পরিচয় সিজন২ (পর্ব-২২-৪৪)
পরিচয়(সিজন২)
ঢাকা শহর খোলা মানুষ
(১)
ঢাকা শহর সবসময়ই ব্যাস্ত শহর নামেই পরিচিত । প্রতিনিয়ত মানুষ কোথাও না কোথাও যায়ই । রাস্তায় যানবাহনের জ্যাম নতুন কিছুই নয় । সেরকমই একটা যানজটের রাস্তায় থেমে আছে জয়নাল আর জামেনা যেই বাসে উঠেছিল, সেই বাস । যানজটটা ওদের জন্য একটু নতুন বিষয়ই বলা যায় । কারণ এর আগে গ্রাম ছেড়ে যাবার সময় এবং গ্রামে ফেরত আসার সময় ছাড়া আর কখনই এটার মুখোমুখি হয় নি । যদিও জয়নাল ট্রাক চালানোর সময় জ্যামে পড়তো, কিন্তু সেটাও এতো বড় শহরে না, আবার এতো বেশি জ্যামেও না । জ্যামের মাঝে বাসে অনেক ফেরিওয়ালা উঠে জিনিস ফেরি করছে । জামেনা এক ফেরিওয়ালার কাছ থেকে আবিরের জন্য একটা ঝুনঝুনি কিন্তু । জিনিসটা একটা হাতল আছে যা তিনটে জোড়া লাগানো গোলাকার মাথার সাথে যুক্ত । গোলাকার মাথাগুলোর ভেতর আবার ছোট ছোট বল রয়েছে । হাতল ধরে ঝাকালে ঝুন ঝুন আওয়াজ করে । বাসে কেউ যাচ্ছে দাঁড়িয়ে, কেউ যাচ্ছে বসে । এরা একেকজন একেকরকম । গ্রামে সবাই যেমন এক রকম দেখতে, সেরকম মোটেও নয় । এখানে কাউকে দেখে মনে হয়, গ্রামের লোক । আবার কাউকে দেখে মনে হয় কত বড়লোক যে হবে । জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই বিরাট বিরাট বাড়ি আর দোকানপাট । জামেনা হ্যাঁ করে বাড়িগুলো কততলা গুনবার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না । অনেকক্ষণ পর হেল্পার এসে বলে গেলো, “ভাই, রেডি থাকেন । এরপর কিন্তু আপনাগো নামতে হইবো । জয়নাল আর জামেনা রেডি হয়ে গেলো । জয়নাল পুটলিটা হাতে নিলো, আর জামেনা আবিরকে । কমলাপুর আসতেই হেল্পার ওদের সামনে থেকে ইশারা করে ডাকলো । দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের সাথে গা ঘেষে ঘেষে ওরা বেরোলো । নামার সময় হেল্পার বলে দিলো, “সামনের দোকানগুলোর মাঝ দিয়ে চলে যান, রেললাইন দেখতে পাইবেন । তার ঐপাশেই বস্তি দেখলেই চিনতে পারবেন ।” জয়নাল কৃতজ্ঞতা স্বরুপ লোকটাকে অনেক ধন্যবাদ জানালো । এরপর যতদূর বাসটাকে দেখে যায়, ততদুর তাকিয়ে রইল বাসটার দিকে । বাসটা চোখের আড়াল হতেই ওরা দোকানপাটগুলো মাঝ দিয়ে চলে গেলো । কিছুদুর এগোরেই চোখে পড়লো রেললাইন । তার ওপাশেই বস্তি সহজেই চোখে পড়ে । পাশেই ষ্টেশন । আপাতত কোন ট্রেন নেই । জয়নাল আর জামেনা বস্তিটার কাছে যেতে লাগলো । দূর থেকে একটা মেয়ে ওদের দেখে দৌড়ে এগিয়ে এলো । চেহারা সুন্দর, একটু শ্যামলা । চুল দুই বেনি করা । গায়ে ময়লা সাদা জামা । দূর থেকে চিনতে না পারলেও কাছে আসতেই ওকে চিনতে ভুল হল না । এ তো কলিমা । ওদের গ্রামে ঢুকতেই বা পাশের বাড়িটায় থাকতো । কলিমা জামেনার কাছে এসেই জামেনাকে জড়িয়ে ধরলো । জামেনা বলল, “আরে কলিমা? তোরে দেইখা যে কি ভালো লাগতাসে ।” কলিমা হাসিমুখে বলল, “জামেনা আপা, তোমারে দেইখা আমার মনে হইতাসে আমি স্বপ্ন দেখতাসি । কেমন আছো তুমি?” জামেনা বলল, “আছি আলহামদুলিল্লাহ ভালো । তুই কেমন আছিস?” কলিমা বলল, “এইতো আছি । জয়নাল চাচা ভালো আছেন?” জয়নাল বলল, “আছি মা । তোর বাপ মা আর বড় ভাই কেমন আছেন?” কলিমা বলল, “হ, উনারাও ভালোই আছেন ।” জামেনার কোলে বাচ্চাটাকে দেখে বলল, “ও মা! এইডা তোমার বাচ্চা? কিন্তু শুনছিলাম তোমার নাকি কোন বাচ্চা হইব না?” জামেনা একটু চুপ করে বলল, “যেহানে গেছিলাম, অইহান যাইয়া চিকিৎসা করাইসি ।” কলিমা বলল, “তোমরা এইহানে কার বাড়িত আইছো?” জামেনা আর জয়নাল দুজন দুজনের দিকে তাকাল । কিছু বলল না । কলিমাই ওদের চুপ থাকতে দেখে বলল, “তোমরা কি এইহানে থাকতে আইছো?” জামেনা উপর নিচ মাথা নাড়ল । কলিমা মহাখুশি । সে বলল, “আইচ্ছা । তোমরা এহন আমাগো বাড়িত চল । কাইল আমার বাপ একখান ব্যাবস্থা কইরা দেবেনে তোমাগো জন্য । চল ।” কলিমা জামেনা আর জয়নালকে নিয়ে গেলো ।
ফাইলগুলো ওলটপালট হয়ে আছে । হাসপাতালে একটা মানুষও নেই । একটা দারোয়ানও না । লাইটগুলো কেন যেন হালকা আলো দিচ্ছে । এই আলোর মাঝে কোনোরকমে এগিয়ে যাচ্ছে সাখুরা । ধীরে ধীরে চলে গেলো মর্গের দিকে । মর্গের লাশগুলোও এখানে ওখানে পড়ে আছে । এক মধ্যে একটা লাশ চিনতে অসুবিধা হল না সাখুরার । ওটা জাশিরের লাশ । সাখুরা ধীরে ধীরে সেই লাশটার দিকে এগিয়ে গেলো । কেমন যেন একটা পচা দুর্গন্ধ আসছে লাশগুলো থেকে । সাখুরা জাশিরের লাশটার কাছে আসতেই জাশির চোখ খুলে তাকালো । সাখুরার বুক ধরাস করে উঠলো । হঠাৎ জাশির বলে উঠলো, “কাজটা আপনি ঠিক করলেন না ।” জাশিরের মুখটা কেমন ঘন সবুজ বর্ণের এবং দাঁতগুলো কেমন কালো হয়ে আছে । দেখে কেমন বমি পায় । হঠাৎ জাশির উঠে বসে সাখুরার ঘাড়ে একটা কামর বসিয়ে দিলো আর তখনই ঘুম ভেঙে গেলো সাখুরার । খেয়াল করে দেখল, জন্মদিন পালন করে শুয়ে ঘুমিয়েছিল, আর তারপর সে এই স্বপ্ন দেখেছে । পাশেই ওর স্ত্রী আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিল । সাখুরাকে হঠাৎ এরকম উঠে বসতে দেখে সে-ও উঠে সাখুরার কাছে এলো । পাশে বসে বলল, “কি হয়েছে?” সাখুরা বলল, “একটা বাজে স্বপ্ন । লাশ ছিল সেখানে ।” ওর স্ত্রীর একটু আগে থাকা চিন্তাযুক্ত চেহারাটা এবার স্বাভাবিক হল । বলল, “কতবার না তোমায় বলেছি হাসপাতালের মালিক, মালিকের মতো থাকো । কে কোথায় লাশ কাটে সেখানে যেও না । না, আমার কথা শোনে কে । আর তোমার বন্ধু, জাশির, সে তো ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও লাশ কাটেই আবার ড্যাং ড্যাং করতে করতে তোমাকেও নিয়ে যায় । সাখুরা আর কিছু বলল না । ওর স্ত্রী সেলিনা ওর মাথায় হাত রেখে বলল, “ইশ! জ্বর-ও এসেছে দেখছি । শুয়ে পড় । আমি তোমার জন্য প্যারাসিটামল আনছি ।” “কিছু হবে না আমার । ঘুমোলেই সেরে যাবে ।” সেলিনা যেতে যেতে বলল, “কোন জেদ দেখালেও হবে না ।” সেলিনা চলে গেলো । সাখুরা আবার শুয়ে পড়লো । ভাবতে লাগলো, জাশিরের কি অবস্থা ।
(২)
এদিকে গ্রামে চেয়ারম্যান ফয়সাল বাড়ির সামনে বসে ছিলেন । এমন সময় এলাকার হাসপাতালের ডাক্তার এলেন যিনি ডাক্তার জাশিরের চিকিৎসা করছেন । নাম তার আকরাম । এসে সালাম জানিয়ে ফয়সালের পাশে রাখা একটা চেয়ারে বসলেন । চেয়ারম্যান ফয়সাল সালামের জবাব দিয়ে বললেন, “ঐ লোকটার কি অবস্থা?” আকরাম বললেন, “চেয়ারম্যান সাহেব, অবস্থা আগের তুলনায় আলহামদুলিল্লাহ্ ভালোই আছে । কিন্তু কণ্ঠনালিতে হয়তো আঘাত পেয়েছে । যার জন্য কথাটা ঠিক মতো না উনি বলতে পারছেন, না আমি বুঝতে পারছি । তবে ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে আশা করছি ।” “হুম। আর প্লাস্টিক সার্জারি না কি সব বলে, ওসব কিছু কি করা লাগবে নাকি?” “না, সেসবের দরকার নেই । চেহারার তেমন ক্ষতিও হয় নি । তবে চেহারাটা হালকা বিকৃত হয়ে গেছে এই যা । উনার পরিচিতজনেরা উনাকে চিনতে পারবেন কি না, এটাই সমস্যা ।” ফয়সাল আর কিছু বললেন না । ডাক্তার আকরামের মোবাইলটা বেজে উঠলো । ফোনটা রিসিভ করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় কি যেন বলল, আর সেটা শুনে উনি চমকে “কি!” বলে একটা চিৎকার করে উঠে দাঁড়ালেন । উনার কথা শুনে চেয়ারম্যান ফয়সালও উঠে দাঁড়ালো । বলল, “কি হয়েছে?” আকরাম বললেন, “ওই লোকটা নাকি হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়েছেন ।” ফয়সাল তখন চিন্তিত হয়ে বললেন, “সে কি! তাড়াতাড়ি সবাইকে বলো উনাকে খোজার জন্য ।” ডাক্তার আকরাম তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে গেলো । চেয়ারম্যান ফয়সাল আবার বসে পড়লো । ভাবতে লাগলো কি হবে এখন । লোকটা এমনিতেই অসুস্থ । তার মধ্যে কোন কারণ ছাড়াই হুট করে চলে গেলো । আচ্ছা, আসলেই কি উনি কারণ ছাড়াই পালালেন? নাকি অন্য কোন কারণ আছে? আচ্ছা, ঐ লোকটা, এই গ্রামের কেউ না, কি করে এলো এখানে? তাও আবার যখন আগুন লাগলো সেই সময়েই? এরকম নানা প্রশ্ন চেয়ারম্যান ফয়সালের মনে বারবার ঘুরতে লাগলো ।
এদিকে জামেনা আর জয়নাল তাদের বাচ্চা আর পুটলিটা নিয়ে বস্তিতে কলিমারা যে ঘরটায় থাকে, সেখানে গেলো । ঘরটাকে ঘর বললে যেন ঘরের অপমান হবে । এটাকে বলা চলে কোনরকমে মুখ গুজে বেচে থাকার ঠাই । ছোট একটা টিনের দেয়াল আর চাল দেয়া ঘর । সেখানে পুরনো ভাঙ্গা কাঠ জোড়া লাগিয়ে কোনোরকমে একটা খাট বানিয়ে সেখানে রাতে কলিমা আর ওর মা সালমা ঘুমায় । এক পাশে দুটো চেয়ার একসাথে লাগিয়ে সেটার ওপর কাপড় বিছিয়ে ঘুমায় কলিমার বাবা রাজিব । কলিমার ভাই রায়হান বেশিরভাগ রাতই স্টেশনের পাশেই কখনো আড্ডা দিয়ে, কখনো কোনোরকমে পাশেই কিছু বলার বেঞ্চির ওপর ঘুমায় । রায়হান আবার এখানকার মাস্তান । বস্তির যতো ছোট বড় মানুষ, তাদের আকুতি-মিনতি সব রায়হানকে জানায়, আর রায়হান তা নিজের যথাসাধ্য দিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করে । ঘরের সেই অদ্ভুত খাটের ওপর বসে সালমার কাছে থেকে সব কথা শুনছিল জামেনা । জয়নাল তখন গেছে রাজিবের সাথে মাথা গোঁজার ঠাই খুজতে । কলিমাদের পাশেই একটা যায়গায় দুই নিঃসন্তান দম্পতি কিছুদিন আগে মারা গিয়েছে । বস্তির কিছু লোকজন তাদের দামি দামি অনেক জিনিস নিয়ে গেলেও পড়ে আছে একটা ভাঙ্গা চারপায়া আর কিছু সুতো বাধা চেয়ার । ঠিক হল আজ থেকে এখানেই থাকবে জামেনারা । কলিমাদের বাসার পেছনে মাটির চুলায় একসাথে রান্না করে ওরা খাবে । সেদিন পুরোটা সময় ওদের কেটে গেলো ঘর গোছাতে গোছাতে ।
এদিকে রাত ৮টার কথা । চেয়ারম্যান ফয়সাল বাড়ির সামনে একবার এপাশ থেকে ওপাশ আবার ওপাশ থেকে এপাশ হাঁটাহাঁটি করছিলেন । উনি যে করেই হোক লোকটাকে চান । কারণ শুধুমাত্র ঐ লোকটাকে পেলেই সব প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে । চেয়ারম্যান ফয়সাল অনেক লোক পাঠালেন । কেউ কোন খোঁজ পেলো না জাশিরের ।
এদিকে নিজেদের থাকার জায়গা বানানো শেষে জয়নাল রাজিবের সাথে গেছে কাজের খোঁজে । রাজিব জয়নালের চেয়ে এক বছরের ছোট হলেও দুজন দুজনকে তুই করে কথা বলতো । যদিও জয়নাল এতে কিছু মনে করতো না । হাটতে হাটতে ওরা রেললাইনের পাশে এসে বসলো । এতো রাতেও কত লোক । গ্রামে এরকম পরিস্থিতি কখনো দেখেনি জয়নাল । কাজ প্রসঙ্গে কথা উঠলে রাজিব বলে, “শুরুতে এইখানে এসে অনেক চিন্তায় ছিলাম কি করমু । তুই তো তাও আমারে পাইলি । আমার তো তখন এইখানে পরিচিত কেউই ছিল না । পড়ে এইখানকারই একখান দোকানে এক বয়স্ক লোক জিনিস বেচাকেনা করতো তার কাজে সাহায্য করা শুরু করলাম । পড়ে লোকটা এইখান থেকে দোকান তুইলা কই জানি গেলো আর তার হদিস পাই নাই ।” বলতে বলতে থেমে গেলো রাজিব । জয়নাল ওর নীরবতা ভাঙ্গাতে জিজ্ঞেস করলো, “তারপর কি করলি?” রাজিব বলল, “এহন এইহানে, ঐহানে পেলাস্টিক, কাগজ, এইসব কুড়াইয়া বিক্রি কইরা ট্যাকা কামাই করি । আমারে কলিমা আর রায়হান সাহায্য করে আর কি ।” “ভালো কথা, রায়হান কই? ওরে তো দেখলাম না?” “দেখ কই যাইয়া কার লগে আড্ডা দিতাসে । আর নাইলে বস্তির পলাপাইন লইয়া মাস্তানগিরি করতাসে ।” জয়নাল হালকা হাসল । কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ । তারপর জয়নাল জিজ্ঞেস করলো, “আইচ্ছা, তুই তো কইলা ঐ বয়স্ক লোক চইলা গেছে । তো এইখানে কি আর কোন দোকান নাই? যেইখানে তুই কাজ করতে পারতি?” জবাবে রাজিব বলল, “আছে তো, দোকান ভালোই আছে । তয়, ছোটখাট দোকানপাট । জিনিস বেইচা ওদেরই পেট চলে না, আমার আর কি চলবো । ঐ বয়স্ক লোকডা বয়সের ভাঁড়ে সব কাজ করতে পারতো না, তাই আমারে রাখসিলো ।” জয়নাল আশে পাশে তাকাল । আশেপাশে অনেক দোকান । কিন্তু সবগুলো টিন দিয়ে বানানো দোকান । কিন্তু আশেপাশে যেসব মানুষ দেখা যাচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই এসব দোকান থেকে তেমন কিছু কেনে না ।” জয়নাল দেখেছে সিনেমাতে । বড়লোকরা ছোট ছোট দোকানে যায় না । যদিও এটা সবাই করে না । বড়লোকদের মধ্যে অনেকে ভালোও আছে ।
(৩)
চুলার পাশে সে সময় বসে গল্প করছিলো জামেনা আর সালমা । পাশে কলিমা বসে বসে হাতে চিনি নিয়ে চেটে খাচ্ছে । সালমা আগুন জালানো চুলায় থাকা ভাতের হাড়ির ভাত চামচ দিয়ে নাড়াতে নাড়াতে বলল “আর কইস না বুইন । গেরামের কথা কত্ত মনে পড়ে । কিন্তু কি করুম । গেরামে তোর রাজিব ভাই যে কামডা করতো, সেইডা তো আর হাতে থাকল না ।” জামেনা বলল, “ক্যান বুইন? কি হইসিল?” ভাতটা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে সালমা বলল, “তুই তো জানিস-ই, রাজিব একখান বাড়িত দারোয়ানের কাম করতো । সেদিন একখান চুরি হইসিলো, ওরা দোষ দিলো তেনার ওপর । অথচ তিনি চুরি করেন নি । খুব বড় কিছু চুরি হয় নাই । তাও ২ বছর জেল খাটছে তিনি । এই ২ বছর গেরামের লোকজনের সমালোচনা আর ট্যাকার অভাবে কত যে কষ্টে ছিলাম । পড়ে যেইদিন চইলা আইলেন, গেরামের লোকজন আমাগো লগে মেশা বাদ দিয়া দিলো । ওরে কেউই কোন কাম দিতেসিলো না । পড়ে চইলা আইসি এইখানে । জামেনা বলল, “সত্যি । গেরামের লোকজন যে কি হইছে ।” “শুধু কি তাই, ঐ জামিলা মা তো চেয়ারম্যানের কাছে আমাগো নামে আরও অনেক উল্টা পাল্টা কথা ছরাইসে ।” কথাটি বলতে বলতে চুলা থেকে ভাত নামিয়ে পাশে রেখে তরকারির পাতিলটা তুলে দিলো । জামেনা আর কিছু বলল না । কলিমা হাত বাড়িয়ে বলল, “ওমা, আরেকটু চিনি দেও ।” সালমা রাগ করে বলল, “খালি খাই খাই করে । চিনি কম আছে । আইজকা আর পাবি না ।” ওপাশের বাড়ি থেকে কোন এক মহিলা জোড় গলায় বলল, “ও কলিমার মা? খড়ি আছে নি? থাইকলে এল্লা কষ্ট কইরা দিয়া যাও না গো ।” সালমা “দিতাসি” জবাব দিয়ে কলিমার হাতে কিছু খড়ি দিয়ে বলল, “যা তো, এইডি দিয়া আয় ।” কলিমা খড়ি নিয়ে চলে গেলো । সালমা জিজ্ঞেস করলো, “ভালো কথা, তোর পোলা কই?” “ওরে ঘুম পাড়াইয়া রাইখা আইসি ।” সালমা বলল, “বাচ্চাডারে একটু সাবধানে রাখিস । এইহানে আবার ছেলেধরার অভাব নাই । দুইদিন আগেই তো একখান বাচ্চারে নিয়া গেছে ।” জামেনা কিছু বলল না । চুপ করে তরকারি তে ঝোলের বুদবুদ দেখতে লাগলো ।
