পরিচয় সিজন৩ (পর্ব-৪৫-৬৯)
পরিচয় (সিজন-৩)
জেদটা একটু বেশিই
(১)
কেটে গেলো ৭টা বছর । আশে পাশের সব কিছু পাল্টে গেলো । পাল্টে গেলো বস্তির পরিবেশ । সেখানে ইফাজের সহায়তায় তৈরি হল একটি ভাস্কর্য যেটা ছিল জয়নাল আর জামেনার । আর বস্তিবাসীর ঠাই হল রেস্টুরেন্টের পেছনে ইফাজের করে দেয়া অনেকগুলো টিনের বাড়িতে । বস্তিবাসীর জন্য নিজ খরচায় এর বাড়িগুলো বানিয়েছিল ইফাজ । ইচ্ছে ছিল বিল্ডিং করার কিন্তু সেটা বড়ই সময় সাপেক্ষ ব্যাপার । পুড়ে যাওয়া রেস্টুরেন্টটাও মেরামত করে আবার শুরু হল সব কার্যক্রম । রেস্টুরেন্টের নামটাও বদলে রাখা হয় জয়নাল জামেনা আলী রেস্টুরেন্ট । যেহেতু নামটা বেশি বড়, তাই সবাই ডাকে জেজেএ রেস্টুরেন্ট । রায়হানই এখন সেই রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করে । আর সেই সোহেলের ছোট ছেলে আবির, তার বয়স প্রায় ৯ । ইফাজের পরিবারে আসার পর বস্তির লোকজনদের সাথে ওর যোগাযোগ হয়না বললেই চলে । শুরুর দিকে মাঝে মাজে কলিমা আর রায়হান দেখা করতো । কিন্তু ধীরে ধীরে ভুলে যায় বললেই চলে । শুধু রেস্টুরেন্টের নামটা দেখলে হয়তো কিঞ্চিত মনে পড়ে, পরে আবার ভুলে যায় । তাছাড়াও এই কয়েক বছরের মধ্যে ইফাজের পরিবারে আগমন হয়েছে নতুন সদস্যের । ইফাজ আর পায়েলের ছেলে, দ্বীপ । দ্বীপের বয়সও প্রায় ৮ এর কাছাকাছি । আবিরটা একটু শান্তশিষ্ট হলেও দ্বীপ প্রচণ্ড চঞ্চল । এখন তো বাবা মায়ের সাথে থাকে, তাতেই দুষ্টুমিতে সেরা । না জানি বড় হয়ে কি হবে । আবির এ বাড়িতে আসার ইফাজ সেই যে একবার আবিরকে চেইন পড়িয়ে দিয়েছিলো, তারপর আর পড়ায়নি পায়েল । ছোট মানুষের গলায় এসব মেটাল না দেয়াটাই ভালো । জয়নাল আর জামেনা অশিক্ষিত গ্রামের মানুষ, তাই হয়তো এসব ওর গলায় পড়িয়ে দিতো ।
সেদিন ছিল শুক্রবার । সাপ্তাহিক ছুটি । তাই আজ না আছে ইফাজের অফিস, না আছে আবির আর দ্বীপের স্কুল । কিন্তু ছুটি নেই পায়েলের । সে কাজ করেই যাচ্ছে । বাড়িতে এখন কাজের লোক তিনজন । কাশেম চাচা, গনি চাচা আর হালিমা চাচি । হালিমা চাচি তখন সবজি কাটছিল, আর পায়েল পরোটা বানাচ্ছিল । ইফাজ তখন ঘুম থেকে উঠে এলো । রান্নাঘরে এসে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পায়েলের চোখে চোখ রেখে বলল, “গুড মর্নিং ।” পায়েলের খানিকক্ষণের জন্য ইফাজের দিকে তাকিয়ে আবার রুটির দিকে তাকিয়ে বলল, “ওভাবে তাকিয়ে না, পাশে হালিমা চাচি আছেন । খারাপ বলবেন । হালিমা হালকা হেসে দিলো । কিছু বলল না । ইফাজ হালিমা চাচির হাসি দেখে বলল, “ঐযে দ্যাখো, হালিমা চাচি হাসছেন । আরে উনি জানেন সব । সেদিনই তো দেখলাম, গনি চাচা উনামে এভাবে জাপটে ধরলো ।” বলেই ইফাজ পায়েলকে জাপটে ধরল । বেচারি হালিমা চাচি লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসতে হাসতে চলে গেলো । পায়েল হালকা বিরক্ত হয়ে বলল, “ইশ! দেখছো না পরোটা বানাচ্ছি, ডিস্টার্ব কোরো না তো ।” ইফাজ পায়েলকে পেছন থেকে জাপটে ধরা অবস্থাতেই পায়েলের কাঁধে মাথা রেখে বলল, “ডিস্টার্ব কোথায় করছি, তোমাকে তো আমি আদর করছি ।” পায়েল হঠাৎ বলে উঠলো, “ঐ যে দ্যাখো আবির ।” ইফাজ দূরে সরে গেলো । যতই হোক, ছোট মানুষের সামনে তো আর এসব করা যায় না । পায়েল মুচকি হেসে উঠলো । ইফাজ যখন দেখল কেউই নেই, তখন বিরক্ত হয়ে বলল, “ঠিক হল না কিন্তু কাজটা ।” পায়েল তখন রান্নাঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল, আবির দাঁড়িয়ে । একটা নীল হাফপ্যান্ট আর সাদা টি শার্ট পড়ে । গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে আছে । একটু আগেও ছিল । মাত্রই বোধ হয় এলো এখানে । না হলে একটু আগে তো ওকে দেখতো । পায়েল ওর মুখ দেখে হাসি থামিয়ে দিলো । তারপর কাছে ডাকলো, কিন্তু এলো না । চলে গেলো । পায়েল ইফাজকে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে ওর?” ইফাজ জবাবে বলল, “জানি না, কাল রাতেও তো ঠিক ছিল । এক রাতে আবার কি হল?” পায়েল বলল, “বুঝেছি । দ্বীপ মনে হয় আবার কোন বদমাশি করেছে । যাও তো দেখে আসো গিয়ে ।” ইফাজ চলে এলো । পায়েলও পরোটা বানানোয় মনোনিবেশ করলো । । ইফাজ এলো দ্বীপ আর আবিরের ঘরে । ওরা একসাথেই থাকে । দুজনেই ছোট তো, আলাদা থাকলে ভয় পেতে পারে । ইফাজ রুমে যেয়ে দেখলো, আবির ঘরে নেই । আর দ্বীপ আয়নার সামনে বসে । মাথায় একটা কাপড় বেধে কি সব যেন বলছে আর অদ্ভুত মুখভঙ্গি করছে । হয়তো নিজেকে কোন এক চরিত্রের সাথে তুলনা করে অভিনয় করছে । ইফাজ বোঝার চেষ্টা করলো । দ্বীপ নিজেকে বাংলা নাটকের অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র কাবিলা ভেবে বারবার বলছে, “আমি কাবিলা, মোর মা নোয়াখাইল্লা ।” আরও নাটকে কাবিলা যেমন যেমন করে, সেরকম করছে । দেখে মুচকি হাসল ইফাজ । কিন্তু মাথার কাপড় দেয়ার মানেটা বুঝে উঠতে পারলো না । হয়তো ছেলে নিজেকে বড় ভাবার জন্য এরকমটা করছে । হঠাৎ-ই দ্বীপের মাথার কাপড়টার দিকে ভালো করে নজর দিতেই হাসিটা চলে গেলো ইফাজের । এটা সেই শার্টটা না? যেটা নতুন বছর উপলক্ষে আবিরকে কিনে দিয়েছিলো ইফাজ? শার্টটা পড়ে অনেক খুশি হয়েছিলো আবির । এতটাই খুশি হয়েছিলো, সে গোসল তাড়াতাড়ি সেরে বেরতো, কারণ ওর শার্ট পড়তে হবে । সেই শার্ট কেটে মাথায় বেঁধে কাবিলা সেজেছে দ্বীপ । ইফাজ এবারে বুঝলো আবিরের মন খারাপের মানেটা । ইফাজ ঘরে ঢুকে দ্বীপের পাশে বলে রাগটা কোনোরকমে চেপে বলল, “এই শার্টটা ছিঁড়েছিস কেন দ্বীপ?” ইফাজ ছোট ছেলেমেয়েদের সামনে কখনো রাগ দেখায় না । এটা ওর পছন্দ না । দ্বীপ তখন জোড় গলায় বলল, “বেশ করেছি । তুমি ভাইয়াকে আমার থেকে ভালো জামা দিয়েছ ।” ইফাজ বলল, “কোথায় ভালো জামা, দুজনের টা তো একই শার্ট ।” দ্বীপ আবার জোড় গলায় বলল, “না, ভাইয়ার শার্ট আমার শার্টের চেয়ে বড় ।” ইফাজ ফু গোছের একটা আওয়াজ করে বলল, “তোর ভাইয়া তোর চেয়ে বড়, তাই তো তোর ভাইয়াকে বড় শার্ট দিয়েছি, আর তুই এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে রাগ করেছিস?” ইফাজ বলল, “কোথায়? কোন চিপসে আনার সময় তো ভাইয়াকে বড় চিপসের প্যাকেট দাও না, তখন তো সমান-ই দাও, তাহলে শার্টের বেলায় এমন কেন?” ইফাজ কিছু বুঝতে পারছে না কি বলবে । বেশ বুঝেছে, ছেলে ওর মতোই হয়েছে । কোন ব্যাপার ভালো মতো না বুঝে শুধু শুধু রাগ করে । ইফাজ শুধু একটা কথাই বলল, “বড় হলে সব বুঝবি ।” বলেই চলে এলো । দ্বীপ নিজের মতো আবার শুরু করলো, “আর ঘরে হানি শেষ হই গেছে…………।” ইফাজ ছাদে চলে গেলো । এ তো আর প্রথমবার নয়, এর আগেও অনেকবার দ্বীপ আর আবিরের মনোমালিন্য হয়েছে । আর তখন আবির ছাদে যেয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে । আজও তার ব্যাতিক্রম হল না । সেখানেই দাঁড়িয়ে চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আবির । ইফাজ ধীরে ধীরে যেয়ে আবিরের পাশে যেয়ে দাঁড়ালো । ছেলেটা অনেক ফর্সা হয়েছে । ঠিক সোহেলের মতো । কিন্তু মোটেও জয়নাল কিংবা জামেনার মতো না । ব্যাপারটা মাঝে মাঝে ভাবায় ইফাজ আর পায়েলকে । আবির যে ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, ইফাজও সেই ভঙ্গিতে দাঁড়ালো । ছাদের রেলিঙের ওপর হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে । পাশে ইফাজের উপস্থিতি টের পেয়ে আবির ইফাজের দিকে তাকালো । ইফাজও আবিরের দিকে তাকালো । আবির রেলিং থেকে একটু সরে দাঁড়ালো । ইফাজও রেলিং থেকে সরে দাঁড়ালো । আবির এবার কেদে দিলো । কিন্তু ইফাজ কাদল না । সে হাঁটু গেড়ে বসে আবিরকে বুকে জড়িয়ে বলতে লাগলো, “কিছু হয় নি বাবা, কাদে না, আমি আছি না, কাদে না ।” কিছুক্ষণ পর আবির ইফাজের দিকে তাকালো । ইফাজ আবিরের চোখ মুছে দিলো । তারপর জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে? কাদছিস কেন?” আবির কিছু বলল না । মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল । ইফাজ ওকে চুপ থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “দ্বীপ তোর প্রিয় শার্টটা ছিঁড়ে ফেলেছে না?” আবির তখন ইফাজের দিকে তাকালো । তারপর বলল, “তুমি কিভাবে জানলে?” ইফাজ হালকা হেসে বলল, “বাবারা সব জানতে পারে । এবার শুনিতো, আমার ছেলেটা কাদছে কেন?” আবির আবার চুপ । ইফাজ তখন বলল, “বাবার দেয়া শার্ট ছিঁড়েছে সেজন্য?” আবির উপর নিচে মাথা নাড়াল । ইফাজ ওকে আবার বুকে জড়িয়ে বলল, “আচ্ছা, বাবা কি আবিরকে একটা শার্ট কিনে দিয়েছে?” আবির হালকা করে বলল, “না ।” ইফাজ তখন বলল, “তাহলে একটা শার্টের জন্য এতো কান্না করার কি হয়েছে?” ইফাজ বাবার বুক থেকে সরে এসে বলল, “তাহলে কেন দ্বীপ আমার জামাটা ছিড়লো?” ইফাজ বলল, “আচ্ছা, তুই যেন কোন ক্লাসে?” আবির বলল, “তুমি তো জানোই ।” ইফাজ আবিরের গালে হাত রেখে বলল, “তোর মুখ থেকে শুনতে চাই ।” আবির বলল, “ক্লাস থ্রি ।” ইফাজ বলল, “হুম । এবার দ্বীপ কোন ক্লাসে পড়ে বলতো?” আবির আবারও হয়তো কিছু বলতে গিয়েছিলো, বলার আগেই ইফাজ বলল, “আমি বলেছি তো, তোর মুখ থেকে শুনতে চাই ।” আবির একটা শ্বাস ফেলে বলল, “ক্লাস টু ।” ইফাজ তখন বলল, “তাহলে দ্বীপ তোর থেকে ছোট না? ও একটু বেশি দুষ্টুমি করবে, এটাই তো স্বাভাবিক, আর তোর ওকে বড় ভাই হিসেবে শাসন করতে হবে, এটাই তো বাস্তবতা, তাই না?” ইফাজ কিছু বলল না । কিছুক্ষণ মাথা এমনভাবে নিচু করলো, মনে হল ইফাজের কথায় ওর সম্মতি আছে । খানিক বাদেই আবার আবির জিজ্ঞেস করলো, “একটা কথা জিজ্ঞেস করবো বাবা?” ইফাজ হাসিমুখে বলল, “একটা কেন, তোর যতো খুশি তত বল ।” আবির জিজ্ঞেস করলো, “ছেলে মেয়েরা নাকি দেখতে মা বাবার মতো হয় । দ্বীপ কে দেখতে মায়ের মতন লাগে, কিন্তু আমাকে দেখতে, তুমি বা মা কারো মতন লাগে না । কেন?” ইফাজ হালকা বিরক্ত হল দ্বীপের ওপর । ভাবল, দ্বীপ-ই বোধ হয় এসব বলেছে । তারপর ইফাজ বলল, “দ্বীপ না, আসলেই খুব দুস্টু হয়েছে । দাঁড়াও, ওকে আমি আজ বকে দেবো ।” আবির ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বলল, “না, আমার কলেজের টিচার সেদিন প্যারেন্টস মিটিং-এর পর বলেছিল । ইফাজ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল । কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না । নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আর কি বলেছে ম্যাডাম?” আবির মুখ গোমড়া করে বলল, “প্রথমে জিজ্ঞেস করেছিলো তোমরা আমাকে দত্তক নিয়েছ নাকি, আমি আসলেই তোমাদের সন্তান কি না । আমি যখন না বললাম, তখন ম্যাডাম আমাকে বলে বাবা মায়ের সাথে আমার চেহারার কোন মিল নেই তাই জিজ্ঞেস করেছেন ।” ইফাজ বাক্যহীন হয়ে গেলো । মানুষ এরকম অদ্ভুত কেন? কাকে কি জিজ্ঞেস করতে হয় এটাও কি বোঝে না? আসলে আমাদের সমাজে এরকম কিছু কমনসেন্সলেস মানুষ আছে, যাদের জন্য আমাদের এই সমাজের পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে । ইফাজ আর কিছুই বলতে পারলো না । আবিরও সেভাবে কিছু জিজ্ঞেস করলো না । ইফাজ উঠে দাঁড়িয়ে যেতে যেতে বলল, “নাস্তা খেতে চল ।” ইফাজকে যেতে দেখে আবির বলল, “জবাবটা দেবে না?” ইফাজ দাঁড়িয়ে গেলো । আবারও ইফাজের কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, “হলুদ আর আর নীল একসাথে হয়ে হালকা নীল রঙে পরিণত হয় । কখনো কি দেখেছিস, হলুদ আর নীল একসাথে হয়ে হলুদ বা নীল দুটোই হয়?” আবির ডানে বামে মাথা নাড়ল । ইফাজ তখন বলল, “সে জন্যই তুই তোর মা কিংবা বাবা কারো মতোই হস নি ।” আবির আবার প্রশ্ন করলো, “তাহলে দ্বীপ কেন মায়ের মতো দেখতে হয়েছে?” ইফাজ তখন বলল, “মানুষের ক্ষেত্রে এটাই সবসময় হয়, ছেলে মেয়ে দেখতে মা কিংবা বাবার মতো হয় । কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঐ রঙের মতো ব্যাতিক্রমও হয় । বুঝলি?” আবির কিছু বুঝল না । কিন্তু গোমড়া মুখটা আর গোমড়া রইল না । স্বাভাবিক হয়ে গেলো ।” ইফাজ আবার একটু হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চল যাই, দেরি করলে তোর মা আমাকে ঝাঁটা পেটা করবে ।” এতক্ষণে আবিরের মুখে হালকা হাসি দেখা গেলো । বাবার হাত ধরে ঘরে ফিরে এলো । এসে দেখল, টেবিলে পরোটা আর সবজি সাজানো আছে । চেয়ারে বসে খাচ্ছেন গনি চাচা, কাশেম চাচা আর হালিমা চাচি, আর দ্বীপ । ইফাজ আর আবিরও যেয়ে বসলো । গনি চাচা বলল, “ইফাজ বাবা, একখান ঝাড়ু কেনা লাগত, আগেরটা দিয়া ঠিক মতো ঝাড়ু দেয়া যায় না ।” ইফাজ হালকা হেসে বলল, “হইছে, খাওয়ার সময়ও কাজের কথা । খেয়ে নিন তারপর কথা ।” ইফাজের পরিবারটা আসলেই ব্যাতিক্রম । ওরা বাড়ির কাজের লোককেও ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে তাদের নিয়ে একসাথে খায় । তারাও যে মানুষ, এ কথা ভুলে যায় না । কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ তো রাস্তায় হালকা হাঁটার সময় এদের সাথে একটু ধাক্কা লাগলেই ছি ছি করে ওঠে । ওরা বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষদের চেয়েও নিচু প্রজাতির । যদিও এটাও সত্য, সব গরীব মানুষও আজকালকার যুগে গনি চাচা , হালিমা চাচি কিংবা কাশেম চাচার মতো ভালো ও সৎ মনের হয় না । এই যুগে যেন সবখানেই বাধা । ভালো করতে গেলেও, ভালো হতে গেলেও । যাই হোক । খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই যে যার কাজে চলে গেলো । সবার খাওয়া থেকে গেলো শুধু ইফাজ । সবার খাওয়া শেষে খেতে বসলো, পায়েল । ইফাজ বলল, “তোমার সাথে কথা আছে ।” পায়েল পরোটা চিবোতে চিবোতে বলল, “বলো ।” ইফাজ বলল, “আমাদের বোধ হয় এই এলাকায় থাকা আর উচিত হবে না । ভাবছি অন্য এলাকায় চলে যাব ।” পায়েল আরেকটা রুটির টুকরোয় ভাজি নিয়ে কেবলই মুখে তুলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় ইফাজের কথা শুনে থেমে গেলো । কিছুক্ষণ ইফাজের ইফাজের