0 %

Thanks a lot for being with us!
We are re-constructing our website!
Sorry for this temporary inconvenience
We are coming to you with a fresh look and design from 1 January 2022!
Till then! Stay connected!

পরিচয় সিজন৪ (পর্ব-৭০-১০০)


পরিচয় (সিজন-৪)
ভুলের নির্ভুলতা






(১)
৭ বছর পরের কথা । সব কিছু অনেক পালটে গেছে । যশোরের ভেকুটিয়া এলাকার পরিবেশও । সেই সাথে পালটেছে আশ্রমের নিয়মকানুন, যুক্ত হয়েছে নতুন ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক শিক্ষিকা আর উন্নত হয়েছে স্কুলের পরিবেশের । গত ১০ বছর ধরে এখানকার যিনি প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন, তিনি অনেক কিছুই করে গেছেন এই আশ্রমের জন্য । শুধু তাই নয়, উনি এই আশ্রমের বাচ্চাদের জন্য একটা সুন্দর স্কুল বিল্ডিং-ও করে দিয়ে গেছেন । ছাদে সবার ক্লাস করতে কষ্ট হয় বলে তিনি এই স্কুল বিল্ডিং তৈরি করেছেন । আর আজ তার বিদায়ের পালা । সবার মনেই তার জন্য অনেক দুঃখ । অনাথ এই ছেলে মেয়েগুলোকে যে পিতৃতুল্য ভালোবাসা এই মানুষটি দিয়ে গেছেন, সে ভালোবাসা সারাজীবনের আয় দিয়েও পরিশোধ করা সম্ভব না । তবে বাস্তবতা হল সবাইকেই কোন না কোন দিন তার কর্মক্ষেত্র থেকে চলে যেতে হবেই । এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই সবাইকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে । কিন্তু এটাও সত্য, সবসময় তো আর ভালো জনই আসবে এমনটা তো না । খারাপ ভালো মিলিয়েই আমাদের এই দুনিয়া । যেহেতু এতবছরের ভালোবাসার একজন মানুষ আজ চলে যাচ্ছেন আর সবাই তাকে শেষ বিদায় জানাবে না? এটা হতে পারে না । সকাল থেকেই স্কুলটা সবাই বেশ করে সাজাচ্ছে । হয়তো অনেকে দেখে আনন্দঘন উৎসব ভেবে ভুল করতে পারে কিন্তু না । এখানে আজ কষ্টের জোয়ার বয়ে বেড়াচ্ছে সকলের মনে মনে । স্কুলের বারান্দায় ফুল লাগানোয় ব্যাস্ত ক্লাস টেনে পড়ুয়া জামি আর শিমুল । একটা ছোট মইতে উঠে দাড়িয়ে শিমুল দেয়ালে দেয়ালে লাগাচ্ছে আর নিচ থেকে সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করে দিক-নির্দেশনা দিচ্ছে জামি । হাত দিয়ে ঈশারা করে বার বার বলছে, "লাল ফুলডি ওই দেয়ালে........., হ । গোলাপডা উপরে দে.........না ওইডি ওইহানে দিস না, বাজে লাগবো দেখতে.........ধুরু! কইলাম না, না লাগাইতে!" এই আর শিমুল বেচারা তো কাজ করছে । মনে মনে হালকা বিরক্তও হচ্ছে । কাজের ফাঁকে শিমুল জামিকে জিজ্ঞেস করলো, "কিরে, আবির কই রে?" "কইস না আর, অয় গতকাল থেইকা কি জানি করতাছে । রুমের মধ্যে বড় একখান কাগজ লইয়া কি জানি আঁকতাছে ।" "আইবো না নিচে? আমরা একলাই সব কাম করমু নাকি?" জামি কথার জবাব না দিয়ে হালকা বিরক্ত হয়ে বলল, "আরে! তুই অইডি ওইহানে লাগাইলি ক্যান? তরে দিয়া যদি একখান কাম হয় ।" শিমুল ফুলটা ঠিক জায়গায় লাগাতে লাগাতে বলল, "হ, একখান কাম হয় না তো । সকাল থেইকা তো মনে হয় একখান কামই করতাছি ।" এমন সময় মেয়েলি কণ্ঠে কেউ একজন পেছন থেকে বলে উঠলো, "কেমন চলছে শিমুল আর জামি ।" জামি পেছনে তাকিয়ে দেখল, সোমা আপু আর তার স্বামী রাকিব । জামি উল্লাসের সাথে পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল, "আরে আপু তুমি! কখন আইলা?" সোমা আপু হালকা হেসে বলল, "এইতো! কেবলই । তোমাদের রাকিব ভাইয়ার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হল বলে আমারও দেরি হল ।" রাকিব জামিকে বলল, "এই যে দ্যাখো, তোমাদের আপুর কাজ কাম নাই, খালি আমার অপর দোষ দেয়া । কিছু কও তো দেহি ।" জামি আপু দিকে তাকিয়ে বলল, "না, আপু আবার ভুল কিছু করে না । তয়, আপু এহন আর আমারে আদর করে না । আগে গালে হাত বুলায় দিতো ।" সোমা আর রাকিব দুজনেই হেসে দিল । হাসতে হাসতেই সোমা বলল, "বাপরে বাপ! তখন ৩-৪ এ পড়তি, ওইটুকু পিচ্চি ছিলি ।আর এখন তোর কাছে দাঁড়াতেই আমার লজ্জা লাগে ।" আবারো মুখে হাসির ছোঁয়া জামি আর শিমুলের । রাকিব তখন সোমাকে বলল, "চল, একটু ওইদিকে যাই ।" সোমা জামি আর শিমুলকে টাটা দিয়ে বলল, "থাক তাহলে, আমরা ওদিকটা ঘুরে আসি ।" বলেই চলে গেলো সোমা আর রাকিব । জামি আর শিমুল সমস্বরে "আচ্ছা আপু!" বলে কাজে লেগে পড়লো । সকাল টা ৩০ থেকে অনুষ্ঠান । সবাই প্রতিদিনের মতো প্রাতঃসমাবেশে দাড়িয়ে গিয়েছে । পুরো স্কুল আর হোস্টেল আর বেশ সুন্দর করে সেজেছে । খানিক পরেই এসে সবার সামনে হাজির হলেন মাননীয় প্রিন্সিপ্যাল স্যার । স্যার এর মুখেও আর কষ্টের ছাপ দেখা যাচ্ছে । গেইটের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই কয়েকজন ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের হাতে ফুল গ্রহন করে শেষ দিন এই প্রাঙ্গনে প্রবেশ করলেন তিনি । তারপর হোস্টেলের রাস্তা দিয়ে হেটে পৌঁছে গেলেন স্কুল বিল্ডিঙে । এরপর প্রাতঃসমাবেশের সামনে দাড়িয়ে গেলেন । সবার দৃষ্টি স্যার এর দিকে আর স্যার এর দৃষ্টি সবার দিকে । সবাই আজ স্যার জন্য কাদছে আর স্যার আজ সবার জন্য কাদছে । তবে সে কান্নায় চোখের জলটা প্রকাশ পায় না বলে সবাই বোঝে না । একটু পর শুরু হয়ে গেলো নিত্যদিনকার মতো প্রাতঃসমাবেশ । প্রথমে সুরা পাঠ, এরপর শপথ গ্রহন, এরপর জাতীয় সঙ্গীত শ্রবণ আর তারপর জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন । প্রাতঃসমাবেশে সবাই একটা ব্যাপার খেয়াল করলো । স্যার যেন কাকে সমাবেশে খুজছেন । ক্লাস টেনের লাইনের মাঝে দাড়িয়ে শিমুল, আর তার পিছে জামি । জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পর সবাই যখন আরামে দাড়িয়ে, জামি তখন শিমুলকে পেছন থেকে গুঁতো দিয়ে বলল, "ওই লম্বু, ছোটু কই রে?" শিমুল পেছনে না তাকিয়েই জবাব দিল, "আমি ক্যামনে কমু । আমিও তো সকাল থেইকা তোর সাথে কাম করতাছি । ওরে ক্যামনে দেখমু ।" জামি আর কিছু বলল না । আশেপাশে তাকিয়ে আবিরকে খুজতে চেষ্টা করলো । জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পর ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া এক মেয়ের দাঁড়া স্যার এর শেষ বিদায়ে বক্তব্য উপস্থাপিত হল । মেয়েটা সামনে দাড়িয়ে বলল, "যেতে নাহি দিব । হায় , তবু যেতে দিতে হয় , তবু চলে যায় । ভোরের শিশির ছাড়া ঘাসের শোভা যেমন ফুটে ওঠে না, বিকেলের রোদ্দুর ছাড়া ফাঁকে আলোর খেলা যেমন মেতে ওঠে না, জ্যোৎস্না ছাড়া কাজলা দিদির খোঁজ নেয়া হয়ে ওঠে না, ঠিক তেমনি, একটা স্কুল একজন প্রিন্সিপ্যাল স্যার ছাড়া পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে না । আর তিনি যদি হন আমাদের মাননীয় প্রিন্সিপ্যাল স্যার হন, তবে সেটা যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পাওয়ার মতোই হয়ে যায় । কিন্তু আজ সেই বৃষ্টি চোখের জলে আমার ভাসিয়ে চলে যাচ্ছে আমাদের ছেড়ে । ১০ বছরের কর্মজীবনে আমাদের মাননীয় প্রিন্সিপ্যাল স্যার যেভাবে আমাদের মতো অনাথ শিশুদের দেখভাল করেছেন, তাতে আমাদের এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয় নি আমরা অনাথ । স্যার এর চলে যাওয়া হয়তো কখনো পূরণ হবার নয় । প্রিন্সিপ্যাল পদটা হয়তো ফাকা থাকবে না, কিন্তু স্যার তো শুধুই প্রিন্সিপ্যাল স্যার নন । এর বাইরেও তিনি যেন ভালোবাসার মাখা, মমতায় ঘেরা আরও অনেক কিছু যে পদগুলো হয়তো ফাকা পড়ে থাকবে । আজ আমাদের স্কুলের সবাই স্যার এর জন্য চোখের জল ফেলছে । সে জল হয়তো কখনোই মুছে যাবার নয় । হিমেল হাওয়ায় হিল্লোলিত এই ঊষা লগনে স্যার এর এই বিদায় ভুলে যাবার নয় । স্যার এর প্রতি আমাদের এই স্কুলের ছেলে মেয়েরা চিরকৃতজ্ঞ । আল্লাহ তা'আলা স্যারকে যেন সুস্থ রাখেন, ভালো রাখেন, দুয়া রইল । মন থেকে সালাম নেবেন স্যার । সময় পেলে চলে আসবেন । শুধু প্রিন্সিপ্যাল হিসেবে নয়, আমাদের অভিভাবক হিসেবে, আমাদের মা বাবা হিসেবে । এই স্কুলের দরজা আজীবন আপনার জন্য খোলা রইল । ভেকুটিয়া অনাথ আশ্রমের পক্ষ থেকে আমি জাকিয়া সুলতানা ।" করতালির আওয়াজ চারিপাশে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠলো । প্রিন্সিপ্যাল স্যার এবার সত্যি কেদে ফেললেন । পকেট থেকে রুমালটা বের করে চোখের জল মুছতে শুরু করলেন । স্কুলের প্রধান শিক্ষক এসে প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে বললেন, "স্যার, আমাদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতেন ।" প্রিন্সিপ্যাল স্যার মাথা উপর-নিচ নাড়িয়ে মাউথপিসের সামনে এসে দাঁড়ালেন । চারপাশের পরিবেশ চুপচাপ । সুনসান নীরবতা । প্রিন্সিপ্যাল স্যার চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন । দেখতে লাগলেন সব ছাত্রছাত্রীদের, দেখতে লাগলেন চারপাশের পরিবেশ, দেখতে লাগলেন পরিচিত সবকিছু । যতোই দেখতে লাগলেন, মনের মাঝে ততই কষ্ট জমা হতে থাকে । এক সময় যখন সব কষ্ট ভরে যায়, মনের মাঝে আর জমে থাকে না, তখন তা আবার চোখের পানি হয়ে বেরিয়ে আসে প্রিন্সিপ্যাল স্যার এর চোখ দিয়ে । স্যার আবারো মাথা নিচু করে টিস্যু দিয়ে চোখ মুছলেন । এরপর অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলেন । তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে কান্না জড়ানো কণ্ঠে তার বক্তব্য দেয়া শুরু করলেন । "কেমন আছো তোমরা?" মাঠ থেকে কোন জবাব এলো না । অনেকে হয়তো খারাপ বলতে চেয়েছিল, কিন্তু পারলো না ফর্মালিটির জন্য । প্রিন্সিপ্যাল স্যার একটু থেমে বললেন, "আমি জানি, আজ আমার চলে যাওয়া তোমাদের ব্যাথিত করছে । কিন্তু কষ্ট পেও না, কারণ কষ্ট পেলেই যে আমি এই স্কুলে স্থায়ী হবো এমন তো আর না ।" আবারো প্রিন্সিপ্যাল স্যার কিছুক্ষন থেমে বললেন, "আসলে কষ্ট আমারও কম হচ্ছে না । কিন্তু এই কষ্ট আনন্দের । কিসের আনন্দ জানো? তোমাদের সান্নিধ্যে আসার আনন্দ, তোমাদের জন্য ভালো অনেক কিছু করে যাবার আনন্দ । কষ্ট পেলেই তো আর চলবে না । তাই না?" আবারো কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন তিনি । চারপাশে তাকিয়ে কাউকে খুজলেন, কিন্তু পেলেন না । তারপর আবার বলা শুরু করলেন, "তোমরা সবাই আমার বাচ্চা, তোমাদের সবাইকে আমি অনেক ভালোবাসি । তবে এই ভালোবাসার মাঝে কিছু কিছু ছেলেমেয়ে আমার কাছে একটু বেশি পরিচিতি পেয়েছে । তার মধ্যে একজন হল, বর্তমানে তোমাদের ক্লাস ১০, এই স্কুলের সবচেয়ে সিনিয়র ব্যাচের ক্যাপ্টেন আবির । এই ছেলেটা আমাদের সোমার হাত ধরে ক্লাস থ্রিতে এই স্কুলে এসেছিল । তখন এই স্কুলে ওই ক্লাসের কোন ছেলেমেয়েই ক্যাপ্টেন হবার যোগ্য ছিল না । ও যখন এলো, তখন আবিরই হয় ওদের ক্লাসের ক্যাপ্টেন । ছেলেটা সেই থ্রি থেকে ফার্স্ট হয়ে আসছে । ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছে, ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়েছে । ইনশাল্লাহ এস এস সি তেও ছেলেটা বৃত্তি পাবে । আমি শুধু তাই না, তোমরা জানো না, তোমাদের স্কুলের যত উন্নতি হয়েছে, তার বেশিরভাগই ওই ছেলেটা আমাকে অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে আমার মাধ্যমে করিয়ে নিয়েছে । এর জন্য একটা হাততালি ওর পাওনা ।" মাঠের সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো । প্রিন্সিপ্যাল স্যার বললেন, "ছেলেটাকে আজ শেষবারের মতো দেখার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ছেলেটাকে আমি খুজে পাচ্ছি না । ক্লাস টেনের সারিতে শুরুতেই ওর দাঁড়ানোর কথা । হয়তো কোথাও গিয়েছে ।" মাঠের মাঝখানে শিমুল জামিকে বলল, "ওই মটু, শেষ তুই তো আবিররে দেইখা আইছস । কই অয়?" জামি বিরক্তির সাথে বলল, "ধুরু, অয় যে কি করে আল্লাহই জানে । বাদ দে । ওরে দিয়া কাম নাই । তয় স্যার ম্যালা কষ্ট পাইবো অয় না আইলে ।" প্রিন্সিপ্যাল স্যার বক্তব্য দিচ্ছেন, "আজ আমার সাড়ে ১১টায় একটা ফ্লাইট আছে যাতে করে আগামী ৬ মাসের জন্য আমি সিঙ্গাপুর যাব । মাঝে হয়তো আর আসা হবে না । তো এই ৬ মাস তোমাদের সাথে হয়তো দেখাও হবে না । কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, ৬ মাস পর যখন আমি ফিরে আসব, তখন তোমাদের সবার সাথে আমি নিয়মিত দেখা করবো । কাল থেকে তোমাদের নতুন প্রিন্সিপ্যাল আসছেন । আশা করি উনি তোমাদের অনেক ভালো রাখবেন । যেহেতু আমার ফ্লাইট আছে, আমি বেশি সময় দিতে পারছি না । তোমরা ভালো থেকো, মন থেকে অনেক অনেক দোয়া আর ভালোবাসা রইলো । আর আবিরের পরিচিত কেউ যদি এখানে থাকো, ওকে বলে দিও, আমি ওকে অনেক মিস করবো ।" প্রিন্সিপ্যাল স্যার মাউথপিস থেকে সরে এলেন । পকেট থেকে আবারো টিস্যুটা বের করলেন । পা বাড়ালেন এয়ারপোর্ট এর উদ্দেশ্যে । যেইনা উনি কয়েক কদম হাঁটলেন, অমনি অ্যাসেম্বলির ছাত্রছাত্রীদের পেছন থেকে আওয়াজ এলো, কেউ চিৎকার করে বলল, "দাঁড়ান স্যার!" যেহেতু পরিবেশ শান্ত ছিল, শব্দটা বেশ স্পষ্টভাবে স্যার এর কানে পৌঁছল । স্যার সেদিকে তাকালেন । দেখলেন, একটা ছেলে দৌড়ে তার দিকেই আসছে । পায়ে একটা চটি, গায়ে কালো জামা, কাল ট্রাউজার । জামায় রঙ লেগে আছে । চোখে চশমা । মুখে কষ্টের ছাপ । হাতে গোল করে ভাজ করা একটা কাগজ । স্যার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে খুব খুশি হয়ে উঠলেন । কারণ এটা আর কেউ নয়, সেই আবির, যে আবির ক্লাস থ্রিতে এই কলেজে এসে ভর্তি হয়েছিলো । এ সেই আবির, যে জন্ম থেকেই পরিচয়হীনতার মাঝে থেকেই অনেক পরিচয়ের মাঝে এখনও ভেসে বেরাচ্ছে কিন্তু আজও সে তার আসল পরিচয় জানে না । এখন সে দশম শ্রেণীর ছাত্র । স্যার এর সামনে এসে দাড়িয়ে একটা হাসি দিয়ে উঠলো । আবির হাসলে দেখতে বেশ লাগে । ছেলেটা এখন আগের চেয়ে আরও সুন্দর আর হ্যান্ডসাম হয়েছে । ঠিক ওর বাবা মি. সোহেলের মতো । এসেই স্যারকে সালাম জানালো । স্যার সালামের জবাব দিয়ে জানতে চাইলো, “কি, আজ আমি চলে যাবো আর আজই তুই আসতে দেরি করলি? আমি তো ভেবেছিলাম আর আসবিই না আজ ।” আবির বলল, “ছি স্যার, কি যে বলেন না । আমি আজ না এসে থাকতে পারি? তবে দেরি হয়েছে আপনারই কারণে ।” স্যার একটু অবাক হয়ে আবিরের দিকে তাকালেন । জানতে চাইলেন, “আমার কারণে মানে?” আবির হাতে থাকা কাগজটা খুলে স্যার এর সামনে মেলে ধরে বলল, “আপনার জন্য এটা আঁকতে গিয়ে দেরি হয়ে গেলো ।” স্যার দেখলেন কাগজে আঁকা একটা ছবি । স্যার এর ছবি । স্যার একটা আরাম কেদারায় বসে । বুকের ওপর চশমা, আর বই । স্যার ঘুমিয়ে আছেন । পেছনে একটা লাইব্রেরী যাতে অনেক বই সাজানো । এতো সুন্দর ছবি দেখলে যে কারো মন আবেগপ্রবণ হতে বাধ্য । আর তার ওপর যে মানুষটা ছবিটা দেখছে তাতে যদি তারই ছবি থাকে, তাহলে সে আবেগটা যেন সীমা ছাড়িয়ে যায় । প্রিন্সিপ্যাল স্যার এর ক্ষেত্রে সীমা না ছাড়ালেও তিনি আবারো পকেট থেকে টিস্যু বের করতে বাধ্য হলেন । কাছে এগিয়ে এসে আবিরকে জড়িয়ে ধরলেন । আবিরে চোখের কোণটা ভিজে উঠলো তবে পানি বেরোল না । বড় হয়ে বেশ শক্ত হয়েছে ছেলেটা । নিজেকে কঠোর রাখতে শিখেছে । তবে তাই বলে যে কাদে না তা না । ছেলেদের স্বভাব আড়ালে কাঁদা । আবিরও সেরকম । যখনই ছোটবেলার কথা ওর মনে পড়ে, আড়ালে বসে কাদে আবির । তবে সামনে সবাই দেখলে বুঝতেই পারবে না ছেলেটার মনে কতো কষ্ট । এমনিতে দেখলে মনে হয় হাশি খুশি বেশ চঞ্চল একটা ছেলে । প্রিন্সিপ্যাল স্যার আবিরের হাত থেকে ছবিটা নিয়ে একবার দেখলেন । তারপর আবার ভাজ করে আবিরের গালে হাত বুলিয়ে বললেন, “খুব সুন্দর হয়েছে । এই ছবি আমি আমার লাইব্রেরীতে সাজিয়ে রাখবো । দিনের বেশিরভাগ সময়ই তো আমি লাইব্রেরীতে কাটাই, সবসময় আমার ওটা চোখে পড়বে, সাথে সাথে তোর আর এই স্কুলের কথা আমার মনে পড়বে ।” আবির হালকা হাসবার চেষ্টা করলো কিন্তু স্যার চলে যাবে বলে পারলো না । এরপর স্যার চলে যাবার জন্য পা বাড়ালেন । বার বার পেছন ফিরে স্যার আবিরের মুখখানা দেখছিলেন । আবিরও স্যার এর দিকে যতদুর স্যারকে দেখা যায়, ততদুর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল । স্যার যখন দৃষ্টির বাইরে চলে যান, আবির তখন মাঠের দিকে তাকাল । প্রধান শিক্ষক আবিরের কাধে হাত রেখে বললেন, “যাও আবির, তুমি এবার লাইনে যাও ।” আবির লাইনে যেয়ে দাঁড়ালো । আজ যেহেতু একটা কষ্টের দিন, তাই আজ স্কুল বন্ধ । স্কুল বন্ধ থাকলেই আবির, জামি আর শিমুল দিনের মধ্যভাগটা কাটায় স্কুল বিল্ডিং এর পিছে একটা পুকুর পাড়ে । পুকুরপাড়ে সারি সারি সেগুন গাছ লাগানো রয়েছে । তারই মাঝে একটা সেগুন গাছের নিচে তিন বন্ধু একসাথে বসে মোবাইল চালায় আর গল্প করে । মোবাইল ওদের স্কুল থেকেই একটা দেয়া হয় । এযুগে তো মোবাইল অনেক কাজে লাগে । যেহেতু এই ছেলেমেয়েগুলো এতিম, এদের নিজেদের কোন আয়ের উৎস নেই, তাই স্কুল থেকেই এদের মোবাইল দেয়া হয় ক্লাস নাইনে ওঠার পর । জামি আর শিমুল সারাদিন ফেসবুক চালায় । আবির আবার ফেসবুক চালাতে পছন্দ করে না । বসে বসে প্রকৃতির ছবি তোলে । আজও অনেকগুলো তুলেছে । সেগুলোই এখন বসে বসে দেখছে । পাশে জামি আর শিমুল গল্প করছে । এক পর্যায়ে শিমুল আবিরকে জিজ্ঞেস করলো, “ওই ছোটু, তুই কি ছবি আঁকলি দেখাইলি না তো ।” আবির বলল, “ক্যামনে দেখামু ক, আইসা দেহি স্যার চইলা যাইতেছে । তহন তোদেরই দেখামু, নাকি স্যাররে দিমু । তয় ছবি তুইলা রাখছি তগো দেখামু বইলা ।” বলে মোবাইলে তোলা ছবিটা বের করে শিমুলের হাতে দিল আবির । শিমুল ছবিটা দেখে বলল, “ওরে দোস্ত! তুই এ কি আঁকছিস! বাপ রে বাপ! তুই তো দেহি আবির দা ভিঞ্চি হইয়া যাইতেছস!” শিমুলের কথা শুনে জামিও একটু উঁকি দিল ফোনের দিকে । ঠিক মতো দেখতে না পেলেও বুঝল ইন্টারেস্টিং কিছু । তাই শিমুলের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিজেও দেখতে লাগলো । দেখে বলল, “আরে দোস্ত! আসলেই তো সেই হইছে!” আবির প্রশংসা পেয়ে লজ্জা পেতে লাগলো । খানিক নিজে থেকেই হাসল । আবার স্যার এর কথা খুব মনে পড়তে লাগলো । একটা শ্বাস ফেলে মোবাইলটা শিমুলের হাত থেকে নিলো । শিমুল তখন বলল, “ব্রো, আমার একটা পিক আইকা দিস ।” আবির ফোন চালাতে চালাতে বলল, “আর পাম দিস না ভাই । সব পাম একদম ঢাইলা দিতেছোস ।” জামি অভিমান করে বলল, “দ্যাখ শিমুল আবির আমাগো বিশ্বাস করে না অয় ভাবে আমরা ওরে পাম দিতাছি ।” আবির ফোনটা পকেটে রেখে বলল, “আরে ইয়ার, Chill! এই সামান্য ব্যাপার তোরা এহন আমার লগে রাগ করিস না ।” শিমুল কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় শিমুলের মোবাইলে একটা কল এলো । মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ইয়ার্কির সাথে বলল, “ওই দ্যাখ, পাপলু চান্দু ফোন দিছে ।” আবির ওর মতোই বসে থাকলেও জামি ফোনের কাছে এগিয়ে এসে ইয়ার্কির সাথে বলল, “ধর ধর, ধইরা লাউড স্পিকার দে ।” শিমুল ফোন ধরে লাউড স্পিকারে দিল । পাপলু হল সেই লোকটা এই অনাথ আশ্রমের রিসিপশনের গেইটে যে লোকটা খাতা নিয়ে বসে থাকে । এই কয়েক বছরে লোকটার মাথার সব চুল পড়ে গেছে । মাথার চাঁদি দেখা যায় এখন । তাইতো শিমুল আর জামি এখন লোকটাকে ইয়ার্কি করে ডাকে চান্দু । আবির শুধু হাসতো কিন্তু কিছু বলত না । ফোন ধরতেই ফোনের অপাশ থেকে পাপলু যখন বলল, “হ্যালো!” সাথেই সাথেই জামি জামি আর শিমুল একসাথে ইয়ার্কির সাথে বলল, “চান্দু!” “হেহ! তোরা মানুষ হবি না! তোরা সব কই?” শিমুল বলতে গেলো, “আপনার নানির......” আবির থামিয়ে দিয়ে বলল, “আহ শিমুল, থামবি! কি সব যে কস তোরা ।” বলে ফোনটা হাতে নিয়ে আবির লাউডস্পিকার অফ করে বলল, “হ কাকা কন ।” পাপলু বলল, “বলি, কই তোমরা?” “কাকা আমরা তো পুকুর পাড়ে বইসা আছি । ক্যান? কিছু লাগবো?” পাপলু একটু কেশে বলল, “না, তেমন কিছু না । আসলে একা একা বসে আছি তো তাই । ভালো লাগতিছে না ।” জামি কোনোরকমে কথাটা শুনল শুনে আবারো ইয়ার্কির সাথে পাপলুকে শুনিয়ে বলল, “ক্যান! বউয়ের লগে ঝগড়া হইছে নাকি?” ফোনের ওপাশ থেকে বিরক্তির সাথে পাপলু বলল, “হায়রে! তোমার বন্ধুগুলা কি হইছে না!” আবির একটু হেসে বলল, “হ । তয় শেষ কথাটা মনে হয় ভুল কয় নাই । আপনের তো মন খারাপের কারণ ওই একখানই ।” পাপলু অবাক হয়ে বলল, “তুমিও?” আবির, শিমুল আর জামি চলে গেলো রিসিপশন রুমে । সেখানে একটা বিছানা আছে । সেই বিছানায় উঠে পড়লো জামি আর শিমুল । দুজনেই মোবাইলেই পড়ে রইল । আবির বিছানার এক পাশে বসে রইল । আর পাপলু জানালার পাশে বসে নিজের মতো কতো কথা বলতে লাগলো । কথা বলার মাঝে পাপলু বলল, “আর বোলো না, স্যার ছিলেন, কতো ভালো লাগত । এখন যে কে আসে, আল্লাহই জানেন । যেন ভালো কেউই আসেন ।” শিমুল আবারো ইয়ার্কির সাথে বলল, “হ, তমারে বেশি ট্যাকা দিত তো ।” আবির আর জামি হেসে দিলো । পাপলু মারার জন্য উঠে আসতে নিয়ে থেমে যেয়ে বলল, “তুই একদিন মাইর খাবি আমার হাতে, দাড়া সময় আসুক না ।” জামি বলল, “সত্যি কথা আসলেই কারো ভালো লাগে না ।” পাপলু আবারো কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় সোমা আপু এসে ডাকল, “আঙ্কেল?” পাপলু সোমার দিকে তাকাল । বলল, “হ্যাঁ মা বলো ।” জামি আর শিমুল তো আপুকে দেখেই “সোমা আপু!” বলে চেঁচিয়ে উঠলো । সোমা ওদের শুধু হাত নাড়িয়ে হাই জানালো । তারপর পাপলুকে বলল, “আঙ্কেল, আরেকজনকে ভর্তি করাতে আসলাম ।” পাপলু বলল, “হ্যাঁ অবসশ্যই । সে কই?” শিমুল আবারও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আবির ইশারায় থামিয়ে দিলো । সোমা আপু পেছন ফিরে তাকিয়ে কাউকে ডাকল, “এসো? লজ্জা পাচ্ছ কেন?” একটু দূরে একটা মেয়ে দাড়িয়ে ছিল । মেয়ে? ব্যাস হয়ে গেলো । জামি আর শিমুল তো দেখার জন্য উঠে দৌড় দিল দরজার কাছে । আবির বেচারা এদের আচরন দেখে কপাল হাত রাখল । জামি আর শিমুল এমনভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে, যে পাপলু নিজেই মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছে না । পাপলু ভ্রু-কুঁচকে হাত দিয়ে জামি আর শিমুলকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “যা সর, পড়ে দেখিস ।” জামি আর শিমুল পাপলুর টাকে হাত রেখে ভেংচি কেটে বিছানায় চলে গেলো । আবির ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে বোঝাল, তোদের দাড়া কিচ্ছু হবে না । আবির তখন পর্যন্ত মেয়েটার দিকে তাকায় নি । পাপলু জানতে চাইলো, “কি নাম ওর ।” সোমা বলল, “নাবিলা ।” এবার আবির চমকে উঠলো । ঠিক শুনেছে তো? নাবিলা? পাপলু আঙ্কেল নামটা ঠিক শুনতে পারলেন না । আবারো জানতে চাইলো নামটা । এবার সোমা আপু কিছু বলার আগেই মেয়েটা বলল, “আমি নাবিলা ।” আবির এবার সত্যি শুনলো, হ্যাঁ এটা নাবিলা । কিন্তু কোন নাবিলা? দেখবার জন্য জানালার দিকে তাকাল । চেনা চেনা লাগছে তবু অচেনা । না, নাবিলা নামে এই কলেজে অনেক মেয়েই এসেছে, কিন্তু এই মেয়েটার চেহারা কণ্ঠ সবটাই কেন যেন আবিরের কাছে অন্যরকম লাগছে । এ কি ছোটবেলার সেই নাবিলা? মেয়েটার মুখে কোন হাসি নেই । হয়তোবা কোন একটা খারাপ পরিস্থিতি থেকে উঠে এসেছে । তবে মেয়েটা খুব সুন্দর দেখতে । গায়ের রঙ ফরসা । চোখ বন্ধ করলে একরাশ চোখের পাপড়ি দৃশ্যমান হয় । চুলগুলো ছড়ানো । দেখলেই যে কারো আলতো করে ধরতে ইচ্ছে করে । “কিরে, তুই কই আছিস?” হঠাৎ শিমুলের ডাক শুনে কল্পনা থেকে ফিরে আসে আবির । "কি আকাশ কুসুম ভাবতেসোস হ্যাঁ? কখন থেইকা তরে ডাকতাছি ।" বলল শিমুল । আবির জবাবে বলল, "ও, না কিছু না । কিছু ভাবতেছিলাম এমনি আরকি ।" আবির মেয়েটার দিকেই তাকিয়ে কথাটা বলল । আশায় ছিল মেয়েটার চোখে চোখ রাখবে কিন্তু মেয়েটা এক মুহূর্তের জন্যও চোখ রাখল না । পাপলু আঙ্কেলের কাছ থেকে চাবি নিয়ে সোমা আপু বলল, "আচ্ছা আঙ্কেল, ওকে ওর রুমটা দেখিয়ে আসি তাহলে ।" বলে মেয়েটাকে নিয়ে যেতে শুরু করলো সোমা আপু । পাপলু আঙ্কেল "আচ্ছা।" জবাব দিল । কিন্তু যাবার সময় মেয়েটা খুব অল্প একটা মুহূর্তের জন্য আবিরের দিকে তাকাল । খুব অল্প একটা মুহূর্ত । আবির মেয়েটাকে দেখে দাড়িয়ে গেলো । ওই নাবিলা কেন হতে যাবে? ও তো ঢাকায় থাকে । কিন্তু চেনা চেনা লাগছে যে! জামি তখন শিমুলকে বলল, "দোস্ত, মাইয়াডা দেখতে কিন্তু সেই ।" শিমুল ভ্রু-কুঁচকে বলল, "হইছে থাম । তুই এ পর্যন্ত যততো মাইয়ারে দেখসোস, প্রত্যেকবার একই কথা কইছোস । একডারেও তুই পটাইতে পারস নাই ।" জামি তখন আবিরের দিকে তাকাল । আবির তখন জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে । জামি বলল, "আমি না পটাই, তয় আমাগো আবির মনে হয় এই মাইয়ারে দেইখা পইটা গেছে ।" জামির কথা শুনে শিমুলও আবিরের দিকে তাকাল । পাপলু আঙ্কেল ও তাকাল । আসলেই তো? আবির হঠাৎ মেয়েটাকে দেখার পর থেকে এতো অন্যমনস্ক হয়ে গেলো কেন? শিমুল আবিরকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, "কিরে আবির? কি হইছে তোর?" আবির শিমুলের দিকে তাকিয়ে বলল, "হ্যাঁ?...হ্যাঁ...না । কিছু হয় নি ।" আবির বিছানায় বসে পড়লো । পাপলু আঙ্কেল বলল, "কি জামানা আইলো । পোলাপাইন মাইয়া দেখলেই বাস্তবে থাকে না । শিমুল ইয়ার্কির সাথে বলল, "ক্যান, তুমি বুঝি কিচ্ছু করো না? এই বয়সেও তো তোমার কম ভীমরতি ধরে না ।" পাপলু আঙ্কেল বিরক্তির সাথে বলল, "ধুরু, তোরা মানুষ হবি না ।" আবির হঠাৎ আমি আইতাছি?" বলে উঠে চলে গেলো । রিসিপশন রুম থেকে বেরিয়ে দুপাশের সারি সারি হোস্টেলগুলোর মাঝের রাস্তার শুরুতে যখন পৌঁছল, তখন দেখল, সোমা আপু নাবিলাকে নিয়ে ক্লাস টেনের বিল্ডিংএ ঢুকছে । আবিরও সেদিকে একটা দৌড় দিল । জামি, শিমুল আর পাপলু আঙ্কেল অবাক হয়ে গেলো । জামি বলল, "হইল টা কি আবিরের?" পাপলু আঙ্কেল বলল, "আমিও তো বুঝলাম না । ওর জায়গায় যদি তোমরা হতে মানা যেত । কিন্তু......। কেসটা সুবিধের ঠেকছে না । আবির বিল্ডিঙে ঢুকল । এক একটা বিল্ডিং এর একপাশে থাকে ছেলেরা, অন্য পাশে মেয়েরা । আবির বিল্ডিংএ উঠে আর কাউকে দেখতে পেলো । সোমা আপুর জুতাটা ও চেনে । প্রথমে নিচ তলায় দেখল । এরপর দোতলা, তিনতলা । চারতলায় ছেলেদের পাশে তো আবির, জামি আর শিমুল থাকে । পাশের বাসায় তো এতদিন তালা ছিল । এই কি প্রথম মেয়ে আনলো এই রুমে? আবির চারতলার দিকে পা বাড়াল । চারতলায় উঠেই চোখটা গিয়ে পড়লো ওদের পাশের বাসার দরজায় । দরজা দরজাটা ভেতর থেকে চাপানো । না নেই তালা, না নেই ছিটকিনি । দরজার সামনের জুতোটাও চেনা, সোমা আপুর । অন্য জুতোটা খুব সম্ভবত ওই যে নাবিলা নামের মেয়েটা এসেছে, ওর । আবির ছাদে গেলো । আবিরদের ঘরটা তালা দেয়া, চাবি শিমুলের কাছে তাই ঘরে যেতে পারলো না আবির । ছাদে দাড়িয়ে অপেক্ষা করলো সোমা আপুর চলে যাবার । সোমা আপুর সামনে মেয়েটার সাথে কথা বলতে কেমন অস্বস্থি বোধ করছিলো আবির । এই ছাদে আবির আগে প্রায়ই আসতো যখন ছাদে ক্লাস হতো । এখন অবশ্য শুধু কাপড়-চোপড় আনা নেয়া ছাড়া তেমন একটা আসা হয় না চারতলায় হলেই কি হবে । ছাদের রেলিঙ্গের পাশে যেয়ে দাঁড়ালো আবির । ওর সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়তে লাগলো যখন ও ছাদের কিনারায় দাড়িয়ে সবকিছু দেখত । কখনো ইফাজ এসে আদর করত, কখনো দ্বীপ এসে মশকরা করতো, কখনো পায়েল এসে পেছন থেকে জাপটে ধরত । কিন্তু ওসব ভেবে কি হবে । শেষদিন যা বলল, সেসব শোনার পর কারই বা ভালো লাগবে? কারই বা ইচ্ছে হবে অন্যের গলগ্রহ হয়ে বাচবার? আবির মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকাল । দেখল, সোমা আপু রিসিপশন রুমের দিকে যাচ্ছে । তার মানে ঘরে এখন মেয়েটা একা । আবির তাড়াতাড়ি করে দৌড় দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলো । দরজার সামনে সোমা আপুর জুতো নেই, আছে শুধু ওই মেয়েটার জুতো । আবির দরজায় নক করতে যাবে এমন সময় ওর মাথায় একটা খেয়াল এলো । মেয়েটা তো বাসায় একা? হ্যাঁ তাইতো? এভাবে একা একটা মেয়ের ঘরে অচেনা অজানা, ঢুকে যাওয়া কি উচিৎ হবে? আবির নিজের ওপর রেগে নিজেই নিজের মাথায় হাত দিয়ে দু তিনবার আঘাত করলো । ভেবে পাচ্ছিল না কি করবে । আবার ভাবল, যদি ওই নাবিলাই হয়, তাহলে তো ঠিকই আছে্‌ চেনা তো আছেই, আর অন্য নাবিলা হলেই কি হল, অন্য নাবিলা হলে তো তার সাত্থে তো কোন কথা নেই, আবার শুধু দরজায় পরিচয়টা জেনেই তো চলে যাবে । হ্যাঁ, ঠিক আছে । আবির দরজায় নক করার জন্য প্রস্তুত । চুলটা একটু গুছিয়ে নিয়ে শার্টটা একটু টেনে ঠিক করে যেই না দরজায় নক করার জন্য হাতটা বাড়াল, অমনি মেয়েটা দরজা খুলল । আবিরকে এভাবে দরজার সামনে দেখে মেয়েটা বলল, "একি! কে আপনি?" আবিরও হঠাৎ দরজা খুলতে দেখে পেছনে ফিরে গেলো । ভয়েও পেলো অনেকটা, পা কাপছে, সাথে কাপা কাপা স্বরে বলল, "ন...ন...না...না...ইয়ে...মানে...আ...আ...আমি আপনার...পা...পাশের রুমে থাকি ।" মেয়েটা হালকা বিরক্তির সাথে বলল, "তাই বলে এভাবে দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকবেন? মানে আমাকে একা পেয়েছেন আর......।" নাবিলার কথা শেষ হতে না হতেই আবির হাত উচিয়ে মেয়েটাকে থামিয়ে দিল । এক নিমিষেই আবিরের সব ভয় দূর হয়ে গেলো । এবার মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে কম্পনহীন কণ্ঠে জোর গলায় আবির বলল, "দেখুন, আমি এখানে দাড়িয়ে ছিলাম ঠিকই কিন্তু তাই বলে এটা ভাববেন না, আমি কোন বদ মতলবে দাড়িয়ে ছিলাম । মানে ছেলে বলতেই আপনারা সব ছেলেকেই খারাপ ভাবেন তাই না? কেন দুনিয়ায় কি শুধু খারাপ ছেলেরাই থাকে নাকি? ভালো ছেলে থাকে না?" একটু থামল আবির । মেয়েটা বেশ লজ্জা পেলো । না বুঝে এরকম বলাটা আসলেই উচিৎ হয় নি । তাই কিছু বলতেও পারলো না । মাথা নিচু করে রইল । আবির আবারো বলল, "আমি আবির ।" কথাটা শুনে মেয়েটা অবাক দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না । আবির বলতে লাগলো, "আপনার নাম আর গলাটা শুনে আমি ভেবেছিলাম আমার পরিচিত কেউ । সেজন্য খোঁজ নিতে এসেছিলাম । সোমা আপুর সামনে আসতে কেমন লাগছিল তাই তো সোমা আপু চলে যাওয়ায় এলাম । কিন্তু আপনি তো......" বলতে গিয়ে থেমে গেলো । আবির সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে নেবে, এমন সময় মেয়েটা আবিরকে ডেকে বলল, "আবির দাঁড়াও, আমিই সেই নাবিলা ।" আবির এবার নামতে গিয়ে দাড়িয়ে গেলো । পেছন ফিরে তাকাল নাবিলার দিকে । নাবিলা হালকা হাসিমুখে দাড়িয়ে । আবির নাবিলার কাছে আবার গেলো । জানতে চাইলো, "তুমি এখানে কি করে?" নাবিলা বলল, "অনেক কাহিনী । আগে বলো তুমি কেমন আছো?" "আমি তো ভালো আছি, কিন্তু আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না তুমি এখানে ।" নাবিলা আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, "তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম পরদিন আমার ঘড়িটা আনার জন্য । তোমাকে পাইনি বলে আমি যে কতো কষ্ট পেয়েছি, তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না ।" আবির বলল, "তোমার ঘড়ি আমার ব্যাগেই আছে । আর ওটা আমার বাসা বোলো না । ওটা না আমার বাসা, ওটা না আমার পরিবার ।" নাবিলা বলল, "মানে?" "হ্যাঁ । আমি ছোটবেলা থেকে ঠকে এসেছি । অনেক কাহিনী হয়েছে । তোমাকে পড়ে সবটা জানাবো । আগে তুমি বলো, তুমি এখানে কি করে?" নাবিলা বলল, "ভেতরে এসো, বসে কথা বলি?" "ভেতরে না প্লিজ? ছাদে চল? এভাবে মেয়েদের রুমে গেলে অন্যেরা খারাপ ভাববে । তার ওপর তুমি আবার একা ।" নাবিলা না করলো না । আবিরের সাথে চলে এলো ছাদে । শুরু করলো ওর গল্প ।