এদিকে জয়নাল তখন রাজিবকে বলল, “চল, আমরা এইহানে একখান ভালো দোকান দেই ।” রাজিব জিজ্ঞেস করল, “ভালো দোকান মানে?” “ওই যে, বড় বড় মানুষরা যে খায় । কি জানি কয়, রেস্টুররে না কি জানি ।” রাজিব বলল, “ও হ । তয় ট্যাকা পামু কই?” জয়নাল বলল, “ট্যাকার চিন্তা তুই করিস না । আগে ক, কাম করবি কি না ।” রাজিব কেবল মাথা নাড়িয়েছে, জয়নাল ওর হাত ধরে ওকে নিয়ে গেলো ষ্টেশন মাস্টারের কাছে । ষ্টেশন মাস্টারকে রাজিব আগে থেকেই চেনে । লোকটা মোটামুটি বয়স্ক । মুখে বড় বড় দাড়ি । গায়ে একটা ঢিলে পাঞ্জাবী । মাথায় গোল তুমি । চোখের নিচে সুরমা মাখা । মোচ নেই । টুপি দিয়ে মাথা ঢাকা থাকায় ঠিক বোঝা গেলো না মাথায় চুল কতটা । তবে মুখটা গোলগাল, শরীরের অনুপাতে একটু ছোট । লোকটা জয়নালের কথা শুনে খিল খিল করে হেসে উঠলো । তারপর বলল, “এ তো দেখি বামুন হয়ে চাদে হাত বাড়ানোর মতো কথা । তা কি করে করবেন শুনি?” জয়নাল বলল, “আমার কাছে অনেক ট্যাকা আছে , সেই ট্যাকা দিয়াই বানাইতে চাই ।” ষ্টেশন মাস্টার জিজ্ঞেস করলেন, “বাহ, তা কত আছে?” “৩৫ হাজার ।” জয়নালের মুখে কথা শুনে লোকটা আবার হেসে গড়িয়ে পড়লো । তারপর হাসি অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলে, “আপনি মনে হয় এইখানে নতুন না?” জয়নাল উপর নিচ মাথা নাড়ল । লোকটা তখন রাজিবকে বলল, “এ রাজিব, তুই এই লোকরে ঢাকা শহরের কথা কিছু বলিস নাই?” রাজিব কিছু বলল না । ষ্টেশন মাস্টার তখন বলল, “কিছু মনে কইরেন না । একখান কথা কই । আপনার কাছে যে ট্যাকা আছে, এই শহরের বড়লোক পোলাপাইনদের পিছে মাসে এর চেয়ে বেশি খরচ হয় ।” জয়নাল কেন যেন লজ্জা পেলো । এ কথা শুনে সে অবাক । গ্রামের ছেলেমেয়েরা পাপড়ওয়ালার কাছ থেকে পাপড় আনতে ১টাকাও অনেক কষ্টে মায়ের কাছ থেকে নিতে পারে না, আর এ শহরে ছেলেমেয়েদের পিছে এতো খরচ হয়? ষ্টেশন মাস্টার তখন বললেন, “তা এখন কি ভাবছেন?” জয়নাল কিছু বলল না । সেখান থেকে বেড়িয়ে এলো । রাজিবও জয়নালকে কিছু বলতে পারলো না । সারারাত ট্রেনের আনাগোনার শব্দে ঠিক মতো ঘুম হয় নি জামেনা আর জয়নালের । তারপরও খুব সকালে জামেনা উঠে গেলেও ওঠেনি এখনো জয়নাল । হঠাৎ বাইরে খুব হইচই-এর আওয়াজ শুনে ঘুম ভাঙল জয়নালের । বাইরে এসে দেখল, বস্তির ৩ জন লোকের সাথে কথা বলছে জয়নালকে দেখেই রাজিব তার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, “ওই যে, এইডা উনারই বুদ্ধি ।” সবাই জয়নালের দিকে এগিয়ে এলো । ওরা এই বস্তিরই লোক । সবাই জয়নাল এই কাজ মেনে নিলো । সবাই নিজেদের জমানো টাকার মধ্য থেকে ৩ হাজার দিতে রাজি । এতে মোট ৪৭হাজার টাকা জমা হল যেটাও এই কাজের জন্য অনেক কম ।
এদিকে সকালে কাজের জন্য হাসপাতালে এলো সাখুরা । নিজের চেম্বারে ঢুকতেই সাখুরা অবাক । স্বপ্নের মতো সব ফাইল এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । সাখুরা খুব ভয় পেলো । তখন মর্গের ঘটনাও সত্য কিনা জানার খুব ইচ্ছে হল । তাই নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই যেতে লাগলো মর্গের দিকে । স্বপ্নের মতো এখানে আলোর কমতি নেই । স্বপ্নের মতো এখানে লোকজনের অভাব নেই । এবং মর্গে ঢুকতেও দেখল, না, সব তো ঠিকই আছে, স্বপ্নের মতো এখানেও কোন গণ্ডগোল নেই । সাখুরা একটা দম ফেলল । যেন দমের সাথে সব ভয়ও বেড়িয়ে গেলো । এমন সময় হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বলে উঠলো, “স্যার” সাখুরা চমকে লাফিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল, জাশিরের পিএ রহিম দাঁড়িয়ে । হাতে একটা কাগজ । সাখুরা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “Nonsense কোথাকার! এভাবে কেউ হুট করে ডাকে নাকি!” রহিম তখন বলল, “সরি স্যার, আসলে জাশির স্যার এই চিঠিটা আপনাকে দিতে বলেছেন তো । তাই আপনাকে এখানে দেখে দিতে এলাম ।” সাখুরা ওর হাত থেকে কাগজটা কেড়ে নিয়ে বলল, “জাশির কোথায়?” রহিম বলল, “জানি স্যার । উনি বললেন আপনি যদি কিছু জানতে চান, এতে সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন । তবে কি জানেন স্যার, উনার মুখটা দেখে মনে হচ্ছিলো পুইড়া গেছে । আমি তো প্রথমে চিনতেই পারি নাই । পড়ে আইডি কার্ড দেখে চিনলাম ।” সাখুরা ওকে যেতে বলল । ও চলে গেলে সাখুরা চিঠিটা খুলে দেখল, তাতে লেখা, “জানি, আপনার প্রথম প্রশ্নটাই হচ্ছে আমি কি করে বেচে ফিরলাম । সেটা জানার অধিকার আপনি হারিয়েছেন । কিন্তু এটুকু বলব, আল্লাহ আমাকে বাছিয়েছেন । আমি আর খারাপ কাজ করবো । ডাক্তারের পদ থেকে আমি সরে এলাম । আমাকে আর কখনো আপনি খুজে পাবেন না । হয়তো দেখেও আমাকে আপনি চিনতে পারবেন না । আর হ্যাঁ, আপনি আমাকে এতোটাও বোকা ভাববেন না ।” সাখুরার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো । তাড়াতাড়ি দৌড়ে চলে এলো সিসিটিভি রুমে । দেখলো, আজ সকাল থেকে কিছুই রেকর্ড করা হয় নি । সিসিটিভির দায়িত্বে ছিলেন রাকিব শেখ নামের এক লোক । সাখুরা সেই রাকিবকে বলল, “কি ব্যাপার? আজ কিছু রেকর্ড করা হয় নি কেন?” জবাবে লোকটা যা বললেন, তা শুনে সাখুরা জাশিরের চিঠির “আর হ্যাঁ, আপনি আমাকে এতোটাও বোকা ভাববেন না ।” লাইনটার মানে স্পষ্ট হয়ে গেলো । লোকটা বলল, সকালে জাশির নাকি ফোন করে বলেছে আজ একটা খুব গোপনীয় কাজ হবে, তাই ভোর ৫টা থেকে দুপুর ৩ টা পর্যন্ত সিসিটিভিতে কিছু যেন রেকর্ড না করা হয় । সাখুরা আর কোন উপায় পেলো না । কারণ রহিমের ভাষ্যমতে ওর চেহারার পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের এই প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মাঝে জাশিরকে খোঁজা অসম্ভব । জাশিরের আপনজন কেউ ছিল না । একটা বাসা ছিল যেখানে ও আর ওর দেখাশোনার জন্য ওর কাজের লোক ছিল । জাশির বিয়েও করে নি । সাখুরা আর সময় বিলম্ব না করে চলে গেল জাশিরের বাসায় ।
(৪)
এদিকে আর কম টাকায় রেস্টুরেন্ট তোলা যাবে না জন্য জয়নাল হতাশ হয়ে যেই বাড়ির দিকে মুখ ফেরালো, সেই পেছন থেকে ওর স্ত্রী জামেনা এসে ডাকলো । জয়নাল পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, মাথায় ওড়না দিয়ে হাতে একটা মাঝারি আকারের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জামেনা । জয়নাল ওর কাছে এসে বলল, “কই গেছিলা তুমি?” জামেনা ব্যাগটা জয়নালের হাতে দিয়ে বলল, “এর মধ্যে লাখ তিনেক ট্যাকা আছে । দ্যাখো, এই ট্যাকা দিয়া কিছু করতে পারো কি না ।” জয়নাল ব্যাগটা খুলে দেখল, সত্যি এর মধ্যে লাখ তিনেক টাকা । জয়নাল অবাক হয়ে জামেনার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এতো ট্যাকা কই পাইলা?” জামেনা বলল, “আমার যতো গয়না ছিল, ঐগুলা বিক্রি কইরা আনছি ।” জয়নাল তখন জামেনাকে বলল, “ক্যান করলা এইডা? ঐগুলা তো তোমার গয়না ।” জামেনা তখন বলল, “আগে দোকান হইয়া যাক, তারপর আমারে গয়না কিনা দিও ।” বলেই একটা মিষ্টি হাসি দিলো । জয়নাল আর জামেনা অনেকক্ষণ দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে রইল । একটু দুরেই দাঁড়িয়ে থাকা রাজিব আর ওর সাথে থাকা বাকি তিনজনও তাকিয়ে রইল ওদের দিকে । একটু পর রাজিব ইয়ার্কি করে তিনজনকে বলল, “আরে ঐদিকে কি দ্যাখো, সিসি, চোখ বন্ধ কর ।” জামেনা লজ্জা পেয়ে মুচকি হেসে ভেতরে চলে গেলো । রাজিব জয়নালের কাছে এসে বলল, “তোর বউ তোরে কত ভালোবাসে ।” জয়নাল তখন বলল, “ক্যান, তোর বউ মনে হয় বাসে না?” রাজিব তখন বলল, “ধুর ধুর । এহন ওরে যদি কই গয়না কয়ডা বেইচা ট্যাকা দেও, গয়না তো দিবোই না, দিবো একখান ঝাটার বারি । জয়নালও তখন রাজিবের কানের কাছে এসে বলল, “শোনো, আমার বউও না যখন রাগে, তখন পাগলি হইয়া আমারে মারতে আসে । মানে কওয়া যায়, এইডা মহিলাগো একখান স্বভাব । এমন সময় পেছন থেকে মহিলা কণ্ঠে দুজন বলে উঠলো, “কি কইলা?” রাজিব আর জয়নাল পেছনে তাকিয়ে দেখল, জামেনা আর সালমা দাঁড়িয়ে ।” ঝেড়ে দুজনে দিলো দৌড় । বউও কম কিসে, ওরাও দিলো এক দৌড় । রেল লাইনের পথ ধরে ওদের এই দৌড় যেন এক অন্যরকম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ । সেদিন বিকেলে জয়নাল আর রাজিব ঐ তিনজন লোক সাথে নিয়ে আবার গেলো সেই ষ্টেশনমাস্টারের কাছে । ষ্টেশন মাস্টার তো দেখে হা । এতো টাকা এক দিনে! কি করে! লোকটা এক গ্লাস পানি খেয়ে বলল, “আচ্ছা, আমি তাহলে ষ্টেশন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলব ।” জয়নাল আর রাজিব সাথে অন্যান্য লোকজনও খুব খুশি । সবাই ষ্টেশনমাস্টারকে সালাম জানিয়ে বেড়িয়ে এলো । কেউ একজন গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে তখন ওদের ফলো করতে থাকে । যদিও রাজিব আর জয়নাল সাথে বাকি লোকগুলো সেটা টের পায় না । জয়নাল বলে, “আলহামদুলিল্লাহ্ । ভালোই হইলো । আমাগো একখান কামের ব্যাবস্থা হইলো ।” তিনজন লোকের মধ্যে একজন বলে উঠলো, “হ ভাই । আপনে ছিলেন বইলা আমরাও সাহস পাইলাম ।” জয়নাল তখন বলল, “ও, তোমাগো নাম-ই তো শোনা হইলো না ।” ওরা যে যার পরিচয় দিলো । মোচওয়ালা মাঝারি লোকটার নাম লেবু মিয়া । লম্বা চিকন লোকটার নাম বাবুল । আর মোটা আর খাটো লোকটার নাম পাপ্পু । হঠাৎ কথা বলার মাঝে কোত্থেকে পিছু নেয়া সেই লোকটা এসে জয়নালের হাত থেকে টাকার ব্যাগটা নিয়ে দিলো এক দৌড় । জয়নাল কিছু বাকিরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই জয়নাল দিলো লোকটার পিছে একটা দৌড় । বাকিরাও খানিক বাদে চোরটাকে ধরার জন্য দৌড় দিলো । সামনে স্টেশনের সীমানা শেষ । চোরটা বামে যেয়ে সবার চোখের আড়ালে চলে গেলো । জয়নাল যখন দেয়ালের ওপাশে গেলো, যেয়ে দেখল, সেই লোকটা মাটিতে শুয়ে কাঁপছে । টাকার ব্যাগটা পাশেই পড়ে আছে। আর তার সাথে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে রাজিবের ছেলে রায়হান । সাথে বস্তি পিচ্চি ছেলেমেয়েও ছিল । রায়হান অনেক লম্বা । চেহারা খুব সুন্দর । শুধু শ্যামলা । মাথার চুল খসখসে । তাই উচু করে রাখতে ওর আলাদা করে জেলও দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না । চুলটা আলতো উপরের দিকে আঙ্গুল দিয়ে নাড়িয়ে বলল, “বলিউডে সালমান খান, ঢালিউডে শাকিব খান । আর এই কমলাপুর বস্তিতে………” রায়হান থেমে গেলো । সাথে সাথে পিচ্চিগুলো একসাথে বলে উঠলো, “রায়হান, রায়হান, রায়হান ।” রায়হান তখন ব্যাগটা হাতে নিয়ে জয়নালের কাছে এলো । রাজিব আর বাকিরাও এসে পড়েছে । জয়নাল রায়হানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আরে রায়হান বাবা, তুমি আজকে কত বড় একখান উপকার যে করলা ।” রায়হান তখন বলল, “চিন্তা করবেন না জয়নাল চাচা, আমার জন্ম সব মানুষের সেবার জন্য । নাম আমার রায়হান, নই খারাপ মাস্তান, করি শুধু সেবা দান ।” জয়নাল হেসে হেসে বলল, “ভালা কইছো । তোমারে দেইখা ভালোই লাগলো ।” রাজিব তখন বলল, “যাক, তোর পড়াশুনা না কইরা এইসব আকাম অন্তত আমাগো একখান উপকারে আইলো ।” রায়হান আবার চুল আঙ্গুল দিয়ে নাড়িয়ে বলল, “বাবা, এটা আকাম নয়, এটা ভালো, ছেড়ে দেবো, যদি একবার বলো ।” রাজিব তখন বলল, “যা তো যা । সারারাত বাড়িত যাস নাই, যাইয়া এল্লা খাইয়া নে ।” রায়হান বলল, “না বাবা না । কি যে বলো । এখন খাওয়ার সময় না । পিচ্চিবাসি, চলো ।” তারপর রায়হান ওর পিচ্চিদের নিয়ে চলে গেলো । জয়নাল বলল, “তোর ছেলে হইছেও, একখান জিনিস ।” রাজিব বলল, “ধুর ধুর, এইসব জিনিস দিয়া কি হইবো । পড়াশুনা করে না । ভাবতেসি ঐ দোকান বানাইলে ওরে কামে লাগায় দিমু । জয়নাল আর কিছু বলল না । সবাই আবার বস্তিতে চলে এলো ।
এদিকে সাখুরা গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেলো জাশিরের বাসায় । বাসায় গেইটটা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই বিরাট এটা বটগাছ । তার পাশেই একটা ছোট ঘর সব সময় তালা দেয়া থাকে যেখানে জাশির লাশ কাটতো সাখুরা সেখানে যেয়ে দরজা তালা দেখে বুঝল, জাশির এখানে নেই । কিন্তু এখানে এলে আগে লাশ পচা
(৫)
একটা জঘন্য গন্ধ পাওয়া যেতো । এখন সেই গন্ধটা কেন যেন পাওয়া যাচ্ছে না । কিন্তু সাখুরা ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দিলো না । ঘরে ঢুকতেই দেখল, কাজের লোক জাবেদ ডাইনিং টেবিল মুছছে । সাখুরা কে দেখেই জাবেদ সাখুরার কাছে এলো । “আরে সাখুরা স্যার, ভেতরে আসেন স্যার । একখান ঘটনা ঘটসে ।” সাখুরা ঘটনা জানতে চাইলে জাবেদ জানায়, জাশির এখানে এসেছিলো আজ সকালে । তারপর ঐ ঘরটার পাশে গর্ত করে কি যেন করেছে । সাখুরা বোঝে, হয়তো সেই রুমে রাখা লাশগুলো দাফন করেছে । জাবেদ আরও জানায়, এরপর নিজের ঘরে যেয়ে জাশির কিছু জিনিস নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে আর যাওয়ার আগে সব জমিজমা জাবেদের নামে করে দিয়ে যায় । জাবেদ নিজের পরিবারের লোকজন আসতে বলেছে, তাই ঘর গোছাচ্ছে । সাখুরা জাবেদকে একটা চড় দিয়ে বলল, “লজ্জা করে না তোমার? তোমাকে জমিজমা দিয়ে দিলো আর তুমিও ড্যাং ড্যাং করে সব নিয়ে নিলে? আর ওকে আটকাতে পারলে না?”জাবেদ কেদে কেদে বলল, “আমি কি করবো স্যার? আমি উনারে অনেক মানা করলাম । কিন্তু কে শোনে কার কথা । উনারে জিগাইলাম কই যান, উনি কইল যেইহানে দুই চোখ যায় সেদিকে । আমি উনারে অনেক মানা করলাম যাইতে, তাও উনি চইলা গেলেন । আর কইলেন, কখনো ফিরা আইবেন না ।” সাখুরা এবার কি করবে বুঝতে পারলো না । কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলো, “কখন গেছে এখান থেকে?” জাবেদ তখন বলল, “মিনিট দশেক হইব ।” সাখুরা আরও রেগে বলল, “এ কথা আরেকটু আগে বলতে পারলে না?” বলেই বেড়িয়ে এলো সাখুরা । গাড়ি নিয়ে আশেপাশের এলাকা অনেক খুজলো কিন্তু পেলো না ।