দিকে তাকালো । তারপর সেটা মুখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “হঠাৎ এই অদ্ভুত সিদ্ধান্ত?” ইফাজ বলল, “আসলে, এই এলাকার বেশিরভাগ লোকজনই জানে যে আবির আমার আর তোমার সন্তান না । তাই আমি অন্য এলাকায় যেতে চাচ্ছি । তাছাড়া একটা ঘটনা ঘটেছে ।” পায়েল এক গ্লাস পানি খেয়ে বলল, “কি ঘটেছে?” ইফাজ আবার বলা শুরু করলো, “প্যারেন্টস মিটিং এর দিন ওর স্কুলের টিচার ওকে জিজ্ঞেস করেছে ও আসলেই আমাদের সন্তান কি না । আবার এও জিজ্ঞেস করেছে, আমাদের কারো সাথে আবিরের চেহারার কোন মিল নেই তার কারণ কি ।” পায়েল নির্দ্বিধায় খেয়ে যাচ্ছে । যেন সবটা স্বাভাবিক । ইফাজ যা বলছে তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই পায়েলের । ইফাজ বলল, “তুমি তো দেখছি কিছুই বলছ না । কিছু তো বলো?” পায়েল উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “তুমি যেটা ভালো বোঝো করো । আমার কোন সমস্যা নেই ।” বলেই পায়েল চলে গেলো । ইফাজ হাতের কনুই টেবিলে রেখে দু হাত একসাথে মুষ্টিবদ্ধ করে তার ওপর থুতনি ঠেকিয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল । কি যেন ভাবছে । কি ভাবছে তা নিয়ে তা সে নিজেও জানে কি না সন্দেহ । এমন সময় হঠাৎ পেছন থেকে এসে ইফাজের পাশে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে বাবা বলে ডেকে উঠলো দ্বীপ । দ্বীপের ডাক শুনে চিনতা ভাবনা থেকে ফিরে এলো ইফাজ । সেও হালকা হেসে দ্বীপের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো । দ্বীপ বাবার কোলে উঠে বসলো । ইফাজ জিজ্ঞেস করলো, “পড়াশুনা শেষ?” ইফাজ উপর নিচে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, আজকে আমি ৮এর নামতা মুখস্থ করেছি ।” ইফাজ বলল, “বাহ, খুব ভালো তো, বলতো একটু শুনি ।” দ্বীপ পুরোটা বলে দিলো । কিন্তু সেদিকে মন নেই ইফাজের । কি যে ভাবছে, তা ওর অজানা । দ্বীপ নামতা বলে শেষ করেছে, তাও সে টের পেলো না । বলা শেষে ইফাজই বাবার হাত ধরে ডেকে বলল, “বললাম তো বাবা ।” ইফাজ আবার কল্পনা থেকে ফিরে এলো । ইফাজ হালকা হেসে বলল, “বাহ, খুব সুন্দর ।” দ্বীপ জিজ্ঞেস করলো, “একটা সত্য কথা বলবে বাবা?” ইফাজ হুম ধরণের একটা আওয়াজ করে সম্মতি জানালো । দ্বীপ জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো? আমাকে না ভাইয়াকে?” ইফাজ ভ্রু কুঁচকে দ্বীপের দিকে তাকিয়ে বলল, “এসব কেমন কথা দ্বীপ, এভাবে বলতে হয় না । তোরা দুজনেই আমার ছেলে । তোদের দুজনকেই আমি অনেক ভালবাসি ।” দ্বীপ তখন বাবার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি ভাইয়া তোমার ছেলে তো?” কথাটা শুনে ইফাজ হালকা রেগে গেলো । দ্বীপকে কোলের উপর থেকে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো । নিজের রাগ কোনোক্রমে দমন করলো । তারপর বলল, “তোর কেন এরকম মনে হয়?” দ্বীপ বলল, “আমি বলিনি বাবা । গতকাল আমার একটা বন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করছিলো । বলছিল, ভাইয়ার সাথে তোমার আমার, মায়ের কোন মিল নেই । অন্তত কিছু না কিছু মিল তো থাকা উচিত ছিল ।” ইফাজ এবার সত্যি খুব চিন্তায় পড়ে গেলো । এভাবে তো পারা যায় না । অন্তত ছেলেটার জন্য এটা ভালো হবে না । এতদিন বাবা মায়ের সাথে থেকে যদি কেউ জানতে পারে, তারা ওর আসল বাবা মা নয়, তখন কত বড় একটা আঘাত লাগে, সেটা যে পায় সে ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারে না । ইফাজ দ্বীপকে বলল, “যার তার কথায় কান দিতে নেই ।” বলেই সেখান থেকে চলে গেলো । দ্বীপ ছোট মানুষ, এসব ব্যাপার নিয়ে সেরকম কিছু সে বোঝেও না । সে নিশ্চিন্ত মনে নিজের ঘরে চলে গেলো । ইফাজ নিজের ঘরে যেয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো । খুব চিন্তায় পড়ে গেলো । কিন্তু কি করারই আছে এখন । করতে গেলে একটাই কাজ করা যায় এখান থেকে অন্য কোথাও যেয়ে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকা যায় । এমন সময় হঠাৎ রান্নার ফাঁকে পায়েল এসে বসলো ইফাজের পাশে বসলো । ইফাজের কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুমি কি অন্য এলাকায় যাবার কথা বলছিলে?” ইফাজ অল্পক্ষণের জন্য পায়েলের দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে নিলো । পায়েল বুঝল, ইফাজ রাগ করেছে । তখন কথা না শোনার জন্য । পায়েল ইফাজের হাতের ওপর হাত রেখে বলল, “আচ্ছা সরি, তখন আমি ভাবছিলাম আজ কি রান্না করবো, তাই তোমার কথায় সেভাবে মন দিতে পারিনি ।” ইফাজ হাতটা সরিয়ে নিলো । পায়েল আর কিছু বলল না । কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল । ইফাজের মাথায় তখন একটা চিন্তা খেলা করে গেলো । পায়েলের ওপর রাগ করে কি লাভ, এতে আবিরের কোন ভালোই হবে না, তার চেয়ে অভিমান ভাঙ্গিয়ে পরামর্শ করাটাই যথার্থ হবে । ইফাজ তখন পায়েলের দিকে তাকিয়ে বলল, “তখন আবিরের ব্যাপারে কি বলেছি সেটা শুনেছিলে?” পায়েল ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বলল, “শেষ বাসা পাল্টানোর কথা ছাড়া আর তেমন কিছুই শুনিনি ।” ইফাজ একটু নড়ে পায়েলের দিকে ঘুরে বসলো । তারপর বলল, “শোনো, আবিরের ক্লাসের টিচার, দ্বীপের বন্ধুসহ আরও অনেকে বলাবলি করছে আবির কেন আমাদের মতো দেখতে না । আবির তো এখন এসব ব্যাপারে তেমন কিছুই জানে না । কিন্তু যদি ভবিষ্যতে কিছু সন্দেহ করে, তখন সত্যিটা জানতে পারলে ছেলেটা কতটা কষ্ট পাবে ভেবেছো?” “তুমি আজ এই ব্যাপার নিয়ে ভাবছো?” চাপা গলায় জবাব দিলো পায়েল । ইফাজ প্রশ্ন করলো, “মানে?” পায়েল জবাবে বলল, “শোনো, ওরাই যে এর মুখোমুখি হয়েছে তা কিন্তু নয়, আমিও এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি অনেকবার । কিন্তু আমি সবাইকে এটাই বলি, সব সময় যে একইরকম চেহারার হতে হবে তা তো আর না ।” ইফাজ হালকা মেজাজ দেখিয়ে বলল, “কিন্তু এই ব্যাপারটা তো কমই ঘটে, হাজারে প্রায় ২ জনের এরকম হতে পারে হয়তোবা ।” পায়েল বলল, “যদি তেমনই হয়, তাহলে আমাদের আবিরও সেই হাজারে ২ জনের একজন ।” ইফাজ ভ্রু কুঁচকে পায়েলের দিকে তাকালও । কৌতূহলী দৃষ্টিতে বলল, “তুমি কি বলছ আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ।” পায়েল বলল, “শেষ যেদিন তুমি ঐ জয়নাল নামের লোকটা আর তার স্ত্রীসহ অন্যান্যদের সাথে ছবি তুলেছিলে, সেই ছবিটা আমি সেদিন দেখছিলাম । অদ্ভুত হলেও সত্য, জয়নাল কিংবা তার স্ত্রীর সাথে আবিরের কোনোরূপ মিল নেই । এমনকি একটু অতিরিক্ত অমিলও আমি লক্ষ্য করেছি । জয়নাল আর তার স্ত্রী কিন্তু মোটামুটি শ্যামলা কিন্তু আবির অনেক ফর্সা, এমনকি আমাদের চেয়েও ফর্সা ।” ইফাজ হালকা চমকে উঠলো । সত্যি তো, ব্যাপারটা তো আগে খেয়াল করে নি, আবির একটু অতিরিক্তই ফর্সা । পায়েল নিজের মতো বলে গেলো, “স্যার গ্রেগোর জোহান মেন্ডেলের সূত্রানুসারে শ্যামলা শ্যামলা মিলে কিন্তু শ্যামলাই হবার কথা ছিল, কিন্তু তা হয়নি ।” ইফাজও হালকা হেসে উঠলো, এর মধ্যেও বায়োলজি । ইফাজ বলল, “বায়োলজিই যখন টেনে আনলে, তখন আমিও একটা কথা বলি । হতে পারে আবিরের দাদা ছিলেন ফর্সা আর দাদি ছিলেন কালো । যার জন্য হয়তো জয়নাল হয়েছে শ্যামলা । আর আবিরের দাদার ফর্সা জীন টা হয়তো জয়নালের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল যা আবিরের মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে । হতে পারে না?” পায়েল হালকা হেসে বলল, “তাহলে মানুষকে তুমি বলতে পারবে না, আবির ওর বাবা মা কারো মতো হয় নি, হয়েছে ওর দাদার মতো ।” ইফাজ খুশিতে হেসেই দিলো । পায়েলের প্রশংসা করে বলল, “সত্যি, তুমি তো দেখছি বায়োলজি সাবজেক্টটা বেশ ভালো করেই পড়েছো । আমার তো বিচ্ছিরী লাগতো । ছ্যাঃ, কি সব তেলাপোকা টিকটিকি সবকিছুর নাড়ীভুঁড়ি দেখা লাগতো । তার চেয়ে বাবার চাকরিটায় বেশ আছি ।” পায়েল কিছু বলল না । হাসিমুখে চুপ করে রইল । খানিক বাদে হাসিমুখটা বিলিন হয়ে গেলো । পায়েল বলে উঠলো, “যতো যা-ই বলি, সত্যি তো এটাই আবির আমাদের ছেলে না ।” ইফাজ উপর নিচ মাথা নেরে হুম বলে উঠলো । ঠিক তখনি ঘরের দরজার দিকে তাকাতেই পায়েল খেয়াল করলো, সেখান থেকে কেউ একজন দৌড়ে অন্য দিকে চলে গেলো । এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছিল । কিন্তু কে হতে পারে? আবির না দ্বীপ? পায়েল “কে?” বলে উঠে দাঁড়ালো । ইফাজও উঠে দাঁড়ালো । দ্বীপ হলে তাও বোঝানো যাবে কিছু একটা বলে কিন্তু আবির হলে? ইফাজ দৌড়ে গেলো দরজার কাছে । আশেপাশে কেউ নেই । যদি আবির হয়, তাহলে নিশ্চয় ছাদে গিয়েছে । ইফাজ তাড়াতাড়ি করে ছাদে গেলো । দেখল, আবির সেই কোণায় দাঁড়িয়ে বার বার রেলিং-এর অপর উঠার চেষ্টা করছে । ইফাজ দৌড়ে যেয়ে আবিরকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেদে ফেলল । তারপর জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলতে লাগলো, “কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু হবে না, আমি তোর সাথে আছে, ভয় পাস না বাবা, কিচ্ছু হবে না………।” আবির অবাক হয়ে ইফাজের দিকে তাকালো । তারপর জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে বাবা? তুমি কাঁদছ কেন?” ইফাজ আবিরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল । তারপ ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলো, “তুই, ঐ রেলিঙের ওপর উঠছিলি কেন?” আবির অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আমি কেন রেলিঙের ওপর উঠতে যাব?” ইফাজ হালকা চমকে গেলো । হতে পারে আবির কিছু শোনে নি । চোখের জল মুছে জিজ্ঞেস করলো, “তাহলে তুই ওদিকে কি করছিলি?” আবির জবাবে বলল, “নিচে দুধ বিক্রেতা এসেছে, তাই আমি উঁকি দিয়ে দেখবার চেষ্টা করছিলাম, উনার দুধের পাত্রে কতটা দুধ আনে । জানো বাবা, আমি শুনেছি, এরা নাকি দুধে জল মিশিয়ে ঘনত্ব কমিয়ে মানুষকে ঠকায় ।” ইফাজ কিছুক্ষণ চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল । কিছু বলল না । আবির ইফাজকে জড়িয়ে ধরল । কিছুক্ষণ পর আবির আস্তে আস্তে বলল, আচ্ছা বাবা, দুনিয়ার কিছু মানুষ এতো খারাপ কেন? ওরা কেন শুধু নিজের ভালটাই বোঝে?” আবির কোন জবাব দিলো না । কি-ই বা জবাব দেবে? আসলেই তো দুনিয়ার মানুষ এতো খারাপ ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে ছেলেটা । টিভির হেডলাইনে কিংবা খবরের কাগজের কলামে প্রতিদিনই কোন না কোন খুনের খবর লেখা থাকে । সেসব খুন আপনজনও মানে না । এমন বাবা নিজের ছেলেকে কিংবা মা নিজের ছেলেকেও………। ছিঃ! কতটা নিচ হয়ে গেছে মানুষ । অবশ্য এটা আমরা বুঝে কি লাভ যদি যারা না বোঝার তারাই না বোঝে । ইফাজ যখন ছাদে আসে আবিরের খোঁজে, ঠিক তখন পায়েলেও যায় দ্বীপের খোঁজে । দ্বীপের ঘরে যেয়ে পায়েল দেখল, দ্বীপ জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে । মনে হচ্ছে দৌড়ে হাফিয়ে গেছে । পায়েল দ্বীপের কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুই হাফাচ্ছিস কেন?” দ্বীপ হালকা চমকে উঠলো । মাকে ঘরে প্রবেশ করতে খেয়াল করে নি দ্বীপ । দ্বীপ কিছুক্ষণ পায়েলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, “আবির ভাইয়া আমার আসল ভাই না?” পায়েল দ্বীপের বিছানায় বসে পড়লো । ওর আরেকটু সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত ছিল কিন্তু এখন কি করবে, পরিস্থিতি সামলানো উচিত, কিছুক্ষণ ভেবে পায়েল জবাব দিলো, “আচ্ছা দ্বীপ, তুই ব্যাচেলর পয়েন্ট এর কাবিলার অভিনয় করিস না মাঝে মাঝে, আয়নার সামনে বসে?” দ্বীপ উপর নিচ মাথা নাড়াল । পায়েল বলল, “আমি আর তোর বাবাও সেরকমই কোন একটা নাটকের চরিত্রের অভিনয় করছিলাম ।” এতক্ষণে দ্বীপের মুখ থেকে সন্দেহের ছাপ চলে গেলো । হাসিমুখে বলল, “ও, তাই বলো । কোন নাটকের কোন চরিত্রের অভিনয় করছিলে?” পায়েল বলল, “উমম…… ঠিক নাটক না, একটা সিনেমার । তুই চিনবে না । আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন দেখতাম ।” দ্বীপ মায়ের পাশে এসে বসে বলল, “শোনাও না আমাকে কাহিনীটা ।” তখন আবিরকে নিয়ে দ্বীপের ঘরে এলো ইফাজ । আবির প্রশ্ন করলো, “কিসের কাহিনী বলছ মা?” দ্বীপ আবিরকে ডেকে বলল, “শুনে যাও ভাইয়া, মা একটা সিনেমার কাহিনী শোনাবে ।” আবির যেয়ে পায়েলের অন্য পাশে বসে পড়লো । তারপর পায়েল শুরু করলো একটা গল্প । কোন সিনেমার গল্প, বানানো গল্প । এখনই যা মনে আসছে, তাই বলে দিচ্ছে । কিন্তু বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছে আবির আর দ্বীপ । ইফাজও দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলো সেই গল্প আর মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো পায়েল আর ওর দুপাশে আবির আর দ্বীপ কে । এ এক অন্যরকম ভালো লাগার অনুভুতি । সেদিন দুপুরের কথা । খাওয়া দাওয়া শেষে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো ইফাজ । পেটটা হাতিয়ে একটা ঢেকোর তুলে বলল, “আজ একটু বেশি খাওয়া হয়ে গেছে ।” আয়নার সামনে বসে নিজের চেহারা দেখছিল পায়েল । হুম ছাড়া আর কোন কথা বলল না । ইফাজ পায়েলের দিকে ঘুরে পায়েলের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমায় দারুন লাগছে দেখতে ।” পায়েল হালকা হেসে বলল, “হুম, যা খেয়েছ, সব হাওয়া হিসেবে আমাকে একটু তেলিয়ে দিলে আরকি ।” ইফাজ বলল, “আরে ধুর, কি যে বলো না । তোমায় আমি তেল দিতে যাব কেন?” পায়েল আয়নার মধ্যে ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি এমনিতেও সুন্দর লাগে । না লাগলেও আল্লাহর দেয়া চেহারা, আলহামদুলিল্লাহ্ আমার কাছে সুন্দর ।” ইফাজ হালকা হাসল । খানিক থেমে বলল, “তুমি অনেক পাল্টে গেছো । আগে এতোটাও মুখে মুখে কথা বলতে না, আর অনেক শান্তশিষ্ট