(২)
নাবিলা জাশিরের একমাত্র মেয়ে । ওর আরেকটা বড় ভাই আছে লাবিব নামে । ছোটবেলা থেকেই নাবিলা ওর পরিবারের কাছে বেশ আদরের মাঝে বড় হচ্ছিলো । নাবিলা ছিল খুব চঞ্চল । পুরো বাড়ি দাপিয়ে বেড়াতো । কিন্তু একটা রুম ছিল, সেই রুমটাতেও শুধু ওর দাপিয়ে বেরাবার সুযোগ হয় নি । নাবিলা দেখত, ওর বাবা আর ভাই-ই কেবল ওই ঘরটায় যেতো, আর কি যেন করতো । কোনোদিন ওই ঘরে না ওর মাকে ঢুকতে দিয়েছে, না ওকে ঢুকতে দিয়েছে । ওই ঘরটায় কেমন যেন গন্ধ ছড়াতো । গন্ধটা খুব জঘন্য । নাবিলার খুব জানতে ইচ্ছে করতো, এই ঘরটায় কি এমন আছে যে এরকম গন্ধ ছড়ায়? একদিন স্কুলে নাবিলা আবিরকে দ্যাখে । আবিরকে ও সবার চেয়ে অন্যরকম অনুভব করে । কারণ ক্লাসের আর সব ছেলেমেয়েদের চেয়ে আবির সত্যি অন্যরকম ছিল । শান্তশিষ্ট, ভদ্র, সৎ ইত্যাদি । তখন থেকেই নাবিলার ইচ্ছে করে আবিরকে বন্ধু বানাতে । কিন্তু কি করে? কি অযুহাতে বানাবে? একদিন স্কুল থেকে বাড়ি এসে নাবিলা ওর মাকে আর খুজে পায় না । এভাবে বেশ কয়েকদিন চলতে থাকে । নাবিলার বাবা নাবিলাকে শান্তনা দিতে থাকে, ওর মা ফিরে আসবে এই বলে । কিন্তু নাবিলার মনের কষ্ট দূর হয় না । তবুও, দিন যতো যেতে থাকে, কষ্টটা ততো কমতে থাকে । নাবিলা আবিরকে বন্ধু বানাতে চায়, কষ্টগুলো ভাগাভাগি করে নিতে চায় । তাই শেষমেশ বন্ধু হতে সেদিন গিয়েছিলো আবিরের বাসায় । এরপর তো যা হবার হলই, পরদিন আবিরকে না পেয়ে কষ্টে বাসায় যাবার পর নাবিলা খেয়াল করলো, ওর ভাই ওই রুমটা থেকে বেরিয়ে রুমটা তালা দিয়ে চাবিটা রেখে দিল বিছানার নিচে । নাবিলা এর আগে কোনোদিন জানতো না, এই রুমের চাবি কোথায় থাকে । আজ যেহেতু জেনেছে, তাই সুযোগটাও হাতছাড়া করতে চায় না নাবিলা । ১ঘণ্টার মাথায় ওর ভাই লাবিব কি একটা কাজে বাইরে যায় । বাবা আগেই হাসপাতালে ছিল । সুতরাং, বাসায় এখন কেউ নেই, এটাই সুযোগ । নাবিলা বিছানার নিচ থেকে চাবিটা নিয়ে ওই ঘরে যায় । দরজাটা খুলতেই একটা উৎকট গন্ধ বেরিয়ে আসে । নাবিলা নাকটা চেপে ধরে । এরপর সামনের দিকে তাকাতেই নাবিলা স্তব্ধ হয়ে যায় । লাশ! নাবিলা ভয় পায় খুব । চিৎকার দিতে যেয়েও থেমে যায় । নিজেকে সামলে নেয় । আর সেদিকে তাকাতে পারে না নাবিলা । ক্লাস থ্রি তে থাকতে এতো মারাত্মক জিনিস দেখার পরও এতক্ষণ যে কিভাবে দাড়িয়ে ছিল এটাই এখনও বুঝতে পারে নাবিলা । দরজার কাছে এসে কাপা কাপা হাতে যখন দরজাটা একটা টান দিয়ে চাপিয়ে দিল, অমনি নাবিলার নজর গেলো একটা লাশের দিকে । নাবিলা দরজাটা খুলে লাশটার দিকে তাকাল । কার লাশ ওটা? নাবিলা এগিয়ে গেলো । এবার ওর পা-ও কাপছে । খানিকটা এগিয়ে যেতেই লাশের মুখটা দৃশ্যমান হল নাবিলার কাছে । এটা তো মা! আরেকটু সামনে এগোতেই নাবিলার মায়ের পেটের অংশ নজরে এলো নাবিলার । একি! ওর মায়ের পেট থেকে পা আলাদা করা! পেট থেকে নাড়ি ভুরি সব বের হয়ে আছে! এমন বীভৎস একটা দৃশ্য দেখে নাবিলা বমি করে দিল । পুরো শরীর থর থর করে কাপছে । মায়ের কাছে যেয়ে যে একটু মাকে ছোঁবে, চুমু খাবে, সে সাহসটুকুও পর্যন্ত নেই । কে করলো এই জঘন্য কাজ? বাবা আর ভাই? নাবিলা আর দাড়িয়ে থাকতে পারলো না । ওখানে শুধু যে ওর মায়ের-ই লাশ, তা নয়, আশেপাশে আরও অনেক লাশ আছে । কোনটার মাথা কাটা, কোনটার পা কাটা, কোনটা থেকে মাংস খসে পড়ছে! সবগুলো লাশ নাবিলার দিকে তাকিয়ে । নাবিলা আর দাড়িয়ে থাকতে পারলো না । দরজার দিকে আসবার জন্য যখন পা বাড়াবে ঠিক তখন পেছন থেকে নাবিলার বাবা সাখুরা পেছন থেকে এসে নাবিলাকে বাম হাত দিয়ে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে । সাখুরার ডান হাতে চাকু । নাবিলাকে ধরেই সাখুরা কেপে কেপে বলতে লাগলো, "মা আর মেয়ের একই শখ না? এবার দুজনেই একইভাবে মর!" নাবিলা রীতিমতো কাঁদতে লাগলো । কিছু করতে পারলো না । তবে এটুকু বুঝলো, ওর মা-ও কোন একদিন এই ঘরটায় আসায় সাখুরা ওর মাকে মেরে ফেলেছে । এবার নাবিলার পালা । সাখুরা চাকু নিয়ে বার বার নাবিলার গলার কাছে ধরল । বারবার চাকু দিয়ে গলা কাটতে গিয়েও পারছে না । যতোই হোক, নিজেরই তো সন্তান । কিন্তু এখন না মেরে উপায় নেই । তাহলে তো হাটে হাড়ি ভেঙ্গে দেবে মেয়ে । সাখুরা নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে লাগলো মেয়েকে মারবার জন্য । সেই ফাঁকে নাবিলা সাখুরার হাটে একটা কামড় বসায় । মন থেকে ভুলে যায়, সাখুরা ওর বাবা । নাবিলা এক দৌড় দিয়ে চলে আসে দরজার কাছে । সাখুরা যেই দৌড় দিতে যাবে, অমনি মেঝেতে পড়ে থাকা নাবিলার মায়ের হৃদপিণ্ডের সাথে পিছলে পড়ে যায় সাখুরা । নাবিলা দরজা আঁটকে চাবিটা টয়লেটের কমোডে ফেলে ফ্ল্যাশ করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে । সেই থেকে নাবিলা বাড়ির বাইরে ।

এটুকু বলে থেমে যায় নাবিলা । ঘটনা শুনে অবাক হয়ে যায় আবির । কিছুক্ষন নির্বাক হয়ে দাড়িয়ে থাকে । একটু পর যখন নাবিলার দিকে তাকাল, দেখল, নাবিলা কাদছে । আবির জানতে চাইলো, "তোমার বাবা এতো জঘন্য একটা মানুষ?" নাবিলা চোখ মুছে বলে, "আমার নিজেরও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না কিন্তু কি করবো? চোখের সামনে ওইটুকু বয়সে যা যা দেখেছি, তারপর তো আর কিছু বলার থাকে না ।" নাবিলা চুপ হয়ে গেলো । আবির জিজ্ঞেস করলো, "তারপর কি হল?" নাবিলা আবার বলা শুরু করলো ।

বাড়ি থেকে বেড়িয়ে নাবিলা হাঁটা ধরতে লাগে । একে তো কাছে টাকা পয়সা নেই, তার ওপর ওর বাবা আর ভাই আজ ওকে খুজে বের করবে জানা কথা । ঠিক সেই সময় নাবিলার চোখে পড়ে একটা ট্রাক । ট্রাকের ওপর একটা লাশ আর ট্রাকের চারপাশে অনেক মানুষ । নাবিলা সেদিকে এগিয়ে যায় । একজনকে জিজ্ঞেস করে, "আচ্ছা আঙ্কেল, এই ট্রাকে কার লাশ? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?" লোকটা জবাব দিলো, "ওটা আমার ভাইয়ের শাশুড়ির লাশ । আমরা মাগুরায় যাচ্ছি ।" নাবিলা তখন বুদ্ধি করে বলল, "আঙ্কেল, আমিও না মাগুরায় থাকি । কিন্তু আমি ভুল মা বাবার সাথে যাবার সময় পথ হারিয়েছি ৩দিন আগে । উনারা মনে হয় মাগুরায় চলে গেছে । আপনি আমাকে মাগুরায় পৌঁছে দেবেন?" লোকটা অবাক হয়ে জানতে চাইলো, "সেকি! তোমার মা বাবা তোমাকে না নিয়েই মাগুরা চলে যাবেন?" নাবিলা বলল, "না না, তা না । আসলে উনারা বাসে করে যাচ্ছিলো, তখন আমি একটু নেমেছিলাম । বাস কখন ছেড়ে চলে যায় আমি টের পাইনি । মা বাবাও বাসে ঘুমাচ্ছিল । তারপর থেকেই এই অবস্থা ।" লোকটার চেহারা দেখে মনে হল লোকটা এখনও সন্দেহের বেড়াজালে বন্দি, কিন্তু তা-ও উনি নাবিলাকে সাথে নিতে রাজি হলেন ।





