপর চাই না প্রথম দিনই তুই আমার কাছে মার খা, তাই আর
কিছু বললাম না ।" বলেই সেখান থেকে চলে আসছিলো আবির, ঠিক
তখনই রাজেশ আবিরের দিকে তাকিয়ে রাগ দেখিয়ে বলল, "ওই তুই
আমার কি করবি শালা মাদার......" কথা শেষ করতে পারলো না
রাজেশ, তার আগেই পেছন ঘুরে জোরে জোরে একের পর একটা রাজেশের মুখে মারতে লাগলো আবির
১টা, ২টা, ৩টা পুরো ১৩টা ঘুষি মারল
আবির । তারপর নিজে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ঠোঁটের নিচের
ঘাম মুছল । রাজেশের নাক দিয়ে রক্ত, ঠোঁট কেটে রক্ত মিশে একাকার, মাটিতে শুয়ে গোঙাচ্ছে আর আবিরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । আবির তখন
রাজেশের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে দুই হাতের তালু এক করে রাজেশকে দেখিয়ে বলল, "নমস্কার ।" তারপর সেখান
থেকে নিজের বেঞ্চে । রাজের পাশে যেয়ে বসলো আবির । রাজ আবিরকে বেশ বাহবা
দিলো । আবির কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে বেঞ্চে রেখে বসতে বসতে একবার রাজেশের দিকে
তাকাল । রাজেশ ততোক্ষণে উঠে বসেছে । আশেপাশে সবাই একবার রাজেশের দিকে, একবার
আবিরের দিকে তাকাচ্ছে । কিছুক্ষণ পরেই ঘণ্টা বেজে উঠলো । তার প্রায় ১মিনিটের
মাঝেই ক্লাসে এলো তুহিন স্যার । চেহারা শ্যামলা, মাঝারি সাইজ, চুলগুলো
বামে সিথি করা, মুখ লম্বা । পড়নে কালো কোট কালো
প্যান্ট । ফিসিক্সের টিচার । স্যার যখন ক্লাসে প্রবেশ করে, রাজেশ
তখন বেঞ্চে বসে রুমাল দিয়ে রক্ত মুছতে থাকে । স্যার ভেতরে ঢুকতেই নজর
যায় তাই রাজেশের দিকে । বইগুলো ডেস্কের ওপর রেখে স্যার নিজের পরিচয় দেয়া শুরু করলো
। যেহেতু আজ
প্রায় ৭০% নতুন শিক্ষার্থী, তাই আজ পরিচয়টা না দিলেই নয় । নিজের পরিচয়
দেয়া শেষে তুহিন স্যার রাজেশের দিকে আঙুল তুলে ঈশারা করে বলে, "তুমি
দাঁড়াও তো ।" রাজেশ দাঁড়ালো । স্যার জিজ্ঞেস করলো, "তোমার নাম?" রাজেশ আবারো নাকে একটু রক্ত আছে
কিনা দেখবার জন্য হাত দিয়ে দেখতে দেখতে
বলল, "স্যার রাজেশ নারায়ণ ।" "ক্লাসে আসার সময়
দেখলাম তুমি নাকের ও মুখের কাছ দিয়ে রক্ত মুছছো, কি হয়েছিল?" আবিরের পেছনে বসে ছিল শিমুল । ভয় পেয়ে আবিরের কানের
কাছে ফিস ফিস করে বলল, "ভাই এইবার কি হইব?" রাজেশ
পেছনে তাকাল । তারপর আবিরের
দিকে তর্জনী উঁচিয়ে ধরল । শিমুল ভয়ে হালকা কেপে উঠলো, যদিও ওর এতে কোন হাত নেই । আবিরও বুঝল, ওকে
স্যার এখন কিছু বলবে, অবশ্য আবির এতে ভয় পাচ্ছে না । আশেপাশের সবাইও
বুঝতে পারছে, আবিরকে দেখাবে রাজেশ,
কিন্তু পরক্ষনেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে রাজেশ বলল,
"পেছনের দেয়ালের বেঞ্চে পা লেগে পড়ে দেয়ালের সাথে জোরে মুখে
আঘাত লেগে রক্ত পড়েছিলো ।" সবাই অবাক হল বটে, বেশি অবাক কিন্তু আবিরই হল । রাজ আবিরের
কানে কানে বলল, "এই, পাগল নাকি ছেলেটা?"
আবির রাজের কথা শুনতেই পায়নি । ও এক মনে রাজেশের দিকে
তাকিয়ে । তুহিন স্যার একটু হেসে বলল, "ও আচ্ছা, তাই
বলো । সাবধানে হাঁটাচলা কোরো । বসো । রাজেশ বসলো । বসার সময় নিজের নাকে হাত বোলাতে বোলাতে একবার আবিরের দিকে
ঘুরে তাকাল ।
টিফিন পিরিয়ডে আবির
ক্যান্টিনের পাশে দাড়িয়ে খাচ্ছিল । দুটো কেক পিস কলেজ থেকেই ফ্রিতে খাওয়ার জন্য দেয়া থাকে, তারপরও
যদি কেউ কিছু খেতে চায়, কিনে খায় । আবির খেয়াল করে
দেখল, সব কিছুতে নতুনদের টাকা গ্রহন করা হলেও ক্যান্টিনে দু পিস কেক ফ্রিতে ঠিকই
দেয়া হচ্ছে, ব্যাপারটা খারাপ না, তবে
খারাপ লাগলো ওরা বাড়তি আরও অনেক দামি দামি কিছু খাচ্ছে আর আশেপাশে ছেলেমেয়েরা
তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে । যদিও এমনভাবে দেখছে যেন কেউ দেখতে না পায়, কিছু
আবিরের চোখ এড়াতে পারলো না । ওদের কাছেও টাকা আছে, ক্কিন্তু সেই টাকা যদি এখানেই শেষ করে,
পড়ে তো সমস্যায় পড়তে হতে পারে, কখন কোন বিপদ
আসে বলা যায় না । ওদের মা বাবার তো অনেক টাকা, আর এদের তো মাত্র ১০০০,
তাও প্রতি মাসে পায় । চারপাশে তাকিয়ে দেখতে দেখতে আবিরের নজরে
এলো রাজেশক্কে । ক্যান্টিন থেকে অনেকটা দূরে দাড়িয়ে বার্গার খাচ্ছে । আবির নিজের
কেকপিসটা খাওয়া শেষে সেদিকেই এগিয়ে গেলো । আবিরকে দেখে রাজেশ কিছুক্ষণ আবিরের দিকে
তাকিয়ে রইল । আবির জিজ্ঞেস করলো, "তুই
স্যারকে মিথ্যে বললি কেন?" রাজেশ আবার খাওয়ায় মনোনিবেশ
করলো । বলল,
"শত্রুকে এতো তাড়াতাড়ি, হারায় ফেলতে চাই
না ।"
আবির
একটু হাসল । বলল,
"যদি সত্যি শত্রু ভাবিস, আশা করি আমার
দুর্বলতাটাও এতক্ষণ জেনে গেছিস?" রাজেশের খাওয়া শেষ । রুমালটা দিয়ে
মুখ মুছে রুমাল পকেটে রাখতে রাখতে বলল, "আবিরের ভালো শত্রু রাজেশ, আর ভালো বন্ধু রাজ, তাইনা?" আবির অবাক হল । জানলো কি করে?" রাজেশ বলল, "জানি জানি, ছেলে তোরে তো তোরে মারছিলাম বলে আমারেও
মারতে আইসতে চাইলো, তা তোর বাকি দুই বন্ধুখান বাধা দিয়ে দেলে
।"
আবির
কিছু বলল না । রাজেশ তখন আবিরের দিকে বাজে দৃষ্টিতে
তাকিয়ে বলল, "মনে রাখিস, তুই স্কুলে ফ্রিতে
পরিস, তোর পরিচয় নেই, তুই বলতে পারবি
না, তুই অমুকের ছেলে, তমুকের ছেলে,
কিন্তু আমি বলতে পারবো, আমি কার ছেলে, তাই নিজের জায়গাটা বুঝে কাজ করিস ।" রাজ চলে
যাচ্ছিলো, এমন সময় আবিরের কথা শুনে থেকে গেলো । "আমি
আবির, আমি বাংলাদেশের নাগরিক, আমি এই
ভেকুটিয়া স্কুলের ছাত্র, আমি রাজ, জামি,
শিমুল, পরশ, নিশির
ফ্রেন্ড । এবং সবচেয়ে বড় কথা, আমি মানুষ, এটাই আমার
পরিচয় ।"
রাজেশ
আবারও চলে যাচ্ছিলো, আবিরের প্রশ্নে আবারো থেমে গেলো, "তা
তোর অমানুষ পরিচয়ের বাইরে অমুকের ছেলে তমুকের ছেলে পরিচয়টা তো বললি না?"