ছিলে ।” পায়েল ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “যার সাথে সংসার করছি, তার সাথে মিশলে যে কোন শান্তশিষ্ট মানুষেরই লেজবিশিষ্ট স্বভাব হয়ে যাবে ।” ইফাজ ইয়ার্কির সাথে বলল, “হুম, আর ভালবাসাটাও কমে যাবে ।” পায়েল ঘুরে ইফাজের দিকে তাকালো । হালকা বিরক্তি নিয়ে বলল, “এ কেমন কথা? আমি কি তোমাকে কম ভালবাসি নাকি?” ইফাজ হেসে বিছানায় লুটিয়ে পড়লো । কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে বলল, “আরে বাবা, আমিও তো মজাই করলাম ।” পায়েল আবার আয়নার দিকে মুখ ঘোরালো । ইফাজ হাসি থামাল । সোজা হয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে দু হাত মাথার নিচে রেখে শুয়ে শুয়ে উপরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে পায়েলকে জিজ্ঞেস করলো, “দ্বীপ কোথায় গেছে?” পায়েল একটা পাউডারের কৌটো হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বলল, “প্রাইভেটে ।” ইফাজ আবার প্রশ্ন করলো, “আর আবির?” “সেও প্রাইভেটে গেছে ।” জবাব পায়েলের । ইফাজ তখন বলল, “তোমার মনে আছে আমার প্রথম দিনের কথা?” পায়েল জানা সত্ত্বেও না জানার ভান করে বলল, “না তো, ভুলে গেছি । একটু মনে করিয়ে দাও তো ।” ইফাজ সেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “সেদিন বৃষ্টির সময় ছিল সম্ভবত । তখন তো আমি বাবার সাথে বলতাম না তেমন । কাশেম আঙ্কেলের সাথে এই বাড়িতেই থাকতাম । একদিন বিকেলে বাবার প্রতি কেন যেন খুব রাগ উঠেছিলো । আমি ভার্সিটি যাব মিথ্যে বলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলাম । বৃষ্টি তখনও শুরু হয় নি । আকাশ ছিল কালো মেঘে ঢাকা । আমি টেরও পাইনি । ছাতা ছাড়াই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলাম । ইসিবি চত্তরে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম । সম্ভবত সেদিন হরতালের জন্য বাস তেমন একটা চলছিল না । রাস্তার একপাশে একটা রিকশা হুড নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, কিন্তু রিকশাওয়ালা নেই । আর তেমন কোন যানবাহনও পাচ্ছিলাম না যাতে করে কোথাও যেতে পারবো । রাস্তায় লোকজনও তেমন একটা ছিল । যারা ছিল, তাদের মধ্যেই হয়তো তুমি ছিলে । হঠাৎ বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম । দূরে কোথাও বৃষ্টি পড়ছে । বুঝলাম, ধীরে ধীরে বৃষ্টি এদিকে আসছে । কিন্তু তখনও আমার মাথায় নেই, বৃষ্টিতে ভিজলে আবার সমস্যা । ঠিক তখনই খেয়াল করে দেখলাম, বৃষ্টি দৃষ্টির সিমানায় এসে পড়েছে কিন্তু এখনো আমার কাছে আসে নি । সবই ছুটোছুটি শুরু করে দিলো বৃষ্টির পানির হাত থেকে বাচবার জন্য । আমিও আর কোন যায়গা খুজে না পেয়ে দিলাম এক দৌড় সেই রিকশাটার দিকে । রিকশার হুডের নিচে ঢুকতেই তুমিও আমার সাথে একই রিকশায় উঠে পড়লে । তখনই তোমার সাথে প্রথম দেখা । কি রোমান্টিক ছিল তাই না?” পায়েল হালকা হেসে বলল, “রিকশাওয়ালার রিকশার হুডটা ফুটো ছিল। তাতে পানি পড়ে তুমি আমি দুজনেই ভিজে গিয়েছিলাম । আমি তোমাকে কত নামতে বললাম, তুমি নামলে না । তারপর বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করে শেষমেশ বৃষ্টি থামলে আমি রিকশা থেকে নেমে চলে যাই । আর তুমি বসে ছিলে রিকশাওয়ালার অপেক্ষায় । দুর্ভাগ্যবশত আমি আমার ভ্যানিটি ব্যাগটা রিকশায় রেখে চলে আসি ।” ইফাজ আবার বলতে লাগলো, “সেই ব্যাগ তোমায় দিতে গিয়ে পেয়ে গেলাম তোমার ঠিকানা । তোমার ওপর আমার কেমন এক ভালোলাগার সৃষ্টি হয় । সেই ভাললাগা থেকে প্রতিদিন তোমায় দেখতে যেতাম । শেষমেশ একদিন প্রপোজ করেই বসলাম । তারপর চাকরিটা হয়ে গেলে বিয়েটাও সেরে ফেললাম ।” পায়েল ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাহ, চমৎকার । তা, আজ হঠাৎ এসব কথা?” ইফাজ আবার পায়েলের দিকে ঘুরে পায়েলের চোখে চোখ রেখে বলল, “আর কয় তারিখ মনে আছে?” পায়েল একটু ভেবে বলল, “১৪ তারিখ তো?” ইফাজ কিছু বলার আগেই পায়েলের মনে পড়লো, আজ ভ্যালেন্টাইন ডে । পায়েল বলে উঠলো, “ও! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম! আজকে ফেসবুকেও ঢুকিনি । সরি সরি সরি!” ইফাজ হাসিমুখে পায়েলের চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল । সেদিন রাতের কথা । বই নিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ার টেবিলে বসে লেখাপড়া করছে আবির । খানিক দূরে বসে বসে মোবাইল চালাচ্ছে দ্বীপ । মোবাইলে কি যেন দেখছে আর লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । হঠাৎ সেই সময় ঘরে এলো পায়েল । দ্বীপ তাড়াতাড়ি করে ফোনটা বালিশের নিচে লুকাবার চেষ্টা করলো কিন্তু না । সে ব্যার্থ হল । হাত ফসকে ফোনটা পড়ে গেলো মেঝেতে । দ্বীপ খুব ভয় নিয়ে ফোনটা তুলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই পায়েল এসে ফোনটা হাতে নিলো । এখনো পর্যন্ত ফোনের স্ক্রিনের দিকে পায়েলের চোখ পড়ে নি, কিন্তু পায়েল খেয়াল করলো, দ্বীপ প্রচণ্ড ভয়ের সাথে একবার মায়ের দিকে একবার ফোনটার দিকে তাকাচ্ছে । বার বার ঢোক গেলার চেষ্টা করছে । সম্ভবত গলা শুকিয়ে আসছে । বুকের দ্রুত স্পন্দন স্পষ্ট লক্ষণীয় । খুব হাফাচ্ছে, চেহারায় ভয়ের ছাপ । আবিরও পড়া বাদ দিয়ে পেছনে ঘুরে দেখতে লাগলো ব্যাপার কি । পায়েল কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে দ্বীপের দিকে তাকিয়ে রইল । কি হয়েছে ওর? এতো ভয় পাচ্ছে কেন? সন্দেহ থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টায় ধীরে ধীরে চোখটা মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে ঘোরালো পায়েল । যা দেখল, তাতে তার সন্দেহ দূর করবার চেষ্টা সফল তো হলই, উলটো মনে প্রচণ্ড রাগ জমতে লাগলো । কেন? কিসের দোষে? কেন তার ছেলে এতো খারাপ হল? কার প্ররোচনায়? এসব প্রশ্ন মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগলো পায়েলের । দ্বীপ ইতোমধ্যে কেদে ফেলেছে । দ্বীপের কান্না শুনে ছুটে ঘরে ঢুকেই “কি হয়েছে বলে উঠলো ইফাজ । পায়েল পাশে দাঁড়িয়ে ইফাজ জানতে চাইলো, “কাদছে কেন ইফাজ?” পায়েল সব রাগ ভেতরে পুষে রেখে চোখ দিয়ে অনর্গল জল ফেলতে লাগলো । ইফাজ কিছু বতে পারলো না । এক ঝলক আবিরের দিকে তাকিয়ে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে কি হয়েছে ইশারায় জানতে চাইলো । আবির ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে কিছু জানে না ইশারায় বলল । ইফাজ কোমল গলায় পায়েলকে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে, আমায় একটু বলবে?” পায়েল কিছু না বলেই ডান হাত উচিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনটা তুলে ধরল ইফাজের চোখের সামনে । দেখল, যতটা ছোট হওয়া সম্ভব তার চেয়েও যেন একটু বেশিই ছোট জামা পড়া এক মডেল বিশ্রী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে । ইফাজ পাথরের মতো শক্ত হতে হতেও নিজেকে সামলে নিলো । পায়েলের হাত থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল, একটা বাজে ওয়েবসাইটে ঢুকে এসব আজে বাজে জিনিস দেখছিল দ্বীপ । ইফাজ অবাক দৃষ্টিতে দ্বীপের দিকে তাকালো । এটা আসলেই ওদেরই ছেলে তো? যেন বিশ্বাস হতে চায় । দ্বীপ সেই জোরে জোরে শব্দ করে কেঁদেই চলেছে । পায়েল কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে চলে এলো । ইফাজের চোখ দিয়েও হয়তো জল বেরোতে চাচ্ছিল, কিন্তু হাত দিয়ে চোখ রগড়ে আটকে দিলো । তারপর আবিরের কাছে যেয়ে বলল, “আবির, তুই একটু তোর মায়ের কাছে ।” আবির মাথা ডান দিকে কাত করে সম্মতি জানিয়ে মায়ের কাছে চলে গেলো । দ্বীপের কান্না তখন কিছুটা থেমেছে । ইফাজ দ্বীপের দুহাত ধরে বিছানার বসে দ্বীপকে ওর পাশে বসাল । ইফাজ দ্বীপের চোখের পানি মুছে বলল, “তুই ওসব কি দেখছিলি?” দ্বীপ কোন জবাব দিলো না । মাথা নিচু করে নিশ্চুপ হয়ে রইল । ইফাজ আবার প্রশ্ন করলো, “তুই জানিস না, এসব আজে বাজে জিনিস দেখলে আল্লাহ গুনাহ দেন? এসব জিনিস দেখা যে পাপ তোকে কি আমরা শেখাই নি?” দ্বীপ কোন জবাব দিলো না । কেবল লজ্জার সহিত উপর নিচে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো । ইফাজ জানতে চাইলো, “তাহলে তুই কেন ওসব দেখছিলি?” দ্বীপ আবারও নিশ্চুপ । ইয়াজ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “ভয় পাস না, আমায় বল, কেন দেখছিলি ওসব?” দ্বীপ ভাঙ্গা আর নিচু গলায় বলল, “আমি জানি না, কিন্তু আমার দেখতে অনেক ভালো লাগতো ।” ইফাজের বুকটা ধরাস করে উঠলো । ছেলেটা এভাবে নষ্ট হয়ে গেলো? না । এতো ছোট বয়সে ওর হাতে মোবাইল দেয়া উচিত হয় নি । আর ওদের আরও সচেতন হওয়া উচিত ছিল । ইফাজ দ্বীপকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “না বাবা, ওসব আর কক্ষনো দেখবি না । ওসব উচিত না বাবা । তুই ভালো ছেলে হয়ে থাকবি ।” দ্বীপ বাবার বুকের মধ্যেই মাথা উপর নিচ নাড়াল । চেহারার মধ্যেও অনুতপ্ততা প্রকাশ পায় । কিন্তু কে জানে, কতক্ষণ থাকবে । তবে একটা কথা মানতেই হবে, আধুনিকতার এই যুগে কিছু মানুষের অশ্লীলতা গ্রাস করে ফেলছে ছোট ছোট শিশুদের বাড়ন্ত মানসিকতাকে । অনেক পরিবারের মা বাবা এসব ব্যাপারে মোটেও সচেতন থাকেন না । রাত ১০টার দিকের কথা । দ্বীপের ব্যাপারটার কষ্টের রেশ সবার মধ্যে থেকে প্রায় চলে গেছে । নিজের রুমে ঘুমিয়ে পড়েছে দ্বীপ । আবির এখনও পড়ছে । নিজের ঘরে দেয়ালে হেলান দিয়ে ল্যাপটপটা হাতে নিয়ে অফিসের ডকুমেন্টস ঘাঁটাঘাঁটি করছিলো ইফাজ । পাশে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিল পায়েল । “ইফাজ?” ইফাজ ভেবেছে পায়েল হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে । হঠাৎ পায়েলের ডাক শুনে তাই একটু চমকে উঠলো । একবার পায়েলের দিকে তাকিয়ে আবার ল্যাপটপের দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, “বলো ।” পায়েল নিচু গলায় বলল, “মোবাইলটা কোথায় রেখেছ?” ইফাজ একটু অবাক হল । হঠাৎ এমন প্রশ্ন? তবুও জবাব দিলো, “আলমারিতে ।” পায়েল কিছুক্ষণ চুপ করে বলল, “মোবাইলটায় চাইল্ড সেফটি শিল্ড অন করে ওকে কাল দিয়ে এসো ।” ইফাজ ভ্রু কুঁচকে পায়েলের দিকে তাকালো । পায়েলের ইফাজের বিপরীতদিকে মুখ করে শুয়ে আছে । তাই ইফাজ ঠিক বুঝতে পারলো না পায়েল কি খুশি হয়ে কথাটা বলছে, নাকি কষ্টে কথাটা বলছে, নাকি রাগ নিয়ে কথাটা বলছে । ইফাজ আবারও ল্যাপটপের দিকে মনোযোগ দিলো । প্রশ্ন করলো, “কেন?” পায়েল এবার ইফাজের দিকে ঘুরে তাকালো । ইফাজের এক পলকের জন্য পায়েলের দিকে তাকালো । চেহারা দেখে মনে হচ্ছে মন থেকেই কথাটা বলছে পায়েল । পায়েল জবাব দিলো, “জানি তুমি অবাক হচ্ছো । কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, ও যে ফোনে অন্য কিছু করে না তা নয় । একটা ছোটোখাটো নেশায় জড়িয়ে পড়েছে ও । এখন হঠাৎ করেই যদি ওকে এই নেশা থেকে ছাড়াতে চাও, তাহলে ওকে তুমি ছাড়াতে পারবে না । উলটে আরও বাজে কিছুও হতে পারে । তাই বলছিলাম আর কি ।” ইফাজ সব কথা শুনেছে ঠিকই, কিন্তু এমন ভাব করলো যেন কিছুই শোনে নি । পায়েল জানে মাঝে মাঝেই ইফাজ এরকম করে । হেসে দিয়ে বলল, “লাভ নেই, আমি জানি তুমি শুনেছো ।” ইফাজও আর হাসি আটকে রাখতে পারলো না । পায়েলের দিকে একবার তাকিয়ে আবার ল্যাপটপে মন দিলো । এদিকে আবির পড়তে পড়তে কখন যে টেবিলে ঘুমিয়ে পড়েছে, টেরও পায় নি । ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত ১১টা বাজে । স্পষ্ট মনে আছে, ১০টার দিকেও জেগে ছিল । চোখদুটো রগড়ে একটা হাই তুলল । একবারটি পেছন ফিরে তাকালো । দেখলো, দ্বীপ ঘুমিয়ে পড়েছে । আবির বইটা বন্ধ করে টেবিল থেকে উঠে বিছানায় দ্বীপের পাশে শুয়ে পড়লো । আবির শুয়ে পড়ার খানিক বাদেই ইফাজ এসে দেখো গেলো, ছেলে দুটো ঘুমিয়েছে কিনা । দরজা দিয়ে দুজনকে ঘুমোতে দেখে হালকা হাসি ফুটে উঠলো । তারপর নিজের ঘরে যেয়ে আলমারিটা খুললো । মোবাইলটা উপরের তাকে রেখেছে । সেটা নিতে গিয়ে মোবাইলের সাথে আরও একটা দড়িতেও টান লেগে পড়ে গেলো একটা বাক্স এবং এর মধ্যে থাকা জিনিসপত্র । ইফাজ প্রথমে হালকা ভয় পেলো যেন পায়েলের ঘুম না ভাঙ্গে । নিঃশব্দে পেছনে ঘুরে পায়েলের দিকে তাকালো । পায়েল শুধু একটা নড়ে উঠলো । যাক, ঘুম ভাঙ্গে নি । ইফাজ একটা দম ফেলল । এরপর একে একে বক্সে সব জিনিস পত্র তুলতে লাগলো । এখানে সব পুরনো জিনিসপত্র । বেশিরভাগই আবির আর ইফাজের খেলনা । গাড়ি, বিমান, ফিশিং গেম আরও কত নি । এগুলো আর এখনকার বাচ্চারা খেলে না । ফোন থাকলে আর কি লাগে? ইফাজ সব বক্সে ভোরে বক্সটা আটকে আলমারিতে ঢুকিয়ে আলমারিটা আটকে দিলো । তখনই নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল, একটা গলার চেইন । একটু বিরক্ত হল । সম্ভবত এটা বক্সের নিচে ছিল যার জন্য খেয়াল করে নি । ইফাজ চেইনটা হাতে নিলো । ভালো করে দেখল, এটা আবিরের সেই চেইন । চেইনের সাথে থাকা লকেটটা হালকা খুলে গেছে । আজ পর্যন্ত কখনো খুলে দেখেনি এর মধ্যে কি আছে । আজ খুব দেখতে ইচ্ছে করছে । হয়তো জয়নাল আর জামেনার ছবি আছে, এরকম একটা প্রত্যাশা নিয়ে লকেটটা খুলল ইফাজ । কিন্তু না । এতে কোন ছবি নেই । আছে শুধু একটা মেমোরি কার্ড আর একটা কাগজ । কাগজে কিছু লেখা, কিন্তু কি লেখা প্রথম দেখাতে ঠিক বুঝতে পারলো না ইফাজ । আজব ব্যাপার? একটা লকেটে কেউ কাগজ বা মেমোরি কার্ড রাখে নাকি? ইফাজের হালকা সন্দেহ হল । ব্যাগ থেকে কার্ড রিডারটা বের করে আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসলো কি আছে দেখার জন্য । ল্যাপটপটা অন হল, এরপর কার্ড রিডারে মেমোরিকার্ডটা লাগিয়ে তা ল্যাপটপের সাথে সংযুক্ত করলো । না, মেমোরি কার্ড চলছে না । ড্যামেজ হয়ে গেছে । মাঝে