(৩)
নাবিলা একটা শাস নিয়ে বলল, "তারপর থেকে মাগুরায় একটা বস্তিতে বড় হয়েছি । ওখানকার একটা চায়ের দোকানে কাজ করতাম, আর একটা সরকারী স্কুলে পড়তাম । কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে গত সপ্তাহে আমাকে কিছু ছেলেধরা ধরে নিয়ে আসে এই যশোরে । অনেক কষ্ট করে আমি ওদের হাত থেকে পালিয়ে এসেছি । তখনই এই সোমা আপুর সাথে আমার দেখা । শেষে উনি-ই আমাকে নিয়ে এলেন এখানে ।" আবির এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে । মুখে একটা হাসি । নাবিলা আবিরের দিকে তাকাল । এরপর আবির নাবিলার দিকে তাকিয়ে বলল, "জীবন কখনো কখনো নাটকীয়তাকেও ছাড়িয়ে যায় । তাই না?" নাবিলা কোন জবাব দিল না । আবির বলল, "এই যে দ্যাখো, তোমার আর আমার শেষ মেশ এক অদ্ভুত নাটকীয়তার মাঝে দেখা হল । আমার ছিল নকল মা বাবা, তোমার ছিল নিষ্ঠুর বাবা ।" নাবিলা বলল, "জানো, আমি আজ পর্যন্ত এই ঘটনা কাউকেই বলিনি । শুধু তোমাকেই বললাম । কারণ কেউ কখনোই এ ধরনের অদ্ভুত কাহিনী বিশ্বাস করবে না । উল্টে আমাকেই পাগল ভাববে ।" আবির অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, "আচ্ছা, তোমার বাবার সমস্যা কি ছিল?" "জানি না আমি । ওই দিনের পর থেকে আমি আর ওইমুখো হই নি । আর জানো, আমি আল্লাহর কাছে সবসময় দোয়া করতাম, উনি যেন তোমার সাথে আমার দেখা করিয়ে দেন । এখন দ্যাখো, সত্যি তোমার সাথে আমার দেখা হয়ে গেলো ।" আবির বলল, "হুম ।" "এবার তোমার কাহিনীট বলো ।" আবির এবার নিজের সব কষ্টের কথা বলতে লাগলো নাবিলাকে । সবটা শুনে নাবিলা বলল, "বাহ! তোমার আর আমার গল্পের কতো মিল তাই না?" আবির কিছু বলল না । শুধু গোমড়া মুখে দাড়িয়ে রইল । নাবিলা তখন আবিরের পাশে এসে দাড়িয়ে বলল, "আচ্ছা, অনেক হয়েছে এসব কথা, এখন বলো, তোমার সাথে কে কে থাকে?" "আ..., আমার সাথে থাকে, জামি আর শিমুল । জামিকে তুমি মোটু ডাকতে পারো, আর শিমুলকে লম্বু ডাকতে পারো । চাইলে আমাকে ছোটুও ডাকতে পারো ।" নাবিলা হাসতে লাগলো । সেই হাসির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আবির । কেন যেন মনের মাঝে আজ এক অন্যরকম দুর্বলতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে । নাবিলা জিজ্ঞেস করলো, "তুমি তো দেখছি আগের চেয়ে অনেক মজার মানুষ হয়ে গেছো?" "শুধু তাই না, আমি তো শুদ্ধ ভাষায়েও তেমন বলি না, জাস্ট তোমার লগে কইলাম ।" আবারো হেসে উঠলো নাবিলা । আবারো আবিরের সেই অপলক দৃষ্টি । আবির জানতে চাইলো, "আচ্ছা, তোমার রুমে তো আর কেউ নেই, তাহলে তুমি কি একা থাকবা?" "একা থাকবো কেন? নীচতলায় নাকি চারজন থাকে । ওদের মধ্যে একজন আমার সাথে চলে আসবে । এখন ও বাসায় নাই বলে আপাতত একা আছি । সন্ধায় আসবে, তখন আমার রুমে চলে আসবে ।" আবির মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে বলল, "যাক তাও ভালো । তুমি একা থাকতে পারলে তো সূর্য পশ্চিম দিকে উঠত । নাবিলা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, "এই! আমাকে নিয়া মজা করবা না!" আবির হাসি মুখে তাকিয়ে বলল, "মজা করলাম, এতো দিরিয়াস নেয়ার কি আছে?" এরপর অনেক কথা বলল ওরা দুজন । বিশেষত এই স্কুলের কথা । নাবিলা জেনে নিলো নিয়মকানুনগুলো । সেদিন রাতের কথা । আবির, শিমুল আর জামি ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছিল । জামি জিজ্ঞেস করলো, "কিরে ছোটু, দুপুরে গেছিলি কই?" আবির জবাব দিল, "গেছিলাম এক জায়গায় । কাম ছিল একটু ।" জামি তখন শিমুলের দিকে তাকিয়ে বলল, "কিরে লম্বু, তাই নাকি? আমরা জানি ওরে কার লগে দেখলাম?" কথাটা শুনে আবিরের গলায় খাবার আটকে গেলো । কেশী উঠলো । সামনে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল জামি । আবির পানি খেয়ে স্বাভাবিক হল । শিমুল বলল, "দ্যাখ মোটু, সত্যি কথা হুনলেই সবডির গলায় খাবার আটকায় । তাইলে ক, আমরা কার লগে থাকছি এতদিন?" আবির বিরক্তির সাথে বলল, "তগো সমস্যা কি? আমি কই থাকি কার লগে থাকি এই লইয়া তগো কি? এতো মানুষের পার্সোনাল ব্যাপারে নাক গলাস ক্যান?" জামি তখন আবিরকে শান্ত করার জন্য বলল, "আরে ভাই? তুই রাগতেছোস ক্যান? আমরা তো মজা লইতাছিলাম? তা কেমন কাটল অর লগে?" আবির বলল, "দ্যাখ, ও আমার ছোট বেলার বন্ধু । উল্টাপাল্টা কিছু বলিস না ।" শিমুল তখন বলল, "বাহ ভাই বাহ! এ তো দেখি দেখা হল বছর কয়েক পর!" বলেই হেসে দিল জামি আর শিমুল দুজনেই । জামি জানতে চাইলো, "নাম কিরে?" "নাবিলা ।" খেতে খেতে জবাব দিল আবির । শিমুল বলল, "আমাগো লগে একটু পরিচয় করায় দিছ ।" জামিও তাল মিলিয়ে বলল, "আমার লগেও ।" আবির আড়চোখে জামি আর শিমুলের দিকে তাকিয়ে বলল, "তোরা মানুষ হবি না ।" পরদিন সকালের কথা । অ্যাসেম্বলিতে দাড়িয়ে সব ছাত্রছাত্রীরা । নিয়ম অনুযায়ী সব ক্লাসের প্রিফেক্টদের তাদের ক্লাসের লাইনের সামনে দাঁড়াতে হয় । তাই আবিরও দাড়িয়ে সামনে । আজ নতুন প্রিন্সিপ্যাল আসবেন । আবির পেছন ফিরে মেয়েদের লাইনের দিকে একটু দেখল, নাবিলা এসেছে কিনা । খেয়াল করে দেখল পেছনের দিকে দাড়িয়ে নাবিলা । যাক । অন্তত এসেছে তো । বাকিটা দেখতে দেখতে শিখে যাবে । এমন সময় সামনে থেকে টিচার কমান্ড দিলেন, "স্টুডেন্টস, সাবধান হবে, সাবধান!" সবাই সাবধান অবস্থায় দাঁড়ালো । বুঝল, নতুন প্রিন্সিপ্যাল এসে গেছেন । আবির বামে তাকিয়ে দেখল নতুন প্রিন্সিপ্যালকে । কেমন একটা উদ্ধত ভাব নিয়ে এগিয়ে আসছে । প্রিন্সিপ্যাল স্যার সামনে এসে দাঁড়ালো । "আরে? স্যার এর সাথে ওটা কে?" পেছন থেকে বলে উঠলো জামি । আবির ভালো করে খেয়াল করে দেখল, প্রিন্সিপ্যাল স্যার এর সাথে একটা ছেলে । দেখে মনে হচ্ছে ওদেরই বয়সি । যাই হোক, এরপর অ্যাসেম্বলি শুরু হল । প্রথমে কুরআন পাঠ, এরপর শপথ গ্রহন, এরপর জাতীয় সঙ্গীত শ্রবন, এরপর জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন । স্কুলের প্রধান শিক্ষক তখন মাউথপিসে বললেন, "আমাদের নতুন প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে এখন অনুরোধ করবো ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে ।" প্রিন্সিপ্যাল স্যার হাতে মাউথপিস নিলেন । এরপর বেশ কর্কশ গলায় বললেন, "কি খবর, ভালো আছো?" সবাই জি স্যার বলে উঠলো মাঠ থেকে । "আমি তোমাদের নতুন প্রিন্সিপ্যাল, বুঝলে, আমি এখন এই স্কুল সামলাবো । তো, তোমরা শৃঙ্খল থাকবে, ভালোভাবে থাকবে । আর কি বলব ।" বলেই মাউথপিস প্রধান শিক্ষকের হাতে দিলেন প্রিন্সিপ্যাল স্যার । প্রধান শিক্ষক স্যার এর নাম রাশেদ স্যার । নেমপ্লেটে নামটা দেখে প্রিন্সিপ্যাল স্যার উনার পাশে থাকা ছেলে দেখিয়ে রাশেদ স্যারকে বললেন, "এই যে রাশেদ স্যার, এ আমার ভাতিজা হয় । ছেলে অনাথ, এতো বছর আমার সাথে ঢাকায় একটা অনাথ স্কুলে ছিল । আমি চাই, ও এখন এই স্কুলে পরুক ।" রাশেদ স্যার তখন হাসিমুখে বললেন, "জি স্যার, অবশ্যই । ও কোন ক্লাসে স্যার?" "ক্লাস টেনে পড়ে ।" বললেন প্রিন্সিপ্যাল স্যার । রাশেদ স্যার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "তোমার নাম কি বাবা?" "অর্ক।" বলল ছেলেটা । কেমন একটা ভাব নিয়ে কথাটা বলল । মনে হচ্ছে না একজন টিচারের সামনে কথা বলছে । রাশেদ স্যার কিছু বললেন না । প্রিন্সিপ্যাল স্যার বললেন, "এই যে রাশেদ স্যার, ওকে ভালো একটা রুম দেবেন কিন্তু । এখানে আমার সাথে থাকতে চাচ্ছে না । আর ও যেন ক্লাস টেনের প্রিফেক্ট হয় ।" রাশেদ স্যার একটু অবাক হয়ে বললেন, "স্যার রুম তো অবশ্যই ভালো দেবো, কিন্তু স্যার প্রিফেক্ট হওয়ার জন্য যে যোগ্যতা লাগে সেটা........." রাশেদ স্যার এর কথা শেষ হতে না হতেই প্রিন্সিপ্যাল স্যার ক্ষিপ্ত মেজাজে বললেন, "আপনার এতো বড় সাহস! আমার মুখে মুখে কথা বলেন? আমি যা বলেছি তাই হবে । নাহলে আমি আপনার কি করতে পারি তা আপনার জানা নেই ।" রাশেদ স্যার মাথা নিচু করে বললেন, "সরি স্যার ।" এরপর ওখান থেকে চলে এলেন ছেলেটাকে নিয়ে । প্রিন্সিপ্যাল স্যার আবার যেদিক দিয়ে এসেছিলেন, সেদিক দিয়েই ফিরে গেলেন । রাশেদ স্যার আবিরের কাছে যেয়ে বললেন, "সরি আবির । আমি এমনটা কখনই চাই নি ।" আবির হালকা হাসিমুখে বলল, "ছি ছি স্যার, এভাবে বলবেন না, আপনার তো এখানে কোন দোষ নেই । এখন প্রিন্সিপ্যাল স্যার বলেছেন কি আর করার ।" আবির কলার থেকে প্রিফেক্ট ব্যাচ খুলে রাশেদ স্যার এর হাতে দিল । একটু দুরেই ওই অর্ক নামের ছেলেটা দাড়িয়ে ছিল । মেজাজ দেখিয়ে বলল, "আপনার এতক্ষণ লাগে কেন স্যার?" রাশেদ স্যার এর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো । এতো অভদ্র কেন ছেলেটা? কাছে যেয়ে ধমকের সাথে বললেন, "এই ছেলে? তোমার কি ভদ্রতা বলে কিছু নেই?" ছেলেটা অসভ্যের মতো স্যার এর দিকে আঙ্গুল তুলে বলল, "এই! আমার ক্ষমতা জানেন আপনি? আমার চাচা এই স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল কিন্তু? এক্কেরে চাকরি থেইকা বাইর কইরা দিমু!" রাশেদ স্যার রাগ হল বটে, কিন্তু কিছু বললেন না । বুঝলেন, আজ থেকে এই স্কুলে ক্ষমতার বড়াই শুরু হতে চলেছে । আবির দূর থেকে ছেলেটাকে ভালো করে দেখল মনে মনে বলল, "একবার আয় আমাগো হোস্টেল বিল্ডিং, দেখায় দিমু, কতো ধানে কতো মুড়ি!" অর্ককে রাখা হল আবিরদের নিচতলায় আবিরদের অন্য দুই বন্ধু পরশ আর রিভুর সাথে । সবাই ক্লাসে চলে গেলেও ছেলেটা সেদিন ক্লাস করলো না । সেদিন রাতে আবির ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছিল, এমন সময় শোনা গেলো তুমুল ঝগড়া ঝাটি । নিচতলা থেকে এলো প্রচুর আওয়াজ আসছিল কিন্তু তেমনভাবে শোনা গেলো না বিধায় এখনও কিছু স্পষ্ট হয়ে উঠলো না ওদের কাছে । আবির জামি আর শিমুল একে অপরের দিকে তাকাল । তারপর প্লেটে খাবার রেখেই হাত ধুয়ে দরজা খুলে শুনতে চেষ্টা করলো । তাকিয়ে দেখল, শুধু ওরাই না । পাশের রুম থেকেও দরজা খুলে শোনার চেষ্টা করছিলো নাবিলা আর ওর রুমমেট নিশি । আবির ঈশারা করে অল্প আওয়াজে নাবিলাকে বলল, "কি হয়েছে?" নাবিলা ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বোঝাল, ও কিছু বুঝতে পারছে না । আবির আবারো বলল, "নিচে যাবা?" ওরা সম্মতি জানাল । ওরা পাঁচজন নিচে এসে দেখল, শুধু ওরাই না, পুরো হোস্টেলের সবাই এসে দরজার সামনে ভিড়েছে রিভুদের ঘরে । দরজা খোলা । ভেতর থেকে খুব সম্ভবত অর্ক চিৎকার করে বলছে, "আমি এসব মানবো । যদি আপনারা কোন ব্যাবস্থা না করেন, তাহলে আমি আপনাদের চাকরি খাব কিন্তু ।" আবির ওর পাচ বন্ধুর সাথে নিচে নেমে এলো । পেছন থেকে উঁকি দিয়ে দেখল, অর্ক একটা বেশ রাগি মেজাজে দাড়িয়ে । সামনে রাশেদ স্যার আর পাপলু আঙ্কেল মাথা নিচু করে দাড়িয়ে । খাবার টেবিলে দাড়িয়ে রিভু আর পরশ । পরশের বাংলার পাঁচের মতো চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, পরশই এই ঘটনার মুল হোতা । পাপলু আঙ্কেল বিনয়ের সাথে বলল, "আচ্ছা, এটা তো এই স্কুলের নিয়ম......" অর্ক তখন চোখ গরম করে পাপলুর সামনে এসে আঙ্গুল তুলে বলল, "এই! কে আপনি! নিয়ম দেখাচ্ছেন আমারে? নিয়ম? আপনি জানেন না আমার চাচা এই স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল? আপনার কি মনে হয়, আমার এদের সাথে বসে খাওয়া মানায়?" আবির কিছুটা আঁচ করলো, আসলে ঘটনা কি ঘটতে পারে । কিন্তু এখনও মুখ খুলল না । রাশেদ স্যার তখন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, ঈশারা করে থামিয়ে দিল পাপলু আঙ্কেল । অর্ক তখন আবারো বলল, "এসব ছ্যাঁচড়া ছেলেপেলের পাশে আমাকে মানায় না । আমি স্ট্যাটাসটাই ওদের থেকে অনেক উপরে । আপনাদের বলে দেয়া উচিৎ ছিল আমাকে যেন এমন রুম দেয়া হয়, যেখানে আর কেউ না থাকে । আমি জানি না আপনারা কি ব্যাবস্থা করবেন, নইলে আমি কিন্তু কঠোর সিদ্ধান্তে যেতে বাধ্য হবো?" বেচারা পরশ এবার চুপসে গেছে । ও বরাবরই বেশ ভিতু । কিন্তু রিভু আবার খুব সাহসী । এই অপমান সহ্য করতে না পেরে কিছু একটা প্রায় বলা শুরু করেছে, অমনি ভিড় ঠেলে ভেতরে এলো আবির । রিভুকে বলল, "এই, তোর সাহস তো কম না, ভাইয়ের মুখে মুখে কথা বলছিস? এমনিতেই করেছিস এক ভুল আবার মুখ খুলিস ।" রাশেদ স্যার বলল, "আবির তুমি এখান থেকে যাও ।" আবির স্যারকে বলল, "না স্যার আমায় বলতে দিন । ভাই আজই এই স্কুলে এসেছে, আর আজই যদি উনার অপমান হয়, এই কলেজের মান থাকবে?" সবাই আবিরকে দেখে অবাক হয়ে গেলো । কি বলছে ও? দরজার সামনে দাড়িয়ে সবাই বিড়বিড় করতে লাগলো । আবির তখন বলে উঠলো, "এই রিভু আর পরশ, তোরা ব্যাগ গুছায় ল, তোরা আইজ থেইকা আমাগো লগে থাকবি । ভাই একা থাকবো । রিভু আবারো কিছু একটা বলতে গেলো আবির থামিয়ে বলল, "আরে যা কইতাছি কর না!" রিভু আর পরশ চলে গেলো । এরপর দরজায় যারা দাড়িয়ে ছিল, আবির ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, "তোরা আবার দাঁড়ায় আছিস ক্যান? যা, রুমে যা ।" সবাই চলে গেলো । নাবিলা কেবল দাড়িয়ে রইল এক অবাক ভঙ্গিতে । ও ভাবছে, এটা আবিরই তো? আবির ইশারা করে অনুনয়ের ভঙ্গিতে নাবিলাকে যেতে বলল । নাবিলা চলে গেলো । এরপর আবির রাশেদ স্যার আর পাপলু আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে বলল, "স্যার, আপনি যান তাহলে । আর পাপলু আঙ্কেল, আপনিও যান ।" উনারা কিছুক্ষন আবিরের আপাদমস্তক চোখ বোলাল । তারপর চলে গেলো সেখান থেকে । যাবার সময়ও বার বার তাকাচ্ছিল আবিরের দিকে উনারা চলে গেলে আবির দেখল, পরশ আর রিভু এসেছে সবকিছু নিয়ে । আবির বলল, "বাহ, সব গোছানো এতো তাড়াতাড়ি শেষ?" রিভু বলল, "আমাদের আছেই বা কি? আমাদের তো আর ভাগ্য করে প্রিন্সিপ্যাল চাচা জোটে নি, কিংবা প্রিন্সিপ্যাল এর চাচার ভাতিজার জন্য চামচামি করার ইচ্ছাও জাগে নি ।" কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে অর্ক ওদের দুজনের দিকে তাকাল । কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু আবির কায়দা করে ঈশারা করে থামিয়ে দিল । তবে, ওদের বলা শেষ কথাটা আবিরকে বেশ কষ্ট দিল । ওরা চলে যাবার পর অর্ক আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, "বাহ, তুই তো শালা বেশ আছিস, তোর মতো পোলাপাইন-ই তো দরকার আমার । আবিরও খানিকটা তেল দিয়ে বলল, "কি যে কন, আপনের মতো এতো বড় মানুষ, প্রিন্সিপ্যাল স্যার এর ভাতিজা, আপনাগো লগে আমি ক্যামনে খারাপ আচরন সহ্য করতে পারি কন?" অর্ক আবিরের কাধে হাত রেখে বলল, "যাক । বুঝছিস তাইলে । তয় তোর মতো আরও কয়েকটা পাইলে ভালো হইত । আবির বলল, "অবশ্যই, ক্যান না? তয়, মাথায় রাইখেন, সবাই আপনার বন্ধু হইয়াও আপনেরই ক্ষতি করার চেষ্টা করবো । আবির কথাটা এমন গম্ভীরভাবে বলল, শুনে আবিরের কাধ থেকে হাত সরিয়ে একটা দূরে সরে গেলো । আবির আবারো হেসে বলল, "না না, ভয় পাইয়েন না, আমি আপনের কাছে যারা ওই কাজ করবো, তাগো ধইরা আনমু ।" অর্ক একটা শ্বাস ফেলল । তারপর বলল, "ভালো ভালো । যা তাইলে এহন, আমি একটু রেস্ট লই ।" "হ অবশ্যই, যাই তাইলে ।" বলেই চলে গেলো আবির । যাবার সময় দরজার সামনে একটু দাড়িয়ে অর্কর দিকে তাকাল । অর্ক যখন টের পেলো, তখন আবির "আসি।" বলে চলে গেলো নিজের রুমে । চারতলায় আসতেই আবির দেখল, রাশেদ স্যার, পাপলু আঙ্কেল, রিভু, পরশ, নিশি, নাবিলা সবাই আবিরদের ঘরে । রাশেদ স্যার আর পরশের চাহনি দেখে বোঝা যাচ্ছে রেগে আছেন । নিজেদের রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে জামি আর শিমুল । আবির রুমে ঢুকে কিছুক্ষন সবার দিকে এক নজর তাকাল । তারপর দরজা লাগাতেই রিভু আবিরের দিকে তেড়ে এসে আবিরের কলার ধরে আবিরের পিঠ দরজায় লাগিয়ে ক্ষিপ্ত মেজাজে বলল, "এটা তুই কি করলি?" পাপলু আঙ্কেল আর জামি এসে অনেক কষ্টে রিভুকে দূরে সরালো । রিভু তো স্যার এর সামনেই আবিরকে নোংরা ভাষায় গালিগালাজ দিতে লাগলো । পাপলু আঙ্কেল অনেকবার বললও, স্যার আছে, মুখ সামলাও, সংযত হও, কিন্তু না থামল রিভু,না কিছু বললেন রাশেদ স্যার । আবির কিন্তু কিছুই বলল না । দাঁড়িয়েই রইল । কিছুক্ষন পর রিভু থামলে আবির রিভুর কাছে এগিয়ে এলো । রিভু জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলো । আবির রিভুর কাধে হাত রেখে কিছু বলতে যাবে, কিন্তু রিভু আবিরের হাত সরিয়ে জোর গলায় বলল, "ছুবিনা আমাকে ।" আবির হাত সরিয়ে নিলো । তারপর বলল, "তোরা আমার অনেক ভালো বন্ধু, জামি আর শিমুলের সাথেই থাকি বলে আমি যে তোদেরকে ওদের চেয়ে কম ভাবি তা কিন্তু না । জানি মানুষটা আমি একটু বেশি জেদি, যা ভাবি তাই করি, কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমি কখনো ভুল কিছু করি না । তাই আশা করি এবারেও যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটাতেও আমি সফল হবো ।" রাশেদ স্যার আবিরের দিকে তাকিয়ে বললেন, "আমি একজন স্যার এবং তোমার চেয়ে বয়সে বড়, যদি তোমার সমবয়সী হতাম না, তবে আমিও তোমাকে হয়তো অনেক আজে বাজে গালিগালাজ করতাম । আমি তো এ পর্যন্ত এটাই বুঝে পেলাম না, তোমার মতো একটা ভালো ছেলে কি করে ওই বাজে ছেলেটার পক্ষে কথা বলে?" আবির তখন বলল, "স্যার, আপনি এখনও বুঝে পান নি, তাহলে এটা কি করে বুঝলেন আমি ওর পক্ষে কথা বলেছি?" সবাই আবিরের দিকে অবাক চোখে তাকাল । রাশেদ স্যার এক কদম হেটে বললেন, "মানে কি?" আবির বলল, "স্যার, শত্রুকে দমন করতে হলে আগে শত্রুর সম্পর্কে একটু জানতে হয় । আর জানতে হলে শত্রুকে বন্ধু বানাতে হয় ।" রাশেদ স্যার বললেন, "তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!" আবির বলল, "আজ বুঝবেন না স্যার । কোনদিন বুঝবেন, সেটাও আমার জানা নেই । কিন্তু যেদিন বুঝবেন, সেদিন আপনি আফসোস করবেন, আমাকে আপনি ভুল বুঝেছিলেন ।" রাশেদ স্যার পাপলু আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, "এই পাপলু? এই ছেলে বলে কি এসব?" পাপলু আঙ্কেল একবার আবিরের দিকে তাকিয়ে আবার রাশেদ স্যার এর দিকে তাকিয়ে বললো, "স্যার, আপনি বাসায় চলে যান । এমনিতেও এতো রাত্রে কষ্ট করে আপনি এসেছেন, এখন চলে যান । কাল আবার আপনাকে স্কুলে আসা লাগবে । রাশেদ স্যার মুচকি হাসলেন । তারপর বললেন, "বাহ! বা বা বা বাহ! তুমিও দেখি ওর সঙ্গ দিচ্ছ?" পাপলু আঙ্কেল বললেন, "না স্যার, আমি সেটা বলছি না । কিন্তু আমার ওর ওপর ভরসা আছে ।" পাপলু আঙ্কেল হয়তো আরও কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু তা বলতে না দিয়ে রাশেদ স্যার বললেন, "একই তো কথা! আমি জাস্ট নিতে পারছি না । থাকো তোমরা ।" বলেই সেখান থেকে চলে গেলেন রাশেদ স্যার । যাবার সময় এমন জোরে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন, পুরো বিল্ডিং মনে হল কেপে উঠলো । আবির পেছন ফিরে সবার দিকে তাকাল । পরশের দিকে তাকিয়ে বলল, "পরশ, হয়েছিলো টা কি ওখানে?" পরশ বলল, "আমি খাওয়ার জন্য ডাইনিং টেবিলে বসছিলাম । কিন্তু হাত ফসকে আমার হাত থেকে গামছাটা পড়ে যায় অর্কর প্লেটের ওপর । এজন্য ও এতো ঝামেলা করলো ।" আবির মেঝের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলো । তারপর রিভু আর পরশকে বলল, "তোরা কষ্ট করে আজ আমার রুমে শুয়ে পড় ।" পরে শিমুলের দিকে তাকিয়ে বলল, "দোস্ত, আজকের জন্য একটু কষ্ট কর, আজ আমি তোর সাথে শোব ।" শিমুল তাড়াতাড়ি করে বলল, "না ভাই, মাফ কর । আমার একা শোয়ার অভ্যাস, পাশে কেউ শুলে আমার ঘুম ধরে না । আবির জামির দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই জামি বলল, "না ভাই, আমারে আগেই মাফ কর, আমি একাই ভাই দুইজন । একলাই আরামে এক খাটে শুইতে পারি না, আবার আরেকজন আইলে তো শেষ । তার ওপর আমার বালিশও একটাই ।" আবির হতাশ হয়ে পড়লো । পরশ আর রিভু এর মধ্যে আবিরের রুমে চলে গেলো । নাবিলা তখন বলল, "আবির, আমাদের ঘরে তো একটা রুম ফাকা আছে, তুমি না হয় পাপলু আঙ্কেলের কাছ থেকে চাবি এনে ওখানে থাকো আজকের জন্য?" আবির বলল, "না না, তা করা ঠিক না । এমনিতেই আমার ওপর সবাই রেগে আছে, তার ওপর আমাকে যদি কেউ মেয়েদের রুমে দ্যাখে, তাহলে ব্যাপারটা ভালো হবে না ।" শিমুল বলল, "তাহলে তুই থাকবি কই?" আবির শিমুলের দিকে হালকা বিরক্তির সাথে তাকিয়ে বলল, "আমার মেজাজটা না এখন খারাপ হয়ে আছে । চাইলে তুই যে প্রায়ই বলিস, তোর নানির কি যেন একটা, ওটা এখন আমিও বলতে পারতাম । কিন্তু বলার ইচ্ছা নেই । যে বন্ধু তার বন্ধুর জন্য একটা দিন স্যাক্রিফাইস করতে পারে না, সে আবার কিসের বন্ধু?" শিমুল মাথা নিচু করলো । একটু পড়ে জামি বলল, "দ্যাখ আবির, তুই কিন্তু আমাদের ভুল বুঝছিস! আমরা তো তোকে নিয়ে ভাবছিই" আবির বলল, "তোদের আমার চিন্তা করা লাগবে না । তোরা ঘুমা । আরও যদি বালিশ-টালিশ লাগে, কইস, আমি আমার চামড়া কাইটা বানায় দিমুনে ।" জামিও মাথা নিচু করলো । আবির বলল, "যা তোরা ঘুমা ।" ওরা গেলো না । আবির আবারো জোর গলায় বলল, "কিরে? যাইতে কইছি না?" এবার দুজনেই দরজা লাগিয়ে চলে গেলো । এরপর নিশি আর নাবিলার দিকে তাকিয়ে বলল, "যাও, তোমরাও যাও । নাবিলা নিশিকে বলল, "তুই যা, আমি আসছি ।" নিশি "আচ্ছা" বলে রুমে চলে গেলো । নাবিলা আবিরের কাছে গেলো । আবির নাবিলার দিকে না তাকিয়েই বলল, "রুমে যাও নাবিলা, কথা বলার মুড নেই এখন ।" নাবিলা বলল, "আমি জানি তোমার কথা বলার মুড নেই । শুধু জানতে চাচ্ছিলাম শোবে কোথায়?" আবির নাবিলার দিকে তাকিয়েই রইল । নাবিলা বলল, "কি দ্যাখো?" "ঘুম ।" নাবিলা বলল, "ঘুম ধরেনি আমার । আগে তোমার শোবার ব্যাবস্থা করবো, তারপর ঘুম আসবে ।" আবির হালকা হেসে বলল, "ওরে পাগল, এক রাত না ঘুমালে তেমন কিছু হয় না । আর আমি তো ছেলে মানুষ । ছেলে মানুষদের এক জায়গায় ঘুমালেই হল । জায়গার অভাব আছে নাকি?" নাবিলা একটু থেমে বলল, "তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছ, তাইনা?" " উহু । ছেলে মানুষের কষ্ট থাকে না । এবার যাও ঘুমিয়ে পড়ো ।" নাবিলা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আবিরের দিকে । যেন শেষ কথাটা ওর কানে যায় নি ।" আবির আবারো বলল, "কি হল, যাও?" এবার নাবিলা উপর নিচে মাথা নাড়ল । তারপর নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল । যাবার সময় একাধিকবার আবিরের দিকে তাকাল । আবিরও নাবিলার দিকে যতক্ষণ দেখা যায়, ততোক্ষণ তাকিয়েই রইল । নাবিলা চলে গেলো । একা দাড়িয়ে রইল আবির । জামির ঘর থেকে নাক ডাকার আওয়াজ আসছে । মানে জামি ঘুমিয়ে পড়েছে । শিমুলের ঘরের দরজা দিয়ে আলো আসছে না । তার মানে শিমুল মোবাইলও চালাচ্ছে না । মানে শিমুলও ঘুমিয়ে পড়েছে । জামি যদিও তাড়াতাড়ি ঘুমায়, কিন্তু শিমুল ঘুমায় না । আজ হয়তোবা কোন কারণে ঘুমিয়েছে । আবির ঘরটা থেকে বেড়িয়ে এলো । দরজা চাপিয়ে দিল । তারপর ধীরে ধীরে ছাদে উঠে এলো । যেহেতু আবির প্রিফেক্ট ছিল, তাই চাবি আবিরের কাছে থাকতো, এখনও আছে । অর্ককে এখনও দেয়া হয়নি । ছাদের দরজা খুলতেই ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকল ভেতরে । আকাশে বার বার নিঃশব্দে বাজ পড়বার আলো দেখা যাচ্ছে । সম্ভবত বৃষ্টি হবে । ছাদের একটা কিনারায় একটা ছোট চারপায়া । ছাদের সিঁড়ির পাশে একটা পুরনো ব্যাগ পড়ে আছে । আবির সেই ব্যাগটা নিয়ে ওই চারপায়ার দিকে গেলো । উত্তর চারপায়ার একপাশে ব্যাগটা রেখে ওটাকে বালিশ বানিয়ে ওর ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লো আবির । পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখল, রাত ১২টা ৭বাজে । চারপায়াটা বেশ বড় । অনায়াসে ২জন শুতে পারবে । কিন্তু আবির একপাশেই শুয়ে রইল । আবির বুঝল, আজ ঘুম এতো তাড়াতাড়ি ধরছে না । না আছে তোষক, না আছে জাজিম, না আছে চাদর, বালিশটাও শক্ত কাপরের ব্যাগ শুধু কাঠের বিছানায় কারই বা এতো সহজে ঘুম ধরবে? তারপর কিছুক্ষন পর পর ক্ষণিকের জন্য আলোর ছটা চোখের সামনে । বাজ পড়বার ভয়টাও রয়েছে । আবার বৃষ্টি পড়লেও বিছানাটা ছেড়ে সিঁড়িঘরে যেয়ে ঘুমাতে হবে । আবির তাও ঘুমাবার চেষ্টা করলো । আবিরের বামে ১হাত দুরেই ছাদের রেলিং । আর ডানে প্রায় ৪০মিটার দূরে ছাদের সিরিঘর । আবির ডানদিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো । সোজা আকাশের দিকে তাকিয়ে আর শুয়ে থাকা যাচ্ছে না । সিঁড়িঘর থেকে ৪তলার সিঁড়ির হালকা আলো দেখা যাচ্ছে । সেদিকেই তাকিয়ে রইল আবির । দেখতে দেখতে চোখে যখনি হালকা ঘুম আসতে যাবে, তখনই আকাশ গর্জন শুরু করলো । খুব বেশি জোরে না, কিন্তু সে শব্দ এক প্রকার ভয়ের জাগরণ ঘটাল । আবির একটু আকাশের দিকে তাকাল । আকাশের ক্ষণিকের আলো উজ্জ্বলতা ধীরে ধীরে বারছে আর চোখ ধাঁধানো হয়ে যাচ্ছে । আবির কিছুক্ষন আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার সিঁড়িঘরের দিকে তাকাল । একি? অন্ধকার লাগছে যে? সিঁড়িঘরটায় তো একটু আগেও আলো ছিল! তাহলে কি বেশি আলো দেখে এই আলয়টা এখন বোঝা যাচ্ছে না? আবির একটু চোখ রগড়ে নিয়ে তাকাল । না, এখনও দেখা যাচ্ছে না । আবির উঠে দাড়িয়ে চারপাশে তাকাল । পুরো শহরে আলো নেই । তাহলে বোধ হয় বিদ্যুৎ চলে গেছে । আবির আবার শুয়ে পড়লো । খাটটা টেনে যে ভেতরে নিয়ে যাবে, তার অবকাশও নেই । কারণ খাটটা ছাদের দরজার তুলনায় বেশি প্রশস্ত । আবির আবারো ডানে কাত হল । ঠাণ্ডা বাতাস বইছে । আবির পা ভাজ করে গুটিসুটি হয়ে গেলো । তবুও ঠাণ্ডা লাগছে । আবির কাপতে লাগলো । খানিক পর বাতাস অনেকটা কমে গেলো । কিন্তু আলোর উজ্জ্বলতা আর শব্দ কমলো না । আবির সিঁড়িঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে রইল । কিছুক্ষন পর পরই আকাশের বাজের আলোতে সিঁড়িঘরটা আলোকিত হয়ে যাচ্ছে । এইতো, একবার হল , ভেতরের খানিকটা দেখা যাচ্ছে । আবার আলো পড়লো, এবারেও খানিকটা দেখা যাচ্ছে । আবারো আলো পড়লো, এবার কে যেন দাড়িয়ে.........আরে! কে দাড়িয়ে? আবির হঠাৎ করে উঠে বসলো । হৃদস্পন্দনটা হঠাৎ করে খুব বেড়ে গেলো । এরপর অনেকক্ষণ আলোর ঝলকানি দেখা গেলো না । আবির ভাবল মনের ভুল । শুয়ে পড়লো ব্যাগটায় মাথা রেখে । ঠিক সময় আবারো সেই আলোর ঝলকানি আর এবার আবির স্পষ্ট দেখল কেউ একজন, এবার দরজা থেকে অনেকটা আবিরের দিকে এগিয়ে এসেছে এবং এদিকেই আসছে । আবির বিছানা থেকে উঠে দাড়িয়ে চিৎকার করে বলল, "কে! কে ওখানে!" আরেকটু কাছে আসতেই আলোর ঝলকানিতে মুখটা স্পষ্ট দেখা গেলো । এটা আর কেউ না, রিভু । আবির একটা দম ফেলে খাটে বসে পড়লো । রিভু আবিরের কাছে এসে খাটে বসলো কিন্তু কিছু বলল না । আবিরই বলল, "কি করিস এখানে?" রিভু জবাবে বলল, "সরি দোস্ত!" "আমি রাগ তো রাগ করিনি । রাগ করলে তো বলতামই ।" রিভু আবিরের কাধে হাত রেখে বলল, "না রে দোস্ত, আমার অমন করা উচিৎ হয় নি । আসলে কি বলতো, রেগে গেলে মাথা ঠিক থাকে না ।" আবির বলল, "আমি তো রাগ করিনি রে, বললাম তো । যা তুই ঘুমা ।" "আমি এইখানে ঘুমামু ।" আবির জানতে চাইল, "ক্যান?" "আর কইছ না, শালা পরশ ঘুমের মধ্যে আমারে জড়ায় ধইরা আকাম করা শুরু করছে । এল্লেইগা ওর লগে ঘুমাইতে ভাল্লাগে না ।" আবির খুব হেসে উঠলো । বলল, "বাহ, অবশ্য অয় তো ফোনে যা দ্যাখে, তাতে ঘুমের মধ্যে আকাম করা অস্বাভাবিক না ।" পরশ বলল, "তুই ক্যামনে জানলি?" "অয় আমারে অর ফোন দিছিলো কি একটা দেহার জন্য । পড়ে চাপ লাইগা হিস্টোরিতে চইলা গেছিলো গা । পড়ে দেখলাম ।" রিভুও হেসে উঠলো । তারপর জানতে চাইলো, "কিরে, তুই কি শুইতে দিবি?" আবির বলল, "শুইয়া পর, না তো আর করতে পারি না ।" রিভু ছাদের দরজার দিকের অংশে শুয়ে পড়লো । অনেকক্ষণ ধরে দুজনেই চুপচাপ শুয়ে রইল । কিছুক্ষন পর রিভু খেয়াল করলো, আবির আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে । আবিরের চোখের মধ্যে আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছে । রিভু জিজ্ঞেস করলো, "ঘুম আসতেছে না?" "না ।" জবাব দিল আবির । "একপাশে শুইয়া চোখ বন্ধ কর । আলোর ঝলকানিতে ঘুম ক্যামনে ধরবে?" আবির না কিছু বলল, না কিছু শুনল । রিভু পকেট থেকে মোবাইল বের করলো । ফেসবুকটা বের করে সবার পোস্ট দেখতে লাগলো । কিছুক্ষণ পরপরই সবার শেয়ার করা ফানি ভিডিও আর ছবি দেখে হালকা হাসতে লাগলো রিভু । কিছু পোস্ট আবিরকেও দেখাচ্ছিল । আবিরও হালকা হাসবার চেষ্টা করছিলো । অনেকক্ষণ দেখানোর পর একসময় যখনই রিভু আরেকটা ভিডিও দেখানোর জন্য ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল, "এই ভিডিওটা দ্যাখ ।" আবির বিরক্তির সাথে বলল, "প্লিজ! আর দেখাইস না । ভাল্লাগতেছে না ।" রিভু কিছু বলল না । আবিরের বিপরীত দিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো রিভু । ও নিজের মতো ভিডিও আর ছবি দেখতে লাগলো । ভিডিওগুলোর শব্দ আবিরের কানেও আসছিলো । প্রথমে ভেবেছিলো সাউন্ডটা একটু কমাতে বলবে, কিন্তু পড়ে আবার ভাবল না থাক, ছেলে আবার রাগ করতে পারে । আবির এই শব্দের প্রতি তেমন মনোযোগ দিচ্ছিল না । চুপচাপ শুয়ে রইলো । একটু পর রিভুর মোবাইলে কোন একটা ভিডিও থেকে মহিলা কণ্ঠে শব্দ এলো, "দ্বীপ এমন করিস না!" আবির চমকে উঠলো । দ্বীপ! আবির শব্দের দিকে মনোযোগ দিল । আবার কর্কশ কণ্ঠে একটা আওয়াজ এলো, "আমারে ট্যাকা দে! নাইলে সব ভাংমু আমি!" এরপরই পুরুষ কণ্ঠের কারো আওয়াজ এলো, "থাক পায়েল, বাদ দাও । একদিনের শাসনে ওকে নেশামুক্ত করা যাবে না ।" আবির পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখবার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না । পড়ে রিভুকেই বলল, "দোস্ত, এই ভিডিওটা একটু দেহি!" রিভু কিছু বলল না । "হ দ্যাখ ।" রিভু ভিডিওটা শুরুর দিকে টেনে আবিরের হাতে দিল । আবির দেখল । একটু দূরে দাড়িয়ে ওর বয়সী একটা ছেলে । আশপাশের ফুলদানী, শো-পিস, সব ভাংছে । ঘরটা দেখে বুঝতে বাকি রইল না, এটা ওরই সেই ছোটবেলার নকল ভাই, দ্বীপ । চেহারা অনেক পাল্টে গেছে । একটু পর একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা দরজার কাছে এসে বলে, "দ্বীপ এমন করিস না!" আবিরের চিনতে ভুল হল না, এটা ওর সেই নকল মা, পায়েল । তারপর দ্বীপ আরও কিছু ভেঙ্গে বলল, "আমারে ট্যাকা দে! নাইলে সব ভাংমু আমি!" পায়েলের চোখ থেকে জল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । একটু পরই আরেকজন লোক এসে পায়েলের কাধে হাত রেখে বলে, "থাক পায়েল, বাদ দাও । একদিনের শাসনে ওকে নেশামুক্ত করা যাবে না ।" এরপর লোকটা দ্বীপের দিকে টাকা ছুঁড়ে মারে । তারপর দ্বীপ ঘরের দরজা দিয়ে দৌড়ে বেড়িয়ে যায় । পায়েল ইফাজের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে । ইফাজও চোখ মোছে । আবিরের খুব কষ্ট লাগলো ভিডিওটা দেখে । দ্বীপ তাহলে আসলেই মানুষ হয় নি । এটা আবির যদিও ছোটবেলাতেই আঁচ করেছিলো কিন্তু এবার স্বচক্ষেই দেখে নিলো । হঠাৎ করে এরকম এই ভিডিওটা দেখে বেশ হতবাক হল আবির । কিন্তু কি আর করার, আবেগটা ভেতরেই পুশে রাখল । বের করলে আবার রিভুকে কৈফিয়ত দিতে হবে । আবিরের নিজের ফেসবুক আইডি না থাকলেও আবির ফেসবুক চালাতে জানত । দেখল, ভিডিওটা পোস্ট করেছে একটা ছেলে, নাম সৈকত । আবির চেনে সৈকতকে । ছোটবেলায় দ্বীপের সাথে অনেকবার স্কুলের সৈকতকে দেখেছে আবির । উপরে ক্যাপশনে লেখা দেখল, "আমার বন্ধু দ্বীপ । ছোটবেলা থেকেই ভালো বন্ধু ছিলাম । কিন্তু আজ সে বখে গেছে । সে এখন মারাত্মক নেশাগ্রস্থ । সে টাকার জন্য নিজের বাবা মা-কে পর্যন্ত মারতে এগিয়ে আসে । সবাই দোয়া করবেন যেন আল্লাহ ছেলেটাকে হেদায়েত ডান করেন ।" এরপরই দ্বীপকে মেনশন করেছে সৈকত । দ্বীপের আইডির নাম "হট বয় দ্বীপ ।" প্রোফাইল পিকচার দেয়া মুখে সিগারেট নিয়ে খালি গায়ে ছাদে দাড়িয়ে । চেহারা নষ্ট হয়ে গেছে ছেলেটার । আবির দ্বীপের আইডি একটু দেখতে লাগলো । বেশিরভাগই অশ্লীল সব ছবি আর ভিডিও শেয়ার করেছে দ্বীপ । আর নিজের যতো ছবি আছে, সব সিগারেট কিংবা মদ নিয়ে । কোনটা খালি গায়ে, কোনটা শার্ট গায়ে বোতাম খুলে । আবিরের আর সহ্য হল না । দ্বীপের আইডি থেকে বেড়িয়ে ফোনটা রিভুকে দিয়ে দিল । তারপর নিজের মতো আবারো আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল । রিভু জানতে চাইলো, "কি দেখলি তুই?" "তেমন কিছু না, শুধু দেখলাম মানুষ কতো খারাপ ।"রিভু বলল, "হ্যাঁ রে । আর এর প্রমান আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না ।" আবির রিভুর দিকে তাকাল । চেহারাটা কেমন বিমর্ষ হয়ে গেছে এক মুহূর্তের মধ্যে । আবির রিভু দিকে ঘুরে শুয়ে পড়লো । জানতে চাইলো, "কেন?" রিভু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল । আবিরও কিছু বলল না । আকাশে এবার বেশ জোরে একটা আওয়াজ হল । আওয়াজটা অনেকক্ষণ ধরে স্থায়ী হল । আওয়াজ শেষে রিভু ওর কাহিনী বলতে শুরু করলো ।