রাজেশ আবিরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, "আমি রাকেশ নারায়ণের ভাই ।" আবির ভ্রু কুঁচকে ঠিক চিনতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, "রাকেশ
নারায়ণ?" রাজেশ হালকা হেসে বলল, "তোদের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপ্যাল রাশেদ স্যার রে বইলে দেখিস ।" বলে রাজেশ সেখান
থেকে চলে গেলো । আবির অনেকটাই অবাক হল । রাকেশ নারায়ণটা আবার কে? এমনভাবে
বলল যেন সবাই চেনে । কিন্তু এই এলাকায় এতদিন ধরে আছে সবাই, তাও এই
রাকেশ নারায়ণকে চেনে না?
(১৩)
"উফ, আজকে ক্লাসটা একদমই বাজে গেলো, আমি বুঝলাম না,
অনাথ আশ্রমের স্কুলে এদের নেয়ার কি দরকার ছিল?" ফাঁকা ক্লাসরুমে একটা বেঞ্চের ওপর বসে আবিরকে কথাগুলো বলছিল রাজ । আবির তখন বোর্ড
মুছছে । ক্লাসে আর কেউ নেই । বাইরে দিয়ে
কিছু ছেলেমেয়ে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর । রাজের প্রশ্নের জবাবে আবির বলল, "কি
জানি, আমাদের রাশেদ স্যার মনে হয় এই সরকারী টাকায় খেতে-টেতে পারছে না । তাই হয়তো এদের টাকা দিয়ে ভর্তি করিয়ে টাকা পাওয়ার নতুন
ধান্দা করছে ।"
রাজ
বলল,
"কিন্তু আমাদের রাশেদ স্যার তো এরকম না, উনি
তো এরকম করার মানুষ না?" আবিরের বোর্ড মোছা প্রায় শেষ । নাম ডাকার
খাতাটা নেয়ার জন্য ডেস্কের দিকে যাচ্ছিলো, এমন সময় অচেনা একটা কণ্ঠে দাড়িয়ে গেলো আবির
। "ঠিক বলেছো ।" আবির পেছন ফিরে তাকাল । ইনি আর কেউ নন, সেদিনের
সুমন স্যার । স্যার বলে সম্মানার্থে রাজও উঠে দাঁড়ালো । আবির বলল, "আসসালামু
আলাইকুম স্যার, আপনি?" সুমন স্যার
ভেতরে এলো । রাজ মাঝের দিকের বেঞ্চগুলোর কোনটায় বসেছিল, সুমন
স্যার এসেছে বলে কাছে এগিয়ে এলো । সুমন স্যার আবিরের কাছে এগিয়ে এসে বলল, "তোমার
বন্ধু ঠিক কথা বলেছে । আমাদের রাশেদ স্যার কিন্তু এরকমটা মোটেও নন । কিন্তু ইদানীং
কালে উনাকে কেমন অন্যরকম লাগছে ।" রাজ জিজ্ঞেস করলো, "তাহলে কি উনি পাল্টে গেলেন?"
সুমন স্যার সে প্রশ্নের জবাব না দিয়েই আবিরকে বলল, "তোমাদের একটা কথা বলি, আমি জানি না কতোটুকু সত্য,
কিন্তু আমার মনে হয় তোমাদের রাশেদ স্যারকে কেউ জোরজবরদস্তি করেছে
এরকমটা করার জন্য ।" "কিন্তু কেন?" জিজ্ঞেস করলো আবির । "জানি
না । কিন্তু তোমাকে জানতে হবে!" আবির অবাক হল । বলল, "আমাকে?"
সুমন স্যার আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, "হ্যাঁ, তোমাকে!" স্যার এর
চোখে মুখে একটা আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠছে যে সে বিশ্বাস করে আবিরই পারবে । সুমন স্যার বলল, "আবির,
শেষবার তুমি যেভাবে বুদ্ধি খাটিয়ে আসল খুনিকে খুঁজে বের করেছো,
ওটা বেশ কঠিন একটা কাজ ছিল, যা তুমি পেরেছো । এখন আমার
বিশ্বাস তুমি এটাও পারবে ।" আবির বলল, "কিন্তু সে সময় খুনিকে আমি আগে থেকেই সন্দেহ করেছিলাম, এবার
তো সন্দেহের কেউ নেই!" সুমন স্যার বলল, "খুঁজে পাবে আবির, ইনশাল্লাহ খুঁজে পাবে । সেদিন তোমাকে আমি বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু
বলিনি । কিন্তু আজ তোমাকে সবটা জানালাম ।" রাজ জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা স্যার, রাশেদ স্যারকে কি সন্দেহ করা যায়?"
সুমন স্যার কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল । তারপর ডানে বামে মাথা
নেড়ে বলল,
"বুঝতে পারছি না । তবে এটুকু বলতে পারি, যা
হচ্ছে ভালো হচ্ছে না । তোমার কি মনে হয় আবির?" আবির কোন জবাব দিলো
না । ওর মাথায় সেই নামটা আবার ফিরে এলো, রাজেশ নারায়ণের ভাই, রাকেশ
নারায়ণ । আবির জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা স্যার, রাকেশ
নারায়ণ কে? চেনেন কি?" সুমন স্যার
নামটা মুখে দু'তিনবার বির বির করে বলল । তারপর বলল, "না
তো্ এরকম নামতো আগে কখনো শুনিনি? আমি ২বছর ধরে এই কলেজে আছি,
অথচ এই নাম আমি কখনো শুনি নি ।" সুমন স্যার হয়তো
আরও কিছু বলতো কিন্তু এমন সময় দরজায় আরেকটা ডাক, "কীরে সুমন?"