মাঝে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ড্যামেজ মেমোরি কার্ড কিছু নিয়ম মেনে চললেই ঠিক হয়ে যায় । ইফাজও একবার সেই চেষ্টা করবার জন্য ইউটিউব-এ ঢুকে অনেক কিছু সার্চ দিয়ে অনেক চেষ্টা করলো কিন্তু সবটাই বিফলে গেলো । মনের ভেতর খুব বড় এক আগ্রহ জন্মেছে দেখার জন্য ভেতরে কি এমন আছে যা একটা ঐটুকু বাচ্চার গলায় চেইনের লকেটে ভরে দেয়া হয়েছে? আরেকটা জিনিস ছিস এক ছিল না? ইফাজ তখন টেবিলের ওপর ঐ কাগজের টুকরার দিকে তাকালও । খানিকক্ষণ দেখে ভাববার চেষ্টা করলো এতে কি লেখা আছে । ভাল করে লেখাটা কাছে নিলো । এতক্ষণ ওর নজর ছিল লেখার শেষটার দিকে, এবার চলে গেলো শুরুর দিকে, এবং সেটা দেখে বুঝতে বাকি রইল না, এটা গুগল ড্রাইভের লিঙ্ক । ইফাজ এটা দেখে চমকে একটু নড়ে বসলো । আফসোসে ইশ ধরণের একটা আওয়াজ করলো তারপর একটা ব্রাউজারে ঢুকে পুরো লেখাটা টাইপ করতে লাগলো । বেশ কষ্ট হল লিখতে, কিন্তু ওকে যে দেখতে হবে এতে কি রয়েছে । হয়তো মেমোরি কার্ডে জায়গা না থাকায় কিছুটা ড্রাইভে রেখেছে, অথবা মেমোরি কার্ডে যা ছিল, তাই ড্রাইভে রয়েছে । কিছুক্ষণ লোডিং হবার পর অবশেষে এলো সেই লিঙ্কের বস্তু । একটা অডিও । কি এমন অডিও যেটা এভাবে এতো যত্ন সহকারে রাখা হয়েছে? ইফাজ সেটা শোনবার জন্য প্লে বাটনটা ওপেন করতে যাচ্ছিলো, এমন সময় মনে পড়লো, পাশে পায়েল শুয়ে আছে । শব্দে ঘুম ভেঙে যেতে পারে । ল্যাপটপটা একপাশে রেখে উঠে যেয়ে ইয়ারফোনটা এনে জ্যাকটা লাগিয়ে ইয়ারফোন কানে দিয়ে প্লে বাটনে ক্লিক করলো । তারপর সে যা শুনলো, তা রীতিমতো অবাক করে দেবার মতো । সেই সে ডাক্তার জাশির আর হাসপাতালের মালিক সাখুরার সেই কথোপকথন । অদ্ভুত ব্যাপার? এগুলো কি বলছে এরা? ইচ্ছে করে বলছে? নাকি সত্যিই? এটা কি কোন নাটক? না, নাটক হলে সাউন্ড কোয়ালিটি আরও ভালো হবার কথা ছিল । তারপর আবার একটা নাটক একটা বাচ্চার গলায় এভাবে ঝুলিয়ে কি লাভ? কিছুই বুঝতে পারলো না ইফাজ । কিছুক্ষণ কিসের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিল । ভাবনা কেটে গেলে সব কিছু আবার গুছিয়ে রাখল । সেই মেমোরি কার্ড আর কাগজের টুকরো চেইনের লকেটে ভরে তা আটকে যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দিলো । ল্যাপটপটা অফ করে রেখে দিলো । বেশি রাত জেগে থাকা অনুচিত হবে । সকালে আবার অফিস আছে । সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবতে গিয়ে অফিস নষ্ট করলে আরেক বিপদ । তবে ব্যাপারটাকে একেবারে গুরুত্ব না দেয়াটাও অনুচিত হবে । ব্যাপারটা আরও ভালো করে খতিয়ে দেখা দরকার ।
(২)
পরদিন দুপুরে ইফাজ অফিস শেষে চলে এলো বস্তিতে । শুরুতে অবশ্য রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলো, সেখানে রায়হানের সাথে দেখা । জয়নালের চলে যাবার পর রায়হান বেশ ভালোই চালাচ্ছে রেস্টুরেন্টটা । মাঝে মাঝে অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা করে । যেন লোকজন ওর এসব হাস্যকর কাণ্ডকারখানা দেখতেই আসে । ইফাজ রায়হানকে এ ব্যাপারে কিছু বলল না । বলতে চেয়েছিল রায়হানের বাবা রাজিবের সাথে, কিন্তু তিনি তখন দোকানে ছিলেন না । খাওয়ার জন্য বাসায় গিয়েছিলেন । তাই জন্যই ইফাজ এলো বস্তিতে । রায়হানরা যে ঘরটায় থাকে, সেখানে ঢুকতে যাবে তখনই বেড়িয়ে এলো কলিমা । ইফাজকে দেখেই কলিমা হাসিমুখে বলল, “আরে ইফাজ আঙ্কেল আপনে? আহেন, ভেতরে আহেন ।” ইফাজ ভেতরে এলো । ঘরে ছোট একটা চারপায়া, একপাশে টেবিল । টিনের দেয়ালে অনেক কাপড়চোপড় ঝুলে আছে । মেঝের কোনাতে পাটি গুটিয়ে রাখা । হয়তো রাতে ঘুমানোর সময় দুজন উপরে ঘুমায়, দুজন পাটি পেতে নিচে ঘুমায় । ইফাজ কে কলিমা বিছানায় বসতে বলল । ইফাজ জিজ্ঞেস করলো, “তোমার মা বাবা কোথায়?” “আম্মা তো রান্নাঘরে, কি জানি রান্না করতাছে । আর আব্বায় এতক্ষণ খাইতেছিল, আপনে আসার এই একটু আগেই বাইর হইয়া হাত ধুইতে গেলো । আর ভাইয়া তো দোকানেই কাম কাজ করতাছে ।” ইফাজ বলল, “হ্যাঁ, ওর সাথে দেখা হয়েছিলো ।” “ও, তাইলে তো ভালোই হইছে । আপনে একটু বসেন, আমি আপনার জন্য একটু নাস্তার ব্যাবস্থা করি ।” “না না, কষ্ট করা লাগবে না । আমি একটু পরেই চলে যাব ।” ভদ্রতাস্বরূপ বাধা দিলো ইফাজ । কলিমা তাও যেতে যেতে বলল, “তা কইলে চলবো না, আপনে আমাগো কত উপকার করছেন ।” বলেই নাস্তা আনতে বেড়িয়ে গেলো কলিমা । ইফাজ সেকেন্ড দশেক অপেক্ষা করতেই ঘরে এলো রাজিব । বাইরে কলিমাই ওকে পাঠিয়ে দিলো তাড়াতাড়ি যাবার জন্য । ইফাজ রাজিবকে ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম জানালো । রাজিব সালামের জবাব দিয়ে বলল, “বসেন বসেন, দাঁড়ায় আছেন ক্যান?” ইফাজ বসলো । “আমি একটু খাওয়া শেষ কইরা গেছিলাম তো, তাই দেরি হইয়া গেলো ।” মেঝেতে পাটি বিছাতে বিছাতে কথাগুলো বলছিল রাজিব । এরপর পাটি বিছানো হয়ে গেলে মেঝে বাবু হয়ে বসে পড়লো রাজিব । ইফাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, “একি, আপনি নিচে বসলেন কেন?” রাজিব বলল, কি যে কও বাবা, বাড়িত আর বসার যায়গা কই?” ইফাজ বলল, “এইতো, খাটের ওপরেই তো কত যায়গা ।” রাজিব একটু ভেবে নিচু ও কোমল গলায় হেসে হেসে বলল, “আপনে বড় মানুষ, আপনার পাশে আমাকে কি মানায়?” “মানে কি? এসব বড় ছোট আমি মানি না । আর বয়সে আপনি আমার চেয়ে অনেক বড়, তাই প্লিজ, আমাকে এভাবে লজ্জা দেবেন না । ওপরে আসুন ।” হালকা রাগ দেখিয়ে কথাটা বলল ইফাজ । রাজিব ইতস্তত করে বলল, “না বাবা কি যে বলো, আমি কি……” রাজিবের কথা শেষ করতে না দিয়েই ইফাজ বলল, “না, আপনি উপরে আসুন । নাহলে আমি কিন্তু নিচে নেমে যাব । ব্যাস, নাছোড়বান্দা ইফাজের কথাই শেষমেশ মেনে নিতে হলো রাজিবকে । রাজিব ধীরে ধীরে উঠে বসলো । ইফাজের থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে । ইফাজ তখন বলল, “যে কথা বলবার জন্য এসেছিলাম, আপনি জয়নাল আর জামেনাকে কবে থেকে চেনেন?” রাজিব বলল, “সে তো আমি ঐ এলাকায় যখন গেছিলাম, তখন বেশিদিন হয় নাই অগোরে বিয়া হইছে । ওরাই অনেক মিশুক ছিল, তাই আমার আর সালাম লগে পরিচিত হইছিল । তখন থেইকাই চিনি । ইফাজ “ও” বলতে বলতে মাথা উপরে নিচে নামাল । কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইফাজ আবারও জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, আবির কি ওদের আসল সন্তান?” রাজিব অবাক দৃষ্টিতে তাকালো ইফাজের দিকে । মাথা চুলকে বলল, “এইডা আবার কেমন প্রশ্ন?” ইফাজ হালকা হেসে বলল, “না এমনি । আসলে আমি সেদিন একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, আবিরের সাথে জামেনা কিংবা জয়নাল কারো চেহারার কোন মিল নেই ।” রাজিব ব্যাপারটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবতে লাগলো । ইফাজ কিছু একটা বলতে যাবে, সেই মুহূর্তে রাজিব বলে উঠলো, “তবে হ্যাঁ, একখান ব্যাপার আমার মনের একই প্রশ্ন তুলছিল ।” ইফাজ একটু নড়ে বসলো । জানতে চাইলো, “কি?” রাজিব কিছু বলতে যাবে এমন সময় নাস্তা নিয়ে ঘরে এলো কলিমা । একটা বড় ট্রের ওপর বিভিন্ন পাত্রের ওপর বিস্কুট, চানাচুর, সিঙ্গারা, সমুচা, নুডুলস, কিছু পেয়ারা আর আপেলও কেটে আনা । ইফাজ বুঝল, সবই রেস্টুরেন্ট থেকে আনা । ইয়ার্কির ছলে বলল, “বাপরে, কতকিছু এনেছো, এ তো আমার আজই ১০ কেজি ওজন বেড়ে যাবে ।” কলিমা আর রাজিব দুজনেই হেসে উঠলো । কলিমা বলল, “নেন, আপনারই তো রেস্টুরেন্টের খাবার । নিজেদের তো তেমন কিছু নেই দেওয়ার ।” ইফাজ রাজিবকে বলল, “বাহ, আপনার মেয়েতো দেখছি ভালোই কথা বলা শিখেছে, যাই হোক, আমার রেস্টুরেন্ট বললে ভুল হবে, ওটা তোমাদেরই রেস্টুরেন্ট । রান্নাবান্না তো সব তোমরাই করো নাকি?” কলিমা আর কিছু বলল না । মাকে কি একটা কাজে সাহায্যও করা লাগবে বলে চলে গেলো । ইফাজ একটা সিঙ্গারা নিয়ে খেতে লাগলো আর জোড় করে রাজিবকেও একটা খেতে বাধ্য করলো । খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো, “কি যেন বলছিলেন?” রাজিব একটু ভেবে বলল, “উমম………ও হ্যাঁ মনে পড়েছে । যে ব্যাপারটা আমার মনেও একই প্রশ্নের জাগরণ ঘটিয়েছিল তা হল, ওদের সাথে পরিচিত হবার কয়েক সপ্তাহের মাথায় আমরা শুনেছিলাম জামেনা নাকি কোনোদিন মা হতে পারবে না ।” ইফাজ খেতে খেতে থেমে গেলো । মা হতে পারবে না তাহলে মা হল কি করে? ইফাজ ব্যাপারটা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলো । ঢাকায় আসার পর জয়নাল রাজিবকে অবসর সময়ে সব কথাই বলছে শুধুমাত্র আবিরকে কুড়িয়ে পাবার কথাটা ছাড়া । সেখানে বলেছিল, নতুন এলাকায় ডাক্তারের চিকিৎসায় মা হবার যোগ্য হয়ে ওঠে জামেনা । আর তার ১০মাস পরেই আবিরকে গর্ভ ধারন করেছে । রাজিবকে জয়নাল যা বলেছে, তা-ই খুলে বলল ইফাজকে । ইফাজ মন দিয়ে কথাগুলো শুনতে লাগলো । রাজিব সব বলা শেষে একটা কথা বলল, “তবে একখান প্রশ্নের আমিও আইজও কোন জবাব পাই না । সেইডা হইলো, আসলেই কি ডাক্তার দেখাইয়া এরকম মা হওয়ার অযোগ্য কাউরে মা কইরা তোলা যায়?” জবাবে ইফাজ কেবল বলল, “বিজ্ঞানের যুগে কত কিছুই সম্ভব ।” কিন্তু ইফাজের মনে একই প্রশ্ন খেলা করছে । আসলেই কি সম্ভব? ইফাজ সেখান থেকে বেরোনোর সময় কেবল একটাই প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা, জয়নালরা কোথায় গিয়েছিলো টাকা জোগাড় করতে সেটা বলেছে কি?” রাজিব একটু ভেবে বলল, “ঢাকায়েই, তয়, এইদিকে না, বেউতা নামের একখান এলাকা আছে, ওইদিকে । ধানমন্ডি থেইকা যাইতে ৫০মিনিট মতো লাগে । ইফাজ আর কিছু বলল না । খাওয়া দাওয়া করে সবার সাথে দেখা সাক্ষাত করে চলে এলো সেখান থেকে । বাসায় এসে দেখলো, খাবার টেবিলে বসে আছে পায়েল । ইফাজ দরজা খুলতেই পায়েল সেদিকে তাকালো । তারপর নড়ে বসে বলল, “ও, তুমি এসেছ ।” ইফাজ জুতো খুলে একপাশে রেখে ভেতরে ঢুকল । ডাইনিং টেবিলের কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করলো, “খেয়েছ?” পায়েল বলল, “উহু । তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো, তারপর একসাথে খাবো ।” ইফাজ কিছু বলল না । ফ্রেশ হয়ে এসে ডাইনিং টেবিলে বসে খাওয়া দাওয়া শুরু করলো । ইফাজ জিজ্ঞেস করলো, “আবির আর দ্বীপ খেছে?” পায়েল বলল, “হুম ।” খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ একটু পর ইফাজ বলল, “আজ কমলাপুর বস্তিতে গিয়েছিলাম ।” পায়েল বলল, “সে তো তুমি প্রায়ই যাও । যেহেতু ঐ এলাকার কাজ তোমার ওপরেই সবসময় বর্তায় । নতুন করে বলবার কি আছে?” ইফাজ বলল, “আমি বলেছি বস্তিতে গিয়েছিলাম জয়নালের প্রতিবেশী রাজিবের সাথে কথা বলতে ।” পায়েল বলল, “ও আচ্ছা । তা কি ব্যাপারে কথা বলতে?” ইফাজ খাওয়া দাওয়া শেষ করে বলবে বলে খেতে লাগলো । খাওয়া দাওয়া শেষে যখন আবির আর দ্বীপ দুজনেই কোচিং-এ, তখন ল্যাপটপ নিয়ে বসলো ইফাজ পাশে পায়েল । গতদিনের সেই অডিওটা ডাউনলোড করেছিলো ইফাজ । সেটা ওপেন করে শোনালো পায়েলকে । পায়েল বেশ মনোযোগ দিয়ে কান পেতে কথাগুলো শুনল । তারপর হালকা অবাক হয়ে বলল, “কি শোনাচ্ছ এটা?” ইফাজ বলল, “তোমার মনে আছে, আবিরের গলায় একটা চেইন ছিল আর সেই চেইনের সাথে একটা লকেট ছিল?” পায়েল বলল, “হ্যাঁ তো?” আবির বলল, “গতকাল ওটা ঘটনাক্রমে দেখলাম, ওর মধ্যে কোন ছবি নেই, আছে একটা মেমোরি কার্ড আর কাগজে লেখা লিঙ্ক ।” পায়েল কথাগুলোর যোগসূত্র মেলাবার চেষ্টা করলো কিন্তু কিছু বলল না । “আমি মেমোরিকার্ডটা ল্যাপটপে ঢোকালাম, কিন্তু কাজ করলো না । ড্যামেজ হয়ে গেছে । তারপর ভালো করে কাগজটা খেয়াল করে দেখলাম, এটা গুগল ড্রাইভের লিঙ্ক । আমি সেই লিঙ্কটা হুবহু টাইপ করে এই অডিওটা পেয়েছি ।” এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝল পায়েল । কিন্তু এখনো এর সাথে রাজিবের সাথে দেখা করতে যাবার যোগসূত্রটা মেলাতে পারলো না পায়েল । জিজ্ঞেস করলো, “বুঝলাম, ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত । কিন্তু এতে রাজিব নামের লোকটার সাথে দেখা করার কি হল?” ইফাজ বলল, “আমার এটা শুনে সন্দেহ হয়েছিলো ও আসলেই জয়নাল আর জামেনার সন্তান কি না । এমনিতেও তো ছিল ওর চেহারার অমিল দেখে । এবারে সন্দেহটা আরও গাঢ় হয়েছিলো । তাই সেই সন্দেহের খোলাসা করতে রাজিবের কাছে যায় এবং অবিস্বাস্য হলেও সত্য যে, এতে আমার সন্দেহটা আরও কিছুটা সত্যের দিকে এগিয়ে গেছে ।” পায়েল চমকে উঠলো । জানতে চাইলো, “তাহলে আবির জয়নাল আর জামেনার সন্তান নয়?” ইফাজ বলল, “সেটা আমি এখনো শিওর না, সন্দেহ মিটবে বেউতা এলাকা এবং ফকিরাপুল গ্রামে গেলে ।” পায়েল জানতে চাইলো, যাবে তুমি?” ইফাজ বলল, “আজ সন্ধ্যায় যাব বেউতা এলাকায় । ধানমন্ডি থেকে ৫০মিনিট মতো লাগে । আর ফকিরাপুলে যাবো সামনের শুক্রবার ।” পায়েল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমিও যাব তোমার সাথে ।” ইফাজ কিছু বলল না । কেবল পায়েলের চোখে চোখ রেখে ইশারায় নিরব সম্মতি জানালো । সন্ধ্যায় ওরা গাড়ি নিয়ে রওনা হল বেউতা এলাকার উদ্দেশ্যে । বাসায় দ্বীপ আর আবির একা । জ্যামে বসে আছে ইফাজ আর পায়েল । ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় সমস্যা এই ট্র্যাফিক জ্যাম । এই জ্যাম যদি না থাকতো, তাহলে কত কাজ যে কত তাড়াতাড়ি করা যেতো । যাই হোক । পায়েল সিটে বলে ফোন চালাচ্ছিল । ইফাজ স্টেয়ারিং ধরে বসে চারপাশে তাকাচ্ছিলো । সম্ভবত জ্যামের মুল উৎস দেখবার চেষ্টা করছিলো । কিন্তু এমন সময় ওর চোখে পড়লো একটা হসপিটাল । নাম নিউক্লিয়াস হসপিটাল । ইফাজের তখন এক মুহূর্তের জন্য মনে পড়লো, ঐ সেই অডিওটার কথা । কারণ সেখানে যে কথপথন হয়েছিলো, সেটা শুনে মনে হচ্ছিলো হাসপাতালে কারো ক্ষতি করবার জন্য । খুব ভালো হতো যদি অডিওতে হাসপাতালটার নামও কোনোভাবে উল্ল্যেখ করা হতো । তাহলে হয়তো খুজে বের করা সহজ হতো । ইফাজ হঠাৎ মোবাইলের ইয়ারফোন কানে নিয়ে আবার শুনতে লাগলো সেই অডিওটা । পায়েল অবশ্য খেয়াল করে ব্যাপারটা কিন্তু কিছু বলে না । ইফাজ ভালো করে শুনে দেখল, একটা নাম তাতে এসেছে । সোহেল । না নামটা আগেও শুনেছে ইফাজ, কিন্তু তেমন গুরুত্ব দিয়ে না । আরও খেয়াল করে দেখল, একজন বলছে, “আর সোহেলরে বল যে মা ও বাচ্চা দুইটাই অসুস্থ, আরও টাকা জমা করতে হবে ।” বাচ্চা! ইফাজ ঘামতে শুরু করলো, এতক্ষণ পর্যন্তও ইফাজ এই অডিওটা তেমন কিছু ভাবে নি, কিন্তু এবার ও সত্যি আচমকা ঘাবড়ে গেলো । বাচ্চাটা আবির নয়তো! আর ওর বাবা সোহেল! সামনের গাড়িটা অনেকটা সামনে এগিয়ে গেছে কিন্তু ইফাজের গাড়ি এখনও আগায় নি । ইফাজের কানে সেই অডিও বেজেই চলেছে কিন্তু ইফাজের সেদিকে মন নেই, ইফাজের মনে শুধু দুটো কথা, বাচ্চা, আর সোহেল । ইফাজের পেছনের গাড়িটা বিরক্ত হয়ে হর্ন বাজিয়ে জানালা দিয়ে মাথা বের করে চিৎকার করে বলে উঠলো, “কি ভাই! সমস্যা কি? গাড়ি সামনে আগাচ্ছেন না কেন?” কথাটা কানে গেলো না ইফাজের কানে গেলো পায়েলের । পায়েলও এতক্ষণ খেয়াল করে নি মোবাইলের দিকে চোখ থাকার কারণে, যখন কথাটা শুনলো, তখন সামনে তাকিয়ে দেখল, সত্যি-ই সামের গাড়িটা অনেক দূর চলে গেছে । পায়েল ইফাজ কে কিছুক্ষণ ধাক্কা দেবার পর ইফাজের হুশ এলো । ইফাজ “হ্যাঁ!” বলে চমকে উঠলো, তখন পায়েল বলল, “কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই তোমার? সামনের গাড়িটা কখন দূরে চলে গেছে সে খেয়াল আছে তোমার?” ইফাজ গাড়িটা সামনে নিয়ে গেলো । তারপর কিছুক্ষণের মাঝেই জ্যামটা কমে গেলো । ইফাজ রাস্তায় গাড়ি চালাতে লাগলো । হঠাৎ এক সময় বলল, “পায়েল?” পায়েল “হুম” জবাব দিলো । পায়েল তখন মোবাইল চালাচ্ছিল না, জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল । ইফাজ বলল, “তুমি কি ঐ অডিওটা ভালো মতো খেয়াল করেছো?” “হুম।” এক শব্দে জবাব দিলো পায়েল । ইফাজ আবারও প্রশ্ন করলো, “তুমি কিছু বুঝেছ?” পায়েল উহু বলে উঠলো । ইফাজ বলল, “আমি বুঝেছি ।” এই কথা শুনে পায়েল জানালা থেকে চোখ সরিয়ে ইফাজের দিকে তাকালো । জিজ্ঞেস করলো, “তা কি বুঝলে?” ইফাজ বলল, “আমার ধারণা যদি ভুল না হয়, ঐ অডিও তে যে বাচ্চার কথা বলা হয়েছে, আবির আর যে লোকটার নাম বলা হয়েছে, সোহেল, উনি আবিরের বাবা ।” পায়েল অবাক হয়ে গেলো । কপালে নিজের কপালে হাতের তালু ঠেকিয়ে বলে উঠলো, “ইয়া আল্লাহ! এভাবে তো ভাবিনি!” “ঐ অডিও শুনে যা বোঝা যায়, তাতে মনে হয় সম্ভবত আবিরকে মারার কোন কু-মতলব করা হয়েছিলো ।” বলল ইফাজ । ওর চোখেমুখে একটা অদ্ভুত আশঙ্কার ছাপ স্পষ্ট । পায়েল খানিকক্ষণ চুপ করে রইল । তারপর জিজ্ঞেস করলো, “তাহলে ছেলেটা জয়নালের না? সোহেল নামের কারোর?” ইফাজ ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বলল, “আমি এখনো জানি না । এটা তো কেবল আমার কল্পনা । হয়তো সত্যটা এটা নাও হতে পারে । সেই সত্যের সন্ধানেই তো বেউতা এলাকায় যাচ্ছি । এরপর ফকিরাপুল গ্রামেও যাব । দেখা যাক, কি সুত্র পাওয়া যায় সেখানে ।” পায়েল কোন জবাব দিলো না । ইফাজের মতো সেও এখন ঐ অডিওটার ব্যাপারে গভীরভাবে ভাবছে । এদিকে বাসায় আবির সন্ধ্যার সময় ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশে তারা দেখছিল । ওর এভাবে ছাদে তারা দেখতে ভালো লাগে । ভালো লাগে, সন্ধ্যার এই বাতাসটা । এক অন্যরকম ভাললাগা মিশে থাকে এই বাতাসে । শীতের শেষে গরমের শুরুতে যখন কাল বৈশাখী হবার সময়টা আসে, তখন ঝড়ের আগে যে মন হরণকারী বাতাসটা পাওয়া যায়, সেরকম একটা বাতাস এই সময়ে প্রায়ই বয় । বেশ ভালো লাগে বাতাসটা । এমন সময় গনি চাচা এলো । ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে ইফাজকে ডেকে বললেন, “ইফাজ, তোমার একখান বান্ধবী আইছে । তোমারে খুজতেছে ।” ইফাজ গনি চাচার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, “যাচ্ছ চাচা ।” ইফাজের জবাব পেয়ে গনি চাচা চলে গেলেন। ইফাজ ছাদের দরজার কাছে আসছিলো । বান্ধবী? না, বান্ধবী ওর অনেক আছে, কিন্তু এখন আবার কে এসেছে? আসলে একজনই আসতে পারে, নাবিলা । আবিরের খুব ভালো বন্ধু । ঘরে এসে দেখল, যা ভেবেছিলো তা-ই । নাবিলা এসেছে । মেয়েটা ভালোই ফর্সা । আবিরের মতোই মোটামুটি লম্বা । নাকটা একটু চিকন । চুলগুলো বেশ বড় । চোখে চশমা । ইফাজ ঘরে ঢুকতেই মেয়েটা উঠে দাঁড়ালো । আবির বলল, “কেমন আছিস?” মেয়েটা হালকা হেসে বলল, “ভালো আছি । তুই?” আবিরও হ্যাঁ বলল । নাবিলা আবিরের টেবিলের কাছে গিয়ে বলল, “আসলে আমি স্কুলে যেতে পারিনি তো, তাই তোর কাছে এলাম আজ ক্লাসে কি কি করিয়েছে সেটা বুঝে নিতে । ইফাজ বলল, “হ্যাঁ অবশ্যই ।” বলে টেবিল থেকে ডাইরিটা বের করলো দাইরির পাতা ওলটাচ্ছিল, নাবিলা বলে উঠলো, তোর কি মন খারাপ?” আবির একবার নাবিলার দিকে তাকিয়ে আবার ডাইরির দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল, “না না, মন খারাপ হতে যাবে কেন?” “বাসায় কে কে আছেন?” আবির বলল, “মা বাবা একটু কাজে বাইরে গেছেন । বাসায় আমার ছোট ভাই আছে । আর আছেন গনি চাচা, হালিমা চাচি, আর কাশেম চাচা আছেন ।” নাবিলা বলল, “কাজের লোক?” ইফাজ নাবিলার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “এভাবে বলছ কেন?” মানুষকে এভাবে বলতে নেই । উনারা বাড়িই তো একজন ।” নাবিলা বলল, “ আচ্ছা, সরি । তুমি তো দেখি খুব ভালো ।” আবির কিছু বলল না । নাবিলাকে পড়া বোঝাতে লাগলো । এদিকে ইফাজ আর পায়েল পৌঁছে গেলো সেই এলাকা বেউতায় । এলাকায় ঢুকতেই একটা মসজিদ চোখে পড়ে ইফাজের । সেখানে দিয়ে সোজা সামনের দিকে এগিয়ে গেলো ওরা । কিছুটা পর পাড়ি দিলো এমন রাস্তা দিয়ে যার দুপাশে ধানক্ষেত । একটা পেয়ারা গাছও নজরে এলো ইফাজের । কিছুতার দূর যাবার পর হালকা গ্রাম্য এলাকা । সেখানে বেশিরভাগ বাড়ি-ই টিনের । রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ পর পরই কেউ না কেউ হেঁটে যাচ্ছে । ইফাজ একজনকে ডেকে মোবাইলে থাকা জয়নালের সাথে তোলা সেই শেষ দিনের ছবিটা দেখিয়ে বলল, “আচ্ছা ভাই, আপনি কি এই লোকটাকে চেনেন?” লোকটা মাথা নাড়িয়ে না জানিয়ে দিলো । সামনে আরও একজনের সাথে দেখা । তাকেও বলল, সেও আগেরজনের মতো না করে দিলো । এভাবে পুরো এলাকা ঘুরে ঘুরে একজন মৃত ব্যাক্তির পরিচিত কাউকে খোঁজা আসলেই খুব চ্যালেঞ্জের ব্যাপার । এমন সময় পায়েল হঠাৎ বলে উঠলো, “আচ্ছা, জয়নাল এখান থেকে চলে গেছে তা তো প্রায় ৯-১০ বছর হবে, তোমার কি মনে হয়, এতো বড় এলাকায় ওদের খুজে পাবো?” ইফাজ হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে দিলো । সত্যি তো, এতো বছর পরেও কি কেউ দিতে পারবে জয়নালের খোঁজ? কিছুক্ষণ কি যেন ভেবে ইফাজ বলল, “চেষ্টা করে তো দেখতে পারি ।” বলেই আবার গাড়ি চালু করে এগোতে লাগলো । রাস্তায় সবাইকে জিজ্ঞেস করলো কিন্তু কেউই চেনে না জয়নাল কে । একজন আবার একটা বাজারে রাস্তা দেখিয়ে সেখানে যেয়ে খোঁজ নিতে বলল । আবির সেটাও করলো কিন্তু না, পারলো না । সে ব্যর্থ হল । কোঁথাও কারো কাছ থেকে পেলো না জয়নাল আর জামেনার কোন খোঁজ । হয়তো তখন যারা জয়নাল কিংবা জামেনাকে চিনত তারা এখন আর বেচে নেই, অথবা এই এলাকা থেকে অন্য কোথাও চলে গেছে । শেষে আর বৃথা চেষ্টা না করে বাসার পথে রওনা হল ওরা । এদিকে বাসার নাবিলার সব পড়া বুঝে নেয়া শেষ । চলে যাচ্ছিলো, তাই বাসার দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলো আবির । মেয়েটা বাইরে বেড়িয়ে জুতোটা পড়ে নিলো । চলে যাবার জন্য পা বাড়াবে, এমন সময় পেছন ফিরে আলতো হেসে বলল, “দরকার পড়ে আবার আসবো কিন্তু ।” আবিরও আলতো হেসে জবাব দিলো, হ্যাঁ অবশ্যই, দরজা খোলা আছে সবসময় ।” বলেই মেয়েটা চলে গেলো । আবির মেয়েটাকে যতদুর দেখা যায়, ততদুর দেখতে লাগলো । মেয়েটা চোখের আড়াল হলে আবির ঘরে ফিরে আসে । মেয়েটা হাতে একটা ঘড়ি পড়ে এসেছিলো । লেখার সময় ঘড়ির জন্য লিখতে একটু সমস্যা হচ্ছিলো বলে ঘড়িটা খুলে আবিরের টেবিলে রেখেছিলো, কিন্তু পড়ে ভুলে রেখে গেছে । আবির ঘড়িটা হাতে নিলো । মেয়েটার বাসাও আবির চেনে না যে গিয়ে দিয়ে আসবে । এখন মেয়েটাই যদি নিতে আসে, তাহলেই দেয়া হবে, নতুবা কাল সকাল ছাড়া উপায় নেই । আবির ঘড়িটা ব্যাগে রেখে দিলো । তারপর পড়ার জন্য টেবিলে বসতে যাবে, এমন সময় বেজে উঠলো গান । সম্ভবত ড্রইং রুম থেকে আসছে । দ্বীপের কাজ শিওর । বাসায় বাবা মা নেই, আর ওর বাঁদরামো শুরু হয়েছে । আবির কিছু না বলে পড়ায় মন দিলো । শব্দটা বেড়ে গেলো না খানিকটা? মন দিতে পারছে না ঠিক মতো আবির । তবুও দু হাত দিয়ে কান চেপে ধরে পড়ায় মন দেবার চেষ্টা করলো । একটু পর আরও বেড়ে গেলো সাউন্ড । না, আর তো পারা গেলো না । টেবিল থেকে উঠে ড্রইং রুমে গেলো আবির । দেখল, দ্বীপ সোফায় লাফিয়ে লাফিয়ে নাচছে আর পাশে সাউন্ড বক্সে গান বাজছে । সাধারানত দ্বীপ খুব খুশি থাকলে এরকমটা করে । বেশি করে আবিরকে মা বাবার হাতে বকা খাওয়াতে পারলে । আজ আবার কি হল? বুঝতে পারলো না আবির । আবির কিছু না বলেই যেয়ে সাউন্ড বক্সের প্লাগটা টেনে খুলে ফেলল । দ্বীপ লাফাতে লাফাতে থেমে যেয়ে রাগ দেখিয়ে বলল, “এটা কি করলা?” “আমি পড়ছি না? ডিস্টার্ব করছিস কেন? তোর পড়া নাই?” মেজাজ দেখিয়ে বলল আবির । দ্বীপ বলল, “আমার পড়া শেষ তাই আমি মজা করছি । তাতে তোমার কি?” আবির দ্বীপের কাছে যেয়ে বলল, “হ্যাঁ, কত পড়লি? আমি তো সবই দেখলাম ।“ দ্বীপ ঠোঁট বেকিয়ে ভেঙচি কেটে বলল, “এহ! এতক্ষণ বান্ধবীর সাথে নোষ্টি-ফোষ্টি করলা, সে সময় কি ছিল হ্যাঁ? তখন পড়া ছিল না?” ইফাজ অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে দ্বীপের দিকে তাকালো । জিজ্ঞেস করলো, “ছি! এসব আজে বাজে ভাষা কোথা থেকে শিখেছিস তুই?” দ্বীপ হালকা হেসে বলল, “হেহ! মাইঙ্কার চিপায় পইড়া এখন সত্যি মানতে কষ্ট হচ্ছে না?” এ কথার পরপরই একটা বাজে, জঘন্য, অকথ্য গালি দিলো দ্বীপ আবিরকে । এবার দ্বীপ সত্যি-ই সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে । আবির এবার দ্বীপের গালে একটা জোরে চড় বসাল । ঠিক যখনই চড়টা ওর গালের কাছাকাছি, তখনই ঘরে ঢুকল ইফাজ আর পায়েল । দ্বীপ তো বাবা মাকে দেখেই ভ্যা ভ্যা করে কান্না শুরু, আর ইফাজ আর পায়েল তো নিজের চোখেই আবিরকে দ্বীপের গালে চড় মারতে দেখেছে । দ্বীপ তো কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে জড়িয়ে ধরল । পায়েল আবিরের কাছে এসে বড় বড় চোখে তাকিয়ে রেগে গিয়ে জোরে জোরে বলতে লাগলো, “কি সমস্যা আবির? ওকে মারলি কেন?” আবির কিছু বলতে যাবে, এমন সময় দ্বীপ বলে উঠলো, “আজকে নিজের বান্ধবী এনে কি যেন করছিলো । সেটা জিজ্ঞেস করেছি, তাই আমাকে মারল ।” পায়েল আবিরের দিকে তাকিয়ে চাপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কে এসেছিল?” আবির বলল, “মা, আমার একটা বন্ধু ।” পায়েল আর কিছু বলতে চাইলো না । চাইলো না বললে ভুল হবে, পারলো না। এমনিতে পায়েল আর ইফাজ বাচ্চাদের সামনে রাগ দেখায় না, তার ওপর আজ দরজা খুলেই মারতে দেখে আর রাগ সামলাতে পারল না । খানিকক্ষণ পায়েল চুপ করে ইফাজের দিকে তাকিয়ে রইল । ইফাজের চোখেমুখে ও রাগ । তা প্রকাশ না করলেও চেহারা দেখে ঠিক বোঝা যায় । দ্বীপও সেই চেহারা দেখে বাব্বা মায়ের রাগটাকে কাজে লাগিয়ে চেলে ফেললো আসল চাল । বলল, “গতকালকের ঐ ছবিগুলো, ওগুলো তো ভাইয়াই আমাকে দেখানোয় অভ্যস্ত করেছে । ওইদিন আমি কিছু বলিনি তোমরা শুনলে ভাইয়াকে বকবে বলে । কিন্তু ভাইয়া তো সীমালঙ্ঘন করেছে বলে আমি বলতে বাধ্য হলাম ।” আবির এতক্ষণ মাথা নিচু করে ছিল । দ্বীপের কথায় অবাক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকালো । পায়েল মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে । খুব কষ্ট হচ্ছে চেপে রাখতে । কষ্টে জর্জরিত চাপা গলায় কোনোরকমে ইফাজকে বলল, “দ্বীপের বাবা, একটু ঘরে চল । কথা আছে ।” কোনোদিন মাতো দ্বীপের বাবা বলে ইফাজকে ডাকে নি, সবসময় ডাকতো আবিরের বাবা বলে । তব্বে আজ হঠাৎ কি হল? শুধুই কি রাগের জন্য? নাকি অন্য কোন কারণ আছে? হঠাৎ প্রশ্ন জাগলো আবিরের মনে । ইফাজ পায়েলের সাথে চলে গেলো নিজেদের ঘরে, আবির তাকিয়ে দেখল, দ্বীপও চলে গেছে । হয়তোবা জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি না হবার জন্য । আবির মেঝেতে বসে পড়লো । আচ্ছা, মা কি যেন বলবে বলছিল বাবাকে না? কি বলবে? আড়ি পেতে মানুষের কথা শোনার স্বভাব আবিরের । কিন্তু আজ ওর মায়ের হঠাৎ-ই এরকম ভিন্নতা দেখে আবির নিজের কৌতূহলী মনোভাব কে আটকে রাখতে পারলো না । উঠে গিয়ে কান পাতলো ইফাজ আর পায়েলের ঘরের দরজায় । পায়েল তখন ইফাজকে বলছে, “শোনো, আমি বলে দিচ্ছি, এরকম যদি আমার ছেলের সাথে আর কোনোদিন ও এরকম করে, আমি কিন্তু বড় কোন স্টেপ নিতে বাধ্য হবো ।” ইফাজও হালকা মেজাজে বলল, “আচ্ছা, রাগ তো আমারও হয়েছে , কিন্তু আমি কি কিছু করেছি? শান্ত হও, সব ঠিক হয়ে যাবে ।” “ঠিক হবে না । এমনিতেই আমার ছেলেটাকে নষ্ট করে দিয়েছে, আরও যে নশ্ত করবে না, তার কি কোন গ্যারান্টি আছে?” আবির দাঁড়িয়ে খানিক ভাবল, মা বার বার দ্বীপ কে আমার ছেলে আমার ছেলে কেন বলছে? আবির আবারও কথায় মনোযোগ দিলো । ইফাজ বলল, “এতদিন ওর সাথে আছো, কই, এতদিন তো এরকম কিছু হয় নি, আজ হঠাৎ, সামান্য একটা কারণে কেন শুধু শুধু এরকম করছ?” পায়েলও বিরক্তির গলায় জবাব দিলো, “সামান্য মনে হয় তোমার? তোমার কি মনে হয়, ও যে আজেবাজে জিনিস আমার ছেলেকে দেখায়, সেটা কি খুব ভালো?” “আহা ও তো এরকম করার মতো ছেলে নয় ।” পায়েল কিছুক্ষণ ইফাজের চোখে চোখ রেখে চাপা গলায় বলল, “তবে তোমার কি মনে হয়? তোমার নিজের ছেলে ইচ্ছা করে ওসব আজে বাজে জিনিস দেখে?” ইফাজ ভেবে জবাব