সেদিন বিকেলের কথা । ঘরে বসে আবিরের গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল জয়নাল । এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে বাহির থেকে এলো রাজিব । জোরে জোরে স্বাস নিতে নিতে বলল, “বাইরে আয়, দ্যাখ, কে আইসে ।” জয়নাল রাজিবের সাথে বাইরে এসী দেখল, কোট প্যান্ট পড়া দুজন লোক । রাজিব বলল, “এনারা এই রেইল ইষ্টিশনের কর্মকর্তা ।” উনাদের মধ্যে বেশ বয়স্ক করে একজন এগিয়ে এলো জয়নালের কাছে । এসে বলল, “আপনিই তাহলে জয়নাল?” জয়নাল উপর নিচ মাথা নাড়াল । লোকটা তখন জয়নালকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, আপনার মাথায় হঠাৎ এই রেস্টুরেন্ট বানানোর প্ল্যান এলো কি করে?” জয়নাল একটু ইতস্তত বোধ করছিলো । আসলে এতো বড়লোক এর আগে কখনো দেখেনি তো । আগে দেখেছে গ্রামের বড়লোক মানুষ । কিন্তু এরা তাদের চেয়ে বড়লোক । ঢাকার বড়লোক । এদের সাথে কথা বলবে, না জানি কি বলতে কি বলে ফেলবে, এসব চিন্তা ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল জয়নালের । রাজিব তখন এগিয়ে এসে বলল, “আমি কইতাসি স্যার । আসলে আমাগো এই বস্তিতে লোকজনের ভালো কোন কাম করার যায়গা নাই । আবার আমরা দেখলাম, আপনাগো এইহানে ভালো কোন খাওয়ার দোকান নাই । মানে, যেইগুলা আছে, ঐগুলাও তেমন লোকজন পছন্দ করে না । আপনারা কি জানি কন, শরীরের জন্য ভালো না । ওই রকমই । তাই এই জয়নাল ভাই চিন্তা করলেন একখান এই রেস্টুরে না কি, ওইডা বানাইবো । বয়স্ক লোকটা কিছু বললেন না । কি যেন ভাবতে ভাবতে উপর নিচ মাথা নাড়ালেন । তারপর জয়নালের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার চিন্তা ভাবনা আসলেই অনেক ভালো । এই স্টেশনের পাশে আসলেই রেস্টুরেন্টের দরকার আছে । রাস্তার পাশের অস্বাস্থ্যকর খাবার মানুষের অনেক ক্ষতি করে । তার ওপর কিছু মানুষ সেসব দোকানে যেতেও চায় না । আপনারা রেস্টুরেন্ট খুললে এক দিকে যেমন যাত্রীরা উপকৃত হবে, তেমনি এই বস্তির লোকজনের একটা কাজের ব্যাবস্থা হবে ।” জয়নাল হালকা হেসে উঠলো । তারপর বলল, “যদি অনুমতি দেন, তাইলে কাইল থেইকাই কাম শুরু করতে পারি ।” লোকটা অন্য যে ছিল তার কাছে গেলো । কি যেন নিজেরা পরামর্শ করতে লাগলো । ঠোঁট নড়তে দেখা গেলেও কি বলছে তা ঠিক শোনা গেলো না । এরপরই যে লোকটা বয়স্ক লোকটার সাথে ছিল, সে এগিয়ে এলো । বলল, “স্যার বললেন, আপনারা কাল থেকেই তাহলে কাজ শুরু করুন । রেস্টুরেন্ট তৈরি হয়ে গেলে যা লাভ হবে, তার কোনটাই স্যার নেবেন না , আর আপনারা যদি কিছু প্রয়োজন পড়ে, আমাদের কাছ থেকে নিতে পারেন ।” রাজিব আর জয়নাল আনন্দে কেদে উঠলো । লোকটাকে সালাম আর ধন্যবাদ দিতেই লাগলো । বয়স্ক লোকটা আর তার সাথে থাকা লোকটা চলে যাবার পর জয়নাল আর রাজিব বাকিদেরও ব্যাপারটা জানালো । সবাই খুব খুশি । মাথা গোঁজার ঠাই এর সাথে এখন একটা আয়ের উৎসও হবে তাদের । আনন্দে ওরা খিচুরি বানিয়ে রাতের আহার গ্রহণ করলো । এদিকে সারারাত দুপুর, বিকেল, রাত জাশিরকে খুজে না পেয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় । ছেড়ে দেয় জাশিরকে খুজে পাওয়ার আশা । ওদিকে গ্রামের জমিদারও সব আশা ছেড়ে দিয়ে গ্রামের নিরাপত্তা জোরদার করে । যদিও তারপর থেকে এ গ্রামে আর কোন সমস্যা হয় নি । এদিকে জয়নালও তার লোকজন নিয়ে কাজ শুরু করে দেয় রেস্টুরেন্ট বানানোর । আর সাখুরা দিন বদলের সাথে সাথে ভুলে যেতে থাকে জাশিরের কথা । কিছু ডাক্তার জাশিরের কথা জিজ্ঞেস করলে সাখুরা শুধু বলে কোন এক অজানা কারণে সে বাড়ি থেকে চলে গেছে, আর কখনো ফিরবে না বলে গেছে । এভাবে কাটতে থাকে দিনকাল ।
(৬)
কেটে গেলো ১বছর । তখন ছিল শীতকাল । বস্তির লোকজনের অবস্থা এই প্রচণ্ড শীতে খুবই করুন । গায়ে গরম জামা নেই । শীতে সব কোনোরকমে কিছু একটা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে থাকে । কেউ কেউ তো এমনও আছে , এই শীতে হাফপ্যান্ট পড়ে ঘুমায় । সারা রাত শীতে পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় । ফজরের আজান হতে না হতেই জামেনা আর সালমা উঠে পড়েছে । সবাই আজ পুরো বস্তির লোকজনকে খিচুরি খাওয়াবে । কারণ আজ ওদের সেই রেস্টুরেন্ট উদ্ভোদন করা হবে । সাথে খাবে সেই বয়স্ক লোক, যার নাম মি আলী । এই রেইল কর্তৃপক্ষের এক বিরাট কর্মকর্তা । রেস্টুরেন্টের পেছনেই রান্নাঘর । সেখানেই খড়ি দিয়ে রান্না করছে ওরা । রায়হান পাশে রাত থেকেই শুয়ে ছিল । সকালে আগুনের তাপে ভালো ঘুম হবে সেই ভেবে । জামেনা হাতে বিরাট চামচ নিয়ে বিরাট হাড়িতে খিচুড়ি নাড়াচ্ছে । পাশে সালমা বসে শাক সবজি কাটছে । বেশ সুন্দর ঘ্রাণ বেরিয়েছে । একটু পর সালমা এসে সবজী ঢেলে দিলো খিচুড়ির মধ্যে । রান্না চলতে লাগলো ওদের । সকাল ১০টা । পুরো বস্তি বাসি এসে হাজির রেস্টুরেন্টের সামনে । জয়নাল হাতে মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মি আলির অপেক্ষায় । উনি এসে উদ্ভোদন করবেন এই রেস্টুরেন্ট । কিছুক্ষণ পর গাড়িতে করে হাজির হলেন মি আলী । সাথে তার সঙ্গে যে লোক থাকেন তিনি । লোকটা আসলে উনার বডিগার্ড । মি আলী রেস্টুরেন্টের কাছে এলেই দেখলেন উপরে বিরাট ব্যানারে টাঙানো, “আলী রেস্টুরেন্ট” লোকটা এই চিত্র দেখে অবাক হয়ে গেলেন । রেস্টুরেন্টের সিঁড়ি বেয়ে একটু উপরে উঠতেই জয়নাল মালাটা নিয়ে এগিয়ে এলো মি আলির কাছে । মালাটা পড়াতে যাবে, অমনি মি আলী মালাটা জয়নালের গলায় পড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এটা আপনারই প্রাপ্য । কিন্তু এই রেস্টুরেন্টের নাম আমার নামে কেন?” জয়নাল বলল, “আসলে জীবনে তো অনেক কাহিনী দেখসি । অনেক মানুষের সাথে পরিচিত হইসি । কিন্তু আপনার মতো মানুষ আমি দেখি নাই । যদ্দুর শুনছি, কিছু মানুষ ঘুষ খাইয়া লোক জনের কাজের অনুমতি দেয় । কিন্তু আপনি তা তো করেনই নাই, উল্টা আমাগো ট্যাকা দিয়া উপকার করলেন ।” মি আলী একটু হেসে বললেন, “দেখুন, এই দুনিয়ায় আমিও অনেক মানুষ দেখেছি । কিন্তু এমন মানুষ খুব কমই দেখেছি যারা উপকারীর কৃতজ্ঞটা প্রকাশ করে । আপনি তাদের মধ্যে অন্যতম । আর আরেকটা সত্যি কথা হল, “এটা আমার জীবনের শেষ কোন কিছু উদ্ভোদন । কারণ সামনের সপ্তাহেই আমি চাকরি থেকে রিটায়ার করবো । তাই এই দিনটা আমার সারা জীবন মনে থাকবে ।” রাজিব তখন একটা থালার ওপর কেচি এনে বলল, “এই নেন স্যার, আমাগো এই রেস্টুরে এহন উদ্ভোদন কইরা দেন ।” মি আলী কেচিটা হাতে নিতে নিতে বললেন, “জয়নাল, আপনি নামটা রেস্টুরেন্ট না দিয়ে রেস্টুরে দিলেই পারতেন ।” যারা উনার কথা শুনেছিলো, তারা খুব হাসল । বেচারা রাজিব লজ্জা পেলো । এরপর মি আলী ফিতা কেটে উদ্ভোদন করলেন । বস্তির সকলের হাততালির আওয়াজে পুরো ষ্টেশনটা মুখরিত হয়ে গেলো । স্টেশনের পাশে একটা দোকানে এক যাত্রী বসে চা খাচ্ছিল । সে জিজ্ঞেস করলো, “কি ব্যাপার ভাই? ওখানে আজ কি হচ্ছে?” দোকানদার আরেক দোকানদারের সাথে কথা বলছিল । সে বলল, “আর বইলেন না ভাই । গেরাম থেইকা আইসা এক লোক এইহানে রেস্টুরেন্ট খুলছে । তাই ওইডার উদ্ভোদনী করতাসেন মি আলী সাহেব তাই ।” অন্য দোকানদার বলল, “কি যে কবো রে মিজান, এইহানে আমাগো দোকান থাইকা লোকজন কত কিছু খায় । রেস্টুরেন্টে আর কয়জন খাইব । কয়েকদিন পরে দেইখো, ওরা কাইন্দা মইরবো । দোকান রেস্টুরেন্ট বেচার জন্য উইঠে পইড়ে লাইগবো ।” দোকানদার মিজান তখন অন্য দোকানদারকে বলল, “হ, ঠিক কইসোস লাল্টু ।” বসে থাকা যাত্রী আর কিছু বললেন না । ট্রেন চলে আসায় তাড়াতাড়ি চা শেষ করতে লাগলেন ।
ফিতে কাটা শেষে লোকটাকে খিচুড়ি খেতে দিয়ে মুল উদ্ভোদনী অনুষ্ঠান শেষ হল । উনার খিচুড়ি অর্ধেকটা খাওয়া হলে বস্তির অন্যান্য যতো জন ভেতরে খেতে পারে তারা ভেতরে এলো । এরপর বাকিরা এলো । এভাবে উদ্ভোদনী অনুষ্ঠান শেষ হল । মি আলির খাওয়া শেষ হলেও উনি এই বস্তির লোকেদের খাওয়া দেখতে বসেই রইলেন । বেশ ভালো লাগলো । ভালো কিছু শুরু যদি ভালো কিছু করেই হয়, তাহলে কার-ই না ভালো লাগে । এইসব গরিব মানুষদের খাইয়ে শুরু হল এই রেস্টুরেন্টের পথচলা । দেখা যাক, কত বছর টেকে । রেস্টুরেন্ট যখন পুরো ফাঁকা হয়ে গেলো, সবাই যখন খাওয়া-দাওয়া শেষে চলে গেলো, তখন জয়নাল আর আবিরকে কোলে নিয়ে জামেনা এলো । আবির এখন আগের চেয়ে কিছুটা বড় হয়েছে । মুখে মা-বাবা কোনোরকমে বেধে বেধে বলার চেষ্টা করে । মাঝে মাঝে ইশারা করে এটা-ওটা উচ্চারণ করে কিছু দেখাতে চায় কিন্তু কেউ বোঝে না আসলে ও কি দেখাতে চাইছে । জয়নাল মি আলিকে বলল, “আপনেরে যে কি কইয়া ধন্যবাদ দিমু ।” মি আলী তখন জয়নাল দান কাধে হাত রেখে বললেন, “ছি ছি, এ কেমন কথা । বরং বলুন আমি আপনাকে কি করে ধন্যবাদ দেবো । আপনি এতো সুন্দর একটা আয়োজন করে এতো ভালো একটা আয়োজন করে এই গরিব মানুষদের খাইয়েছেন, এটা হয়তো খুব কমই দেখা যায় । এখনকার যুগে লোকজন শুধু পার্টি করেই এসব করতে জানে । কিছু লোক বলে গরিব মানুষ অবুঝ । ওরা কিছু বোঝে না । কিন্তু আমি বলব, না, কিছু সেরকম হলেও কিছু মানুষের অনেক বুদ্ধি । বড়লোক মানুষের থেকেও বেশি বুদ্ধি । বড়লোকদের মধ্যে কিছু মানুষ টাকার লোভে খারাপ হয় । আর গরিবদের মধ্যে কিছু মানুষ টাকার অভাবে পেটের দ্বায়ে খারাপ হয় । পার্থক্য এটাই । কিন্তু তাই বলে সব বড়লোক কিংবা সব গরিবই যে খারাপ তা কিন্তু নয় ।” জয়নাল আর কিছু বলল না । পেছন থেকে উনার বডিগার্ড এসে বললেন, “স্যার, আপনাকে গুলশানের ফেয়ারওয়েলে যেতে হবে ।” মি আলী বললেন, “ও হ্যাঁ, আমার তো খেয়ালই ছিল না ।” তারপর জয়নালকে মি আলী বললেন, “জয়নাল, ভালো থাকবেন । কোন দরকার হলে আমার পর যে আসছেন, তাকে বলবেন । কারণ সে আমারই ছেলে । যদিও এটাও একটা বড় সমস্যা ।” জয়নাল শেষ কথাটার মানে বুঝল না । সে বড়োজোর “আচ্ছা” শব্দটা ছাড়া আর কিছু বলতে পারলো না । বয়স্ক লোকটা তারপর আবিরের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে চলে গেলেন । আবির নিজের মতো আঙ্গুল চুষছে । গলায় এখনো রয়েছে সেই সোনার হার যার লকেটে এখনো আছে সেই মেমোরি কার্ড আর অডিও এর লিঙ্ক । এ কয়েক বছরে কেউ সেটা খুলে দেখেনি । সেদিন থেকেই লোকজন আসা শুরু । রান্নাবান্নার কাজ করে পাপ্পু, লেবু আর বাবুল । জয়নাল ক্যাশ কাউন্টারে বসে আর রায়হান ও ওর সাথেকার কিছু জোয়ান ছেলে ওয়েটার হয়েছে ।
(৭)
কেটে গেলো আরও একমাস । সেই এর মাঝে খবর এসেছে সেই মি আলী স্ট্রোক করে মারা গেছেন । যদিও তার আগেই এখানকার দায়িত্ব পেয়েছে । ব্যাবসা খুব রমরমা । এখন আর কেউ রাস্তার পাশের দোকানে যায় না । এদিকে ওদের বেচা কেনা হয় না বলে কোম্পানির লোকজন ওদের কাছে খুব একটা মালপত্রও দেয় না । বেশিরভাগ দেয় জয়নালের এই আলী রেস্টুরেন্টে । ক্যাশ কাউন্টারে টাকা তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন চিপস, বিস্কিট, চানাচুর, সিগারেট ইত্যাদি বিক্রি করে জয়নাল । এদিকে ক্ষতির মুখে পড়ে অবস্থা খারাপ স্টেশনের পাশের দোকানদারগুলোর । মোট ৬ টা দোকান আছে স্টেশনের পাশে তার মধ্যে দুজন দোকানদারতো শুরু থেকেই হিংসে করেছিলো । তারা হলো লাল্টু আর মিজান । শুরুতে ভেবেছিলো ভালোমতো ব্যাবসা করতে পারবে না । কিন্তু শেষ মেষ ওরা ভালো ব্যাবসা করে দেখিয়ে দিলো । এখন লাল্টু আর মিজান পড়েছে বিপাকে । বাকি চার দোকানদার এ ব্যাপারে তেমন মাথা না ঘামালেও এই লাল্টু আর মিজান নিজেদের মাথা তো ঘামিয়েছেই, উলটো নিজেদের ব্যাবসা লাটে ওঠার কারণে চিন্তা করেছে ওদের রেস্টুরেন্টের একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে । পরদিন সকালের কথা । প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিক একটা দিন । রেস্টুরেন্টে অনেক লোকজন খেতে এসেছে । লাল্টু আর মিজানও এসেছে যাত্রী সেজে । যেহেতু ওরা বস্তির লোকেদের এড়িয়ে চলতো, সে কারণে বস্তির তেমন কোন লোক ওদের সেভাবে চেনে না । আর জয়নাল আর ওর সাথেকার সবাই তো আরও বেশি করে চেনে না । তো, ব্যাপারটা ওদের জন্য একদমই সহজ হয়ে গেলো । ভেতরে যেয়েই একটা টেবিলে বসে অর্ডার করলো এক কাপ চা । বেচারারা গরীব মানুষ । তাই চা ছাড়া আর তেমন কিছুই অর্ডার করতে পারলো না । রায়হান একটু পড়ে দুই কাপ চা এনে হাজির করলো ওদের সামনে । তারপর আবার রায়হানের ডাক পড়লো রান্নাঘরের দিকে । সেই ফাঁকে মিজান আগে থেকে আনা কিছু আধমড়া মাছি ছেড়ে দিলো চায়ের কাঁপে । তারপর আশেপাশে সবাইকে শুনিয়ে রাগি মেজাজে বলতে লাগলো, “এ ওয়েটার, কোথায় তুমি?” রায়হানের এক বন্ধু একটু দুরেই ছিল । কাছে এসে বলল, “জী স্যার, বলেন কি হইছে?” প্রচণ্ড রেগে বলল, “এসব কি? চায়ের কাঁপে এই মাছি ক্যান? এইসব খাবার খাওয়ান আপনেরা?” ওয়েটার কি বলবে কিছু বুঝতে পারলো না । কোনরকমে তোতলাতে তোতলাতে বলল, “ইয়ে মানে স্যার, আ…আ…আমরা তো এইরকম কখনো করি না । আর এই রেস্টুরেন্টে তো মাছিই না…নাই ।” লাল্টু তখন রাগ দেখিয়ে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, “ছি ছি! আবার মিত্থাও কইতাসেন? আপনেরা এতো অস্বাস্থ্যকর খাবার