"আরে ওইটা না, ডানে পাকা আমটা দ্যাখ গাধা!" হোস্টেলের পেছনে
বড় আম গাছটার ওপর বসে আম পারছিলো শিমুল আর নিচে দাড়িয়ে ছিল পরশ আর নিশি । পরশকে একটা আম
ইতোমধ্যে দিয়েছে , তা নিশিকে দিতে গিয়ে নিশিই বলছিল শিমুলের ডানে ঝুলে থাকা একটা
পাকা আম দেয়ার কথা । সেটা পেরে নিশির হাতে দিয়ে নিজেও একটা আম পেরে গাছ থেকে
নেমে এলো শিমুল । শিমুল আর নিশি পেয়েছে পাকা আম আর পরশ চেয়েছিল কাচা, কিন্তু
পারার পর দেখল, আধপাকা । আম খেতে খেতে পরশ বলল, "আরে
শালা! তোরে কইলাম কাচা দিতে দিলি আধপাকা । আধপাকা কি
ভাল্লাগে?"
শিমুল বলল, "আমি কি তাইলে এখন ভেতরে
খুইলা খুইলা চেক কইরা দেখমু কোনডা কাচা কোনডা পাকা?" পরশ
বলল, বাইর থেইকা দেইখা বুঝস না?" নিশি
বলল, "আরে থাম, দুই বান্দরের
প্যান প্যানানি শুরু । আবির আর জামি কই?" পরশ জবাব দিলো, "আবির আর রাজ ক্লাস রুমে, জামি আর নাবিলা দোকানের
দিকে গেছে ।" নিশি বলল, "আবির তো আবার ক্যাপ্টেন মানুষ,
তার লগে রাজ আবার ওর জানের দোস্তো । কিন্তু এই নিশি আবার
দোকানে কি করতে গেছে?" শিমুল বলল, "কি জানি,
ওর নাকি কি সব কেনা লাগবে একটু তাই ।" পরশ গুন গুন করে
একটা ইংলিশ গান ধরেছে অনেকক্ষণ ধরল । নিশি বলল, "আজকে
মেজাজটাই খারাপ হইয়া গেছে ।" শিমুল জিজ্ঞেস করলো, "কেন?" "আর কইস না, ক্লাসে একটা মেয়ের লগে বন্ধুত্ব করার
জন্য হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়ায় দিলাম, ঢঙ্গী মাইয়া কয়
ধোরো না! ধোরো না আমার স্ট্যাটাস অনেক হাই! ইচ্ছা করতেছিল চুলগুলো টাইনা দেখায় দেই আমার স্ট্যাটাস কতো হাই!"
পরশ হঠাৎ গান গাওয়া থামিয়ে দাড়িয়ে গেলো । পরশকে দাঁড়াতে
দেখে জামি আর নিশিও দাড়িয়ে গেলো । নিশি জিজ্ঞেস করলো, "কিরে? দাঁড়ায়
গেলো ক্যান?" পরশ কিছু বলল না । সামনের দিকেই
তাকিয়ে আছে । পরশকে দেখে নিশি আর শিমুলও সেদিকে তাকাল । দাড়িয়ে আছে ওদেরই
পরিচিত ক্লাস টু এর একটা ছোট মেয়ে । ওরা চেনে, মেয়েটার নাম পরী । যেমন নাম, তেমনি
চেহারা । মেয়েটার পরী স্কুল শেষেই বোধ হয় বাড়ি ফিরছিল । সে সময়ই দাড়িয়ে
গেছে । নিশি আর শিমুল কিছু বলার আগেই পরশ সেদিকে দৌড়ে গেলো । পিছে পিছে নিশি আর
শিমুলও এগিয়ে গেলো । পরশ হাঁটু গেড়ে মেয়েটার পাশে বসলো । জিজ্ঞেস করলো, "কি
হল পরী?" পরীর চোখে মুখে বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট বোঝে
যাচ্ছে । আঙুল তুলে সামনের দিকে ঈশারা করলো । ওরা তিনজন পরীর আঙুল
বরাবর সামনের দিকে তাকাল । যা দেখল, তা দেখে ওদেরও মন বিষণ্ণ হয়ে গেলো । নতুন যেসব
ছেলেমেয়ে এসেছে টাকা দিয়ে পড়ছে, যারা এতিম না, তাদের
মা কিংবা বাবা এসেছে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য । ছেলেমেয়েগুলো কতো হাসি
খুশি । মা বাবারাও ওদের চিপস কিনে দিচ্ছে, চকলেট কিনে দিচ্ছে, জুস
কিনে দিচ্ছে । ছেলেমেয়েগুলো বাবা কিংবা মায়ের হাত ধরে স্কুল গেইট দিয়ে
বের হয়ে যাচ্ছে । কেউ কেউ কথা বলছে । খুব সম্ভবত নতুন স্কুলের ওদের প্রথম দিন
কেমন গেলো সে বিষয়ে । হঠাৎ পরী পরশকে বলল, "পরশ ভাইয়া, আমরা
এতিমরা খুব অসহায় তাই না?” পরশ পরীর দিকে তাকাল । পরী আবারো বলল, "আজকে
জানো, আমার পাশে একটা মেয়ের পেন্সিল বক্স দেখলাম । কতো দামি একটা
পেন্সিল বক্স, আর আমরা প্রতি বছর একটা করে পেন্সিল বক্স পাই । তাও কেমন কেমন । ভালো না । আমাদের মা বাবা
থাকলে ওরকম পেন্সিল বক্স কিনে দিত তাই না?" পরশ কিছু বলল না ।শিমুল আর নিশিও
মনও বিষণ্ণ হয়ে গেলো । পরশ পরীকে জড়িয়ে ধরল । পরীও পরশকে জাপটে ধরে
প্রায় কেঁদে ফেলল ।
ডাক শুনে পেছন ফিরে
তাকাল সুমন স্যার । দাড়িয়ে আছে বকর স্যার । সুমন স্যার
জিজ্ঞেস করলো, "এইতো, যাচ্ছি ।"এরপর সুমন স্যার
আবির আর রাজের দিকে তাকিয়ে "আমি যাই তাহলে ।" বলে চলে গেলো । আবির আর রাজ
স্যার চলে যাবার সময় সালাম জানালো, স্যার ও যেতে যেতেই জবাব সিল । রাজ তখন আবিরকে
জিজ্ঞেস করলো, "কিরে তুই আবার এই রাকেশহ নারায়ণ নামটা কোত্থেকে শুনলি?"