দেয়, “না, আমার ছেলে হিসেবে ব্যাপারটা মেনে নেয়া আসলেই খানিক অদ্ভুত লাগে আমার ।” আবির আরও একটু ভয় পেলো । কেন বারবার তোমার নিজের ছেলে, আমার ছেলে এরকম করছে মা বাবা? পায়েল সে সময় এমন একটা কথা বলল, যা শুনলে যেকোন ছেলে নিজেকে সামলে রাখতে পারবে না । রুমের অন্য দরজার ওপাশে ছিল দ্বীপ। সেও শুনছিল মা বাবার শলা পরামর্শ । সেও পর্যন্ত শুনে অবাক । পায়েল বলল, “আমি বলি, এ নিশ্চয় কোন গুন্ডা বা মাস্তানের ছেলে । ভাগ্যক্রমে এখানে এসেছে । যতই আমরা বড় করি, গুন্ডা মাস্তানি ওর ক্রোমোজোমের জিনের মধ্যে আছেই । তাই বেশি কুটনামি পারে । আমি বলি কি, এই ছেলে কে বাসা থেকে বিদায় করো । তা না হলে আমার ছেলেও নষ্ট হয়ে যাবে ।” আবির পাথর হয়ে গেলো । নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিচ্ছে সে । ওপাশে দ্বীপও ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল । বলছি কি এসব মা? ইফাজ তখন বলল, “দ্যাখো আস্তে কথা বলো । আমি চাইনা ঐ ছোট মানুষ এসব কথা শুনুক । বেশ কষ্ট পাবে আর তাছাড়া ও আমাদের সন্তান না, এটা শুনলে তো আরও ঘাবড়ে যাবে ।” বলেই রুম থেকে বেরোনোর জন্য দরজাটা খুলেই অবাক ইফাজ । দাঁড়িয়ে রয়েছে আবির । তাও সে টের পায় নি ইফাজ যে দরজা খুলেছে এতটাই কষ্ট পেয়েছে আবির । ইফাজ অবাক স্বরে, “আবির!” বলে উঠলো । পায়েলও অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল, ইফাজের মুখে আবির ডাক শুনে দরজার দিকে তাকিয়ে আবিরকে দেখে সে বিস্ময়ে মুখে হাত চেপে ধরে ভয়ে তাকালো । আবিরও আবির ডাকটা শুনে একবার ইফাজের দিকে, একবার পায়েলের দিকে তাকালো । তারপর দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেলো । ইফাজ পেছন ফিরে পায়েলের দিকে তাকিয়ে হালকা রেগে বলল, “বলেছিলাম তোমায় ।” পায়েলের চোখ দিয়ে পানি চলে এলো । সে কি করবে বুঝতে পারছিলো না । রাগের মাথায় এতো বড় কথা সে বলে ফেললো? আশেপাশে আবির যে থাকতে পারে এ কথা একবারের জন্যও সে ভেবে দেখল না? ইফাজ তাড়াহুড়া করে ঘর থেকে আবিরের কাছে দৌড়ে গেলো । পায়েলও বেরোতে যাবে, এমন সময় চোখে পানি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো দ্বীপ । দ্বীপ জানতে চাইলো, “ও আমার আসল ভাই না?” পায়েল কিছু বলতে পারছিলো না । কেবল বুকে জড়িয়ে নিলো দ্বীপকে । চোখ দিয়ে অশ্রুধারা অনর্গল পড়তে লাগলো । এদিকে ইফাজ ঘরে আবিরকে পেলো না । তাই এবার খুজতে গেলো ছাদের দিকে । ছাদে উঠে দরজার কাছেই তো থাকার কথা, কিন্তু না, আবির সেখানেও নেই । ইফাজ তাড়াতাড়ি করে আবার নিচে নেমে এলো । জুতার র্যাকটা খুলে দেখল, আবিরের পায়ের চটিটা নেই যেটা পড়ে সে সবসময় বাইরে বের হয় । ইফাজ গেইটের কাছে যেয়ে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলো, “ভাই আবিরকে দেখেছেন?” দারোয়ান জবাব দিলো, “এইতো, কেবলই বাইর হইয়া গেলো । কি নাকি বাজার থেইকা আনতে কইছেন । ইফাজ বেড়িয়ে গেলো বাহিরে । কতদুরই বা যাবে, আশেপাশেই থাকবে হয়তোবা । আশেপাশে সব জায়গায় খুজে বেরালো । আবিরের কিছু বন্ধুবান্ধব আশেপাশেই থাকে, তাদের বাসায়েও যেয়ে দেখে আসলো, কিন্তু না । আবিরকে কোথাও খুজে পাওয়া গেলো না । ইফাজ প্রায় ১ঘণ্টা খোঁজাখুজি করে হতাশ মনে বাড়ি ফিরে এলো । পায়েল তখন দ্বীপকে পাশে নিয়ে ড্রইংরুমের সোফার ওপর বসে ছিল । গনি চাচা, হালিমা চাচি আর কাশেম চাচা অনেকটা দূরে রান্নাঘরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন । ঘরে ঢোকা থেকে ইফাজের দৃষ্টি নড়ছেই না । প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছে । পায়েল আর দ্বীপ ইফাজকে ঢুকতে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো । দ্বীপ দৌড়ে যেয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল কিন্তু না, ইফাজের দৃষ্টি তবুও নড়ল না । পায়েল একটু উঁকি দিয়ে দেখবার চেষ্টা করলো সাথে আবির এসেছে কি না, কিন্তু সে আবিরকে খুজে পেলো না । নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলো, “তু...তুমি...একা.....।” “এটাই তো চেয়েছিলে না!” পায়েলের কথা শেষ করতে না দিয়েই ক্ষিপ্ত মেজাজে কথাটা বলল ইফাজ । ভয়ে দূরে সরে গেলো দ্বীপ । কখনো বাবাকে এরকম রাগতে দেখেনি, তাই ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক । পায়েল কাঁদতে কাঁদতে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ইফাজ আবারও ক্ষিপ্ত স্বরে বলল, “তুম তো আগে এমন ছিলে না! কেন এমন করলে! কি এমন দোষ ছিল ওর? যে এক নিমিষেই এতোগুলো কথা তুমি বলে ফেললে?” পায়েল কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দিলো, “এরকমটা হবে আমি বুঝিনি ইফাজ ।” পায়েলের কথা শেষ হতে না হতেই ইফাজ আবারও বলে উঠলো, “তুমি তো কত কিছুই বোঝো না, তুমি তো বাচ্চা তাইনা? কখন কি কথা বলতে হবে সেসব শিখিয়ে দিতে হবে না?” পায়েল আবারও কিছু বলতে যাচ্ছিলো, ইফাজ আবারও থামিয়ে দিয়ে বলল, “এখন যদি ছেলেটা কষ্টের বশে কিছু করে বসে তখন......।” “এতটাই পাগল নই আমি আঙ্কেল ।” দরজার দিক থেকে গলা ভেসে এলো । সবাই সেদিকে তাকালো । দরজায় দাঁড়িয়ে আবির । ইফাজ আবিরের কাছে যেয়ে আবিরকে জড়িয়ে ধরল । কপালে গালে অনেক চুমু খেলো আর বলতে লাগলো, “কিচ্ছু হয় নি বাবা, আমি আছি, যে যাই বলুক, তুই আমার ছেলে । তুমি আমাদের ছেলে । তুই কিচ্ছু চিন্তা করিস না ।” ইফাজ ওর শরীর থেকে বাবার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ আঙ্কেল, আমাকে এতদিন নিজের ছেলের মতো মানুষ করার জন্য ।” ইফাজ অবাক হয়ে চাপা গলায় বলল, “আবির!” আবির বলল, “না আঙ্কেল, একটা গুণ্ডার ছেলের জন্য আর কষ্ট পাবেন না । আমার জন্য অনেক করেছেন । এর জন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ । এর ঋণ আমি হয়তো কখনো শোধ করতে পারবো না । শেষ আরেকটা জিনিস চাইব । আমাকে কোন অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দিন । আপনাদের ঋণের বোঝা আমি হতে চাই না ।” পায়েল কাঁদতে কাঁদতে আবিরের কাছে এসে বলল, “আবির প্লিজ! এরকমটা বলিস না । আমরা অনেক কষ্ট পাব ।” আবির বলে উঠলো, “আশা করি আপনাদের কষ্টের পরিমান আমার কষ্টের সমান বা তার চেয়ে বেশি হবে না ।” আবির আর পায়েল আর কিছু বলতে পারলো না । দূরে দাঁড়িয়ে দ্বীপ । আবির একটু ওর দিকে তাকালো । দ্বীপ লজ্জায় মাথা নিচু করেই রইল । আবির সেখান থেকে নিজের ঘরে চলে গেলো । পায়েল চাপা গলায় বলল, “এবার কি করবে?” ইফাজ কিছু বলল না । এদিকে আবির ঘরে এসে ব্যাগ গোছানো শুরু করলো । নিজের জামাকাপড়, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ইত্যাদি । সবটা নিলো না । যেটা একান্তই প্রয়োজন, সেটাই নিলো । ওর মধ্যে এখন এই মানসিকতা কাজ করছে, এসব অন্য কারো সম্পত্তি । এসব নেবো না আমি । টেবিল থেকে যা যা প্রয়োজন, সবটা নিলো । ব্যাগটা বিছানায় রেখে চেয়ারের ওপর বসলো । টেবিলের ওপর একটা ছবি । ছবিতে আবির, ইফাজ, পায়েল আর দ্বীপ বেশ পরিপাটি হয়ে কোন এক পার্কে দাঁড়িয়ে আছে । আবির সেটা হাতে নিয়ে কাঁদতে লাগলো । কে ওর আসল বাবা মা? তারা কি ওর কখনো খোঁজ করে নি? মনে মনে ভাবতে লাগলো আবির । এমন সময় ঘরে কারো প্রবেশ টের পেয়ে ছবিটা রেখে চোখ মুছে উঠে বসলো আবির । ইফাজ এসেছে ঘরে । ইফাজ আবিরের কাছে আসতে চাইলো, কিন্তু আবির বলে উঠলো, “আমার মা কিংবা বাবার নামটা বলতে পারেন?” ইফাজ বলল, “দ্যাখ আবির, তুই কিন্তু ছোট মানুষ । এসব কোন ঝামেলায় জড়াবার কোনো মানে নেই । তুই আমাদের ছেলে, আমাদের সাথেই থাক ।” আবির বলে উঠলো, “কোন ঝামেলার কথা বলছেন আঙ্কেল? বাবা মাকে খোঁজার? তার চেয়ে বরং নিজেকে এই প্রশ্ন করুন না, কেন আমার বাবা মায়ের থেকে এতদিন আপনারা আমাকে দূরে রেখেছিলেন? কেন আপনারা আমার মা বাবাকে খুজবার চেষ্টা করেননি?” ইফাজ বলল, “দ্যাখো আবির, এতদিন আমরা জানতাম জয়নাল আর জামেনা নামের দুজন মানুষ তোমার বাবা মা যারা মারা গেছেন তোমার যখন প্রায় তিন বছর বয়স । কিন্তু কিছুদিন আগেই আমরা বুঝলাম উনারা তোমার মা বাবা না-ও হতে পারেন ।” আবির একটু থেমে গেলো । জয়নালের ছবি আবির দেখেছে । সেই লুঙ্গি পড়া ছেলেটার কোলে ছোট আবির । ইফাজ বলেছিল জয়নালের পরিচয়, কিন্তু এটা বলে নি আবির ওর সন্তান । বলেছিল কোন একদিন ওই লোকটা আবিরের সাথে ছবি তুলতে চেয়েছিল, তাই ঐ ছবি তোলা । আবির আর কিছু বলল না । ইফাজ আবিরের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “দেখ আবির, যা হবার হয়ে গেছে । এসব ভুলে যা । আমরা আছি তো তএ সাথে সবসময় । তুই কিচ্ছু চিন্তা করিস না । আমরা তোর বাবা মায়ের খোঁজ নেবো ।” আবির তখন অভদ্রতার সাথে বলল, “এ বাড়িতে আপনাদের ঐ চেহারাগুলো দেখলে না আমার নিজের অজান্তেই ঝুলে যাবার ইচ্ছে হবে ।” ইফাজ আর কিছু বলল না । নিজের কাছে নিজেকেই কেন যেন দোষী মনে হতে লাগলো । আবার রাগও জন্মাল আবিরের ওপর । এ ছেলে কথা বোঝে না কেন? ইফাজ মাথা নিচু করে একটা শ্বাস ফেললো । কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল । তারপর আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাকে আর কয়েকটা ভাবার সময় দে প্লিজ!” আবিরও কিছুক্ষণ ভাবল । অগত্যা সম্মতি জানালো ইফাজের কথায় । দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল, এতক্ষণ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে ইফাজ আর আবিরের কথোপকথন শুনছিল পায়েল । রাতে দ্বীপের সাথে ঘুমিয়েছিল আবির । না ঘুম আসছে আবিরের, না ঘুম আসছে দ্বীপের । দ্বীপ আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাইয়া, তুমি কি সত্যি চলে যাবে?” আবির “হুম” আওয়াজ করলো । দ্বীপ বলল, “সরি ভাইয়া । কিন্তু বাবা মাকে কিছু বোলো না । তাহলে তারা আমার ওপর রাগ করবেন ।” আবির কিছু বলল না । দ্বীপ অনেকক্ষণ আবিরের জবাবের প্রতিক্ষায় আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল । কিন্তু জবাব না পেয়ে বলল, “বলবে না তো?” আবির দ্বীপের মাথায় হাত রেখে বলল, “ঘুমো তুই । । অনেক রাত হয়ে গেছে ।” দ্বীপ অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে পড়লো । আবির কিছুক্ষণ ফ্যানের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবল । এক পাশে কাত হয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না । আবির উঠে বসলো । ইচ্ছে হচ্ছিলো খানিকটা ছাদ থেকে ঘুরে আসতে যদিও এর আগে কখনো এতো রাতে ছাদে যায় নি আবির । ছাদে যেতে গেলে পায়েল আর ইফাজের রুমটা পার করে যেতে হয় । আবির সেদিক দিয়েই যাবার সময় দেখল, ইফাজ আর পায়েল এখনো ঘুমায় নি । দরজার কাছে আরেকটু এগিয়ে আসতেই খেয়াল করলো পায়েল ইফাজকে বলছে, “তুমি কি সত্যি আবিরকে এ বাড়ি থেকে যেতে দেবে?” ইফাজ জবাবে বলে, “কই, না তো । কেন?” “ঐযে, তুমি যে একটু সময় চেয়ে নিলে?” ইফাজ একটু থেমে জবাব দিলো, “না । সময়টা চেয়েছি ওকে এ বাড়িতে থাকার কথা বোঝাবার জন্য ।” আবির আর সময় নষ্ট করতে চায় না । এবার ও নিজের সিদ্ধান্তে বাচতে চায় । খুজতে চায় নিজের পরিচয় ।
(৩)
পরদিন সকালে দ্বীপ ঘুম থেকে উঠে দেখল, পাশে আবির নেই । ভাবল হয়তো ছাদে গেছে । উঠে বসলো দ্বীপ । জানালা দিয়ে আলো এসে পড়েছে মুখের । একবারটি তাকানোর চেষ্টা করলো কিন্তু সূর্যের আলর তেজে কিছুই দেখতে পারলো না । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, ৭টা বাজে । বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে যেতে নেবে, এমন সময় চোখ পড়লো টেবিলের ওপর । কি যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে না? গতকাল এখানে কি যেন ছিল, কি যেন? কি যেন? ও হ্যাঁ, ভাইয়ার ব্যাগ না? তার মানে.........। দ্বীপ দৌড়ে ডাইনিং রুমে গেলো । পায়েল কেবলই ঘুম থেকে উঠে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে জগ থেকে পানি ঢেলে খেতে যাবে, ঠিক তখনই দ্বীপ এসে বলল, “মা, ভাইয়া ঘরে নেই । পায়েল উঠে দাঁড়ালো । ঘুম জড়ানো ভাবটা মুহূর্তের মধ্যে কেটে গেলো । পায়েল দরজার কাছে এসে দেখল, দরজা খোলা । “যা তো, তোর বাবাকে ডেকে তোল ।” বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো পায়েল । দারোয়ানের কাছে যেয়ে জানতে চাইলো রাতে আবির বেরিয়েছে কি না, উত্তরে দারোয়ান বলল, “কি জানি, তা তো কইতে পাড়ি না, তয় রাইতে আমি তাহাজ্জুদের নামায পরবার লাইগা যহন অযু করতে গেছিলাম, তখন গেইট তো লাগাইয়াই গেছিলাম । তয় আইসা দেহি, দরজা খোলা । আমি তো ভাবসিলাম আমি হয়তো ভুলে খুইলা রাইখা গেছিলাম ।” পায়েলের বোঝা বাকি রইল না, আবির চলে গেছে । ইফাজ তখন এসে দাঁড়ালো পায়েলের সামনে । হালকা রাগ দেখিয়ে বলল, “খুব খুশি হলে তো না?” পায়েল কিছু বলল না । ইফাজ দারোয়ানকে বলল, “গাড়ি বের করতে বলো, আমি বেরবো ।” কিন্তু ইফাজ আর এই এলাকায় নেই । এই এলাকায় কেন, সে এই পুরো ঢাকা শহরেই নেই । আসবার সময় ২ হাজার টাকা নিয়ে এসেছে । একটা চিঠিও লিখে এসেছে । রাতের একটা খুলনার বাস ধরে চলতে লাগলো । বাসটা এখন মাগুরাতে । জানালার পাশের একটা সিটে বসেছে । হাতে ব্যাগটা নিয়ে জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে । ওর মনটা খুব খারাপ লাগছে ইফাজ, পায়েল, আর দ্বীপের জন্য । এর মাঝে বাসে কত যাত্রী এলো গেলো, তার খেয়াল করে নি আবির । এইতো, মাত্রই ওর পাশে কেউ একজন বসলো । লোকটা বেশ বয়স্ক চুল দাড়ি পেকে গেছে । গায়ে তার পাঞ্জাবী আর পায়জামা । দেখে বেশ ভদ্রলোকই মনে হচ্ছে । আবিরের কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই । সে আপন মনে বাইরের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতি দেখছে । হঠাৎ বয়স্ক ভদ্রলোকটা বলে উঠলো, “তোমার