লোকজনরে দেন?” আশেপাশের লোকজন তাকিয়ে দেখতে লাগলো । জয়নাল আসতে যাবে, রান্নাঘর থেকে রায়হানকে আসতে দেখেই থেমে গেলো । রায়হান সেখানে যেয়ে সেই ওয়েটারকে বলল, “কি হয়েছে আমার ভাই?” ওয়েটার তখন বলল, “দোস্ত এর মধ্যে কি করে যেন মাছি পড়েছে?” রায়হান জোরে জোরে হাসতে লাগলো । আশেপাশের লোকজন আগ্রহের সাথে ঘটনাটা দেখছিলো মিজান তখন বলল, “ও, তোমাদের চায়ের কাপে মাছি নাচানাচি করে, আর তোমরা হাসছো?” রায়হান তখন চুলে আঙ্গুল ঘষে বলল, “৫ টাকার চায়ের কাপে মাছি নাচবে নাতো কি কারিনা কাপুর নাচবে?” আশেপাশের লোকজন ব্যাপারটা দেখে হেসে দিলো । মিজান কিছু বলতে যাবে, তার আগেই রায়হান বলল, “শোনেন ভাই, আপনে ইচ্ছা কইরা করছেন, নাকি অন্য কিছু আমি জানি না । তয়, আপনি কইলে কেউই বিশ্বাস করবো না যে এই কাম আমাগো । কারণ আমরা যদি কইরাও থাকি, তাইলে একটা পড়তে পারে । এর মধ্যে এততোগুলা ক্যামনে আসে?” আশেপাশের মানুষ রায়হানের দিকে তাকিয়ে রইল । ভুল কিছু বলে না , কথাটা আসলেই যৌক্তিক । মিজান আর লাল্টু চুপ করে রইল । আর কিছু বলতে পারলো না । যারা বসে ছিল, তাদের মধ্যে একজন বলে উঠলেন, “আমি প্রায়ই এই রেস্টুরেন্টে আসি । কই? আমি তো উনাদের খাবারে অস্বাস্থ্যকর কিছু পাই না ।” আশে পাশের অনেকেই তার কোথায় তাল মিলিয়ে একই কথাই বলল । শেষমেষ লজ্জা পেয়ে সেখান থেকে চলে গেলো মিজান আর লাল্টু । রায়হান তখন বলল, “বলিউডে সালমান খান, ঢালিউডে শাকিব খান, আর কমলাপুর বস্তিতে?” আশে পাশে থাকা ওর সমবয়সী বন্ধুরা চিৎকার করে বলল, “রায়হান, রায়হান ।” রায়হান মাথার চুল আঙ্গুল দিয়ে ঘষলো । সব কিছু আবার স্বাভাবিক । সবাই আবার নিজেদের মতো খাওয়া শুরু করলো । লাল্টু আর মিজান দোকানে ফিরে এলো । দুজনেই প্রচুর রেগে আছে । অবশ্য কাজে সফলতা না আসলে এরকমটা অস্বাভাবিক না । মিজান তখন লাল্টুকে বলল, “ধুর । কি যে হইলো । কিছুই হইলো । উলটা আমরা অপমানিত হইলাম ।” মিজান বলল, “তুই-ই তো একখান বোকার মতো কাম করলি । অতো গুলা মাছি দেয়ার দরকার কি ছিল? একখান দিলেই তো হইত ।” মিজান তখন বলল, “দাড়া, পরেরবার এমন কিছু একখান করমু, আশেপাশের লোকজন তখন এই রেস্টুরেন্ট থেইকা পালাইবো ।” লাল্টু জানতে চাইলো, “কি করবেন?” মিজান কিছু বলল না । শুধু ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো । সেদিন আর কিছু করলো না মিজান আর লাল্টু । পরদিন সকালের কথা প্রতিদিনের মতো সেদিনও লোকজন খাওয়াদাওয়ায় ব্যাস্ত । একটা টেবিল থেকে কেবলই এক দম্পতি উঠে গেছে । সেই টেবিলে পড়ে থাকা ময়লা মুছে দিচ্ছিল রায়হান । এমন সময় নজর চলে যায় কাচের দরজার বাইরে । দেখানে দুজন বোরখা পড়ে পুরো শরীর ঢাকা দুজন মহিলা কি যেন শলা পরামর্শ করতে করতে আসছে । দুজনেই কথা বলতে বলতে ভেতরে এলো । হাঁটাচলা দেখে মনে হচ্ছে দুজন পুরুষ । রায়হান তেমন একটা পাত্তা দিলো না । রায়হান টেবিলটা মুচ্ছে, আশেপাশে আরও অনেক টেবিল থাকা সত্ত্বেও ওরা দুজন এই টেবিলেই এলো । এরা আর কেউ নয়, লাল্টু আর মিজান । মিজান টেবিলের কাছে এসেই ইচ্ছা করে রায়হানের সাথে ধাক্কা খেলো তারপর রেগে চারপাশের লোকজনকে শুনিয়ে বলল, “এই হারামি, চোখ নেই, ছি! মেয়ে মানুষের সাত্থে ধাক্কা খাওয়ার খুব শখ ।” রায়হান তখন বলল, “ও ম্যাডাম, কি বলছেন টা কি? আমি আপনেরে কখন ধাক্কা দিলাম?” লাল্টু তখন বলল, “ছি ছি! এতো মিথ্যে বলছেন কেন? আপনারা পুরুষ মানুষ এমন কেন? মজাও নেবেন, মিথ্যেও বলবেন?” রায়হান তো লজ্জায় লাল হয়ে গেলো । এ মহিলা বলে কি এসব! মিজান তখন বলল, “সেদিন আমার ভাগ্নিও বলছিলো । আপনারা নাকি ওর সাথে বাজে আচরণ করেছেন । কেন বলুন তো? কে দিয়েছে এই অধিকার আপনাদের?” “হ্যাঁ………” এই অংশটুকু বলতে গিয়ে থেমে গেলো লাল্টু । ভুল করে পুরুষ গলায় উচ্চারণটা করে ফেলেছে । আর কেউ না বুঝলেও রায়হান কিন্তু ঠিকই বুঝলো । লাল্টু তখন নিজেকে সামলে নিয়ে হালকা হেসে আবার মেয়েলি গলায় বলল, “হ্যাঁ তো, আমার শাশুড়িও তো সেদিন এসেছিলেন । বেচারী বয়স্ক মানুষ ।” ক্যাশ কাউন্টারে তখন জয়নাল বসে সব শুনছিল । জামেনা কি একটা কাজে ওর কাছে এসেছিলো, সেও সেখানে দাঁড়িয়ে ঘটনা দেখছে । লাল্টু জয়নালকে ইশারা করে বলল, “সেই বেচারীকে ঐ বয়স্ক লোকটা নাকি চোখ টিপ মেরেছে । জামেনা তো শুনে হা । সামনে থাকা সব লোকজনও জয়নালের দিকে তাকিয়ে । জয়নাল এখন কি বলবে বুঝতে পারছে না । অবশ্য হঠাৎ এরকম একটা অদ্ভুত কথা শোনার পর কেউই এরকম স্বাভাবিক থাকতে পারে না । জামেনা চোখ বড় বড় করে জয়নালের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, “ও, এইখানে আইসা তোমার ভীমরতি ধরসে? আইজকা বাড়িত আসো । আজকে তোমার হবে ।” জয়নাল, “বি……বিশ্বাস করো, আমি কিছুই করি নাই……এরা কি কইতাসে উল্টাপাল্টা?” জামেনা তখন উচু গলায় বলল, “কি কইতাসে মানে কি? তোমারে আমি আইজকা খামু । দাঁড়াও । ঝাড়ুডা গতকাইলকাই আবার আগামী কাইল বাড়িত নতুন ঝাড়ু আনমু ।” জয়নাল ছল ছল চোখে জিজ্ঞেস করলো, “জামেনা, তুমি আমারে বিশ্বাস করো না?” জামেনা আবার রেগে বলল, “কিয়ের বিশ্বাস? আমি দেখছি সিনেমায় । লোকজন শহরে আইলে শহরের মাইয়াগো লগে পালাইয়া যায় । বাড়িত আসো, দেখো, তোমার আমি কি করি । তোমার ভরতা বানাইয়া আমি ভাত খামু ।” লোকজন জামেনা আর জয়নালের ঝগড়া শুনছিল । লাল্টু আর মিজানও শুনছিলো । রায়হান সেই ফাঁকে পুরুষ কণ্ঠের সেই আওয়াজটাকে সন্দেহের দরজায় দাড় করিয়ে সেটাকে বের করার জন্য লাল্টু আর মিজানের মাথার কাপড় ধরে দিলো টান । ব্যাস, বরখার মাথার কাপড় খুলে গেলো । রায়হান তখন, “জামেনা বু, এই দেখো ।” জামেনা তখন সেদিকে তাকিয়ে দেখল বোরখা পড়া দুজন পুরুষ । রায়হানের চিনতে অসুবিধে হল না । এরা গতকালকের সেই দুজন । ওরা তো নিজেদের সম্মান বাঁচাতে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়েছে । আশেপাশের লোকজন আবার হেসে উঠলো । রায়হান আবার চুলে আঙ্গুল ঘষে বলল, “বলিউডে সালমান খান, ঢালিউডে শাকিব খান আর কমলাপুর বস্তিতে……” আশেপাশে থাকা ওর সমবয়সী ওয়েটাররা বলে উঠলো, “রায়হান, রায়হান ।”
(৮)
লাল্টু আর মিজান নিজেদের দোকানের সামনে এসে বেঞ্চের ওপর বসলো । লাল্টু বলল, “এহ! কি সব বুদ্ধি তুই দেস, কিছুই কাজে আসে না ।” মিজান তখন বলল, “তাইলে তুই দে বুদ্ধি । এতো যখন কথা কইতে পারোস ।” লাল্টু বলল, “হ । এইবার দেখবি, আমি কি করি ।” মিজান কিছু জানতে চাইলো না কি করবে লাল্টু । কিন্তু রাজি হল ।
সেদিনও ওরা কিছু করলো না । পরদিন সকাল হওয়ার পরপরই ওরা আবার এসে হাজির । এবার না পুরুষ, না মহিলা । এবার একদম হিজরা সেজে এসেছে । গায়ে শাড়ি । চেহারায় এমন মেকআপ দিয়েছে যে বোঝার উপায় নেই এরা কারা । আর যাই, মেয়েদের মতো অভিনয় করতে না পারলেও হিজরাদের মতো ঠিকই সুন্দর অভিনয় করছে এরা । তবে রায়হানের মনে খটকা এবারও থেকে গেলো । আগের দুদিন যেহেতু কিছু করেছে, আজ নিশ্চয় কিছু করতেই এসেছে । কিন্তু আবার মাথার মধ্যে কেমন যেন অদ্ভুত এর ভাবনার উদয় হয় । না, শুধু শুধু টেনশন করার কি মানে । ওরা না-ও তো হতে পারে, তখন আবার বাজে একটা অবস্থা হয়ে দাঁড়াবে । তাই রায়হান আর কিছুই করলো না । সামনের টেবিলে থাকা দুজন লোকের খাবারের অর্ডার নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো । দুই হিজরা কথা বলতে বলতে হাঁটার ফাঁকে একসময় মিজান এক মহিলার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে সাবধানে মোবাইল চুরি করার জন্য হাত বাড়ায় । অনেক দূরে থাকা আরেক মহিলা সেই ব্যাপার লক্ষ্য করে, “চোর! চোর! আপা আপনার মোবাইল চুরি করলো! চোর চোর!” উনার কথা শুনে এই মহিলা ব্যাগ সামলে রেগে বলে উঠলো, “ছি! চোর! এ ভাই, দেখেন তো আপনাদের কারো কিছু চুরি করেছে কিনা?” আজ আর জয়নাল বসে থাকল না । এগিয়ে গেলো সেখানে । যেয়ে বলল, “আপা কি হইসে? আমারে কন ।” সেই মহিলা বলল, “আপনি না মালিক এখানকার? তাহলে আপনার এই রেস্টুরেন্টে এরকম চোর ঢোকে কি করে?” জয়নাল বলল, “আইচ্ছা আপা, আমি দেখতেসি । আমার কাছে পুলিশের নাম্বার আছে ।” বলেই পকেট থেকে জয়নাল মোবাইল বের করলো । মিজান তখনই বলে উঠলো, “এই, তুই-ই তো আমাদের বললি, সবাই যখন খেতে বসবে, আমরা যেন তখনই তাদের কাছ থেকে চুরি করি। এখন ভাব নিচ্ছিস কেন? ভালো সাজিস না কিন্তু ।” জয়নাল যেন পাথর হয়ে গেলো । বলে কি এরা? কি বলবে বুঝতে পারছে না জয়নাল । এমন সময় পেছন হঠাৎ এসে রায়হান মিজান আর লাল্টুর নকল চুল টান দিয়ে খুলে ফেলল । আশেপাশে তখন অনেক লোকজন ছিল যারা আগের দুদিন বা আগের দুদিনের কোন একদিন এদের ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে । তারা তো দেখেই বুঝে ফেলল । তারা জোরে জোরে বলতে লাগলো, “আরে! আবার এরা! মার এদের! মারো!” আশে পাশে অন্যান্য যারা এদের চেনেনা, তারাও সবার মারা দাবি শুনে এমনিতেই বুঝে গেলো, আসল দোষ এদের দুজনেরই । আরও নিশ্চিত হল দুজনকে ঐ ঘটনার পর দৌড়ে পালাতে দেখে । জয়নাল রায়হানের মাথায় হাত রেখে বলল, “সত্যি বাবা, তুমি ছিলা বইলা প্রতিদিন আমি বাইচা যাই । আমার আবিরও যেন তোমার মতোই ভালো পোলা হয় । রায়হান তখন বলল, “আরে চাচা, কি যে বলেন না, আমি সাহায্যও না করলে কে করবে? কারণ বলিউডে আছে সালমান খান, ঢালিউডে শাকিব খান, আর কমলাপুরের এই বস্তিতে………” আশেপাশে থাকা ওর সমবয়সী ওয়েটারদের সাথে এবার আগে এদের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরাও বলে উঠলো, “রায়হান, রায়হান ।” রায়হান চুলের সাথে হাতের আঙ্গুল ঘষল । এদিকে মিজান আর লাল্টু দৌড়ে এসে নিজেদের দোকানের সামনে এসে বসলো । লাল্টু তখন বলল, “আর বলিস না ভাই, আমি তো গরমে সিদ্ধ হইয়া যাইতেছিলাম । মাইয়ারা শাড়ি পড়ে ক্যামনে?” মিজান তখন বলল, “হ তাই তো, কাম না পারলে গরম লাগে ।” “আমার তো শরম লাগে ।” বলেই লাল্টু শাড়ি খোলা শুরু করলো । ভেতরে টি-শার্ট আর লুঙ্গি পড়াই ছিল ।” মিজানও শাড়ি খুলতে খুলতে বলল, “আগের দিন তুই কি করবি, এইডা না শোনা আমার ভুল হইয়া গেছে । নাইলে আইজকা আমরা কিছু না কিছু একটা করতে পারতামই ।” লাল্টু তখন বলল, “হ, আগের দুই দিনও তো মনে হয় আমি প্ল্যান করছিলাম ।” মিজান বলল, “আইচ্ছা শোন । আমরা কিছু করতে না পারলেও এইবার আমরা আরেকজনরে দিয়া কামডা করামু ।” লাল্টু তখন বলল, “কার কথা কইতাসোস?” মিজান নামটা উল্লেখ করলো না । কেবল হেসে উঠলো । এদিনও ওরা আর কোন ঝামেলা করলো না । তবে সেদিন রাতের কথা । মিজানদের বাসার পাশেই থাকে এক ডাকপিয়ন । সেই ডাকপিয়নের কাছ থেকে জামাটা ধার করে এনে একটা চিঠি লিখে তার সেটা স্ট্যাম্প যুক্ত খামের ভেতর ঢুকিয়ে নিজেই সেটা নিয়ে গেলো এই রেইল স্টেশনের নতুন কর্মকর্তা ইফাজের বাড়ি । সে আগের কর্মকর্তা আলিরই ছেলে । অনেকে লোকমুখে বাবার জন্য এই পদে এসছে বলে ইফাজের নামে সমালোচনা করলেও ইফাজ কিন্তু মোটেও সেভাবে এই পদে আসে নি । ওর জীবনেও রয়েছে এক অন্যরকম গল্প । ইফাজ যখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়তো, তখন ওর বাবার সাথে ওর মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায় । ইফাজ বাবার চেয়ে ওর মাকেই অনেক ভালোবাসতো । ফলে এক্ষেত্রেও সে ওর মায়ের কাছেই থাকতে চাইলো । কিন্তু ওর বাবা কিছুতেই ওকে ছাড়তে চায় নি । ফলে বাধ্য হয়ে ও ওর বাবার কাছেই থেকে যায় । আসল দোষটা কিন্তু ওর মায়েরই । ওর মা ওর বাবা ছাড়াও অন্য এক লোকের সাথে রাত কাটাত । কিন্তু এটুকু ছেলে এর মানে কি করে বোঝাতেন মি আলি? সে কি এর মানে বুঝবে? ধীরে ধীরে ছেলে বড় হয়ে গেলেও মি আলী তার ছেলেকে কিছু জানান নি । কারণ যে ছেলে তার মাকে এতো ভালবাসে, তার কাছে এই কথা বলার কোন মানেই হয় না । ইফাজ ভার্সিটির পড়াশুনা শেষে রাগ করেই বাবার চাকরিতে ঢুকে যায় । এরও অবশ্য একটা কারণ ছিল । এক সময় সে বিয়ে করে বাবার থেকে দূরে সরে যায় । আর সে তার বাবার কোন খোঁজ খবর নিতো না । চাকরি ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে বাবার সাথে দেখা হলেও কোন পাত্তা দিতো না । এদিকে ওর মাকে শত খোঁজা শেষেও খুজে পেলো না । বাবা রিটায়ার করলে বাবার পদে উন্নীত হয় ইফাজ । সে দেখতে চায়, এই পদটাই কি বাবা মার বিচ্ছদের মুল? কারণ বাবা মায়ের ঝগড়ার সময় সে শুনেছে, ওর মা ওর বাবার চাকরি নিয়ে বাবাকে অনেক খোটা দিতো । এখনও ইফাজ সন্তানহীন ভয় করে ওর । যদি যাকে ও বিয়ে করেছে তার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে ছেলে কষ্ট পায়? এতে অবশ্য কোন আফসোস নেই ওর স্ত্রী পায়েলের । সে সবসময় নিজের স্বামীর যত্ন করতো । মুখ ফুটে কখনো এমন কথা বলতো না, যেন ওর স্বামী কষ্ট পায় । পায়েলের বাড়ির লোকজন মাঝে মাঝে নানান কথা বলতো । তবে সেসব কথায় কান দিতো না পায়েল । এভাবেই চলছে ওদের দিন সেদিন নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিল ইফাজ । ছেলেটা দেখতে বেশ সুদর্শন । চেহারা ফর্সা, চুলগুলো বাদামি । মুখটা লম্বাটে । দেহের আকার ফিটফাট বলা চলে । পড়নে সাদা টি-শার্ট আর সাদা ট্রাউজার এমন সময় চা হাতে ঘরে ঢুকলো ওর স্ত্রী পায়েল । সেও দেখতে ফর্সা । মুখটা গোলাকার । মাথার চুল কোমর পর্যন্ত নেমে গেছে । পড়নে শাড়ি । ঘরে ঢুকেই বলল, “চা এনেছি ।” পায়েলের কণ্ঠ শুনে এক পলক পায়েলের দিকে তাকিয়ে বইটা বন্ধ করে এক পাশে রেখে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসলো ইফাজ । পায়েল ইফাজের চায়ের কাপ ইফাজের হাতে দিয়ে নিজেরটাও হাতে নিয়ে ট্রেটা সাইড টেবিলে