আবির নাম ডাকার খাতাটা নিয়ে এসে বলল, "রাজেশ
নারায়ণের কাছ থেকে । চল এবার যাই ।" রাজ আরও অনেক প্রশ্ন করলো, সেসব প্রশের জবাব দিতে
দিতেই ওরা বেড়িয়ে এলো । নাম ডাকার খাতাটা টিচার্স রুমে দিয়ে এসে হোস্টেলের দিকে পা
বাড়াল ।
এই নাবিলা দোকান থেকে যা
কেনার কিনে জামি সাথে হোস্টেলের দিকে আসতে লাগলো । জামি বলল, "এই
নাবিলা! তুই কিন্তু কামডা ত্থিক করলি না । আমারে কিছু না
খাওয়াইয়াই যাইতেছোসগা !" নাবিলা আড়চোখে জামির দিকে তাকিয়ে বলল, "মোটার ঘরের মোটা, তুই আগে ওজন কমা । পর দেখা যাইবো, কি করা
যায় ।"
"তুই আমারে নিয়া আসার সময় কইছিলি কিছু খাওয়াবি ।" নাবিলা বিরক্ত
হয়ে বলল,
"থামনা ভাই! এমনতেও ট্যাকা পয়সা কম,
তার ওপর সামনে রোজার মাস শুরু হইয়া যাইতেছে । ঈদের জন্যও তো
কিছু রাখা লাগবো নাকি?" জামি আর কিছু বলল না । নাবিলা বুঝল বেচারা
জামি রাগ করেছে । নাবিলা হঠাৎ আবার দোকানের দিকে ঘুরে বলল, "আচ্ছা,
তুই এইহানেই দাড়া, আমি কিছু আনতেছি ।" বলে নাবিলা আবার
দোকানের দিকে গেলো । জামি ওখানেই দাড়িয়ে রইলো । দোকানে যেয়ে পকেট থেকে
পঁচিশ টাকা বের করে ফিরে ভেতর একটা কাপ আইসক্রিম দেখিয়ে দোকানদারকে বলল, "আঙ্কেল,
ওই আইসক্রিমটা দেন তো ।" দোকানে আরেকটা
মেয়েও ছিল । সেও এই স্কুলে আজ প্রথম এসেছে, টাকা দিয়ে পড়বে । নাবিলা ক্লাসে
দেখেছে ওকে । নাবিলা আইসক্রিম নিয়ে চলে আসছিলো, এমন সময়
মেয়েটা নাবিলাকে ডাকল, "হাই!" নাবিয়া চলে আসছিলো, মেয়েটার ডাক শুনে পেছন ঘুরে
তাকাল । দেখল,
মেয়েটা হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে । ঠোঁটের কোণে
হাসি । মেয়েটা বলল, "আমি রিতা ।" নাবিলা মেয়েটার
সাথে হ্যান্ডশেক করলো । বলল, "আমি নাবিলা ।" রিতা বলল, ও,
ওয়াও । তুমি তো ক্লাস টেনেই, তাই না?" নাবিলা উপর নিচে মাথা নাড়ল । রিতা বলল, "আমাকে
দেখেছিলে কি?" "হ্যাঁ দেখেছি, কিন্তু কিছু বলিনি । আসলে কিছু ছেলেমেয়ে এমন করছিলো, যে নতুন
কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করে নি । কিছু মনে কোরো না ।" রিতা একটু হেসে
বলল,
"না না, মনে করবো কেন? আসলে এই ছেলে মেয়েগুলো খুব খারাপ । এদের বাপ না হঠাৎ করেই
বিশাল টাকার মালিক হয়েছে তো, তাই ওরা এরকম । নিজেদেরকে খুব বড় মনে
করে ।"
নাবিলা
বলল,
"ও আচ্ছা । তুমি কি এখানকার স্থানীয়?" রিতা
বলল, "হ্যাঁ । আমি জন্ম থেকেই এখানে
থাকি । আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ।" নাবিলা জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা, এই
এলাকার লোকজন হঠাৎ করে বড়োলোক হল কেন?" রিতা বলল,
"সে তো অনেক বড় কাহিনী, আমার বলতে সময় নাই, কিন্তু তোমার সময় হবে কি না! শুনবে?" নাবিলা একটু হেসে বলল, "বলো, শুনি ।" রিতা বলতে শুরু করলো, "তুমি নিশান জব্বারের নাম শুনেছো?"
নাবিলা একে চিনত । ইনি এখনকার মেয়র । নাবিলা বলল, হ্যাঁ
চিনি তো । উনারই জন্যই তো এখানকার এতো উন্নতি, উনার জন্যই
তো আমরা এতো ভালো একটা স্কুল পেয়েছি ।" রিতা বলল, "হ্যাঁ
। উনি । উনার বাবা ছিলেন । কাশেম আহমেদ । ওই কাশেম আহমেদ উনিই কিন্তু তোমাদের
হোস্টেলগুলো আগে তৈরি করেছিলেন । আমি আমার বাবার কাছ থেকে শুনেছি । কাশেম আহমেদের এই নিশান
জব্বার বাদে যে বাকি ছেলেমেয়ে তারা সবাই বিদেশে পাড়ি জমালেও......" বলতে যাচ্ছিলো রিতা এমন সময় নাবিলা বলল, "হ্যাঁ,
এসব তো শুনেইছি!" রিতা তখন একবার
দোকানদারের দিকে তাকাল । দোকানদার মোবাইল চালাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু
কান রিতার কথার দিকে । রিতা বলল, "দোকানে অনেক গরম, চলো, বাইরে যেতে কথা বলি ।" নাবিলা বলল চলো ।" রিতা নাবিলাকে
নিয়ে একটা নির্জন জায়গায় গেলো । দোকান থেকে তেমন বেশি দূরে না, ১
মিনিটের রাস্তা । রিতা বলল, "ভুল শুনেছ । এটা বানোয়াট ।" নাবিলা বলল, "মানে?"
রিতা বলল, "আমার বাবা কাশেম আহমেদ যখন
বয়স্ক ছিল, তখন কাশেম আহমেদের প্রেশার চেক করতেন । আমার বাবা
শিক্ষক, কিন্তু উনি প্রেশার মাপতে পারেন । তাই যেতেন । তখন শুনেছিলেন, কাশেম
আহমেদের বড় মেয়ে বিদেশে যায় নি ।" নাবিলা মন দিয়ে শুনতে লাগলো । রিতা বলল, "উনার বড় মেয়ে ছিল খুব বদ মেজাজি আর
ছোটবেলা থেকেই সব নিজের করতে চাইতো । মেয়ের নাম আলেয়া । বড় হয়ে বিয়ে করে এক
হিন্দু ছেলেকে । এ জন্য কাশেম আহমেদ তার বড় মেয়েকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন । ধীরে ধীরে ছোট
ছেলে নিশান বাদে বাকি ছেলে মেয়েগুলোও যখন চলে যায়, তখন কাশেম আহমেদ মানসিকভাবে
ভেঙ্গে পড়েন । এলাকার উপকার আর করবেন কি, নিজের পরিবারের চিন্তায়ই
উনি বিভোর থাকতেন । ফলে এলাকার মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে বিপক্ষ যে প্রার্থী ছিল, তাকে
পরবর্তী নির্বাচনে জয় লাভ করায় । এদিকে ছোট ছেলে নিশানও কি কারণে চাকরিটা
হারিয়ে ফেলে । অন্যদিকে উনার বউয়েরও হঠাৎ একদিন টিউমার ধরা পড়ে । সেটা চিকিৎসা করতে
বাধ্য হয়ে জমিজমা কম দামে বিক্রি করে টাকা জোগাড় করতে হয় উনার ।" নাবিলা বলল, "ও,
এইজন্য সবাই সে সময় আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল?" রিতা বলল, "হ্যাঁ, সে
অনেক আগের কথা, কিন্তু বংশের সুত্র ধরেই এখনকার ছেলেমেয়েরাও
নিজেদের বড় বড় ভাবে । উনার ছোট ছেলে বলেছিল এই এতিমখানার জমিট কারো কাছে বেচতে, কারণ এই
জমির দামও অনেক, সাথে বিদেশি অনেকেও বলেছিল এই জমি কখনো
বিক্রি করলে জানাতে । কিন্তু জমিদার কাশেম আহমেদ সেটা বিক্রি করেন নি । আল্লাহর রহমতে
যা টাকা পেয়েছিলেন, তাই দিয়ে উনার স্ত্রীর চিকিৎসা হয় । শেষে উনি সিদ্ধান্ত নেন পরবর্তী ভোটে উনার
ছেলে নিশানকে দাঁড় করাবেন । নিশান জব্বারকে এলাকার সবাই অনেক ভালবাসতো, তাই
পরবর্তী নির্বাচনে এই নিশান জব্বারই জয়ী হন
। কিন্তু আমার বাবা একটা ব্যাপার জেনেছেন ।" নাবিলা বলল, "কি?"