(৪)
রিভু ছোটবেলার ঘটনাগুলো তেমন মনে নেই । যতোটুকু মনে পড়ে, যতদুর মনে পড়ে, রিভু একটা বস্তিতে কোন একটা মেজাজি মহিলার দোকানে কাজ করতো । কি করে করতো, কে-ই বা ওকে এখানে এনেছিল কিংবা কোত্থেকে ও এসেছে তার কিছুই রিভু জানে না । ওই মহিলা রিভুকে ছোটবেলা থেকেই শুনিয়ে এসেছে উনি রিভুর মা নন, রিভুকে কেউ একজন রাতে এই দোকানের সামনে রেখে গিয়েছিলো তাই ওই মহিলা রিভুকে পালা শুরু করেন । রিভুও মহিলাকে কাকিমা বলতো মহিলা বিয়ের ১দিনের মাথায় স্বামীহারা হয়েছিলেন এবং সেই শোকের ভাব কাটিয়ে উঠতেই মেজাজি হয়ে গিয়েছিলেন ধারনা করা এলাকাবাসীর কাছে সব শুনেছিল রিভু । তবে মহিলা বদ মেজাজি হলেও খারাপ না । এই দোকানটা মহিলারও না । মহিলার স্বামীর । মহিলার শ্বশুর শাশুড়ি দোকানের দু বাড়ি পেছনেই থাকেন । মহিলাই রান্না করে খাওয়াতেন । কিন্তু মেজাজের কারণে তেমন একটা কথা বলতেন না মহিলার শ্বশুর শাশুড়ি । তবে বদমেজাজি বলে মহিলা যে কাউকে ভালবাসতেননা, তা-ও নয় । মহিলা সবাইকে মেজাজ দেখিয়ে ভালোবাসতেন এভাবে যেতে থাকে দিন । একদিন হঠাৎ করে রিভুর খুব অসুখ হয় । খুব সম্ভবত জ্বর । পুরনো কথা তেমন মনে নেই । ওষুধ খাওয়ানো সত্ত্বেও কোন লাভ হয়না রিভুর । এদিকে দোকানে খুব একটা সদাই সেদিন বিক্রিও হয় না । খুব বিপদে পড়ে যান ওই মহিলা । এলাকার সবার কাছে টাকা খোঁজেন, কিন্তু পান না । আসল কথা কেউ দেন না । শেষ মেশ এলাকার কিছু বখাটে ছেলেপেলের কাছে টাকা পান । কিন্তু ছেলেপেলে গুলো টাকা দেবার জন্য ওই মহিলাকে একটু ওদের আস্তানায় যেতে বলে কারণ হিসেবে বলে টাকা আস্তানাতাতেই আছে । মহিলা রিভুকে একা ফেলে চলে যান টাকা আনতে । এরপর সময়ের পর সময়ে যেতে থাকে, কিন্তু মহিলা আর আসেন না । এভাবে দেখতে দেখতে অনেক রাত হয়ে যায় । রিভুর জ্বর খানিকটা কমে । বিছানা থেকে উঠে উঠোনে দাঁড়ায় । খুজতে থাকে মহিলাকে । তখনই মনে পড়ে, ওই মহিলা উঠোনে দাড়িয়ে বখাটে ছেলেদের সাথে কথা বলেছিল পড়ে টাকা আনতে ওদের সাথেই গিয়েছে । রিভু বখাটেদের আস্তানা চিনত । তাই দুর্বল শরীর নিয়ে হেঁটে গেলো সেখানে । দরজাটা তালা দেয়া । এমনিতেই অনেক রাত হয়েছে, এতো রাতে মাস্তানরা থাকার কথা না । রিভু চলে আসছিলো এমন সময় আস্তানাটার জানালার দিকে চোখ যায় । কি একটা ঝুলে আছে না? এগিয়ে যায় সেদিকে । জানালার কাছে আসতেই রিভু দেখল.........।

বলতে বলতে থেমে যায় রিভু । ঘটনা বলার শুরু থেকেই আবির রিভুর মুখের দিকে তাকিয়ে । রিভুর মুখভঙ্গি দেখছে । এই মুহূর্তে ওর ঠোঁটগুলো কাঁপছে । দেখে মনে হচ্ছে এখনও ওর সেদিনের সেই কথা মনে পড়ে খুব কষ্ট লাগছে । বজ্রপাতের আওয়াজটা এবার খুব তীব্র হয়েছে । কান আর চোখ দুটোই ধাধিয়ে । ঠাণ্ডা বাতাস আবারো বইতে শুরু করে দিয়েছে । আবির কাঁপছে, কিন্তু রিভু না । খুব সম্ভবত কষ্টটার কারণে । আবির জানতে চাইলো, "কি দেখেছিলি তুই?" রিভু থেমে থেমে কম্পিত কণ্ঠে বলল, "ওই বখাটেগুলো আমার কাকিমাকে ধর্ষণ করে খুন করে রেখেছে ।" আবির অবাক হয়ে গেলো । জিজ্ঞেস করল, "কি বলিস! তুই কাউকে বলতে পারিস নি?" "না । আমি ভয়ে চিৎকার করছিলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একজন বখাটে ছেলে তখন আশেপাশেই ছিল । আমাকে দেখে আমাকে ধরার জন্য ছুটে আসে । আমিও টের পেয়ে ছুট দেই । আসতে আসতে আমি একটা পুকুরপাড়ে চলে আসে । লোকটার হাত থেকে বাচতে আমি পুকুরে ঝাঁপ দেই আর ঝাঁপ দিয়েই আমি সেন্সলেস হয়ে যাই ।" একটু থেমে রিভু আমার বলল, "যখন আমার জ্ঞান ফেরে, আমি দেখি, আমি এই আশ্রমে । যদ্দুর জেনেছি, একজন মাঝি নাকি আমাকে সকালে পুকুরটা অন্য পাড়ে পেয়ে আমাকে আশ্রমে দিয়ে গিয়েছিলো । সেই থেকে আমি এই আশ্রমে ।" আবির নির্বাক হয়ে গেলো । দুনিয়ায় এমন কিছু মানুষ আছে যাদের দেখলে পশুগুলোও বোধ হয় হাসে । পশুগুলোও বোধ হয় এতোটা খারাপ হয় না, যতোটা এসব মানুষ হয় । আবিরের নাবিলার কথা মনে পড়ে গেলো । মনে পড়লো নাবিলার সেই মর্মান্তিক আর নিকৃষ্ট ঘটনাটার কথা । আবির ভাবল সব মানুষেরই জীবনে তাহলে কষ্ট । শুধু আবিরের একারই না । কেবল পার্থক্য এই, আবিরের জীবনে কখনও নাবিলা কিংবা রিভুর মতো মর্মান্তিক আর ভয়াবহ ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় নি । আবির খেয়াল করলো রিভু কাদছে । চোখটা মুছে দিয়ে সাহস দেবার জন্য বলল, "আরে শালা! কাদতেসোস ক্যান?......ধুর! তুই না এত্তো সাহসী! সাহসীগো চোখে পানি মানায় না । নিজেরে শক্ত কর ।" রিভু একটু হেসে বলল, "হ ভাই, ওই দিন থেইকাই নিজেরে সাহসী মনে করি । ভাইবা দ্যাখ, ওই বয়সে ওইরকম একখান দৃশ্য । কততো সাহসী আমি!" আবির ইয়ার্কি করে বলল, "ও ভাই! মারো! মুঝে মারো!" রিভু আবিরকে মারতে মারতে বলল, "এই ল, মারলাম ।" "আরে ভাই মজা লইলাম তো!" তারপর রিভু যেখানে মেরেছে, সেখানে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, "উফ! এততো জোরে মারলি ক্যান?" "সরি ব্রো ।" বলেই রিভু আকাশের দিকে মুখ করে চোখটা বন্ধ করলো । আবির ফোনটা অন করে দেখল, রাত আড়াইটা বাজে । আজকের আবহাওয়াটাও খুব জঘন্য! একবার মনে হচ্ছে এই তো বৃষ্টি এলো বলে, একবার মনে হচ্ছে না বোধ হয়, আজ আর বৃষ্টি এলো না । এইতো একটু আগেও কি চোখ ধাঁধানো আলো আর কানে তালা লাগানো আওয়াজ হচ্ছিলো, এখন তার কিছুই আর তেমন তীব্র নেই । আবিরও চোখটা বন্ধ করলো । ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়লো আবির ।

চোখ খুলতেই সবার আগে নজর পড়লো মেঘাচ্ছন্ন আকাশটা । ততটাও কালো না, তবে বৃষ্টি আসলেও আসতে পারে । আবির উঠে বসলো । ফোনটা অন করে দেখল, ভোর সাড়ে ৬টা বাজে । পাশে শুয়ে রিভু । মুখটা খুলে অদ্ভুত ভঙ্গিতে শুয়ে আছে । দেখে বেশ হাসি পেলো আবিরের । একটা ছবি তুলে রাখল । পড়ে পচানো যাবে । তারপর খাট থেকে উঠে হাঁটতে হাঁটতে ছাদের রেলিংটার কাছে গেলো । এপাশে একটা নারিকেল গাছ । গাছে ঝুলছে একটা বাবুই পাখির বাসা । বাতাসে দুলছে । ভেতরে একটা পাখি বসে কার সাথে যেন কথা বলছে । পাশ দিয়ে সে সময় উড়ে এলো একটা চড়ুই পাখি । ছাদ ঠিক দেখা না গেলেও আবিরের জানা আছে কোন একটা সানসেটের ওপর ভেন্টিলেশনের কোটরে বাসা বেঁধেছে চড়ুই পাখি । আবিরের ওই কবিতার কথা মনে পড়ে গেলো কবি রজনীকান্ত সেনের সই 'স্বাধীনতার সুখ' কবিতাটি । বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই- “কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই; আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা 'পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।'' ঠাণ্ডা হাওয়া এখনও বইছে তবে তা গা সওয়া । এই হাওয়া ভালোই লাগে । সাথে একটা গন্ধ অনেকটা মাটির মতো । এই গন্ধটাও মন ভরিয়ে দেবার মতো । আবির দুহাত উপরে তুলে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে শরীরের জড়তাটা কাটিয়ে নিলো । তারপর পকেতে হাত দিয়ে চারপাশটা দেখতে লাগলো । গেইটের কাছে অনেকগুলো ফুল গাছ । সেখানে পানি দিচ্ছেন পাপলু আঙ্কেল । প্রতিদিনই দেন ।