রাখল । তারপর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পায়েল বলল, “এই সময় চা খাওয়ার অভ্যাসটা বাদ দেয়া উচিত ।” ইফাজ প্রশ্ন করলো, “কেন?” “কেন আবার, রাতে ঘুম হয় না ।” ইফাজ হালকা হেসে বলল, “আবার তো রাত জাগতে খারাপ লাগে না । ভালোই লাগে ।” পায়েল জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, তোমার পুরনো সাদা শার্টটা কোথায় রেখেছ?” “ড্রয়ারেই তো আছে । কেন?” পায়েল বলল, “তুমি তো পড় না । ওটা গনি চাচাকে দিয়ে দিলেই তো হয় । তুমি তো পড়ই না ।” বলে রাখা ভালো, গনি চাচা উনাদের বাড়ির কাজের লোক । বাড়ির সব কাজ এই গনি চাচা আর তার স্ত্রী হালিমা চাচি করে দেয় । ইফাজ জবাবে বলল, “দিও ।” পায়েল হঠাৎ হাসিমুখে বলল, “জানো, আজ সকালে গনি চাচার ছেলে এসেছিলো । কি কিউট ছেলেটা । আমার সাথে অনেক কথা বলল ।” হঠাৎ চা খেতে খেতে পায়েলের কথা শুনে কি যেন এক ভাবনায় ঢুকে গেলো । পরক্ষনে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, “আচ্ছা পায়েল?” পায়েল হুম আওয়াজ করলো । ইফাজ আবার বলল, “আমি তোমাকে মা হতে দেই নি বলে কি তোমার কষ্ট হয়?” পায়েল বলল, “আরে ধুর, কষ্ট হবে কেন? হলে তো এতো দিনে আমি তোমাকে বলতামই ।” ইফাজ বলল, “না । মাঝে মাঝে মনে হয় বাবার ওপর রাগ করে তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি ।” পায়েল ইফাজের গালে হাত বুলিয়ে বলল, “শোনো, মানুষের জীবনে অনেক কষ্ট আসে । তাই বলে এমন না, সামনে শুধু কষ্ট আর কষ্ট । তাই কষ্টকে মনের ভেতর পুষে রেখে তো লাভ নেই । তুমি দেখো, আল্লাহ সামনে তোমাকে অনেক বড় কিছু দেবেন ।” এতক্ষণে ইফাজের দৃষ্টি নড়লো । এমন সময় দরজার বাইরে থেকে নক করে গনি চাচা বলল, “ইফাজ বাবু, আপনের জইন্য একখান চিঠি আইছে ।” পায়েল বলল, “ভেতরে আসুন গনি চাচা, দরজা খোলা আছে ।” গনি চাচা ভেতরে এলো । লোকটা মোটামুটি বয়স্ক বলা চলে, যদিও চুলের মাঝে এখনো সেই বয়সের ছাপ পড়ে নি । গালের চামড়া কিছুটা ঝুলে গেছে । কপালেও রেখাগুলো কিছুটা গভীর হয়ে গেছে । চুল দাড়ি দিব্যি কালো । হালকা মোটা ও বেটে গায়ে ময়লা সাদা টিশার্ট, আর লুঙ্গি । ভেতরে এসে পায়েলের হাতে চিঠিটা দিয়ে চলে গেলো । পায়েল দেখল, তাতে ইফাজের নাম লেখা । ইফাজ জিজ্ঞেস করলো, “কিসের চিঠি?” পায়েল চিঠিটা ইফাজের হাতে দিয়ে বলল, “কি জানি । তোমার নামে এসেছে চিঠিটা । তুমিই দ্যাখো ।” ইফাজ চিঠিটা হাতে নিলো । সেটা খুলে দেখল, একটা দাওয়াত পত্র । কমলাপুরের আলী রেস্টুরেন্ট থেকে । যেহেতু ইফাজ তার বাবার কোন খোঁজ খবর নিত না, তাই ওর বাবার নামেই যে আলী রেস্টুরেন্ট এটা ও জানতো না । মি আলীও ব্যাপারটা অফিসের অন্যান্যদের কাছে গোপন রেখেছিলেন । শুধু জানতেন উনার বডিগার্ড । তবে নামটা শুনেই বাবার কথা মনে পড়ে গেলো । ছোট বেলায় বাবা ওকে কত আদর করতো । বাবার চেয়ে মা-ই বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকতো । ফলে বাবার সাথে দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাত । তাও সে মাকেই বেশি ভালোবাসতো । প্রচলিত এক কথায় আছে, ছেলেরা মায়ের বেশি ভক্ত হয়, মেয়েরা বাবার । এখানেও তার ব্যাতিক্রম নয় । পরক্ষনেই বাবা মায়ের ডিভোর্সের কথাটা মাথায় চলে এলো । আর তখনই বাবার প্রতি যে রাগ, সেই রাগটা ফুটে উঠতে লাগলো ওর মাঝে । দাঁতে দাঁত লাগিয়ে চোখদুটো বড় বড় করে কোনোরকমে রাগ আটকানোর চেষ্টা করতে লাগলো । এক মুহূর্তে হাতে থাকা চিঠিটা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ভাঁজ করে ছুঁড়ে ফেলে দিলো । কিছুটা রাগ কমলো, কিছুটা কমলো না । পায়েল মেঝে থেকে কাগজটা তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করলো, “ফেলে দিলে কেন?” কিন্তু ইফাজের কাছ থেকে কোন জবাব পেলো না । ইফাজ গায়ের ওপর কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে পড়লো । চা-টাও পুরো খায় নি । পায়েল চিঠিটা পড়লো । পায়েল ইফাজের বাবার নাম জানত । আবার এও জানত, ওই হোস্টেলটা নতুন খোলা হয়েছে এবং একদল বেকার লোকের প্রচেষ্টায় বেশ ভালভাবেই ওরা টাকা আয় করছে । এই মুহূর্তে ইফাজকে আর কিছু বলল না পায়েল । চিঠিটা নিজের কাছে রেখে দিলো । পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খাবার টেবিলে ইফাজ যখন খাচ্ছিল, তখন পায়েল মুখ খুলল । বলল, “একটা কথা বলার ছিল ।” ইফাজ জ্যাম পাউরুটি চিবোতে চিবোতে বলল, “বলো ।” “তুমি তো আমাকে অনেক ভালোবাসো । তাই না?” ইফাজ বলল, “বাসি তো । কেন?” পায়েল কেন এর জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “কতটা?” “একজন ছেলের পক্ষে তার বউকে যতটা বেশি ভালোবাসা সম্ভব, ততটা ।” পায়েল তখন বলল, “আচ্ছা, পায়েল নামের তো একটা অলঙ্কার আছে । আমার নামও পায়েল, ঐ অলঙ্কারটার নামও পায়েল । তবে কেন তুমি সেটা পড় না কেন?” ইফাজ হেসে দিলো । অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, “পাগল নাকি? পায়েল তো মেয়েরা পড়ে । আমি কেন পড়বো? তুমি পড়তে চাইলে বলো, কিনে দেবো ।” পায়েল তখন বলল, “কেন পড়বে না? আমার নাম যে পায়েল?” ইফাজ আবার হালকা হেসে বলল, “তোমার নাম পায়েল বলে কি আমারও পায়েল পড়া লাগবে?” পায়েল তখন বলল, “তোমার বাবার নাম আলী বলে কি আলী রেস্টুরেন্টের লোকগুলোর দেয়া ইনভাইটেশনে এভাবে রিয়েক্ট করা লাগবে?” ইফাজ তখন পাউরুটি একটা কামড় বসাতে যাচ্ছিলো পায়েলের কথা শুনে থেমে গেলো । পায়েল তখন বলল, “আমি শুনেছি, ঐ এলাকার কিছু বেকার লোকজন নিজেরা উদ্যোগ গ্রহণ করে ঐ রেস্টুরেন্ট বানিয়েছে । আমি জানিনা এভাবে কেন ওরা তোমাকে ইনভাইট করেছে, হয়তো ভেবেছে তুমি যেহেতু এই স্টেশনের একজন বড় কর্মকর্তা, সেক্ষেত্রে তোমাকে দাওয়াত করেছে ।” ইফাজ কিছুক্ষণ কথাটা ভেবে দেখল । কথায় আসলেই যুক্তি আছে । যদিও এভাবে কোন রেস্টুরেন্ট বড় কোন কর্মকর্তাকে এভাবে দাওয়াত দেয় না, তবুও । এরা হয়তো লেখাপড়া জানেনা বিধায় এসব ব্যাপারেও অজ্ঞ । তাই যেতে রাজি হল ইফাজ । নিমন্ত্রণ পত্রে সময় লেখা ছিল সকাল ১০টা । ৯টা ৪৫ এর ইফাজ পৌঁছে গেলো রেস্টুরেন্টের সামনে । একা ড্রাইভিং করে এসেছে । মুলত ও নিজেই ড্রাইভিং করে, কোন ড্রাইভার রাখে নি । রেস্টুরেন্টের সামনে এসেই নাম দেখে অবাক ইফাজ । বলে রাখা ভালো, ইফাজের বাবার অফিসের পক্ষ থেকে একজন বডিগার্ড থাকলেও ইফাজ কোন বডিগার্ড রাখে নি । ও এরকমই । নিজের নিরাপত্তার জন্য কেন অন্যকে কষ্ট দেবে এই মনোভাবটা সবসময় ওর মনের মধ্যে খেলা করে । সেজন্যই ও না রেখেছে নিজের বডিগার্ড, না রেখেছে গাড়ির ড্রাইভার । গাড়িটা রেস্টুরেন্টের সামনে এনে রাখল । আরও অবাক হল, কোন জাকজমকতা নেই, কেউ ওকে রিসিভ করার জন্য দাঁড়িয়ে নেই এটা দেখে । যদিও ও মনে মনে এসব বাড়তি কষ্ট পছন্দ করে না, কিন্তু তবুও, লোকজন তা-ও তো করে, আর ও নিজেও তো এদের মানাও করে নি । তাও নিজেকে বোঝাল এই বলে, হয়তো বস্তির লোকজন, এসব নিয়মকানুন মানতে জানে না । অথবা এটাও হতে পারে, এই পদে নতুন এসেছে, তেমন কেউ ওকে চেনে না , বিশেষ করে এই এলাকার লোকজন আরও চেনে না । সেজন্যই হয়তো । যাই হোক, সব প্রশ্নকে বাধা দিয়ে রেস্টুরেন্টের কাছে যেতে লাগলো । একটু দূর থেকে সবটা দেখছিলো লাল্টু আর মিজান । লাল্টু জিজ্ঞেস করলো, “কিরে, এবার কি হবে?” মিজান চাপা গলায় জবাব দিলো, “আরে, দেখেই যা না, কি হয় ।” লাল্টু বলল, “ধুর, তুই আর ন্যাকামি করিস না তো । বল কি জন্য এনাকে আনলি ।” মিজান বিরক্ত হয়ে বলল, “শোন, এই রেস্টুরেন্টে উনাকে আসতে চিঠি লিখেছে কে?” “কে?” লাল্টুর গালে চড় দিয়ে বলল, “গাধা! তোর সামনে বসে আমি-ই তো লিখলাম । ভুইলা গেছস ।” লাল্টু গালে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “আইচ্ছা, বুঝলাম । তারপর ক ।” মিজান বলল, “আচ্ছা, চিঠি লিখসি আমি, ওরা তো জানেনা এনি কে, ভেতরে যাইয়া যহন দেখবো ওরা এনার কাছ থেইকা খাবারের অর্ডার চাইতাসে, তহন তো এনি অবাক হইয়া যাইবো । এই রেস্টুরেন্টের বদনাম হইব । আর ক্ষেপে যাইয়া যদি রেস্টুরেন্ট বন্ধ কইরা দেয়, তাইলে তো আরও ভালো ।” লাল্টু কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল, ইফাজ দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নামটা দেখতে লাগলো । পরক্ষনেই আবার চোখটা পাশে উদ্বোধনী ফলকের দিকে গেলো । তারপর সেদিকে পা বাড়াতে লাগলো । হয়তো কৌতূহলের বশে । লাল্টু তখন মিজানকে জিজ্ঞেস করলো, “আর যদি ওরা এনারে চেনে?” মিজান বলল, “যদি চেনে, তাইলেও ওরা কি করবো । ওরা তো এহনই রান্না করতে পারব না । আরও যদি চিঠির কথা অস্বীকার করে, তাইলে তো আরও ক্ষেপে যাইবো এই লোক ।” এদিকে ইফাজ যখন উদ্বোধনী ফলকের কাছে গেলো, তখনই ফলকে উদ্বোধকের নাম দেখে ইফাজের চক্ষু চড়কগাছ । “মি আলী! মানে বাবা!” ইফাজ অবাক হয়ে গেলো । ওর বাবা উদ্বোধন করেছে, আর ও জানেই না? ভেতরে আর ঢুকল না ইফাজ । দ্রুত পদক্ষেপে গাড়িতে উঠে রওনা হল অফিসের দিকে । এদিকে লাল্টু আর মিজান বুঝতেই পারলো না, হয়েছে টা কি । লাল্টু মিজানের ওপর রাগ দেখিয়ে বলল, “দেখলি, আমি জানতাম তুই পারবি না । খালি খালি আমার সুময় নষ্ট করাইলি ।” মিজান বলল, “আরে ধুর, আমিও তো বুঝতেসি না । ক্যামনে হইলো এইডা? উনি ভেতরে গেলেই তো কাম হইয়া যাইতো । গেলোগা ক্যান?” লাল্টু তখন বলল, “পারস না কিছু, আবার ভাব লস ।” বলেই সেখান থেকে চলে গেলো লাল্টু । মিজান সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল ।
(৯)
এদিকে ইফাজ গাড়ি নিয়ে চলে গেলো নিজের বাবার সেই বাড়িতে । ঐ বাড়ি বাবা মারা যাবার পর ইফাজের হওয়া সত্ত্বেও ইফাজ কখনো ঐ বাড়িতে যায় নি । আজই প্রথম । বাড়ির সামনে গাড়ি রেখে দ্রুত পদক্ষেপে ভেতরে ঢুকল । বাড়িতে এখন থাকে চাকর কাশেম । লোকটা সৎ আর বেশ কর্মঠ । ইফাজকে ছোটবেলা থেকেই ইফাজের বাবার মতন কোলেপীঠে মানুষ করেছেন । ইফাজ দরজা ধাক্কালে উনিই এসে দরজাটা খুললেন । বয়স হয়েছে এখন অনেক লোকটার । পাকা দাড়িগুলো এলোমেলো হয়ে আছে । মাথার চুলের ঘনত্বটাও বেশ কমেছে । গালের চামড়া ঝুলে গেছে, কপালে বয়সের ভাঁজটাও স্পষ্ট লক্ষণীয় । পড়নে সাদা জামা, আর লুঙ্গি । কিন্তু ইফাজ এই লোকটার দিকে এক পলক তাকালও না । পাশ কেটে দ্রুত পদক্ষেপে ভেতরে চলে গেলো । কাশেম কিন্তু খুব খুশিই হল । বাড়ির ছেলে এতদিন পর বাড়ি ফিরেছে । হয়তো কেমন আছিস, বউমা কেমন আছে, এসব কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলো, কিন্তু সে সুযোগ ইফাজ আর দিলো কোথায় । ইফাজ দ্রুত পদক্ষেপে বাবার ঘরে যেয়ে বুকশেলফ ওর বাবার সেই ফাইল খুজতে লাগলো, যেখানে আছে ওর বাবার সেই রেস্টুরেন্ট উদ্বোধনের কাগজ । অনেকক্ষণ খুজতে খুজতে চোখ পড়লো ফাইলের আড়ালে রাখা এক এক ডায়রিতে যেটায় লেখা ১৯৯৩ সাল । অথচ জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত সেই ডায়রিটা কখনই দেখেনি ইফাজ । হঠাৎ এই রাগি মেজাজের মাঝেও কেন যেন ডায়রিটা দেখতে ইচ্ছে হল ইফাজের । হাত বাড়িয়ে ডায়রিটা বুকশেলফ থেকে নিলো ইফাজ । দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ওর বাবা সবার থেকে আড়াল করতে এই ডায়রিটা এভাবে রেখেছে । অনেক পুরনো একটা গন্ধ এই ডায়রিটা থেকে । ডায়রিটার মলাট উলটোতেই দেখল, এতে লেখা, “আমার জীবনের যতো না বলা কথা এতে লিখে রাখলাম । কেউ এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আমার মৃত্যুর পর দেখতে পারেন, না চাইলে দেখার প্রয়োজন নেই । কিন্তু মনে রাখবেন, দুনিয়াটা বড়ই আজব । অন্তত আমার সাথে যা ঘটেছে, তারপর থেকে এই দুনিয়াটাকে আমি আজব ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পাড়ি না ।” ইফাজ খানিক অবাক হল । কি এমন ঘটনা ওর বাবার জীবনে ঘটেছে যা তার বাবা সারাজীবন সবার কাছ থেকে লুকিয়েছেন? পরের পাতা উলটোতে যাবে, এমন সময় খেয়াল করলো, দরজায় দাঁড়িয়ে কাশেম । ইফাজ তাড়াতাড়ি করে একটা ফাইলে ডায়রিটা ঢোকাল । তারপর যে ফাইল খুজছিল সেটা খুজতে খুজতে কাশেমকে বলল, “কেমন আছো আঙ্কেল?” কাশেম তো মহা খুশি । হাত দিয়ে দুচোখ মুছল । তারপর বলল, “ভালো আছি বাবা, তুমি কেমন আছো?” লোকটাকে চোখ মুছতে দেখে একটু মায়া হল ইফাজের । কিন্তু সে “ভালো” ছাড়া আর কিছুই বলল না । কাশেম হয়তো আরও কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু বলল না । চোখের জল বাধা না মানায় চলে গেলো সেখান থেকে । ইফাজ খুজতে খুজতে পেয়ে গেলো সেই ফাইল যা এতক্ষণ ও খুজছিল । খুলে দেখল, সত্যি ওর বাবা এই রেস্টুরেন্ট এর উদ্বোধন করেছে । ওর হালকা রাগ হল । ওর বাবা নিজের নাম প্রতিষ্ঠা করতে শেষমেশ নিজের নামে এই রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠা করলো! এতো নিচ ওর বাবার মানসিকতা! অবশ্য যে স্বামী তার স্ত্রীকে ডিভোর্স দেয়, সে স্বামীর পক্ষে এরকম কাজ করা কোন অস্বাভাবিক বিষয় না । নিজের দাম্ভিকতা দিয়ে নিজের নামে রেস্টুরেন্ট বানিয়ে মিথ্যে মহানুভবতা দেখিয়ে গেছেন ভালোই । ইফাজ আবার সেই আগের মেজাজে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো । কাশেম আঙ্কেলের কথা ভুলেই গেছে বলা চলে । এদিকে কাশেম আঙ্কেল এসে দেখল রুমে নেই ইফাজ । উনি জানতেন ইফাজ বেশিক্ষন এখানে থাকবে না । তাও একটা আশা নিয়ে এসেছিলেন । সেই আশার ওপর হতাশা নামক চাদর বিছিয়ে কেবল একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের দরজাটা আবার ছিটকিনি লাগিয়ে দিল কাশেম । ইফাজ তখন ঐ ফাইল নিয়ে অফিসে গেলো । অফিসের অন্যান্যরা দাঁড়িয়ে ইফাজকে সম্মান জানালো । বাবার ডায়রিসহ ফাইলটা গাড়িতে রেখে এসেছে । হাতে উদ্বোধনের কাগজপত্র । সেটা সবাইকে দেখিয়ে রাগি মেজাজে বলল, “কি এটা!” সবাই চুপ হয়ে গেলো । একদন পিন পতন নীরবতা । ইফাজ আবার জিজ্ঞেস করলো, “চুপ করে আছেন কেন? কিসের অনুমতিপত্র এটা? মি আলী রেস্টুরেন্টের না! কি ঐ অহংকারী মানুষকে আপনারাও ভালো তেল টেল দিতেন তাইতো?” কেউ কোন কথা বলল না । কারণ সবাইকে কোন একদিন এ ব্যাপারে ইফাজকে কিছু বলতে মানা করেছিলো মি আলী । ইফাজ বলল, “মানুষ এতো খারাপ আমি সত্যি অবাক হচ্ছি । একজন মানুষ মরার আগে নিজের মহানুভবতা দেখতে নিজের নামে রেস্টুরেন্ট বানিয়ে গরীব মানুষদের চাকরি দিয়ে বলছে গরীব মানুষরা কর্মসংস্থান পেয়েছে । আহা! কি দয়ালু মানুষ রে বাবা ।” কেউ কিছু বলল না । কেউ যে ওকে সমস্ত সত্যিটা বলবে, সে সাহসটা পর্যন্ত কারো নেই । কারণ সকলের চাকরি হারানোর ভয় । ইফাজ একটু থেমে বলল, “আমি আজই ঐ রেস্টুরেন্ট সিল গালা করে দেবো ।” বলেই সেখান থেকে চলে এলো ইফাজ ।