"ওই যে কাশেম আহমেদের মেয়ে আলেয়া, ওর
স্বামী মাঝে মাঝেই নাকি হুমকির চিঠি পাঠায় এই নিশান জব্বারকে । যেন এই
এতিমখানার জমিটা দিয়ে দেয় । নিশান জব্বার কাউকে জানান নি এলাকার মানুষ ভয় পাবে এটা
ভেবে । কিন্তু উনি এখন এই বিষয়ে চিন্তায় আছেন । পড়ে রাশেদ স্যার যখন
উনাকে বললেন, এলাকার ছেলেমেয়েদেরকেও এই এতিমখানার স্কুলে পড়ার সুযোগ দেয়া
হোক, তখন নিশান জব্বার ভাবলেন খারাপ না, বেশি ছাত্র ছাত্রী হলে ওই লোক ঝামেলা করতে পারবে না হয়তোবা ।" নাবিলা জিজ্ঞেস
করলো,
"আচ্ছা, এই আলেয়ার স্বামীর নাম কি?"
রিতা বলল, "আলেয়ার স্বামীর নাম প্রদেশ
নারায়ণ, তার বড় ছেলে রাকেশ নারায়ণ আর ছোট ছেলের নামটা ঠিক
জানি না । কিন্তু আমাদের স্কুলে জানতো.........।" বলতে যাচ্ছিলো
রিতা, এমন সময় মনে হল দূর থেকে কেউ ওকে ডেকে উঠলো, "এই
রিতা!"
রিতা চমকে পেছন ফিরে
তাকাল । দূরে রাস্তায় ওর বাবা দাড়িয়ে । রিতা পেছন ফিরে তাকাতেই রিতার বাবা বলল, "বাড়ি
চল মা, দেরি করছিস কেন?" রিতা বলল,
"যাই বাবা!" এরপর নাবিলার দিকে
তাকিয়ে বলল, "আমায় যেতে হবে রে, আমি
যাই ।"
যেতে
যাচ্ছিলো, আবারো পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল, "আর শোনো, এসব কথা তুমি প্লিজ কাউকে বোলো না ।" নাবিলার ডানে
মাথা হালকা কাত করলো, কিছু বলল না । নাবিলার মাঝে কেবলই একটা অবাক দৃষ্টি । তাকিয়ে দেখল, রিতা
বাবার কাছে গেলো, রিতার বাবা রিতাকে একটু আদর করলো । রিতা একবার
ইশারা করে ওর বাবাকে নাবিলাকে দেখিয়ে কি যেন বলল
। বোধ হয় নতুন বন্ধু, তাই বলছিল । তারপর সাইকেলের
কেরিয়ারে চড়ে চলে গেলো বাসার দিকে । রিতা একবার নাবিলার দিয়ে হাত নাড়িয়ে বাই বলল । নাবিলাও হাসি
মুখে নাত নাড়িয়ে জবাব দিলো । এমন সময় খেয়াল করলো, জামির জন্য যে আইসক্রিম কিনেছিল, তা গলে গেছে ।
(১৪)
চেয়ারের ওপর ব্যাগটা
রেখে ইঙ্কটা খুলে শার্টের ওপরের দুটো বোতাম খুলে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো
রাজ । আবির ওর ব্যাগটা রাজের পড়ার টেবিলে রেখে বিছানার একপাশে বসলো । আবির বলল, "তোরে
ডিস্টার্ব করতেছি না তো?" রাজ আবিরের পিঠে একটা লাঠি
মেরে বলল, "এতো ঢং করলে যা ভাগ! আমার
রুমেইতো আইছোস, এতো ভদ্রতা দেখানোর কি আছে! আজিব তুই আসলেই ।" আবির হালকা হেসে বলল, "না, এখন গোসল
খাওয়া-দাওয়ার একটা ব্যাপার আছে না, তার
ওপর আজ স্কুল থেকে আসতেও লেট হয়ে গেলো ।" রাজ ডান দিকে
কাত হয়ে ডান হাতের ওপর মাথা রেখে বলল, "আলতু ফালতু কথা না বইলা কি কইতে আইলি
তাই ক।"
আবির
কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল । তারপর বলল, "আচ্ছা, তোর কি
মনে হয়, আমাদের রাশেদ স্যার কি এরকম কিছু করতে পারে?"
রাজ একটু ভেবে বলল, "স্যাররে এই কয়েকদিনে
যা দেখলাম, তা দেইখে তো মনে হয় না স্যার এরকম মানুষ, তবে, একটা কথা সত্য, স্যার
কিন্তু কেমন কেমন ।" আবির বলল, "কেমন কেমন বলতে?" "ঠিক জানি না, তবে যেন এমন, কেউ
যদি উনার সামনে কোন কিছুর ত্রুটি তুলে ধরে, উনি ওটাই মেনে
নেন, আবার পড়ে যদি কেউ এই ত্রুটির বিপক্ষে কথা বলে, উনি সেটাও মেনে নেন । মানে যে কূলে আরাম, সে কূলে উনি ।" আবির একটু হাসল । বলল, "তোর
কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না । শুধু এটুকুই বুঝলাম, যে কূলে
আরাম, সে কূলে উনি । শুধু রাশেদ স্যার-ই না
কিন্তু, অন্যান্য মানুষের ক্ষেত্রেও কিন্তু কথাটা খাটে ।" রাজ প্রশ্ন করলো, "যেমন?"
আবির উঠে দাড়িয়ে রুমের মধ্যে পায়চারি শুরু করে বলতে লাগলো,
"যেমন ধর, একটা মানুষ, সে যে কাজটা করলে তার লাভ হয়, কিংবা যে কাজটা করলে
তার মনের আনন্দ হয়, সেটাই কিন্তু সে করে কখনো কখনো সেটা ভয়ে
ভয়ে, কখনো কখনো সেটা আনন্দের সাথে ।" রাজ প্রশ্ন করলো, "শেষ
কথাটার মানে ঠিক বুঝলাম না" আবির জবাব দিলো,
"দ্যাখ, আমি এখন তোরে বললাম, নাবিলারে একটা কিস কর, তুই কিন্তু মনের আনন্দে ওরে
কিস করবি । কারণ এটা তোর কাছে একটা আরামের কারণ ।" রাজ হেসে বলল, "ভাইরে
ভাই! যা মেকআপ করে, ঠোঁটের মধ্যে আটা
ময়দা লাইগা থাকবে ।" আবির রাজের ইয়ার্কির কোন জবাব না দিয়ে বলল, "আর
ধর আমি তোকে বললাম আমারে একটা কিস করতে, তা না হইলে আমি তোরে
খুন কইরা ফেলমু । এখন ব্যাপারটা কিন্তু তোর কাছে খুবই কষ্টকর, কিন্তু
তোর কাছে আর কোন উপায় নাই, কারণ না করলে তুই মরবি । তাই আরাম পাইতে
হইলে একটু কষ্ট পাওয়ার ব্যাপারটাকেই আমি ওভাবে বললাম আর কি ।" রাজ আবার চিত
হয়ে শুয়ে পড়লো । তারপর আবার ইয়ার্কি শুরু, "তুই কি কিস ছাড়া আর
কোন উদাহরণ পাইলি না?" আবির কিছু বলতে যাচ্ছিলো,
এমন সময় বাসায় এলো পরশ । বাইরের দরজা খোলার শব্দ
শুনে আবির রাজের রুমের দরজার কাছে গেলো । আবিরকে দেখে পরশ বলল, "আরে
মামা, তুই তো দেহি এইহানে ।" জুতোটা খুলে
রেখে এসে হ্যান্ডশেক করলো আবিরের সাথে । পরশ জিজ্ঞেস করলো, "কি
অবস্থা?" আবির কিছু বলার আগেই রাজ রুম থেকে আবার
ইয়ার্কি করা শুরু করলো, "ছেলে এখন আমাকে কিস করায়
ব্যাস্ত!" পরশ হেসে দিলো । পাল্টা ইয়ার্কি করে বলল, "হ্যাঁ,
তোরা কিস করতে থাক, আমি জামাটা ছেড়ে আসি ।" আবির বলল, "হ
যা, আমি একটু ঝাড়ুর কাজ করি ।"রাজ আবারও
ইয়ার্কি করে বলল, "করবি? কর তাইলে । আমার রুমে না
ময়লা জইমা গেছে । আজ থেইকে তুই আমার
রুমের বুয়া ।"
আবির
ঝাড়ু নিয়ে রাজকে মারা জন্য এগিয়ে যাচ্ছিলো, পরশও নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিলো, এমন সময় পরশ দাড়িয়ে গেলো । পেছন ফিরে তাকিয়ে ডাকল, "আবির!"