৮টা ১৫ । বাইরে বেশ বৃষ্টি পড়ছে । তাই আজ আর প্রাতঃ সমাবেশ করা হল না । ক্লাসের ঘণ্টা পড়েছে । টিচার এখনও আসে নি । প্রতিদিন আবির, জামি আর শিমুল একসাথে লাস্টের আগের বেঞ্চে বসতো । আজ জামি আর শিমুল এসে দেখলো, আবির বসেছে রিভুর কাছে । দেখে জামি বলল, "দ্যাখ, হালায় কি স্বার্থপর এতদিন আমাগো দরকার ছিল, আর আমাগো লগে থাকছে, আর এহন ওগো লগে ঘোরে ।" শিমুল বলল, "আসলেই । তুই জানোস, আইজকা সারারাত অয় ছাদে ঘুমাইছিলো, ওই দেইখা ওই রিভু হারামিডাও যাইয়া অর লগে ছাদে ছিল ।" "এহ! ঝগড়া করা আবার আলগা ভাব লয় । বয় এইহানে ।" ওরা দুজন বসে পড়লো । আবির আর রিভুর সাথে অর্কও বসেছে । জানালার পাশটায় রিভু, মাঝে আবির, তার পাশে অর্ক । অর্ক আবিরকে প্রিফেক্ট ব্যাচটা দিয়ে বলল, "অয়, শোন । তুই আগে প্রিফেক্ট ছিলি না?" "হ ভাই।" জবাব দিল আবির । "তাইলে তুই-ই প্রিফেক্ট থাক । এই ধর প্রিফেক্ট ব্যাচ ।" বলেই আবিরের হাতে প্রিফেক্ট ব্যাচটা দিল অর্ক । আবির অবাক হয়ে বলল, "কিন্তু ভাই আপনি......" আবিরকে থামিয়ে দিয়ে অর্ক বলল, "আহ! বেশি কথা কইছ না । ধর কইতাছি ।" আবির প্রিফেক্ট ব্যাচটা নিয়ে হাতের বাহুতে লাগাল । তারপর অর্ক বলল, "শোন, এখন ব্যাপারটা হচ্ছে প্রিফেক্ট মানে খাটা-খাটনি করা । আমি ক্যান খাটমু? খাটবি তুই, আর আমি অর্ডার দিমু ।" আবির কিছু বলল না । অন্যপাশ থেকে রিভু আবিরকে বলল, "দোস্ত, এর পাশে বইবি না কাল থেইকা । এরে দেখলেই আমার গা জ্বলে ।" আবির কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় অর্ক বলে উঠলো, "আর শোন, আমাকে ভাই বলে ডাকোছ, ভালো কথা । আপনি কইরা ডাকার দরকার নাই । তুমি কইরাই কইছ । আর আইজ সবসময় আমার পাশে বইবি ।" আবির রিভুর দিকে তাকিয়ে কিছু করার নেই এরকম ধরনের একটা কিছু হাসিমুখে ঈশারা করলো । রিভু চোখের পাতা একটু নামিয়ে আড়চোখে আবিরের দিকে কিছুক্ষণ তাকাল । যাই, হোক, এরপর ক্লাস শুরু হল । টিফিন পিরিয়ডের কথা । স্কুল ক্যান্টিনে যাচ্ছিলো আবির, এমন সময় পেছন থেকে ডাকল অর্ক । আবির পেছনে ঘুরল । হাতে টাকা নিয়ে আবিরের দিকে ধরে বসে আছে অর্ক । তারপর বেশ একটা জমিদারি ভাব নিয়ে বলল, "এই ১০০টাকা ল । একখান ৫০টাকার বিরিয়ানির প্যাকেট আনবি আর সাথে একখান কোল্ড ড্রিঙ্কস আনবি আড়াইশো মিলি । আইজকা যাইতে ভাল্লাগতেছে না ক্যান্টিনে ।" আবির টাকাটা নিলো । ক্যান্টিন থেকে নিজের টিফিন না খেয়ে অর্কর বলা খাবার কিনে আনল । ক্লাস রুমে এসে দেখল, অর্ক ওখানেই বেশ একটা জমিদারি স্টাইলে বসে । আবির খাবার এগিয়ে দিল । অর্ক বলল, "বাহ, তুই তো বেশ কাজের আছিস দেখছি!" আবির পকেট থেকে ৩০টাকা বের করে অর্কর হাতে দিয়ে বলল, "এই নেন ভাই......" অর্ক চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে কথা শেষ করতে না দিয়েই ধমকের স্বরে বলল, "আবার আপনি করে বলতেছোস?" "ও সরি ভাই! এই নাও তোমার বাকি টাকা ।" অর্ক খেতে খেত বলল, "ওটা তুই রাখ, কিছু কিনা খাইছ । আবির টাকাটা পকেটে ভরল । এরপর বাইরে এলো । বাইরে ওর জন্য অপেক্ষা করছিলো নাবিলা । আবিরকে দেখেই আবিরের হাত ধরে আবিরকে নিয়েই দিল একটা দৌড় । আবির জানতে চাইলো, "আরে! কোথায় নিয়ে যাচ্ছ! আরে......আরে বলবে তো......দাঁড়াও না!" কিন্তু কোন জবাব দেয় না নাবিলা । দৌড়োতে দৌড়োতে স্কুলে মাঠে শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছায় । দুজনেই হাফিয়ে গেছে । আবির জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে জানতে চাইলো, "এখানে আনলে কেন?" নাবিলা কিছু বলে না । শুধু হাত দিয়ে অপেক্ষা করতে বলে নিজেও জোরে জোরে হাফাতে থাকে । একটু পর দুজনেই কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে যায় । নাবিলা একটু পেছন ফিরে কিছু দেখে । তারপর আবিরকে বলে, "তুমি ওই ছেলেটার চামচামো করছ কেন?" আবির বলল, "চামচামো করছি কোথায়? দ্বায়িত্ব পালন করছি!" নাবিলা কপালে হাতের তালু ঠেকিয়ে বলল, "হায় আল্লাহ! তুমি তো দেখি একটা আস্তো গাধা । এটাকে দায়িত্ব বলে?" আবির বলল, "কোনটাকে?" "এই যে, অন্যের টিফিন এনে দেয়াকে?" আবির একটু হাসল । আবিরের হাসি দেখে নাবিলা হালকা বিরক্তির সাথে বলল, "আবির আমি কোন হাসির ব্যাপারে কথা বলছি না ।" আবির হাসি থামিয়ে বলল, "আরে বোকা মেয়ে, আমি তো ওটাকে দায়িত্ব বলিনি । যদিও আমার দায়িত্ব পালনের কাজের মাঝেও এটা অন্তর্ভুক্ত ।" নাবিলা জানতে চাইলো, "তাহলে কোনটাকে বলেছ?" "সেটা তুমি বুঝবে না ।" এরপর মাঠের বাউন্ডারির বাইরে একটা ফুচকার গাড়ি দেখিয়ে আবির বলল, "ফুচকা খাবে?" নাবিলা খুশিমনে বলে, "হ্যাঁ অবশ্যই! উফফ! কতদিন ফুচকা খাই না । চলো যাই ।" আবির জানে এখন নাবিলা কে প্রশ্ন করার সুযোগ না দেবার এই একটাই উপায় । ফুচকা ।






(৫)
স্কুল ছুটি হয় ২টায় । আবির স্কুল শেষে নাম ডাকার খাতাটা নিয়ে টিচার্স রুমে গেলো জমা দেবার জন্য । ক্লাস টিচার খায়রুল স্যার । আবির খাতাটা স্যার এর কাছে দিয়ে সালাম দিয়ে চলে আসতে নেবে, এমন সময় খায়রুল স্যার "দাঁড়াও আবির" বলে আবিরকে থামিয়ে দিলেন । আবির স্যার এর সামনে এসে আবার দাঁড়ালো । স্যার সবসময় আবিরের সাথে হাসিমুখে কথা বলেন তবে আজ স্যার এর মুখে সেই হাসিটা লক্ষ করে যাচ্ছে না । তবে বেশ একটা মলিন গলায় স্যার বললেন, "তোমাকে আমি আর সবার চেয়ে একটু বেশি পছন্দ করি তোমার উপস্থিত বুদ্ধি, তোমার আচরন, তোমার বিচক্ষণতা এগুলোসহ আরও অনেক ভালো গুণ তোমার মাঝে আছে সেজন্য । কিন্তু সেই তুমি-ই কিনা হঠাৎ এক দিনে এমন পাল্টে গেলে কি করে, আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে?" আবির বুঝল স্যার এ কথা বলেছে গতকাল অর্কর পক্ষ নেয়ার জন্য । এও বুঝল, রাশেদ স্যার নিশ্চয় খায়রুল স্যার কে বলেছেন । তবুও আবির বলল, "স্যার আমি কিছু বুঝতে পারছি না ।" খায়রুল স্যার টেবিলে কয়েকটা খাতা গোছাতে গোছাতে বললেন, "আবির, তোমাকে আমার চেয়ে ভালো আর কেউ চেনে না । এইটে ম্যাথ ক্লাস নিতাম, তখন থেকে তোমাকে চিনি । নাইনে ক্লাস না নিলেও দেখা তো হতো, আর টেনে এসে ক্লাস টিচার হয়ে আরও ভালোভাবে তোমায় চিনলাম । তো, তুমি কি বোঝো কি বোঝো না, আমার চেয়ে ভালো আর কেউ সেটা বুঝবে না । তুমি যে আমার কথা বুঝতে পেরেছ, তা তোমার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ।" আবির আর কোন জবাব দিল না । যদিও এটাই প্রথমবার না । এর আগেও স্যার অনেকবার আবিরকে এরকমভাবে ধরে ফেলেছিলেন । খাতাগুলো একটা ড্রয়ারে রেখে স্যার আবিরকে বললেন, "এবার বলো । ব্যাপার কি?" "আসলে স্যার, আমি অর্কর পক্ষে কথা বলি নি । আর ও......" স্যার আবিরকে শেষ করতে না দিয়েই বললেন, "আমাকে রাশেদ স্যার সব বলেছেন । সো, মিথ্যে বলে লাভ নেই আবির ।" আবির তখন মাথা নিচু করে বলল, "মাফ করবেন স্যার, এর কৈফিয়ত আমি এখন দিতে পারবো না । তবে দোয়া করবেন, যা করছি, তাতে যেন সফল হতে পারি ।" বলেই আবির চলে গেলো । স্যার আবিরকে আর পিছু ডাকলেন না । নিজেই নিজেকে বললেন, "ওরে আবির, তোমারে তো আমি বিশ্বাস করি । আর দোয়া তো সবসময়ই আছে ।" টিচার্স রুম থেকে বেড়িয়ে হোস্টেল বিল্ডিং এর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল আবির । তিনতলায় কি করতে অর্কর ঘরের দিকে নজর গেলো । দু-জোড়া জুতো ঘরের সামনে । না, একজোড়া জুতো তো অর্করই, দেখেই চেনা যাচ্ছে, অন্যটা আগে দেখে নি এখানে আবির । নতুন জুতো । কেবল হালকা ময়লা লেগেছে । হতে পারে নতুন কিনেছে । আবির আর তেমন একটা ভ্রুক্ষেপ করলো না । চারতলায় উঠে ঘোরে ঢুকল । আবির যে রুমে থাকে, সে রুমে ঢুকল । আরে! কিছু জিনিস এমন অচেনা লাগছে কেন? ধুর! আবির ফু গোছের একটা আওয়াজ করলো । মনেই ছিল না, এই রুমে এখন ওর ঠাই নেই । আবির রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো । ছাদে যেয়ে সেই বিছানায় যেয়ে বসলো । আকাশ এখনও মেঘলা । বৃষ্টি হবে কি হবে না, এখনও বোঝা যাচ্ছে না । ইউনিফর্মের ইঙ্কটা খুলে শার্ট এর ওপরের দুটো বোতাম খুলে কাঠের বিছানার ওপর শুয়ে পড়লো । প্রতিদিনের মতো আজও ক্লান্ত লাগছে, কিন্তু প্রতিদিনের মতো আজকে শুয়ে থাকবার আরামটা নেই । আবির আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল । মেঘগুলো দ্রুত বেগে ভেসে বেড়াচ্ছে । বাতাসও হচ্ছে মোটামুটি । দেখতে দেখতে আবির ঘুমিয়ে গেলো । এমনিতে রাতে ভালো ঘুম হয় নি, তার ওপর সারাদিন ক্লাস হবার ক্লান্তি । ঘুম আসাটাই স্বাভাবিক । ঘুম ভাঙল কারো ডাকে । কেউ আবিরের গা ধরে ঝাঁকি দিতে দিতে ডাকছে, "ওই আবির, ওঠ! আরে ভাই ভিজা যাবি তো!...ওঠ!...বৃষ্টি হইতাছে তো!" আবির চোখ খুলল । হাতে ওপর কি যেন টপটপ করে পড়ছে না? আবির উঠে বসলো । মাঝারি বৃষ্টি হচ্ছে । তাকিয়ে দেখল, পাশে রিভু । আবিরকে উঠতে দেখে রিভু বলল, "আরে ভাই, তাড়াতাড়ি ওঠ, দেখ তুই ভিজা গেছোস! ওঠ!" বলেই রিভু সিঁড়িঘরের দিকে দৌড় দিল । আবিরও ব্যাগ নিয়ে দৌড় দিল । মোটামুটি আবিরও ভিজে গেছে, তবে ততোটাও না । সিঁড়িঘরের নিচে যেয়ে দুজনেই দাঁড়ালো । আবির জানতে চাইলো, "কটা বাজে?" "সাড়ে তিনটা ।" "কি! এতো বাইজা গেছে! খাইছোস তুই?" না রে ।" আবির তখন বাইরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "খাটটাও ভিজা গেলো । রাতে থাক্কমুনে কই আল্লাহই জানেন । তুই খাস নাই ক্যান, খাবার দিয়া যায় নাই?" রিভু বলল, "দিছে, কিন্তু ওইডি তো রুম ।" আবির একটু বিরক্তির সাথে বলল, "তো? যাইয়া খাইয়া আইবি, খাবার তো আমাগোরেই । নাকি?" রিভু কোন জবাব দিল না । আবির বলল, "চল, নিয়া আসি ।" আবির রিভুর সঙ্গে নিচে গেলো । ঘরের দরজা খুলল । হোস্টেলের সবাই বাইরের দরজা খোলাই রাখে । এমনিতে রুমের দরজা লাগিয়ে রাখে । আবির ভেতরে ঢুকেই ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকাল । একটা পানির গ্লাস ছাড়া কিছু নেই । ফ্রিজের কাছে এগিয়ে যেয়ে ফ্রিজ খুলল । সেখানেও তেমন কিছু নেই । রিভু জানতে চাইলো, "কিরে! কই খাবার? আবির কোন জবাব দিল না । পরশের রুমের দরজায় নক করলো । কিছুক্ষণ পর মোবাইল হাতে দরজা খুলল পরশ । বলল, "কিরে? কি চাস?" আবির বলল, "বলছিলাম কি, আমাদের খাবারগুলো কি তোরা খাইছিস? নাকি কিছু রাখছিস?" পরশ বলল, "আরে ভাই, আইসাই এইসব কি বলা শুরু করলি তুই? আমরা তো খাবার পাই? তোর খাবার খাইতে যামু কোন দুঃখে?" আবির বলল, "তাহলে আমাদের খাবার কই?" "আমি ক্যামনে কমু?" বলেই দরজা লাগাতে গেলো পরশ, এমন সময় কি মনে করে আবার দরজা খুলে বলল, "ও হ্যাঁ, ভালো কথা । তোদের খাবার মনে হয় নিচে দিছে ।" রিভু বলল, "নিচে?" পরশ বলল, "হ । এই ঘোরে তিনডা দিছিল, ওইডা মনে হয় আবিরের ছিল, ওইডি আমি খাইছি । আর আমারটা আর রিভুরটা মনে হয় নিচে আছে ।" আবির জানতে চাইলো, "তুই আমারটা খাইছোস ক্যান?" রিভু বলল, "আরে ভাই, একই তো খাবার । আর এহন থেইকা তো আমি এই রুমেই থাকমু । সেক্ষেত্রে খাবারও আমার, সমস্যা তো নাই ।" বলেই দরজা লাগিয়ে দিল রিভু । জামি আর শিমুল অনেক আগেই আবির আর রিভুর কথা শুনে দরজার সামনে এসে দাড়িয়ে কথা শুনছিল । আবির ওদের দিকে ফিরেও তাকাল না । ওদের সামনে দিয়ে আসছিলো, এমন সময় জামি বলল, "দেখলি শিমুল, আমাদের আর পাত্তা দেয় না ।" শিমুল বলল, "টা দেবে ক্যান ক? এহন সে প্রিন্সিপ্যালের ভাতিজার বুজুম দোস্তো । সে কি আর আমাগো লগে থাকবো?" আবির দাড়িয়ে যেয়ে ভ্রু কুঁচকে ওদের দিকে তাকিয়ে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল, 'ভাই আমারে ক তো, তোরা কি মানুষ? মাইয়াগো মতো করিস ক্যান তোরা? এইরকম কুটনামি স্বভাব ক্যান তোদের? তোদের কি কামরায় না চুলকায়? মানে আমার নিজেরই লজ্জা লাগে তোরা আমার বন্ধু এই ভাইবা । নিজেরা কি দোষ করছিস, সেইডাও একটু ভাবোস নাই । অর্ক আইসা অন্তত একটা ভালো কাজ করছে । তোদের এই আসল চেহারাটা আমারে দেখায় দিছে । মানে সবাই স্বার্থপর । নিজের ভালো ছাড়া কেউ আর কিচ্ছু বোঝে না ।" বলে আবির চলে আসতে নেবে, এমন সময় শিমুল জামিকে বলল, "এই জামি, চামচার মুখে এসব কথা মানায় বলতো?" আবির এবার আর পারলো না । জামিকে কোন জবাব দেবার সুযোগ না দিয়ে পেছন ফিরে প্রথমে শিমুলের গলা ঘোরে শিমুলকে মেঝেতে ফেলে দিল । তারপর শিমুলে পাশে হাঁটু গেড়ে বসে শিমুলের মুখে ঘুষি মারতে লাগলো । একের পর এক মারতেই লাগলো । শিমুল চিকন বলে গায় তেমন শক্তি নেই । ফলে আবিরকে ঠেকাতে পারলো না । জোরে জোরে বেশ জোরে চিৎকার করতে লাগলো । নাক মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে লাগলো । দূর থেকে দাড়িয়ে ভয় পেয়ে গেলো রিভুও । জামিও উঁকি দিয়ে দেখছিল, কিন্তু এগিয়ে এলো না । রিভুই এগিয়ে এসে আবিরকে ধরে মেঝে থেকে ওঠাল । শেষমেশ আবিরকে অনেক জোরজবরদস্তি করে শিমুলের রুম থেকে বের করে আনতে সক্ষম হল রিভু । আবির জোরে জোরে হাফাচ্ছে । শিমুল মেঝেতে শুয়ে কাঁপছে । জামিও কাঁপতে কাঁপতে একবার আবিরের দিকে তাকাচ্ছে, আর একবার শিমুলের দিকে তাকাচ্ছে । শিমুলের চিৎকার শুনে এসে দাঁড়ালো পরশও । রিভু আবিরকে বলল, "চল দোস্ত । মাথা ঠাণ্ডা কর ।" শিমুল অনেক কষ্টে উঠে বসলো । এখনও শিমুলের শরীর কাঁপছে । একটা করুণ দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকাল শিমুল । আবির সেটা দেখে কষ্ট পেলো ঠিকই, কিন্তু রাগ কমালো না । রাগ আর কষ্ট একসাথে জোড় গলায় করে শিমুলকে বলল, "দ্যাখ, তোর বন্ধু জামিরে দ্যাখ, একবারও তোর দিকে আগায় আসার সাহস করে নাই যহন আমি তোরে মারছি । এই বন্ধুত্ব তাই না? শিমুল কিছু বলল না । এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । আবির হঠাৎ আবারও শিমুলের রুমের দিকে স্রুত বেগে ঢুকল । রিভু ডাকল "আবির! আর না! প্লিজ!" কিন্তু আবির শুনল না । জামি আর পরশ ভয়ে সরে গেলো যখন আবির ওদের সামনে দিয়ে রুমে ঢুকল । সবাই ভাবল, আবির বোধহয় এবারো মারতে চলেছে শিমুলকে, কিন্তু না । আবির ভেতরে ঢুকেই শিমুলের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে শিমুলকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল । শিমুলের রক্ত আবিরের ইউনিফর্মে লেগে গেলো । আবির কাঁদতে কাঁদতে বলল, "সরি দোস্ত ।" শিমুল কথা বলার শক্তি পেলো না । আবির শিমুলের কপালে একটু চুমু খেয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে ওদের ওই ঘর থেকেই বেড়িয়ে এলো । জামি জামি আর পরশ শিমুলের রুমে ঢুকল । জামি শিমুলের হাত ধরে ওঠাতে চাইলো, কিন্তু কেন যেন শিমুল হাতটা সরিয়ে নিলো । রিভুও ওদের ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো । দুপুরে আর খাওয়া হল না আবিরের । রিভুও আর কিছু খেতে পারলো না । দুপুরে যতক্ষণ বৃষ্টি হয়েছিলো, ততোক্ষণ আবির ছাদের সিঁড়িঘরের দরজার সামনে বসে ছিল । রিভু খেতে ডেকেছিল একবার, কিন্তু আবির বলেছিল, "আমাকে প্লিজ জোর করিস না । আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না ।" রিভুও তখন আর জোর করে নি । বৃষ্টি থামলে ছাদে যেয়ে ওই ভেজা খাটের ওপরই সারাদিন শুয়ে ছিল আবির । আকাশ এখন ফাঁকা । তারা জলছে । দেখতে বেশ লাগছে । আবির সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই তখন থেকে । এমন সময় কেউ একজন মেয়ে কণ্ঠে ডাকল, "আবির?" আবির পাশে তাকিয়ে দেখল, সোমা আপু । সাথে রিভু, আর নাবিলা । সোমা আপু আবিরের কাছে এলো । আবির উঠে বসলো । সোমা আপুকে সালাম দিয়ে বলল, "কেমন আছো সোমা আপু?" “ওয়ালাইকুমুস সালাম । আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি ।" আবির বলল, "তোমাকে যে কোথায় বসতে দেই, খাটটাও ভেজা । সোমা আপু ভেজা খাটেই বসে বলল, "আর ধুর, সমস্যা নেই । এখানেই বসছি ।” আবির বলল, "তুমি তো আসোই না আর ।" সোমা আপু বলল, "এই যে এলাম, একটা ভালো খবর দিতে এলাম, আর এসেই একটা খারাপ খবর শুনলাম ।" আবির কোন জবাব দিল না । সোমা আপু রিভু আর নাবিলার দিকে তাকিয়ে বলল, "তোরা যা, আমি পড়ে তোদের সাথে দেখা করে যাবো ।" নাবিলা আর রিভু চলে গেলো । সোমা আপু আবিরের কাধে হাত রেখে বলল, "আচ্ছা আবির, তোরা প্রায় ৭টা বছর একসাথে থেকেছিস, এতদিন কিছুই হয় নি, আর ওই অর্ক নামে কি একটা ছেলে আসার জন্য কেন তোরা নিজেদের মধ্যে এরকম ঝগড়া শুরু করলি?" আবির জানতে চাইলো, "কে বলেছে এসব কথা তোমাকে?" সোমা আপু বলল, "আমি সবটাই শুনেছি আবির । তোকে নিয়ে স্যাররা কাল মিটিং ডেকেছেন ।" আবির জিজ্ঞেস করলো, "শিমুল এখন কেমন আছে?" সোমা আপু বলল, "ভালো । শুধু ব্যাথা আছে ।" আবির মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল, রাত ৮টা বাজে । এরপর সোমা আপুর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় সোমা আপু বলল, "আমি জানি আবির, তোর কোন দোষ নেই । শিমুল আর জামি তোর সাথে স্বার্থপরতা করেছে । শুধু তাই-ই না, তোমার নামে অনেক উল্টাপাল্টা কথাও বলেছে ।" আবির বলল, "হুম । তবে গতকাল যে কথা বলেছিল, তা শুনে নিজেকে সাম্লাইতে পারি নাই । তাই মারলাম আরকি । কিন্তু মারা পর শিমুলের চেহারা দেখে বেশ খারাপ লাগছিল । ভালো কথা, ওরা যে আমার সাথে স্বার্থপরতা করেছে, আমাকে উল্টাপাল্টা কথা বলেছে, এসব তো তুমি জানতে না?" "শিমুলই বলেছে ?" "শিমুল!" অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে সোমা আপুর দিকে তাকাল আবির । সোমা আপু বলল, "হ্যাঁ । আমি যখন ওর সাথে কথা বলছিলাম, তখন ও খুব কাঁদছিল । আমাকে বারবার করে এও বলল, তোকে যেন বলি ওকে ক্ষমা করে দিতে ।” আবির কোন জবাব দিল না । সোমা আপু তখন বলল, "তোদের ক্লাস কেমন চলছে?" "ভালো ।" সোমা আপুও এবার চুপ হয়ে গেলো । চুপ করে কিছুক্ষণ দুজনেই আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল । আবির তখন হঠাৎ করেই বলে উঠলো, "জানো আপু, একসময় ছোটবেলায় আমি যখন মন খারাপ করতাম, তখন আমি এই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম । আর ভাবতাম, কেন এতো কষ্ট আসে মনে? তখন আল্লাহই হয়তো আমার মনে একটা চিন্তার জাগরণ ঘটাতেন । আর তা হল, কষ্ট তো আসবেই, কিন্তু সে কষ্টটা থেকে শিক্ষা নিয়ে আনন্দের কিছু করার প্রত্যয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে ।"সোমা আপু "হুম" ছাড়া আর কিছুই বলল না । আবির তখন হঠাৎ করে সোমা আপুর দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বলল, "তুমি না কি একটা ভালো খবর দিতে এসেছ বলছিলে?" সোমা আপুও তখন হাসিমুখে বলল । ও হ্যাঁ । শোন । তোরা সবাই মামা হচ্ছিস!" আবির প্রথম প্রথম ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না । জিজ্ঞেস করলো, "মানে?" "আরে, আমি মা হচ্ছি!" আবির প্রচণ্ড খুশিতে বলল, "কি! সত্যি! ট্রিট দাও ।" বলে হাত বাড়িয়ে দিল আবির । সোমা আপু ব্যাগ থেকে একটা বিরিয়ানির প্যাকেট বের করে বলল, "নে, বিরিয়ানি খা । সবার জন্য এনেছিলাম, তুই ওপরে আছিস জেনে আমি ব্যাগে করে আনলাম । জানতে চাইলো, "তুমি বানিয়েছ?" "তা এতো ভালো একটা খবর আনলাম, তোদের বাইরের খাবার খাওয়াতে?" "রাকিব ভাই আসে নাই?" সোমা আপু উঠে দাড়িয়ে বলল, "হ্যাঁ, নিচে আছে , ওরা সবাই তোর সাথে খাবে বলে বসে আছে । চল যাই ।" আবির সোমা আপুর দিকে তাকাল । তারপর বলল, "ওরা সবাই বসে আছে আমার জন্য?" সোমা আপু উপর- নিচ মাথা নেড়ে বলল, "হ্যাঁ । চল এবার ।" সোমা আপু বলে চলে গেলো । আবিরও উঠে সোমা আপুর সাথে হাঁটা ধরলো । চারতলায় ওদের ঘরে ঢুকে দেখল, সবাই বসে আছে শিমুলের রুমে । বিছানায় মুখে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে শুয়ে শিমুল । দুপুরের সেই দুর্বল ভাবটা কিছুটা কমেছে । আবির রুমের দরজার কাছে আসতেই শিমুলের দিকে তাকাল । শিমুলও আবিরের দিকে তাকাল । প্রথমে মুখে কোন হাসি না থাকলেও একটু পর একটা হাসি দিয়ে বলল, "আয় ভেতরে ।" আবির রুমে ঢুকে চারপাশে তাকাল । মেঝেতে একপাশে বসে রিভু, পরশ, এবং নিচতলার আরও দুটো ছেলে । ওদের সাথে আরও বসে রাকিব ভাই । অন্যপাশে মেঝেতে বসে নাবিলা, নিশিসহ আরও কিছু মেয়ে । পড়ার টেবিলের পাশে চেয়ারটায় বসে জামি । মোটা তো, ছেলের মেঝেতে বসতে কষ্ট হয় । মূলত যাদের সোমা আপুর হাত ধরে এই আশ্রমে আসা, তারাই এসেছে । সবার হাতেই একটা করে বিরিয়ানির প্যাকেট । আবিরকে রাকিব কাছে ডেকে পাশে বসতে বলল । আবির সেখানে যেয়ে বসলো । সোমা আপু যেয়ে আরেকটা চেয়ার নিয়ে শিমুলের পাশে বসলো । যেহেতু বেচারা আজ অসুস্থ, তাই সোমা আপুই খাইয়ে দেবে শিমুলকে । সোমা আপু বলল, "এবার খাওয়া শুরু করি । চল ।" সবাই হাতের প্যাকেটটা খুলে খাওয়া শুরু করলো । সোমা আপুও শিমুলকে খাওয়াতে খাওয়াতে নিজেও খেতে লাগলো । সবাই পেট পুরে খেলো বিরিয়ানি । খাওয়া শেষে সবার প্রশংসা, বিরিয়ানি অনেক ভালো হয়েছে । সবাই হাত ধুয়ে এসে আবারো যে যার যার জায়গায় বসলো । নিশি তখন বলল, "সোমা আপু, তুমি তো অনেক ভালো গান পারো, একটা গান শোনাও না ।" সবাই নিশির সাথে তাল মিলিয়ে জোর করতে লাগলো সোমা আপুকে । সোমা আপু সবার অনুরোধের শোরগোল থামিয়ে দিয়ে বলল, "হয়েছে, থাম । আমি গাচ্ছি ।" সোমা আপু উঠে দাঁড়ালো । তারপর গান ধরল । "ভালবাসবো বাসবোরে, বন্ধু, তোমায় যতনে........." সাথে তাল মেলাল রাকিব ভাইও । দুজন একসাথে দাড়িয়ে গান গেলো । বেশ লাগছে আজ দুজনকে দেখতে । গান শেষে সবাই হাততালি দিল । রিভু তখন বলল, "আপু জানো, নাবিলা অনেক ভালো নাচতে পারে ।" সোমা আপু বলল, "তাই নাবিলা!" নাবিলা লজ্জায় জবাব দিল, "আপু তেমন ভালোও পারি না ।" সোমা আপু বলল, "হইছে, আমিও তেমন ভালো গাই না । এবার আমাদের নেচে দেখাও তো ।" এরপর সোমা আপু পরশকে উদ্দেশ্য করে বলল, "এই পরশ, আবিরের রুম থেকে সাউন্ড বক্সটা নিয়ে আয় ।" পরশ অবাক হয়ে বলল, "আবিরের রুম! মানে এখন যেটায় আমি থাকি?" সোমা আপু কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখনই মেজাজ দেখিয়ে শিমুল বলল, "এখন যেটায় তুই থাকিস বলেই তো আবিরের রুম বললে তুই চিনবি না এরকম ভাব নিস না । আপু যা বলছেন, তাই কর ।" সবাই শিমুলের দিকে তাকাল । পরশ কোন জবাব না দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো । আবির শিমুলের দিকে তাকিয়েই ছিল, এমন সময় শিমুল একবার আবিরের দিকে তাকাল । আবির আর লজ্জায় শিমুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না । চোখ ফিরিয়ে নিলো । নাবিলা তখন বলল, "আপু, আমি নাচবো, কিন্তু আমার একটা ছেলে পার্টনার লাগবে ।" সোমা আপু তখন কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় আবারো শিমুল বলে উঠলো, "আবির নাচবে ।" সবাই আবারো শিমুলের দিকে তাকাল । রাকিব তখন বলল, হ্যাঁ, এটা ভালো বুদ্ধি । আবিরও তো শুনেছিলাম রুমের দরজা আটকে সাউন্ড বক্সে গান ছেড়ে নাচে ।" এবার সবাই আবিরকে জোর করা শুরু করলো । অবশেসে আবির ইতস্তত করে বলল, "আচ্ছা, সবাই যখন এতো জোর করছ, আমি নাবিলার সাথে নাচবো ।"নাবিলা আবিরের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো । ঠিক তখন সাউন্ড বক্স নিয়ে হাজির হলো পরশ । সোমা আপুই গান ছাড়ল । "আমার সকল অভিযোগে তুমি, তোমার মিষ্টি হাসিটা কি আমি, আমার না বলা কথার মাঝে, তোমার গানের কতো সুর ভাসে............।" আবির আর সোমা একসাথে নাচল । একজন আরেকজনের হাতে হাত রেখে, আবির নাবিলার কোমর আর নাবিলা আবিরের কাধে হাত রেখে, নাবিলা আবিরের আঙ্গুল ধরে নিজ অবস্থানে ঘুরে, আরও নানাভাবে ওরা নাচল । নাচের মাঝে দুজনে অন্য এক ভাবনায় ডুবে গেলো । শেষ করলো, দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে চোখে চোখ রেখে । নিজেরাও হয়তো টের পায়নি নাচ শেষ । সবাই হাততালি দিলেও ওরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ । একে অপরের চোখে ওরা কি যেন দেখছে । এক অন্যরকম অনুভূতি দুজনের ভেতরে কাজ করছে । এমন সময় সোমা আপু বলল, "কি রে? তোরা কি এবার মনে মনে নাচ শুরু করলি নাকি?" সঙ্গে সঙ্গে দুজনে কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে এলো । দুজনে দুদিকে ঘুরে লজ্জায় হেসে ফেললো । রিভু তখন ইয়ার্কির সাথে বলল, "দুজনকে কি সুন্দর লাগছিলো, যেন দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে মুভির রাজ-সিমরান ।" আবির আর নাবিলা দুজনেই আবার দুজনের দিকে কি করতে তাকাল । তারপর আবার যে যার জায়গায় বসে পড়লো । সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত মজা করলো ওরা । শিমুল অনেক অনুরোধ করেছিলো বটে, কিন্তু আবির অনেক বুঝিয়ে চলে এসেছে যে আজ না, অন্য কোনোদিন থেকে, আজ ওর রেস্ট দরকার ।