নাম কি বাবা?” প্রথম্ববার আবির শুনতে পেলো না । লোকটা আবিরকে হাত দিয়ে ডেকে বলল, “কি নাম তোমার বাবা?” “আবির ।” ভদ্রতার সাথে জবাব দিল আবির । “বাহ, খুব সুন্দর নাম তো । যাচ্ছ কোথায় তুমি?” আবির একটু ভেবে জবাব দিল, “এই বাসটা যেখানে শেষ লোক নামায়, সেখানে ।” বয়স্ক লোকটা ভাবল, আবির ছোট মানুষ বলে হয়তোবা বলতে পারছে না জায়গাটার নাম । লোকটা আবার জিজ্ঞেস করলো, “ তোমার মা বাবা কোথায়?” আবিরের চোখের সামনে পায়েল আর ইফাজের চেহারাটা ভেসে উঠলো । পরক্ষনেই একটু ভেবে বলল, “আমার কেউ নেই । আমি অনাথ ।” লোকটা তখন বলল, “আহারে । থাকো কোথায় তুমি?” “রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই ।” লোকটা একটু মাথা নিচু করলো । তারপর বলল, “আর যে কতো মানুষকে এই দুনিয়ায় এরকম অসহায় দেখবো আল্লাহ-ই জানেন । তা বলছি কি, আমার একটা অনাথ আশ্রম আছে যশোরের ঝিকরগাছাতে থাকবে ওখানে?” আবির ভাবল, না, কে না কে, চেনা নাই, জানা নেই, যাওয়াটা উচিৎ হবে না । আবার ভাবল, না, গেলে তো ভালোই হয় । এমনিতেই কোথায় থাকবে, তার কোন নিশ্চয়তা নেই । একটা আশ্রয় পেলে তাও না হয় ভাল হয় ।” অগত্যা আবির রাজি হয়ে গেলো । এদিকে ইফাজ পুরো শহরে খোঁজাখুঁজি করবার পরও যখন আবিরকে পেলো না, তখন পুলিশ স্টেশনে একটা মিসিং ডাইরি লিখে এল । বাড়ি ফিরে দেখল, দরজার পাশে একটা চেয়ারে ইফাজের অপেক্ষায় বসে আছে পায়েল । চেহারাটা দেখে মনে হচ্ছে ও নিজেও বেশ ভেঙ্গে পড়েছে । যতোই হোক দোষটা ওর তা ও মনে মনে ধরেই নিয়েছে । ইফাজ আর কিছু বলল না । বেচারি এমনিতেই অনেক কষ্ট পেয়েছে । তবে যা বলেছে, মা হিসেবে নিজের ছেলের ভালোর জন্যই বলেছে । আর তাছাড়া সত্যিই তো, যেহেতু আবির জয়নাল আর জামেনার ছেলে না, তাহলে ও যে কার ছেলে তার তো কোন ঠিক নেই । কে জানে, শেষে যদি সত্যিই কোন গুন্ডা মাস্তানের ছেলে হয় তখন আবার দেখা যাবে জিনের মিলে এই পরিবারেরও নাক কাটাবে । কিন্তু যদি তা না হয়? যদি ও কোন ভদ্র বাড়ির ছেলে হয়, যে কিনা ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে জন্ম থেকেই নিজের পরিচয় হারিয়েছে তাহলে? যাগগে, ইফাজ মানুষ হিসেবে যা দায়িত্ব পালন করার করেছে । খুজেও তো এল, পুলিশকেও বলে এল, খুজে পেলে ভাল না পেলে দোয়া করা ছাড়া কোন উপায় নেই । কিন্তু তাই বলে ইমোশোন তো আর ছাড় দেবে না । যতোই হোক, নিজের ছেলের মতো এতদিন লালন পালন করেছে । কষ্ট তো খানিক হবেই । নিজের ঘরে যেয়ে শুয়ে পড়লো ইফাজ । চোখ দিয়ে সম্ভবত দু-এক ফোঁটা পানি পড়বার উপক্রম হচ্ছিলো, কিন্তু নিজেকে সাম্লে নিলো ইফাজ । পায়েল এসে একবার ঘরটায় উকি দিয়ে গেলো । কিছু বলল না । ইফাজ অবশ্য পায়েলের আগমন টের পেয়েছে, কিন্তু তা জানান দিল না । সকাল ১১টার দিকের কথা । এদিকে খুব শীঘ্রই যশোর ঝিকরগাছা পৌঁছে গেলো আবির । কাধে ওর সেই ব্যাগ । লোকটার সাথে না ও তেমন একটা কথা বলছিল, না আবির তেমন একটা কথা বলছিল । আবির হালকা ভয় পাচ্ছিল, কারণ এই এলাকাটা একটা প্রত্যন্ত নির্জন গ্রাম । লোকজনের সমাগম তেমন বেশি না । তাই একটু লোকটা থেকে পিছিয়েই রইল আবির । একটু পর লোকটা একটা গলির ভেতর ঢুকল লোকটা । আবিরও পিছু পিছু গেলো । এমন সময় লোকটার মোবাইলে একটা কল আসে । লোকটা ফোন কানে নিয়ে ইংরেজিতে কথা বলা শুরু করলো । কথাটার বাংলা করলে এমন হবে, "হ্যাঁ, ছেলেটা আমার সাথেই আছে । কোনোক্রমেই ৯০লাখের কম হবে না । আমি যা বলেছি তাই হবে । নিলে নাও, নইল নাই, লোক আর খুজছে বাচ্চা খোজার জন্য । হে হে, এবার পথে এসো বাছা । বিকেলে টাকা এনে ছেলেটাকে নিয়ে যেয়ো ।" লোকটা হয়তো ভেবেছিল, অনাথ ছেলে, বোধ হয় তেমন ইংরেজি পারবে না । কিন্তু আবির ইংলিশ ভার্সনের ছাত্র, ততটা ইংরেজি না জানলেও কিছুটা বোঝার ক্ষমতা ওর আছে । তাই ও যা বুঝল, এ কোন ভদ্রলোক না, এ বাচ্চা পাচারকারী । লোকটা হঠাৎ বলে উঠলো, "তা তোমার নামটা যেন কি?" পেছন থেকে কোন জবাব এল না । একবারটি পেছনে তাকিয়ে দেখল, আবির পেছনে নেই । ওদিকে আবির লোকটার কথা শুনে দিয়েছে এক দৌড় । কিছুক্ষণ দৌড়োতে দৌড়োতে পেয়ে একটা লোকাল বাস । আবির তো বাবার গাড়িতে স্কুল থেকে ফিরত, কিন্তু ওর অনেক বন্ধুরা এসব লোকাল বাসে উঠে বাসায় ফিরত । ও দেখেছে, যখন বাস আসে, তখন লোকজন হাত বাড়িয়ে গাড়ির সামনে দাড়িয়ে থাকে । সেজন্য আবির হাত বাড়িয়ে দাঁড়ালো, বাসও থামল । বাসে উঠে পড়লো আবির । ভাগ্য ভাল থাকায় একটা সিট পেয়ে গেল । জানালার ধারে বসে আছে ও । বাসের হেল্পার সবার কাছ টাকা তুলতে তুলতে আবিরের কাছে এল । আবিরকে দেখে লোকটা বলল, “এ ছোট ভাই, আপনের বাপ মা কনে? নাকি আপনে একাই উঠিছেন?” আবির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল । লোকটার ডাক শুনে ঘুরে তাকাল । আবিরের লোকটাকে কেমন কেমন দেখতে লাগছিল । কেমন অভদ্র মত, নোংরা জামা পড়া, এতক্ষণ যতোগুলো গালগালাজ দিল, তাতেই অর্ধেক অভদ্রতা ফুটে উঠেছে । আবির বলল, “আমি একাই উঠেছি আঙ্কেল ।” লোকটা টাকা গুণতে গুণতে বলল, “তা টাকা পয়সা আছে নাকি?” ইফাজ ব্যাগ থেকে বাসা থেকে টাকা থেকে ১হাজার টাকা লোকটাকে দেয়ার জন্য টাকাটা হাতে নিয়ে হাত বাড়াল, কিন্তু লোকটা বলল, “বাপরে বাপ, এত বড় নোট ভাংতি হবেন না তো বাপ, ছোট নোট নাই?” আবির ডানে বামে মাথা নাড়াল । লোকটা আলতো হেসে বলল, “থাউকগা, পরে দেখা হলি দি দিয়েনে ।” বলেই লোকটা চলে গেলো অন্যদের ভাড়া নিতে । আবিরের বেশ ভাল লাগলো । যাকে দেখে ভদ্র ভেবেছিলো, সেই হয়ে গেলো ভিজে বেড়াল । আর যাকে অভদ্র ভাবল, সেই হয়ে গেলো একজন ভালো মানুষ । কি আজব! এই যুগে মানুষকে চেহারা দেখে বিশ্বাস করাটা বেশ কঠিন । কেউ বিশ্বাস করে ঠকে, কেউ না করে । তবে বিশ্বাস থাকা ভালো । এতে নিজের ক্ষতি হোক না হোক, অন্যের তো হয় না । আপনি ভালো তো জগত ভালো । বাসটা যশোরের পালবাড়ি রোডের সামনে এসে থামল । আবির চেনেনা, তবুও কেন যেন এখানেই নামতে মন চাইল । বাসের হেল্পার টাকা তোলবার সময় আবিরের দিকে বার বার তাকাচ্ছিলেন । হয়তোবা এই যুগে এরকম একটা ছেলেকে একলা দেখে ওর খারাপ লাগছিল । তাই হঠাৎ আবিরকে না দেখতে পেয়ে অবাক হল । আশেপাশে তাকাল । তারপর কোন এক জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, আবির রাস্তা পার হচ্ছে । জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল । বাস তখন টানতে শুরু করেছে । হেল্পার জানালা দিয়েই আবিরকে “এই মণি, মণি!” বলে ডাকবার চেষ্টা করলো কিন্তু যানবাহনের কোলাহলের ভিড় ঠেলে সেই আওয়াজ পৌঁছল না আবিরের কানে । খুব দ্রুত বাসটা আবিরের থেকে এমন দুরত্বে চলে গেলো, যেখান থেকে আর আবিরকে দেখতে পেলো না ওই হেল্পার । ভেতরে এসে খানিকক্ষণ কি যেন ভাবল । তারপর আবার মন দিল তার কাজে । ওদিকে আবির পালবাড়ির রাস্তার একপাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলো । ঢাকার মত এই এলাকাও তবে অতটাও শহুরে না । এখানে হালকা গ্রামের ছোঁয়া বিদ্যমান । হাঁটতে হাঁটতে আরবপুর মোড়ে এল আবির । পা ব্যাথা করছে খুব । একটু দূরে রাস্তার পাশেই একটা উচু কিছুতে বসবার উপযোগী জায়গায় যেয়ে বসে পড়লো । ব্যাগটা কাধ থেকে খুলে কোলে নিলো । পানির বোতলটা বের করে একটু পানি খেয়ে বোতলটা ব্যাগে রাখতেই চোখ পড়লো একটা ঘড়ির দিকে । আরে! এটা নাবিলার না! আবির ঘড়িটা বের করে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল । আজ স্কুলে গেলে দেয়া হতো মেয়েটাকে ঘড়িটা । থাক, মেয়েটার একটা স্মৃতি তো সাথে রইল । ভবিষ্যতে না চিনলে ঘড়িটা দেখিয়ে চেনাতে পারবে । ঘড়িটা আবার ব্যাগে রেখে ব্যাগের চেইন আটকে সামনের দিকে তাকাল আবির । দেখল একই রকম জামা পড়া কয়েকটা বড় বড় আপু ভাইয়ারা এলাকার ছোট আর গরীব মানুষদের কি যেন দিচ্ছে । আবির সেদিকে তাকিয়ে রইল । সবার গায়ে একই কাল জামা , জামায় লেখা, “আলোকিত সংঘ ।” আবির বসে বসে অদের কাজ দেখছিল । জামায় যে লোগোটা লাগানো, সেরকমই লোগো লাগানো একটা প্যাকেটে কি যেন দিচ্ছে । দেবার ফাঁকে হঠাৎ এক চশমা পড়া ছেলে আরেকজনকে আবিরের দিকে ইশারা করে দেখাল । আবির তখনও বোঝে নি, আবিরকে ইশারা করেছে । যাকে সেই চশমা পড়া ছেলেটা আবিরকে ইশারা করে দেখিয়েছিল, একটু পর সেই ছেলেটা একটা প্যাকেট নিয়ে আবিরের হাতে দিয়ে গেলো । বলল, “নাও ভাইয়া ।” আবির প্যাকেটটা হাতে নিলো । ভেতরে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের প্যাকেটে কি যেন একটা । সম্ভবত বিরিয়ানি, ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে । আবির সেটা বের করে খাওয়া শুরু করলো । খুব খিদে পেয়েছে । চশমা পড়া যে ছেলেটা সবাইকে লিড করছে, তার নাম হাসিব । সে এই টিমের ক্যাপ্টেন । ওদের কাজ, বড়োলোকদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে এবং নিজেরাও যতোটুকু পারে ততোটুকু দিয়ে গরীব মানুষদের সাহায্য করা । ওই টিমের আরেকজন মেয়ে সদস্য রাইসা । আবিরকে যে খাবার দিয়ে গেলো, ওর নাম রিদু । রাইসা তখন রিদুকে বলল, “কিরে? তুই কারে দিয়া আসলি? ওর বেশভূষা দেখে মনে হয় ও গরীব?” রিদু কাজের ব্যাস্ততার মাঝে বলল, “আরে, আমারে হাসিব কইছে ।” হাসিবকে তখন রাইসা বলল, কিরে হাসিব? তুই কি রে?” হাসিব হাল্কা ইয়ার্কির ছলে বলল, তরে দেখলে যেমন বোঝা যায় না তুই কতোটা বদমাইশ, তেমনি অরে দেইখাও বুঝতে পারি নাই । আচ্ছা বাদ দে, পিচ্চি মানুষই তো ।” রাইসা বলল, “ভালো কইরা ভাইবা দেখ কি তুই কি ফালতু একটা যুক্তি দিছিস । আর খাবার যদি শর্ট পরে না, তাইলে তোর ক্যাপ্টেন্সি বাদ ।” হাসিব তখন অন্য দিকে মন দিয়ে বলল, “আইচ্ছা যা, তুই ক্যাপ্টেন হইস । ওই উপমা, ওইদিকটা দ্যাখ ।” একটু এই সংস্থা সম্পর্কে জানা যাক । এরা গরীবদের জামাকাপড়, খাবার-দাবাড় বিতরণ করে থাকে । এদের বিভিন্ন টিম আছে যারা বিভিন্ন এলাকায় কাজ করে । এদের টিমের ১০ জন সদস্য । ৫জন ছেলে, ৫জন মেয়ে । ছেলে পাঁচজন হাসিব, রিদু, গালিব, শাকের শক্তি । মেয়ে পাঁচজন রাইসা, উপমা, সোমা, সাদিয়া আর শিফু । সবাই কাজে ব্যাস্ত কিন্তু সেই সময় সোমার চোখ গেলো আবিরের দিকে । সোমা এই দিকেই কোন এলাকায় থাকে । ফলে এলাকার অনেকের সাথে ওর চেনা জানা সম্পর্ক আছে । কিন্তু এই ছেলেকে তো আগে কখনো দ্যাখে নি । নতুন এসেছে? নাকি আগেই ছিল খেয়াল করে নি? না । এমন হবার কথা না । সবাইকে সাহায্য করার খাতিরেও অনেকের সাথেই দেখা হয়েছে । একে তো কখনো দ্যাখে নি? তাহলে কে এ? হাসিব তখন গালিবের সাথে কি একটা কথা বলছিল এমন সময় সোমা, “আমি একটু আসছি” বলে চলে গেলো কিন্তু গালিবের সাথে কথা বলতে থাকায় ঠিক টের পেলো না হাসিব । সোমা যেয়ে আবিরের পাশে বসলো । সোমা ব্যাগে সবসময় লজেন্স রেখে দিত । যখনই এলাকার কোন ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে দেখা হতো, তখনই একটা করে লজেন্স তাকে দিত । আজ আবিরকে একটা দিল । আবিরের খাওয়া তখন প্রায় শেষ । মুখে শেষ চামচ নিয়ে প্যাকেটটা পাশে থাকা একটা ডাস্টবিনে ফেলবার জন্য উঠতে যাবে, তখনই হাত বাড়িয়ে চকলেট দিল সোমা । আবির একটু আড় চোখে আবিরের দিকে তাকাল । সোমা হাতটা নাড়িয়ে আবার নেবার জন্য ঈশারা করলো । আবির চকলেটটা নিলো । সোমা একটু হাসল । তারপর আবিরকে বলল, “যাও ওটা ডাস্টবিনে ফেলে আস । যেখানে সেখানে ফেলবে না কিন্তু । যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা উচিৎ না ।” আবির “আমি জানি” বলে চলে গেলো সেটা ফেলতে । সোমা ওর কথা বলার ধরণ দেখে বুঝল, ওর ভালোই আত্মসম্মানবোধ আছে । আবির ময়লাটা ফেলে সোমার থেকে খানিকটা দূরে এসে বসলো । সোমা জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছো?” আবির লজেন্সটা মুখে নিয়ে বলল, “ভালো ।” সোমা বলল, “এলাকায় কি নতুন?” “বলতে পারেন ওরকমই ।” “ও আচ্ছা । তা তোমার মা বাবা কি করেন?” আবির আবার আড় চোখে সোমার দিকে তাকাল । জিজ্ঞেস করলো, “আপনাকে তো আমি চিনি তা, তাহলে আমি আপনাকে কেন এসব প্রশ্নের জবাব দেবো?” সোমা একটু নড়ে বসলো । তারপর কিছুক্ষন রাস্তার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবল । তারপর আবার আবিরের দিকে ঘুরে বসে বলল, “আমি সোমা, আমার মা একজন ডাক্তার, আমার বাবা একজন কেমিস্ট, আমি এই এলাকার পাশে এলাকায়েই থাকি, আমার একটা ছোট ভাই আছে যার বয়স ১৩ । দেখলে, আমি তোমাকে চিনি না, তাও সবটা বললাম । এবার তুমি বল ।” আবির হালকা হেসে দিল । তারপর বলল, “আপনার কথা শুনেই বুঝলাম আপনাকে ভরসা করা যায় । কিন্তু এ যুগে এমন অনেক মানুষ আছে, যাদের ভরসা করা যায় না ।” সোমা এবার প্রান খুলে হাসা শুরু করলো । অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, “বাহ! তুমি তো দেখি এই বয়সে অনেক কিছু জানো? তা যখন ভরসাটা করলেই এবার তাহলে জবাবটা দাও ।” আবির একটু ভেবে বলল, “বলব? ঠিক আছে । বলিই । আমার তো আর হারানোর কিছু নেই ।” আবিরের কথা শেষ হতে না হতেই সোমা প্রশ্ন করে বসলো, “হারানোর কিছু নেই বলতে?” আবির একটু শ্বাস ফেলে বলল, “আমি একজন অনাথ, এতিম একটা ছেলে । আমার মা বাবা ভাই কেউ নেই, কোথাও থাকার জায়গাও নেই ।” কথাটা শুনে সোমা একটু কষ্ট পেলো । বলল, “সরি, আমি আসলে বুঝতে পারিনি ।” আবির বলল, “না না, ঠিক আছে । আপনি তো আর জানতেন না ।” সোমা জিজ্ঞেস করলো, “এতদিন কোথায় থাকতে তাহলে?” আবির বলল, "এতদিন যাদের কাছে থাকতাম, তারাও আমাকে নিজের সন্তানের মতোই লালন পালন করতো । তারাও আমার জন্য অনেক করেছে এজন্য আমি তাদের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ । কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে খারাপ লেগেছে তারা আমার মা বাবার কোন খোঁজ খবর না নিয়ে আমাকে নিজেদের কাছে রেখেছিল । তাই আমি নিজে থেকেই তাদের কাছ থেকে দূরে সরে এসেছি ।"সোমা মাথা নাড়াল । তারপর জিজ্ঞেস করলো, "এখানে নতুন এসেছ?" "হ্যাঁ । মাত্রই এসেছি । আর এসেই আপনাদের টিমের কেউ একজন খাবার দিয়ে গেলো । আমার খুব খিদে পেয়েছিল, তাই খেয়ে ফেলেছি ।" সোমা তখন বলল, "তুমি কি একটা আশ্রমে থাকবে?" আবির বলল, "কি আশ্রম?" "অনাথ আশ্রম । যেখানে তোমার মতো আর অনেক মা বাবাহীন ছেলে মেয়ে আছে ।" আবির খানিক ভাবল । থাকা যায়, অন্তত এমন কারো সাথে তো থাকবে, যার কষ্ট ওর কষ্টের মতোই । আবির বলল, "ঠিক আছে । কোথায় এটা?" সোমা বলল, "ভেকুটিয়া ।" আবির জানতে চাইল, "কতোদূর?" "বেশি দূর না । ১৫-২০মিনিটের রাস্তা ।" আবির আর কিছু বলল না । সোমা-ই উঠে দাড়িয়ে বলল, "তুমি এখানে একটু বসো, আমি আমার কাজটা করে আসি ।" আবির মাথা ডানে কাত করলো । সোমা কাজে লেগে পড়তে উঠে গেলো । আবির সেখানে বসে বসেই সোমা ও তার টিমের কাজ দেখতে লাগলো ।