আবির তখন রাজকে ঝাড়ু দিয়ে মারতে
যাবে আর রাজ নিজেকে বাঁচাতে একটা বালিশ দিয়ে নিজেকে আড়াল করেছে, সেই মুহূর্তে আবির পেছন ফিরে তাকাল । পরশের চেহারাটা
মুহূর্তের মধ্যে কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেলো না?
"কিরে? সামান্য ট্রিট চাইলাম বইলা তুই আমারে এতো বড় একখান শাস্তি দিলি?"
অনেকক্ষণ পর নাবিলাকে এইদিকে আসতে দেখে রাগ করে কথাটা নাবিলাকে বলল
জামি । জামি যেখানে অপেক্ষা করছিলো, সেখান থেকে দোকানটা ঠিক দেখা যায় না । নাবিলা কাছে
এসে জামির হাতে আইসক্রিমের প্যাকেটটা দিয়ে বলল, "সরি রে দোস্ত,
একটু দেরি হল ।" জামি বলল, "একটু না, তুই
অনেক দেরি করছোস!" তারপর আইসক্রিমটা খুলতে খুলতে বলল,
"বাই দা ওয়ে, আইসক্রিম তো একটুও ঠাণ্ডা
নাই রে!" নাবিলা আবারো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তখনই জামির কাপ আইসক্রিমের ওপরের ঢাকনাটা খোলা শেষ । বলে উঠলো, "একি
রে! দিলি তো দিলি! তাও গইলা যাওয়া
আইসক্রিম!" নাবিলা জামিকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো আর বলল,
"সরি দোস্ত, এইবারের মতো মাফ কর, পরের বার না গলাটাই দিমুনে ।" জামি তবু থামল না । নিজের মতো করে কথা বলতেই লাগলো । নাবিলা কেমন
নীরবে শুনতেই লাগলো । কিছু বলল না ।
আবির একটা হতাশার দম
ফেলল । ওরও মনটা খারাপ হয়ে গেলো পরশের মুখে পরীর ঘটনাটা শুনে । মন খারাপ হয়ে গেলো
রাজেরও । আবির আর পরশ মুখোমুখি রাজের বিছানায় বসে, আবিরের একটু পেছনে বসে বাবু
হয়ে বসে রাজ । আবির বলল, "দোষটা ওইসব ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের না,
যারা মা বাবাকে নিয়ে যায়, দামি দামি জিনিস
ব্যাবহার করে । ওরা এসব তফাতের কতটুকুই বা বোঝে । কিন্তু সমস্যা ওদের
এখানে আনায় । তাছাড়া একটা এতিমখানার স্কুলে বাইরের ছেলেমেয়েদের ভর্তি করানোটারই কিন্তু কোন
যুক্তি খুঁজে পাই না আমি ।" রাজ পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলো, "এই রাকেশ নারায়ণ কে
এটা জানতে পারলে না বেশ হতো । রাকেশ নারায়ণ আমাদের স্কুলের ওই হারামজাদা রাজেশের ভাই ।" রাজ ভ্রু কুঁচকে
জিজ্ঞেস করলো, "তুই জানলি কি করে?" আবির আজ
স্কুলে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা খুলে বলল সবাইকে ।" পরশ তখন উঠে
দাড়িয়ে বলল, "আচ্ছা দোস্ত, অনেক দেরি হয়ে গেছে
রে, খাবারটা ঠাণ্ডা হয়ে এবার মাছি উড়তে শুরু করবে বোধ হয় ।" আবিরও উঠে
দাঁড়ালো । বলল,
"রাজ দোস্ত, আমিও যাই তাইলে । থাক ।" পরশও নিজের রুমে
চলে গেলো, আবিরও চারতলায় চলে এলো । রাজ "আচ্ছা" ছাড়া
কিছু বলল না । কথাগুলো শোনার পর ইয়ার্কি করার মুডও ছিল না ।
আবির রুমে আসতেই দেখল
শিমুল খাবার টেবিল ছেড়ে কেবলই উঠে যাচ্ছে, আর জামি প্লেটে খাবারের পরিমাণ দেখেই বোঝা
যাচ্ছে কেবলই খেতে বসেছে । আবির জিজ্ঞেস করলো, "কিরে! জামি!
তুই দেরি কইরা খাইতেছোস! সূর্য কি আজ উত্তরে
উঠছে নাকি?" জামি কিছু বলল না । শিমুল শুধু একটু হেসে বলল, "ছেলে মনে হয় ডায়েট
করতেছে ।"
দরজায় নক করবার আওয়াজ
শুনে দরজা খুলল নিশি । দেখল, রাজ দাড়িয়ে । রাজকে দেখে বলল, "আরে দোস্ত তুই?" সময় তখন রাত প্রায় ৮টা । রাজ বলল, "হ্যাঁ
রে । না......।" রাজের কথা শেষই
হল না, নিশি বলে উঠলো, "আপোনার
সিমরান মানে নাবিলা ডায়রি লিখিতেছিলেন, মাত্রই তিনি......এই টয়লেটের সাধু ভাষা কি রে?" রাজ হালকা হেসে
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, "আরে গাধি, ওটা ইংলিশ ভাষা ।" রাজকে ভেতরে ঢুকতে দেখে নিশি ফিসফিসিয়ে বলল, "এই!