(৬)
পরদিন সকালের কথা । সেদিন ছিল শুক্রবার । সেদিন রাতটাও আবির আর রিভু কাটিয়েছে ছাদে । সারারাত আর বৃষ্টি হয় নি, যার জন্য খাটটাও আর ভেজে নি । শুক্রবার হলে আর সবাই বলা যায় একটু দেরি করেই ওঠে, কিন্তু আবির ব্যাতিক্রম । ও আবার একটু তাড়াতাড়িই উঠে চলে যায় আজও উঠলো । উঠেই রিভুকে হা করে ঘুমিয়ে থাকতে দেখল । বেচারা কাল রাতে অনেক খেটেছে । পুরো রুম সাফাই থেকে শুরু করে সোমা আপু আর রাকিব ভাইয়ার জন্য রিকশা ডাকা আরও কতো কি । আবির উঠে বসলো । পায়ের নিচে জুতোটা পড়লো । আজ আকাশে একটুও মেঘ নেই । একদম নীল আকাশ । পূর্ব পাশে সূর্য অনেকটা উঠে গেছে । আবির ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল, সাড়ে ৭টা বাজে । প্রতিদিনের মতো আজও গাছে পানি দিচ্ছে পাপলু আঙ্কেল । আবির নিচে নামার জন্য সিঁড়ি ঘরের দিকে যাচ্ছিলো, কি করতে যেন পেছন ফিরে তাকাল, এমন সময় চোখটা চলে গেলো রিভু খাটের যে পাশে ঘুমিয়েছে সে পাশের নিচে । একজোড়া জুতো । জুতোজোড়া খুব চেনা চেনা লাগছে না! আবির কাছে এগিয়ে গেলো । ভালো করে দেখল, এটা সেই জুতো, যেটা আবির সেদিন অর্কর রুমের সামনে দেখেছিলো । তবে কি রিভু অর্কর ঘরে যায়? না না, তা কি করে হয় । অর্ককে তো রিভু সহ্যই করতে পারে না । তাহলে? শুধু তাই নয়, এই জুতোজোড়াও নতুন । আবির আর সাতপাঁচ না ভেবে নিচে নামতে লাগলো । চারতলায় নিজেদের ঘরে এসে দেখল, টেবিলে খাবার দিয়ে গেছে । পাঁচটা থালায় কিছু একটা ঢাকা । তুলে দেখল, ৩টে করে পরোটা, আর এক বাটি ডাল । আবির নিজেরটা খেয়ে নিলো । তারপর আবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো । তিনতলায় একবার দরজার সামনে চোখ রাখল । না, এখন তো জুতোটা দেখা যাচ্ছে না । আবির নিচে নেমে এলো । স্কুল বিল্ডিঙের দিকে গেলো । যেহেতু শুক্রবার, আজ স্কুলও বন্ধ । প্রতি ছুটির দিন আবির সকালে এই সময় উঠে স্কুলটা একটু ঘুরে আসে, তারপর পাপলু আঙ্কেলের সাথে যেয়ে দেখা করে । আজও ব্যাতিক্রম হল না । গেইট দিয়ে স্কুল বিলিং-এ ঢুকল আবির । সকালর সূর্যের আলো যখন ক্লাসরুমের জানালার গ্লাসে এসে পড়ে, আর সেই আলোয় যখন চারপাশ ঝলমল করে, তখন মনে হয়, আলোয় ভুবন ভরা । পুরো স্কুলটা ঘুরে আবির পাপলু আঙ্কেলের রুমে গেলো । পাপলু আঙ্কেল গাছে পানি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছে । আবির ভেতরে ঢুকেই বলল, "আসসালামু আলাইকুম পাপলু আঙ্কেল ।" পাপলু আঙ্কেল মাথা উঁচিয়ে দেখলো আবির এসেছে । তারপর আবার মাথা বালিশে রেখে শুয়ে বলল, "হ্যাঁ আবির, এসো এসো । তোমারই অপেক্ষা করছিলাম ।" আবির রিসিপশনের জন্য রাখা জানালার পাশে রাখা চেয়ারটাতে বসলো । পাপলু আঙ্কেল আবিরের দিকে ঘুরে শুয়ে পড়লো । জিজ্ঞেস করলো, "খাওয়া দাওয়া হয়েছে?" আবির রিসিপশনের কলমটা নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, "হ, হইছে । তুমি খাইছো?" "খেলাম আরকি ।" "কি খাইলা?" "কি আর, নরেশ তোদের যা দেয়, আমাকেও তো তাই-ই দেয় ।" নরেশ খাবার দিয়ে যায় । রান্না করে শরেশ । নরেশের মায়ের পেটের ভাই । বলতে গেলে রান্নার করে যে টাকা পায়, সব এই দুই ভাই-ই ভোগ করে । আবির বলল, "আচ্ছা, একখান কথা কইবা?" "বল কি বলবি ।" একটু নড়ে চরে বসে জবাব দিল পাপলু আঙ্কেল । আবির প্রশ্ন করলো, "তুমি শুদ্ধ ভাষায় কথা কও ক্যান? দেহো না, আমরা সবডি তোমার লগে কি সুন্দর কইরা একটু আঞ্চলিকতা মিশাইয়া কথা কই!" পাপলু আঙ্কেল একটু অনুকম্পার হাসি হাসল । তারপর একটা হাই তুলে বলল, "ভাষা কি আর পাল্টানো যায়? আমি ছোট বেলা থেকেই কুষ্টিয়ার মানুষ, আমার এলাকার মানুষ আবার এই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতো । তাই সে অভ্যেস এখনও রয়ে গেছে । তাছাড়া তুই-ই বল, তুইও তো কোনো গুরুতর সময়ে কিংবা শিক্ষকদের সামনে এই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলিস না । বলিস কি?" আবির ডানে বামে মাথা নাড়ল । পাপলু আঙ্কেল আবারো বলল, "তাছাড়া তোরাও যে কি আঞ্চলিক বলিস, আমি নিজেও বুঝি না । না হয় যশোরের, না হয় ঢাকার ।" আবির একটু হেসে বলল, "ও ভাষা তুমি বুঝবানা পাপলু আঙ্কেল, এডি হইলো বন্ধুত্বের ভাষা ।" পাপলু আঙ্কেল আবারো হাসল । কোন জবাব দিল না । আবির জানতে চাইলো, "আজ নাকি টিচাররা আমারে নিয়া মিটিং ডাকছিলো?" পাপলু আঙ্কেল বলল, "হ্যাঁ কিন্তু তোর সোমা আপু গতকাল এসে সব মিটমাট করে দেয়ায় টিচাররা আর কিছু বলে নি । মিটিং ও বাতিল করে দিল ।" আবির বিরক্তির সাথে বলল, "উফ! ওই অর্কটার জন্য যতো কিছু হচ্ছে আরকি!" পাপলু আঙ্কেল অর্ক নামটা শুনেই তাড়াতাড়ি করে উঠে বসে এক প্রকার ভয়ের সাথে বলল, "ভালো কথা, তোমার ক্লাস টিচার খায়রুল স্যার বলছিলেন, তুমি নাকি ওই ছেলেটার সাথে তাল-মিলিয়ে চল?" আবির বলল, "সেটা চলি কিন্তু সেটা......" আবিরের কথা শেষ করতে না দিয়েই পাপলু আঙ্কেল বলল, "না আবির, ভুল করছ, ছেলেটা মোটেও ভালো না, সুবিধারও না । গতকাল যা দেখলাম, ছি!ছি!ছি! এতো বছর ধরে এই কলেজের গেইটে দেখাশোনা করছি, এমন ছেলে কখনো দেখিনি ।" আবির আর আগের কথা সামনে বাড়াল না । প্রশ্ন করলো, "কেন? কি হয়েছে?" "তোমাদের ম্যাডাম, বায়োলজির, উনি কাল খাতা দেখছিলেন, এই অর্ক পাশে দাড়িয়ে ছিল । ম্যাডাম কতো বলল, চলে যেতে, কিন্তু সে ছেলে কিছুতেই যাবে না । ম্যাডাম বকা দিতে গেলে ছেলে চাকরির হুমকি দেয়, নিজে প্রিন্সিপ্যালের ভাতিজা বলে বেশি ক্ষমতার দাপট দেখায় । শেষমেশ ওই ছেলের খাতা যখন ম্যাডাম দেখল, ছেলে জোর করে তাতে ৯৮ নাম্বার আনলো! শুধু তাই নয়, যতক্ষণ দাড়িয়ে ছিল, কি সব অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছিলো । ছি! এসব ছেলেদের ওপর আল্লাহর গজব পড়ুক দোয়া করি । আর তোমাকেও বলি, এদের সাথে তাল মিলিয়ে চলবে না, একে তো মিশে পাপ করবে, পড়ে দেখবে, এ-ই তোমাকে একদিন ফাসিয়ে দিয়েছে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে ।" আবির "হুম" আওয়াজ করে উপর নিচ মাথা নাড়ল আর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল । কোন জবাব দিল না ।

হোস্টেল বিল্ডিং-এ এসে আবির সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল । তিনতলার কাছাকাছি আসতেই আবিরের নজরে এলো, জুতোজোড়া অর্কর ঘরের সামনে । আবির তাড়াতাড়ি করে দরজার কাছে গেলো । ভেতরে কারা যেন কথা বলছে । আবির কান পেতে শুনতে লাগলো । স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে কথাগুলো । আবির মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনল । মাঝে মাঝে অবাক-ও হল । একসময় হঠাৎ দেখল, সিঁড়ি বেয়ে নামছে নাবিলা । আবিরকে দেখেই নাবিলা কিছু একটা বলতে যাবে, আবির ঠিক সেই সময় তর্জনী আঙ্গুল ঠোঁটের সামনে ধরে চুপ করতে বলল নাবিলাকে । তারপর আরও ৫সেকেন্ডের মতো কথাগুলো শুনে আবির নাবিলাকে নিয়ে ছাদে চলে এলো । খাটের ওপর নেই রিভু, নেই ওর জুতোজোড়াও । আবির ছাদের রেলিঙের পাশে যেয়ে দাঁড়ালো । নাবিলাও গেলো । নাবিলা জিজ্ঞেস করলো, "আবির তুমি ওই অর্কর দরজার সামনে দাড়িয়ে কি শুনছিলে?" আবির হেসে হেসে বলল, "কই কিছু না তো!" নাবিলা বিরক্তির সাথে বলল, "আবির! আমি কি হাসির কিছু বললাম!" আবির আবার হাসা শুরু করলো । জোরে জোরে হাসলো । নাবিলাও আবিরের হাসি দেখে হেসে দিল । অনেকক্ষণ দুজনে হাসল । একটু পর নাবিলাই নিজেকে সামনে বলল, "হয়েছে, এবার থামো । খেয়েছ?" আবির বলল, "হ্যাঁ । তুমি?" নাবিলা বলল, "খেয়েছি, কিন্তু একটা পরোটা । গতকাল যা বিরিয়ানি খেয়েছি, খিদে পুরো চলে গেছে ।" আবির বলল, "ও তাই, তাহলে সোমা আপুকে বলা লাগবে তোমাকে দত্তক নেয়ার জন্য । নাবিলা বিরক্ত হয়ে বলল, "ধ্যাত! কি সব যে বলো না । আচ্ছা, তোমার কি তোমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে?" আবিরের হাসিমুখটা হঠাৎ করে হারিয়ে গেলো । মুখের ওপর বিষণ্ণতার ছাপ । নাবিলা হালকা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কি হল আবির! তুমি রাগ করলে না তো?" আবির সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, "জানো নাবিলা, আমি সেদিন দ্বীপকে দেখলাম । ও অনেক খারাপ হয়ে গেছে । নেশা করে । আচরনও খারাপ হয়ে গেছে । ইফাজ আঙ্কেল আর পায়েল আনটি মোটেও সুখে নেই ।" নাবিলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কোথায় দেখেছো?" "রিভুর ফেসবুকে ।" "ও । তোমার ফেসবুক আইডি নেই?" আবির রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে বলল, "না । খুলতে ইচ্ছে হয় নি । যদি হঠাৎ ইফাজ আঙ্কেল আর পায়েল আনটি আমাকে খুঁজতে আসে । তোমার আছে?" নাবিলাও আবিরের মতো করে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে বলল, "আমারও নেই । যদি হঠাৎ আমার ভাইয়া আর বাবা আমাকে মারার জন্য খুঁজতে আসে ।" আবির হঠাৎ জানতে চাইলো, অনামিকা কে, চেন?” “না ।” এক শব্দে জবাব দিল নাবিলা । তারপর দুজনেই চুপ । দুজনে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল । নাবিলা একটু একটু করে আবিরের কাছে এলো । আবির আকাশের দিকেই তাকিয়ে কি যেন অনুভব করছে । নাবিলা একবার আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে আবিরের সেই অনুভূতিটা বোঝার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না । নাবিলা আবিরের কাছে আসতে আসতে আবিরের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো । তারপর ধীরে ধীরে আবিরের কাধে মাথা রাখবার জন্য মাথা কাঁত করতে লাগলো । যখন প্রায় মাথাটা আবিরের কাঁধ ছোঁবে, এমন সময় আবির হঠাৎ সেখান থেকে সামনে সরে এলো । নাবিলা পড়তে পড়তে নিজেকে সামল নিলো । আবির কি যেন ভেবে পেছন ফিরে নাবিলাকে বলল, "থাকো তাহলে, আমি একটু আসছি ।" বলেই চলে গেলো আবির । নাবিলা কিছুই বলল না, তবে চেহারা দেখে বোঝা গেলো খুব বিরক্ত হয়েচে । এদিকে আবির তখন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলো, এর দৌড়ে চলে গেলো পাপলু আঙ্কেলে রিসিপশন রুমের দিকে । পাপলু আঙ্কেন জানালার কাছেই বসে । আবির বলল, "আঙ্কেল, আমার মোবাইলডা ফালায় রাইখা গেছি । দাও তো ।" পাপলু আঙ্কেল দেখলেন, টেবিলের পাশেই আবিরের মোবাইল আবিরের হাতে দিয়ে বললেন, "আমি খেয়ালই করিনি তোর মোবাইলে এখানে । নে ধর ।" "কেউ ফোন করেছিলো?" "না ।" আবির সেখান থেকে চলে এলো । দুপাশে সারি সারি হোস্টেলের মাঝের রাস্তাটা দিয়ে ফোন চালাতে চালাতে, ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে । "না......" আবির হঠাৎ দাড়িয়ে গেলো । একটা শব্দ ডানদিকে ক্লাস এইটের একটা বিল্ডিং থেকে এসেছে মনে হল । বা দিকে তো ক্লাস থ্রি এর হোস্টেল, আওয়াজটা ওদিক থেকে আসবার কথা না, কারণ আওয়াজ শুনে মনে হল না ক্লাস থ্রি এর কারো । তাছাড়া স্পষ্ট বোঝাও গেলো ডানদিক থেকেই এসেছে এবং গলাটা কোন মেয়ের । আবির কিছুক্ষণ দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো, আবার কোন আওয়াজ হয় কি সেটার । কিন্তু না । আর কোন আওয়াজ হল না । তাই এরকম সময় আর সবাই যা করে, আবিরও তাই করলো, মনের ভুল ভেবে চলে এলো সেখান থেকে । ক্লাস টেনের হোস্টেলের সামনে ক্লাস সিক্সের হোস্টেল । সব ক্লাসের ছেলে মেয়েরাই আবিরকে নতুন ৪-৫জন বাদে । ক্লাস সিক্সের বিল্ডিং এর তিনতলার বারান্দা থেকে একটা ছেলে আবিরকে ডাকল, "আবির ভাইয়া!" আবির তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো কোত্থেকে এলো আওয়াজটা । ছেলেটাই আবার বলল, "এই যে ভাইয়া তিনতলায় ।" আবির তিনতলার বা পাশের বাসাটার দিকে তাকাল । ক্লাস সিক্সের সানি । আবির বলল, "হ্যাঁ বল সানি ।" সানি জিজ্ঞেস করলো, "রিভু ভাইয়া আপনাকে খুজছিলো । ভেকুটিয়া বাজারে গেছেন, বলেছেন, আপনার সাথে দেখা হলে যেন আপনাকে জানাই ।" "আচ্ছা থাঙ্কস ।" বলে আবির উপরে চলে গেলো । ধুর! এখন আবার বাজারে যায় কে । নিজেদের হোস্টেলের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিল, এমন সময় আবির খেয়াল করলো, তিনতলায় অর্কর ঘরের সামনে রিভুর জুতো । কি ব্যাপার! সানি তো বলল রিভু নাকি বাজারে গেছে, তাহলে এই জুতো এখানে কি করে? আর এই জুতো কেন অর্কর ঘরের সামনেই দেখা যায়? আবির কান পেতে শুনবার চেষ্টা করলো, একটু আগেও আবির কান পেতে কিছু শুনেছিলো, যদ্দুর মনে হয়েছিলো, রিভুরই গলা, কিন্তু না । এখন ভেতর থেকে কোন আওয়াজ আসছে না । রিভুর জুতোর পাশে অবশ্য অর্কর জুতোও দেখা যাচ্ছে, কিন্তু ভেতর থেকে মোটেও কোন আওয়াজ আসছে না । আবির অনেকক্ষণ শুনবার চেষ্টা করলো, কিন্তু কিছুই শুনতে পেলো না । আবির ওপরে চলে গেলো ।

যেহেতু শুক্রবার, সবাই জুম্মার নামায পড়ে এসে খেতে বসেছে । আজ আবির আর রিভু শিমুল জামি আর পরশের সাথে ডাইনিং টেবিলে বসেই খাচ্ছে । শুক্রবারে স্পেশাল খাবার হয়, খিচুড়ি মাংস ।