(৪)
বেলা ১২টার দিকের কথা । রান্নাঘরে তরকারিতে লবণ হয়েছে কি না চেক করছিলো পায়েল । এমন সময় দরজায় কলিংবেল বেজে উঠলো । পায়েল হালিমা চাচিকে জানান দিতে জোরে বলল, "হালিমা চাচি, দ্যাখতো কে এসেছে।" হালিমা চাচি তখন ডাইনিং টেবিল মুচ্ছিল । সেখান থেকে বলল, "যাইতাসি আপা ।" পায়েল তরকারিটা ঢেকে একটা ফুলকপি নিয়ে কাটা শুরু করলো । খানিক বাদেই হালিমা চাচি এসে বলল, "ও আপা, দ্যাখো তো, একখান পিচ্চি মাইয়া আইছে । ইস্কুল ডেরেস পইড়া ।" পায়েল অবাক হয়ে বলল, "পিচ্চি মেয়ে? কোন মেয়ে?" হালিমা বলল, "আমি চিনি না আপা । কইল আবিরের বন্ধু ।" পায়েল খানিকক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে রইল । তারপরেই জিজ্ঞেস করলো, "বসতে বলেছ?" হালিমা চাচি বলল, "হ । ড্রইংরুমে বইসা আছে ।" "আচ্ছা, আমি যাচ্ছি, তুমি একটু এই ফুলকপিটা কেটে আলুগুলো ছিলতে থাকো ।" বলেই সেখান থেকে চলে এল পায়েল । ড্রইংরুমে এসে দেখল একটা মেয়ে বসে আছে । পায়েলকে দেখেই দাড়িয়ে যেয়ে সালাম জানাল । পায়েল বলল, "ওয়ালাইকুমুস সালাম । কেমন আছো?" "আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি । আপনি কেমন আছেন?" পায়েল মেয়েটার কাছে এগিয়ে যেয়ে ওর পাশে বসে বলল, "হ্যাঁ মা ভালো আছি । তা তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না?" "আনটি আমি নাবিলা । আবিরের বন্ধু ।" পায়েল আবারো একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলো । তারপর জিজ্ঞেস করলো, "ও । তোমার মা-বাবা কি করেন?" নাবিলা বলল, "আনটি আমার মা সেলিনা, আর আমার বাবা সাখুরা । আমার বাবা নিউক্লিয়াস হাসপাতালের মালিক ।" এই সেই সাখুরা যে সেই নিউক্লিয়াস হাসপাতালের মালিক, যার প্ররোচনায় কতো মানুষ একসময় নির্বিচারে মারা যেত তার কোন হিসেব নেই । শেষ মেশ নিজেকে নিজেকে শুধরেও নিয়েছিলো অবশ্য কিন্তু পেরেছিল কি? যাই হোক, পায়েল তো আর এসবের কিছুই জানে না । তাই কেবল বলল, "বাহ! খুব ভালো । তোমার ভাই বোন কয়জন?" "আমার একটা বড় ভাই আছে নাম লাবিব । ভাইয়া ক্লাস এইটে পড়ে ।" পায়েল বলল, "বাহ, খুব ভালো ।" আবিরের কথা যেন না জিজ্ঞেস করলো সেজন্য এতক্ষণ পায়েল অনেক কথাই বলল, কিন্তু আর কি জিজ্ঞেস করবে? কিছু বলতে না পেরে ভাবতে লাগলো কি বলবে, আর সেই সুযোগটাই কাজে লাগালো নাবিলা । জিজ্ঞেস করলো, "আনটি আবির কোথায়?" পায়েল বলল হঠাৎ করে চমকে উঠলো । আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই নাবিলা আবার বলল, "না আসলে কাল আপনাদের বাসায় এসেছিলাম । তখন আমি আমার ঘড়িটা আপনাদের বাসায় রেখে গিয়েছিলাম । সেটাই নিতে এসেছিলাম আরকি । ভেবেছিলাম আবির স্কুলে আনবে, কিন্তু ওতো স্কুলেই এলো না ।" পায়েল কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না । পায়েলের এমন সময় পাশের বাসার এক পরিচিত মহিলা, যে পায়েলের খুব পরিচিত ঘরে এসেই চিৎকার করে বলতে লাগলো, "ওমা দ্বিপের মা! শুনলাম তোমার আবিররে নাকি পাওয়া যাইতাছে না? তা কই গেছে আবির? হঠাৎ কইরা ক্যামনে হারায় গেলো?" বলতে বলতে মহিলা ড্রইংরুম অবধি চলে এলো । নাবিলা অবাক হয়ে জানতে চাইল, “আনটি আবির……!” কথা শেষ না করতে দিয়েই পায়েল বলে উঠলো, “হ্যাঁ । আবিরকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না ।” এরপর পাশের বাসার মহিলাটা পায়েলকে শান্তনা দেবার জন্য অনেক কথা বলতে লাগলো যার কোনো কথাতেই হয়তো পায়েলের মন নেই । পায়েল শুধু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে । নাবিলা স্থম্ভিত হয়ে গেলো । কিন্তু এখানে বসে থেকেও তো আর লাভ নেই । উঠে দাড়িয়ে ঘরে থেকে বেরোতে লাগলো । যখন দরজার কাছে পৌঁছল, তখন হঠাৎ পায়েল দাড়িয়ে বলল, “শোনো, তুমি আর এ বাড়িতে না এলে খুব খুশি হবো ।” নাবিলা হালকা হেসে পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল, “আবির নেই মানে এখানে এসে কি লাভ? আমার কষ্ট ও ছাড়া কিভাবে নিভবে?” বলেই চলে গেলো নাবিলা । বাড়ির সামনেই ওর গাড়ি দাড়িয়ে ছিল । গাড়িতে উঠে চলে গেলো সে । পায়েল নাবিলার বলা শেষ কথাটার কোন মানে বুঝল না । নাবিলা চলে গেলো । দরজা দিয়ে যতদুর নাবিলার গাড়িটা দেখা গেলো, ততোক্ষণ গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল পায়েল । গাড়িটা দৃষ্টির বাইরে যেতেই পাশের বাসার ভাবির কথায় কান দেয়া শুরু করলো কিন্তু সেভাবে কোন জবাব দেয়া শুরু করলো না । এদিকে আবিরকে নিয়ে সেই আশ্রমে এসে হাজির হল সোমা । ভেকুটিয়া নামক এক এলাকার মাঝে এই আশ্রমটা । রিকশা নিয়ে আশ্রমের সীমানায় ঢুকতেই ছোট একটা উঠোন । উঠোনে কিছু বাচ্চা খেলছিল হঠাৎ রিকশা আসতে দেখে দাড়িয়ে গেলো । যখনি দেখল সোমা এসেছে, সবাই "এই দ্যাখ, সোমা আপু এসেছে, এই দ্যাখ দ্যাখ ।" বলে রিকশার দিকে এগিয়ে এলো । সোমা রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে সবাইকে দিয়ে সবার খোঁজ খবর নেয়া শুরু করলো । আবির পাশে দাড়িয়ে দেখতে লাগলো । পিচ্চিদের মধ্যে একজন বলল, "সোমা আপু, সোমা আপু, আমাদের এবারের ঈদে জামা দেবে না?" সোমা পিচ্চিটার গালে হাত বুলিয়ে বলল, "কেন দেবো না? অবশ্যই দেবো । তবে ঈদের তো অনেক দেরি । ঈদ এলেই দেবো ।" আরেকটা পিচ্চি তখন আবিরকে দেখিয়ে বলে উঠলো, "আপু, ও কি এখন আমাদের নতুন বন্ধু?" পায়েল একবার আবিরের দিকে তাকাল । তারপর পিচ্চিটার দিকে তাকিয়ে বলল, "হ্যাঁ । ও তোদের নতুন বন্ধু । তোদের সাথেই থাকবে । এখন যাই তবে? তোদের নতুন বন্ধুকে ভর্তি করিয়ে আনি?" সবাই সমস্বরে "ঠিক আছে" বলে উঠলো । সোমা আবিরকে নিয়ে আশ্রমের বিল্ডিঙের ভেতর ঢুকল । পিচ্চিগুলো আবারো নিজেদের মতো খেলা শুরু করলো । আশ্রমে ঢুকতেই একটা রিসিপশন রুম । সেখানে দাড়িয়ে বসে একজন রিসিপশনিস্ট । নাম তার পাপলু । লোকটা সোমার চেয়ে অনেক বড় দেখেই বোঝা যায়, তবে ততটাও বয়স্ক নয় । সোমাকে দেখেই পাপলু বলে উঠলো, "কি খবর সোমা? আরেকটা অনাথ এনেছিস?" সোমা আলতো হেসে বলল, "জি আঙ্কেল । আসলে আমাদের কাজ-ই তো মানুষের সেবা করা । দিনে অন্তত একটা না করলে ভালো লাগে না ।" পাপলু উপর-নিচ মাথা নেড়ে বলল, "হুম । তবে, গত সপ্তাহে যে বাচ্চাটাকে এনেছিলে, তাকেও আমি এবারের ক্যাপ্টেন বানাতে পারলাম না । সে তো নিজেকেই সেভাবে সামলাতে পারে নি । ওর ক্লাসকে কি করে সামলাবে?" সোমা বলল, "আমি জানতাম ও পারবে না । আচ্ছা ও যেন কোন ক্লাসের ছিল?" "ক্লাস থ্রি ।" কি যেন লিখতে লিখতে কথাটা বলল পাপলু । সোমা আবিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "তোকে আমি তুই করে ডাকা শুরু করলাম ।" আবির ডানে বামে মাথা কাত করলো । সোমা বলতে লাগলো, "তুই কোন ক্লাসে পড়িস?" আবির জবাব দিল, "থ্রি ।" সোমা তখন পাপলুর দিকে তাকিয়ে বলল, "এই যে আঙ্কেল, আপনার ক্যাপ্টেনকেই এনেছি এবার ।" পাপলু কথাটা শুনে একটু হেসে বলল, "বাহ! তবে দেখা যাক কি হয় । এ পর্যন্ত তোর যে কোন কথাটা মিলে গেছে, সে হিসেবটা ঠিক করা হয় নি ।" সোমা ফু গোছের আওয়াজ করে বলল, "হয়েছে, এবার ফর্মটা পূরণ করুন ।" এরপর আবিরকে দিয়ে একটা ফর্ম পূরণ করালো । শেষে লোকটা সোমার হাতে একটা চাবি দিয়ে বলল, "ক্লাস ৩ এর বিল্ডিং-এর চার তলায় ৪০২নং রুমে ওর জন্য একটা বিছানা ফাকা আছে । ওখানে ও বেশ থাকতে পারবে ।" সোমা বলল, "থাঙ্ক ইউ আঙ্কেল । আসি তাহলে ।" বলেই আবিরকে নিয়ে ভেতরে গেলো সোমা । দরজা দিয়ে বেরতেই একটা রাস্তা । সেই রাস্তা দিয়ে এক পাশে ক্লাস ১, ২, ৩, ৪, ৫ অন্যপাশে ৬, ৭, ৮, ৯ ও ১০ এর বিল্ডিং । প্রতিটা বিল্ডিং ৪তলা করে আর প্রতিটা সিঁড়িতে দুটো করে বিল্ডিং । এরই মধ্যে ক্লাস ৩এর বিল্ডিং এর ৪তলায় আবিরকে নিয়ে গেলো সোমা । বাহির থেকে আবির ভেবেছিলো হয়তো তেমন ভালো না কিন্তু না । বেশ সুন্দর । সিরি বেয়ে ৪তলা উঠলো । চাবিটা ব্যাবহারের প্রয়োজন হল না । দরজা খোলাই ছিল । নক করলো সোমা । প্রথমবার কেউ সারা দিল না । সোমা আবার নক করলো । এবারে ভেতরে কে যেন ক্ষীণ গলায় বলে উঠলো, “কে?” সোমা বলল, "আমি, সোমা ।" ছেলেটা মনে হল তাড়াতাড়ি করে উঠে এসে দরজা খুলল । এরপর "সোমা আপু!" বলেই উল্লাস করে সোমাকে জড়িয়ে ধরলো । ছেলেটার নাম জামি । সোমাই ওকে এনেছে এরকম আবিরের মতো করে । জামি অনেক মোটা । দেখে হালকা হাসল আবির কিন্তু কিছু বলল না । সোমা ব্যাগ থেকে একটা লজেন্স বের করে জামির হাতে দিয়ে বলল, "এই নাও লজেন্স । আরেকটা ছেলে কই, শিমুল নামের?" জামি বলল, "আপু ও একটু বাইরে গেছে । মাত্রই গেলো । তুমি ওর লজেন্সটা আমাকে দাও, আমি ওকে দিয়ে দেবো ।" সোমা জামিকে শিমুলের লজেন্সটাও দিল । তারপর আবিরকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল । এই ইউনিটে তিনটে চারটে ঘর । তিনটে বেডরুম, একটা ডাইনিং রুম । বেডরুম তিনটের সাথে একটা করে বারান্দা আর বাথরুম-টয়লেট । প্রতিটা বেডরুমে একটা করে বিছানা, একটা করে বুকশেলফ আর একটা করে টেবিল রয়েছে । আরও রয়েছে একটা করে আলমারি । ঘরে ঢুকতেই ডাইনিং রুমটা আগে পড়ে । মাঝখানে একটা ডাইনিং টেবিল । একপাশে একটা বেসিং, আর তার পাশেই একটা ফ্রিজ । ঘরের যে দেয়ালে মুল দরজা, সে পাশ বাদে বাকি ৩টে দেয়ালে ওই ৩বেডরুমের দরজা । সামনের দরজা আর ডানের দরজাটা খোলাই ছিল । আর বাম পাশের দরজাটা লাগানো । সোমা আবিরকে নিয়ে ওই দরজাটার দিকেই এগিয়ে গেলো । দরজাটা খুলল । বেশ পরিপাটি করে সাজানো । আবিরকে সোমা বলল, "এই হল তোর রুম । আজ থেকে এখানেই থাকবি । পারবি না?" আবির একটা হাসি দিয়ে সোমার দিকে তাকিয়ে মাথা ডানে কাত করে বলল, "খুব পারবো ।" এরপর সোমা জামির দিকে তাকিয়ে বলল, "আজ থেকে ও তোর বন্ধু । তোরা এক সাথে থাকবি । ঠিক আছে?" জামিও বলল, "ঠিক আছে আপু । শিমুল এলে আমি ওর সাথে কথা বলিয়ে দেবো ।" "আচ্ছা" বলে সোমা আবির আর জামির গালে হাত বুলিয়ে বলল, "আমার তো এখন যেতে হবে । আমি যাই তাহলে?" আবির সোমার হাত ধরে বলল, "আপু, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ । তুমি না থাকলে আমি কখনোই এখানে আসতে পারতাম না ।" সোমা আবিরের দিকে তাকাল । তারপর আবিরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আবিরকে চুমু খেয়ে বলল, "এটা আমার কাজ ভাইয়া । এরপর তোর মতো আর কাউকে পেলে তাকেও এরকম থাকার ঠাই আমারই দেয়া লাগে । আর আমি প্রতি সপ্তাহেই তোদের দেখতে আসি । তাই প্রতি সপ্তাহে দেখা হবে ।" বলে উঠে দাঁড়ালো সোমা । তারপর জামিকে বলল, "জামি, ও তো নতুন, ওকে এখানকার সব নিয়ম শিখিয়ে দিস আর সাহায্য করিস । ঠিক আছে?" জামি বলল, "ঠিক আছে ।" এরপর সোমা দুজনেরই মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলো । দরজাটা বাহির থেকে চাপিয়ে দিতেই জামি আবিরের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, "ফ্রেন্ড?" আবির হাত মিলিয়ে বলল, "ওকে মটু ।" জামি হালকা রাগ করে বলল, "আমাকে মটু বলবি না ।" "আচ্ছা মটু ।" বলে উঠলো আবির । এরপর ওরা বেশ ভালো বন্ধু হয়ে উঠলো । শিমুল খুব তাড়াতাড়িই চলে এলো । শিমুল খুব চিকন কিন্তু অনেক লম্বা । আবির শিমুলের সাথেও বন্ধুত্ব করলো । আবির শিমুলকে লম্বু বলে ডাকলো । জামি আর শিমুল কেন চুপ থাকবে? ওরাও আবিরকে ছোটু বলে ডাকা শুরু করলো । সেদিন রাতের কথা । নিজের ঘরে শুয়ে ছিল পায়েল । এমন সময় অফিস থেকে ঘরে ঢুকল ইফাজ । ইফাজকে দেখে পায়েল উঠে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, "আবিরকে পেলে ।" ইফাজ কোন জবাব দিল না ঠিকই কিন্তু চেহারা দেখে মনে হচ্ছিলো না ওর কাছ থেকে কোন আশানুরূপ জবাব পাবে পায়েল । কিছুক্ষন পর ইফাজ বলল, "আজ থেকে তোমার আর আমার একটাই ছেলে । দ্বীপ । ইফাজ না আমাদের ছেলে ছিলো, না হতে পারবে ।" কিন্তু আবিরের খোঁজটা তো অন্তত নেবে!" বিরক্তির সাথে জবাব দিল পায়েল । ইফাজ তখন বলল, "শোনো । পুলিশ অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু পায় নি । এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছে । তবে মনে হয় না আর পাওয়া যাবে । তাই তোমাকে বললাম । ভুলে যাও ।" পায়েল কিছু বলল না । কিন্তু হালকা কষ্ট পেলো । কারণ যত যাই-ই হোক, ওর কথাতেই তো রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গেছে আবির । ওদিকে আবিরও ওই আশ্রমে নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করলো । প্রতিদিন সকালে ওদের স্কুল থাকে । ক্লাস হয় বিল্ডিঙের ছাদে । সকাল বিকেল রাত একজন কর্মচারী এসে ওদের খাবার দিয়ে যায় । সেই খাবারে বেশ চলে দিনকাল । বিকেলে ওরা খেলাধুলা করে, অন্যান্য অবসর সময় ওরা আড্ডা দেয় । ধীরে ধীরে স্কুলের সবার সাথে পরিচিত হতে থাকে আবির । ও ক্লাস ৩এর প্রিফেক্ট হিসেবেও নির্বাচিত হয় । বেশ কাটতে থাকে আশ্রমে আবিরের দিনকাল । ওদিকে ইফাজের পরিবার থেকেও সবাই ধীরে ধীরে ভুলে যেতে থাকে, আবির নামে কেউ ছিল ওদের ছেলে হিসেবে ।