করতেছোস কি!" মাইয়াগো হোস্টেলে ঢুকোস
ক্যান?" রাজ নিশির মাথায় একটা চাটি মেরে বলল,
"আরে বাদ দে তো, হুদাই এইসব নিয়ম । কতো মাইয়ারা
পোলাগো আর পোলারা মাইয়াগো হোস্টেলে গেলো ।" নিশি আর কিছু বলল না । বাইরে আর কেউ আছে নাকি, একবার
দেখে নিয়ে দরজাটা আটকে দিলো । রাজ নাবিলার রুমে গেলো । নাবিলা তখন টয়লেটে । ঘরের ফ্যানটা
চলছে । সম্ভবত সেই জন্যই নাবিলা ডায়রিটার ওপর কিছু একটা চাপা দিয়ে গেছে, যেন
পেইজটা উড়ে না যায় । ডায়রিটা খোলাই ছিল । মানুষের ডায়রি পড়ার কিংবা গোপনীয়তা নষ্ট
করার অভ্যেস নেই রাজের, তবুও কাছে যেয়ে না ছুঁয়েই ডায়রিটা একটু পর্যবেক্ষণ করলো রাজ । যেতা দিয়ে ঢেকে
রেখেছে তাতে একটা ওয়ার্ড ছাড়া বাকি সব ঢাকা পড়েছে । এই ওয়ার্ডটাই শেষ ওয়ার্ড
যেটা লিখতে গিয়েই হয়তো নাবিলা ওয়াশরুমে গেছে । লেখা নারায়ণ । নারায়ণ! রাজ
চমকে গেলো । নাবিলা হঠাৎ নারায়ণ লিখতে যাবে কেন? রাজের
ইচ্ছে জাগলো এটা জানার, এর আগে রাকেশ আছে কি না । যে জিনিসটা
দিয়ে ঢেকে রেখেছিল, সেটা খানিকটা সরাল এবং রাজ রীতিমতো তাজ্জব হয়ে গেলো । এতো সত্যি
রাকেশ নারায়ণ লেখা! কিন্তু নাবিলা এর ব্যাপারে জানলো কি করে! রাজ ডায়রিটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগলো ঘটনা ।
"হ্যাঁ রাজ বল ।" ফোনটা রিসিভ করে
কানে নিয়ে বলল আবির পড়ার টেবিলেই বসে, সামনে
কেমিস্ট্রি বইটা খোলা । ফোনের ওপাশ থেকে রাজ বলল, "দোস্ত, তুই একটু তাড়াতাড়ি ছাদে আয়, কথা আছে ।" রাজের গলা শুনে
মনে হচ্ছে কেমন যেন চিন্তিত হয়ে আছে । আবির বলল, "আচ্ছা আমি আসতেছি ।" বলেই ছাদের দিকে
গেলো রাজ ।
"ওই কুত্তা!"
নিশির বাচ্চা!" টয়লেট থেকে বেড়িয়ে নিজের
ডায়রি বন্ধ দেখে এবং ওর ওপর যা দিয়ে ঢাকা ছিল তা দেখে রেগে নিশিকে ডাকল নাবিলা । নিশি অন্য রুম
থেকে এসে বলল, "কি রে ভাই? ডাকোছ ক্যান?"
নাবিলা চোখ গরম করে বলল, "তুই আমার ডায়রি
পরছোস?" নিশি ভ্রু কুঁচকে বলল, "কই না তো!" আশেপাশে রাজকে না দেখে নিশি জিজ্ঞেস
করলো, "রাজ কই?" নাবিলা অবাক
হয়ে গেলো, "রাজ! রাজ আসবে
কোত্থেকে? তুই কি পাগল!" নিশি বলল,
"আরে না, সত্যি ও আইছিলো ।" "কি!" "হ, আমি বারণ করলাম, মেয়েদের
বাসায় আসিস না, তাও ও আইলো । কিন্তু গেলো ক্যান?" নাবিলা
জিজ্ঞেস করলো, "তাইলে ওই-ই কি
আমার ডায়রি পড়ছে নাকি?" নিশি একটু ভেবে বলল,
"হইতে পারে, আমি কইতে পারি না ।"
ছাদে ঢোকার দরজাটার
দিকেই তাকিয়ে ছিল রাজ, দেখার
জন্য আবির কখন আসবে, তাই আবির আসার সাথে সাথেই আবিরের
দিকে এগিয়ে এলো সে । আবির কাছে যেয়ে
বলল,
"কিরে কি হয়েছে?" "আমি রাকেশ
নারায়ণ সম্পর্কে জানতে পেরেছি ।" আবির চমকে গেলো । এই সময় হঠাৎ
করে এইটুকু সময়ের ব্যাবধানে কি করে রাকেশ খানের সম্পর্কে জানতে পারলো? জিজ্ঞেস
করলো, "কোথায় পেয়েছিস?" রাজ
সবটা বলতে শুরু করলো । নাবিলার ডায়রিতে নাবিলা সবটাই লিখেছিল শুধু মাত্র রিতার
বাবা ওকে ডেকে নিয়ে গেলো, এটুকু বাদে । রিতা রাকেশ নারায়ণ
পর্যন্ত লিখেই টয়লেটে চলে যায় । হুবহু আবিরকে বলতে পারবে কি না, তাই
নাবিলার ডায়রির ওই পাতার একটা ছবিও তুলে এনেছে ।আবির সেটাই ভালো করে পড়ে
দেখল । তারপর বলল, "মাই গড! তাহলে কি এই রাকেশ নারায়ণ
নিজের শ্বশুরের সম্পত্তির ভাগ পেতে এখানে ফিরে এসেছে?" রাজ
কোন জবাব দিলো না । আবির রাজের দিকে তাকিয়ে বলল, "কিন্তু আমি এটা
বুঝলাম না, সম্পত্তি নেয়ার সাথে এই এতিমখানায় ছেলেমেয়ে ভর্তি
করানোর সম্পর্ক কি?" রাজ ডানে বামে মাথা নাড়ল । বলল, "আমি
কিচ্ছু জানি না । শুধু এটুকুই ভাবছি, ওই রিতা নামের মেয়েটা আবার কে? এর উদয় কোত্থেকে হল?" "তার মানে তুমিই
আমার ডায়রি পারমিশন ছাড়া পড়েছ, তাই না?- হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠে ছাদের দরজার দিকে তাকাল আবির ও রাজ দুজনেই । দাড়িয়ে আছে
নাবিলা আর নিশি ।
"হ্যালো! হ্যাঁ, আচ্ছা, আরে ধুর! এতো চিন্তার কি আছে, কাল দিস, আচ্ছা, প্যারা নিস না ঠিক আছে । রাখি ।" ক্লাস নাইনের
একটা ছেলের কাছে ৫০ টাকা পায় পরশ । আজ দেবে বলেছিল
কিন্তু পারে নি বলে পরশকে ফোন দিয়ে জানালো । ফোনটা অফ করে বইয়ের দিকে মন দিতে যাচ্ছিলো, এমন সময়
মনে পড়লো পরীর কথা । আহারে, মেয়েটা যে কি কষ্ট পেয়েছে । এমনিতেই ছোট
মানুষের চেহারায় আলাদা একটা মোহ থাকে, ওরা হাসলে দেখে নিজেদের খুব হাসি পায়,
ওরা রাগলেও বেশ মজা লাগে । কিন্তু যখন কাঁদে? না । পড়ায় আর মন বসে
না । নিচে দিয়ে একটু ঘুরে এলে খারাপ হয় না । পরশ বাইরে বেড়িয়ে নিচে নামলো । নামবার সময়
রাজকেও ডাকতে চাইলো, কিন্তু ছিটকিনি দেখে বুঝল, রাজ ভেতরে
নেই । তাই একাই রওনা হল । সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে ভাবলো কোথায় যাবে? গাইন
পার্কে কিংবা বাইন দ্বীপে চাইলে যাওয়া যায় । কিন্তু এতো রাতে যেতে
ইচ্ছে করছে না । পরীদের হোস্টেলে যেয়ে একটু দেখা করে আসবে কি? না থাক । মেয়েদের