(৭)
খাওয়া শেষে আজ অনেকদিন পর আবির, জামি, শিমুল, পরশ রিভু একসাথে ছাদে গোল হয়ে বসে গল্প করতে লাগলো । কথা প্রসঙ্গে শিমুল হঠাৎ বলল, "আচ্ছা আবির, জানোস, আমার না মাঝে মাঝে মনে হয় কি, নাবিলা তোরে পছন্দ করে ।" আবির বিরক্তির সাথে বলল, "ধুরু ভাই, তোরা আবার ফাউল প্যাঁচাল শুরু কইরা দিলি? ভালো কিছু পারলে ক ।" পরশ বলল, "থামা যাইবো না, কিছু একখান চলতেছে এগোর মাঝে, বুঝলি শিমুল, খোঁজ লইতে হইবো ।" রিভু তাল মিলিয়ে বলল, "আরে, আমিও তো দেখলাম ছাদে ক্যামনে নাবিলা অর গা ঘেঁইষা দাঁড়ায় আছে ।" আবির রিভুর কথা শুনতেই একবার রিভুর পায়ের দিকে তাকাল । জুতোটা সেই একই জুতো । কিছু বলল না আবির । কিন্তু কিছু একটা গরমিল যে আছে, এটা আবির নিশ্চিত । আর সকালে যেসব কথা শুনেছে, সেগুলো তো আরও সন্দেহের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে । আসলে সকালে আবির যখনই দরজায় কান পেতেছিলো, আবির তখনই শুনতে পেয়েছিলো রিভুর গলা । রিভু বলছে, "আমি তোমার কথা শুইনা সব করমু, তয় কথা যেন মাথায় থাকে ।" তখনই অর্ক বলেছিল, "শোন, তোরে আমি যা কইতেছি তাই আগে কর । বাকিডা পড়ে বোঝা যাইবো ।" রিভু তখন বলেছিল, "পড়ে বোঝা যাইব মানে? টাকা চাই, টাকা ।" ঠিক তখনই অর্ক খুব সম্ভবত কিছু টাকা রিভুর হাতে দিয়ে বলে, "এই ধর হারামজাদা ।" রিভু তখন বলল, "গালির চেয়ে টাকা বড় । তাই গালিটালি আর গায়ে মাখি না । এইবার কাম কি কন ।" অর্ক বলেছিলো, "কি করমু তা তো আগেই কইছি । তয় কার লগে করমু, তা কওয়া বাকি ছিল ।" ঠিক সেই সময় নাবিলা এসে দাড়িয়েছিল সিঁড়িতে আর আবির নাবিলাকে চুপ করতে বলে বাকি কথা শোনার চেষ্টা করেছিলো । কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আবির আর কিছুই সেরকম স্পষ্ট শুনতে পায় নি একটা নাম ছাড়া । অনামিকা । তাই তো ছাদে আসার পর নাবিলাকে জিজ্ঞেস করেছিলো অনামিকা নামে কাউকে চেনে কি না । "কিরে? কি ভাবতেছিস তুই?" শিমুলের ডাক শুনে কল্পনা থেকে ফিরে এলো আবির । জামি তখন বলল, "আরে বুঝোস নাই, নাবিলার কথা ভাবতেছে ।" এমন সময় ছাদে এলো নাবিলা আর নিশি । ওদের দেখে জামি বলল, "ভাই, তোর নাবিলা দেহি অনেক দিন বাঁচবো, নাম লইতে না লইতেই আইয়া পড়ছে ।" সবাই ছাদের দরজার দিকে তাকাল । বিছানায় আবিরের পাশে বসেছিল পরশ । নাবিলাকে আসতে দেখে উঠে যেয়ে অন্য পাশে বসতে বসতে বলল, "আমারে আর ওপাশে মানাইবো না ।" রিভু ইয়ার্কি করে বলল, "দ্যাখ, আহাম্মকডার বুদ্ধি-শুদ্ধি হইছে তাইলে ।" নাবিলা আর নিশি এদিকেই এলো । নিশি একটা নিরাপদ দূরত্বে বসলেও নাবিলা কিন্তু ঠিকই আবিরের পাশে বসে বসলো । সবাই অবাক হয়ে, "উও........." ধরণের একটা আওয়াজ করে মুচকি হাসল । নাবিলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কি হয়েছে?" রিভু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় আবির বলল, "কিছু না । জাস্ট এখানী তোমাদের দেখে এমন করছে । কেমন আছো?" নাবিলা বলল, "এহ! ভাব দ্যাখো । সকালেই তো দেখা হল ।" শিমুল তখন ইয়ার্কি করে বলল, "দোস্ত, চল, আমরা একটু ওদিক থেকে ঘুরে আসি । এই নিশি, যাবা?" নিশিও ইয়ার্কির সাথে বলল, "হ্যাঁ, আমিও যাই, হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় পানি হবার মাঝে প্রভাবক হয়ে বাধা না দেই ।" বলে সবাই উঠে গেলো । ছাদের অন্য পাশে যেয়ে দাঁড়ালো । নাবিলা বলল, "তোমার বন্ধুগুলা এতো বদমাইশ!" আবির হেসে বলল, "কেন, তোমার বান্ধবীও তো কম না!" নিশি একটু আবিরের দিকে বিরক্তির সাথে তাকাল, আর আবির হেসে দিল । আবিরের হাতটা পাশেই ছিল । নিশি ধীরে ধীরে নিজের হাতটা এগিয়ে নিতে থাকল আবিরের হাতের দিকে । যখন তর্জনী আঙ্গুলটা আবিরের হাতের আঙ্গুলের সাথে স্পর্শ করাতে যাবে, ঠিক এমন সময় পাপলু আঙ্কেল হাফাতে হাফাতে ছাদের সিঁড়ির সামনে হাজির হয় । আবির দাড়িয়ে যায়, নিশিও প্রথমে হাত সরিয়ে নেয়, তারপর দাড়িয়ে যায়, ছাদের অন্যপাশে যারা ছিল ওরাও পাপলু আঙ্কেলকে দেখে এগিয়ে আসে । আবির জিজ্ঞেস করে, "কি হইছে পাপলু আঙ্কেল, হাফাইতেছো ক্যান?" পাপলু আঙ্কেল জোরে জোরে দম ফেলতে ফেলতে বলল, "একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে আবির, ক্লাস এইটের একটা ছাত্রী ওর ঘরে ময়া অবস্থায় পাওয়া গেছে ।" সবাই এক নিমিষেই হতবাক হয়ে যায় । মরা অবস্থায়! মানে লাশ পাওয়া গেছে! আবির বলে "চলতো সবাই দেখে আসি ।" সবাই আবিরের সঙ্গে যেতে থাকে । সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আবিরের মাথায় একটাই ব্যাপার মনে পড়তে থাকে । সেই আওয়াজটা যেটা আসতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গিয়েছিলো । আর সেটাও ক্লাস এইটের বিল্ডিঙেরই দিক থেকে । আবির সবাইকে নিয়ে বিল্ডিঙের কাছাকাছি আসতেই দেখলো, নিচতলার দরজার সামনে অনেক ভীর । শুধু তাই নয়, হোস্টেলের এ পাশটায় মেয়েরা থাকে, অথচ ছেলেরাও দেখতে এসেছে ঠিক কি হয়েছে । আবির ভেতরে ঢুকল সাথে ওর বন্ধুরাও । অনেক দূর থেকেই কান্নার আওয়াজ আসছিলো ভেতরে এসে বোঝা গেলো কে কাদছে । এই মেয়েটা যে ঘরে থাকতো, সেই ঘরের অন্য রুমে যে মেয়েটা থাকতো, সে । আবির চেনে ওকে । সায়রা নাম । আবিরকে বলেছিল মেয়েটা যে ওর পাশের রুমে নতুন একটা মেয়ে এসেছে, কিন্তু নামটা ঠিক কি বলেছিল মনে পড়ছে না আবিরের । মেঝেতে পড়ে থাকা মেয়েটার বুকের ওপর মাথা রেখে কাদছে সায়রা । যে মেয়েটা মারা গেছে, ওর মুখ দিয়ে এক প্রকার সাদা তরল বেড়িয়ে আছে । হাতের পাশেই পড়ে আছে বিষের কৌটো । আর তাছাড়া এই প্রতিষ্ঠানে থাকাকালীন মারা যাবার ঘটনা এই প্রথম ঘটলো । তাও যে-সে মারা যাবার ঘটনা না, একেবাড়ে সুইসাইড! খানিক বাদে পুলিশ এলো । কিছু পুলিশ মেয়েটার লাশটা একটা সাদা কাপড়ে মুড়ে নিয়ে গেলো, কিছু পুলিশ এই রুমের আশেপাশে পড়ে থাকা কিছু নমুনা নিয়ে চলে গেলো । যিনি সবার প্রধান পুলিশ অফিসার ছিলেন উনি বাইরে এসে রাশেদ স্যার এর সাথে কথা বললেন । আবির এতক্ষণ খেয়াল করে নি, রাশেদ স্যারও এসেছেন । অফিসার রাশেদ স্যারকে বললেন, "স্যার, ব্যাপারটা আসলেই খুব অদ্ভুত । এই প্রতিষ্ঠানে প্রথম মৃত্যু হল প্রতিষ্ঠানে থাকাকালীন । আচ্ছা, আপনাদের কি মনে হয়, এই মেয়ের হঠাৎ করে এতো বড় একটা স্টেপ নেবার কারণ কি হতে পারে?" রাশেদ স্যার বললেন, "আমি নিজেও কিছু বুঝতে পারছি না অফিসার । আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, এই কলেজে একটা মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ।" পুলিশ অফিসার উনার ক্যাপটা মাথায় পড়ে বললেন, "দেখুন স্যার, জন্ম মৃত্যু তো আল্লাহর হাতেই, উনি যখন যাকে নেবার, তাকে নিয়ে যান, আবার অনেকে আছে যারা এই জঘন্য সুইসাইড করে মারা যায় । কিন্তু এখন আমাদের যা কাজ, সেটাও তো করতে হবে । এমনও তো হতে পারে, মেয়েটাকে কেউ খুন করেছে ।" রাশেদ স্যার অবাক হয়ে বললেন, "খুন! কে করবে!" পুলিশ অফিসার বললেন, "হ্যাঁ । আচ্ছা খুনের দিকে না আসি, আপনি বলুন কি এমন ঘটতে পারে যার জন্য মেয়েটা এতো বড় একটা স্টেপ নেয়?" রাশেদ স্যার বললেন, "আমি যেহেতু ওদের ক্লাস নেই না, তাই সেভাবে বলতে পারছি না । তবে ক্লাস এইটের ক্লাস টিচার কলি ম্যাম । আপনারা উনার সাথে কথা বলতে পারেন । আর এই মেয়ের সবচেয়ে ক্লোজ রুমমেট ছিল ভেতরের সায়রা মেয়েটা । ওর সাথেও কথা বলতে পারেন ।" অফিসার একটা বিল্ডিংটার দিকে তাকালেন । তারপর বললেন, "ওই মেয়েটার মনের যে অবস্থা, এই অবস্থায় ওকে কিছু জিজ্ঞেস না করাটাই ভালো । আমি তার চেয়ে বরং পরশু স্কুলে এসে কলি ম্যাম এর সাথে কথা বলব । কাল তো শনিবার, স্কুল্ল ছুটি ।" রাশেদ স্যার বললেন, "জি অফিসার । কোন দরকার লাগলে আমায় জানাবেন ।" অফিসার, "আচ্ছা" বলে চলে গেলেন । পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলেন, ভেতর থেকে আবির বেরোচ্ছে । আবির স্যার এর কাছে এসে বলল, "আসসালামু আলাইকুম স্যার । কেমন আছেন?" স্যার ভ্রু-কুঁচকে আবিরের দিকে তাকিয়ে কেবল সালামের জবাব দিয়ে চলে গেলেন । কোন জবাব দিলেন না । আবির পিছু ডাকতে গিয়েও ডাকল না । বুঝল, আবিরের প্রতি স্যার এর রাগ এখনও কমে নি । এমন সময় পাপলু আঙ্কেল আবিরের কাধে হাত রাখল । আবির পেছন ফিরে পাপলু আঙ্কেলকে দেখে বলল, "আরে আঙ্কেল! হইছেটা কি আসলে?" পাপলু আঙ্কেল মাথা নিচু করে বললেন, "আজকে সকালে এই মেয়ের রুমের সব বান্ধবী শপিং করার জন্য বাইরে গিয়েছিলো । ফিরতে ফিরতে ওদের দুপুর হয়ে যেয় । এই মেয়েটাই শুধু যায় না কি একটা কাজে । কিন্তু ওর বান্ধবীরা শপিং করে এসে দ্যাখে, দরজা খুলছে না এই মেয়েটা । অনেক দরজা ধাক্কাল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না । তখন ওরা আমাকে ডেকে নিয়ে আসি । আমি দরজা ভেঙ্গে দেখি, এই অবস্থা । মেঝেতে পড়ে আছে মেয়েটা । আমি তাড়াতাড়ি স্যারদের কল দেই । পড়ে তোমাদের ডেকে নিয়ে আসি । বাকিটা তো দেখলেই ।" আবির বলল, "আচ্ছা, মেয়েটার নাম কি?" পাপলু আঙ্কেল জবাব দিলেন, "অনামিকা ।" অনামিকা! আবির অবাক হয়ে গেলো । ওর মনে পড়লো, সকালে অর্কর ঘরে উঁকি দিয়ে অস্পষ্ট কথাগুলোর মাঝে একটা কথা আবির স্পষ্ট শুনেছিলো । অনামিকা । তবে কি অর্কই অনামিকার সাথে কিছু একটা করেছে? কিন্তু কীভাবে? তখন জুতোজোড়া তো দরজার সামনেই ছিল । খালি পায়ে এসে করেছে কি? আবির কিছুই বুঝতে পারলো । কেমন যেন সব কিছু ঘোলাটে লাগতে শুরু করলো । কিছুতেই বুঝতে পারছে না, হচ্ছেটা কি ওর চারপাশে? এই ৭বছরে যা হয় নি, এই কিছুদিনের মধ্যে এরকম উল্টাপাল্টা হয়ে যাচ্ছে কেন সব? আবির নিজেকে সামলে নিলো । নিজেকে আর কোন প্রশ্ন করলো না । করে কি লাভ? শুধু শুধু সময় নষ্ট । কোন জবাব এখনই পাওয়া যাবে । এখন করার মতো একটাই কাজ আছে । অপেক্ষা ।

সেদিন রাতের ছাদে খাটের ওপর শুয়ে ছিল আবির । এমন সময় নাবিলা এলো আবিরের কাছে । পাশে এসে বসলো । আবিরের মন খারাপ, নাবিলারও চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, মন তেমন ভালো নেই । নাবিলা বলল, "মন খারাপ?" আবির উঠে বসলো । জবাব দিলো, "না ।" "হঠাৎ করে কোত্থেকে যে কি বিপদ চলে আসে, আল্লাহ-ই জানেন ।" "হুম" সায়রা মেয়েটা এখনও অনেক কষ্টে আছে । কারো সাথে তেমন কোন কথা বলছে না ।" আবিরের আবারও একই জবাব, "হুম ।" নাবিলা আবারও বলল, "আহারে, মেয়েটার পোস্টমর্টেম করা হবে । রেজাল্ট যে কি বেরোবে!" আবির এবারও "হুম" ছাড়া আর কোন কথা বলল না । নাবিলা হঠাৎ করে ধীরে ধীরে আবিরের হাতটা ধরলো, আবিরও ঠিক তখনই হাতটা দ্রুত বেগে সরিয়ে নিয়ে রাগী মেজাজে বলল, "সমস্যা কি তোমার! আমার সাথে এতো ক্লোজ হবার ইচ্ছে হয় কেন?" নাবিলা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, আবির তখনই বলল, "কি ভাবো, আমি কিছু বুঝি না, সকালে আমার কাধে মাথা রাখতে চেয়েছিলে, দুপুরে আমার হাতে হাত রাখতে চেয়েছিলে, মানে আমাকে ধরার তোমার এতো শখ!" "আবির তুমি......।" ভয়ে ভয়ে আবারো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো নাবিলা, আবির আবারো থামিয়ে দিয়ে বলল, "আমার সামনে বেশি ন্যাকামো করবে না বলে দিলাম, আমার কিন্তু সহ্য হয় না ।" বলে বিছানা থেকে উঠে ছাদের রেলিঙের ওপর হাত রেখে দাঁড়ালো আবির । নাবিলা কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে মূর্তির মতো আবিরের দিকে তাকিয়ে রইল । কাঁদো কাঁদো গলায় এক পর্যায়ে বলল, "আবির!" কথা শেষ হতে না হতেই আবির প্রচণ্ড রাগি মেজাজে বেশ জোরে চিৎকার করে বলল, "যাও তুমি! তোমাকে আমার এখন দেখতে ইচ্ছে করছে না!" নাবিলা উঠে কাঁদতে কাঁদতে নিচে চলে গেলো ।

এদিকে নিশি, জামি আর পরশ ছিল সায়রার কাছে । সায়রা এক মনে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল । সায়রার অন্য একটা রুমমেটও পাশেই বসে ছিল । নিশি সায়রাকে বলল, "আপু, তুমি এতো কষ্ট পাচ্ছো কেন? দ্যাখো, যা হবার হয়েছে, এখন এভাবে কাদলে তো কোন সমাধান হবে না তাই না?" সায়রার মুখে কোন জবাব নেই । জামিও বলল, "সায়রা, তোমাকে এখন সামনে এগিয়ে যেতে হবে তো । এখন অনামিকা সুইসাইড করেছে বলেই যে তোমাকে.........।" "ও সুইসাইড করে নি!" জামিকে থামিয়ে দিয়ে কথাটি বলল সায়রা । জামি কিছু একটা বলতে গেলো কিন্তু নিশি ঈশারা করে থামিয়ে দিল । নিশি তখন সায়রাকে বলল, "সায়রা আপু, তুমি এখন একটু ঘুমাও, ভালো লাগবে । আর তুমি যে বলছো ও সুইসাইড করে নি, কেউ ওকে খুন করেছে, যারা খুন করেছে, ওদের শাশ্তি হবেই । তুমি চিন্তা কোরো না ।" সায়রা তখন বলল, "জানেন আপু, অনামিকা ছিল আমার মা, আমার বোন । এখানে মাত্র দু-মাস ওর সাথে আমার পরিচয় আর মাত্র এই দু-মাসেই ও আমার এতোটা ক্লোজ হয়ে গিয়েছিলো । ওর মতো ভালো মানুষ আমি কখনোই দেখিনি । আর ওর মতো ভালো মানুষ যে সুইসাইড করতে পারে, আমি বিশ্বাস করতেই পারি না ।" নিশি তখন বালিশ এগিয়ে দিয়ে বলল, "হ্যাঁ সায়রা, আমরাও বিশ্বাস করি না অনামিকা সুইসাইড করেছে । এবার তুমি ঘুমোও তো ।" সায়রা কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল । তারপর শুয়ে পড়লো । নিশি সায়রার মাথায় হাত বোলাতে লাগলো ।

এদিকে রিভু আর পরশ গিয়েছে পাপলু আঙ্কেলের রিসিপশন রুমে । প্রসঙ্গক্রমে পাপলু আঙ্কেল বলল, "তাহলে এবার তোমরাই বলো, এরকম একটা মেয়েকি কখনো সুইসাইড করতে পারে? কি সুন্দর ছিল দেখতে । আর আমার সাথে কি সুন্দর করে কথা বলতো বললামই ।" রিভু তখন বলল, "হুম কে জানে, কে কি করেছে । তবে আমার কাছে ওর চেহারা তেমন ভালো লাগে না ।" রিভু পরশ অবাক হয়ে বলল, "কি কস তুই! মাথা ঠিক আছে! আমাগো আবিরের নাবিলার চেয়েও সুন্দর!" পাপলু আঙ্কেল তখন বলল, "আচ্ছা, বাদ দাও । এখন বলেই কি হবে এসব ।" পরশ বলল, "না পাপলু আঙ্কেল, তুমিই কও, ক্যামনে ও ওই মেয়েরে অসুন্দর কয় ।" রিভু হালকা রাগ দেখিয়ে বলল, "ক্যান! আমার কাছে ভাল্লাগে না, তাই আমি কইছি । এহন কি তুই আমারে দোষী বানাবি নাকি!" পাপলু আঙ্কেল কিছু বলতে যাবে এমন সময় পরশ বলল, "আমি কি তোরে একবারও দোষী কইছি?" রিভু কোন জবাব দিল না । পাপলু আঙ্কেল বিরক্ত হয়ে বলল, "আহ! কি শুরু করলে দুজন! থামো । একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া শুরু করলে ।" রিভু তখন মেজাজ দেখিয়ে বলল, "তুমি ওরেই কও, ওই মাইয়ারে ভালো না-ই লাগতে পারে । এতে অয় এইসব আলতু-ফালতু কথা কয় ক্যান?" পাপলু আঙ্কেল এবার ধমক দিয়ে বলল, "থামো! তোমরা যে কি হয়েছো!" রিভু আর পরশ আর কিছু বলল না ।






(৮)
এদিকে শিমুল এতক্ষণ ঘরেই ছিল । বেড়িয়ে নিচের দিকে যাচ্ছিলো, এমন সময় খেয়াল করলো কাঁদতে কাঁদতে দ্রুত পদক্ষেপে ছাদ থেকে নিচে নেমে আসছে নাবিলা । শিমুল নাবিলাকে ডাকল, কিন্তু নাবিলা কোন জবাব দিল না । নাবিলা ঘরে যেয়ে নিজের রুমে দরজা আটকে দিল । আটকাবার সময় দরজাটা প্রচণ্ড শব্দ করে লাগালো, মনে হল যেন পুরো বিল্ডিঙটা কেপে উঠলো । অন্য রুম থেকে বেড়িয়ে এলো নিশি । শিমুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কি হইছে?" শিমুল নিচের ঠোঁট সামনের দিকে বাকিয়ে ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে ঈশারা করে বলল, কিছু জানে না । ছাদে দাড়িয়ে তখন আবির কি যেন ভাবছে । একবার মনে পড়ছে অনামিকার কথা, একবার মনে পড়ছে দরজার সামনে দাড়িয়ে অনামিকা শব্দটা শুনবার কথা । কিন্তু এর মাঝে কোন যোগসূত্রই খুজে পাচ্ছে না আবির । হ্যাঁ হতে পারে অর্কই অনামিকাকে মেরেছে, কিন্তু এর মধ্যে অর্কর কি স্বার্থ থাকতে পারে? আবির ভাবতে ভাবতে বিরক্ত হয়ে গেলো । একটা বিরক্তিসূচক আওয়াজ করে ছাদের রেলিং-এ কয়েকবার ঘুষি মারল । ব্যাথাটা যদিও নিজেই পেলো । এমন সময় পেছন থেকে এসে আবির যে হাত দিয়ে ঘুষি মেরেছিল, সেই হাতটা ধরে দেখে বলল, "কিরে শালা! পাগল হইলি নাকি?" আবির হাতটা সরিয়ে নিলো । শিমুল আবারো বলল, "আজিব! কি হইছে তোর?" আবির বলল, "ভাল্লাগতেছে না । যা এখান থেইকা ।" "নাবিলা ছাদ থেকে কাঁদতে কাঁদতে গেলো কেন?" আবির শিমুলকে আবারো একটা ঘুষি দিয়ে বলল, "যেতে বলছি না তোরে!" শিমুলের সেদিনকার মুখের ক্ষতটা মোটামুটি সেরে যাচ্ছিলো, কিন্তু আজকে আবার ঘুষি খেয়ে রক্ত পড়তে শুরু করলো । আবির কিছুক্ষণ আবারো রেগে যখন দেখল শিমুলের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, তখন শিমুলকে আবারো জড়িয়ে ধরে বলল, "সরি দোস্ত! বার বার ক্যান যে তরেই মারি!" শিমুল আবিরকে দূরে ঠেলে বলল, "সর হারামি! রক্ত লাগলো তোর জামায় দ্যাখ ।" আবির বলল, "ব্যাপার না । আমগো সবার রক্তই তো এক ।" শিমুল তখন বলল, "তাইলে বল, হইছে টা কি?" আবির চুপ হয়ে গেলো । শিমুল তখন বলল, "হুম, আমি জানতাম তুই আমাকে বলবি না । থাক । আসলে আমি তো বস্তি থেকে উঠে এসছি, তাই তুই এমন করছিস না!" আবির বিরক্ত হয়ে বলল, "আরে ভাই! এইসব কথা আসতেছে ক্যান?" "হুম । আসতেছে । যেমন ব্যাবহার করতেছিস, আমার ছোটবেলার কথা মনে পইড়া যাইতেছে ।" আবির খেয়াল করলো শিমুলের চোখে কোণে পানি ছলছল করছে । আবির তখন শিমুলের কাধে হাত রেখে বলল, "বাপরে বাপ! যা! তুই জিতছিস ।" শিমুল জিজ্ঞেস করলো, "ক্যামনে?" "এইযে, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল কইরা ।" শিমুল হেসে দিল । বলল, "আরে ধুর, ইমোশনাল কই হইছি? নাকে ব্যাথা করতেছে । তাই পানি পরতেছে ।" আবির বলল, "বাহ! বাহ! এবার চল । মেডিক্যালে যাই ।" শিমুল বলল, "আগে ক কি হইছে?" "আচ্ছা, কমুনে । আগে মেডিক্যাল থেইকা আসি । চল ।" আবির শিমুলকে নিয়ে মেডিক্যাল গেলো । আবিরদের স্কুলের বাইরে একটা মেডিক্যাল আছে । কোন শারীরিক সমস্যা হলে ওরা মেডিক্যালে যায় । বেরোবার সময় রিসিপশন জানালায় পাপলু আঙ্কেল, রিভু আর পরশের সাথে দেখা । পরশ দেখে জিজ্ঞেস করলো, "কিরে? কই যাস তোরা?" আবির জবাব দিল, "আমি আবার শিমুলরে ঘুষি মারছি । রক্ত পড়তেছে, তাই মেডিক্যালে যাচ্ছি ।" পাপলু আঙ্কেল কপাল হাত রেখে বলল, "হায়রে! এখানে দুজনের ঝগড়া থামাচ্ছি, ওদিকে দুজনের মারামারিও করা সারা!" পরশ তখন বলল, "আমিও যাবো চল ।" আবির রিভুকে জিজ্ঞেস করলো, "তুই যাবি?" রিভু হঠাৎ চমকে বলল, "না না, আমার একটু কাজ আছে । যাই আমি ।" বলেই রিভু সেখান থেকে বেড়িয়ে যেতে লাগলো হোস্টেল বিল্ডিং-এর দিকে । পরশ বলল, "হুহ! গেছে ভালো হইছে । চল যাই ।" আবির, শিমুল আর পরশ যেতে লাগলো । পাপলু আঙ্কেল শুধু বলল, "তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু, অনেক রাত হয়েছে ।" আবির "আচ্ছা" বলে জবাব দিল । মেডিক্যালে বসে তারেক আঙ্কেল । তারেক আঙ্কেল যা যা করার সব করলো । এরপর একটা কাগজ দিয়ে বলল, "এই ওষুধখান নিয়ি যা । পাশের দোকানেই পায়ি যাবি । ৩০ ট্যাকা নেবেনে ।" আবির বলল, "থাঙ্ক ইউ আঙ্কেল । আসি তাইলে ।" তারেক আঙ্কেল বলল, "যা । তয় মারামারি কম করিস । নাইলে মাইর খাবিন বোলো ।" আবির, শিমুল আর পরশ চলে এলো । সামনেই ওষুধের দোকান । দোকানে বসে হাবিব ভাই । আবির যেয়ে কাগজটা হাতে দিয়ে বলল, "ভাই, এই ওষুধটা দ্যান ।" হাবিব ভাই কাগজটা দেখল । তারপর তাকে তাকে খুঁজতে লাগলো । শিমুল বলল, "দোস্ত, আমি দাম দেই?" আবির চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, "চুপ! আমি দিমু দাম ।" বলেই আবির সামনের দিকে তাকাল । একটা সিসি ক্যামেরা নজরে এলো । হাবিব ভাই ওষুধটা আবিরের হাতে দিয়ে বলল, "নেও ওষুধ ।" আবির ওষুধ হাতে নিয়ে শিমুলের হাতে দিল । আবির পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলো, "হাবিব ভাই, এই সিসিক্যামেরা কি ২৪ঘণ্টাই খোলা থাকে?" হাবিব ভাই বলল, "হয়, ক্যান?" আবির বলল, "না, এমনি ।" মানিব্যাগে দেখল, ৫০০ টাকার একটা নোট । আরও টাকা খুঁজতে লাগলো, কিন্তু পেলো না । অবাক হয়ে মনে মনে বলল, "কি ব্যাপার! আমার ব্যাগে তো ৩০ টাকা ছিল! অর্কর দেয়া । কি হল তাহলে ব্যাপারটা?" আবির আর কাউকে কিছু বলল না । ৫০০ টাকার নোটটা হাবিব ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলল, "ভাই ভাংতি হইবো?" হাবিব ভাই ড্রয়ারে খুজে খুজে খুচরা বের করলো, কিনতু লাগে আরও ২০ টাকা খুচরা হতে । হাবিব ভাই বলল, "২০ কম পড়ি যাইতেছে ।" আবির বলল, "২০টাকার বিষ দেন ।" হাবিব ভাই অবাক হয়ে বলল, "অ্যাঁ! বিষ!" আবির শিমুল আর পরশও অবাক হয়ে গেলো । আবির বলল, "হ বিষ, ক্যান পাওয়া যায় না?" হাবিব ভাই বলল, "হ যায় তো । কিন্তু......" হাবিব ভাইয়ের কথা শেষ করতে না দিয়েই আবির বলল, "আচ্ছা বাদ দেন, মজা লইতেছিলাম । শিমুল, এহন তুই-ই দে ।" শিমুল টাকাটা দিল । এরপর আবির বলল, "আচ্ছা পরশ, তুই একটু শিমুলরে লইয়া যা, আমি পড়ে আইতাছি।" পরশ জিজ্ঞেস করলো, "কই যাবি তুই?" আবির বলল, "আরে যা না, কইলাম তো কাম আছে!" পরশ আর শিমুল চলে গেলো । আবির দোকানের সামনে দাড়িয়ে ওদেরকে যেতে দেখল যতক্ষণ ওদের দেখা যায় । গেইটে আসতেই পাপলু হাফাতে হাফাতে আঙ্কেল জিজ্ঞেস করলো, "কিরে, আবির কোথায়?" পরশ বলল, "অয় কইলো পড়ে আইবো ।" শিমুল জিজ্ঞেস করলো, "ক্যান কি হইছে? আর তুমি হাফাইতেছো ক্যান?" পাপলু আঙ্কেল বলল, "পুলিশ এসেছে । সাথে খাইরুল স্যার, রাশেদ স্যার এনারাও এসেছে ।" "আবার পুলিশ!" অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো শিমুল । পাপলু আঙ্কেল, "হ্যাঁ । আর পুলিশ সাথে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এনেছে ।" শিমুল বলল, "ও তাই! তা ওই পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কি এসেছে?" পাপলু আঙ্কেল চুল হয়ে গেলো । পরশ জিজ্ঞেস করলো, "কি হইল পাপলু আঙ্কেল? চুপ হইয়া গেলা ক্যান?" পাপলু আঙ্কেল ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল । শিমুল বলল, "আঙ্কেল বলেন, পোস্টমর্টেমের রেজাল্ট কি?" পাপলু আঙ্কেল মুখের ঘাম মুছলেন ।