সেদিন বিকেলের কথা । একটা ট্রেন কেবলই চলে গেলো । আওয়াজটা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে । চুলার পাশে বসে রান্না করছে জামেনা আর সালমা । একটু দুরেই আবিরকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে কলিমা । ছোট আবির নিজের এই পরিবেশটাকেই আপন করে নিয়েছে । মা বলতে জামেনা, বাবা বলতে জয়নাল । ওর বাবা সোহেল আর মা শায়লার কথা সে আজও জানে না । কিন্তু তবুও মুখের মধ্যে আনন্দের হাসি । চারপাশে তাকিয়ে সবটা সে দেখে । কিছুক্ষণ কিছু ভাবে । আবার কলিমাকে বলে “আফু…আফু…ঐ দে ওইতা ওইতা । কি ইশারা করে তা ও নিজেও জানে কি না কে জানে । কথা বলার এক মুহূর্তে আবিরের দিকে তাকালো জামেনা । তারপর আবার চুলায় একটু কাঠ দিয়ে সালমাকে বলল, “আবির যে কবে বড় হইব । তাইলে বাপের লগে একটু আধটু কাজ কাম-ও করতে পারতো । কি জানি, পোলাডা কবে বড় হইব ।” সালমা চামচ দিয়ে তরকারিটা নাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, “সেভাবে বোলো নে । দেইখো, তোমার পোলা অনেক বড় মানুষ হইব । আল্লাহ তোমার পোলারে এমন গুণ দিবো, যেইডা তুমি কল্পনাও করতে পারো নাই ।” জামেনা ফু গোছের একটা আওয়াজ করে বলল, “দেহা যাইক । অন্যের পোলা, ক্যামনে মানুষ করি । আসল মা থাকলে আমার চেয়ে ভালো কইরা আদর করতো ।” সালমা ভ্রু কুঁচকে সন্দেহের সহিত জিজ্ঞেস করলো, “কি! অন্যের পোলা মানে?” জামেনা সালমার এই কথাটা বলার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বুঝতে পারে নি যে ও মুখ ফসকে কি বলে ফেলেছে । সালমার মুখে কথাটা শুনে ওর হুশ এলো । কি বলবে বুঝতে পারছিলো না । সালমার দিকে তাকানোর সাহসটুকুও পাচ্ছে না । সালমা তখন আবার জিজ্ঞেস করলো, “কিরে? কও?” জামেনা আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাবে এমন সময় কথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো রায়হান । এসেই জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো । রায়হানের চোখে মুখে ভীতির ছাপ স্পষ্ট লক্ষণীয় । সালমা রায়হানকে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে? তুই এমন করতেসিস ক্যান?” রায়হান তখন দম ফেলতে ফেলতে বলল, “বাইরে পুলিশ আইসে । আমাগো রেস্টুরেন্ট বন্ধ কইরা দিয়া সিলগালা কইরা দিতেসে । জামেনা আর সালমা তাড়াহুড়া করে বেড়িয়ে এলো । কলিমাও আবিরকে নিয়ে বেড়িয়ে এলো । বস্তি থেকে বেরোতেই নজরে এলো রেস্টুরেন্টের গেইটের সামনে লোকজনের ভিড় । বেশিরভাগই উৎসুক জনতা । বাকিরা পেটের দ্বায়ে মানা করছে সিলগালা না করতে । পাশের দুটো গাড়ি । একটা পুলিশের জীপ, অন্যটা ইফাজের । ইফাজ গাড়িতেই বসে । জয়নাল রাজিবসহ রেস্টুরেন্টের অন্যান্য যারা আছে সবাই পুলিশকে শত বারনের সত্ত্বেও পুলিশ কোন কথাই কানে নিলো না । কারণ জানতে চাইলে পুলিশ শুধু বলে, এখানে নাকি স্বাস্থ্যসম্মত খাবার বানানো হয় না । অথচ এ ব্যাপারে কোন অভিযোগ জানায় নি সাধারণ জনগন । জানিয়েছে কেবল ইফাজ । জয়নাল শত বোঝানোর পরেও কোন লাভ যখন হল না, সেখান থেকে চলে এলো । কলিমার হাত থেকে আবিরকে কোলে নিয়ে আবিরকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো । আবির কিন্তু দিব্যি হাসছে । চারপাশে কি হচ্ছে এ ব্যাপারে কোন সম্যক ধারনা হবার ক্ষমতা যে এখনো হয়নি ওর । এলাকার কিছু স্থানীয় সাংবাদিকও এসেছে এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে । ইফাজ সাংবাদিকদের সাথে কোন কথা বলতে চায় নি । বলেছে শুধু পুলিশ , পুলিশই নিজেদের মতো শুধু জানিয়ে দিলো খাবারের মান ভালো না থাকায় এই রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেয়া হল । আশেপাশের লোকজনের কোলাহল ইফাজের ভালো লাগছিলো না । অফিসারকে ফোন করে “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমি এখন যাচ্ছি, ডকুমেন্টস গুলো পড়ে আপনার কাছ থেকে নিয়ে নেবো ।” বলে সেখান থেকে ফেরার জন্য গাড়ি ঘোরালো ইফাজ । সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে বা পাশের জানালার কাচটা নামাতেই হঠাৎ ওর নজর আটকে গেলো কোন এক দৃশ্যে । আবির আর ওর বাবার দিকে । ইফাজের নিজের বাবার কথা মনে পড়ে গেলো । চোখ থেকে সানগ্লাসটা নামাল । জয়নালও তখন ব্যাপারটাটের পেয়ে ধীরে ধীরে ইফাজের দিকে তাকালও । জয়নালের সাথে সাথে আবির ইফাজের দিকে তাকালো । ইফাজের চোখ দিয়ে জল পড়তে চাইছে, কিন্তু ইফাজ সে জল বের করতে চাইছে না । এ দৃশ্য ওর আরও দেখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু চোখের জল বাধা মানছে । নিজের ইচ্ছে বিরুদ্ধেই সেখান থেকে এক টান দিয়ে অনেকটা দূরে চলে এলো ইফাজ । এবার আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না ইফাজ । খানিকক্ষণ নিজেকে সামলে নিয়ে জানালার কাচটা আটকে দিয়ে চোখ মুছে সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে রওনা হলো বাড়ির পথে । জয়নাল আর আবির যতদুর ইফাজের গাড়ি দেখা যায়, ততদুর সেদিক পানে তাকিয়ে রইল । বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকতেই ইফাজের নাম ধরে বেশ কর্কশ কণ্ঠে ইফাজকে ডাকল ওর স্ত্রী । ওর স্ত্রী তখন সোফায় বসে টিভি দেখছিল । ইফাজকে ডেকে উঠে দাঁড়ালো ইফাজ খেয়াল করলো, টিভির ব্রেকিং এ লাল রঙে ব্রেকিং নিউজ উঠে আছে, “কমলাপুর রেস্টুরেন্ট অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দিলো রেইল কর্তৃপক্ষ । মিথ্যে অভিযোগ জানিয়ে রেস্টুরেন্ট বন্ধ করা হয়েছে অভিযোগ বস্তিবাসী এবং রেস্টুরেন্টে দায়িত্বরত লোকজনের ।” ইফাজের স্ত্রী ইফাজের কাছে এসে চাপা গলায় বলল, “কেন করলে এমন?” ইফাজ মেজাজ দেখিয়ে বলল, “ঐ রেস্টুরেন্ট আমার বাবার নামে………।” ইফাজের স্ত্রী ইফাজের কথা শেষ করতে না দিয়েই বলল, “সেটাই কি বড় দোষ ছিল? তুমি না জেনে শুনে এরকম একটা কাজ করতে পারলে?” “দ্যাখো, আমার যেমনটা ইচ্ছে হয়েছে, আমি তেমনটাই করেছি । আমি যেটা ভালো মনে করেছি, আমি সেটাই করেছি । তুমি এর মধ্যে কথা বলতে এসো না ।” বলেই সেখান থেকে ইফাজ চলে আসতে চাইলে বাধা দেয় ওর স্ত্রী । ওর স্ত্রী তখন হালকা রাগি মেজাজে বলল, “ঐ রেস্টুরেন্ট তোমার বাবা বানান নি । ঐ রেস্টুরেন্ট ওখানকার বস্তির লোকেরা নিজেদের পেটের দ্বায়ে বানিয়েছিল । আর রেস্টুরেন্টের নাম তোমার বাবা ইচ্ছে করে নিজের নামে দেন নি । ঐ রেস্টুরেন্টের মুল উদ্যোক্তা ইচ্ছে করে তোমার বাবার নামে ঐ রেস্টুরেন্টের নাম দিয়েছিলেন ।” কথাগুলো শুনে ইফাজ হালকা লজ্জা পেলো । ওর স্ত্রী এসব কি শোনাচ্ছে? না, ওর বাবা হলে ও বিশ্বাস করতো না । এ কথা ও ওর স্ত্রীর মুখে শুনছে । তাও আবার যেই স্ত্রী ওর ওপর কখনো রাগ করে না সেই রাগি মেজাজে এসব কথা বলছে । নিশ্চয় ইফাজের করা ভুলটাই ওর স্ত্রীর মেজাজের কারণ । ইফাজ কিছু বলল না । ইফাজের স্ত্রী কেবল তাচ্ছিল্যের স্মরে বলল, “খুব ভালো । তুমি কাজের লোক রাখ না, ড্রাইভার রাখ না তাদের কষ্ট হবে বলে, অথচ এক দল লোকের পেটে লাথি মেরে এলে । এই তোমার সততা । দারুন ।” ইফাজের স্ত্রী সেখান থেকে চলে গেলো । ইফাজ কি করবে বুঝতে পারছে না । একদিকে বাবার প্রতি ওর রাগ, অন্যদিকে বেচারা গরীব মানুষগুলো । ইফাজের হাতে তখন দুটো ফাইল ছিল । একটা ওর বাবার ডায়রি রাখা, অন্যটা রেস্টুরেন্টে বানানোর অনুমতিপত্রের । বাবার ডায়রির কথা ও ভুলেই গিয়েছিলো । নিজের ঘরে যেয়ে টেবিলের ওপর ফাইলটা রাখতেই নজরে পড়লো বাবার ডায়রিটা । জামাকাপড় চেঞ্জ না করেই ডায়রি নিয়ে বসে পড়লো বিছানায় ।
(১০)
এদিকে রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মিজান আর লাল্টু খুব খুশি । ওদের দোকানে আজ বেশ ভিড় । লোকজনের অভাব নেই । লাল্টু তখন দূর থেকেই মিজানকে ডেকে বলল, “তোর বুদ্ধি ভালোই কামে লাগছে ।” মিজান কিছুই বলল না । কেবল হাত উঠিয়ে ইশারায় বোঝাল, খুব ব্যাস্ত সে এই মুহূর্তে । লাল্টুও আবার কাজে লেগে পড়লো ।
রেস্টুরেন্টের সামনে সিঁড়ির ওপর বসে রেস্টুরেন্টের সব কর্মকর্তা । মন খারাপ করে বসে আছে । পরামর্শ করছে । কেউ বলছে আন্দোলন করবে, কেউ বলছে ইফাজের বাসা ভাংচুর করবে । একটু দুরেই মাটিতে বসে আবিরকে কোলে নিয়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে জয়নাল । আবির ঘুমিয়ে পড়েছে । জয়নাল একদৃষ্টিতে রেললাইনের দিকে তাকিয়ে আছে । খানিক বাদে জামেনা এসে ওর পাশে বসলো । জামেনা জয়নালের গালে হাত রেখে বলল, “শোনো না, এতো ভাইঙ্গা পইড় না । দেইখো, সব ঠিক হইয়া যাইব । জয়নাল বলল, “দেহা যাক কি হয় । আর আমি ভাইঙ্গা পড়ছি কই, এই তো, দিব্যি ভালা আছি । হালকা হাসবার চেষ্টা করলো জয়নাল । কিন্তু হাসির মধ্যেও কষ্টের ভাবটা স্পষ্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছে । জামেনা আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না । কিছুক্ষণ পর জয়নাল নিজেই জিজ্ঞেস করলো, আইজকা কি রান্না করছো?” জামেনা বলল, “পাঙ্গাস মাছের তরকারি রান্না করতে গিয়া এই খবর শুইনা ছুইটা আইলাম । রান্না করা আর হইলো না । সালমা করতেছে মনে হয় এখন রান্না । আবার দুজনেই চুপ হয়ে গেলো ।
এদিকে ইফাজ বাবার ডায়রিটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো । বিছানায় পা তুলে উঠে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসলো ইফাজ । তারপর ডায়রিটা খুলল । প্রথম পাতা আগেই দেখেছে তাই আর দ্বিতীয়বার খুলল না । পরের পাতা থেকে সব কাহিনী শুরু হল । ওর বাবা লিখেছেন । ইফাজ পড়তে লাগলো ।
“আমি জানি না শেষ বয়সে এসব লিখে রাখা ঠিক হচ্ছে কি না । সেই ১৯৯৩ সালে স্ত্রীর কাছে উপহার পাওয়া সেই ডায়রিটা আজ হঠাৎই খুজে পেলাম । সেই কবে আগের পাতায় কিছু লিখেছিলাম কৌতুকের ছলে কিন্তু আজ দেখি জীবনের শেষে সেই কৌতুকটাই বাস্তবতায় পরিণত হল । আজকাল খুব মনে হয় আর বেশিদিন হয়তো বেচে থাকব না । মরে গেলে যেসব ভুল ধারনা আমায় নিয়ে অন্য কেউ করেছে, সেসব ভুল ধারনা তার কাছে হয়তো ভুলই থেকে যাবে । তাই সংক্ষেপে লিখে রেখে যাওয়ার এই প্রচেষ্টা । হয়তো সে কখনই দেখবে না এটা । তবু, একটা শেষ চেষ্টা করতে চাই ।
১৯৯০ সালে আমাদের বিয়ে হয় । বিয়ের সময় সবকিছু যেমন ঠিকঠাক ছিল কিন্তু বিয়ের পরবর্তী পাঁচ বছরও সব কিছু ঠিকঠাক ছিল । ১৯৯১ সালে আমার ঘরে আসে নতুন সদস্য । আমার ছেলে ইফাজ । যার মনে থেকে সব প্রশ্ন সব প্রশ্ন মুছে দেবার জন্য আমার এই ব্যার্থ প্রচেষ্টা । হয়তো সফল হতেও পারে । যাই হোক । মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী ছেলের নাম দেয়া হল আল আমিন আহমেদ । আর আমার ইচ্ছা অনুযায়ী ডাক নাম দেয়া হল ইফাজ । ধীরে ধীরে সময় পার হতে থাকে, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের বয়সও বাড়তে থাকে । ইফাজ্ও দেখতে দেখতে দেখতে বড় হতে থাকে । ওর যখন দুই বছর বয়স, তখনই ওর মা আমাকে এই ডায়রিটা অ্যানিভারসারিতে গিফট করেছিলো ।