হোস্টেলে ছেলেদের যাওয়া নিষেধ, তার ওপর ছোটদের হোস্টেলে একটা করে
কেয়ারটেকার আছে । যদিও পরশ সিনিয়র, তবুও, ইচ্ছে করলো না । না, তার
চেয়ে বরং ছাদে যাওয়া যায় । ওখানে একটু ঠাণ্ডা হাওয়া পাওয়া যাবে ভালো । পরশ ছাদে
যাওয়ার জন্য হোস্টেলের দিকে ফিরছিলো, কিন্তু একটু হাঁটতেই স্কুল বিল্ডিঙের দিকে
নজর যেতেই থেমে গেলো পরশ । আরে! রাশেদ স্যার না? কিন্তু
রাশেদ স্যার তো এরকম সময় আসে না খুব প্রয়োজন ছাড়া । স্কুলের গেইটের সামনে
দাড়িয়ে পায়চারী করছে । খুব সম্ভবত কারো জন্য অপেক্ষা করছে । পরশ ব্যাপারটাকে তেমন
গুরুত্ব দিলো না । সেদিকে তাকিয়ে থেকেই ছাদের দিকে যাচ্ছিলো । হঠাৎ আবার একটা
ব্যাপার খেয়াল করে দাড়িয়ে গেলো । মনে হল, ভেতর থেকে কেউ রাশেদ স্যারকে ডাকল, আর রাশেদ স্যার স্কুলের ভেতরে চলে গেলো । কার কাছে গেলো স্যার? কোন আয়া
কিংবা কর্মচারী কি? না না, তা কি করে । উনারা তো
সন্ধ্যায়েই বাসায় চলে যায় । থাকে শুধু পাপলু আঙ্কেল আর রিসিপশনের সামনের গেইটের
দারোয়ান । তাহলে কে? স্কুলের ওপাশে তো কোন গেইট নেই, প্রাচির
দেয়া । আর এপাশ থেকে যদি কেউ আসতো তবে পরশ দেখতে পেত । তবে ওপাশে কে ছিল? পাপলু
আঙ্কেল? নাকি দারোয়ান? পরশ এবার পা
বাড়াল পাপলু আঙ্কেলের রুমের দিকে ।
"নাবিলা, আসলে ও......" "আমি আপনার সাথে এবং আপনি আমার সাথে কখনো কথা বলবেন না কথা হয়েছিলো কিন্তু!"-আবির নাবিলাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো, সেই সময় কথাটা বলল নাবিলা । আবির থেকে গেলো । নাবিলা কিছুক্ষণ আবিরের দিকে তাকিয়ে রাজের কাছে গেলো । বলল, "তুমি আমার পারমিশন ছাড়া কেন ডায়রিটা দেখলে?" রাজ বলল, "নাবিলা, বিশ্বাস করো, আমি খুবই ইম্পরট্যান্ট একটা জিনিস দেখেছিলাম যেটা জানা খুব দরকার ছিল ।" নাবিলা ক্ষেপে গিয়ে বলল, "ইডিয়ট! পারমিশন নিতে কি সমস্যা হতো? নাকি আমি ন্যাকামো করে ফিরিয়ে দিতাম?" শেষ কথাটা আবিরের দিকে আড়চোখে কিছুক্ষনের জন্য তাকিয়ে বলল নাবিলা । আবির মাথা নিচু করলো । রাজ বলল, "দ্যাখো নাবিলা, আমি এক্সট্রিমলি সরি যে আমি তোমার ডায়রির লেখাগুলো পড়েছি । কিন্তু বিশ্বাস করো, যা পেয়েছি তা আবিরের অনেক উপকারে আসবে ।" নাবিলা বলল, "তুমি পড়লেও ততোটা রাগ করতাম না । কিন্তু তুমি একে বলেছো কেন?" রাজ বলল, "আরে নাবিলা! যেটুকু বলেছি তাতে তোমার পার্সোনাল কিছুই ছিল না । সো টেনশন কোরো না ।" নাবিলা বলল, "টেনশন তো তোমাকে নিয়ে হয় । বেশি বন্ধু বন্ধু করো না! একদিন দেখে নিয়ো, কোনদিন তোমার এই বন্ধুই তোমার ক্ষতি করে বসে ।" আবির এবার আর কিছু না বলে পারলো না । কাছে এসে রাজের দিকে তাকিয়েই নাবিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল, "রাজ, বন্ধুত্ব কখনোই এরকম না । আসলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এই প্রেম জিনিসটাই ধোকা । সেটা তুই আমি সবাই ভালো করে জানি!" রাজ অবাক আবিরের দিকে তাকাল । ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, "তুই জানোস মানে!" নাবিলাও রাজের দিকে তাকিয়ে বলল, "তুমি জানো মানে!" আবির গলা খাখরে উঠলো । নিশি মাঝখানে এসে বলল, "আরে! থাম না ভাই তোরা! কি শুরু করলি!" নাবিলা নিশির দিকে তাকিয়ে বলল, "আমি প্রমান কইরা দিমু, এইসব বন্ধুত্ব সব ভুয়া । প্রেম আর বন্ধুত্ব কেউ একসাথে করতে পারে না । বন্ধু ঠিকই বাধা দেয়!" মাঝখান আবির আবার বলল, "মিথ্যে কথা, প্রেম আর বন্ধুত্বের মাঝে এই মেয়েগুলা বন্ধুদের সাথে মিশতে মানা করে । বন্ধুরা কিছুই বলে না, উল্টো প্রেমে সাহায্য করে!" নাবিলা রাজের কাছে যেয়ে বলল, "এই! তুমিই বলো! কোনটা সত্যি!" রাজ মুচকি হেসে নিশির পেছনে দাড়িয়ে নিজেকে আড়াল করে বলল আবির যেটা বলছে সেটাই সত্য । নাবিলা আমাকে রাজের সাথে মিশতে নিষেধ করছিলো, কিন্তু আবির আমাকে কখনোই সেরকম বলে নাই, উলটা নাবিলার সাথে প্রেমে সাহায্য করছে।" নাবিল তখন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে জোরে একটা রাগান্মিত শ্বাস নিয়ে "হুহ!" ধরণের একটা আওয়াজ করে বলল, "ঠিক আছে! আমিও প্রমান করে ছাড়বো । আমি প্রমান করে ছাড়বো, তোমরা যে ভালোবাসা দেখাও, এই ভালোবেসে সবটা হয় না!" বলেই সেখান থেকে দ্রুতপায়ে নেমে এলো নাবিলা । নাবিলা চলে গেলে রাজ আবিরকে বলল, "রাগ করিস না দোস্ত, তুই তো ওরে চিনোসই, আবির রাজের কাঁধে হাত রেখে একটু হেসে বলল, "আরে পাগল, রাগ করমু ক্যান? চিল ব্রো ।" এমন সময় নিশি এসে জিজ্ঞেস করলো, "হুম, অনেক হইছে ব্রো, আর রাজ সিমরানের কাহিনী, এইবার আমি কি আক্তু জানতে পারি রাকেশ নারায়ণ আবার কে যাকে নিয়ে তোমাদের এতো মাথা ব্যাথা!" আবির নিশির কথার জবাব না দিয়ে বলল, "দেখেছো কাণ্ড! এশার নামাযটা মসজিদে আর যাওয়া হল না!" রাজ বলল, "আচ্ছা চল, স্কুলের নামাযের রুমে পরমুনে । তারপর একেবারে আমি জিম কইরা তারপর আসমুনে ।" আবির, "হ্যাঁ চল!" বলতেই দুজনে চলে যাচ্ছিলো, পেছন থেকে নিশি বলল, "এভাবে কথা ঘোরাস না! বলে তো যা অন্তত!"