(৯)
এদিকে নিশি অনেকক্ষণ ধরে নাবিলার দরজা ধাক্কাবার পর নাবিলা দরজা খুলল । নিশি জানতে চাইলো, "কিরে, কি হইছে? তুই কাদতেছোস ক্যান?" নাবিলা আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিল । নিশি তখন বলল, "শোন একদম কাঁদবি না । তুই না সাহসী?" নাবিলা কিছু বলে না । শুধু কাদে ।" নিশি জানতে চায় অনেকবার কিন্তু নাবিলা কিছুতেই ওর কান্নার কারণ বলে না । এক পর্যায়ে নিশি বলে, "আচ্ছা বলা লাগবে না । তবে কেউ যদি তোর সাথে কিছু করে থাকে, তুই তার সাথে আজ থেকে আর কথা বলবি না । দেখিস, সেও আর তোর সাথে কিছু করবে না ।" নাবিলার কান্না হঠাৎ করে থেমে গেলো । কথাটা একটু ভাবল । নিশি বলল, "যাক! মেয়ের কান্না থেমেছে ।" এমন সময় দৌড়াতে দৌড়াতে দরজার সামনে এলো রিভু । জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, "তাড়াতাড়ি চল, একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটছে ।" নিশি জিজ্ঞেস করলো, "কি হইছে?" রিভু জবাব দিল, "পুলিশ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়া আসছে । আর পুলিশ বলছে, দোষী......।" বলতে গিয়ে থেমে যেয়ে ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে লাগলো রিভু । নিশি আর নাবিলা দুজনেরই মুখে ভয়ের ছাপ । নাবিলা জিজ্ঞেস করলো, "কে দোষী?" রিভু শ্বাস নিতে নিতে নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দিল, "আবির ।" নাবিলা আর নিশি অবাক হয়ে চিৎকার করে উঠলো, "কিহ!" রিভু জবাব দিল, "হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি চলো, পুলিশ অনামিকার রুমে আছে ।" রিভু নিশি আর নাবিলাকে নিয়ে হাজির হল অনামিকার রুমে । নিশিকে দেখেই সায়রা এগিয়ে এসে নিশিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো । ভেতরে আরও ছিল পাপলু আঙ্কেল, শিমুল, পরশ, জামি । আরও ছিল রাশেদ স্যার, খায়রুল স্যার । ছিল না শুধু আবির । পুলিশ অফিসারের সাথে ছিল আরও ২জন হাবিলদার । হাবিলদার দুজন পাশে দাড়িয়ে, পুলিশ অফিসার বিছানায় বসে । অফিসারের সামনে বসে খায়রুল স্যার আর রাশেদ স্যার । পেছনেই দাড়িয়ে পাপলু আঙ্কেল, শিমুল, জামি আর পরশ । রিভু, নিশি আর নাবিলা ভেতরে এলো । সবাইকে দেখে পুলিশ অফিসার দাড়িয়ে যেয়ে বলল, "বাহ! চমৎকার । সবাইকেই তো দেখছি, কিন্তু আসল অপরাধীই তো এখনও এসে হাজির হল না ।" শিমুল তখন বলতে গেলো, "একটু আগেই আমি ওকে ফোন.........।" শিমুলের কথা শেষ করতে না দিয়েই অফিসার বলল, "ফোন দিয়েছ আর ও বলছে আসছে । না? এই কথা তুমি আমাকে ১০ মিনিট আগেও বলেছ । কি এমন দূরে গেছে যে আসতে এতক্ষণ লাগে?" শিমুল মাথা নিচু করলো । খায়রুল স্যার তখন বলল, "ছিছি! শেষমেশ আবির!" আমি এখন পর্যন্তও বিশ্বাস করতে পারছি না । আচ্ছা, আপনারা কীভাবে বুঝলেন ওই আসল দোষী?" অফিসার কোন জবাব দিল না । কিছুক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখল, তারপর বলল, "আপনাকে আগেও বলেছি, দোষী এলে তারপর বলবো ।" রাশেদ স্যার তখন বলল, "আমি এটাই বুঝতে পারছি না, ৭টা বছর ধরে ওকে দেখেছি, কিন্তু ও যে এতো খারাপ তা তো কোনোদিন বুঝিনি?" খায়রুল স্যার তখন বলল, "আমার না এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না । আমার মনে হয় কোন গণ্ডগোল আছে এখানে ।" রাশেদ স্যার খায়রুল স্যার এর দিকে আর চোখে তাকিয়ে বলল, "হইছে, আপনের ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিল তো, তাই এমন মনে হচ্ছে । আসলে ও ছিল মিচকা শয়তান ।" এমন সময় ভেতরে এলেন সোমা আপু আর রাকিব ভাই । সোমা আপু ঢুকেই বলল, "কি ব্যাপার, কি হয়েছে, আমাকে জামি ফোন করে বলল কি নাকি হয়েছে?" পুলিশ অফিসার জামির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে বলল, "তোর দোস্ত আবির কি সোমা আপু হয়ে এসেছে নাকি হারামজাদা!" জামি বলল, "আমি তো আবিরকে ফোন দিয়েছি!" "চুপ!" জামিকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল অফিসার । তারপর বলল, "আর একটাও কথা বলবি না । ওই কুত্তার বাচ্চা না আসলে আগে তোর পেছনে পাশ দেবো ।" জামি আবারো মাথা নিচু করলো । কিন্তু কষ্ট পেলো না । কারণ ও জানে পুলিশের মুখে এসব ভাষা আসা অস্বাভাবিক না । সোমা আপু পাপলু আঙ্কেলের কাছে সবটা জানতে চাইলে পাপলু আঙ্কেল সবটা খুলে বলে । সোমা আপু আর রাকিব ভাই অবাক হয়ে যায় । রাকিব ভাই বলে, "আবির! না না, এটা বিশ্বাস করার মতো না ।" সোমা আপু শিমুলকে বলল, "আবির কোথায়?" শিমুল কোন জবাব দিল না । পুলিশ অফিসার একটু হেসে বলল, "সে তো ভেগে যাবার তালে আছে । কে জানে এতক্ষণে ভেগেছে কি না ।" এমন সময় দরজা থেকে কেউ একজন বলল, "আমি ভাগি নাই ।" সবাই দরজার দিকে তাকাল । আবির দাড়িয়ে । হাসিখুশি ভাবে নর্মাল দাড়িয়ে আছে । দেখে মনেই হচ্ছে না, ও কোন দোষ করেছে । আবির ভেতরে এলো । রাশেদ স্যার, খায়রুল স্যার দুজনেই দাড়িয়ে গেল । আবির স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে ভেতরে ঢুকল । আবিরকে এতোটা স্বাভাবিক দেখে পুলিশ অফিসার প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে হাতে লাঠি উঁচিয়ে আবিরকে মারার জন্য তুলে ধরে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, "এখন ভাব নিচ্ছিস!" যেই না অফিসার মারতে যাবে, অমনি আবির হাত তুলে বলল, "এক মিনিট ।" অফিসার মারতে গিয়েও থেমে গেলো । অবাক হয়ে গেলো সবাই আবিরের সাহস দেখে । আবির বলল, "আপনারা কোন যুক্তির ভিত্তিতে এসব বলছেন? কোন গোয়েন্দা পুলিশের মাধ্যমে জেনেছেন, নাকি নিজেরাই বিচার বিবেচনা করে এসব করছেন?" অফিসার উচু গলায় বলল, "আরে হারামজাদা! এসব জানতে গোয়েন্দা লাগে! যা পেয়েছি সেটাই প্রমান করতে যথেষ্ট আবির তখন বলল, "কচু করেছেন আপনারা ।" সবাই ভ্রু-কুঁচকে আবিরের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল । এমনভাবে তাকিয়ে যেন সবাই জিজ্ঞেস করছে, এ তুই এতো বড় খারাপ কাজ করার পর কি করে এতো কথা বলতে পারছিস । অফিসার তখন বলল, "নিজেকে আমার চেয়ে বিচক্ষণ মনে করো, না?" আবির ডানে বামে মাথা নেড়ে বলল, "না, তবে এটা যে আপনারা ভুল করছেন সেটাই আমি বোঝাচ্ছি । অফিসার তখন বলল, "বেশ, তাহুলে প্রমান করতে পারবি তুই দোষী নস?" আবির কথা শেষ হতে না হতেই জবাব দিল, "প্রমান সাথে নিয়েই আমি এসেছি ।" সবাই অবাক হয়ে গেলো । কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারলো না । অফিসারও কিছু বলতে পারলো না আর । আবির তখন বলল, "আমি সবটা প্রমান করবো, তবে এর জন্য আমার দুজন লোককে লাগবে । অফিসার বলল, "কাকে?" "এই স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল স্যার, আর তার গুণধর ভাতিজা অর্ককে ।" অফিসার তখন অন্যান্য ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে বলল, "বেশ! এই তোমরা কেউ যেয়ে অর্ককে ডেকে আনো তো ।" আবির ডানে বামে মাথা নেড়ে বলল, "উহু, এভাবে তো হবে না ।" অফিসার আবিরের দিকে তাকাল । তারপর বলল, "তাহলে কিভাবে হবে?" আবির বলল, "আমি বলছি । শিমুল, এদিকে আয় তো ।" শিমুল আবিরের কাছে এলো ।" আবির বলল, "শোন, আবিরের রুমে যাবি, যেয়ে ওকে জানাবি রাশেদ স্যার এর আজ জন্মদিন, সবাই ওকে ডাকছে ।" অফিসার কিছু একটা বলতে গেলে আবির তার আগেই বলে, "এভাবে না বললে কিছুতেই আসবে না । চোরকে তো আর চুরি করেছ বলে কাছে টানা যাবে না ।" শিমুল চলে গেলো । আবির যা যা বলল, সেই অনুযায়ী অর্ককে বলল । প্রথম প্রথম অর্ক রাজি না হলেও পরবর্তীতে রাজি হল । অর্ক তখনও ভেতরে ঢোকে নি, এমন সময় রিভু আবিরের কাছে এসে বলল, "দোস্ত, আমার একটু যাওয়া লাগবো ।" আবির ডানে বামে মাথা নেড়ে বলল, "না সোনা, তুমি এখন গেলে তো তোমার ওই চাঁদের মতো মুখখানা মিস করবো । তোমার যাওয়া চলবে না ।" রিভু আর কিছু বলল না । একটু পরেই অর্ক ঢুকল ভেতরে । দরজার কাছে এসেই পুলিশ দেখে একটু চমকে উঠলো । তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, "আ......আ...আহম...তু...তুই না কইলি রাশেদ স্যার এর জন্মদিন!" আবির তখন বলল, "হ্যাঁ অবশ্যই, আগে ভেতরে আসেন ভাই, আপনি আইলেন, কিন্ত স্যার, মানে আপনের চাচা না আইলে ক্যামনে হইবো?" আবির তখন অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বলল, "অফিসার আঙ্কেল, আপনি এবার রাশেদ স্যার এর ফোন দিয়ে প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে ফোন করুন ।" অফিসার আঙ্কেল নাম্বার খুঁজতে খুঁজতে আবির বলল, "দিয়ে বলুন তার ভাতিজা অর্ক মারাত্মক অসুস্থ, উনাকে দেখতে চায় । এবং আমরা ক্লাস এইটের নীচতলায় আছি ।" অর্ক মেজাজ নিয়ে বলল, "এই আবির! হইতেছে কি!" আবির তখন একটু হেসে বলল, "সিনেমা । আর সিনেমায় একটু টুইস্ট না থাকলে চলে?" কিছুক্ষন অপেক্ষা করবার পর প্রিন্সিপ্যাল স্যার এল । গাড়ির শব্দ ভেতর থেকেও শোনা গেলো । ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে প্রিন্সিপ্যাল স্যার বলছিল, "রিসিপশনে পাপলু নেই কে........." ন অক্ষরটা উচ্চারন করা হল না স্যার এর । পুলিশ দেখেই ঠিক অর্কর মতো চমকে গেল বলল, "পুলিশ! আমাকে রাশেদ ফোন করেছিলো না?" আবির তখন বলল, "জি স্যার ।" প্রিন্সিপ্যাল স্যার তখন তাকিয়ে দেখল অর্ক পাশেই দাড়িয়ে । অর্ককে দেখে বলল, "কিরে! তুই নাকি অসুস্থ!" অর্ক মেজাজ দেখিয়ে বলল, "চাচা দ্যাখো, এরা কি করতে এইহানে আনছে । ধুরু!" আবির ততোক্ষণে পরশকে কিছু বলে দেখিয়ে দরজার কাছে পাঠিয়ে দিল । অফিসার তখন বলল, "এবার শুরু করুন, আপনার মহামূল্যবান প্রমানের ব্যাখ্যা!" আবির তখন বলল, "দাঁড়ান না স্যার, আরেকজন আসছে । আমি উনাকে বলেছিলাম প্রিন্সিপ্যাল স্যার এর গাড়ি ঢুকতে দেখলেই চলে আসতে । চলে এলো বলে ।" এমন সময় একজন বছর ষাটের একজন লোক ভেতরে ঢুকল । হাতে একটা ব্যাগ । অফিসার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "আপনি! কারণ লোকটাকে অফিসার চেনে । ইনি গোয়েন্দা বিভাগের ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট । যতো ইনভেস্টিগেশনের কাজে উনিই সব খতিয়ে দেখেন । নাম, জাকির । আবির তখন পরশকে বলল, "দোস্ত, যা কইছিলাম, তাই কর ।" পরশ দরজা আটকে দিল । আবির তখন বলল, "এবার কি আমি বলা শুরু করতে পারি?" অফিসার বলল, "সেটা শোনার জন্যই তো এতক্ষণ দাড়িয়ে আছি!" আবির বলল, "ঠিক আছে, শুরু করলাম ।" আবির জাকিরের হাতে ব্যাগ থেকে অনেকগুলো জিনিস বের করলো । সেটা খুলে দেখালো অফিসারকে । আধপোড়া কিছু । অফিসার জানতে চাইল, "কি এগুলো?" আবির বলল, "এখানে আছে হ্যান্ডগ্লাভস, অ্যাপ্রোন, ট্রাউজার, মোজা, আর একটা অতীব অদ্ভুত জিনিস, যেটা প্রত্যেকটা পুরুষ শারীরিক মিলনকালে ব্যাবহার করে এইডস থেকে বাচতে ।" সবাই জিনিসগুলো দেখে অবাক হয়ে গেলো । সবগুলোই অনেকাংশ পুড়ে গেছে । অফিসার জিজ্ঞেস করলো, "এগুলো দিয়ে কি প্রমান হল?" আবির ওর বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা, তোদের মনে আছে, আজ দুপুরে খাওয়ার সময় আমি আসতে একটু দেরি করেছিলাম?" সবাই উপর-নিচ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল । আবির বলল, "সে সময় আবির এগুলো একজনকে পোড়াতে দেখেছি ।" সবাই প্রশ্ন করলো, "কে?" আবির কিছুক্ষণ হাসল । তারপর রিভুর দিকে আঙ্গুল দিয়ে ঈশারা করে বলল, "এই ছেলেটা ।" সবাই রিভুর দিকে তাকাল । রিভুর পায়ের কাঁপুনি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, আসলেই ও এমনটা করেছে । রিভু না বলবারও সাহস পেলো না । কাঁপতে লাগলো । পরশ বলল, "তার মানে এই হারামিটাই দোষী!" আবির ডানে বামে মাথা নাড়ল । বলল, "না ।" অফিসার বিরক্ত হয়ে বলল, "আজব, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ।" আবির তখন বলল, "হ্যাঁ, রিভুই এগুলো পুড়িয়েছে, রিভুরও হালকা দোষ আছে, কিন্তু রিভু আসল দোষী না । আচ্ছা, আপনারা তো এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন, এগুলো পরিধান করে অনামিকা নামের মেয়েটাকে ধর্ষণ করা হয়েছে?" সবাই সম্মতি জানালো । কিন্তু জামি প্রশ্ন করে বসলো, "ট্রাউজার আর অ্যাপ্রোন পড়ে কেউ ধর্ষণ করে?" আবির বলল, "ভালো একটা প্রশ্ন । এখানে করেছে, কারণ দোষী চায় নি নিজের কোন স্পর্শ অনামিকার গায়ে লাগাতে । এতে তো ডিএনএ টেস্টেই বেড়িয়ে যাবে আসল দোষী কে ।" রাকিব ভাই জিজ্ঞেস করলো, "তাহলে এই জিনিসগুলোতে যে ধর্ষণ করেছে, তার ডিএনএ থাকার কথা ।" আবির বলল, "অবশ্যই! এখানে ধর্ষিতা আর ধর্ষণকারী দুজনেরই ডিএনএ পাওয়া গেছে সেটা খুজতেই তো জাকির আঙ্কেলের কাছে গিয়েছিলাম ।" জাকির আঙ্কেল তখন বলা শুরু করলো, "তোমরা জানোনা, তোমাদের সবার পরীক্ষার খাতা আমরা নিয়ে গিয়েছিলাম ডিএনএ ম্যাচিং টেস্ট এর জন্য । এর মধ্যে একটা খাতার ডিএনএ- এর সাথে এই জিনিসগুলোতে পাওয়া ডিএনএ-এর মিল পাওয়া গেছে । অফিসার জানতে চাইল, "কার খাতার?" জাকির আঙ্কেল খাতাটা হাতে নিয়ে বলল, "শাকের জামান অর্ক ।" সবাই অর্কর দিকে তাকাল । অর্ক যখন বুঝে গেলো বাচার আর উপায় নেই, দরজা খুল বেরোতে চাইলো, কিন্তু দরজাতো ছিটকিনি দেয়া । ওটা খুলতে খুলতেই অফিসারের ইশারায় হাবিলদার দুজন ধরে ফেলে অর্ককে । অর্ক কান্না করতে করতে বলে, "আমারে মাফ কইরা দ্যান! আমি আর করমু না!" পুলিশ অফিসার বলে, "তোমাকে আমি ফাসি দেবার জন্য আদালতে দাবি করবো ।" এরপর অফিসার প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে বলল, "স্যার, কিছু মনে করবেন না । ওকে আমাদের নিয়ে যেতেই হবে ।" প্রিন্সিপ্যাল স্যার তখন একপ্রকার কেমন ভয় লুকিয়ে বললেন, "আরে না, না, ঠিকই আছে, এসব ছেলের এমন হওয়াই উচিৎ ।" অর্ক তখন মেজাজ দেখিয়ে বলল, "ক্যান! এহন ভালো সাজো ক্যান চাচা! আপন পরান বাঁচাইতেছ? নিজে যে আশেপাশের মাইয়াগো লগে বাড়িতে রাত কাটাও সেই বেলায়?" "মি.....মিথ্যে বলছিস ক্যান?" প্রিন্সিপ্যাল স্যার বললেন । দুজন কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেলো । পুলিশ অফিসার তখন বলল, "দুজনেই চুপ! দুটোই শুয়োরের বাচ্চা ।" এরপর পুলিশ অফিসার একজন হাবিলদারকে বলল, "তোমরা আরও কয়েকজনকে আসতে বলো, এই প্রিন্সিপ্যাল, ওর ভাতিজা, আর এই রিভু নামের ছেলেটাকে হাতখড়া পড়াও!" রাশেদ স্যার তখন বলল, "তাহলে আশেপাশের সবকিছুতে যে আবিরের হাতের ছাপ পাওয়া গেলো সেটা কীভাবে?" রিভু কিছু বলার আগেই বলল, "আমি রাতে যখন আবিরের সাথে ঘুমাতাম, তখন এই বিষে ওর হাতের ছাপ লাগিয়েছিলাম । শুধু তাই না, এই মেয়েটার কাপড়েও আবিরের হাতের স্পর্শ লাগিয়েছিলাম । পড়ে এই অর্ক মেয়েটার সাথে এরকম বাজে কাজটা করার পর এই জামাটা পড়িয়ে দিয়েছিল যেন সন্দেহটা সবাই আবিরকেই করে । এমনকি আবিরের পকেট থেকে ৩০টা টাকাও এনে এখানে রেখেছিলাম ।" পুলিশ অফিসার তখন বলল, "ছি ছি! কতো নিকৃষ্ট তোমরা । অপরাধী যদি ভাবে, ও এমন কিছু করবে যাতে কেউ ওকে ধরতে পারবে না, তাহলে সেটাই সে ভুল ভাবে । কোন না কোন একদিন ওকে ধরা তো খেতেই হবে । আর কোনভাবে যদি ধরা নাও খায়, মরার পর আল্লাহ তায়ালাই ওকে শাস্তি দেবেন ।" অফিসার আবিরকে জিজ্ঞেস করলো, "আবির! তুমি অনেক বুদ্ধিমান । এবার একটু জানতে পারি তুমি কি করে এতো কিছু করলে?" আবির বলল, "প্রথমত এই অর্ক আসবার পর থেকেই ওর আচরন দেখে আমি বুঝেছিলাম এই ছেলে এই কলেজে বাজে কিছু একটা করবে । তাই আমি এর সাথে বন্ধু হবার অভিনয় করেছিলাম যেন আমি কিছু করলেও অর্ক আন্দাজ না করতে পারে । কিন্তু অর্ক তখন চালে উল্টো চাল । ও আমি কি আসলেই ওর বন্ধু কি না সেটা জানার জন্য রিভুকে নিজের বন্ধু বানায় । রিভু সেদিন রাতে আমার সাথে ঘুমিয়েছিল তারপরে আবার ও আমার ওপর রেগেও ছিল একটু আগে । আমি তখন কিছু মনে করিনি । কিন্তু ধীরে ধীরে ও আমাদের সাথে মিশতে মিশতে বুঝে যায় আমি বাহিরে অর্ককে বন্ধুত্ব দেখালেও ভেতরে ভেতরে আমি ওর চালচলন খেয়াল করছি । আমি একবার দেখি রিভুর জুতো অর্কর দরজার সামনে । আজ সকালে দরজায় কান পেতে ওদের অনেক কথাও শুনে ফেল । এমনকি অনামিকা শব্দটাও শুনি । কিন্তু অনামিকার সাথে কি করবে, তা বুঝতে পাড়ি না । তখন আমি বুঝে যাই, রিভু অর্কর বন্ধু হয়েছে । এরপর আমি সবাইকেই আর আমার কোন প্ল্যান বলা বন্ধ করে দেই । দুপুরে এই পোরানো জিনিসগুলো কাছে রেখে দেই কিছু একটা ঘটেছে এই ভেবে । আজ যখন এই অনামিকার সাথে এই ঘটনা ঘটলো, তখন আমি বুঝে যাই, এই অর্কই কিছু একটা করেছে এবং ওই জিনিসগুলো পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিলো কোন প্রমান না রাখার জন্য । রাতে ওষুধের দোকানে সিসি ক্যামেরা দেখে আমার জানতে ইচ্ছে করলো, এই জিনিসগুলো এই দোকান থেকেই কেনা কি না । অনেক কষ্ট করে আমি হাবিব ভাইকে মানিয়ে সিসিক্যামেরার ভিডিওতে দেখি, সত্যি সকালে রিভু এসব জিনিস কিনেছিল । শুধু তাই নয়, ক্লাস সিক্সের সানি নামের একটা ছেলেকে বলে গিয়েছিলো ও বাজারে গেছে এবং যাবার সময় আমাকে খুজেছে, যাতে আমি ওকে সন্দেহ না করি ।" আবির পকেট থেকে মোবাইল বের করে ভিডিওটা দেখাল । তারপর আবির আবার বলা শুরু করলো, "এরপর আমি ডিএনএ টেস্ট করার জন্য জাকির আঙ্কেলের কাছে যাই । সেজন্য আমার এখানে আসতে এতোটা দেরি হল । আর বাকিটা তো আপনারা দেখলেনই ।" খায়রুল স্যার বলল, "যাক, সবটা পরিষ্কার হয়ে গেলো ।" আবির রিভুর সামনে দাড়িয়ে বলল, "আমার কাছে এখনও একটা জিনিস পরিষ্কার হয় নি ।" তারপর একটু থেমে বলল, "কেন এমন করলি রিভু?" রিভু কিছু বলল না ।" আবির আবারও প্রশ্ন করলো, "কেন করলি? তোকে কতো ভালো বন্ধু ভেবেছিলাম জানিস?" রিভু কোন জবাব দিল না । পাশ থেকে অর্ক বলল, "লোভী ওই শালা! এক নাম্বারের লোভী ট্যাকার লোভ দেখাইছিলাম, তাই এমন করছে ।" এমন সময় দরজায় নক করবার শব্দ এলো । পরশ দরজা খুলে দেখল, "বাকি পুলিশ চলে এসেছে । সবাই প্রিন্সিপ্যাল, রিভু আর অর্ককে ধরে নিয়ে গেলো । যাবার সময় পুলিশ অফিসার আর ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট জাকির আঙ্কেল দুজনেই প্রশংসা করে গেলো । উনাদের একটাই কথা, আবির একদিন অনেক বড় গোয়েন্দা হতে পারবে । আবিরের বন্ধুরাও আবিরের প্রশংসা করলো । শিমুল বলল, "দেখো ভাই দেখো, হামারা আবির নে জাসুস নিকলা!" সোমা আপু বলল, "বাহ আবির! তুমি সত্যি চমৎকার একটা কাজ করেছো!" বাকিরা সবাই আবিরের অনেক প্রশংসা করলো । কিন্তু সেখান থেকে আবিরকে প্রশংসা করার মাঝে চলে গেলো নিশি । ও নিজেও খুশি হয়েছে, কিন্তু কিছু বলল না আবিরকে ।

সেদিন রাতের কথা সবাই শোবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল । আবির নিজের রুমে বিছানায় শুয়ে বলল, "আহ! কতদিন পর নিজের রুমে! কি মজা লাগছে! এর চেয়ে আরামের আর কিছু হয় নাকি!" কাথাটা গায়ে দিয়ে চোখটা বুজল, এমন সময় দরজায় নক । আবির একটা বিরক্তিসূচক আওয়াজ করলো । তারপর উঠে দরজা খুলে দেখল, পরশ দাড়িয়ে । আবির বলল, "কিরে? তুই এইহানে ক্যান?" "দোস্ত, নিচে একা ঘুমামু! অন্য রুমগুলাতেও কেউ নাই, ভয় লাগতাছে?" আবির কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল পরশ আবারো জিজ্ঞেস করলো, "প্লিজ দোস্ত! যতদিন ওই ঘরের অন্য কোন রুমে আর কেউ না আসে ততদিন? প্লিজ?" আবির ফু গোছের একটা আওয়াজ করে বলল, "আচ্ছা, আয় ।" পরশ, "থ্যাংকস দোস্ত ।" বলে আবিরের গালে একটু চুমু খেয়ে ঢুকে গেলো আবির গাল মুছতে মুছতে বলল, "হ্যাট...! কি করলি এ!" দরজা লাগিয়ে দেখল, আবিরের কাথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়েছে আবির বলল, "ওই হারামি ওঠ! এডি আমার কাথা!" বলে কাথা নিয়ে দুজনের টানাটানি শুরু হয়ে গেলো ।