সাল তখন ১৯৯৯ এর শেষের দিকে । পুরো বিশ্ব তখন নতুন এক শতকে পা রাখার মুহূর্তটা উদযাপনে ব্যাস্ত । কিন্তু সেই সময় শতকের সাথে সাথে আমাদের জীবনেও যে এতো বড় একটা পরিবর্তন আসবে সেটা আসলেই আমার অজানা ছিল । দিনটা আমার বেশ ভালোই মনে আছে । ৩০ ডিসেম্বর ১৯৯৯ বৃহস্পতিবার । অফিস থেকে আমার এক কলিগের সাথে ফিরছিলাম । ড্রাইভিংটা আমিই করছিলাম । পাশে আমার কলিগ । বেশ আলাপ আলোচনা করতে করতে পথ পাড়ি দিচ্ছিলাম । আমার কলিগের নাম ছিল রাসেল । ধানমন্ডি লেকের পাশের রাস্তা দিয়ে ড্রাইভিং করে যাচ্ছিলাম, এমন সময় হঠাৎ-ই আমার বন্ধু আমাকে গাড়ি দাড় করাতে বলল । তারপর ইশারায় আমাকে কিছু দেখাল । যা দেখাল, তা আমি আদৌ ঠিক দেখেছি কি না আমি নিজেও আজও জানি না । পুকুর পাড়ে অন্য এক ছেলের হাত ধরে তার কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে আমার স্ত্রী । আমি নিজেকে বারবার জিজ্ঞেস করছিলাম, যা দেখছি তা কি সত্য? না, মিথ্যে কি করে হবে, তাহলে আমার বন্ধু কি করে দেখছে । আচ্ছা এটা আসলেই আমার স্ত্রী? এইতো, কিছুদিন আগেই এই জামাটা কিনে দিয়েছিলাম, আর চেহারা এতোটাও অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো না যে চেনার ভুল হবে । আমি স্থম্ভিত হয়ে গেলাম । রাসেল আমাকে কিছু বলতে পারছিলো না । অবশ্য ঐ মুহূর্তে কিছু বলারও থাকে না । বিষণ্ণ মন নিয়ে আমি যাচ্ছিলাম পথ ধরে । রাস্তায় খুব একটা গাড়ি চলছিল না । কিন্তু আমার মনে হাজারো প্রশ্নের আনাগোনা হচ্ছে । হঠাৎ রাসেল আমাকে চিৎকার করে সাবধান হতে বলল এবং আমি ভালো করে মনোযোগ দিয়ে দেখলাম, সামনে পুলিশের গাড়ি । কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে গেলো । যদিও সে সময়ই ব্রেক চেপে ধরায় তেমন কোন ক্ষতি হতো না । পুলিশের গাড়ি থেকে পুলিশ নেমে এলো । একজন অফিসারের মাথায় আঘাত লেগেছে । অফিসার আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স কেড়ে নিলেন এবং বাতিলও করে দিলেন । আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না কারণ ঐ সময়টা আমার কাছে ঝড়ের মাঝে বজ্রপাতের মতো মনে হচ্ছিলো । যাই হোক, আমাকে ড্রাইভিং করে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে নিজের বাসায় চলে গেলো রাসেল । বাসায় যেয়ে নিজের ঘরে বসে আমার স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম । ইফাজ তখন স্কুলে । ওর মা ওকে স্কুল থেকে নিয়ে আসে । দেড়টার দিকে ইফাজকে নিয়ে ঘরে ফিরলো ওর মা । ওর মায়ের সাথে সাথে ইফাজও আমাদের রুমে চলে এসেছে । আমি ইফাজকে অন্য রুমে যেতে বলব, তার আগেই দেখি ইফাজের মা ইফাজকে অন্য রুমে যেতে বলল । ইফাজ চলে যাবার পর আমি আমার স্ত্রীকে কিছু বলতে যাব, তার আগেই আমার স্ত্রী আমাকে বলল, আমার সাথে ওর কথা আছে । আমাক অবাক হয়ে গেলাম । তারপর দেখলাম ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে আমার হাতে দিলো । আমি হাতে নিয়ে কাগজের ভাঁজটা খুলে যা দেখলাম, এ যেন কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেবার মতো । এটা ডিভোর্স পেপার । আমি বাক্যহীন হয়ে গেলাম । একবার ডিভোর্স পেপারের দিকে, একবার আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলাম । সে আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, সে নাকি আমায় আর পছন্দ করে না । আমি না তার যোগ্য নই । আর যে ছেলেটাকে ও আবার বিয়ে করবে, সে ছেলেটা নাকি ওর পুরনো বয়ফ্রেন্ড । তার সাথে নতুন জীবন শুরু করতে চায় । আমি নিজেকে কোনমতে সামলে নিলাম । নাহলে হয়তো সেখানে আমি জ্ঞান হারাতাম । রাতের দিকে নিজেকে পুরোপুরি সামলে ওকে অনেক বোঝালাম, ইফাজের কথা ভাবতে বললাম, কিন্তু না । ওর কাছে ইফাজ তেমন বড় কিছু না । ওর কাছে এখন নিজের নতুন জীবনই বড় । অনেক জোরাজুরির পরেও কিছুতেই কিছু হল না । শেষমেষ ওকে আমার ডিভোর্স-ই দিতে হল । ডিভোর্সের সব প্রক্রিয়া পুরোপুরি শেষ হতে লাগলো ৬মাস । আমার স্ত্রী আগের রাতেই সব কিছু গুছিয়ে নেয় চলে যাবে বলে । সকালে সব প্রক্রিয়া শেষ যখন ও বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছে, তখন আমার ছেলে প্রচুর কান্নাকাটি শুরু করে দেয় । আমার চেয়ে ইফাজ ওর মাকে অনেক ভালোবাসতো । ওর মা-ও হয়তো ওকে নিয়ে যেতো যদি না আমি ওকে আটকাতাম । যাবার সময় আমার ছেলে ওকে যখন শেষবারের মতো ওর মাকে বলে “মা, তুমি আমায় তোমার সাথে নিয়ে যাচ্ছ না কেন?” ওর মা তখন জবাবে বলে, “আমি তো তোকে নিতামই, কিন্তু তোর বাবাই তোকে নিতে দিচ্ছেন না ।” ব্যাস । এই কথাটাই যেন সব কিছু পাল্টে দিলো । ইফাজ তখন আমার দিকে এমনভাবে তাকালো, যেন আমি কত বড় অপরাধ করে ফেলেছি । এক দৌড়ে নিজের ঘরে যেয়ে দরজা আটকে দিলো । আমি সবচেয়ে বেশি অবাক হলাম আমার স্ত্রীকে দেখে । সে এক মুহূর্তের জন্যও পেছন ফিরে তাকালো না । আমি কিছু বলতে পারলাম না । স্তব্ধ হয়ে গেলাম । কিন্তু আমিই বা কি করতাম, আমার ছেলেটাকে কি বোঝাবো তা আমার জানা নেই । স্বামীর হাত ছেড়ে অন্যের সাথে ঘোরাঘুরির করা কত বড় অপরাধ তার কি বোঝে ও? আর যে মাকে ও এতো ভালবাসে তার সম্পর্কে বড় হয়ে ওর মনে কত বিরূপ প্রভাব পড়বে সে জন্যেও আমি ওকে কিছু বলিনি । আর ও এই বিষয়ে আমাকেই দোষী ভেবে বসলো । মনের মধ্যে আমার জন্য যে রাগ তা পুষে রেখে আমায় আর ক্ষমা করতে পারলো না । আমি ওর কাছে পর হয়ে গেলাম । যতদিন আমার কাছে ছিল, ততদিন কাশেমই ওকে কোনোরকমে খাওয়া দাওয়া আর অন্যান্য দেখভাল করতো । কিন্তু বিয়ে হবার পর চলে গেলো আমায় ছেড়ে, আর দেখা করতে এলো না । লেখার আর কিছু নেই । সেদিন আমার কোন দোষ ছিল না, তবুও আমি ওর কাছে এখনো দোষী ।”
(১১)
লেখাটা দেখে ইফাজ অবাক হয়ে গেলো । ও নিজের বাবার সাথে এতো বড় একটা ভুল করেছে? সত্যি ওর সেই মা এমন করেছে ওর সাথে? নাকি মরার আগে মি আলী রেস্টুরেন্টের মতো এটাও ওর বাবার মিথ্যে মহত্বের পরিচয়? ইফাজ কিছু বুঝতে পারছে না । একটা কথা মানতেই হবে, ইফাজ ওর মাকে অনেক খুজেছে, কিন্তু পায় নি । আচ্ছা, যেই মাকে ও এতো ভালোবাসতো, সেই মায়ের কি একবারও ইচ্ছে হয় না ছেলেকে দেখার? ইফাজ কিছু বুঝতে পারছে না । খেয়াল করলো আসরের আজান দিচ্ছে । ইফাজ ডায়রিটা নিয়ে চলে যায় ওর স্ত্রীর কাছে । ইফাজের স্ত্রীকে ডায়রিটা পড়তে বলে তাড়াহুড়ার সাথে সেখান থেকে চলে যায় ইফাজ । গন্তব্য কাশেম । ইফাজ গাড়ি নিয়ে চলে গেলো বাবার বাড়িতে । গাড়িতে থেকে বেড়িয়ে ঘরের ভেতর ঢুকল । কাশেম তখন রান্নাঘরে বসে বসে কি যেন করছে । দূর থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না । কাছে যেয়ে ইফাজ দেখল, কাশেম আঙ্কেল টমেটো কাটছেন । খুব সম্ভবত টমেটো ভর্তা করছেন । বাবা মরার পর ইফাজ কখনো এই পিতৃতুল্য মানুষটিকে এরকম সময়ে কখনো দেখতে আসে নি । ইফাজ ধির পায়ে লোকটার কাছে গেলো । কাশেম যখনই টের পেলো ইফাজ এসেছে, সে দাঁড়িয়ে গেলো । কাশেম কখনো ভাবতেও পারে নি, ইফাজ এরকম একটা সময়ে এখানে আসতে পারে । কাশেম কিছু বলতে পারছিলো না । কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো । পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি ভাঁজ করে কষ্ট কমানোর চেষ্টা করছেন । কিন্তু তা আর খুব বেশিক্ষন পারলেন না । হঠাৎ এক পর্যায়ে তিনি কেঁদেই ফেললেন । ইফাজ কাশেমকে থামানোর চেষ্টা করলো । কাশেমের কান্না পুরোপুরি থামলে পুরো ঘটনা কাশেমকে খুলে বলে ইফাজ । কাশেম তখন বলে, “আসলে পুরা ঘটনাই সত্যি । তোমার বাপে কিছুই করে নাই । যা করছে, তোমার মায়ে । তোমার বাপও চায় নাই তোমারে তোমার মায়ের কাছে পাঠাইতে । কারণ তোমার বাপে জানত, তুমি যদি তোমার মায়ের কাছে থাকতা, তাইলে পুরা আদরে থাকতে পারতা না । তাই তোমার বাপে তোমারে নিজের কাছে রাইখা দিছিলেন । আর তোমারে কিছু কন নাই কারণ তোমার বাপ চান নাই তোমারে কষ্ট দিতে ।” ইফাজ এখন ঠিকই বুঝেছে কেন ওর বাবা কিছু বলেন নি । কারণ সত্যি এখন ওর মনে ওর মায়ের কর্মকাণ্ডের জন্য যে কষ্ট হচ্ছে, তা খুবই অসহনীয় । একটু চুপ করে কাশেম আঙ্কেল আবার বললেন, “তোমার বাপে কোন ডায়রিতে এইসব লিখছেন, আমি কিছুই জানি না । খালি দেখছি, উনি কি সব লিখতেন । মাঝে মাঝে মনে হইত পইড়া দেখি । কিন্তু খুইজা পাইতাম না কই রাখছেন ।” ইফাজের চোখের কোণে জল আসতে যাচ্ছিলো । সেটাকে থামানোর জন্য হয়তো হঠাৎ বলে উঠলো, “আচ্ছা, ঐ রাসেল আঙ্কেলকে পাওয়া যাবে কোথায়?” ইফাজের কোথায় কষ্টের ভাব স্পষ্ট । কিন্তু কাশেম তাও অবাক হয়ে ইফাজকে জিজ্ঞেস করলো, “ক্যান? আমার কথা বিশ্বাস হয় নাই তোমার?” ইফাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “না, এসব বিশ্বাস করার মতো কোন কথাই না । এখনো মন আমার শান্তি পাচ্ছে না ।” কাশেম আর কিছু বলতে পারলো না । ইফাজ ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে জানালার কাছে যেয়ে দাঁড়ালো । কাশেম তখন বলল, “তোমার বাপের অফিসের ডায়রিতে রাসেল নামের ঐ লোকের নাম্বার থাকতে পারে ।” ইফাজ চলে গেলো ওর বাবার অফিসের ডায়রিতে কমবেশি সব লোকজনেরই ফোন নাম্বার থাকে । রাসেল নামের লোকটার নাম্বারও খুজে পেলো ইফাজ । নাম্বারটা মোবাইলে তুলে কল করলো । কিছুক্ষণ বেজে ফোনটা রিসিভ হলো । ফোনের ওপাশ থেকে বয়স্ক এক কণ্ঠ ভেসে এলো, “হ্যালো! কে বলছেন?” ইফাজ তখন বলল, “আঙ্কেল আমি ইফাজ বলছি । আপনি কি রাসেল আঙ্কেল?” লোকটা হালকা কেশে বলল, “হ্যাঁ । কিন্তু তুমি কোন ইফাজ?” “আজ্ঞে আমি আপনার কলিগ মি আলির ছেলে ইফাজ ।” ফোনের ওপাশ থেকে রাসেল ইফাজের কথা শুনে উঠে বেশ আনন্দিত হয়ে বলল, “ও তুমি, কেমন আছো বাবা?” ইফাজ বলল, “জী আঙ্কেল, ভালো । আপনি কেমন আছেন? রাসেল বলল, “তুমি তো তোমার মা চলে যাবার পর আর কথাই বলো নি আমার সাথে । ইফাজ একটা শ্বাস ফেলে বলল, “আঙ্কেল একটা কথা জানার ছিল ।” রাসেল বলল, “হ্যাঁ বলো ।” ইফাজ পুরো ঘটনা খুলে বলল । ইফাজের কথা শুনে রাসেল চুপ হয়ে গেলো । ইফাজ ফোন কেটে গেলো কিনা ভেবে জিজ্ঞেস করলো, “হ্যালো আঙ্কেল?” রাসেল তখন বলল, “হুম । পুরো ঘটনাই সত্য । আসলে সমস্ত দোষটাই তোমার মায়ের । তোমার বাবার কোন দোষ ছিল না । আর সেদিন তোমার বাবার আগে আমিই তোমার মাকে অন্য সেই লোকটার সাথে দেখেছিলাম ।” ইফাজের চোখ আর বাধ মানলো না । চোখ দিয়ে জল বেড়িয়ে এলো । দরজায় তখন কলিংবেলের আওয়াজ বেজে উঠলো । কাশেম যেয়ে দরজা খুলে দেখল, ইফাজের স্ত্রী এসেছে । কাশেম ইফাজের স্ত্রীকে আগে তেমন ভালোভাবে দেখেনি । ইফাজের ইফাজের স্ত্রী-ই ভেতরে এসে নিজের পরিচয় দিলো । ইফাজ এতটাই কষ্ট পেয়েছে যে আশেপাশে কি হচ্ছে সে ব্যাপারে তার হিতাহিত জ্ঞান আপাতত নেই । তাই ওর স্ত্রীর আগমনের ব্যাপারটা খেয়াল করেনি । ইফাজের স্ত্রী কাশেমের কাছে সবটা জানতে চাইলে কাশেম সবটা খুলে বলে । ইফাজ তখন এক দৃষ্টিতে কিসের দিকে যেন তাকিয়ে আছে । ইফাজের স্ত্রী কাছে যেয়ে দেখল, ইফাজ কাদছে । ঠোঁট হালকা কাঁপছে । চোখের পাপড়ি আর ভ্রু হালকা সংকুচিত হবার চেষ্টা করছে । ইফাজের স্ত্রী ইফাজের দৃষ্টির দিকে লক্ষ্য করে দেখল, সামনে ঝোলানো মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে ইফাজ । ওর মনে মায়ের জন্য কতটা ক্ষোভ জমা হয়েছে তা ওর চাহনি দেখেই বোঝা যায় । ইফাজের স্ত্রী ইফাজের কাঁধে হাত রেখে বলল, “কেঁদো না ইফাজ, দ্যাখো, বাস্তবতা মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই । এতে না তোমার বাবা ফিরে আসবেন, না তোমার মা শুধরে যাবেন । তাই পেছনের সবটা ভুলে যায় । সামনে কি করে ভালো করা যায় সেটা ভাবো । আল্লাহ জীবনে উত্থান পতন দেন । এখন খারাপ আছো বলে এমন তো আর না, যে সারা জীবন তুমি খারাপ থাকবে ।” এতক্ষণে ইফাজ একটু সায় দিলো । কিছু বলল না, মাথা নিচু করে চোখ দুটো মুছলো । বাহিরে তখন মাগরিবের আজান দিচ্ছে । কাশেম ইফাজের সামনে এসে বলল, “ইফাজ বাবা, তোমারে তো ছোটবেলা থেইকা মানুষ করছি, কোনদিন বউমারে নিয়া তো তোমার এই বাপের বাড়ি থাকো নাই, আমিও তোমার সান্নিধ্য পাই নাই । আইজকা যেহেতু তোমার বাপের ওপর থেইকা রাগ চইলা গেছে, তাই আইজকার দিনটা এই বাড়িত থাকো? আমার খুব ভালো লাগতো ।” কাশেম হয়তো ভালো একটা জবাব আশা করেছিলো ইফাজের কাছে কিন্তু ইফাজ সেই আশাকে হতাশা পরিণত করে দিয়ে এক শব্দে বলল, “না ।” কাশেম খানিক মর্মাহত হল তা ওর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে । ইফাজ তখন মুচকি হেসে বলল, “আজ থেকে সবসময়ের জন্য আমরা আপনার সাথে এই বাড়িতে থাকবো ।” লোকটা আনন্দিত চেহারায় ইফাজের দিকে তাকালো । কথাটা যেন বিশ্বাসই হতে চায় না । সেই সন্দেহ মেটাতে কাশেম জিজ্ঞেস করলো, “মানে?” ইফাজ কাশেমের কাঁধে হাত রেখে বলল, “মানে, আমরা ঐ বাড়ি থেকে এই বাড়িতে চলে আসবো এবং আমরা আজ থেকে এই বাড়িতেই সংসার করবো ।” ইফাজের স্ত্রী-ও খুব খুশি হল । কাশেম রান্না বসাবে বলে তাড়াতাড়ি করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো । ইফাজ তখন ওর স্ত্রীকে বলল, “শোনো, তুমি এখানে থাকো, আমি ঐ বাড়ি থেকে আপাতত যা প্রয়োজন আনছি, কাল লোক পাঠিয়ে কিছু মালামাল নিয়ে আসবো ।” ইফাজের স্ত্রী ইফাজকে বলল, “তুমি কিছু ভুলে যাচ্ছ ।” ইফাজ বুঝলো ওর স্ত্রী কিসের কথা বলছে । কিছু বলল না ইফাজ । কেবল একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল ।
এদিকে এশার নামায পড়ে বাড়ির পথে ফিরছিল জয়নাল । তখনই চোখে পড়লো মিজান আর লাল্টুর দোকান । অনেক লোক বসে । কিন্তু এখানে এতো লোক থাকার কথা ছিল না । তাতে অবশ্য জয়নালের কোন কষ্ট নেই, কষ্ট শুধু রেস্টুরেন্টটা হারানোয় । জয়নাল সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো । বস্তিতে নিজের ঘরে এসে দেখল, আবিরকে কোলে নিয়ে বসে জামেনা । আবির এটা ওটা ইশারা করে হাসছে, চেচাচ্ছে । আর জামেনা বিষণ্ণ মুখে বসে আছে । জয়নালকে ঢুকতে দেখে জামেনা বলল, “বসো । তোমার জন্য ভাত নিয়া বইসা আছি ।” জয়নাল বলল, “তুমি খাইছো?” জামেনা মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে বলল, “তুমি আগে খাও ।” জয়নাল কিছু বলল না । পাশে রাখা প্লাস্টিকের বোতলের পানি দিয়ে হাতটা ধুয়ে নিলো । জামেনা জয়নালের পাতে ভাত বেড়ে তরকারি দিলো । জামেনা বসে বসে মাছি তাড়াতে লাগলো, আর জয়নাল খেতে লাগলো । একটু পর রায়হান এসে ভারি একটা সিলিন্ডার জামেনার পাশে রাখলো । কিছু বলল না । ওরও আজ মন খারাপ । জয়নাল খাওয়ার ফাঁকে একটু জিজ্ঞেস করলো, “গ্যাস কতটুক আছে রে?” রায়হান, “অর্ধেকেরও বেশি ।” জবাব দিয়ে চলে গেলো । জয়নাল আর জামেনা কেউই কিছু বলল না । জয়নাল খাওয়া শুরু করলো । জামেনা তখন বলল, “আল্লাহ, আমাগো জীবনেই জীবনেই ক্যান যে এইরকম হয় । আল্লাহ যে ক্যান এইরকম দেয় । জয়নাল তখন বলল, “এতো চিন্তা কইরো না । দেইখো, আল্লাহ আমাগো ভালোই করবো, খারাপ না ।” এমন সময় আবার রায়হান দৌড়ে এলো । আবার হাফাতে হাফাতে বলল, “জয়নাল চাচা, তাড়াতাড়ি আসো! পুলিশ আর ঐ লোকটা আইসে যে রেস্টুরেন্ট বন্ধ কইরা দিতে চাইসিলো । জয়নাল তাড়াতাড়ি করে হাত ধুয়ে উঠে পড়লো । জামেনাও আবিরকে কোলে নিয়ে চলে এলো । আবির তখন গলার লকেট খুলে হাতে নিয়েছে খেলার ছলে । বাহিরে এসে দেখলো, সত্যি । পুলিশ রেস্টুরেন্ট খুলে দিলো । যেসব কাগজপত্র কেড়ে নিয়েছিল সেগুলোও ফেরত দিলো । সাথে আছে ইফাজ । ইফাজ জয়নালের কাছে এসে বলল, “আমায় ক্ষমা করবেন, আসলে আমি সবাইকে ভুল বুঝেছিলাম ।” জয়নাল জবাবে বলল, “ছি ছি! কি যে কন! আপনেরা বড় বড় মানুষ, আমরা আপনাগো মতো মানুষদের জন্যই বাইচা আছি । আপনেরা না থাকলে যে কি হইতো ।” জয়নাল ঠিক গুছিয়ে কথাটা বলতে না পারলেও মুল বক্তব্যটা ঠিকই বুঝল ইফাজ । জয়নাল আপনারা বলতে ইফাজ আর ওর বাবার মতোন ভালো মানুষদের বুঝিয়েছে । ইফাজ হালকা হাসল । জয়নালের পেছনেই আবিরকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে জামেনা । সেদিকে দৃষ্টি গেলো ইফাজের । ইফাজ কাছে যেয়ে জামেনাকে বলল, “আমি কি ওকে একটু কোলে নিতে পারি?” জামেনা “হ, নেও ।” বলে আবিরকে ইফাজের কোলে তুলে দিলো । ইফাজ আবিরকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো । আবির এটা ওটা ইশারা করে হেসে হেসে চেঁচাতে লাগলো । খেলার ছলে ওর গলার সেই লকেটটা ঢুকিয়ে দিলো ইফাজের শার্টের পকেটে । ইফাজ টের পেলো, কিন্তু আবির কোলে থাকায় বের করতে পারলো না । একটু বাদেই পুলিশ এলো ইফাজের কাছে । অফিসার ইফাজকে বলল, “হুম, সব কাজ হয়ে গেছে । তবে আপনাকে আরেকটু কাজ সারতে হবে । এজন্য একটু থানায় আসতে হবে ।” ইফাজ আবিরকে জয়নালের কোলে দিয়ে অফিসারকে বলল, “জী আপনি যান, আমি আসছি ।” পুলিশ চলে গেলো । ইফাজ পকেট থেকে মোবাইল বের করে জয়নালকে বলল, “আপনি আপনার ছেলের সাথে আপনার একটা ছবি তুলতে চাই ।” ইফাজ ছবি তুলল । তারপর জয়নাল, আবির আর জামেনার একসাথে ছবি তুলল, অন্যান্য বস্তিবাসীরও ছবি তুলল । ছবি তোলা শেষে রায়হান জয়নালের কাছে এসে বলল, “চাচা, আপনের রুম থেইকা সিলিন্ডার আনি?” জয়নাল বলল, “আইজকা থাইক, কাইল আনিস । কাইল থেইকা সব শুরু করমু নে ।” রায়হান আর কিছু বলল না । ইফাজ সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো । সেখানকার সবাই তখন খুব খুশি হলেও একটু দূর থেকে এসব দেখে রাগ আর হিংসেয় ফোঁসফোঁস করছিলো লাল্টু আর মিজান । লাল্টু বলল, “কি হইলো এইটা?” মিজান বা দিকে মুখ ঘুরিয়ে থুথু ফেলে বলল, “আর সহ্য করতে পারলাম না । এবার গোঁড়া থেকেই গাছ উপড়াইয়া দিতে হইবো ।”
(১২)
থানায় কিছু কাগজপত্রের কাজ করতে করতে রাত ১১:৩০ বাজলো ইফাজের । ইফাজ বাড়ির দিকে ফেরার জন্য রওনা হচ্ছিলো, এমন সময় গাড়িতে ওঠার সময় মনে হল বুকে কিছু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে । পকেটে হাত দিয়ে দেখল, পকেটে রাখা আবিরের সেই লকেটটা । আসার সময় ফেরত দিতে ভুলে গিয়েছিলো । ইফাজ সেটা ফেরত দিতে আবার রওনা হল বস্তির উদ্দেশ্যে ।
এদিকে বস্তির লোকজন তখন গভীর ঘুমে নিমজ্জিত । অন্যান্য দিন তও দু একজন জেগে থাকতো, আজ যেন কেউই জেগে নেই । সেই সুযোগটাকেই গ্রহণ করে নিজেদের শেষ এবং ঘৃণ্য চালটা চালতে কেরোসিন হাতে বস্তির কাছে এলো লাল্টু আর মিজান । ধীরে ধীরে ওরা বস্তির চারপাশে কেরোসিন ঢালতে লাগলো, তার সাথে কেরোসিন ঢাললো রেস্টুরেন্টেও । টাকা খুবই উপকারি একটা জিনিস । মানুষের জীবনের প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রে টাকা লাগেই । কিন্তু সেই টাকা অতিরিক্ত পাবার লোভ মানুষকে কখনো কখনো এতো নিচে নিয়ে যায়, যা সে হয়তো নিজেও বুঝতে পারে না । সেরকমের লোভের স্বীকার আজ এই লাল্টু আর মিজান । কেরোসিন ঢালা শেষ হলে মিজান হাতে একটা ম্যাচ নিয়ে তা থেকে কাঠি বের করে ম্যাচ বক্সের সাথে ঘষে ম্যাচটা জালালো । কিছুক্ষণ বড় বড় চোখে ম্যাচের কাঠির আগুনের দিকে তাকিয়ে রইল । তারপর সেটা ফেলে দিলো কেরোসিনের ওপর । ধীরে ধীরে আগুন ছড়াতে লাগলো । এমনিতেই শীতকাল । ফলে শুরুর দিকে আগুন যতোটুকু তাপ দিয়েছে, তা এই শীতের রাতের জন্য বেশ আরামদায়ক ছিল । ফলে কারো ঘুম ভাঙ্গা তো দুরের কথা, আরও ঘুম যেন চোখের ওপর জেঁকে বসলো । রেলষ্টেশনের পাশে অবশ্য কিছু যাত্রী ছিল, কিন্তু তারা তখনও ঠাওর করতে পারে, কিসের আগুন জলছে । বস্তির আশে পাশের পরিবেশ বেশ স্যাঁতস্যাঁতে বলে এদিকে কেউ আসে না । ফলে, সবকিছুই আজ যেন বস্তিবাসীর জন্য দুর্ভাগ্যে পরিণত হচ্ছে । আগুন যখন একটু বেশি তাপ দেয়া শুরু করলো, ঠিক তখনই কেউ একজন ঘুম থেকে উঠে পড়লো । তারপর “আগুন! আগুন!” বলে চেঁচাতে লাগলো । আশেপাশের সবাই তখন তাড়াতাড়ি করে যে যা পারে নিয়ে আগুনের সীমানা পেরিয়ে কোনোরকমে সেখান থেকে বেরোনোর চেষ্টা করতে লাগলো । কেউ কেউ ইতোমধ্যে পানিও আনতে চলে গেছে । জামেনা আর জয়নালের তখনও ঘুম ভাঙ্গে নি । আবির জামেনার পাশে । কলিমা এদিক দিয়েই বের হচ্ছিলো, জামেনা আর জয়নালকে ঘুমাতে দেখে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে এলো । আগুন তখন ভেতরেও অনেকটা চলে এসেছে । কলিমা তাড়াতাড়ি করে জামেনাকে ডাকলো । “ও জামেনা আপা, উঠো, দ্যাখো আগুন লাগসে, ও জামেনা আপা!” দু তিনবার জামেনার গায়ে ধাক্কা দিয়ে এসব কথা বলার পর ঘুম ভাঙল জামেনার । জামেনা আশেপাশে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে বসলো । জামেনা ভয়ে ভয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “ও আল্লাহ! আগুন লাগলো ক্যামনে?” কলিমা বলল, “জানি না, তুমি তাড়াতাড়ি পালাও । জামেনা আবিরকে কলিমার কোলে দিয়ে বলল, “তুই ওরে নিয়া যা, আমি তোর চাচারে লইয়া আসতেসি ।” কলিমা আবিরকে কোলে নিয়ে দিলো এক দৌড় । আগুন প্রায় জামেনাদের ঘরের কাছে চলে এসেছে । জামেনা জয়নালকে ডাকলো, “এই, ওঠো, আগুন লাগছে, ওঠো!” জয়নালকেও দুইতিনবার ডাকার পর সে উঠলো । কলিমা ততক্ষণে আগুন থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে । জয়নাল উঠেই ভয়ের সাথে বলল, “ইয়া আল্লাহ! কি হইলো এইডা!” তারপর একটা ব্যাগের কাছে ইশারা করে জয়নাল বলল, “ঐ ব্যাগটা দেও, অইডার মধ্যে ট্যাকাগুলা সব আছে । জামেনা ব্যাগের দিকে হাত বাড়াল । ঠিক সেই সময় ইফাজও মোড় ঘুরে বস্তির পাশের রাস্তায় এসে সবটা দেখে অবাক । ইফাজ গাড়িটা থামাল । ঠিক সেই সময় ঘটে গেলো এক হৃদয় বিদারক ঘটনা । কেউ হয়তো এই ঘটনা কখনো প্রত্যাশা করেনি কখনো । বস্তির যে ঘরে জামেনা আর জয়নাল থাকতো, এই ঘরটা থেকে বিরাট বিস্ফোরণ, আর বিকট শব্দ আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে গেলো । সবাই অপলক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে । কি হল কেউ বুঝতে পারলো না । এক মুহূর্তের জন্য সবাই যেন পাথর হয়ে গেলো । শুধু বস্তিবাসী নয়, রেলষ্টেশনের পাশে যারা ছিল, তারাও অবাক হয়ে গেলো । এখানেই শেষ নয়, একটু দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিল মিজান আর লাল্টু । ওরাও অবাক হল । না, ওরা তো কোন বিস্ফোরক জাতীয় কিছু ওখানে রাখেনি? তবে হলো টা কি? সব চুপচাপ । এতক্ষন সবাই আগুন আগুন বলে চেচাচ্ছিল, সেই শুব্দও নেই । খানিক বাদে ধীরে ধীরে বিস্ফোরণের রেশ কমে গেলো । সবাই পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালিয়ে গেলো । ইফাজ ফায়ার সার্ভিসে কল করে ফায়ার সার্ভিসের গানি আনালো । ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এসে আগুন নেভানোয় ব্যাস্ত হয়ে পড়লে বস্তিবাসীদের আর বালতি বালতি পানি এনে আগুন নেভানোর প্রয়োজন হল না । সবাই যে যার যার স্বজনদের খোজায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লো । সবাই সবাইকে খুজে পেলো কিন্তু, কেউ খুজে পেলো না জয়নাল আর জামেনাকে । প্রায় ১ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নেভানো সম্ভব হল । ইতোমধ্যে ঘটনা স্থলে এসে উপস্থিত হল সাংবাদিক, পুলিশ, বোম ডিসপোজাল ইউনিট । ইফাজ জয়নাল আর জামেনাকে অনেক খুজলো, কিন্তু পেলো না । বস্তিবাসীকে পুলিশ পুড়ে যাওয়া এলাকা থেকে অনেকটা দূরে থাকতে বলায় ওরা অনেকটা দূরে চলে গেলো । ওদের মধ্যে সবাইকে কিছু পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলো । এদিকে কিছু পুলিশ ঘটনাস্থলে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো আর বোম ডিসপোজাল ইউনিট সেই জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো । পুরো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে । এখনো হালকা ধোয়া উড়ছে কোন কোন জায়গায় । বোম ডিসপোজাল ইউনিট এর প্রধান সেই জায়গায় চলে গেলো যেখানে বিস্ফোরণের সূত্রপাত । একটা টিনের চাল পড়ে । মনে হচ্ছে নিচে কিছু আছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে না । লোকটা এগিয়ে গেলেন । টিনটা সরাতেই যা দেখলেন, তা দেখে উনার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো । পড়ে আছে দুজনের লাশ । পুড়ে শরীরের মাংস ঝলসে গেছে । হার বেড়িয়ে গেছে কোথাও কোথাও । এটা আর কেউ না জয়নাল আর জামেনা । এতোটা বাজে ভাবে মৃত্যু হল ওদের । কেউ কখনো ভাবতেও পারে নি । পাশেই তাকিয়ে লোকটা দেখল, একটা সিলিন্ডারের ভগ্নাবশেষ পড়ে আছে । বোম ডিসপোজাল ইউনিট এর সেই লোক পুলিশের সহায়তায় কোনোরকমে জয়নাল আর জামেনার লাশটা সেখান থেকে দূরে এনে রাখল । লাশটা ধরাই যাচ্ছে না বলা চলে । মাংস খসে খসে পড়ছে । তবুও কোনোরকমে আনা হল । সবাই দেখছে, কেউ কেউ বমিও করে দিয়েছে । কলিমার কোলে কাদছে আবির । কিছু জানে না সে কি হয়েছে, কিন্তু তবুও কাদছে সে । কলিমা, কলিমার বাবা মা সবাই মর্মাহত হল । একটু দূর থেকে ওদের লাশটা দেখে কেঁদেই ফেলল ইফাজ । তার একটু পাশেই কৌতূহলবশত লাশটা দেখতে এসে থর থর করে কাঁপতে লাগলো লাল্টু আর মিজান । যতই হোক, আগুনটা তো ওরাই লাগিয়েছে । পুলিশ এসে জানালো, “আমাদের মনে হয় কি, ঐ রুমে একটা সিলিন্ডার ছিল, ওটা বিস্ফোরিত হয়ে আগুনটা ধরে ফেলেছে ।” পুলিশের কথা শুনে কেদে ফেলল রায়হান । কারণ রাতে ওই সিলিন্ডারটা জয়নালের ঘরে রেখেছিলো । ইফাজ চোখের জন মুছে এগিয়ে এসে বলল, “কিন্তু স্যার, আগুনটা কিন্তু বিস্ফোরণের আগেই ধরেছিলো ।” আশেপাশের লোকজন ইফাজের সাথে সম্মতি জানালো । পুলিশ তখন বলল, “তাহলে তো এটা কারো চক্রান্ত ছাড়া অন্য কিছু বলে তো মনে হচ্ছে না । আচ্ছা, আপনাদের কি কাউকে সন্দেহ হয়?” রায়হান চোখ মুছে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “আমার দুজনকে হয় ।” পুলিশ জিজ্ঞেস করলো, “কাদের?” রায়হান তখন বলল, “আমি নাম জানি না, তয় ওরা আমাদের এই রেস্টুরেন্ট বন্ধ করার জইন্য অনেক কিছু করছিলো ।” পুলিশ বলল, “তাদের কাছে নিয়ে যেতে পারবেন?” রায়হান বলল, “এহনি চলেন ।” রায়হানের সাথে পুলিশও গেলো । লাল্টু আর মিজান তখন ওদের দোকানে বসে । প্রচুর ভয়ে আছে ওরা । অবশ্য যা লাশ দেখে এলো, এটা দেখার পর কারোরই স্বাভাবিক থাকা উচিত না । রায়হান একদিন লাল্টু আর মিজানকে দেখেছিল দোকানে । বলেও এসেছিলো হোটেলে এসে চায়ের কাপে মাছি ঢুকিয়ে, মেয়ে বা হিজরা সেজে রেস্টুরেন্ট বন্ধ করার ফন্দি এঁটে কোন লাভ নেই । সেই সুত্র ধরে মিজান আর লাল্টু দোকানের দিকে যেতে লাগলো ওরা । মিজান লাল্টুকে জিজ্ঞেস করলো, “ভাই, এ কিন্তু বড় ভুল হইয়া গেলো । আমরা কিন্তু এতো কিছু করতেও চাইনাই ।” লাল্টু বলল, “হ ভাই, আমার তো এহনও বুক কাপতাসে ।” তারপর দুজনেই মাটির দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেলো । ফলে ওরা খেয়ালই করে নি, পুলিশ ওদের দিকে আসছে । কিছুক্ষণ পর পুলিশ ওদের কাছে এসে চারপাশে থেকে ঘিরে ফেলল । অফিসার জিজ্ঞেস করলো, “আপনারা কারা?” কথা পুরোপুরি শোনার আগেই কেদে দিলো দুজনেই । মিজান কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমাগো মাফ কইরা দেন স্যার, আমরাই আগুন ধরাইসি ।” ব্যাস, প্রমানিত হয়ে গেলো ওরাই কাজটা করেছে । পুলিশ ওদের ধরে নিয়ে গেলো । কলিমার কোলে আবিরকে কাঁদতে দেখে এগিয়ে গেলো ইফাজ । আবিরকে কোলে নিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “আজ থেকে আমিই ওর বাবা ।” এরপর পুলিশ জয়নাল আর জামেনার লাশটাও নিয়ে চলে গেলো । বস্তির পরিবেশও কিছুটা শান্ত হয়ে গেলো । রাতে ওরা স্টেশনের ওপরেই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে লাগলো । এদিকে ইফাজের জন্য টেনশনে না ঘুমিয়ে বসে আছে পায়েল, মানে ইফাজের স্ত্রী । কাশেম চাচা ঘুমিয়ে গেছেন । বেচারার বয়স হয়েছে । রাত প্রায় ৩ টার দিকে কলিংবেল বেজে উঠলো । পায়েল যেয়ে দরজা খুলে দেখল, কোলে একটা বাচ্চাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ইফাজ । পায়েল জিজ্ঞেস করলো, “কার বাচ্চা এটা?” ইফাজ একটা শ্বাস ফেলে বলল, “ভেতরে চলো, বলছি ।” ইফাজ আর পায়েল ভেতরে গেলো । নিজেদের ঘরে বিছানায় আবিরকে রেখে শরীর থেকে জ্যাকেটটা খুলে পায়েলকে “শোনো” বলে পুরো ঘটনা খুলে বলল ইফাজ । ঘটনা শুনে পায়েলেরও খুব খারাপ লাগলো । তারপর আবিরের পাশে বসে ওকে আদর করতে লাগলো । ইফাজ জিজ্ঞেস করলো, “পারবে না ওর মা হতে?” পায়েল মুচকি হেসে বলল, “খুব পারবো ।” ইফাজও হালকা হাসার চেষ্টা করলো, কিন্তু জয়নাল আর জামেনার লাশের কথা মাথায় আসতেই হাসিটা যেন আটকে গেলো । আবির ঘুমিয়ে পড়েছে । ইফাজ পকেটটা থেকে সেই লকেট নিয়ে পড়িয়ে দিলো আবিরের গলায় । তার ইফাজ আর পায়েল দুজনেই আবিরের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে আবিরের ঘুমের মধ্যে যে সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে, তা দেখতে লাগলো ।